ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান, ইজিবাইক: কর্মসংস্থান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রশ্ন

ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান, ইজিবাইক: কর্মসংস্থান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রশ্ন

ইমরান হাবিব রুমন

গত ২০ জুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। বলেছেন, ইজিবাইকও ক্রমান্বয়ে বন্ধ করে দেওয়া হবে। অথচ এগুলোর অনেককিছুই বহুদিন ধরে বৈধ আমদানির তালিকায়। সড়কে শৃঙ্খলা আনা আর দুর্ঘটনা কমানোর জন্য এগুলো নিষিদ্ধ করার কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু তা কতটুকু যৌক্তিক? সড়কে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা, সড়ক পরিবহণে নৈরাজ্য নিয়ে গত বহু বছর বহু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেয়া হলেও সরকার তাতে কান দেয়নি। বরং নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করা হয়েছে। এছাড়া গত ১০ বছরে রিকশা-ভ্যান, ইজিবাইকের নিরাপদ উন্নত ডিজাইন করতে, উন্নত মডেলের রিকশা-ভ্যান তৈরি করতে সরকারকে নানা সুপারিশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারের এসব সমাধানে মনোযোগ নেই। উল্টো যখন তখন মানুষকে বিপদে ফেলার সিদ্ধান্ত জানাতে তার কোনো দ্বিধা নাই। এই লেখায় সরকারি সিদ্ধান্ত পরীক্ষা করে সংকট সমাধানের যথাযথ পথ দেখানো হয়েছে।

প্রকৃত তথ্য কোথাও পাওয়া না-গেলেও ধারণা করা যায় যে, সারা দেশে ৫০ লক্ষাধিক মানুষ ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক চালিয়ে তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন। এর সঙ্গে ব্যাটারি চার্জ ও গ্যারেজ ব্যবসা, ব্যাটারি ও বিভিন্ন যন্ত্রাংশ বিক্রি, গাড়ি মেরামত, চালকদের থাকা-খাওয়াসহ নানান কাজে আরও কয়েক লাখ মানুষ এই পেশার সঙ্গে পরোক্ষভাবে যুক্ত। সুলভে যাত্রী ও পণ্য পরিবহণের মাধ্যমে ৫০ লাখ মানুষ গড়ে ৬০০ টাকা আয়ে দৈনিক প্রায় ৩০০ কোটি টাকা সঞ্চালনের মাধ্যমে শহর ও গ্রামীণ অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন এই ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক শ্রমিকরা।

সারা দেশে ৫০ লক্ষাধিক মানুষ ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক চালিয়ে তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন। এর সঙ্গে ব্যাটারি চার্জ ও গ্যারেজ ব্যবসা, ব্যাটারি ও বিভিন্ন যন্ত্রাংশ বিক্রি, গাড়ি মেরামত, চালকদের থাকা-খাওয়াসহ নানান কাজে আরও কয়েক লাখ মানুষ এই পেশার সঙ্গে পরোক্ষভাবে যুক্ত।

বিগত প্রায় ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমাদের দেশে এই ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকের প্রচলন। জ্বালানি ও সময়সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব এবং প্যাডেল রিকাশা-ভ্যানের অমানবিক কায়িক শ্রম লাঘব হওয়ায় এই বাহনগুলো সারা দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে ইজিবাইকগুলো এবং এর যন্ত্রাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করা হলেও পরবর্তী সময়ে ইজিবাইকের বডি স্থানীয়ভাবে তৈরি করা হয় এবং যন্ত্রাংশগুলো বাইরে থেকে আমদানি হয়। ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যানের ক্ষেত্রে প্যাডেলচালিত রিকশা আর ভ্যানেই ব্যাটারি-মোটর বসিয়ে এগুলোকে ব্যাটারিচালিত যান্ত্রিক বাহনে পরিণত করা হয়। প্যাডেল রিকশার বডি হালকা হওয়ায় গতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষার জন্য স্থানীয় মেকাররা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন জেলায় স্টিল বডির অপেক্ষাকৃত ভারী ও টেকসই এবং আরামদায়ক ও নিরাপদ স্টিল বডির রিকশা ও ভ্যান তৈরি করেছেন। বেশকিছু জেলায় বিদেশ থেকে মোটা চাকার ব্যাটারিচালিত রিকশা আমদানি করা হয়েছে। মোটা ও ছোট চাকা, পায়ে ব্রেক এবং স্প্রিং থাকায় এগুলো অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও আরামদায়ক।

শুরুতে ইজিবাইকগুলো এবং এর যন্ত্রাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করা হলেও পরবর্তী সময়ে ইজিবাইকের বডি স্থানীয়ভাবে তৈরি করা হয় এবং যন্ত্রাংশগুলো বাইরে থেকে আমদানি হয়।

একটা ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান বানাতে বর্তমানে খরচ হয় প্রায় ৫০ হাজার টাকা আর নতুন ইজিবাইক বানাতে লাগে প্রায় দেড় লাখ টাকা। সারা দেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যানের প্রায় অর্ধেকের মতো রিকশা-ভ্যান চালকদের নিজের। বাকিরা রিকশা বানিয়ে সেগুলো চালকদের কাছে ভাড়া দেন। ভাড়া বাবদ প্রতিদিন ২০০-২৫০ টাকা পান। এরকম সারা দেশে নিম্নমধ্যবিত্ত অনেক পরিবার, অনেক বিধবা নারী বা ছোট চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্তরা নিজেদের শেষ সম্বল দিয়ে দু-একটা রিকশা-ভ্যান, ইজিবাইক কিনে সেগুলোর ভাড়ার টাকায় পুরো সংসার পরিচালনা করেন। আবার এদের একটা বড় অংশ এনজিও থেকে ঋণ করে এগুলো বানিয়েছেন। রিকশা-ভ্যান চালিয়ে একজন চালক দৈনিক ৭০০-৮০০ টাকা রোজগার করেন। কোনো গ্যারেজে রিকশা রাখা ও চার্জ দেওয়ার জন্য প্রতিদিন গড়ে তাকে ৭০ টাকা দিতে হয়। আর রিকশা ভাড়ায় নিলে ২০০ টাকা। এভাবে লাখ লাখ পরিবার বর্তমানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যাটারিচালিত বাহনের ওপর নির্ভরশীল।

সারা দেশে নিম্নমধ্যবিত্ত অনেক পরিবার, অনেক বিধবা নারী বা ছোট চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্তরা নিজেদের শেষ সম্বল দিয়ে দু-একটা রিকশা-ভ্যান, ইজিবাইক কিনে সেগুলোর ভাড়ার টাকায় পুরো সংসার পরিচালনা করেন। আবার এদের একটা বড় অংশ এনজিও থেকে ঋণ করে এগুলো বানিয়েছেন।

দুঃখের বিষয় হলো, গত ২০ জুন রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সড়ক পরিবহণ টাস্কফোর্সের সভাশেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্তের কথা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। ইজিবাইকের বিষয়ে তিনি বলেছেন, ইজিবাইক নিয়ন্ত্রণ করা হবে, ক্রমান্বয়ে এটা বন্ধও করে দেওয়া হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই বাহনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ, অনিরাপদ বলে বন্ধ করার কথা বলছেন; সড়কে শৃঙ্খলা আর দুর্ঘটনা কমানোর কথা বলেছেন। অথচ বিগত ১০ বছর ধরে আমরা এই সংকটগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানের কথা বলে আসছি, সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবও দিয়েছি। ১০ বছর পর্যাপ্ত সময় এই রিকশা-ভ্যান, ইজিবাইকের নিরাপদ উন্নত ডিজাইন করে সেই মডেলের রিকশা-ভ্যান তৈরি করতে চালকদের উদ্বুদ্ধ করতে। কিন্তু সরকার এই দীর্ঘ সময় সংকট সমাধানের চেষ্টা করেনি। আর এই সময়ে ধীরে ধীরে সারা দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ রিকশা-ভ্যান ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যানে পরিণত হয়েছে।

হঠাৎ করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত সারা দেশে পঞ্চাশ লক্ষাধিক পরিবারকে কীরকম দুশ্চিন্তা আর আতঙ্কের মধ্যে ফেলেছে, তা এসব হাড়জিরজিরে দরিদ্র মানুষের সঙ্গে যারা মেশেন না, তারা কল্পনাও করতে পারবেন না। ঘোষণার পরপরই বেশকিছু জায়গায় ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক চলাচলে বাধা দেওয়া হচ্ছে।

অনেক জায়গায় চালকরা ভয়ে রিকশা, ভ্যান ও ইজিবাইক বের করছেন না। কারণ, যদি রাস্তা থেকে গাড়িটি জব্দ করা হয়, তাহলে উপার্জনের এই শেষ সম্বল হারিয়ে পথে বসা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকবে না। বাস্তবতা হলো, বেশিরভাগ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক মালিক এনজিও থেকে ৫০-৬০ হাজার টাকা লোন নিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও প্রায় দেড় লাখ টাকা লোন করে ইজিবাইক কিনেছেন। সপ্তাহান্তে এদের এনজিওর কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে হয়। তাই রিকশা-ভ্যান, ইজিবাইক না চালিয়ে ঘরে বসে থাকাও তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

এ কথা আমরা সবাই জানি, যে কোনো প্রযুক্তিই মানুষের সময় এবং কায়িক শ্রম লাঘবের জন্য। এই আধুনিক যুগে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টা কতটা অমানবিক, সেটা আমরা অনেকেই উপলব্ধি করতে না পারলেও নিশ্চিতভাবেই আর ৫০ বছর পরের মানুষ আমাদের এই কাজের জন্য অসভ্য, বর্বর বলে গালি দেবে। যেমন টানা রিকশার বেলায় আমরা এখন বলি। আবার ইতিহাস খুঁজলে নিশ্চয়ই এই ঘটনাও খুঁজে পাওয়া যাবে যে, টানা রিকশায় প্রযুক্তি ব্যবহার করে যখন প্যাডেল রিকশা এসেছিল, তখনও একদল মানুষ এর বেশি গতি বা দুর্ঘটনার কথা বলে বিরোধিতা করেছিল। সাইকেল, মোটরগাড়ি, রেলগাড়ি সব ক্ষেত্রেই এমন বিরোধিতা হয়েছিল। প্রযুক্তির কল্যাণে সর্বক্ষেত্রেই মানুষের কায়িক শ্রম কমেছে, গতি বেড়েছে, সাশ্রয় হয়েছে মানুষের সময়।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রেক বা কাঠামোগত যে সমস্যার কথা বলেছেন, তা যদি সমাধানযোগ্য না হয়, তবেই তিনি সেটা নিষিদ্ধ করার কথা বলতে পারেন। ব্যাটারি দিয়ে মোটর ঘোরানোর বিষয়টা প্রযুক্তিগতভাবে খুবই স্বাভাবিক বিষয় এবং এই প্রক্রিয়ার অভ্যন্তরীণ কোনো বিপদ নেই। তাহলে আধুনিক যন্ত্র প্রকৌশলবিদ্যা কাজে লাগিয়ে ব্রেক বা কাঠামোর পরিবর্তন করে ডিজাইন উন্নত করে খুব সহজেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উল্লিখিত সমস্যার সমাধান করা যায়, রিকশা-ভ্যানগুলো নিরাপদ করা যায়। নিরাপদ করা যায় ৫০ লক্ষাধিক মানুষের জীবিকা।

বর্তমানে এই বিতর্কে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যানসহ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বেশকিছু সময় উপযোগী আলোচনা করেছেন, সরকার চাইলে এই রিকশাগুলো নিরাপদ করতে সহযোগিতা করার কথা বলেছেন, যা এই সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বুয়েটের উপাচার্য ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অ্যাপ্রোপ্রিয়েট টেকনোলজি ডেভেলপ করা প্রয়োজন। ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোর ডায়ামিটার কী হওয়া উচিত, ব্রেক কেমন হওয়া উচিত–সেগুলো স্টাডি করে হুইলগুলো ডিজাইন করা, ব্রেকিং সিস্টেমটা ডিজাইন করা, স্পিড লিমিট তৈরি করা প্রয়োজন।’ মেকানিক্যাল বিভাগের তাহমিদ হোসেন বলেন, ‘অটো রিকশাগুলো একটা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ, এগুলো স্থানীয়ভাবে তৈরি হচ্ছিল। বাংলাদেশে অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি খুব ভালোভাবে তৈরি হয়নি। এই রিকশাগুলো উৎপাদনের মাধ্যমে আমরা ধীরে ধীরে আরও বড় অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রির দিকে এগিয়ে যেতে পারতাম। এই রিকশাগুলো যথেষ্ট পরিবেশবান্ধব। কারণ, এগুলো ব্যাটারিচালিত। নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে এগুলো চালানো সম্ভব। দুর্ঘটনা ঘটার যে প্রবণতা, সেটাও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।’ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শেখ রিয়াজ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনায় কিছু যায়-আসে না। আমরা পরিকল্পনা করলে কী লাভ হবে? আমাদের পরিকল্পনার কোনো দাম আছে? সরকার চাইলে আমরা হেল্প করতে পারি। বিআরটিএ চাইলে আমরা হেল্প করতে পারি। আমাদের সাহায্য না চাইলে আলাদাভাবে পরিকল্পনা দেওয়ার তো কোনো সুযোগ নেই।’ এই আলোচনায় এটা স্পষ্ট, যে সংকটের কথা বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলেন, বুয়েটের দক্ষ প্রকৌশলীরা সেই সংকট দূর করে এটাকে একটা বড় সম্ভাবনা হিসেবে দেখলেন। সংকট নিরসনে সরকার দায়িত্ব দিলে তারা সানন্দে সেই কাজটাও করতে চান।

‘অটো রিকশাগুলো একটা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ, এগুলো স্থানীয়ভাবে তৈরি হচ্ছিল। বাংলাদেশে অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি খুব ভালোভাবে তৈরি হয়নি। এই রিকশাগুলো উৎপাদনের মাধ্যমে আমরা ধীরে ধীরে আরও বড় অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রির দিকে এগিয়ে যেতে পারতাম। এই রিকশাগুলো যথেষ্ট পরিবেশবান্ধব। কারণ, এগুলো ব্যাটারিচালিত। নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে এগুলো চালানো সম্ভব। দুর্ঘটনা ঘটার যে প্রবণতা, সেটাও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।’

বিগত ১০ বছর থেকে আমরা এই আলোচনাগুলো করে এসেছি। ২০১০-১১ সাল থেকে আমরা রিকশার ডিজাইন আধুনিক করে, প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করে ব্যাটারিচালিত সব বাহনের লাইসেন্স প্রদানের কথা বলেছি। গত ১৫ মার্চ ২০২১ ‘রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক চালক সংগ্রাম পরিষদ’-এর ব্যানারে শত শত শ্রমিক ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ করে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিতে গেলে মন্ত্রণালয় থেকে আশ্বস্ত করে বলা হয়েছিল, ব্যাটারিচালিত যানবাহনের লাইসেন্স প্রদানের বিষয়টি সরকারের বিবেচনাধীন এবং দ্রুতই প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করে লাইসেন্স প্রদান করা হবে। এরপর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে সংবাদ এসেছিল, দেশের সব জেলা-উপজেলায় ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক অনেকটা প্রধান যানে পরিণত হয়েছে, ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যানের সংখ্যাও বাড়ছে হুহু করে। তাই এসব মোটরযানের চলাচল নিয়ন্ত্রণসহ নিবন্ধনের আওতায় আনতে ইলেকট্রিক মোটরযান রেজিস্ট্রেশন ও চলাচল সংক্রান্ত নীতিমালা ২০২১-এর খসড়া চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। তবে কোনগুলো ইলেকট্রিক যান হিসেবে বিবেচনা করা হবে, তা নির্ধারণের জন্য বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের প্রতিবেদন পাওয়ার পর নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করে সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হবে। এসব ঘোষণায় সারা দেশের শ্রমিকেরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন, আর ভয়ে ভয়ে নয়, অনুমোদনের পর মর্যাদা নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন।

গত ১৫ মার্চ ২০২১ ‘রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক চালক সংগ্রাম পরিষদ’-এর ব্যানারে শত শত শ্রমিক ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ করে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিতে গেলে মন্ত্রণালয় থেকে আশ্বস্ত করে বলা হয়েছিল, ব্যাটারিচালিত যানবাহনের লাইসেন্স প্রদানের বিষয়টি সরকারের বিবেচনাধীন এবং দ্রুতই প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করে লাইসেন্স প্রদান করা হবে।

এর আগে ২০১৭ সালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে নকশা আধুনিক ও প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করে ব্যাটারিচালিত যানবাহনের লাইসেন্সের দাবিতে সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে শ্রমিক সমাবেশের পর মিডিয়ায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তৎকালীন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীও ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যানের লাইসেন্স প্রদানে সরকারের সদিচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন। তখন এ আলোচনাও এসেছিল যে, ব্যাটারিচালিত বাহনে একজন যাত্রী পরিবহণে যেখানে মাত্র ১৩ পয়সা খরচ হয়, সেখানে অন্য পরিবহণে ন্যূনতম ৫৭ পয়সা খরচ হয়। তাই এই বাহন শুধু পরিবেশবান্ধবই নয়, জ্বালানিসাশ্রয়ীও বটে।

ব্যাটারিচালিত বাহনে একজন যাত্রী পরিবহণে যেখানে মাত্র ১৩ পয়সা খরচ হয়, সেখানে অন্য পরিবহণে ন্যূনতম ৫৭ পয়সা খরচ হয়। তাই এই বাহন শুধু পরিবেশবান্ধবই নয়, জ্বালানিসাশ্রয়ীও বটে।

প্রথমদিকে অনেকেই না বুঝে বিদ্যুৎ অপচয়ের কথা বলতেন। পরে যখন তারা জানল, একটা ব্যাটারিচালিত রিকশা সারা দিন চলার জন্য যে চার্জ দিতে হয়, তার পরিমাণ মাত্র ২ ইউনিটের মতো, যা এক ঘণ্টায় একটা এসি চালানোর জন্য বিদ্যুতের সমান। ঘরের এসিতে এই দুই ইউনিট বিদ্যুতে যেখানে সরকার পায় ১২/১৪ টাকা, সেখানে রিকশা চার্জ দেওয়ার জন্য এই দরিদ্র চালকেরা সরকারকে বাণিজ্যিক রেটে ২ ইউনিটের জন্য ২০-২৪ টাকা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেন। স্পষ্টত বিদ্যুৎ বিক্রিতে দরিদ্র রিকশা শ্রমিকদের কাছ থেকে সরকারের আয় অনেক বেশি। আবার যদি মানবিক দিক থেকেও বিষয়টা দেখি, তাহলে ৫-৬ সদস্যের একটা পরিবার চালানোর জন্য মাত্র ২ ইউনিট বিদ্যুৎ কি তারা পেতে পারেন না! কোনটাকে আমরা অপচয় বলব, ২ ইউনিট বিদ্যুৎ দিয়ে এসির বাতাসে এক ঘণ্টা শরীর জুড়ানো নাকি সেই দুই ইউনিট বিদ্যুৎ দিয়ে ৫-৬ সদস্যের একটা পরিবারের জীবন-জীবিকা নির্বাহ?

কোনটাকে আমরা অপচয় বলব, ২ ইউনিট বিদ্যুৎ দিয়ে এসির বাতাসে এক ঘণ্টা শরীর জুড়ানো নাকি সেই দুই ইউনিট বিদ্যুৎ দিয়ে ৫-৬ সদস্যের একটা পরিবারের জীবন-জীবিকা নির্বাহ?

আবার মহাসড়কে দুর্ঘটনার জন্য এদের দোষারোপ করা হয়। আমরাও কিন্তু মহাসড়কে থ্রি হুইলার চলাচলের বিপক্ষে। আমরা বারবার বলেছি, মহাসড়কের পাশে কমগতির থ্রি হুইলারের জন্য আলাদা পার্শ্বরাস্তা তৈরি করে খুব সহজেই এই সংকট দূর করা সম্ভব। ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহাসড়কে এমন আলাদা পার্শ্বরাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে।

আজকের দিনের যত আধুনিক যানবাহন–সেটা বিমান, লঞ্চ, ট্রেন, বাস যাই হোক না কেন, সব ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য যে, এগুলোর কোনোটিই কিন্তু একদিনে নিরাপদ বাহনে পরিণত হয়নি। প্রতিনিয়ত নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গবেষণার মাধ্যমে আজকের এই আধুনিক বাহনে পরিণত হওয়ার পরও কিন্তু নানা ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। সেই তুলনায় ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যানের প্রযুক্তি অনেক সহজ। নকশা আধুনিক করে, গতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করে, চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে এবং প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করে খুব সহজেই ৫০ লাখ পরিবারকে পথে না বসিয়ে মর্যাদার সঙ্গে জীবিকা অর্জনের ব্যবস্থা করা সম্ভব।

গত দেড় বছরে করোনা মহামারি ও টানা লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত নানা পেশার শ্রমিক এবং কর্মহীন, বেকার ও ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকের পাশে সরকার কতটা দাঁড়িয়েছে? করোনা মহামারিতে নতুন করে আরও ২.৫ কোটি মানুষসহ দেশের প্রায় ৫০ ভাগ মানুষ যখন দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে, সেই সময় একটা ভুল সিদ্ধান্তে আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে কর্মরত ৫০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভ্যান, ইজিবাইক চালক যদি কর্মহীন হয়ে পড়েন, তাহলে সারা দেশে এক ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের সমাজে রিকশা বা ভ্যান চালানো মোটেও কোনো সম্মানজনক, লাভজনক বা আরামের পেশা নয়। মানুষ উপায়হীন হলেই এই পেশা বেছে নেয়।

তাই সরকারের উচিত, অবিলম্বে ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক বন্ধের গণবিরোধী ও প্রযুক্তিবিরোধী সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে, প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন ও নকশা আধুনিকায়ন করে ব্যাটারিচালিত সব যানবাহনের লাইসেন্স প্রদান করা। তাতে দারিদ্র্যের মাঝেও কিছুটা মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করতে পারবে প্রায় ৫০ লাখ পরিবার।

ইমরান হাবিব রুমন: প্রকৌশলী, সদস্যসচিব, রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক চালক সংগ্রাম পরিষদ।

ইমেইল: rumonbam@gmail.com

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •