বৃটিশ শাসন ও পাকিস্তান রাষ্ট্রে পুরাতন ছক

২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-২

বৃটিশ শাসন ও পাকিস্তান রাষ্ট্রে পুরাতন ছক

মেহেদী হাসান

বাংলাদেশে পুঁজিবাদের বিকাশ উল্লেখযোগ্য আকার নিয়েছে। এই বিকাশ ধারায় একদিকে তৈরি হয়েছে পাকিস্তানের ২২ পরিবারের চাইতেও সম্পদশালী বেশ কিছু গোষ্ঠী, অন্যদিকে বৈষম্য ও পরিবেশ বিধ্বংসী তৎপরতাও অভূতপূর্ব মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ‘উন্নয়ন’ ধারার স্বরূপ বিশ্লেষণ, পুঁজি কেন্দ্রীভবনের ধরন, শ্রেণি বিন্যাস,এই ধারার পুঁজিবাদ বিকাশে রাষ্ট্রের ভূমিকা ইত্যাদি পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান প্রবন্ধ কয়েক কিস্তিতে এই অনুসন্ধান বিশ্লেষণ হাজির করবে। দ্বিতীয় কিস্তিতে কোম্পানি ও বৃটিশ শাসনকালে পুঁজির কেন্দ্রীভবন এবং পাকিস্তান পর্বে তার ধারাবাহিকতা আলোচনা করা হয়েছে।

ইউরোপীয় শিল্প বিকাশে বণিক পুঁজি একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে, ভারতবর্ষে পুঁজিবাদী সম্পর্ক তৈরীর ক্ষেত্রে ইউরোপীয় বণিক পুঁজি অন্যতম কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। ইউরোপীয় পুঁজির প্রভাবে তৎকালীন ভারতবর্ষে পণ্য উৎপাদনের বাজার বিস্তৃত হয়। সামন্তীয় শাসনামলে অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাজার প্রাধান্যে ছিল না। আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য যৎসামান্য উৎপাদিত হতো। বেশীরভাগ কৃষি উদ্বৃত্ত সামন্তীয় শাসকবর্গের ভোগ-বিলাস এবং সামরিক খাতে ব্যবহৃত হতো। এই প্রথম সামন্তীয় উৎপাদন সম্পর্ককে সঙ্কুচিত করার উদ্দেশ্যে পুঁজিবাদী বাজারের জন্য পণ্যদ্রব্য উৎপাদিত হওয়া শুরু করে। নতুন উৎপাদন পদ্ধতি এবং উৎপাদন সম্পর্ক পুরাতনের উপর আধিপত্য করে। মোঘল শাসনকে পরাজিত করে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসনভার দখল করে। ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা তৈরী করার উদ্দেশ্যে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন প্রবর্তন করা হয়। সামন্তীয় রাষ্ট্রের পরিবর্তে ভূমির মালিকানা ব্যক্তি মালিকের হাতে আসে যদিও তবে যে উদ্দেশ্যে এই আইন প্রবর্তিত হয় সেই উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। সামগ্রিকভাবে কৃষির উদ্বৃত্ত পুঁজিবাদী বাজারকে কেন্দ্র করে উৎপাদিত হতো না।   

পুঁজির বিকাশ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিধি বাড়ানোর তাগিদে ইউরোপের পুঁজি ভারতে প্রবেশ করে। বাণিজ্য, লুণ্ঠন এবং শোষণের মধ্য দিয়ে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। প্রথমাবস্থায় যখন ইউরোপিয়ান ব্যবসায়ীরা ভারতবর্ষে আসে তখন তাদের স্বার্থ ছিল কেবল বাণিজ্যের মাধ্যমে সম্পদ বৃদ্ধি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শুরুতে মোঘল শাসকদের সহযোগিতায় অন্যান্য প্রতিযোগী এবং বিরোধী বাণিজ্যিক শক্তিগুলোকে কোনঠাসা করার প্রয়াস পায়। ১৭০০ সালের দিকে মাদ্রাজ, বোম্বে এবং কলকাতায় তারা তাদের বসতি স্থাপন করে। তাদের দ্বারা স্থাপিত কারখানা এবং ব্যবসা কেন্দ্রের নিরাপত্তার জন্য সামরিক বাহিনী গঠন করে। বাহিনীর কলেবর বাড়ায়। ভারতবর্ষের কাঁচামাল ইউরোপে রপ্তানি এবং ইউরোপের বিশেষ করে বৃটেনের শিল্প-কারখানার পণ্যের বাজার বিকাশ ঘটানোর তাগিদে কোম্পানি ভারতবর্ষের শাসনক্ষমতা দখল করে বন্দরকেন্দ্রিক শহরের উন্নয়ন ঘটায়।

বাণিজ্য এবং শাসন সুরক্ষার জন্য সামরিক বাহিনীর কলেবর বৃদ্ধির প্রয়োজন হয়। রাজস্ব আদায়ের সিংহভাগ খরচ হতো সামরিক বাহিনীর ব্যবস্থাপনায়। রেলওয়ে থেকে শুরু করে শিল্প-কারখানা স্থাপন পর্যন্ত সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে বিকশিত করার প্রয়োজন হয় ইউরোপের পুঁজির স্বার্থে। ১৮৫৮ সালের দিকে বৃটিশ সরকারের অধীনে ভারতের শাসনভার হাতে নেওয়ার পর এই প্রক্রিয়া আরও জোরদার হয়। বৃটিশ রাষ্ট্রের সাথে ঔপনিবেশিক ভারতের প্রাথমিক সম্পর্ক ছিল মূলত: সামরিক।

ভারতবর্ষের শিল্পায়ন নিয়ে বৃটিশ পুঁজি কিংবা বৃটিশ রাষ্ট্রের কোন মাথাব্যথা ছিল না। বৃটিশ বাণিজ্যিক স্বার্থ নিহিত ছিল কাঁচামাল আহরণ এবং রপ্তানী বৃদ্ধিতে। এই প্রয়োজনে তাদের অবকাঠামো নির্মাণের তাগিদ দেখা দেয়। রেলওয়ে তাদের মধ্যে অন্যতম। রেলওয়েকে কেন্দ্র করে লোহা এবং ইস্পাত কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৮২ সালে ভাইসরয় লর্ড রিপন প্রস্তাব করেন যে, ভারতে লোহা এবং ইস্পাত স্থাপন করা জরুরী। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন যে, এতে করে রেলপথ নির্মাণের খরচ কমে আসবে, সরকারের ব্যয় কমবে, অকৃষি খাতের কর্মসংস্থান তৈরী করবে এবং পুঁজি বিনিয়োগের অনেক বড় জায়গা তৈরী হবে। ১৮৯৯ সালে ভাইসরয় হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হলে রিপন প্রশাসন মাইনিং রুল সংস্কার করে, বৃটিশ পুঁজিপতিদের বিনিয়োগে উৎসাহ দেয় এবং বেঙ্গল আয়রন এন্ড স্টিল কোম্পানিকে ভর্তুকি প্রদান করে।

বৃটিশ বাণিজ্যিক স্বার্থ নিহিত ছিল কাঁচামাল আহরণ এবং রপ্তানী বৃদ্ধিতে। এই প্রয়োজনে তাদের অবকাঠামো নির্মাণের তাগিদ দেখা দেয়। রেলওয়ে তাদের মধ্যে অন্যতম। রেলওয়েকে কেন্দ্র করে লোহা এবং ইস্পাত কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়।

উল্লেখ্য যে, রেলওয়ে ছিল বৃটিশ সরকারের কৌশলগত শিল্প। পণ্য বাণিজ্য, সরবরাহ এবং বাজার সম্পর্কিত তথ্য আদান-প্রদানের জন্য এটি ছিল দ্রুততম মাধ্যম। দিল্লি ও গঙ্গার আশেপাশের অঞ্চলের সাথে কলকাতা, বোম্বে এবং মাদ্রাজ বন্দরের বাণিজ্যিক-সামরিক যোগাযোগের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে রেলপথ নির্মাণ করা হয় ১৮৬৯ সালে এবং ১৮৮২ সালে এটিকে প্রাইভেট কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হয়।

তৎকালীন সময়ে ভারতে যে সকল বড় বড় শিল্প-কারখানা স্থাপন করা হয় সেসব ছিল বৃটিশ উদ্যোক্তাদের এবং পরবর্তীতে ভারতীয় পুঁজির মালিকরা সেখানে জায়গা করে নেয়। ঊনিশ শতকের শেষের দিকে স্কটিশ এবং ইংরেজ ব্যবসায়ীদের হাত ধরে প্রথম পাট এবং চা শিল্প স্থাপিত হয়। অন্যদিকে, অল্পসংখ্যক ভারতীয় পুঁজিপতি তুলা শিল্পে বিনিয়োগ করে।

অবিভক্ত ভারতবর্ষে প্রথম পুঁজির মালিকরা ছিল মূলত: ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে কেবলমাত্র নির্দিষ্ট গোষ্ঠীরই অধিকার ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য করার। অবশ্য বর্ণপ্রথার বাইরে যারা ছিল তাদের মধ্যেও কেউ কেউ উদ্যোগী হয় বাণিজ্যে ভাগ্য ফেরানোর আশায়। এক্ষেত্রে প্রথম কাতারে যাদের নাম আসে তাদের মধ্যে গুজরাতি বণিক গোষ্ঠী এবং মারওয়ারী সুদী কারবারী, দক্ষিণ ভারতের শেঠি (সুদী কারবারী), নাইডু (তুলা ব্যবসায়ী) সম্প্রদায় উল্লেখযোগ্য। পরের সারিতে পাওয়া যায় বোম্বের পার্সী সম্প্রদায়কে।

অবিভক্ত ভারতবর্ষে প্রথম পুঁজির মালিকরা ছিল মূলত: ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে কেবলমাত্র নির্দিষ্ট গোষ্ঠীরই অধিকার ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য করার। অবশ্য বর্ণপ্রথার বাইরে যারা ছিল তাদের মধ্যেও কেউ কেউ উদ্যোগী হয় বাণিজ্যে ভাগ্য ফেরানোর আশায়। এক্ষেত্রে প্রথম কাতারে যাদের নাম আসে তাদের মধ্যে গুজরাতি বণিক গোষ্ঠী এবং মারওয়ারী সুদী কারবারী, দক্ষিণ ভারতের শেঠি (সুদী কারবারী), নাইডু (তুলা ব্যবসায়ী) সম্প্রদায় উল্লেখযোগ্য। পরের সারিতে পাওয়া যায় বোম্বের পার্সী সম্প্রদায়কে।

১৯০০ সাল থেকে ভারতীয় শিল্পোদ্যোক্তারা বাংলাদেশের কয়লা খনিগুলোতে বিনিয়োগ করা শুরু করে। ১৯১৪ সালের দিকে প্রায় ডজন খনি থেকে বছরে এক কোটি পঞ্চাশ লক্ষ টনেরও বেশী কয়লা উত্তোলন করা হয়। রপ্তানীর বড় একটি ক্ষেত্র ছিল এটি। ভারতীয়রা লোহা এবং ইস্পাত শিল্প উৎপাদনেও তাদের পুঁজি বিনিয়োগ করে। অমর্ত্য সেনের উদ্ধৃতি দিয়ে ডেভিড লকউড উল্লেখ করেছেন যে, বৃটিশ শিল্প বিপ্লবের ভিত্তি তৈরী হয় মূলত: তুলা, টেক্সটাইল, লোহা এবং ইস্পাত শিল্পকে কেন্দ্র করে এবং এসব শিল্পের ক্ষেত্রে বৃটিশ সংস্থাগুলোর তুলনায় ভারতীয়দের অবদান বেশী। এ নিয়ে অবশ্য বিতর্ক রয়েছে।

এছাড়া মরিস-এর হিসাবের কথাও ডেভিড উল্লেখ করেছেন যে, বৃটিশ এবং ভারতীয় শিল্প মিলিয়ে ১৯১৪ সাল নাগাদ বিশ্বের মধ্যে পাঁচটি বৃহৎ তুলা টেক্সটাইল, দু’টি বৃহৎ পাট শিল্প এবং বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম রেলওয়ে নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতে। যদিও শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে ভারতীয়দের যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা ছিল। রেলওয়ে বাদে ক্ষুদ্র আকারের ভারী শিল্প, কেমিক্যাল, ভারী ইলেকট্রিক সরঞ্জাম কারখানা এবং কম ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন শিল্পে বিনিয়োগ ছিল ভারতীয়দের। শিল্প-কারখানা মূলত: বোম্বে, কলকাতা, বিহারের কয়লা খনি অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত ছিল বলে উল্লেখ করেছেন ডেভিড লকউড। তার মতে, বৃটিশ পুঁজির কারণে ভারতীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের ক্ষমতা ‘খর্বাকৃতি’ করে রাখা হয়।

বৃটিশ এবং ভারতীয় শিল্প মিলিয়ে ১৯১৪ সাল নাগাদ বিশ্বের মধ্যে পাঁচটি বৃহৎ তুলা টেক্সটাইল, দু’টি বৃহৎ পাট শিল্প এবং বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম রেলওয়ে নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত বৃটিশ পুঁজির ছায়াতলে ভারতীয় পুঁজির বিকাশ ঘটে। বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে খাদ্যপণ্য এবং যুদ্ধের সরঞ্জামাদি সরবরাহের প্রয়োজনে ভারতীয় অর্থনীতিতে উলম্ফন ঘটে। ভারতীয় পুঁজিপতিদের পণ্য উৎপাদনের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। আমদানি শুল্কহার হ্রাস, ভর্তুকি প্রদান এবং রাষ্ট্র কর্তৃক স্থাপিত শিল্প গড়ে তোলার কারণে ভারতীয় পুঁজির মালিক এবং ঔপনিবেশিক সরকারের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরী হয়। ইউরোপিয়ান পুঁজির পাশাপাশি ভারতীয় পুঁজিপতিদের একটা শক্ত অবস্থান তৈরী হয়। পারস্পরিক সহযোগিতা সম্পর্ক তৈরী হয় অল্পসংখ্যক ভারতীয় পুঁজিপতির সাথে ভারত সরকারের। পরবর্তীতে স্থাপিত ভারী এবং মাঝারি শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের বাজার সংরক্ষণের একটা তাগিদ তৈরী হয় ভারতীয় শিল্প মালিকদের মধ্যে। তারা সংগঠিত হয় এবং বৃটিশসহ ইউরোপিয়ান পুঁজির প্রতিযোগিতা থেকে বাঁচতে (ঔপনিবেশিক) সরকারের কাছে রাষ্ট্রীয়ভাবে ভারতীয় শিল্প সংরক্ষণের জোর দাবী জানায়। অবশ্য ইতোমধ্যে যুদ্ধের প্রয়োজনে রাষ্ট্র বেশ কিছু শিল্প-কারখানা গড়ে তোলে যে সবের সাথে ভারতীয়দের সম্পৃক্ততা ছিল। ততদিনে বিভিন্ন প্রদেশে শহরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনও তৈরী হয়।

বৃটিশ পৃষ্ঠপোষকতায় যে সব রাজনৈতিক সংগঠন তৈরী হয় তাদের মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের আওয়াজ জোরালো হতে থাকে। কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ কোন কোন শিল্প মালিককে সহযোগী হিসেবে পাশে পায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতীয় শিল্প সংরক্ষণের দাবীর সাথে স্বদেশী আন্দোলনের একটা যুক্ততা দেখা যায়। ভারতীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সাথে পুঁজির মালিকদের সখ্যতা তৈরী হয়। যদিও যেসকল পুঁজির মালিক রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায় বেড়ে উঠেছিল তাদের কারো কারো ক্ষেত্রে বৃটিশ শাসকদের সাথে থাকাটাই শ্রেয় মনে হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বও দেখা দেয় বৃটিশ শাসকদের পক্ষে থাকা না থাকা নিয়ে।  বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ভারতীয় যেসকল শিল্পকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয় (এসবের মধ্যে ছিল সরকার কর্তৃক উৎপাদিত দ্রব্য কিনে নেওয়া, শুল্কহার কমানো, ভর্তুকি প্রদান, আমদানি বিকল্প শিল্প গড়ে তুলতে ঋণ প্রদান ইত্যাদি), যুদ্ধের পরে তারা সে জায়গা থেকে সরে আসে। পরবর্তীতে কংগ্রেসের রাজনীতি এবং শিল্প মালিকদের চাপের কারণে ভারী শিল্পের সাথে জড়িত মালিকদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া চলতে থাকে।

বৃটিশ শাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারী এবং আমদানি বিকল্প শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠে এবং ইউরোপীয় পুঁজির সাথে পাল্লা দিয়ে তাদের বাজার বিকশিত হওয়ার এক পর্যায়ে নিজেদের অধীনে শাসনভার নেওয়ার তাগিদ তৈরী হতে থাকে। যদিও কংগ্রেস ছিল সমাজের মধ্য শ্রেণির বৃটিশ শিক্ষিত অংশ নিয়ে গঠিত তবু অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য পুঁজির মালিকদের প্রয়োজন থাকায় তারা পারস্পরিক সহযোগিতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।

ভারতীয় পুঁজিপতিদের বেশীরভাগ অংশের ধর্মীয় পরিচয় ছিল হিন্দু। বৃটিশ শাসকদের সাথে তাদের সম্পর্ক মুসলমান শিল্প মালিকদের চাইতে ঘনিষ্ঠ ছিল। বৃহৎ পুঁজিপতি টাটা, বিড়লা গোষ্ঠী বৃটিশ শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের শিল্পের বিকাশ ঘটায়, বিশেষ করে ভারী শিল্পের। সে তুলনায় মুসলমান পুঁজিপতিদের ভূমিকা ছিল সহযোগীর। কিন্তু পুঁজির নিয়ম অনুযায়ী মুসলমান শিল্পপতিদের মধ্যে নিজেদের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ বিকাশের আকাঙ্ক্ষা বাড়তে থাকে। অভিজাত মধ্যশ্রেণির অন্য আরেকটি অংশ মুসলিম লীগ তাদের সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রতিশ্রুতি দেয়। নিজেদের পারস্পরিক আকাঙ্ক্ষার কারণে বৃটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে বিভাজন দেখা দেয়। তারই ফলশ্রুতিতে হিন্দু মুসলিম ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’র ভিত্তিতে ভাগ হয় ভারতবর্ষ।

আদমজী পীরভয় (পীরভাই/পীরভায়) ঊনিশ শতকে জাহাজ নির্মাণ শিল্প থেকে প্রথম লাখপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। আদমজী গ্রুপের দাউদ আদমজী বার্মার রেঙ্গুনে ট্রেডিং ব্যবসা শুরু করেন ১৮৯৪ সালে, পরবর্তীতে ম্যাচ ফ্যাক্টরি এবং চাল কল তৈরী করেন সেই রেঙ্গুনেই। ১৯৩৭ সালে কলকাতায় তৈরী করেন জুট মিল। এভাবে দাউদ আদমজী চাল এবং পাট রপ্তানীর মাধ্যমে তিনি তার বৃহৎ শিল্প যাত্রায় প্রাথমিক ভূমিকা পালন করেন। টাটা-বিড়লাকে যেমন কংগ্রেসের অন্যতম কারিগর হিসেবে বিবেচনা করা যায় তেমনি দাউদ আদমজীও পাকিস্তান মুসলিম লীগের মূল কারিগর হিসেবে বিবেচিত।

আদমজী পীরভয় (পীরভাই/পীরভায়) ঊনিশ শতকে জাহাজ নির্মাণ শিল্প থেকে প্রথম লাখপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। আদমজী গ্রুপের দাউদ আদমজী বার্মার রেঙ্গুনে ট্রেডিং ব্যবসা শুরু করেন ১৮৯৪ সালে, পরবর্তীতে ম্যাচ ফ্যাক্টরি এবং চাল কল তৈরী করেন সেই রেঙ্গুনেই। ১৯৩৭ সালে কলকাতায় তৈরী করেন জুট মিল। এভাবে দাউদ আদমজী চাল এবং পাট রপ্তানীর মাধ্যমে তিনি তার বৃহৎ শিল্প যাত্রায় প্রাথমিক ভূমিকা পালন করেন। টাটা-বিড়লাকে যেমন কংগ্রেসের অন্যতম কারিগর হিসেবে বিবেচনা করা যায় তেমনি দাউদ আদমজীও পাকিস্তান মুসলিম লীগের মূল কারিগর হিসেবে বিবেচিত।

পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তাই দেখা যায় নানান রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পেয়ে অর্থনীতির নেতৃস্থানীয়তে পরিণত হয় এই পরিবারগুলো। জিএম আদমজী এজন্য বলেন, পাকিস্তান সৃষ্টি হলো ‘অনেকটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সোনার খনি’ পাওয়ার মতো ঘটনা।

১৯৪৬ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন উপলব্ধি করলেন যে, আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে গেলে বিশেষ করে আধুনিক অর্থনতির উপর দাঁড়াতে গেলে সে সমস্ত ব্যক্তি পুঁজির উপর নির্ভর করতে হবে যারা তার পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে জড়িত কিংবা সমর্থক কিংবা বিশ্বাসযোগ্য। এ ধরনের ব্যক্তিবর্গ তার চারপাশেই ছিল এবং যাদের উপর ভর করে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ তিনি গ্রহণ করেন। অন্যভাবে বলা যায়, পুঁজির বিকাশের জন্য জিন্নাহ প্রাথমিক অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিলেন; কোন কোন ক্ষেত্রে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন।

তাঁর পাশে ছিলেন হাবিব (হাবিব ব্যাংক), আদমজী এবং মুসলিম কর্মাশিয়াল ব্যাংক। বীমার জন্য ছিল ইস্টার্ন ফেডারেল ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি যার বড় অংশীদার ছিলেন ইস্পাহানি। ইস্পাহানি চা ব্যবসার বড় যোগানদার ছিলেন। পাট শিল্পের জন্য তিনি পেয়েছিলেন আদমজীকে। ইস্পাহানি এবং আদমজী ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ এবং পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স (পিআইএ) নিয়ে জিন্নাহর পাশে ছিলেন। বিশ্বাসযোগ্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে আরও ছিলেন বানটওয়া এবং ধোরাজী, হুসাইন কাশিম দাদা এবং আব্দুল রহমান আব্দুল ঘানি। ইউসুফ হারুন ছিলেন শিপিং কোম্পানির জন্য। রুস্তম কাউসজী মোহাম্মদী স্টিমশিপ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের প্রধানের অনুরোধে। এই পুঁজিপতিরাই তৎকালীন পাকিস্তানের উৎপাদন-কর্মসংস্থান-আইন-কানুন-পরিকল্পনার উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন, একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। লাইসেন্স থেকে শুরু করে শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যদেরকে এই নির্দিষ্ট কিছু পরিবারের উপর নির্ভর করতে হতো এবং তাদের পুঁজি বিনষ্ট হওয়ার নূন্যতম কোন সম্ভাবনা থাকলে সরকারের তরফ থেকে পুরোপরি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হতো। বিশেষ করে শ্রমিক এবং জনগণের পক্ষ থেকে তাদের ন্যায্য দাবী-দাওয়া সংক্রান্ত কোন বিষয়ে পুঁজিপতিদের পক্ষ নিয়ে বিভিন্ন সময়ের সরকার আইন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতো।

পাশে ছিলেন হাবিব (হাবিব ব্যাংক), আদমজী এবং মুসলিম কর্মাশিয়াল ব্যাংক। বীমার জন্য ছিল ইস্টার্ন ফেডারেল ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি যার বড় অংশীদার ছিলেন ইস্পাহানি। ইস্পাহানি চা ব্যবসার বড় যোগানদার ছিলেন। পাট শিল্পের জন্য তিনি পেয়েছিলেন আদমজীকে। ইস্পাহানি এবং আদমজী ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ এবং পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স (পিআইএ) নিয়ে জিন্নাহর পাশে ছিলেন। বিশ্বাসযোগ্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে আরও ছিলেন বানটওয়া এবং ধোরাজী, হুসাইন কাশিম দাদা এবং আব্দুল রহমান আব্দুল ঘানি। ইউসুফ হারুন ছিলেন শিপিং কোম্পানির জন্য।

এ প্রসঙ্গে মাওলানা ভাসানীর দু’টি বক্তব্য উল্লেখযোগ্য। প্রথমটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে, দ্বিতীয়টি লুণ্ঠন প্রক্রিয়া নিয়ে। প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে তিনি বলেছেন,

‘‘ইংরেজ আমলের মাথাভারী শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন করা দূরের কথা, মুসলিম লীগ তাকে পূর্বাপেক্ষাও মাথাভারী করতে প্রস্তুত হলেন। যে দেশের মাথাপিছু বার্ষিক আয় এখন পর্যন্ত সম্ভবতঃ একশত রুপির উর্দ্ধে নয়, সেই দেশে বার্ষিক দু’তিন লাখ রুপি পর্যন্ত আয়ের পদ রাখার নজির বর্তমান দুনিয়ায় নেই। গ্রেট বৃটেনের মত উন্নত দেশের প্রধানমন্ত্রীর বেতনের চাইতে বেশী এদেশের অনেকের মাসিক বেতন। পাকিস্তানের মত দরিদ্র দেশের বৈদেশিক দূতাবাস, ট্রেড কমিশন, ডেলিগেশন প্রভৃতির সংখ্যা কানাডা ও বৃটেনের মত উন্নত রাষ্ট্রের চাইতেও সম্ভবতঃ অনেক বেশী, অথচ অতি সহজেই একটি বৈদেশিক দূতাবাস থেকে অনেক ক্ষেত্রে একাধিক দেশে কাজ করতে পারে।

…মোট কথা, মুসলিম লীগ মুখে ধর্মের জিগির এবং কার্যত দেশের জনসাধারণকে ইংরেজ আমল অপেক্ষাও দারিদ্র্যে নিমজ্জিত করে দেশকে ভিক্ষুকের দেশে পরিণত করার যে অদম্য উৎসাহ ও প্রচেষ্টায় মত্ত হলো, তার নজির কোন ইতিহাসে নেই। তাদের এই প্রচেষ্টার ফলে দেশ আজ  দৈনন্দিন খরচের জন্য পরমুখাপেক্ষী। বিদেশের অর্থ সাহায্য ছাড়া আজ  পাকিস্তান অচল। এজন্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা পর্যন্ত বিসর্জন দেওয়ার মত অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে দেশ।’’

অন্যদিকে লুণ্ঠনের বিষয়ে তিনি জানিয়েছেন,

‘‘..মুসলিম লীগের কর্ণধারগণ পাকিস্তানকে তাদের ব্যক্তিগত জমিদারী মনে করে নিজেদের ব্যাংক ব্যালেন্স এবং সম্পত্তি ইত্যাদির জন্য রাষ্ট্রের ধন ও সম্পদ নির্লজ্জ লুণ্ঠনে মত্ত হলেন। লীগের উপরের স্তরের লোকগণ চরম দুর্নীতি, চোরাকারবারি এবং স্বজনপ্রীতিতে গা ভাসিয়ে দিলেন, এ অবস্থা যখন সরকারী কর্মচারীগণের কাছে ধরা পড়লো তখন তাদেরও অনেকে পাকিস্তান লুণ্ঠনের কার্যে অবতীর্ণ হলেন (গোলাম মুহম্মদের জামাতা হোসেন মালিক ফ্রান্স থেকে ওয়াগন কেনার নামে কেন্দ্রীয় সরকারের ৪৬ লাখ রুপি ৭/৮ বৎসর ধরে ব্যক্তিগত তহবিলভুক্ত করে রেখেছেন)। পাকিস্তান হবার পর মুসলিম লীগের নেতা, উপনেতা ও সরকারি কর্মচারীদের অনেকেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। তাদের সম্পত্তি কিভাবে অর্জিত হলো যদি তার তদন্ত কোন দিন হয় তবে পাকিস্তান লুণ্ঠনের যে চিত্র জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়ে পড়বে, তা অতীতের সমস্ত রাজনৈতিক অসততা, দুর্নীতি, ফেরেববাজি ও চুরিচামারিকে হার মানাবে।’’

পাকিস্তান পর্বে পুঁজির আদিম সঞ্চয়নের একটি দিক তুলে ধরেছিলেন মওলানা ভাসানী। এ পর্বকে ধরা যায় পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক পুঁজির পুঞ্জিভবনের প্রাথমিক পর্যায়।  

নতুন রাষ্ট্রে বৈষম্য কমেনি

১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ থেকে ভাগ হয়ে যে শোষণ-বৈষম্যহীন মুসলিম ঐক্যের কথা বলে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলো সেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব এবং পশ্চিমাংশের মধ্যে ছিল হাজার মাইলের দূরত্ব। ১৯৫০ সাল থেকে ভারত হলো রিপাবলিক অব ইন্ডিয়া আর ১৯৫৬ সাল থেকে পাকিস্তান হলো ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান।  ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশ হলো পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ যার অর্থ বলা হলো, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।

সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও রাজধানী লাহোরসহ পাঞ্জাবের অংশগুলো নিয়ে গঠিত পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের সাথে পূর্বাংশের বিভিন্ন ভাষা, জাতি, সংস্কৃতির মধ্যে ছিল বিস্তর পার্থক্য। পাকিস্তান আন্দোলনে এই পার্থক্যগুলো কখনোই বিবেচনার মধ্যে নেওয়া হয়নি। ভারত বিভক্তিতে ভাগ হলো বৃটিশ ভারতীয় আর্মি, রয়েল ইন্ডিয়ান নেভি আর বিমান বাহিনী। দেশভাগের পূর্বে ভারতীয় আর্মি ছিল ৪১০.০০০। পাকিস্তানের ভাগে পড়ার কথা ছিল শতকরা ৩৬ ভাগ অর্থাৎ প্রায় ১৪০,০০০। ১৯৪৭ সালে শেষ পর্যন্ত তার অনুপাত দাঁড়ালো ভারতীয় আর্মির শতকরা ৩০ ভাগ, নেভির শতকরা ৪০ ভাগ এবং বিমান বাহিনীর শতকরা ২০ ভাগ। আর ভাগ হলো ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস, রেলওয়ে আর কেন্দ্রীয় রাজকোষ।

সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে দেখা যায়, একই বাড়ির মাঝখান বরাবর সীমানা রেখা। আগে এক সীমানার মধ্যে থাকা এক পরিবার র‌্যাটক্লিফের ছুরিতে দুইভাগ হয়ে দুই সীমানার পরিসংখ্যানে ঠাঁই পেলো। অদল-বদল হলো রাষ্ট্রীয় পরিচয়। নানা ধরনের খুনসুটি সত্ত্বেও প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পাশাপাশি থাকা খেলার সাথী অপরিচিত হয়ে গেল। সাম্প্রদায়িক নৃশংসতার বলি হল লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ। হিন্দু মুসলিম পরিচয়ের বাইরে আরও নানান পরিচয় যাদের ছিল। বহু যুগ পরে নতুন প্রজন্ম হয়তো তাদের পূর্বপরিচয়ের সন্ধান করবে ফেলে আসা সময়ের মধ্যে। যে সময়কে ভাগ করা হয়েছিল মানুষ, মানুষের প্রকৃতি-শিকড় সংস্কৃতি প্রভৃতি বিবেচনায় না নিয়ে কেবলমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায়। সাধারণ মানুষকে যার খেসারত দিয়ে যেতে হচ্ছে বর্তমান পর্যন্ত। 

মুসলিম-অমুসলিম দ্বন্দ্বটিকে রাজনৈতিক ইস্যু করা হয় মূলত: রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অভিজাত মুসলিম শাসকদের হাতে কেন্দ্রীভূত করার উদ্দেশ্যে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সাংস্কৃতিক-সামাজিক-উৎপাদন সম্পর্ককে হিসাবের মধ্যে না নিয়ে পশ্চিম এবং পূবের অবিবেচনাপ্রসূত এই জোড়া লাগানোকে টাইম ম্যাগাজিন দেখেছিল ‘অসম বিয়ে’ হিসেবে।

দুই অংশের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরতে টাইম ম্যাগাজিন উল্লেখ করেছিল,

‘‘স্বাভাবিক সময়েও পাকিস্তানীরা উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে, দুই প্রান্তের দুই মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভেতর নানা ধরনের আকাশ-পাতাল পার্থক্যের মধ্যে দু’টি বিষয় তাদের একত্রিত করতে পেরেছিল। এক, ইসলামী বিশ্বাস; দুই, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স। এছাড়া তাদের মধ্যে আর কোন ঐক্য ছিল না। না সীমানার দিক থেকে, না সংস্কৃতির দিক থেকে। ভারতের সীমানা থেকে দুই অঞ্চলের দূরত্ব ১১০০ মাইল। পাকিস্তান হলো, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মধ্যে ‘অসম বিয়ে’র পরিণতি। পশ্চিম পাকিস্তানের উঁচু-লম্বা, হালকা গোরা বর্ণ, পাঠান, বেলুচ, সিন্ধিরা হলো আর্য ধারাবাহিকতার যারা খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহশ্রাব্দে এই উপমহাদেশে বসতি স্থাপন করে।

পশ্চিম পাকিস্তানীরা (শাসকগোষ্ঠী) যাদের দমাতে চায় সেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাঙালীরা কিছুটা অনুজ্জ্বল বর্ণের যাদের সাথে দ্রাবিড়িয়ান জনগোষ্ঠীর ঘনিষ্ট নৈকট্য রয়েছে। পশ্চিমাংশের মানুষজনের রুটি এবং মাংস প্রধান খাদ্য, উর্দুতে কথা বলে যেটি আরবী হরফে লিখা হয়েছে কিন্তু যে ভাষাটি মূলত: পারস্য এবং হিন্দির সংমিশ্রণে গঠিত। অপরদিকে, পূর্বাংশের মানুষজন ভাত এবং মাছের উপর নির্ভরশীল; বাংলায় কথা বলে যে ভাষাটি ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠী থেকে উদ্ভুত।…পশিমাঞ্চলের চাইতে পূর্বাংশে হিন্দু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বসবাস অনেক বেশী। পূর্বাংশে ৭ কোটি ৮০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ১ কোটি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন বসবাস করেন যেখানে পশ্চিমে ৫ কোটি ৮০ লাখ মানুষের মধ্যে ৮ লক্ষ হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস।’’

’৪৭ এর পূর্বে ও পরে মুসলিম লীগ নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে ধর্মীয় পরিচয়কে প্রধান হিসেবে উপস্থিত করে। এর মূল কারণ মুসলিম লীগের শ্রেণিগত পরিচয়। বড় ভূস্বামীকেন্দ্রিক দল হিসেবে এই দ্বন্দ্বের বাইরে তাদের দেখার কোন উপায় ছিল না। কিংবা বলা যায়, স্বীয় শ্রেণির স্বার্থ পরিপুষ্ট করার জন্য এই শ্রেণির প্রয়োজন ছিল ধর্মীয় পরিচয়ের একটি রাজনৈতিক দলকে ব্যবহার করা। সেটিই তারা করেছে। পরবর্তীতে বাঙালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে ধর্মীয় পরিচয়টি নীচের সারিতে ঠাঁই পায় ঠিকই কিন্তু অপরাপর শ্রেণিগত-অবাঙালী নৃগোষ্ঠীগত পরিচয়কে উপেক্ষা করে বাঙালী-অবাঙালী দ্বন্দ্বটিকে প্রধান হিসেবে দেখা হয়।  

পূর্ব অংশে কী ধরনের বৈষম্য বিরাজিত ছিল তার উদাহরণ দেওয়া যায় বৃহৎ ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের বিষম অনুপাত দিয়ে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী দেখা যায় ১৯৬৪-৬৫ সাল পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্বাংশের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হারে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের বিকাশ ঘটানো হয়েছে। যদিও প্রথম অবস্থায় পূর্বাংশের সাথে পশ্চিমাংশের শিল্পের যে অনুপাত ছিল তা মোটামুটি কাছাকাছি ছিল। কিন্তু বছর বাড়ার সাথে সাথে একদিকে পূর্বাংশের শ্লথগতি অন্যদিকে পশ্চিমাংশের ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় পার্থক্য বাড়তে থাকে। পূর্ব অংশে কৃষিতে মূল্য সংযোজনের আপাত হার বাড়তে থাকা সত্ত্বেও পশ্চাদপদতা না কাটিয়ে বরং কৃষি নির্ভর রাখার প্রক্রিয়া জারী থাকে অন্যদিকে পশ্চিম অংশ শিল্পকে ‘আধুনিকীকরণে’র প্রয়াস পায়। নীচে একটি ছকের সাহায্যে বৈষম্যের ধরনগুলো দেখানো হলো:

উৎপাদনী কাঠামো এবং মাথাপিছু উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে মৌলিক তথ্য (১৯৫৯-৬০ সালের উপাদান ব্যয়, মিলিয়ন রুপি হিসেবে)

খাত

পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পূর্বে

প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা

দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা

 

১৯৫০/৫১-১৯৫৪-৫৫

১৯৫৫/৫৬-১৯৫৯/৬০

১৯৬০/৬১-১৯৬৪/৬৫

 

পূর্ব

পশ্চিম

পূর্ব

পশ্চিম

পূর্ব

পশ্চিম

কৃষি

৮,৬৪৮

৬,৬০৮

৮,৬০৫

৭,৪২৮

১০,১০৪

৮,৪৮৯

অকৃষি

৪,৮৬০

৬,৪২৮

৫,৫২০

৮,১৭১

৭,৩৭৬

১০,৬৫৪

(বৃহৎ ম্যানুফ্যাকচারিং)

(১৩৫)

(৫৪০)

(৩২৪)

(১,০৬৩)

(৭০১)

(১৫৮৯)

মোট আঞ্চলিক/জাতীয় উৎপাদন

১৩,৫০৮

১৩,০৩৬

১৪,১০৭

১৫,৫৯৯

১৭,৪৮০

১৯,১৪৩

জনসংখ্যা (মিলিয়ন)

৪৫.৫

৩৮.০

৫১.৩

৪২.৯

৫৮.০

৪৮.৭

জিডিপি/মাথাপিছু (রুপি)

২৯৭

৩৪৩

২৭৫

৩৬৪

৩০১

৩৯৩

পূর্ব পাকিস্তান জিডিপি/পশ্চিমাংশের মাথাপিছু জিডিপি’র হার অনুপাতে তুলনায়

৮৬.৬

৭৫.৫

৭৬.৬

জিডিপি অনুপাতে কৃষিতে মূল্য সংযোজন

৬৪.০

৫০.৭

৬১.০

৪৭.৬

৫৭.৮

৪৪.৩

জিডিপি অনুপাতে বৃহৎ শিল্পে মূল্য সংযোজন

১.০

৩.১

২.৩

৬.৮

৪.০

৮.৩

সূত্র: Basic data on productive structure and product per capital: east and west Pakistan, table 1.5. লুইস, অপ.সিআইটি, টেবিল ৬.২ (Anil Chatterjee, Ranajit Dasgupta, Kalyan Dutt – Bangladesh economy an analytical study (1973, People’s Pub. House),  page-18.)

বিচ্ছিন্ন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সামগ্রিক ক্ষেত্রে দুই অংশের মধ্যে আয়-বণ্টন বৈষম্য ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। ধারাবাহিক এই প্রক্রিয়ায় ১৯৬৯-৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় প্রায় শতকরা ৬১ ভাগ বৃদ্ধি পায়।১০

রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা অধিষ্ঠিত হয় তারা তাদের অন্যান্য পরিচয়কে তুলে ধরার পরিবর্তে ধর্মীয় পরিচয়কে প্রধান হিসেবে তুলে ধরে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের আকাঙ্ক্ষা থেকে। যদিও পূর্ব অংশ ছিল ধর্মীয় দিক থেকে মুসলিম সংখ্যাগুরুর বসবাস। কিন্তু মুসলিম আশরাফ আতরাফ বিভাজিত মনস্তত্বের কারণে পূর্ব বাংলার জনগণ আতরাফ হিসেবেই পরিচিত ছিল পশ্চিমাংশের শাসকশ্রেণির কাছে। উৎপাদন সম্পর্কের শ্রেণিগত দ্বন্দ্ব প্রধান মনোযোগের বিষয় যাতে না হয় সে কারণেই সাংস্কৃতিক এই দ্বন্দ্বকে প্রাধান্যে নিয়ে আসা হয় বলেও কোন কোন বিজ্ঞজন দেখিয়েছেন সে সময়। শাসকশ্রেণির সাংস্কৃতিক এই দৃষ্টিভঙ্গীর অবস্থান থেকে বিচার করলেও পশ্চিমাংশের সাথে পূর্বাংশের সুযোগের সমানতা শুরু থেকে সচেতনভাবেই প্রতিষ্ঠিত করা হয়নি। আমলাতন্ত্র, সামরিক বাহিনী, ব্যবসায়ী, লগ্নী পুঁজি এবং শিল্পপতিদের সমন্বয়ে গঠিত পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক রাষ্ট্রে পূর্বাংশ ছিল বরাবরই অবহেলিত। একই সময়ে সরাসরি বৃটিশ শাসন থেকে মুক্ত হলেও ভারত এবং পাকিস্তানের বিকাশে আলাদা ধরণ দেখা যায়।

ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলংকার মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠে মূলত: বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের হাত ধরে। আবার, বৃটিশ শাসকরা অভিজাত, ধনাঢ্য এবং শিক্ষিত মধ্যশ্রেণিকে ততক্ষণই তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল যতক্ষণ না তারা কর্তৃপক্ষকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। মূল ধারার রাজনৈতিক আন্দোলন অবশ্য সে ধৃষ্টতা দেখায়নি। যার ফলে, বৃটিশ রাজের ভারতবর্ষ ভাগের যে পরিকল্পনা সেটিকে এই নেতৃত্ব মাথা পেতে নিয়েছে, বৃটিশ প্রশাসনিক ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। যে কারণে, এই অঞ্চলগুলোতে বৃটিশদের রেখে যাওয়া আমলাতান্ত্রিক এবং সামরিক ব্যবস্থা উত্তরোত্তর বিকশিত হয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের সময় সরকারের অভ্যন্তরে যে অভিজাত সম্প্রদায়ের আধিপত্য দেখতে পাওয়া যায় তা গঠিত হয়েছিল সামরিক-বেসামরিক আমলা, টেকনোক্র্যাট, সামরিক কর্মকর্তা, একাডেমিকস এবং শিল্প-বণিক-লগ্নী পুঁজিপতিদের সমন্বয়ে। সে হিসেবে বলা যায়, বৃটিশ শাসকদের হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয় মূলত: এই বিদেশী শিক্ষিত উকিল, ভূ-স্বামী, শিল্পপতি, সামরিক প্রধান কর্মকর্তা এবং তার সাথে সম্পর্কিত বুদ্ধিজীবীদের কাছে।১১     

১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিস যেসমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিয়ে গঠিত হয় তারা ছিল মূলত: উর্দুভাষী। উচ্চ মধ্যবিত্ত-ধনী যারা শহরে বসবাস করতো তাদের বেশীরভাগ ভারত থেকে অভিবাসিত হয়ে এসেছিল এবং উর্দু ছিল কথা বলার প্রধান মাধ্যম। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে তাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ ছিল। অপরদিকে ঐতিহাসিক বিভিন্ন কারণে পূর্বাংশে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষিত অংশের অনুপাত ছিল খুবই কম। দেশভাগের সময় বৃটিশ প্রশিক্ষিত অবাঙালী শিক্ষিত আমলাদের নিয়ে পশ্চিম এবং পূর্বাংশের আমলাতান্ত্রিক কাঠামো সাজানো হয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে ছিল এই আমলারা। বৃটিশরা ভারতবর্ষ থেকে চলে যাওয়ার পর ভারত যেভাবে বৃটিশদের প্রাতিষ্ঠানিক আমলাতান্ত্রিক কাঠামোগত সুবিধাগুলো পেয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে সে সুবিধাগুলো ছিল না। মুসলিম লীগের রাষ্ট্র পরিচালনার কোন অভিজ্ঞতা ছিলনা বিধায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর ক্ষেত্রে এরাই ছিল প্রাধান্যে। যে কারণে, রাষ্ট্রের মধ্যে আমলারা খুব শক্তিশালী হয়ে ওঠে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেই কেবল নয় বরং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও। পূর্ব পাকিস্তানের সেক্ষেত্রে কোন কার্যকরী ভূমিকা ছিল না।

উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই ছিল পাঞ্জাবী। বাদবাকী নিয়োগ দেওয়া হতো উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের তিন-চারটি অঞ্চল থেকে (শতকরা প্রায় ২০ ভাগের মতো)। বাকী বালুচিস্তান এবং সিন্ধ থেকে (শতকরা প্রায় ৫ ভাগের মতো)। বাহিনীর অন্যান্য সৈনিক সদস্যদের অনুপাতটি ছিল একইরকম। শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ ছিল পাঞ্জাব থেকে আগত । বৃটিশ রাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এই অঞ্চল থেকে বেশীসংখ্যক সৈন্য নিয়োগ দেওয়া হতো সামরিক বাহিনীতে।১২ কর্মসংস্থানের অভাব, বৃটিশ রাজের প্রতি আনুগত্যের বিনিময়ে,বৃটিশ সরকার পূরণ করতো সৈনিক হিসেবে নিয়োগদান করে; সেই একই ধারা পাকিস্তান সরকারও বজায় রাখে। পূর্ব বাংলা থেকে এ ধরনের উচ্চ পদে কোন প্রতিনিধিত্ব সেখানে ছিল না। বৃটিশ নীতিতে বালুচ, সিন্ধি এবং বাঙ্গালীদের বৃটিশ সশস্ত্র বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করায় অনীহা ছিল ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকেই। সেই একই নীতি অনুসরণ করে পাকিস্তান।১৩ যার ফলে, পাকিস্তান আর্মিতে ভারসাম্যহীনতা বরাবরই রয়ে গিয়েছিল। এছাড়া, সামরিক বাহিনী ছিল একটু লাভজনক প্রতিষ্ঠান। ১৯৪৭-’৪৮ সালে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ভারতের ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ থেকে ‘মুসলিম রাষ্ট্র’কে বাঁচাতে বাজেটের শতকরা ৭০ ভাগ প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়।১৪ সামরিক প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণ থেকে শুরু করে অস্ত্র-প্রযু্ক্তি ক্রয় পর্যন্ত নানা ধরনের লেনদেনের সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে সামরিক-বেসামরিক ঠিকাদাররা জড়িত ছিল যাদের মধ্য কেউ কেউ পরবর্তীতে বড় পুঁজিপতি হিসেবে অর্থনীতিতে জায়গা করে নেয়।

উভয় পাকিস্তান কিন্তু ভারতের তুলনায় অগ্রগতিতে পিছনের সারিতে অবস্থান করছিল বিশেষ করে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে। দেশভাগের পূর্বে দুই অঞ্চলেই বিনিয়োগের সুযোগ কম ছিল। তার মধ্যে মুসলিম বিনিয়োগকারীদের অংশ ছিল ভারতের তুলনায় যথেষ্ট কম। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পাকিস্তানের পুঁজিপতিদের বিকাশে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সময়ে পূর্ব এবং পশ্চিম পাঞ্জাবের উভয় অংশের শরণার্থীদের পুরো অংশকে এপার-ওপারে অভিবাসিত হতে হয় বাধ্য হয়ে। এই প্রক্রিয়ায় শরণার্থীদের একটি অংশের মুসলিম ব্যবসায়ীদের মধ্যে বড় সুযোগ ঘটে বড় পুঁজিপতি বনে যাওয়ার। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষেও সুযোগ ঘটে পূর্ব বাংলার তুলনায় পশ্চিমাংশে বৃহৎ পুঁজির কেন্দ্রীভবনের। এছাড়া, ভাষা-সংস্কৃতি এবং জাতিগত ঐক্য থাকার কারণে ভারতের কেন্দ্রীয় অঞ্চল, গুজরাট, কাথিয়াওয়ার, বোম্বের প্রায় সমস্ত বড় ব্যবসায়ী পাকিস্তানের পশ্চিমাংশে এসে জড়ো হওয়ায় সেখানে পূর্ব বাংলার তুলনায় পুঁজির বড় ধরনের কেন্দ্রীভবন ঘটে।

ভাষা-সংস্কৃতি এবং জাতিগত ঐক্য থাকার কারণে ভারতের কেন্দ্রীয় অঞ্চল, গুজরাট, কাথিয়াওয়ার, বোম্বের প্রায় সমস্ত বড় ব্যবসায়ী পাকিস্তানের পশ্চিমাংশে এসে জড়ো হওয়ায় সেখানে পূর্ব বাংলার তুলনায় পুঁজির বড় ধরনের কেন্দ্রীভবন ঘটে।

দূরত্ব আরেকটি কারণ, যার ফলে বহু ধরনের সুবিধা যেসব পশ্চিমাংশের ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্র থেকে আদায় করতে পারতো খুব সহজে এবং কম সময়ে, পূর্বাংশের ব্যবসায়ীদের পক্ষে সে ‍সুযোগ-সুবিধা আদায় ছিল কষ্টসাধ্য। প্রাথমিক পর্যায়ে নতুন ব্যবসা-শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার জন্য লাইসেন্স প্রক্রিয়াকরণ থেকে শুরু করে ব্যাংকিং সুবিধা ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় এবং বাণিজ্যিক কাঠামোগত সুবিধা পেতে হলে এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের করাচি যেতে হতো। রাষ্ট্রীয় কেন্দ্রীয় এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় রাজধানীতে অবস্থিত ছিল। পূর্ব বাংলা থেকে রাজধানীর অবস্থানগত দূরত্বের কারণে বেশীরভাগ সময় নানা ধরনের ঝক্কি-ঝামেলা পোহানোর পাশাপাশি এ অঞ্চলের মানুষ হওয়ার কারণে প্রতিকূল অবস্থার শিকার হওয়া ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। এ সমস্ত কারণে, পুঁজির বিকাশে পূর্ব সবসময় বঞ্চিত ছিল এবং গঠনকালীন সময় থেকেই পশ্চিম সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল।       

পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি মানে পুঁজির প্রবৃদ্ধি; পুঁজিপতিদের বিকাশ। অপরদিকে, শ্রমশক্তির দ্বারা উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদন এবং বাজার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে তা উশুলের প্রক্রিয়া। অন্যদিকে সঞ্চয়, অর্থাৎ যতটা পারা যায় উদ্বৃত্ত মূল্য কিংবা উদ্বৃত্ত উৎপাদনের সম্ভাব্য বড় অংশ পুনরায় পুঁজিতে রূপান্তর ঘটানোতেই পুঁজির মূল আগ্রহ! এ ব্যবস্থার ব্যবচ্ছেদ করতে গিয়ে মার্কস ‘পুঁজি’র এক জায়গায় ক্ল্যাসিক্যাল অর্থনীতিবিদদের সমালোচনা করে বলছেন, পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতিতে ‘‘..পুঞ্জিভবন কেবল পুঞ্জিভবনের স্বার্থে, উৎপাদন কেবল উৎপাদনের স্বার্থে: এটি হলো সূত্র।’’১৫

 একচেটিয়া আধিপত্যের পরিপ্রেক্ষিত

১৯৫১ সালের দিকে,পাকিস্তানের জাতীয় অর্থনীতি সংকটের মধ্যে পড়ে। ’৫০-’৫১ সালে মধ্যে রপ্তানি কমে যায় শতকরা ২০ ভাগের মতো। আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যায় শতকরা ৩৮ ভাগ। আমদানি-রপ্তানির শর্ত কঠিন থেকে কঠিনতর হয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বকালের সর্বনিম্ন অবস্থায় পৌঁছে যায়। আন্তর্জাতিক অর্থনীতির যোগ-বিয়োগে অর্থ মন্ত্রণালয় দিশেহারা হয়ে পড়ে। কোরিয়ান যুদ্ধের কারণে সাময়িক উত্তরণ ঘটে বটে কিন্তু সামগ্রিকভাবে তাতে কোন সুবিধা হয়নি। কোরিয়ান উলম্ফন শেষ হওয়ার পরও করাচি যথারীতি উদার আমদানি নীতি থেকে সরে আসেনি। ’৫১ সালে নতুন আমদানি নীতির গুণগত কোন পরিবর্তন না করে পুরাতন এবং নতুন ব্যবসায়ীদের ভর্তুকি দিয়ে আমদানি অব্যাহত রাখা হয়। অভ্যন্তরীণ বাজারে শতকরা প্রায় ৮৫ ভাগ পণ্য আমদানি হয় লাইসেন্স ছাড়াই। অন্যদিকে রপ্তানির ক্ষেত্রে চড়া দাম রহিত করারও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে, রাষ্ট্রটি অভ্যন্তরীণভাবে দেউলিয়া হওয়ার শর্ত পূরণ করে। ১৯৫২ সালের গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত এমন কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি যার ফলে আমদানির পাগলা ঘোড়াকে দমানো যায় কিংবা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ে। আমলাতান্ত্রিক আধিপত্যের কারণে সরকারের অবশ্য সামান্যই করণীয় ছিল। যে কারণে সে সময় কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি সেটি হলো, কর্তাব্যক্তিরা ধারণা করেছিল উত্তরোত্তর আমদানি বৃদ্ধির ফলে যে মুষ্টিমেয় পুঁজির মালিকরা লাভবান হবে তার ফলে উদ্বৃত্ত পুঁজি বৃহৎ শিল্প-কারখানা স্থাপনের কাজে লাগাবে তারা। বিশেষ করে টেক্সটাইল শিল্পে। তুলা এবং পাট শিল্পের মালিকরা অবশ্য আমদানি উদারীকরণের পক্ষে সোচ্চার ছিল।

উদার নীতির সুফল আমদানিকারকরা ভোগ করে। চড়া দাম সত্ত্বেও উদ্বৃত্ত তহবিল তারা শিল্পের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে বিনিয়োগ করে। রাষ্ট্রীয় যে সমস্ত শিল্প-কারখানা মূলধনী ব্যয়ের অভাবে এবং প্রতিযোগিতার কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল সেসবে পুঁজি বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করে। সরকার দ্রুত শিল্পায়নের জন্য ব্যক্তি পুঁজির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কর্পোরেশনের সীমিত সামর্থ্য সত্ত্বেও যেসব ব্যক্তি মালিকরা নিজস্ব উদ্যোগে শিল্প গড়ার আগ্রহ প্রকাশ করে তাদেরকে নানা প্রকার সুবিধা দেওয়ার জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করে। আমদানী পণ্যের ক্ষেত্রে ভর্তুকিসহ শুল্ক ছাড় এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা, অবকাঠামো নির্মাণ থেকে শুরু করে রপ্তানি ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা প্রদান; এসব প্রণোদনা সহযোগিতা দিতে রাষ্ট্র উদ্যোগ নেয়। ফলে, অল্প সময়ের মধ্যে তাদের হাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ জমা হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে আমদানিকারকদের লাভের হার দাঁড়ায় শতকরা ১০০ থেকে ২০০ ভাগ। অন্যদিকে, উদারনীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ঘাটতি দেখা দেয়। সার্বিক এই পরিস্থিতি সমাজের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করে।১৬

কোন ধরনের পুঁজির প্রাধান্য একটি নির্দিষ্ট সমাজে থাকবে তা অনেকগুলো শর্তের উপর নির্ভর করে। তার মধ্যে অন্যতম একটি শর্ত হলো সরকারীভাবে কোন পুঁজিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে বা পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হচ্ছে; তার উপর। যেমন: ১৯৪৭ সাল পরবর্তী প্রথম বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১৫০ মিলিয়ন রুপি এবং যার মধ্যে বেসরকারি হাবিব ব্যাংকের কাছ থেকে ৮০ মিলিয়ন রুপি ধার করা হয় সরকারি কর্মচারী এবং অন্যান্য ব্যয় নির্বাহের জন্য।১৭ তরল পুঁজির জন্য সরকারের নির্ভরশীলতার কারণে লগ্নী পুঁজির মালিকরা আধিপত্য করার সুযোগটি হাতছাড়া করতে চাইবে না এটাই স্বাভাবিক।

শিল্প প্রকল্প হিসেবে প্রথম যে শিল্পজাত পণ্যগুলোর বাজারে আবির্ভাব ঘটে (রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরুর পর) তার মধ্যে ডেনটোনিক টুথ পাউডার এবং পাকোলা অন্যতম। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এর উদ্বোধন করেন।১৮ আন্তর্জাতিক পুঁজির সাথে একীভূত স্থানীয় পুঁজিকে জনগণের মনস্তত্ত্বে ‘নিজস্বতা’র মোহ তৈরীর একটা চেষ্টা ছিল শিল্প মালিকদের। বলা হলো, ‘‘পাকোলা হলো সেই ব্র্যান্ড যেটি অহংকার, ভালবাসা এবং দেশাত্মবোধের জন্ম দেয়। পাকোলা জাতীয়তাবোধের সাথে আমাদের হৃদয় এবং মননের সংযোগ তৈরী করে। সর্বোপরি, ‘দিল বলে পাকোলা!’’১৯ সদ্য জন্ম নেওয়া রাষ্ট্রে জনগণের মননে পণ্যের মাধ্যমে জাতীয়তার বোধ তৈরীর চেষ্টা!

পাকিস্তান জন্মের পর শিল্প-ব্যবসা-ব্যাংক-বীমা নিয়ে বাইশ পরিবার ছিল তুলনামূলকভাবে অর্থনীতিতে প্রধান শক্তিশালী ভূমিকায়। বিভাগপূর্ব সময়ে যেমন অল ইন্ডিয়া কংগ্রেসে আধিপত্য ছিল মাড়োয়ারিদের তেমনি মুসলমান বড় ব্যবসায়ীরা ছিল মুসলিম লীগের সাথে  সম্পর্কিত। এ ব্যবসায়ীদের মধ্যে কেউ কেউ শারীরিকভাবে সরাসরি মুসলিম লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল, আবার কেউ কেউ সরাসরি যোগদান না করলেও পাকিস্তান আন্দোলনে অর্থ সহায়তা দিয়েছে। মেমন ব্যবসায়ী গোষ্ঠী’র বিষয়টি এখানে উল্লেখযোগ্য। মুসলিম লীগে শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব করতো আবদুল্লাহ হারুন এবং দাউদ আদমজী।

পাকিস্তান জন্মের পর শিল্প-ব্যবসা-ব্যাংক-বীমা নিয়ে বাইশ পরিবার ছিল তুলনামূলকভাবে অর্থনীতিতে প্রধান শক্তিশালী ভূমিকায়। বিভাগপূর্ব সময়ে যেমন অল ইন্ডিয়া কংগ্রেসে আধিপত্য ছিল মাড়োয়ারিদের তেমনি মুসলমান বড় ব্যবসায়ীরা ছিল মুসলিম লীগের সাথে  সম্পর্কিত।

মুসলিম লীগের প্রতি মোহভঙ্গ হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল পূর্ব বাংলার জনগণের। ভারতের সাথে পাকিস্তানের বাণিজ্য বন্ধ করার ফলে প্রাদেশিক অর্থনীতি প্রচণ্ড ধাক্কা খায়। বাংলায় তখন পাট উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র ছিল। পশ্চিম বাংলায় এখান থেকে প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি হতো। পাঞ্জাবে গম উৎপাদকদের তুলনায় পাট চাষীরা ব্যাপকভাবে মার খায় কাঁচা পাটের দাম কমে যাওয়ায়। পশ্চিম বাংলার যথেষ্ট চাহিদা সত্ত্বেও  করাচির প্রাধান্য এবং চাপের কারণে সরকার রপ্তানির এই জায়গাটি বন্ধ করে দেয়। পাট ব্যবসাকে করাচিকেন্দ্রিক করার বাসনায় কেন্দ্রীয় সরকার জুট বোর্ড গঠন করে। পাটের দাম বেঁধে দেয়। প্রকৃত কারণটি উদ্ঘাটিত হতে বেশী সময় নেয়নি যখন দেখা যায় এই বোর্ডের দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয় গোলাম ফারুককে। তিনি ছিলেন সেক্রেটারি অব ইন্ডাস্ট্রি একজন অবাঙ্গালী। আরেকজন বৃহৎ পুঁজির মালিককে এই বোর্ডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তিনি ছিলেন ওয়াশিংটনে করাচি’র রাষ্ট্রদূতের বড় ভাই, পাকিস্তানের সবচাইতে বড় পাটের ডিলার —  এম, এ ইস্পাহানি।

জুট বোর্ডের শোষণ এবং দুর্নীতির কাহিনী ছিল তখন ওপেন সিক্রেট। নানা ধরনের জটিলতার কারণে চাষীরা বেশীরভাগ সময় বেঁধে দেওয়া দামের চাইতেও কম দামে পাট দিতে বাধ্য হতো। অন্যদিকে ইস্পাহানির মতো বড় বড় ব্যবসায়ীরা বেশী লাভে জুট বোর্ডের কাছে পাট বিক্রি করতো। জুট বোর্ডের সদস্যদের কারসাজির ফলে পূর্ব বাংলা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।২০ মালিক ফিরোজ খান নুন ছিলেন পাঞ্জাবের বড় ভূস্বামী পরিবারের সদস্য। তাকে পাঞ্জাবের গভর্ণর করা হয়। নুন-এর নিয়োগ জুট বোর্ডের জন্য সুসংবাদ হলেও পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর জন্য ছিল দুঃসংবাদ। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়োগের ফলে প্রাদেশিক মন্ত্রীসভাকে অবজ্ঞা করে যে কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গভর্ণর এবং জুট বোর্ডের কোনপ্রকার সমস্যাই হতো না। এর সাথে এম, এ ইস্পাহানির যুক্ততা পরিস্থিতিকে আরও সঙ্কটময় করে তোলে। ইস্পাহানির মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক পাট বাণিজ্যের বড় খেলোয়াড় হিসেবে জায়গা করে নেয়। জুট বোর্ডে তার প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে ব্যাংকটি প্রচুর লাভবান হয়। একদিকে সরকারের ঘনিষ্টজন অন্যদিকে বড় পুঁজির মালিক; সুতরাং তাকে ইস্পাহানিকে ঘাটানোর খুব কমই খেলোয়াড় তখন অবশিষ্ট ছিল এবং এই সুযোগকে কাজে লাগাতে তার কোন বেগ পেতে হয়নি। যার ফলে (আয়েশা জালাল-এর বিবরণ অনুযায়ী) দেখা যায় যে, ন্যায্য দাম না পাওয়ার কারণে যখন পাট উৎপাদকরা ভীষণভাবে পর্যুদস্ত; অসংখ্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়ছে; সেপ্টেম্বর ১৯৪৯ সাল থেকে জুন ১৯৫০ পর্যন্ত সে সময়টাতে ইস্পাহানির লভ্যাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২ কোটি রুপি।২১

অন্যদিকে, বোর্ডের দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির বিরোধিতার কারণে এক শিল্পপতি আমিনকে কোণঠাসা করে ফেলা হয়। ১৯৫০-৫১ সালে প্রাদেশিক সরকারের বাজেটে ঘাটতি দেখানো হয় ১ কোটি ৭৩ লাখ রুপি। কেন্দ্র এবং প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে পাটের রপ্তানি শুল্কের হিস্যা নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরী হয়। এই দ্বন্দ্ব সমাধানের পূর্ব পর্যন্ত প্রাদেশিক সরকারের ঘাটতি পূরণ করতে কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বাংলার বিপর্যস্ত জনগণের উপর নতুন করে বিভিন্ন ধরনের করের বোঝা চাপিয়ে দেয়। বছরের পর বছর অপ্রয়োজনীয় খাতে বাজেট বরাদ্দ করা, প্রদেশের উপর অন্যায়ভাবে অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া এবং পাট উৎপাদকদের ন্যায্য দাম প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করা এবং প্রদেশের আয়ের উপর দাঁড়িয়ে কেন্দ্রের সৌধ নির্মাণ করার জন্য তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করেন। তার সমালোচনার কারণে ‘বিদেশী সরকার’ কর্তৃক নির্দেশিত জুট বোর্ডে ‘একঘরে’ করে রাখা হয়। তাকে কোণঠাসা করার পর প্রাদেশিক পরিবহণ, যোগাযোগ, দাম নির্ধারণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে জুট বোর্ড একচ্ছত্র কর্তৃত্ব চালায়। এসব ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপের দাবী তুললে প্রাদেশিক সরকারের পক্ষ থেকে তাকে বলা হয় যে, ‘পূর্ব বাংলার সরকারের এ বিষয়ে কিছু করার নেই’।২২

আয়েশা জালাল তাঁর বইতে লিখেছেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক পলিসি নির্লজ্জভাবে বৃটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের দ্বারা গৃহীত নীতির কথা মনে স্মরণ করিয়ে দেয়। মুসলিম লীগের প্রতি বাঙ্গালীদের নূন্যতম যে সহানুভূতিটুকু ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের ইরি’র (International Rice Research Institute কর্তৃক উদ্ভাবিত ধানের জাত) প্রবর্তনের কারণে সেটুকুনও শেষ হয়ে যায়’’।২৩ কেন্দ্রীয় সরকারের এ ধরনের নানাবিধ পদক্ষেপ দেখে প্রাদেশিক লীগ কেন্দ্র থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলা শুরু করে এবং প্রদেশের স্বায়ত্বশাসনের দাবী তুলতে থাকে।

যে প্রেক্ষিতে পশ্চিমকেন্দ্রিক একচেটিয়া পরিবারগুলো আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলো তার একটি চিত্র তুলে ধরা হয় ১৯৭১ সালের টাইম ম্যাগাজিনে। পত্রিকার বর্ণনামতে,

‘প্রথম থেকেই, পাকিস্তানের কাছ থেকে পূর্বাংশ তার হিস্যা বুঝে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রান্তিক অবস্থানে ছিল। যদিও পুরো দেশের মাত্র এক-ষষ্ঠমাংশ ভূমি তার অংশে ছিল কিন্তু পূর্বাংশে মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের বসবাস ছিল। প্রথম দিকের বছরগুলোতে বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে প্রাপ্ত মোট আয়ের ৭০% ভাগের মতো যোগান দিত পূর্ব কিন্তু পশ্চিমাংশ বৈদেশিক অনুদানের চার ভাগের তিন ভাগ এবং মোট রপ্তানী আয়ের শতকরা ৭০ ভাগ প্রতিনিয়ত গ্রাস করে নিতো। শুরু থেকে দুই দশক পর্যন্ত এর নিয়ন্ত্রণে ছিল অভিজাত পাঞ্জাবী শাসকবর্গ। পূর্ব পাকিস্তানকে কৃষিনির্ভরতার মধ্যে পিছিয়ে রেখে বঞ্চিত করা হয়েছে। জনযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে সরকারি চাকুরি করতো ১৫% এবং সামরিক বাহিনীতে ২৭৫,০০০ এর মধ্যে মাত্র ৫% নিয়োজিত ছিল। মাত্র বিশটি কোটিপতি পরিবার যাদের প্রায় সবাই পশ্চিমকেন্দ্রিক ছিল; তারা দেশের সম্পদের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করতো (একটি প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণামতে, সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শিল্প এবং ব্যাংকিও ও বীমা সম্পদের প্রায় চার-পঞ্চমাংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল)। পুরো পাকিস্তানেই জনপ্রতি আয় ছিল দুঃসহজনকভাবে অল্প কিন্তু তার মধ্যে পশ্চিমের (৪৮ মার্কিন ডলার) তুলনায় পূবে ছিল প্রায় অর্ধেক (৩০ মার্কিন ডলার)।’২৪

উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে তৎকালীন আইয়ুব খান সরকার যে পথে পা বাঁড়ালো তাতে মুষ্ঠিমেয় কিছু পুঁজিপতি তৈরী হলো বটে কিন্তু অন্যদিকে ব্যাপকভাবে বৈষম্য-নির্যাতন বৃদ্ধির শর্তও তৈরী করলো। যার ফলশ্রুতিতে যেমন দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পুঁজির পুঞ্জিভবনের ক্ষেত্রে একটা উলম্ফন দেখা যায়; তার ঠিক পরপরই সামগ্রিক অর্থনীতিতে এক ধরনের ধীরগতি দেখা যায়। কিন্তু মূলত: বাইশ পরিবারের হাতে সম্পদ আহরণের প্রক্রিয়া খুব একটা ব্যাহত হয়নি। কিংবা অপরদিকে বলা যায় সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠতার কারণে পুঁজি আহরণ প্রক্রিয়া বড় আকারে বাধাগ্রস্ত হয়নি। ব্যাংক ঋণ এবং শিল্প লাইন্সেস অল্প কিছু পরিবারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণে তারা শিল্পের নানা ধরণের বিকাশের সুযোগ পায়। ‘আমদানী বিকল্প পণ্য’ উৎপাদনের জোর দেওয়া হলেও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নানান হিসাব-নিকাশ, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের লাল ফিতার দৌরাত্ম্য ইত্যাদি কারণে শিল্পের ধরনে প্রধান জায়গা করে নিতে পারেনি। এছাড়া একচেটিয়া পুঁজির অভ্যন্তরে প্রতিযোগিতাও ছিল এর একটা অন্যতম কারণ।

রাষ্ট্রীয় ছত্রচ্ছায়ায়, আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির কোলে পিঠে চড়ে, শুল্ক ছাড়, বিশাল আকারে ঋণপ্রাপ্তি, ভর্তুকির আবহাওয়ায় এবং নিজেদের বৃহৎ পুঁজির মালিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় বিভাজনের রাজনীতির যে ছক তারা সাজিয়েছিলেন তার পরবর্তী ফল যে নিজেদের ভাঁড়ার পূর্ণ করবে এরকমটি আগেই হয়তো ভেবে রেখেছিলেন। নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর নিজেদের আরও উচ্চশিখরে নিয়ে যাওয়া; লুণ্ঠনের আরও  নতুন নতুন রাস্তা তৈরী করা; অর্থনীতির উপর একচেটিয়া আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ করার জন্য উন্মত্ত হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় বঞ্চিত হয় পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষ। নতুন রাষ্ট্রটি তাদের আঞ্চলিক আকাঙ্ক্ষা পূরণে নানাভাবে উদ্যোগী হয়। পরবর্তীতে যদিও কোন কোন সরকারের আমলে নির্দিষ্ট পুঁজির আহরণে শ্লথগতি হয় কিন্তু সামগ্রিকভাবে মূল প্রক্রিয়া বিশেষ করে ব্যক্তি পুঁজির পুঁঞ্জিভবনের ক্ষেত্রে অব্যাহত থাকে । (চলবে)

আগের পর্ব: ২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-১

পরের পর্ব: ২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-৩

মেহেদী হাসান: লেখক, অনুবাদক। ইমেইল: mehedihassan1@gmail.com 

তথ্যসূত্র:

  1. David Lockwood: The Indian Bourgeoisie: A Political History of the Indian Capitalist Class in the Early Twentieth Century, Bloomsbury Publishing Plc, London,  New York,  Oxford, New Delhi, Sydney, 2012, page: 17-18.
  2. — ibid — page: 9.
  3. — ibid —
  4. Shaid Ur Rehman: Who owns Pakistan.Fluctuating Fortunes of Business Mughals. page-86.
  5. https://www.dawn.com/news/1074371, শিরোনাম: Credibility, Published October 10, 1999.
  6. কাগমারী সম্মেলনে আন্তর্জাতিক রাজনীতির উপর উপস্থাপিত মওলানা ভাসানীর বক্তব্য। দৈনিক সংবাদ, ৬ ও ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৭। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রঃ প্রথম খণ্ড।
  7. Ayesha Jalal: The State of Martial Rule: The Origins of Pakistan’s Political Economy of Defence, Vanguard Books Pvt ltd, Pakistan edition, 1991, Page-42.
  8. http://content.time.com/time/subscriber/article/0,33009,878408-5,00.html, শিরোনাম: World: Pakistan: The Ravaging of Folden Bengal,Monday, Aug 02, 1971
  9. Anil Chatterjee, Ranajit Dasgupta, Kalyan Dutt – Bangladesh economy an analytical study, 1973, People’s Pub. House, page-18.
  10. — ibid — page-19.
  11. Roy, Tirthankar – The Economy of South Asia – From 1950 to the Present, 2017, Springer International Publishing, page-33.
  12. Ayesha Siddiqa, Military Inc. Inside Pakistan’s Military Economy, Oxford University Press, 2007, page-59.
  13. — ibid — page-60.
  14. — Ibid — page-63.
  15. Marx, The process of Accumulation of Capital, Capital, vol-1, Translated by Ben Fowkes, page-742.
  16. Ayesha Jalal, The State of Martial Rule: The Origins of Pakistan’s Political Economy of Defence, Vanguard Books Pvt ltd, Pakistan edition, 1991, Page-141-142.
  17. Shaid Ur Rehman: Who owns Pakistan; Fluctuating Fortunes of Business Mughals. page-9.
  18. https://www.dawn.com/news/1398497, শিরোনাম: Pakola: Engaging with Pakistan’s mighty hearts, updated 06 jan, 2020.
  19. https://aurora.dawn.com/news/1143036/pakola-engaging-with-pakistans-mighty-hearts. শিরোনাম: Pakola: Engaging with Pakistan’s mighty hearts, Published: 13 june, 2018.
  20. Ayesha Jalal, The State of Martial Rule: The Origins of Pakistan’s Political Economy of Defence, Vanguard Books Pvt ltd, Pakistan edition, 1991, Page-106.
  21. — ibid — Page-106-107.
  22. — ibid — Page-107.
  23. — ibid —
  24. http://content.time.com/time/subscriber/article/0,33009,878408-5,00.html, শিরোনাম: World: Pakistan: The Ravaging of Golden Bengal, Monday, Aug 02, 1971.
Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •