উন্নয়ন, বৈষম্য ও প্রতিরোধ: উন্নয়নের ‘পোস্টার চাইল্ড’ চিলির অভিজ্ঞতা

উন্নয়ন, বৈষম্য ও প্রতিরোধ: উন্নয়নের ‘পোস্টার চাইল্ড’ চিলির অভিজ্ঞতা

রিচার্ড ডেভিস

দ্রুত প্রবৃদ্ধির বহুল আলোচিত মডেল ল্যাটিন আমেরিকার দেশ চিলি। এই মডেল নিয়ে আলোচনা বিশ্লেষণ বর্তমান বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রিক উন্নয়নের ভবিষ্যৎ গতি বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই লেখাটি চিলিরি উন্নয়ন মডেল অনুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে রচিত প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানমূলক একটি লেখার সংক্ষেপিত অনুবাদ। Richard Davies-এর Extreme Economies: What Life at the World’s Margins Can Teach Us About Our Own Future (২০২০, ব্ল্যাক সোয়ান) শীর্ষক পুস্তকের Santiago অধ্যায় অবলম্বনে এটি তৈরি করেছেন কল্লোল মোস্তফা

১৯৭০-এর দশকে চিলির মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল আর্জেন্টিনার অর্ধেক। আর আজ চিলির মাথাপিছু জাতীয় আয় ১৪ হাজার ডলার, যা ল্যাটিন আমেরিকার মধ্যে সর্বোচ্চ এবং গ্রিস বা পর্তুগালের চেয়ে খুব বেশি পিছিয়ে নেই। চিলির অর্থনৈতিক সফলতার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১০ সালে চিলিকে ল্যাটিন আমেরিকার প্রথম দেশ হিসেবে উদীয়মান অর্থনীতির দেশ থেকে উন্নত অর্থনীতির দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ‘অর্গানাইজেশন ফর ইকোনোমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ (ওইসিডি)-এর সদস্য করে নেওয়া হয়। দ্রুতগতির প্রবৃদ্ধি অর্জন ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত দারিদ্র্য দূরীকরণ দেখিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো চিলিকে ‘অর্থনৈতিক বিস্ময়’ হিসেবে উন্নয়নের ‘পোস্টার চাইল্ড’ হিসেবে হাজির করে এবং অন্যান্য দেশের প্রতি ‘চিলি মডেল’ অনুসরণের আহ্বান জানায়।

দ্রুতগতির প্রবৃদ্ধি অর্জন ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত দারিদ্র্য দূরীকরণ দেখিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো চিলিকে ‘অর্থনৈতিক বিস্ময়’ হিসেবে উন্নয়নের ‘পোস্টার চাইল্ড’ হিসেবে হাজির করে এবং অন্যান্য দেশের প্রতি ‘চিলি মডেল’ অনুসরণের আহ্বান জানায়।

চিলির অর্থনৈতিক সাফল্যের গল্পের মধ্যে একটা ঝামেলা হলো বিস্ময়কর প্রবৃদ্ধির সঙ্গে আসা চরম বৈষম্য। ওইসিডির সদস্য ধনী দেশগুলোর মধ্যে চিলির অর্থনৈতিক বৈষম্য সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে বেশি আয় করা ১০ শতাংশ মানুষের হাতে ১৯৭০-এর দশকে যেখানে জাতীয় আয়ের ৩০ শতাংশ যেত, ১৯৯০-এর দশকে তা বেড়ে হয় ৫০ শতাংশের বেশি। আর এর পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে। যার অর্থ, চিলির ৯০ শতাংশ মানুষকে জাতীয় আয়ের অর্ধেকেরও কম নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।

দ্রুতগতির প্রবৃদ্ধি এবং তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকা বৈষম্যের যে পথে চিলি একসময় হেঁটেছে, তা ক্রমশ উন্নয়নের সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত রাস্তায় পরিণত হচ্ছে, চিলির ধাঁচের চরম বৈষম্য হয়ে উঠছে বৈশ্বিক বাস্তবতা। চীন এবং ভারতে সম্মিলিতভাবে সারা দুনিয়ার এক-তৃতীয়াংশ মানুষের বসবাস এবং গত ৩০ বছরে দুটি দেশেই অর্থনীতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বৈষম্য আরও বেড়েছে। চিলির প্রতিবেশী দেশ পেরুর লিমা থেকে শুরু করে নাইজেরিয়ার লাগোস কিংবা মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরসহ বিভিন্ন দ্রুত বর্ধনশীল শহরগুলো বিশ্বের সবচেয়ে বৈষম্যমূলক শহরে পরিণত হচ্ছে।

আমি সান্তিয়াগো যাই সবচেয়ে বেশি ও সবচেয়ে কম আয়ের মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এবং এই চরম অর্থনৈতিক মডেল যারা তৈরি করেছেন, সেই বিতর্কিত নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলতে। চিলির ধাঁচের অর্থনীতির তো ব্যাপক প্রশংসা করা হয় এবং অন্যদের তার অনুকরণ করতে চাপ দেওয়া হয়। চিলির সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমি বুঝতে চেয়েছি চিলির উন্নয়ন সম্পর্কে তাদের বক্তব্য কী: প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে যদি দারিদ্র্য দূর হয়, তাহলে বৈষম্য বাড়লে কি কোনো সমস্যা আছে? আর যদি বৈষম্যকে সমস্যাজনক মনে করা হয়, তাহলে এই বৈশ্বিক প্রবণতার একেবারে সামনের সারিতে থাকা চিলিতে কি আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু আছে, প্রতিরোধ, সহযোগিতা ও ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো লক্ষণ কি দেখা যায়?

ছবি: ওইসিডির অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে চিলির অর্থনৈতিক বৈষম্য সবচেয়ে বেশি

‘শিকাগো বয়েজ’দের উত্থান

‘সে সময় আমরা ভাবতাম, বৈষম্য অবশেষে একদিন দূর হয়ে যাবে।’–১৯৭০-এর দশকের দিনগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে লা কনডেসে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে বসে কথাগুলো বলছিলেন রলফ লুডারস। সান্তিয়াগো নগরী যে ৩২টি জেলা বা কমুনা-তে বিভক্ত, তার মধ্যে এই এলাকাটি সবচেয়ে বিলাসবহুল: রাস্তার পাশে রয়েছে গলফ ক্লাব আর এল গলফ সাবওয়ে স্টেশনের চারপাশের রাস্তাগুলোর ধারে দেখা যায় সবুজ চত্বরসমৃদ্ধ বিভিন্ন দূতাবাস। লুডারস তরুণ বয়সে চিলির অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন, ১৯৮০-র দশকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। যে ছোট গ্রুপটি চিলির অর্থনীতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিল তিনি ছিলেন তাদেরই একজন।

মিল্টন ফ্রিডম্যানের সম্মানে এক কনফারেন্সে রলফ লুডারস (বাঁ-দিক থেকে দ্বিতীয়) ও সারজিও ডি ক্যাস্ত্রো (বাঁ-দিকে সবশেষে)। লুডারস ও ডি ক্যাস্ত্রো ছিলেন চিলির অর্থনীতি বদলে দেওয়া শিকাগো বয়েজদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুজন ব্যক্তিত্ব। ছবি: LOOKSfilm

১৯৩৩ সালে ফ্রাংকলিন ডি. রুজভেল্ট (যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট) তাঁর উদ্বোধনী বক্তৃতায় যেসব নীতিমালার কথা ঘোষণা করেছিলেন, সেগুলোই ছিল চিলির নিরীক্ষার উৎসমূল। সেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট যুদ্ধ সম্পর্কে তার বিতৃষ্ণার কথা উল্লেখ করে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তার দেশ এরপর থেকে আর কোনো প্রতিবেশী দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করবে না। তার বদলে যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিবেশীদের ওপর আরও কোমল উপায়ে সন্তর্পণে প্রভাব বিস্তারের কাজ করতে থাকে। ১৯৩০-এর দশকের শেষের দিকে ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (আইসিএ) নামের একটি সংস্থা ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোয় দক্ষ ও প্রশিক্ষিত ব্যক্তিদের পাঠানোর জন্য অর্থসাহায্য দিতে শুরু করে–যে নীতিমালার নাম ছিল ‘টেকনিক্যাল অ্যাসিসটেন্স’ বা কারিগরি সহায়তা। এর মাধ্যমে আমেরিকা মহাদেশজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞরা ইকুয়েডরের কলাচাষিদের জন্য নতুন ধরনের কীটনাশকের পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে শুরু করে এল সালভাদরের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, পেরুর সিম চাষ, হন্ডুরাসের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, গুয়েতেমালার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রভৃতি শত শত প্রকল্পে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে।

এর মধ্যে একটা প্রকল্প ছিল চিলির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানোন্নয়নবিষয়ক। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে ১৯৫৫ সালে আইসিএ-র আর্থিক সহায়তায় ‘ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো’ ও ‘ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব চিলি’ একটি কারিগরি সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষর করে। আনুষ্ঠানিকভাবে এই পরিকল্পনাটা ছিল এ রকম: চিলির পিএইচডি শিক্ষার্থীরা দুই বছরের জন্য শিকাগোয় অর্থনীতিতে পড়াশোনা করবেন এবং ফিরে এসে সান্তিয়াগোতে শিক্ষকতা করবেন। এই শিক্ষা বিনিময় কর্মসূচির মাধ্যমে চিলির অর্থনীতি শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটবে এবং চিলির ছাত্র-শিক্ষকরা বামপন্থি ও সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণা থেকে সরে আসবেন। বাস্তবে এর ফলাফল হয় আরও অনেক সুদূরপ্রসারী: সারা দুনিয়ায় এখন ‘শিকাগো বয়েজ’ নামে পরিচিত ওই শিক্ষার্থীরা একপর্যায়ে চিলির অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন।

চিলির সাবেক প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দের স্কেচ হাতে এক তরুণ। আলেন্দের চিন্তা এখনো চিলিতে বেশ প্রভাবশালী: পোস্টারে লেখা আছে ‘ইতিহাস আমাদের এবং জনগণই এর নির্মাতা’। ফটো: Martin Bernetti/AFP/Getty Images 

হুকুমের মুক্তবাজার

১৯৭৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চিলির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সালভাদোর আলেন্দের পতন এবং জেনারেল আগুস্তো পিনোশের ক্ষমতা গ্রহণের পর চিলির অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণী ক্ষমতা চলে যায় ‘শিকাগো বয়েজ’দের হাতে। এই শিকাগো বয়েজরা চিলির অর্থনীতির যেসব সমস্যা চিহ্নিত করেন তার মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি, অস্থিতিশীলতা, দারিদ্র্যসহ বিভিন্ন বিষয় থাকলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় রাষ্ট্রের স্ফীতিকে। ফলে তাদের একটা বড় কাজ হয়ে দাঁড়ায় অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে সংকুচিত করা, যা ছিল আলেন্দের পদক্ষেপের ঠিক উলটো। উদাহরণস্বরূপ শিল্পের মালিকানার কথাই ধরা যাক: আলেন্দের সমাজতান্ত্রিক সরকার কর্তৃক জাতীয়করণের কারণে ১৯৭০ থেকে ১৯৭৩ পর্যায়ে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪৬ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৩০০ হয়। শিকাগো বয়েজদের বেসরকারীকরণের এজেন্ডার কারণে ১৯৮০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা কমে ২৪-এ নেমে আসে। দেশের আর্থিক খাতেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে: জাতীয়করণকৃত ব্যাংকগুলো বেসরকারীকরণ করা হয় এবং আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের চিলিতে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ করে দেওয়া হয়; সুদের হারের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া হয় যেন ব্যাংকগুলো তাদের ইচ্ছামতো সুদের হার নির্ধারণ করতে পারে। সরকারি ব্যয় কাটছাঁট করা হয়–সবচেয়ে বেশি কাটছাঁট হয় অবকাঠামো, গৃহায়ণ, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে।

এর প্রাথমিক ফলাফল ছিল মিশ্র। ক্রেতাদের কেনাকাটার সুযোগ বাড়ে–সিগারেট­­­ কিংবা মুরগির মতো পণ্যের ওপর থেকে কোটা উঠে যায়, বাণিজ্য উন্মুক্ত হয়, আমদানি শুল্ক ৯০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে নিয়ে আসা হয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি কিংবা জাপান থেকে আসা পণ্য হঠাৎ ক্রয়যোগ্য হয়ে ওঠে। (ক্যামেরা আমদানি বাড়ে ২০০ শতাংশ, রেডিও ৮৭০ শতাংশ এবং টেলিভিশন নয় হাজার শতাংশ।) কিন্তু প্রবৃদ্ধি ততটা বৃদ্ধি পায়নি, যা ছিল ৩ শতাংশেরও কম।

চিলিতে ‘শিকাগো-স্কুল’ অর্থনীতি বাস্তবায়নের প্রথম দশকটা ছিল মন্দার: ১৯৮২ সালে ল্যাটিন আমেরিকা জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার সময় এসব তারকা অর্থনীতিবিদের নিয়ন্ত্রণে থাকা চিলির অর্থনীতির অবস্থা ছিল সবচেয়ে খারাপ। উৎপাদন কমে গেল ১৪ শতাংশ, ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে এক-চতুর্থাংশ সংকোচন ঘটল এবং বেকারত্ব বেড়ে হলো ২৭ শতাংশ। অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও দ্রব্যমূল্য বাড়ল ২০ শতাংশ। কাজের খোঁজে সান্তিয়াগোতে আসা অনেক চিলীয় শ্রমিক কাজ ও বাসস্থানের সংকটে শেষ পর্যন্ত রাজধানীর উপকণ্ঠের বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকতে বাধ্য হলো। অবশ্য কোনো ধরনের গণতান্ত্রিক বাধা না-থাকায় শিকাগো বয়েজরা তাদের কাজ চালিয়ে গেল। পেনশন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং নিম্ন আয়ের মানুষের আবাসন–সবকিছুই বিকেন্দ্রীকরণ ও বেসরকারীকরণ করা হলো। একপর্যায়ে চিলির অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকল, ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৭ সালে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ শতাংশ। বিনিয়োগ ও রপ্তানিতে একসময় সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা চিলি ল্যাটিন আমেরিকার মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে গেল।

চিলির অর্থনৈতিক বিস্ময়

১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে এসে ওয়াশিংটন ডিসি ও জেনেভাভিত্তিক আন্তর্জাতিক পরামর্শদাতাদের প্রিয় দৃষ্টান্তে পরিণত হলো চিলি। চিলির উড্ডয়নের সম্মানে কনফারেন্স আয়োজন করা হলো, ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড (আইএমএফ) বলল, চিলি অর্থনৈতিক উন্নয়নের চূড়ান্ত ধাপে আছে; বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বলল, উদার বাণিজ্যনীতির মাধ্যমে চিলির অর্থনীতি ‘সবচেয়ে স্থিতিস্থাপক অর্থনীতির একটি’-তে পরিণত হয়েছে এবং বিশ্বব্যাংক পথপ্রদর্শক দেশ হিসেবে চিলিকে নিয়ে ৪৫০ পৃষ্ঠার বই প্রকাশ করে অন্য দেশগুলোকে চিলির ‘অনুকরণযোগ্য শিক্ষা’ বাস্তবায়নের সুপারিশ করল।

১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে এসে ওয়াশিংটন ডিসি ও জেনেভাভিত্তিক আন্তর্জাতিক পরামর্শদাতাদের প্রিয় দৃষ্টান্তে পরিণত হলো চিলি। চিলির উড্ডয়নের সম্মানে কনফারেন্স আয়োজন করা হলো, ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড (আইএমএফ) বলল, চিলি অর্থনৈতিক উন্নয়নের চূড়ান্ত ধাপে আছে; বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বলল, উদার বাণিজ্যনীতির মাধ্যমে চিলির অর্থনীতি ‘সবচেয়ে স্থিতিস্থাপক অর্থনীতির একটি’-তে পরিণত হয়েছে এবং বিশ্বব্যাংক পথপ্রদর্শক দেশ হিসেবে চিলিকে নিয়ে ৪৫০ পৃষ্ঠার বই প্রকাশ করে অন্য দেশগুলোকে চিলির ‘অনুকরণযোগ্য শিক্ষা’ বাস্তবায়নের সুপারিশ করল।

শিকাগো বয়েজদের বক্তব্য হলো, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলে দরিদ্রতম মানুষেরও আয় বৃদ্ধি পায় এবং দারিদ্র্যের হার হ্রাস পায়। চিলির সরকারি তথ্যানুসারে ১৯৮৭ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৭ শতাংশ (যাদের আয় মৌলিক চাহিদা যেমন: খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়) আর অতি দরিদ্রের হার ছিল ১৭ শতাংশ (যারা এমনকি প্রয়োজনীয় খাদ্য জোগাড় করতে পারত না)। ২০০০ সাল নাগাদ দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশ এবং অতি দরিদ্রের হার ৬ শতাংশে নেমে এলো।

ছবি: ১৯৬০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পেরু, বলিভিয়া, ইকুয়েডর ও আর্জেন্টিনার তুলনায় চিলির মাথাপিছু জিডিপি বৃদ্ধির চিত্র

প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বৈষম্য বৃদ্ধির ঘটনাকে কোনো মৌলিক সমস্যা মনে করা হলো না, এটাকে ছোটখাটো সমস্যা হিসেবে দেখা হলো। ১৯৭৩ থেকে ১৯৮০-র দশকের শেষ পর্যন্ত অ্যাবসুলিউট বা পরম মানে দরিদ্রতম ১০ শতাংশ শ্রমিকের আয় আগের চেয়ে বৃদ্ধি পায়, ফলে দারিদ্র্যের হার হ্রাস পায়। কিন্তু উচ্চ আয়ের মানুষের আয় বৃদ্ধি পায় তুলনামূলক অনেক বেশি হারে, যার ফলে সবচেয়ে বেশি উপার্জনকারী ১০ শতাংশের আয় চিলির গড় আয়ের সাত গুণ বেশি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৩৫ গুণ হয়ে গেল। চিলির পিঠার আকার আরও বড় হয়েছে; কিন্তু ধনী ১০ শতাংশ ছাড়া আর বাকিদের জন্য পিঠার টুকরো তুলনামূলকভাবে ছোট হয়েছে। সুতরাং রিলেটিভ টার্মস বা তুলনামূলক বিচারে চিলির নিম্ন আয়ের মানুষের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।

শিকাগো অর্থনীতিবিদরা মনে করতেন, যেহেতু দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেয়েছে তাই তাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সফল। সান্তিয়াগো ছিল এমন একটা শহর, যেখানে শিশুরা খালি পায়ে থাকত এবং পরিবারগুলো তাঁবুতে বসবাস করত। সেখান থেকে এখন শিশুরা জুতো পরতে পারে আর পরিবারগুলো ঘরে থাকতে পারে। এ রকম একটা প্রেক্ষাপটে তাদের কাছে বৈষম্য বৃদ্ধি হলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় একটা খেসারত। তারা মনে করতেন, ‘সুযোগের সমতা বিধান’ করতে পারলে নীচু তলার মানুষের কাজে লাগবে, যার মাধ্যমে চিলির ‘অন্তর্গত সম্ভাবনা’ বিকাশের পথ উন্মোচিত হবে। আর যে নীতিমালার মাধ্যমে এই কাজটি করা হবে তা হলো, শিক্ষানীতির ব্যাপক পরিবর্তন। তাদের বক্তব্য হলো, উচ্চশিক্ষার সুবিধা শুধু স্নাতকদের কাজে লাগে, তাই উচ্চশিক্ষা খাতে রাষ্ট্রের কোনো বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। তার বদলে বরং শিক্ষাঋণ সহজ করা যেতে পারে যেন দরিদ্র ঘরের সন্তানরা ঋণ নিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারে। প্রচলিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খাতকে অদক্ষ ও পিছিয়ে পড়া হিসেবে চিহ্নিত করা হলো এবং এগুলোর দায় কেন্দ্রীয় সরকারের হাত থেকে স্থানীয় রাজনৈতিক ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতে ছেড়ে দেওয়া হলো।

এর ফলে চিলিতে বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যার ব্যাপক প্রবৃদ্ধি হলো। ১৯৭০-এর দশকে চিলিতে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ৮টি, যার সব কটিই ছিল সরকারি। ১৯৯০ সালে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা হলো ৬০টি, যার দুই-তৃতীয়াংশই বেসরকারি, এর সঙ্গে ধরতে হবে আরও ২৫০টি পেশাগত ও কারিগরি প্রশিক্ষণ সংস্থাকে। উচ্চশিক্ষা আর বিনা মূল্যের থাকল না, যদিও আগের চেয়ে আরও বেশিসংখ্যক বৈচিত্রময় বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করার সুযোগ তৈরি হলো। এক দশকে চিলির উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক লাখ ২০ হাজার থেকে বেড়ে দুই লাখ ৫০ হাজার হলো। বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থী উভয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির এই ধরনকে শিকাগো অর্থনীতিবিদরা তাদের সফলতা হিসেবেই ধরে নিলেন।

আজ শিকাগো-শিক্ষিত অর্থনীতিবিদদের বয়স ৮০-র ঘরে, যারা তাদের তৈরি এই ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ ও ন্যায্য বলে মনে করে বেশ সন্তুষ্ট। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করলেও চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোয় আজকাল শিকাগো ধাঁচের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিয়মিত মিছিল-সমাবেশ হয়। ওই অর্থনীতিবিদদের কাছে এই ব্যাপারটি ধাঁধার মতো মনে হয়, তারা কোনোভাবেই বুঝতে পারেন না, তাদের জীবনের সমস্ত অবদানকে কেন এভাবে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে।

জনাব লুডার জানান, তিনি এই বিক্ষোভগুলোকে বুঝে উঠতে পারছেন না। তার মনে হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই ঈর্ষান্বিত হয়ে মানুষ এসব করছে।’ তার গুরু আরনল্ড হাররার্জারেরও অবাক লাগে: ‘ল্যাটিন আমেরিকার সবচেয়ে সেরা অর্থনীতি এটা; কিন্তু মানুষ তা বুঝতে পারছে না।’ এই অর্থনীতিবিদদের কাছে চিলির আধুনিকায়ন সম্পন্ন হয়ে গেছে। জনগণ কী বিষয়ে অভিযোগ জানাচ্ছে, তা তারা বুঝতেই পারছেন না।

স্যানহাটনের দৃশ্য

গ্র্যান তোরে সান্তিয়াগো নামের ৬৪তলা টাওয়ারটি চিলির অভিজাত বিপণিবিতান এলাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য। ৩০০ মিটার উঁচু এই টাওয়ারটি ল্যাটিন আমেরিকার সবচেয়ে উঁচু অবকাঠামো, যার তুলনায় তুলনামূলক কম উঁচু ভবন সংবলিত সান্তিয়াগো শহরের অন্য ভবনগুলো অতি ক্ষুদ্র মনে হয়। গ্র্যান তোরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো, শপিং বা কেনাকাটার ছয়টি তলাজুড়ে রয়েছে ল্যাটিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় শপিং মল, যা গোটা অঞ্চলের উঠতি মধ্যবিত্তের মধ্যে দুর্বার আকর্ষণ তৈরি করেছে (এই জায়গাটা ধনাঢ্য ব্রাজিলীয় পর্যটকদের কাছে এত জনপ্রিয় যে, বিভিন্ন পণ্যের বর্ণনা স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ উভয় ভাষাতেই দেওয়া থাকে)। সন্ধ্যার উষ্ণ আলোয় জ্বলজ্বল করতে থাকা সবুজ-নীল কাচের এই টাওয়ারটির কারণে লা কন্দেজ অঞ্চলটির দিগন্ত রেখা অনেকটা নিউইয়র্ক শহরের দিগন্ত রেখার মতো মনে হয়। ফলে এই অঞ্চলটিকে অনেকে ‘স্যানহাটন’ বলে ডাকেন। টাওয়ারের উচ্চতার কারণে সান্তিয়াগো শহরের যেকোনো স্থান থেকেই এই টাওয়ারটি অর্থাৎ স্যানহাটনকে দেখা যায়।

‘গ্র্যান তোরে সান্তিয়াগো টাওয়ার’টি একাধারে চিলির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বৈষম্যের প্রতীক। স্যানহাটন নামে পরিচিত উপশহরে অবস্থিত বিশাল শপিং মল সংবলিত এই টাওয়ারটি দরিদ্র মানুষের বসতি নুয়েভো ১৪ থেকে দৃশ্যমান। ফটো: রিচার্ড ডেভিস

এই টাওয়ার থেকে ১২ কিমি দক্ষিণের নুয়েভো ১৪ এলাকাটি একেবারেই ভিন্ন একটি অঞ্চল: স্টিল, কাচ আর কংক্রিটের দামি কোনো স্থাপনা নেই, চারদিকে ঢেউটিনের চালাসহ সস্তা ভবন দেখা যায়। এই উপশহরের কোনো কোনো ঘরের অবস্থা আরও করুণ। ময়লা-আবর্জনা ফেলার একটা জায়গায় ৪০টির মতো পরিবার বসতি গেড়েছে। তারা কতগুলো অস্থায়ী ঘর তৈরি করে এই এলাকাটিকে একটি ছোট গ্রামের মতো করে তৈরি করেছে, যার মাঝখানে আছে একটা বড় ভবন। এই ভবনটিকে তারা কমিউনিটি হল ও রান্নাঘর-ক্যানটিন হিসেবে ব্যবহার করেন, যেখানে সবার ব্যবহারের জন্য একমাত্র ফ্রিজ ও গ্যাসের চুলাটি রয়েছে।

এই টাওয়ার থেকে ১২ কিমি দক্ষিণের নুয়েভো ১৪ এলাকাটি একেবারেই ভিন্ন একটি অঞ্চল: স্টিল, কাচ আর কংক্রিটের দামি কোনো স্থাপনা নেই, চারদিকে ঢেউটিনের চালাসহ সস্তা ভবন দেখা যায়। এই উপশহরের কোনো কোনো ঘরের অবস্থা আরও করুণ। ময়লা-আবর্জনা ফেলার একটা জায়গায় ৪০টির মতো পরিবার বসতি গেড়েছে।

নুয়েভো ১৪-এর বসতির একটি দৃশ্য, অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে চকচকে গ্র্যান তোরে সান্তিয়াগো টাওয়ার। ফটো: রিচার্ড ডেভিস

এর অধিবাসীরা যৌথভাবে বসবাস করেন। সেন্ট্রাল হলের দেওয়ালে অনেকগুলো তালিকা দেখা যায়: এর একটি আছে কে কোন দিন রাত জেগে পাহারা দেবেন তার তালিকা (তারা জানালেন মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকাসক্তদের হাত থেকে এলাকাটি রক্ষার জন্য এই পাহারার প্রয়োজন পড়ে)। আরেকটা তালিকা বেশ লম্বা-খাদ্যদ্রব্যের লেনদেনসহ ঋণের হিসাব আছে এখানে। মূল হলরুমের বাইরে একটা টয়লেট ও গোসলখানা রয়েছে, যা সব পরিবার, ৫৬ জন শিশুসহ সবাই মিলে ব্যবহার করেন। এর পরেই আছে সম্ভবত আট ফুট উঁচু একটা ময়লার স্তূপ। অনেক দূরে গ্রান তোরে টাওয়ার প্লাটিনামের টুকরোর মতো জ্বলজ্বল করছে।

এখানে সবকিছুই জোড়াতালি দেওয়া, রিসাইকেল করা বা ধার করে আনা। তাদের জীবনের এই অস্থায়ী ধরন, যৌথতা, ভাগাভাগি করে কাজ করা ইত্যাদি সবকিছু মিলে এলাকাটিকে মনে হতে পারে নতুন যুগের হিপ্পিদের ক্যাম্প। কিন্তু নুয়েভো ১৪ এলাকার অধিবাসীরা বিচ্ছিন্নভাবে জীবনযাপন করতে চাওয়া কোনো অর্থনৈতিক বহিরাগত নন, এখানকার নারী-পুরুষ সবাই পার্শ্ববর্তী লা কনডেজ ও ভিটাকুরার মতো অভিজাত এলাকার পূর্ণকালীন কর্মী।

 সান্তিয়াগোর নতুন মধ্যবিত্ত

‘আমরা এখানে বাস করি। কারণ, কর্মস্থলের কাছাকাছি থাকতে হলে এটাই একমাত্র জায়গা,’ বললেন ২৪ বছর বয়সি মেলিসা নেইরা। সান্তিয়াগো বেশ বড় একটা শহর, শহরের কেন্দ্রের কর্মস্থলগুলোয় বাসে যেতে প্রায় ৯০ মিনিটের মতো লাগে (নুয়েভো ১৪ নামটি এসেছে বহু বছর আগে চালু হওয়া ‘নতুন’ বাস রুটের ১৪ নম্বর থামার জায়গার নাম হিসেবে)। মেলিসা জানালেন, চিলিতে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকিতে তৈরি বাসাবাড়ি আছে ঠিকই; কিন্তু এগুলো শহর থেকে এত দূরের প্রান্তে অবস্থিত যে, সেখান থেকে প্রতিদিন শহরে এসে কাজ করা প্রায় অসম্ভব। কর্মস্থল থেকে ফিরে আসা লোকজনে হলটি ভরে উঠছে এবং তারাও এই বক্তব্যে সায় জানালেন। মেলিসা আরও বললেন, ‘তাছাড়া রাষ্ট্রীয় সহায়তা পাওয়ার মতো গরিবও না আমরা। আমাদেরকে দরিদ্র না বলে মধ্যবিত্ত হিসেবে ধরা হয়।’ শুনে সবাই একসঙ্গে হেসে উঠলেন।

নাদুসনুদুস দেখতে সারিজিও মুনিওজ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সমর্থক। আবর্জনা ফেলার জায়গার কাছে তার সঙ্গে যখন আমার দেখা হলো, তিনি তার বয়স বললেন ৪৩; কিন্তু তার স্ত্রী বার্থা চাপা হেসে বললেন, ‘তোমার বয়স তো ৪৪, সার্জিও!’ সিটি সেন্টারের ছোট একটি দোকানে ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে তিনি মাসে ৪ লাখ পেসো (৬০০ ডলার বা ৫০ হাজার টাকা) আয় করেন। বাধ্যতামূলক কর, পেনসন, স্বাস্থ্য ও বেকারত্ব বিমা বাবদ টাকা কেটে নেওয়ার পর তিনি ঘরে আনতে পারেন মাসে তিন লাখ ২০ হাজার পেসো। বার্থা অভিজাত এলাকার এক বাগানের মালী হিসেবে কাজ করেন। তার বেতন জানতে চাইলে তিনি অন্য নারীদের দিকে তাকিয়ে জোরেশোরে বললেন, ‘ন্যূনতম!’ (চিলিতে ২০১৮ সালে ন্যূনতম মজুরি ছিল দুই লাখ ৫০ হাজার পেসো)। এখানকার সব দম্পতির আয় মোটামুটি এ রকমই। পিংক ফ্লয়েড টি-শার্ট পরা আরনেল গোমেজ অ্যালুমিনিয়াম ও কাচ রিসাইকেল করে মাসে চার লাখ ২০ হাজার পেসো আয় করেন এবং তার স্ত্রী একটা সেলুনের সহকারী হিসেবে কাজ করে বার্থার মতোই ন্যূনতম মজুরি পান। এখানকার দম্পতিরা যৌথভাবে সব মিলিয়ে সাত লাখ পেসোর মতো আয় করে থাকেন।

চিলির দারিদ্র্যসীমা হলো ছয় লাখ পেসো। যেহেতু সার্জিও এবং বার্থার মতো দম্পতিরা এর চেয়ে কিছুটা বেশি আয় করেন, তাই সরকারি হিসাব অনুসারে তারা দরিদ্র নন। অথচ চিলিতে যে তীব্র বৈষম্য বিরাজ করছে, তার দৃষ্টান্ত হলো তাদের আয়: চিলির জাতীয় আয়কে যদি সমানভাবে পরিবারগুলোর মাঝে বণ্টন করা যেত, তাহলে পরিবারপ্রতি মাসিক আয় হতো ২৮ লাখ পেসো, যা তাদের বর্তমান আয়ের চার গুণ। তারা এখানে যৌথভাবে বসবাস ও কেনাকাটা করার পরেও তাদের অবস্থা এমন যে, তাদের যে পূর্ণ কর্মসংস্থান আছে সেটা বোঝা মুশকিল হয়ে যায়। তাদের কোনো গ্যাস বা বিদ্যুৎ সংযোগ নেই: সেন্ট্রাল হলে যে রেফ্রিজারেটর ও অল্প কয়েকটা বাল্ব জ্বলছে তার সংযোগ নেওয়া হয়েছে রাস্তা থেকে বেআইনিভাবে। তাদের কার্ডবোর্ডের ঘরগুলো ছোট ছোট (দৈর্ঘ্য  প্রস্থে ৩ মিটার বাই ২ মিটার এবং কোনো জানালা নেই)। বসতির তিন দিকে দেওয়াল থাকলেও এক পাশে শুধু ময়লার স্তূপ। জর্ডানের মরুভূমিতে অবস্থিত ক্যাম্পে সিরিয়ার উদ্বাস্তুদের জন্য নির্মিত ঘরগুলোও এরচেয়ে ভালো।

তারা এখানে যৌথভাবে বসবাস ও কেনাকাটা করার পরেও তাদের অবস্থা এমন যে, তাদের যে পূর্ণ কর্মসংস্থান আছে সেটা বোঝা মুশকিল হয়ে যায়। তাদের কোনো গ্যাস বা বিদ্যুৎ সংযোগ নেই: সেন্ট্রাল হলে যে রেফ্রিজারেটর ও অল্প কয়েকটা বাল্ব জ্বলছে তার সংযোগ নেওয়া হয়েছে রাস্তা থেকে বেআইনিভাবে। তাদের কার্ডবোর্ডের ঘরগুলো ছোট ছোট (দৈর্ঘ্য  প্রস্থে ৩ মিটার বাই ২ মিটার এবং কোনো জানালা নেই)। বসতির তিন দিকে দেওয়াল থাকলেও এক পাশে শুধু ময়লার স্তূপ। জর্ডানের মরুভূমিতে অবস্থিত ক্যাম্পে সিরিয়ার উদ্বাস্তুদের জন্য নির্মিত ঘরগুলোও এরচেয়ে ভালো। 

স্বল্পব্যয়ে চলার চড়া মূল্য

নুয়েভো ১৪ এলাকার যে ১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, তারা কেউই শহরের ধনীদের উচ্চ আয় নিয়ে কোনো অভিযোগ করেননি। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, মজুরি বৃদ্ধির কোনো দাবিও তাদের নেই। এমনকি তাদের অনেকে-নারীদের সবাই-স্রেফ ন্যূনতম মজুরি পেলেও তারা কেউই বিশ্বাস করেন না যে, ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো হলে তাদের সমস্যার কোনো সমাধান হবে। ‘এটা করে কোনো লাভ নেই,’ মেলিসা বলেন। ‘যা ঘটবে তা হলো, আমাদের খাদ্যের মূল্য, যাতায়াতের বাসভাড়া ইত্যাদির খরচ একই অনুপাতে বেড়ে যাবে।’ তাদের বেশি ক্ষোভ উঁচু দ্রব্যমূল্য নিয়ে। ‘এই এলাকার আমরা হলাম গরিব মানুষ, অথচ আমাদেরকেই বেশি দরে জিনিসপত্র কেনাকাটা করতে হয় আর লা কন্দেজের মতো অভিজাত এলাকার দ্রব্যমূল্য তুলনামূলক কম,’ বললেন মারগরিতে। তিনি মূলত খাদ্যসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চমূল্যের কথা বলছিলেন। তার অভিযোগ হলো, ধনীরা সস্তায় বাঁচে আর দরিদ্রদের তুলনামূলক উচ্চমূল্য দিতে হয়। সান্তিয়াগোর অর্থনৈতিক সমস্যার বিবেচনায় তিনি ঠিকই বলেছেন।

সান্তিয়াগোর নিম্ন আয়ের মানুষ দিন আনে দিন খায়, তারা যা আয় করেন তার পুরোটাই এমনকি অনেক সময় তার চেয়েও বেশি পরিমাণ খরচ করে ফেলতে হয়। সারজিয়াগো জানালেন, প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ সুবিধা না-পাওয়ায় তাদেরকে প্রায়ই উচ্চ সুদের অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের দ্বারস্থ হতে হয়, যার ফলে তাদের মাসিক খরচ ২০ শতাংশ বেড়ে যায়। চিলিতে ধার করে কেনাকাটা করা খুব সাধারণ একটা ব্যাপার: দেশের প্রেসিডেন্ট সিবাস্টিয়ান পিনেরা এখানে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবসা চালু করে ব্যাপক অর্থ উপার্জন করেছেন। সাম্প্রতিক কালে ক্রেডিট কার্ডের বেশ বিকাশ হলেও এ ধরনের ঋণ সুবিধা নুয়েভো ১৪-এর বাসিন্দাদের কাছে পৌঁছেনি। সান্তিয়াগোয় প্রচুর বড় বড় সুপার শপ রয়েছে, যেখানে একসঙ্গে বেশি পরিমাণে কিনলে নানান ছাড় পাওয়া যায়। কিন্তু নুয়েভো ১৪-এর বাসিন্দারা যেহেতু দিন এনে দিন খান, তাই তাদের পক্ষে এই সুযোগ নেওয়া সম্ভব হয় না। দরিদ্রতম অঞ্চলের স্থানীয় দোকানগুলো থেকে দরিদ্র মানুষেরা কেনেন অল্প পরিমাণে: টয়লেট টিস্যুর একটা রোল কিংবা একটা খুচরা সিগারেট। তারা জানেন, একবারে বেশি পরিমাণে কিনে এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ না নিয়ে তারা খরচ কমাতে পারেন; কিন্তু নিম্ন আয়ের কারণে তারা তা করতে পারেন না।

সান্তিয়াগোর নিম্ন আয়ের মানুষ দিন আনে দিন খায়, তারা যা আয় করেন তার পুরোটাই এমনকি অনেক সময় তার চেয়েও বেশি পরিমাণ খরচ করে ফেলতে হয়। সারজিয়াগো জানালেন, প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ সুবিধা না-পাওয়ায় তাদেরকে প্রায়ই উচ্চ সুদের অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের দ্বারস্থ হতে হয়, যার ফলে তাদের মাসিক খরচ ২০ শতাংশ বেড়ে যায়।

নুয়েভো ১৪-এর বাসিন্দারা জানেন, তারা অনেক সময় দামি জিনিসপত্র কিনে ফেলেন, যদিও তা কেনা তাদের উচিত নয়। ‘আমরা নিশ্চিতভাবেই অনেক সময় ভুল করি,’ নিজে থেকেই বললেন মেলিসা যার দুটি শিশুসন্তান রয়েছে। তিনি কিডসম্যানিয়া নামের একটা শিশুদের থিম পার্কের প্রতি তার দুর্বলতার কথা বললেন। ‘আমি জানি, এটা ব্যয়বহুল এবং টাকার শ্রাদ্ধ,’ বললেন মেলিসা। তিনি ব্যাখ্যা করে বললেন, টিপস কিংবা বোনাসের মাধ্যমে হাতে কোনোদিন বাড়তি অর্থ এলে সেই টাকা বিছানার নিচে জমানোর বদলে ঘোরাঘুরি করে খরচ করতেই বেশি ভালো লাগে। তার সঙ্গী এমানুয়েল নেইরার কথা হলো, নিম্ন আয়ের কারণে ভালোভাবে বাঁচা খুব কঠিন: ‘আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখেন, কেমন মোটা গোলগাল হয়ে গেছি আমরা।’ (সাম্প্রতিক সময়ে চিলিতে ওবিসিটি বা স্থূলতার সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কদের এক-চতুর্থাংশ এবং শিশুদের এক-পঞ্চমাংশ এখানে স্থূলতার সমস্যায় ভুগছে। নুয়েভো ১৪ এলাকাটি এই প্রবণতার বাইরে নয়, বিশেষ করে এখানকার পুরুষের মধ্যে স্থূলতার সমস্যা বেশি।) এমানুয়েল বলেন, ‘আমি জানি, লা কন্দেজের বাসিন্দারা কিনওয়া (ল্যাটিন আমেরিকার একধরনের খাদ্যশস্য যা স্বাস্থ্যসম্মত হিসেবে জনপ্রিয়-অনুবাদক) খান এবং আমাদেরও কিনওয়া খাওয়া উচিত; কিন্তু বারো ঘণ্টার শিফট শেষ করার পর আপনার এমন কিছু খেতে ইচ্ছা করবে যাতে আপনার পেট ভরবে।’

শিক্ষার মাধ্যমে সমতা অর্জিত হবে–শিকাগো বয়েজদের এই ধারণার কথা শুনে মেলিসা ও তার প্রতিবেশীরা রেগে যান। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চমূল্য ছাড়াও আর যে বিষয়টি এই মানুষগুলোর সবচেয়ে বড় সমস্যা তা হলো, শিক্ষার উচ্চব্যয়। এখানে রাষ্ট্রীয় খরচে চলা স্কুলে পড়ার অর্থ হলো আপনার অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ এবং বেসরকারি স্কুলে পড়ানোর সামর্থ্য আপনার নেই। তাছাড়া পুরো প্রক্রিয়ায় অনেক সময় ব্যয় হয়–অনেক ধরনের ফরম পূরণ ও মিটিংয়ে অংশ নিতে হয়, যার অর্থ পিতামাতার আয় হারানো। আর বাধ্যতামূলক পাঠ্যবইয়ের মূল্য অনেক বেশি–সান্তিয়াগোতে সাধারণ একটি স্কুলবইয়ের দাম ২০ হাজার পেসো যা একজন ন্যূনতম মজুরি আয় করা মানুষের দুদিনের আয়ের সমান। বইয়ের অতি উচ্চমূল্যের ফলস্বরূপ এখানে পাঠ্যবইয়ের কালোবাজার তৈরি হয়েছে, যেখানে মূল বইয়ের ১০ শতাংশ মূল্যে সাদাকালো ফটোকপি পাওয়া যায়। বই নকলকারীদের পেছনে পুলিশ লাগলেও পিতামাতারা তাদের পছন্দই করেন। ‘দেখলেন তো, চিলিতে এমনকি বিনা মূল্যের শিক্ষাও আসলে বিনা মূল্যের নয়,’ বললেন বার্থা।

শিক্ষার মাধ্যমে সমতা অর্জিত হবে–শিকাগো বয়েজদের এই ধারণার কথা শুনে মেলিসা ও তার প্রতিবেশীরা রেগে যান। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চমূল্য ছাড়াও আর যে বিষয়টি এই মানুষগুলোর সবচেয়ে বড় সমস্যা তা হলো, শিক্ষার উচ্চব্যয়। এখানে রাষ্ট্রীয় খরচে চলা স্কুলে পড়ার অর্থ হলো আপনার অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ এবং বেসরকারি স্কুলে পড়ানোর সামর্থ্য আপনার নেই।

নুয়েভো ১৪-তে রাত নেমে আসায় এমানুয়েল ও সারজিও আমাকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলেন। জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে এমানুয়েল বললেন, ‘সান্তিয়াগোকে বুঝতে হলে একে মানুষের হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে তুলনা করতে হবে। নিচ থেকে দূষিত রক্ত হৃৎপিণ্ডে প্রবেশ করে আর হৃৎপিণ্ড থেকে পরিশোধিত রক্ত ওপর দিকে প্রবাহিত হয়।’ সান্তিয়াগো শহরের উচ্চতার সঙ্গে আয়ের সম্পর্ক তুলনা করার বহুল প্রচলিত উপমা এটা। কাজের জন্য শহরের দরিদ্র অধিবাসীরা দক্ষিণের নিচু অঞ্চল থেকে উঁচু অঞ্চলে অবস্থিত শহর-কেন্দ্রের দিকে যায় আর শহরের উঁচু অঞ্চল বারিও আলতো থেকে ধনীরা নিচু অঞ্চলের দিকে যায়। বিশুদ্ধ ইংরেজিতে বলা ইমানুয়েলের কথাটা বেশ বুদ্ধিদীপ্ত ও ধারালো–বাধ্য হয়ে চোর ও মাদকাসক্তদের হাত থেকে আবর্জনার স্তূপের ওপর স্থাপিত বসতি পাহারা দেওয়া একজন মেধাবী মানুষের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা এক মারাত্মক রসিকতা। অবশেষে যখন একটা উবার পাওয়া গেল, চালক নুয়েভ ১৪ থেকে ফেরার সুযোগ পেয়ে বেশ স্বস্তিই প্রকাশ করলেন। কারণ, তিনি জানেন এলাকাটা বিপজ্জনক।

শিক্ষাগত বর্ণবৈষম্য

‘আমরা নির্মম বৈষম্যের শিকার,’ বললেন ৬১ বছর বয়সি কার্মেন মাতামেলা। আমরা বসে আছি সান্তিয়াগোর অন্যতম দরিদ্র একটি এলাকা রেনেকায় অবস্থিত এসকুয়েলা ডোমিঙ্গো সান্তা মারিয়া গনজালেজ নামের একটি স্কুলে, মারিয়া যে স্কুলের শিক্ষাবিষয়ক পরিচালক। স্কুলের প্রধান শিক্ষক লুসি নিয়েতো এই কথার সঙ্গে সায় জানালেন। পাঁচ থেকে এগারো বছর বয়সি ৬৫০ জন বালক এখানে পড়াশোনা করে যাদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগই শিক্ষার্থী হিসেবে দুর্বল শ্রেণিভুক্ত–তারা হয় খারাপ ফল অথবা বাজে আচরণের জন্য অন্যান্য স্কুল থেকে বিতাড়িত। এই স্কুলটা আসলে দরিদ্র এলাকার ডুবন্ত শিশুদের স্কুল, যেখানে শিক্ষার লক্ষ্য অন্যান্য স্কুলের মতো নয়। মিস লুসি নিয়েতো জানালেন, ‘আমরা এখানকার শিক্ষার্থীদের কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর কথা ভাবি না। আমরা স্রেফ চেষ্টা করি এদেরকে এমন একদল তরুণ হিসেবে তৈরি করতে, যারা বিভিন্ন ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে পারবে।’

মিস মাতামেলা স্কুলটি ঘুরিয়ে দেখানোর প্রস্তাব দিলেন। স্থাপত্যের দিক থেকে দেখলে স্কুলটিকে পড়াশোনার জন্য উপযুক্ত জায়গাই মনে হয়: একটা বড় গোলাকার মাঠকে কেন্দ্র করে শ্রেণিকক্ষগুলো বেশ ভালোভাবে তৈরি করা হয়েছে, দুপুরে খাবারের বিরতিতে যেখানে ফুটবল খেলা চলে। স্কুলের ভবন এবং শ্রেণিকক্ষগুলোকে দেখে এখানকার সমস্যা বোঝা যাবে না, দেখতে হবে শিক্ষাগত অর্জনের কী অবস্থা: এখানকার অনেক ছোট ছেলেই পড়তে পারা তো দূরের কথা, এমনকি ভালোভাবে কথা পর্যন্ত বলতে পারে না। ‘এরা যখন আমাদের কাছে আসে তখন শুধু আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে নিজেদের চাহিদাটুকু প্রকাশের কাজটাই পারে।’ চিলির উন্নয়নের আরেকটা ধাঁধা এটা, যা দারিদ্র্যবিষয়ক সরকারি পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে না: দশকের পর দশক ধরে উচ্চ প্রবৃদ্ধির ফলে সান্তিয়াগোর স্কুলগুলোয় সুন্দর সুন্দর ভবন তৈরি হয়েছে বটে; কিন্তু এই নগরে এমন সব স্কুলগামী ছেলেমেয়ে তৈরি হচ্ছে, যারা এমনকি ঠিকঠাক করে কথা পর্যন্ত বলতে পারে না।

চিলির উন্নয়নের আরেকটা ধাঁধা এটা, যা দারিদ্র্যবিষয়ক সরকারি পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে না: দশকের পর দশক ধরে উচ্চ প্রবৃদ্ধির ফলে সান্তিয়াগোর স্কুলগুলোয় সুন্দর সুন্দর ভবন তৈরি হয়েছে বটে; কিন্তু এই নগরে এমন সব স্কুলগামী ছেলেমেয়ে তৈরি হচ্ছে, যারা এমনকি ঠিকঠাক করে কথা পর্যন্ত বলতে পারে না।

মিস মাতামেলা ব্যাখ্যা করে বললেন, বৈষম্যের শুরু তার ছাত্রদের জন্মেরও আগে থেকে। তাদের অনেকেই এমনসব পরিবার থেকে আসে যেখানে প্রাপ্তবয়স্করা বেকার, যেখানে অনুকরণ করার মতো কোনো রোল মডেল থাকে না এবং থাকে না পড়ার মতো কোনো বই বা সংবাদপত্র। এ ধরনের সমস্যার সমাধানের উপায় হিসেবে স্কুলের পক্ষ থেকে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়, যার মাধ্যমে বেশি সমস্যাগ্রস্ত ছেলেদের জন্য স্পিচ থেরাপিসহ বিশেষ যত্নের সঙ্গে পড়ানো হয়। ‘ফলাফল বেশ অসাধারণ,’ জীবনের শুরুতে পিছিয়ে যাওয়া ছেলেরা কত দ্রুত সামলে উঠতে পারে, তার বর্ণনা করতে করতে তার মুখটা বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সবচেয়ে সেরা ছেলেরা এখান থেকে যায় সান্তিয়াগো কলেজে, যেটা রাষ্ট্রীয় অর্থে চলা দেশের সবচেয়ে ভালো কলেজ। ‘তাহলে এই ব্যবস্থা তো বেশ ভালোই কাজ করছে, শিক্ষার মাধ্যমে সুযোগের সমতা তৈরি হচ্ছে, তাই না?’ আমার এই প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষিকারা জানালেন, ‘না, এই বালকেরা ব্যতিক্রম। চিলিতে শিক্ষা হলো কেনাবেচার পণ্য, এখানে ধনীদের জন্য এক ব্যবস্থা আর গরিবের জন্য আরেক।’ তাদের বক্তব্য হলো, সমতাবিধানের বদলে চিলির শিক্ষাব্যবস্থা বৈষম্যকে উলটো স্থায়ী করে তোলে।

‘এডুকেসিওন ২০২০’ নামের স্থানীয় একটি থিংক ট্যাংকের গবেষকদের সঙ্গে আমার দেখা হয়, যারা স্রেফ একটা চার্টের মাধ্যমে গোটা সমস্যার বিস্ময়কর একটা বিশ্লেষণ হাজির করেন। চার্টের আনুভূমিক অক্ষে প্লট করা হয় মেট্রোরেলের চার নম্বর লাইনের স্টেশনগুলোকে, যা তোবালাবা (লা কন্দেজ এলাকার নিকটবর্তী, ‘স্যানহাটনের’ সবচেয়ে ধনী এলাকা) থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণের নিচু তুলনামূলক দরিদ্রতর এলাকার বিভিন্ন স্টেশনের দিকে যেতে থাকে। প্রত্যেক স্টেশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকার গড় আয়ের প্লট করা হয়, ট্রেনটি যত দক্ষিণে যায় আয় তত কমতে থাকে। এর সঙ্গে প্লট করা হয় স্থানীয় শিশুদের শিক্ষাগত অর্জন, যা এসআইএমসিই টেস্টের ফলাফল থেকে নেওয়া। এই টেস্টের ফলাফল থেকেই নির্ধারিত হয় কারা বিশ্ববিদ্যালয় বা কারিগরি প্রতিষ্ঠানে যেতে পারবে। এভাবে প্রতিটা স্টেশন অঞ্চলের আয় এবং টেস্টের ফলাফল একসঙ্গে মিলিয়ে দেখলে আয়ের সঙ্গে শিক্ষাগত অর্জনের যোগসূত্র একেবারে পরিষ্কার দেখা যায়: এমন কোনো ধনী এলাকা নেই যেখানকার শিশুরা এসআইএমসিই টেস্টে খারাপ করে এবং এমন কোনো দরিদ্র এলাকা নেই, যেখানকার শিশুরা ভালো ফল করে।

এই গ্রাফ থেকে দেখা যায়, সান্তিয়াগো একটি বিভাজনের শহর: স্রেফ একটা মানুষ কোন এলাকায় বসবাস করে, এই তথ্য থেকেই বুঝে নেওয়া যায় তার শিক্ষাগত অর্জন কী হবে। ‘এডুকেসিওন ২০২০’-এর গবেষণাবিষয়ক পরিচালক মারিও ওয়েইজব্লথ এই ফলাফলকে ‘এডুকেশনাল এপারথেইড’ বা ‘শিক্ষাগত বর্ণবৈষম্য’ হিসেবে অভিহিত করলেন।

চার্টের আনুভূমিক অক্ষে প্লট করা হয় মেট্রোরেলের চার নম্বর লাইনের স্টেশনগুলোকে, যা তোবালাবা (লা কন্দেজ এলাকার নিকটবর্তী, ‘স্যানহাটনের’ সবচেয়ে ধনী এলাকা) থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণের নিচু তুলনামূলক দরিদ্রতর এলাকার বিভিন্ন স্টেশনের দিকে যেতে থাকে। প্রত্যেক স্টেশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকার গড় আয়ের প্লট করা হয়, ট্রেনটি যত দক্ষিণে যায় আয় তত কমতে থাকে। এর সঙ্গে প্লট করা হয় স্থানীয় শিশুদের শিক্ষাগত অর্জন, যা এসআইএমসিই টেস্টের ফলাফল থেকে নেওয়া। এই টেস্টের ফলাফল থেকেই নির্ধারিত হয় কারা বিশ্ববিদ্যালয় বা কারিগরি প্রতিষ্ঠানে যেতে পারবে। এভাবে প্রতিটা স্টেশন অঞ্চলের আয় এবং টেস্টের ফলাফল একসঙ্গে মিলিয়ে দেখলে আয়ের সঙ্গে শিক্ষাগত অর্জনের যোগসূত্র একেবারে পরিষ্কার দেখা যায়: এমন কোনো ধনী এলাকা নেই যেখানকার শিশুরা এসআইএমসিই টেস্টে খারাপ করে এবং এমন কোনো দরিদ্র এলাকা নেই, যেখানকার শিশুরা ভালো ফল করে।

 শিক্ষাযুদ্ধ

জনাব ওয়েইজব্লাথ বলেন, ‘সান্তিয়াগোর শিক্ষার বাজারটা হলো অনেকগুলো স্তর সংবলিত একটা কেক। ধনী, আধা ধনী, কম ধনী, বিভিন্ন রকম মধ্যবিত্ত, দরিদ্র–সবার জন্য আলাদা ধরনের স্কুল এখানে।’ একেবারে তলার দিকে রয়েছে ৩৪ শতাংশ শিক্ষার্থী, যারা রেনেকার ডোমিঙ্গো সান্তামারিয়া গনজালেজ-এর মতো রাষ্ট্রীয় অবৈতনিক স্কুলে পড়াশোনা করে। এর পর রয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্কুল, যে স্কুলের আওতায় রয়েছে ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী। এসব স্কুলে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি দেওয়া হয় আবার শিক্ষার্থীদের মা-বাবাকেও অর্থ দিতে হয় (কো-পেমেন্ট স্কুল)। এখানে শতাধিক উপস্তর রয়েছে, যেগুলোয় কয়েক হাজার পেসো থেকে শুরু করে বার্ষিক দুই লাখ ৪০ হাজার পেসো (প্রায় ৩৫০ ডলার বা ৩০ হাজার টাকা) পর্যন্ত ফি নেওয়া হয়। বাকি ৬ শতাংশ হলো কেকের সবচেয়ে উপরের স্তর, যেগুলো বেসরকারি স্কুল। এর মধ্যে সবচেয়ে নামকরা হলো The Grange, যেখানে ব্রিটিশ পদ্ধতিতে পড়াশোনা করানো হয়। এ স্কুলে একজন শিক্ষার্থীর পিতামাতাকে বছরে প্রায় ২০ হাজার ডলার বা ১৭ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়।

সান্তিয়াগোতে শিক্ষার পেছনে খরচ করাটা গুরুত্বপূর্ণ। এখানকার চাকরিদাতারা চাকরিপ্রার্থীর কাছে জানতে চায়, তারা কোন স্কুল থেকে পাস করেছে, এমনকি চাকরিপ্রার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী হলেও। কারণটা বোঝা কঠিন নয়, The Grange থেকে পাস করা কাউকে নিয়োগ দেওয়ার অর্থ হলো, একইসঙ্গে তার যোগাযোগের নেটওয়ার্কটাকেও কিনে ফেলা। ভিন্ন কোনো স্কুল থেকে পাস করা একই রকম শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন কাউকে নিয়োগ দেওয়া তুলনামূলক কম লাভজনক। সান্তিয়াগোয় ভালো কোনো স্কুলে ভর্তি হতে হলে ভীষণ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। একজন মধ্যবিত্ত অভিভাবক বলেন, ‘ধরুন, এই শহরে ১০ স্তরের বেসরকারি স্কুল আছে। প্রতিটিই তার নিচের স্তরের স্কুলগুলোকে ঘৃণা করে এবং এক স্তর উপরে যেতে যা যা করা দরকার তাই করে থাকে।’ আরেকজন অভিভাবক এর নাম দিলেন ‘শিক্ষাযুদ্ধ’।

একজন মধ্যবিত্ত অভিভাবক বলেন, ‘ধরুন, এই শহরে ১০ স্তরের বেসরকারি স্কুল আছে। প্রতিটিই তার নিচের স্তরের স্কুলগুলোকে ঘৃণা করে এবং এক স্তর উপরে যেতে যা যা করা দরকার তাই করে থাকে।’ আরেকজন অভিভাবক এর নাম দিলেন ‘শিক্ষাযুদ্ধ’।

মধ্যম স্তরের কো-পেমেন্ট স্কুলগুলো হলো এই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় খেলোয়াড়। ১৯৮০ সালে প্রবর্তিত কো-পেমেন্ট নীতিমালার মাধ্যমে অভিভাবকদের শিক্ষা ভাউচার প্রদান করা হয়, যে ভাউচার তারা তাদের পছন্দের স্কুলে ‘খরচ’ করবেন। এই ভাউচারের বিনিময়ে স্কুলগুলো আবার সরকারের কাছ থেকে নির্দিষ্ট অর্থ আদায় করে থাকে, আর সেইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ (কো-পেমেন্ট) তো আছেই। প্রত্যেক স্কুলের পারফরম্যান্স স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিমাপের জন্য প্রবর্তন করা হয় এসআইএমসিই ব্যবস্থা। এর পেছনে শিকাগো বয়েজ ধাঁচের চিন্তাটা ছিল এ রকম: অভিভাবকরা যেহেতু তাদের পছন্দমতো স্কুলে সন্তানদের ভর্তি করাতে পারবেন এবং সেই সিদ্ধান্ত তারা স্কুলগুলোর পারফরম্যান্সের তথ্যের ভিত্তিতেই গ্রহণ করবেন, ফলে স্কুলগুলো নিজেদের মান বাড়ানোর জন্য পরস্পরের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। এভাবে শিক্ষাবাজার নিজে নিজেই নিয়ন্ত্রিত হবে।

আজ বেশিরভাগ ভাউচার স্কুল সবৈতনিক এবং সেখানে অভিভাবকদের কাছ থেকে অর্থ (কো-পেমেন্ট) নেওয়া হয়। আর রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি পাওয়ার পরও তিন-চতুর্থাংশ স্কুলই মুনাফার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের এসআইএমসিই টেস্টের ফলাফল অনেকটা শেয়ারের মূল্যের মতো কাজ করে, যেখান থেকে অভিভাবকরা স্কুলের মূল্য সম্পর্কে ধারণা পেয়ে থাকেন। এর পেছনের ভাবনাটি ছিল এ রকম যে, শিক্ষার্থীদের ফল ভালো করার জন্য শিক্ষকরা নিশ্চয় আরও বেশি করে চেষ্টা করবেন, যারা তুলনামূলক দুর্বল তাদের বেশি করে যত্ন করবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, সান্তিয়াগোর স্কুলগুলো ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শুধু সেরা শিক্ষার্থীদেরই ভর্তি করার চেষ্টা করে, যেন কোনো দুর্বল শিক্ষার্থীর কারণে স্কুলের এসআইএমসিই স্কোর খারাপ না হয়। একই ধরনের ঘটনা ঘটে শিক্ষক নিয়োগের বেলায়: সবচেয়ে ভালোভাবে প্রশিক্ষিত শিক্ষকরা যান বেসরকারি ভাউচার স্কুলগুলোয় যেখান থেকে সবচেয়ে বেশি বেতন পাওয়া যায়; অযোগ্য এবং দুর্বল শিক্ষকদের জায়গা হয় দুর্বল শিক্ষার্থীদের সরকারি স্কুলে।

চিলির শিক্ষাবাজারের উভয় প্রান্তের নেতৃস্থানীয় শিক্ষাবিদরা এই ধরনের বিভাজনকে বড় ধরনের সমস্যা মনে করেন। রেনেকার স্কুলটির প্রিন্সিপাল লুসি নিয়েতো বলেন, শিক্ষকদের মান অন্যতম প্রধান একটি সমস্যা: তার সঙ্গে যখন আমাদের দেখা হয়, তিনি তখন শিক্ষাবিষয়ক নতুন একটি কর্মসূচির ওপর ভরসার কথা বলেছিলেন, যে কর্মসূচির আওতায় শিক্ষকদের ভালোভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এবং স্কুলগুলোর শিক্ষার্থী বাছাই করার ক্ষমতা সীমিত করা হবে। অন্যদিকে The Grange-এর রেকটর রিচার্ড বেনামার বলেন, এ সমস্যা সমাধানে তার স্কুল যে ভূমিকাটি নিতে পারে তা হলো, বিনা মূল্যে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, যে উদ্দেশ্যে তারা নতুন একটি একাডেমি স্থাপন করেছেন। এসব পরিকল্পনা হয়তো ভালোই; কিন্তু চিলির সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক: জাদুকরী প্রবৃদ্ধি ও উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদা প্রাপ্তি সত্ত্বেও চিলির হাইস্কুলের শিক্ষার্থীদের ফলাফল কলম্বিয়ার মতো ল্যাটিন আমেরিকার সবচেয়ে দরিদ্র একটি দেশের শিক্ষার্থীদের সমমানের।

সান্তিয়াগোর হাইস্কুলগুলো যেভাবে পরিচালিত হয়, তার ফলে অর্থনৈতিক বিভাজন হ্রাস পাওয়ার বদলে উলটো আরও স্থায়ী হয়। এটা শিকাগো বয়েজদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার দলিল এল লাদ্রিলোতে বর্ণিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের বিপরীত। কারণ, সেখানে শিক্ষাকে দেখা হয়েছে একধরনের বিমা হিসেবে। শিকাগো বয়েজদের পরিকল্পনায় একটানা প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন এবং উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে সুযোগের সমতা নিশ্চিত হওয়ার কথা বলা হয়েছিল। শিক্ষার সংস্কারের জন্য শিকাগো ধাঁচের ধারণার ওপর নির্ভর করা হয়েছিল: বেছে নেওয়া এবং প্রতিযোগিতা, বেসরকারীকরণ ও উদারীকরণের ফলে উদ্ভাবনের স্বাধীনতা, সর্বোপরি বাজারের ভূমিকার ওপর নির্ভর করা ইত্যাদি। কিন্তু বাজারের বাধ্যমে সেরা ফল অর্জনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। চিলির শিক্ষাবাজার তার একটি দৃষ্টান্ত: হাইস্কুল পর্যায়ে শিক্ষাবাজারকে যদি খারাপ বলা হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রির ক্ষেত্রে তা জঘন্যতম।

স্নাতক কর

কোনো শিক্ষার্থী হাইস্কুলের শ্রেণি বিভাজিত শিক্ষাবাজার অতিক্রম করতে যদি সক্ষম হয় এবং এরপর সান্তিয়াগোর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করতে চায়, তাহলে তাকে বুনো পশ্চিমের পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। শিকাগো বয়েজদের পরিকল্পনা ছিল, চিলির শিক্ষাব্যবস্থাকে এমন একটা বেসরকারি ব্যবস্থায় পরিণত করা, যেখানে শিক্ষার্থীদের বাছাই করার অনেক সুযোগ থাকবে; কিন্তু উচ্চশিক্ষা খাতে রাষ্ট্র তেমন কোনো খরচ করবে না। এই পরিকল্পনাটি অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছে: চিলি উচ্চশিক্ষা খাতে জিডিপির মাত্র ০.৫ শতাংশ বরাদ্দ করে, যা ওইসিডি দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন; বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে, বর্তমানে ১৫০টিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যার দুই-তৃতীয়াংশই বেসরকারি মালিকানায় মুনাফার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। সান্তিয়াগোর সব জায়গাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দেখা মেলে–প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি এমনকি দুটি গাড়ির শোরুমের মধ্যের জায়গায়ও। শহরের মেট্রো স্টেশন ও বাস স্টপগুলোয় হাস্যোজ্জ্বল শিক্ষার্থীদের ছবিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞাপনী পোস্টারের ছড়াছড়ি–যেসব পোস্টারে উচ্চশিক্ষা শেষে ভালো কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

শিকাগো বয়েজদের পরিকল্পনা ছিল, চিলির শিক্ষাব্যবস্থাকে এমন একটা বেসরকারি ব্যবস্থায় পরিণত করা, যেখানে শিক্ষার্থীদের বাছাই করার অনেক সুযোগ থাকবে; কিন্তু উচ্চশিক্ষা খাতে রাষ্ট্র তেমন কোনো খরচ করবে না। এই পরিকল্পনাটি অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছে: চিলি উচ্চশিক্ষা খাতে জিডিপির মাত্র ০.৫ শতাংশ বরাদ্দ করে, যা ওইসিডি দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন; বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে, বর্তমানে ১৫০টিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যার দুই-তৃতীয়াংশই বেসরকারি মালিকানায় মুনাফার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়।

নুয়েভো ১৪ এলাকায় বসবাসকারী তরুণ দম্পতি মেলিসা ও ইমানুয়েল উভয়েই মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি থাকলে ভালো বেতনের চাকরি পাওয়া যায়। মেলিসা মনোবিজ্ঞানের একটি কোর্স করেছেন; কিন্তু তেমন লাভ হয়নি। তিনি লা কন্দেজে একজন চাইল্ডমাইন্ডার বা শিশুপালনকারীর সহকারী হিসেবে কাজ করেন। তার স্বামী একটি আইটি কোর্স নিয়ে তিন বছর পড়াশোনা করেছেন; কিন্তু তাদের দ্বিতীয় সন্তান জন্মের সময় তিনি কোর্সটি বাদ দিয়ে নিরাপত্তাকর্মীর কাজ শুরু করেন। ইমানুয়েল বলেন, তাদের সন্তানেরা আরেকটু বড় হলে তিনি তার কোর্সটি শেষ করতে চান আর মেলিসা আরও ভালো কোনো কোর্স করতে চান। তার আগ পর্যন্ত তাদেরকে তাদের উচ্চশিক্ষাহীন প্রতিবেশীদের মতোই শ্রমিকশ্রেণির মজুরির চাকরি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এখন প্রতিবেশীদের সঙ্গে তাদের একমাত্র পার্থক্য হলো, তাদের ঘাড়ে থাকা শিক্ষাঋণের বোঝা, যা বহু বছর ধরে তাদেরকে পরিশোধ করতে হবে।

বাজারের প্রতিযোগিতার নিয়মানুসারে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে শিক্ষার খরচ কম এবং মান বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতির নীতি অনুসারে গড়ে তোলা চিলির শিক্ষাব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার গড় খরচের সঙ্গে গড় আয়ের অনুপাত ৪১ শতাংশ, যা ওইসিডি দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। এর অর্থ হলো, উচ্চশিক্ষা শেষে শিক্ষার্থীদের বিপুল পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করতে হয়। ঋণ পরিশোধ করার জন্য ১৫ বছর ধরে তাদের আয়ের ‌১৮ শতাংশ করে ব্যয় করতে হয়। মুনাফা সর্বস্বতার কারণে শিক্ষার মূল্য বেশি; কিন্তু শিক্ষার পেছনে খরচ করা হয় কম। খরচ কমানোর খাতের মধ্যে শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং বাবদ খরচও রয়েছে। যার ফলস্বরূপ চিলিতে উচ্চশিক্ষা খাতে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার ৫০ শতাংশ। এই ধরনের অস্বস্তিকর পরিসংখ্যানে চিলি সারা দুনিয়ার মধ্যে প্রথম সারিতে আছে, যে দেশের রাজধানী ইমানুয়েলের মতো অর্ধডিগ্রিধারী; কিন্তু পূর্ণমাত্রায় ঋণগ্রস্ত শিক্ষার্থী দিয়ে পূর্ণ।

চিলিতে উচ্চশিক্ষা খাতে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার ৫০ শতাংশ। এই ধরনের অস্বস্তিকর পরিসংখ্যানে চিলি সারা দুনিয়ার মধ্যে প্রথম সারিতে আছে, যে দেশের রাজধানী ইমানুয়েলের মতো অর্ধডিগ্রিধারী; কিন্তু পূর্ণমাত্রায় ঋণগ্রস্ত শিক্ষার্থী দিয়ে পূর্ণ।

শিক্ষার মূল্য বেশি হলেও মান ভালো নয়। শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণের জন্য কমিশন ন্যাশিওনাল ডি এক্রিদিতাসিওন নামের প্রতিষ্ঠান থাকলেও স্বীকৃতি বিষয়টা স্বেচ্ছামূলক এবং ৭০ শতাংশ কোর্সের কোনো স্বীকৃতি নেই। অর্থাৎ, এগুলোর কোনো মান নিয়ন্ত্রণ করা হয় না। সমস্যার একটা দিক হলো অভিজ্ঞতার অভাব–বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই তাদের পরিবারের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের অনভিজ্ঞতা বা সরলতার সুযোগ নিচ্ছে। একজন সাবেক মন্ত্রী আমার কাছে এ বিষয়ে যেমনটি বলেছেন: ‘চিলিতে সবচেয়ে ভালো ব্যাবসা হলো বিশ্ববিদ্যালয় খুলে বসা, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফি আদায় করা এবং এরপর প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ লুটপাট করা।’ কোনো কোনো কেলেঙ্কারি বেশ করুণ। এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ আদায় করেছে; কিন্তু সেখানে তেমন কোনো পড়াশোনা হয়নি, পরে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে বন্ধ হয়ে গেছে। আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কয়েক বছর ধরে দন্ত চিকিৎসা, স্থাপত্য ও আইন বিষয়ে কোর্স সম্পন্ন করার পর জানতে পারে, তাদের এই ডিগ্রির কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। শিকাগো বয়েজদের পরিকল্পনা অনুসারে শিক্ষা বিষয়টা আরও বেশি সহজলভ্য, সস্তা ও ভালো মানের হওয়ার কথা ছিল। সব আশা ও প্রতিশ্রুতি কেমন করে হতাশা ও ঋণে পর্যবসিত হতে পারে, তার একটি প্রতীকী দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে সান্তিয়াগোর শিক্ষা। এই নগরে আয় ও সুযোগের অসমতা ইতোমধ্যে রাজনৈতিতে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনের সূচনা ঘটিয়েছে, যার মধ্যদিয়ে একেবারে নতুন ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্ম হতে পারে।

 নতুন চিন্তাধারা: পেঙ্গুইন থেকে প্রেসিডেন্ট

পালটা লড়াইয়ের শুরু ২০০৬ সালে হাইস্কুলের প্রায় আট লাখ শিক্ষার্থীর ডাকা হরতালের মধ্য দিয়ে, যা পরবর্তী সময়ে ‘পেঙ্গুইন বিপ্লব’ নামে পরিচিতি লাভ করে (চিলিতে শাদা শার্ট ও কালো ব্লেজার পরা স্কুলের শিক্ষার্থীদের আদর করে অনেক সময় পেঙ্গুইন বলে ডাকা হয়)। ২০১১ সাল নাগাদ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আরও বিস্তার লাভ করে: বড় বড় মিছিল-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতে থাকে, যার মধ্যে রয়েছে শিকাগো বয়েজ ও তাদের বাজারবান্ধব নীতিমালার বিরোধিতা করে সান্তিয়াগোতে অনুষ্ঠিত ছয় লাখ জনের মিছিল। ‘চিলিয়ান উইন্টার’ বা ‘চিলির শীত’ বলে পরিচিত ২০১১ সালের প্রতিবাদ আন্দোলনের মধ্যদিয়ে ইউনিভার্সিটি অব চিলির ক্যামেলিয়া ভাল্লেজো এবং ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটির জর্জিও জ্যাকসনের মতো ছাত্রনেতারা জনগণের মধ্যে পরিচিতি পায় এবং ২০১৩ সালে উভয়েই জাতীয় পর্যায়ের নেতা হিসেবে নির্বাচিত হয়। এর মধ্যে ভাল্লেজো চিলির কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন, যে দলটি মধ্যপন্থি ও বামপন্থিদের জোটকে সমর্থন জানায়। আর জ্যাকসন রেভ্যুলুসিওন ডেমোক্রেটিকা নামের নতুন একটি দল তৈরি করে ছোট ছোট দল নিয়ে ফ্রেন্তে এমপ্লিও নামের একটি জোট গঠন করেন। এই জোট ২০১৭ সালে তাদের প্রথম নির্বাচনে ২০ শতাংশ ভোট পায় এবং জ্যাকসন তার আসনে ৬০ শতাংশ ভোট পেয়ে চিলির ১২০ জন সিনেটরের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন।

ছবি: বিনা মূল্যে মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার দাবিতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের সঙ্গে বৈঠকের অংশ হিসেবে ১৪ অক্টোবর ২০১১ তারিখে প্যারিসে ইউনেস্কোর হেডকোয়ার্টারে অনুষ্ঠিত এক সভায় চিলির ছাত্রনেতা (বাঁ থেকে) জিওর্জিও জ্যাকসন, ফ্রান্সিসকো ফিগুয়েরোরা এবং ক্যামেলিয়া ভাল্লেজিও। ফটো: Stéphanie Cadel/AFP/Getty Images

জর্জিও জ্যাকসনের সংসদীয় অফিসটি থেকে সান্তিয়াগোর বৈষম্য সম্পর্কে চমৎকার একটা ধারণা পাওয়া যায়। আট তলা ভবনের সবচেয়ে উপরের তলার এই অফিসে বেশ বড় একটা বেলকনি রয়েছে, যার মুখোমুখি অবস্থিত সান্তা লুসিয়া পার্ক। এই সর্বজন বাগানটিতে বহু প্রাচীন বৃক্ষ ও ঔপনিবেশিক আমলের ভাস্কর্য রয়েছে। ডানদিকে একটি প্রশস্ত রাস্তা চলে গেছে প্রভিডিন্সিয়া আর ভিটাকুরার মতো ধনাঢ্য এলাকার মধ্য দিয়ে, যেখানে রোদের আলোয় জ্বলজ্বল করছে গ্র্যান তোরে টাওয়ার। আর বামদিকে রাস্তা ঢালু হয়ে নেমে গেছে প্লাজা ইটালিয়ার দিকে, যা সান্তিয়াগোর ধনী ও দরিদ্র এলাকার অনানুষ্ঠানিক সীমানা হিসেবে পরিচিত। জ্যাকসন অফিসে আসেন একটা বাইসাইকেলে করে, তার মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি ও পিঠে থাকে বইভর্তি ব্যাগ, যা তার একটা ট্রেডমার্ক। তার বয়স তিরিশের কোঠায়, এখনই মাথার চুল কমতে শুরু করেছে, একটা বেজবল ক্যাপ দিয়ে মাথা ঢেকে রাখেন। তাকে খুব সহজেই একজন স্নাতক শিক্ষার্থী বলে ভুল হতে পারে। সান্তিয়াগোর অনেকেই তাকে চিলির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ হিসেবে দেখেন এবং মনে করেন, একদিন তিনি চিলির প্রেসিডেন্ট হবেন।

উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া জ্যাকসন ধনী এলাকা প্রভিডেন্সিয়ার একটি বেসরকারি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। একজন দক্ষ অ্যাথলেট হিসেবে তিনি কিশোর বয়সে চিলির জাতীয় ভলিবল দলে খেলেছেন এবং খেলাধুলা বাবদ পাওয়া বৃত্তি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশল নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। শুরুতে তার রাজনীতিতে আসার কোনো ইচ্ছা ছিল না বলে জানান জ্যাকসন; কিন্তু শিক্ষাকেন্দ্রিক বিভিন্ন আন্দোলন এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য তাকে রাজনীতিতে আগ্রহী করে তোলে। তার মধ্যে এক ধরনের অপরাধবোধ ও ক্ষোভের জন্ম হয়, যা তাকে কিছু একটা করতে উদ্বুদ্ধ করে। ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অনেক রাজনীতিবিদ যেখানে চিলিকে আলেন্দের সমাজতন্ত্রের দিকে নিয়ে যেতে চায়, জ্যাকসনের পরিকল্পনা নতুন কিছু করা এবং তা ক্রমশ জনপ্রিয়তা লাভ করছে।

জ্যাকসন চলনে-বলনে পাকা রাজনীতিবিদ। সেইসঙ্গে হিসাব-নিকাশে পাকা ও যে কোনো বিষয়ের গভীরে যেতে পারঙ্গম। তিনি বলেন, পুরোনো ডানপন্থি এবং বামপন্থি উভয় ধারণাই ব্যর্থ হয়েছে, এখন প্রয়োজন একেবারে নতুন ধরনের রাজনীতির যা স্রেফ দ্বিমাত্রিক নয়, হবে বহুমাত্রিক। ধরাবাঁধা রাজনৈতিক লাইন ও আদর্শগত জোয়াল থেকে মুক্ত জ্যাকসন বেশ খোলাখুলিভাবেই স্বীকার করলেন যে, তার দল রেভ্যুলুসিওন ডেমোক্রেটিকা চলতে চলতে রাজনৈতিক নীতিমালা তৈরি করছে। শিকাগো বয়েজদের তৈরি এল লাদ্রিলোর কোনো বিকল্প এখনো তৈরি হয়নি; কিন্তু এ জন্য তার দল কাজ করে চলেছে। চিলির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার দলিলটি কেমন হতে পারে, তা বোঝার উদ্দেশ্যে আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, তিনি কার কার লেখা পড়তে পছন্দ করেন।

তিনি তার প্রেরণা হিসেবে যেসব চিন্তাবিদের কথা স্মরণ করলেন, তারা নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর নন–এর মধ্যে ধ্রুপদি দার্শনিক থেকে শুরু করে আধুনিক রাজনৈতিক তাত্ত্বিক রয়েছেন। তিনি বিশেষত মুগ্ধ হয়েছেন বাইয়ুং-চুল হান নামের কোরীয় বুদ্ধিজীবীর সাম্প্রতিক কাজগুলো থেকে, যিনি বর্তমানে বার্লিনে থেকে কাজ করেন। জনাব হান একজন হাল আমলের পুস্তিকা রচয়িতা, যে পুস্তিকাগুলো জার্মান দর্শনের তারকা পরিচিতি দিয়েছে তাকে। তিনি মিল্টন ফ্রিডম্যান এবং সেই সূত্রে শিকাগো বয়েজ ও চিলির অর্থনৈতিক মডেলের একজন সমালোচক। হান মনে করেন, আধুনিক পুঁজিবাদে যদিও বলা হয়, মানুষ স্বাধীনভাবে যে কোনো পণ্য কিনতে পারে এবং যে কোনো পেশা বেছে নিতে পারে, বাস্তবে আমরা সবাই বাজারের প্রলোভনে প্রলুব্ধ ও ভোগবাদের দাস, যে বাজারের কাজ হলো কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করা। যেমন, ফ্যাশন বিষয়টির কাজ হলো মানুষকে এমন একটি ধারণা দেওয়া, যে সাম্প্রতিক ডিজাইনের পোশাক পরার জন্য তার রয়েছে গভীর বাসনা। হানের কাছে অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানের ভূমিকাও একইরকম। বিনা মূল্যে ব্যাপক পরিমাণে পরিসংখ্যান আমাদেরকে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রেও আমাদের আচরণ দাসের মতোই–ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রামের লাইকের মতো প্রশংসার পেছনে ছুটি।

এসব থেকে জ্যাকসনের শিক্ষা হলো ‘মিথ্যা অভাবের’ ধারণা–বাজারে অনেক জিনিসের মূল্য এত বাড়তি থাকে যে, বহু মানুষের পক্ষে তা কেনা সম্ভব হয় না, অথচ খুব সহজেই সবার কাছে এসব পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। তিনি মনে করেন, ‘ফ্যাসিলিটেটেড মনোপলি’ বা ‘সুবিধাভোগী একচেটিয়া’র কারণে এ রকমটা ঘটে। বিশেষ করে তিনি পেটেন্ট, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির ধারণাসহ বাজারের প্রতিযোগিতাকে খর্ব করে এমন সবকিছুর বিরোধী। চিলির মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যাংক থেকে বই বিক্রেতা, পেনশন থেকে ওষুধ ব্যাবসা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ও ব্যাবসা চিলিতে কীভাবে চলে, সে সম্পর্কে ধারণা পেলে আপিন বুঝতে পারবেন তিনি আসলে কী বলতে চাইছেন এবং কেন চিলিতে তার কথা জনপ্রিয়তা লাভ করছে। 

আরামের পুঁজিবাদ

মুরগি, বাসভাড়া কিংবা টয়লেট টিস্যুর উচ্চমূল্যের কারণে চিলির নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর জীবন দুর্বিষহ। চিলির বাজারের আরও কিছু সমস্যা রয়েছে সমাজে, যার প্রভাব গভীর। এখানে দুটো কোম্পানির হাতে সংবাদপত্রের বাজারের ৮৫ শতাংশ, অনলাইন সংবাদের ৮৫ শতাংশ এবং বিজ্ঞাপনী আয়ের ৮০ শতাংশ কেন্দ্রীভূত। স্বাস্থ্যসেবার বাজারও কেন্দ্রীভূত: গোটা কয়েক বিমা কোম্পানির হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ। স্রেফ ৩টি ফার্মেসি চেইনের হাতে ওষুধ কেনাবেচার বাজারের ৯০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ।

‘বাজারের কোনো বিচার-বিবেচনা নেই,’ বললেন ড্যানিয়েল জ্যাদুই, ‘ওষুধের বাজার থেকে তা স্পষ্টভাবে দেখা যায়।’ জ্যাদুই হলেন সান্তিয়াগোর পূর্বদিকের দরিদ্র একটা জেলা রিকোলেতার মেয়র এবং চিলির কমিউনিস্ট পার্টির একজন নেতা। সমস্যা হলো, তার এলাকার মানুষের আয় এত কম যে, ফার্মেসিগুলো এখানে ওষুধ কেনাবেচার প্রয়োজনই বোধ করে না। লা কন্দেজ অঞ্চলে প্রতি ২০ হাজার মানুষের জন্য একটা ফার্মেসি থাকলেও রিকোলেতা এলাকায় এক লাখ ৪০ হাজার মানুষের জন্য একটা ফার্মেসি আছে এবং এমন অনেক এলাকা আছে যেখানকার অধিবাসীদের জন্য কোনো ফার্মেসিই নেই। তার মানে, নুয়েভো ১৪-এর মেলিসা নিয়েরা যেমন বলেছিলেন, দরিদ্র মানুষের খরচ বেশি করতে হয়। রিকোলেতা অঞ্চলের অধিবাসীদের বাসে করে গিয়ে ওষুধ কিনতে হয় বলে ওষুধ কেনা বাবদ তাদের বেশি ব্যয় করতে হয়, বিশেষ করে বয়স্ক ও দীর্ঘস্থায়ী অসুখে যারা ভুগছেন তাদের ভোগান্তিটা সবচেয়ে বেশি।

লা কন্দেজ অঞ্চলে প্রতি ২০ হাজার মানুষের জন্য একটা ফার্মেসি থাকলেও রিকোলেতা এলাকায় এক লাখ ৪০ হাজার মানুষের জন্য একটা ফার্মেসি আছে এবং এমন অনেক এলাকা আছে যেখানকার অধিবাসীদের জন্য কোনো ফার্মেসিই নেই। তার মানে, নুয়েভো ১৪-এর মেলিসা নিয়েরা যেমন বলেছিলেন, দরিদ্র মানুষের খরচ বেশি করতে হয়। রিকোলেতা অঞ্চলের অধিবাসীদের বাসে করে গিয়ে ওষুধ কিনতে হয় বলে ওষুধ কেনা বাবদ তাদের বেশি ব্যয় করতে হয়, বিশেষ করে বয়স্ক ও দীর্ঘস্থায়ী অসুখে যারা ভুগছেন তাদের ভোগান্তিটা সবচেয়ে বেশি।

এই সমস্যার সমাধান হিসেবে মেয়র জ্যাদুই নিজেই ফার্মেসি খুলে বসেছেন, যার নাম তিনি দিয়েছেন ফার্মাসিয়া পপুলার অর্থাৎ পিপলস ফার্মেসি বা সবর্জন ফার্মেসি। টাউন হলের নিচতলায় অবস্থিত ও পিনোশের সিক্রেট পুলিশের হাতে খুন হওয়া ফার্মাসিস্ট রিকার্ডা সিলভা সোতোর নামে প্রতিষ্ঠিত ফার্মেসিতে এন্টিবায়োটিক, এন্টিহিস্টামিনসহ প্রবীণদের জন্য বহু ধরনের চিকিৎসাসামগ্রী বিক্রি হয়, যার মধ্যে চোখের ড্রপ থেকে শুরু করে প্রস্রাব শুষে নেওয়ার প্যাড পর্যন্ত আছে। চিলির ওষুধের বাজারের একচেটিয়া আঁতাঁতের হাত থেকে মুক্তি পেতে এই ফার্মেসিতে বিদেশ থেকে ওষুধ আমদানি করে বিক্রি করা হয়, যার মাধ্যমে ক্রেতাদের এমনকি ৭০ শতাংশ পর্যন্ত সাশ্রয় হয়।

ছবি: মেয়র ডেনিয়েল জ্যাদুই তার হাতের পোস্টারের মাধ্যমে দেখাচ্ছেন ‘পিপলস ফার্মেসি’ বা ‘সর্বজনের ফার্মেসি’র মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে। অনেকটা বাধ্য হয়ে রিকোলেতা অঞ্চলে তিনি এই ফার্মেসিটি স্থাপন করেছিলেন। ফটো: Agencio Uno

রিকোলেতায় চশমার লেন্স তৈরির কোনো দক্ষ কারিগর না-থাকার সমস্যা সমাধানের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে অপটিকা পপুলার। এখানে ছয় হাজার ২০০ পেসোতে (৯ ডলার বা ৭৬০ টাকা প্রায়) চশমা এবং আট হাজার ৮০০ পেসোতে প্রেসক্রিপশন সানগ্লাস বিক্রি করা হয়। এর ফলে রিকোলেতার বাইরে থেকে চশমা কিনতে হলে যে খরচ হতো, তার প্রায় ৯০ শতাংশ কম খরচ হয়। এই যে একজন কমিউনিস্ট মেয়রকে বাধ্য হয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিদেশ থেকে আমদানি করে বিক্রি করতে হচ্ছে–এ থেকেই বোঝা যায়, যারা চিলির পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক মডেলের ব্যাপক প্রশংসা করেন এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশের জন্য অনুকরণযোগ্য বলে মনে করেন, তারা প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে কতটা অজ্ঞ।

সর্বজনের পার্কে কতিপয়ের দখলদারিত্ব

সান্তিয়াগোর অভিজাত ব্যক্তিরা নিজেদের মধ্যে আলোচনার সময় তাদের শহরের পরিস্থিতি নিয়ে দুশ্চিন্তার কথাই বলেন: ভালোভাবে লক্ষ করলে এই শহরে এমন সব ফাটল চোখে পড়বে, যা ধনী-দরিদ্র সবার জন্যই ক্ষতিকর। দেশের অর্থনীতির যে বহুমুখিতা অর্জিত হলো না, তা নিয়েও অনেকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত: বিস্ময়কর প্রবৃদ্ধি নিয়ে চিলি যেন সন্তুষ্ট হয়ে বসে আছে। অথচ দেশটি এখনো সালভাদর আলেন্দের সময়কার মতোই খনিজ রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল, সরকারের বার্ষিক আয়ের ৩০ শতাংশই আসে খনিজ রপ্তানি থেকে। এল লাদ্রিলোতে চিলির অর্থনীতিকে খনির মতো মামুলি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে সরিয়ে আধুনিক শিল্পের দিকে নিয়ে আসার যে পরিকল্পনার কথা শিকাগো বয়েজরা বলেছিলেন, তার খুব সামান্যই বাস্তবায়িত হয়েছে। ফলে দেশটি পণ্যের বৈশ্বিক মূল্যের ওঠানামার ফলে বিপদাপন্ন হয়ে পড়ে।

যেসব অভিভাবক The Grange স্কুলে তাদের সন্তানদের পাঠান, তারাও নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন–যে চরম আরামে তাদের সন্তানদের তারা রেখেছেন, তার কী প্রভাব তাদের ওপর পড়বে। পুরাতন অভিজাত সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করার কোনো আগ্রহ এসব ছেলেমেয়ের থাকে না; বরং তাদের গন্তব্য আধুনিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়া, যেগুলোর পড়াশোনার মান মাঝারি কিন্তু খরচ অনেক বেশি। কর্মসংস্থানের জন্য তাদেরকে অন্যান্য মেধাবী শিক্ষার্থীর সঙ্গে কোনো প্রতিযোগিতা করতে হয় না। কারণ, তাদের পিতামাতার প্রতিষ্ঠানে তাদের জন্য চাকরি নিশ্চিত হয়েই আছে। একজন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত পিতা বলেন, ‘মাকিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপের অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের যেমন পরীক্ষার মধ্যে ফেলেন, চিলির অভিজাতরা তাদের সন্তানদের তেমন কোনো চাপের মধ্যে ফেলেন না।’

পুরাতন অভিজাত সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করার কোনো আগ্রহ এসব ছেলেমেয়ের থাকে না; বরং তাদের গন্তব্য আধুনিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়া, যেগুলোর পড়াশোনার মান মাঝারি কিন্তু খরচ অনেক বেশি। কর্মসংস্থানের জন্য তাদেরকে অন্যান্য মেধাবী শিক্ষার্থীর সঙ্গে কোনো প্রতিযোগিতা করতে হয় না। কারণ, তাদের পিতামাতার প্রতিষ্ঠানে তাদের জন্য চাকরি নিশ্চিত হয়েই আছে।

পাবলিক স্পেস বা সর্বজনের জায়গার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বৈষম্যের ছায়া দেখা যায়। ‘এখানকার বিভিন্ন সামাজিক স্তরের মানুষ পরস্পরের সঙ্গে একেবারেই মেলামেশা করেন না।’ অফিসের প্রোগ্রাম হিসেবে গ্রীষ্মকালীন বনভোজন আয়োজন করতে গিয়ে ব্যর্থতার কথা স্মরণ করতে করতে কথাটা বললেন একজন বিদেশি নাগরিক। কোন কোন স্থান এবং কাজ ‘কুইকো’ বা অভিজাত আর কোনটা নয়, সে বিষয়ে কিছু অলিখিত বিভাজন আছে, যে বিভাজনের কারণে সবাই সব ধরনের কাজ করতে বা স্থানে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। ‘মানুষ অফিসের কাজের বাইরে অন্য কোথাও পরস্পরের সঙ্গে দেখা করতে চায় না। কারণ, কিছু পার্ক আছে কুইকো পার্ক আর কিছু আছে নন-কুইকো, একশ্রেণির মানুষ অন্য শ্রেণির মানুষের পার্কে যায় না।’ আনুষ্ঠানিকভাবে সান্তিয়াগোর পার্কগুলো সর্বজনের জায়গা, যেগুলো সর্বজনের করের টাকায় পরিচালিত হয় এবং যেখানে সবারই প্রবেশাধিকার থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে বৈষম্যের কারণে এই পার্কগুলো প্রাইভেট পার্কে পরিণত হয়েছে, যেখানে সবার প্রবেশাধিকার থাকে না।

সাম্প্রতিক অনেক গবেষণায় দেখে গেছে, লাইব্রেরি ও পার্কের মতো ‘সামাজিক অবকাঠামো’ দুঃসময়ের জন্য বিমা হিসেবে কাজ করে। এ বিষয়টি আমি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয়ও দেখেছি: মানুষ যখন পরস্পরের সঙ্গে মেলামেশা করে এবং প্রতিবেশীদের সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে খোঁজখবর রাখে, তখন তারা যে কোনো বিপদ-আপদ তুলনামূলক ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারে। কিন্তু চিলিতে সর্বজনের স্থানগুলোয় সবার প্রবেশাধিকার নেই। শহরে অপরাধের হার ততটা বেশি না-হলেও ধনী-দরিদ্র উভয় এলাকায় নিরাপত্তার জন্য ব্যাপক বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং অনেক ঘরবাড়ি লোহার বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা। বিভিন্ন এলাকার অলিগলিতে সর্বসাধারণের প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে এমন অবস্থা করা হয়েছে যে, এগুলো বেসরকারি এলাকায় পরিণত হয়েছে, যেখান দিয়ে সবার পক্ষে হাঁটা কিংবা সাইকেল চালানো সম্ভব নয়। ভিটাকুরা অভিজাত এলাকার ধনবান নাগরিকদের নিরাপত্তাভীতি কাটানোর জন্য সিসিটিভি ক্যামেরাসহ বাতাসে ভেসে থাকে বিশালাকৃতির হিলিয়াম বেলুন। চিলির নাগরিকদের প্রতি পাঁচজনের একজন স্বদেশিকে বিশ্বাস করার কথা জানান, যা উন্নত বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় খুবই কম।

চিলিতে সর্বজনের স্থানগুলোয় সবার প্রবেশাধিকার নেই। শহরে অপরাধের হার ততটা বেশি না-হলেও ধনী-দরিদ্র উভয় এলাকায় নিরাপত্তার জন্য ব্যাপক বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং অনেক ঘরবাড়ি লোহার বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা। বিভিন্ন এলাকার অলিগলিতে সর্বসাধারণের প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে এমন অবস্থা করা হয়েছে যে, এগুলো বেসরকারি এলাকায় পরিণত হয়েছে, যেখান দিয়ে সবার পক্ষে হাঁটা কিংবা সাইকেল চালানো সম্ভব নয়।

‘লা কন্দেজ এলাকার গৃহকর্মীদের দুপুরের খাবারের বিরতিতে দোকানে যাওয়া কিংবা কাজ থেকে বাড়ি ফেরার সময় ইউনিফর্ম পরে থাকতে হয়,’ জানালেন নুয়েভো ১৪-এর বাসিন্দা মেলিসা নেইরা। ‘এই গৃহকর্মীরা যে ভিন্ন এবং এই এলাকার বাসিন্দা নয়, তা বোঝানোর জন্যই এটা করা হয়।’ এ বিষয়ে যে কোনো সুনির্দিষ্ট আইন আছে তা নয়, এটা স্রেফ এক ধরনের সংস্কৃতি, শ্রেণিবিভাজন ও শ্রেণিগত মর্যাদা রক্ষার একটা উপায়। টেকসই হওয়ার জন্য সামাজিক পুঁজি ও সামাজিক অবকাঠামোর যদি কোনো ভূমিকা থেকে থাকে, তাহলে মানুষ যা ভাবে তার থেকেও দুর্বল চিলির অর্থনীতি।

উপসংহার

দ্রুত প্রবৃদ্ধি ও চরম বৈষম্য–চিলির এই রাস্তায় আরও অনেক উন্নয়নশীল দেশই চলছে। চিলির পথ যারা অনুসরণ করছে, সান্তিয়াগো তাদের জন্য সতর্কবার্তা দিচ্ছে। মুক্তবাজার যেমন সব সময় ভ্যালু বা মূল্য তৈরি করে না, উচ্চ প্রবৃদ্ধির মাধ্যমেও তেমনি সবসময় কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয় না। সান্তিয়াগোতে কিছু মৌলিক চাহিদার সমস্যার সমাধান হলেও আরও উচ্চতর চাহিদা যেমন: শিক্ষা, জীবনের ওপর কর্তৃত্ব ইত্যাদি আরও বেশি নাগালের বাইরে চলে গেছে। নিজ মহাদেশে চিলির মাথাপিছু জিডিপি সবচেয়ে বেশি। কিন্তু ওইসিডিভুক্ত উন্নত দেশগুলোর মধ্যে চিলিতে ওবিসিটি বা স্থূলতা সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে, স্কুলের ফলাফল সবচেয়ে খারাপ, বিশ্ববিদ্যালয় খরচ সবচেয়ে বেশি এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার হারও সবচেয়ে বেশি। সান্তিয়াগোতে থাকার সময় আমার মনে হয়েছে, এর সবকিছু বৈষম্যের সঙ্গে সম্পর্কিত।

বাজার এখানে এক ধরনের বিকৃত প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছে, শিক্ষা খাতের অবাধ ও ধ্বংসাত্মক প্রতিদ্বন্দ্বিতা যার একটা গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। বাজার এখানে সুযোগের সমতাকে অসম্ভব করে তুলেছে, বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকে আরও মজবুত করেছে এবং এমন সব জনবসতির জন্ম দিয়েছে যেখানকার অধিবাসীদের আয় এত কম যে, সেখানকার ক্রেতাদের কেউ পাত্তা দেয় না।

এই বাস্তব ব্যর্থতাগুলো থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, চিলি আবারও একটা আকর্ষণীয় জায়গায় পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন চিন্তা ও দর্শনের লড়াই চলছে। কিছুদিন নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিতে চলার পর, একটা পর্যায়ে এসে শিকাগো বয়েজরা চিলির অর্থনীতির কর্তৃত্ব গ্রহণ করে এবং দেখাতে চায় যে, মুক্তবাজার অর্থনীতিই সেরা; এ সময়ে চিলির প্রবৃদ্ধির জাদুর কথা শুনলে মনে হবে তাদের কথাই ঠিক। কিন্তু হাল আমলে সান্তিয়াগোর বাস্তব পরিস্থিতি থেকে এটা পরিষ্কার যে, বাজার এখানে এক ধরনের বিকৃত প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছে, শিক্ষা খাতের অবাধ ও ধ্বংসাত্মক প্রতিদ্বন্দ্বিতা যার একটা গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। বাজার এখানে সুযোগের সমতাকে অসম্ভব করে তুলেছে, বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকে আরও মজবুত করেছে এবং এমন সব জনবসতির জন্ম দিয়েছে যেখানকার অধিবাসীদের আয় এত কম যে, সেখানকার ক্রেতাদের কেউ পাত্তা দেয় না। ফলে মৌলিক প্রয়োজনীয় সামগ্রী রাষ্ট্রীয়ভাবে সরবরাহ করতে হয়। এই চরম বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার শিকার সান্তিয়াগোর তরুণরা এখন প্রশ্ন তুলছেন: বাজারের ওপর আদৌ নির্ভর করা যায় কি না, যে তরুণ অর্থনৈতিক পথপ্রদর্শকদের দেখানো পথে দুনিয়ার আরও অনেক দেশের তরুণরাই হাঁটবে।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •