মজুরের দেশে মজুরের জীবন
বাংলাদেশ মূলত মজুরের দেশ। কৃষি শিল্প হোটেল রেস্তোরা পরিবহণ দোকান নির্মাণসহ নানা ক্ষেত্রে কাজ করছেন বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী পুরুষ এমনকি শিশু কিশোরেরাও। তাদের জীবন জীবিকা, আশা আকাঙ্খা, বিপদ অনিশ্চয়তা, স্বপ্ন লড়াই এর খবর কমই প্রকাশিত হয়। পরিসংখ্যানের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায় তাঁদের প্রকৃত জীবন কথা। আগের বিভিন্ন সংখ্যায় আমরা এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন নিয়ে প্রত্যক্ষ অনুসন্ধান চিত্র প্রকাশ করেছি। এই সংখ্যাতেও দুটো লেখা প্রকাশ করা হলো।
১
জীবন ও জীবিকার সংগ্রামে হোটেল রেস্তোরার শ্রমিকরা
প্রকাশ দত্ত
বাহারী মিষ্টি আর ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির দোকান আজ রাজধানী ঢাকা, জেলা, উপজেলাসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে চোখে পড়ে। আমাদের দেশের বিভিন্ন পার্বনে, উৎসবে, আনন্দের সংবাদের সাথে মিষ্টি মুখ করা অনেক পুরাতন ঐতিহ্য। শুরুতে রসগোল্লাসহ কয়েক পদের মিষ্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও বহুমুখী চাহিদার ফলে শ্রমিকের সৃষ্টিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে বাহারী পদের মিষ্টি তৈরি করা হচ্ছে। এমনই বাস্তবতায় রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রিক বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভান্ডার, ভাগ্যকুল সুইটমিট, মুসলিম সুইটস, রস, প্রাইম সুইটস, মিঠাই, সিলেট শহরে মোহন লাল, চট্টগ্রাম শহরে ফুলকলি, বৃহত্তর ফরিদপুরসহ ঝিনাইদহ জেলাতে বাঘাট মিষ্টান্ন ভান্ডারসহ বিভিন্ন জেলা সুনির্দিষ্ট মিষ্টির জন্য দেশব্যাপী পরিচিতি রয়েছে।
নানা পদের মিষ্টি আর নামিদামি প্রতিষ্ঠানের বিকাশ ঘটলেও শ্রমিকের জীবন অধিকতর সংকটে পতিত। এই চিত্র শুধু মাত্র মিষ্টি, হোটেল, বেকারি শ্রমিকদের জীবনে নয়, সমগ্র শ্রমিকের জীবনের ক্ষেত্রে এ এক সাধারণ চিত্র। ৫০ বছরের বাংলাদেশের অগ্রগতির পরিসংখ্যানের সূচক নিয়ে আজ যে মাতম চলছে তার বিপরীতে প্রায় ৬ কোটি ৭০ লক্ষ শ্রমিকের জীবন আজ নিত্য ক্ষুধার ঘরে পরিণত হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করেছে। বৈষম্যের এই চিত্রে লুকিয়ে আছে শ্রেণি বিভক্ত সমাজের উন্নয়নের প্রকৃত সত্য। আজ রাষ্ট্রীয় আয়োজনে যখন সুবর্ণ জয়ন্তীর বাজনা বাজছে তখন এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক বাজারদরের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ, বকেয়া মজুরি পরিশোধ, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, নিরাপদ কর্মপরিবেশসহ শ্রমআইন বাস্তবায়নের দাবিতে রাজপথে বিক্ষোভ করছে। আর রাষ্ট্র তখন শ্রমিকদের দাবিকে দু’পায়ে দলে আইনের খড়গ হাতে দানবীয় মূর্তি নিয়ে শ্রমিকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তার ব্যতিক্রম হয়নি রাজধানী মিষ্টান্ন ভান্ডারের শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও।
হাউজ নং-১, রোড নং-৩, সেকশন-৭, মিরপুর-১১ বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এই মিষ্টির দোকান। মোট শ্রমিকের সংখ্যা ২৩ জন। প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা ‘বাংলাদেশ হোটেল রেস্টুরেন্ট মিষ্টি বেকারী শ্রমিক ইউনিয়ন’-এর পতাকাতলে সংগঠিত। প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিকরা গত ৮ অক্টোবর ২০২০ তারিখে মালিক-ম্যানেজার বরাবর চিঠি দিয়ে শ্রম আইন বাস্তবায়ন, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে দীর্ঘ সময় মজুরি বৃদ্ধি না হওয়ায় তা বৃদ্ধির দাবি জানায়। শ্রম মন্ত্রণালয়, শ্রম অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরসহ ১৫টি সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে অনুলিপি দিয়ে অবগত করে।
কিন্তু মালিকের পক্ষ থেকে সমস্যা সমাধানের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। ১ নভেম্বর ২০২০ তারিখে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর থেকে প্রেরিত উম্মে সালমা, শ্রম পরিদর্শক (সাধারণ), মোহাম্মদ আব্দুল মোতালেব শ্রম পরিদর্শক (সাধারণ) স্বাক্ষরিত পত্রে শ্রম আইন ২০০৬ ধারা ১২৪ক মোতাবেক নিষ্পত্তির নিমিত্তে পত্র দেওয়া হয়। ১৫ নভেম্বর ২০২০ তারিখে দুপুর ২টায় শ্রম কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে শ্রমিক প্রতিনিধি এবং ম্যানেজার ও মালিকের ছেলে উপস্থিত হন। আলোচনা সভায় সরকারি গেজেট অনুযায়ী মূল মজুরির সাথে বাৎসরিক ৫% ইনক্রিমেন্ট প্রদানসহ শ্রম আইনে প্রাপ্য সুবিধা বাস্তবায়নের বিষয় নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়। আলোচনাতে নানা টালবাহানার পর মালিকপক্ষ এক পর্যায়ে শ্রমিকদের দাবি বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী মালিকপক্ষ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না করে প্রশাসন ও মাস্তান দিয়ে ভয়ভীতি সৃষ্টি করাসহ নানা অপতৎপরতা চালায়। সংগঠনের সাহসী ভূমিকা আর শ্রমিকের ঐক্যের কারণে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে দাবি আদায়ে শ্রমিকরা অনড় থাকে। শ্রমিকের অনড় মনোভাবের কারণে মালিকপক্ষ আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এমনই বাস্তবতায় শ্রমিকরা সমস্যা সমাধানে ১ সপ্তাহের সময় বেঁধে দেন। সমস্যার সমাধান না হলে শ্রমিকরা কর্মবিরতি পালন করবেন বলে ঘোষণা দেন। পরবর্তিতে সমাধান না হওয়ায় ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখ সকাল থেকে শ্রমিকরা দাবি আদায়ে কর্মবিরতি পালন করতে থাকেন। কর্মবিরতি চলার এক পর্যায়ে মালিকের ভাড়াটিয়া মাস্তানরা শ্রমিকদের হুমকি-ধমকি দিয়ে কাজে যোগদান করার কথা বললে শ্রমিকরা যোগদান করতে অস্বীকার করেন। মাস্তানরা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী শ্রমিক কামাল হোসেনকে বেধড়ক মারপিট করে। এই ঘটনায় শ্রমিকরা স্থানীয় থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। ঘটনার প্রতিবাদে বিকাল ৪টায় প্রতিবাদ মিছিলের ঘোষণা দেন।
আলোচনাতে নানা টালবাহানার পর মালিকপক্ষ এক পর্যায়ে শ্রমিকদের দাবি বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী মালিকপক্ষ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না করে প্রশাসন ও মাস্তান দিয়ে ভয়ভীতি সৃষ্টি করাসহ নানা অপতৎপরতা চালায়।
বিকাল ৪টায় শ্রমিকদের প্রতিবাদ মিছিল শুরুর এক পর্যায়ে পুলিশ এসে মিছিলে বাধা দেয় এবং মিছিলের অনুমতি না নেওয়ায় অজুহাত তুলে গ্রেফতারের হুমকি দেয়। শ্রমিক নেতৃবৃন্দ পুলিশের কাছে তাদের দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরলে পুলিশ শ্রমিকদেরকে সাথে নিয়ে রাজধানী মিষ্টান্ন ভান্ডারে যায়। পুলিশ প্রশাসন মালিকের সাথে কথা বলে শ্রমিকদের কাজে যোগদান করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। শ্রমিকরা দাবি বাস্তবায়ন না হলে কাজে যোগদান করবেন না বলে জানায়। এই প্রেক্ষাপটে সিনিয়র কারিগরদের মাসিক মজুরি ১,৫০০ টাকা এবং জুনিয়র কারিগরদের মজুরি ১,২০০ টাকা বাড়ানোসহ অন্যান্য দাবি পূরণ করার ব্যাপারে মালিকপক্ষ এবং শ্রমিকের মধ্যে লিখিত চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী মজুরি বৃদ্ধি করলেও নিয়োগপত্র-পরিচয়পত্রসহ অন্যান্য দাবির বিষয়ে মালিকপক্ষ এখনও সময়ক্ষেপণ করে চলেছে।
এই প্রেক্ষাপটে সিনিয়র কারিগরদের মাসিক মজুরি ১,৫০০ টাকা এবং জুনিয়র কারিগরদের মজুরি ১,২০০ টাকা বাড়ানোসহ অন্যান্য দাবি পূরণ করার ব্যাপারে মালিকপক্ষ এবং শ্রমিকের মধ্যে লিখিত চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী মজুরি বৃদ্ধি করলেও নিয়োগপত্র-পরিচয়পত্রসহ অন্যান্য দাবির বিষয়ে মালিকপক্ষ এখনও সময়ক্ষেপণ করে চলেছে।
কলকারখানা পরিদর্শক ও পরিদর্শন অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষের মালিকতোষণ নীতির কারণে শ্রমিকরা নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র বিহীন পরিচয়হীন শ্রমিক হিসেবে যুগের পর যুগ কাজ করে চলেছে। এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ কিন্তু এখনও পর্যন্ত এই অপরাধীরা রাষ্ট্রের নাকের ডগায় থাকলেও ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। অন্যদিকে মালিকগোষ্টির হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলায় শ্রমিক ঘুরছে বছরের পর বছর, এমন কি জেলও খাটছে। আজ যে ‘উন্নয়ন’ সোপানে হাঁটছে বাংলাদেশ, তার প্রতিটি সিঁড়ি হচ্ছে জমাট বাঁধানো রক্ত-ঘাম। আর এই জমাট বাঁধানো সিঁড়িতেও জমে আছে হোটেল শ্রমিকদের রক্ত-ঘাম। ঢাকা শহরের টমটম গাড়ির ঘোড়ার চাবুকের মত শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে যেন হোটেল শ্রমিকদের জীবিকা।
আজ যে ‘উন্নয়ন’ সোপানে হাঁটছে বাংলাদেশ, তার প্রতিটি সিঁড়ি হচ্ছে জমাট বাঁধানো রক্ত-ঘাম। আর এই জমাট বাঁধানো সিঁড়িতেও জমে আছে হোটেল শ্রমিকদের রক্ত-ঘাম। ঢাকা শহরের টমটম গাড়ির ঘোড়ার চাবুকের মত শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে যেন হোটেল শ্রমিকদের জীবিকা।
রাষ্ট্রের উদাসীনতা আর শ্রমিক বৈরীতার বড় উদাহরণ হচ্ছে দেশের কয়েক লক্ষ শিল্প প্রতিষ্ঠানে শ্রম আইন বাস্তবায়ন, কারখানার পরিবেশ দেখ-ভাল করার জন্য পরিদর্শক মাত্র ৩’শ ২৭ জন। তারপরও যদি কখনো শ্রম পরিদর্শক প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শনে যান তখন শুধু মালিক, ম্যানেজারের চেহারা দর্শন করেই ফিরে আসেন। আজ তাই শ্রমিকরা বলেন ১০ বছর চাকরি করার পর মালিক শ্রমিককে খালি হাতে ফেরালেও পরিদর্শন কর্মকর্তাদের কখনোই খালি হাতে ফিরতে হয় না। যে কারণে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের প্রতি শ্রমিকদের আস্থা আজ তলানিতে ঠেকেছে। শ্রম আইনকে অমান্য করে নামমাত্র মজুরি দিয়ে হোটেল রেস্টুরেন্ট, সুইটমিট, বেকারির মালিকরা যে বেপরোয়া মুনাফা করে চলেছে তার পিছনে রয়েছে রাষ্ট্রের আনুকূল্য।
রাষ্ট্রের উদাসীনতা আর শ্রমিক বৈরীতার বড় উদাহরণ হচ্ছে দেশের কয়েক লক্ষ শিল্প প্রতিষ্ঠানে শ্রম আইন বাস্তবায়ন, কারখানার পরিবেশ দেখ-ভাল করার জন্য পরিদর্শক মাত্র ৩’শ ২৭ জন। তারপরও যদি কখনো শ্রম পরিদর্শক প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শনে যান তখন শুধু মালিক, ম্যানেজারের চেহারা দর্শন করেই ফিরে আসেন।
তার আর একটি দিক হলো শ্রম আইনের ১০৩ ধারায় সপ্তাহে দেড়দিন ছুটি, ১১৫ ধারায় বছরে ১০ দিন নৈমিত্তিক ছুটি, ১১৬ ধারায় ১৪ দিন অসুস্থতাজনিত ছুটি, ১১৭ ধারায় প্রতি ১৮ দিন কাজের জন্য ১ দিন অর্জিত ছুটি, ১১৮ ধারায় ১১ দিন মজুরিসহ উৎসব ছুটির টাকা কখনই এই সেক্টরের মালিকরা দেয় না। এই হিসাবে মিষ্টির দোকানের একজন স্পেশাল কারিগরের নিকট থেকে মালিকের বৎসরে মুনাফা হচ্ছে সপ্তাহে দেড় দিন ছুটি হিসাবে দৈনিক ৫০০ টাকা হারে এক মাসের পাওনা ৩,০০০ টাকা; ১ বছরে পাওনা ৩৬,০০০ টাকা; ১০ দিন নৈমিত্তিক ছুটি বাবদ পাওনা ৫,০০০ টাকা, ১৪ দিনের অসুস্থতাজনিত ছুটির পাওনা ৭,০০০ টাকা, প্রতি ১৮ দিন কাজের জন্য বছরে ২০ দিন ছুটির পাওনা ১০,০০০ টাকা, ১১৮ ধারায় ১১ দিন মজুরিসহ উৎসব ছুটির পাওনা ৫,৫০০ টাকা। এই হিসেবে একজন স্পেশাল কারিগরের শুধুমাত্র এক বছরে ছুটির বাবদ ন্যায্য পাওনা ৬৩,৫০০ টাকা।
রাজধানী মিষ্টান্ন ভান্ডারের মোট শ্রমিক সংখ্যা ২৩ জন। তাদের পদ বিন্যাস হিসাবে ২ জন স্পেশাল মিষ্টি কারিগরের জনপ্রতি দৈনিক মজুরি ৫০০ টাকা, ২ জন শুকনা মিষ্টি কারিগরের জনপ্রতি দৈনিক মজুরি ৫০০ টাকা, দই কারিগর ২ জনের জনপ্রতি দৈনিক মজুরি ৪১০ টাকা হারে, পরাটা কারিগর ১ জনের দৈনিক মজুরি ৩৯০ টাকা ,পার্সেল বয় ৫ জনের দৈনিক মজুরি ৩৫৫ টাকা, গ্লাস বয় ৩ জনের দৈনিক মজুরি ৩১০ টাকা হারে। একই ভাবে ২৩ জন শ্রমিকের শুধুমাত্র ছুটির দিনের পাওনা যুক্ত করলে বছরে মোট ৭,৫১,২০৫ (সাত লাখ একান্ন হাজার দুইশত পাঁচ) টাকা পাওনা হয়। এখানে উল্লেখ করা দরকার উপরের হিসাব শুধু ছুটির দিন হিসেব করে সরলীকরণ করে করা হয়েছে। যদি শ্রমআইন অনুযায়ী দৈনিক ৮ ঘন্টার অতিরিক্ত কাজের দ্বিগুণ মজুরি, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কাজের জন্য ক্ষতিপূরণমূলক একদিনের ছুটি এবং উৎসব ছুটির দিনে কাজের জন্য একদিনের বিকল্প ছুটি ও দুই দিনের ক্ষতিপূরণমূলক ছুটির হিসেবে যুক্ত করা হয় তাহলে এই পাওনা আরও অনেক বাড়বে। এই চিত্র থেকেই ভেসে ওঠে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, সুইটমিট, বেকারির ব্যবসা আজ কেন এত জমজমাট। আর এই প্রকৃত সত্যকে আড়াল করে এই ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে টাকার পাহাড় গড়ছে হোটেল রেস্টুরেন্ট সুইটমিট প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। শ্রম শোষণ আর লুটপাটকে জায়েজ করতে পুঁজি খাটিয়ে মালিক লাভ করে- এই কথা জোরেসোরে প্রচার করা হচ্ছে।
২৩ জন শ্রমিকের শুধুমাত্র ছুটির দিনের পাওনা যুক্ত করলে বছরে মোট ৭,৫১,২০৫ (সাত লাখ একান্ন হাজার দুইশত পাঁচ) টাকা পাওনা হয়। এখানে উল্লেখ করা দরকার উপরের হিসাব শুধু ছুটির দিন হিসেব করে সরলীকরণ করে করা হয়েছে। যদি শ্রমআইন অনুযায়ী দৈনিক ৮ ঘন্টার অতিরিক্ত কাজের দ্বিগুণ মজুরি, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কাজের জন্য ক্ষতিপূরণমূলক একদিনের ছুটি এবং উৎসব ছুটির দিনে কাজের জন্য একদিনের বিকল্প ছুটি ও দুই দিনের ক্ষতিপূরণমূলক ছুটির হিসেবে যুক্ত করা হয় তাহলে এই পাওনা আরও অনেক বাড়বে।
আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিপূরক শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত রয়েছে শ্রম শোষণের ন্যায্যতা দেওয়ার মতাদর্শ। যে কারণে অসচেতন শ্রমিক বিদ্যমান মতাদর্শের কাছে সাময়িক বশ্যতা স্বীকার করে মুখ বুঝে মেনে নিচ্ছে এই বর্বরতা। প্রচলিত সমাজে চাবুকের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী হচ্ছে এ ক্ষেত্রে মতাদর্শ। রাষ্ট্রের কাছে জিডিপির পরিসংখ্যান যতটা গুরুত্বপূর্ণ, শুধু ভাতের জন্য শ্রম শক্তি বিক্রি করে শোষণের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে তিলে তিলে মৃত্যুবরণ করা শ্রমিকের পরিসংখ্যান রাখা ততটাই গুরুত্বহীন। কারণ এই মৃত্যু রাষ্ট্র দ্বারা স্বীকৃত। প্রতিনিয়তই রাষ্ট্রের আইনের মারপ্যাঁচের বেড়াজালে ফেলানীর জীবনের মতো ঝুলছে শ্রমিকের জীবন। শুধু তাই নয়, যে কোনো দুর্যোগ-দূর্বিপাক, মহামারিতে শ্রমিকদের জীবন যে কত অনিশ্চিত তারই নিষ্ঠুর চিত্র ভেসে উঠলো করোনা মহামারিতে। সারাদেশে প্রায় ৩০ লক্ষ হোটেল শ্রমিকের মধ্যে অর্ধেক শ্রমিক করোনার কারণে চাকরিচ্যূত হয়ে এখন অর্ধাহারে-অনাহারে দিনাতিপাত করছে।
প্রতিনিয়তই রাষ্ট্রের আইনের মারপ্যাঁচের বেড়াজালে ফেলানীর জীবনের মতো ঝুলছে শ্রমিকের জীবন। শুধু তাই নয়, যে কোনো দুর্যোগ-দূর্বিপাক, মহামারিতে শ্রমিকদের জীবন যে কত অনিশ্চিত তারই নিষ্ঠুর চিত্র ভেসে উঠলো করোনা মহামারিতে। সারাদেশে প্রায় ৩০ লক্ষ হোটেল শ্রমিকের মধ্যে অর্ধেক শ্রমিক করোনার কারণে চাকরিচ্যূত হয়ে এখন অর্ধাহারে-অনাহারে দিনাতিপাত করছে।
গত বছরের ২৬ মার্চ ‘সাধারণ ছুটি’ (যা পর্যায়ক্রমে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়) ঘোষণার পর যারা বাড়িতে গিয়েছিল বা ঢাকাতে অবস্থান করছিল তারা বেঁচে আছে না মরে গেছে তারও খোঁজ নেয়নি, মজুরিও দেয়নি মালিকরা। বঞ্চিত করা হয়েছে উৎসব ভাতা থেকেও। সীমিত আকারে হোটেল চালু হলে করোনার অজুহাতে অর্ধেক শ্রমিক দিয়ে চালু করে আজও তা অব্যাহত রেখেছে। একদিকে ডিউটি করতে হচ্ছে বারো থেকে তেরো ঘণ্টা। কিন্তু দেওয়া হয় না অতিরিক্ত কাজের দ্বিগুণ মজুরি। হোটেল শ্রমিকরা পায়নি সরকার ঘোষিত প্রণোদনা। জীবন আর জীবিকার প্রয়োজনে আজও অনেক হোটেল শ্রমিক রিকশা চালাচ্ছে। কেউবা ফুটপাতে ফল, সবজি বিক্রি করছে। কেউ ভ্যানে ভ্যানে হকারি করছে। আবার কেউ বা মুটে-মজুরের কাজ করছে। যে সামান্য অংশ পরিবার-পরিজন নিয়ে ঢাকাতে থাকতো তারা টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করেও টিকতে না পেরে শেষ পর্যন্ত পরিবার-পরিজন বাড়িতে পাঠাতে বাধ্য হয়েছে। নিজে উঠেছে মেসে। আজ আবার করোনা বাড়ার সংবাদে লকডাউন শুরু হওয়ায় শ্রমিকদের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তা।
একদিকে ডিউটি করতে হচ্ছে বারো থেকে তেরো ঘণ্টা। কিন্তু দেওয়া হয় না অতিরিক্ত কাজের দ্বিগুণ মজুরি। হোটেল শ্রমিকরা পায়নি সরকার ঘোষিত প্রণোদনা। জীবন আর জীবিকার প্রয়োজনে আজও অনেক হোটেল শ্রমিক রিকশা চালাচ্ছে। কেউবা ফুটপাতে ফল, সবজি বিক্রি করছে। কেউ ভ্যানে ভ্যানে হকারি করছে। আবার কেউ বা মুটে-মজুরের কাজ করছে।
গত বছরের অভিজ্ঞতায় শ্রমিকরা দেখেছে কর্মহীন হওয়ার পর তাদের দুঃসহ-দুর্বিষহ সময়ে রাষ্ট্র, সরকার, মালিক, জনপ্রতিনিধি কেউ-ই তাদের খোঁজ নেয়নি। শ্রমিকদের সংগঠন দাবি-দাওয়া এবং তালিকা নিয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে প্রেরণ করে সাধ্যানুযায়ী ভূমিকা রেখেছে। তাই শ্রমিকদের নিজেদের প্রয়োজনেই নিজেদের সংগঠনকে শক্তিশালী করে জীবন ও জীবিকার রক্ষায় সংগ্রামের বিকল্প নেই। হোটেল সেক্টরসহ ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার ভিন্নতা থাকলেও একই চিত্র ফুটে ওঠে সবার জীবনে। আজ তাই জীবিকার প্রয়োজনে ন্যায্য হিস্যা বুঝে নিতে দাঁড়াতে হবে একই কাতারে। সংগ্রাম করতে হবে নিজের স্বার্থে সচেতনভাবে। চিনতে হবে মজুরি শোষণকে আড়াল করে সংগ্রামের পরিবর্তে সমঝোতার ফেরিওয়ালা শ্রমিক নেতৃত্ব ও সংগঠনকে। আজ গণতান্ত্রিক শ্রম আইন, বাঁচার মত ন্যূনতম মজুরি, অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার আর নিরাপদ কর্মস্থলের দাবিতে সংগ্রামের পথ ধরে লাগাতার কর্মবিরতির পথে সমাধানের রাস্তা খুঁজতে হবে। আর চুড়ান্ত মুক্তির জন্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা।
প্রকাশ দত্ত: যুগ্ম-সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ। ইমেইল: pkdutta.dhaka@gmail.com
২
বন্ধ করে দেওয়া জুটমিলের বদলি শ্রমিক
মিলের চাকা বন্ধ হয়েছে ১০ মাস আগে, জীবনের চাকা চলছে অর্ধাহারে-অনাহারে-অনিশ্চয়তায়
শহীদুল ইসলাম সবুজ
ডেমরা শিল্প এলাকার কাছের গ্রাম দেইল্লা। গ্রামটি আবার দুই পাড়ায় বিভক্ত। পূর্ব ও পশ্চিমপাড়া। যাত্রাবাড়ী-ডেমরা সড়কের, ডেমরা বাসস্ট্যান্ডের পশ্চিম পাশে দেইল্লা বাসস্ট্যান্ডে নেমে গ্রামটিতে প্রবেশ করা যায়। স্বাভাবিকভাবেই হাঁটা দূরত্বের কাছাকাছি অনেক শিল্পকারখানা থাকায় প্রচুর শ্রমজীবী মানুষের বসবাস গ্রামটিতে।
পরিচিত একজনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকল শ্রমিকদের খোঁজে সানারপাড় পর্যন্ত যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু উন্নয়নের তোড়ে অস্তিত্বহীন হয়ে যাওয়া যাত্রাবাড়ী-ডেমরা সড়কে দেইল্লা বাসস্ট্যান্ডের আগেই জ্যামে আটকে যায় বাস। ড্রাইভার-কন্ডাক্টর দুজনেই কোরাসে চিল্লাচ্ছে: ‘সবাই নামেন ভাই, তাড়াতাড়ি নামেন, গাড়ি ঘুরামু, সামনে জ্যাম দ্যাখতাছেন তো, হাঁইট্টা গ্যালে আগে যাইবেনগা।’ যাত্রীরা দু-একজন ডেমরা পর্যন্ত যাওয়ার জন্য গোঁ ধরলেন। ড্রাইভার কারো কথায় কান না-দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে দিলেন। চৈত্র সংক্রান্তির মধ্যদুপুর, মাথার ওপর খাড়া সূর্যের তাপ, পায়ের নিচে ভাঙাচোরা রাস্তায় বালু, মাটি, কাঠ, রডসহ নানান নির্মাণসামগ্রী। ডেমরার যাত্রীরা এর মধ্য দিয়েই হাঁটা শুরু করতে বাধ্য হলেন।
একটু সামনে এগিয়ে বাঁয়ে দেইল্লা পশ্চিমপাড়া ঢোকার রাস্তার মুখে, স্থানীয় যুবক মাছ ধরার সামগ্রীর দোকানির সঙ্গে পরিচিত হয়ে পাটকল শ্রমিকদের অবস্থানের কথা জানতে চাইলে, প্রথমে কিছুই বলতে চাইলেন না। এমনকি নিজের নামটাও বলতে চাইলেন না। বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকলবিষয়ক কোনো কথাই নাকি বলা নিষেধ গ্রামে। কিছুক্ষণ আলাপে একটু সহজ হলেন। কাছাকাছি চা-এর দোকান আছে কি না, জানতে চাইলে বললেন: ‘গলি ধরে সামনের দিকে আগাইতে থাকেন, মোড়ে চা-র দোকান পাইবেন, সেইখানে আলাপ করলেই দুই-চারজন পাটকল শ্রমিকের খোঁজ পাইবেন।’ পাশে থাকা একজন বললেন: ‘এই যে যারা নামাজের জন্য মসজিদে আইতেছে তাদের মধ্যেও দুই-একজন পাটকল শ্রমিক আছে।’ গলির ভেতরের দিকে হাঁটা শুরু করলে তিনিও সঙ্গী হলেন। তাঁর সহযোগিতায় দেখা হলো মাঝবয়সি পাটকল শ্রমিক সালাউদ্দিন, তারেকুল আহসান ও মো. নূর করিমের সঙ্গে। তিনজনেই জানালেন, কাজ করার সামর্থ্য থাকলেও বয়স বেশি বলে তাদের কেউ কাজ দেয় না এখন, অসহায় কর্মহীন জীবনযাপন করছেন। তাঁরা নামাজে যাচ্ছেন বলে আর কথা বাড়ালাম না।
মাছ ধরার সামগ্রীর দোকানির সঙ্গে পরিচিত হয়ে পাটকল শ্রমিকদের অবস্থানের কথা জানতে চাইলে, প্রথমে কিছুই বলতে চাইলেন না। এমনকি নিজের নামটাও বলতে চাইলেন না। বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকলবিষয়ক কোনো কথাই নাকি বলা নিষেধ গ্রামে।
এগিয়ে মোড়ে চায়ের দোকান পাওয়া গেল। দুজন চা পান করছেন। চায়ের অর্ডার দিয়ে দোকানির কাছে পাটকল শ্রমিকদের অবস্থান জানতে চাইলে বললেন: ‘নোয়াখাইল্লা বাড়িতে বাচ্চু শেখ নামে একজন থাকে, করিম জুটমিলে কাম করত। ওর বউও কোনো একটা জুটমিলে কাম করত, ওদের পাইলে আপনার কাম হইয়া যাইব।’ আরো দু-একজনের সহায়তায় নূর আলম ও জাকির মিয়াদের নোয়াখাইল্লা বাড়িতে পৌঁছলাম। বাচ্চু শেখের বাসায় তখন ওঁরা কেউ নেই। একজন নারী বললেন: ‘বাচ্চু কামে গেছে, ওর বউ আনু আমার ঘরে কাম করতাছে, ডাইকা দিতাছি।’
এক বছরের বেশি বয়সি শিশু কোলে ২০ বছরের কাছাকাছি বয়সি আনু বেগম এলেন। আক্ষরিক অর্থেই অর্ধাহার-অনাহারের প্রভাব অবয়বজুড়ে। অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকে তাঁর স্বামী বাচ্চু শেখের জন্য অপেক্ষা আর দীর্ঘ আলাপ। সঙ্গে তাঁর সদা হাস্যোজ্জ্বল শিশুসন্তান ইউছুব শেখের প্রাণবন্ত দুষ্টুমি। কান্না-হাসি যার একসঙ্গেই বহমান। কলম, ফোন, নোটবুক সবই তার দরকার। এগুলো একটু হাতে নিতে পারলেই, মিষ্টি হাসি দিয়ে ফেরত দেওয়ার মধ্যে তার আনন্দ। সঙ্গী হলেন পাশের বাসার নারী ও তার ৭/৮ বছরের শিশুসন্তান।
আনু বেগম বন্ধ করে দেওয়া করিম জুটমিল-২-এর বদলি শ্রমিক ছিলেন। তাঁর কার্ড নম্বর ৭৫৩। তিনি সুইং সেকশনের হেলপার ছিলেন। বন্ধ করে দেওয়ার আগে তিন বছর কাজ করেছেন আনু বেগম। ২০২০ সালের ১ জুলাই তাঁর মিলটি করোনা মহামারির মধ্যেই বন্ধ করে দেয় সরকার! তিনি ৩০০ টাকা হাজিরায়, মাসিক নয় হাজার টাকা মজুরি পেতেন। বাসা থেকে হেঁটেই প্রতিদিন মিলে যাতায়াত করতেন। এখন পাশের বাড়িওয়ালার ঘরে থালাবাসন ধোয়ার কাজ করেন। মাসে ৫০০ টাকা মজুরি পান!
আনু বেগম বন্ধ করে দেওয়া করিম জুটমিল-২-এর বদলি শ্রমিক ছিলেন। তাঁর কার্ড নম্বর ৭৫৩। তিনি সুইং সেকশনের হেলপার ছিলেন। বন্ধ করে দেওয়ার আগে তিন বছর কাজ করেছেন আনু বেগম। ২০২০ সালের ১ জুলাই তাঁর মিলটি করোনা মহামারির মধ্যেই বন্ধ করে দেয় সরকার! তিনি ৩০০ টাকা হাজিরায়, মাসিক নয় হাজার টাকা মজুরি পেতেন। বাসা থেকে হেঁটেই প্রতিদিন মিলে যাতায়াত করতেন। এখন পাশের বাড়িওয়ালার ঘরে থালাবাসন ধোয়ার কাজ করেন। মাসে ৫০০ টাকা মজুরি পান!
স্বামী বাচ্চু শেখের নিয়মিত কাজ থাকে না। চারদিকে করোনা মহামারির কারণে মানুষ কাজ কম করায়। রাজমিস্ত্রির হেলপারের কাজ যেদিন থাকে সেদিন ৩০০ টাকা মজুরি পান। নিজে মাসে ৫০০ টাকা আর স্বামীর কাজ জুটলে ৩০০ টাকা হাজিরায় যা পান, তা দিয়ে ঘরভাড়া আড়াই হাজার টাকা, আর দু-বেলার আহার জোটানো দায়। শিশুটির জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য বা খেলনা কিনে দেওয়ার সামর্থ্য তাদের হয় না।
শিশুসন্তানটি পেটে থাকা অবস্থায়ও করিম জুটমিলে কাজ করতেন আনু বেগম। দুই ভাই, দুই বোনের সবার ছোট আনু বেগম সন্তান জন্মদানের জন্য ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার চর পশ্চিম লেংগুটিয়ায় নানির কাছে যান। ঢাকায় তাকে সহযোগিতা করার মতো কেউ নেই। গ্রামে নানি আর তাঁর এক দিনমজুর ভাই থাকেন। মা-বাবা মারা গেছেন শিশুবয়সেই। আরেকটি বোন আছে, বিবাহিত, স্বামীর সঙ্গে থাকেন। ডেমরা ঘাট এলাকায় বালুশ্রমিক হিসেবে কর্মরত তাঁর বড়ভাই কাওসার মিথ্যা কথা বলে ফুসলিয়ে ঢাকায় এনে প্রায় ৫০ বছর বয়সি বাচ্চু শেখের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেন। বাচ্চু শেখ তাঁকে বিয়ে করার আগে আরো ৩টি বিয়ে করেছিলেন। সেই তিন বউয়ের একজনও বেঁচে নেই। তবে বাচ্চু শেখ স্ত্রী হিসেবে আনু বেগমকে খুবই ভালোবাসেন।
তাদের ১০ ফুট বাই ৮ ফুটের টিনের ঘরটির মেঝেটা পাকা। উপরে টিনের গরম থেকে বাঁচার জন্য চাটাইয়ের মাচান। আসবাবপত্র বলতে একটা ঘুমানোর চৌকি। চৌকিতে বিছানো দু-খানা ছেঁড়া কাঁথা, বালিশ, আধখোলা মশারি। টিনের বেড়ার সঙ্গে ঝোলানো রশিতে নিজেদের ব্যবহার্য দু-একটা কাপড় আর একটি আয়না। টিনের বেড়া আর খুঁটির ফাঁকে ঝোলানো প্লাস্টিকের ডাল ঘুঁটনি। টিনের বেড়ার সঙ্গে একটি তেলের টিনের ওপর কিছু পুরোনো কাপড়-চোপড়, ব্যাগ। চৌকিলাগোয়া একটি খানাডুলি, যার মধ্যে ২/৩টি হাঁড়ি, দুটি চামচ, দুটি প্লেট, একটি গ্লাস, একটি প্লাস্টিকের পানির জগ ও আধা লিটারের দুটি পানির বোতল, টিনের বেড়ায় ঝোলানো আরেকটি প্লাস্টিকের বোতলের তলায় একটু ডিটারজেন্ট পাউডার। খানাডুলির পাশেই প্লাস্টিকের টুলের ওপর কাঁথা রাখা।
আসবাবপত্র বলতে একটা ঘুমানোর চৌকি। চৌকিতে বিছানো দু-খানা ছেঁড়া কাঁথা, বালিশ, আধখোলা মশারি। টিনের বেড়ার সঙ্গে ঝোলানো রশিতে নিজেদের ব্যবহার্য দু-একটা কাপড় আর একটি আয়না। টিনের বেড়া আর খুঁটির ফাঁকে ঝোলানো প্লাস্টিকের ডাল ঘুঁটনি। টিনের বেড়ার সঙ্গে একটি তেলের টিনের ওপর কিছু পুরোনো কাপড়-চোপড়, ব্যাগ। চৌকিলাগোয়া একটি খানাডুলি, যার মধ্যে ২/৩টি হাঁড়ি, দুটি চামচ, দুটি প্লেট, একটি গ্লাস, একটি প্লাস্টিকের পানির জগ ও আধা লিটারের দুটি পানির বোতল, টিনের বেড়ায় ঝোলানো আরেকটি প্লাস্টিকের বোতলের তলায় একটু ডিটারজেন্ট পাউডার। খানাডুলির পাশেই প্লাস্টিকের টুলের ওপর কাঁথা রাখা।
তাদের রান্নাঘর বসবাসের ঘর থেকে একটু দূরে। সেখানে ৩টি পরিবার একটি চুলায় রান্না করে। আনু বেগমের রান্নার পালা ছিল সকাল ১০টার দিকে। তখনই তিনি দুপুরের রান্নার কাজ সেরে রেখেছেন। টয়লেট, পানির কলও একটু দূরে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়।
ঘণ্টা খানেকেরও বেশি সময় আলাপে আনু বেগম অন্তত সাত-আটবার স্বামী বাচ্চু শেখের আসার পথে উঁকি দিলেন। তিনি এসে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার কাজে যাবেন। দুপুর ২টা ১০ মিনিটে বাচ্চু শেখকে আসতে দেখে আনু বেগম এগিয়ে গেলেন। বাসায় অচেনা আগন্তুকের কথা জানালেন। কলপাড়ে হাত-মুখে পানি দিয়ে বাচ্চু শেখ ঘরে ঢুকলেন। আগেই আনু বেগমের সঙ্গে আলোচনায় ঠিক হয়েছিল, তাঁর স্বামী আসার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তাকে খাবার দেবেন–তাই হলো। একটি প্লেটে ভাত, এক টুকরো তেলাপিয়া মাছ ভাজা, একটু আলুর ভর্তা আর পাতলা ডাল দিয়ে তার খাওয়ার মধ্যেই আলোচনা চলছিল। আনু বেগম খাচ্ছেন না কেন–জানতে চাইলে বললেন, আগেই খেয়ে নিয়েছেন। কিন্তু কখন খেলেন আনু বেগম! স্বামীকে খাইয়ে পুরো দিনই হয়তো না-খেয়ে কাটবে তাঁর।
বাচ্চু শেখের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর সদর উপজেলার ফরক্কাবাদের বালিয়ায়। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। করিম জুটমিল-১-এ বদলি শ্রমিক হিসেবে প্রায় ১৫ বছর কাজ করেছেন তিনি। ৪০০ টাকা হাজিরায় বছরের পর বছর কাজ করে যখন তার হাজিরা ৫০০ টাকা হলো, ১ জুন ২০২০ তারিখে তাঁর চাকরি যখন স্থায়ী হলো, তখনই এক মাসের মাথায় মিলটি বন্ধ করে দেওয়া হলো। ৩০ জুন ২০২০ সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফিরে বউয়ের সঙ্গে গল্প করতে করতেই শোনেন তার বহু বছরের পুরোনো কর্মস্থল করিম জুটমিল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শুধু করিম জুটমিলই নয়, ডেমরায় অবস্থিত সরকারি মালিকানাধীন সব জুটমিল বন্ধের ঘোষণা আসে সেদিন। শ্রমিক অধ্যুষিত দেইল্লা গ্রামজুড়ে সেদিন ছিল কবরের নিস্তব্ধতা। এই গ্রামের অনেক শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা সেদিন হাউমাউ করে কেঁদেছেন। সরকারের এক ঘোষণায় সবাই হয়ে গেলেন কর্মহীন–উপার্জনহীন! সামনের দিনগুলোয় তাদের সংসার কীভাবে চলবে, কী খাবেন, সন্তানদের লেখাপড়া কীভাবে চালাবেন–এই নিয়ে দুনিয়ার দুশ্চিন্তা পরিবারগুলোকে ঘিরে ধরেছে।
শুধু করিম জুটমিলই নয়, ডেমরায় অবস্থিত সরকারি মালিকানাধীন সব জুটমিল বন্ধের ঘোষণা আসে সেদিন। শ্রমিক অধ্যুষিত দেইল্লা গ্রামজুড়ে সেদিন ছিল কবরের নিস্তব্ধতা। এই গ্রামের অনেক শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা সেদিন হাউমাউ করে কেঁদেছেন। সরকারের এক ঘোষণায় সবাই হয়ে গেলেন কর্মহীন–উপার্জনহীন! সামনের দিনগুলোয় তাদের সংসার কীভাবে চলবে, কী খাবেন, সন্তানদের লেখাপড়া কীভাবে চালাবেন–এই নিয়ে দুনিয়ার দুশ্চিন্তা পরিবারগুলোকে ঘিরে ধরেছে।
মিল বন্ধ করে দেওয়ার কয়েক মাস পর, মিল থেকে তাকে সাত হাজারের কিছু বেশি এবং তার স্ত্রী আনু বেগমকে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল। আরো কিছু টাকা তাদের দেবে বলেছে মিল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কবে সেই টাকা তারা পাবেন, তার নিশ্চয়তা দিচ্ছে না মিল কর্তৃপক্ষ। দেনা শোধ আর ঘরভাড়া দিয়ে সে টাকা এক মাসেই শেষ হয়ে যায়। তারপর থেকেই শুরু হয় তাদের অনাহার-অর্ধাহারের জীবন।
লোকসানের অজুহাতে জুটমিলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হলো, সেই আলোচনা আসতেই উপস্থিত আহমেদ বাওয়ানী জুটমিলে ৩৫ বছর চাকরি করা আব্দুল কাদির জানালেন: ‘আমরা শ্রমিকরা তো নিয়মিতই কাজ করেছি। একসময় এই পাটকলের চাকরিই ছিল সোনার হরিণের মতো। আশির দশকের শুরুতে কম শিক্ষিত যুবকরা জুটমিলকে কেন্দ্র করে রঙিন স্বপ্ন দেখত। তখন অন্য চাকরির সুযোগ তেমন একটা ছিল না। যাও-বা ছিল, সেখানে কর্মরত কর্মচারীরা বোনাস পেতেন না। জুটমিল শ্রমিকরা বোনাস পেতেন। তখন আরো বেশকিছু আর্থসামাজিক সুযোগ-সুবিধা ছিল জুটমিল শ্রমিকদের জন্য। সে কারণেই তখনকার যুবকরা নিজেদের উন্নত ভবিষ্যতের আশায় জুটমিলে চাকরি নিতেন। কিন্তু আজ কারখানার চাকা তো চিরতরে বন্ধ হয়েছেই, সঙ্গে শ্রমিকদের জীবনের চাকাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে!’
তিনি আরো বলেন: ‘একসময় পাটই ছিল সরকারের আয়ের প্রধান উৎস। বৈদেশিক মুদ্রার বেশিরভাগ আয় হতো পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে।’
সরকারের কৃষিতথ্য সার্ভিসের হিসাবেও স্বাধীনতার পর দেড় যুগ ধরে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পাটের অবদানই ছিল বেশি।
আব্দুল কাদির আরো বলেন: ‘৩৫ বছরের চাকরিজীবনে দেখেছি, পাটকলগুলোর লোকসানের মূল কারণ হলো, প্রথম সারির কর্মকর্তাদের অব্যাহত সর্বগ্রাসী দুর্নীতি এবং লুটপাট। কৃষকের কাছ থেকে পাট ক্রয় থেকে শুরু করে, পাটপণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ পর্যন্ত সর্বত্রই ছিল দুর্নীতি এবং লুটপাটের উৎসব। যন্ত্রপাতি আধুনিকায়নের কোনো বালাই ছিল না। কোথাও সামান্য আধুনিকায়নের উদ্যোগ দেখা গেলেও লুটপাট আর দুর্নীতির কারণে তা আলোর মুখ দেখত না।’
যার অনিবার্য পরিণতি জুটমিল বন্ধ আর আমাদের শ্রমিকের জীবনে নেমে আসা অসহনীয় বেকারত্ব, অর্ধাহার আর অনাহার!
শহীদুল ইসলাম সবুজ, রাজনৈতিক সংগঠক
ইমেইল: sabuj.shahidul933@gmail.com
677