পুরুষতান্ত্রিক সহিংসতা, নিপীড়ন ও বঞ্চনার বাস্তবতায় গড়া নারীর মানস

নারী-পুরুষের মানস : পুরুষতান্ত্রিক ধারণা ও বৈষম্যের জৈবসামাজিক ভিত্তি-৬

পুরুষতান্ত্রিক সহিংসতা, নিপীড়ন ও বঞ্চনার বাস্তবতায় গড়া নারীর মানস

মনিরুল ইসলাম

“ (জিম্মি আটকের ঘটনায়) আটককারী যেমন তাদের কাঙ্ক্ষিত জিনিস পাওয়ার জন্য কিছু জিম্মিকে হত্যা বা কমপক্ষে আহত করে, পুরুষেরা তেমনি নারীদেরকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তাদের কাঙ্ক্ষিত জিনিস পাওয়ার জন্য: (তারা চায়) নারীদের কাছ থেকে যৌন, আবেগগত, গৃহস্থালী এবং প্রজননগত অব্যাহত সেবা। জিম্মিরা যেমন খুন হওয়া থেকে বাঁচার জন্য আটককারীদের সন্তুষ্ট করতে চায়, নারীরাও তেমনি পুরুষকে সন্তুষ্ট করার জন্য কাজ করে যায়, তাদের এই প্রচেষ্টা থেকেই উৎসারিত হয় নারীসুলভ মানসিকতা। নারীসুলভ মানসিকতা বলতে আমরা (নারীদের) সেই সব আচরণসমূহকেই বুঝি যা (কর্তৃত্বময়) পুরুষকে সন্তুষ্ট করে, কারণ এতে বোঝা যায় যে নারী তার অধস্তন অবস্থা মেনে নিয়েছে।” ৭০

-ডি এল আর গ্রাহাম, Loving to Survive: Sexual Terror Men’s Violence & Women’s Life

“নারীর উপর সহিংসতা (বিদ্যমান) লিঙ্গবৈষম্যের বহিঃপ্রকাশ। এতে (নারী-পুরুষের) অসম ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে পুরুষতন্ত্রের মনোভাবও প্রকাশিত হয়। যুগ যুগ ধরে ক্ষমতাহীন ও অবদমিত হবার কারণে নারীরা পুরুষতন্ত্রের হাতে অরক্ষিত শিকারে পরিণত হয়েছে। লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার মধ্যে রয়েছে ভয়ঙ্কর সব অপরাধ যেমন- ধর্ষণ, পারিবারিক সহিংসতা, মেয়ে ভ্রুণ হত্যা, যৌতুকের কারণে হত্যা, নারী-পাচার, এসিড নিক্ষেপ, সম্মান রক্ষার্থে হত্যা (তালিকা আরও দীর্ঘ) …সম্ভাব্য অপরাধীরা প্রায়ই স্বামী, বাবা, ছেলে, বন্ধু ইত্যাদি মুখোশের আড়ালে থাকে।”৭১

-রাজীব কাউর, Violence Against Women: Patriarchy And Power Politics

১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয় আফ্রিকান আমেরিকান লেখক আলেক্স হ্যালির সত্য ঘটনা ভিত্তিক উপন্যাস Roots: The Saga of an American Family। যেখানে আফ্রিকার মানুষদের জোর করে দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ করার এক নির্মম কাহিনির অসাধারণ বর্ণনা রয়েছে। উপন্যাসটি প্রকাশিত হবার পরের বছরই তৈরি হয় এর উপর ভিত্তি করে টেলিভিশন মিনিসিরিজ Roots ; বিটিভির কল্যাণে বাংলাদেশের দর্শকেরাও ছবিটি দেখেছিলেন। ছবিটি দেখে একটা ব্যাপার আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছিল- নিরীহ মানুষকে দাসত্বে বাধ্য করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে সহিংসতা ও নিপীড়ন। মানব সমাজের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, যেকোনো অসম ক্ষমতা-সম্পর্ককেই টিকিয়ে রাখার জন্য শেষ পর্যন্ত সহিংসতা ও নিপীড়নের উপর অথবা এগুলোর হুমকির উপর নির্ভর করতে হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অধস্তন ও অবদমিত গোষ্ঠী হিসেবে নারীও এর ব্যতিক্রম নয়। নারীকে তার অধস্তন অবস্থান এবং অসম ক্ষমতা-সম্পর্কের মধ্যে রাখার ক্ষেত্রেও পুরুষতান্ত্রিক পরিবার এবং সমাজের কাছে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে সহিংসতা ও নিপীড়ন। এ সমাজে মোটের উপর প্রতি তিনজনে একজন নারী সহিংসতা ও নিপীড়নের শিকার হন এবং তাদের ব্যাপক অধিকাংশই এগুলোর ভীতি ও হুমকির মধ্যে থাকেন। ১৯৭০ এর দশক থেকেই নারীবাদীরাই (বিশেষত র‌্যাডিক্যাল ফেমিনিস্টরা) গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য করেন এই ভীতি ও হুমকি যে সামাজিক বাস্তবতা তৈরি করে তা নারীর মানসিক প্রকৃতির গঠনে এবং এর গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।৭২ তাঁরা আরও লক্ষ্য করেন যে, অন্যান্য অসম সম্পর্কের ক্ষেত্রে সহিংসতা ও নিপীড়নের যে চরিত্র নারীর ক্ষেত্রে তা ভিন্ন প্রকৃতির কারণ নারীর উপর নিপীড়নের বড় অংশ হচ্ছে যৌন-নিপীড়ন।

যেকোনো অসম ক্ষমতা-সম্পর্ককেই টিকিয়ে রাখার জন্য শেষ পর্যন্ত সহিংসতা ও নিপীড়নের উপর অথবা এগুলোর হুমকির উপর নির্ভর করতে হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অধস্তন ও অবদমিত গোষ্ঠী হিসেবে নারীও এর ব্যতিক্রম নয়।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বাস্তবতা এমন যে নারীর ক্ষেত্রে সবচেয়ে নাজুক, দুর্বল এবং গ্লানির জায়গা হচ্ছে তার যৌনতা এবং যৌন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ । অতএব, নারীকে সবচেয়ে নির্মমভাবে আঘাত করার উপায় হচ্ছে যৌন নিপীড়ন। বেশিরভাগ রক্ষণশীল সমাজ, পশ্চাৎপদ ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী নারীর উপর যৌন-নিপীড়ন যার দ্বারাই সংঘটিত হোক এর মুখ্য গ্লানি হচ্ছে আক্রান্ত নারীর। পশ্চাৎপদ সমাজে এই গ্লানি বা ‘কলঙ্ক’ এমন এক গ্লানি যা কোনো কিছু দ্বারাই মোচনীয় নয়। যে সমাজ যত পশ্চাৎপদ সে সমাজে এই মনোভাব তত গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে আছে। ১৯৭১ সালে এদেশের যে সব নারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্রে আটক ছিলেন এবং নির্মমভাবে তাদের অপমান ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন তাদের অনেকের পরিবার আর তাদের ফিরিয়ে নেয় নি; এসব পরিবারের লোকেদের ভাষ্য এমন ছিল যে মেয়েটি বেঁচে না থেকে মরে গেলেই তারা স্বস্তি পেত। এখনও আমাদের দেশে কোনো নারী যৌন-নিপীড়নের শিকার হলে (যদি সে জীবিত থাকে) সংবাদ-মাধ্যমে তার নাম প্রকাশ করা হয় না। এই বাস্তবতা থেকে অনুমান করা যায় যৌন-নিপীড়নের নেতিবাচক প্রভাব কতটা নির্মম ও গভীরভাবে আক্রান্ত নারীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করতে পারে।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বাস্তবতা এমন যে নারীর ক্ষেত্রে সবচেয়ে নাজুক, দুর্বল এবং গ্লানির জায়গা হচ্ছে তার যৌনতা এবং যৌন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ । অতএব, নারীকে সবচেয়ে নির্মমভাবে আঘাত করার উপায় হচ্ছে যৌন নিপীড়ন।

এই বিপর্যস্ত অবস্থা শুধু তার নয় যে নিপীড়িত হল, এর প্রভাব পড়ে সমাজের সকল নারীর উপর। ‌র‌্যাডিক্যাল ফেমিনিস্ট লেখক অ্যান্ড্রিয়া ডরকিনের ভাষায়- “যদিও এদেশের তিনজনের মধ্যে একজন মেয়ে ১৮ বছর হবার আগেই নিকটাত্মীয় দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, কিন্তু তুমি তাদের একজন নও, এবং প্রতি তিন মিনিটে যদি একজন নারী ধর্ষিত হয় কিন্তু তুমি কখনও তাদের মধ্যে ছিলে না এবং প্রতি ১৮ সেকেন্ডে একজন নারী পেটানোর শিকার হয়, কিন্তু তুমি হয়তো এদের মধ্যে নেই”… কিন্তু তুমি কি অস্বীকার করতে পার যে এই নির্দয় নির্মম মারমুখী পৃথিবীর বাস্তবতা বালিকা ও তরুণীকে সর্বদা আতঙ্কগস্ত রাখে, তাদের মানসিক ও শারীরিক অস্তিত্বকে হুমকির সম্মুখিন করে।”৭৩ দাসমালিকের আদেশ অমান্য করার কারণে কিংবা পালিয়ে যাবার চেষ্টার কারণে দাসদের উপর চরম নিষ্ঠুর অত্যাচার চালানো হত, কখনও কখনও তাদের হত্যা করে বেশ কিছুদিন প্রকাশ্যে লাশ ঝুলিয়ে রাখা হত। এই সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতার প্রভাব পড়ত অন্য দাসদের উপর। এর বিনিময়ে পাওয়া যেত তাদের বশ্যতা এবং বাধ্যতা। কিছু নারীর উপর পুরুষতান্ত্রিক পরিবার ও সমাজের নিপীড়নও  অন্যান্য নারীদের মধ্যে আতঙ্ক ও হুমকি ছড়িয়ে দেয় এবং আদায় করে নেয় বশ্যতা ও বাধ্যতা।

সরাসরি নিপীড়ন না করেও বশ করার কিছু পরোক্ষ উপায়ও আছে যা নারীর উপরে প্রায়ই প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।‘বিয়ের রাতে বিড়াল মারা’ কিংবা ‘ঝিকে মেরে বৌকে শিক্ষা দেওয়া’র প্রবাদ আমরা শুনেছি। সামান্য কারণে একজনের উপর সহিংসতা দেখিয়ে অন্যদের পরোক্ষভাবে হুমকির মধ্যে রাখা যায়। বশ করার অন্য একটি উপায় হল নারীকে ক্ষমতাহীন করা কিংবা সে যে ক্ষমতাহীন সেটা তাকে পদে পদে বুঝিয়ে দেয়া। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত কমেডি নাটক দ্যা টেমিং অফ দ্যা শ্রু-তে(মুখরা রমণী বশীকরণ) আমরা এই উভয় কায়দার বশীকরণ কৌশলই দেখতে পাই। যেখানে একজন ‘মুখরা’, ‘ঝগড়াটে’ এবং ‘অবাধ্য’ নারী ক্যাথেরিনকে বশ করেন তার স্বামী পেট্রোশিও। পেট্রোশিও প্রথমে ক্যাথেরিনের কাছে প্রমাণ করেন তিনি খাম-খেয়ালি এবং যথেচ্ছাচারী কিন্তু তুচ্ছ কারণে হতে পারেন নিষ্ঠুর। তিনি সত্যি সত্যি ‘চাকরের উপর রাগ করে’ বাসরঘরে আছাড় দিয়ে একটা বিড়াল মেরে ফেলেন। বিয়ের পর কোনো আনুষ্ঠানিকতার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত বউকে বাপের বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যান। মেয়েটি যতই অবাধ্য হোক বাপের বাড়ির বাইরে তার কোনো ক্ষমতা নেই। এই সুযোগে পেট্রোশিও যখন কায়দা করে তার ঘুম, খাওয়া-দাওয়া ‘হারাম’ করে দিল তখন এই চরম অবাধ্য মেয়েটিও বশ্যতা মানতে বাধ্য হল। এটি একটি ‘হাসির’ নাটক, কিন্তু ভিন্ন দৃষ্টিতে আমরা দেখি এখানে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা কী করে তাদের অধস্তন অবস্থা মেনে নিতে বাধ্য হয় সেই করুণ কাহিনিটিও রয়েছে। ক্যাথেরিনের মতো এখনও নিপীড়নের ভয় এবং ভাত-কাপড়-আশ্রয়ের দায়ে এ সমাজের বেশিরভাগ নারীর ‘অবাধ্য’ মন বশ্যতা মেনে নেয়।

নারীর মধ্যে অন্তর্মুখীতা, আক্রান্ত হবার ভীতি, ঝামেলা এড়িয়ে চলার প্রবণতা, ‘রহস্যময়ীতা’ (নিজের মনোভাব আড়াল করার প্রবণতা), সংকোচ ও লাজুকতা ইত্যাদি পুরুষের তুলনায় বেশি থাকে। যার প্রতিফলন দেখা যায় তাদের আচরণের মধ্যে । যেমন, নির্বিবাদী হওয়া, মানিয়ে নেয়া, ছলনা বা কায়দা করে কথা বলা বা ভাব প্রকাশ করা, ‘সহজে’ গুটিয়ে যাওয়া, ঝুঁকি নিতে আগ্রহী না হওয়া ইত্যাদি আচরণগত বৈশিষ্ট্য তাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এগুলো অনেকাংশে আসে পুরুষতান্ত্রিক সহিংসতা ও নিপীড়ন সম্পর্কে তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এবং কিছুটা আসে বয়োজেষ্ঠ্য নারীদের দিক নির্দেশনা থেকে। ছোটবেলা থেকে মেয়েদের অভিজ্ঞতা হয়- প্রতিবাদী, মেনে না-নেওয়া, বহির্মুখী নারীদেরকেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষদের সহিংস আচরণ এবং নিপীড়নের শিকার হতে হয়। তাই বেশিরভাগ মেয়েকেই “মা ছোটবেলা থেকে শিখিয়েছেন, ‘বেশি প্রতিবাদ করলে ওরা পিষে মারবে, মাথা নিচু করে নিজের কাজ গুছিয়ে নে।”৭৪ অতএব এ সমাজে বেশিরভাগ মেয়েদের মধ্যে আমরা যে মনোভঙ্গি ও আচরণ লক্ষ্য করি, যা এ সমাজে ‘নারীসুলভ’ আচরণ বলে পরিচিত তা জন্মগত ভাবে নারীর মধ্যে আসেনি, এর বেশিরভাগটাই আসে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এসব প্রতিকূলতার সঙ্গে মানিয়ে নেবার প্রবণতা থেকে।

নির্বিবাদী হওয়া, মানিয়ে নেয়া, ছলনা বা কায়দা করে কথা বলা বা ভাব প্রকাশ করা, ‘সহজে’ গুটিয়ে যাওয়া, ঝুঁকি নিতে আগ্রহী না হওয়া ইত্যাদি আচরণগত বৈশিষ্ট্য তাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এগুলো অনেকাংশে আসে পুরুষতান্ত্রিক সহিংসতা ও নিপীড়ন সম্পর্কে তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এবং কিছুটা আসে বয়োজেষ্ঠ্য নারীদের দিক নির্দেশনা থেকে।

নিপীড়নের ভিত্তিভূমি দাসত্ব, বন্দীত্ব এবং অসহায়ত্ব

সাধারণত বন্দী ও দাসদের জীবন এত তুচ্ছ হয়ে থাকে যে খুব সহজেই তাদের হত্যা করা, নিপীড়ন করা, তাদের শরীর ও মনকে বিকৃত ও নিষ্পেষিত করা যায়। ক্রীতদাস (Slave), যুদ্ধবন্দী ও অন্যান্য বন্দী, নীচু জাতের মানুষেরা এ ধরণের নির্মম নিষ্পেষণের শিকার হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীও যে এরকম বন্দীত্ব ও দাসত্বের মধ্যে থাকে তা প্রায়ই আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। কিছু চরম নিদর্শন দেখলে এর স্বরূপ আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। গত কয়েক শতাব্দীর ইতিহাসেই রয়েছে নারীর বন্দীত্ব ও দাসত্বের তিনটি চরম নিদর্শন । তুচ্ছ কারণে নারীকে হত্যা করা এবং তার দেহ ও মনের চরম নিগ্রহের এসব নিদর্শন আমাদের সামনে মূর্ত করে তোলে তাদের বন্দীত্ব ও দাসত্বের শেকড় কত গভীরে প্রোথিত।  ১) শৈশব থেকে চীনা মেয়েদের উপর চাপিয়ে দেয়া অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক পায়ের পাতার বাঁধন, যা দিয়ে একে বিকৃত করা হয় (Chinese  Foot-binding), ২)  ইউরোপের ‘ডাইনি শিকার’ (Withch Hunting) অর্থাৎ অপয়া সন্দেহে বিনা দোষে নারীদের নির্মমভাবে নির্যাতন ও হত্যা করা এবং ৩) ভারতীয় নারীদের সহমরণ প্রথা, অর্থাৎ স্বামীর মৃত্যুর পর নারীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার প্রথা। নারীর প্রতি এসব সহিংস আচরণ নিষ্ঠুরতা ও বিবেচনাহীনতার দিক থেকে পৃথিবীর ইতিহাসের সংঘটিত চরম বর্ণবাদী এবং সাম্প্রদায়িক ঘটনাগুলোর সমকক্ষ।৭৫ আমেরিকা মহাদেশে ইউরোপীয়দের দ্বারা সংঘটিত নেটিভ আমেরিকানদের গণহত্যা, ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের ইহুদি গণহত্যা কিংবা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে চালানো পাকিস্তানি গণহত্যার মতই নির্মম এই ঘটনাগুলো।

বন্দীত্ব, দাসত্ব এবং অসম সম্পর্কে আবদ্ধ মানুষই সবচেয়ে বেশি এবং নিয়মিত নিপীড়নের শিকার হন। এখনও আমাদের সমাজে বেশিরভাগ নারীই এই চক্রে আবদ্ধ। নারীর বন্দীত্ব অর্থাৎ সীমাবদ্ধ পরাধীন জীবনের ভিত্তি হল পরিবার, বিবাহিত জীবন এবং সামাজিক বিধিনিষেধ। অধিকাংশ পরিবারই পুরুষতান্ত্রিক ভাবধারায় পরিচালিত হয় ফলে মেয়েদের চলাফেরা, স্বাধীন ইচ্ছা এবং মত প্রকাশও পরিবারের পুরুষদের তুলনায় অনেক সীমাবদ্ধ ও অবদমিত থাকে। বিয়ের পর বেশিরভাগ মেয়েকে নিজের পরিবার ছেড়ে শ্বশুর বা স্বামীর পরিবারে চলে যেতে হয়। সেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সীমাবদ্ধতা ও অবদমন আরও বেশি মাত্রায় থাকে। গৃহস্থালীর কাজ, সন্তান পালন এবং স্বামীর সেবা ও মনোরঞ্জনের কাজ দাসত্বের মতই নারীর জীবনে চেপে থাকে। এটাকে আপাতদৃষ্টিতে নির্ভেজাল শ্রম-বিভাজন মনে হলেও এটা কেবল তা নয়। অধিকাংশ মেয়ের ক্ষেত্রে এটি এক ধরণের দাসত্ব ছাড়া কিছু নয়। ‘বিয়ে করা বউ’ স্বামীর অধীনে থাকতে, তার ঘর সংসার সামলাতে, তার যৌনক্ষুধা মেটাতে, সন্তান জন্ম দিতে এবং সন্তান লালনপালন করার অধিকাংশ কাজ করতে বাধ্য। এটার কোনো ধরনের অন্যথা তার জন্য গর্হিত অপরাধ। স্ত্রী অসুস্থ থাকলে বা কর্মজীবী হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বামীরা গৃহস্থালী কাজ ও সন্তান পালনের কাজ করতে চান না। স্ত্রীর এসব কাজের স্বীকৃতি নেই বললেই চলে। মনে করা হয় স্বামী স্ত্রীকে ‘ভাত-কাপড় দেয়’ অতএব স্বামীর সেবা করা, তার অধীনস্থ ও আজ্ঞাবহ থাকা স্ত্রীর দায়িত্ব। স্ত্রীকে যতটা দাসী হিসেবে দেখা হয় ততটা মানুষ হিসেবে নয়।  বেশিরভাগ বিবাহিত সম্পর্কের মধ্যে দেখা যায় গৃহকর্মী এবং শয্যাসঙ্গী হিসেবে নারীর উপযোগিতা কমে গেলে তার উপর বৈষম্য ও অবহেলা নেমে আসে। স্বামীর সঙ্গতি থাকলে এসব ক্ষেত্রে তার ‘বিকল্প’ খোঁজা হয় (দ্বিতীয় বিয়ে বা রক্ষিতা)। এ যুগেও অসুস্থ স্ত্রীর জন্য অর্থব্যয়ে আগ্রহী হয় না বেশিরভাগ স্বামী। যদি তার পূর্ণবয়স্ক স্বাধীন সন্তান থাকে তারা হয়ত তাদের জন্য খরচ করে।

এই বন্দী ও অসহায় দাসত্বের জীবন প্রায়ই নারীর কাছে কষ্টকর ও অসহনীয় হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় তারা পারিবারিক বিধিনিষেধের বাইরে গিয়ে নিজের ইচ্ছে মতো কিছু করতে গেলে, কাজ করতে বা যৌনসঙ্গ দিতে অস্বীকার করলে কিংবা চাপিয়ে দেওয়া বিধিনিষেধ এবং অন্যান্য পেরেশানির প্রতিবাদ করলে পুরুষতান্ত্রিক পরিবারের সদস্যদের সহিংসতা ও নিপীড়নের শিকার হতে হয় তাদের। প্রতিটি সমাজের পরিসংখ্যানই বলে নারীরা সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হন পরিবারের সদস্যদের দ্বারা। “…খুন হওয়া প্রতি পাঁচজন নারীর চার জনই নিহত হন পুরুষ কর্তৃক, এদের (খুন হওয়া নারীদের) একতৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক পর্যন্ত খুনির সঙ্গে বিবাহিত সম্পর্কে আবদ্ধ ছিল। যদি আপনি প্রেমিক এবং প্রাক্তন স্বামীদের যোগ করেন এ সংখ্যা অনেক বাড়বে।”৭৬ হত্যা ছাড়াও নারীরা পরিবার ও পরিবারের বাইরে যে সব নির্মম নিপীড়নের শিকার হন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ধর্ষণ, অজাচার, যৌন-হয়রানি, এসিড সন্ত্রাস ইত্যাদি। এসবের শিকার না হলেও এসব সহিংস ঘটনার মধ্যে যে নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতা থাকে তাতে সম্ভাব্য শিকার হিসেবে সেই আতঙ্ক এই সমাজের বেশিরভাগ নারীর মানস এবং মানসিক বিকাশকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

ইউরোপে উইচ-হান্ট তুঙ্গে ছিল এমন সময়ে যখন রেনেসাঁস ও রিফরমেশন এর কালে মানুষ রাজতন্ত্র, প্রচলিত রীতিনীতি এবং ধর্মীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ও বিদ্রোহী হয়ে উঠছিল। উইচ-হান্ট এর নামে ব্যাপক গণহত্যাকে শাসকেরা ব্যবহার করেছে “…একটি সম্ভাব্য বিপ্লবকে দমন করার জন্য যা নারী, গরীব ও সম্পত্তিহীনদের উপকার করবে।”৭৭ নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে (তুচ্ছ কারণে) এই ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ নারীদের মধ্যে কার্যকরভাবে এই ভীতি জাগাতে পেরেছিল যে সীমার বাইরে গেলে বা মতে ও আচরণে বিরোধী হয়ে উঠলে তাদের মৃত্যু অবধারিত। এই সহিংসতা ও মৃত্যুভয় নারীর মনকে পুরুষতন্ত্রের চাহিদা অনুযায়ী ‘নারীসুলভ’ আকার দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

এই ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ নারীদের মধ্যে কার্যকরভাবে এই ভীতি জাগাতে পেরেছিল যে সীমার বাইরে গেলে বা মতে ও আচরণে বিরোধী হয়ে উঠলে তাদের মৃত্যু অবধারিত। এই সহিংসতা ও মৃত্যুভয় নারীর মনকে পুরুষতন্ত্রের চাহিদা অনুযায়ী ‘নারীসুলভ’ আকার দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

‘নারীসুলভ’ হবার অন্য একটি সংজ্ঞা হল নিজেকে পুরুষের মনোরঞ্জনের উপযোগী করে তোলা। যত কষ্টদায়কই হোক নিজের শরীর ও মনকে পুরুষের মনোরঞ্জনের উপযোগী করে তোলার চাপ কৈশোর থেকেই নারীর উপর চাপানো হয়। দশম শতক থেকে প্রায় এক হাজার বছর চীনের মেয়েশিশুদের বৃদ্ধির বছরগুলিতে (Growing age) পায়ের পাতা বাঁধার চরম কষ্টদায়ক নিপীড়ন চাপিয়ে দেয়া হত শুধু তার দেহকে পুরুষের ভোগের জন্য অধিক উপযোগী করে তোলার জন্য। যেন সে মানুষ নয় পুরুষের মনোরঞ্জনের একটি বস্তু। নারীদেহকে সৌন্দর্যমন্ডিত বা যৌন আবেদনময়ী করার জন্য কান-ফোঁড়ানো, নাক-ফোঁড়ানো থেকে শুরু করে সাজসজ্জার যে সব পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে সেগুলোর বেশিরভাগই যন্ত্রণাদায়ক। বয়ঃসন্ধি থেকে বালিকা যখন পূর্ণ উদ্যমে এসবে নিয়োজিত হয় তখন এই ব্যথা সহ্য করার ব্যাপারটিকে রোমান্টিকৃত করা হয়। কিশোরীকে বলা হয় এগুলো হচ্ছে ‘নারী হয়ে ওঠার যন্ত্রণা’। নিজের শরীরকে বিকৃত করে, যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে নিজেকে ‘নিখুঁত’ করার যে ধারণা বয়ঃসন্ধিতে তাকে দেওয়া হয়, তা পরবর্তী জীবনে অনেক নারীর ভেতরেই মর্ষকামী ব্যক্তিত্বের জন্ম দেয়।৭৮

নারীদেহকে সৌন্দর্যমন্ডিত বা যৌন আবেদনময়ী করার জন্য কান-ফোঁড়ানো, নাক-ফোঁড়ানো থেকে শুরু করে সাজসজ্জার যে সব পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে সেগুলোর বেশিরভাগই যন্ত্রণাদায়ক। বয়ঃসন্ধি থেকে বালিকা যখন পূর্ণ উদ্যমে এসবে নিয়োজিত হয় তখন এই ব্যথা সহ্য করার ব্যাপারটিকে রোমান্টিকৃত করা হয়। কিশোরীকে বলা হয় এগুলো হচ্ছে ‘নারী হয়ে ওঠার যন্ত্রণা’।

সতীদাহ বা সহমরণ প্রথা ভারতে টিকে ছিল কমপক্ষে দুহাজার বছর। এটি পরিপূর্ণভাবে ‘হিন্দু-শাস্ত্র সম্মত’ না হলেও গুপ্ত যুগ থেকে ব্রিটিশ শাসনামল পর্যন্ত লোকাচারে উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের মধ্যে প্রবলভাবে টিকে ছিল এই চরম অমানবিক প্রথা। ধর্মগুরুগণ একে ‘গৌরবান্বিত’ করার চেষ্টা করতেন কিন্তু এই বর্বর প্রথার নিষ্ঠুরতার ব্যাপারটি চিন্তা করলেও আমাদের গা শিউরে ওঠে। ‘সতী হওয়া’ অর্থাৎ স্বামীর প্রতি একান্ত বিশ্বস্ত থাকার জন্য নারীকে পুড়িয়ে মারার প্রথা যে সমাজে ছিল সেখানে নারীদের অবস্থান ছিল ক্রীতদাসের চেয়েও করুণ। এরকম নিষ্ঠুর প্রথা যে সমাজে আছে সে সমাজের নারীদের সমগ্র অস্তিত্বই যে সবসময় হুমকির মধ্যে থাকবে তা সহজেই অনুমেয়।

নারীর উপর চাপিয়ে দেয়া তিনটি চরম নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার অস্তিত্ব এখন আর নেই কিন্তু এগুলোর ছায়া এখনও আমরা নানাভাবে দেখতে পাই। কারণ যে ধরনের অসম সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে এসব অমানবিক প্রথা গড়ে উঠেছিল এযুগেও সেগুলো অনেকাংশেই রয়ে গেছে।

নিপীড়ন ও বন্দীত্বের সঙ্গে মানিয়ে নেবার মনস্তাত্বিক রসায়ন ‘সামাজিক স্টকহোম সিনন্ড্রোম’

কোনো নির্দিষ্ট মনোভঙ্গী বা ব্যক্তিত্ব নিয়ে কেউ জন্মায় না। আধুনিক মনোবিজ্ঞানের ধারণা হচ্ছে- সামাজিক পরিবেশে অন্যদের সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া শুরু হবার আগে শিশুর ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে না। মানুষের ব্যক্তিত্ব ও মনোভঙ্গী গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই মুখ্য ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে- নারী বা পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে অনুকূল ও প্রতিকূল পরিবেশে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ভিন্ন মানসিক প্রবণতার জন্ম দেয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর প্রকাশিত মনোভাব, ব্যক্তিত্ব ও আচরণসমূহকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এর ধরন হচ্ছে দাসত্ব, অবদমন ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বেড়ে ওঠা মানুষের মনোভাবের মতো। ১৯৫১ সালে মার্কিন মনস্তত্ববিদ হেলেন মায়ার হ্যাকার জনগোষ্ঠী হিসেবে নারীদের সঙ্গে আফ্রিকান-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গদের গোষ্ঠীগত মানসিক প্রবণতাগুলোর তুলনা করেন। হ্যাকার লক্ষ করেন গোষ্ঠীগতভাবে নারীদের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই আফ্রিকান-আমেরিকানদের আচরণ ও মনোভঙ্গির মিল রয়েছে; যেমন, অধিক আবেগময় ও শিশুসুলভ ব্যবহার, নিজেকে হীনতর হিসেবে প্রকাশ করা, অসহায়ত্ব বা দুর্বলতা প্রকাশ করা, ছলনাময় ও দুর্বোধ্য আচরণ করা ইত্যাদি। তিনি ব্যাখ্যা করেন এগুলো জন্মগত কোনোবৈশিষ্ট্য নয় উভয় জনগোষ্ঠীর উপর বিদ্যমান বন্দীত্ব,অবদমন এবং (নিয়মিত) সহিংসতা ও নিপীড়নের সঙ্গে মানিয়ে চলার জন্য এক ধরণের অভিযোজনমূলক প্রতিক্রিয়া থেকে গড়ে ওঠা আচরণ।৭৯

শুধু হ্যাকার নন নিপীড়িত ও অবদমিত জনগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে নারীদের মনস্তত্বের সাদৃশ্য অন্যান্য গবেষকরাও লক্ষ্য করেন। পরবর্তী কালে জে বি মিলার (Toward A New Psychology of Women,1976), জ্যাঁ লিম্পেন-ব্লুমেন (Gender roles and power,1984) ইত্যাদি লেখকের লেখায় নিপীড়িত গোষ্ঠীর সঙ্গে নারীর মানসের সাদৃশ্য উঠে এসেছে। তারা এটাও তুলে ধরেন যে, পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে সেই সব আচরণই ‘নারীসুলভ’ বলে চিহ্নিত হয় যেসব আচরণ নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে আশা করা হয়।৮০ লিম্পেন-ব্লুমেন দেখান ক্ষমতাহীন গোষ্ঠীর লোকেরা তাদের প্রয়োজনে ক্ষমতাসীনদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে চায় এজন্যে তারা তাদের বুদ্ধি, চালাকি, স্বজ্ঞা (intuition), ব্যক্তিগত সম্পর্ক, যৌনতা, ছলাকলা, এড়িয়ে চলা ইত্যাদি কৌশল ব্যবহার করে। মিলার আরও দেখান যে- অধিনস্তরা (নারী) আধিপত্যকারীদের (পুরুষ) স্বরগ্রামে এতটা গভীরভাবে বাঁধা পড়ে যে কোনটা তাদের (আধিপত্যকারীদের) সন্তুষ্ট করবে এবং কোনটাতে তারা অসন্তুষ্ট হবে তা তাদের অন্তরাত্মার মধ্যে ঢুকে যায়। অতএব ‘নারীর ষষ্ঠেন্দ্রিয়’ এবং ‘মেয়েলি ছলাকলা’ আসলে আধিপত্যকারীদের সন্তুষ্ট করার প্রয়োজনে গড়ে ওঠা কলা-কৌশল। মিলারের মতে, যেহেতু অধিনস্তরা আধিপত্যকারীদের সন্তুষ্ট করতে চায় তারা আধিপত্যকারীদের সম্পর্কে যতটা জানে নিজের সম্পর্কে তার একাংশও জানেনা। এ কারণে সে নিজের সম্পর্কে হীন এবং আধিপত্যকারীদের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করে । এর মাধ্যমে তারা এই অসম সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে। এভাবে নিপীড়ন ও আধিপত্যের সঙ্গে মানিয়ে নেবার যে মনস্তত্ত্ব তার রসায়নকে নারীবাদীরা ব্যাখ্যা করেছেন ‘সামাজিক স্টকহোম সিন্ড্রোম’ হিসেবে।

অধিনস্তরা (নারী) আধিপত্যকারীদের (পুরুষ) স্বরগ্রামে এতটা গভীরভাবে বাঁধা পড়ে যে কোনটা তাদের (আধিপত্যকারীদের) সন্তুষ্ট করবে এবং কোনটাতে তারা অসন্তুষ্ট হবে তা তাদের অন্তরাত্মার মধ্যে ঢুকে যায়। অতএব ‘নারীর ষষ্ঠেন্দ্রিয়’ এবং ‘মেয়েলি ছলাকলা’ আসলে আধিপত্যকারীদের সন্তুষ্ট করার প্রয়োজনে গড়ে ওঠা কলা-কৌশল। মিলারের মতে, যেহেতু অধিনস্তরা আধিপত্যকারীদের সন্তুষ্ট করতে চায় তারা আধিপত্যকারীদের সম্পর্কে যতটা জানে নিজের সম্পর্কে তার একাংশও জানেনা।

১৯৭৩ সালের কথা, সুইডেনের স্টকহোম শহরের একটি ব্যাংকে দুজন ডাকাত চারজন ব্যাংক কর্মচারীকে তাদের দাবী আদায়ের জন্য জিম্মি করে। জিম্মিদের মধ্যে তিনজন ছিল নারী, একজন পুরুষ। ছয় দিনের জিম্মি নাটকে, আটককারীরা যথারীতি জিম্মিদের সঙ্গে কঠোর ব্যবহার করে এবং মেরে ফেলার হুমকিও দেয় একাধিক বার। তবে বাধ্য অনুগত থাকায় তারা জিম্মিদের সঙ্গে মাঝে মাঝে ভাল ব্যবহারও করে। জিম্মি নাটকের অবসানের পর যখন বন্দীরা (জিম্মি) ছাড়া পেল তখন একটা আশ্চর্য ব্যাপার সবাই লক্ষ্য করল- বন্দীরা আটককারীদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন। তাদের অনুভবে এরা ‘নির্দোষ’ বলে প্রতীয়মান হয় এবং তারা আটককারীদের মুক্তি দাবী করে। বন্দীদের মধ্যে এক নারী, আটককারী একজনের প্রেমে পড়ে যায়। আটককারীদের প্রতি বন্দীদের এই বিপরীত (paradoxical) অনুভব ও আচরণই এই প্রপঞ্চটির অস্বাভাবিকত্ব (peculiarity). আধিপত্যকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি নিপীড়িত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর এই অদ্ভুত মানসিকতাকে আধুনিক মনস্তত্বের ভাষায় বলা হয়- ‘স্টকহোম সিন্ড্রোম’। এটি অসম সম্পর্কের মধ্যে অবদমিত ও নিপীড়িত মানুষদের মানিয়ে নেয়ার এবং টিকে থাকার একটি কৌশল এর উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা মনোভাব। ১৯৯০ এর দশক থেকে নারীবাদী তাত্ত্বিকগণ লক্ষ্য করেন পুরুষতান্ত্রিক অসম সমাজে আধিপত্যকারী ও নিপীড়নকারীদের (পুরুষ) সঙ্গে মানিয়ে চলার একধরনের মানসিকতা বেশিরভাগ নারীর মধ্যে দেখা যায় যা ‘নারীসুলভ’ মানসিকতা বা আচরণ বলে পরিচিত। এই মানসিক প্রবণতার মধ্যে আধিপত্যকারীদের প্রতি এক ধরনের ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে এবং এই মানসিকতা মোটামুটিভাবে সমাজের অবদমিত ও অধস্তন অংশের সবার মধ্যেই দেখা যায়। একারণে নারীর এই মানসিক প্রবণতার রসায়নকে তারা ‘সামাজিক স্টকহোম সিন্ড্রোম’ (Societal Stockholm Syndrome) হিসেবে নামকরণ করেছেন।৮১

সমাজে আধিপত্যকারী ও নিপীড়নকারীদের (পুরুষ) সঙ্গে মানিয়ে চলার একধরনের মানসিকতা বেশিরভাগ নারীর মধ্যে দেখা যায় যা ‘নারীসুলভ’ মানসিকতা বা আচরণ বলে পরিচিত। এই মানসিক প্রবণতার মধ্যে আধিপত্যকারীদের প্রতি এক ধরনের ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে এবং এই মানসিকতা মোটামুটিভাবে সমাজের অবদমিত ও অধস্তন অংশের সবার মধ্যেই দেখা যায়।

নারীবাদী মনস্তত্ববিদগণ লক্ষ্য করেন মূলত চারটি বিষয় ‘সামাজিক স্টকহোম সিন্ড্রোম’ গড়ে ওঠার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে- ১) নিজ অস্তিত্বের প্রতি হুমকি অনুভব করা, ২) নিপীড়ন থেকে পালানোর অক্ষমতা ৩) আধিপত্যকারী কর্তৃক বিচ্ছিন্ন (isolated) হওয়া এবং ৪) (বশ্যতা স্বীকারের মাধ্যমে) আধিপত্যকারীর দয়া বা করুণা লাভ করা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নিপীড়ন ও অবদমনের কারণে নারীর অস্তিত্ব কীভাবে হুমকির মধ্যে থাকে তা উপরে আলোচিত হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীরা নিপীড়ন ও অবদমনের চক্র থেকে মুক্ত হতে পারে না কিংবা তারা বিশ্বাস করে যে এর থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব না। পরিবারের গন্ডির মধ্যে কারাগারের মতোই সে বন্দী ও বিচ্ছিন্ন থাকে। বেশিরভাগ নারীই পুরুষ ও পরিবারের আধিপত্যকে মেনে নিয়ে সে পরিবারের আধিপত্যকারীদের দয়াও পেয়ে থাকে। তবে, সব মেয়েদের ক্ষেত্রে এই মানিয়ে নেয়ার ব্যাপারটি এক নয় বরং ব্যক্তি-ভেদে, অবস্থান ভেদে এক্ষেত্রে বিস্তর তফাৎ হয়।

রবীন্দ্রনাথের ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পের তিনটি নারী চরিত্রে এই ভিন্নতা দেখতে পাই। এই তিনজনই পুরুষতান্ত্রিক পরিবারের চক্রে বন্দী কিন্তু এর মধ্যে মেজ বৌ বা মৃণালের অবস্থান অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক কারণ ‘রূপ’ থাকায় পুরুষতান্ত্রিক পরিবারে তার ‘মূল্য’ বা গ্রহণযোগ্যতা বেশি ছিল। বড় বৌএর রূপ বা বাপের বাড়ির ধনসম্পদ কোনোটাই ছিল না তাই তিনি “সকল বিষয়েই নিজেকে যতদূর সম্ভব সংকুচিত করে” রাখতেন। “তিনি নিতান্ত দরদে পড়ে” অনাথ অসহায় বোনকে নিজের কাছে এনেছিলেন। “কিন্তু যখন দেখলেন স্বামীর অনিচ্ছা তখন এমনি ভাব করতে লাগলেন… যেন একে দূর করতে পারলেই বাঁচেন। এই অনাথা বোনটিকে মন খুলে প্রকাশ্যে স্নেহ দেখাবেন সে সাহস তার হল না।” বরং তার ছোটবোন বিন্দুকে প্রশ্রয় দেবার জন্য মেজ বৌএর নিন্দা করতেন। ওই পরিবারের বিন্দুকে চরম অবহেলা করার স্রোতে তিনিও গা ভাসাতেন। অপাত্রে বিয়ে ঠিক হওয়াতে বিন্দুর জন্য তিনি লুকিয়ে চোখের জল ফেলতেন কিন্তু উপরে উপরে আচরণ করতেন উল্টোটাই। পুরুষতান্ত্রিক পরিবারের অবদমনের সঙ্গে মানিয়ে চলার এই মনোভাব তার মধ্যে এত গভীরভাবে ছিল যে স্বতস্ফূর্তভাবেই তিনি এধরনের আচরণ করতেন।

অন্যদিকে বিন্দুর অবস্থান তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর। সে গরীবের ঘরের আশ্রয়হীনা, রূপহীনা এক বালিকা। আচরণে স্বভাবে সে চরম সংকুচিত, পুরুষতান্ত্রিক সকল নিষ্পেষণের কাছে নতজানু, তার মন এতই অবদমিত যে কিছু চাওয়া বা চরম অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়ের সামান্যতম প্রতিবাদের মানসিক শক্তিও তার ছিল না। তাকে প্রশ্রয়-দেওয়া মেজবৌ ছাড়া কারও কাছেই নিজের মনোভাব প্রকাশের সাহস তার ছিল না। দাসত্ব ও বন্দীত্বের চরম অবস্থায় থাকা সবচেয়ে অসহায় এক সামাজিক অবস্থান বিন্দুর মধ্যে এই নতজানু ও অক্ষম মানসিকতার জন্ম দিয়েছে । বিন্দু এবং বড়-বৌ এর সংকুচিত, ভীত, অবদমিত, নতজানু ইত্যাদি প্রকাশিত আচরণ প্রকৃতপক্ষে পুরুষতান্ত্রিক পরিবারের আধিপত্য ও নিপীড়নের সঙ্গে মানিয়ে চলার প্রবণতা থেকে সৃষ্ট। এভাবে নারীরা গভীরভাবে পুরুষতান্ত্রিক ভাবধারায় আচ্ছন্ন হয় এবং নিজেদের পুরুষের তুলনায় মূল্যহীন মনে করতে থাকে। বিন্দুর করুণ কাহিনি বলতে গিয়ে এক জায়গায় মৃণাল লিখেছে- “মেয়েমানুষ মেয়েমানুষকে দয়া করে না। বলে, ‘ও তো মেয়েমানুষ বই তো নয়। ছেলে হোক-না পাগল, সে তো পুরুষ বটে।’ ”

তবে মেজ বৌ মৃণাল এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। এই ব্যতিক্রম দেখেই আমরা নিয়মটাকে নতুন করে আবিষ্কার করি এবং এটাও অনুভব করি যে, সমাজে যা ‘নারীসুলভ’ মনোভাব ও আচরণ বলে পরিচিত তা জন্মগত নয়। মৃণাল প্রচলিত অর্থে নারীসুলভ মানসিকতার নয়। পুরুষতান্ত্রিক পরিবারের অবদমন, বৈষম্য ও নিপীড়নের সঙ্গে আপোষ করে নিজের আবেগ, আহ্লাদ ও মতকে বিসর্জন দিয়ে অন্যদের সঙ্গে মানিয়ে নেয়া বা মনরাখা আচরণ করার প্রবণতা তার মধ্যে নেই। এ সমাজের অন্যান্য নারীর মতো সে ‘সামাজিক স্টকহোম সিনড্রোম’ দ্বারা আক্রান্ত হয়নি। এর মূল কারণ- যে সব বিষয়ের কারণে নারীদের মধ্যে এই রসায়ন কাজ করে সেগুলো তার মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম ছিল। যেমন, নিজ অস্তিত্বের প্রতি হুমকি অনুভব করার বিষয়টি তার মধ্যে কম ছিল। এর কিছুটা তার অধিক সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার কারণে, কিছুটা তার বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তার কারণে। এই চিন্তা করার ক্ষমতার কারণেই সম্মানহীন জীবনের মূল্য তার কাছে ছিল না। তাই সে বলতে পেড়েছে- “জীবন আমাদের কীই বা যে মরণকে ভয় করতে হবে?” অন্যদিকে পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়নের চক্কর থেকে বের হওয়া সম্ভব নয় সেটাও সে মানত না। সে সাহস করে বলতে পেরেছিল-“সংসারের মাঝখানে মেয়েমানুষের পরিচয়টা যে কী তা আমি পেয়েছি। আর আমার (সংসারের) দরকার নেই।” বশ্যতা স্বীকারের মাধ্যমে আধিপত্যকারীর দয়া বা করুণা লাভ করার বিষয়টিকে সে বরাবর ঘৃণা করেছে। তাই তার মানস এ সমাজের দৃষ্টিতে ‘নারীসুলভ’ নয়।

অ্যান্ড্রিয়া ডরকিন লিখেছেন- “অন্ধকার যুগ কতটা অন্ধকার ছিল, সে ধারণা পাওয়া কঠিন।” মধ্যযুগের সেই অন্ধকার মূলত ছিল চিন্তাগত অস্পষ্টতা এবং সামাজিক পশ্চাৎপদতার। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে এখনও কতটা অন্ধকার রয়ে গেছে? কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন-

“সে যুগ হয়েছে বাসি
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’,
নারীরা আছিল দাসী।”

সে যুগ বাসি হয় নি। একশো বছরেও “সংসারের মাঝখানে মেয়েমানুষের পরিচয়টা” খুব বেশি বদলে যায়নি। শেষ হয় নি দাসত্ব, অজ্ঞতা ও অমানবিকতার অন্ধকার। অবসান হয়নি নারীপুরুষের অসম সম্পর্কের। সেকারণেই টিকে আছে তার উপর সংঘটিত হওয়া সহিংসতা ও নিপীড়ন। যা আমাদের আশেপাশেই প্রতিদিন দেখছি। তাই সহিংসতা, নিপীড়ন ও বঞ্চনার খাঁচার পাখি আজও বেশিরভাগ নারীর মন।

মনিরুল ইসলাম: বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, লেখক ও শিক্ষক, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ।

ইমেইল: monirul852@gmail.com

তথ্যসূত্র:

৭০. Dee L.R. Graham with Edna I. Rawlings and Roberta K. Rigsby: Loving to Survive: Sexual Terror Men’s Violence & Women’s Life; New York University Press, New York and London,1994, pp.xiv (Preface).

৭১.Rajbir Kaur: Violence AgainstWomen: Patriarchy And Power Politics; International Journal Of Advance Research, Int. J. Adv. Res. 6(5), 116-119

৭২. Leidig M W:  Violence against women: A feminist psychological analysispdf .

৭৩. অ্যন্ড্রিয়া ডরকিন:পেন্টহাউস পত্রিকার সাক্ষাৎকার, এপ্রিল ১৯৮৭ সংখ্যা।Penthouse, 18(8), 50-52,56,70,72.

৭৪.মৌমিতা সেন: সোশ্যাল মেডিয়ার নারীবাদী আন্দোলন: কনসেপ্ট, পরিকাঠামো এবং ক্ষমতা; চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম (ইন্টারনেট কাগজ), নভেম্বর ১, ২০১৯।

৭৫. Andrea Dworkin: Women Hating; PLUME, Published by the Penguin Group Penguin Books, New York, USA, 1974, pp- 93-94

৭৬. MacKinnon, C.A. :Feminism unmodified: Discourses on life and law. Cambridge, Mass.: Harvard University Press.1987, pp-24.

৭৭. Starhawk (1982). Dreaming the dark: Magic, sex and politics. Boston: Beacon Press. Pp 185

৭৮. Andrea Dworkin: ibid (1974), pp-115

৭৯. Hacker, H. M. (1981). Women as a minority group. In S. Cox, ed., Female psychology: The emerging self, pp. 164- 178. 2d ed. New York: St. Martin’s Press. (Originally published in Social Forces, 1951, 6- 69.)

৮০. Dee L.R. Graham with Edna I. Rawlings and Roberta K. Rigsby: Ibid-pp-189.

৮১. Lang, D. (1974, November ij). A reporter at large: The bank drama. The New Yorker, pp. 56—126

Social Share
  •  
  •  
  • 207
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *