বাংলাদেশে পুঁজির গতি-প্রকৃতি: পশ্চিমের ধারাবাহিকতায় পূবের যাত্রা

২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-১

বাংলাদেশে পুঁজির গতি-প্রকৃতি: পশ্চিমের ধারাবাহিকতায় পূবের যাত্রা

মেহেদী হাসান

বাংলাদেশে পুঁজিবাদের বিকাশ উল্লেখযোগ্য আকার নিয়েছে। এই বিকাশ ধারায় একদিকে তৈরি হয়েছে পাকিস্তানের ২২ পরিবারের চাইতেও সম্পদশালী বেশ কিছু গোষ্ঠী, অন্যদিকে বৈষম্য ও পরিবেশ বিধ্বংসী তৎপরতাও অভূতপূর্ব মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ‘উন্নয়ন’ ধারার স্বরূপ বিশ্লেষণ, পুঁজি কেন্দ্রীভবনের ধরন, শ্রেণি বিন্যাস,এই ধারার পুঁজিবাদ বিকাশে রাষ্ট্রের ভূমিকা ইত্যাদি পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান প্রবন্ধ কয়েক কিস্তিতে এই অনুসন্ধান বিশ্লেষণ হাজির করবে। প্রথম কিস্তিতে পাকিস্তান পর্বের অভিজ্ঞতা, পুঁজিবাদ বিকাশ ও ২২ পরিবারের উত্থানের রাষ্ট্রিক-আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করা হয়েছে।

ভূমিকা

পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে ঐতিহাসিক কারণেই সে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্ন হওয়ার শর্ত তৈরী হয়েছিল। আঞ্চলিক শোষণ-বৈষম্য, নিপীড়নমূলক আইন -ভাষাগত আধিপত্য ইত্যাদির বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-শ্রেণি-পেশার জনগণের দীর্ঘ ধারাবাহিক লড়াই এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে সশস্ত্র সংগ্রামের পরিণতি বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্র।

রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয়ের পর থেকে বাংলাদেশ অর্ধশত বছর পার করছে। শুরুতে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কথা বলা হলেও পূর্বতন উৎপাদন ব্যবস্থার নানাবিধ শর্ত জিইয়ে রাখা এবং তার ধারাবাহিকতায় পুঁজিতান্ত্রিক ‘মুক্ত-উদার’ বাজার অর্থনীতির প্রক্রিয়ার সাথে বর্তমানের যুক্ততা কাঠামোগত প্রক্রিয়ারই ধারাবাহিকতা বলা যায়। তবে,এ সময়ের মধ্যে উৎপাদন ব্যবস্থার মৌলিক কোন পরিবর্তন সাধিত না হলেও উপরিকাঠামোসহ বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে। মূল ও বিরোধী ধারার সম আদর্শের কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন নামের রাজনৈতিক সংগঠনের উত্থান-সাময়িক পরাজয়-পুনরুত্থান এ সময়ের মধ্যে যেমন দেখা যায়, তেমনি, শ্রেণিভেদে সামাজিক-সাংস্কৃতিক মনস্তত্ত্ব গড়ে ওঠা, পুরাতন ধ্যান-ধারণার ভিন্ন ধরনে আবির্ভাব-সমন্বয়-বিলয় সাধনও দেখা যায়। এ সবই প্রান্তস্থ পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবেই বিকশিত হয়েছে।

এ সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র-সংস্থার সাথে পূর্বের তুলনায় অনেক বেশী গাটছড়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে অর্থনীতি দেশীয় বাজার ছাড়িয়ে বৃহৎ আকারে আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সম্পর্কিত হয়েছে; অর্থনৈতিক উৎপাদনকে অনেক বেশী আন্তর্জাতিকীকরণ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবত জনগণের অবস্থানের গুণগত পরিবর্তন হয়েছে সামান্যই।

যে কোন অর্থনীতিতে বিশেষ করে পুঁজিবাদের স্বাভাবিক নিয়মে প্রবৃদ্ধি একটি সাধারণ প্রপঞ্চ কিন্তু এই প্রবৃদ্ধি মানেই কি সাধারণ মানুষের সার্বিক উন্নয়ন? যেভাবে সাধারণের মনস্তত্বে ঠাঁই নিয়েছে যে, ‘প্রবদ্ধি মানেই উন্নয়ন’,আসলে কি তাই? পুঁজিবাদী বাজার সম্প্রসারণের চাহিদা থেকে অবকাঠামোগত নির্মাণ, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসজনিত উৎপাদন বৃদ্ধি, চোরাই কোটিপতিদের আধিপত্যের ‘উন্নয়ন’ আর জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা-চাহিদা-প্রয়োজনীয়তা সাপেক্ষে উন্নয়ন কি একই অর্থ বহন করে?     

মানুষের সমাজবদ্ধ হয়ে চলার পর থেকে যত ধরনের উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সময় পার করেছে তার মধ্যে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা অনেক বেশী গতিশীল, অস্থির। এই গতিশীলতার মধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিভিন্ন সময়ে পুরাতনের ভেতরেই নতুন উৎপাদন ব্যবস্থার তাগিদে নতুন ধরনের রাষ্ট্র-সমাজ বিনির্মাণের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সংগ্রাম চলেছে এবং অব্যাহত আছে। উত্থান-পরাজয় আবার নতুনভাবে উত্থানের চেষ্টা চলছে। শাসকশ্রেণির পক্ষ থেকে পুরাতন কাঠামোর অবশেষ যেমন টিকিয়ে রাখার জোর চেষ্টা আছে অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে সংগ্রামও জারী রয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে অর্থনীতিতে একদিকে জিডিপি বেড়েছে, অন্যদিকে কমেছে জীবন-মানের নিশ্চয়তা; কৃষি-শিল্প-কারখানার উৎপাদন বেড়েছে, কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে (বিশেষ করে চোরাই কোটিপতি) কমেছে শ্রমিক-কৃষকের ‘মানুষে’র মতো বেঁচে থাকার নূন্যতম নিশ্চয়তা (করোনার সময়কালে বিষয়গুলো আরও বেশী করে স্পষ্ট হয়েছে। যেমন, করোনার শুরুতে খাদ্যশস্যের মজুদ ছিল ১৭ লাখ ৩৯ হাজার ৪৯৫ মেট্রিক টন। যা দিয়ে সারা দেশের প্রতিটি নাগরিককে কয়েক মাস খাওয়ানো যেতো।); বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাণিজ্য বেড়েছে, অন্যদিকে বেড়েছে জনগণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তাহীনতা; শিক্ষা ক্ষেত্রে মুনাফাকেন্দ্রিক তৎপরতা বেড়েছে, গুণগত এবং পরিমাণগত উভয় দিকেই বিজ্ঞানমনস্ক-গণতান্ত্রিক শিক্ষা পাওয়ার অধিকার কমেছে। একটি গ্রাফ যদি কল্পনা করা হয় তাহলে চিত্রটি মোটামুটি এরকম হবে; একদিকে বাজারকেন্দ্রিক ‘উদার’ অর্থনীতির উর্দ্ধমুখী রেখা অন্যদিকে সর্বজনের গণতান্ত্রিক অধিকারের নিম্নমুখী রেখা; দু’টোই আপন গতিতে পরষ্পরবিরোধী অবস্থানের দিকে ছুটছে।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাণিজ্য বেড়েছে, অন্যদিকে বেড়েছে জনগণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তাহীনতা; শিক্ষা ক্ষেত্রে মুনাফাকেন্দ্রিক তৎপরতা বেড়েছে, গুণগত এবং পরিমাণগত উভয় দিকেই বিজ্ঞানমনস্ক-গণতান্ত্রিক শিক্ষা পাওয়ার অধিকার কমেছে। একটি গ্রাফ যদি কল্পনা করা হয় তাহলে চিত্রটি মোটামুটি এরকম হবে; একদিকে বাজারকেন্দ্রিক ‘উদার’ অর্থনীতির উর্দ্ধমুখী রেখা অন্যদিকে সর্বজনের গণতান্ত্রিক অধিকারের নিম্নমুখী রেখা; দু’টোই আপন গতিতে পরষ্পরবিরোধী অবস্থানের দিকে ছুটছে।

শহরাঞ্চল বসবাসের অযোগ্য কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার খবর প্রায়শই বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০২১ সালের বাসযোগ্য শহরের তালিকায় ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৩৭তম। অর্থাৎ, বাসযোগ্য শহরের তালিকার শেষের থেকে ঢাকা চতুর্থ।বাংলাদেশ এবং বিশ্বব্যাপী পুঁজিতান্ত্রিক, ‘উদার’, ‘মুক্ত’, ‘বাজার’ অর্থনীতির বিকাশের এ সময়ের মধ্যে একদিকে দেখা যায়, সম্পদের প্রাচুর্য্য-কেন্দ্রীভবন-পুঞ্জিভবন আবার অপরদিকে চরম দারিদ্র্য। বিবিসি’র ২০১৬ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, সারা বিশ্বব্যাপী শতকরা ৯৯ শতাংশ মানুষের কাছে যে পরিমাণ সম্পদ আছে তার চাইতে বেশী সম্পদ আছে শতকরা মাত্র ১ শতাংশ পুঁজিপতির হাতে। তাদের মধ্যে সবচাইতে ধনী ৬২ জনের কাছে পৃথিবীর অর্ধেক দরিদ্র্য মানুষের সম্পদের চাইতে বেশী সম্পদ।

জনগণের সম্পদ নানা কৌশলে ব্যক্তি পুঁজির মালিকদের হাতে তুলে দিতে সরকার যতটা বদ্ধ পরিকর ততটাই উদাসীন জনগণের সম্পদের উপর জনগণের মালিকানা-নিয়ন্ত্রণ-কর্তৃত্ব বজায় রাখতে। আনু মুহাম্মদ ২০২১-’২২ সালের বাজেটের প্রতিক্রিয়ায় অর্থনীতির প্রধান সমস্যা প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, বর্তমান বাংলাদেশে চলছে ‘‘চোরাই টাকার মালিকদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব। খেয়াল করলে দেখা যাবে, পাবলিক বা সর্বজনের সবকিছুর অবস্থাই খারাপ। সর্বজন পরিবহন, সর্বজন শিক্ষা, সর্বজন স্বাস্থ্যসেবা, সর্বজন নিরাপত্তা, সর্বজনের অধিকার, সর্বজনের প্রাণ-প্রকৃতি — এগুলো খারাপ বলেই বা এগুলো খারাপ করেই বাংলাদেশে চোরাই টাকার মালিকদের রমরমা অবস্থা, ধনী বৃদ্ধির হার বিশ্বে সর্বোচ্চ, বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি, বন-নদী বিনাশেও প্রথম সারিতে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিপন্ন দশা। আর এসবই ঘটছে সেই পাবলিকেরই শ্রম, টাকা দিয়ে এবং তাদের প্রতারণা করে।..প্রশাসনিক খাতে, বিলাসিতা-কেনাকাটা-বিদেশ সফরে বরাদ্দ খরচে কোন কমতি হয় না, যেসব প্রকল্পের সঙ্গে  ক্ষমতাবান সুবিধাভোগী গোষ্ঠী যুক্ত, সেগুলোর বাস্তবায়ন দ্রুত, আবার যেগুলো জনস্বার্থে দরকার কিন্তু পেছনে চাপ নেই, সেগুলো পড়ে থাকে অবহেলায়।’    

২০১০ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, সরকারি হিসেবে ৩২ শতাংশ এবং বেসরকারি হিসেবে বাংলাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার শতকরা ৮৩ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে সরকারের নানা ধরনের পরিকল্পনা বা ঘোষণা সত্ত্বেও এই হারের খুব একটা রকমফের হয়নি। পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থার ‘অদৃশ্য হস্ত’ বৈষম্যমূলক এই ব্যবস্থার মধ্যকার সম্পদ বৈষম্য কমাতে পারেনি বরং আরও বাড়িয়ে তুলছে।

২০১০ সালে মোট জনসংখ্যা ছিল ১৫ কোটি। তার মধ্যে ৫ কোটি ৭৫ লাখ চরম দরিদ্র; ৯ কোটি ৮৯ লাখ নিরঙ্কুশ দরিদ্র; ২ কোটি ৫৪ লাখ নিম্ন মধ্যবিত্ত; ৪ কোটি ৭০ লাখ মধ্যবিত্ত; ১ কোটি ৪৬ লাখ মধ্য মধ্যবিত্ত; ৭০ লাখ উচ্চ মধ্যবিত্ত; ৪১ লাখ ধনী। এই ধনীদের মধ্যে চরম ধনী প্রায় ৪ লাখ। মোট জনসংখ্যার তুলনায় শতকরা প্রায় ০.২৭ শতাংশ। অথচ গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা প্রসঙ্গে জনগণের খাতে ব্যয়ের প্রসঙ্গ আসলেই আমরা প্রায়শই শুনি যে, বাংলাদেশ গরীব দেশ, সম্পদের অভাব রয়েছে বাংলাদেশে!

একদিকে চরম দারিদ্রের বৃহৎ উপস্থিতি অন্যদিকে অল্পকিছু পুঁজিপতির হাতে সম্পদ-আয়ের ক্রমোবৃদ্ধি তাহলে কীভাবে হলো? এই শ্রেণিবৈষম্য কী হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কোন ঘটনা না দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়াগত বিষয়? এই প্রক্রিয়ার সাথে রাষ্ট্র-সরকারের সম্পর্ক কোথায়? পুঁজিপতিদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র-সরকারের সম্পর্ক এবং পারস্পরিক ভূমিকা কী ধরনের? ঐতিহাসিক কারণগুলো কী? পুঁজিপতি শ্রেণির নিজস্ব ভূমিকাই বা কী? পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশ আমলে, জনগণের  সাথে বৃহৎ পুঁজিপতিদের কী ধরনের দ্বন্দ্ব দেখা গেছে? তার পরিণতি কী? বর্তমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো কি পূর্বতন রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ধারাবাহিকতার ফসল নাকি এর কোন স্বাধীন অস্তিত্ব রয়েছে? নীতি-পরিকল্পনা-কাঠামো-আইন-কানুন কী জনগণের স্বার্থসাপেক্ষে তৈরী হয় নাকি ক্ষমতাকাঠামোর অংশীদারদের স্বার্থসাপেক্ষে?   

একদিকে চরম দারিদ্রের বৃহৎ উপস্থিতি অন্যদিকে অল্পকিছু পুঁজিপতির হাতে সম্পদ-আয়ের ক্রমোবৃদ্ধি তাহলে কীভাবে হলো? এই শ্রেণিবৈষম্য কী হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কোন ঘটনা না দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়াগত বিষয়? এই প্রক্রিয়ার সাথে রাষ্ট্র-সরকারের সম্পর্ক কোথায়? পুঁজিপতিদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র-সরকারের সম্পর্ক এবং পারস্পরিক ভূমিকা কী ধরনের? ঐতিহাসিক কারণগুলো কী? পুঁজিপতি শ্রেণির নিজস্ব ভূমিকাই বা কী? পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশ আমলে, জনগণের  সাথে বৃহৎ পুঁজিপতিদের কী ধরনের দ্বন্দ্ব দেখা গেছে? তার পরিণতি কী? বর্তমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো কি পূর্বতন রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ধারাবাহিকতার ফসল নাকি এর কোন স্বাধীন অস্তিত্ব রয়েছে? নীতি-পরিকল্পনা-কাঠামো-আইন-কানুন কী জনগণের স্বার্থসাপেক্ষে তৈরী হয় নাকি ক্ষমতাকাঠামোর অংশীদারদের স্বার্থসাপেক্ষে?   

এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বর্তমানের সাথে সাথে অতীতের ধারাবাহিক প্রক্রিয়াগুলো দেখা দরকার। আমূল পরিবর্তন কিংবা সংস্কার অতীতকে প্রশ্ন করে কিংবা অতীত সাপেক্ষেই হয়ে থাকে। দীর্ঘ মরণপণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম সে রাষ্ট্রে জনগণের জীবন-মান-মর্যাদা প্রথম স্থানে থাকবে এটিই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তার পরিবর্তে অস্বাভাবিক গতিতে গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোর হরণ কেবল সমসাময়িক ঘটনা নয়, এর নেপথ্যে দীর্ঘ নীতি-পরিকল্পনা-কাঠামোগত প্রক্রিয়ার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। একদিকে জনগণের দুর্দশা অন্যদিকে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র ও পুঁজির পারষ্পারিক ‘হয়ে ওঠা’ ঐতিহাসিক কাঠামোর মধ্যে তাই অনুসন্ধান করা জরুরী। এ প্রবন্ধে মূলত: পরষ্পরসম্পর্কিত বিভিন্ন দিকগুলোর মধ্যে পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে পুঁজিপতিদের ‘হয়ে ওঠা’, রাজনৈতিক দল-সরকার-রাষ্ট্রের সাথে তাদের সম্পর্ক, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পুঁজিপতিদের বিকাশ, ’৭১পূর্ব পাকিস্তানের সাথে বর্তমান বাংলাদেশের পুঁজির ধরনের মধ্যে তুলনামূলক পার্থক্য, সরকারের নীতি-পরিকল্পনা গ্রহণে পুঁজিপতি, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের প্রভাব এবং জনসমাজে তার প্রতিক্রিয়ার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা এবং তার বর্তমান ফলাফল ইত্যাদি দিকগুলো অনুসন্ধান করে দেখা হবে।

 পাকিস্তান পর্বে পুঁজিপতিদের বিকাশ

১৯৪৭-এর পর রাজনৈতিকভাবে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান গঠন করা হলেও এর মধ্যে পুরাতন রাষ্ট্রের সাথে মৌলিক কোন তফাৎ ছিলনা এটা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। কারণ, যে শোষণ-শাসনের ধারা বৃটিশ শাসকরা প্রবর্তন করেছিল এবং যে ধারার সাথে বিরোধের কারণে দুই রাষ্ট্রের জন্ম অথচ সেই বৃটিশ প্রবর্তিত প্রায় একই ধরনের বিচার ধারা, আইন-কানুন, নীতি-পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা অনুসরণ করা হয়েছিল নতুন রাষ্ট্রে। একদিকে ঐতিহাসিক শ্রেণি সম্পর্কের কারণে উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে কোন গুণগত পরিবর্তন না হওয়া অন্যদিকে বৃটিশ ঔপনিবেশিক মানসিকতা — এই দু’য়ের ধারে এবং ভারে সাধারণ মানুষের জীবন-মান পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছিল। ‘পাকিস্তান রাষ্ট্রের সূচনালগ্নে পাঞ্জাবি এবং ভারতের উত্তরাংশ থেকে আসা মুসলিম সামন্তীয় জমিদার, ব্যবসায়ী ও প্রশাসনিক আমলারা বিভিন্ন জাতীয়তার (বাঙালী, পাখতুন, সিন্ধি, বালুচ) সাংস্কৃতিক এবং জাতীয় অধিকারকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করার জন্য নীতি-পদ্ধতি অনুসরণ করে’। শাসন-শোষণের ক্ষেত্রে পূর্বতন বৃটিশ শাসক শ্রেণির সাথে নীতিগত ঐক্যের অবস্থানটি প্রধান হয়ে দেখা দেয়। এই মৌলিক ঐক্যের কারণে উৎপাদন পদ্ধতি কিংবা উৎপাদন সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোন `গুণগত পরিবর্তন’ ঘটানো সম্ভব ছিলনা — ঐতিহাসিক কারণেই।

ইউরোপে যখন পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে তখন অভ্যন্তরীণ শর্ত হিসেবে উদ্বৃত্ত শ্রম শোষণ প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা বজায় ছিল যেটি ক্ষুদ্র উৎপাদন থেকে বৃহদায়তন শিল্পে রূপ নেয়। পরসম্পদ গ্রাস, পররাজ্য লুণ্ঠন, ডাকাতি থেকে শুরু করে উপনিবেশ স্থাপন ইত্যাদি বাহ্যিক শর্তগুলো অভ্যন্তরীণ শর্তকে পুষ্ট করে। পুঁজির বিকাশের সহায়ক হয়। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে উপনিবেশ স্থাপনের মধ্য দিয়ে সামন্তীয় উৎপাদনের উদ্বৃত্ত আদায় পরবর্তীতে শিল্পায়নের কাজে ব্যবহৃত হয়। বিশ্বের এক এক অঞ্চলে একেকভাবে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে। ভারতে যখন পুঁজিবাদী উৎপাদন বিকশিত হয় তখন বৃটিশ পুঁজির সহায়ক হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, একদিকে যেমন ইউরোপের বুর্জোয়া শ্রেণি সামন্ত শক্তির সাথে লড়াই-সংগ্রাম করে নিজেদের স্বাধীনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, অপরদিকে, সেই স্বাধীন শক্তিই আবার তার উপনিবেশগুলোকে রাখে পরাধীন; তার পুঁজির বিকাশের স্বার্থে। বিপরীতদিকে, ভারতে কিংবা পরবর্তীতে পাকিস্তানে সে ধরনের দ্বন্দ্বের প্রগতিশীল সমাধান হতে দেখা যায়নি। বৃটিশ শাসকরা সে সুযোগ নিতে কার্পণ্যও করেনি। উপনিবেশের জোয়াল মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছে এ অঞ্চলের মধ্যেই সুবিধাভোগী গোষ্ঠী তৈরী করে।

পরাধীন রাখার মানসিকতা এবং আনুগত্য তৈরীর ব্যবস্থা কী ধরনের হতে পারে তার একটি দৃষ্টিভঙ্গী থমাস ব্যাবিংটন ম্যাকলের বয়ান থেকে পাওয়া যায়। ১৮৩৫ সালে শিক্ষা দর্শন বাস্তবায়নের উপায় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘লক্ষ কোটি মানুষকে শাসন করার জন্য আমাদের একটি শ্রেণি গঠন করা অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে। যারা আমাদের (বৃটিশ শাসক) এবং জনগণের মাঝখানে অবস্থান করবে। এমন একটা শ্রেণি যারা রক্ত-মাংস-বর্ণে হবে ভারতীয় কিন্তু নৈতিকতা-রুচিবোধ-ভাষা এবং জ্ঞান-গরিমায় হবে আমাদের (বৃটিশ ঔপনিবেশিক) ধাঁচের।’১০  

বৃটিশ শাসকদের দ্বারা সেই মধ্যবর্তী শ্রেণিটির গঠন হয় যাদের একটা অংশকে আমরা আমলা বলে জানি। ১৮৫৪ সালে ম্যাকলে কমিটির সুপারিশে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস)-এর গোড়াপত্তন হয়। এই কমিটি একদিকে যেমন বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতাভিত্তিক ব্যবস্থার পরিবর্তে মেধা ছেঁকে নেওয়ার জন্য প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষা ব্যবস্থার জন্য সুপারিশ করে অন্যদিকে উত্তীর্ণ মেধাবীদের গুণ (পশ্চিমা ধাঁচের) বৃদ্ধি করার জন্য অক্সফোর্ড এবং ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটদের নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করে।১১ ১৮৫৫ সালে এই সুপারিশ গৃহীত হয় এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা প্রণীত হয়। অতঃপর, পশ্চিমা মনস্তত্ব-রুচিবোধ-দর্শনসাপেক্ষ ‘অভিজাত’ প্রশাসনিক আমলাদের গঠন করার নিমিত্তে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৯২২ সালে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস)-এ উচ্চ পর্যায়ে অক্সফোর্ড এবং ক্যামব্রিজ অফিসারদের রেখে স্থানীয় ভারতীয়দের মেধার ভিত্তিতে তাদের অধীনস্ত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে।১২ সেই বৃটিশ প্রশাসনিক অভিজাত (এলিট) উত্তরাধিকারী প্রথা ভারত (ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস) পাকিস্তান (পাকিস্তান এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস-পিএএস; সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান-সিএসপি) হয়ে বর্তমানে বাংলাদেশেও (বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস-বিসিএস) বর্তমান।    

ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার প্রথার প্রাতিষ্ঠানিক-কৌশলগত-অর্থনৈতিক-আদর্শিক ধারাবাহিকতা নতুন রাষ্ট্রটির গঠনে এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।১৩ রাষ্ট্রীয়ভাবে উপনিবেশমুক্ত হওয়ার পর ভারত-পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র গঠন হলেও বৃটিশ আইন-কানুন-পরিকল্পনা ইত্যাদি যেমন উপনিবেশোত্তর পাকিস্তান রাষ্ট্রে দেখা যায়, তেমনি পরবর্তীতে সেখান থেকে ভাগ হওয়ার পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মধ্যেও তার অস্তিত্ব ধারাবাহিকভাবে রেখে দেওয়া হয়েছে।

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কর্তৃক ভারতবর্ষ বিভাজনের পর পাকিস্তানের অর্থনীতি এবং প্রশাসন চালানোর উপযুক্ত জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী উপাদানের অভাব ছিল। পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী দলটির মধ্যে প্রধানত: ছিল সামন্ত অভিজাত শ্রেণি, ব্যবসায়ী (যাদের আদি শেকড় ভারত ছাড়াও এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যে প্রোথিত ছিল), বৃটিশ প্রশাসন প্রশিক্ষিত সিভিল সার্ভিসের আমলা ধরনের লোকজন —  মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের আধিপত্য ছিল প্রধান। এটা উল্লেখযোগ্য যে, নতুন রাষ্ট্রে আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো (বিশেষ করে জেলা কমিশনার, জেলা মেজিস্ট্রেট, সচিবালয় ইত্যাদি)ছিল মূলত: সামন্ততান্ত্রিক ধারার বিচ্ছিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং আঞ্চলিক ইতিহাস, মূল্যবোধ, জনগণের সংস্কৃতির বিরোধী।

ভারত বিভাজনের পর ১১৫৭ জন আইসিএস অফিসারের মধ্যে ১৫৭ জন অফিসার (৯৫ জন তার মধ্যে মুসলিম) পাকিস্তান প্রশাসনে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।১৪ বৃটিশ ভারতীয় সিভিল প্রশাসনের ৯৪ জন আমলাকে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য বিচারিক এবং আইনসভাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব দেয়া হয়।১৫ এছাড়া, প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য ৫০ জন বৃটিশ ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস)-ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল সার্ভিস (আইপিএস) অফিসারের সাথে সরকারিভাবে চুক্তি সম্পাদিত হয়।১৬ যার ফলে, ব্যাংকিং, পোস্ট এবং টেলিগ্রাফ, ট্রেড এবং বাণিজ্য, রেলওয়ে-এর যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে নতুন নামে পূর্বতন আদলে। ডন পত্রিকা সিভিল-মিলিটারী প্রশাসনের ধরন উল্লেখ করে সে সময় একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করে — ‘বেসামরিক আমলাদের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল। নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সে অভিজ্ঞতা তারা কাজে লাগায় এবং যে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তারা কাজকর্ম পরিচালনা করে তার সাথে ঔপনিবেশিক মডেলের কোন তফাৎ ছিল না।’১৭  

অনভিজ্ঞ পুঁজিতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য একটি আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থেকে যে সমস্ত অভিজ্ঞ বৃটিশ প্রশিক্ষিত আমলাদের নিয়োজিত করা হয় তাদের সম্পর্কে পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশে স্বাভাবিক কারণেই কিছুদিনের মধ্যেই প্রশ্ন উঠতে থাকে। কারণ,যে রাজনৈতিক দল সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিল তাদের মধ্যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সমগ্র জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব ছিল না। সে কারণে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকেও একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করতে হয়েছিল। এবিষয়ে গবেষকরা বলছেন,

‘সাধারণভাবে বললে, নতুন রাষ্ট্রটি শ্রেফ লন্ডন এবং কলকাতার পরিবর্তে করাচি এবং ইসলামাবাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের প্রতিস্থাপন। বৃটিশ ঔপনিবেশিকরা বাঙালীদের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক জীবনের উপর যে আধিপত্য করতো; ঠিক একইভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা, বিশেষ করে পাঞ্জাবী শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত মৌলিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক জীবনের উপর বৃটিশ ঔপনিবেশিক ধরনের আধিপত্য কায়েম করছে; এই বিষয়গুলো তারা (পূর্বাংশের জনগণ) বুঝে গিয়েছিল।… মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাঞ্জাব এবং উত্তর ভারত থেকে আসা বেশীরভাগ সিভিল আমলা এবং সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিয়েছিলেন তার চারপাশে। মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ এবং আইনসভার সদস্যদের এড়িয়ে তার একক হাতে যাতে সব ক্ষমতা থাকে এজন্য তিনি একনায়কতান্ত্রিক রীতি-নীতির প্রবর্তন করতে সামরিক-বেসামরিক এই আমলাদের উৎসাহিত করেছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক জীবনে বেসামরিক আমলাতন্ত্র এবং বারবার সামরিক উত্থান হতে দেখা গেছে। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, পাকিস্তানের ২৪ বছরের জীবনে, হয় বেসামরিক আমলারা রাজনীতিবিদ বনে গিয়েছিল অথবা আর্মির কর্মকর্তারা ২০ বছর ধরে রাষ্ট্রের প্রধান হয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে ছিল।’১৮

পশ্চিম পাকিস্তানের অভিজাত পুঁজিপতি শ্রেণির প্রতি পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গী, আঞ্চলিক বৈষম্যমূলক আচরণ, শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থ পরিপন্থী দৃষ্টিভঙ্গী ইত্যাদির প্রতিফলন সরকারের নীতি-পরিকল্পনা-আইন-কানুনের মধ্যেই দেখা গিয়েছিল। আমলারা উল্লেখিত দৃষ্টিভঙ্গীজনিত আইন-কানুনী স্বার্থ বাস্তবায়নের পাশাপাশি সরকারি দলের সমন্বয়ে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র-সংস্থার স্বার্থ বিবেচনায় রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে। অন্যদিকে, আমলারা উচ্চস্তর থেকে নিম্নস্তর পর্যন্ত পশ্চিম কেন্দ্রিক ক্ষমতাসীন পুঁজিপতি ও রাজনীতিবিদদের স্বার্থ পরিপুষ্ট করা এবং ‘লাল ফিতা’র দৌরাত্ম্য বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজস্ব এবং আত্মীয়-স্বজনের রাষ্ট্রীয় সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করায় পারদর্শী হয়ে উঠেছিল।১৯ রাজনৈতিক দল এবং আমলাদের পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্টতার ভিত্তিতে একটি কর্তৃত্ববাদী প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এবং এই প্রক্রিয়ায় পাকিস্তান রাষ্ট্র তার জনগণের উপর চেপে বসেছিল।

সদ্যপ্রাপ্ত রাষ্ট্র-ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর শাসকশ্রেণির প্রধান কাজ ছিল ঔপনিবেশিক ধাঁচে নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী রাষ্ট্র যন্ত্রকে ঢেলে সাজানো। এর প্রস্তুতি চলছিল বহু আগে থেকেই। প্রস্তুতি, সংগঠন, রাজনৈতিক ক্রিয়া-কলাপের প্রক্রিয়ায় নিজেদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা আসার পর নিজেদের স্বার্থে তার ব্যবহার আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র এবং পুঁজিতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির সাথে সম্পর্কিত থাকার আকাঙ্ক্ষা রাষ্ট্রযন্ত্র এবং অর্থনীতিকে যে পথে নিয়ে যায় তাকে ঠিক স্বাধীন পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের সাথে সম্পর্কিত করা যায় না।

একদিকে সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভরশীল পুঁজির বিকাশ অন্যদিকে প্রাক পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক বজায় রাখা; এই দুইয়ের ঘূর্ণাবর্তে পড়ে ঘুরপাক খেতে থাকে নতুন রাষ্ট্রটি। একদিকে ভিত্তিমূলক শিল্প বিকাশের পরিবর্তে মাঝারি মানের শিল্প, বাজারকেন্দ্রিক কৃষি ব্যবস্থার বিকাশ ঘটানোর উদ্যোগ দেখা যায় অপরদিকে পুঁজিবাদী অর্থনীতি-রাজনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনস্তত্বের পরিবর্তে প্রাক পুঁজিবাদী যুগের সাংস্কৃতিক, মনস্তত্বের চর্চা জারী রাখার এক ধরনের প্রবণতাও দেখা যায়।    

তৎকালীন পাকিস্তানের এই নির্ভরশীলতার অর্থনীতি (সামরিক-বেসামরিক) এবং অনুন্নয়নের নেপথ্যে বাহ্যিক শর্ত ছিল প্রধান। আলাদা রাষ্ট্র হওয়ার অল্প কিছুকাল পরে ১৯৫০ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু ‘বিশেষজ্ঞ’ দেশটির পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তৈরী করে এবং পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয় যাতে তারা পরিকল্পিত ছকে ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। এই বিশেষজ্ঞরা পশ্চিমের ধাঁচে কিন্তু নির্ভরশীল পুঁজির বিকাশ ঘটানোর পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের কাজে নিয়োজিত ছিল।২০ একই ধরনের প্রক্রিয়া আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখতে পাই। উদাহরণস্বরূপ চিলির কথা বলা যায়। ১৯৭০-’৮০ দশকে মার্কিন অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান এবং আর্নল্ড হার্বার্জার-এর নেতৃত্বে ‘শিকাগো বয়েজ’ খ্যাত অর্থনীতিবিদরা চিলিসহ দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে সামরিক জান্তার সাথে মিলেমিশে পুঁজিবাদী ‘মুক্ত’ বাজার অর্থনীতি বিকাশের অনুকূলে ব্যাপকভাবে বেসরকারিকরণ-বিরাষ্ট্রীয়করণ, নীতি-পরিকল্পনা গ্রহণ করে।২১

আলাদা রাষ্ট্র হওয়ার অল্প কিছুকাল পরে ১৯৫০ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু ‘বিশেষজ্ঞ’ দেশটির পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তৈরী করে এবং পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয় যাতে তারা পরিকল্পিত ছকে ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।

বলাই বাহুল্য, ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র এবং অর্থনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মডেলে এ অঞ্চলের পুঁজিবাদী বিকাশ ঘটানোর আকাঙ্ক্ষা নতুন শাসকশ্রেণির দিক থেকে যেমন ছিল তেমনি ছিল সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের পক্ষ  থেকেও। অবশ্যই পেট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্কের ভিত্তিতে। স্বাধীনতার সংজ্ঞার পরিধি এখানে ততটুকুই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল যতটুকু আন্তর্জাতিক পুঁজির সাথে খাপ খায়। সাধারণভাবে ‘প্রান্তস্থ-নির্ভরশীল-অনুন্নত’২২ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এর কোন ভিন্নতা তখনও ছিলনা এখনও পাওয়া যাবে না।

বৃটিশ রাজশক্তি এ অঞ্চল থেকে শারীরিকভাবে বিদায় নিলেও তাদের নানাবিধ সম্পর্ক এ অঞ্চলে বরাবরই টিকে ছিল। সাম্রাজ্যবাদের কেন্দ্রীয় শক্তির পরিবর্তন ঘটেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার আধিপত্য নিশ্চিত করার তাগিদে এ অঞ্চলের শাসকশ্রেণির সাথে মিলে আন্তর্জাতিক পুঁজির বিকাশ ঘটিয়েছে পশ্চিমাংশে। অন্যদিকে, পূর্বাংশ ছিল এই ভিত্তির যোগানদার। তাই এটা ঠিক যে,

‘..নতুন রাষ্ট্রটির মধ্যে পূর্ব বাংলা শুধুমাত্র কনিষ্ঠতম অংশীদারই ছিল না; বরং, এটা ছিল পশ্চিমাংশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপনিবেশ; এটা ছিল নয়া ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার অংশ, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহুমাত্রিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং বিস্তৃত সামরিকায়নের নয়া ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার অংশ।…বৃহৎ ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষিত এবং নিয়ন্ত্রিত হতো, হয় পশ্চিম পাকিস্তানী অথবা ভারতের মধ্য ও উত্তরাংশ থেকে অভিবাসিত ধনাঢ্য মুসলিমদের দ্বারা।’২৩  

আধিপত্য বজার রাখার একটি বড় কৌশল ছিল আন্তর্জাতিক ঋণ। আইয়ুব সরকারের আমলে পাকিস্তানের অর্থনীতিতে মার্কিনী পুঁজির আধিপত্য এবং উত্তরোত্তর ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি তখনকার আন্তর্জাতিক ঋণের হিসাব থেকেই পাওয়া যায়। হাজী মোহাম্মদ দানেশ তখন হিসাব করে দেখিয়েছিলেন যে, আইয়ুব সরকারের আমলে মার্কিনী ঋণের পরিমাণ ছিল ১০০০ কোটি রুপিরও বেশী। এর সুদ বাবদ প্রায় ৫০ কোটি রুপি খরচ করতে হতো সরকারকে। এছাড়া বৃটিশ এবং অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিও ঐ অঞ্চলে নিয়োজিত ছিল।২৪   

এ ধরনের অবস্থায় এবং অবস্থানে একটি রাষ্ট্র যে স্বাধীনভাবে বিকশিত হতে পারবে না তা বলাই বাহুল্য। ইউরোপে বণিক শ্রেণি তাদের নিজেদের শ্রেণিস্বার্থে যেমন স্বাধীনভাবে পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতির বিকাশ ঘটাতে পেরেছিল, ভারী-মাঝারি শিল্প গঠন এবং সে অনুযায়ী জাতিগত-রাষ্ট্রীয় কাঠামো, জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পেরেছিল তেমনটি এ অঞ্চলে হয়নি। হওয়ার মতো শর্তও ছিল না। কেননা, ইউরোপের শিল্প বিকাশের অন্যতম শর্ত ছিল তাদের এশিয়া, আফ্রিকার উপনিবেশ থেকে উৎপাদনের কাঁচামাল, শ্রমশক্তি ইত্যাদির যোগান নিশ্চিত করা। তাই ভূমির সাথে সম্পর্কিত উৎপাদন সম্পর্কের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে কৃষি উদ্বৃত্ত শিল্পে বিনিয়োগ সম্ভবপর হয়েছিল পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের স্বার্থেই।

অন্যদিকে, গোড়া থেকেই পাকিস্তানের অর্থনীতি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র-পুঁজির নির্ধারিত মডেল অনুযায়ী বিকশিত হয়। পাকিস্তানের যে বৃহৎ পুঁজিপতিদের কথা আমরা শুনি তাদের বেড়ে ওঠাও এই শর্তের অধীনস্ত ছিল। আন্তর্জাতিক বাজার অর্থনীতির মডেলে অর্থনীতির সম্প্রসারণ ঘটে। এই নির্ভরশীলতার কারণে সদ্য আলাদা হওয়া রাষ্ট্রটির নীতি-পরিকল্পনার মধ্যে জনগণের স্বার্থ সম্পর্কিত অর্থনীতির স্বাধীন বিকাশের কোন প্রতিফলন দেখা যায়নি।  

নির্ভরশীলতা বলতে এখানে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র/সরকার-পুঁজিপতির পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক এবং অপরদিকে, অভ্যন্তরীণ উপাদানের সাথে বাহ্যিক উপাদানের পারস্পরিক নির্ভরতার ক্ষেত্রে বাহ্যিক শর্তকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের ফলে ব্যক্তিমালিকানাধীন পুঁজি যেমন পরিপুষ্ট হয়েছে অপরদিকে, ব্যক্তি পুঁজি নতুন রাষ্ট্রটির বিকাশে সহযোগিতা করেছে। রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার মধ্যে ছিল আন্তর্জাতিক পুঁজির গঠন অনুযায়ী স্থানীয় শিল্পের বিকাশ; পশ্চিম অংশের বৃহৎ পুঁজিপতিরা সে অনুযায়ী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।  স্থানীয় চাহিদা বিবেচনায় ক্ষুদ্র পরিসরে যে কয়টি উদ্যোগ ছিল, সামগ্রিক বৃহৎ পুঁজির তুলনায় সেসব ছিল নিতান্তই গৌণ। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার আবরণের বাইরে; বিশেষ করে পূর্বাংশে। যদিও তারা পরবর্তীতে বৃহৎ পুঁজিপতি হিসেবে পুঁজির তালিকায় অবস্থান নেয় এবং নানাবিধ পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। 

যে রাজনৈতিক শক্তি (মুসলিম লীগ) নতুন রাষ্ট্র গঠনে উদ্যোগী হয়েছিল তারা ব্যবসায়ী পুঁজিবাদী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে যারা পাকিস্তান গঠনের আন্দোলনে মূল সহযোগী হিসেবে ছিল তাদেরকেই (মেমন, আগা খানি ইসমাইলি, চিনিওতি, খোজা, বোহরা, পাঞ্জাবি-দিল্লী সওদাগর, পার্শি প্রভৃতি সম্প্রদায়ের নির্দিষ্ট ব্যবসায়ী)২৫ প্রাধান্য দেয়। জনগণের শক্তি-সামর্থ্য-ভাবনা উপেক্ষিত থাকার কারণে ‘উন্নয়ন’-র পাল্লা সর্বদা একদিকেই ঝুঁকে ছিল। একদিকে রাষ্ট্র-সরকার-আমলাতন্ত্রের সাথে পারস্পরিক নির্ভরতার ভিত্তিতে সামরিক-বেসামরিক পুঁজিপতিদের বিকাশ অব্যাহত রাখা অপরদিকে, বাজার ব্যবস্থাকে সম্প্রসারণ করার জন্য যাবতীয় পরিকল্পনার কেন্দ্রে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থানের সমন্বয়ে চলতে থাকে পাকিস্তানের যাত্রা।

যে রাজনৈতিক শক্তি (মুসলিম লীগ) নতুন রাষ্ট্র গঠনে উদ্যোগী হয়েছিল তারা ব্যবসায়ী পুঁজিবাদী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে যারা পাকিস্তান গঠনের আন্দোলনে মূল সহযোগী হিসেবে ছিল তাদেরকেই (মেমন, আগা খানি ইসমাইলি, চিনিওতি, খোজা, বোহরা, পাঞ্জাবি-দিল্লী সওদাগর, পার্শি প্রভৃতি সম্প্রদায়ের নির্দিষ্ট ব্যবসায়ী)২৫ প্রাধান্য দেয়। জনগণের শক্তি-সামর্থ্য-ভাবনা উপেক্ষিত থাকার কারণে ‘উন্নয়ন’-র পাল্লা সর্বদা একদিকেই ঝুঁকে ছিল।  

২৭ এপ্রিল ১৯৪৮ সালে ব্যক্তি মালিকানাধীন পুঁজির বিকাশ ঘটাতে রাষ্ট্রটির বাণিজ্য নীতি কী হবে সে প্রসঙ্গে পুঁজির প্রতিনিধিদের সভায় তাই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে বলতে হয়েছে,

‘শিল্পায়নের প্রতিটি ধাপে ব্যক্তি খাতের বিকাশ ঘটাতে পাকিস্তান সরকারের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য আপনাদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। যে কয়টি খাত সরকারের ব্যবস্থাপনার জন্য সংরক্ষিত রয়েছে যেমন: যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ, জ্বালানী, রেলওয়ে ওয়াগন তৈরী, টেলিফোন, টেলিগ্রাম এবং ওয়্যারলেস সরঞ্জাম ছাড়া বাকী সব ধরনের শিল্পায়ন কার্যক্রম ব্যক্তি খাতের জন্য উন্মুক্ত থাকলো। শিল্পের বিভিন্ন খাতের বিকাশ ঘটানোর জন্য ব্যক্তি মালিককে একটি সরকারের পক্ষ থেকে যত ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায় তাই দেওয়া হবে। সরকার শিল্পায়ন এবং ব্যবসার বিকাশের জন্য নানা ধরনের অনুকূল শর্ত সৃষ্টি করবে..।’২৬  

এরই ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বৃহৎ শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বিভিন্ন মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য। ফলস্বরূপ, কথিত ২২ পরিবারের উত্থান এবং তাদের সমৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। জিন্নাহর ঘোষণায় পাকিস্তানের সমগ্র অঞ্চলে শিল্পায়নের ঘোষণা থাকলেও মূলত: বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে পূর্বাংশ তখন উপেক্ষিতই থেকে যায়।

 ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ (বর্তমান দামস্তর অনুযায়ী) (মিলিয়ন রুপি)২৭

 

১৯৬০/৬১

১৯৬১/৬২

১৯৬২/৬৩

১৯৬৩/৬৪

১৯৬৪/৬৫

১৯৬৫/৬৬

১৯৬৬/৬৭

১৯৬৭/৬৮

১৯৬৮/৬৯

১৯৬৯/৭০

সমগ্র পাকিস্তান

৯৮৩.৬

১২৫৪.৩

৯১৩.২

১৩৮১.৫

১৬১৩.৫

১৪৫৬.৮

১৪৭৮.০

১৫৩৬.০

১৫২২.৬

১৬৬৭.৪

পশ্চিম পাকিস্তান

৮০৮.৩

৮০৯.২

৬৩৯.৯

১০৪৪.১

১১৮৮.১

১০৮৪.০

১০১১.২

১০৫০.৮

১০০৩.৩

১১৬৫.৭

পূর্ব পাকিস্তান

১৭৫.৩

৪৪৫.১

২৭৩.৩

৩৩৭.৪

৪২৫.৩

৩৭২.৮

৪৬৬.৮

৪৮৫.২

৫১৯.৩

৫০১.৭

সূত্র:   i) ১৯৬০-৬৩, প্ল্যানিং কমিশন, ১৯৬৬, পৃ. ১৮৯।

  1. ii) ১৯৬৩-৭০, কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান অফিস, করাচি (অপ্রকাশিত)। ‘Estimates of private industrial investment’, Table A.6, রশিদ আমজাদ, পৃঃ-১৯০, ২০০৭।   

উপরের ছক-এ দেখা যাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে বিনিয়োগের পরিমাণ বেশী। অন্যকথায়, সরকারী ব্যয় বা রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ, বিদেশী সম্পদ প্রবাহ সবক্ষেত্রেই পশ্চিম পাকিস্তান মূল গুরুত্বের জায়গায় ছিল। ১৯৬৪/৬৫-র সর্বোচ্চ বিনিয়োগকালীন সময়েও পূর্ব পাকিস্তানে বিনিয়োগ হয়েছিল মোট বিনিয়োগের শতকরা মাত্র ৩৮.৬ ভাগ।২৮ 

পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে ৩০০০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬০টি শিল্প গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করতো প্রায় ৬০.৬ শতাংশ সম্পদ এবং মোট শিল্প বিক্রয়ের ৪৩.৫ শতাংশ। এদের মধ্যে আবার ৭ টি গ্রুপ একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করতো ২৪.৪ শতাংশ শিল্প সম্পদ এবং মোট ব্যক্তিগত বাণিজ্যের মধ্যে ১৫.৬ শতাংশ। অন্য আরেকটি হিসাবে দেখা যায়, প্রকৃত অর্থে ২২ পরিবারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে ছিল মোট শিল্প উদ্যোগ-সম্পদের শতকরা ৬৬ ভাগ; মোট ইন্স্যুরেন্স এর ৭০ শতাংশ এবং শতকরা ৮০ ভাগ ব্যাংকিং সম্পদের মালিক।২৯

পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে ৩০০০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬০টি শিল্প গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করতো প্রায় ৬০.৬ শতাংশ সম্পদ এবং মোট শিল্প বিক্রয়ের ৪৩.৫ শতাংশ। এদের মধ্যে আবার ৭ টি গ্রুপ একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করতো ২৪.৪ শতাংশ শিল্প সম্পদ এবং মোট ব্যক্তিগত বাণিজ্যের মধ্যে ১৫.৬ শতাংশ। অন্য আরেকটি হিসাবে দেখা যায়, প্রকৃত অর্থে ২২ পরিবারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে ছিল মোট শিল্প উদ্যোগ-সম্পদের শতকরা ৬৬ ভাগ; মোট ইন্স্যুরেন্স এর ৭০ শতাংশ এবং শতকরা ৮০ ভাগ ব্যাংকিং সম্পদের মালিক।

এই বাইশ পরিবারকে নিয়ে পুরো ’৬০ দশক জুড়েই নানান প্রশ্ন উঠতে থাকে এবং তা ছিল রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম একটা ইস্যু। এদের মধ্যে ১৯৭০-র দিকে আদমজী ছিল তৃতীয় বৃহত্তম ব্যক্তিমালিকানাধীন একচেটিয়া পরিবার। এদের হাতে ছিল আলাদা আলাদা মোট ২০টি প্রতিষ্ঠান। তুলা, টেক্সটাইল, পাট, চিনি, কাগজ, বোর্ড, রাসায়নিক, মটর ইঞ্জিন সংযোজন, বনস্পতি ঘি উৎপাদন, শিপিং, ট্রেডিং কোম্পানি (কাঁচামাল, চা, তুলা, পাট), বাণিজ্যিক ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি অর্থাৎ শিল্প, উৎপাদন, লগ্নী পুঁজির সর্বক্ষেত্রে ছিল তাদের একচেটিয়া দৌরাত্ম্য। নীচে পশ্চিম পাকিস্তানের ২২ পরিবারসহ একচেটিয়া পরিবারগুলোর একটি তালিকা দেওয়া হলো—

মোট বিনিয়োগের মধ্যে একচেটিয়া পরিবারগুলোর অংশ, ১৯৭০ (শতকরা হার)৩০

ক্রম

একচেটিয়া পরিবার

শতকরা হার

ক্রম

একচেটিয়া পরিবার

শতকরা হার

১.

দাউদ

৬.৯৫

২১.

ওয়াজির আলি

০.৯৬

২.

সায়গল

৫.৮২

২২.

ইস্পাহানি

০.৮০

৩.

আদমজী

৫.০২

২৩.

হাফিজ

০.৪২

৪.

বাওয়ানি

৪.৪২

২৪.

জাফর-উল-আহসান

০.৩৬

৫.

গান্ধারা

৩.৬৭

২৫.

মিলওয়ালা

০.৩৪

৬.

ফ্যান্সি

২.৮৪

২৬.

হেইসনস

০.৩৫

৭.

কলোনি (এন)

২.৬৭

২৭.

রহিমতুলা

০.৩৫

৮.

গুল আহমেদ

২.৮০

২৮.

হোতি

০.২৪

৯.

নিশাত

২.২

২৯.

বাওয়া

০.১৯

১০.

বি.ই.সি.ও

২.৭৪

৩০.

এ.কে.খান

০.১২

১১.

করিম

১.৯৪

৩১.

ফ্রন্টিয়ার

০.১৩

১২.

ক্রিসেন্ট

১.৮১

৩২.

শাহনেওয়াজ

০.২২

১৩.

হাবিব

১.৬৪

৩৩.

দাদা

০.২৬

১৪.

ফারুক

১.৪৩

৩৪.

কলোনি (এফ)

০.১৭

১৫.

হুসেইন

১.৪৫

৩৫.

হারুনস

০.৩১

১৬.

এ. খালীলি

১.২৯

৩৬.

ফিরোজসনস

০.০৪

১৭.

আরাগ

১.২৬

৩৭.

রেঙ্গুনওয়ালা

০.১৮

১৮.

ফাতেহ

১.১১

৩৮.

প্রিমিয়ার

০.০১

১৯.

নুন

১.০৪

৩৯.

রেয়াজ-ও-খালিদ

০.০১

২০.

ভালিকা

০.৮১

৪০.

আমিন

২.৫১

১. মোট কোম্পানির শতকরা হার=৬০.৮৮%,  ২. অভ্যন্তরীণ কোম্পানির শতকরা হার হিসেবে (বিদেশী কোম্পানি বাদে)-৬৪.৮%; ৩. ব্যক্তি মালিকানাধীন অভ্যন্তরীণ শতকরা হার হিসেবে (বিদেশী এবং রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কোম্পানি বাদে)=৭৩.৯%।

সূত্র: ন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট (ইউনিট) ট্রাস্ট (NIT), ডিরেক্টর’র রিপোর্ট ও স্টেটমেন্ট অব একাউন্টস, ১ জুলাই ১৯৬৯-৩০জুন ১৯৭০ (করাচি,১৯৭০)। ‘‘Share of monopoly houses’ companies in total N.I.T. Investments 1970, Table B.4’’, রশিদ আমজাদ, (২০০৭), পৃঃ-২০৩।

উপরে উল্লিখিত পুঁজিপতিরা বেড়ে ওঠে মূলত: পঞ্চাশ থেকে সত্তর দশকের মধ্যে। তখন ভারত ও উভয় পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় নানাপ্রকার সহায়তা দানের মাধ্যমে ব্যক্তি পুঁজির বিকাশ ঘটানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর যোগানের একটা অংশ আসে রপ্তানী আয় (রপ্তানী বোনাস ভাউচার, কর ও শুল্কছাড়, ভর্তুকি ইত্যাদির মাধ্যমে), বৈদেশিক ঋণ (আন্তজার্তিক সংস্থাগুলোর ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী) ইত্যাদি থেকে। এক্ষেত্রে ভারতের সাথে পার্থক্য হলো, ভারতের শিল্পায়নে তৎকালীন সরকারের যে ভূমিকা সেখানে গুরুত্বের দিক থেকে জাতীয় সক্ষমতা  বিবেচনা এবং ভিত্তিমূলক স্থানীয় ভারী ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ (লৌহ ও ইস্পাত, পাট, তুলা প্রভৃতি) ঘটানো একটি বড় অবস্থানে ছিল। তার মানে এই নয় যে, সে সময় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রীয় শাসকদের বৈষম্যমূলক শোষণ-শাসন ছিল না। ছিল অবশ্যই। কিন্তু অর্থনীতির কেন্দ্রীয় গতিমুখ নির্ধারণে আত্মনির্ভরশীলতার দিকটি প্রধান ছিল। অন্যদিকে পাকিস্তানের শিল্পায়নের ভূমিকায় আত্মনির্ভরশীলতার পরিবর্তে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র-সংস্থার ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী মাঝারি ধরনের শিল্পের বিকাশ বিবেচনা ছিল প্রধান গুরুত্বের জায়গায়। যার ফলে, ভারতের জাতীয় শিল্প-প্রতিষ্ঠান যেভাবে দাঁড়াতে পেরেছে; পাকিস্তানে তা পারেনি।  

একদিকে ভারত ভারী (শ্রমঘন শিল্প), মাঝারি (ভোগ্যপণ্য) শিল্প গড়ায় মনোযোগী হয় অন্যদিকে পাকিস্তানে (মূলত: পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক অল্প কয়েকটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর স্বার্থে) উৎপাদনের উপকরণ আমদানী (মেশিনারী, প্রযুক্তিপণ্য ইত্যাদি) এবং মাঝারি শিল্প বিকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এছাড়া ইউরোপে ভূমি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাপেক্ষে যেভাবে শিল্পায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল; তার বিপরীতে সামন্তীয় সম্পর্ক বজায় রেখে পাকিস্তানে ভূমি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

এর কারণ হিসেবে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠিত একটি মত হলো; তিনটি কারণে পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক শিল্পায়ন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের চাইতে দুর্বলভাবে পথ চলতে শুরু করে। প্রথমত: শিল্পের বিকাশের জন্য যে ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে ভিত্তিমূলক শিল্পায়নের তুলনায় তা যথেষ্ট পরিমাণ দুর্বল। দ্বিতীয়ত: রাজনৈতিক এবং আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্ব সামরিক খাতের বিকাশকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছেন। তৃতীয়ত: মুসলিম লীগ সরকারের রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক ভিত্তি ছিল খুবই দুর্বল।৩১ এই ত্রিবিধ কারণে এবং সুযোগে দেশী-বিদেশী নির্দিষ্ট ঘরানার পুঁজিপতিরা অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষেত্রে একচেটিয়া আধিপত্য করার সুযোগ পায়।

ভারত ভাগ হওয়ার পর পাকিস্তান যে সব অঞ্চল নিয়ে গঠিত হল সেসব ছিল মূলত: অশিল্পায়িত এলাকা। এসব অঞ্চল ছিল কৃষি নির্ভর এবং পশ্চাদপদ। বিশেষ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাঞ্জাব ছিল কলকাতা ও বোম্বের পাটকল, টেক্সটাইল শিল্পের কাঁচামাল পাট ও তুলার যোগানদাতা। ভারতের তুলনায় খনিজ সম্পদ মজুদ হিসাব ছিল বর্তমানের তুলনায় যথেষ্ট পরিমাণ কম। দেশভাগের সময় ভারতবর্ষের মোট অর্থনীতির শতকরা ১৮ ভাগ নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হলেও অর্থনীতিতে শিল্পের হার ছিল শতকরা ১০ ভাগেরও কম। 

তৎকালীন পাকিস্তান এবং ভারতের জাতীয় উৎপাদনের তুলনামূলক গঠন ৩২

 

পাকিস্তান (পূর্ব ও পশ্চিম)

১৯৬০ সালে উপাদান ব্যয় এবং জিএনপি’র শতকরা হার হিসাবে

ভারত

১৯৮০ সালে দামস্তর এবং এনডিপি’র শতকরা হার হিসাবে

 

১৯৫০

১৯৬০

১৯৭০

১৯৫০

১৯৭০

কৃষি

৬০.০

৫৩.৩

৪৪.৪

৫০.১

৪১.৮

ম্যান্যুফ্যাকচারিং

৫.৯

৯.৩

১২.২

১১.৪

১৫.৩

১. বৃহৎ শিল্প

১.৪

৫.০

৯.০

২. ক্ষুদ্র শিল্প

৪.৪

৪.৩

৩.২

অন্যান্য

৩৪.১

৩৭.৪

৪৩.৪

৩৮.৫

৪২.৯

সূত্র: আমজাদ (১৯৮২): টেবিল ১.২, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল একাউন্টস স্ট্যাটিক্টিস, ১৯৯০। ‘Comparative Compositions of National Prduct: Pakistan and India, Table 2’, The Political Economy of Industrial Policy in Pakistan 1947-1971,  Mustaq H. Khan, page: 7-8।

উপরের ছকে দেখা যাচ্ছে, মোট জাতীয় উৎপাদনে কৃষির অংশগ্রহণ যেখানে প্রায় ৬০ শতাংশ সেখানে ম্যান্যুফ্যাকচারিং খাতের অংশ মাত্র প্রায় ৫.৯ ভাগ। তার মধ্যে বৃহৎ ম্যানুফ্যাকচারিং-এর অংশ মাত্র প্রায় ১.৪ ভাগ। অপরদিকে ১৯৫০-এর দশকে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ভারতের অংশ পাকিস্তানের প্রায় দ্বিগুণ। শতকরা প্রায় ১১.৪ ভাগ। ঐতিহাসিক কারণে ভারতে শিল্পখাতের বিকাশ সাধিত হয়েছিল বিশেষ করে বৈচিত্র এবং ভিত্তিমূলক শিল্পের স্বাধীন বিকাশের দিকে নজর রেখে; পাকিস্তানের বেলায় নীতিগত কারণে সে বিকাশের সম্ভাবনা ছিল না। সাম্রাজ্যবাদী আনুগত্যের পরিবর্তে দেশীয় পুঁজির পারস্পরিক স্বার্থ সংরক্ষণগত লেনদেনের শর্তগুলো প্রধান ছিল ভারতে। যদিও পরবর্তীতে তার ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি; সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নানান ধরনের সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে।

প্রথম এগার বছর বণিক পুঁজির বিকাশের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যদি হিসাব করা হয় তাহলে দেখা যাবে, সে সমস্ত ব্যবসায়ী, রপ্তানীকারক এবং উৎপাদক পুঁজিপতিরা জাতিরাষ্ট্রের নির্মাণের কেন্দ্রে ছিল যারা আন্তর্জাতিক লেনদেন বিশেষ করে কোরিয়ান যুদ্ধের সময় পণ্য-দ্রব্য কেনাবেচা করে প্রচুর লাভবান হয়েছিল। ক্ল্যাসিক্যাল মার্কেন্টালিজম-এ যেমনটি দেখা যায় সেরকমভাবে নয় কারণ দেশীয় বুর্জোয়ারা মূলত: ছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে ওতোপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তি তাই বিকশিত হয়েছিল বণিক এবং ব্যবসায়ী শ্রেণির স্বার্থ বিবেচনায়।

বিভাগপূর্ব সময় থেকেই এ শ্রেণিটি মুসলিম লীগের সাথে সম্পর্কিত ছিল। ভারতীয় পুঁজির সাথে প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিতে না পারার কারণে এদের কাছে তাই আলাদা রাষ্ট্র গঠন প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। যেসব মুসলমান ব্যবসায়ী অর্থলগ্নী, শিপিং এবং ক্ষুদ্র শিল্প-কারখানার মাধ্যমে পরবর্তীতে ‘জাতি গঠন কোম্পানি’র আওয়াজ তুলেছিল ’৪৭ পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে তারাই মুসলিম লীগের কর্মসূচি নির্ধারণে মূল ভূমিকা পালন করতো। এদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ছিল হাবিব ব্যাংক, মোহাম্মদী স্টিমশিপ কোম্পানি এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যারা পরবর্তীতে পাকিস্তান রাষ্ট্রে অন্যতম বৃহৎ পুঁজিপতিতে রূপান্তরিত হয়।৩৩ সরকারের তরফ থেকে যদিও তখন ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল যে,

‘সর্বপ্রথমে পাকিস্তানের নিজস্ব সীমানায় কাঁচামাল বিশেষ করে পাট, তুলা, বাণিজ্য ও শিল্প উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে পশুচর্ম ইত্যাদি উৎপাদনে মনোযোগ দিতে হবে যাতে দেশে অথবা বিদেশে তার বাজার নিশ্চিত করা যায়। একই সাথে দেশীয় বাজারের চাহিদা পূরণের জন্য বাইরের যেসকল উৎসের উপর পাকিস্তান বর্তমানে নির্ভরশীল সেসব ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য শিল্প’ গড়ে তোলার দিকে নজর দিতে হবে।’৩৪

পরবর্তীতে শিল্প পার্ক গড়ে তুলে ব্যক্তি মালিকানাধীন বৃহৎ পুঁজিকে উৎসাহিত করতে ১৯৫৩-’৫৪ সালে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করে সরকার। এজন্য নানা ধরনের ভর্তুকি, ছাড়, কর মওকুফ এবং প্রণোদনা প্রদান করা হয়। সরাসরি কর মওকুফের ঘোষিত কর্মসূচি ছিল,

‘ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য ব্যাপক ভর্তুকি ও ছাড় প্রদানের লক্ষ্যে বার্ষিক নীতি-পরিকল্পনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।…শিল্পের বিকাশের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা, পথ প্রদর্শন এবং নিয়ন্ত্রণসাপেক্ষে ‘বুদ্ধিদীপ্ত’ আমদানী ও মূলধন সম্পর্কিত নীতি নির্ধারণ, নির্দিষ্ট কর সুবিধা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে সরকার মূখ্য ভূমিকা পালন করবে।’৩৫

অন্যদিকে, একই সময়ে ‘কমিউনিস্ট আগ্রাসন’, ‘মুক্ত বিশ্ব প্রতিরক্ষা’, ‘বহিঃশত্রু মোকাবেলার জন্য সীমান্তে নজরদারি বৃদ্ধি’ ইত্যাদির কথা বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বিভিন্ন ধরনের সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়াতে একদিকে যেমন সামরিক-প্রতিরক্ষা ব্যবসায়ী-আমলাদের কোন প্রকার অসুবিধা হয়নি ঐতিহ্যগত সম্পর্কের কারণে, অন্যদিকে বেসামরিক ব্যক্তিপুঁজি মালিক, অভিজাত ভূমি মালিক, লুম্পেন বুর্জোয়ারাও বিভিন্নভাবে এ সমস্ত চুক্তিগুলো থেকে বিভিন্ন সময়ে লাভবান হয়েছে। সামরিক-বেসামরিক পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন সমস্যা হয়নি বিশেষ করে বৃহৎ পুঁজিপতিদের ক্ষেত্রে এবং উভয় দিক থেকে শ্রেণিগত ঐক্যের কারণে শাসকশ্রেণির পক্ষে আন্তর্জাতিক পুঁজির সাথে গাটছড়া বাঁধতে সুবিধা হয়েছে।

একই সময়ে ‘কমিউনিস্ট আগ্রাসন’, ‘মুক্ত বিশ্ব প্রতিরক্ষা’, ‘বহিঃশত্রু মোকাবেলার জন্য সীমান্তে নজরদারি বৃদ্ধি’ ইত্যাদির কথা বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বিভিন্ন ধরনের সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়াতে একদিকে যেমন সামরিক-প্রতিরক্ষা ব্যবসায়ী-আমলাদের কোন প্রকার অসুবিধা হয়নি ঐতিহ্যগত সম্পর্কের কারণে, অন্যদিকে বেসামরিক ব্যক্তিপুঁজি মালিক, অভিজাত ভূমি মালিক, লুম্পেন বুর্জোয়ারাও বিভিন্নভাবে এ সমস্ত চুক্তিগুলো থেকে বিভিন্ন সময়ে লাভবান হয়েছে।

পরবর্তীতে সরকারি সরাসরি হস্তক্ষেপ আস্তে আস্তে গুটিয়ে নেওয়া হয় যাতে বাজার ব্যবস্থা ভালভাবে কাজ করতে পারে। বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে সামরিক খাতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। আমদানীর একটি বড় অংশ মিলিটারি স্থাপনা-অস্ত্র-প্রযুক্তি এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি কিনতে ব্যয় হতে থাকে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশ একটি করদ রাজ্যে পরিণত হয়, বিশেষ করে পরিণত হয় পশ্চিম পাকিস্তানের আমদানীকৃত-উৎপাদিত পণ্যের নির্দিষ্ট বাজারে। প্রাক্তন উপনিবেশিতের নতুন উপনিবেশ বানানোর আকাঙ্ক্ষায় শুরু থেকেই বিভিন্ন বৈষম্যমূলক নীতি-পরিকল্পনার কারণে তৎকালীন পূর্ব অঞ্চলে শিল্পের বিকাশ নানাভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়।

১৯৫৮-৭১ সময়কালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কিছু অর্থনীতিবিদ নীতি-পরিকল্পনা তৈরী করার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। প্রবৃদ্ধি খাত বিশেষ করে যে সমস্ত শিল্পখাতগুলো উচ্চ প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সেসব খাতগুলোর উপর গুরুত্ব আরোপ করে নীতি প্রণীত হয়। বৃহৎ পুঁজি তৈরী করার জন্য তারা ভর্তুকি, প্রণোদনা এবং বৈদেশিক বিনিময় সহজসাধ্য করার জন্য নানান ধরনের সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে এই তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে যে, এতে করে এই পুঁজিপতি শ্রেণি তাদের মুনাফা থেকে সঞ্চয় করে পুনরায় বিনিয়োগের দিকে আকৃষ্ট হবে। এতে যে বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে সে হিসাবটা তাদের বরাবরই ছিল। সেটিকে তারা নানাভাবে যৌক্তিক করার চেষ্টা করেছে।

আইয়ুব খানের আমলে মাহবুবুল হক ছিলেন পরিকল্পনাবিদদের মধ্যে অন্যতম একজন। তিনি বলেছিলেন,

‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথটি খুব মসৃণ নয়, কঠোর এবং কঠিন একটি প্রক্রিয়া। এর জন্য কোন শর্টকাট রাস্তা নেই। এর মূল জায়গাটি হলো শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় ভোগের (কর্তৃপক্ষ তাদের জন্য যতটুকু ভোগ নির্ধারণ করে দেবে) চাইতে আরও বেশী পরিমাণ উৎপাদন করতে হবে এবং এই বাড়তি উৎপাদন বিনিয়োগ ও পুনঃবিনিয়োগে নিয়োজিত হবে। যেটা সবচাইতে বেশী গুরুত্বপূর্ণ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে খোলাখুলি স্বীকার করতে হবে যে, প্রবৃদ্ধিগত সমস্যার মূল জায়গা হলো এই উদ্বৃত্তমূল্য বাড়তি পরিমাণে সৃষ্টির সমস্যা। হয় পুঁজিপতিদের এই ভূমিকা পালন করতে দিতে হবে অথবা পুঁজিবাদের ধরনের কারণে যদি মনে হয় এতে তারা অপারগ তাহলে রাষ্ট্রকে সে দায়িত্ব নিতে হবে। (পুঁজির) উদ্বৃত্তমূল্য উৎপাদনকে শোষণ আখ্যা দেয়াটা ভুল কেননা এটি একটি জরুরী ধারাবাহিকতা; অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য এই শোষণ খুবই যৌক্তিক।’৩৬ 

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘Harvard Advisory Group (HAG)’৩৭ ‘বিশেষজ্ঞ’দের সরাসরি তত্ত্বাবধানে আইয়ুব খান আমলে পরপর দুইটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ছক করা হয় যার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এবং আন্তর্জাতিক একচেটিয়া পুঁজির সাথে যৌথভাবে বেশকিছু ‘আমদানি বিকল্প’ ভোগ্যপণ্যের শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা হয়। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ব্যক্তিমালিকানাধীন ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় শতকরা ১৬.২ শতাংশ।৩৮ (এই হার নিয়ে ভিন্নমত আছে কোন কোন বিশ্লেষকের)৩৯ তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এই হার ক্রমান্বয়ে কমে যায়।

দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৬০-৬৫) খুব প্রশংসিত হয় এবং বলা হয়ে থাকে যে, এটি হলো পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সবচাইতে সার্থক সময়। ১৯৫০ সালের পর থেকে যে স্থবিরতা তৈরী হয়েছিল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সেখান থেকে তার একটা উল্লম্ফন ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বার্ষিক শতকরা ৩.৫ থেকে শতকরা ৬.৭ ভাগে উন্নীত হয়। শিল্প উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় বার্ষিক ১২ শতাংশ এবং বিনিয়োগ হার বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ শতাংশে। মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ২ শতাংশ।৪০

তবে সাধারণভাবে বলা যায়, উত্তরোত্তর প্রবৃদ্ধি অর্জনের তাগিদে একদিকে যেমন ব্যক্তিমালিকানাধীন পুঁজির প্রতিষ্ঠান বেড়েছে অন্যদিকে উদ্বৃত্তমূল্য উৎপাদনের প্রধান কারিগর উৎপাদিকা শক্তির ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে নজর না দেওয়ার ফলে অধিকহারে বৈষম্য বেড়েছে। একদিকে যেমন শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল এবং সস্তা শ্রমিকের যোগান দেওয়ার উৎস ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অন্যদিকে আবার উৎপাদিত পণ্যের বাজার হিসেবে বড় একটা ক্ষেত্র ছিল এই অঞ্চলটি।

একদিকে উৎপাদন বৃদ্ধি অন্যদিকে আয় বৈষম্য এবং মজুরীর নিম্নহার, এই পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিকদের প্রতিরোধ-প্রতিবাদ সে সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। রপ্তানী আয় যেমন পূবের কৃষক উৎপাদিত পাট এবং তুলাকে কেন্দ্র করে হতো কিন্তু এর সুফলভোগী ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যক্তি পুঁজি এবং অপরদিকে যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি আমদানী, সামরিক-প্রতিরক্ষা ব্যয় ইত্যাদির কেন্দ্রীভবন ছিল পশ্চিমকে কেন্দ্র করে। অসামঞ্জস্যপূর্ণ এই প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরিকল্পনা এবং বৈষম্য নীতি তাই পাকিস্তান কাঠামোর জন্য পরবর্তীতে কোন সুফল বয়ে আনেনি। মোদ্দাকথা, সরকারের সাথে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে পুঁজিপতিরা একদিকে বিকশিত হয় অন্যদিকে,সামাজিক আয় বৈষম্য চরমভাবে বৃদ্ধি পায় এবং এর প্রতিক্রিয়ায় রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাত্রা উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হতে থাকে।(চলবে)

পরের পর্ব: ২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-২

মেহেদী হাসান: লেখক গবেষক। ইমেইল:mehedihassan1@gmail.com

তথ্যসূত্র:

  1. Samir Amin – Unequal Development: An Essay on the Social Formations of Peripheral Capitalism (1977, Monthly Review Press).
  2. করোনা: মজুদ-সরবরাহ পর্যাপ্ত, তবুও চালের দর বেড়েছে ৭ টাকা, বাংলানিউজটুয়েন্টিফোরডটকম, মার্চ ২০, ২০২০।
  3. বাসযোগ্য শহরের তালিকার শেষ চারে ঢাকা,ডেইলিস্টার অনলাইন বাংলা, ১০ জুন, ২০২১।
  4. Oxfam says wealth of richest 1% equal to other 99%, BBC, 18 January, 2016.
  5. ‘সরকার চায় নির্বোধ, প্রশ্নহীন, অনুগত মানুষ’, আনু মুহাম্মদ, প্রথম আলো, ১৩ জুন ২০২১
  6. Proverty Analysis of Bangladesh,march 24, 2014.
  7. — Ibid —
  8. Anil Chatterjee, Ranajit Dasgupta, Kalyan Dutt – Bangladesh economy an analytical study (1973, People’s Pub. House), page-8.
  9. Badruddin Umar, Politics and society in East Pakistan and Bangladesh, Mowla Bros. (1974)
  10. https://en.wikipedia.org/wiki/Thomas_Babington_Macaulay. Headline: Thomas Babington Macaulay. Para: India (1834-1838) 23 June, 2021.
  11. Faisal Iqbal, An Analysis of Administrative Reforms in Pakistan’s Public Sector, 2014, University of Bedfordshire, page-28
  12. — idid —
  13. Ayesha Jalal – Democracy and Authoritarianism in South Asia: A Comparative and Historical Perspective (Contemporary South Asia) (1995), page-4.
  14. Faisal Iqbal, An Analysis of Administrative Reforms in Pakistan’s Public Sector, 2014, University of Bedfordshire, page-30.
  15. Amna Imam, Eazaz A. Dar; Democracy and Public Administration in Pakistan, CRC press, 2014, page-49.
  16. Roy, Tirthankar – The Economy of South Asia : From 1950 to the Present, Springer International Publishing-2017, page-31.
  17. Special report: The founding fathers 1947-1951, dawn, 19 Oct, 2017.
  18. Anil Chatterjee, Ranajit Dasgupta, Kalyan Dutt – Bangladesh economy an analytical study (1973, People’s Pub. House), page-8, 11-12.
  19. Faisal Iqbal, An Analysis of Administrative Reforms in Pakistan’s Public Sector, 2014, University of Bedfordshire, page-32.
  20. Hassan Gardezi, Jamil Rashid (Eds) – Pakistan: Roots of Dictatorship (1983, Zed Books Ltd, page-5).
  21. Milton Friedman’s involvement with the brutal Pinochet dictatorship,Sep. 9, 2014.
  22. Paul M. Sweezy, Four Lectures On Marxism, Monthly Review Press, New York and London, 1981, page-73.
  23. Anil Chatterjee, Ranajit Dasgupta, Kalyan Dutt – Bangladesh economy an analytical study (1973, People’s Pub. House), page-5, 8.
  24. জনাব আইয়ুব খাঁর জবাবে হাজী মোহাম্মদ দানেশ; পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পুস্তিকা, অক্টোবর, ১৯৬৪; বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রঃ দ্বিতীয় খন্ড, পৃঃ-২৩৭।
  25. Iqbal M. Khan, Successful Entrepreneurial Minorities of Pakistan, Lahore School of Economics, page-3.
  26. M. Burke, The Commercial Policy of Pakistan; Jinnah:Speeches And Statements 1947-1948,  Oxford university press. 2000.  page-211. 
  27. Rashid Amjad, Private Industrial Investment in Pakistan: 1960-1970, page-190 (2007), Cambridge University Press.
  28. — idid — page-20.
  29. — idid — page-44-45.
  30. — idid — page-203.
  31. Mushtaq H. Khan, The Political Economy of Industrial Policy in Pakistan 1947-1971, Department of Economics, SOAS, University of London. page: 7-8.
  32. — idid —
  33. Hassan Gardezi, Jamil Rashid (Eds), Pakistan:  Roots of Dictatorship, page-6 (1983, Zed Books Ltd).
  34. — idid —
  35. — idid — page-7.
  36. — idid — page-10.
  37. Abid Ghafoor Chuadhry & Hafeez Ur Rahman Chaudhry, Develoment Chronicle of Pakistan: A Case of Colonial Legacy. revision paper received: March 21, 2012. page-52.
  38. Tahir Kamran, Democracy and Governance in Pakistan, South Asia Partnership-Pakistan, 2008, page-56.
  39. Stephen E. Guisinger, Patterns of Industrial Growth in Pakistan, p-10, The pakistan Development Review, Spring 1976, Vol.15, No.1.
  40. Abid Ghafoor Chuadhry & Hafeez Ur Rahman Chaudhry, ‘Develoment Chronicle of Pakistan: A Case of Colonial Legacy’. revision paper received: March 21, 2012. p-52.
Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •