বৈশ্বিক দারিদ্র্য ও বৈষম্য সম্পর্কে খোলা চিঠি
(স্টিভেন পিঙ্কারকে এবং একই বিষয়ে বিল গেটসকেও লেখা)
জেসন হিকেল
বৈশ্বিক দারিদ্র্য এখন কমতির দিকে এমনটি দাবি করছে পুঁজিবাদের রক্ষাকর্তারা। তাদের এই দাবি বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে যেমন অসৎ তেমনি বাস্তব চিত্রের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন জেসন হিকেল তাঁর An open letter to Steven Pinker (and Bill Gates, for that matter) about global poverty শীর্ষক খোলা চিঠিতে। লেখাটিতে বিবৃত তথ্য ও যুক্তির গুরুত্ব বিবেচনা করে তা সর্বজনকথায় প্রকাশ করা হচ্ছে। সর্বজনকথার জন্য এই চিঠি/লেখা বাংলা ভাষায় রূপান্তর করেছেন মেহেদী হাসান। জেসন হিকেল The Divide: Global Inequality from Conquest to Free Markets (WW Norton, 2017) গ্রন্থের লেখক। লেখকের ব্লগ পড়া যাবে এখান থেকে।]
প্রিয় স্টিভেন,
বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্ সম্পর্কে দ্যা গার্ডিয়ান পত্রিকায় আমি যেসব দাবি করেছিলাম সে সম্পর্কে আপনার একটি চিঠির জবাবে এই চিঠি লিখছি। আপনাকে সরাসরি সম্বোধন করছি কারণ আমি মনে করি বিতর্কে জড়িত হওয়াই বাঞ্ছনীয় এবং পরবর্তী প্রতিক্রিয়া জানার আগ্রহের কারণে আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যা সততা ও আন্তরিকতার সাথে পারস্পরিক অংশগ্রহণ দাবি করে।
আপনার এবং গেটস-এর বৈশ্বিক দারিদ্র্য সম্পর্কে যে জানা-বুঝা তার চাইতে প্রকৃত অর্থে বিষয়গুলো অনেক জটিল; এটিই ছিল আমার বক্তব্যের মূল অংশ। নয়া উদারনৈতিক বিশ্বায়ন সম্পর্কিত যে সমস্ত তথ্য-উপাত্ত রয়েছে সেগুলো আপনার ব্যাখ্যাকে সমর্থন করে না। এ বিষয়ে যে কোন বিভ্রান্তি দূর করার জন্য এখানে আমার মূল বক্তব্য একটু বিস্তৃত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি আপনার নির্দিষ্ট মতামতগুলোও উল্লেখ করবো।
প্রথমত: ম্যাক্স রোজার (১৮২০ সাল থেকে নিকট বর্তমান পর্যন্ত) যে দীর্ঘমেয়াদী দারিদ্র্য লেখচিত্র তৈরি করেছেন এবং অতি সাম্প্রতিককালে বিল গেটস যেটি টুইট করেছেন সেটি আসলে বিভ্রান্তিকর এবং এর সাথে বাস্তব অভিজ্ঞতার সামান্যই মিল আছে। এর কিছু কারণ রয়েছে।
বিশ্ব ব্যাংকের মাধ্যমে ১৯৮১ সাল থেকে দারিদ্র্য সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করা শুরু হয়েছে। যারা বৈশ্বিক দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণা করেন তাঁরা এ বিষয়ে মোটামুটি একমত যে, ১৯৮১ সালের পূর্বের তথ্য-উপাত্তগুলো গবেষণায় ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য নয় এবং এ জন্য ১৮২০ সালের সমসাময়িক তথ্যের উপর নির্ভর করা কমবেশি অর্থহীন।
১৮২০-১৯৭০ সাল পর্যন্ত তথ্যগুলো যে উৎস থেকে (বোওরগুইগনন এবং মরিসন, ২০০২) এসেছে সেসব বিশ্ব জিডিপি’তে মেডিসন ডাটাবেজ হিসেবে পরিচিত। ঐ তথ্যগুলোতে দারিদ্র্য পর্যালোচনা করার মতো যত না আগ্রহ ছিল তার চাইতে অধিক আগ্রহ ছিল বৈশ্বিক বন্টন নিয়ে; তাও আবার দেশগুলোর অভ্যন্তরে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে। দরিদ্রতম মানুষগুলোর ভাগে কত অংশ জুটেছিল এ বিষয়ে আমরা হয়তো ধারণা করতে পারি কিন্তু সেসব গল্প বাস্তব দারিদ্র্যদশার প্রকৃত অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বিধায় এ সম্পর্কে আমাদের পরিষ্কার কোন ধারণা দেয় না।
দুই ভিন্ন ধরনের সংমিশ্রণ লেখচিত্রে দেখা যায়, এটি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। ১৮২০-১৯৭০ সাল পর্যন্ত যে মানদণ্ড তা মূলত: আয় ভিত্তিক। অন্য কথায়, উপহার হিসেবে আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে এবং ভূমি, বন, নদী ও সমুদ্র থেকে মানুষের যে অনর্থনৈতিক সম্পদ ও দ্রব্য আহরিত হয় সেসব এই মানদণ্ডের মধ্যে নেই। বিপরীতভাবে, ১৯৮১ সালের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বিশ্বব্যাংকের পরিমাপ হলো ভোগ-ভিত্তিক। এই পরিমাপে কেবল আয়কেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বরং সমস্ত অনর্থনৈতিক আদান-প্রদানকেও অর্থ মূল্যের মধ্যে ধরা হয়েছে।
এই দুই আলাদা ধরনের পরিমাপক কোনো একক দীর্ঘমেয়াদী প্রবণতার মধ্যে একীভূত হতে পারে না। রোজারের গ্রাফে সে ধরনের একটা চেষ্টা আছে কিন্তু এটি পিয়ার-রিভিউ স্বীকৃত না। আমার জানা মতে এই ধরনের কাজের জন্য স্বীকৃত কোন স্কলারশিপ নেই। সামাজিক মাধ্যমের জন্য এটি চমৎকার হতে পারে কিন্তু এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
আসলে, আলাদা দুই ধরনের পদ্ধতিকে একীভূত করা উভয় দিক থেকেই বিভ্রান্তিকর। (১)১৮২০-১৯৭০ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র আয়ের ভিত্তিতে পর্যালোচনা করার ফলে জীবন-যাপনের জন্য যে সাধারণ সম্পদ মানুষের আওতাভুক্ত ছিল, পরবর্তীকালের উপস্থাপনায় তুল্যমূল্যবিচারের নিরীখে সেটিকে অবমূল্যায়ন করা হয়, এবং (২) ১৯৮১ সাল পরবর্তী সময়ে মোট ভোগের পর্যালোচনা আসলে জনগণের আয় সম্পর্কে পূর্বের তুলনায় অতিমূল্যায়ন।
একটি বৈধ দীর্ঘমেয়াদী লেখচিত্র তৈরী করার একমাত্র উপায় হতে পারে, একটি নির্দিষ্ট সূচক ব্যবহার করা। এটি হতে পারে আয়ভিত্তিক অথবা ভোগভিত্তিক। যদিও দারিদ্র্য মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আয় সম্পর্কিত তথ্য এককভাবে শক্তিশালী পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত নয়; তবু নানা ধরনের হেজিপেঁজি সত্ত্বেও, অন্ততপক্ষে পুরো সময়ের জন্য তা হাতের কাছে পাওয়া যায়। কিন্তু এই ধরনের লেখচিত্রতে অনর্থনৈতিক লেনদেনকে হিসাবের মধ্যে নেওয়ার কারণে ১৯৮১ সাল থেকে দারিদ্র্য কমতির যে চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে তা আসল অবস্থার ধারে-কাছেও না। অপরপক্ষে, যতদিন না কেউ ১৮২০ সাল থেকে ভোগ-ভিত্তিক শর্তে দারিদ্র্য পরিমাপের জন্য একটি যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতি তৈরী করে ততদিন আমরা অপেক্ষা করতে পারি। এই সময়ে, আমি মনে করি, দীর্ঘমেয়াদী দারিদ্র্য প্রবণতার অনুকূলে দাবি করা থেকে বিরত থাকা বুদ্ধিমানের কাজ, যেহেতু এর অভিজ্ঞতাপ্রসূত বৈধতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
আপনি বলেছেন: ‘‘অতীত সম্পর্কে হিকেলের চিত্রায়ন একটি কাল্পনিক রোমান্টিক গল্প; প্রমাণ এবং তথ্যসূত্রবিহীন।’’ বরং উল্টো, উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়ে থাকলে, আপনি অতীতের যে লেখচিত্রের উপর যারপরনাই নির্ভর করেছেন সেগুলোরই কোন প্রামাণিক ভিত্তি নেই।
অতীত সম্পর্কে আমি যেসব দাবি করেছি প্রকৃত অর্থে সেগুলো ছিল সোজাসাপ্টা বয়ান। আমি কেবল উল্লেখ করেছিলাম, ১৮২০ সাল থেকে প্রায় ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বিশ্বের দক্ষিণের অধিকাংশ অঞ্চলে নিষ্ঠুর ধরনের যেসব উচ্ছেদ হয়েছে সেগুলো আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। আপনি যদি কোন উপনিবেশের ইতিহাসের কথা পড়েন তাহলে দেখবেন যে, ঔপনিবেশিকরা তাদের খনি এবং আবাদের জন্য মানুষকে কাজ করাতে মারাত্মক সব জটিলতার মধ্যে পড়েছে। দেখা গেছে, এসব কাজে মজুরি যথেষ্ট না থাকায় মানুষ তাদের জীবন-যাপনের নিজস্ব ধরনে থাকতেই বেশী পছন্দ করেছে। ঔপনিবেশিকরা জনগণকে শ্রমবাজারে আসতে বাধ্য করেছে: করের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে, সাধারণ মানুষকে অবরোধ করে রেখে এবং খাদ্যের যোগানকে সীমিত করে অথবা সাধারণ মানুষকে তাদের জমি থেকে সরাসরি জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে।
আপনি তথ্যসূত্রের কথা বলেছেন। এখানে কয়েকটি বইয়ের কথা উল্লেখ করছি যেগুলো আপনি পড়ে বিবেচনা করে দেখতে পারেন। যেমন: স্ভেন বেকার্ট-এর এম্পায়ার অফ কটন (Empire of Cotton), এলেন উডস-এর দ্যা অরিজিন অব ক্যাপিটালিজম: এ লঙ্গার ভিউ (The Origins of Capitalism: A Longer View), মাইক ডেভিস-এর লেইট ভিক্টোরিয়ান হলোকাস্টস (Late Victorian Holocausts), এডাম হচসচাইল্ড-এর কিং লিউপোল্ড’স ঘোস্ট (King Leopold’s Ghost) এবং অবশ্যই কার্ল পোলানির দ্যা গ্রেট ট্রান্সফরমেশন (The Great Transformation)।
উপনিবেশের মানুষজনকে ব্যাপকভাবে তাদের আবাসভূমি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করেই পুঁজিবাদী শ্রম ব্যবস্থায় আবদ্ধ করেছে ঔপনিবেশিক শাসকরা (আমার বই দ্যা ডিভাইড-এ এর ঐতিহাসিক দিকগুলো তুলে ধরেছি)। স্মরণে রাখা দরকার, কঙ্গোতে বেলজিয়ান শ্রম ব্যবস্থা প্রচলনের সময় অর্থনীতিকে এমনভাবে বিপর্যস্ত করা হয়েছিল তাতে কঙ্গোর প্রায় অর্ধেক মানুষ অর্থাৎ ১ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘ন্যাটিভ ল্যান্ড এ্যাক্ট’-এর সময়ে দেশটির প্রায় শতকরা ৯০ শতাংশ মানুষকে তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। বৃটিশরা যখন ভারতের কৃষিতে ঔপনিবেশিক নীতিমালা চাপিয়ে দেয় তখন তার ফলে ভারতে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং সে সময় ৩ কোটি অভুক্ত মানুষ মারা যায়। এটা সেই সময় যখন চীনে আফিম যুদ্ধ বাধানো হয় এবং নানা ধরনের অসম চুক্তি চাপিয়ে দিয়ে জনগণকে নি:স্ব করে ফেলা হয়। এটা ভুললে চলবে না যে, এই সমস্ত কিছু করা হয়েছিল ‘‘মুক্ত বাজার’’-এর নামে।
কঙ্গোতে বেলজিয়ান শ্রম ব্যবস্থা প্রচলনের সময় অর্থনীতিকে এমনভাবে বিপর্যস্ত করা হয়েছিল তাতে কঙ্গোর প্রায় অর্ধেক মানুষ অর্থাৎ ১ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘ন্যাটিভ ল্যান্ড এ্যাক্ট’-এর সময়ে দেশটির প্রায় শতকরা ৯০ শতাংশ মানুষকে তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। বৃটিশরা যখন ভারতের কৃষিতে ঔপনিবেশিক নীতিমালা চাপিয়ে দেয় তখন তার ফলে ভারতে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং সে সময় ৩ কোটি অভুক্ত মানুষ মারা যায়। এটা সেই সময় যখন চীনে আফিম যুদ্ধ বাধানো হয় এবং নানা ধরনের অসম চুক্তি চাপিয়ে দিয়ে জনগণকে নি:স্ব করে ফেলা হয়। এটা ভুললে চলবে না যে, এই সমস্ত কিছু করা হয়েছিল ‘‘মুক্ত বাজার’’-এর নামে।
এই সমস্ত সন্ত্রাস এবং তারও বেশী কিছু, আপনার বয়ানে এসেছে সুখী প্রগতিশীল গল্প হিসেবে। আর আপনিই কিনা আমাকেই বলছেন যে, আমি রোমান্টিক সব কাল্পনিক গল্পের বয়ান দিয়েছি!
আপনি যে মেডিসন তথ্যভান্ডারের উপর নির্ভর করেছেন সেটি হয়তো আমাদের বলতে পারে টাকার অঙ্কে এই নি:স্ব মানুষদের আয় (শেষ পর্যন্ত) কতটা বেড়েছে। তবে এই টাকার অঙ্ক মানুষের জমি, সাধারণ সম্পত্তি, সামাজিক সহযোগীতা, স্থিতিশীল স্থানীয় অর্থনীতির ধ্বংস বা ক্ষতির পূরণ করে কিনা সেটি বলতে পারে না। যদি স্বাধীনভাবে নিজেদের শর্তে বিকশিত হতে পারতো তাহলে বিশ্বের দক্ষিণ অঞ্চলের অর্থনীতি বর্তমানে কোথায় এসে দাঁড়াতে পারতো সে সম্পর্কে এসব তথ্য কিছুই জানায় না (উদাহরণ হিসেবে ভারতের বিষয়টি উল্লেখ করা যায়)।
এ বিষয়টা পরিষ্কার করা দরকার যে, এই পর্যালোচনা কিন্তু শিল্পায়নবিরুদ্ধ সমালোচনা নয়। বরং আলোচ্য সময়ে শিল্পায়ন যেভাবে ঘটেছে তার সমালোচনা। পুঁজিবাদী শ্রম ব্যবস্থাকে জনগণ যদি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করতো, পাশাপাশি সাধারণ সম্পত্তিতে তাদের অধিকার বজায় রাখা হতো, উৎপাদিত ফসলের ঠিকঠাক অংশ তারা পেতো তাহলে হয়তো আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক গল্প পেতাম। কাজেই, শিল্পায়নের অর্জন নিয়ে আমরা উল্লসিত হতে পারি — অবশ্যই — কিন্তু এই অর্জনকে দেখতে হবে উপনিবেশিকীকরণ, সন্ত্রাস, উচ্ছেদ এ সবের প্রেক্ষিতে সঠিকভাবে উপস্থাপন করে। এই ইতিহাসকে এড়িয়ে গিয়ে আমরা শুধু অজ্ঞতাই অর্জন করতে পারি, এর বেশী কিছু না।
পুঁজিবাদী শ্রম ব্যবস্থাকে জনগণ যদি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করতো, পাশাপাশি সাধারণ সম্পত্তিতে তাদের অধিকার বজায় রাখা হতো, উৎপাদিত ফসলের ঠিকঠাক অংশ তারা পেতো তাহলে হয়তো আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক গল্প পেতাম।
এখন বর্তমানে আসা যাক।
আপনি বলেছেন যে, ‘‘বৈশ্বিক চরম দারিদ্র্যের ব্যাপক অবসান’’ কেবল তথ্যের এক নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতামাত্র। কিন্তু আপনি যা বুঝেছেন তথ্যগুলো তার চাইতে বেশ জটিল (মৌলিক দিকগুলো নিয়ে চার্লস কেনি’র সাথে যৌথভাবে করা পর্যালোচনাটি পাওয়া যাবে এখানে)।
আপনি এবং গেটস দৈনিক ১.৯০ মার্কিন ডলার দারিদ্র্য সীমার উপর ভর করে বয়ান দিয়েছেন। আমি নিশ্চিত, আপনারা এ বিষয়ে সচেতন যে, এই সীমা ঈশ্বর কিংবা প্রকৃতিপ্রদত্ত কোন নিরপেক্ষ প্রপঞ্চ নয়। মানুষই এটা আবিষ্কার করেছে এবং নিজেদের নির্দিষ্ট প্রয়োজনে এটিকে ব্যবহার করেছে; এবং বিদ্যাজগতের ভেতরে-বাইরে এ নিয়ে তুমুল বাকবিতণ্ডা হয়েছে। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞদের মতে এই ১.৯০ ডলার সীমা এতই কম যে এটি মূলত: অর্থহীন। যে কারণে আমি আমার কাজের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে এর উল্লেখ করেছি। (দেখুন এখানে এবং এখানে)। দৈনিক ১.৯০ মার্কিন ডলার নিয়ে রেড্ডি এবং লাহোতি’র পদ্ধতির সমালোচনা দেখতে পারেন এখানে।
আপনি এবং গেটস দৈনিক ১.৯০ মার্কিন ডলার দারিদ্র্য সীমার উপর ভর করে বয়ান দিয়েছেন। আমি নিশ্চিত, আপনারা এ বিষয়ে সচেতন যে, এই সীমা ঈশ্বর কিংবা প্রকৃতিপ্রদত্ত কোন নিরপেক্ষ প্রপঞ্চ নয়।
মনে রাখার জন্য এখানে কয়েকটা পয়েন্ট উল্লেখ করছি। দৈনিক ১.৯০ মার্কিন ডলারের সীমা ধরলে দেখা যায় মাত্র ৭০ কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাস করছে। কিন্তু এখানে উল্লেখযোগ্য, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) বলছে যে, ৮১ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ ‘নূন্যতম’ মানবিক ক্রিয়াকলাপের উপযোগী ক্যালোরিটুকুও পায় না। ১৫০ কোটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে; ‘সাধারণ’ ক্রিয়াকলাপ বজায় রাখার উপযোগী ক্যালরি থেকে তারা বঞ্চিত এবং ২১০ কোটি মানুষ ভুগছে অপুষ্টিতে। ক্ষুধার্ত এবং অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের চাইতে কীভাবে দরিদ্র্ মানুষ সংখ্যায় কম হতে পারে? দৈনিক ১.৯০ মার্কিন ডলার যদি মৌলিক পুষ্টি এবং স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য অপর্যাপ্ত হয় তাহলে সময়ের হিসেবে এটি খুবই কম। তাই এখনই আপনার এবং গেটস’র এই তথ্যের ব্যবহার বন্ধ করা উচিৎ। অপরদিকে এই সীমার উর্দ্ধে ওঠার মানে এই নয় যে, তাতে ‘‘চরম’’ বা অন্যভাবে দারিদ্র্যসীমার উর্দ্ধে উঠে যাওয়া হয়।
অর্থনীতিবিদ ডেভিড উডওয়ার্ড একবার হিসাব করে দেখিয়েছিলেন যে, (২০০৬ সালের হিসেবে) বৃটেনে এই সমপরিমাণ অর্থে বেঁচে থাকার জন্য ৩৫ জন মানুষকে আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে হয়, যাদের ‘‘কেবল নির্দিষ্ট মজুরী ছাড়া না আছে কোন প্রকার বাড়তি ভাতা, না আছে কোন উপহার। যাদের ধার-দেনা, আবর্জনা থেকে খাদ্য সংগ্রহ, ভিক্ষা কিংবা সঞ্চয় ভেঙ্গে চলতে হয়। (আর দারিদ্র্য মূল্যায়নের সময় এসবকে ‘আয়’ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়)।’’ এটি যে কোন ‘চরম’-এর সংজ্ঞারও বাইরে। এটা স্পষ্টতই অযৌক্তিক। মানবতার জন্য এটি চরম অপমানকর বিষয়।
এমনকি বিশ্বব্যাংক অনবরত বলে বেড়ায় যে, সীমার অঙ্কটি অল্প বিধায় দরিদ্র দেশগুলো ছাড়া এর ব্যবহার সীমিত এবং কোন নীতিমালায় এর ব্যবহার করা উচিৎ নয়। দারিদ্র্য সীমা নিয়ে এ্যাটকিনসন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তারা যে দারিদ্র্য সীমার পরিবর্তন ঘটিয়েছে সেখানে দেখানো হয়েছে যে, নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য দারিদ্র্য সীমা হলো দৈনিক ৩.২০ মার্কিন ডলার এবং উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য দৈনিক ৫.৫০ মার্কিন ডলার। সে সীমা হিসেবেও, ২৪০ কোটি মানুষ বর্তমানে দরিদ্র অবস্থার মধ্যে বসবাস করে — যে সংখ্যা আপনাদের ধারণার চেয়ে কমপক্ষে ৩ গুণ বেশী।
নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য দারিদ্র্য সীমা হলো দৈনিক ৩.২০ মার্কিন ডলার এবং উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য দৈনিক ৫.৫০ মার্কিন ডলার। সে সীমা হিসেবেও, ২৪০ কোটি মানুষ বর্তমানে দরিদ্র অবস্থার মধ্যে বসবাস করে — যে সংখ্যা আপনাদের ধারণার চেয়ে কমপক্ষে ৩ গুণ বেশী।
কিন্তু এই হিসাবগুলোও যথ্ষ্টে নয়। ইউএসডিএ (USDA)-এর বক্তব্য অনুসারে মৌলিক পুষ্টিচাহিদা পূরণের জন্য দৈনিক কমপক্ষে ৬.৭ মার্কিন ডলার প্রয়োজন। পিটার এডওয়ার্ডের ভাষ্যমতে, যদি মানুষকে স্বাভাবিক আয়ুসীমা পেতে হয় তাহলে কমপক্ষে দৈনিক ৭.৪০ মার্কিন ডলার প্রয়োজন। দ্যা নিউ ইকোনোমিকস ফাউন্ডেশন অনুযায়ী, শিশু মৃত্যুহার একটি অর্থবহ সীমার মধ্যে রাখার জন্য দৈনিক ৮ মার্কিন ডলার প্রয়োজন। ল্যান্ট প্রিটচেট এবং চার্লস কেনির বক্তব্য অনুসারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রয়ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে যেহেতু দারিদ্র্য সীমা নির্দিষ্ট করা হয়েছে তাই এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দারিদ্র্য সীমার সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবেই রাখা উচিৎ — কমপক্ষে দৈনিক ১৫ মার্কিন ডলার।
যদি মানুষকে স্বাভাবিক আয়ুসীমা পেতে হয় তাহলে কমপক্ষে দৈনিক ৭.৪০ মার্কিন ডলার প্রয়োজন। দ্যা নিউ ইকোনোমিকস ফাউন্ডেশন অনুযায়ী, শিশু মৃত্যুহার একটি অর্থবহ সীমার মধ্যে রাখার জন্য দৈনিক ৮ মার্কিন ডলার প্রয়োজন।
এই ইস্যুতে ব্যাপক এবং সুক্ষবিচারী সাহিত্য রয়েছে। আমি শুধু ভাসা ভাসা কিছু দাগ টেনেছি মাত্র এবং আপনি এমন ভাব করেছেন যেন এসবের কোন অস্তিত্বই নেই। এটা বুদ্ধিবৃত্তিক দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং পান্ডিত্য যাচাইয়ের একটি অসম্পূর্ণ পদ্ধতি।
আপনি বলেছেন: ‘‘দারিদ্র্যসীমা রেখা’টি কোথায় স্থাপন করা হচ্ছে সেটি অপ্রাসঙ্গিক — বণ্টনের পুরো ধরনটি পাল্টে গেছে, কাজেই দারিদ্র্যসীমা রেখাটি যেখানেই স্থাপন করা হোক না কেন তার প্রবণতা একই রকম দেখা যায়।’
ধীরে বন্ধু, ধীরে! এতো তাড়াহুড়োর কিছু নেই। দারিদ্রসীমার অবস্থানভেদে গল্পের মধ্যে যে অনেক পরিবর্তন ঘটে যায় এটা আপনার না বোঝার কোন কারণ নেই। আমরা যদি দৈনিক ৭.৪০ মার্কিন ডলার ধরে এগুতে থাকি তাহলে দেখবো, দরিদ্র্ মানুষের অনুপাতের মধ্যে একটি পরিবর্তন হচ্ছে ঠিকই কিন্তু আপনি যে ধরনের নাটকীয় পরিবর্তনের বয়ান দিয়েছেন তার ধারে-কাছেও তা নয়। বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করা গেছে, ১৯৮১ সালে দারিদ্রের হার ছিল ৭১%। আর বর্তমানে এই হার ৫৮% (সর্বশেষ ২০১৩ সালের তথ্য অনুযায়ী)। ফলে, আপনার প্রগতির মহান গল্পটি হঠাৎ মনে হয় জঘন্য, সাধারণ মানের এবং আমাদের বর্তমান বিশ্বের সমৃদ্ধির তুলনায় মনে হয় রীতিমত অশ্লীল। এমন একটি বিশ্বে আনন্দে উল্লসিত হওয়ার মতো প্রকৃত অর্থে কিছুই নেই যেখানে বৈষম্য এতোটাই প্রকট যে, শতকরা ৫৮ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে। যেখানে অল্প কয়েক ডজন বিলিয়নিয়ারের হাতে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের সম্পদের চেয়ে বেশী সম্পদ কেন্দ্রীভূত।
এমন একটি বিশ্বে আনন্দে উল্লসিত হওয়ার মতো প্রকৃত অর্থে কিছুই নেই যেখানে বৈষম্য এতোটাই প্রকট যে, শতকরা ৫৮ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে। যেখানে অল্প কয়েক ডজন বিলিয়নিয়ারের হাতে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের সম্পদের চেয়ে বেশী সম্পদ কেন্দ্রীভূত।
আমাকে ভুল বোঝার অবকাশ নেই জনাব: অনুপাত একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি এবং আমাদের এদিকটায় মনোযোগ দেওয়াই উচিৎ, তবে পরম সংখ্যার দিকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া দরকার। প্রকৃতপক্ষে এটিই সেই পদ্ধতি, বিশ্বের সরকারগুলোর সম্মতির ভিত্তিতে ১৯৯৬ সালে যেটিকে রোম ঘোষণাপত্রে লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল এবং এটি ছিল ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’র পূর্বসূরী। পরবর্তী বছরগুলোতে লক্ষ্যবস্তু সরে যায় অনুপাতের দিকে। যার ফলে দ্রুত উন্নতির এক ধরনের চেহারা দেখানো সহজ হয়। তবে সত্যিকার অর্থে বর্তমানে বিতর্কের মূল পয়েন্টটি হলো: পরম সংখ্যা। যদি দারিদ্র্য নিরসন মূল লক্ষ্য হয় তাহলে পরম সংখ্যাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনার উপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। নিশ্চিতভাবে দরিদ্র মানুষের অবস্থান থেকে এটি গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা যদি পরম সংখ্যার দিকে তাকাই তাহলে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী প্রবণতা দেখতে পাবো। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ১৯৮১ সালের তুলনায় দারিদ্র্যের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২০ কোটি থেকে ৪২০ কোটিতে। সংখ্যাটি আপনাদের বিশ্বাসের তুলনায় ছয় গুণ বেশি! এটি আমার বইয়ে উন্নতি হিসেবে দেখানো হয়নি — দেখানো হয়েছে অপমান হিসেবে। এটি হলো আমাদের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিষ্পেষণের অভিযোগ। এটি এমন একটি ব্যবস্থা যা অধিকাংশ মানুষের জীবনকে পরিষ্কারভাবে বিপর্যস্ত করছে। বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য সম্পর্কে আপনার দাবিগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে এই সত্যটিকে পুরোপুরি এড়িয়ে গেছে। আবারও বলছি, এটি আসলে দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন পান্ডিত্য নয়।
আপনার চিঠির বক্তব্য অনুযায়ী; মুক্ত বাজারের পক্ষাবলম্বন করে যে বয়ানগুলো দাঁড় করাতে চেয়েছেন সে কারণেই আসলে আপনি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছেন। আপনার কথা হলো যে, নয়া উদারনৈতিক পুঁজিবাদ দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সবচাইতে কার্যকর চালিকা শক্তি হিসেবে দায়িত্ব নিতে পারে। এই দাবি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অসৎ এবং সার্বিক চিত্রের সাথে তা খাপ খায় না। কেন বলছি তার কারণ হলো:
একটি মাত্র অঞ্চলে বেশিরভাগ মানুষ দারিদ্র্য সীমার উপরে অবস্থান করতে পেরেছে — তার নাম পূর্ব এশিয়া। চীন এবং পূর্ব এশিয়ান বাঘ বলে পরিচিত দেশগুলোতে এই ধরনের অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। হা-জুন চ্যাং এবং রবার্ট ওয়েডের মতো বিশেষজ্ঞরা বিশদ আকারে এটি উল্লেখ করেছেন যে, নয়া উদারনৈতিক বাজার ব্যবস্থার কারণে নয় (আপনি পক্ষাবলম্বন করে যেমনভাবে বলেছেন তেমনভাবে নয়)বরং রাষ্ট্র পরিচালিত শিল্প নীতি, সংরক্ষণবাদিতা এবং বিধি-বিধান-নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির কারণে এই সাফল্য অর্জিত হয়েছে (পশ্চিমের জাতিগুলো তাদের শিল্পায়নকে বিকশিত করার সময়ে একই ধারার প্রক্রিয়াগুলো অবলম্বন করেছিল এবং এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ছিল ব্যাপক)। এটি নিশ্চিত যে, উপরোক্ত দেশগুলো অনেক কিছুকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে কিন্তু সেটি করেছে ক্রমান্বয়ে এবং তাদের নিজেদের শর্তের অধীনে রেখে।
হা-জুন চ্যাং এবং রবার্ট ওয়েডের মতো বিশেষজ্ঞরা বিশদ আকারে এটি উল্লেখ করেছেন যে, নয়া উদারনৈতিক বাজার ব্যবস্থার কারণে নয় (আপনি পক্ষাবলম্বন করে যেমনভাবে বলেছেন তেমনভাবে নয়)বরং রাষ্ট্র পরিচালিত শিল্প নীতি, সংরক্ষণবাদিতা এবং বিধি-বিধান-নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির কারণে এই সাফল্য অর্জিত হয়েছে
বিশ্বের বাকি দক্ষিণের ক্ষেত্রে এ ধরনটি প্রযোজ্য নয়। আসলে, পদ্ধতিগতভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে যেন দক্ষিণের দেশগুলো এই ধরনের কোন নীতিমালা গ্রহণ করতে না পারে এবং যেসব দেশে এ ধরনের নীতিমালাগুলো ছিল সেগুলোকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। ১৯৮০ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ )এবং বিশ্বব্যাংক নিষ্ঠুরভাবে ‘কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচি’ তাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে এবং ঠিক বিপরীতধর্মী ঘটনা ঘটিয়েছে, যেমন: শুল্ক, ভর্তুকি ব্যবস্থার পরিবর্তন, সামাজিক খাতে ব্যয় সংকোচন এবং সামাজিক মূলধন নিয়ন্ত্রণের মতো নানান ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। বিপরীতধর্মী ভূমি সংস্কার এবং জনগণের সম্পদ ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তরের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। আর এসব কাজ করতে গিয়ে জনগণের ব্যাপক প্রতিবাদের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদের। এই সময়ের মধ্যে, চীন বাদে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ১৩০ কোটি। প্রকৃতপক্ষে, এমনকি দারিদ্র্যের অনুপাত (আপনার পছন্দসই পদ্ধতি অনুযায়ী) বেড়েছে ৬২% থেকে ৬৮% । (প্রাসঙ্গিক অর্থনৈতিক তথ্য ও সূত্র বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন দ্যা ডিভাইড বইয়ের ৫ নং অধ্যায়)।
১৯৮০ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ )এবং বিশ্বব্যাংক নিষ্ঠুরভাবে ‘কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচি’ তাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে এবং ঠিক বিপরীতধর্মী ঘটনা ঘটিয়েছে, যেমন: শুল্ক, ভর্তুকি ব্যবস্থার পরিবর্তন, সামাজিক খাতে ব্যয় সংকোচন এবং সামাজিক মূলধন নিয়ন্ত্রণের মতো নানান ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে।
অন্য কথায়, ১৯৮০ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত যে নয়া উদারনৈতিক পুঁজিবাদ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তার ফলে দারিদ্র্য হার উন্নতির দিকে তো নয়ই বরং ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে গেছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে, চীনের বাইরে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে। বামপন্থী কিংবা সামাজিক গনতন্ত্রীদের (সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট) এই মহাদেশে একের পর এক অঞ্চলের ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এই সরকারগুলো সম্পর্কে যে যাই বলুক না কেন (আমার নিজেরও এদের সম্পর্কে সমালোচনা আছে), তবে আপনার নয়া উদারনৈতিক বয়ানের সাথে সেসব ভালভাবে খাপ খায় না।
তবে এখানে আরও কিছু কথা বলার আছে। দারিদ্র্য সংখ্যাকে ব্যবহার করে আপনি এবং গেটস বিদ্যমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বৈধতা দাবী করতে চান। আপনি বলছেন যে, এই ব্যবস্থাটি গরীবের জন্য কাজ করছে সুতরাং এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের অভিযোগ তোলা বন্ধ করা উচিৎ।
যখন এই ধরনের একটি দাবির মূল্যায়নের প্রসঙ্গ আসে তখন এটি প্রকৃতঅর্থে নিখুঁত সংখ্যা বা অনুপাতের প্রশ্ন নয়। বরং বৈশ্বিক দারিদ্র্যের বিস্তৃতি এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে আমাদের সক্ষমতাকে মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। যে বিষয়গুলো আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, দারিদ্র্য দূরীকরণে আমাদের সক্ষমতা (যেমন, দরিদ্র নন এমন জনগোষ্ঠীর আয়ের তুলনায় দারিদ্র দূরীকরণের খরচের অনুপাত) আনুপাতিক হারে দারিদ্র্য হ্রাসের তুলনায় বহুগুণে বেড়েছে (আপনার পছন্দের মানদণ্ডকে আবারও হিসাবের মধ্যে ধরে নিয়ে)। এই মাপকাঠি অনুযায়ী, পরিস্থিতি আগের যে কোন সময়ের তুলনায় যথেষ্ট খারাপ। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের সভ্যতা উল্টোদিকে হাঁটছে। কেন? কারণ, বৈশ্বিক অর্থনীতির বেশীরভাগ ফসল বিশ্বের অল্প কিছু ধনীরা কব্জা করে নিচ্ছে।
গার্ডিয়ানে যে বিষয়টি আমি উল্লেখ করেছি, বিশ্বব্যাপী প্রবৃদ্ধি থেকে নতুন আয়ের মাত্র ৫% যায় ৬০% গরীবের ঘরে। দৈনিক ৭.৪০ মার্কিন ডলারের কম আয় নিয়ে মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। আপনি এটাকে সমস্যা হিসেবে আমলে নেনটি কিংবা এর সপক্ষে ব্যাখ্যা দেওয়ারও চেষ্টা করেননি; আপনি স্রেফ বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। আমার ধারণা, এই অর্থনীতি সুচারুভাবে দরিদ্র মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে – আপনার এই ধরনের দাবিকে নস্যাৎ করে বলে এই বিষয়গুলোকে আপনি আমলে নেননি।
এই অর্থনীতি কতটা ভালভাবে কাজ করছে এখন তা খতিয়ে দেখা যাক। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক রিভিউতে প্রকাশিত গবেষণা অনুসারে, যদি দৈনিক ১.৯০ মার্কিন ডলার হিসেবে দারিদ্র্য সীমা ধরা হয় তাহলে আমাদের গ্রহের বাস্তবতায় দারিদ্র্য দূর হতে ১০০ বছরেরও বেশী সময় লাগবে। আর যদি দৈনিক ৭.৪ মার্কিন ডলার ধরা হয় তাহলে লাগবে ২০০ বছর। সবকিছু বাদ দিয়ে বিদ্যমান বাস্তবতায় সে জায়গায় পৌঁছাতে গেলে; অন্যকথায়, আয়ের সুষম বন্টন ছাড়া যদি আমরা দারিদ্র্য নির্মূলের সে জায়গায় পৌঁছাতে চাই তাহলে আমাদের বৈশ্বিক অর্থনীতির আকার বর্তমানের তুলনায় বাড়াতে হবে ১৭৫ গুণ। এই আকাশকুসুম কল্পনা যদি বাস্তবে রূপায়িত করা যায়ও তবু দেখা যাবে দারিদ্র্য দূরীকরণে যতটুকু সাফল্য অর্জিত হবে, সেটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন এবং বাস্তুসংস্থানের শৃঙ্খল ধ্বংস হওয়ার কারণে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক রিভিউতে প্রকাশিত গবেষণা অনুসারে, যদি দৈনিক ১.৯০ মার্কিন ডলার হিসেবে দারিদ্র্য সীমা ধরা হয় তাহলে আমাদের গ্রহের বাস্তবতায় দারিদ্র্য দূর হতে ১০০ বছরেরও বেশী সময় লাগবে। আর যদি দৈনিক ৭.৪ মার্কিন ডলার ধরা হয় তাহলে লাগবে ২০০ বছর।
এভাবে যে হবে না তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের জন্য সুষম বন্টনের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক নীতিমালা তৈরী করে আমরা এখনই দারিদ্র্যের অবসান ঘটাতে পারি। (কীভাবে আমরা করতে পারি তার বিস্তারিত বর্ণনা আমি দ্যা ডিভাইড বইটিতে দিয়েছি। মজুরী, ঋণ, ট্রেড লেনদেন ইত্যাদি সবকিছুরই বর্ণনা পাওয়া যাবে এখানে)। কিন্তু সেগুলো এমন কিছু উপায় যা আপনি এবং গেটস মিলে বর্তমান বাস্তবতা রক্ষার স্বার্থে সদম্ভে এড়িয়ে যেতে চান।
আপনি বলেছেন,‘‘আয় ছাড়াও ভাল থাকার অনেকগুলো মানদণ্ড রয়েছে যেগুলোর সাথে সমৃদ্ধির সম্পর্ক দেখা যায়। এই মানদণ্ডগুলো হলো; আয়ুষ্কাল, শিশু মৃত্যুহার, মাতৃত্বকালীন মৃত্যুহার, স্বাক্ষরতা, মৌলিক শিক্ষা, অপুষ্টি, ভোগ ইত্যাদি। চরম দারিদ্রের ব্যাপক হ্রাসের সাথে এই পরিমাপকগুলো সঙ্গতিপূর্ণ।’’
আয়ুষ্কাল,মুত্যুহার, শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে বৈকি। এটি আনন্দের সংবাদ এবং এসব বিষয়ে আমরা উল্লাস করতে পারি! কিন্তু কিছু বিষয়:
১. আপনি অন্য বিষয়ে অঙ্গুলী নির্দেশ করে প্রকৃত দারিদ্র্যের বিষয়টিকে দিকভ্রান্ত করে কোন ব্যাখ্যা হাজির করতে পারেন না। ভোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে কথাটি ঠিক। কিন্তু সেটি এখানে মূল ধর্তব্যের বিষয় নয়। এখানে মূল আলোচ্য বিষয় হলো — ভোগ এমনভাবে বাড়ছে কিনা যাতে দারিদ্র্য অবস্থা থেকে মানুষের উত্তরণ ঘটার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
২. ভাল থাকার জন্য আয় এবং ভোগ একমাত্র মাপকাঠি না, এর সাথে আমি একমত । কিন্তু একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণে এই মাপকাঠিগুলো মাথায় রাখতে হয় এজন্য যে, বিশ্বের সম্পদ বন্টনের বৈষম্যমূলক পর্যালোচনা এগুলোর মাধ্যমে জানা যায়। বৈশ্বিক আয়ের যে ক্ষুদ্র এবং ক্রমসংকোচনশীল অংশের ভাগ গরীব মানুষ পাচ্ছে, গড় আয়ু বৃদ্ধি দিয়ে তার যৌক্তিকতা বিচার করা যাবে না। এ অবস্থান নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
বৈশ্বিক আয়ের যে ক্ষুদ্র এবং ক্রমসংকোচনশীল অংশের ভাগ গরীব মানুষ পাচ্ছে, গড় আয়ু বৃদ্ধি দিয়ে তার যৌক্তিকতা বিচার করা যাবে না।
৩, আপনি আপনার কাজের মধ্যে গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করে নয়া উদারনৈতিক বিশ্বায়নকে যৌক্তিক করার ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। কিন্তু আবারও বলতে হচ্ছে, এটি হলো বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা। জনগণের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপের (পয়ো:নিষ্কাষন, এন্টিবায়োটিকস, ভ্যাক্সিন) কারণে গড় আয়ু বেড়েছে এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে উন্নয়নের পেছনেও একইভাবে কাজ করছে গণশিক্ষা ব্যবস্থা। সে সমস্ত দেশই ব্যাপকভাবে সফলতা অর্জন করেছে যেসব দেশ তাদের জনগণের স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে বিনামূল্যে সবার জন্য উপহার দিতে পেরেছে। এটা ভুলে গেলে চলবে না যে কিউবার চাইতে শিশু মৃত্যুহারের দিক দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা শোচনীয়।
সে সমস্ত দেশই ব্যাপকভাবে সফলতা অর্জন করেছে যেসব দেশ তাদের জনগণের স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে বিনামূল্যে সবার জন্য উপহার দিতে পেরেছে। এটা ভুলে গেলে চলবে না যে কিউবার চাইতে শিশু মৃত্যুহারের দিক দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা শোচনীয়।
৪. ক্ষুধার বিষয়ে আপনি আপনার দাবী উপস্থাপন করেছেন ২০১২ সাল পরবর্তী খাদ্য এবং কৃষি সংস্থার (FAO) ব্যবহৃত পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে, বিশেষজ্ঞরা যে পদ্ধতির ব্যাপক সমালোচনা করেছেন। আপনার ১.৯০ মার্কিন ডলার দারিদ্র্য রেখার ন্যায় ক্ষুধা দূরীকরণের ব্যাখ্যা নির্ভর করে ক্যালোরি রেখার উপর। এই ক্যালোরি রেখা এতই নিম্নগামী যে স্বাভাবিক মানবীয় কর্মকান্ডকেও তা সমর্থন করেনা, খাদ্যপণ্যের দাম সঙ্কটের প্রভাব তাতে এড়িয়ে যাওয়া হয় এবং পুষ্টিজনিত ঘাটতির কোন চিত্রই এই রেখা থেকে পাওয়া যায় না। এর বিস্তারিত বিবরণ আমি দিয়েছি আমার লেখার দ্বিতীয় ভাগে। FAO-এর পূর্ববর্তী পদ্ধতি অনুযায়ী, ১৯৯৫ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে সংখ্যা এবং অনুপাত বিচারে ক্ষুধার্ত মানুষ অনেক বেড়েছে — এ বিষয়টিও আপনি সযত্নে এড়িয়ে গেছেন।
উপসংহারে এসে আপনি যে কাজটি করেছেন তা হলো, দারিদ্র্য বিষয়ে যার কোন পড়াশুনা নেই; যিনি কোচ ব্রাদার্স থেকে অনুদানপ্রাপ্ত ডানপন্থী ক্যাটো ইনস্টিটিউট এর একজন কর্মচারী সেই রায়ান বোওর্ন-এর কাছ থেকে কিছু বিষয়ের উ্দ্ধৃতি দিয়েছেন। যে অংশটির কথা বলেছেন সেটি বিভ্রান্তিকর দাবির সাথে হেঁয়ালিপূর্ণ ভাষ্যে ভরা। এ বিষয়টি তাকে ধরিয়ে দেওয়ার পরও সেটি তিনি কখনো সংশোধন করেননি। এটিকে গ্রহণযোগ্য কোন উৎস হিসেবে আমাদের বিবেচনা করা উচিৎ নয় বলে আমি মনে করি।
আপনি আপনার পত্রের শুরুতেই আমাকে ‘‘মার্ক্সবাদী ভাবাদর্শী’’ বলে উপহাস করার চেষ্টা করেছেন। এটা নিশ্চয় আমার বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এটি বিতর্কের কোন তরিকা না। এবং আপনি যে আমার স্বতন্ত্র দাবিগুলোর ধারে-কাছেও ঘেঁষেননি বরং উপহাস করে এড়িয়ে গিয়েছেন তা বলাই বাহুল্য। আমি অবশ্য নিশ্চিত না যে আপনি আসলে কী বুঝাতে চেয়েছেন! আপনার বয়ানের সীমাবদ্ধতা অর্থাৎ দরিদ্রাবস্থার যে তথ্য আপনি উপস্থাপন করেছেন বিষয়গুলো তার চাইতেও অনেক জটিল বলে কেউ যদি ধরিয়ে দেয় আর তাকে ‘‘মার্ক্সবাদী ভাবাদর্শী’’ বলে আপনি উপহাস করতে চান তো বলতেই হচ্ছে, তাহলে বোধহয় আমি তাই-ই।