সম্পাদকীয় ভূমিকা
আগষ্ট-অক্টোবর ২০২১ সংখ্যা সর্বজনকথা যথারীতি অনলাইনেই প্রকাশিত হল।
গত সংখ্যা প্রকাশের পর গত তিনমাসে বাংলাদেশে নতুন ভাবে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ও মৃত্যু সংখ্যা বেড়েছে। এখন তা আর শুধু বড় শহরে সীমাবদ্ধ নেই, গ্রাম পর্যায়েও ছড়িয়ে গেছে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ভারতের পর বহুদেশে ছড়িয়েছে, বাংলাদেশেও তার বিস্তার আগের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। রাজধানী ঢাকা শহরেই যেখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল সেখানে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে জেলা, থানা পর্যায়ে মানুষের যে অসহায় অবস্থা তা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। স্বাস্থ্যখাতে ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতা, অপচয়-দুর্নীতি ইত্যাদির অতীত রেকর্ড বদলানোর কোনো চেষ্টা এখনও দেখা যাচ্ছে না। সাথে সাথে লকডাউন নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের এখন তখন বদলে বারবার শ্রমজীবী মানুষকে অধিক থেকে অধিকতর ভোগান্তির মধ্যে ফেলছে।
সারাবিশ্বে করোনা ভাইরাস যে প্যানডেমিক বা অতিমারি সৃষ্টি করেছে তা দেশে দেশে দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক অর্থনৈতিক এমনকি রাজনৈতিক নানামুখি পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। তবে কোন দেশ এই অতিমারিতে কীভাবে এবং কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সমাজের বিভিন্ন অংশের ওপর এর প্রভাবমাত্রা কেমন তা নির্ধারিত হচ্ছে এসব দেশের করোনাপূর্ব ও করোনাকালের রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও ব্যবস্থাবলী দ্বারা। বাংলাদেশে সর্বজন চিকিৎসা ব্যবস্থার ভয়াবহ ঘাটতি এবং সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার দৈন্যদশার কারণে করোনা বিশাল সংখ্যক মানুষের জীবনে অভূতপূর্ব বিপর্যয় নিয়ে এসেছে, দারিদ্র ও বৈষম্য বেড়েছে দ্রুতহারে। বৈশ্বিক মহামারি ও বৈষম্য: ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা নিয়ে অনুবাদের পাশাপাশি বাংলাদেশে বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাবলীর অসঙ্গতি, বৈষম্য ও সংকটসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি এই সংখ্যায় তুলে ধরা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের তুলনামূলক চিত্রও উপস্থিত করা হয়েছে।
এই করোনার মধ্যে শ্রমজীবী মানুষের জীবনে নতুন নতুন সংকট আসছে মালিক-সরকারের নানা ভূমিকায়। তারই একটি চিত্র রূপগঞ্জে কারখানায় আগুন, ৫২ জন পুড়ে মৃত্যুর হিসাব দেয়া হলেও জখম ও নিখোঁজ হিসাব এখনও স্পষ্ট নয়। এই নিয়ে একটি স্থিরচিত্র প্রতিবেদন ও নাগরিকদের উদ্যোগের খবর দেয়া হল।
বৈশ্বিক দারিদ্র্য ও বৈষম্য সম্পর্কে একটি ‘খোলা চিঠি’র মাধ্যমে ‘মূল ধারার’ প্রচারণার একটি শক্তিশালী জবাব দিয়েছেন শিক্ষক গবেষক জেসন হিকেল। এই সংখ্যায় তার অনুবাদ প্রকাশ করা হল। সেইসাথে ‘মূলধারার’ উন্নয়নের ‘পোস্টার চাইল্ড’ চিলির অভিজ্ঞতা নিয়েও একটি লেখার অনুবাদ প্রকাশ করা হল।
বাংলাদেশে পুঁজিবাদের বিকাশ ধারায় একদিকে তৈরি হয়েছে পাকিস্তানের ২২ পরিবারের চাইতেও সম্পদশালী বেশ কিছু গোষ্ঠী, অন্যদিকে বৈষম্য ও পরিবেশ বিধ্বংসী তৎপরতাও অভূতপূর্ব মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ‘উন্নয়ন’ ধারার স্বরূপ বিশ্লেষণ, পুঁজি কেন্দ্রীভবনের ধরন, শ্রেণী বিন্যাস, এই ধারার পুঁজিবাদ বিকাশে রাষ্ট্রের ভূমিকা ইত্যাদি নিয়ে কয়েক কিস্তিতে একটি অনুসন্ধানী লেখা প্রকাশ শুরু হল এই সংখ্যায়।
করোনাকালে দ্বিতীয়বারের মতো বাজেট পেশ করা হয়েছে গত ৩রা জুন। এই বৈশ্বিক করোনা অতিমারি কি বাংলাদেশের বাজেট প্রস্তাবে কোনো প্রভাব ফেলতে পেরেছে? শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তাখাতসহ যেসব দুর্বলতা এই সংকটকালে উন্মোচিত হয়েছে সেগুলো কি বিশেষ মনোযোগ পেল? উন্নয়ন বরাদ্দ ও তার বাস্তবায়নে অতীত ধারাবাহিকতায় কি কোনো পরিবর্তন এসেছে? বাজেট বরাদ্দের বিশ্লেষণ ছাড়াও ২০২১-২২ বাজেট বিষযক লেখায় উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর সন্ধান করা হয়েছে।
বাংলাদেশে রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত অন্যতম প্রধান পরিবহণের ভূমিকা পালন করছে রিকশা-ভ্যান সহ বিভিন্ন হালকা যান। এতে কর্মসংস্থান বিশাল, যাত্রী ও পণ্য পরিবহণে এগুলোর ভুমিকা খুবই বেশি। অথচ এসব যানের গুণগত মান উন্নয়নে কোনো ভূমিকা না নিয়ে বারবার এদের ওপর আক্রমণ, বিধিনিষেধ, অপপ্রচারই দেখা যায়। গত ২০ জুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আকস্মিকভাবে ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। বলেছেন, ইজিবাইকও ক্রমান্বয়ে বন্ধ করে দেওয়া হবে। গত ১০ বছরে রিকশা-ভ্যান, ইজিবাইকের নিরাপদ ও উন্নত ডিজাইন করতে, উন্নত মডেলের রিকশা-ভ্যান তৈরি করতে নানা সুপারিশ দেয়া হলেও এসব সমাধানে সরকারের আগ্রহ দেখা যায়নি। এই সংখ্যায় দুটি লেখায় এসব পরিবহণের গুরুত্ব, এগুলোর সমস্যা সমাধানের পথ দেখানো হয়েছে এবং তৃতীয় একটি লেখায় প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়নের প্রস্তাব করা হয়েছে।
অত্যধিক বাড়িভাড়া নিয়ে অভিযোগ ঢাকায় বসবাসকারী শ্রমজীবী মানুষসহ নিম্নবিত্ত মানুষের। বাসাভাড়া কীভাবে অধিকাংশ শ্রমজীবী ও নিম্নবিত্ত মানুষেরই আয়ের সিংহভাগ নিয়ে নেয় এবং অধিকাংশ পরিবারের জীবন বিপর্যস্ত করে তা কয়েকটি পরিবারের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আলোচনা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি পাদুকা শ্রমিকদের নিয়ে প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানভিত্তিক লেখায় তাদের জীবনকথা তুলে ধরা হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য পাদুকা যারা তৈরি করেন, তাদের জীবন ও জীবিকার খবর অধিকাংশ মানুষের কাছেই অজানা।
২০ মে ঐতিহাসিক ‘চা-শ্রমিক হত্যা দিবস’। চা-শ্রমিকরা ব্রিটিশ চা-বাগান মালিক কর্তৃক অত্যাচার-নিপীড়ন, অবহেলা-নির্যাতন সইতে না-পেরে ১৯২১ সালের এই দিনে নিজ মুল্লুকে (আবাসভূমিতে) ফিরে যাওয়ার জন্য ‘মুল্লুকে চলো আন্দোলন’ সংঘটিত করেছিল। ব্রিটিশ গুর্খা বাহিনী তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় এবং হাজার হাজার চা-শ্রমিককে মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। সেই ভুলিয়ে দেয়া রক্তাক্ত ইতিহাস আবার সামনে আনার পাশাপাশি শতবর্ষ পরের চা শ্রমিকদের পরিস্থিতিও পর্যালোচনা করা হয়েছে একটি লেখায়।
ভারতের বাংলা ভাষার লেখকদের মধ্যে স্মরণীয় নাম মহাশ্বেতা দেবী ২০০৯ সালে যখন ঢাকায় আসেন তখন তাঁর কাজ ও চিন্তা নিয়ে যে আলাপ হয়েছিল তা এখানে পুনপ্রকাশ করা হল। গত পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন নিয়ে একটি লেখাও এই সংখ্যায় পুনপ্রকাশ করা হল। বিজেপি কেন্দ্র সরকার নির্বাচন জিততে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করেছিল, এই কাজে তারা বাংলাদেশকেও ব্যবহার করেছে। শেষ পর্যন্ত বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ দখল করতে পারেনি, কিন্তু আগের তুলনায় অনেক বেশি ভোট আনতে পেরেছে। অন্যদিকে বামফ্রন্ট আরও বিপর্যস্ত হয়েছে। ভোটের বিস্তারিত তথ্যসহ এর কারণ অনুসন্ধান করা হয়েছে এই লেখায়।
এই সংখ্যায় ধারাবাহিক লেখা ‘অ্যাঞ্জেলা ডেভিসের সাথে কথোপকথন-৮’, ‘নারী-পুরুষের মানস: পুরুষতান্ত্রিক ধারণা ও বৈষম্যের জৈবসামাজিক ভিত্তি-৭’ ছাড়াও থাকছে নিয়মিত কয়েকটি বিভাগ- চলচ্চিত্র পর্যালোচনা, গ্রন্থ পর্যালোচনা, চিঠিপত্র এবং সংবাদপত্রের পাতা থেকে।
আনু মুহাম্মদ
৩১ জুলাই ২০২১