শরীরী সৌন্দর্যের চক্কর এবং নারীর মন

নারী-পুরুষের মানস : পুরুষতান্ত্রিক ধারণা ও বৈষম্যের জৈবসামাজিক ভিত্তি-৭

শরীরী সৌন্দর্যের চক্কর এবং নারীর মন

মনিরুল ইসলাম

“কোন পরিস্থিতির কারণে একজন পুরুষ এমনকি অন্য একজন নারীও, নারীর অন্যসব গুণকে উপেক্ষা করে তার সৌন্দর্যকেই সর্বাগ্রে লক্ষ্য করে? আজকের দিনেও একজন নারী সম্পর্কে বলতে গিয়ে যে সব শব্দ আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহার করি (আমি নিজেও এই দোষ থেকে মুক্ত নই) সেগুলো মূলত সে দেখতে কেমন সেই বিষয় সম্পর্কিত… আমরা নারীদের অন্যসব গুণকে উপেক্ষা করি কারণ আমাদের বারবার সেখানো হয় সৌন্দর্যের তুলনায় নারীর অন্য সব গুণই গৌণ।”৮২

– নন্দিতা হরিহরণ, Beauty Standards – The Ugliest Trick Of Patriarchy

“সৌন্দর্যের মানদন্ডগুলো সুনির্দিষ্ট ছকে নারীর সঙ্গে তার শরীরের সম্পর্ককে বেঁধে দেয়। এই মানদন্ড থেকেই নির্দেশনা আসে তার নড়াচড়া, স্বতঃস্ফূর্ততা, দেহভঙ্গী, হাঁটাচলার ধরণ, বিভিন্ন কাজে শরীরের ব্যবহার ইত্যাদি সম্পর্কে। এর দ্বারাই নির্ধারিত হয় তার শারীরিক স্বাধীনতার মাত্রা। এবং অবশ্যই শারীরিক স্বাধীনতার সঙ্গে মানসিক বিকাশ, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্ভাবনা ও সৃজনশীল প্রতিভা গড়ে ওঠার একটি নাড়ির সম্পর্ক রয়েছে।” ৮৩

-অ্যান্ড্রিয়া ডরকিন, Woman Hating

“আমার মতে সৌন্দর্যের মানদন্ডগুলো হচ্ছে…নিপীড়নের হাতিয়ার যা লিঙ্গবৈষম্য, বর্ণবৈষম্য, সাদা-কালোয় ভেদাভেদ, শ্রেণিবৈষম্য, প্রতিবন্ধীদের প্রতি বৈষম্য, বয়স্কদের প্রতি বৈষম্য এবং লিঙ্গীয় ধারণাগুলোকে আরও শক্তিশালী করে। এগুলো তৈরি হয় আমাদের সমাজেই এবং গেঁথে যায় আমাদের মগজের ভেতরে। এগুলো আমাদের মধ্যে জাগিয়ে তোলে উৎকণ্ঠা, হতাশা, শরীরী বিকৃতি, খাদ্যঅনীহা, আত্মধ্বংসী প্রবণতা এবং আত্মমর্যাদাবোধের ঘাটতি।… কিছু মানদন্ডের ছকে বাঁধা তথাকথিত সৌন্দর্যের নামে এরকম পরিমিতিহীন, অবাস্তব, আবেগময় … ধারণাকে শিরোধার্য করছি…কী কারণে? কার সেবা করতে?”৮৪

– জেসিকা ডেফিনো, How White Supremacy and Capitalism Influence Beauty Standards

আমাদের ছেলেবেলার কথা মনে পড়ছে। তখন ঢাকা শহরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে পত্রমিতালী বা ‘পেন-ফ্রেন্ড’ করার বেশ চল ছিল। আমার চেনা এক কিশোরীর পেন-ফ্রেন্ড ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক কিশোরী । চিঠিতে চিঠিতে তাদের বন্ধুত্ব বেশ জমে উঠল। কিছুদিন পরেই মার্কিন মেয়েটি তার ছবি (ফটোগ্রাফ) পাঠায় এবং তার এদেশি বন্ধুকে অনুরোধ করে তার ছবি পাঠাতে। মার্কিন বন্ধুটি বারবার তাগাদা দেবার পরও এদেশের মেয়েটি ছবি পাঠায় না, তার ধারণা সে দেখতে ‘খারাপ’। তার এই চেহারা দেখে মার্কিন দেশের ধবধবে ‘ফর্সা-সুন্দর’ মেয়েটি ‘কী ভাববে’ ? এদেশের মেয়েটার গায়ের রং কালো, তার পিঠাপিঠি ছোট বোনটির গায়ের রং উজ্জ্বল। ছেলেবেলা থেকেই বোনের সঙ্গে বিরূপ তুলনার মুখোমুখি হয়েছে সে। তাকে বিয়ে দিতে ‘কত কষ্ট হবে’, বরপক্ষ তাকে ‘দেখতে এলে’ ছোট বোনকে ‘লুকিয়ে রাখতে হবে’, অনেকেই প্রকাশ্যে এসব কথা বলেছে। কেউ কেউ ‘পরামর্শ’ দিয়েছে এটা ওটা মাখার। পরিবারে এবং সমাজে তার অবয়ব সম্পর্কে এরকম করুণা ও হতাশার কথা তাকে আশৈশব শুনতে হয়েছে। অতএব তার শরীর আর চেহারা নিয়ে হীনমন্যতায় গভীরভাবে আক্রান্ত অন্তর্মুখী কিশোরী শেষ পর্যন্ত তার ছবি আর পাঠাতে পারে নি। একই সঙ্গে বড় হয়ে ওঠা প্রায় সমবয়সী বালকদের অনেকেরই গায়ের রং ছিল কালো, এদের কখনও গায়ের রঙ বা চেহারা নিয়ে বিশেষ কোনো দুশ্চিন্তা করতে দেখিনি। এভাবে ছোটবেলা থেকেই লক্ষ্য করেছি শারীরিক সৌন্দর্য মেয়েদের জন্য অনেক ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কিছু যা নিয়ে অধিকাংশ মেয়ে এতটাই সচেতন ও উদ্বিগ্ন থাকে যে তাদের চিন্তা, দৈনন্দিন জীবনের কার্যকলাপ এবং বেশ কিছুটা সময় এর জন্য নিয়োজিত থাকে। এর কারণ জানতে গভীর কোনো গবেষণার প্রয়োজন হয় না, আমাদের আশে পাশে তাকালেই আমরা দেখি এই সমাজে বাহ্যিক বা শারীরিক সৌন্দর্যই নারীর গ্রহণযোগ্যতার মুখ্য মাপকাঠি, আর সব গুণই গৌণ। ‘আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী’ প্রবাদটি আমাদের সমাজে বেশ প্রচলিত। এর অন্য অর্থ থাকতে পারে কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে এর অর্থ হচ্ছে দেখতে ভাল না হলে তোমার অন্য সব গুণও কেউ খুঁজতে যাবে না। শরীরী সৌন্দর্যকে ঘিরে এই করুণ বাস্তবতা নারীর মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।

এ সমাজে নারীকে সুন্দর হতেই হবে, সৌন্দর্যই এখানে তার অস্তিত্বের আসল সার্থকতা বলে স্বীকৃত। পৌরাণিক কাহিনী থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বেশিরভাগ সাহিত্যে নারীর যেসব বন্দনা ও গুণকীর্তন রয়েছে তা মূলত তার দৈহিক সৌন্দর্যের। ছোটবেলা থেকে শুরু করে এবং বড় হয়েও তারা যে সব কাহিনি পড়ে বা নাটক ও সিনেমায়  যে কাহিনি দেখে তার সবই ‘সুন্দরী’ মেয়েদের ঘটনা। এসব পড়ে বা দেখে মনে হয় নারীর দৈহিক সৌন্দর্যই পুরুষের রোমান্টিক প্রেম জাগিয়ে তোলার প্রধান উদ্দীপক এবং এর যৌক্তিকতাকে ধরে রাখার মূল প্রেরণা। প্রেম হোক, বিয়ে হোক অধিকাংশ পুরুষই এসব সম্পর্কে নারীর প্রতি অনুগৃহিত ও বাধিত থাকে যত দিন তার দৈহিক সৌন্দর্যের প্রতি সে আকৃষ্ট থাকে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই মেয়েদের পত্রিকা ও ফ্যাশন ম্যাগাজিনের মডেল হন সমাজের দৃষ্টিতে সুন্দরী ও যৌন আবেদনময়ী নারীরা। গবেষণায় দেখা গেছে পশ্চিমা বিশ্বে অধিকাংশ নারীর ‘রোল-মডেল’ও সুন্দরী নারীরা। কিন্তু অধিকাংশ পুরুষের রোল-মডেল সুদর্শন পুরুষেরা নন। তবে অধিকাংশ পুরুষের কাছে নারীর গ্রহণযোগ্যতার প্রধান উপাদান তার শারীরিক সৌন্দর্য ও যৌন আবেদন। উন্নত এবং অনুন্নত বেশিরভাগ সমাজে এখনও অধিকাংশ নারীকে পুরুষের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। অতএব পুরুষের কাছে তার উৎকৃষ্টতা ও গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠিতেই প্রধানত সমাজে নারীর উৎকৃষ্টতা ও গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারিত হয়।

প্রায় সব ক্ষেত্রেই মেয়েদের পত্রিকা ও ফ্যাশন ম্যাগাজিনের মডেল হন সমাজের দৃষ্টিতে সুন্দরী ও যৌন আবেদনময়ী নারীরা। গবেষণায় দেখা গেছে পশ্চিমা বিশ্বে অধিকাংশ নারীর ‘রোল-মডেল’ও সুন্দরী নারীরা। কিন্তু অধিকাংশ পুরুষের রোল-মডেল সুদর্শন পুরুষেরা নন।

সৌন্দর্যের পুরুষতান্ত্রিক মানদন্ডে উত্তীর্ণ হবার যন্ত্রণাদায়ক নির্মম যাত্রা

সমস্যা হল পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর সৌন্দর্য বলতে যা বোঝায় তা সার্বজনীন নান্দনিক কিছু নয়। বরং নির্দিষ্ট একটি সমাজে সৌন্দর্যের নির্দিষ্ট কিছু মানদন্ড থাকে, সেই মানদন্ডে উত্তীর্ণ হলেই তাকে সুন্দর বলা হয়। এই মানদন্ড অনেকগুলো বিষয়ের সমন্বয়ে তৈরি হয়, তবে এর প্রধান দিক হল যৌন আবেদন। সাহারা মরুভূমির দেশ মৌরিতানিয়ায় পুরুষদের কাছে স্থ’লকায় অর্থাৎ মোটা মেয়েদের যৌন আবেদন সবচেয়ে বেশি। ওই দেশে ছোটবেলা থেকে মেয়েদের জোর করে বেশি খাইয়ে মোটা করা হয়। অন্য দিকে পশ্চিমা বিশ্বের পুরুষের কাছে ‘স্লিম’ নারীদের যৌন আবেদন বেশি অতএব ওই সমাজে মেয়েরা না খেয়ে থেকে ওজন কমাতে চায়। এই উপমহাদেশের পুরুষের কাছে উজ্জ্বল গায়ের রঙের আবেদন বেশি। অতএব এদেশের মেয়েরা নানা উপায়ে ত্বক উজ্জ্বল করার চেষ্টা চালায়। তবে বিশ্বায়নের এই যুগে অর্থনৈতিকভাবে অধিপতি দেশের কালচার ও সৌন্দর্যের মানদন্ড দ্রুত ছড়িয়ে যায় অধীনস্ত দেশগুলোতে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে প্রচার মাধ্যম এবং পণ্যের বিপনন ও বিজ্ঞাপন।

সমাজের সৌন্দর্যের মানদন্ডে আদর্শ সৌন্দর্য এক অবাস্তব লক্ষ্য যা অর্জনের যাত্রাও যন্ত্রণাবিদ্ধ। এ যন্ত্রণা শারীরিক এবং মানসিক। বেশিরভাগ নারীই জীবনের কোনো না কোনো সময় এই যাত্রায় শামিল হয় বা হতে বাধ্য হয়। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা দেখি পুরুষের দৃষ্টিতে ‘সুন্দর’ ও যৌন আবেদনময়ী হবার জন্য নারীকে অবর্ণনীয় শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যে যেতে হচ্ছে। এখনও অনেক সমাজে এমন ঘটনা ঘটছে। সৌন্দর্যের জন্য জোরপূর্বক এ ধরনের শারীরিক এবং মানসিক যন্ত্রণা চাপিয়ে দেবার চরম উদাহরণ হচ্ছে চীনের মেয়েদের ‘সৌন্দর্য বৃদ্ধির’ জন্য ছোটবেলা থেকে পায়ের পাতার যন্ত্রণাদায়ক বাঁধন। এই নিষ্ঠুর প্রথার যন্ত্রণা কতটা অসহনীয় ও নির্মম তা ভুক্তভোগী নারীদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা থেকে কিছুটা আঁচ করা যায়। দশম শতক থেকে একহাজার বছর টিকে থাকা এই প্রথা বাতিল হবার পর ১৯৩৪ সালে এক বৃদ্ধ চীনা নারী তার নির্মম অভিজ্ঞতার কথা বলেন এভাবে-

“ পায়ের পাতা বাঁধার যন্ত্রণা আমার উপর চাপানো হয় যখন আমার বয়স সাত বছর। আমি ছিলাম দুরন্ত এবং লাফ ঝাঁপ দিতে পছন্দ করা একটি বাচ্চা কিন্তু ঐ সময় থেকে আমার মুক্ত ও আশাবাদী মনটা মরে গেল।…আমি কাঁদছিলাম এবং প্রতিবেশীর বাড়িতে লুকিয়ে ছিলাম কিন্তু মা আমাকে মারতে মারতে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এলেন…পায়ের আঙ্গুল জোর করে বাঁকিয়ে পায়ের তলায় ঠেকানো হল এরপর দশ ফুট লম্বা এবং দুই ইঞ্চি চওড়া কাপড় দিয়ে কষে প্রথমে ডান পা এবং পরে  বাম পা বাঁধা হল । মা আমাকে (জুতো পরে) হাঁটতে বললেন এতে পায়ে অসহনীয় যন্ত্রণা হতে থাকল। ওই দিন রাতে মা আমাকে জুতো খুলতে দেন নি। সারা রাত আমি ঘুমাতে পারিনি, আমার মনে হচ্ছিল আমার পায়ে কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আমি কাঁদলে আমাকে মারা হয়েছে। পরের কয়েক দিনও আমাকে ঐ জুতো পরে হাঁটতে বাধ্য করা হয়। …প্রতি দু-সপ্তাহ পর পর আগের জুতা বদলে নতুন জুতা পরতে হত। প্রত্যেক নতুন জোড়া ছিল আগের জোড়ার চেয়ে এক ইঞ্চির পাঁচভাগের একভাগ ছোট।…এভাবে দশের অধিক জোড়া জুতা বদলে পা চার ইঞ্চির কাছাকাছি আকার পেল।”৮৫

চিত্র-১: চীন দেশে মেয়েদের পায়ের পাতা বাঁধার পর এর দুরবস্থা

এই কাঙ্ক্ষিত ‘সৌন্দর্য’ পুরুষের মনোরঞ্জন বা পুরুষের কাছে যৌন আবেদন সৃষ্টির জন্যেই। পায়ের পাতা ছোট ও বিকৃত হওয়াতে উরু ও নিতম্বে কিছুটা টান পড়াতে এগুলো কিছুটা ফোলা দেখাত, যা চীনা পুরুষদের কাছে বেশ ‘রসালো’ মনে হত।৮৬ চীনাদের ধারণা ছিল এর মাধ্যমে যৌনাঙ্গের আবেদনও বাড়ে। তাদের ভাষায়-

“নারীর পা যত ছোট হবে তত বিস্ময়কর হয়ে উঠবে যোনির ভাঁজগুলো। অতএব এসব নারীদের (যাদের পায়ের পাতা ছোট) অন্য নারীদের আগেই বিয়ে হয়ে যায়।”৮৭

যেহেতু বিয়ে বা বিয়ের বাইরে পুরুষের ভোগে লাগা এবং তাদের সন্তানের জন্ম দেয়াই ছিল এসব নারীদের সমাজ-নির্দিষ্ট ভূমিকা অতএব মেয়েকে পাত্রস্থ করার স্বার্থেই পরিবারের সদস্যরাই মেয়েদেরকে এই চরম যন্ত্রণার মধ্যে নিয়ে যেত।

বলপূর্বক কিশোরীদের সৌন্দর্য বাড়ানোর যন্ত্রণাদায়ক কিছু প্রথা এখনও বিভিন্ন দেশে রয়ে গেছে। আফ্রিকা মহাদেশের মৌরিতানিয়া, নাইজার, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা ইত্যাদি অনেকগুলো দেশের গ্রামাঞ্চলে বিয়ের আগে ‘সৌন্দর্য বাড়াবার জন্য’ পাঁচ থেকে উনিশ বছরের মেয়েদের বলপূর্বক খাইয়ে মোটা করা হয়। কারণ এ অঞ্চলের পুরুষদের কাছে মোটা মেয়েদের অধিক ‘সুন্দর’ ও যৌন আবেদনময়ী বলে মনে হয়। লেবলো (Leblouh ) নামক বালিকাদের মোটাতাজা করার এ পদ্ধতির সঙ্গে আমাদের দেশে কোরবানির আগে গরু-ছাগল মোটাতাজা করণের অনেক মিল আছে। মরুভূমির মধ্যে ‘বিশেষ ক্যাম্প’ করে বালিকাদের একদিনে ষোল হাজার কিলো-ক্যালরি পরিমাণের খাবার খাওয়ানো হয় যা তার

চিত্র-২: মোটা-তাজা করার জন্য আফ্রিকার মৌরিতানিয়ায় একটি মেয়ে শিশুকে জোর করে খাওয়ানো হচ্ছে।

দৈনিক স্বাভাবিক চাহিদার সাত থেকে দশগুণ। কয়েক মাসব্যাপী এই জোর করে খাওয়ানো মেয়েদের জন্য ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক ও অস্বস্তিকর। অনেক মেয়ে এতে অসুস্থ হয়ে পরে। গরু মোটাতাজা-করণের মত এখানেও ‘দ্রুত ফল পাবার জন্য’ অনেক পরিবার মেয়েদেরকে পশুকে খাওয়ানোর স্টেরয়েড বড়ি খেতে দেয় যার অনেক মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে।

গরু মোটাতাজা-করণের মত এখানেও ‘দ্রুত ফল পাবার জন্য’ অনেক পরিবার মেয়েদেরকে পশুকে খাওয়ানোর স্টেরয়েড বড়ি খেতে দেয় যার অনেক মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে।

হাজার বছর ধরে চলে আসা এই নিষ্ঠুরতম প্রথাগুলি যার নির্মমতায় লক্ষ লক্ষ বালিকা ও কিশোরীকে অঙ্গহানী ও পঙ্গুত্বের শিকার হতে হয়েছে তার অপরাধের পরিমাণ সীমাহীন। কিন্তু সভ্যতার আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন সমাজ ও সংস্কৃতিতে পুরুষের ভোগ ও মনোরঞ্জনের কারণে নারীর শারীরিক ও মানসিক আত্মাহুতি দেবার যে রীতিনীতি ও আচার চলে আসছে তার তুলনায় এই হাজার বছর এক ক্ষুদ্র কিন্তু নির্মম ও ভয়াবহতম অংশ। এই বাস্তবতা থেকে যে বিষয়টি মূর্ত হয়ে ওঠে তা হচ্ছে নারীর প্রতি পুরুষের প্রেম, কামনা, পুলক ও ভোগ-সুখ ইত্যাদির চরিতার্থ করার জন্য প্রয়োজন হয় নারীর ব্যক্তি-সত্ত্বাকে অগ্রাহ্য করার, তাকে শারীরিক ভাবে অক্ষম এবং মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার।৮৮যেন সে মানুষ নয় পুরুষের ভোগের বস্তু মাত্র, ভোগের জন্য অধিক উপযোগী করতে তাকে যেমন ইচ্ছা তেমন ভাবে কেটে ছিঁড়ে তৈরি করে নেয়া যাবে।

আধুনিক বিশ্বে সৌন্দর্যের জন্য নারীদের উপর পরিবার ও সমাজের প্রত্যক্ষ জবরদস্তি কমে গেলেও তাদের সৌন্দর্যের দৌড় কমেনি। এ যুগে সৌন্দর্যের ভূত অন্যভাবে নারীর ঘাড়ে চেপেছে। ফ্যাশন ও কসমেটিক ইন্ডাস্ট্রির বাণিজ্য এবং ‘সর্বত্রগামী’ প্রচার মাধ্যমের উপর সওয়ার হয়ে সৌন্দর্য চর্চার পুরানো বৃক্ষ বহু শাখা-প্রশাখা মেলেছে। ‘নিখুঁত’ সৌন্দর্য পাবার জন্য শরীরের এমন কোনো অঙ্গ নেই যার পরিচর্যা এ যুগের নারীরা করে না। ৩ নং ছবিতে লক্ষ্য করুন- চুল থেকে পায়ের নখ এবং মুখ থেকে যোনি পর্যন্ত নারীর শরীরের সর্বত্রই এই কসমেটিক চর্চার দৌরাত্ম। শরীরকে সৌন্দর্যের মানদন্ডে উত্তীর্ণ করার জন্য যে সব অঙ্গ ও অংশে।

চুল থেকে পায়ের নখ এবং মুখ থেকে যোনি পর্যন্ত নারীর শরীরের সর্বত্রই এই কসমেটিক চর্চার দৌরাত্ম। শরীরকে সৌন্দর্যের মানদন্ডে উত্তীর্ণ করার জন্য যে সব অঙ্গ ও অংশে।পরিবর্তন আনা হয় সেগুলো হচ্ছে- চুল, ভুরু, চোখ, নাক, কান, ঘাড় ও কাঁধ, ঠোঁট, থুতনি,বগল,কব্জা,হাতের নখ, স্তন ও স্তনের বোঁটা, পেট, নাভি, যৌনাঙ্গ, নিতম্ব, উরু, পা (Leg), পায়ের পাতা (Foot), পায়ের নখ ইত্যাদি।

চিত্র-৩ : সৌন্দর্য (চর্চা)ক্ষত-বিক্ষত করে (মাথা থেকে পায়ের নখ, মুখ থেকে যোনি পর্যন্ত কোনো স্থানের রক্ষা নেই এই চর্চার আগ্রাসন থেকে)।

পরিবর্তন আনা হয় সেগুলো হচ্ছে- চুল, ভুরু, চোখ, নাক, কান, ঘাড় ও কাঁধ, ঠোঁট, থুতনি,বগল,কব্জা,হাতের নখ, স্তন ও স্তনের বোঁটা, পেট, নাভি, যৌনাঙ্গ, নিতম্ব, উরু, পা (Leg), পায়ের পাতা (Foot), পায়ের নখ ইত্যাদি। কৈশোর থেকে চেপে বসা এইসব ‘চর্চা’ যন্ত্রণাদায়ক এবং ব্যয়বহুল। প্লাস্টিক সার্জারি, স্তন ও নিতম্বে কৃত্রিম ইমপ্লান্ট বসানো, হেয়ার ইমপ্লান্ট, লাাইপো-সাকসন (অপারেশনের মাধ্যমে চর্বি অপসারণ), ওয়াক্সিং (যৌনাঙ্গ বা অন্যস্থানের লোমকূপসহ লোম অপসারণ) ইত্যাদি বেশি যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়া। ভ্রু-প্লাক ও মুখমন্ডলের চুল তোলা, চুল রঙ করা, নিতম্ব গার্ডলিং, উরুতে গার্টার পড়া ইত্যাদি মাঝারি ধরণের যন্ত্রণার। এছাড়া মেক-আপ ও অন্যান্য অস্থায়ী কসমেটিক লাগানো ও ওঠানো, ফেসিয়াল, চুলকাটা ইত্যাদির যন্ত্রণা কম হলেও ঝামেলা কম নয়। সৌন্দর্য রক্ষার আরেকটি অতি যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়া হল ডায়েটিং অর্থাৎ স্লিম হবার জন্য কষ্টদায়কভাবে কম খাওয়ার অভ্যাস করা। যা পশ্চিমা বিশ্বে গত শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয় এবং এখনও ওইসব দেশেই বেশি প্রচলিত। তবে সৌন্দর্যের মানদন্ডের বিশ্বায়নের কারণে এখন তা অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে গেছে। ডায়েটিং-এর অবসেসন থেকে খাদ্যে-অনীহা রোগ বা অ্যানোরেক্সিয়ার প্রাদুর্ভাব পশ্চিমা বিশ্বে ব্যাপক। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে ১৪-১৫ বছরের মেয়েদের মধ্যে এর প্রাদুর্ভাব ১৭.৯% এবং একই বয়সের ছেলেদের মধ্যে মাত্র ০.২% অর্থাৎ, নেই বললেই চলে।৮৯

শরীরের পরিবর্তন ছাড়াও নারীর সৌন্দর্যের বড় অনুষঙ্গ হচ্ছে পোশাক, জুতো ও গয়না। এগুলোর ক্ষেত্রেও সৌন্দর্যের মানদন্ডে উত্তীর্ণ হবার জন্য নারীকে কষ্ট ও যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ফ্যাশনেবল অনেক পোশাক, জুতো ও গয়না এই যন্ত্রণার উৎস। প্রাচীন কাল থেকেই গয়না পড়ার জন্য শরীরে বিভিন্ন অংশে ছিদ্র করতে হতো, বিশেষত নারীদের। ভিক্টোরিয় যুগে পেট চাপানো করসেটের প্রচলন ঘটে। আধুনিক যুগের ফ্যাশনে যন্ত্রণাদায়ক পোশাকের মধ্যে রয়েছে শেপ ওয়ার, ব্যান্ডেজ ড্রেস, থং আন্ডার ওয়্যার, পুশ-আপ ব্রা, স্ট্র্যাপলেস ব্রা ইত্যাদি। যন্ত্রণাদায়ক পাদুকার মধ্যে রয়েছে পিন-টো, পেনসিল হাইহিল ইত্যাদি। নতুন ফ্যাশনের বিজ্ঞাপন দেখে কিংবা প্রচার মাধ্যমে নায়িকা ও মডেলদের পরনে এসব পোশাক, অন্তর্বাস, জুতো বা গয়না দেখে সাধারণ মেয়েরাও এই যন্ত্রণার পথে হাঁটে।

সৌন্দর্যের সংস্কৃতির কব্জায় নারীর শরীর মন

সৌন্দর্য রক্ষা ও সৌন্দর্য বাড়ানোর নানা দক্ষযজ্ঞের সঙ্গে মেয়েরা জড়িয়ে যায় খুব ছোটবেলা থেকেই। অধিকাংশ মেয়েদের মধ্যে এগুলো আসে তার পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ নারী এবং অন্যান্য পারিপার্শ্বিকতা থেকে। উচ্চ বা মধ্যবিত্ত ঘরের ছোট মেয়েটাকে তার মা রোদে খেলতে যেতে দেয় না গায়ের রং কালো হয়ে যাবে বলে কিংবা সে ‘বেশি মাংশল’ হয়ে যাবে বলে। এ সমাজের সৌন্দর্যের মানদন্ড অনুযায়ী পরিবারের মেয়েরাই তাকে শেখায়, তাকে লম্বা চুল রাখতে হবে, চুলের যত্ন নিতে হবে। তাকে ত্বকেরও যত্ন নিতে হবে এটা ওটা মাখতে হবে। প্রথমে পরিবারের সদস্য ও সমবয়সীদের কাছ থেকে এরপর মিডিয়া, ফ্যাশন, বিজ্ঞাপন ইত্যাদির মাধ্যমে তারা ওই সমাজের সৌন্দর্যের মাপকাঠি সম্পর্কে ‘সচেতন হয়’। এই ‘সচেতনতা’ তাদের মধ্যে তৈরি করে অপূর্ণতা, হতাশা ও হীনমন্যতার বোধ কারণ তথাকথিত আদর্শ সৌন্দর্যের অবাস্তব মানদণ্ডে প্রাকৃতিকভাব উত্তীর্ণ হওয়া বোধ হয় কোনো নারীর পক্ষেই সম্ভব নয়। আমার গায়ের রঙ এমন কেন? আমার চামড়া এত রুক্ষ কেন? আমার নাকটা বেশি চ্যাপ্টা কেন? আমার স্তন যথেষ্ট বড় নয় কেন? অল্প বয়স থেকেই নিজের শরীরের অপূর্ণতা নিয়ে এ ধরণের প্রশ্ন এবং এ সংক্রান্ত নানা উৎকণ্ঠা জেগে ওঠে তার মনে। আদর্শ সৌন্দর্যের কাছাকাছি যাওয়ার বাসনা বেশিরভাগ কিশোরী ও তরুণীকে আচ্ছন্ন করে।

এই ‘সচেতনতা’ তাদের মধ্যে তৈরি করে অপূর্ণতা, হতাশা ও হীনমন্যতার বোধ কারণ তথাকথিত আদর্শ সৌন্দর্যের অবাস্তব মানদন্ডে প্রাকৃতিকভাব উত্তীর্ণ হওয়া বোধ হয় কোনো নারীর পক্ষেই সম্ভব নয়। আমার গায়ের রঙ এমন কেন? আমার চামড়া এত রুক্ষ কেন? আমার নাকটা বেশি চ্যাপ্টা কেন? আমার স্তন যথেষ্ট বড় নয় কেন? অল্প বয়স থেকেই নিজের শরীরের অপূর্ণতা নিয়ে এ ধরণের প্রশ্ন এবং এ সংক্রান্ত নানা উৎকণ্ঠা জেগে ওঠে তার মনে। আদর্শ সৌন্দর্যের কাছাকাছি যাওয়ার বাসনা বেশিরভাগ কিশোরী ও তরুণীকে আচ্ছন্ন করে।

কসমেটিক ও ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির প্ররোচনায় মিডিয়া ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই বাসনা আরও প্রবল হয়। সৌন্দর্য সামগ্রী (কসমেটিক) বেচে নারীদের মধ্যে প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী ব্যক্তি হয়েছিলেন হেলেনা রুবেইনস্টেইন। বিশ শতকের প্রথম দশকে তিনিই প্রথম ‘আবিষ্কার’ করেন যে মেয়েদের ‘শুষ্ক’, ‘স্বাভাবিক’ ও ‘ তৈলাক্ত’ এই তিন রকমের ত্বক রয়েছে। তার এই প্রচারের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না থাকলেও এই প্রচারণার ফলে তার ভালাজ (Valaze) ব্র্যান্ডের তিন ধরণের ত্বকের ক্রিমের ব্যাপক কাটতি হয়েছিল। তাদের প্রচারণায় বিভ্রান্ত নারীরা ত্বকের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে (যেমন, তেল জাতীয় পদার্থ নিঃসরণ, ত্বকের উপরিস্তরে মৃত কোষ থাকা বা ত্বকে বলীরেখা দেখা দেওয়া ইত্যাদি) এর ঘাটতি বলে মনে করতে থাকে।৯০ এই ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন স্বার্থবাদী গোষ্ঠী নানা গালগপ্প দিয়ে সৌন্দর্যের কৃত্রিম ও অবাস্তব মানদন্ডকে টিকিয়ে রাখে এবং এর উপর নানাভাবে ‘রঙ চড়ায়’ এবং এ সমাজের অধিকাংশ নারীকে এর চক্করে ফেলতে সহায়তা করে।

নারীর বাহ্যিক অবয়ব কেমন হবে সৌন্দর্যের মানদন্ডগুলো শুধু সে নির্দেশ দেয় তাই নয়, এগুলো নারীর চলাফেরা, দেহভঙ্গি, কথাবলা এবং আচার-আচরণ সম্পর্কেও নির্দেশনা দিয়ে থাকে। যেনতেন ভাবে বাইরে যাওয়া যাবে না, ফিটফাট হয়ে বের হতে হবে যেন তার ‘লুক’ সম্পর্কে খারাপ ধারণা না হয়। ‘সুন্দর’ দেখায় এমনভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে তাকে পোশাক ও সাজগোজ দিয়ে। পুরুষের কাঙ্ক্ষিত নারীরূপই সুন্দরের আদর্শ, সমাজের কাঙ্ক্ষিত নারীরূপও তাই। এই আদর্শ নারীরূপের সঙ্গে দৌড়ঝাঁপ এমনকি ধুমধাম করে নড়াচড়াও মানায় না, চেঁচিয়ে কথা বলা বা অট্টহাসিও না। এ সমাজের সৌন্দর্যের মানদণ্ডে আদর্শ নারী হবে ‘গোলাপের মত সুন্দর ও কোমল’। এই মানদণ্ডই বলে দেয় ব্যক্তি নারীর সঙ্গে তার শরীরের সম্পর্ক কেমন হবে। এসব নির্দেশনা নারীর শারীরিক স্বাধীনতার উপর এমন অনেক সীমাবদ্ধতা আরোপ করে যা তার সমবয়সী পুরুষের ক্ষেত্রে থাকে না। শারীরিক স্বাধীনতার ঘাটতি তার মানসিক বিকাশ, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্ভাবনা ও সৃজনশীল প্রতিভাকে মুক্তভাবে গড়ে উঠতে দেয় না।

এই আদর্শ নারীরূপের সঙ্গে দৌড়ঝাঁপ এমনকি ধুমধাম করে নড়াচড়াও মানায় না, চেঁচিয়ে কথা বলা বা অট্টহাসিও না। এ সমাজের সৌন্দর্যের মানদন্ডে আদর্শ নারী হবে ‘গোলাপের মত সুন্দর ও কোমল’।

ত্বকের যত্ন, চুলের যত্ন, পোশাক ও সাজগোজের ফ্যাশান ও স্টাইলের প্রতি মেয়েদের সময়, আগ্রহ ও মনোযোগ এতটাই কেন্দ্রীভূত হয় যে জীবন জগতের অনেক কিছুই তাদের লক্ষ্য ও আগ্রহের বাইরে থেকে যায়। একই বয়সী পুরুষের তুলনায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সমাজ-সংস্কৃতির প্রতি তাদের কৌতূহল ও সময় দেওয়ার প্রবণতা কম থাকে। এর কারণ এসব ক্ষেত্রে তাদের আগ্রহের ঘাটতি, ক্ষমতার ঘাটতি নয়। সাজ-পোশাকের এই চক্কর মেয়েদের বেশিরভাগ আগ্রহ ও পছন্দকে একটি ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ করে ফেলে। এখন পর্যন্ত আমাদের সমাজে শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সমাজের বাইরে বেশিরভাগ মেয়েকেই কৈশোরেই বিয়ে দেওয়া হয়। যেসব মেয়েরা শিক্ষার সুযোগ পায় এমনকি যারা উচ্চ পর্যায়ে শিক্ষিত হয় তাদেরও বেশির ভাগের ক্ষেত্রে ‘ভাল বিয়ে’ হওয়া পরিবারের জন্য সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর জন্য মেয়েটির উপরও যথেষ্ট চাপ থাকে। অতএব সামাজিক মানদন্ডে ‘সুন্দর’ হওয়ার বা থাকার জন্য চেষ্টা চালানো এবং এর জন্য সময় দেওয়া থেকে বিরত থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। বিয়ের পরেও স্বামীর সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক’ ধরে রাখতে শরীরের সৌন্দর্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী নারীও সন্তানের কারণে, সামাজিক কারণে বিয়ে টিকিয়ে রাখতে চায়। আর বেশিরভাগ বিবাহিত নারীই অর্থনৈতিকভাবে স্বামীর উপর নির্ভরশীল। অতএব, শারীরিক সৌন্দর্যের চক্কর বৃদ্ধ হবার আগে নারীকে ছাড়ে না। তার শারীরিক ও মানসিক স্বাধীনতাকে খর্ব করে এবং তার সৃজনশীল সম্ভবনার অনেক পথ বন্ধ করে দেয়।

পিউবার্টির পর স্ত্রী প্রাণীর শরীর প্রজননের জন্য যেভাবে পরিবর্তিত হয় তা প্রাকৃতিকভাবেই পুরুষ প্রাণীর কাছে যৌন আবেদন সৃষ্টি করে। এটা সব প্রাইমেট এমনকি স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রেই সত্য। মানুষের কাছাকাছি প্রজাতিসহ বেশিরভাগ প্রাণীর ক্ষেত্রেই পুরুষ প্রাণীই সাধারণত প্রণয় প্রার্থী হয়। তারা ‘প্রাকৃতিক সাজসজ্জা’ বা অন্য কোনো উপায়ে স্ত্রী-প্রাণীকে আকৃষ্ট করতে চায় এবং স্ত্রী প্রাণী সাধারণত ‘সাজসজ্জা’ করে না। মানুষের ক্ষেত্রে বিষয়টি বিপরীত হবার কারণ তাই প্রাকৃতিক নয়। সাজসজ্জা দিয়ে একটি নির্দিষ্ট মানদন্ডে নারীদের সুন্দর হবার ব্যাপারটিও কৃত্রিম। এই মানদন্ডও সার্বজনীন নয়, বিভিন্ন কালে, বিভিন্ন সমাজে তা ভিন্ন ও পরিবর্তনশীল। সমাজের নানা বিষয় এই মানদন্ডকে প্রভাবিত করে। এজন্য নারী ও পুরুষ কেউই জন্মগতভাবে এই মানদণ্ডের প্রতি অনুগত হয় না বরং সমাজই তাদের তাদের সামনে তা উপস্থাপন করে। দুই শতক আগে চীনে জন্মানো পুরুষদের কাছে মেয়েদের ছোট এবং বিকৃত পা’ই বেশি সুন্দর মনে হত। এখন চীনের পুরুষেরা তা মনে করে না।৯১ একসময় মেয়েদের তেল-দেওয়া বেণি-করা চুল, মিশি-দেওয়া দাঁত এদেশের পুরুষদের কাছে সুন্দর বলে মনে হত। এখন মনে হয় না। সৌন্দর্যের এই কৃত্রিম মানদন্ড যে পাল্টায় তা আমরা নতুন ফ্যাশন ও স্টাইল এলেই দেখতে পাই ।

মানুষের কাছাকাছি প্রজাতিসহ বেশিরভাগ প্রাণীর ক্ষেত্রেই পুরুষ প্রাণীই সাধারণত প্রণয় প্রার্থী হয়। তারা ‘প্রাকৃতিক সাজসজ্জা’ বা অন্য কোনো উপায়ে স্ত্রী-প্রাণীকে আকৃষ্ট করতে চায় এবং স্ত্রী প্রাণী সাধারণত ‘সাজসজ্জা’ করে না। মানুষের ক্ষেত্রে বিষয়টি বিপরীত হবার কারণ তাই প্রাকৃতিক নয়।

সৌন্দর্য চর্চার বাস্তবতা এবং নারীর মন

নিজের বাহ্যিক অবয়ব নিয়ে অতৃপ্তিই আধুনিক সমাজের নারীদের তাড়িয়ে বেড়ায়, তাদের মধ্যে তৈরি করে হীনমন্যতা ও অপূর্ণতার বোধ। কারণ সৌন্দর্যের অবাস্তব সামাজিক মানদন্ডে নিজেকে বিচার করতে গিয়ে কোনো নারীই তৃপ্ত হতে পারে না। এই মানদন্ডের আদর্শ রেখা থেকে বিভিন্ন মাত্রায় যে যত নিচে থাকে এই অতৃপ্তির পরিমাণ ততই বাড়তে থাকে। রূপকথার রানির মত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন তার মধ্যে জেগে ওঠে শরীর আর সৌন্দর্য নিয়ে উদ্বেগ। গায়ের রঙ, ত্বকের ধরণ, ত্বকের লোম, শরীরের আকার ও ওজন, মুখমন্ডলের গঠন, স্তন, নিতম্ব ইত্যাদি যতদিকে পুরুষের আগ্রহ আছে বা অন্যভাবে বলা যায় শরীরের যে অংশেরই যৌন আবেদন আছে সেই অংশ নিয়ে খুঁতখুঁতে ভাব নারীকে আচ্ছন্ন করে। এই উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে তোলে সামাজিক পরিবেশের কয়েকটি দিক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ১)  প্রেম ও বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়েদের প্রধান যোগ্যতা হিসেবে আসে সৌন্দর্য, পুরুষের ক্ষেত্রে প্রধান যোগ্যতা অর্থনৈতিক ক্ষমতা । ২) পেশাগত দক্ষতা বিচারে মেয়েদের ক্ষেত্রে সৌন্দর্যকে একটি অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে দেখা হয় এবং কিছু কিছু পেশায় সুন্দরী না হলে মেয়েদের কোনো সুযোগই থাকে না। যেমন- রিসিপশনিস্ট, এয়ার হোস্টেস, রেস্টুরেন্টের ওয়েটার ইত্যাদি। ৩) বাণিজ্য, প্রচার-মাধ্যম ও বিজ্ঞাপনে আদর্শ নারী হিসেবে কেবল সুন্দরীরাই থাকে। এই নারীদের সামনে রেখে সত্য মিথ্যা মিলিয়ে সৌন্দর্য-চর্চার নানা অনুষঙ্গ তৈরি করে বাণিজ্যিক প্রচারণা।

এই পরিবেশে বেড়ে ওঠা অনেকের মধ্যেই সৌন্দর্য বাড়ানোর আকাঙ্ক্ষা ও প্রবণতা এতটাই গভীর হয় যে তা থেকে এক ধরণের অবসেসন (Obsession) বা অপরাপর মনোবৈকল্য দেখা দেয়। মার্কিন দেশের টেলিভিশনের জনপ্রিয় অপরাহ উইনফ্রে শো-এর একটি পর্বে উপস্থিত করা হয়েছিল সেই নারীদের যাদের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা গুরুতর অবসেসনজনিত মানসিক রোগে পরিণত হয়েছে। আটাশ বছর বয়সী এক তরুণী বিগত দশ বছরে ছাব্বিশবার প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছেন মুখমণ্ডল ও শরীরের নানান ‘ঘাটতি’ দূর করার জন্য। মেয়েটির চেহারা এখন অনেকটাই ডিজনির বারবি’র মত দেখতে। তার পরেও তিনি সন্তুষ্ট নন এবং ‘নিখুঁত’ হবার বাসনায় আরও ‘অনেক কিছু’ করতে চান । অধিকাংশ মেয়েদের অবস্থা এতটা চরম না হলেও (বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে) পশ্চিমা বিশ্বে ১৫ থেকে ৬৫ বৎসর পর্যন্ত বেশিরভাগ নারী তাদের বর্তমান অবয়ব (ইংরেজিতে যাকে বলে ‘লুক’) নিয়ে সন্তুষ্ট নন এবং পরিবর্তনে আগ্রহী। গত শতাব্দীর ৮০’র দশক থেকে পশ্চিমা নারীরা অধিক হারে সাবলম্বী হচ্ছে এবং ক্ষমতার কাঠামোর মধ্যে ঢুকছে। কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় এই সময় থেকেই মার্কিন মেয়েদের মধ্যে অধিক সুন্দর (স্লিম) হবার জন্য খাদ্য-অনিহা বাতিক (eating disorders) ব্যাপকহারে বেড়েছে এবং দেখা যাচ্ছে এ সময় থেকেই চিকিৎসা শাস্ত্রের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল একটি শাখা হিসেবে চলে এসেছে কসমেটিক সার্জারি, যার শতকরা পঁচাশি জন খদ্দের নারী।৯২

আটাশ বছর বয়সী এক তরুণী বিগত দশ বছরে ছাব্বিশবার প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছেন মুখমণ্ডল ও শরীরের নানান ‘ঘাটতি’ দূর করার জন্য। মেয়েটির চেহারা এখন অনেকটাই ডিজনির বারবি’র মত দেখতে। তার পরেও তিনি সন্তুষ্ট নন এবং ‘নিখুঁত’ হবার বাসনায় আরও ‘অনেক কিছু’ করতে চান ।

এই বাস্তবতা নারীর জীবনযাপন ও মনোজগতে গভীর প্রভাব ফেলে। নারীর মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও হতাশার এক বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায় তার শরীর ও তার বাহ্যিক অবয়ব। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে যে প্রাকৃতিক পরিবর্তন ঘটে তাকেও মেনে নিতে কষ্ট হয় তার। যে নারী সৌন্দর্যের মানদন্ডের যত নিচে থাকে তার হীনমন্যতা, অপূর্ণতাবোধ, হতাশা তত বেশি হয় এবং আত্ম-প্রত্যয়ের মাত্রাও তত কমে যায়। হীনমন্যতা আরও বাড়ে যখন সৌন্দর্যের মানদন্ডে উন্নীত না হবার কারণে বর্ণবৈষম্য বা শ্রেণিবৈষম্যেরও শিকার হতে হয়। দাস প্রথা, বর্ণপ্রথা এবং উপনিবেশোত্তর সমাজগুলোতে দেখা যায় সৌন্দর্যের মানদন্ডে উজ্জ্বল ত্বক খাড়া নাক সোনালি চুল ইত্যাদি বেশি সুন্দর বলে স্বীকৃত। কারণ এগুলো উপনিবেশকারী, উচ্চ বর্ণ বা ধনী পরিবারের মেয়েদের বৈশিষ্ট্য। অতএব কালো মেয়েটা প্রায় সময়েই ‘নিচু’ জাতের মতই বৈষম্যের বা অপছন্দের শিকার হয়।

নারীর মধ্যে অন্যান্য গুণের বিকাশ হলে হয়তো সৌন্দর্য নিয়ে তাদের এই নেতিবাচক মনোভাব অনেকটাই দূর হত। কিন্তু এ সমাজের বাস্তবতায় অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রতিভা থাকলেও বেশিরভাগ নারীর কাছে সৌন্দর্যের ‘ঘাটতি’ দূর করাটাই অগ্রাধিকার পায়। তাদের সময় ও মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয় সাজগোজ, পোশাক ও অন্য উপায়ে নিজের ‘খুঁত’ ঢাকার চেষ্টায়। সৌন্দর্য বাড়াবার এই চক্করে জড়িয়ে তার চলাফেরা সীমিত হয় এবং শরীরকে যথাযথ ব্যবহারের স্বাধীনতাও অনেকটা হারিয়ে যায়। তখন অন্যান্য বিষয়ে প্রতিভা থাকলেও তার বিকাশের জন্য সর্বান্তকরণে নিয়োজিত হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় না। গত শতাব্দীর নব্বই দশক থেকে পশ্চিমা বিশ্বের নারীদের ব্যাপক অংশের মধ্যে দেখা দিয়েছে সৌন্দর্য নিয়ে নানা বাতিক, শরীরী বিকৃতি, খাদ্য-অনীহা, আত্ম-ধ্বংসী প্রবণতা। এর থেকে নারীরা এক জটিল মানসিক বৈকল্যের চক্রে জড়িয়ে যাচ্ছে। প্রচার মাধ্যম এবং ফ্যাশন ও কসমেটিক ইন্ডাস্ট্রির বিশ্বায়নের ফলে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের নারীদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে এই প্রবণতা ।৯৩

সৌন্দর্যের চক্করের গভীরে যে সত্য রয়েছে তা হল- নারী পুরুষের অধীন এবং তার ভোগের ও সাজিয়ে রাখার বস্তু। পুরুষ যেমন চায় সেভাবে তার দেহকে পরিবর্তন করে ‘তৈরি’ করতে হবে তা যত কষ্টেরই হোক। কখনও বল প্রয়োগে তাকে তা করতে বাধ্য করা হয়, কখনও পারিপার্শ্বিক ও সামাজিক প্রণোদনা থেকে সে নিজেই এতে নিয়োজিত হয়। এই সত্যের উপলব্ধি নারীর মনের গভীরে নিজের এক অধীন,আবদ্ধ ও দেহ-সর্বস্ব প্রতিচ্ছবি তৈরি করে যা তার মনের মুক্ত বিকাশের বড় প্রতিবন্ধক। এই চক্কর বেশিরভাগ নারীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল করে। শরীর ও মনের পরিপূর্ণ বিকাশ থেকে বঞ্চিত মানুষের পক্ষে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে নিজের স্বাধীন ও সৃজনশীল ভূমিকা রাখা সম্ভব হয় না। এই চক্কর নারীকে দুর্বল-চিত্ত, ভীরু, আত্মকেন্দ্রিক ও বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত করে। মুক্তি ও স্বাধীন বিকাশের পথে এগিয়ে যাবার স্বার্থে তাকে অবশ্যই এ অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিশ শতকের মহীয়সী নারীবাদী লেখক অ্যান্ড্রিয়া ডরকিনের ভাষায়-

“নারীর মুক্তির প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে শরীরের সঙ্গে নারীর যে সম্পর্ক রয়েছে তার আমূল পরিবর্তন করা। শরীরকে অবশ্যই আক্ষরিক অর্থেই সকল রঙচঙ, ধাতব বাঁধন ও আবর্জনা থেকে মুক্ত ও স্বাধীন করতে হবে । …অবশ্যই নিজের শরীরকে কেটে ছিঁড়ে নষ্ট করা বন্ধ করতে হবে এবং এর (শরীরের) ভেতরে বাস করা শুরু করতে হবে। হয়ত তখনই সৌন্দর্যের (নতুন) এক ধারণা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসবে যা হবে সত্যিকারভাবেই গণতান্ত্রিক এবং অসীম ও গৌরবান্বিত অর্থেই মানুষের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সম্পন্ন।”৯৪

মনিরুল ইসলাম: বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, লেখক ও শিক্ষক, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ।

ইমেইল: monirul852@gmail.com  

তথ্যসূত্র:

৮২। Nandhita Hariharan :Beauty Standards – The Ugliest Trick Of Patriarchy; Intersectional Feminism- Desi Style, May 10, 2017, 10076

৮৩। Andrea Dworkin: Woman Hating; PLUME, Published by the Penguin Group Penguin Books, New York, USA, 1974, pp- G13.

৮৪।. Jessica Defino : How White Supremacy and Capitalism Influence Beauty Standards: Teen Vouge (Online News Letter),OCTOBER 19, 2020 issue, www.teenvougue.com

৮৫। Howard S. Levy, Chinise Foot Binding: The History of Curious Erotic Custom (New York: W. Rawls, 1966), pp-26-28

৮৬। Andrea Dworkin, ibid, pp- 181-82

৮৭। Howard S. Levy, ibid,pp-141

৮৮। Andrea Dworkin: ibid, pp-112

৮৯। Einar Kjelsås , Christian Bjørnstrøm, K Gunnar Götestam: Prevalence of eating disorder s  in female and male adolescents (14-15 years); Eat Behav. 2004 Jan;5(1):13-25.doi: 10.1016/S1471-0153(03)00057-6

৯০। Jessica Defino : ibid.

৯১। Andrea Dworkin, ibid, pp- 116

৯২।. Naomi Wolf :The Beauty Myth: How Images of Beauty are Used Against Women; Harper Collins Books, 2002, New York, pp-10

৯৩। Naomi Wolf : ibid, pp-10

৯৪। Andrea Dworkin, ibid, pp- 116

ছবির সূত্র-

১ নং চিত্র- ইন্টারনেট

২ নং চিত্র- ইন্টারনেট

৩ নং টিত্র- Andrea Dworkin, ibid, pp- 117

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •