আফগানিস্তান : বিশ্ব সন্ত্রাসের ‘নতুন’ যাত্রা

পুনপ্রকাশ

আফগানিস্তান : বিশ্ব সন্ত্রাসের ‘নতুন’ যাত্রা

আনু মুহাম্মদ

২০০১ সালে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামে আগ্রাসনের নতুন পর্ব শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। যে তালিবানদের তারা ক্ষমতায় বসিয়েছিল তাদের উচ্ছেদ করে সেবছর আফগানিস্তান দখলে নেয়, তারপর ২০০৩ সালে দখল করে ইরাক।  ২০ বছর পর খুব সহজেই তালিবানরা আবারও দখলে নিয়েছে আফগানিস্তান, তবে সমঝোতার মাধ্যমে। গত কয় বছরে তালিবানদের সাথে নানারকম সমঝোতা আলোচনা হচ্ছিলো মার্কিন প্রশাসনের। ট্রাম্প আমলে শুরু, তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব এসব বিষয় পরিচালনা করেছেন, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুপক্ষের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তার আগে বর্তমান তালেবান নেতা বারদারকে পাকিস্তান জেল থেকে মুক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্রই। অর্থাৎ বাইডেন আমলে এসে তালিবানদের হাতে ছেড়ে দিয়ে তাদের আফগানিস্তান ত্যাগ একটি পূর্ব সিদ্ধান্তেরই বাস্তবায়ন। এখন এই দেশে নতুন ব্যবসার জন্য মার্কিন, চীন, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত ও পাকিস্তান তাকিয়ে আছে তালিবানেরই দিকে। এই পর্যায়ে ইতিহাসের দিকে আবারও দৃষ্টি দেয়া দরকার। এই পরিপ্রেক্ষিতে আফগানিস্তান দখলের পরপর লেখা এবং ২০০৩ সালে ত্রৈমাসিক পত্রিকা নতুন পাঠ-এ প্রকাশিত এই প্রবন্ধ এখানে পুনপ্রকাশ করা হলো। এই প্রবন্ধে ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে আফগানিস্তান সংকট অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রাসঙ্গিকভাবে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার সন্ত্রাসী গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক আগ্রাসন নতুন ঘটনা নয়, পাঁচ দশকে মার্কিনি ইতিহাস এরকম বহু সামরিক আগ্রাসনের ঘটনায় রক্তাক্ত। তবে টুইন টাওয়ার ধ্বংস এবং পেন্টাগনে এই মাপের ‘হামলা’ নতুন। বিশাল ক্ষমতাধর সামরিক শক্তি, তার গোয়েন্দা বাহিনী কি তবে কাগুজে বাঘ? আফগানিস্তান এখন ‘বিশ্ব কোয়ালিশন’-এর প্রত্যক্ষ করতলগত। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় এটি কি নতুন কোন ধরন? আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসনের পাশাপাশি পশ্চিমের দেশগুলোতে নতুন নতুন কালাকানুন, ধরপাকড়, গোয়েন্দাবৃত্তি এবং প্রতিবাদী সংগঠনগুলোর উপর চড়াও তবে কি তাৎপর্য বহন করে? মিডিয়ার ভূমিকা কী? হান্টিংটনের ক্রুসেড মডেল কী? সাম্রাজ্যবাদ কখনো জেহাদ কখনো ক্রুসেড এর নিশান ধরে কেন? আফগানিস্তান তার ভেতরে কিভাবে একইসাথে সম্পদ ও বিপদ এবং সৃষ্টি ও ধ্বংসকে লালন করে? আফগান জনগণের লড়াই এর পরিচয় তবে কী? আফগানিস্তান ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদী নানা অভিযান এবং জনগণের লড়াই, পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার অন্তর্গত চাপ এবং বহিরাবরণ, মিডিয়া যুদ্ধ এবং মতাদর্শিক লড়াই এর নানা মাত্রা নিয়েই প্রবন্ধ। 

সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় এটি কি নতুন কোন ধরন? আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসনের পাশাপাশি পশ্চিমের দেশগুলোতে নতুন নতুন কালাকানুন, ধরপাকড়, গোয়েন্দাবৃত্তি এবং প্রতিবাদী সংগঠনগুলোর উপর চড়াও তবে কি তাৎপর্য বহন করে? মিডিয়ার ভূমিকা কী? হান্টিংটনের ক্রুসেড মডেল কী? সাম্রাজ্যবাদ কখনো জেহাদ কখনো ক্রুসেড এর নিশান ধরে কেন? আফগানিস্তান তার ভেতরে কিভাবে একইসাথে সম্পদ ও বিপদ এবং সৃষ্টি ও ধ্বংসকে লালন করে? আফগান জনগণের লড়াই এর পরিচয় তবে কী? আফগানিস্তান ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদী নানা অভিযান এবং জনগণের লড়াই, পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার অন্তর্গত চাপ এবং বহিরাবরণ, মিডিয়া যুদ্ধ এবং মতাদর্শিক লড়াই এর নানা মাত্রা নিয়েই প্রবন্ধ। 

টুইন টাওয়ার ও ‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ’

১১ সেপ্টেম্বর সকালে নিউইয়র্কে বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র ধসে পড়লো, পর পর দুটো বিমান দুটো শতাধিক তলা বিশিষ্ট ভবনের মধ্যে প্রবেশ করে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো। একই সময়ে পেন্টাগন-এর ভবনের ওপর একটি বিমান বিধ্বস্ত হলো। আরেকটি বিমান বিধ্বস্ত হলো ‘গন্তব্যস্থলে’ পৌঁছাতে না পেরে পেনসিলভেনিয়ায়। সব মিলিয়ে আধঘণ্টার মধ্যে সবগুলো ঘটনা ঘটলো। এতে হতাহত কতজন হলেন সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পরের এক মাসেও জানা যায়নি। প্রথমদিকে তাই আনুমানিক সংখ্যা বিভিন্ন রকম ছিল। এখন মার্কিন সরকারি তথ্য বিবরণী অনুযায়ী এই সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। 

ধ্বংসের পরিমাণ ও নিহতের সংখ্যা বিবেচনা করলে এই ঘটনাটিকে অভূতপূর্ব বলা যায় না। কারণ এর আগে মুহুর্তের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের কারণে হিরোশিমায় ৭০ হাজার এবং নাগাসাকিতে ৫০ হাজার নিহত হয়েছিলেন। মুহুর্তের ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যাকাণ্ডের এরকম ঘটনা ছাড়া গত পাঁচ দশকে মাস-বছর ধরে গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞের ইতিহাস দেখলে ঘাতক বা ধ্বংসকারী হিসেবে যে রাষ্ট্রের চেহারা সবচাইতে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে তার নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেখা যাবে, সন্ত্রাস-হত্যা ও ধ্বংসে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনীয় অন্য কোন রাষ্ট্র পৃথিবীতে নেই। লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা, একের পর এক জনপদ ধ্বংস করায় বহু দেশের সম্ভাবনা বিনাশে মার্কিন প্রশাসন, পেন্টাগন-সিআইএ-র কাছাকাছিও কোন সংস্থা বা কোন রাষ্ট্র নেই। 

সন্ত্রাস-হত্যা ও ধ্বংসে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনীয় অন্য কোন রাষ্ট্র পৃথিবীতে নেই। লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা, একের পর এক জনপদ ধ্বংস করায় বহু দেশের সম্ভাবনা বিনাশে মার্কিন প্রশাসন, পেন্টাগন-সিআইএ-র কাছাকাছিও কোন সংস্থা বা কোন রাষ্ট্র নেই। 

তবে ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা নিয়ে বিশ্বব্যাপী মাসের পর মাস ধরে যে রকম প্রচার, উদ্যোগ, আয়োজন হলো এর থেকে বহু বহু গুণ বেশি ধ্বংস ও হত্যাকাণ্ডে এর কাছাকাছিও হয়নি। এর কারণ যে রাষ্ট্র অন্য দেশে, জনপদে বোমাবর্ষণ, হামলা, হত্যাকাণ্ড, ধ্বংসেই কেবল অভ্যস্ত, এ বারে আক্রমণ (যদি তা আক্রমণ হয়ে থাকে) এসেছে তার উপরই। নিহত বা ধ্বংসের বিচার না হলেও ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা অন্যদিক থেকে অভূতপূর্ব। এ যাবতকালের ইতিহাসে, ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে, বিশেষত ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে এযাবতকাল পর্যন্ত ঔপনিবেশিক বা সাম্রাজ্যবাদী কোন রাষ্ট্র যেটি বিশ্বে ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করছে, তার ভূসীমানায় এমনকি কেন্দ্রে এই মাত্রায় ‘আক্রমণ’ আর কখনো হয়নি। 

এই ‘আক্রমণ’ কারা পরিচালনা করেছেন সে বিষয়টি এখনও পরিষ্কার নয়। তবে একটি দল খুবই পরিকল্পিত উচ্চ দক্ষতার সঙ্গে এই কাজটি সম্পাদন করেছে। যারা এটি করেছেন তারা সকলে নিহত হয়েছেন বলে এটা ‘আত্মঘাতী হামলা’ ছিল এমনটি ধারণা করা যায়। বিশ্বের সবচাইতে ক্ষমতাধর গোয়েন্দা সংস্থা যেটি সারা বিশ্বের সর্বত্র বিরাজমান এবং সক্রিয় সেটি এই ঘটনা সম্পর্কে কেন কিছু টের পায়নি তার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। বিশ্বের সবচাইতে ক্ষমতাধর গোয়েন্দা সংস্থা-র এই ‘ব্যর্থতা’ নিয়ে কোন তদন্তই হয়নি! “সন্ত্রাসী হামলা” বলে অভিহিত করে যাদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে প্রথম থেকে প্রচার করা হচ্ছে তাদের সম্পর্কে প্রচারিত তথ্যের অসঙ্গতিও অনেক। এখানে এতটুকু বলা যায় যে, যদি সিআইএ-র অজান্তে এই ঘটনাটি ঘটেই থাকে তাহলে এতে এটিই প্রমাণিত হয়েছে যে, অন্য দেশে তো বটেই মার্কিন সামরিক ক্ষমতা তার নিজের কেন্দ্রেই বধ্য। আর দানবীয় গোয়েন্দা সংস্থা এবং সামরিক শক্তি আসলেই কাগুজে বাঘ! 

অন্যদিকে ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত ঘটনাবলির গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণে একটা গোছানো কাজের ধারা পাওয়া যায়। ১১ সেপ্টেম্বর থেকেই ওসামা বিন লাদেন ও আফগানিস্তানকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয় এবং একটি ক্ষুদ্র যুদ্ধবিধ্বস্ত দুর্বল দেশের উপর মহাক্ষমতাধর দেশগুলোর সামরিক হামলা পরিচালনা করা হয় সাড়ম্বরে, মহা হাঁকডাক করে। অতি দুর্বল দেশের উপর হামলা করে মহাক্ষমতাবানদের উল্লাসও দেখার মতো! 

আফগানিস্তানে একটানা তিনমাস সামরিক অপারেশন চালাবার পর সে দেশ এখন ‘বহুজাতিক’ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। ২২ ডিসেম্বর জার্মানিতে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সম্মেলনে নতুন সরকার গঠিত হলো এবং ২১-২২ জানুয়ারি জাপানে অনুষ্ঠিত আরেক সম্মেলনে ১৫০০ কোটি ডলারের ‘উন্নয়ন’ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলো। বিপর্যস্ত আফগানিস্তান এখন বিশ্বের কেন্দ্রীয় সামরিক শক্তি, আন্তর্জাতিক সকল সংস্থা, বৃহৎ এনজিও-র উৎসব ভূমি। সকল বহুজাতিক কোম্পানি আর কনসালট্যান্টরা কয়েক বছরের বাজার পেয়ে খুশিতে অস্থির!

১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে ‘হামলা’ এবং তাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী কোয়ালিশন গঠন করে সন্ত্রাস দমনের নামে যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করেছে ও করতে যাচ্ছে এবং অন্যদিকে বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরে ‘সন্ত্রাসী দমনের’ নামে নতুন কালাকানুন জারি ও দমন পীড়নের যে অভিযান চলছে তাকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণের বিরুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন পর্যায়ের শাসকশ্রেণীর সন্ত্রাস বিস্তারের একটি নতুন যাত্রা হিসেবে অভিহিত করা চলে। 

১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে ‘হামলা’ এবং তাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী কোয়ালিশন গঠন করে সন্ত্রাস দমনের নামে যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করেছে ও করতে যাচ্ছে এবং অন্যদিকে বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরে ‘সন্ত্রাসী দমনের’ নামে নতুন কালাকানুন জারি ও দমন পীড়নের যে অভিযান চলছে তাকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণের বিরুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন পর্যায়ের শাসকশ্রেণীর সন্ত্রাস বিস্তারের একটি নতুন যাত্রা হিসেবে অভিহিত করা চলে। 

এই প্রবন্ধে আফগানিস্তানের উপর বিশেষ মনোযোগ দিয়ে বর্তমানে বিশ্বের এই ‘নতুন যাত্রা’কেই বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা হয়েছে। আসলে আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক হামলা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোন নতুন ঘটনা নয়। আফগানিস্তানে হামলা করা হয়েছে ‘সন্ত্রাস দমনের’ নামে; এর আগে কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, কিউবা, নিকারাগুয়া, ইরান, ইরাক, লিবিয়া, হাইতি, থাইল্যান্ড, ঘানা, চিলি, কলম্বিয়া সহ বহু দেশে মার্কিনি সামরিক আক্রমণ, হামলা, অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা সংঘটিত হয়েছে। এসব আক্রমণ, হামলা করা হয়েছিল ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার জন্য, ‘মুক্ত বিশ্বের’ স্বার্থে!

১৯৯০ এরপর পুঁজিবাদ শারীরিকভাবেই ইতিহাসে প্রথম একটি বিশ্বব্যবস্থা হিসেবে আবির্ভূত হয়। এ সময় তার সম্প্রসারণও দ্রততর হয়। বলাবাহুল্য, পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ গতি ও সম্প্রসারণ কখনোই স্বয়ংক্রিয়, শুধুমাত্র বাজার প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয় না। তার জন্য অতি আবশ্যিকভাবে প্রয়োজন হয় সামরিক আগ্রাসন, সাংস্কৃতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক সমন্বিত কার্যক্রম এবং রাষ্ট্র ও অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাবলি। তাছাড়া একক বৈশ্বিক ব্যবস্থার রূপ নিলেও যুদ্ধ, অধিকতর যুদ্ধ পুঁজিবাদের অনিবার্য সঙ্গী। ১৯৯০-এর পরও এর অন্যথা হয়নি। বরঞ্চ নতুন পরিস্থিতিতে এসব ক্ষেত্র ‘বিশ্বায়ন’ নামের পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়ায় নতুন বৈশ্বিক চেহারা পেয়েছে। একই সময়ে, একই প্রক্রিয়ার আরেক ফল হিসেবে মানুষের সংঘবদ্ধ বৈশ্বিক প্রতিরোধের কাঠামোরও সূচনা দেখা গেছে এ সময়ই। এই প্রতিরোধ কখনও কখনও সমন্বিত কখনও বিচ্ছিন্ন, কখনও কখনও ত্বরিৎ প্রতিক্রিয়া, কখনও কখনও বৃহৎ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ধারাবাহিক, কখনও স্পষ্ট, কখনও অস্পষ্ট, কখনও সশস্ত্র, কখনও নিরস্ত্র। 

এই বিক্ষোভ-প্রতিরোধের ক্রমশ সংহত রূপ লাভের মুখে সাম্রাজ্যবাদের “সন্ত্রাস দমনের” আওয়াজ নিয়ে উন্মত্ত হয়ে উঠা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। একই সঙ্গে বিশ্বে ধর্মীয়, জাতিগত, বর্ণগত ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থান এবং জাতিগত-ধর্মীয়-বর্ণগত পার্থক্যগুলোকে বৈরী রূপ দানের পরিকল্পিত চেষ্টাও অলক্ষণীয় নয়।  

আফগান বিপ্লব থেকে ওসামা

বাংলাদেশে আফগানিস্তান খুব পরিচিত দেশ নয়। কিন্তু গত পঁচিশ বছরের মধ্যে কোন কোন সময়ে আফগানিস্তান এখানে বেশি আলোচিত হয়েছে। প্রচার মাধ্যমের বারংবার উচ্চারণে ও বিবিধ উপস্থাপনে এর একটা চেহারাও দাঁড়িয়েছে। দেশের এই চেহারায় যা আছে তা প্রধানত যুদ্ধ, ধ্বংস, ‘বর্বরতা’, বোরখা, পাগড়ি-সেলোয়ার-কুর্তা। দু’বার বাংলাদেশে ‘আফগান স্টাইলের বিপ্লবের’ পক্ষে-বিপক্ষে আওয়াজ শোনা যায়। প্রথমে সোভিয়েত সমর্থিত বামপন্থীদের এবং পরে মার্কিন সমর্থিত মুজাহেদিনদের। প্রথমবারে আফগান স্টাইলের বিপ্লবের চেষ্টার অভিযোগে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) নিষিদ্ধও হয়েছিলো। আবার মুজাহেদিনদের ক্ষমতা দখলের পর এখানে মুজাহেদিনদের পক্ষে ইসলামী দলগুলোর উত্তেজনা দেখা যায় এবং তাদের হঠিয়ে তালেবানরা ক্ষমতা দখলের পর “আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান” শ্লোগানটি নিয়মিত হয়ে উঠে কোন কোন ইসলামী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে। 

১১ সেপ্টেম্বরের পরে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ-হুংকার এবং অবশেষে আফগানিস্তানে তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে বোমাবর্ষণ, ধ্বংস, হত্যাকাণ্ড অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে আফগানিস্তান সম্পর্কে বিশেষ মনোযোগ সৃষ্টি করে। বিভিন্ন বহিঃপ্রকাশ থেকে এই ধারণা করা যায় যে, মার্কিনি একটানা প্রচার এবং ‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের’ আওয়াজ সত্ত্বেও এখানে জনগণের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রই সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সন্ত্রাসী নেতা হিসেবে ওসামা বিন লাদেনকে চিহ্নিত করবার যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রচারের ফল দাঁড়ায় ওসামা এখানে জনগণের মধ্যে পরিণত হন মার্কিন সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের নায়কে। 

বাংলাদেশে ওসামা ইতিমধ্যে ঘরে ঘরে পরিচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। বহু ছোট বড় সংগঠন বা ব্যক্তির উদ্যোগে লক্ষ লক্ষ পোস্টার, ক্যালেন্ডার ছাপা হয়েছে ওসামার ছবি নিয়ে। সেসব ছবিতে ওসামা কোথাও সৌম্য মূর্তিতে, কোথাও নির্দেশদাতা, কোথাও মার্কিন বোমা-বিমানের মুখোমুখি যোদ্ধা হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন। কবিতা বেরিয়েছে তাঁকে নিয়ে, লোককবিতা, চার আনা আট আনা দামে, জারি গানের সুরে সুরে সেগুলো পাঠ হয়েছে বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে; ক্যাসেট বেরিয়েছে। লোকগানে ওসামা হয়েছেন ‘লাদেন ভাই’, ‘আমাদের লাদেন ভাই’-তাঁর ‘বীরত্ব গাথা’ এই অঞ্চলের নানা চরিত্রের সঙ্গে মিলেমিশে এই অঞ্চলের মানুষের বিদ্রোহী রূপ ধারণ করে নতুন চিত্র তৈরি করেছে। সেখানে বাস্তব ওসামা যাই হোন, মানুষ কি ধরনের চরিত্রের মধ্যে নিজেদের আকাঙক্ষা, বিদ্রোহের বোধ স্থাপন করতে আগ্রহী তার প্রকাশ ঘটেছে। 

কবিতা বেরিয়েছে তাঁকে নিয়ে, লোককবিতা, চার আনা আট আনা দামে, জারি গানের সুরে সুরে সেগুলো পাঠ হয়েছে বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে; ক্যাসেট বেরিয়েছে। লোকগানে ওসামা হয়েছেন ‘লাদেন ভাই’, ‘আমাদের লাদেন ভাই’-তাঁর ‘বীরত্ব গাথা’ এই অঞ্চলের নানা চরিত্রের সঙ্গে মিলেমিশে এই অঞ্চলের মানুষের বিদ্রোহী রূপ ধারণ করে নতুন চিত্র তৈরি করেছে। সেখানে বাস্তব ওসামা যাই হোন, মানুষ কি ধরনের চরিত্রের মধ্যে নিজেদের আকাঙক্ষা, বিদ্রোহের বোধ স্থাপন করতে আগ্রহী তার প্রকাশ ঘটেছে।

তবে এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যে, যে ওসামা আফগানিস্তানে মার্কিন হামলা বিরোধী ‘যুদ্ধের’ নায়ক হিসেবে এখানে পূজিত হচ্ছেন তিনি আফগান নাগরিক নন। আফগান কোন চরিত্র আসলে বাংলাদেশে নায়ক হয়ে উঠতে পারেননি। ওসামা সৌদি ধনকুবের পরিবারের সদস্যদের একজন। হতে পারে মুসলিম ছাড়াও তাঁর জনপ্রিয়তার একটি অন্যতম একটি কারণ তাঁর পারিবারিক পরিচয়, অন্যটি মার্কিন নিয়ন্ত্রিত প্রচার মাধ্যমে ওসামা বিরোধী একটানা প্রচার।  

আফগানিস্তান:পরিচয় অপরিচয়ের স্থান 

আফগানিস্তান সম্পর্কে এ দেশে সাধারণভাবে প্রচলিত ধারণাগুলোর উৎস ছিলো মূলত তিনটি: ১. এ দেশে ভ্রাম্যমান মহাজন ব্যবসায়ী হিসেবে আফগানিস্তান থেকে অগত ব্যক্তিদের সম্পর্কে সত্য-মিথ্যা, ঠিক-অতিরঞ্জিত কাহিনী ২. রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ এবং ৩. সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে-বিদেশে। 

এই তিনটিই বিশ শতকের প্রথমার্ধের চিত্র বা রচনা কিন্তু এগুলোই নানা গল্পে-কাহিনীতে ছড়িয়ে আফগানিস্তান এবং সে দেশের মানুষদের সম্পর্কে একটি ভাবমূর্তি এ দেশের মানুষের মনোজগতে স্থায়ী আসন তৈরি করেছে। এর সূত্র ধরে কৌতুকও কম তৈরি হয়নি এ দেশে। এই অনুযায়ী আফগানিস্তান একটি দারিদ্র্য পীড়িত ভয়াবহ স্থান এবং সে দেশের মানুষেরা সরল (যাকে বোকা বলা হয়), পরিশ্রমী এবং নাছোড়বান্দা। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাবুলিওয়ালা’ কাবুলিওয়ালা সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার নিষ্ঠুর চরিত্রের বিপরীতে এক ‘রহমত’ এর মধ্য দিয়ে মমতাময় এক মানুষের চিত্র উপস্থিত করে।  সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে-বিদেশের যে খণ্ডাংশ পাঠ্য পুস্তকের মাধ্যমে বছরের পর বছর এ দেশের লক্ষ লক্ষ শিশু কিশোরেরা পাঠ করেছে তাতে আফগানিস্তানের একটি চরিত্র এখানে বহুল প্রচার লাভ করেছে সেটি হলো : আব্দুর রহমান। সরল, পরিশ্রমী, অনুগত আবার নাছোড়বান্দা। পুরো দেশে বিদেশে পাঠ আফগানিস্তানের এক অসাধারণ ব্যাখ্যানের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটায়। বিশের দশকে একজন বাঙালি মুসলিম লেখক ‘দুর্গম গিরি’ পার হয়ে অপরিচিত এক দেশে বসবাস ও শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে সমাজকে যেভাবে দেখেছেন, আফগানিস্তানের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব তাঁর লেখায় যেভাবে এসেছে তার সাহিত্য মূল্য তো বটেই ঐতিহাসিক মূল্যও অপরিসীম।

যখন মুজতবা আলী আফগানিস্তানে, তখন সেদেশের ভেতরে ও বাইরে দু’ক্ষেত্রে বড় দুটি পরিবর্তনের উত্তর-পর্ব চলছে। বাইরে তখন রুশ বিপ্লবের মত একটি বড় ঘটনা ঘটেছে এবং ভেতরে বাদশা আমানুল্লাহ ব্রিটিশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নানারকম সংস্কারে হাত দিয়েছে; কিন্তু যেগুলো ‘হাত দেয়া’ নয়, ভীমররুলের চাকে ‘ঢিল ছোঁড়ার’ মতো অবস্থার সৃষ্টি করেছে। 

১১ সেপ্টেম্বরের পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী ‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধে’র নামে সন্ত্রাসী যে যুদ্ধ উন্মাদনা তৈরি করা হয়েছে সেখানে ব্রিটিশ শক্তির যে অতি সক্রিয় ভূমিকা দেখি তারও একটা সূত্র এই ইতিহাস থেকে পাওয়া সম্ভব। আফগানিস্তানে অভ্যন্তরীণ নানা সংকট এবং দীর্ঘদিন তার উপর বহিঃস্থ আগ্রাসন ও চাপের ক্ষেত্রে ব্রিটিশদের ভূমিকা বহু পুরনো। ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন নিশ্চিত হবার পর আফগানিস্তানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটেন চেষ্টা করেছে একটানা কিন্তু বারবারই শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে জারের রাশিয়াও আফগানিস্তানের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের চেষ্টা করেছে বহুবার। তারাও তাতে সফল হতে পারেনি। এসব ব্যর্থতা সত্ত্বেও বাইরের এই ঔপনিবেশিক চাপ, আগ্রাসন ও চক্রান্ত আফগানিস্তানে স্থিতিশীল শাসন ও অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে অবিরাম বাধা সৃষ্টি করেছে।

ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন নিশ্চিত হবার পর আফগানিস্তানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটেন চেষ্টা করেছে একটানা কিন্তু বারবারই শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে জারের রাশিয়াও আফগানিস্তানের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের চেষ্টা করেছে বহুবার। তারাও তাতে সফল হতে পারেনি। এসব ব্যর্থতা সত্ত্বেও বাইরের এই ঔপনিবেশিক চাপ, আগ্রাসন ও চক্রান্ত আফগানিস্তানে স্থিতিশীল শাসন ও অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে অবিরাম বাধা সৃষ্টি করেছে। 

১৯১৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত ছিল একদিকে জারের সাম্রাজ্য অন্যদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। রুশ বিপ্লব জার সাম্রাজ্য উচ্ছেদ করবার মাধ্যমে আফগানিস্তানে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে আনুকূল্য প্রদান করে এবং ১৯১৯ সালের পর বাদশা আমানুল্লা যে ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনভাবে সংস্কারমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেন তাতে রাশিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

আফগানিস্তানের আয়তন প্রায় সাড়ে ৬ লাখ বর্গ কিলোমিটার, বাংলাদেশের প্রায় ৬ গুণ। মূলত পাহাড়ি অঞ্চল। এর যে সীমান্ত বর্তমানে আছে (যার বড় অংশ ব্রিটিশ আরোপিত) তার দৈর্ঘ্য সাড়ে ৫ হাজার কিলোমিটার। এর প্রায় অর্ধেকটাই বর্তমান পাকিস্তানের সঙ্গে। ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশদের প্রবর্তিত ‘ডুরান্ড লাইন’ আফগানিস্তানের একটি বড় অংশ ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে যা এখন পাকিস্তানের অংশ। এই অংশের উপর দখলিস্বত্ব কায়েম করেই ব্রিটিশরা আফগানিস্তানকে সমুদ্র পথে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হয়। সেই ডুরান্ড লাইন অনুযায়ী পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের সীমান্ত প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার। আরব সাগরে যেতে গেলে ১৯৪৭-এর আগে ব্রিটিশ ভারত হয়ে এবং ৪৭এর পর পাকিস্তান হয়ে আফগানদের বেরুতে হত। সেই কারণে ৪৭ পূর্ব ব্রিটিশ এবং ৪৭ পরবর্তী পাকিস্তান (অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র)-এর ভূমিকার উপর আফগানিস্তানের অনেক কিছুই নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।   

আফগানিস্তানের সঙ্গে অন্যান্য দেশের যে সীমান্ত আছে তার মধ্যে চীন সবচাইতে কম ৭৬ কিলোমিটার। ইরানের সঙ্গে সীমান্তও বেশ দীর্ঘ প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার। ১৯৭৯-এর পূর্ব পর্যন্ত ইরান ছিল মার্কিন উপগ্রহ। সুতরাং ইরান-পাকিস্তান মিলে দীর্ঘ সীমান্ত বস্তুত প্রথমে ব্রিটিশ ও পরে মার্কিনি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্র হিসেবেই কাজ করেছে দীর্ঘদিন। এর বাইরে আর যে সমস্ত রাষ্ট্রের সঙ্গে বর্তমান আফগানিস্তানের সীমান্ত, এক সময় তার সবগুলোই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। এগুলো হলো-তাজিকিস্তান : ১২০০ কিলোমিটার, তুর্কমেনিস্তান : ৭৪৪ কিলোমিটার এবং উজবেকিস্তান : ১৩৭ কিলোমিটার। তুর্কমেনিস্তানের বিশাল গ্যাস ও তেল সম্পদ আফগানিস্তানের উপর দিয়ে পাকিস্তান, আরব সাগর ও ভারত পর্যন্ত নিয়ে যাওয়াই এ অঞ্চলে মার্কিনি তেল কোম্পানি ইউনোক্যাল-এর অন্যতম আগ্রহের জায়গা। আফগানিস্তনের নিজস্ব সম্পদ তো আছেই। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পূর্ব পর্যন্ত তাই কার্যত আফগানিস্তানের একদিকে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যদিকে প্রথমে ব্রিটিশ ও পরে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রিত শক্তি। চারদিকের এই চাপের মধ্যে আফগানিস্তান বরাবর উঠানামা করেছে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন নিয়ে বাদশা আমানুল্লাহ যখন সংস্কার কাজে হাত দেন তখন ব্রিটিশ শক্তি বারবার পরাজয়ের গ্লানি সঙ্গে নিয়ে হাত মেলায় সংস্কারবিরোধী সামন্ত শক্তির সঙ্গে। বাদশাহ আমানুল্লাহর সংস্কার সবটা সুপরিকল্পিত বা গোছানো ছিল না। এর সুযোগে তাকে ‘কাফির,’ ‘ইসলাম বিরোধী’ আখ্যা দিয়ে সামন্ত শক্তি ব্রিটিশ সহায়তায় নানাভাবে হামলা শুরু করে। এরই এক পর্যায়ে ডাকাত সর্দার বাচ্চা সাকাও ক্ষমতা দখল করে এবং সকল সংস্কার বাতিল ঘোষণা করে। 

আফগানিস্তানে ব্রিটিশ-মার্কিনিদের আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টায় বরাবরই সে দেশের জাতিগত পার্থক্য, ধর্মীয় বিভিন্ন বিভেদকে কাজে লাগানো হয়েছে। মুসলিম ধর্মাবলম্বী সে দেশে শতকরা ৯৯ ভাগের বেশি তার মধ্যে সুন্নী প্রায় ৮৫ ভাগ এবং শিয়া প্রায় ১৫ ভাগ। আফগানিস্তানে যেসব জাতি গোষ্ঠী আছে তার মধ্যে পশতুনই সংখ্যাগরিষ্ঠ, শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ পশতুন, তাজিক শতকরা ২৫ ভাগ, হাজারা শতকরা ১৯ ভাগ এবং উজবেক ৬ ভাগ। ভাষার দিক থেকে আফগান পার্সীই ব্যবহার হয় বেশি-শতকরা ৫০ ভাগ, পশতুন : শতকরা ৩৫ ভাগ এবং তাজিক ১১ ভাগ। 

জাতিগত এই পার্থক্য থেকে বেরিয়ে রাষ্ট্র-জাতির মধ্যে নিজেদের পরিচয়কে স্থিত করবার অবস্থা আফগানিস্তানে তৈরি হয়নি কখনোই। আফগান বা মুসলমান এর দুটোর কোনটিই সেখানে নির্ধারক হিসেবে দাঁড়ায়নি। মুসলমান পরিচয় দিয়ে কিংবা ইসলামকে ঝাণ্ডা হিসেবে ব্যবহার করে বিভিন্ন সময়ে (আমানুল্লাহ থেকে নজিবুল্লা পর্যন্ত) যে সংস্কার বিরোধী তৎপরতার দেখা যায় তার পেছনে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ইন্ধন ছিল মুখ্য-প্রথমে ব্রিটিশ ও পরে অধিকতর প্রত্যক্ষভাবে মার্কিন। 

জাতিগত এই পার্থক্য থেকে বেরিয়ে রাষ্ট্র-জাতির মধ্যে নিজেদের পরিচয়কে স্থিত করবার অবস্থা আফগানিস্তানে তৈরি হয়নি কখনোই। আফগান বা মুসলমান এর দুটোর কোনটিই সেখানে নির্ধারক হিসেবে দাঁড়ায়নি। মুসলমান পরিচয় দিয়ে কিংবা ইসলামকে ঝাণ্ডা হিসেবে ব্যবহার করে বিভিন্ন সময়ে (আমানুল্লাহ থেকে নজিবুল্লা পর্যন্ত) যে সংস্কার বিরোধী তৎপরতার দেখা যায় তার পেছনে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ইন্ধন ছিল মুখ্য-প্রথমে ব্রিটিশ ও পরে অধিকতর প্রত্যক্ষভাবে মার্কিন।

মোহসেন মাখমালবাফ আফগানিস্তান নিয়ে দুটো চলচ্চিত্র বানিয়েছেন, প্রথমটি হলো ‘সাইক্লিস্ট’ (১৯৮৮) এবং দ্বিতীয়টি ‘কান্দাহার’ (২০০১)। এই চলচ্চিত্র বানাতে গিয়ে আফগানিস্তানকে তিনি বোঝার চেষ্টা করেছেন গভীরভাবে। ইরানের সঙ্গে আফগানিস্তানের বহুবিধ সম্পর্ক তাঁকে অনেক বিষয় ভেতর থেকে, ঐতিহাসিকভাবে দেখার সুযোগ দিয়েছেন। তিনি বলছেন, “… আফগানিস্তানের মানুষ যে শুধু অর্থনৈতিকভাবে মেষপালনের অবস্থা থেকে খুব বেশিদূর এগুতে পারেননি তাই নয়, গোষ্ঠীশাসন থেকেও এক পা এগুতে পারেনি তারা। আর এ কারণে কোন আফগান জাতীয়তাবাদের মনোভাব গড়ে ওঠেনি। মাতৃভূমি ত্যাগ না করা পর্যন্ত একজন আফগান তার আফগান সত্তা টের পায় না। কিন্তু আফগানিস্তানের ভেতরে তারা হয় পশতু, হাজারা, উজবেক, নয়তো তাজিক। … তাজিক আর হাজারারা পশতুদের পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় শত্রু মনে করে। পশতুরাও তাই। একে অন্যের মসজিদে নামাজ পর্যন্ত পড়তে যায় না। … এক গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য গোষ্ঠীর বিয়েও হয় না।”  তালিবান ও মুজাহেদিনদের মধ্যেকার বিরোধ বস্তুত এই জাতিগত বৈরীতার উপরই দাঁড়ানো। মার্কিন পক্ষ যা পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগিয়েছে।  

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর : আফগানিস্তান অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদের দখল পর্ব 

১৯৪৭ এ ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি শারীরিকভাবে বিদায় নেয়। একই সময়কালে বিশ্ব পুঁজিবাদী কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে ব্রিটিশদের নেতৃত্বের অবস্থানেরও অবসান ঘটে এবং তার স্থান দখল করে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্ব শক্তির নতুন ভারসাম্যে, পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার নেতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের এবং তার তৎকালীন কেন্দ্র সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে নানাবিধ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। একদিকে পুঁজির বিনিয়োগ ক্ষেত্র সম্প্রসারণ, বাজার বিস্তার এবং অন্যদিকে সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে মতাদর্শিক-সামরিক যুদ্ধে বিভিন্ন অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র নতুন শক্তির বিন্যাস গঠনে মনোযোগী হয়। দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার অঞ্চলে তার এই ভূমিকায় আফগানিস্তান বিভিন্নভাবে বিভিন্ন দিক থেকে আক্রান্ত হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রও কখনোই ব্রিটিশদের মতোই আফগানিস্তানের উপর তার সার্বিক নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে পারেনি। কিন্তু তার চেষ্টা-চক্রান্ত-আক্রমণের অবসানও হয়নি। 

৫০ দশকের শুরুতে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন অন্যদিকে চীনের হুমকি মোকাবিলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ব্যবস্থাপনার দিকেই অগ্রসর হয় বেশি। এর একটি দিক ছিল বিভিন্ন দেশে সামরিক বাহিনীর শাসনের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করা, দ্বিতীয়টি হল আঞ্চলিক সামরিক চুক্তির মাধ্যমে অঞ্চল জুড়ে পুঁজিবাদের বা নির্ভরযোগ্য শাসন ব্যবস্থার রক্ষাব্যুহ তৈরি করা এবং তৃতীয়টি হলো সরাসরি সামরিক আগ্রাসন। 

কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও লাওসে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সামরিক আগ্রাসন পরিচালনা করে। অন্যদিকে পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ইরান, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশে কাছাকাছি বিভিন্ন সময়ে সামরিক শাসন জারী হয় এবং অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ নিয়ে সিয়াটো, সেন্টো সামরিক জোটও গড়ে উঠে। পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একাধিক সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয় এবং তার সঙ্গে ইরাক, ইরান ও তুরস্কও যুক্ত হয়। ন্যাটোর ধারাবাহিকতায় এই চুক্তিগুলো ছিল এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের এবং সমাজতন্ত্র বিরোধী শক্তিসমূহের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার চেষ্টা মাত্র।

আফগানিস্তানের পার্শ্ববর্তী দুই বড় প্রতিবেশী পাকিস্তান ও ইরান যখন যুক্তরাষ্ট্রের একান্ত বশ্য হিসেবে সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ, আফগানিস্তান তখনও এসব চুক্তির বাইরে অবস্থান করছে। সুতরাং এর উপর কি রকম চাপ কার্যকর ছিল তা বোধগম্য। পাকিস্তান এবং ইরান দুটো দেশই প্রায় অভিন্ন প্রক্রিয়ায় কাছাকাছি সময়ে সামরিক/রাজ শাসনে প্রবেশ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বশ্যরাষ্ট্রে পরিণত হয়।

আফগানিস্তানের পার্শ্ববর্তী দুই বড় প্রতিবেশী পাকিস্তান ও ইরান যখন যুক্তরাষ্ট্রের একান্ত বশ্য হিসেবে সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ, আফগানিস্তান তখনও এসব চুক্তির বাইরে অবস্থান করছে। সুতরাং এর উপর কি রকম চাপ কার্যকর ছিল তা বোধগম্য। পাকিস্তান এবং ইরান দুটো দেশই প্রায় অভিন্ন প্রক্রিয়ায় কাছাকাছি সময়ে সামরিক/রাজ শাসনে প্রবেশ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বশ্যরাষ্ট্রে পরিণত হয়।

ইরানের বিষয়টি এখানে একটু খোলাসা করা দরকার। সেদেশে মোসাদ্দেক প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠন করেন ১৯৫১ সালে। ক্ষমতায় এসে তিনি ইরানের তেলক্ষেত্রগুলো জাতীয়করণ করেন এবং তাতে আঘাতপ্রাপ্ত হয় প্রধানত ব্রিটিশ তেল কোম্পানি। এই কোম্পানির মাধ্যমে ইরানের তেলসমৃদ্ধ প্রায় আড়াই লাখ বর্গমাইল এলাকা ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এছাড়া ছিল বছরে আড়াই কোটি টন তেল শোধনের শোধনাগার, বাইরে প্রেরণের জন্য একশোরও বেশি অয়েল ট্যাংকার এবং দেশের মধ্যে পরিবহণের জন্য দশ হাজারেরও বেশি ট্রাকের বহর। ইরানি তেল সম্পদের উপর ব্রিটিশ কোম্পানির একচেটিয়া কর্তৃত্বের ফলাফল ছিল : আশেপাশের দেশগুলোর তুলনাতেও অনেক বেশি হারে সম্পদ লুণ্ঠনে তাদের সাফল্য। এটা ধারণা করা যায় ১৯৪১ থেকে ১৯৫০ সময়কালে তাদের মুনাফা ও ইরানিদের প্রাপ্তির অনুপাত দেখলে। এই কোম্পানি তাদের যাবতীয় আমদানি দ্রব্যাদির জন্য ইরান সরকারকে কোনপ্রকার শুল্ক দিতো না। ৪১-৫০ এর সময়কালে ব্রিটিশ আমদানি থেকে যে পরিমাণ শুল্ক ইরান পেতে পারতো কিন্তু পায়নি তা সে সময়ে তেল থেকে প্রাপ্ত সরকারি রাজস্ব থেকে বেশি। অন্যদিকে আবার কর্তৃত্বের ধরনের জন্য ইরানি তেল থেকে ব্রিটিশ কোম্পানি যা মুনাফা করতো তার শতকরা মাত্র ৮ ভাগ ইরান পেতো রাজস্ব হিসেবে, ১৯৪১-৫০ এর সময়কালে ইরান থেকে তেল রফতানি হয়েছে ৩২.৪ কোটি টন, কোম্পানির মুনাফা হয়েছে ৫০০ কোটি ডলার এবং ইরান পেয়েছে ৪২ কোটি ডলার।

১৯৫১ সালে ইরানি তেলক্ষেত্র জাতীয়করণ করে ‘জাতীয় ইরান তেল কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করা হয় যা দেশের পুরো তেলক্ষেত্রের দায়িত্ব নেয়। এই ঘটনায় ব্রিটিশ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। প্রথমে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয় এবং পরে ‘গণতন্ত্রের’ জপকারী ব্রিটিশ-মার্কিন শক্তি সিআইএ ও ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার প্রত্যক্ষ ভূমিকায় ইরানের প্রথম নির্বাচিত সরকারকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উচ্ছেদ করে এবং ‘শাহেনশাহ’-র শাসন বলবৎ হয়। ইরান এরপর থেকে পুরো অঞ্চলে মার্কিনি আধিপত্য রক্ষায় স্থানীয় পুলিশ কিংবা মাস্তান হিসেবে ভূমিকা পালন করতে থাকে। 

জনপ্রিয় মোসাদ্দেক সরকারের তেলক্ষেত্র জাতীয়করণের প্রভাব অন্যান্য দেশের উপরও পড়েছিল। এসব দেশে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ কিংবা তার বন্ধু শ্রেণীসমূহের শাসন-পীড়ন-লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম  চীন বিপ্লব (১৯৪৯) তো বটেই ইরানের জাতীয়করণ (১৯৫১) ঘটনা দ্বারাও পুষ্টিপ্রাপ্ত হয়। ইরানে তেলক্ষেত্র জাতীয়করণের কয়েক মাসের মধ্যে বাহরাইনে ব্রিটিশ-আমেরিকানদের কর্তৃত্ব উচ্ছেদ করে তেলক্ষেত্র জাতীয়করণের দাবি উঠে। একই বছর মিশরেও দাবি উত্থাপিত হয় এবং এক পর্যায়ে সেখানে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে জামাল আবদুল নাসের ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করেন। সুতরাং ইরানে শাহানশাহর রাজত্ব প্রতিষ্ঠা, পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি এবং পুরো এলাকায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক আধিপত্য নিশ্চিত করা সাম্রাজ্যবাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। 

ইরানে তেলক্ষেত্র জাতীয়করণের কয়েক মাসের মধ্যে বাহরাইনে ব্রিটিশ-আমেরিকানদের কর্তৃত্ব উচ্ছেদ করে তেলক্ষেত্র জাতীয়করণের দাবি উঠে। একই বছর মিশরেও দাবি উত্থাপিত হয় এবং এক পর্যায়ে সেখানে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে জামাল আবদুল নাসের ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করেন।

আফগানিস্তানের সংস্কার চেষ্টা এবং বিরোধিতা

দুইদিক থেকে অর্থাৎ ইরান ও পাকিস্তানের মাধ্যমে আফগানিস্তানের উপর মার্কিনি চাপে আফগানিস্তান তখন বিপর্যস্ত। এছাড়া ব্রিটিশ প্রবর্তিত ডুরান্ড লাইনের সূত্র ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে তার সীমান্ত বিরোধও ঘনীভূত হচ্ছিল। এ সময়ে পরিস্থিতির চাপেই আফগানিস্তান ক্রমান্বয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বস্তুত আফগান অর্থনীতিতে অবকাঠামো উন্নয়নে সোভিয়েত ভূমিকা ১৯৭৯-তেই শুরু হয়নি-১৯১৯ থেকে শুরু করে কয়েক দশক ধরেই এটি অব্যাহত ছিল। অন্যদিক থেকে বলা যায় আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি পুরোপুরি বৈরী শাসকগোষ্ঠী যখন ক্ষমতাসীন হয় ততদিনে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটেছে। অর্থাৎ যতদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন টিকে ছিল আফগানিস্তানে সকল শাসকগোষ্ঠীই, বাদশা আমানুল্লাহ থেকে প্রেসিডেন্ট নজিবুল্লাহ পর্যন্ত, কমবেশি সকলেই সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নির্ভরশীল ছিল। এই নির্ভরশীলতা তৈরির পেছনে অনেকখানি ক্রিয়াশীল ছিল মার্কিন-ব্রিটিশ আগ্রাসনের হুমকি। পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে মার্কিনিদের পাকিস্তান পক্ষাবলম্বন এবং পাকিস্তান, ইরান, ইরাক ও তুরস্ককে নিয়ে গঠিত মার্কিনি সামরিক জোটে যোগদানের চাপও আফগানিস্তানকে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি ঝুঁকে পড়তে প্রভাব বিস্তার করে। 

যতদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন টিকে ছিল আফগানিস্তানে সকল শাসকগোষ্ঠীই, বাদশা আমানুল্লাহ থেকে প্রেসিডেন্ট নজিবুল্লাহ পর্যন্ত, কমবেশি সকলেই সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নির্ভরশীল ছিল। এই নির্ভরশীলতা তৈরির পেছনে অনেকখানি ক্রিয়াশীল ছিল মার্কিন-ব্রিটিশ আগ্রাসনের হুমকি। পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে মার্কিনিদের পাকিস্তান পক্ষাবলম্বন এবং পাকিস্তান, ইরান, ইরাক ও তুরস্ককে নিয়ে গঠিত মার্কিনি সামরিক জোটে যোগদানের চাপও আফগানিস্তানকে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি ঝুঁকে পড়তে প্রভাব বিস্তার করে।

১৯৫৫ এর পর থেকে আফগানিস্তানে বহু সংখ্যক সোভিয়েত বিশেষজ্ঞ আসেন বিভিন্ন খাতে প্রশিক্ষক বা সহযোগী হিসেবে; সড়ক, বিমানবন্দর, কারখানা গড়ে উঠে তাদেরই সহযোগিতায়-গ্যাস, তেল, লোহা, তামা সম্পর্কে সমীক্ষা পরিচালিত হয়। বহুসংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষত পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট গড়ে উঠে। আফগানিস্তান থেকে বহু তরুণ সোভিয়েত ইউনিয়নে যান শিক্ষা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে। ১৯৫৮ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে সামরিক বাহিনীর অফিসার ও কারিগরদের মধ্যে শতকরা ৫০ ভাগই সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন।

আফগানিস্তানে রাজ শাসকেরা যে মতাদর্শিকভাবে কিংবা রাজনৈতিকভাবে সোভিয়েত নীতি অনুসরণ করেছেন কিংবা সেভাবে অর্থনীতি রাজনীতির কোন মৌলিক সংস্কার সাধন করেছেন তা নয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন, সহযোগিতা নেয়া ছাড়া তাদের গত্যন্তর ছিল না-কেননা এর বিকল্প ছিল মার্কিন-ব্রিটিশ পকেটে প্রবেশ করা। এমনকি কড়া সোভিয়েত ব্লক বিরোধী বলে পরিচিত বাদশা জহির যিনি এখন মার্কিনী ছকের অন্যতম খুঁটি তিনিও তার শাসনামলে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক রেখেছেন। 

পাশাপাশি আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে সোভিয়েত বিরোধী, কমিউনিস্ট বিরোধী প্রচারণাও ছিল বরাবর পুরোদমে। সৈয়দ মুজতবা আলী বিশ দশকে গিয়েই এর চাপ টের পেয়েছেন। বাদশা আমানুল্লাহর বিরুদ্ধে ‘ডাকাত সর্দার’ বাচ্চা সাকাও নেতৃত্বাধীন কিংবা সহযোগী সামন্ত প্রভু এবং তাদের সঙ্গী ধর্মীয় নেতাদের মূল প্রচারণা ছিল আমানুল্লাহ ‘নাস্তিক’ ‘কমিউনিস্ট’। আমানুল্লাহ-র অপরাধ ছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ক্ষেত্রে সংস্কার সাধনের চেষ্টা করা। তাঁর সম্ভবত ভুল হয়েছিল অগ্রাধিকার নির্ধারণে। পশ্চিম থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও ‘আধুনিকতা’র পশ্চিমী মডেলকে তিনি আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করে অন্ধভাবে তার অনুকরণ করতে গিয়েছিলেন। করতে গিয়ে পোশাকের উপর অনাবশ্যক জোর আচার-আচরণ প্রচলিত নিয়ম-কানুনের উপর হস্তক্ষেপ ইত্যাদি তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে বাধা সৃষ্টি করেছিল, জনমতও বৈরী হয়ে উঠেছিল।

বাদশা আমানুল্লাহর বিরুদ্ধে ‘ডাকাত সর্দার’ বাচ্চা সাকাও নেতৃত্বাধীন কিংবা সহযোগী সামন্ত প্রভু এবং তাদের সঙ্গী ধর্মীয় নেতাদের মূল প্রচারণা ছিল আমানুল্লাহ ‘নাস্তিক’ ‘কমিউনিস্ট’। আমানুল্লাহ-র অপরাধ ছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ক্ষেত্রে সংস্কার সাধনের চেষ্টা করা। তাঁর সম্ভবত ভুল হয়েছিল অগ্রাধিকার নির্ধারণে।

বোরখা পরা নিয়ে আমানুল্লাহর নামে অনেক কথাই ছড়ানো হয়েছিল। কিন্তু সেসময়ও আফগানিস্তানের গ্রামাঞ্চলে মেয়েরা কৃষি জমিতে কাজ করেছেন, বোরখা ছাড়াই। রাজ পরিবারের মেয়েদের মাথায় হ্যাট থেকে একটা জাল ঝোলানো থাকতো মুখের উপর। রানী সুরাইয়া অতি উৎসাহে আনুষ্ঠানিকভাবে সেটা ছিঁড়ে ফেলার পর ‘বোরখার বিরুদ্ধে বাদশা নেমেছেন’ বলে প্রচার ছড়িয়ে পড়ে। 

বিশ এর দশকে আফগান মেয়েদের অবস্থা বোঝার জন্য মুজতবা আলীর আশ্রয় নেই। সেসময় তিনি বাসে করে পেশাওয়ার থেকে কাবুলে যাচ্ছিলেন। রাস্তায় তাঁর বহুবিধ ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। বহুবার মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে প্রবেশ করেছেন স্বস্তির এক উপত্যকায়। লিখেছেন, ‘চোখ বন্ধ অবস্থায়ই ঠাণ্ডা হাওয়ার প্রথম পরশ পেলুম; খুলে দেখি সামনে সবুজ উপত্যকা-রাস্তার দুদিকে ফসল ক্ষেত। সর্দারজী পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘জলালাবাদ’। দক্কার পাশের সেই কাবুল নদীর কৃপায় এই জলালাবাদ শস্য শ্যামল। … এমনকি যে দুটো-চারটে পাঠান রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল তাদের চেহারাও যেন সীমান্তের পাঠানের চেয়ে মোলায়েম বলে মনে হলো। লক্ষ্য করলুম যে পাঠান শহরে গিয়ে সেখানকার মেয়েদের বেপর্দামির নিন্দা করে তারই বউ-ঝি ক্ষেতে কাজ করছে অন্য দেশের মেয়েদেরই মত। মুখ তুলে বাসের দিকে তাকাতেও তাদের আপত্তি নেই।’

‘চোখ বন্ধ অবস্থায়ই ঠাণ্ডা হাওয়ার প্রথম পরশ পেলুম; খুলে দেখি সামনে সবুজ উপত্যকা-রাস্তার দুদিকে ফসল ক্ষেত। সর্দারজী পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘জলালাবাদ’। দক্কার পাশের সেই কাবুল নদীর কৃপায় এই জলালাবাদ শস্য শ্যামল। … এমনকি যে দুটো-চারটে পাঠান রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল তাদের চেহারাও যেন সীমান্তের পাঠানের চেয়ে মোলায়েম বলে মনে হলো। লক্ষ্য করলুম যে পাঠান শহরে গিয়ে সেখানকার মেয়েদের বেপর্দামির নিন্দা করে তারই বউ-ঝি ক্ষেতে কাজ করছে অন্য দেশের মেয়েদেরই মত। মুখ তুলে বাসের দিকে তাকাতেও তাদের আপত্তি নেই।’

আফগান নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসা শুরু করেন ৬০ দশকে কিন্তু তা স্বচ্ছল পরিবারগুলোর বাইরে খুব বেশি যায়নি। ৭০ দশকে গ্রাম পর্যন্ত নারী শিক্ষা, কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির নানা উদ্যোগ টিকতে পারেনি ধর্মের নামে এর বিরোধিতা ও যুদ্ধ সংঘাতের কারণে। মুজাহেদিনরা ক্ষমতায় আসার পরও যতটুকু অবস্থা ছিল তালেবানরা ক্ষমতায় আসার পর তারও অবসান ঘটে। নারী অদৃশ্য হয়ে যায় আফগানিস্তানের অবয়ব থেকে। মোহসেন মাখামালবাফ এই অবস্থা সম্পর্কে বলছেন, “নানা কারণে আফগানিস্তানের কোন চেহারা নেই। আফগান মেয়েরা চেহারাহীন। মানে দুই কোটি জনসংখ্যার এক কোটিকে চোখেই দেখা যায় না। যে জাতির অর্ধেক অংশকে দেখা যায় না, সে জাতির চেহারা থাকে কী করে? গত কয়েক বছরে কোনো টেলিভিশন প্রচারিত হয়নি এ দেশে। শুধু প্রচার করা হয়েছে শরিয়ত, হিভাদ ও আনিস প্রভৃতি দু’পৃষ্ঠার সাদাকালো গুটিকয় পত্রিকা। তাও পত্রিকার শরীরে কোথাও কোন ছবি নেই। … চিত্রকলা ও আলোকচিত্র কড়াকড়িভাবে নিষিদ্ধ।”  

বাম আন্দোলনের উত্থান ও পতন

১৯৬৪ সালে বাদশা জহিরের সময়কালে আফগানিস্তানে সংবিধান প্রণয়ন করা হয় এবং সাংবিধানিক রাজতন্ত্র সেখানে দল গঠনের অনুমোদন দান করে। এরপর থেকেই বিভিন্ন মার্কসবাদী বিপ্লবী গ্রুপের কার্যক্রমের বিস্তার ঘটে এবং বিভিন্ন দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ৬০ দশকের শেষ নাগাদ তিনটি পত্রিকাকে কেন্দ্র করে তিনটি মার্কসবাদী গ্রুপের অস্তিত্ব ছিল উল্লেখযোগ্য। পত্রিকাগুলো হলো : খালক (জনতা), পারচাম (পতাকা) এবং শোলা (অগ্নিশিখা)। পরচম গ্রুপের বিশেষ প্রভাব ছিল সেনাবাহিনীর মধ্যে। 

১৯৭৩ সালে বাদশাহ জহিরের চাচাতো ভাই প্রিন্স দাউদ এই পরচম গ্রুপের সহায়তাতেই অভ্যুত্থান সংঘটিত করে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটান। রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে বিভিন্ন সংস্কার কাজের উদ্যোগ নেয় নতুন সরকার। এর মধ্যে ভূমি সংস্কার থেকে শিল্পায়ন পর্যন্ত অনেকগুলো দিকই ছিল। কিন্তু সংস্কার কর্মসূচির বাস্তবায়ন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নানা চাপ নিয়ে দাউদ এর সঙ্গে পরচম গ্রুপের সদস্যদের মতানৈক্য শুরু হয় এবং কিছুদিনের মধ্যেই দাউদ তাঁর সরকার থেকে পরচম গ্রুপের অনেককে সরিয়ে দেন। এ পর্যায়ে মার্কসবাদী গ্রুপগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রচেষ্টা জোরদার হয় এবং পরচম ও খালক গ্রুপ ঐক্যবদ্ধ হয়ে “পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অব আফগানিস্তান” গঠন করে। এর সভাপতি হন খালক গ্রুপের নূর মোহাম্মদ তারাকি এবং সহ-সভাপতি হন পরচম গ্রুপের বাবরাক কারমাল।

১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট হবার পর থেকে মোহাম্মদ দাউদ ইরান, সৌদি আরব, মিশর, কুয়েত এর সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনের মধ্য দিয়ে নতুন সমর্থন ভিত্তি তৈরি করতে চেষ্টা করেন। অন্য দিকে চলে বামপন্থীদের অপসারণ, আক্রমণ, গ্রেফতার ও হত্যা। এই পরিপ্রেক্ষিতেই সোভিয়েত সমর্থিত ক্যু সংঘটিত হয়। অবশ্য এভাবে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরোধিতা মার্কসবাদী বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যেই ছিল যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন মার্কসবাদী তাত্ত্বিক মীর আকবর খাইবার। তিনি এই সময়েই নিহত হন।   

দাউদ এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র নতুনভাবে যে সম্পর্ক স্থাপন করতে সচেষ্ট হয় তার মাধ্যম ছিল শাহ-র ইরান। ইরান সেসময় এই অঞ্চলের মার্কিনি পুলিশ হিসেবে (কু)খ্যাত ছিল। ইরানের ভেতরে সকল মত দমনে নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতায় বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল শাহের গোয়েন্দা সংস্থা সাভাক (savak)। এজন্য এই সংস্থাকে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর বাম-বিপ্লবী-গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের দমন ও তাদের মধ্যে অন্তর্ঘাত ইত্যাদি কাজে নিয়োগ করতো। আফগানিস্তানে দাউদ-এর সরকার থেকে বামপন্থীদের বিতাড়ন, তাদের উপর বিভিন্ন ধরনের গোয়েন্দা তৎপরতা, অন্তর্ঘাত, গুপ্ত খুন, আটক ইত্যাদি কাজে সাভাক-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

ইরানের ভেতরে সকল মত দমনে নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতায় বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল শাহের গোয়েন্দা সংস্থা সাভাক (savak)। এজন্য এই সংস্থাকে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর বাম-বিপ্লবী-গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের দমন ও তাদের মধ্যে অন্তর্ঘাত ইত্যাদি কাজে নিয়োগ করতো।

একদিকে সাভাক-এর এরকম কর্মসূচি যখন চলতে থাকে তখন ইরানের শাহানশা মার্কিনি প্রকল্প অনুযায়ী আফগানিস্তানে ২০০ কোটি ডলারের অর্থসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দেন, সে সময়ে বৈদেশিক অর্থসংস্থানে এটা ছিল বৃহত্তম। এছাড়া ইরান উদ্যোগ নেয় আফগানিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় জোট আরসিডি-তে (Regional Cooperative for Development) অন্তর্ভুক্ত করতে। আরসিডির সদস্য ছিল পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্ক। এসব গোপন-প্রকাশ্য তৎপরতায় আফগানিস্তানের সোভিয়েত-মার্কিন সম্পর্কে এক ধরনের নিরপেক্ষ কিংবা মধ্যপন্থী অবস্থানের অবসান ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।

পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যখন ক্ষমতায় আসে তখন এর নেতা নূর মোহাম্মদ তারাকি নিজেদেরকে অভিহিত করেন জাতীয়তাবাদী, বিপ্লবী হিসেবে। ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠান ও চর্চার ক্ষেত্রে এই সরকারের যে কোন বৈরিতা ছিল না তা সে সময়কার ইকনমিস্ট, নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকাতেও বলা হয়েছে। কিন্তু নতুন সরকারের বিরুদ্ধে যেসব প্রচারণা দেশের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপকভাবে শুরু হয় সেগুলোর মধ্যে ছিল প্রথমত, তারা নাস্তিক, ধর্ম বিরোধী; দ্বিতীয়ত, তারা কমিউনিস্ট, সোভিয়েত অনুচর এবং তৃতীয়ত, তারা আফগান মানুষদের ঐতিহ্য ধ্বংস করতে চায়। 

কেন এসব প্রচার? এটা বুঝতে আমাদের দেশের যেসব বিপ্লবী কর্মীর জনগণের মধ্যে শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে কাজ করবার অভিজ্ঞতা আছে তাঁদের অসুবিধা হবার কথা নয়। আমাদের এখানেও এরকম খন্ড খন্ড অনেক ঘটনা আছে যেখানে আমরা দেখি, কোথাও কোন কর্মী, জোতদার, মহাজন, বড় ক্ষমতাবান কাউকে আঘাত করবার মতো আন্দোলন গড়ে তুললে সেই কর্মী যেসব ইস্যু তুলছেন সেসব জায়গায় না গিয়ে তার নামে ‘নাস্তিক’ ‘কমিউনিস্ট’ ইত্যাদি প্রচার শুরু হয়। ‘নাস্তিক’ ‘কমিউনিস্ট’ সমার্থক হিসেবে ধরা হয় এবং এ ধরনের আখ্যা পাবার জন্য প্রকৃতই ‘নাস্তিক’ বা ‘কমিউনিস্ট’ হবারও দরকার হয় না। শোষণ-পীড়নের বিরুদ্ধে, অধিকারের পক্ষে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, লুন্ঠনের বিরুদ্ধে, কথা বা আন্দোলন তুললেই এ ধরনের খেতাব পেতে হয়। এই কারণে এ দেশে অনেক ধার্মিক অ-কমিউনিস্ট গণতান্ত্রিক কর্মীও গালি হিসেবে ‘নাস্তিক’ ‘কমিউনিস্ট’ খেতাব পেয়েছেন। এর মাধ্যমে তাদেরকে কোণঠাসা জনবিচ্ছিন্ন করবার চেষ্টা করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে জনরোষ তৈরি করবার চেষ্টা করা হয়েছে। যারা জনগণের মধ্যে যথেষ্ট শক্ত ভিত্তি তৈরি করতে পেরেছেন এসব বাধা তাদের থামাতে পারেনি, কিন্তু যাদের ভিত্তি যোগাযোগ যথেষ্ট ছিল না তাদের অনেকেই অনেকরকম লাঞ্ছনা, নির্যাতন, ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। জীবনও হারিয়েছেন অনেকে।

শোষণ-পীড়নের বিরুদ্ধে, অধিকারের পক্ষে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, লুন্ঠনের বিরুদ্ধে, কথা বা আন্দোলন তুললেই এ ধরনের খেতাব পেতে হয়। এই কারণে এ দেশে অনেক ধার্মিক অ-কমিউনিস্ট গণতান্ত্রিক কর্মীও গালি হিসেবে ‘নাস্তিক’ ‘কমিউনিস্ট’ খেতাব পেয়েছেন। এর মাধ্যমে তাদেরকে কোণঠাসা জনবিচ্ছিন্ন করবার চেষ্টা করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে জনরোষ তৈরি করবার চেষ্টা করা হয়েছে।

নিয়মিত ধর্ম চর্চাকারী এমনকি ধর্ম প্রচারক ব্যক্তিও যখন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ক্ষমতার মুখোমুখি দাঁড়ান তখন তাদের কপালেও যে এরকম তিলক লাগতে পারে তার একটি বড় উদাহরণ : মওলানা ভাসানী। সাম্রাজ্যবাদ, সামরিক শাসন, সামন্ত শোষণ, জোতদার মহাজনদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে মওলানা হিসেবে সক্রিয় থেকেও মওলানা ভাসানী ধর্ম অনুশীলনের সাথে সম্পর্কহীন, পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর কাছ থেকে ‘ইসলামের দুশমন’ খেতাব পেয়েছেন-‘ভারতের দালাল’ ‘কমিউনিস্ট’ বলে তাঁকে কোণঠাসা করারও চেষ্টা হয়েছে। 

এগুলো শুধু বাংলাদেশের কিংবা মুসলিম সমাজের ঘটনা নয়। নিকারাগুয়া সহ বহু দেশে স্বৈরাচার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে অনেক ধর্মযাজক সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁদের ‘কমিউনিস্ট’ বা ‘কমিউনিস্টদের দালাল’ বলে অপদস্থ, কোণঠাসা এমনকি হত্যা করা হয়েছে। 

আফগানিস্তানে এরকম প্রচার ওঠা তাই বিচিত্র নয়, অপরিকল্পিতও নয়। সে সময়কার নিউইয়র্ক টাইমস ‘বামপন্থী ক্ষমতা গ্রহণের’ প্রথম দিকে জানায়, ‘কিছুসংখ্যক আফগান ধর্মীয় ইস্যু ব্যবহার করছে আসলে প্রেসিডেন্ট তারাকির ভূমি সংস্কার ও সামন্ত সমাজের আরও কিছু সংস্কার বিরোধিতা করবার জন্য।’ কিন্তু এরপর পশ্চিমী মূলধারার সব পত্রপত্রিকা ইসলাম রক্ষার সুরই তোলে, ‘মুজাহেদিনরা’ তখন তাদের কাছে মুক্তিযোদ্ধা।

আফগানিস্তানে সেসময় শতকরা ৯০ জন মানুষ ছিলেন নিরক্ষর, যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই দুর্বল, গড় আয়ুসীমা ৪০-এরও নিচে, মেয়েদের শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা শহরের বাইরে নেইই প্রায়, ভূসম্পদ কতিপয় ভূস্বামীর হাতে; ভূস্বামী ও গোত্র প্রধানদের নিয়ন্ত্রণে অর্থনীতি, রাজনীতি, জীবনযাপন সবই। ধর্মীয় নেতারা ছিলেন এদেরই অংশ। সুতরাং ভূস্বামীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা, গোত্র প্রধানদের রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং এদের সম্মিলিত সামাজিক আধিপত্য খর্ব হবার কোন সম্ভাবনা দেখা গেলেই ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার তাদের জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে উঠে। আর তা সহজও হয় তাদের অবস্থানের কারণেই।

আফগানিস্তানে সেসময় শতকরা ৯০ জন মানুষ ছিলেন নিরক্ষর, যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই দুর্বল, গড় আয়ুসীমা ৪০-এরও নিচে, মেয়েদের শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা শহরের বাইরে নেইই প্রায়, ভূসম্পদ কতিপয় ভূস্বামীর হাতে; ভূস্বামী ও গোত্র প্রধানদের নিয়ন্ত্রণে অর্থনীতি, রাজনীতি, জীবনযাপন সবই। ধর্মীয় নেতারা ছিলেন এদেরই অংশ। সুতরাং ভূস্বামীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা, গোত্র প্রধানদের রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং এদের সম্মিলিত সামাজিক আধিপত্য খর্ব হবার কোন সম্ভাবনা দেখা গেলেই ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার তাদের জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে উঠে।

ক্ষমতা গ্রহণের পর তারাকি সরকার যেসব ক্ষেত্রে সংস্কারে বিশেষ গুরুত্ব দেন তার মধ্যে একটি ছিল: ভূমি ব্যবস্থার সংস্কার। ভূমি সংস্কারে প্রায় দুই লাখ গ্রামীণ ভূমিহীন পরিবারের জমি পাবার উদ্যোগ নেয়া হয়, ভূস্বামীদের কাছে কৃষকদের বহুগুণে বর্ধিত ঋণ এবং দাদন প্রথা বাতিল করা হয়। এসব উদ্যোগ সরাসরি ভূস্বামী-মহাজন-গোত্র প্রধানদের ক্ষমতার ভিত্তির উপর হামলা করে বলে তারা ক্ষিপ্ত হয়। কিন্তু এসব উদ্যোগে যারা লাভবান হতো সেই বিশাল গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এসব উদ্যোগ সম্পর্কে কমই অবহিত ছিলেন। ব্যাপক সংখ্যক স্কুল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য উদ্যোগের মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাল্যবিবাহ এবং পণ্যের বিনিময়ে মেয়েকে বিয়ে দেয়ার রীতি নিষিদ্ধ করা। ‘ইসলামের শত্রু’ প্রচারে এসবগুলোই বিকৃতভাবে ব্যবহার করা হয়।১০

১৯৭৮ এর এপ্রিলে বিপ্লবী সরকার ক্ষমতাসীন হবার দুমাসের মধ্যেই বিভিন্ন ইসলামী গ্রুপ সংগঠিত হয় এবং ‘জেহাদি’ যুদ্ধ শুরু করে তবে ১৯৮০ পর্যন্ত এগুলোর তৎপরতা ছিল সীমিত পর্যায়ের এবং প্রচারণামূলক। কিন্তু এর মধ্যেই বিভিন্ন সংস্থার ব্যানারে (যেমন US Drug Enforcement Agency, Association of American Aid for Afghan Refugees) সিআইএ তার তৎপরতা শুরু করে। অন্যদিকে সরকার এসব বিষয় জনগণের মধ্য নিয়ে যাবার জন্য মনোযোগ দেবার চাইতে নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বেই জড়িয়ে পড়ে বেশি। এর মধ্যে নানারকম অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা ছিল বলেও ধারণা করা হয়।

ক্ষমতাসীন হবার এক বছরের মধ্যে বিপ্লবী সরকারের ভেতরে অন্তর্দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পায় এবং ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বরে নূর মোহাম্মদ তারাকিকে খুন করে ক্ষমতাসীন হন হাফিজুল্লা আমিন। আমিনের শাসনামলে বামপন্থী গ্রুপগুলোর অনেক নেতৃবৃন্দের উপর হামলা এবং সংস্কার কাজে জবরদস্তি বিপ্লব বিরোধী তৎপরতাকে অনেক সহায়তা করে। ডিসেম্বরে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর অনুপ্রবেশের মাধ্যমে আমিনকে উৎখাত, বাবরাক কারমাল সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক পরিকল্পনার জন্য উপযোগী হয়। ভিয়েতনামে বিপর্যস্ত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে আরেকটি ভিয়েতনাম জাতীয় ফাঁদে ফেলা দরকার ছিল। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নের নীতি ও পদ্ধতি যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য খুবই সুবিধাজনক ছিলো।

যুক্তরাষ্ট্রের জেহাদ পর্ব

১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে শুরু হয় পুরোদস্তুর ‘ইসলামী’ যুদ্ধ। পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনের মাধ্যমে যেসব রাজনৈতিক দল মিলে এই যুদ্ধ পরিচালনার ফ্রন্ট গঠন করে সেগুলো হলো : জামাতে ইসলামী, হারকাতই ইনকিলাবি ইসলামী, ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট, ইসলামিক ও ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবী পরিষদ এবং হিজবে ইসলামী (দুই গ্রুপ)।১১

এসব তৎপরতার কেন্দ্রীয় দফতর ছিল পাকিস্তানে। কেননা পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ছিল এদের স্থানীয় অভিভাবক। মুজাহেদিন হিসেবে পরিচিত এই বাহিনীর যাবতীয় খরচ, প্রশিক্ষণ, আশ্রয়, বুদ্ধি সবই মার্কিন সিআইএ এবং পাকিস্তানের আইএসআই পরিচালনা করে। দশ বছরে এই যুদ্ধের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের করের অর্থ দিয়ে সিআইএ খরচ করে প্রায় ৩২ বিলিয়ন ডলার যা বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। পাকিস্তানে জিয়াউল হক-এর নেতৃত্বাধীন চরম ডানপন্থী, স্বৈরতন্ত্রী এবং ‘ইসলামী’ সামরিক শাসন আফগানিস্তানে মার্কিনি এই যুদ্ধ পরিচালনার জন্য খুবই সুবিধাজনক ছিল। ১৯৭৯ সালে ইরানে শাহানশাহ সরকারের পতন এবং খোমেনী সরকারের ক্ষমতা দখলের ফলে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম হাতিয়ার ইরান হাতছাড়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র তাই আফগানিস্তানে নিজেদের কর্তৃত্ব রক্ষায় উন্মত্ত হয়ে উঠে এবং এর জন্য পুরোপুরি ভর করে পাকিস্তান ও “ইসলাম”-এর উপর।

১৯৭৯ সালে ইরানে শাহানশাহ সরকারের পতন এবং খোমেনী সরকারের ক্ষমতা দখলের ফলে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম হাতিয়ার ইরান হাতছাড়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র তাই আফগানিস্তানে নিজেদের কর্তৃত্ব রক্ষায় উন্মত্ত হয়ে উঠে এবং এর জন্য পুরোপুরি ভর করে পাকিস্তান ও “ইসলাম”-এর উপর। 

এর পরের ইতিহাস দশ বছরে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু, ধ্বংস এবং আফগানিস্তানে চরম বিপর্যয়ের সূত্রপাত। মার্কিন রাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী কার্যকলাপের একনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক এবং লেখক উইলিয়াম ব্লুম ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর সঠিকভাবেই বলেছেন,

‘গত কয়েক বছরে আফগানিস্তানে তালিবানদের নিষ্ঠুরতা ও পশ্চাৎপদতা সম্পর্কে প্রচার মাধ্যমে আমরা অনেক কিছুই শুনেছি। বারবার প্রচার মাধ্যম আমাদের সেখানে নারীর উপর ব্যাপক নির্যাতন, সঙ্গীত নৃত্য নিষিদ্ধ করা, ইসলাম ভিন্ন অন্যান্য ধর্মচর্চা প্রায় নিষিদ্ধ করা, প্রকাশ্যে ফাঁসিস্থানসহ বহু বীভৎস ঘটনা সম্পর্কে জানিয়েছে। যে বিষয়টি আমাদের কখনোই বলা হয়নি বা মনে করিয়ে দেয়া হয়নি সেটা হলো, যদি যুক্তরাষ্ট্র না চাইতো তাহলে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় সেই তালিবান কিংবা অন্য কোন ইসলামী মৌলবাদী গ্রুপ বসতে পারতো না। ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত ছিল, যেটিও মুসলিম সরকারই ছিল কিন্তু তা ভূমি সংস্কার, রাষ্ট্র ও ধর্মকে পৃথকীকরণ, রাষ্ট্রায়ত্ত খাত সম্প্রসারণ, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, ট্রেড ইউনিয়ন বৈধকরণ, নারীর মুক্তি ইত্যাদি কর্মসূচির মাধ্যমে আফগানিস্তানকে বিংশ শতকে নিয়ে আসতে সচেষ্ট হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র অসীম প্রজ্ঞা দিয়ে সেই সরকারকে উচ্ছেদ করবার সিদ্ধান্ত নিল। কেন? কারণ সেই সরকার সে দেশের প্রতিবেশী সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বারা সমর্থিত ছিল। সেটাই ছিল একমাত্র কারণ।’

স্টেট ডিপার্টমেন্ট ছেড়ে আসা কর্মকর্তা এই উইলিয়াম ব্লুম-এর আরও উদ্ধৃতি এখানে প্রাসঙ্গিক। তিনি এরপর বলছেন,

‘সেই সরকারের বিরুদ্ধে সিআইএ সরাসরি সবরকম সাহায্য দিতে থাকলো মুজাহেদিনদের। ওসামা বিন লাদেন তাদেরই একজন। সেসময় প্রেসিডেন্ট কার্টারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন ঝিগনিউ ব্রেজলস্কি। তিনি পরে স্বীকার করেছেন যে, (আফগানিস্তানে) সোভিয়েত অনুপ্রবেশের ছয়মাস আগেই মুজাহেদিনদের সবরকম পৃষ্ঠপোষকতা দানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে-এটা করা হয়েছে এই আশায় যে এটি রাশিয়াকে অনুপ্রবেশ করতে প্ররোচিত করবে এবং আরেকটি ভিয়েতনামে এটাকে (সোভিয়েত ইউনিয়নকে) আটকে ফেলবে।’

সেভাবেই ঘটনা এগিয়ে চললো এবং

‘সোভিয়েত অনুপ্রবেশের পর সরকারের বিরুদ্ধে জেহাদে সিআইএ প্রধান সমন্বয়কারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো-বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে সংগ্রহ করে মুজাহেদিন বাহিনী তৈরি, তাদের সশস্ত্র করা, প্রশিক্ষণ দান, যুদ্ধের জন্য তহবিল সংগ্রহ সবই এর অন্তর্ভুক্ত।’

ফলাফল কি দাঁড়ালো?

‘খুবই সফল হলো সব কিছু। ফলাফল এক দশক পরে যুক্তরাষ্ট্র আর মৌলবাদীরা “জিতলো” আর হারলো নারী ও আফগানিস্তানের অবশিষ্ট সবাই। দশ লাখেরও বেশি মানুষ নিহত হলেন, ত্রিশ লক্ষ হলেন পঙ্গু। পঞ্চাশ লক্ষ উদ্বাস্তু, প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যাই।’১২

 হত্যা ও ধ্বংসের যুক্তি বিন্যাস : প্রচার মাধ্যম

একটানা প্রায় তিনমাসের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক বিমান বন্দর থেকে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচাইতে শক্তিশালী ধ্বংসাত্মক বোমা বর্ষণ করা হয়েছে আগে থেকেই বিপর্যস্ত মৃতপ্রায় আফগানিস্তান ও তার জনগোষ্ঠীর উপর। ৭ অক্টোবর (২০০১) থেকে শুরু হবার পর এক মাসের মধ্যে আফগানিস্তানে ফেলা হয়েছে ৫ লক্ষ টন বোমা। ইকনমিস্ট পত্রিকার (২ নভেম্বর, ২০০১) হিসাব অনুযায়ী অক্টোবর মাসের মধ্যেই আফগান প্রতিটি নারী, পুরুষ ও শিশুর জন্য মাথাপিছু বোমা পড়েছে ২০ কিলোগ্রাম। ‘খাদ্য’ নামের মশকরা বাক্স আর বোমার চেহারা ছিল একইরকম বলে খাদ্য ভেবে বোমা ধরতে দৌড়েছে মানুষ। বিধ্বস্ত, ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত জনগোষ্ঠী বিশেষত শিশুরা যখন খাদ্য ভেবে বোমা ধরতে দৌড়াচ্ছে তখন টিভি পর্দায় তা হয়ে উঠছে বিশেষ বিনোদন। 

৭ অক্টোবর (২০০১) থেকে শুরু হবার পর এক মাসের মধ্যে আফগানিস্তানে ফেলা হয়েছে ৫ লক্ষ টন বোমা। ইকনমিস্ট পত্রিকার (২ নভেম্বর, ২০০১) হিসাব অনুযায়ী অক্টোবর মাসের মধ্যেই আফগান প্রতিটি নারী, পুরুষ ও শিশুর জন্য মাথাপিছু বোমা পড়েছে ২০ কিলোগ্রাম।

২০০১ সালের ৭ অক্টোবর থেকে একটানা বোমা বর্ষণ শুরু হয় আফগানিস্তানের উপর কিন্তু বিশ্বব্যাপী প্রচারের ব্যাপক বোমা বর্ষণ শুরু হয় ১১ সেপ্টেম্বর থেকেই। বিশ্বের সকল অঞ্চলের মানুষের কাছে এটাই প্রতিষ্ঠা করবার জোর অভিযান চলতে থাকে যে, পৃথিবী, পৃথিবীর সভ্যতা, মানুষের সকল অগ্রগতি সবকিছু গভীর বিপদের মুখে কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর হামলা সংঘটিত হয়েছে। ‘যুক্তরাষ্ট্র মানেই সভ্যতা’, ‘ওসামা বিন লাদেন মানুষের এক নম্বর শত্রু’ এবং যে কোনভাবে তার ধ্বংস সাধন ছাড়া মানুষের কোন উদ্ধার নেই! এবং তার ধ্বংসের একমাত্র উপায় সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি, নতুন যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদন এবং একটানা যুদ্ধ!! 

১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ার বিধ্বস্ত হবার দশ মিনিটের মাথায় শুরু হয়ে সিএনএন-এ “অসবৎরপধ ঁহফবৎ ধঃঃধপশ” কথাটি টিভি পর্দায় স্থায়ী লোগো হয়ে দাঁড়ায়। সকল সংবাদ ও সংবাদ ভাষ্য আসে তারই অংশ হিসেবে। সিএনএন-এর এই ভূমিকা কোন বিশেষ ঘটনা নয়, কেননা একই ধরনের আচরণ আমরা সেসময় বিবিসি, ফক্স টিভিতেও দেখতে থাকি। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা যেগুলো বিশ্বব্যাপী সংবাদ প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে যেমন এএফপি, রয়টার, এপি সেগুলোর সংবাদ, মনোযোগ এবং বিবরণের ভাষা কিংবা বিশ্লেষণের ধরন সবগুলিতেই বিস্ময়কর সাদৃশ্য দেখা যায়। এটা বিস্ময়কর নয় আসলে। কেননা কখনোই এই ‘বিভিন্ন’ সংবাদ মাধ্যম ও সংবাদ সংস্থার বক্তব্য, অগ্রাধিকার, ফোকাস, ব্যাখ্যা, ভালবাসা-ঘৃণার পাত্র-পাত্রী বিভিন্ন হয় না। কিভাবে সকল সংবাদ ‘মুখপাত্র’ একইভাবে সংবাদ তৈরি-ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে থাকে; কিভাবে তা নির্ধারিত হয় সেটা অনুসন্ধান করলে কোন জগতে আমরা বসবাস করি তা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না।  সে আলোচনায় আপাতত না গিয়ে এখানে এটুকু বলা যায় যে, যখন পশ্চিমের সংবাদ সংস্থাগুলোতে একটি রব উঠে তখন অবাধে, বিনা প্রশ্নে তো বটেই, এমনকি আরও মহিমান্বিত রূপে বাংলাদেশের মতো দেশে তার অনুলিপি দেখা যায়-প্রতিধ্বনি শোনা যায়।

‘আমেরিকায় সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে,’ ‘করেছে’ তৃতীয় বিশ্বের নির্দিষ্ট অংশের মুসলিম নামধারী কিছু ব্যক্তি এবং ‘আমেরিকা সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ করছে’ এটাই প্রচারের মূল সুর। ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর থেকে টুইন টাওয়ারে বিমান হামলা তাই বিজ্ঞাপনের মত বার বার আসতে থাকে, এক পর্যায়ে দর্শকরা যেন অপেক্ষা করতে থাকে দৃশ্যটি দেখার জন্য। ঐ দৃশ্যের সঙ্গে আসে ওসামা বিন লাদেন, আসে ঐ আক্রমণে হতাহতদের নিয়ে করুণ বর্ণনা। পাশাপাশি চলতে থাকে আফগানিস্তান নিয়ে, বিভিন্ন তুলনীয় ঘটনার নতুন উপস্থাপনা কিংবা তথ্যচিত্র, সংবাদ ভাষ্য, মন্তব্য। টক শো, ডিবেট, সাক্ষাৎকারেরও মুখ্য বিষয় থাকে এটিই। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বার বার সভা হয়। এসব সংবাদ মাধ্যমের কিছু বাঁধা বিশেষজ্ঞ থাকে। তাদের ‘বিশেষজ্ঞ মতামত’-এ সুরের কোন বিঘ্ন সৃষ্টি হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট, পেন্টাগন থেকে শুরু করে টিভির সাংবাদিক, সংবাদ বিশ্লেষক কিংবা বিশেষজ্ঞ পর্যন্ত সর্বত্র তাল লয় একইভাবে বাজতে থাকে। ‘জনমত জরিপ’ হয়। এগুলোর উত্তরগুলোও মিলে যায় স্টেট ডিপার্টমেন্ট-এর চাহিদার সঙ্গে। প্রশ্ন নিয়ে প্রশ্ন, উত্তরদাতার সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন, উত্তরদাতা বাছাইয়ের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন সব ঢাকা পড়ে থাকে।

এসব সংবাদ মাধ্যমের কিছু বাঁধা বিশেষজ্ঞ থাকে। তাদের ‘বিশেষজ্ঞ মতামত’-এ সুরের কোন বিঘ্ন সৃষ্টি হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট, পেন্টাগন থেকে শুরু করে টিভির সাংবাদিক, সংবাদ বিশ্লেষক কিংবা বিশেষজ্ঞ পর্যন্ত সর্বত্র তাল লয় একইভাবে বাজতে থাকে। ‘জনমত জরিপ’ হয়। এগুলোর উত্তরগুলোও মিলে যায় স্টেট ডিপার্টমেন্ট-এর চাহিদার সঙ্গে। প্রশ্ন নিয়ে প্রশ্ন, উত্তরদাতার সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন, উত্তরদাতা বাছাইয়ের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন সব ঢাকা পড়ে থাকে।

আনন্দের সঙ্গে বিভিন্ন নিউজ টিভি চ্যানেল (বিবিসি, ফক্স, সিএনএন ইত্যাদি) থেকে আমাদের বার বারই বলা হয় যে, এগুলো সারা বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলের খবরের পরিবেশক, ‘দুর্দান্ত’ সংবাদ সংগ্রাহকেরা নানা বাধা-বিঘ্ন পার হয়ে খবর সংগ্রহ করছেন এবং এগুলো হচ্ছে ২৪ ঘণ্টার টিভি চ্যানেল। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি এগুলো হলো ১ ঘণ্টার টিভি চ্যানেল অর্থাৎ বড় জোর ১ ঘণ্টার খবরই ২৪ ঘণ্টায় বার বার প্রচার হতে থাকে। তাহলে কি খবরের অভাব? না। বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলের খবর নিয়ে এসব চ্যানেলের কোন আগ্রহ নেই। আগ্রহ কোন্ সব খবর নিয়ে হবে তা খবরের ‘নিজস্ব ভ্যালু’, ‘গুরুত্ব’, মানবিক বিপর্যয় ইত্যাদির উপরও নির্ভর করে না। এটি নির্ভর করে এসব সংস্থা যাদের ক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করে তাদের প্রয়োজনের উপর। এদের প্রয়োজন বা আগ্রহ থাকলে অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ খবর হয়ে উঠতে পারে প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ খবরও ধামা দিয়ে চাপা দেয়া হতে পারে।

বস্তুত সারা বিশ্বে মানবিক বিপর্যয়, কিংবা ধ্বংস এমনকি ‘নিউজ ভ্যালু’ যুক্ত পরিবেশ-মানুষ ধ্বংসের কারণ বের করার খবর, খবরের পেছনের খবর, গণহত্যা, দেশে দেশে সম্ভাবনা অপচয় কিংবা বিনাশের কত খবর প্রতিদিন ‘কিল’ করা হয় তা নিশ্চয়ই ভবিষ্যতের গবেষণার বিষয় হবে। এসব ‘সংবাদ কেন্দ্রে’ ধ্বংসকে উন্নয়ন, উন্নয়নকে ধ্বংস, মানুষের মুক্ত জীবনকে শৃঙ্খলিত, শৃঙ্খলিত জীবনকে মুক্ত, নরহত্যাকারী বা তার পৃষ্ঠপোষককে মানবপ্রেমিক, মানুষের জীবনকে প্রতিষ্ঠা করবার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের স্বৈরাচারী-সন্ত্রাসী-খুনী, সন্ত্রাসকে শান্তি, প্রতিবাদকে সন্ত্রাস ইত্যাদি হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্যই নিয়োজিত থাকে নানা বিষয়ের ‘দক্ষ’ লোকজন। এই লক্ষ্যে খবর, প্রয়োজনে, তৈরি হয়। প্রয়োজনে সাক্ষাৎকার, ‘বিশেষজ্ঞ’ মতামত, করুণ ছবি বারবার প্রচার হতে থাকে। শুধু ‘নিউজ চ্যানেল’ নয় একই বিষয় গানে, নাটকে, বিজ্ঞাপনে, চলচ্চিত্রেও চলে আসতে থাকে। আর এসবেরই ভক্তি গদগদ অনুবাদ হয় আমাদের মত দেশে। 

এসব ‘সংবাদ কেন্দ্রে’ ধ্বংসকে উন্নয়ন, উন্নয়নকে ধ্বংস, মানুষের মুক্ত জীবনকে শৃঙ্খলিত, শৃঙ্খলিত জীবনকে মুক্ত, নরহত্যাকারী বা তার পৃষ্ঠপোষককে মানবপ্রেমিক, মানুষের জীবনকে প্রতিষ্ঠা করবার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের স্বৈরাচারী-সন্ত্রাসী-খুনী, সন্ত্রাসকে শান্তি, প্রতিবাদকে সন্ত্রাস ইত্যাদি হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্যই নিয়োজিত থাকে নানা বিষয়ের ‘দক্ষ’ লোকজন।

আফগানিস্তান নিয়ে গত তিন মাসে যা ঘটলো তা এই চারিত্রের একটি ছোট প্রকাশ। ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর থেকে সকল সংবাদ সংস্থা এক সুরে যেভাবে বিষয়গুলো উপস্থাপন করতে থাকে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ-উন্মাদনা তৈরি, আফগানিস্তানে তিন মাস ধরে একটানা ধ্বংসযজ্ঞ খুবই স্বাভাবিক ন্যায়সঙ্গত যুক্তিযুক্ত কাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এরকম ঘটনা নতুন নয়। ভিয়েতনাম, কোরিয়া, কিউবা, ইরাক সবগুলো আগ্রাসনের আগে কয়েক সপ্তাহ এবং হামলা চলাকালে প্রচার মাধ্যমের প্রচার মনোযোগ দেখলে এটাই পাওয়া যাবে। আবার সেরকম আগ্রাসন, ধ্বংস, গণহত্যার উদাহরণ আছে অনেক যেগুলো প্রচার মাধ্যমে আসেইনি-বেশিরভাগ তথ্য, সংবাদ, বিপর্যয় ‘কিল’ করা হয়েছে কেননা সেগুলোর প্রচার তাদের জন্য অসুবিধাজনক! নিকারাগুয়া সহ বিভিন্ন দেশে একটি উজ্জ্বল অগ্রযাত্রা কিভাবে যুক্তরাষ্ট্র তার ভাড়াটে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে থামিয়ে দিয়েছে, নিয়ে গেছে পেছন দিকে, কিভাবে দেশে দেশে সামরিক অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারের ক্ষমতাবৃদ্ধি, খুনী পৃষ্ঠপোষকতায় যুক্তরাষ্ট্র মূল ভূমিকা পালন করেছে কিংবা কিভাবে দেশে দেশে হীরা, সোনা, তেল, গ্যাস সহ বিভিন্ন মল্যবান খনিজ সম্পদ, সামুদ্রিক সম্পদ, ভূসম্পদ ইত্যাদির উপর বহুজাতিক সংস্থার আধিপত্য কীভাবে সেসব দেশের জনগণের জীবনকে বিষময় করে তুলেছে সেই খবর সব পেছনেই ‘মরে যায়’। বরঞ্চ উল্টো রিপোর্ট  তৈরি হয় : ভাড়াটে বাহিনী হয় ‘মুক্তিযোদ্ধা’, স্বৈরাচার হয় গণতন্ত্রী এবং দখলদার-বিপর্যয় সৃষ্টিকারী বহুজাতিক সংস্থা হয় ‘উন্নয়নের বাহক’। 

নিকারাগুয়া সহ বিভিন্ন দেশে একটি উজ্জ্বল অগ্রযাত্রা কিভাবে যুক্তরাষ্ট্র তার ভাড়াটে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে থামিয়ে দিয়েছে, নিয়ে গেছে পেছন দিকে, কিভাবে দেশে দেশে সামরিক অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারের ক্ষমতাবৃদ্ধি, খুনী পৃষ্ঠপোষকতায় যুক্তরাষ্ট্র মূল ভূমিকা পালন করেছে কিংবা কিভাবে দেশে দেশে হীরা, সোনা, তেল, গ্যাস সহ বিভিন্ন মল্যবান খনিজ সম্পদ, সামুদ্রিক সম্পদ, ভূসম্পদ ইত্যাদির উপর বহুজাতিক সংস্থার আধিপত্য কীভাবে সেসব দেশের জনগণের জীবনকে বিষময় করে তুলেছে সেই খবর সব পেছনেই ‘মরে যায়’। বরঞ্চ উল্টো রিপোর্ট  তৈরি হয় : ভাড়াটে বাহিনী হয় ‘মুক্তিযোদ্ধা’, স্বৈরাচার হয় গণতন্ত্রী এবং দখলদার-বিপর্যয় সৃষ্টিকারী বহুজাতিক সংস্থা হয় ‘উন্নয়নের বাহক’। 

১১ সেপ্টেম্বর থেকে কেউ যদি চিন্তার শক্তি নিষ্ক্রিয় করে সিএনএন, বিবিসি দেখতে থাকেন কিংবা তাদের সংবাদ সংস্থার খবর পড়তে থাকেন ভক্তির সঙ্গে, তাহলে তাকে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার দিলে তিনি আফগানিস্তানে বোমা বর্ষণেরই সিদ্ধান্ত নিতেন। প্রথম দিন থেকেই এটা বলা হয় যে, মানুষের ইতিহাসে এরকম সন্ত্রাসী হামলা-ধ্বংস-হত্যা আর হয়নি। এটি যে সর্বৈব মিথ্যা তার জ্বলন্ত উদাহরণ যুক্তরাষ্ট্রের ‘সভ্যতা’ নিজেই!

টুইন টাওয়ার ধ্বংসের খবর প্রকাশের একটু পর থেকেই সংবাদ মাধ্যমগুলো কোনরকম ব্যতিক্রম ছাড়া এর জন্য দায়ী হিসেবে আঙুল নির্দেশ করতে থাকে ‘মুসলিম সন্ত্রাসীদের’ দিকে। প্রথম দিনই নাম উচ্চারিত হওয়া শুরু হয়: ওসামা বিন লাদেন। সেদিনই আফগানিস্তানে বোমা বর্ষিত হয়, ‘অজানা’ উৎস থেকে। প্রথম মুহূর্তে যে ধরনের যুক্তি, তথ্য দিয়ে সংবাদ মাধ্যমগুলো ওসামা বিন লাদেন ও আফগানিস্তানের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিল তিন মাসে পৃথিবীর সকল গোয়েন্দা সংস্থার সবচাইতে দক্ষ তৎপরতার পরও নতুন কিছু তাতে যোগ হয়নি। যোগ হবার প্রয়োজন হয়নি। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ শুরুর জন্য দরকার প্রচার, প্রমাণ নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বহু লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে যুক্তরাষ্ট্র, কত সম্পদ ধ্বংস করেছে তার ইয়ত্তা করা দুষ্কর। এর কোনটাই যুক্তরাষ্ট্র কোন ‘প্রমাণ দেখিয়ে’ করেনি কিন্তু তার দরকার হয়েছে একদিকে প্রচার অন্যদিকে মুখ বন্ধ করা-যাতে সব বর্বরতা সভ্যতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ শুরুর জন্য দরকার প্রচার, প্রমাণ নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বহু লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে যুক্তরাষ্ট্র, কত সম্পদ ধ্বংস করেছে তার ইয়ত্তা করা দুষ্কর। এর কোনটাই যুক্তরাষ্ট্র কোন ‘প্রমাণ দেখিয়ে’ করেনি কিন্তু তার দরকার হয়েছে একদিকে প্রচার অন্যদিকে মুখ বন্ধ করা-যাতে সব বর্বরতা সভ্যতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

বর্তমান বিশ্বে, বিশেষত পশ্চিমা কেন্দ্রে, এই ধরনের প্রচার কাজ সংগঠিতভাবে পরিচালনার জন্য বিভিন্ন পাবলিক রিলেশনস ফার্ম-এর ব্যাপক বিকাশ হয়েছে। বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগন-সিআইএ পর্যন্ত এ ধরনের ফার্মগুলোকে নিয়োগ করে থাকে প্রফেশনাল বিষয়টা ডিল করবার জন্য। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি বোস্টনে নিয়োজিত রেনডন গ্রুপ আফগানিস্তানকে টার্গেট করে প্রচারের দায়িত্ব লাভ করে। প্রাথমিক চুক্তি স্বাক্ষরের সময় এটি পায় প্রায় ৪ লাখ মার্কিন ডলার।১৩

যুক্তরাষ্ট্র যখন বিশ্বব্যাপী ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে’ ঐক্য গড়ার ডাক দেয় তখন সে ডাকে সাড়া দিয়েছে সকল সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের মুখে বর্ম হিসেবে তাদের এই জোট দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘ তো তাদের সেবার জন্য সবসময়ই প্রস্তুত। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য-যুদ্ধের অবসানের জন্য, ‘ন্যায়বিচার’-এর জন্য জাতিসংঘের উপর ভরসা তুলনা করা যায় বাংলাদেশে বড় বড় ক্ষমতাবান সন্ত্রাসীদের হামলা নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পুলিশের উপর ভরসা করবার সঙ্গে। পুলিশ যেমন ক্ষমতাবানদের পকেটে থেকেই আস্ফালন করতে পারে জাতিসংঘও তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের পকেটে বসেই যাবতীয় বড় বড় আওয়াজ করতে থাকে। বিশ্ব আদালত বলেও একটা জিনিস আছে, সেটা ততক্ষণই কার্যকর যতক্ষণ তা যুক্তরাষ্ট্র কিংবা এই ‘ক্ষমতাবানদের’ পক্ষে থাকে। এর বিরুদ্ধে গেলে বিশ্ব আদালতের প্রাপ্ত প্রমাণ, রায় সব অকার্যকর হয়ে যায়।

পুলিশ যেমন ক্ষমতাবানদের পকেটে থেকেই আস্ফালন করতে পারে জাতিসংঘও তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের পকেটে বসেই যাবতীয় বড় বড় আওয়াজ করতে থাকে। বিশ্ব আদালত বলেও একটা জিনিস আছে, সেটা ততক্ষণই কার্যকর যতক্ষণ তা যুক্তরাষ্ট্র কিংবা এই ‘ক্ষমতাবানদের’ পক্ষে থাকে। এর বিরুদ্ধে গেলে বিশ্ব আদালতের প্রাপ্ত প্রমাণ, রায় সব অকার্যকর হয়ে যায়।

নিকারাগুয়ার সন্ত্রাসী, বিশ্ব দরবারে

এর একটি অন্যতম উদাহরণ বিশ্ব আদালতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিকারাগুয়ার মামলা। যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত ইতিহাসের অন্যতম নিকৃষ্ট স্বৈরাচারী সমোজা সরকারকে উচ্ছেদ করে ব্যাপক ভিত্তিক জোট ‘স্যান্ডিনিস্টা’ সেখানে সরকার গঠন করে ১৯৭৮ সালে। ক্ষিপ্ত যুক্তরাষ্ট্রের সকল শাখা সক্রিয় হয়ে উঠে। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ জনগণের বিজয়ে ভীত হয়ে অর্থসংস্থান বন্ধ করে দেয়, বিশ্বের সকল বৃহৎ ব্যবসায়িক সংস্থা হুমকি দিতে থাকে। তথাকথিত উন্নয়ন  সংস্থাসমূহের তথাকথিত বিদেশী সাহায্য কয়েক দশকে যা করতে পারেনি, এসব তথাকথিত সাহায্য বন্ধ হবার পর, তা সম্ভব হয়-শিক্ষা, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতি সাধিত হয়। সকল পর্যায়ে জনগণের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে উৎপাদনশীল খাত বিকশিত হবার ক্ষেত্রও তৈরি হয়।১৪  বিপ্লবের পর স্বৈরাচারী শাসকের প্রাসাদ, বিলাসবহুল পাঁচ তারা হোটেল রূপান্তরিত হয় শিল্প সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রে। আর যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমে এই ব্যবস্থাই অভিহিত হয় ‘অগণতান্ত্রিক’ ব্যবস্থা হিসেবে। কাজেই তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শাখা-পেন্টাগন, সিআইএ তাদের অভিযানে নামে। ভাড়াটে বাহিনী গড়ে তোলা হলো ‘কন্ট্রা’ নামে, বিশ্বের সম্মুখে যাদের উপস্থিত করা হলো মুক্তিবাহিনী হিসেবে। তাদের নিয়োজিত করা হলো স্যান্ডিনিস্টাদের সাফল্যের জায়গাগুলোতে-হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কৃষি ফার্ম, সেতু, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিল্প প্রতিষ্ঠান হামলার জন্য, সেগুলো ধ্বংসের জন্য; একটানা যুদ্ধের চাপ রেখে অর্থনীতি ও নয়া ব্যবস্থা পঙ্গু করে দেবার জন্য।১৫

স্যান্ডিনিস্টাদের হাতে সন্ত্রাস ও অন্তর্ঘাতের প্রমাণের কোন অভাব ছিল না। সবপ্রমাণ নিয়ে নিকারাগুয়া হাজির হলো বিশ্ব আদালতের কাছে। প্রমাণ এতই অকাট্য ছিল যে, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রায় না দিয়ে বিশ্ব আদালতের কোন উপায় ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র পরিষ্কার বলে দিল, এ রায়কে তারা থোড়াই কেয়ার করে। আদালত মুখে আঙুল দিয়ে বসে থাকলো। নিকারাগুয়া এরপর গেল জাতিসংঘে। নিরাপত্তা পরিষদে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রস্তাবে ভেটো দিল যুক্তরাষ্ট্র। এটা হলো সেই সময় যখন যুক্তরাষ্ট্রে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রেগ্যান বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সন্ত্রাসের এক নতুন যাত্রার সূচনা করেছেন। নিকারাগুয়া গেল সাধারণ পরিষদে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও এল সালভেদরের বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রস্তাব পাস হলো। কিন্তু তা শুধুই ইতিহাসের খোরাক দিল। এটাকে বাস্তবায়নের জন্য জাতিসংঘের কোন সময় হলো না। সুতরাং নিকারাগুয়ায় নিজেদের তল্পিবাহক লুম্পেনদের ক্ষমতা দখল সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস চললো অবাধে। ফলাফল: এর মধ্যে দিয়ে নিকারাগুয়ায় জনউন্নয়নমুখি সকল তৎপরতা বিপর্যস্ত হলো। নিকারাগুয়ায় সর্বব্যাপী এই সন্ত্রাসের সময় বিখ্যাত পত্রিকাগুলো টাইম-নিউজউইক-ইকনমিস্ট এবং টিভি চ্যানেল বরাবর সাবাস দিয়ে গেয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে। 

সে সময় এই সন্ত্রাসী হামলা পরিচালনার অন্যতম নায়ক ছিলেন জন নিগ্রোপন্টে, তখন ছিলেন হন্ডুরাসে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত। নিকারাগুয়ার ভৌগলিক অবস্থানটি খেয়াল করলে দেখা যাবে নিকারাগুয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য যুৎসই দুটি দেশ ছিল হন্ডুরাস ও কোস্টারিকা। প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে নিকারাগুয়ার সঙ্গে সীমান্ত ছিল এ দুটি দেশেরই। এবং এ দুটি দেশই যুক্তরাষ্ট্রের করতলগত ছিল। এ দেশগুলিতে গুণ্ডা বাহিনীর প্রশিক্ষণের জন্য তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নানা বাহিনী কাজ করে। এই দুটি দেশের জনগণের উপর যে নির্যাতন-নিপীড়ন এবং ব্যাপক হত্যাকাণ্ড তখন চলছিল তারও প্রধান সহযোগী ছিল যুক্তরাষ্ট্র। হন্ডুরাসে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জন নিগ্রোপন্টে এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিশেষ কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সম্ভবত তারই পুরস্কার হিসেবে এই দুর্বৃত্তকে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই বিশ্বব্যাপী ‘সন্ত্রাস বিরোধী’ যুদ্ধ পরিচালনার জন্য জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়েছে!১৬

‘ইসলামী সন্ত্রাস’: সন্ত্রাসীর জোর গলা

আগেই বলেছি, যুক্তরাষ্ট্র যখন আফগানিস্তানে একটানা বোমাবর্ষণ শুরু করে তখন প্রচার মাধ্যমেও একটানা বোমাবর্ষণ চলছিল মানুষের মাথায়। আফগানিস্তান, ওসামা বিন লাদেন, আল কায়েদা ছাড়া প্রচার মাধ্যমে তখন আর কোন খবর ছিল না। বড় বড় বোমাবর্ষণকে যুক্তিযুক্ত করার জন্য সংবাদ সংস্থাগুলির দরকার ছিল ওসামাকে একটি দানব হিসেবে উপস্থিত করার, দরকার ছিল রূপকথার রাক্ষস কিংবা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর সবকিছু ধ্বংস করে ফেলার মত কোন উন্মাদ চরিত্র হিসেবে তাকে উপস্থিত করার। সুতরাং তার হাতে এটম বোমা আছে, জীবাণু বোমা আছে, যে কোন সময় তারা যুক্তরাষ্ট্রে আবারও হামলা করতে পারে, বিশাল অস্ত্রের মজুত নিয়ে আল কায়েদা বাহিনী যে কোন ধরনের হামলার জন্য প্রস্তুত ইত্যাকার কাহিনী তৈরি ও প্রচারের জন্য বিভিন্ন ‘বিশেষজ্ঞ,’ ‘সাংবাদিক’ ও ‘তথ্যচিত্র’ নির্মাতা হাজির হতে থাকে। 

এবং এর মাধ্যমে চেষ্টা হয় উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে এই সন্ত্রাসী তৎপরতাকে গ্রহণ করে নেবার মনোজগত তৈরি। অব্যাহত এই প্রচারের বোমাবর্ষণের সঙ্গে যুক্ত হয় বিভিন্ন দুর্ঘটনা কিংবা ‘অ্যানথ্রাক্স’ পর্ব। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের মানুষদের মধ্যে আতংক ও যুদ্ধোন্মাদনা তৈরির চেষ্টার ফলাফল নির্দিষ্ট করা মুশকিল তবে এরকম একটি অব্যাহত মানসিক চাপ, ভীতি, আতংক ও অনিশ্চয়তার প্রচারণায় মানসিক রোগীর সংখ্যা যে অনেক বেড়েছে সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। 

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার মতোই অ্যানথ্রাক্সের হামলারও কোন কুলকিনারা বিশ্বের সবচাইতে বড়, ব্যয়বহুল, দাপুটে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো করতে পারেনি। কিন্তু প্রচার মাধ্যমে তাদের অনুমান, আন্দাজ, গোপন প্রমাণের কথা বার বারই শোনা গেছে। ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পেছনে ওসামা আছে এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকার কথা আমরা প্রথম থেকেই মার্কিন কর্মকর্তা এবং তাদের পোষ্যদের মুখে শুনেছি। কিন্তু সেই সুনির্দিষ্ট প্রমাণ কখনোই প্রকাশিত হয়নি। “প্রমাণ আছে” বলে হামলা শুরু হয়ে গেছে এবং “অনুমান” কে “সত্য” ধরে বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ-অগ্রসর হয়েছে। অবশেষে বিমান হামলার একেবারে শেষ পর্যায়ে একটি ভিডিও ক্যাসেট প্রকাশ করা হয়। ক্যাসেট প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে বুশ-ব্লেয়ার এবং তার সাথে সকল সংবাদ সংস্থা লম্ফঝম্ফ করে উল্লাস প্রকাশ করে : “এই যে আমাদের সকল কার্যক্রম যে সঠিক তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।” প্রথমে এ্যাকশন পরে তার পক্ষে প্রমাণ!

এই ক্যাসেট দেখে অবাক হতে হয় এই ভেবে যে হলিউড মার্কা যাবতীয় ব্যবস্থা হাতে থাকা সত্ত্বেও, কিংবা প্রযুক্তি ও অর্থের যাবতীয় সুবন্দোবস্ত থাকা সত্ত্বেও পেন্টাগন এত কাঁচা একটি কাজ কি করে করলো? এখন পৃথিবীর যে কোন ব্যক্তির চেহারা পুনর্নিমাণ করে ভিডিও তৈরি কোন সমস্যা নয়। কিন্তু পেন্টাগন প্রচারিত এই ভিডিও-তে গণ্ডগোল আছে অনেকরকম। প্রথমত, কেন ওসামা এরকম একটি ভিডিও তৈরি করলেন সেটা পরিষ্কার নয়। দ্বিতীয়ত, বলা হয়েছে এটি ১৫ নভেম্বরে ধারণ করা কিন্তু কেন ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা নিয়ে প্রাথমিক উল্লাস ওসামা এতদিন পরে প্রকাশ করতে গেলেন সেটা বোঝা গেলো না। কিন্তু এই উল্লাসটি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, সেটিকেই ওসামার সন্ত্রাস যুক্ততার প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয়েছে। তৃতীয়ত, ১৫ নভেম্বরে ওসামা যখন আলোচনা করছেন অতিথির সঙ্গে তখন বলছেন মাহে রমজানের পূর্ণিমার কথা-অথচ সেবছর রমজান মাসে পূর্ণিমা ছিল ৩০ নভেম্বর! এইসব হিসাব পেন্টাগন সম্ভবত করে উঠতে পারেনি। চতুর্থত, অতিথির চেহারা ও কণ্ঠ ভিডিওতে পরিষ্কার থাকলেও ওসামাকে কখনই সামনে থেকে দেখা যায়নি, তার কণ্ঠও পরিষ্কারভাবে শোনা যায়নি।১৭

এ্যানথ্রাক্স দিয়ে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ অর্থাৎ পশ্চিমা বিশ্বে যে আতংক ছড়ানো হয়েছিল তাও অধিক থেকে অধিকতর হারে বোমাবর্ষণ, হত্যা, সন্ত্রাসকে যুক্তিযুক্ত করছিল। তখন একটাই রব তোলা হয়েছিল : ‘শিগগির ধ্বংস কর,’ ‘দানবকে ধ্বংস কর,’ ‘সভ্যতা বাঁচাও,’ ‘শিগগির’ ‘শিগগির’!!

কে এ্যানথ্রাক্স এর পেছনে? এফবিআই বলেছে, সুনির্দিষ্ট কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ডিক চেনি মাঝখান থেকে বলেছেন-এর সাথে আল কায়েদা, ইরাকের যুক্ত থাকার প্রমাণ আছে। কি করুণ অবস্থা! তাড়াহুড়ার মধ্যে সামান্য সমন্বয়টুকুও হয়নি। গোয়েন্দা সংস্থা জানে না-ভাইস প্রেসিডেন্ট জানেন!! তবে তাতে আক্রমণ হামলার কোন অসুবিধা নেই।১৮

যাইহোক, ভয় দেখিয়ে, আতংক ছড়িয়ে আফগানিস্তান দখল পর্ব মোটামুটি শেষ হয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে ওসামা, আল কায়েদার এমন কোনো শক্তি নেই যে, এসব হামলা মোকাবিলায় নূন্যতম কিছু করতে পারে। এদের এতদিন ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে নিছক যুদ্ধকেই বৈধতা দেবার জন্য। বস্তুত ওসামা বা আফগান মুজাহেদিনদের সোভিয়েত বিরোধী যে যুদ্ধের সাফল্যের কথা বলা হয় তাতো আসলে সিআইএ পেন্টাগনের যুদ্ধ। সেখানে মুজাহেদিনরা নিছক খেটেছে মার্কিনি প্লটের নির্বোধ মজুর হিসেবে। মার্কিনি প্লটে আফগানিস্তান ধ্বংস করে মুজাহেদিনরা ক্ষমতায় এসেছে আবার মুজাহেদিনদের হটিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ করে তালেবানরা এসেছে, আবার আফগানিস্তানকে ধুলোয় মিশিয়ে তালেবানদের হটিয়ে আনা হলো মুজাহেদিনদের। পুরোটার কেন্দ্রে মার্কিনি ক্রীড়া। এতে ‘ইসলাম ধর্ম’কে যথেচ্ছাচার কাজে লাগানো হয়েছে-‘আল্লাহর শক্তি’ নাম দিয়ে মার্কিনি যুদ্ধ শক্তির কাজ হয়েছে। আর এর মধ্যে মার্কিনি জনগণের অর্থ ঢেলে সিআইএ বিশ্বজুড়ে তৈরি করেছে ইসলামের নিশান ধরা একটা ভাড়াখাটা নেটওয়ার্ক। 

মার্কিনি প্লটে আফগানিস্তান ধ্বংস করে মুজাহেদিনরা ক্ষমতায় এসেছে আবার মুজাহেদিনদের হটিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ করে তালেবানরা এসেছে, আবার আফগানিস্তানকে ধুলোয় মিশিয়ে তালেবানদের হটিয়ে আনা হলো মুজাহেদিনদের। পুরোটার কেন্দ্রে মার্কিনি ক্রীড়া। এতে ‘ইসলাম ধর্ম’কে যথেচ্ছাচার কাজে লাগানো হয়েছে-‘আল্লাহর শক্তি’ নাম দিয়ে মার্কিনি যুদ্ধ শক্তির কাজ হয়েছে। আর এর মধ্যে মার্কিনি জনগণের অর্থ ঢেলে সিআইএ বিশ্বজুড়ে তৈরি করেছে ইসলামের নিশান ধরা একটা ভাড়াখাটা নেটওয়ার্ক। 

কাজেই তালেবানদের কোথায় কি আছে, ওসামা কি, কোথায় কখন, কোন ‘সন্ত্রাসী’ বাহিনী কোথায় আছে কি করছে এ বিষয়ে সিআইএর চাইতে আর ভাল কারও জানবার কথা নয়। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পরিস্থিতির কিছু পরিবর্তন হয়েছে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায়’ এই ‘ইসলামী সন্ত্রাসী’ বাহিনীর প্রতিপালনের আগ্রহ তারা হারিয়ে ফেলে। দ্বিতীয়ত, সোভিয়েত পতনের পর পরই ইরাকে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা, সুদান আফগানিস্তানে বোমাবর্ষণ, সৌদি আরব সহ বিভিন্ন স্থানে মার্কিন বাহিনী মোতায়েন, প্যালেস্টাইনে ইসরাইলের সন্ত্রাসী তৎপরতায় অব্যাহত মদদ দান ইত্যাদির ফলে আরব বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বিক্ষুব্ধ তরুণ জঙ্গী গ্রুপ গড়ে উঠে। তৃতীয়ত, এদের অনেকে পুরনো গ্রুপগুলো থেকেই রসদ জোগাড় করে বেড়ে উঠে। তবে এখন অনেকগুলো যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলেই মনে হয়। বস্তুত এরা একক কারও নিয়ন্ত্রণে আছে বলেই মনে হয় না। 

প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায়’ এই ‘ইসলামী সন্ত্রাসী’ বাহিনীর প্রতিপালনের আগ্রহ তারা হারিয়ে ফেলে। দ্বিতীয়ত, সোভিয়েত পতনের পর পরই ইরাকে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা, সুদান আফগানিস্তানে বোমাবর্ষণ, সৌদি আরব সহ বিভিন্ন স্থানে মার্কিন বাহিনী মোতায়েন, প্যালেস্টাইনে ইসরাইলের সন্ত্রাসী তৎপরতায় অব্যাহত মদদ দান ইত্যাদির ফলে আরব বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বিক্ষুব্ধ তরুণ জঙ্গী গ্রুপ গড়ে উঠে। তৃতীয়ত, এদের অনেকে পুরনো গ্রুপগুলো থেকেই রসদ জোগাড় করে বেড়ে উঠে। তবে এখন অনেকগুলো যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলেই মনে হয়।

ওসামা নিজে সৌদি ধনকুবের পরিবারের সদস্য হওয়ায় ব্যক্তি হিসেবে তাঁর আলাদা একটা গুরুত্ব মার্কিন সহযোগী হিসেবেও ছিল। এমনিতে সৌদি আরবের লাদেন পরিবারের সঙ্গে মার্কিনি বিভিন্ন কোম্পানির বিবিধ ব্যবসা-বাণিজ্য আগে থেকেই ছিলো। সর্বশেষ হিসাবে এর পরিমাণ প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ওসামার নিয়ন্ত্রণেও এই গ্রুপগুলো কাজ করছে এরও কোন যুক্তিযুক্ত প্রমাণ পাওয়া যায় না। সেকারণে ওসামার ‘জেহাদ’ আবেদন কিংবা বিভিন্ন গ্রুপের কাজ এর মধ্যে কোন সমন্বয় দেখা যায় না। যেসব জঙ্গী গ্রুপ বর্তমানে সক্রিয় তাদের মধ্যে অনেকে যে মার্কিনি ছক এর অন্তর্ভুক্ত সেটাও সহজেই বোধগম্য। 

এখানে বিশেষভাবে বলা দরকার যে, কখনোই ছিল না, এখনও ইসলাম এক নয়। বিশ্বে ইসলাম বহুরূপে কার্যকর রয়েছে। শিয়া, সুন্নি বিভাজন ছাড়াও সুন্নির মধ্যেও নানা ধারা শক্তিশালী। এই বিভাজনগুলো বাস্তবে অবৈরী নয়। বহু দ্বন্দ্ব সংঘাত এখনও জীবন্ত। এই বিভাজন সক্রিয় হয়ে উঠে অন্যান্য বিশেষত বহিঃস্থ উপাদানের সংস্পর্শে। সেজন্য ইরান বিপ্লব সুন্নি প্রভাবিত পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে সেভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।১৯ এসব অঞ্চলের মধ্যে পাকিস্তানে মুসলিম ধর্মীয় সংগঠনগুলো শিয়া এবং আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে লড়াই-এই অনেক বেশি জঙ্গী এবং মনোযোগী। তাছাড়া দীর্ঘদিন পাকিস্তান-বাংলাদেশের ধর্মীয় গ্রুপগুলো মার্কিনি এজেন্ডা বাস্তবায়নেই কাজ করেছে। ১৯৭১ তার একটি ভয়াবহ অধ্যায়।

(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

আনু মুহাম্মদ: শিক্ষক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: anu@juniv.edu

তথ্যসূত্র:

১। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ‘কাবুলিওয়ালা’, গল্পগুচ্ছ। পাওনা টাকা পরিশোধ না করে মিথ্যা কথা বলায় ক্রুদ্ধ হয়ে যে রহমত ‘কাবুলিওয়ালা’ দেনাদার ব্যক্তির গায়ে ছুরি মেরে জেল খেটে এসেছে তাঁর আরেক পরিচয়, “… সে আপনার মস্ত ঢিলা জামাটার ভিতর হাত চালাইয়া দিয়া বুকের কাছে কোথা হইতে এক টুকরা ময়লা কাগজ বাহির করিল। বহু যত্নে ভাঁজ খুলিয়া দুই হস্তে আমার টেবিলের উপর মেলিয়া ধরিল। দেখিলাম, কাগজের উপর একটি ছোট হাতের ছাপ। ফটোগ্রাফ নহে, তেলের ছবি নহে, হাতে খানিকটা ভূষা মাখাইয়া কাগজের উপরে তাহার চিহ্ন ধরিয়া লইয়াছে। কন্যার এই স্মরণচিহ্নটুকু বুকের কাছে লইয়া রহমত প্রতি বৎসর কলিকাতার রাস্তায় মেওয়া বেচিতে আসে-যেন সেই সুকোমল ক্ষুদ্র শিশুহস্তটুকুর স্পর্শখানি তাহার বিরাট বিরহী বক্ষের মধ্যে সুধাসঞ্চার করিয়া   রাখে।”

২। সৈয়দ মুজতবা আলী : দেশে বিদেশে, প্রথম প্রকাশ ১৩৫৬ (বাংলা), কলিকাতা। লেখকের শবনম উপন্যাসটিও ঐ সময়কে বুঝতে সাহায্য করে।

৩। S.J. Noumef : “The boomerang always returns”, Internet,  Doctor Zayar : Afghanistan-An Historical Overview, October 2001, Chronology of Afghan History (Internet), , “Terror Crisis in Context”, Monthly Review, November 2001.

৪। মোহসেন মাখমালবাফ : না শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ (অনুবাদ : মোস্তফা কাওসার), প্রথম আলো ২৩.১১.২০০১। মূল লেখা Limbs of No Body : The Afghan Tragedy (June 20, 2001), Monthly Review পূর্বোক্ত।

৫। এই চুক্তির বিরোধিতা করবার মধ্য দিয়ে ১৯৫৭ সাালে তৎকালীন পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত হয় এবং মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন চুক্তি বিরোধী অংশ গঠন করে নতুন রাজনৈতিক দল, ন্যাপ। পরে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন চুক্তিপক্ষীয় অংশও পাকিস্তানের সরকারে ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। কালক্রমে সামরিক বাহিনী পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে।

৬। ইরানের ওপর সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ, শাহ আমলের নিষ্পেষণ ও প্রতিরেধের বিস্তৃত আলোচনার জন্য দেখুন, Soroosh Irfani : Revolutionary Islam in Iran, Popular liberation or Religious Dictatorship? Zed, 1983.

৭। Sayed Qasim Reshtya : The price of liberty : the tragedy of Afghanistan, 1984 Part I.

৮। সৈয়দ মুজতবা আলী, দেশে বিদেশে, পৃষ্ঠা ৯০-৯১

৯। মার্কিনী  গণহত্যা,ক্যু, অন্তর্ঘাতে সিআইএর ভূমিকার বিশ্বস্ত বিবরণের জন্য দেখুন, William Blum : Killing Hope : US Military CIA Intervention Since World War II. Common Courage Press 1995 Ges The CIA : A Forgotten History, Zed, 1986.

১০। Lal Khan : Bracing for a New Afghan war, www.PTUDC.org

১১। আফগানিস্তানে তৎকালীন সময়ের ঘটনাবলির প্রামাণ্য বর্ণনার জন্য দেখুন,  সলিমুল্লাহ খান : ‘আফগানিস্তান বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লব’, প্রাক্সিস জার্নাল, জানুয়ারি-জুন, ১৯৮০। এবং সেই সঙ্গে মার্কিন সমর্থিত মুজাহেদিনদের ভাষ্যের বাংলাদেশী উপস্থাপনার জন্য দেখুন : আল মাহমুদ ও আফজাল চৌধুরী সম্পাদিত : আফগানিস্তান আমার ভালবাসা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১৯৮৩।

১২। William Blum : “Understanding the Attack on America : An Alternative View” UNC-Chapell Hill campus-এ দেয়া বক্তৃতা। ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০০১ (Internet).

১৩। “Pentagon bombs public with lies.” Workers World, New York, November 15, 2001

১৪। এই পর্যায়ে নিকারাগুয়া সহ যেসব প্রান্তস্থ দেশ যে বিভিন্নভাবে স্বাধীন উন্নয়ন চেষ্টা নিয়েছে তার বিশ্লেষণের জন্য দেখুন আনু মুহাম্মদ : পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণ ও অনুন্নত বিশ্ব, দ্বিতীয় অধ্যায়, সমাজ গবেষণা কেন্দ্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৯৪।

১৫।নিকারাগুয়ায় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখা দুটো প্রামাণিক গ্রন্থ  এই সময় ও পরিস্থিতি বুঝতে সাহায্য করবে। এগুলো হলো, মানব বন্দোপাধ্যায় : মুক্ত মানবের মন, ১৯৯০ এবং Salman Rushdie : Jaguar Smile, A Nicaraguan Journey,  Random House, 1991

১৬। Noam Chomski : “The New War Against Terror” transcribed from audio recorded at the Technology and Culture Forum at MIT, (Internet).

১৭। Yusuf Agha : The Camera that couldn’t shoot straight : Osama Gump! Counter Punch, 4.12.2001, Boston, (Internet).

১৮। Anthrax নিয়ে ভাল বাণিজ্যও হয়েছে। মুখোশ, ওষুধ, পোশাক দেদার বিক্রি হয়েছে। কানাডার একটি দেশী ওষুধ কোম্পানি প্রতিটি ১ ডলারে ১ কোটি ওষুধ তৈরির অর্ডার পেল সরকার থেকে। পরে কানাডার সংসদ এটি বাতিল করে মার্কিন কোম্পানিকে প্রতিটি ২ ডলার দামের ওষুধের অর্ডার দান করে।

১৯। বলাই বাহুল্য, ইরানের বিপ্লব বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। ইরান বিপ্লবকে সাধারণভাবে ‘খোমেনী’র বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু এই ধারণা খণ্ডিত এবং বিপ্লবের অনেক শক্তিকে তা আড়াল করে। ইরান বিপ্লব একই সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনের বিপ্লবীকরণের একটি দৃষ্টান্ত। এই বিপ্লবী ধারা তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক দুইভাবেই বিকশিত হয়েছিল। খোমেনী এই ধারার মূল প্রতিনিধি নন। খোমেনীর ক্ষমতা গ্রহণের পর বরঞ্চ ঐ বিপ্লবী ধারা, যারা মার্কসবাদীদের সঙ্গে সহযোগী কার্যক্রমের মাধ্যমে ইরান বিপ্লবের মূলভিত্তি নির্মাণ করেছিলেন, ভয়াবহ নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হন। মার্কসবাদী বিভিন্ন গ্রুপ ও  মুজাহেদীন খালকসহ ইসলামী বিপ্লবী ধারার অসংখ্য নারী পুরুষ নিহত-পঙ্গু ও বন্দি হন খোমেনী আমলে।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •