অযান্ত্রিক যন্ত্ররিকশা

অযান্ত্রিক যন্ত্ররিকশা

ফিরোজ আহমেদ

বাংলাদেশে রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত অন্যতম প্রধান পরিবহণের ভূমিকা পালন করছে রিকশা-ভ্যান সহ বিভিন্ন ব্যাটারিচালিত বা হালকা ইঞ্জিন চালিত ছোট যান। এতে কর্মসংস্থান বিশাল, যাত্রী ও পণ্য পরিবহণে এগুলোর ভুমিকা খুবই বেশি। অথচ এসব যানের গুণগত মান উন্নয়নে কোনো ভূমিকা না নিয়ে বারবার এদের ওপর আক্রমণ, বিধিনিষেধ, অপপ্রচারই দেখা যায়। এই লেখায় এসব যানের গুরুত্ব, এগুলোর দুর্বলতা দূর করার পথ, এর সাথে দেশীয় শিল্পায়ন বিকাশের সম্পর্ক, এগুলো নিয়ে গবেষণার বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।    

বছর বিশেকেরও আগে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গ্রামীণ সড়কে প্রথমবার দেখা একটি দৃশ্যের কথা বলি। গ্রামীণ সেই সরু বাঁধানো রাস্তায় যাচ্ছিল নসিমন-করিমন-ভটভটি আর আলম সাধুসহ নানান নামের দেশোয়ালী গাড়ি; সেগুলোর একটা বড় অংশেরই যাত্রী ছিল মেয়েরা, যাচ্ছিল বাড়ি থেকে বহুদূরের বিদ্যালয়ে। তখন এই কথাটা মাথায় আসলো, বাংলাদেশের গ্রামীণ নারী-শিশুদের শিক্ষার অগ্রগতিতে একক বৃহৎ অবদান হয়তো এই দেশীয় কারিগরদের হাতে বানানো গ্রামীণ ও মফস্বলী গাড়িগুলোর। এরপর নিজের গ্রামে ঘুরতে গিয়েও দেখলাম এই সব বাহনের আনাগোনা শুরু হয়েছে, কৃষক এক বস্তা ধান কিংবা সুপারি নিয়ে দূরের হাটে পৌঁছে যেতে পারছেন প্রত্যন্ত সেই গ্রাম থেকে; চিকিৎসা বা কাজের খোঁজে বাইরে যাওয়াতে গতি এসেছে। সকাল-বিকাল দূরের জেলা সদর কিংবা অন্তত উপজেলায় যাওয়া যায়। কিন্তু শহরের গণমাধ্যমে, নাগরিক আলোচনায় এগুলো নিয়ে শুধু অবজ্ঞা নয়, দেখেছি স্পষ্ট বিরোধিতাও, অজস্রবার। তখনই গ্রামীণ এই পরিবহণগুলোর বিরুদ্ধে একতরফা প্রচারণার হৃদয়হীনতা ও নির্মমতা নিয়ে ভাবনার শুরু। কোটি কোটি মানুষের পরিবহণের, যাতায়াতের, যোগাযোগের এই বন্দোবস্তটি যে বাহনগুলো করলো, উৎপাদন থেকে পরিচালনা পর্যন্ত যত রকমের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলো, যেটা হতে পারতো আমাদের দেশীয় পরিবহণ শিল্পের প্রাথমিক ভিত্তি, সেটাকে আরও ভালো কিছুতে উত্তরিত করবার চেষ্টা না করে কেন তাকে একতরফা বন্ধ করার চেষ্টা? কেন এ বিষয়ক কোনো জাতীয় ভিত্তিক পর্যালোচনা হয়নি? রাতারাতি বন্ধ করে দেয়ার উদ্যোগের অর্থনৈতিক ফলাফলের কোনো মূল্যায়ন কেন হয়নি?

কোটি কোটি মানুষের পরিবহণের, যাতায়াতের, যোগাযোগের এই বন্দোবস্তটি যে বাহনগুলো করলো, উৎপাদন থেকে পরিচালনা পর্যন্ত যত রকমের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলো, যেটা হতে পারতো আমাদের দেশীয় পরিবহণ শিল্পের প্রাথমিক ভিত্তি, সেটাকে আরও ভালো কিছুতে উত্তরিত করবার চেষ্টা না করে কেন তাকে একতরফা বন্ধ করার চেষ্টা? কেন এ বিষয়ক কোনো জাতীয় ভিত্তিক পর্যালোচনা হয়নি? রাতারাতি বন্ধ করে দেয়ার উদ্যোগের অর্থনৈতিক ফলাফলের কোনো মূল্যায়ন কেন হয়নি?

আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা পদ্ধতি আসলে যে কতভাবে অধিকাংশ মানুষের স্বার্থ কিংবা প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতিহীন, তারই আরেকটা নিদর্শন এই গাড়িগুলোকে বিনা পর্যালোচনায় উচ্ছেদের নিয়মিত চেষ্টা। আদালতের আদেশে কয়েক বছর আগে ঢাকা শহর থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশার উচ্ছেদের কদিনের মাঝে ঢাকা শহরেরই ভূতের গলিতে বিদ্যালয়গামী শিশুর হাত ধরে থাকা এক মাকে বলতে শুনেছিলাম: “আর বইলেন না ভাবী, ঘুমের সময় এক ঘণ্টা কমে গেছে…”, প্রতিবেশি আরেক নারীকে তিনি বলছিলেন নাশতা বানান, বাচ্চাকে বিদ্যালয়ে পৌঁছে দেন, তারপর নিজের কাজে যান। আদালতের ওই এক হুকুম তার এই কর্মক্লান্ত দিন থেকে বিশ্রামের সময়টাকে কমিয়ে দিয়েছে। গ্রাম কিংবা শহর জুড়ে যান্ত্রিক গতি মানুষকে যে স্বাচ্ছন্দ্যটুকু এনে দিতে পেরেছে, যে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে, অর্থনৈতিক তৎপরতায় গতি এনেছে, সেই গ্রামীণ দেশীয় প্রযুক্তির পরিবহণগুলোকে যে বদনাম, যে প্রতিকূলতা, যে প্রবল বিরুদ্ধতা ও প্রতিরোধের ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে ও হয়েছে, সেটা কল্পনাতীত। এই প্রচারণা এতই শক্তিশালী যে ব্যবহারকারীদেরও একটা বড় অংশ এটা নিয়ে অপরাধবোধে ভোগেন।

জনজীবনে স্থানীয় কারিগরদের হাতে বিবর্তিত এই যান্ত্রিক প্রযুক্তির ব্যবহার চিরকাল টিকে থাকার উপযুক্ত নয়। তাকে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যেতেই হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু কোথায় কোন মাত্রায় তার প্রয়োজন আছে, কতদূর সে চলতে পারে, কোন প্রক্রিয়ায় তার রূপান্তর হলে জাতীয় সামর্থের বিকাশ ঘটবে, পরিবহণ খাতে দেশীয় পুঁজির বৈধ বিকাশ ঘটবে, সেই বিষয়ক একটা জাতীয় পর্যালোচনা ও চাহিদার নিরূপণ অত্যন্ত জরুরি। শহর ও গ্রাম নির্বিশেষে যান্ত্রিক ও দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি যানবাহন বিষয়ে কিছু পর্যালোচনা এই লেখার বিষয়বস্তু।

গ্রামীণ পরিবহণ নিয়ে পরিকল্পনা কোথায়?

সারা দেশে নসিমন-করিমন-আলমসাধু-ভটভটির সংখ্যা কত? কোনো কোনো হিসেবে বলা হচ্ছে ১৩ লাখ, কেউ বলছেন ১৯ লাখ। কেউ বলছেন ১০ লাখ, তাও বছর কয়েক আগের হিসাব। অগভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচ দেয়ার জন্য আমদানি করা ইঞ্জিনটিকে সড়ক পরিবহণের কাজে ব্যবহার নাকি শুরু হয় বৃহত্তর যশোর অঞ্চলের সড়ক পথে, মধ্য আশির দশকে। সে হিসেবে তিরিশের কোঠায় এই সব বাহনের অভিজ্ঞতা। ওই দশকেই এই যন্ত্রে চালিত নৌকারও প্রচলন শুরু হয়েছিল দক্ষিণাঞ্চলে। স্থানীয় কারিগররা অতি সাধারণ কারিগরি বিদ্যা দিয়েই এর নির্মাণ ও মেরামতি পুরোটাই চালিয়ে যাচ্ছেন। এর অন্তর্দাহী যন্ত্রটা বিদেশে প্রস্তুত, বাকি দেহকাঠামোর পুরোটাই খুবই প্রাথমিক ধরনের প্রযুক্তির প্রয়োগে দেশে তৈরি হয়েছে।

ওই দশকেই এই যন্ত্রে চালিত নৌকারও প্রচলন শুরু হয়েছিল দক্ষিণাঞ্চলে। স্থানীয় কারিগররা অতি সাধারণ কারিগরি বিদ্যা দিয়েই এর নির্মাণ ও মেরামতি পুরোটাই চালিয়ে যাচ্ছেন। এর অন্তর্দাহী যন্ত্রটা বিদেশে প্রস্তুত, বাকি দেহকাঠামোর পুরোটাই খুবই প্রাথমিক ধরনের প্রযুক্তির প্রয়োগে দেশে তৈরি হয়েছে।

ক) পত্রিকা নিয়মিত এদের বলে বিপদজনক। কথা মিথ্যা না। অজস্র দুর্ঘটনার জন্য দায়ী এরা। বেশ গতিমান এবং কাঠ ও লোহার তৈরি দেহের কারণে ভরবেগও এদের মন্দ না। অন্যদিকে এদের গতিনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা খুবই খারাপ, আধুনিক বাহনের বৈশিষ্ট্য সুলভ অন্যান্য নিরাপত্তা বন্দোবস্ত এই গাড়িগুলোতে নেই বললেই চলে। দেশের বহু অঞ্চলে বাস-ট্রাক-লরিসহ সকল প্রকার পরিবহণ মালিক ও শ্রমিকরা বেশ কয়েকবার ধর্মঘট করেছেন মহাসড়কে এদের চলাচলের বিরুদ্ধে। বহু স্থানে কঠোর পুলিশী বন্দোবস্ত করেও এদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। কোনো কোনো স্থানে খানিকটা রোধ করা গিয়েছে।

গ্রামীণ পরিবহণের অন্য অংশটি পুরোপুরি আমদানিকৃত, তাদের প্রচলন এক দশকের খুব বেশি না। তবে দেশে গত দশ বছরে এখন কত লক্ষ ইজিবাইক, মোটর চালিত ভ্যান, মাহিন্দ্রা, বেবি ট্যাক্সি এসেছে, কতগুলো সচল আছে তার ইয়ত্তা আপাতত নাই। এগুলো আমদানি হয়ে আসছে প্রধানত ভারত ও চীন থেকে। কম গতির হালকা এই বাহনগুলো বিপুল সংখ্যাধিক্যের কল্যাণে মফস্বলেযানজটের জন্য অন্যতম দায়ী, এগুলোকে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনের কথা নানান মহল থেকে নিয়মিত বলা হয়। সর্বদা অযৌক্তিকও নয় কথাগুলো। সেই প্রসঙ্গে আমরা পরে আসি। আপাতত এগুলো কেন টিকে থাকছে, সেই বিষয়টাতে নজর দেয়া যাক।

গ্রামীণ পরিবহণের অন্য অংশটি পুরোপুরি আমদানিকৃত, তাদের প্রচলন এক দশকের খুব বেশি না। তবে দেশে গত দশ বছরে এখন কত লক্ষ ইজিবাইক, মোটর চালিত ভ্যান, মাহিন্দ্রা, বেবি ট্যাক্সি এসেছে, কতগুলো সচল আছে তার ইয়ত্তা আপাতত নাই। এগুলো আমদানি হয়ে আসছে প্রধানত ভারত ও চীন থেকে।

খ) মফস্বলের এই সব ক্ষুদ্র বাহনের একেকটি একেক ধরনের সামাজিক চাহিদা মেটায়। ব্যক্তিগতভাবে কেউ ‘সংরক্ষিত’ করে মালামাল বা যাত্রী পরিবহণ উভয় প্রয়োজন মেটাতে পারেন। এর বাইরে অধিকাংশ সময়ে এগুলো গণপরিবহণ হিসেবেই চলাচল করে। মাহিন্দ্র বেশ গাট্টাগোট্টাদ্রুতগামী, গাদাগাদি করে জনা দশেক চড়তে পারেন। এক ‘উপজেলা থেকে আরেক উপজেলা’ এমন ধরনের মাঝারি দূরত্ব মোটামুটি তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য একে ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে ইজিবাইক জাতীয় বাহনগুলো যেন মফস্বলের চলন্ত সিঁড়ি, স্বল্প দূরত্বে সামান্য ভাড়ায় মানুষজন ক্রমাগত ওঠানামা করছেন তাতে। স্থানীয় পুলিশ ও প্রভাবশালীরা এগুলো চলার সনদ দেয়, কখনো এত পরিমাণে বেশি দেয় যে গাড়িগুলো নিজেদের যটে নিজেরাই আটকে পড়ে। ফলে কিছুদিন চলে প্রশাসনের কড়াকড়ি, মোড়ে মোড়ে হয়রানি। তারপর আবার পুরনো বন্দোবস্ত। মানুষের প্রতিক্রিয়াও সঙ্গতই; পয়লা দিনে যা থাকে যানজট থেকে মুক্তির স্বস্তি, কয়েকদিনেই তা মিলিয়ে গিয়ে শুরু হয় সস্তার দ্রুতযানটির জন্য আকুতি।

নসিমন-করিমন-আলম সাধু এরা অবশ্য ভারত-চীন থেকে আসা বাহনগুলোর তুলনায় একটু বড় সড়। এদের কোনো কোনোটি ছোটখাট ট্রাক আকৃতির। কোনো কোনোটিতে বসার বন্দোবস্ত আছে, যাত্রী পরিবহণে ব্যবহৃত হয় বলে। কোনো কোনোটির আকৃতি মানুষ ও মানবেতর যে কোনো প্রাণী ও মালামাল পরিবহণের উপযুক্ত। চাষা দুই বস্তা ধান বেচবে, আগেকার দিন হলে মাথায় নিয়ে যাও বড় রাস্তা পর্যন্ত, আরেক বস্তা চাপিয়ে দাও আর কারও মাথায়। এরপর বাসের চালক কিংবা সহকারির সাথে অসহায় দরদাম। তারপর বাসের ছাদে তুলে আবার ফের জায়গায় নিয়ে মাথায় তোল। এখন ভাঙাচোরা কিংবা রাস্তাহীন ‘রাস্তা’ ধরেও বাড়ির দোরগোড়ায় ইটখোলা থেকে মাল নিয়ে চলে আসছে (সম্ভবত) ১২ অশ্বশক্তির যন্ত্রচালিত আলম সাধু। মাইক্রোবাস কিংবা টেম্পোতে ব্যবহারপোযোগী চাকার ওপর ভর দিয়ে এক টন পর্যন্ত বোঝা নিতে পারবে সে। মালামাল যদি কম হয়, বস্তা দুয়েক ধান বাড়ির দোরগোড়া থেকে হাট পর্যন্ত নিয়ে যেতে আছে সনাতন রিকশা-ভ্যানের সাথে কম অশ্বশক্তির যন্ত্র ব্যবহার করা নসিমন। এই যে কন্যা শিশুরা ছেলেদের ডিঙিয়েও মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে পৌঁছে যাচ্ছে, সেই বিপ্লবের ইতিহাস কোনোদিন লেখা হলে নসিমন নামের বাহনটার নামও অত্যাবশ্যকভাবেই আসবে।

বছর সাতেক আগেকার একটা অন্তর্জাল ঠিকানায় প্রতিবেদন দেখেছিলাম: “যশোর শহর থেকে বাঘারপাড়া জনপ্রতি বাসভাড়া ১২টাকা। আর নসিমনে ভাড়া ৭/৮টাকা।” তারিখ বলা নেই, কবেকার হিসেব। তবে ভাড়ার এই পার্থক্যটা স্বাভাবিকই। আলম সাধু-নসিমনের ওজন খুব কম বলে জ্বালানি খায় কম, স্থানীয়ভাবে তৈরি বলে বিনিয়োগও কম। ফলে গ্রামীণ জীবনে এই যন্ত্রগুলোর টিকে যাবার পেছনে যা কার্যকারণ, সেটা রীতিমত অর্থনৈতিক দস্তুর। অন্যদিকে, যে কোনো জাতীয় সংবাদপত্র পড়লে এদের বিরুদ্ধে অজস্র অভিযোগ পাওয়া যাবে। গ্রামগঞ্জের সড়ক পথ এরা তো দখলে নিয়েছেই, নিয়মিত হানাও দিচ্ছে রাজপথে। এদের সাথে বড় বড় যানবাহনের সংঘাতে রক্তাক্ত দুর্ঘটনা ঘটছে। অতি সামান্য সহানুভূতি আপনি দেখবেন না এই বাহনগুলোর জন্য।

এবং সত্যিই তাই, সহানুভূতিদিয়ে রাজনৈতিক-অর্থনীতি চলে না। কোনো-না-কোনো ন্যায্যতা তৈরি তাকে করতে হয় সমাজের কোনো-না-কোনো অংশের মাঝে, যারা তাকে টিকিয়ে রাখবে, প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাত থেকে রক্ষাও করবে। সেটা যেটুকু সে করতে পেরেছে গ্রামীণ ও মফস্বলের জীবনে, ততটুকুই তার বিকাশ হয়েছে। বিপরীতক্রমে যতটুকু সে বৃহৎ পরিবহণ বাণিজ্যের স্বার্থে হাত দিয়েছে, তাকে বসিয়ে দেয়ার শক্তিটাও তাকে ঘিরে ততটুকু ক্রিয়াশীল। এই ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে নেতিবাচকভাবে যুক্ত হবে এই লোকজ বাহনগুলোর দুর্ঘটনাপ্রবণতা; কারণটা সকলেই জানেন: কারিগরি জ্ঞানের ঘাটতি, প্রশিক্ষণহীনতা, প্রযুক্তিগত দুর্বলতা।

গ) অন্য আরেকটি দিক দিয়ে আমরা এবার ভাবার চেষ্টা করি। প্রকৌশলবিদ্যার চিরকালের একটা লক্ষ্য হলো সমাজের যান্ত্রিক সঙ্কট মোচন। খুবই উঁচুমানের একটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের আছে যেটি রাষ্ট্রটির নামে নামাঙ্কিত। এছাড়া বহু জেলায় আছে জেলার নামে প্রতিষ্ঠিত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। জাতীয় দৈনিকগুলোতে আমরা অজস্রবার দেখেছি, মুগ্ধ হয়েছি, কত রকমের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় আমাদের সন্তানেরা প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় হয়েছেন, অন্তত সান্ত্বনা পুরস্কার পেয়েছেন। নতুন নতুন কৌশল ও ভাবনায় তারা সৃজনীশক্তির ব্যয় করছেন। এমনকি দেশীয় স্তরেই আয়োজন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক সব বিষয়ে নানান প্রতিযোগিতা। পৃথিবী বিখ্যাত নানানসংস্থায় তারা কাজ করেন। এগুলো নিশ্চয়ই জরুরিও। বিশ্বের বাসিন্দা হিসেবে বৈশ্বিক সমস্যার কথা আমরা কেন ভাববো না? সুদিন এলে এই অভিজ্ঞতাগুলো আমাদেরও কাজে লাগবে।

তবে, আমাদের চাষা যে আদিম বা প্রায় আদিম যে সকল যান্ত্রিক শক্তির সমস্যায় আজও ভুগছেন, সেটা নিয়ে আমাদের প্রকৌশলীরা বিশেষ সাফল্য দেখিয়েছেন, গবেষণা করছেন, বা ভাবছেন এমন সংবাদ আমরা নিত্য দেখি না। অল্প কিছু ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। ড্রোন বানাবার উদ্যোগ নিয়ে এদেশে অনেক আলাপ আছে, কিন্তু ঢেঁকির সাথে যন্ত্র জুড়ে দিয়ে কোটি কোটি গ্রামীণ নারীর শ্রম লাঘবের চেষ্টার কথা ভাবতেও সেদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমাদের কাদামাটি, আমাদের জলহাওয়ার উপযোগী সম্ভাব্য নানান প্রযুক্তি নিয়ে যুক্ততার চেষ্টা প্রশিক্ষিত প্রকৌশলীদের দিক দিয়ে বলার মত দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এই সমস্যাগুলো ততটা অর্থকরী নয়, এমনকি সমস্যা হিসেবেও তত জটিল কিছু না বলে মর্যাদার দিক দিয়েও বলবার মত কিছু নয়। আলম সাধু উৎপাদনে যন্ত্রপ্রকৌশলীর তেমন কিছু করার নেই, এটি নির্মাণ ও সারাইয়ে শুধু মিস্ত্রী-কারিগরই যথেষ্ট। ফলে দেশের পরিবহণ নিয়ে, কিংবা মফস্বল ও গ্রামীণ মানুষের প্রযুক্তিগত সমস্যা নিয়ে এখানকার যন্ত্রকৌশলীদের যুক্ততা বলার মত কিছু না। সাধারণ কারিগররাই লাগসই কিছু প্রযুক্তি উদ্ভাবন অথবা অনুকরণ করে আমদানির বাইরে যে চাহিদাটুকু বাকি থাকে, তা মেটাচ্ছেন।

আমাদের চাষা যে আদিম বা প্রায় আদিম যে সকল যান্ত্রিক শক্তির সমস্যায় আজও ভুগছেন, সেটা নিয়ে আমাদের প্রকৌশলীরা বিশেষ সাফল্য দেখিয়েছেন, গবেষণা করছেন, বা ভাবছেন এমন সংবাদ আমরা নিত্য দেখি না।

এর জন্য ঢালাও ভাবে প্রকৌশলীদের দায়ী করাও বৃথা। জগত চলে প্রণোদনায়। এই প্রণোদনা যদি অর্থনীতিতে চাহিদা তৈরি করতে পারে, তার ঢেউ রাজনীতিতেও আসে। রাজনীতিতে যদি এই আকাঙ্ক্ষা শক্তি তৈরি করতে পারে, সে অর্থনীতির রাস্তা বদলে দিতে পারে। এইভাবেই একটা জাতীয় চেতনা বিকশিত হয়, উদ্যোক্তা বলুন, প্রকৌশলী বলুন, পরিকল্পনাবিদ বলুন, সকলের মাঝে একটা যৌথ আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়। রাজনীতি ও অর্থনীতি একটা আরেকটাকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, চালিকা শক্তি হতে পারে, মানুষকে আদর্শিকভাবে কোনো উদ্দেশ্য সাধনে সংযুক্ত করতে পারে বলেই বিষয়টা রাজনৈতিক-অর্থনীতি। গ্রামীণ এই পরিবহণের সমস্যার সমাধান হতে পারে তখনই, যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো যে, গ্রামীণ এই চাহিদা মেটাবার জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ হবার সুযোগ আমরা সৃষ্টি করবো। এর যান্ত্রিক উন্নয়ন, নতুন নকশা এবং কারিগরি সকল দিক দিয়ে একটা জাতীয় উদ্যোগ গৃহীত হবে।

এর জন্য ঢালাও ভাবে প্রকৌশলীদের দায়ী করাও বৃথা। জগত চলে প্রণোদনায়। এই প্রণোদনা যদি অর্থনীতিতে চাহিদা তৈরি করতে পারে, তার ঢেউ রাজনীতিতেও আসে। রাজনীতিতে যদি এই আকাঙ্ক্ষা শক্তি তৈরি করতে পারে, সে অর্থনীতির রাস্তা বদলে দিতে পারে।

ঘ) তো, ১০ না কি ১৩ কিংবা ১৮ লাখ অথবা যে কোনো সংখ্যার নসিমন-করিমন-আলম সাধু চিরকাল টিকিয়ে রাখার পক্ষে আমার বলার কিছু নাই। কিন্তু গ্রামীণ সড়কের বিপুল পরিমাণ এই অবৈধ বাহনের প্রতিস্থাপন কি মাহিন্দ্র অথবা ক্ষুদে আকৃতির পিকআপ এবং সমজাতীয় আমদানি করা বাহন দিয়ে হবে, নাকি এ নিয়ে জাতীয় ভিত্তিতে কোনো নতুন পরিকল্পনা করা হবে, সেটা নিয়ে প্রতিটা নাগরিকের গুরুতর ভাবনার কারণ আছে। কারণ, এই খাতটার চাহিদা আমরা যা ভাবছি, তারচেয়ে অনেক বড়। এটা আরও বড় হতে যাচ্ছে। গ্রাম ও মফস্বলের মানুষের গড় মোট চলাচল নগরবাসীর চেয়ে এখনও বহুগুণ বেশিই, এবং দেশের প্রায় ৭০ ভাগের বেশি মানুষ এসব অঞ্চলেই থাকেন।

আমরা যদি জানিই যে, গ্রামাঞ্চলে-মফস্বলে পরিবহণের এমন একটা বিপুল চাহিদা তৈরি হচ্ছে সেই ৮০ দশক থেকে, সেই চাহিদা আমরা দেশীয়ভাবে মানসম্পন্ন এবং নিরাপদ বাহন দিয়ে মেটাবার কতটুকু উদ্যোগ নিয়েছি? এই ধরনের ক্ষুদ্র বাহন নির্মাণ, যার এই বিপুল চাহিদা আছে, সুনিশ্চিত বাজার আছে, তাকে কি করে আমরা এতটা অবহেলা করতে পারলাম? এবং শুধু উপেক্ষা না, সেই বাজারের একটা বড় অংশ আমরা পূরণ করলাম ভারত ও চীন থেকে সস্তার নানা বাহন আমদানি করে। এবং শেষ পর্যন্ত, সেই বাজারের যে অংশটুকু দেশীয় উদ্যোগে পূরণ হয়েছে, তার বিরুদ্ধেই অহর্নিশ যুদ্ধ পরিচালনা করতে শেখালাম! ফলে, এই বিশাল বাজার থেকে প্রকৌশলী বলি, পুঁজিপতির বলি, শ্রমিকের বলি, প্রায় যা কিছু মূল্যসংযোজন হচ্ছে, তা ঘটেছে, এবং ক্রমবর্ধমান হারে বাড়বে, তা চীনে অথবা ভারতে। বাংলাদেশে নয়।

এই ধরনের ক্ষুদ্র বাহন নির্মাণ, যার এই বিপুল চাহিদা আছে, সুনিশ্চিত বাজার আছে, তাকে কি করে আমরা এতটা অবহেলা করতে পারলাম? এবং শুধু উপেক্ষা না, সেই বাজারের একটা বড় অংশ আমরা পূরণ করলাম ভারত ও চীন থেকে সস্তার নানা বাহন আমদানি করে।

বাংলাদেশের পরিকল্পনামন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী কিংবা শিল্প ইত্যাদি যে সকল মন্ত্রীরা আছেন, বা ছিলেন, তাদের মুখে কি কখনো শুনেছেন গ্রাম, মফস্বল আর নগরপ্রান্তের পরিবহণ চাহিদা বলে একটা বিষয় আছে? সেখানে যে পরিমাণ গাড়ি এখনই লাগে, ভবিষ্যতে আরও অনেকদিন লাগবে, সংখ্যার দিক দিয়ে তার পরিমাণ সবগুলো মেট্রোপলিটন শহরের মোট বাহনের চাইতে অনেক অনেক বেশি। ২০১৫ সালের বিআরটিএর হিসেবে দেশে অনুমোদিত গণপরিবহণের সংখ্যা ১০ লাখ ৩৪ হাজার। দেখাই যাচ্ছে যে, বৈধতা-না-পাওয়া দেশীয় বাহনের সংখ্যাই অনুমোদিত বাহনের আনুমানিক সংখ্যার চেয়ে ঢের বেশি, সাথে ধরুন আমদানি করা অনুমোদনহীন বাহনগুলোর কথা। সংখ্যার তাৎপর্যটি এই যে, এই প্রতিটি বাহনপিছু অন্তত এক বা একাধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। এগুলোর নির্মাণ ও সারাইয়ের সাথে জড়িত হতে পারেন আরও বহু মানুষ। 

দেশের এই মুহূর্তের অন্যতম প্রধান চিন্তা কর্মসংস্থান। অথচ গ্রামীণ ও মফস্বলের পরিবহণের দিকে তাকালেই আমরা বুঝতে পারি, এই বিপুল সুনিশ্চিত বাজার শুধু এই মুহূর্তেই বিশাল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে রাখেনি, আমদানি করা ইজিবাইক-মাহেন্দ্র-সিএনজি ইত্যাদির বিকল্প বাহনগুলি দেশে উৎপাদনের পরিকল্পনা ঠিকঠাক গ্রহণ করা হলে শুধু এই খাতেই বিপুল কর্মসংস্থান হয়তো সৃষ্টি হতে পারবে। কিংবা বিপদের অন্য দিকটিও ভাবুন, কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে আমদানি সুবিধা ও ছাড় দিয়ে ছোট ও মাঝারি যে বিপুল পরিমাণ বাহন ইতোমধ্যে আমদানি করা হয়েছে (এবং এর সাথে যুক্ত করুন দেশীয় বাহনগুলোর বিরুদ্ধে নানান রকম যুদ্ধ ও প্রচারণার মধ্য দিয়েসেগুলোর স্থান সংকোচন করে ভবিষ্যতে আরও যা আমদানি হবে), তার ফলাফল হবে দেশে সম্ভাবনাময় বিপুল কর্মসংস্থান হারানো।

কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে আমদানি সুবিধা ও ছাড় দিয়ে ছোট ও মাঝারি যে বিপুল পরিমাণ বাহন ইতোমধ্যে আমদানি করা হয়েছে (এবং এর সাথে যুক্ত করুন দেশীয় বাহনগুলোর বিরুদ্ধে নানান রকম যুদ্ধ ও প্রচারণার মধ্য দিয়েসেগুলোর স্থান সংকোচন করে ভবিষ্যতে আরও যা আমদানি হবে), তার ফলাফল হবে দেশে সম্ভাবনাময় বিপুল কর্মসংস্থান হারানো।

গ্রামীণ চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথেই, অথবা আগেই আসলে এই উৎপাদন পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত ছিল। পরিবহণ খাতের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতের—হোক তা হালকা ও মাঝারি বাহন নির্মাণ—বিকাশ আমাদের দেশে বিনিয়োগ সঙ্কট বেশ খানিকটা কাটতো, শ্রমিক থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপক ও প্রকৌশলী পর্যন্ত বিপুল একটা দক্ষ জনশক্তিরও চাহিদা তৈরি হতো। আবার এই বিপুল জনশক্তিকে আইনী অনুমোদনের আওতায় আনা, তাদের প্রশিক্ষণ এবং কাগজপত্রের বন্দোবস্তও বহুতর কাজের জন্ম দিতে সক্ষম। সবচাইতে বড় কথা এই গোটা উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একটা জনগোষ্ঠী তৈরি হতো, সেটা উৎপাদক-বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে খুচরো বিক্রেতা পর্যন্ত।

ঙ) দেশীয় এই বাজারকে ঘিরে সরকারের পরিকল্পনা নাই সেটা বা বলি কী করে! বরং উলটো সেই পরিকল্পনাটাই অমোঘ গতিতে বাস্তবায়িত হচ্ছে। খুব দেরি নেই যে নসিমন-করিমন-আলম সাধুরা গ্রামীণ পরিবহণের ইতিহাস থেকে অন্তর্হিত হবেন। এই বাহনগুলো ইতিহাসে অন্তবর্তীকালীন সময়েই আসেন। এই অপসারণ সর্বদা যন্ত্রের প্রতিযোগিতায় ব্যর্থতার কারণে না, শুধু দুর্ঘটনার কারণেও না। এর সাথে যুক্ত আছে আইন, পুলিশ, বড় বড় আমদানিকারক, পরিবহণ মালিকের স্বার্থ। নসিমন-করিমন-আলম সাধুরা সেই তুলনায় দুর্বল স্থানীয় পুঁজির প্রতিনিধি। তবে শেষ পর্যন্ত যন্ত্রের প্রতিযোগিতাও একটা বিষয়, কেননা কারিগরি দক্ষতা আর বাংলাদেশের গ্রামের চাহিদা অনুযায়ী নিত্য নতুন বাহনের নকশা নির্মাণ ও তাদের আগমন অপ্রশিক্ষিত কারিগরদের হটিয়ে দেবেই। কিন্তু এই রূপান্তর যদি দেশীয় শিল্প দিয়েহয়, দেশীয় উদ্যোক্তাদের দিয়ে হয়, শুধু তা বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে না, শুধু তা দেশীয় পুঁজির অস্থিরতাকে খানিকটা হলেও কমাবে না, আজকের গ্রামের পরিবহণের চাহিদা, আজকের মফস্বলের পরিবহণের চাহিদা শুধু মেটাবে না, জাতীয় আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে। এই কাজটি করতে গিয়ে শিল্পসংগঠন সংক্রান্ত যে অজস্র নতুন সঙ্কটের মোকাবেলা ও তাকে অতিক্রম করতে হবে, ঠিক সেটাই বাংলাদেশের উপযুক্ত শিল্পসংস্কৃতির প্রবর্তনও ঘটাবে।    

একই আলাপ দেশে ক্রমবর্ধমান বাস-ট্রাকসহ নাগরিক পরিবহণ নিয়েও হতে পারে, যেগুলো অপেক্ষাকৃত ভারি শিল্প। বহুগুণ বেশি কর্মসংস্থানও সৃষ্টি সম্ভব তাতে। ভবিষ্যৎ চাহিদা বৃদ্ধির কথা মাথায় রেখে তাদের সুরক্ষা দিয়ে উৎপাদনের সুযোগ করে দেয়া যেতে পারে। আপাতত হালকা পরিবহণেই ক্ষ্যান্ত দিলাম, অন্তত কিছু একটা দিয়ে শুরু হোক।

নগর জীবনে নানান গতির দ্বন্দ্ব

ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোকে‘আনুষ্ঠানিকভাবে’ ইতোমধ্যেই উচ্ছেদ করা হয়েছে আদালতের আদেশে বেশ কয়েক বছর হলো। যদিও শহরতলীতে এবং বহু দীর্ঘ গলিতে এই রিকশা বা এর মতোই উপজেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নগরগুলোতে কিছুদিন পরপর এই যুদ্ধ চালানো হচ্ছে বাহনগুলোর বিরুদ্ধে।

ক) ব্যাটারি চালিত রিকশার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যে অভিযোগটি সবচে বেশি করা হয়, সেটি হলো যাত্রী- নিরাপত্তাজনিত সঙ্কট। রিকশার মতো একটি কাঠামোতে এই বাড়তি গতি প্রায়ই দুর্ঘটনার কারণ ঘটায়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর সাথে ধাক্কা লেগে আহতরাও আছেন এর মাঝে। অতিরিক্ত দুর্ঘটনার কারণ প্রধানত এর বেঢপ আকৃতি। সনাতন রিকশার আকারটি তৈরি হয়েছে দৈহিক শক্তিপ্রয়োগে যান্ত্রিক শক্তি উৎপাদন করে বাহনটাকে গতি দেয়ার জন্য। সে কারণে এর চাকা বৃহদাকারের। ফলে যাত্রীরা বসার আসনে অনেক উঁচু হয়ে পা-টিকে ভূমির সাথে উলম্ব আকৃতিতে রাখতে বাধ্য হন। এই আসন-ভঙ্গিতে বাহনের গতির হেরফেরে যাত্রী প্রায়ই আসন থেকে ছিটকে পড়ে যান। এই কারণেই সাধারণ রিকশাতেও বসার সময় দুর্বল, অশক্ত কাঠামোর মানুষেরা পা দিয়ে পাদানিতে ঠেস দিয়ে রাখেন অথবা হাত দিয়ে রিকশার ছাউনি ধরে নিজেকে সামলে রাখেন। ব্যাটারির সুবাদে গতিবৃদ্ধি অসুবিধাজনক বসার বন্দোবস্তটির ঝুঁকি বহুগুণ বৃদ্ধি করে। ব্যাটারি-চালিত রিকশায় দুর্ঘটনা বৃদ্ধির সহজ কারণ এটিই।

এর সাথে যুক্ত হয়েছে রিকশার গঠন উপকরণ। দৈহিক শ্রম দিয়ে চালিত বলে এর চাকা ও অন্যান্য অংশগুলো যথাসম্ভব হালকা বস্তু দিয়ে গঠিত, তাই সহজে ভঙ্গুর। অন্য যে কোনো বাহনের সাথে সামান্য সংঘর্ষে এর চাকা বেঁকে বসে যাচ্ছে, যাত্রীরা ছিটকে রাস্তায় পড়ে কিংবা আর কোনো বাহনের সাথে ধাক্কা খেয়ে আহত হচ্ছেন, এমন দৃশ্য নৈমত্তিক। সংঘর্ষের গতি বেশি হলে সম্পূর্ণ বাহনটিই দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে যায়। এছাড়া রিকশা চালক পেছন দিকটা দেখবেন, তেমন কোনো রিয়ার ভিউ মিরর নেই। এমন পলকা বাহনের গতি ব্যাটারির সাহায্যে বাড়িয়ে দিলে এর সবগুলো দুর্বলতাই যে বহুগুণে বৃদ্ধি পায়, তাতে সন্দেহ করার উপায় কি?

গাণিতিক হিসেব করেই বের করা সম্ভব কত অনুমোদিত গতিতে কতখানি আনুভূমিক পা ছড়িয়ে বসার ব্যবস্থা রাখলে বাহনের হঠাৎ গতি বদলে যাত্রী বেতাল হবেন না। দৈহিক শক্তিতে চালিত হবে না বলে কাঠামোটাকে অপেক্ষাকৃত ভারী ও মজবুত করাও সম্ভব হবে। চাকার আকৃতিও ছোট হয়ে আসবে, কিছুটা সিএনজিচালিত রিকশার মতই, কিংবা তার চেয়ে কিছুটা বড়।

কিন্তু দুর্ঘটনাই যদি যান্ত্রিক রিকশা বন্ধ করার একমাত্র কারণ হতো, তার নিরসন খুব কঠিন ছিল না। আমার বন্ধু, পেশায় তড়িৎপ্রকৌশলী, কিন্তু রিকশার যান্ত্রিকীকরণ নিয়ে সদা উৎসুক মাহবুব সুমন একদিন ছবি এঁকে বুঝিয়ে দিলেন বিষয়টা: যন্ত্রচালিত রিকশার কাঠামো বদলে দিলে, যাত্রীদের নিচু হয়ে পা ছড়িয়ে বসার ব্যবস্থা করলে ছিটকে পড়ার হার শূন্যের কোঠায় চলে যাবে। গাণিতিক হিসেব করেই বের করা সম্ভব কত অনুমোদিত গতিতে কতখানি আনুভূমিক পা ছড়িয়ে বসার ব্যবস্থা রাখলে বাহনের হঠাৎ গতি বদলে যাত্রী বেতাল হবেন না। দৈহিক শক্তিতে চালিত হবে না বলে কাঠামোটাকে অপেক্ষাকৃত ভারী ও মজবুত করাও সম্ভব হবে। চাকার আকৃতিও ছোট হয়ে আসবে, কিছুটা সিএনজিচালিত রিকশার মতই, কিংবা তার চেয়ে কিছুটা বড়। পেছনের দিকের যানবাহন দেখার ব্যবস্থাও বাধ্যতামূলক করা সম্ভব সহজেই। সব মিলিয়ে এটি বৈধ সিএনজি চালিত তিন চাকার গাড়িটির মতই, কিংবা তার চেয়েও নিরাপদ হয়ে উঠবে। দেশেই তা উৎপাদন সম্ভব বলে আমদানিও করা লাগবে না। এখন দেখি আন্তর্জাতিক স্তরের অনেকগুলো বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়, এবং বাংলাদেশে বুয়েট এ নিয়ে বিপুল গবেষণা করে বসে আছে। কথা হলো, নিরাপদ প্রমাণ হলে কি যান্ত্রিক রিকশাকে অনুমোদন দেবেন নীতি নির্ধারকেরা?

এখন দেখি আন্তর্জাতিক স্তরের অনেকগুলো বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়, এবং বাংলাদেশে বুয়েট এ নিয়ে বিপুল গবেষণা করে বসে আছে। কথা হলো, নিরাপদ প্রমাণ হলে কি যান্ত্রিক রিকশাকে অনুমোদন দেবেন নীতি নির্ধারকেরা?

সম্ভাবনা খুব কম। সেই জন্য আরও কিছু আপাত সঙ্গত যুক্তিও তাদের ঝুলিতে মজুদ আছে। এটার গতি বেপরোয়া। যেমন: এর চালকেরা লাইসেন্সহীন, প্রশিক্ষণহীন। এ যানজট বাড়ায়। সাধারণ রিকশা আর যান্ত্রিক রিকশার গতির পার্থক্য অনেক বলে গতির অনুমান-বিভ্রাট তৈরি হয়। শেষতঃ এ বিদ্যুৎ খায়!

এই ‘যুক্তিগুলো’গণমাধ্যমে এতোবার আমরা শুনি যে এগুলো সত্যি বলেই ভ্রম হয়। কিছু সহজ বিবেচনা: গতির সমস্যাটা মেটানো সম্ভব যান্ত্রিক উপায়েই এর গতির সীমাকে নির্দিষ্ট করে দিয়ে। এর ফলে একটা সীমার বাইরে গতি তোলার যান্ত্রিক ক্ষমতাই থাকবে না ব্যাটারি-রিকশার। এছাড়া, চালকদের জন্য অনুমতিপত্র বাধ্যতামূলক করে এবং গতিসীমা লঙ্ঘন করলে সেটা বাজেয়াপ্ত করেও সহজেই এই সমস্যাটাকে দূর করা সম্ভব। আর, কাঠামোগত উন্নতি সাধন করা হলে এর মাঝারি গতি- যেটা সিএনজি চালিত অটোরিকশার চেয়ে অনেক কম- সামান্যই ঝুঁকিপূর্ণ থাকবে। প্রশিক্ষণের উদ্যোগটাতো সরকার কিংবা যারা এই বাণিজ্য করতে আগ্রহী, তাদেরকেই নিতে হবে। যে কোনো পেশাতেই প্রশিক্ষণ ও অনুমতিপত্র একদিকে চালককে দায়িত্ব ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে, অন্যদিকে সীমা লঙ্ঘন করলে জরিমানা ও অনুমতি বাতিলের শাস্তির মাধ্যমে তার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে এগুলোর অভাবের যুক্তি দেখিয়ে ব্যাটারি রিকশাকে অবৈধ বলা যায় না।

খ) যানজটের অভিযোগটি বরং বিভ্রান্তিকর। যদি সমসংখ্যক রিকশাই নগরে উপস্থিত থাকে, তবে সেগুলোকে যান্ত্রিক থেকে অযান্ত্রিকে পরিণত করে যানজট কীভাবে কমানো সম্ভব? বরং বাহনের গতি হ্রাস পেয়ে সবার আগে যেটা বাড়ে সেটা ওই যানজটই। এটা তো সাধারণ বুদ্ধির বিষয় যে বাকি সকল শর্ত অটুট থাকলে বাহনের গতি বৃদ্ধির সাথে সাথে তুলনামূলক যানজট হ্রাস পাবে। কারণ বাহনগুলো দ্রুততর সময়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে সড়কের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করছে এবং অপরকে সেটা ব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে। বিশেষ করে বড় রাস্তার সংযোগস্থলগুলোতে সঙ্কেত বাতিগুলোর যে বিপুল পরিমাণ সময় ব্যয় হয় রিকশার ঢেউ অতিক্রম করতে, সেটা রাতারাতি অনেকখানি কমে আসে যান্ত্রিক রিকশায়। যান্ত্রিক রিকশাতে আরও একটা কারণে যানজট কমার কথা, সেটা হলো রিকশার সংখ্যা ও চাহিদা তাতে হ্রাস পায়, কম বাহনেই বেশি যাত্রী পরিবহন সম্ভব হয়, কেননা একই বাহন তখন প্রায় দ্বিগুণ মানুষকে পরিবহণ সেবা দিতে পারে।

গ) কিন্তু ব্যাটারি-রিকশা যে বিদ্যুৎ খায়, তার কী হবে? আমাদের সেক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত হচ্ছে বিদ্যুৎ খুব দামি বলে দেশের লক্ষ লক্ষ রিকশাচালককে নিজেদের গতর ঠেলেই আমাদের টেনে নিয়ে যেতে হবে। চট্টগ্রামের পাহাড়ি সড়কে হাঁপরের মত ওঠানামা বুক নিয়ে তারা আমাদের টেনে চলুক, ঢাকার রোদে পোড়া সড়কে তারা প্যাডেল মেরে পৌঁছে দিক গন্তব্যে। বিদ্যুৎ এমনই দামি। বিদ্যুৎ জাতীয় সম্পদ, জাতীয় গূরুত্বপূর্ণ স্বার্থেই ব্যবহার করা উচিত।

কিন্তু ওই যে আপনার ব্যক্তিগত গাড়িতে সিএনজি ভরে নিচ্ছেন, তার বেলা? এমনকি এই যে আপনি বাসে ডিজেল ব্যবহার করছেন, তার সাথে রিকশার বিদ্যুৎ খাওয়ার পার্থক্য কেন করছেন? রিকশাও একটা গণপরিবহণ বটে। গ্যাস/ডিজেল পুড়িয়েই বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। সারাদিন একটা ব্যক্তিগত গাড়ি এবং একটি রিকশা গড়ে যে কয়জন নাগরিককে গন্তব্যে পৌঁছে দেন, তাদের তুল্যমূল্য বিচারে জ্বালানি পাবার ক্ষেত্রে তো রিকশার বহুগুণ অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা। বরং কেউ বলে বসতে পারেন যে, কাফকো ইত্যাদির মতো বিশেষ শিল্পকলকারখানায় যে রকম ভর্তুকি দরে জ্বালানি সরবরাহ করা হয়েছে, উপযোগিতা বিচারে আমাদের প্রস্তাবিত নিরাপদ কাঠামোর-নিয়ন্ত্রিত গতির যান্ত্রিক রিকশায় সে রকমই ভর্তুকি দরে জ্বালানি দেয়া উচিত।

ঘ) এ রকম বলে বসলেই অবশ্য লাভ হচ্ছে না। ব্যাটারি রিকশায় যারা খুশি ছিলেন, তাদের অন্যতম হলেন সাত সকালে শিশুকে বিদ্যালয়ে নিয়ে যাবার তাড়ায় থাকা বাবা-মা। কর্মক্ষেত্র, নাশতা বানাবার তাড়া ইত্যাদি হুড়মুড়ের মাঝে সাত সকালে বহুমূল্যবান দশ-বিশ মিনিট বাঁচিয়ে দিয়েছিল এই বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য পরিবহণহীন দেশটিতে। দুর্ঘটনার ঝুঁকি সত্ত্বেও তারা ব্যবহার করতেন এটি। গলির অনেক ভেতরে যাদের বাস, তারা ব্যবহার করতেন এটি। পাদানি ঝুলে পড়া গণপরিবহণে বিপুল যুদ্ধ করে জায়গা পাবার আশা ছেড়ে দেয়া বাড়ি ফেরতামানুষেরাও ব্যবহার করতেন এটি। আনন্দিত ছিলেন রিকশাচালক স্বয়ং, তার বিপুল দৈহিক শ্রম লাঘব ঘটতো, আয়ও মন্দ হতো না। প্রত্যেকেই সচেতন ছিলেন দুর্ঘটনার ঝুঁকি বিষয়ে। এদের সামান্য অংশও সচেতন নন এর ঝুঁকি হ্রাস করাটা যে সহজেই সম্ভব, সেই বিষয়ে। ফলে তাদের ‘ভালোর জন্যই’ আদালত এই বাহনটি বন্ধ করে দিয়েছেন, সেটা মেনে নিয়ে তারা আজও খানিকটা ক্লান্ত সময় সড়কে কাটিয়ে দেন। এই নগরীর মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তকে আসলে যে একটা গতির লড়াইতে হারিয়ে দিয়েছে নগরটির গতিমান অংশ, গতিযুদ্ধের সেই চেহারাটি পুরোপুরি আড়ালে পড়ে গিয়েছে।

গতিযুদ্ধ? এটা খুব পুরনো একটা বিষয়। বিলাতেও একদা এই যুদ্ধ হয়েছে পথচারীর সাথে যানবাহনের, এই যুদ্ধ দুনিয়াব্যাপী চলছে গণপরিবহণের সাথে ব্যক্তিগত বাহনের। যে হারে গণতন্ত্র এবং সভ্যতার বিস্তার, সেই হারে জনতার বিজয় ঘটেছে; যে হারে লুণ্ঠন এবং মুষ্টিমেয়র রাজত্ব, সেই হারে জনতার অধিকারের পশ্চাৎপসরণ ঘটেছে। সড়ক যেহেতু সীমিত, গতিমানউচ্চশ্রেণি সর্বদা তার জন্য অগ্রাধিকারটুকুকে দখলে রাখতে তৎপর। জ্বালানির ভর্তুকি হোক আর রাস্তার গতির সুবিধা হোক, সম্ভাব্য সবটুকু যে করায়ত্ত রাখতে চায়। যান্ত্রিক রিকশার কারণে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের গতি কিছুটা বাড়লেও, শ্রমজীবীর দুর্দশা লাঘব হলেও আইন-আদালত-ক্ষমতা-গণমাধ্যম একচেটিয়া উচ্চবিত্তের হাতে এমনভাবে কেন্দ্রীভুত যে অনেকগুলো অযৌক্তিক অভিযোগ তুলেই ঢাকা শহরের সবচাইতে উপযুক্ত বাহন হতে সক্ষম যান্ত্রিক রিকশাকে কোনো উন্নতির, কোনো গবেষণার, কোনো পাইলট প্রকল্পের সুযোগ না দিয়ে বিদায় করে দিয়েছে। আমাদের দেশে সর্বত্র তাদের একচেটিয়া অধিকার, সড়কের ওপরও।

সড়ক যেহেতু সীমিত, গতিমানউচ্চশ্রেণি সর্বদা তার জন্য অগ্রাধিকারটুকুকে দখলে রাখতে তৎপর। জ্বালানির ভর্তুকি হোক আর রাস্তার গতির সুবিধা হোক, সম্ভাব্য সবটুকু যে করায়ত্ত রাখতে চায়।

যান্ত্রিক রিকশার প্রতি তাদের এই বিদ্বেষ অনেকখানিই অজ্ঞতাপ্রসূত। সমস্যাটির যন্ত্রপ্রকৌশলগত দিকগুলোকে অতিক্রম করা গেলে সার্বিকভাবেই সকলের গতি বহুগুণ বাড়বে। কিন্তু সুবিধাভোগীও ক্ষমতাবান যদি অজ্ঞ ও স্বার্থান্ধ হয়, তাহলে তার অজ্ঞতার বিশ্বজনীন বৈশিষ্ট্যই এই, আপাত দৃশ্যমান সুবিধাটা আঁকড়ে ধরে থেকে সে বহুক্ষেত্রে সমাজের সার্বিক প্রগতিকে, এমনকি নিজের গতিকেও অবরুদ্ধই করে। স্বীকার করা প্রয়োজন, রিকশা রক্ষা আন্দোলন কিংবা যান্ত্রিক রিকশার প্রচলন আমাদের সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান না। সেটা বৃহদাকারের গণপরিবহণেই সম্ভব। কিন্তু প্রতিটি নগরের বিশিষ্ট চরিত্র ও সুযোগ-সুবিধার কথা চিন্তা করলেও আরও বহুদিন আমাদের গলি ঘুপচির নগরে যান্ত্রিক রিকশা অনেকটাই যুতসই। শুধু তাই না, বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে এটা উপযোগিতার দিক দিয়ে বাস ও অন্যান্য বাহনের চেয়ে কম কার্যকরী না। দেখা যাবে বহু দীর্ঘ গলিতে যেখানে অন্য কোনো পরিবহণের সুবিধা নেই, কিংবা এই লকডাউনের রাস্তায় ব্যাটারি চালিত রিকশারা এখনও আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিব্যি টিকে আছে, মাস্তান ও গুণ্ডাতন্ত্রের প্রতিনিধিদের যথাযথ চাঁদা দিয়ে।

স্বীকার করা প্রয়োজন, রিকশা রক্ষা আন্দোলন কিংবা যান্ত্রিক রিকশার প্রচলন আমাদের সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান না। সেটা বৃহদাকারের গণপরিবহণেই সম্ভব। কিন্তু প্রতিটি নগরের বিশিষ্ট চরিত্র ও সুযোগ-সুবিধার কথা চিন্তা করলেও আরও বহুদিন আমাদের গলি ঘুপচির নগরে যান্ত্রিক রিকশা অনেকটাই যুতসই।

বিদ্যুতের উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু তার ব্যবহারের অধিকারে রিকশা চালক তাই বঞ্চিত। তার সুবিধা এই বর্ধিত বিদ্যুৎ চাহিদার বিবেচনার আওতায় নেই। ফলে প্রায় দাসশ্রমের তুল্য দৈহিক শক্তিতে চালিত বাহনের যুগে আমাদের ফেরত পাঠানো হলো। রাষ্ট্রের ভর্তুকিতে বিদ্যার্জন করা আমাদের প্রকৌশলীরা যখন মানব জাতির সুক্ষ্মতম ও সর্বশেষতম সমস্যা নিয়ে নিমগ্ন, তখন সেই করের পয়সাটা জোগানো রিকশাচালক আবারো ফেরত গেলেন যন্ত্রশক্তির আদিমতম রূপে।

এভাবেই নগরে গতির যুদ্ধে বিজয়ী উচ্চবিত্ত তার একচেটিয়া অধিকার নিশ্চিত করে মধ্যবিত্ত থেকে শ্রমজীবী পর্যন্ত সবগুলো জনসম্প্রদায়কে বিপন্ন করলেন, নিজের জন্যও একটা যানজটপূর্ণ নগরী নিশ্চিত করলেন।

সারসংক্ষেপ

বড় সড়কের বড় বড় বাসের মতই বাংলাদেশের গলিঘুপচির বাস্তবতায় সত্যিকারের গণপরিহণ হলো ব্যাটারি রিকশা, ইঞ্জিন চালিত ভ্যান, আলম সাধু, ভটভটি এই সব। কিন্তু বাংলাদেশের প্রায় সকল গবেষণা বিষয়টাই বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার অর্থায়নে  পরিচালিত হয় বলে এগুলো নিয়ে এখন পর্যন্ত একটাও যথাযথ গবেষণা হয়নি। এমনকি পত্রিকাগুলোর দিকে তাকালে বুঝবেন, এরা রীতিমত জিহাদ করেছে এই বাহনগুলোর বিপক্ষে। বিপরীতে কয়েকটা ছোট তথ্য ভাবা যাক:

১. বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে নারী শিক্ষার যে বিপ্লব, সেটা কি আলম সাধু, ভটভটি, মোটর রিকশার কল্যাণে না? বিশ বছর আগে যখন গ্রামের রাস্তায় অজস্র এমন গাড়িতে মেয়েদের যেতে দেখলাম বই হাতে, এই বাহনগুলোর অবদান বুঝতে বিন্দুমাত্র সময় লাগেনি। এই পরিবহণের চাহিদা কি ফুরিয়েছে? বিকল্প কী দিয়েছেন?

২. ক্ষুদ্র চাষী ও ব্যবসায়ীদের কথা ভাবেন, এক বস্তা চাল বা অন্য পণ্য নিয়ে বাজারে যাবার সামর্থ্য মানেই বাজারের একচেটিয়া কারবারীর হাত থেকে বেশ খানিকটা মুক্তি। পণ্যের গতিশীলতা এনেছে এটা। আগে এক বস্তা মাথায় করে তাকে আসতে হতো বড় রাস্তা পর্যন্ত।

৩. আজ থেকে তিরিশ বছর আগে গ্রামে আত্মীয়রা কখন কোথায় যাবেন, তা ছিল বছরের হিসাবে। কারণ পরিবহণ ছিল কম। গ্রামীণ ও মফস্বলের জগতে এই পরিবহণগুলো যাতায়াত, বিনোদন, চিকিৎসা, শিক্ষায় অভাবিত রূপান্তর এনেছে। ঢাকার উপকণ্ঠের বহু জায়গাতেও এটা দারুণ রকম সত্যি আজকেও।

৪. ঢাকার অধিকাংশ সড়কে নিরাপদ প্রযুক্তির যান্ত্রিক রিকশা ব্যবহার করা গেলে মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তের গতি বৃদ্ধি হবে, সময়ের সাশ্রয় হবে। গতিশীলতার এই বৃদ্ধি শহরে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করবে, অর্থনৈতিক তৎপরতা, বিনোদন, বিশ্রাম সকলই বৃদ্ধি পাবে। রিকশার মডেল উন্নত করে, গতি নিয়ন্ত্রণ করে শ্রমজীবী থেকে মধ্যবিত্ত বিপুল জনগোষ্ঠীর উপকারে আসতে পারতো এই বাহনটি।

৫. ব্যাটরি রিকশার শ্রমিকের জীবনমানের কথা বললাম না। এই যুক্তি বাংলাদেশের বিদ্যমান ‘জ্ঞানী সমাজ’ খাবেন না। কিন্তু যা তারা খাচ্ছেন, সেটা তাদেরকে একটা রাস্তা নামের নরকের বাসিন্দা বানিয়ে ফেলছে। প্রত্যেকে একটা করে গাড়ি কেনার জন্য মরিয়া হচ্ছেন, কারণ এই সব গণপরিবহণের অনুপস্থিতি।

কোনো সংলাপ দেখেছেন কোনো পত্রিকার, যেখানে একতরফা বদনাম করার বদলে এর সমাধান নিয়ে ভাবা হয়েছে? এর অবদান এবং সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলা হয়েছে? এগুলো নিয়ে গবেষণা জাইকা বলা হোক, এডিবি বলা হোক, বিশ্বব্যাঙ্ক কিংবা আর সব তথাকথিত উন্নয়ন সহযোগী, তাদের দিক দিয়ে দেখা যাবে না। কারণ তারা আরও ব্যক্তিগত গাড়ি গেলাতে চায়।

৬. কোনো সংলাপ দেখেছেন কোনো পত্রিকার, যেখানে একতরফা বদনাম করার বদলে এর সমাধান নিয়ে ভাবা হয়েছে? এর অবদান এবং সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলা হয়েছে? এগুলো নিয়ে গবেষণা জাইকা বলা হোক, এডিবি বলা হোক, বিশ্বব্যাঙ্ক কিংবা আর সব তথাকথিত উন্নয়ন সহযোগী, তাদের দিক দিয়ে দেখা যাবে না। কারণ তারা আরও ব্যক্তিগত গাড়ি গেলাতে চায়।

৭. এই হালকা বাহনগুলো মহাসড়ক বাদ দিয়ে দেশের অধিকাংশ রাস্তার জন্য দারুণভাবে উপযুক্ত। বাংলাদেশের বিশেষ গঠন কাঠামোতে নিয়ন্ত্রিত, করের আওতায় থাকা এবং দেশীয়ভাবে নির্মিত হালকা যান্ত্রিক বাহনই ভবিষ্যত। মহাসড়কগুলোতেও এই হালকা বাহনগুলোর জন্য পার্শ্বরাস্তা থাকাটা অত্যাবশ্যক।

৮. খুলনার মত মফস্বলগুলোতে দেখবেন, চলাচলটা আরামের। কারণ পাশ দিয়ে যাচ্ছে ইজিবাইক, তুলে নিচ্ছে। ৫ কিংবা ১০ টাকাতে বহুদূর নিয়ে নিচ্ছে। নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশু উঠছেন, নেমে যাচ্ছেন। চট্টগ্রামে মরিয়া প্রতিযোগিতা বাসে ওঠবার, কারণ সেখানে এগুলো চলে না।

৯. সরকারি লোকদের গাড়ি ব্যবহার সীমিত করে দেখেন, তাদের বাধ্য করেন গণপরিবহণ ব্যবহার করতে, কোন বাহন সবচাইতে ভালো, সে বিষয়ে জাতির ধারণা বদলে যাবে রাতারাতি।

১১. ঢাকার রাস্তায় চলা হালকাতম ব্যক্তিগত গাড়ির চাইতেও ব্যাটারি রিকশাগুলোর ওজন বহুগুণ কম। ফলে স্রেফ এই কারণেই তার যান্ত্রিক কার্যদক্ষতা অনেক বেশি, প্রযুক্তিগত ভাবে পিছিয়ে থাকা সত্ত্বেও। [এই কারণেই গাড়িগুলো একটু দুর্ঘটনা-প্রবণও, ওজন আরেকটু বাড়ানোর বন্দোবস্ত করা উচিত। এবং সেই বাড়তি ওজন সমেতই তা বেশি বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হবে]। ওজন কম বলেই শুধু ব্যাটারি চালিত রিকশা ব্যক্তিগত গাড়ির তুলনায় কম জ্বালানি খরচ করে না, পাঁচজনের আসনে অধিকাংশ সময়ে ফাঁকা চলা ব্যক্তিগত গাড়ির অপচয় যাত্রী সংখ্যার কারণেও বহুগুণ বেশি। অধিকাংশ সময়ে যাত্রীবহন করা ব্যাটারি চালিত রিকশার বিদ্যুৎ অপচয় বহুগুণ বেশি কম, কারণ তা বাণিজ্যিকভাবে চলে, যতক্ষণ চলে ফাঁকা না থাকাটা তার লক্ষ্য থাকে। ব্যাটারিচালিত রিকশা গলিঘুপচির বাংলাদেশের সবচাইতে আদর্শ গণপরিবহণ হতে সক্ষম।

১২. রিকশার আধুনিক কাঠামোগুলো ব্যবহার করলে এটার কর্মদক্ষতা আরও বহুগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। সেই রকম বহু গবেষণা ইতোমধ্যেই হয়ে আছে।

গণপরিবহণে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ীমূল্যে দেয়া উচিত, বহুদেশে যেমন দেয়া হয়। ব্যাটারি রিকশাশহরের গলিতে, জেলা-উপজেলা ও মফস্বল শহরগুলোতে সম্ভাবনাময় বাহন, একে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ দেয়ার দাবিটিকে রাজনৈতিক দাবিতে পরিণত করা প্রয়োজন।

১৩. গণপরিবহণে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ীমূল্যে দেয়া উচিত, বহুদেশে যেমন দেয়া হয়। ব্যাটারি রিকশাশহরের গলিতে, জেলা-উপজেলা ও মফস্বল শহরগুলোতে সম্ভাবনাময় বাহন, একে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ দেয়ার দাবিটিকে রাজনৈতিক দাবিতে পরিণত করা প্রয়োজন।

ফিরোজ আহমেদ: প্রাবন্ধিক, রাজনীতিবিদ। ইমেইল: subarnasava@gmail.com

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •