পাদুকাশ্রমিক: নামমাত্র মজুরি আর মর্যাদাহীন জীবন

পাদুকাশ্রমিক: নামমাত্র মজুরি আর মর্যাদাহীন জীবন

প্রকাশ দত্ত

নামিদামি ব্র্যান্ডের জুতার শোরুম আজ যাদের নাগালের বাইরে, সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য পাদুকা যারা তৈরি করেন, তাদের জীবন ও জীবিকার খবর অধিকাংশ মানুষের কাছেই অজানা। এই লেখায় প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানের মাধ্যমে এই খাত ও তার শ্রমিকদের কঠিন জীবনকথা তুলে ধরা হয়েছে।

পাদুকাশ্রমিকদের তৈরি কমদামি স্লিপার, স্যান্ডেল, জুতা, কেডস রাজধানী থেকে উপজেলা পর্যায়ের ফুটপাত, মাঝারি মানের জুতার দোকানগুলোতে আর পাড়া-মহল্লায় ভ্যানে ফেরি করে বিক্রি করা বিভিন্ন ধরনের পাদুকা হরহামেশাই আমাদের চোখে পড়ে। কিন্তু চোখের আড়ালে থেকে যান সেই কারিগর পাদুকাশ্রমিক। শুরুতে পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজার, আলুবাজার, আগামসি লেন, মালিটোলা, সুরিটোলা আর চট্টগ্রাম মহানগরকেন্দ্রিক ছিল এই শিল্প। প্রথমদিকে মালিক নিজেও কাজ করতেন এবং সঙ্গে ২ থেকে ৪ জন কারিগর রাখতেন। এই শিল্পের শুরুতে যারা হেলপার, তারা টাকা দিয়ে কাজ শিখতেন।

সময়ের আবর্তে জীবনযাপনের ধরনের পরিবর্তন হওয়ায় চাহিদা এবং জনসংখ্যা বাড়ায় ৯০-পরবর্তী সময়ে পুরান ঢাকার বংশাল থানাকেন্দ্রিক বাসাবাড়িতে দ্রুত বাড়তে থাকে জুতার কারখানা। একইসঙ্গে জেলা, উপজেলা ও থানা পর্যায়ে কমবেশি ছোট-বড়, মাঝারি কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় তৈরি এক জোড়া স্লিপার ৮০-১২০ টাকা, স্যান্ডেল ২০০-৬০০ টাকা, কেডস ২৫০-৩০০ টাকা, জুতা ২৫০ টাকা থেকে ১,২০০ টাকা মূল্যে বিক্রি হয়।

সম্প্রতি পুরান ঢাকার মালিকদের একটা অংশ অতিরিক্ত জামানত ও ভাড়া বৃদ্ধি, অসহনীয় ঘনবসতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে কামরাঙ্গীরচর, নবাবগঞ্জ, হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ এলাকা এবং ঢাকার বাইরে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে কারখানা স্থানান্তর করেন। এই জুতার কারখানাগুলোর প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে এখন ঢাকা, ভৈরব, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। তবে এখনো বেশিরভাগ কারখানা পুরান ঢাকায় অবস্থিত; যার সংখ্যা প্রায় সাত হাজার। কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরবে প্রায় তিন হাজার, চট্টগ্রাম শহরে কয়েক শ, জেলা পর্যায়ে নয়/দশটা এবং থানা পর্যায়ে কমবেশি দু-চারটা কারখানা আছে। সব মিলিয়ে কারখানার সংখ্যা প্রায় এগারো বা বারো হাজার।

এই জুতার কারখানাগুলোর প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে এখন ঢাকা, ভৈরব, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। তবে এখনো বেশিরভাগ কারখানা পুরান ঢাকায় অবস্থিত; যার সংখ্যা প্রায় সাত হাজার। কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরবে প্রায় তিন হাজার, চট্টগ্রাম শহরে কয়েক শ, জেলা পর্যায়ে নয়/দশটা এবং থানা পর্যায়ে কমবেশি দু-চারটা কারখানা আছে। সব মিলিয়ে কারখানার সংখ্যা প্রায় এগারো বা বারো হাজার।

ছোট কারখানাগুলোতে সাত-আটজন, মাঝারি কারখানাগুলোতে পনেরো থেকে বিশজন, বড় কারখানাগুলোতে চল্লিশ জনের বেশি শ্রমিক কাজ করেন। চার লক্ষাধিক শ্রমিক এই কারখানাগুলোর সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়াও জুতাসামগ্রীর ব্যাবসা ও বিপণন পর্যায়ে কয়েক ধাপে লক্ষাধিক মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত এই শিল্পের সঙ্গে; জাতীয় অর্থনীতিতেও এই শিল্পের অবদান কম নয়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না-থাকায় বিদেশ থেকে আসা জুতা-স্যান্ডেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না-পেরে অনেক খুদে মালিক ব্যাবসা গোটাতে বাধ্য হয়েছেন। এমনই বাস্তবতায় ২০১২-১৩ সালের দিকে ছোট ছোট কারখানার আট থেকে দশজন মালিক মিলে আধুনিক মেশিনপত্র সংবলিত একটু বড় কারখানা গড়ে তোলেন। এসব কারখানায় ১০০ থেকে ২০০ শ্রমিক কাজ করেন। তুলনামূলক বড় কারখানাগুলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গাজীপুর, ভৈরব, নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর, ঢাকার সাভার, নবাবগঞ্জ, ডেমরা অঞ্চলে অবস্থিত। এই কারখানাগুলোর শ্রমিকরা বেতনভুক্ত, বাকি সব কারখানার শ্রমিকরা ফুরনভিত্তিক কাজ করেন। ভারত, মিয়ানমার, চীনসহ প্রতিবছর বিদেশ থেকে আসা নিত্যনতুন ডিজাইনের জুতা-স্যান্ডেলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখনো টিকে থাকার পেছনে মূল ভূমিকা রয়েছে শ্রমিকের সস্তা শ্রম আর কারিগরি দক্ষতা। আধুনিক প্রযুক্তি বা জ্ঞানের ছোঁয়াবিহীন অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে নিত্যনতুন ডিজাইনের জুতা তৈরি করতে করতে আজ তাদেরই একটি অংশ এই শিল্পের ডিজাইনার।

চার লক্ষাধিক শ্রমিক এই কারখানাগুলোর সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়াও জুতাসামগ্রীর ব্যাবসা ও বিপণন পর্যায়ে কয়েক ধাপে লক্ষাধিক মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত এই শিল্পের সঙ্গে; জাতীয় অর্থনীতিতেও এই শিল্পের অবদান কম নয়।

কাজের ধরন অনুযায়ী সাত ধরনের কাজ করেন পাদুকাশ্রমিকরা। যারা ডিজাইন তৈরি করেন তারা ডিজাইনম্যান, উপরের অংশ যারা প্রস্তুত করেন তারা আপারম্যান, সোলের কাজ যিনি করেন তাকে সোলম্যান বলে, সোলের সঙ্গে যারা আপার সেট করেন তাদের বলে ফিটিংম্যান, সেলাইয়ের কাজ যারা করেন তারা সেলাইম্যান, সর্বশেষ কালার এবং বাক্স ভরার কাজ যারা করেন তাদের বলে ফিনিশম্যান। বর্তমানে ফুরনভিত্তিক কাজের ক্ষেত্রে হেলপারের দায়িত্ব কারিগরের। তাদের কাজ পেটেভাতে আর মাসে একবার বাড়ি গেলে যাতায়াত খরচ। যারা হেলপার তাদের সবারই বয়স ১০ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। ক্ষুধা আর অভাবের কারণে মায়ের কোল, খেলার মাঠ, বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ, বই-খাতা সবকিছু আজ হারিয়ে গেছে হেলপারের কাজ করা এই শিশুশ্রমিকদের জীবন থেকে।

বর্তমানে ফুরনভিত্তিক কাজের ক্ষেত্রে হেলপারের দায়িত্ব কারিগরের। তাদের কাজ পেটেভাতে আর মাসে একবার বাড়ি গেলে যাতায়াত খরচ। যারা হেলপার তাদের সবারই বয়স ১০ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। ক্ষুধা আর অভাবের কারণে মায়ের কোল, খেলার মাঠ, বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ, বই-খাতা সবকিছু আজ হারিয়ে গেছে হেলপারের কাজ করা এই শিশুশ্রমিকদের জীবন থেকে।

প্রতি নতুন বছরের শুরুতে রাষ্ট্রীয় আয়োজনে ঘটা করে প্রধানমন্ত্রী যখন শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেন, পাদুকাশিল্পের হেলপাররা তখন হাতুড়ি হাতে টিভির পর্দার দিকে ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। জুতা কারখানার শ্রমিকরা যে যেখান থেকেই আসুক, একটি কারণ তাদের সবার জীবনের জন্য এক এবং অভিন্ন। সেটি হচ্ছে, তীব্র ক্ষুধার জ্বালা। পাদুকাশিল্পের শ্রমিকরা সবাই গ্রামীণ কৃষক পরিবার থেকে আগত। তাদের অধিকাংশের একসময় জমি ছিল। বর্তমানে জমি হারিয়ে ভূমিহীন দিনমজুর। যারা হেলপার হিসেবে আজ জুতা কারখানায় কাজ করছেন, পরিবারগুলো মূলত তাদের দুটি কারণে কাজে পাঠিয়েছে। তা হচ্ছে, পরিবারের একজন খাওয়ার মানুষ কমবে আর কাজ শিখলে রোজগার করে পরিবারকে দেবে। কৃষির লাভ মধ্যস্বত্বভোগী লুটপাট করায় বাড়ছে ভূমিহীন গরিব কৃষকের সংখ্যা। তারাই আজ দলবেঁধে পাড়ি জমাচ্ছে শহরে।

এ শিল্পের যারা শ্রমিক তাদের বেশিরভাগের বাড়ি কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর। হেলপার বাদে অধিকাংশের বয়স ১৮ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। এই বয়সটা হচ্ছে নির্মম শ্রম শোষণের জন্য মোক্ষম সময়। ৮০ ভাগের বেশি কারখানায় ফুরনভিত্তিক কাজ হওয়ায় শ্রমিকরা দুটো বাড়তি রোজগারের আশায় ১৪ ঘণ্টার উপরে কাজ করেন। দুই ইদ, পূজা, পহেলা বৈশাখের উৎসবকে কেন্দ্র করে বেশিরভাগ কারখানায় ৬-৭ মাস কাজ হয়। শ্রমিকরা বছরে ৭ থেকে ৮ বার বাড়ি যান। যেসব জেলা থেকে তারা আসেন, সেই হিসাব করলে বাড়ি যাওয়াকেন্দ্রিক বছরে ন্যূনতম খরচ হয় ছয় হাজার টাকা। সিজন এবং ডাল সিজন মিলিয়ে একজন শ্রমিক প্রায় আট মাস ঢাকায় থাকেন। সেই হিসাবে খাওয়া বাবদ খরচ হয় ৩৬ হাজার টাকা। একজন আপারম্যান সাত মাসে আয় করেন এক লাখ ৪০ হাজার টাকা, মাসিক আয় ২০ হাজার টাকা। খাওয়া ও যাতায়াত খরচ বাদে প্রতিমাসে রোজগার ৮ হাজার ২০০ টাকার মতো। একজন আপারম্যান দৈনিক ১৪ ঘণ্টা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ৩০০ টাকা ডজন হিসেবে দুই ডজন জুতার কাজ করার বিনিময়ে ৬০০ টাকা পেয়ে থাকেন।

শ্রম আইন অনুযায়ী, আট ঘণ্টার অতিরিক্ত কাজের জন্য দ্বিগুণ মজুরি হিসাবে ১৪ ঘণ্টা কাজের জন্য একজন আপারম্যানের মোট মজুরি হওয়ার কথা (২৬০×২=৫২০+৩৪০) টাকা= ৮৬০ টাকা। শ্রমিকদের নিম্ন মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য করার ফাঁদ হিসেবে কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের অগ্রিম (যা আরেক ধরনের দাদন) টাকা দিয়ে থাকেন। যে টাকা শ্রমিকরা কখনোই শোধ করতে না পারায় এই শিল্পের শ্রমিকরা যেন মালিকের কেনা গোলাম। আর এই ফাঁদে আটকে রেখে মালিকরা তাদের ইচ্ছেমতো ফুরনভিত্তিক কাজের মজুরি নির্ধারণ করে থাকেন।

শ্রমিকদের নিম্ন মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য করার ফাঁদ হিসেবে কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের অগ্রিম (যা আরেক ধরনের দাদন) টাকা দিয়ে থাকেন। যে টাকা শ্রমিকরা কখনোই শোধ করতে না পারায় এই শিল্পের শ্রমিকরা যেন মালিকের কেনা গোলাম। আর এই ফাঁদে আটকে রেখে মালিকরা তাদের ইচ্ছেমতো ফুরনভিত্তিক কাজের মজুরি নির্ধারণ করে থাকেন।

ফুরনভিত্তিক পদ্ধতি সামনে আসে পুঁজির মুনাফার স্বার্থে। শ্রম শোষণের নানারকম ফন্দি-ফিকিরের মধ্যে শুধু ৮ ঘণ্টার অতিরিক্ত সময়ের কাজের হিসাবে একজন মালিক একজন আপারম্যানের কাছ থেকে দৈনিক ২৫০ টাকা অতিরিক্ত হারে মুনাফা করেন। যার মাসিক পরিমাণ দাঁড়ায় সাত হাজার পাঁচশ টাকা। একইভাবে সোলম্যান, ফিটিংম্যান, ফিনিশম্যান, সেলাইম্যানকেও তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বেপরোয়া লাভের এই প্রাণ ভোমরার জন্যই সরকার মালিকগোষ্ঠীর স্বার্থে ন্যূনতম জাতীয় মজুরি ঘোষণা করে না। গত ৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ‘চামড়াজাত পণ্য ও জুতা কারখানা’ শিল্প সেক্টরের জন্য নিম্নতম মজুরি ঘোষণা করা হলেও তার বাস্তবায়ন নেই এসব ব্র্যান্ডহীন জুতা কারখানায়।

১৯৯০ সালে গরিবের মোটা চালের দাম ছিল কেজি প্রতি ৮ থেকে ৯ টাকা। সেই চাল আজ ৪২ থেকে ৪৮ টাকা। দাম বাড়ল ৬ গুণ। আর একজন পাদুকাশ্রমিকের ১৯৯০ সালে এক ডজন স্যান্ডেলের আপারম্যানের মজুরি ছিল ৯০ টাকা। ৩১ বছর পর তাদের বর্তমান মজুরি ৩০০ টাকা।

১৯৯০ সালে গরিবের মোটা চালের দাম ছিল কেজি প্রতি ৮ থেকে ৯ টাকা। সেই চাল আজ ৪২ থেকে ৪৮ টাকা। দাম বাড়ল ৬ গুণ। আর একজন পাদুকাশ্রমিকের ১৯৯০ সালে এক ডজন স্যান্ডেলের আপারম্যানের মজুরি ছিল ৯০ টাকা। ৩১ বছর পর তাদের বর্তমান মজুরি ৩০০ টাকা। জীবন-জীবিকার ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির প্রশ্ন কার্যকর থাকলে একজন আপরম্যানের এক ডজন স্যান্ডেলের মজুরি হতো ন্যূনতম ৫৪০ টাকা। আজ যারা নিরাপদ প্রকোষ্ঠে আরাম কেদারায় বসে রাষ্ট্রের কৃপায় উচ্ছিষ্ট খেয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নের পরিসংখ্যান দিয়ে চলেছে অহর্নিশ, তাদের দু-চোখে খুবই সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে চলে শ্রমজীবী জনগণের জীবনের প্রকৃত চিত্র।

এমনই বাস্তবতায় নিরাপদ কর্মপরিবেশের নামে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের টাকায় আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে চলছে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা প্রদানের মাতম। পুরান ঢাকার সাততলা একটি বিল্ডিংয়ে জুতার কারখানা, লোকাল গার্মেন্টের কারখানাসহ সব মিলিয়ে প্রায় ৫০০ শ্রমিক কাজ করেন। সরু রাস্তা আর অপরিকল্পিত বাড়িঘর মিলিয়ে যে ঘিঞ্জি পরিবেশে শ্রমিকদের কাজ করতে হয়; ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড বা ভবনধসের মতো দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধারকাজ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। শিল্প ও কর্মপরিবেশের বিচারে একেকটি জুতা কারখানা হচ্ছে একেকটি মৃত্যুকূপ। প্রতিটি কারখানা মাচাং সিস্টেম হওয়ায় শ্রমিকরা দীর্ঘসময় বসে কাজ করার পর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। একটি কারখানার শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার কারখানায় ৩১ ফুট লম্বা, ১৮ ফুট চওড়া ও ১০ ফুট উচ্চতার একটি রুমে, নিচে এবং উপরে ২৯ জন শ্রমিক কাজ করেন। এই ছোট্ট রুমে অতিরিক্ত আলোর জন্য একসঙ্গে ২২টা এলইডি বাল্ব জ্বলে। ৪টা ছোট জানালা থাকলেও এই কারখানার বিল্ডিংয়ের সঙ্গে আরেকটা বিল্ডিং লাগোয়া থাকায় বাহিরের আলো-বাতাস ভেতরে ঢুকতে পারে না। আর আছে সোল, পেস্টিং, রেক্সিন এবং চামড়ার উৎকট গন্ধ। কাজ, খাওয়া আর ঘুম একই জায়গায়। হাড়ভাঙা খাটুনির ফলে ক্লান্ত শরীর নিয়ে কারখানার ওই পরিবেশের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েন শ্রমিকরা। ফুরনভিত্তিক কাজের কারণে সবাই একসঙ্গে ঘুমান না। ফলে কোনো শ্রমিক উঠে যখনই লাইট জ্বালান, তখনই অন্যদের ঘুম ভেঙে যায় আলোর তীব্রতার কারণে। ফলে ঘুমও আর হয় না, ক্লান্তিও আর কাটে না।

শিল্প ও কর্মপরিবেশের বিচারে একেকটি জুতা কারখানা হচ্ছে একেকটি মৃত্যুকূপ। প্রতিটি কারখানা মাচাং সিস্টেম হওয়ায় শ্রমিকরা দীর্ঘসময় বসে কাজ করার পর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। একটি কারখানার শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার কারখানায় ৩১ ফুট লম্বা, ১৮ ফুট চওড়া ও ১০ ফুট উচ্চতার একটি রুমে, নিচে এবং উপরে ২৯ জন শ্রমিক কাজ করেন। এই ছোট্ট রুমে অতিরিক্ত আলোর জন্য একসঙ্গে ২২টা এলইডি বাল্ব জ্বলে। ৪টা ছোট জানালা থাকলেও এই কারখানার বিল্ডিংয়ের সঙ্গে আরেকটা বিল্ডিং লাগোয়া থাকায় বাহিরের আলো-বাতাস ভেতরে ঢুকতে পারে না। আর আছে সোল, পেস্টিং, রেক্সিন এবং চামড়ার উৎকট গন্ধ। কাজ, খাওয়া আর ঘুম একই জায়গায়।

পাদুকাশ্রমিকদের খাওয়া বলতে সকালে রুটি, ডাল বা ভাজি, আর দু-বেলার খাবারে সপ্তাহে দুদিন দুই পিস করে ব্রয়লার মুরগির মাংসের সঙ্গে এক টুকরো আলু আর ডাল, কখনো ভাজি; সপ্তাহে ৩ দিন মাছ, সঙ্গে ডাল, ভাজি অথবা ভর্তা; সপ্তাহে ২ দিন ডিম, সঙ্গে ভাজি বা ডাল। এটা হচ্ছে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা পরিশ্রম করা একজন শ্রমিকের খাবার। বাজারের সস্তা দামের পাঙাশ, তেলাপিয়া বা সিলভার কার্প ছাড়া অন্য কোনো মাছ পাদুকাশ্রমিকদের মূলত জোটে না। শ্রমিকরা যাদের কাছ থেকে ৪০ টাকা করে প্রতি বাটি খাবার কিনে খান, তারা চাহিদামতো ভাত দিয়ে থাকে। ক্ষুধার্ত শ্রমিকরা খাওয়া বলতে বোঝে পেটভর্তি ভাত খেয়ে ক্ষুধার জ্বালা নিবারণ করা। বৈষম্যের বেড়াজালে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা সমাজে এই শ্রমিকদের অভাবক্লিষ্ট জীবনে সুষম খাদ্য খাওয়া আজীবন অধরাই থেকে যায়।

পেশাগত কারণে গ্যাস্ট্রিক, জন্ডিস, চোখের সমস্যা, চর্মরোগ ছাড়াও বয়সের একটা পর্যায়ে শ্বাসকষ্টে ভোগেন জুতা কারখানার শ্রমিকরা। পেশাগত কারণে আমাদের দেশে কত শ্রমিকের মৃত্যু হয়, রাষ্ট্রীয়ভাবে তার পরিসংখ্যান থাকলে দেশবাসী জানতে পারত পাদুকাশ্রমিকদের সংখ্যা। তারপরও পাদুকাশ্রমিকদের নেই কাজের ১২ মাসের নিশ্চয়তা, কাজ থাকলেও নেই বাঁচার মতো মজুরি। সরকারের মালিকতোষণ নীতির কারণে পাদুকাশ্রমিকরা শ্রম আইনের সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাদের দাবি নিয়ে লড়াই করার মতো সংগঠন গড়ে না ওঠায় মালিকরা বেপরোয়া শোষণ-নির্যাতন করতে পারছেন। প্রচলিত সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতো নেই তাদেরও মর্যাদা। একইসঙ্গে পেশাগত কারণে পাদুকাশ্রমিকরা প্রচলিত রাষ্ট্র, সমাজে অন্যদের থেকে আরও বেশি হেয় প্রতিপন্ন হন।

সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তন হয় না সমাজসৃষ্ট এই দৃষ্টিভঙ্গির। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ, পাকিস্তান আমলের মতো এখনো শ্রমিকদের বাঁচার মতো মজুরি, বকেয়া পাওনা, বেতন-বোনাস, সংগঠন করার অধিকার এবং ছাঁটাই-নির্যাতন বন্ধের দাবিতে লড়তে হচ্ছে। পাকিস্তান আমলেও সরকার এবং মালিকগোষ্ঠীর স্বার্থে রাষ্ট্র শ্রমিকের সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলত, বাংলাদেশ আমলেও সেই একই চিত্র। দুর্যোগ-মহামারি আর পবিত্র রমজান মাসেও সেই চিত্র বদলায় না। ১৭ এপ্রিল বাঁশখালীতে পুলিশের গুলিতে সাতজন শ্রমিকের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে আবারও বোঝা গেল রাষ্ট্র ও সরকার কখনোই সবার হয় না। সামগ্রিক মুক্তির প্রয়োজনে শোষণ থেকে মুক্তি আর মর্যাদাপূর্ণ জীবনের পূর্বশর্ত হচ্ছে একটি জাতীয় গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। যে সংগ্রাম আজ সব শোষিত-নিপীড়িত মুক্তিকামী মানুষের।

প্রকাশ দত্ত: যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ। ই-মেইল: pkdutta.dhaka@gmail.com

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •