করোনা অতিমারি ও বৈষম্য

করোনা অতিমারি ও বৈষম্য

কল্লোল মোস্তফা

সারাবিশ্বে করোনা ভাইরাস যে প্যানডেমিক বা অতিমারি সৃষ্টি করেছে তা দেশে দেশে দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক অর্থনৈতিক এমনকি রাজনৈতিক নানামুখি পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। তবে কোন দেশ এই অতিমারিতে কীভাবে এবং কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সমাজের বিভিন্ন অংশের ওপর এর প্রভাবমাত্রা কেমন তা নির্ধারিত হচ্ছে এসব দেশের করোনাপূর্ব ও করোনাকালের রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও ব্যবস্থাবলী দ্বারা। বাংলাদেশে সর্বজন চিকিৎসা ব্যবস্থার ভয়াবহ ঘাটতি এবং সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার দৈন্যদশার কারণে করোনা বিশাল সংখ্যক মানুষের জীবনে অভূতপূর্ব বিপর্যয় নিয়ে এসেছে, দারিদ্র ও বৈষম্য বেড়েছে দ্রুতহারে। বর্তমান প্রবন্ধে করোনাকালে পরিচালিত বিভিন্ন সমীক্ষার ফলাফল এবং তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশে বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাবলীর অসঙ্গতিসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। সেইসাথে এসব বিষয়ে অন্যান্য দেশের তুলনামূলক চিত্রও উপস্থিত করা হয়েছে।      

সম্পদ ও আয়ের বণ্টনের ওপর অতিমারি/মহামারির প্রভাব কেমন হবে, তা বেশ কতগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভর করে, যার মধ্যে রয়েছে মহামারির বিস্তৃতি, মৃত্যুর হার ও মৃতের সংখ্যা। সেইসঙ্গে বিদ্যমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ধরন। মৃত্যুর হার বেশি হওয়ার কারণে যদি স্বল্প সময়ে জনসংখ্যার একটি বড় অংশের মৃত্যু ঘটে, তাহলে শ্রমবাজারে চাহিদার তুলনায় শ্রমিকের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি ও বৈষম্য হ্রাসের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। ইউরোপে চৌদ্দ শতকে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামে পরিচিত প্লেগ মহামারির কারণে এ রকমটাই ঘটেছিল। সেই সঙ্গে অধিকসংখ্যক ভুস্বামীর মৃত্যুর কারণে সম্পত্তি খণ্ড খণ্ড হয়ে চাহিদার তুলনায় বাড়তি সরবরাহের কারণে জমির দাম কমে যায় ও ভূসম্পত্তিতে জনসাধারণের মালিকানার সুযোগ বৃদ্ধি পায়, ফলে সম্পদ বৈষম্য হ্রাস পায়। কিন্তু এই পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী সময়ে ইউরোপের ধনিক শ্রেণি ভিন্ন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলার কারণে সতেরো শতকে ইউরোপজুড়ে প্লেগ মহামারিতে মৃত্যুর হার চৌদ্দ শতকের ব্ল্যাক ডেথের কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও আয় ও সম্পদবৈষম্য তেমন একটা কমেনি। অন্যদিকে মহামারির ধরন যদি এ রকম হয় যে, অস্বাস্থ্যকর ও ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারীরাই বেশি আক্রান্ত হয়, তাহলে সেই মহামারির কারণে তুলনামূলক দরিদ্র মানুষের মৃত্যু বেশি হওয়ার কারণে দারিদ্র্য কমে যেতে পারে, যেমনটা ঘটেছিল উনিশ শতকের কলেরা মহামারির ক্ষেত্রে। আবার ১৯১৮-১৯১৯ সালের স্প্যানিশ ফ্লু মহামারিতে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হলেও মৃত্যুর হার তুলনামূলক কম হওয়ায় স্প্যানিশ ফ্লুর কারণে শ্রমবাজারের সংকোচন ব্ল্যাক ডেথের মতো ঘটেনি। ফলে বৈষম্য হ্রাসের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারেনি। উলটো এই মহামারির কারণে যে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছিল, তার ফলে কর্মসংস্থান ও আয়ের বিচারে সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যার ফলে বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল।

শুধু বিগত শতাব্দীগুলোর মহামারিই নয়, বর্তমান শতাব্দীর পাঁচটি মহামারির (SARS, 2003; H1N1, 2009; MERS, 2012; Ebola, 2014 ও Zika, 2016) অভিজ্ঞতা নিয়ে করা এক গবেষণা থেকেও দেখা গেছে, মহামারিগুলোর কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৈষম্য নির্দেশক গিনি সহগ বৃদ্ধি পেয়েছে, দেশগুলোর মোট আয়ে সবচেয়ে ধনী ২০ শতাংশের অংশীদারত্ব বেড়েছে আর সবচেয়ে দরিদ্র ২০ শতাংশের অংশীদারত্ব কমেছে। শুধু তাই নয়, করোনা মোকাবিলায় সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপও দরিদ্রদের তুলনায় ধনীদের আয় বাড়াতে সাহায্য করেছে। অতীতের এসব অভিজ্ঞতার শিক্ষা হলো, বিদ্যমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাঠামোগত ব্যবস্থাপনা ও মহামারি মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপভেদে একই মহামারি বিভিন্ন দেশের মানুষের ওপর এবং একই দেশের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের ওপর বিভিন্ন রকম প্রভাব ফেলতে পারে।

মহামারিগুলোর কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৈষম্য নির্দেশক গিনি সহগ বৃদ্ধি পেয়েছে, দেশগুলোর মোট আয়ে সবচেয়ে ধনী ২০ শতাংশের অংশীদারত্ব বেড়েছে আর সবচেয়ে দরিদ্র ২০ শতাংশের অংশীদারত্ব কমেছে। শুধু তাই নয়, করোনা মোকাবিলায় সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপও দরিদ্রদের তুলনায় ধনীদের আয় বাড়াতে সাহায্য করেছে।

বর্তমান লেখায় আমরা দেখব বিদ্যমান অর্থনৈতিক কাঠামো, কর্মসংস্থানের ধরন, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, গণবণ্টন ব্যবস্থা, মহামারি মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ ও কর্মসূচি ইত্যাদি ভেদে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংক্রমণ, মৃত্যু, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য, আয় প্রভৃতির ওপর করোনা মহামারির প্রভাব কেমন পড়েছে।

করোনাকালে শ্রেণিবিভাজনের রূপ

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে সমাজের বিদ্যমান শ্রেণিবিভাজন আরও উৎকটরূপে নতুন চেহারা নিয়ে ধরা পড়ছে। মার্কিন অর্থনীতিবিদ রবার্ট রাইখ করোনাভাইরাস মহামারির প্রেক্ষাপটে ঘরে থেকে কাজ করতে পারা না-পারা, ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় কাজ করা না-করা, কাজ ও মজুরি পাওয়া না-পাওয়া ইত্যাদির নিরিখে কর্মজীবী মানুষকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন: দ্য রিমোটস, দি এশেনসিয়ালস, দি আনপেইড এবং দ্য ফরগটেন ক্লাস। রবার্ট রাইখের বিভাজন অনুসারে বাংলাদেশের কর্মজীবী মানুষকে নিম্নোক্ত চার ভাগে ভাগ করা যায়:

১) ঘরে থাকতে পারা মানুষ: ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, ম্যানেজার, দক্ষ কারিগর প্রভৃতি পেশার মানুষ, যারা ঘরে থেকে কাজ করেছেন, তাদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। এদের অনেকের কাজের চাপ আগের চেয়ে বেড়েছে, অনেকে একঘেয়েমি কিংবা দুশ্চিন্তায় ভুগেছেন; কিন্তু কাজের কারণে বাইরে যেতে বাধ্য নন বলে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বিবেচনায় সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলেন। এসব মানুষের কাজ হারাতে হয়নি বলে আর্থিক সমস্যা থেকেও মুক্ত।

২) অপরিহার্য কর্মী: ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, ওষুধের দোকানদার, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত শ্রমজীবী মানুষ, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, টেলিকমিউনিকেশন প্রভৃতি সেবা খাতের মাঠকর্মী, কাঁচাবাজারের কর্মী, দোকানদার, জরুরি সামগ্রী পরিবহণ, আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত কর্মী, ফায়ার ফাইটার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য প্রমুখ হলেন অপরিহার্য কিছু পেশার উদাহরণ। করোনা মোকাবিলায় এবং দেশের জীবনযাত্রা চলমান রাখার ক্ষেত্রে এই মানুষগুলো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন; যদিও তাদের অনেকেরই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সামগ্রীর ঘাটতি রয়েছে, ঝুঁকির তুলনায় আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধাদিও তেমন নয়।

৩) কর্মহীন ও মজুরিবিহীন: বাংলাদেশের শতকরা ৮৫ ভাগ শ্রমজীবী মানুষই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। দিনমজুর, হকার, রিকশাচালক, পরিবহণ শ্রমিক, হোটেল রেস্টুরেন্ট ও দোকান কর্মচারী, ছোট-বড় বিভিন্ন শিল্পকারখানার শ্রমিক, খুদে ব্যবসায়ী, কর্মহীন বিদেশফেরত প্রবাসী শ্রমিক–এ রকম কিছু পেশার উদাহরণ। এদের বেশিরভাগকেই ‘কাজ নেই তো মজুরি নেই’ ধরনের কাজ করতে হয়। সাধারণ ছুটি ও লকডাউনের মধ্যে এদের বেশিরভাগেরই কোনো কাজ না-থাকায় আয় বন্ধ ছিল। এই বর্গের মানুষকেই ত্রাণ বা সাহায্যের আশায় রাস্তায় দেখা গেছে। সুনির্দিষ্ট আর্থিক সহায়তা না-থাকার কারণে লকডাউন এই মানুষের জীবনের সব ধরনের আর্থিক ও রোগ সংক্রমণকেন্দ্রিক সব ধরনের নিরাপত্তা কেড়ে নিয়েছে।

৪) ভুলে যাওয়া ও খরচযোগ্য: জেলখানার কয়েদি, রোহিঙ্গা শরণার্থী কিংবা দেশের ভেতরকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সদস্যরা হলেন : ভুলে-যাওয়া মানুষ আর গার্মেন্ট কারখানাসহ জাহাজভাঙা শ্রমিক, লবণ কারখানার শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশার শ্রমিক, যাদের ব্যবসায়ীদের স্বার্থে কিংবা অর্থনীতির স্বার্থে কোনো ধরনের সুরক্ষা ছাড়াই কাজ করতে হচ্ছে, তারা হলেন খরচযোগ্য। ভুলে যাওয়া বা খরচযোগ্যের মধ্যে বস্তিতে বসবাসকারী বিপুল জনগোষ্ঠীর মানুষ, যারা আবার বেশিরভাগই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবী মানুষ, তাদেরও ধরা যেতে পারে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে বসবাস করা এই মানুষগুলোর পক্ষে যে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা কোনোভাবেই সম্ভব নয়–তাদের খাদ্যের জন্য, সুরক্ষার জন্য, করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসার জন্য যে বিশেষ আয়োজন করা প্রয়োজন–এই সত্যটি ভুলেই কিন্তু করোনা মোকাবিলার কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে।

করোনা মহামারিকালীন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি, চিকিৎসার সুযোগ, মৃত্যুর হার, জীবিকা, খাদ্যনিরাপত্তা, অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদির অনেক কিছুই নির্ভর করেছে ব্যক্তি উপরোক্ত চারটি শ্রেণিবিভাজনের কোনটিতে পড়ে, তার ওপর। পরবর্তী আলোচনা থেকে বিষয়গুলো আরও পরিষ্কার হবে।

দারিদ্র্য ও মহামারিতে মৃত্যুর ঝুঁকি

ঝড়ে সাগরে থাকা ছোট-বড় সব জাহাজ ও নৌকা আক্রান্ত হলেও ছোট নৌকায় থাকা মানুষের ঝুঁকি বড় নৌকা বা জাহাজে থাকা মানুষের চেয়ে অনেক বেশি। একইভাবে মহামারি সব শ্রেণির মানুষের জন্যই বিপজ্জনক হলেও সব শ্রেণির মানুষ মহামারিতে সমান ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। এর আগের বিভিন্ন মহামারিতে দেখা গেছে, দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষ মহামারিতে বেশি আক্রান্ত হয়েছে এবং বেশি হারে মৃত্যুবরণ করেছে।

বিয়াট্রিজ ইকেভেরি ১৯১৮-১৯ সালের মহামারিতে স্পেনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন:

‘দারিদ্র্যের সঙ্গে সব সময়ই যুক্ত থাকে অপুষ্টি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও রোগ। ফলে যে কোনো মহামারিতে দারিদ্র্য বাড়তি ঝুঁকি তৈরি করে। তাছাড়া এমন একটা সময়ে যখন ইনফ্লুয়েঞ্জাজনিত জটিলতার কোনো কার্যকর চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি, তখন অসুস্থদের সেবা-যত্ন করা ও খাদ্যের জোগান দেওয়ার মতো সাধারণ বিষয়গুলোও জীবন-মৃত্যুর পার্থক্য তৈরি করে দেয়। ১৯১৮ সালে এমনকি তুলনামূলক উন্নত দেশগুলোতেও এসব কাজের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো একেবারে পঙ্গু না-হয়ে গেলেও ব্যাপকসংখ্যক সংক্রমণ ও মৃত্যুর ভারে অসহায় হয়ে পড়েছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সমাজের যে অংশের মানুষগুলো অতি দরিদ্র ও দুর্বল স্বাস্থ্য অবকাঠামোর মধ্যে বসবাস করছিল, তারা সবচেয়ে জটিল পরিস্থিতির শিকার হয়।’

ফ্রান্স সম্পর্কে প্যাট্রিক জিলবারম্যানের লেখা থেকে দেখা যায়:

‘আবাসস্থলগুলো যত বেশি বদ্ধ, তত বেশি মানুষের সঙ্গে মানুষের সংস্পর্শ ঘটে এবং বায়ুবাহিত রোগ তত সহজে ছড়ায়। কিন্তু ফ্রান্সের সম্ভ্রান্ত এলাকাগুলোয় তাহলে জনসংখ্যার ঘনত্ব তুলনামূলক কম হলেও মৃত্যুর হার বেশি ছিল কেন? কারণ, রাজধানীর সবচেয়ে জঘন্য আবাসস্থলের অধিকারী মানুষগুলো–গৃহকর্মী ও অন্যন্য সেবাদাতা–এখানেই বসবাস করে। মহামারিতে মৃত্যুবরণ করা মানুষের একটা বড় অংশই হয় এমন স্থানে বসবাস করত, যেখানে নড়াচড়া করাই মুশকিল ছিল (উদাহরণ: প্রহরী ও রাঁধুনি) অথবা ধনীদের সেবা করার জন্য এমন স্থানে কাজ করত, যেগুলো ছিল ছোট ও অস্বাস্থ্যকর (উদাহরণ: কারুশিল্পী, মুচি, দর্জি, কাঠমিস্ত্রি, স্বর্ণকার, ধোপা)। প্রকৃতপক্ষে প্যারিসে মহামারিতে মারা যাওয়া নারীদের এক-চতুর্থাংশই ছিলেন গৃহকর্মী।’

উপরে আলোচিত শতবর্ষ আগের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, কর্মক্ষেত্র ও বাসস্থানের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অপুষ্টি ও পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোর অভাবে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষ মহামারিতে সমাজের অন্য যে কোনো শ্রেণির মানুষের চেয়ে বাড়তি ঝুঁকিতে থাকে। আফসোসের বিষয় হলো, শতবর্ষে মানবসমাজের বহু ধরনের অগ্রগতি হলেও মহামারি মোকাবিলার ক্ষেত্রে দরিদ্র মানুষকে আগের মতোই বাড়তি ঝুঁকি বহন করতে হচ্ছে। শতবর্ষের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দরিদ্র মানুষের কর্মপরিবেশ, বাসস্থান, পুষ্টি বা স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। করোনাভাইরাস মহামারিতেও দেখা যাচ্ছে, ধনী ও সম্পদশালীদের তুলনায় দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষই বেশি মৃত্যুবরণ করছে।

শতবর্ষ আগের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, কর্মক্ষেত্র ও বাসস্থানের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অপুষ্টি ও পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোর অভাবে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষ মহামারিতে সমাজের অন্য যে কোনো শ্রেণির মানুষের চেয়ে বাড়তি ঝুঁকিতে থাকে। আফসোসের বিষয় হলো, শতবর্ষে মানবসমাজের বহু ধরনের অগ্রগতি হলেও মহামারি মোকাবিলার ক্ষেত্রে দরিদ্র মানুষকে আগের মতোই বাড়তি ঝুঁকি বহন করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ বা এই অঞ্চলের দেশগুলোয় আর্থসামাজিক অবস্থাভেদে মহামারিতে মৃত্যুর কোনো পরিসংখ্যান চোখে পড়েনি। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের মতো ধনী দেশগুলোর পরিস্থিতি নিয়ে যেসব পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, বরাবরের মতোই করোনাভাইরাস মহামারিতেও ধনী ও সম্পদশালীদের তুলনায় দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষই বেশি ঝুঁকির মধ্য রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণার বরাত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার তুলনামূলক বেশি। অ-হিস্পানিক কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার ১২ শতাংশ হলেও করোনায় মৃতদের মধ্যে তাদের হার ৩৪ শতাংশ। শিকাগোর যে অঞ্চলে দারিদ্র্যের হার বেশি এবং শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের হার কম, সেসব অঞ্চলের অধিবাসীদের সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেশি। কোভিড ট্র্যাকিং প্রজেক্ট ও বোস্টন ইউনিভার্সিটির এন্টিরেসিস্ট রিসার্চের যৌথ গবেষণা অনুসারে ৬ মার্চ ২০২১ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গদের মৃত্যুর হার ১.৪ গুণ বেশি–প্রতি লাখে শ্বেতাঙ্গ মৃত্যুর সংখ্যা ১২৪ এবং কৃষ্ণাঙ্গ মৃত্যুর সংখ্যা ১৭৮। বিবিসি যুক্তরাজ্যের অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকসের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, ইংল্যান্ডের সম্পদশালী অঞ্চলে প্রতি এক লাখ মানুষে করোনাভাইরাস মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ২৫ হলেও দরিদ্রপ্রধান অঞ্চলগুলোয় এ সংখ্যা প্রতি এক লাখে ৫৫ অর্থাৎ দরিদ্র অঞ্চলে মৃত্যুর হার ধনী অঞ্চলের তুলনায় দ্বিগুণ!

যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার তুলনামূলক বেশি। অ-হিস্পানিক কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার ১২ শতাংশ হলেও করোনায় মৃতদের মধ্যে তাদের হার ৩৪ শতাংশ। শিকাগোর যে অঞ্চলে দারিদ্র্যের হার বেশি এবং শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের হার কম, সেসব অঞ্চলের অধিবাসীদের সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেশি।

অক্সফামের ‘ইনইকোয়ালিটি ভাইরাস’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, মহামারির প্রথম ছয় মাসে প্রায় ৯০ শতাংশ দেশেরই স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীর মানুষ। কারণ, তারাই সর্বজন স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর বেশি নির্ভরশীল। দরিদ্র শ্রেণির মানুষকে বেশি অর্থ ব্যয় করে বেসরকারি খাতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। এতে তারা আরও বেশি করে ঋণ ও দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়েছে অথবা চিকিৎসা না-পেয়ে তাদের স্বাস্থ্য ও জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। অন্যদিকে ধনী ব্যক্তিরা অর্থের বিনিময়ে অধিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে ও অন্যদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে নিজেদের নিরাপদে রাখতে পেরেছে। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ আফ্রিকার জনসংখ্যার ৮৪ শতাংশ সরকারি বা সর্বজন স্বাস্থ্য খাতের ওপর নির্ভরশীল হলেও দেশের মোট চিকিৎসকের মাত্র ৩০ শতাংশ সেখানে কাজ করেন। অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় দেশের জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ চিকিৎসা গ্রহণ করলেও চিকিৎসকদের ৭০ শতাংশই সেখানে কাজ করেন। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, মহামারিতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার সঙ্গে বিদ্যমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের যোগসূত্র রয়েছে। দরিদ্র মানুষই ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে বেশি থাকে। তারা বসবাস করে ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে, যেখানে বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাব থাকে। তাদের বেশিরভাগ কাজ করে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে, যেখানে হোম অফিস করা বা ছুটি নিয়ে নিজেদের নিরাপদে রাখার কোনো সুযোগ থাকে না। তাদের অনেককেই কাজ করতে হয় সেবা খাত, স্বাস্থ্য খাতসহ অন্যান্য খাতে, যেখানে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। অনেকগুলো মহামারি আক্রান্ত দেশের গবেষণা থেকে দেখা গেছে, সংক্রমণ ও মৃত্যুর হারের সঙ্গে সামাজিক স্তর বিন্যাসের সম্পর্ক রয়েছে। যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে দরিদ্র ১০ শতাংশ এলাকায় মৃত্যুর হার সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ এলাকার চেয়ে বেশি। একই ধরনের প্রবণতা লক্ষ করা গেছে ফ্রান্স, ব্রাজিল, নেপাল, স্পেন ও ভারতের ক্ষেত্রে।

অনেকগুলো মহামারি আক্রান্ত দেশের গবেষণা থেকে দেখা গেছে, সংক্রমণ ও মৃত্যুর হারের সঙ্গে সামাজিক স্তর বিন্যাসের সম্পর্ক রয়েছে। যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে দরিদ্র ১০ শতাংশ এলাকায় মৃত্যুর হার সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ এলাকার চেয়ে বেশি। একই ধরনের প্রবণতা লক্ষ করা গেছে ফ্রান্স, ব্রাজিল, নেপাল, স্পেন ও ভারতের ক্ষেত্রে।

কর্মসংস্থানের ওপর করোনা মহামারির প্রভাব

সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কর্মসংস্থান ও প্রকৃত আয় হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে বৈষম্য হ্রাসবৃদ্ধির সম্পর্ক সরাসরি। মহামারির কারণে যদি দেশের জনসংখ্যার একটা বড় অংশের কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যায়, তাহলে প্রকৃত আয় কমে গিয়ে বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশ্বজুড়ে যে সাধারণ ব্যবস্থাটি গ্রহণ করা হয় তা হলো, মানুষের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব নিশ্চিত করা। আর এই কাজটি করতে গিয়ে অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়লেও সব খাত এবং সব ধরনের পেশার ওপর তার সমান প্রভাব পড়েনি। হোটেল, রেস্তোরাঁ, পর্যটন, পরিবহণ, ব্যক্তিগত সেবা প্রভৃতি খাতে যে ধরনের প্রভাব পড়েছে টেলিযোগাযোগ বা ই-কমার্সভিত্তিক খাতে সেরকম প্রভাব পড়েনি। শারীরিক উপস্থিতি নির্ভর কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অনলাইনভিত্তিক কর্মসংস্থানের বিকাশ হয়েছে। আনুষ্ঠানিক খাতের কর্মসংস্থান আর অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মসংস্থানের ওপরও করোনা মহামারির প্রভাব একরকম ছিল না। আবার কোনো দেশের বিদ্যমান শ্রম আইন কতটা শ্রমবান্ধব, মোট কর্মসংস্থানে অনানুষ্ঠানিক খাতের অংশ কতটুকু, বেকার ভাতা, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও কর্মসংস্থান রক্ষায় সরকারের গৃহীত নীতিমালা, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য গৃহীত পদক্ষেপের চরিত্র ইত্যাদি অনেক কিছুর ওপরই নির্ভর করেছে দেশে দেশে এবং দেশের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের শ্রমজীবী মানুষের ওপর মহামারির প্রভাব কেমন পড়েছে।

কর্মসংস্থানের ওপর করোনা মহামারির প্রভাব বোঝার জন্য মার্চ এবং এপ্রিল ২০২০-এ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির সর্বমোট ২০ হাজার ৯১০ জন অংশগ্রহণকারীর সমন্বয়ে একটি জরিপভিত্তিক গবেষণা করা হয়। যৌথভাবে Abi Adams-Prassl, Teodora Boneva, Marta Golin, ও Christopher Rauh-এর করা ‘Inequality in the Impact of the Coronavirus Shock: Evidence from Real Time Surveys’১০ শীর্ষক গবেষণার মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে যে, কোন ধরনের কর্মীরা কাজ এবং আয় হারানোর বাড়তি ঝুঁকিতে পড়েছেন, সেইসঙ্গে দেশ এবং কাজের ধরনভেদে কর্মসংস্থানের ওপর মহামারির প্রভাব কেমন পড়েছে। গবেষণাটি থেকে দেখা গেছে, দেশভেদে এবং দেশের ভেতরে কর্মসংস্থানের ওপর করোনা মহামারির প্রভাব একরকম নয়।

জার্মানিতে স্বল্পমেয়াদি কর্মসংস্থান বা short time work (STW) নামের স্কিমটি বেশ সুপ্রতিষ্ঠিত। এ স্কিমের আওতায় কোনো কোম্পানি সর্বোচ্চ ১২ মাসের জন্য কর্মীদের কর্মঘণ্টা বিভিন্ন মাত্রায় কমিয়ে দিতে পারে এবং কমে যাওয়া কর্মঘণ্টার ক্ষতিপূরণ প্রদান করে ফেডারেল এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সি।

প্রথমত, দেশভেদে এর প্রভাবে বড় রকমের পার্থক্য দেখা গেছে। ২০২০ সালের এপ্রিলের শুরুতে জরিপে অংশগ্রহণকারী যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের যথাক্রমে ১৮ এবং ১৫ শতাংশ নাগরিক জানিয়েছে, তারা মহামারি শুরুর প্রথম চার সপ্তাহের মধ্যে কাজ হারিয়েছে, জার্মানির ক্ষেত্রে যার পরিমাণ মাত্র ৫ শতাংশ। জার্মানিতে স্বল্পমেয়াদি কর্মসংস্থান বা short time work (STW) নামের স্কিমটি বেশ সুপ্রতিষ্ঠিত। এ স্কিমের আওতায় কোনো কোম্পানি সর্বোচ্চ ১২ মাসের জন্য কর্মীদের কর্মঘণ্টা বিভিন্ন মাত্রায় কমিয়ে দিতে পারে এবং কমে যাওয়া কর্মঘণ্টার ক্ষতিপূরণ প্রদান করে ফেডারেল এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সি। মহামারির শুরুতে জার্মানি কোম্পানিগুলোর জন্য এই স্কিমের আওতাভুক্ত হওয়ার শর্ত শিথিল করে দেয় যেন পুরোপুরি ছাঁটাই না-করে আরও বেশিসংখ্যক কোম্পানি দক্ষ কর্মীদের ধরে রাখতে পারে। জরিপ থেকে দেখা গেছে, জার্মানির অংশগ্রহণকারীদের ৩৫ শতাংশের কর্মঘণ্টা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশেই ফারলো (Furlough) বা সাময়িক ছুটি দেওয়ার স্কিম থাকলেও যুক্তরাজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় এটি বেশি প্রচলিত। যুক্তরাজ্য সরকারের ঘোষিত করোনাভাইরাস জব রিটেনশন স্কিম অনুসারে কোনো কোম্পানি তিন মাসের জন্য ফারলো ঘোষণা করতে পারবে এবং সরকার হারানো মজুরির ৮০ শতাংশ (মাসে সর্বোচ্চ ২,৫০০ পাউন্ড) ক্ষতিপূরণ প্রদান করবে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার ঘোষিত করোনাভাইরাস এইড, রিলিফ অ্যান্ড ইকোনমিক সিকিউরিটি (সিএআরইএস) অ্যাক্ট (মার্চ ২০২০)-এর মাধ্যমে ফারলো ঘোষিত, অস্থায়ী ও স্বনিয়োজিত কর্মীদের চার মাস ধরে সপ্তাহে বাড়তি ৬০০ ডলার বেকারত্ব ভাতা এবং পরিবারগুলোর জন্য প্রাপ্ত বয়স্কপ্রতি ১২০০ ডলার এবং শিশুদের জন্য ৫০০ ডলার সরাসরি অর্থসহায়তা প্রদান করা হয়। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে যথাক্রমে ৪৩ ও ৩১ শতাংশ অংশগ্রহণকারী ফারলোর শিকার হয়েছেন। জার্মানি ও যুক্তরাজ্য স্বনিয়োজিত কর্মীদের জন্যও বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করে। জার্মানিতে সর্বোচ্চ পাঁচজন পর্যন্ত কর্মী রয়েছে এমন ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানকে এককালীন নয় হাজার ইউরো, ১০ জন কর্মী আছে এমন প্রতিষ্ঠানকে এককালীন ১৫ হাজার ইউরো বরাদ্দ করা হয়। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে সেলফ এমপ্লয়মেন্ট ইনকাম সাপোর্ট স্কিমের আওতায় একজন স্বনিয়োজিত কর্মী তার ব্যাবসায়িক মুনাফার ৮০ শতাংশ, সর্বোচ্চ মাসে দুই হাজার ৫০০ পাউন্ড পর্যন্ত অর্থ তিন মাস ধরে সহায়তা পেতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র সরকার ঘোষিত করোনাভাইরাস এইড, রিলিফ অ্যান্ড ইকোনমিক সিকিউরিটি (সিএআরইএস) অ্যাক্ট (মার্চ ২০২০)-এর মাধ্যমে ফারলো ঘোষিত, অস্থায়ী ও স্বনিয়োজিত কর্মীদের চার মাস ধরে সপ্তাহে বাড়তি ৬০০ ডলার বেকারত্ব ভাতা এবং পরিবারগুলোর জন্য প্রাপ্ত বয়স্কপ্রতি ১২০০ ডলার এবং শিশুদের জন্য ৫০০ ডলার সরাসরি অর্থসহায়তা প্রদান করা হয়।

দ্বিতীয়ত, কাজের ধরন অনুসারে একই দেশের মধ্যে করোনা মহামারির প্রভাবে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। যেসব কাজের একটা বড় অংশ ঘরে বসে করা যায়, সেসব কাজের কর্মীরা তুলনামূলক কম কাজ হারিয়েছেন। দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে ‘খাদ্য প্রস্তুত ও পরিবেশন’ এবং ‘ব্যক্তিগত সেবা’ খাতের কর্মীরা তুলনামূলক বেশি কাজ হারিয়েছেন। অন্যদিকে ‘কম্পিউটার ও হিসাব-নিকাশ সংক্রান্ত’ কিংবা ‘প্রকৌশল ও স্থাপত্য’ সংশ্লিষ্ট পেশার কর্মীরা তুলনামূলক কম কাজ হারিয়েছেন। এ রকম প্রবণতা জার্মানির ক্ষেত্রেও দেখা গেছে।

তৃতীয়ত, স্থায়ীভাবে নিযুক্ত কর্মীরা অস্থায়ী ও স্বনিয়োজিত কর্মীদের তুলনায় কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে নিযুক্ত কর্মীদের কর্ম হারানোর ঝুঁকি অস্থায়ী চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের তুলনায় ১৭ শতাংশ কম। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে এই হার যথাক্রমে ৭ এবং ৫ শতাংশ।

চতুর্থত, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, নারী-পুরুষ ও উচ্চশিক্ষার হার অনুসারে কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া নির্ভর করে। নারী এবং কলেজ শিক্ষিত নয়, এ রকম কর্মীরা তুলনামূলক বেশি কাজ হারিয়েছে। কিন্তু জার্মানিতে এ রকম কোনো পার্থক্য দেখা যায়নি।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কর্মসংস্থানের ওপর করোনা মহামারির প্রভাবের এই পার্থক্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আইএলওর সাবেক শ্রমবিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা রিজওয়ানুল ইসলাম লিখেছেন:

‘যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবাজারের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, সেখানে চাকরি যেমন সহজে পাওয়া যায়, তা সহজে চলেও যেতে পারে। অনেক চাকরির চুক্তিই এমন যে, স্বল্প সময়ের নোটিশে অথবা বিনা নোটিশে কর্মীদের ছাঁটাই করা যায়। কোভিড সংক্রমণ রোধের লক্ষ্যে যখন লকডাউন জারি করা হলো, তখন অনেক ব্যাবসা বন্ধ হয়ে গেল আর সেগুলোতে কর্মরত অনেককেই সঙ্গে সঙ্গে ছাঁটাই করা হয়। সেখানে অবশ্য বেকারত্ব ভাতার ব্যবস্থা রয়েছে এবং অর্থনৈতিক সংকটের শুরুতেই যেসব নীতিমালা গ্রহণ করা হয় তার মধ্যে অন্যতম ছিল, এই ভাতার সময়কাল বাড়ানো।…

অন্যদিকে ইউরোপের, বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশে শ্রম আইন এত সহজে ছাঁটাইয়ের সুযোগ দেয় না। শুধু তা-ই নয়, অনেক দেশেই লকডাউন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতিকে সুরক্ষা দিতে যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়, তার মধ্যে অন্যতম ছিল কর্মী ছাঁটাই রোধ এবং চাকরিগুলো বাঁচিয়ে রাখা। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয়, ইউরোপের সোশ্যাল মডেলের কথা, যার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শোভন কর্মসংস্থান এবং সামাজিক সুরক্ষার মাধ্যমে একটি কল্যাণমুখী সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। এই মডেল কার্যকর করার জন্য কর্মসংস্থানের ধারাবাহিকতা এবং গুণগত মানের ওপর জোর দেওয়া হয়। সে কারণে আইনি কাঠামোতেও কর্মী ছাঁটাইয়ের শর্তাবলি এবং বেকারত্ব ভাতার ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়।’১১

বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের চরিত্রটাই এমন যে, তা মহামারির ফলে বেশিরভাগ শ্রমজীবীর জীবিকা হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ও দেশের সার্বিক বৈষম্য বৃদ্ধির পক্ষে অনুকূল। এখানকার শতকরা ৮৫ ভাগ কর্মসংস্থানই অনানুষ্ঠানিক খাতের, যাদের কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই, আনুষ্ঠানিক কোনো নিরাপত্তা-জাল বা ক্ষতিপূরণের কোনো ব্যবস্থা নেই।

এখন দেখা যাক, করোনা মহামারির ফলে বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের ওপর কেমন প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের বিপদ হলো এই যে, এখানে ইউরোপের মতো কর্মসংস্থানের কোনো ‘সোশ্যাল মডেল’ চালু নেই যে, শ্রমজীবীরা ছাঁটাই হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মডেলের মতো বেকার ভাতার কোনো ব্যবস্থা নেই যে, হুট করে ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকরা পরবর্তী কর্মসংস্থান পাওয়ার আগপর্যন্ত বেকার ভাতার ওপর নির্ভর করে চলতে পারবে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের চরিত্রটাই এমন যে, তা মহামারির ফলে বেশিরভাগ শ্রমজীবীর জীবিকা হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ও দেশের সার্বিক বৈষম্য বৃদ্ধির পক্ষে অনুকূল। এখানকার শতকরা ৮৫ ভাগ কর্মসংস্থানই অনানুষ্ঠানিক খাতের, যাদের কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই, আনুষ্ঠানিক কোনো নিরাপত্তা-জাল বা ক্ষতিপূরণের কোনো ব্যবস্থা নেই। এর মধ্যে কৃষি খাতে অনানুষ্ঠানিক শ্রমের অংশ ৯৫.৪, শিল্পে ৮৯.৩, নির্মাণে ৯১.৯, পরিবহণ ও যোগাযোগ খাতে ৯২.৫ শতাংশ। মোট কর্মীদের ৩৪.৫ শতাংশ দৈনিক ভিত্তিতে এবং ৭.৩ শতাংশ সাপ্তাহিক ভিত্তিতে নিয়োজিত–যাদের কাজের কোনো স্থায়িত্ব নেই এবং কাজ না-থাকলে তাদের কোনো আয় থাকে না। আর বাংলাদেশে মোট কর্মসংস্থানের মাত্র ১০ শতাংশ কাজ ঘরে বসে সম্পাদন করা সম্ভব।১২ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য প্রতিকূল–এ রকম একটা শ্রমবাজারে যখন করোনার আঘাত লাগল, তখন তা কী পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে–সহজেই অনুমেয়। আবার মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে প্রণোদনা হিসেবে ৪-৫ শতাংশ সুদে যে ঋণ বিতরণ করা হয়, তার একটা বড় অংশ পেয়েছে বড় শিল্পগ্রুপ ও প্রভাবশালীরা। প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ প্রদানসংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত শিল্প ও সেবা খাতের ৪০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে বেসরকারি খাতের শিল্পগ্রুপগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ৯৬১ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে আবুল খায়ের গ্রুপ। এ ছাড়া এস আলম গ্রুপও পেয়েছে ৮৫১ কোটি টাকা, বিএসআরএম গ্রুপ ৬১৯ কোটি টাকা, বসুন্ধরা গ্রুপ ৬০০ কোটি টাকা, প্রাণ গ্রুপ ৫৪০ কোটি, সিটি গ্রুপ ৫০২ কোটি, কেএসআরএম ৩২৫ কোটি, জিপিএইচ ইস্পাত ২৮৬ কোটি, এসিআই গ্রুপ ৩০৪ কোটি, নাভানা গ্রুপ ২৬৮ কোটি, বেক্সিমকো গ্রুপ ২৬০ কোটি, জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ২৩৫ কোটি, স্কয়ার গ্রুপ ২০২ কোটি এবং থারমেক্স গ্রুপ ১৯০ কোটি টাকার ঋণ পেয়েছে। এভাবে বড় গ্রুপগুলো বেশিরভাগ ঋণ পাওয়ায় ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা বঞ্চিত হয়েছেন। এমনকি কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতের জন্য বরাদ্দ করা ঋণও প্রান্তিক পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। এতে কেউ কেউ ব্যাবসা বন্ধ করে দিয়েছেন, আবার অনেকে ব্যাবসা ছোট করে আনছেন। এর প্রভাব পড়েছে দেশের কর্মসংস্থানের ওপর।১৩

৪০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে বেসরকারি খাতের শিল্পগ্রুপগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ৯৬১ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে আবুল খায়ের গ্রুপ। এ ছাড়া এস আলম গ্রুপও পেয়েছে ৮৫১ কোটি টাকা, বিএসআরএম গ্রুপ ৬১৯ কোটি টাকা, বসুন্ধরা গ্রুপ ৬০০ কোটি টাকা, প্রাণ গ্রুপ ৫৪০ কোটি, সিটি গ্রুপ ৫০২ কোটি, কেএসআরএম ৩২৫ কোটি, জিপিএইচ ইস্পাত ২৮৬ কোটি, এসিআই গ্রুপ ৩০৪ কোটি, নাভানা গ্রুপ ২৬৮ কোটি, বেক্সিমকো গ্রুপ ২৬০ কোটি, জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ২৩৫ কোটি, স্কয়ার গ্রুপ ২০২ কোটি এবং থারমেক্স গ্রুপ ১৯০ কোটি টাকা

হকার, দিনমজুর, রিকশাচালক, পরিবহণ শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, দোকান-হোটেল-রেস্তোরাঁর কর্মচারীসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের আয় যেহেতু দৈনিক কাজের ওপর নির্ভরশীল, সেহেতু লকডাউনের কারণে তারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কিন্তু এসব অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য কোনো ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেমন, রেশন ইত্যাদির কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা না-থাকা, সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে তাদের কোনো তালিকা বা ডেটাবেজ না-থাকার কারণে এবং তাদেরকে চিহ্নিত করে অল্প সময়ের মধ্যে তাদের কাছে নগদ অর্থ ও খাদ্যসহায়তা পৌঁছে দেওয়ার যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ না-নেওয়ার কারণে কাজ হারানো এই শ্রমজীবী মানুষকে দিন কাটাতে হয় নিদারুণ কষ্টে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬ সালের জরিপ অনুসারে, দেশে মোট শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ছয় কোটি। যার মধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের সংখ্যা ৮৫.১ শতাংশ অর্থাৎ পাঁচ কোটিরও বেশি শ্রমিক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের। এই বিপুল পরিমাণ শ্রমজীবী মানুষ দেশের অর্থনীতিতে বিপুল অবদান রাখলেও সরকারি প্রণোদনায় তাদের ভাগ ছিল খুবই সামান্য। মহামারির কারণে সরকার যে এক লাখ ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকার ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে, তার সিংহভাগই ছিল প্রাতিষ্ঠানিক খাতকে সহযোগিতার জন্য। এককালীন দুই হাজার ৫০০ টাকা করে ২০২০ সালে ৩৪ লাখ ৯৭ হাজার এবং ২০২১ সালে  ১৭ লাখ ২৪ হাজার ৪৭০ জন নিম্ন আয়ের শ্রমজীবি মানুষকে যে নগদ সহায়তা করা হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় ছিল খুবই অপ্রতুল।১৪

হকার, দিনমজুর, রিকশাচালক, পরিবহণ শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, দোকান-হোটেল-রেস্তোরাঁর কর্মচারীসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের আয় যেহেতু দৈনিক কাজের ওপর নির্ভরশীল, সেহেতু লকডাউনের কারণে তারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কিন্তু এসব অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য কোনো ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেমন, রেশন ইত্যাদির কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা না-থাকা, সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে তাদের কোনো তালিকা বা ডেটাবেজ না-থাকার কারণে এবং তাদেরকে চিহ্নিত করে অল্প সময়ের মধ্যে তাদের কাছে নগদ অর্থ ও খাদ্যসহায়তা পৌঁছে দেওয়ার যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ না-নেওয়ার কারণে কাজ হারানো এই শ্রমজীবী মানুষকে দিন কাটাতে হয় নিদারুণ কষ্টে।

উদাহরণস্বরূপ, হোটেল-রেস্তোরাঁ, নির্মাণ ও পরিবহণ খাতের শ্রমিকদের কথা বলা যেতে পারে। বাংলাদেশ হোটেল-রেস্টুরেন্ট-সুইটমিট-বেকারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি আক্তারুজ্জামান খানের বক্তব্য অনুসারে, মহামারির শুরু থেকে এই ইউনিয়নের কোনো শ্রমিক কোনো ধরনের সরকারি সহায়তা পাননি। তার হিসাবে, এই খাতে নিয়োজিত ৩০ লাখ শ্রমিকের প্রত্যেকে ভয়ানক আর্থিক সংকট অতিক্রম করেছেন। ২০২০ সালের লকডাউনে কাজ হারানো শ্রমিকদের অন্তত ৪২ শতাংশ বা ১২ লাখ শ্রমিক ২০২১ সালের মে মাসেও বেকার ছিলেন। কারণ, লকডাউন শিথিলের পরেও অনেক রেস্তোরাঁ মালিক তাদের লোকবল কমিয়ে দেন। তাদের দাবি ছিল, প্রতিমাসে বেকার শ্রমিকদের যেন অন্তত ১০ হাজার টাকা করে নগদ আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। তারা এ জন্য প্রধানমন্ত্রী ও শ্রম প্রতিমন্ত্রী বরাবর চারটি বিবৃতি দিয়েছিলেন; কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। বাংলাদেশ ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুর রাজ্জাক জানান, এই খাতের শ্রমিকদের জন্য সরকারি সহায়তা চাওয়ার ব্যাপারে তার সংগঠন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তারা অনেকবার সরকারের কাছে সহযোগিতার দাবি জানানোর পরও কোনো সাড়া পাননি। তার তথ্যমতে, ২০২০ সালের লকডাউনে অল্প কিছু নির্মাণ শ্রমিক বিভিন্ন জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ত্রাণসহায়তা পেয়েছিলেন। তার হিসাব অনুসারে, চলাচলের ক্ষেত্রে চলমান বিধিনিষেধের কারণে এই খাতের অন্তত ৪০ শতাংশ অর্থাৎ ১৬ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন। সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলীর বক্তব্য অনুসারে লকডাউনের কারণে প্রায় ৫০ লাখ পরিবহণ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েন, যারা পরিবার নিয়ে দুর্দশাগ্রস্ত জীবন কাটাতে বাধ্য হন। পরিবহণ খাতের কিছু সংগঠন সরকারের কাছে আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি শ্রমিকদের জন্য রেশন চালু করার দাবি জানিয়েছিল, যার মধ্যে বাস টার্মিনালগুলোতে ১০ টাকা কেজি দরের চাল বিক্রির দাবিও অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু তাদের সেই দাবি পূরণ হয়নি।১৫

এ বিষয়ে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান যেসব জরিপ করেছে, তা থেকে বেশিরভাগ শ্রমজীবী মানুষের জীবিকা হারিয়ে চরম বিপর্যস্ত হওয়ার চিত্রটাই পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘কোভিড-১৯ বাংলাদেশ: জীবিকার ওপর অভিঘাতের ধারণা জরিপ-২০২০’ শীর্ষক জরিপ অনুসারে, এপ্রিল-জুলাই সময়ে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ২২.৩৯ শতাংশ নিজেদের বেকার বলে উল্লেখ করেছিল।১৬

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) পরিচালিত ‘পভার্টি ডায়নামিকস অ্যান্ড হাউসহোল্ড রিয়েলিটিস’শীর্ষক জরিপ অনুসারে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে চাকরি ছিল এমন ১৭ শতাংশ মানুষ জুন-২০২০ নাগাদ কর্মসংস্থান হারিয়েছিল, এই কর্মসংস্থান হারানো মানুষের মধ্যে গড়ে ৮ শতাংশ ২০২১-এর মার্চ পর্যন্ত কোনো কর্মসংস্থান পায়নি। কিন্তু কোনো কোনো পেশার কর্মজীবীদের মধ্যে কাজ ফিরে না-পাওয়ার হার তুলনামূলক বেশি যেমন: দক্ষ শ্রমিক (১৪%), চাকরিজীবী (১১%) এবং গৃহকর্মী (৩২%)। মহামারির অভিঘাত সামাল দেওয়ার জন্য মার্চ ২০২১ নাগাদ ৪১ শতাংশ মানুষকে কর্মসংস্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে। মহামারি শুরুর পর এক বছরে ২৭ দশমিক তিন শতাংশ বস্তিবাসী বাধ্য হয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যান, যাদের ৯.৮ শতাংশ এক বছর পরেও ফিরে আসেননি।১৭

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর ‘কোভিডকালে আয় ও কর্মসংস্থান পরিস্থিতি: কীভাবে মানুষ টিকে আছে?’ শীর্ষক একটি জরিপ অনুসারে, করোনা-পূর্ব সময়ে কর্মসংস্থান ছিল এমন মানুষের শতকরা প্রায় ৬২ শতাংশ করোনাকালীন সময়ে, বিশেষত মে ও জুন ২০২০-এর লকডাউন চলাকালীন কর্মহীন হয়ে যায়। এই কর্মহীন হয়ে যাওয়া মানুষের মধ্যে ৮৫ শতাংশ এক মাসের বেশি সময় কর্মহীন ছিল। জরিপ চলাকালীন সময় অর্থাৎ জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০২১ নাগাদ তাদের প্রায় সবাই আবার কর্মসংস্থান পেলেও তাদের কর্মসংস্থানের ধরন পরিবর্তন করতে হয়, তাদের আয় হ্রাস পায় (১২ শতাংশ) ও কর্মঘণ্টা কমে যায়। তাদের কর্মসংস্থানের একটা বড় অংশ এসেছে স্বনিয়োজিত কর্মসংস্থান ও দিনমজুরির মাধ্যমে। দেখা যায়, তাদের কর্মসংস্থান আনুষ্ঠানিক খাত থেকে অনানুষ্ঠানিক খাতের দিকে সরে গিয়েছে। সেবা খাত থেকে কৃষি খাতের দিকে সরে যেতে বাধ্য হওয়ায় কৃষি খাতের গড় আয় আবার কমে যায় (১৭ শতাংশ)। জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় ৪৫ শতাংশ পরিবারের আয় করোনা-পূর্ব আয়ের সমান হয়নি। ৮৬ শতাংশ জানায়, তাদের আয় প্রতিদিনের খরচ মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য পরিবারের আরও বেশিসংখ্যক সদস্য কর্মসংস্থানের খোঁজ করেন। জরিপে অংশ নেওয়া ৭৮ শতাংশ ব্যক্তি তাদের ব্যয় হ্রাস করতে এবং ৫৩ শতাংশ পরিবার খাবারের ধরন পাল্টাতে বাধ্য হয়। প্রায় ৪৭ শতাংশ পরিবারের সঞ্চয় হ্রাস পায় এবং ৫৬ শতাংশ পরিবার ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। পরিবারপ্রতি গড় ঋণ হয়ে যায় দ্বিগুণ। মাত্র ২০ শতাংশ পরিবার সরকারের কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছে বলে জানায়, বেশিরভাগকেই (৪৬ শতাংশ) বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও বেসরকারি ত্রাণের ওপর নির্ভর করতে হয়।১৮

শুধু অনানুষ্ঠানিক খাত নয়, আনুষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবীদেরও করোনায় সংক্রমণ ও জীবিকা হারানোর ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, গার্মেন্টস সেক্টরের কথা বলা যেতে পারে। মহামারিতে কারখানা খোলা থাকা না-থাকার অনিশ্চয়তার মধ্যে একাধিকবার শ্রমিকদের হেঁটে ঢাকা ত্যাগ ও ঢাকায় ফেরত আসার মতো নিদারুণ ঘটনা ঘটেছে। শেষপর্যন্ত মহামারির ঝুঁকির মধ্যেই কারখানা খোলা থাকার সিদ্ধান্ত হয় এবং সরকারি প্রণোদনা ও আগের চেয়ে কম মজুরিতে কাজ করার পরও বিপুলসংখ্যক শ্রমিককে ছাঁটাইয়ের শিকার হতে হয়।১৯

ঢাকা ও গাজীপুরের ১০২টি পোশাক কারখানা (এর মধ্যে বড় কারখানা ২৩.৫ শতাংশ ও ছোট কারখানা ৭৬.৫ শতাংশ), ৩০১ জন কর্মরত শ্রমিক ও ১০০ জন বেকার শ্রমিকের তথ্য নিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও সজাগ কোয়ালিশনের ‘Corporate Accountability of the RMG sector in view of Covid-19 Pandemic: Challenges in Ensuring Workers’ Well-being’ শীর্ষক যৌথ গবেষণা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য পোশাক কারখানাগুলো সরকারের কাছ থেকে ২০২০ সালে ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা পেলেও এই সুবিধা পাওয়া ২৫ শতাংশ কারখানা শ্রমিক ছাঁটাই করেছে। চাকরি হারানো শ্রমিকদের ৫৯ শতাংশ স্রেফ মজুরি পেয়েছেন, কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি, আর ১৮ শতাংশ শ্রমিক ক্ষতিপূরণ তো দূরের কথা, মজুরিটুকুও পাননি। চাকরি হারানো শ্রমিকদের মধ্যে যারা নিজেদের কারখানায় কাজ ফিরে পাননি, তাদের ২০ শতাংশ দিনমজুরের কাজ করেন। ২০ শতাংশের মতো শ্রমিক কাজ করছেন অনানুষ্ঠানিক খাতে। আরও ২০ শতাংশ শ্রমিক পোশাক খাতের বাইরে বিভিন্ন কারখানায় কাজ নিয়েছেন। নিজেরাই কিছু করার চেষ্টা করেছেন, এমন শ্রমিক প্রায় ২৭ শতাংশ। মাত্র ৬ দশমিক ৭ শতাংশ শ্রমিক তৈরি পোশাক খাতেই কাজ ফিরে পেয়েছেন। জরিপে অংশ নেওয়া শ্রমিকদের ৩০ শতাংশ অভিযোগ করেছেন, করোনার পর তাদের ওপর কাজের চাপ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শ্রমসংক্রান্ত হয়রানির অভিযোগ করেছে ২২ শতাংশ। শ্রম আইনে শ্রম অধিকার সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি ধারা স্থগিত রাখার কারণে তারা কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। নতুন কাজে শ্রমিকদের আয়ও কমে গেছে। আগে যেখানে শ্রমিকরা মাসে ৮ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় করত, সেখানে চাকরি হারানোর পর নতুন কাজে তারা এখন মাসে গড়ে সাত হাজার টাকা আয় করে।২০

শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য পোশাক কারখানাগুলো সরকারের কাছ থেকে ২০২০ সালে ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা পেলেও এই সুবিধা পাওয়া ২৫ শতাংশ কারখানা শ্রমিক ছাঁটাই করেছে। চাকরি হারানো শ্রমিকদের ৫৯ শতাংশ স্রেফ মজুরি পেয়েছেন, কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি, আর ১৮ শতাংশ শ্রমিক ক্ষতিপূরণ তো দূরের কথা, মজুরিটুকুও পাননি।

বিশ্বজুড়ে ধনীরা আরও ধনী, দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হয়েছে

করোনা মহামারির প্রভাবে বিশ্বজুড়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠী যখন জীবন ও জীবিকার সংকটে ভুগছে, তখন ধনীদের সম্পদ বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। ১৮ মার্চ ২০২০ থেকে ১৮ মার্চ ২০২১-এর মধ্যে বিশ্বের দুই হাজার ৩৬৫ বিলিওনিয়ার বা শতকোটিপতিদের সম্পদ ৮.০৪ ট্রিলিয়ন থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১২.৩৯ ট্রিলিয়ন। এক বছরে সম্পদ বৃদ্ধির পরিমাণ চার ট্রিলিয়ন ডলার বা ৫৪ শতাংশ।২১ অক্সফামের ‘ইনইকোয়ালিটি ভাইরাস’ শীর্ষক রিপোর্ট২২ অনুসারে এ সময়ে সবচেয়ে ধনী ১০ বিলিওনিয়ারের সম্পদ বৃদ্ধি পায় ৫৪০ বিলিয়ন ডলার। যে দুজনের সম্পদ সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায় তাদের ব্যাবসা ছিল প্রযুক্তি, অটোমোবাইল, ব্যাটারি উৎপাদন ও মহাকাশবিষয়ক: এলন মাস্কের সম্পদ বৃদ্ধি পায় ১২৮.৯ বিলিয়ন ও জেফ বেজোসের ৭৮.২ বিলিয়ন।

১৮ মার্চ ২০২০ থেকে ১৮ মার্চ ২০২১-এর মধ্যে বিশ্বের দুই হাজার ৩৬৫ বিলিওনিয়ার বা শতকোটিপতিদের সম্পদ ৮.০৪ ট্রিলিয়ন থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১২.৩৯ ট্রিলিয়ন। এক বছরে সম্পদ বৃদ্ধির পরিমাণ চার ট্রিলিয়ন ডলার বা ৫৪ শতাংশ।

মহামারির শুরু থেকেই বৃহৎ করপোরেশনগুলো শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতের চেয়ে মুনাফা অর্জনের ওপর জোর দেয়, পুরো সাপ্লাই চেইন ধরে খরচ কমিয়ে আনে ও সরকারগুলোর নীতিমালা নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসার জন্য রাজনৈতিক প্রভাব খাটায়। এর ফলে বৃহৎ করপোরেশনগুলোর মুনাফা ব্যাপক বৃদ্ধি পায় ও এসব কোম্পানির ধনী শেয়ার মালিকদের সম্পদের উল্লম্ফন ঘটে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান (এসএমই) এবং নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ ক্ষতির মুখে পড়ে। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সারির ২৫টি বৃহৎ করপোরেশনের মুনাফা যেখানে ১১ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষুদ্র ব্যাবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো ২০২০ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে তাদের মুনাফার ৮৫ শতাংশ হারায়। মার্চ ও অক্টোবর ২০২০-এর মধ্যে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রির মালিক ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি মুকেশ আম্বানির সম্পদ দ্বিগুণ হয়, যার পরিমাণ ৭৮.৩ বিলিয়ন ডলার। এই সময়ে আম্বানির সম্পদ প্রতি চার দিনে যে পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, তা তার কোম্পানির এক লাখ ৯৫ জন কর্মীর মোট বার্ষিক মজুরির চেয়েও বেশি। মার্চ ২০২০ থেকে আগস্ট ২০২০-এর মধ্যে জেফ বেজোস যে সম্পদ অর্জন করেছেন, তা কাজে লাগিয়ে তিনি যদি আট লাখ ৭৬ হাজার কর্মীর প্রত্যেককে এক লাখ পাঁচ হাজার ডলার করে বোনাস দিতেন, তারপরও তার সম্পদ মহামারি-পূর্ব সময়ের সমপরিমাণ থাকত।২৩

মার্চ ও অক্টোবর ২০২০-এর মধ্যে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রির মালিক ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি মুকেশ আম্বানির সম্পদ দ্বিগুণ হয়, যার পরিমাণ ৭৮.৩ বিলিয়ন ডলার। এই সময়ে আম্বানির সম্পদ প্রতি চার দিনে যে পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, তা তার কোম্পানির এক লাখ ৯৫ জন কর্মীর মোট বার্ষিক মজুরির চেয়েও বেশি।

মার্চ এবং আগস্ট ২০২০-এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের অতি ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধি পায় ২০ শতাংশ, যা ওই সময়ে ওই অঞ্চলের জন্য আইএমএফ-এর জরুরি ঋণসহায়তা তহবিলের সমপরিমাণ এবং জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা তহবিলের পাঁচ গুণ। মার্চ ও জুলাই ২০২০-এর মধ্যে ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের অতি ধনীদের সম্পদ বাড়ে ১৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলার, যা ওই সময়ে করোনা মহামারি উপলক্ষ্যে গোটা অঞ্চলের সরকারগুলো কর্তৃক নেওয়া প্রণোদনা প্যাকেজের এক-তৃতীয়াংশ, আইএমএফ-এর জরুরি ঋণের টাকার নয় গুণ এবং এক বছরে এক কোটি ২৪ লাখ মানুষকে চরম দারিদ্র্যের হাত থেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের পাঁচ গুণ। সারা দুনিয়ার ধনীরা যে মহামারির সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাবগুলোর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে, সে বিষয়ে বিভিন্ন প্রমাণ পাওয়া যায়। লকডাউনের সময় যুক্তরাজ্যের নিম্ন আয়ের মানুষ যখন ঋণজালে আটকে পড়ে, ধনীরা তখন ৩০ বিলিয়ন ডলার সঞ্চয় করে। লেবাননের অর্থনীতিতে যখন ধস নামে, সেখানকার অতি ধনীরা তখন পাহাড়ি রিসোর্টে শান্তি খুঁজে নেয়। লকডাউনের সময় সারা দুনিয়ায় বাণিজ্যিক বিমান চলাচল যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন ব্যক্তিগত জেট বিমানের বিক্রি বেড়ে যায় আর ধনীরা আরও বেশি করে তাদের অর্থ বিভিন্ন করস্বর্গে স্থানান্তর করে ফেলে।২৪

অন্যদিকে অক্সফামের এই প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০ সালে দৈনিক সাড়ে পাঁচ ডলারের কম উপার্জনকারী মানুষের সংখ্যা ২০ কোটি থেকে ৫০ কোটি বৃদ্ধি পেয়ে থাকতে পারে। ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভের তথ্যানুসারে, করোনা মহামারির কারণে বিশ্বের প্রায় সব দেশের দরিদ্রতম মানুষের আয় হ্রাস পায়। নতুন করে দরিদ্র হওয়া মানুষের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নাগরিক। ২০২০ সালে ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের চার কোটি মানুষ কর্মসংস্থান হারানো এবং পাঁচ কোটি ২০ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে পড়ে। করোনাভাইরাস মহামারি যে বিষয়টা উন্মোচিত করে দেয় তা হলো, বেশিরভাগ মানুষের মানবেতর জীবনযাপনের বাস্তবতা। স্বাভাবিক সময়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দারিদ্র্যসীমার উপরে কোনো রকমে টিকে জীবনযাপন করে। বিশ্বের প্রায় ৫৬ শতাংশ মানুষ দৈনিক দুই থেকে ১০ ডলার উপার্জন করে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর অর্ধেক কর্মজীবী মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে। বেকার ভাতা, চিকিৎসা ভাতা ইত্যাদি কোনো ধরনের সুরক্ষা ছাড়াই তাদেরকে কাজ করতে হয়। এ কারণেই মহামারির মধ্যে লকডাউনের ফলে তারা রাতারাতি ক্ষুধার হুমকির মধ্যে পড়ে যায়।২৬

নতুন করে যারা দরিদ্র হয়েছে, তাদের বেশিরভাগই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মী। তাদের জন্য কোনো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থাকে না, আনুষ্ঠানিক ঋণ সুবিধাও তারা পায় না। সংকটের সময় তাই তাদেরকে বাইসাইকেল, গবাদি পশুর মতো সম্পদ পানির দরে বেচে দিতে হয়। ফলে তাদের পক্ষে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে। তারা দারিদ্র্যের ফাঁদে আটকা পড়ে। দারিদ্র্যের এই ফাঁদটা এমন যে, সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি না-থাকলে এতে আটকে পড়া ব্যক্তিরা অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালেও দ্রুত তা থেকে বের হয়ে আসতে পারে না। এতে বৈষম্য আরও বেড়ে যায়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন নারী, তরুণ, শিশু, আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও অভিবাসী শ্রমিক। কারণ, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে তারাই বেশি কাজ করেন।

করোনা মহামারিতে বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও বৈষম্য পরিস্থিতি

আগেই বলা হয়েছে, কোনো দেশের দারিদ্র্য ও বৈষম্যের ওপর মহামারির প্রভাব কেমন পড়বে, তা অনেকাংশেই নির্ভর করে বিদম্যান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ওপর। যে নয়া উদারনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির প্রভাবে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে, বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। বরং সুপ্রতিষ্ঠিত গণবণ্টন ব্যবস্থা ও পূর্ণাঙ্গ জীবনচক্রভিত্তিক সুনির্দিষ্ট সামাজিক কর্মসূচি না-থাকার কারণে মহামারির অভিঘাত বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ওপর আরও তীব্রভাবে পড়েছে।২৬ বাংলাদেশের চলমান প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধরনটি এমন যে, একদিকে অতি ধনী বৃদ্ধির হারের দিকে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম এবং ধনী বৃদ্ধির হারে বিশ্বে তৃতীয়, অন্যদিকে অতি গরিব মানুষের সংখ্যা বেশি এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম।২৭ বৈষম্য পরিমাপের গিনি সহগ ১৯৮৩-৮৪ সালের ০.৩৬ থেকে বাড়তে বাড়তে ২০১৬-তে ০.৪৮-এ উঠেছে। ফলে মহামারি পূর্বাবস্থায় বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অবস্থাটা এমন ছিল যে, দারিদ্র্যরেখা ১০ শতাংশ উপরে উঠিয়ে দিলে গ্রামাঞ্চলে দরিদ্রের সংখ্যা বেড়ে যায় ২৯ শতাংশ আর শহরাঞ্চলে ৩৩ শতাংশ।২৮ এ রকম একটা পরিস্থিতিতে করোনা মহামারির আঘাত এলো, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে গেল।

একদিকে অতি ধনী বৃদ্ধির হারের দিকে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম এবং ধনী বৃদ্ধির হারে বিশ্বে তৃতীয়, অন্যদিকে অতি গরিব মানুষের সংখ্যা বেশি এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘কোভিড-১৯ বাংলাদেশ: জীবিকার ওপর অভিঘাতের ধারণা জরিপ-২০২০’ শীর্ষক জরিপ অনুসারে, কোভিড-১৯-এর প্রভাবে ২০২০ সালের মার্চের তুলনায় আগস্টে দেশের পরিবারগুলোর গড় আয় হ্রাস প্রায় ২০ দশমিক ২৪ শতাংশ। এ সময় আর্থিক সংকট মোকাবিলায় মাত্র ২১ দশমিক ৩৩ শতাংশ পরিবার সরকারি সহায়তা পায় বলে জরিপ থেকে জানা যায়। ১৩ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০-এ টেলিফোনে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে করা এই ধারণা জরিপে দুই হাজার রিকশাচালক থেকে ডাক্তার, প্রকৌশলীসহ সব শ্রেণির পেশাজীবীকে দৈবচয়ন প্রক্রিয়ায় নির্বাচন করা হয়, যার মধ্যে ৯৮৯ জন তাদের তথ্য প্রদান করে। জরিপের তথ্যানুযায়ী, করোনা মহামারির আগে যে পরিবার ১৯ হাজার ৪২৫ টাকা মাসিক আয় করত, সেই পরিবার ২০২০-এর আগস্টে আয় করে ১৫ হাজার ৪৯২ টাকা। অর্থাৎ, এ সময়ে আয় কমে তিন হাজার ৯৩৩ টাকা। প্রায় ৬৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ পরিবার কোনো-না-কোনোভাবে কোভিড-১৯-এর অভিঘাতে আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়। বিশেষ করে রিকশা-ভ্যানচালক ও দিনমজুররা অধিক মাত্রায় আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হন।২৯

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর ‘দারিদ্র্য ও জীবিকার ওপর কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব: সানেমের দেশব্যাপী জরিপের ফলাফল’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে, করোনা মহামারির প্রভাবে দেশের সার্বিক দারিদ্র্যের (আপার পোভার্টি রেট) হার ২০১৮ সালের ২১.৬ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২০ সালে ৪২ শতাংশ হয় এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৯.৪ শতাংশ থেকে বেড়ে হয় ২৮.৫ শতাংশ। গ্রাম ও শহরাঞ্চলের সার্বিক দারিদ্র্যের হার দাঁড়ায় যথাক্রমে ৪৫.৩ ও ৩৫.৪ শতাংশ এবং চরম দারিদ্র্যের হার দাঁড়ায় যথাক্রমে ৩৩.২ ও ১৯ শতাংশ। ২০১৮ সালে সানেম পরিকল্পনা কমিশনের জেনারেল ইকোনমিক ডিভিশন (জিইডি)-এর সঙ্গে যৌথভাবে দেশজুড়ে ১০ হাজার ৫০০ পরিবারের ওপর একটি জরিপ করে। দারিদ্র্য, বৈষম্য ও কর্মসংস্থানের ওপর করোনার প্রভাব পরিমাপের জন্য সানেম সেই একই পরিবারের মধ্য থেকে টেলিফোনে মোট পাঁচ হাজার ৫৭৭টি পরিবারের ওপর ২০২০ সালের ২ নভেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত জরিপ পরিচালনা করে। জরিপের ফল অনুসারে, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২০ সালে অতি দরিদ্র (সর্বনিম্ন দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী), মোটামুটি দরিদ্র (দারিদ্র্যের নিম্ন ও ঊর্ধ্বসীমার মধ্যে বসবাসকারী) ও দারিদ্রসীমার কিছুটা উপরে বসবাসকারী পরিবারগুলোর গড় ব্যয় হ্রাস পায় যথাক্রমে ৪৫, ২৯ ও ১৭ শতাংশ। অন্যদিকে অতি দরিদ্র পরিবারগুলোর ব্যয় বৃদ্ধি পায় ৬ শতাংশ। জরিপ থেকে আরও দেখা যায়, করোনার প্রভাবে মাত্র ১৭.৩ শতাংশ পরিবার কোনো বিপত্তি ছাড়াই আগের মতো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ৫৫.৯ শতাংশ পরিবারের কাজ থাকা সত্ত্বেও আয় কমে, ৮.৬ শতাংশ পরিবার কাজ হারায়, ৭ শতাংশ পরিবারের কাজের সময় হ্রাস পায় এবং ৩৩.২ শতাংশ পরিবার বলেছে, তারা কিছু সময়ের জন্য কাজ হারিয়েছিল। এ ছাড়া ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যে পরিবারের প্রধান উপার্জনকারীদের প্রায় সবারই গড় আয় হ্রাস পায়। এই আয় হ্রাসের হার স্বনিযুক্তদের জন্য ছিল ৩২ শতাংশ, মজুরিভিত্তিক কর্মীদের জন্য ২৩, দিনমজুরের জন্য ২৯ এবং অন্যদের জন্য ৩৫ শতাংশ। সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ পরিবার ও দরিদ্রতম ২০ শতাংশ পরিবারের আয়ের অনুপাত ফেব্রুয়ারি ২০২০-এ ছিল ২ দশমিক ০৫ শতাংশ, যা নভেম্বর ২০২০-এ বেড়ে হয় ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অন্যদিকে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ পরিবার ও দরিদ্রতম ২০ শতাংশ পরিবারের ব্যয়ের অনুপাত ২০১৮ সালে ছিল ১ দশমিক ৩৪, যা নভেম্বর ২০২০-এ বেড়ে হয় ২ দশমিক ১৫ শতাংশ। এর কারণ হলো, ধনী ৫ শতাংশ পরিবারের ব্যয়ের অংশ যেখানে ১ দশমিক ০২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, সেখানে দরিদ্রতম ২০ শতাংশ পরিবারের ব্যয়ের অংশ ৩ দশমিক ১৩ শতাংশ হ্রাস পায়। কিন্তু জরিপে যেহেতু অতিধনী পরিবারগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল না, তাই প্রকৃতপক্ষে আয় ও ব্যয়ের বৈষম্যের পরিমাণ হবে আরও অনেক বেশি।৩০

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) পরিচালিত ‘পভার্টি ডায়নামিকস অ্যান্ড হাউসহোল্ড রিয়েলিটিস’ শীর্ষক জরিপ অনুসারে, মহামারির প্রথম ঢেউয়ে জুন ২০২০ নাগাদ তিন কোটি ৭০ লাখ মানুষ অর্থাৎ জনসংখ্যার প্রায় ২২ শতাংশ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। করোনা মহামারির আগে যে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ দরিদ্র ছিল, তাদের সঙ্গে যোগ হয় নতুন এই ২২ শতাংশ। মার্চ ২০২১-এ এসে দেখা যায়, এক বছরে নতুন দরিদ্রের সবাই দারিদ্র্যমুক্ত হতে পারেনি, দুই কোটি ৪৫ লাখ ‘নতুন দরিদ্র’ দরিদ্রই রয়ে গেছে। জরিপ থেকে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারি ২০২০-এ যাদের মাথাপিছু আয় ছিল ১১৬ টাকা, জুন ২০২০-এ তা ৪৪ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ৬৫ টাকা হয়ে যায়। মার্চ ২০২১-এ এসেও তা আগের সমান হয়নি, ১০৭ টাকা হয়, যা আগের তুলনায় ৭ শতাংশ কম। শহুরে বস্তিতে এর পরিমাণ ফেব্রুয়ারি ২০২০-এর তুলনায় ১৪ শতাংশ কম। জুন ২০২০ নাগাদ যেসব পেশার মানুষ সবচেয়ে বেশি আয় হারিয়েছে তারা হলো: পরিবহণ শ্রমিক (আয়ের ৪৮%), কৃষিশ্রমিক (৩৩%), দক্ষ (৪৩%) ও অদক্ষ শ্রমিক (৫০%), ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী (৪৯%), রিকশাচালক (৪৮%), গৃহকর্মী (৬১%)। এর মধ্যে কৃষিশ্রমিকের আয় আগের চেয়ে কিছুটা ভালো হলেও বাকিদের আয় এক বছরেও পূর্বাবস্থায় ফেরেনি। করোনা-পূর্ব সময়ের তুলনায় শহরের বস্তিবাসীর আয় কমলেও খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় জুন ২০২০-এর তুলনায় মার্চ ২০২১-এ দ্বিগুণ হয়েছে। এ সময়ে সবার সঞ্চয় কমেছে এবং ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রামীণ ও শহুরে পরিবারের সঞ্চয় কমেছে যথাক্রমে ২৪ ও ১১ শতাংশ এবং ঋণ বেড়েছে যথাক্রমে ৭৬ ও ৮৬ শতাংশ।৩১

মহামারির প্রথম ঢেউয়ে জুন ২০২০ নাগাদ তিন কোটি ৭০ লাখ মানুষ অর্থাৎ জনসংখ্যার প্রায় ২২ শতাংশ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। করোনা মহামারির আগে যে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ দরিদ্র ছিল, তাদের সঙ্গে যোগ হয় নতুন এই ২২ শতাংশ।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ‘কোভিডকালে আয় ও কর্মসংস্থান পরিস্থিতি: কীভাবে মানুষ টিকে আছে?’ শীর্ষক জরিপ থেকে দেখা যায়, জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় ৪৫ শতাংশ পরিবারের আয় করোনা-পূর্ব আয়ের সমান হয়নি। ৮৬ শতাংশ ব্যক্তি জানান, তাদের আয় প্রতিদিনের খরচ মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য পরিবারের আরও বেশিসংখ্যক সদস্য কর্মসংস্থানের খোঁজ করেন। জরিপে অংশ নেওয়া ৭৮ শতাংশ ব্যক্তি তাদের ব্যয় হ্রাস করতে এবং ৫৩ শতাংশ পরিবার খাবারে ধরন পালটাতে বাধ্য হয়। প্রায় ৪৭ শতাংশ পরিবারের সঞ্চয় হ্রাস পায় এবং ৫৬ শতাংশ পরিবার ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। পরিবারপ্রতি গড় ঋণ হয়ে যায় দ্বিগুণ। মাত্র ২০ শতাংশ পরিবার সরকারের কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছে বলে জানায়, বেশিরভাগকেই (৪৬ শতাংশ) বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও বেসরকারি ত্রাণের ওপর নির্ভর করতে হয়।৩২

মহামারির কারণে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাওয়ার ফলাফল হিসেবে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, শ্রম থেকে সরিয়ে স্কুলে ভর্তি করা অনেক দরিদ্র শিশু পরিবারকে সহায়তা করতে আবারও কাজে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছে। বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) কর্তৃক এপ্রিল ২০২০ থেকে এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত ঢাকা (কামরাঙ্গীরচর ও কেরানীগঞ্জ), কুমিল্লা, বরিশাল, যশোর ও খুলনায় ৩৩ হাজার শিশুশ্রমিকের ওপর পরিচালিত জরিপ থেকে জানা যায়, কাজ ছেড়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছিল, এমন আড়াই হাজার শিশু করোনাকালে পরিবারকে সহায়তা করতে আবার কাজে ফিরে গেছে। আগের চেয়ে কম পারিশ্রমিকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত হয়েছে দুই হাজার ৪০০ শিশু এবং নতুন করে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত হয়েছে সাত হাজার ৮০০ শিশু।৩৩

৩৩ হাজার শিশুশ্রমিকের ওপর পরিচালিত জরিপ থেকে জানা যায়, কাজ ছেড়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছিল, এমন আড়াই হাজার শিশু করোনাকালে পরিবারকে সহায়তা করতে আবার কাজে ফিরে গেছে। আগের চেয়ে কম পারিশ্রমিকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত হয়েছে দুই হাজার ৪০০ শিশু এবং নতুন করে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত হয়েছে সাত হাজার ৮০০ শিশু।

করোনা মহামারির অভিঘাতে একদিকে যখন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে, বেঁচে থাকার জন্য নিজের শেষ সঞ্চয়টুকু বিক্রি করতে কিংবা ঋণ করতে বাধ্য হয়েছে, কিংবা শিশুসন্তানকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে পাঠানোর মতো হৃদয়বিদারক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে, তখন কিন্তু দেশে কোটিপতি বৃদ্ধির সংখ্যা থেমে ছিল না; বরং গতি আরও বেড়েছে। ২০২০ সালের মার্চে যখন দেশে করোনা মহামারির আবির্ভাব হয়, তখন ব্যাংকে কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৬২৫টি। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৭ হাজার ৪৮৮টি। অর্থাৎ, ছয় মাসে (১ এপ্রিল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর) ব্যাংক খাতে কোটি টাকা আমানত রাখা অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় চার হাজার ৮৬৩টি।৩৪ এর পরের তিন মাসে কোটি টাকার বেশি অর্থের অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ছয় হাজার ৪০০টি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে কোটিপতি হিসাব ছিল ৮৩ হাজার ৮৩৯টি, যা ২০২০ সালের ডিসেম্বর নাগাদ হয় ৯৩ হাজার ৮৯০ অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে কোটিপতি আমানতকারীর হিসাব বেড়েছে ১০ হাজার ৫১টি। এই সময়ে ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা হিসাবের সংখ্যা ২০১৯ সালের এক হাজার ২৮৩ থেকে বেড়ে হয়েছে এক হাজার ৩৯০টি। অর্থাৎ, এক বছরে ৫০ কোটি টাকার বেশি হিসাবধারীর সংখ্যা বেড়েছে ১০৭টি।৩৫

শুধু তাই নয়, সরকার ঘোষিত নীতিমালার কল্যাণে প্রায় ১০ হাজার করদাতা নগদ বা ব্যাংকে থাকা প্রায় ১২ হাজার কোটি কালোটাকা সাদা করেছেন। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় শেয়ারবাজার, জমি-ফ্ল্যাট, ব্যাংক-সঞ্চয়পত্রে রাখা টাকা ও নগদ টাকা—সব ধরনের অবৈধভাবে উপার্জিত টাকা স্রেফ ১০ শতাংশ করের বিনিময়ে সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত দেশে ১৭ বার এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে; কিন্তু কোনোবারই এত বেশি পরিমাণ কালো টাকা সাদা হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কালোটাকা সাদা হয়েছিল ২০০৭ ও ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে; কিন্তু তার পরিমাণ এখনকার মতো এত বেশি ছিল না। তখন ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মাত্র তিন হাজার ৭৭৫ কোটি কালোটাকা সাদা করেছিল। ধারণা করা যেতে পারে, করোনা মহামারির কারণে বিদেশে যাতায়াত ও সরাসরি সংযোগ আগের চেয়ে অনেক কমে যাওয়ায় বিদেশে কালোটাকা পাচারের সুযোগ কমে যাওয়ায় দেশের মধ্যে কালোটাকা সাদা করার প্রবণতা বেড়েছে।৩৬

শেষ কথা

করোনা মহামারি এখনো চলমান, ফলে দেশে দেশে মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর মহামারির অভিঘাত নিয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি। এই লেখাটি মহামারি চলাকালীন প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। আয় ও সম্পদ বৈষম্যের ওপর মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে করোনা মহামারির প্রভাব কী পড়বে, তা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ধরন (V নাকি K আকৃতির), কর্মসংস্থান পরিস্থিতি, শ্রমিকের প্রকৃত মজুরির হ্রাসবৃদ্ধি, সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ, নীতিমালা ইত্যাদি বহু কিছুর ওপর নির্ভর করবে। তবে মহামারি চলাকালে যে চিত্রটি পাওয়া গেছে, তাতে করোনা মহামারির ফলে আয় ও সম্পদের বৈষম্য যে অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, তা স্পষ্ট। এবং এটা যে কোনো দৈব কারণে ঘটছে না, তা-ও স্পষ্ট। সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কারণে দেশে দেশে এবং দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা-বর্ণ-গোত্র-লিঙ্গের মানুষের ওপর একই মহামারির ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব লক্ষ করা গেছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বৈষম্য ও মুনাফাভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে ধনী ও সম্পদশালীদের তুলনায় দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষ বেশি ঝুঁকি বহন করেছে। বৃহৎ করপোরেশনগুলোর মুনাফা ও এসব কোম্পানির ধনী শেয়ার মালিকদের সম্পদের ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটেছে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান (এসএমই) এবং নিম্ন আয়ের বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু মহামারির এই প্রভাব সর্বত্র একই রকম ছিল না। যেসব অঞ্চলে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে গণমুখী এবং পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন বা গণবণ্টন ব্যবস্থা কার্যকর, সেইসঙ্গে করোনার প্রভাব মোকাবিলায় সরকারের পদক্ষেপ ও নীতিমালা জনবান্ধব, সেই সব দেশে বা অঞ্চলে করোনা মহামারির কারণে সার্বিকভাবে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপন্ন হয়েছে তুলনামূলক কম। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিবেশী দেশ ভারতের কেরালা রাজ্যের কথা বলা যেতে পারে। বামপন্থি সরকারের অধীন সোশ্যাল ডেমক্রেটিক নীতিমালার ভিত্তিতে পরিচালিত কেরালার অর্থনীতি করোনা মহামারিতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সরকারের গণমুখী পদক্ষেপের কারণে ক্ষুধা ও অভাবের তীব্রতা তেমন ছিল না, যেমনটা দেখা গেছে ভারতের অন্যান্য রাজ্য কিংবা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে।

সোশ্যাল ডেমক্রেটিক নীতিমালার ভিত্তিতে পরিচালিত কেরালার অর্থনীতি করোনা মহামারিতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সরকারের গণমুখী পদক্ষেপের কারণে ক্ষুধা ও অভাবের তীব্রতা তেমন ছিল না, যেমনটা দেখা গেছে ভারতের অন্যান্য রাজ্য কিংবা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে।

যথাযথ গণবণ্টন ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশে ২০২০ সালের মার্চে করোনাভাইসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় ঘোষিত সাধারণ ছুটির মধ্যে দরিদ্র মানুষকে খাদ্যের জন্য রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হয়েছে, বিক্ষোভ প্রতিবাদ জানাতে হয়েছে। এক গবেষণার তথ্যানুসারে, ২৯ মার্চ ২০২০ থেকে ২৮ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত—এই এক মাসে সারা দেশের ৪৩টি জেলায় সর্বমোট ১৪৮ বার ত্রাণের দাবিতে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।৩৭ অন্যদিকে লকডাউনের কারণে দরিদ্র নাগরিকদের যেন ক্ষুধার্ত থাকতে না হয়, সে জন্য ৮৭ লাখেরও বেশি রেশন কার্ডধারীকে নিয়মিত চাল, গম, আটা রেশন প্রদান করা ছাড়াও কেরালা রাজ্য সরকার ২০২০-এর এপ্রিল মাসে ১৭ ধরনের প্রয়োজনীয় মুদিসামগ্রী, আগস্টে ১১ ধরনের মুদিসামগ্রী এবং সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আট ধরনের মুদিসামগ্রী বিনা মূল্যে প্রদান করে। স্কুলের মিড ডে মিলের বিকল্প হিসেবে মার্চ থেকে মে ২০২০ প্রাক-প্রাথমিক থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের চাল ছাড়াও নয় ধরনের মুদিসামগ্রী প্রদান করে। সাপ্লিমেন্টারি ফুড প্রোগ্রামের টেক হোম রেশন স্কিমের আওতায় অঙ্গনওয়ারি প্রোগ্রামের নয় লাখ ৬২ হাজার শিশুকে ১২ মার্চ ২০২০ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০ পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করা হয়। সেইসঙ্গে লকডাউনের মধ্যে কর্ম হারানো মজুর, অভিবাসী, রাস্তায় থাকা ছিন্নমূল কিংবা কোয়ারেন্টাইনে থাকা সহায়হীন মানুষকে যেন না-খেয়ে থাকতে হয়, সে জন্য চালু করা হয় এক হাজার ১৬৫টি কমিউনিটি কিচেন। এ ছাড়া কেরালা সরকারের সংবিধিবদ্ধ বিভিন্ন লেবার ওয়েলফেয়ার বোর্ড-এর সদস্য ৬৮ লাখেরও বেশি শ্রমিককে সরাসরি এক হাজার রুপি; আবকারি ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ডের শ্রমিকদের পাঁচ হাজার রুপি; মোটর ভেহিকল ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ডের সদস্য বাস শ্রমিকদের পাঁচ হাজার রুপি, পণ্য পরিবহণ শ্রমিকদের তিন হাজার ৫০০ রুপি, ট্যাক্সি চালকদের দুই হাজার ৫০০ রুপি, অটোরিকশা ও ট্রাক্টর শ্রমিকদের দুই হাজার রুপি; করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ১০ হাজার রুপি ও করোনায় কোয়ারেন্টাইনে থাকা কৃষকদের দুই হাজার রুপি করে প্রদান করা হয়। করোনায় দেশে এসে আটকে পড়া ৭৮ হাজার প্রবাসী শ্রমিককে মাথাপিছু পাঁচ হাজার রুপি করে সাহায্য প্রদান করা হয়।৩৮ শুধু আর্থিক সহায়তাই নয়, কেরালা রাজ্যে একটি শক্তিশালী সর্বজনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থাকায় করোনাকালে ভারতজুড়ে অক্সিজেন, আইসিইউ, ভেন্টিলেটরসহ চিকিৎসাসামগ্রীর ব্যাপক সংকট থাকলেও কেরালা রাজ্যে কোনো সংকট ছিল না। কেরালা তার নিজের অক্সিজেন চাহিদা পূরণ করেও গোয়া, কর্নাটক ও তামিলনাড়ুতে মেডিক্যাল অক্সিজেন ট্যাংকার পাঠিয়েছে। করোনা চিকিৎসায় অক্সিজেন যেহেতু ভীষণ জরুরি একটি উপাদান, তাই রাজ্য সরকার এই বিষয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করে দেয়, যাদের কাজ দৈনিক অক্সিজেন চাহিদার ওপর নজর রাখা এবং সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলার জন্য আগাম পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া। এই মনিটরিংয়ের কাজটি কেরালা করেছে ২০২০ সালের মার্চ থেকে। শুধু অক্সিজেনই নয়, কেরালা রাজ্যে আইসিইউ বা ভেন্টিলেটরেরও কোনো সংকট ছিল না। এর কারণও যথাযথ প্রস্তুতি। ২০২০ সালে করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরেই কেরালা রাজ্য আইসিইউ ও ভেন্টিলেটরের সংখ্যা দ্বিগুণ করে।৩৯

শুধু আর্থিক সহায়তাই নয়, কেরালা রাজ্যে একটি শক্তিশালী সর্বজনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থাকায় করোনাকালে ভারতজুড়ে অক্সিজেন, আইসিইউ, ভেন্টিলেটরসহ চিকিৎসাসামগ্রীর ব্যাপক সংকট থাকলেও কেরালা রাজ্যে কোনো সংকট ছিল না।

করোনা মহামারির এসব অভিজ্ঞতা আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে, ‘স্বাভাবিক’ পরিস্থিতিতে যেমন, মহামারির মতো দুর্যোগ মোকাবিলার জন্যও বর্তমান নয়া উদারনৈতিক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কাছে অপাঙ্‌ক্তেয় হয়ে পড়া পাবলিক সেক্টর বা সর্বজন খাতকে শক্তিশালী করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

কল্লোল মোস্তফা: লেখক, গবেষক, প্রকৌশলী। ইমেইল: kallol_mustafa@yahoo.com 

তথ্যসূত্র

১) ‘Pandemics and inequality: A historical overview’, Guido Alfani, ১৫ অক্টোবর ২০২০, voxeu.org; 

২)  COVID-19 will raise inequality if past pandemics are a guide, Davide Furceri, Prakash Loungani, Jonathan D. Ostry, Pietro Pizzuto, ৮ মে, ২০২০, voxeu.org 

৩) Covid-19 pandemic shines a light on a new kind of class divide and its inequalities, Robert Reich, গার্ডিয়ান, ২৬ এপ্রিল ২০২০

৪) Beatriz Echeverri, “Spanish influenza seen from Spain” The Spanish influenza pandemic of 1918-19: new perspectives, edited by Howard Phillips and David Killingray, Routledge, 2003

৫) Patrick Zylberman, ‘A holocaust in a holocaust: The Great War and the 1918 Spanish influenza epidemic in France’, The Spanish influenza pandemic of 1918-19: new perspectives, edited by Howard Phillips and David Killingray, Routledge, 2003

৬) COVID-19 Racial and Ethnic Health Disparities, সিডিসি, ১০ ডিসেম্বর ২০২১,  সর্বশেষ প্রবেশ করা হয়েছে ৩১ মে ২০২১

৭) https://covidtracking.com/race, সর্বশেষ প্রবেশ করা হয় ৩১ মে ২০২১

৮) Coronavirus: Higher death rate in poorer areas, ONS figures suggest, বিবিসি, ১ মে ২০২০, সর্বশেষ প্রবেশ করা হয়েছে ৩১ মে ২০২১

৯) The Inequality Virus, অক্সফাম, জানুয়ারি ২০২১

১০) Abi Adams-Prassl, Teodora Boneva, Marta Golin, Christopher Rauh, “Inequality in the Impact of the Coronavirus Shock: Evidence from Real Time Surveys”, IZA Institute of Labor Economics, April, 2020 

১১) রিজওয়ানুল ইসলাম, করোনাঘাতে অর্থনীতি ও শ্রমবাজার, বাতিঘর, ২০২১, পৃষ্ঠা: ৩৮-৩৯

১২) রিজওয়ানুল ইসলাম, করোনাঘাতে অর্থনীতি ও শ্রমবাজার, ২০২১, পৃষ্ঠা: ৯৫-৯৮

১৩) বড়রা পেয়েছে বেশি, ছোটরা অনেক কম, ৩১ মে ২০২১, প্রথম আলো

১৪) কঠিন সময়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের দেখার কেউ নেই, ডেইলি স্টার অনলাইন বাংলা, ৬ মে ২০২১; লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ৩,২০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ, ডেইলিস্টার অনলাই বাংলা, ১৩ জুলাই ২০২১

১৫) পূর্বোক্ত

১৬) কোভিড-১৯ প্রভাব নিয়ে বিবিএসের জরিপ: পরিবারগুলোর গড় আয় কমেছে ২০.২৪ শতাংশ, ৭ অক্টোবর ২০২০, বণিক বার্তা

১৭) PPRC-BIGD Rapid Response Research Phase III: Poverty Dynamics and Household Realities Part 1, ২০ এপ্রিল ২০২১

১৮) Income and Employment Situation in COVID Times: How the People Are Coping?, সিপিডি, ৫ মে ২০২১

১৯) বিস্তারিত দেখুন, সায়দিয়া গুলরুখ ও মাহতাব উদ্দীন আহমেদ, করোনায় ‘খরচযোগ্য’গার্মেন্ট শ্রমিক, সর্বজনকথা, ৬ষ্ঠ বর্ষ, ৩য় সংখ্যা 

২০) 25pc garment factories shed jobs despite receiving stimulus: CPD, ৯ মে ২০২১, ডেইলি স্টার; চাকরি হারিয়ে দিনমজুর হয়েছেন ২০ শতাংশ পোশাকশ্রমিক, ৮ মে ২০২১, প্রথম আলো অনলাইন; করোনায় একতরফা পোশাকের দর কমিয়েছে ক্রেতারা, ৯ মে ২০২১, দেশ রূপান্তর

২১) Wealth Of World’s Billionaires Surges Us $4 Trillion During Pandemic Year, March 31, 2021, Institute for Policy Studies -Program on Inequality

২২) The Inequality Virus, অক্সফাম, জানুয়ারি ২০২১ ২৩) পূর্বোক্ত

২৪) পূর্বোক্ত

২৫) পূর্বোক্ত

২৬) ‘পূর্ণাঙ্গ জীবনচক্রভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি’র গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন, রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ও অন্যান্য, “বাংলাদেশ ‘জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি’ : আসন্ন বাজেটের জন্য একটি প্রস্তাব”, সর্বজনকথা, ৬ষ্ঠ বর্ষ ৩য় সংখ্যা, মে ২০২০ 

২৭) বিশ্বে অতি ধনীর উত্থানে শীর্ষে বাংলাদেশ, প্রথম আলো, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮; ধনী বৃদ্ধির হারে বিশ্বে তৃতীয় বাংলাদেশ, প্রথম আলো, ১৯ জানুয়ারি ২০১৯; গরিব মানুষের বসবাসে বিশ্বে পঞ্চম বাংলাদেশ, প্রথম আলো, ২০ জানুয়ারি ২০১৯

২৮) রিজওয়ানুল ইসলাম, করোনাঘাতে অর্থনীতি ও শ্রমবাজার, বাতিঘর, ২০২১, পৃষ্ঠা ৪৯-৫০

২৯) কোভিড-১৯ প্রভাব নিয়ে বিবিএসের জরিপ: পরিবারগুলোর গড় আয় কমেছে ২০.২৪ শতাংশ, ৭ অক্টোবর ২০২০, বণিক বার্তা

৩০) Summary: Webinar on COVID-19 Fallout on Poverty and Livelihoods in Bangladesh: Results from SANEM’s Nation-wide Survey Conducted in Nov-Dec 2020, 23 January 2021 

৩১) PPRC-BIGD Rapid Response Research Phase III: Poverty Dynamics and Household Realities Part 1, ২০ এপ্রিল ২০২১

৩২) Income and Employment Situation in COVID Times: How the People Are Coping?, সিপিডি, ৫ মে ২০২১

৩৩) আবার ফিরতে হলো কাজে, প্রথম আলো, ১২ জুন ২০২১

৩৪) ছয় মাসে কোটিপতি আমানতকারী বেড়েছে চার হাজার ৮৬৩, ৮ জানুয়ারি ২০২১, বাংলাট্রিবিউন

৩৫) দেশে কোটিপতির সংখ্যা ৯৩৮৯০, বেড়েছে করোনাকালেও, ঢাকা পোস্ট, ১৯ এপ্রিল ২০২১

৩৬) করোনাকালেও কালোটাকার ঢল, ৬ মে ২০২১, প্রথম আলো

৩৭) মাহতাব উদ্দীন আহমদ, এক মাসে ৪৩ জেলায় ১৪৮ বার ত্রাণের দাবিতে বিক্ষোভ!, সর্বজনকথা, ৬ষ্ঠ বর্ষ, ৩য় সংখ্যা 

৩৮) Economic Review 2020, Government Of Kerala, January 2021, Volume One, পৃষ্ঠা: ৬৩-৬৯

৩৯) No oxygen crisis in Kerala: CM, দ্য হিন্দু, ২১ এপ্রিল ২০২১; How Kerala is managing its medical oxygen supply, দ্য নিউজমিনিটস ডট কম, ২১ এপ্রিল ২০২১; How Kerala Managed To Beat The Oxygen Crisis, ইন্ডিয়া ডট কম, ২৩ এপ্রিল ২০২১

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •