চলচ্চিত্র পর্যালোচনা
৫টি ভাঙ্গা ক্যামেরা
মুহম্মদ আনোয়ার হোসেন
সিনেমা সম্পর্কিত তথ্য
নামঃ ৫টি ভাঙ্গা ক্যামেরা/ 5 Broken Cameras
নির্মাণঃ এমাদ বার্নাত/বুরনাত/বুরনেত ও গাই দাভিদি। রচনা: গাই দাভিদি/ডেভিডি
প্রযোজনাঃ ক্রিস্টিন কেমেদিয়াস, সার্জ গরদি, এমাদ বার্নাত ও গাই দাভিদি
চিত্রগ্রহণ: এমাদ বার্নাত
সম্পাদনা: ভেরোনিক লাগাগার্দে – সাগোদ, গাই দাভিদি
সংগীত: লে ট্রায়ো জোব্রান
বিতরণ: কিনো লোরবার। মুক্তির তারিখঃ ২৩ নভেম্বর ২০১১ (আইডিএফএ)
দৈর্ঘ্য: ৯৪ মিনিট। দেশ: ফিলিস্তিন, ইজরায়েল, ফ্রান্স। ভাষা: আরবি, হিব্রু
পটভূমি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জায়নবাদী মতবাদ শুরু হয় এক দখলদারি হিসেব দিয়ে।
মোটাদাগে সেখানে বলা হয় ৬০ লক্ষ ‘ইহুদি’ নিহত হয়েছে এ যুদ্ধে, যা সঠিক চিত্র দেয় না। কারণ সেখানে কখনই স্বীকার করা হয়না যে এই সংখ্যার ভিতরের অনেক মানুষের মৃত্যুর কারণ ছিল তার ইহুদি ধর্ম পরিচয় নয় বরং এর ভিতরে অনেক মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে তার রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্য (কম্যুনিস্ট হওয়ার অপরাধে), তার জীবনযাপনের জন্য (মূলত ভবঘুরে, যৌনকর্মী, বিভিন্ন ছোটখাটো অপরাধে জড়িত মানুষদের), ভিন্ন সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার জন্য (মূলত রোমা ও বিভিন্ন জাতিভুক্ত জিপসি মানুষদের, কালো আফ্রিকানদের), বিপরীতকামী নন, এমন মানুষদের (সমকামী পুরুষদের), শারীরিকভাবে সক্ষম নন (শারীরিকভাবে অক্ষম বা পঙ্গু ও অসুস্থ) এবং হত্যার শিকার হয়েছেন নানান ধর্ম–বর্ণ ও পেশার এক বিশাল সংখ্যক মানুষ যারা নাজি দর্শনের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন বা সহযোগিতায় যেতে রাজি হননি। কিন্তু জনপ্রিয় ও অতি শক্তিশালী জায়নবাদী মতবাদ ও প্রকল্প এসব অস্বীকার করে দেখাতে চেষ্টা করে যে, এই নিধনের শিকার শুধুমাত্র ইহুদি মানুষেরা (যদিও বিশাল একটা সংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তার বা তাদের ইহুদি ধর্ম পরিচয়ের কারণে)। আর এভাবেই অন্যসব নিধনের শিকার মানুষকে জায়নবাদী মতবাদ দখল করে নেয় এবং জায়নবাদীদের দখলদারি মনোভাব, আচরণ এখন পর্যন্ত চলছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে।
জায়নবাদীদের প্রভাবে ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর যে বেলফোর ঘোষণা দেয়া হয় সেই থেকে শুরু ফিলিস্তিনি মানুষদের উপর আনুষ্ঠানিক নির্যাতন, দখল ও জাতিগত নিধনের। এ সময়ে ভেঙ্গে পড়ে অটোমান সাম্রাজ্য এবং বিশাল আরব ভূখণ্ড হস্তগত করে নেয় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষকেরা আর আরব জুড়ে তাদের লেজুড় সব লোকেদের ক্ষমতায় বসায়, যার ভিতরে অন্যতম বর্তমান সৌদি রাজপরিবার। এখানেই শেষ নয় এ প্রকল্পকে জিইয়ে রাখতে ব্রিটিশরা তাদের সুবিধামত সীমান্ত নির্ধারণ করে। যার ফলে দেখা যায় সৌদিরা কখনোই এমন কোনো নীতি বা প্রস্তাবের সমর্থন করেনা যা ইজরায়েলকে বিপাকে ফেলতে পারে বরং সব সময়ে এমন আচরণ ও নীতির পক্ষে কাজ করে যা আদপে ফিলিস্তিনিদের নিধন হালাল করে, ইজরায়েলের জায়নবাদী প্রকল্পকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে। বাকি আরব দেশগুলোর অবস্থান এর চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়! (বাংলাদেশও এর ব্যাতিক্রম নয়, নেই ইজরায়েলের বিপক্ষে ফিলিস্তিনিদের উপর জাতিগত নিধন বিরোধী কোনো মৌলিক শক্তিশালী অবস্থান, বরং বিভিন্ন গোপন যোগাযোগের খবর দেখা যায় সংবাদমাধ্যমে* এবং দেখতে/পড়তেপারেন বাংলাদেশ সরকারের পাসপোর্ট কাণ্ড আর সে নিয়ে সরকারের ব্যাখ্যা**)। ফিলিস্তিনিদের উপরে এ গণহত্যার নেতৃত্বে রয়েছে ইহুদি রক্ষণশীল মানুষেরা ও ইজরায়েল রাষ্ট্র, কিন্তু পিছনে তার সমর্থনের ভিত্তি হচ্ছে সাবেক (ও বর্তমান) উপনিবেশবাদিগণ। যদিও সরল চোখে দেখা হয় এখন আর উপনিবেশায়ন বা উপনিবেশবাদ নেই কিন্তু ১৯১৭ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত ইজরায়েলকে টিকিয়ে রাখতে এবং প্রতিষ্ঠিত করতে বিনা প্রশ্নে ইংল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্র হেন কোনো কাজ নেই যা করেনা- হত্যা, গুম, দখল, অত্যাচার, নির্যাতন, যুদ্ধসহ সবকিছু। আর ইজরায়েল রাষ্ট্র হচ্ছে সে ঔপনিবেশিক ভুতের টিকে থাকা শেষ বংশধর (যদিও এখনও চালু রয়েছে নতুন ধরনের দখল ও উপনিবেশায়ন)।
জায়নবাদীদের প্রভাবে ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর যে বেলফোর ঘোষণা দেয়া হয় সেই থেকে শুরু ফিলিস্তিনি মানুষদের উপর আনুষ্ঠানিক নির্যাতন, দখল ও জাতিগত নিধনের। এ সময়ে ভেঙ্গে পড়ে অটোমান সাম্রাজ্য এবং বিশাল আরব ভূখণ্ড হস্তগত করে নেয় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষকেরা আর আরব জুড়ে তাদের লেজুড় সব লোকেদের ক্ষমতায় বসায়, যার ভিতরে অন্যতম বর্তমান সৌদি রাজপরিবার।
জাতিসংঘসহ সকল আন্তর্জাতিক সংস্থার সকল আইন-কানুন ও নিয়মনীতির কোনো প্রকার তোয়াক্কা করা হয়না ইজরায়েলের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য। আবার ইজরায়েলের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্র-ইংল্যান্ড মুক্তকচ্ছ হয়ে যা খুশি তাই করে বেড়ায় আর বাকিদের বেলায়, আইন-কানুন, মানবধিকার, শিশু অধিকার, নারী স্বাধীনতা, পরিবেশ রক্ষা ইত্যাদি ইত্যাদি নানান অজুহাত তোলে। কিন্তু তাদের দৃষ্টিতে যেন ফিলিস্তিনের মানুষদের জন্য নারী স্বাধীনতার দরকার নেই, ফিলিস্তিনি শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করা যায়, এতে তেমন কোনো অপরাধ হয়না, মাইলের পর মাইল জমির জলপাই গাছ উপড়ে সেখানে পশ্চিমা পরিবেশের গাছ লাগানো যায়, এতে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেনা। রাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে, গুলি করে যে কাউকে মেরে ফেলা যায় এতে কোনো প্রকার মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়না! এপি ও আল জাজিরার মত সংবাদ মাধ্যমের ভবন বোমা মেরে মিশিয়ে দিলেও কোনো প্রকার বাকস্বাধীনতার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়না বা তাতে গণতন্ত্র, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, অধিকার কোনো বাধার সামনে পড়েনা!
সাদা চোখে ১৯৪৮ সাল থেকে ইজরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দেখানো হলেও ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণার থেকেই কিন্তু খুব হিসাব কষেই এগিয়ে যাচ্ছিল ইংল্যান্ড–যুক্তরাষ্ট্র (অনেকটা এসময়ের ইরাক আক্রমণের মতো করে, ভেবে দেখুন যুক্তরাষ্ট্র কত আগে থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়ে দুর্বল করে ইরাকে আক্রমণ করে এবং যে জীবাণু অস্ত্রের দোহাই দিয়ে ইরাক ধ্বংস করা হল তা তাদের গণমাধ্যমই পরে খুঁজে বের করলো এসব সব বানোয়াট, মিথ্যা অজুহাত ছিল। আক্রমণের জন্য, আক্রমণের মূল কারণ খনিজ সম্পদের দখল ও অস্ত্র বাণিজ্য বিস্তার, আর কিছুই না!)। ১৯১৭ থেকেই দলে দলে চলছিল ফিলিস্তিনিদের নানা মাত্রায় নিপীড়ন, জমি দখল। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই বিভিন্ন পক্ষ মাঝে মাঝে শান্তি আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে, ইজরায়েলের সুবিধাজনক সময়ের জন্য, ঠিকঠাকভাবে ইজরায়েলের প্রস্তুত হওয়ার জন্য (ফিলিস্তিনিদের প্রতি জাতিগত নিধন আবার শুরু করার জন্য) এবং ঠিক সময়ের অপেক্ষা করা হয় আবার যুদ্ধ শুরু করার জন্য, নতুন করে দখল ও মানুষ নিধন করার জন্য। এসবের পাশাপাশি চালানো হয় জায়নবাদী অতিরঞ্জিত একতরফা প্রচারণা।
ফিলিস্তিন এখন চারিদিকে ইজরায়েলের দেয়াল ঘেরা এক জেলখানা বিশেষ। শুধুমাত্র ভূমির নিয়ন্ত্রণ করেই ক্ষান্ত নয় ইজরায়েল, এ রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের অর্থনীতি, খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ করে। এসব ঘটে চলেছে দিনের পর দিন ধরে, সবার সামনে। এরকম পরিস্থিতির ভিতরেই এমাদ বুরনেত এর বেড়ে ওঠা।
ফিলিস্তিন এখন চারিদিকে ইজরায়েলের দেয়াল ঘেরা এক জেলখানা বিশেষ। শুধুমাত্র ভূমির নিয়ন্ত্রণ করেই ক্ষান্ত নয় ইজরায়েল, এ রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের অর্থনীতি, খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ করে। এসব ঘটে চলেছে দিনের পর দিন ধরে, সবার সামনে। এরকম পরিস্থিতির ভিতরেই এমাদ বুরনেত এর বেড়ে ওঠা। তিনি রাজনৈতিক আন্দোলনকর্মী নন বা নন চলচ্চিত্রকার তিনি শুধু চেয়েছিলেন তার চারপাশ, বন্ধুবান্ধব, সন্তান ও নিজের পরিবারকে ক্যামেরায় ধরে রাখতে। কিন্তু যার জাতিগত পরিচয় ফিলিস্তিনি তারতো সমস্ত জীবনটাই রাজনীতি, সে কি করে রাজনীতির বাইরে যাবে? ফলে তার হাত দিয়েই তৈরি হয়েছে এক অসম্ভব শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রামাণ্যচিত্র, যার পরতে পরতে ছড়ানো রয়েছে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ইজরায়েলের যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ।তার সাথে সহযোগী নির্মাতা হিসেবে আছেন গাই দাভিদি নামের এক বামধারার আন্দোলনকর্মী চলচ্চিত্রকার যিনি ইজরায়েলে বসবাস করেন।
তৈরি হয়েছে এক অসম্ভব শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রামাণ্যচিত্র, যার পরতে পরতে ছড়ানো রয়েছে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ইজরায়েলের যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ।তার সাথে সহযোগী নির্মাতা হিসেবে আছেন গাই দাভিদি নামের এক বামধারার আন্দোলনকর্মী চলচ্চিত্রকার যিনি ইজরায়েলে বসবাস করেন।
মুক্তির সংগ্রাম চলছে, চলছিল, চলবে
খুব সাধারণভাবে আমরা যা যা ঘটতে দেখি “৫টি ভাঙ্গা ক্যামেরা” (২০১১) প্রামাণ্যচিত্রে, তার খানিক এখানে তুলে ধরা হলো। ২০০৫ সালে এমাদ তার চতুর্থ সন্তান জিবরিল এর জন্মের সময় একটা সাধারণ ডিজিটাল ক্যামেরা দিয়ে ধারণ করতে থাকেন তার প্রতিদিনের যাপিত জীবন। ছোট করে বলা যায় এরপরের অর্ধযুগ তিনি পরপর ৫টি ক্যামেরা দিয়ে ধারণ করে গিয়েছেন তার জীবন। আর প্রতিটা ক্যামেরাই ভেঙ্গেছে ইজরায়েলি বাহিনীর হাতে/আক্রমণে, নানানভাবে! ভেঙ্গে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ধারণকৃত সব ঘটনা দেখি আমরা যেখানে তার যাপিত জীবন ধারণ করার মাধ্যমেই রচিত হয়েছে এক মূল্যবান প্রতিরোধের দলিল, এক গণহত্যার দৃশ্যগত প্রমাণ। কারণ তার জাতিগত পরিচয় সে ফিলিস্তিনি এবং সে বাস করে ইজরায়েলের দখলকৃত পশ্চিম তীরের বিলিন এ।
অর্ধযুগ তিনি পরপর ৫টি ক্যামেরা দিয়ে ধারণ করে গিয়েছেন তার জীবন। আর প্রতিটা ক্যামেরাই ভেঙ্গেছে ইজরায়েলি বাহিনীর হাতে/আক্রমণে, নানানভাবে! ভেঙ্গে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ধারণকৃত সব ঘটনা দেখি আমরা যেখানে তার যাপিত জীবন ধারণ করার মাধ্যমেই রচিত হয়েছে এক মূল্যবান প্রতিরোধের দলিল, এক গণহত্যার দৃশ্যগত প্রমাণ।
ফলে তার সাধারণ প্রতিদিনের জীবনে ঘটে যাওয়া ধারণকৃত ঘটনাক্রম হয়ে ওঠে এক চলমান প্রতিরোধ ও পরিবেশ বিনাশি ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ। যেখানে থাকে ইজরায়েলকৃত জোরপূর্বক জমি দখল, সাধারণ মানুষের উপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ, একের পর এক জলপাই গাছ ও বাগান ধ্বংস করে পরিবেশ, প্রতিবেশ বিনাশি আগ্রাসী এক রাষ্ট্রের চরিত্রের উন্মোচিত প্রামাণ্য দলিল।
দিনে রাতের যেকোনো সময়ে ইজরায়েল সেনা হামলা করে ফিলিস্তিনিদের উপরে। তাদের ধরে তুলে নিয়ে যায়। মনে হলে গুলি করে, ইচ্ছা হলে সোজা গুলি করে মেরে ফেলে, কিছুটা দয়া হলে হয়তো গুলিটা মাথায় বা বুকে না করে পায়ে করে। আজীবনের জন্য পঙ্গু করে দেয়, যেন বাকিরা বুঝে নিতে পারে, ইজরায়েল কত ক্ষমতাবান! পৃথিবীর কারো কোনো সাহস নেই যেখানে ইজরায়েলের বিরোধিতা করার সেখানে এসব পাথর ছোঁড়া মানুষেরা কী করে সাহস দেখায় ইজরায়েল রাষ্ট্রের জায়নবাদী প্রকল্পের বিরোধিতা করার! আর এসব ফিলিস্তিনিদের অস্ত্রের তালিকায় রয়েছে, গুলতি দিয়ে পাথর ছোঁড়া। দলবেঁধে যখন দানবের মত ইজরায়েলের সৈনিকেরা আসে, যেকোনো কাউকে তুলে নিতে বা ভূমি দখল করতে বা কাউকে মেরে ফেলতে, তখন তারা এ গুলতি দিয়ে পাথর ছোঁড়ে। আবার কখনো কখনো ফিলিস্তিনিরা হাতের কাছে যা পায় যেমন- হাড়ি, পাতিল, বালতি তাই লাঠি দিয়ে জোরে জোরে পেটায়, যতটা কুলায়, যতক্ষণ কুলায়, এই বাজনা হয়ে ওঠে তাদের কণ্ঠ, লড়াই।
ঘৃণা করে, মিথ্যা ইতিহাস রচনা করে, কাউকে ঠকিয়ে, মিথ্যা অপবাদ দিয়ে সম্ভবত কাউকে চিরকাল দমিয়ে রাখা যায়না, তার প্রমাণ ইহুদি জনগোষ্ঠী নিজেরাই। তাদের নিয়ে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির যে সকল ইতিহাস রয়েছে সেখানে তাদের যেভাবে নির্যাতন করা হতো, যেভাবে রাখা হতো এখন তারা নিজেরা তার চেয়ে বেশি নির্যাতন করে ফিলিস্তিনিদের উপরে! এসবের হয়তো আশু কোনো প্রকার সমাধান নেই। এই নির্যাতন হয়তো চলতে থাকবে (নব্য নির্বাচিত (২০২০) মার্কিন রাষ্ট্রপতি তার পূর্বসূরিদের অনুকরণেতোতাপাখির মত বুলন্দ আওয়াজ তুলেছেন ক্ষমতার মসনদে বসেই, যে ইজরায়েলের নিজেকে রক্ষার এবং আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। আহা! আত্মরক্ষার অধিকার বলে কথা!)। কিন্তু ইতিহাস, মানুষ, সমাজ প্রতিনিয়ত বদলায়।
যে জিবরিলের জন্ম থেকে এ সিনেমা শুরু হয়েছিল, এ সিনেমা শেষ হতে হতে সে প্রায় ৫-৬ বছরের। অনেক কষ্ট, অনেক আইন কানুনের বেড়া ডিঙিয়ে, অনুমতি জোগাড় করে এমাদ তাকে সহ পরিবার নিয়ে সমুদ্র দেখতে যায় (যে সমুদ্র একসময় ছিল ফিলস্তিনিদের নিজেদের)। আরো দেখতে থাকি সে এই বয়সেই বাকি সবার সাথে তার গ্রামে ও আশেপাশে যেখানে প্রতিরোধ হচ্ছে, সেও সমান তালে অংশগ্রহণ করছে এবং সে তার শিশু বয়সে প্রথম প্রথম যে শব্দ উচ্চারণ করা শিখেছে সেসব হল “দেয়াল” “যুদ্ধ” “প্রতিরোধ” ইত্যাদি ইত্যাদি।
এবং আশাবাদ
এমাদ নিজে কোনো প্রথাগত চলচ্চিত্রকার নন, প্রথাগত চলচ্চিত্রকার নন গাই দাভিদি (দাভিদির রচিত সকল সিনেমাই তার কোনো না কোনো আন্দোলনকে নিজের মতো করে বোঝাপড়া ও উপস্থাপনের প্রচেষ্টা) নিজেও। এমাদ নিজে নিজেই ভেবে বের করেছেন হাতে একটা ক্যামেরা থাকলে ইজরায়েলের সৈনিকেরা ও জায়নবাদী মিলিশিয়ারা খানিকটা হলেও ছাড় দেয়। তিনি এ সুবিধা নিতে চেয়েছেন এবং ধরে রাখতে চেয়েছেন নিজের ভূমি, ইতিহাস ক্যামেরার ভিতর দিয়ে। কিন্তু কোনোভাবেই প্রতিরোধ আন্দোলনের চেয়ে তাদের দুজনের কাছে “সিনেমা” বড় হয়ে ওঠেনি বরং সিনেমা প্রতিরোধের অংশ হিসেবেই এসেছে। গাই দাভিদি পরিষ্কার করেই জানান যে তিনি কোনো তথাকথিত “ভারসাম্য” রাখতে সিনেমা বানাচ্ছেন না। তাই তিনি “সিদ্ধান্তপূর্ণ মতামত” দিতেও দ্বিধা করেননা বা তাকে কেউ “বিষাক্ত” বললেও তার কিছু যায় আসেনা। তাই ২০১৩ সালের অস্কারে যখন এ সিনেমা সেরা ৫ এর তালিকায় চলে আসে তিনি সোজা বলে দেন তিনি ইজরায়েলের প্রতিনিধিত্ব করছেননা এ আসরে। তিনি শুধু তার নিজের প্রতিনিধিত্বই করছেন (এমাদ কিন্তু সাধারণভাবে ঢুকতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্রে অস্কার অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য। তাকে আটকে রাখা হয়েছিল এল.এ বিমানবন্দরে পরে অনেক জল ঘোলা হওয়ার পরে তাকে ঢুকতে দিতে বাধ্য হয় ‘মহান গণতন্ত্রের দেশ’ ‘আমেরিকা’!!??)।
জায়নবাদী রক্ষণশীল ইহুদি ও ফিলিস্তিনি রক্ষণশীল মুসলিম দু’দলের ভিতরে অনেক অনেক অমিল থাকলেও রয়েছে প্রচুর মিল,
চলচ্চিত্রকারদ্বয়ের চলচ্চিত্র মাধ্যম সম্পর্কেও রয়েছে সম্পূর্ণ সম্যক ধারনা ফলে “৫টি ভাঙ্গা ক্যামেরা” এক অনবদ্য চলচ্চিত্র যেখানের বাস্তবতা যেকোনো রোমহর্ষক বানানো গল্পের চেয়েও বেশি রোমহর্ষক। এমাদের সৌখিন ক্যামেরার ছন্দ, দুর্দান্ত হয়ে ওঠে যথাযথ সম্পাদনার জন্য ও শব্দ নকশায়ন দ্বারা। এ সবের ফলশ্রুতি তৈরি করেছে এক দুর্দান্ত সিনেমা। যেখানে ভালোমন্দ মিশে রয়েছে, শুধু আদর্শায়িত করা হয়নি ফিলিস্তিনিদের, রয়েছে সমালোচনাও। দেখা যায়, জায়নবাদী রক্ষণশীল ইহুদি ও ফিলিস্তিনি রক্ষণশীল মুসলিম দু’দলের ভিতরে অনেক অনেক অমিল থাকলেও রয়েছে প্রচুর মিল, যেমন এমাদ যখন প্রতিরোধ চলাকালীন ইজরায়েলি বাহিনীর হাতে আহত হয়ে মৃতপ্রায় এবং হাসপাতালে, তখন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তাকে কোনোপ্রকার আর্থিক, মানসিক সহযোগিতা করেনি কারণ তার প্রতিরোধ তাদের কাছে যথেষ্ট ঠিকঠাক নয়, তার মেলামেশা, ওঠাবসা ঠিকঠাক লোকেদের সাথে নয় বলে (একইভাবে গতবছরের শেষদিকে স্বনামধন্য ফিলিস্তিনি সংগীতজ্ঞ সামা আব্দুলহাদিকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ জেলে নেয় ধর্মীয় স্থান অবমাননার জন্য (!?) -যদিও তিনি তা করেননি)। অন্যদিকে ইজরায়েলের ইতিহাসবিদ ইলান পাপে ইজরায়েলে কয়েকবার মৃত্যুর হুমকির সামনে পড়েছেন এবং তাকে কীরূপ পরিস্থিতির সামনে দাঁড়াতে হয়েছে ফিলিস্তিন ও আরব ইতিহাস নিয়ে তার মতামতের জন্য!! আবার জায়নবাদী রক্ষণশীল ইহুদি ও ফিলিস্তিনি রক্ষণশীল মুসলিম, সবাইকে এক হয়ে রাস্তায় নামতে দেখা যায় নারী অধিকারের বিপক্ষে, পরিবেশ–প্রতিবেশ সুরক্ষার বিপক্ষে, সমকামীদের অধিকারের বিপক্ষে, তখন কে মুসলিম কে ইহুদি সেসবের বালাই তুলে রাখা হয়। এরকম জটিল আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক এক পরিস্থিতির ভিতরে “৫টি ভাঙ্গা ক্যামেরা”সকল নিপীড়নের বিপক্ষে আন্দোলনের, কথা বলার, সাহসের এক প্রামাণ্য দলিল।***
মুহম্মদ আনোয়ার হোসেন: চলচ্চিত্রকার, চলচ্চিত্র সমালোচক। ইমেইল: raiparasadardi@gmail.com
ভূমিকার তথ্যসূত্র
*** বিদেশি নাম-ধামের বাংলাকরণে সাধারণভাবে উচ্চারণরীতি অনুসরণ করা হয়েছে, ফলে বাংলায় “ঠিক” বানান হয়তো ভিন্নরকম হতে পারে।
*All the Prime Minister’s Men | Al Jazeera Investigations
https://www.youtube.com/watch?v=a6v_levbUN4
** Bangladesh removes passport clause that barred travel to Israel
বাংলাদেশ | বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে ইসরায়েলের গণমাধ্যমে খবর
বাংলাদেশ | “একসেপ্ট ইসরায়েল” বাদ পাসপোর্টের আন্তর্জাতিক মানের স্বার্থে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
Israel calls on Bangladesh to forge diplomatic ties
Bangladesh denies normalization with Tel Aviv despite removing caveat from passports
https://www.arabnews.com/node/1863571/world
https://www.dw.com/en/new-bangladeshi-passport-fuels-speculation-over-israel-ties/a-57731321
The New York Times slammed for full-page ad condemning pro-Palestinian celebrity models for their views
https://www.arabnews.com/node/1863201/media
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত । দ্বিরাষ্ট্রিক সমাধানের বিবেচনা আপাতত নেই: ইসরায়েল । ১৪ জুলাই ২০২১ । প্রথম আলো ডেস্ক
Noam Chomsky: Israel and Palestine (Full Lecture)
https://www.youtube.com/watch?v=bUsXt8TmVfU
Israel-Palestine: The double standard in American newsrooms | The Listening Post
https://www.youtube.com/watch?v=I38385fKahQ
https://www.youtube.com/watch?v=nf-ULLCOgAU
Israel flattens Gaza building hosting AP, Al Jazeera in air strike | AFP
https://www.youtube.com/watch?v=4RCZtqJmvcc
https://www.youtube.com/watch?v=gRez3nd-FAU
https://www.youtube.com/watch?v=TtJs4Z-jWso
The Holocaust
https://en.wikipedia.org/wiki/The_Holocaust#Gay_men,_Afro-Germans
https://en.wikipedia.org/wiki/State_of_Palestine
https://en.wikipedia.org/wiki/Palestinian_territories
ইজরায়েল ও ফিলিস্তিনের ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থা সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত কিছু সারসংক্ষেপ জানতে দেখতে ও পড়তে পারেন নিচের বিভিন্ন ভ্লগ ও ওয়েব ঠিকানা
The Israel-Palestine conflict: a brief, simple history
https://www.youtube.com/watch?v=iRYZjOuUnlU
Israeli settlements, explained | Settlements Part I
https://www.youtube.com/watch?v=E0uLbeQlwjw
Gaza’s Deadly Night: How Israeli Airstrikes Killed 44 People | Visual Investigations
https://www.youtube.com/watch?v=rrYHge7tqsQ
Why does Israel want to annex the West Bank? | Start Here
https://www.youtube.com/watch?v=6uuD0cGKu1Y
Israel Palestine Conflict: 1000 year History | Jerusalem | Gaza | West Bank | Dhruv Rathee
https://www.youtube.com/watch?v=CISbbt1x2dc
Israeli minister: The Bible says West Bank is ours – UpFront
https://www.youtube.com/watch?v=Png17wB_omA
https://en.wikipedia.org/wiki/The_Ethnic_Cleansing_of_Palestine
https://en.wikipedia.org/wiki/Ilan_Papp%C3%A9
বই আলোচনা | ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্নকরণের ইতিবৃত্ত | আসজাদুল কিবরিয়া
মতামত | ফিলিস্তিনের ভুলে যাওয়া তেল ও গ্যাস–সম্পদ | মাহমুদ আল খাফিফ | বুধবার, ১৪ জুলাই ২০২১
ফিলিস্তিনে ‘গুপ্তহত্যা’ চালাচ্ছে ইসরায়েল | প্রথম আলো ডেস্ক | প্রকাশ: ৩০ মে ২০২১
ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার গুলি, ৩৭৯ ফিলিস্তিনি আহত | প্রথম আলো ডেস্ক | প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২১
মতামত | ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের জন্য যে আমেরিকা দরকার | মোহাম্মাদ এলবারাদি
১৯ জুলাই ২০২১
আলোচনা বানচাল করতে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল: ইরান | প্রথম আলো ডেস্ক | প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২১, ২২: ৫৩
মতামত | ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ ছাড়া পথ নেই | ইয়ারা হাবারি | প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২১
দোহাই
https://en.wikipedia.org/wiki/5_Broken_Cameras
https://en.wikipedia.org/wiki/Emad_Burnat
https://en.wikipedia.org/wiki/Guy_Davidi
https://vimeo.com/73945145 (এখানে দেখতে পারেন সিনেমা “৫টি ভাঙ্গা ক্যামেরা” (২০১১))
https://visualizingpalestine.org/visuals/5-broken-cameras
পড়তে পারেন আলোচিত সিনেমা সম্পর্কিত পশ্চিমের বিভিন্ন সমালোচকের পর্যালোচনা
https://www.theguardian.com/film/2012/oct/21/5-broken-cameras-review
শেষ অংশের তথ্যসুত্র