কর্মসংস্থানের নতুন অনিশ্চিত রূপ: যুক্তরাজ্যের অভিজ্ঞতা

কর্মসংস্থানের নতুন অনিশ্চিত রূপ: যুক্তরাজ্যের অভিজ্ঞতা

স্টেফান আর্মস্ট্রং

বিশ্বজুড়ে পুঁজির আগ্রাসনে স্থায়ী স্থিতিশীল কর্মসংস্থান ক্রমেই দুর্লভ হয়ে উঠছে। নব্য উদারতাবাদী মডেলে বিস্তৃত হচ্ছে চুক্তিভিত্তিক, খন্ড, অস্থায়ী, ঠিকাদার ভিত্তিক কাজ। ‘আউটসোর্স’ এখন একটি প্রধান ধরনে পরিণত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে শ্রমিকের সংগঠিত হওয়া, নিশ্চিত কাজ, নিয়মিত কাঠামোবদ্ধ মজুরি সবকিছু থেকেই শ্রমিক বঞ্চিত হয়। পুঁজিপতির খরচ কমে, মুনাফা বাড়ে, মধ্যস্বত্ত্বভোগী ভাগ বসায়, শ্রমিকের জীবন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। শিল্পোন্নত দেশগুলোতেও এই মডেলে অনিশ্চিত কাজে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। যুক্তরাজ্যের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে লেখা Stephen Armstrong-এর ‘The New Poverty’ (2017, Verso, London) শীর্ষক পুস্তকের ‘The New Full Employment’ অধ্যায় অবলম্বনে কল্লোল মোস্তফার তৈরি এই লেখায় এই পরিস্থিতিই তুলে ধরা হয়েছে।

২০১৬-১৭ সালের ক্রিসমাসে চব্বিশ ও তেইশ বছর বয়সি স্কট ও জর্ডান ডিএইচএল (DHL)-এর একটি ওয়্যারহাউসে কাজ করছিলেন। ডিএইচএল বৃহৎ খাদ্য সরবরাহকারী কোম্পানি নিসা-র (Nisa) হয়ে এটি পরিচালনা করে। নিসা প্রায় ২,৫০০ ব্যক্তিমালিকানাধীন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকানে পণ্য সরবরাহ করে, যার মধ্যে পারিবারিক মালিকানাধীন দোকান, লোকোর (Loco) মতো খুদে চেইন শপ এবং নিজস্ব ব্র্যান্ডের দোকান রয়েছে। নিসার বিতরণের কাজ ডিএইচএল করলেও ওয়্যারহাউসে কর্মী নিয়োগের কাজটি ব্লু অ্যারো (Blue Arrow) নামের একটি কোম্পানির কাছে আউটসোর্স করে দিয়েছে, যে কোম্পানিটি ২০১৪ সালে দুর্ঘটনা বিমার জন্য অস্থায়ী কর্মীদের কাছ থেকে ২.৫০ পাউন্ড করে আদায় করে সংবাদ শিরোনাম হয়েছিল। কারণ, এ ধরনের বিমার বাজারদর ছিল আরো অনেক কম–৩ পেন্স।

নিসা/ডিএইচএল/ব্লু অ্যারো-এর এই ওয়্যারহাউসটি থেকে ঠান্ডা খাদ্যদ্রব্য বিতরণ করা হয়। সুতরাং স্কট ও জর্ডানকে প্রকৃতপক্ষে একটি বৃহদাকার ফ্রিজারে কাজ করতে হচ্ছিল। তাদেরকে ঠান্ডাপ্রতিরোধী পোশাক, পুরু বুট জুতা এবং কথা শোনার জন্য হেডফোন দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে তাদেরকে পণ্য ওঠানামা ও স্থানান্তর করার নির্দেশ দেওয়া হতো। ‘আমাদেরকে একটা নির্দিষ্ট স্থানের ট্রাক থেকে পণ্য নামানোর কথা বলা হতো। আমরা সেখান থেকে পণ্য নামিয়ে প্যালেটের (ভারী পণ্য ওঠানামার কাজে ব্যবহৃত কাঠের বা ধাতুর তৈরি পাটাতন) উপরে রাখতাম।’ স্কট ব্যাখ্যা করে বললেন, “পণ্যের কথা বলতে আমরা একেকটা ২৫ বা ৩০ কেজি ওজনের বাক্সের কথা বোঝাচ্ছি।… অবাক-করা ব্যাপার হলো, আমি সেখানে মাত্র একবার দুর্ঘটনায় পড়েছিলাম। বাক্সটার ওজন ছিল ৩৫ কেজি। অবশ্য ভেতরে কী ছিল জানি না। বাক্সের ভেতরে কী আছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই লেখা থাকে না। বাক্সটাকে প্যালেটের ওপর রাখার সময় ভার সামলাতে না-পেরে হঠাৎ হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল। তারা শুধু বলেছিল, ‘আমরা এটাকে আবার মুড়িয়ে নিতে পারব। কিন্তু তোমাকে তো বাসায় চলে যেতে হবে। কাল যদি তুমি না-আসতে পার, তাহলে একজন ডাক্তারের কাছ থেকে লিখিত লাগবে।’ কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শ জোগাড় করতে ৭ পাউন্ড লাগবে, তাছাড়া একটা দিনও নষ্ট হবে। কাজেই আমি কাজ চালিয়ে গেলাম।”

সেই ছুটির মৌসুমে জর্ডানের পায়ে ঘা হয়ে গেল। তাদের দেওয়া বুট জুতার ভেতরে ফার বা পশমের আবরণ ছিল। ভারী কাজ করতে গিয়ে পা ও মোজা ঘেমে ভিজে থাকত সারা দিন। তিনি সারাক্ষণ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কাজ করছিলেন দেখে তার সুপারভাইজার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিলেন যে, তিনি কাজ করার মতো যথেষ্ট সুস্থ আছেন। তিনি বললেন, ‘কী করব, আমি কাজ টিকিয়ে রাখার জন্য মিথ্যা বলব? আর কী করার থাকতে পারে! আমি অর্থের জন্যই স্বাক্ষর করলাম।’

শুরুতে তাদেরকে বলা হয়েছিল ক্রিসমাসের সময় কাজ দেখিয়ে যদি খুশি করতে পারেন, তাহলে পরের বছর তাদেরকে পূর্ণ মেয়াদে নিয়োগ দেওয়া হবে। অবসরভাতা ও ছুটিভাতা নিয়েও কথা হয়েছিল। তাদেরকে ইলেকট্রিক অর্ডার পিকার যন্ত্র (প্যালেট উত্তোলনের হস্তচালিত যন্ত্র ও ফর্ক লিফট ট্রাকের সংকর) চালনায় পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে দেখে তাদের উৎসাহ বেড়েছিল। স্কট ব্যাখ্যা করে বললেন, “আপনি মনে মনে ভাবলেন, ‘আমাকে এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তাহলে নিশ্চয়ই আমাকে স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে।’ সুতরাং আমি ভালো কর্মী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লাগলাম। একেকটা শিফট বা পালা বারো ঘণ্টার, অনেক সময় তা পনেরো ঘণ্টারও হয়। কাজের আগ্রহ প্রমাণ করার জন্য এই দীর্ঘ শিফটও করতে হতো। অনেক সময় বাড়ি পাঠাতে চাইলেও আমরা তর্ক করতাম। বলতাম, না। আমরা আরো কাজ করতে চাই… কিন্তু তারা বাড়ি পাঠিয়ে দিত।”

দিনের পালা শুরু সকাল ৭টায় আর রাতেরটা সন্ধ্যা ৭টায়। ভেতরে ঢুকে সময় লিপিবদ্ধ করার পর থেকেই শুধু সময় গণনা শুরু হয়। দুপুরের খাবারের সময় এক ঘণ্টা বাদ যায়। ফলে একটা বারো ঘণ্টার পালা থেকে এগারো ঘণ্টার মজুরি পাওয়া যায়। কাজ কমে এলেই বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। রাতের পালায় এরকম ঘটনা রাত ৩টা বা ৪টার সময়ও ঘটতে পারে। ওই সময় কোনো গণপরিবহণ চালু থাকে না, আর ট্যাক্সি করে ফিরলে আয়ের একটা বড় অংশই চলে যায়। ফলে তারা এরকম ক্ষেত্রে হেঁটেই বাড়ি ফিরতেন। ‘ক্রিসমাসের আগের টানা তিন দিন তারা আমাকে ভোর চারটায় ফেরত পাঠিয়েছে,’ বেশ খেদের সঙ্গে বললেন জর্ডান। ‘পূর্ণকালীন কর্মীরা কাজের সুযোগ পায় সবার আগে। আপনি কখন সুযোগ পাবেন, তা নির্ভর করবে এজেন্সির মর্জির ওপর। আমাদের মতো অস্থায়ী কর্মীদের তো যে কোনো সময় ছুড়ে ফেলে দেওয়া যায়।’

তাদের কাজের পালা ছিল বেশ অনিশ্চিত। জর্ডান এক সপ্তাহে বাহাত্তর ঘণ্টা কাজ করলেন, তার পরের সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা, তারপর তেত্রিশ ঘণ্টা আর তারপর মাত্র আট ঘণ্টা। আর সবকিছুই জানানো হতো মোবাইলে টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে। বেলা ৩টা নাগাদ তাদেরকে টেক্সট করে জানানো হতো যে, পরদিন তাদেরকে লাগবে-কী-লাগবে না। কখনো কখনো হিসাবে ভুল হতো, ফলে কাজে গিয়েই ফিরে আসতে হতো। মাঝখান থেকে খরচ হয়ে যেত বাস ভাড়ার ৩.৫০ পাউন্ড। অনেক সময় সকাল ৬টায় তাদেরকে টেক্সট করে জানানো হয়েছে যে, পরদিন তাদেরকে কাজে যেতে হবে। তারা সব সময় হ্যাঁ বলতেন, যারা ‘না’ বলতেন, তারা কাজ করতে পারতেন না।

কাজের পালা ছিল বেশ অনিশ্চিত। জর্ডান এক সপ্তাহে বাহাত্তর ঘণ্টা কাজ করলেন, তার পরের সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা, তারপর তেত্রিশ ঘণ্টা আর তারপর মাত্র আট ঘণ্টা। আর সবকিছুই জানানো হতো মোবাইলে টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে। বেলা ৩টা নাগাদ তাদেরকে টেক্সট করে জানানো হতো যে, পরদিন তাদেরকে লাগবে-কী-লাগবে না।

এমনকি তাদের পে স্লিপ বা বেতনের হিসাবও দেওয়া হতো টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে। কোনো কাগজপত্রে তাদেরকে হিসাব-নিকাশ দেওয়া হতো না, স্রেফ সাপ্তাহিক টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে জানানো হতো কত ঘণ্টা তারা কাজ করেছেন এবং কত টাকা তাদেরকে দেওয়া হলো। জর্ডান তার টেক্সট মেসেজগুলো আমাকে দেখালেন–এক সপ্তাহে তিনি ১০২ পাউন্ড আয় করেছেন, তার পরের সপ্তাহে ৭০ পাউন্ড। পে স্লিপ ছাড়া বোঝা অসম্ভব যে, কোনো অর্থ কেটে রাখা হয়েছে কি না।

ক্রিসমাসের পরপরই যখন ব্লু অ্যারো তাদেরকে ছাঁটাই করে দিল, টেক্সট মেসেজের পে স্লিপ দেখিয়ে হাউজিং বেনিফিট বা আবাসন সুবিধা ভাতা আদায় করা জটিল হয়ে গেল। কর্তৃপক্ষ টেক্সট মেসেজকে বেতনের প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি হচ্ছিল না; বরং তাদের ভাতা হিসাব করার জন্য পরপর তিন মাসের পে স্লিপ চাইছিল। তারা অবশ্য এই চাকরির ওপর ভরসা করার জন্য নিজেদের ওপরই বিরক্ত হয়েছিলেন। ‘প্রতিশ্রুতি শুনে আপনি আশায় থাকবেন, নেতিয়ে পড়ার আগপর্যন্ত কাজ করবেন আর এদিকে নতুন বছর আসার সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে ছাঁটাই করে দেওয়া হবে,’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জর্ডান। ‘আপনি এটাকে ভালো একটা সুযোগ মনে করেছেন। আপনি এটা নিয়ে বিভিন্নজনের সঙ্গে আলাপ করছেন, এটা নিয়ে নানান ভাবনাচিন্তা করছেন। অনেক পরিকল্পনা করতে শুরু করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হলো না। আপনাকে এত বেশি আশা দিয়ে অবিশ্বাস্যভাবে স্রেফ একটা ইটের টুকরার মতো ছুড়ে ফেলে দিল। কেন আমাদের সঙ্গে এরকম করা হয়? এর ফলে তো শরীর ও মন বিধ্বস্ত হয়ে যায়। কাজ পেয়ে আপনি যখন নিজের সবকিছু উজাড় করে দিচ্ছেন, যখন নানা স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছেন, তখনই তারা আপনাকে ছুড়ে ফেলে দেয়। ফলে হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়।’

ক্রিসমাসের পরপরই যখন ব্লু অ্যারো তাদেরকে ছাঁটাই করে দিল, টেক্সট মেসেজের পে স্লিপ দেখিয়ে হাউজিং বেনিফিট বা আবাসন সুবিধা ভাতা আদায় করা জটিল হয়ে গেল। কর্তৃপক্ষ টেক্সট মেসেজকে বেতনের প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি হচ্ছিল না

তারা বাসা ভাড়া জোগাড় করতে পারছিলেন না। আবাসন ও বেকার ভাতার অর্থ পেতে অন্তত দু-চার সপ্তাহ সময় লাগে। আর মানুষ এ ধরনের কাজে যোগ দেয় এই আশায় যে, অন্তত তাদের সিভিতে কিছু অভিজ্ঞতা যুক্ত হবে। কিন্তু এসব এজেন্সির কাজ মিশ্র ধরনের, যেখানে কোনো ধরনের পে স্লিপ দেওয়া হয় না। সুতরাং চাকরিদাতারা সিভির দিকে তাকিয়ে ভাবে ‘এখানে ঘোড়ার ডিম কী আছে?’

জর্ডান বললেন, ‘এর ফলে ভীষণ চাপ তৈরি হয়। আমি বছর খানেক আগে একটা ওয়্যারহাউসে একটা ছেলের সঙ্গে কাজ করেছি, যার মধ্যে গৃহহীন হয়ে যাওয়ার ভয় কাজ করত এবং মনে হতো জীবন একেবারেই শেষ। সুনির্দিষ্ট কোনো চুক্তি ছাড়া কাজ করলে সব সময়ই একটা ভয়ের মধ্যে থাকতে হয়। কারণ, কোনো একটা ভুল করলেই দেখা যাবে আপনাকে ছাঁটাই করে দেওয়া হচ্ছে। আপনি কি বুঝতে পারছেন ব্যাংকে কোনো টাকা না-থাকা বলতে কী বোঝায়? আসলে পকেটে কোনো টাকা না-থাকাটা ভীষণ ভয়ের একটা ব্যাপার।’

গত চার-পাঁচ বছরে তারা ফ্যাশন রিটেইলার নিউ লুক ও বিলাসবহুল গাড়ি নির্মাতা বেন্টলির বিভিন্ন ওয়্যারহাউসে, আরসিবি নামের এজেন্সির হয়ে পরিচ্ছন্নতার কাজ এবং নেটওয়ার্ক রেল-এর হয়ে কায়িক শ্রমের কাজ করেছেন। আরসিবি জর্ডানকে পরিচ্ছন্নতা কাজের জন্য ক্রু (Crewe) শহরে পাঠিয়েছে, তারপর শহরে পাঠিয়ে একই দিনে আবার ক্রুতে ফেরত পাঠিয়েছে; কিন্তু যাতায়াতের জন্য ভাড়া বা পর্যাপ্ত সময় বরাদ্দ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। নেটওয়ার্ক রেল তাদেরকে নিজেদের প্রশিক্ষণের খরচ বহন করতে বাধ্য করেছে এবং স্টোক (Stoke) থেকে ক্রু-তে যাওয়ার রেলের পুরো ভাড়া তাদেরই বহন করতে বলেছে।

তাদের কাছ থেকে তাদের কাজের বার্ষিক পরিকল্পনা শুনলে রীতিমতো আতঙ্ক হয়। স্কটের মুখ থেকেই শোনা যাক, ‘মার্চ থেকে নভেম্বরের শুরু পর্যন্ত এখানে ছয় সপ্তাহ, ওখানে আট সপ্তাহ এভাবে কাজ করতে হয়। আমরা অপেক্ষা করি ক্রিসমাস মৌসুমের জন্য। কারণ, ওই সময়েই আমাদের চাহিদা বেশি থাকে। এ সময় কিছু অর্থ সঞ্চয়ের চেষ্টা করতে হয় যেন ড্রাইভিং লাইসেন্সের খরচ কিংবা পরবর্তী দু-মাসের ভাড়াটা হাতে থাকে। গ্রীষ্মকালে স্পেনে কাজ করতে যাওয়ার জন্য আমার একটা পাসপোর্ট করা প্রয়োজন; কিন্তু তার জন্যও তো ৭০-৮০ পাউন্ড খরচ লাগে।’

জর্ডান এ বছর প্লাম্বিং (পানির পাইপ বসানো বা মেরামত)-এর ওপর কোর্স করার আশা করছেন। তিনি একসময় তার বাবাকে এ কাজে সাহায্য করেছেন এবং বেশিরভাগ কাজই করতে পারেন; কিন্তু আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছাড়া কেউ তাকে কাজ দেবে না। আর স্কট আশা করছেন, ম্যাকডোনাল্ডে একটা কাজ পাওয়ার। একবার ম্যাকডোনাল্ডে ঢুকে প্রশিক্ষণ পর্যায়টা পার করতে পারলে সপ্তাহে ৩৫ ঘণ্টা কাজের নিশ্চয়তা থাকে।

ফাকুন্ড স্পেন থেকে যুক্তরাজ্যে এসেছেন ২০১৪ সালের মার্চে। এর আগে তিনি স্পেনের একটি ধনী পরিবারের গাড়ি চালাতেন; কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট শুরু হওয়ায় তার চাকরি চলে যায়। যুক্তরাজ্যে তার প্রথম কাজ হয় ইটফার্স্ট (EatFirst)-এর জন্য খাবার সরবরাহ করা, মজুরি ঘণ্টায় ৪ পাউন্ড, সেইসঙ্গে প্রতিটি সরবরাহের জন্য ৫ পাউন্ড বোনাস। একেকজন চালক সাধারণত প্রতি পালায় দুটি বা তিনটি সরবরাহের কাজ পান, কাজগুলো সাধারণত দুপুর বা রাতের খাওয়ার সময় বেশি হয়। গাড়ি সরবরাহ করে ইটফার্স্ট। এভাবে তার দৈনিক আয় হয় মোটামুটি ৪০ পাউন্ড। স্পেনে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময়টুকু বাদ দিয়ে হিসাব করলে তার বার্ষিক আয় হয় ১০ হাজার পাউন্ডের কিছু কম।

এর পর তিনি কাজ করেন হার্মিস (Hermes)-এ, যে প্রতিষ্ঠানটি তাদের সব কুরিয়ার কর্মীকে স্বনিয়োজিত কর্মী হিসেবে দেখে থাকে। কর্মীরা মজুরি পায় কাজ হিসাবে, প্রতিটি পার্সেল-এর জন্য ৪৮ পেন্স করে। পরিবহণ, জ্বালানি ও গাড়ির বিমার খরচ কর্মীদের নিজেদেরই বহন করতে হয়। ডেলিভারির কাজ সম্পন্ন করা সাপেক্ষে তারা অন্য কাজও করতে পারেন, অন্তত কাগজে-কলমে সেরকমই আছে।

কিন্তু ফাকুন্ড বলেন, ‘বাস্তবে দিনেরটা দিনে সরবরাহ না-করলে সুপারভাইজার ভবিষ্যতে কাজ না-দিয়ে কর্মীদের শায়েস্তা করেন। যদিও পার্সেলটি হয়তো তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে সরবরাহ করলেই চলে। এক শনিবার বিকালে আমার কিছু কাজ ছিল। ফলে দুপুরের মধ্যে যেসব পার্সেল এসেছিল তার মধ্য থেকে যেগুলো জরুরিভাবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সরবরাহ করতে হবে, সেগুলো সরবরাহ শেষ করে বাকিগুলো আমি পরদিন সরবরাহ করি। কিন্তু এতে তারা আমার ওপর রেগে যায় এবং বলে ভবিষ্যতে এরকম হলে আমার চাকরি চলে যাবে। ফলে রাত ১টা পর্যন্ত কাজ করতে হোক আর রাত ১১টায় লোকজনকে বিরক্ত করাই হোক, তাদের তাতে কিছুই যায়-আসে না। একদিন ছুটি নিতে চাইলে আপনার কাজ করে দেবে এমন একজনকে খুঁজে বের করতে হবে আপনাকে।’

গত গ্রীষ্মে পিতামাতাকে দেখতে তিনি দু-সপ্তাহের জন্য স্পেনে গিয়েছিলেন। যাওয়ার দু-মাস আগে থেকে তিনি তার সুপারভাইজারকে জানিয়ে রেখেছিলেন; কিন্তু তারপরও ফিরে আসার পর তিন সপ্তাহ তাকে কোনো কাজ দেওয়া হয়নি। –তারা আমাকে মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে জানায়, ‘আপনার জন্য এখন আর কোনো কাজ নেই, ছুটি নেওয়াটা আপনার ঠিক হয়নি।’ মেসেজগুলো দেখিয়ে তিনি আমাকে বললেন, ‘এ ব্যাপারে আসলে তেমন কিছু করার নেই। আমরা আসলে স্বনিয়োজিত কর্মী। একদিন কাজ থাকে, আরেকদিন কেউ কাজ দেয় না, যাওয়ার জায়গা থাকে-না কোথাও।’

২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে টিইউসি (TUC) প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, কথিত স্বনিয়োজিত কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে যুক্তরাজ্য সরকার ৪০০ কোটি পাউন্ড কম কর পাচ্ছে। কারণ, একই ধরনের কাজ থেকে স্বনিয়োজিত কর্মীরা পূর্ণকালীন কর্মীর তুলনায় কম আয় করেন এবং চাকরিরত অবস্থায় তাদের সরকারি সাহায্য প্রয়োজন পড়ে। বাস্তবে ক্ষতির পরিমাণটা আরো বেশি। যুক্তরাজ্য সরকারের কর্মসংস্থানবিষয়ক উপদেষ্টা মেথু টেইলর একই সময়ে দেখিয়েছেন যে, স্বনিয়োজিত কর্মীরা পূর্ণকালীন স্থায়ী কর্মীর চেয়ে অন্তত দুই হাজার পাউন্ড কর কম প্রদান করেন। স্বনিয়োজিত কর্মীর সংখ্যা মোট কর্মসংস্থানের ১৫ শতাংশ বা ৪৮ লাখ হলে, কর বাবদ সরকারের আয় কম হয় প্রায় ৯০০ কোটি পাউন্ড, যা যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা বাজেটের এক-চতুর্থাংশ।

স্বনিয়োজিত কর্মীর সংখ্যা মোট কর্মসংস্থানের ১৫ শতাংশ বা ৪৮ লাখ হলে, কর বাবদ সরকারের আয় কম হয় প্রায় ৯০০ কোটি পাউন্ড, যা যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা বাজেটের এক-চতুর্থাংশ।

কিন্তু কর্মসংস্থানের অনানুষ্ঠানিকীকরণ ও দারিদ্র্য তৈরির এই প্রক্রিয়া কেবল ওয়্যারহাউস ও কারখানাতেই সীমাবদ্ধ নেই। ২০১৬ সালের বসন্তে মেষশাবক প্রসব মৌসুমে ভিকি মিলরয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়। তিনি তার সঙ্গী জেসনকে নিয়ে এক হাজার ভেড়ির একটা পালের দেখাশোনা করছিলেন। তারা চার দিন হলো কাজ করেছেন, প্রতিদিন সকাল ৫টায় তাদের কাজ শুরু হয়। ভেড়িগুলো তাদের নিজের নয়। জমির মালিক একজন নারী, যার আরো অনেক খামার রয়েছে। তার হয়ে কাজ করে রব নামের একজন ম্যানেজার। ভিকি আর জেসনকে বলা যেতে পারে ফ্রিল্যান্স রাখাল। অবশ্য এই নামে ডাকলে ভিকি হেসে ওঠেন।

কিন্তু কর্মসংস্থানের অনানুষ্ঠানিকীকরণ ও দারিদ্র্য তৈরির এই প্রক্রিয়া কেবল ওয়্যারহাউস ও কারখানাতেই সীমাবদ্ধ নেই।

ভেড়ার লোম ছাঁটার সময় ভিকি প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে শুরু করে বারো ঘণ্টা কাজ করেন। তিনি সবসময়ই চাষি হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। তিনি বিনা মূল্যে অনেক খামারে কাজ করেছেন এবং সিরেনসেস্টার (cirencester)-এর ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকালচারাল কলেজ থেকে ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তার একটাই স্বপ্ন–তার আর জেসনের একটা কাউন্টি ফার্ম থাকবে। ফার্মের মালিকানা কাউন্টির থাকলেও কাউন্সিল হাউসের মতো কাউন্টি কর্তৃপক্ষ তাদের কাছে ফার্মটি ভাড়া দেবে। কিন্তু চীনের ইস্পাতের কারণে যেমন টাটার পোর্ট অ্যালবটের কারখানা হুমকির মুখে পড়েছে, তেমনি সস্তায় আমদানি করা গরু ও ভেড়ার মাংস এবং উলের কারণে ব্রিটিশ চাষিরাও হুমকির মধ্যে।

উল, ভেড়া ও গরুর সবচেয়ে বড় ভোক্তা হিসেবে চীনের ওপর বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের মূল্য কার্যত নির্ভর করে। উল মার্কেটিং বোর্ডের তথ্যানুসারে, চীন যুক্তরাজ্যের উলের ৩০ শতাংশ ক্রয় করে। তাছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভেড়া পালনও করা হয় চীনে। চীনের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির কারণে উলের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ব্রিটিশ কৃষকরা উলের দাম ভালো পাচ্ছেন। গত সাত বছর ধরে ব্রিটিশ কৃষকরা প্রতি কেজি উলের জন্য এক পাউন্ডেরও বেশি দাম পেয়েছেন।

কিন্তু চীনের অর্থনীতির সাম্প্রতিক শ্লথগতি ও ব্রিটিশ মুদ্রার তুলনামূলক শক্তিশালী অবস্থানের কারণে উলের দাম কমে গেছে, ফলে প্রতি কেজির দাম পাওয়া যাচ্ছে ৮৩ পেন্স করে। সেইসঙ্গে চীন আরো বেশি করে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ভেড়া ও উল ব্যবহার করার কারণে চীনের উদ্দেশ্যে উৎপাদিত নিউজিল্যান্ডের সস্তা ভেড়া ব্রিটেনের বাজারে অতি সরবরাহের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, ফলে ব্রিটিশ খামারের মুনাফা কমে যাচ্ছে।

ন্যাশনাল শিপ অ্যাসোসিয়েশনের জোয়ান ব্রিগস বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বললেন, ‘২০১৫ সালের দিকে চীনে নিউজিল্যান্ডের ভেড়ার মাংসের চাহিদা হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, আক্ষরিক অর্থেই নিউজিল্যান্ডের রপ্তানির জাহাজগুলো তাদের যাত্রার মাঝপথ থেকে ব্রিটেনের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। এর ফলে অসময়ে আমাদের বাজার সস্তা মাংসে ভেসে যায়। এ কারণে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সাধারণ একজন উৎপাদনকারী প্রতিটি ভেড়া বাবদ ১০.৯৫ পাউন্ড করে ক্ষতির শিকার হয়। এরকম পরিস্থিতিতে টিকে থাকা কঠিন।’

২০১৬ সালের এপ্রিলে ন্যাশনাল ফারমার্স ইউনিয়নের (এনএফইউ) প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৫ সালে যুক্তরাজ্যের খামারগুলোর মুনাফা হ্রাস পায় ২৯ শতাংশ, যার ফলে ক্ষতি হয় ১.৫ বিলিয়ন পাউন্ড। এই সহস্রাব্দে এটাই এক বছরে সবচেয়ে বড় দরপতন। এর জন্য এনএফইউ ‘বিশ্বজুড়ে বাড়তি উৎপাদন, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে চাহিদা হ্রাস, ২০১৫ সালে ব্রিটেনের মুদ্রার শক্তিশালী হওয়া এবং টানা চব্বিশ মাস খামারগুলোয় দরপতন–এসবের সম্মিলিত প্রভাবকে’ দায়ী করে।

মিলরয়ের কাছে এর অর্থ হলো তার বিদ্যমান নিম্ন মজুরির আরো হ্রাস পাওয়া। ব্রিটেনের সিরেনসেস্টার শহর থেকে তিনি বছরের প্রথম ছয় মাসজুড়ে বিস্তৃত মেষশাবক জন্মদান ও ভেড়ার পশম কাটার মৌসুমে সারা দেশে ভ্রমণ করেন, তারপর নরওয়েতে যান ভেড়ার পশম কেটে আরো এক মাসের বাড়তি আয়ের জন্য। ভেড়ার পশম কাটার কাজে একজন সহকারী হিসেবে তিনি ভেড়াপ্রতি ২৮ পেন্স করে আয় করেন। সব মিলিয়ে, নরওয়ের আয়সহ, তিনি বছরে ১০ হাজার পাউন্ডের মতো আয় করেন, যা একজন সহকারী শিক্ষক বা শিক্ষানবিশের আয়ের চেয়ে কম। আর এর জন্য তাকে প্রতিদিন ভোর সাড়ে ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কঠোর শ্রম দিতে হয়।

‘কৃষিকাজের অবস্থা খনি ও স্টিলের মতোই খারাপের দিকে যাচ্ছে,’ কাজের বিরতির মাঝে কটসওল্ড (Cotswold) অঞ্চলের একটা বড় খামারের নিচু পাথুরে দেওয়ালে ভর দিয়ে তিনি ব্যাখ্যা করে বললেন। ‘প্রক্রিয়াটা একটু ধীর এই যা, একবারে সব মানুষকে উচ্ছেদ করার বদলে একজন একজন করে ধীরে ধীরে করে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আমি জীবিকার জন্য অর্গানিক বা প্রাকৃতিক ভেড়ার মাংস উৎপাদন করি; কিন্তু নিজে খাওয়ার জন্য তা কিনতে পারি না। আমাকে সস্তা কোনো সুপার মার্কেট থেকে সস্তা মুরগির মাংস খুঁজে নিতে হয়।’

‘প্রক্রিয়াটা একটু ধীর এই যা, একবারে সব মানুষকে উচ্ছেদ করার বদলে একজন একজন করে ধীরে ধীরে করে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আমি জীবিকার জন্য অর্গানিক বা প্রাকৃতিক ভেড়ার মাংস উৎপাদন করি; কিন্তু নিজে খাওয়ার জন্য তা কিনতে পারি না। আমাকে সস্তা কোনো সুপার মার্কেট থেকে সস্তা মুরগির মাংস খুঁজে নিতে হয়।’

সাপ্তাহিক ফারমার্স গার্ডিয়ান (Farmers Guardian)-এর সম্পাদক বেন ব্রিগস মনে করেন, সুপারমার্কেটগুলোর মূল্যযুদ্ধের কারণে খামারিরা আরো বেশি আয় হারাচ্ছেন। ২০১৫ সালে খামারিরা প্রতি কেজি ভেড়ার মাংসের জন্য মাত্র তিন পাউন্ড করে পেয়েছেন, ফলে ৪০ কেজির একটা ভেড়া থেকে যে আয় এসেছে, তা খুবই কম। বিগ্রস বলেন, ‘ডেইরি ফার্মের খামারিদের অবস্থা তো আরো খারাপ। ১৮ মাস আগেও যেখানে একজন খামারি প্রতি লিটার দুধের দাম পেতেন ৩৫–৩৬ পেন্স, বর্তমানে তারা পাচ্ছেন মাত্র ১৬–১৭ পেন্স। ৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় যুক্তরাজ্যে ৩৫ হাজারের মতো গবাদি পশু ছিল। আর এখন এ সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১০ হাজারে। অনেকে মনে করছেন, এ সংখ্যা আগামী ১০ বছরে আরো কমে পাঁচ হাজারে নেমে আসবে।’

‘ডেইরি ফার্মের খামারিদের অবস্থা তো আরো খারাপ। ১৮ মাস আগেও যেখানে একজন খামারি প্রতি লিটার দুধের দাম পেতেন ৩৫–৩৬ পেন্স, বর্তমানে তারা পাচ্ছেন মাত্র ১৬–১৭ পেন্স। ৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় যুক্তরাজ্যে ৩৫ হাজারের মতো গবাদি পশু ছিল। আর এখন এ সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১০ হাজারে। অনেকে মনে করছেন, এ সংখ্যা আগামী ১০ বছরে আরো কমে পাঁচ হাজারে নেমে আসবে।’

ব্রিটেনের রিয়েল এস্টেট কোম্পানি স্যাভিলিস (Savills)-এর হিসাব অনুসারে ২০১৬ সালের জমি বিক্রেতাদের ৫০ শতাংশই হলেন কৃষক। গত সাত বছরের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। পণ্যের নিম্নমূল্য ও উচ্চ ঋণগ্রস্ততার কারণে কৃষকরা আগেই অবসর নিয়ে অ-কৃষকদের কাছে খামার বিক্রি করে দিচ্ছেন, যাদের মধ্যে রয়েছে লাইফস্টাইল ক্রেতা (১৬ শতাংশ), বিনিয়োগকারী (১০ শতাংশ) এবং প্রাতিষ্ঠানিক/করপোরেট ক্রেতা (২০ শতাংশ)। ব্রিগসের জিজ্ঞাসা হলো, ‘এর ফলে কৃষকদের অবস্থা কি দাঁড়াচ্ছে? আমরা গ্রাম থেকে মানুষগুলোকে হারাচ্ছি, বিশেষত তরুণদের। অনেক আগ্রহী তরুণেরই এ বিষয়ে নতুন নতুন ভাবনা আছে; কিন্তু এগুলো বাস্তবায়ন করতে হলো তো অন্তত টিকে থাকার মতো পরিবেশ থাকতে হবে।’

পণ্যের নিম্নমূল্য ও উচ্চ ঋণগ্রস্ততার কারণে কৃষকরা আগেই অবসর নিয়ে অ-কৃষকদের কাছে খামার বিক্রি করে দিচ্ছেন, যাদের মধ্যে রয়েছে লাইফস্টাইল ক্রেতা (১৬ শতাংশ), বিনিয়োগকারী (১০ শতাংশ) এবং প্রাতিষ্ঠানিক/করপোরেট ক্রেতা (২০ শতাংশ)।

আর ওদিকে কটসওল্ড এ মিলরয় বেশ হতাশ। তিনি বললেন, ‘এখানে জমি কেনার মতো টাকা আমার কোনোদিনই হবে না। কারণ, এখানে লন্ডনের টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে। গ্লোচেস্টারশায়ার (Gloucestershire)-এর কাউন্টি কাউন্সিল তাদের কাউন্সিল ফার্মগুলো বিক্রি করে দিচ্ছে। আমরা একমাত্র এগুলোই কেনার আশা করতে পারি; কিন্তু তার জন্যও তো ৩০ হাজার থেকে এক লাখ পাউন্ডের মতো খরচ হবে–গবাদি পশু ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনার খরচসহ।’ অবশ্য তিনি জোরের সঙ্গে বললেন, ‘আমি হাল ছাড়ব না। আমি সবসময়ই কৃষি বিষয়ে আগ্রহী ছিলাম। আহা, মানুষ যদি কৃষকদের আরেকটু বেশি সম্মান দিত।’

অসুস্থতা ভাতা ও পিতৃত্বকালীন ছুটির অধিকার অস্থায়ী কর্মীদের নেই, অন্যায্যভাবে ছাঁটাই থেকে সুরক্ষা পাওয়ার কোনো অধিকারও তাদের নেই। যদিও তাদের হয়ে তাদের নিয়োগকর্তাদের কর ও জাতীয় বিমা বাবদ খরচ বহন করতে হয়। এজেন্সি ওয়ার্কার রেগুলেশন-২০১০ অনুসারে কোনো অস্থায়ী এজেন্সি কর্মী যদি কোনো প্রতিষ্ঠানে টানা ১২ সপ্তাহ কাজ করেন, তাহলে তিনি পূর্ণকালীন কর্মরতদের সমান বেতন, ছুটি ও অবসর ভাতার অধিকার পাবেন। যদিও এর বাস্তবায়ন হয় খুব কমই।

এজেন্সি ওয়ার্কার রেগুলেশন-২০১০ অনুসারে কোনো অস্থায়ী এজেন্সি কর্মী যদি কোনো প্রতিষ্ঠানে টানা ১২ সপ্তাহ কাজ করেন, তাহলে তিনি পূর্ণকালীন কর্মরতদের সমান বেতন, ছুটি ও অবসর ভাতার অধিকার পাবেন। যদিও এর বাস্তবায়ন হয় খুব কমই।

এছাড়াও কাজের আরো নানা ধরনের উদ্ভব হচ্ছে, যার ফলে এজেন্সির কাজ আর অন্যান্য কাজের মধ্যকার পার্থক্য অস্পষ্ট হয়ে আসছে। এক ধরনের কাজ রয়েছে যেখানে কর্মীদের এমন একটি কোম্পানির মাধ্যমে বেতন প্রদান করা হয়, যাদের কাজ শুধু পে রোল সার্ভিস বা বেতনবিষয়ক। এক্ষেত্রেও কর্মীরা এজেন্সির মাধ্যমেই কাজ করেন; কিন্তু অন্যান্য এজেন্সি কর্মীর সঙ্গে তাদের পার্থক্য হলো, তাদেরকে স্বনিয়োজিত কর্মী হিসেবে দেখা হয়। এ ধরনের কর্মীর সংখ্যা কম হলেও তাদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। তাদের কাজের অধিকার ন্যূনতম এবং তাদের জন্য কর ও বিমার হারও ভিন্ন ধরনের।

রেজুলেশন ফাউন্ডেশন (Resolution Foundation)-এর হিসাব অনুসারে, প্রায় ৬৬ হাজার এজেন্সি কর্মী আসলে স্বনিয়োজিত কর্মী। এমিলি মে’র কথাই ধরা যাক। তার বয়স তিরিশ এবং তিনি বিশেষ প্রয়োজনসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষা সহকারী হিসেবে কাজ করেন। পনেরো বছর আগে তিনি এনিমেশন শেখার উদ্দেশ্যে লন্ডন আসেন। পাস করার পর তিনি ফেয়ারব্রিজের কিশোর-কিশোরীদের জন্য এনিমেশন ওয়ার্কশপ পরিচালনা করেছেন। ফেয়ারব্রিজ সমস্যাগ্রস্ত কিশোর-কিশোরীদের জন্য গঠিত একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান, যা এখন প্রিন্সেসে’স ট্রাস্ট-এর অংশ। এরপর থেকে তিনি বিভিন্ন ধরনের স্থায়ী কাজই করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে ডেভেলপমেন্ট টিউটর থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের দাতব্য প্রতিষ্ঠানের ভ্রমণ ব্যবস্থাপক ইত্যাদি। কিন্তু ২০১৫ সালের আগস্টে তিনি যে দাতব্য প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করছিলেন সেটা বন্ধ হয়ে যায়, ফলে তিনি বেকার হয়ে যান। কয়েক মাস পর তিনি স্থানীয় চাকরি কেন্দ্রের সঙ্গে নিউ এন্টারপ্রাইজ অ্যালাউন্স স্কিমে যোগ দেওয়ার জন্য চুক্তি করেন, যার ফলে কার্যত তিনি একজন স্বনিয়োজিত কর্মীতে পরিণত হন, যেখানে তার ব্যাবসা হলো শিক্ষা প্রদান। তাকে সাপ্তাহিক একটা ভাতা প্রদান করা হয় এবং আশ্বাস দেওয়া হয় যে, এর ফলে আবাসন ভাতাসহ অন্যান্য ভাতার ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না।

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে এমিলি ট্রানজিশনাল কেয়ার এডুকেশন সার্ভিসেস লিমিটেড (টিসিইএস)-এ বিশেষ প্রয়োজনসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষা সহকারী হিসেবে একটি পার্টটাইম চাকরি পান। এটি একটি বেসরকারি কোম্পানি, যা এসেক্স ও লন্ডনের স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় চলা শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। বিশেষ প্রয়োজনসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য কোম্পানিটি তিনটি বেসরকারি স্কুল পরিচালনা করে। এমিলি কাজটা পেয়েছিলেন টিচিং ট্যালেন্ট নামের একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে, যারা মূলত বিশেষ প্রয়োজনসম্পন্ন শিশুদের জন্য শিক্ষক সরবরাহ করে। টিচিং ট্যালেন্টের মালিকানা আবার পুরোপুরি টিসিইএস-এর হাতে। ফলে এমিলিকে নিয়োগ দিয়েছে এমন একটি এজেন্সি, যার মালিক হলো এমিলি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করে সেই প্রতিষ্ঠানটি। চাকরিতে যোগদানের কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য তিনি জানতে পারলেন, তার নিয়োগকর্তা আসলে আরেকটি তথাকথিত আমব্রেলা কোম্পানি, যার নাম ‘সারি ডাক সলুশন্স’ (Surrey Duck Solutions)।

তিনি বললেন, ‘এজেন্সিটি আমাকে দৈনিক ১০০ পাউন্ড করে দেওয়ার কথা বলেছিল; কিন্তু কাজ শুরুর পর তারা বলল, আপনাকে এই আমব্রেলা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করতে হবে এবং তারা প্রসেসিং ফি হিসেবে আপনার মজুরি থেকে পাঁচ পাউন্ড করে কেটে নেবে।’

‘আমি তাদের পে স্লিপ দেখে কিছুই বুঝতে পারতাম না–ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স পেমেন্টের পরিমাণ একেক সময় একেক রকম এবং টাকা কাটার হারও সব সময় পরিবর্তিত হতো।’

এমনকি আমব্রেলা কোম্পানির নামও ক্রমাগত পরিবর্তন হতে থাকল–এক মাসে তিনি ভিসন হাউস, ৩ডি রোড, রিচমন্ড টিডব্লিউনাইন ঠিকানায় অবস্থিত সারি ডক সলুশন্সের অধীন কাজ করলেন। তার পরের মাসেই আবার তাকে কাজ করতে হলো অরকিড কনসালটেন্সি লিমিটেডের অধীন, যার ঠিকানা আবার সেই ভিসন হাউস, ৩ডি রোড, রিচমন্ড টিডব্লিউনাইন। তার সহকর্মীরাও একেকজন একেক আমব্রেলা কোম্পানির কাছ থেকে মজুরি পেতেন।

এক মাসে তিনি ভিসন হাউস, ৩ডি রোড, রিচমন্ড টিডব্লিউনাইন ঠিকানায় অবস্থিত সারি ডক সলুশন্সের অধীন কাজ করলেন। তার পরের মাসেই আবার তাকে কাজ করতে হলো অরকিড কনসালটেন্সি লিমিটেডের অধীন, যার ঠিকানা আবার সেই ভিসন হাউস, ৩ডি রোড, রিচমন্ড টিডব্লিউনাইন।

কোম্পানিজ হাউসের কাছে থাকা অর্কিড কনসালটেন্সির পরিচালকদের তালিকা থেকে অদ্ভুত একটা ব্যবস্থা চোখে পড়ে–১৩ মার্চ ২০১৬ তারিখে প্রমোদ পাঠাকে পরিচালক এবং একমাত্র শেয়ার মালিক হিসেবে দেখিয়ে কোম্পানিটি যাত্রা শুরু করে। ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ পরিচালক হিসেবে প্রমোদ পাঠার নিয়োগ বাতিল করে দিপেন হাসমুখভাই প্যাটেলকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আবার ২০১৬ সালের মে মাসে দিপেন হাসমুখভাইয়ের নিয়োগ বাতিল করে প্রমোদ পাঠাকে পরিচালক করা হয়। এভাবে প্রতিবারই কোম্পানির একমাত্র শেয়ার দুজন ব্যক্তির মাঝে স্থানান্তরিত হতে থাকে।

অন্যদিকে ২০১৩ সালের মার্চে সারি ডাক সলুশন্স কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেন রুয়াইরি লাফলিন ম্যাক্কেন। ২০১৪ সালের অক্টোবরে লাফলিন ম্যাক্কেন কোম্পানিটি ছেড়ে যান এবং ভেঙ্কট শ্রীকান্ত পোলাভারাপু কোম্পানিটির একমাত্র মালিক ও পরিচালক বনে যান। তিনি কোম্পানিটি ছেড়ে যান ২০১৬ সালের এপ্রিলে এবং তার জায়গা দখল করেন দিপেন হাসমুখভাই প্যাটেল, যিনি একইসঙ্গে পাইওনিয়ার বিজনেস কনসাল্টিং-এরও পরিচালক হন, যে কোম্পানিটির ঠিকানা সেই ৩ডি রোডের ভিসন হাউস। এই কোম্পানিটি তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ২০১১ সালে। ২০১২ সালে তিনি ছেড়ে যাওয়ার পর তার স্থান দখল করেন জয়েশ জাভেরচাঁদ শাহ। প্রকৃতপক্ষে ২০১১ সাল থেকে দিপেন হাসমুখভাই প্যাটেল উনষাটটি কোম্পানির পরিচালক ছিলেন, যার তেতাল্লিশটিতে তিনি ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান এবং ২০১৬ সালের ৬ মে পদত্যাগ করেন।

ভিসন হাউস, ৩ডি রোড, রিচমন্ড টিডব্লিউনাইন হলো রিচমন্ডের একটি সাদামাটা অফিস ভবন। আনুষ্ঠানিকভাবে ভবনটি ফাইন্যান্সিয়াল পার্টনারশিপ এলএলপি নামের একটি হিসাবরক্ষণ বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের অফিস। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে এই প্রতিষ্ঠানটির জন্ম দেন দিপেন হাসমুখভাই প্যাটেল এবং জয়েশ জাভেরচাঁদ শাহ। অবশ্য অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জয়েশ জাভেরচাঁদ শাহ প্রতিষ্ঠানটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন আর দীপেন হাসমুখভাই প্যাটেল এখান থেকে পদত্যাগ করেন ২০১৬ সালের ১১ এপ্রিল।

গত পাঁচ বছরে ভিশন হাউসের তিনটি রুম–এফ১ থেকে এফ৩–প্রায় ষাটটি ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানির অফিস ঠিকানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, যার অনেকগুলোই এখন বিলুপ্ত। এর মধ্যে রয়েছে: ডায়াল আ মিল, ওথ্রি টেকনোলজি সলুশন্স, হারলে স্ট্রিট কসমেটিক ডক্টরস লিমিটেড, গ্রিন স্পেস হোমস, কার মাইন্ডস ইউকে, রায়ান সারভেইলেন্স সার্ভিসেস ও বিউড ইন্টেরিয়রস অ্যান্ড কনসাল্টিং। এই কোম্পানিগুলো ফাইন্যান্সিয়াল পার্টনারশিপ এলএলপির পে রোল সার্ভিসের অংশ হিসেবে কাজ করেছে। কাগুজে এই কোম্পানিগুলো কর্মীদের সঙ্গে চুক্তি করে তাদেরকে স্থায়ীভাবে অধিকারহীন করে রেখেছে এবং তাদের নিম্ন মজুরি থেকে আরো অর্থ শুষে নিয়েছে।

এই কোম্পানিগুলো ফাইন্যান্সিয়াল পার্টনারশিপ এলএলপির পে রোল সার্ভিসের অংশ হিসেবে কাজ করেছে। কাগুজে এই কোম্পানিগুলো কর্মীদের সঙ্গে চুক্তি করে তাদেরকে স্থায়ীভাবে অধিকারহীন করে রেখেছে এবং তাদের নিম্ন মজুরি থেকে আরো অর্থ শুষে নিয়েছে।

‘এখন সবকিছুর মধ্যেই বাড়তি একটা স্তর দেখা যায়, যা আগে কখনোই ছিল না,’ বেশ শান্ত ও ক্লান্ত গলায় বললেন এমিলি। ‘বাসায় খাবার অর্ডার দিলে ভিন্ন একটা কোম্পানি তা দিয়ে যায়। কোথাও কাজ করতে গেলে এর মাঝে অন্য মানুষ ঢুকে পড়ে যেন প্রতিটি পদক্ষেপ থেকে টাকা আদায় করা যায়। ধরলাম এগুলো খুব চালাকির কাজ; কিন্তু এই চালাকি করে কার উপকার হচ্ছে? টিসিইএস-এর সঙ্গে কাজ করার সময় যেভাবে কাজ-কারবার চলছে এবং যেভাবে বিশেষ প্রয়োজনসম্পন্ন শিশুদের অস্থায়ী কর্মীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে আমি বেশ উদ্বিগ্ন ছিলাম। আমাকে একবার কোনোরকম পূর্বাপর ব্যাখ্যা ছাড়াই একদল শিশুর দেখভাল করার দায়িত্ব দেওয়া হলো, যারা বেশ জটিলরকম আচরণ সমস্যায় ভুগছিল। তারা যখন দেওয়ালে লাথি মারতে শুরু করেছিল, তখন সেই পরিস্থিতি সামলানোর মতো পর্যাপ্ত তথ্য আমার কাছে ছিল না।’

এমিলি তার কিছু পে স্লিপ আমাকে দেখালেন। এক সপ্তাহে দেখা গেল তার আয় ছিল ৫০০ পাউন্ড; কিন্তু তার নিয়োগকর্তা আমব্রেলা কোম্পানি তার বেতন থেকে ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের টাকা এবং প্রসেসিং ফি বাবাদ ২০ পাউন্ডসহ মোট ৫০.৮৫ পাউন্ড কেটে নিয়েছে। তার পরের সপ্তাহে কেটে নেওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়াল ৫১.১৭ পাউন্ড।

এমিলি তার কিছু পে স্লিপ আমাকে দেখালেন। এক সপ্তাহে দেখা গেল তার আয় ছিল ৫০০ পাউন্ড; কিন্তু তার নিয়োগকর্তা আমব্রেলা কোম্পানি তার বেতন থেকে ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের টাকা এবং প্রসেসিং ফি বাবাদ ২০ পাউন্ডসহ মোট ৫০.৮৫ পাউন্ড কেটে নিয়েছে। তার পরের সপ্তাহে কেটে নেওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়াল ৫১.১৭ পাউন্ড। কোম্পানি এক সপ্তাহে দেখা গেল পিএওয়াইই (পে এজ ইউ আর্ন) খাতে কর এবং বিমার কিস্তিসহ মোট ৬০.৫৫ পাউন্ড এবং তার পরের সপ্তাহে ৬১.২২ পাউন্ড কেটে নিল। এছাড়া তারা কখনো স্টুডেন্ট লোন পরিশোধ আবার কখনো স্রেফ ‘কোম্পানি কর্তৃক কেটে নেওয়া অর্থ’ বাবদ তিন পাউন্ড করে কেটে নেয়। এভাবে কেটে নেওয়ার কারণে তার আয় দাঁড়ায় গড়ে ৩৮৫ পাউন্ড। কেটে নেওয়া অর্থের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে এই আয়ের পরিমাণ ওঠানামা করে। যুক্তরাজ্যের প্রথানুসারে বছরে ৩৯ সপ্তাহ কাজের হিসাব ধরলে তার আয় দাঁড়ায় বার্ষিক ১৫ হাজার পাউন্ড।

স্বামী-সন্তানসহ এক বেডরুমের স্যাঁতসেঁতে একটি বাসার জন্য তাকে মাসে ভাড়া দিতে হয় ৭০০ পাউন্ড। কাজের সময় তার সন্তানকে যে স্থানীয় নার্সারিতে রেখে যেতে হয়, তার জন্য খরচ সপ্তাহে ১৫০ পাউন্ড। আবাসন সুবিধা ও চাইল্ড ট্যাক্স ক্রেডিট থেকে অর্থ না-পেলে তার বেতনের পুরো অর্থই খরচ হয়ে যেত চাইল্ডকেয়ার বাবদ ৮০০০ পাউন্ড এবং বাসাভাড়া বাবদ ৮৪০০ পাউন্ড দিতে গিয়ে। এমিলির স্বামী সংগীত জগতে কাজ করেন, যেখান কাজের চুক্তি হয় খুবই স্বল্প মেয়াদের। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলিতভাবে বছরে ২০০০০ পাউন্ড আয় করলেও বাসাভাড়া, চাইল্ড কেয়ারসহ বিভিন্ন খাতের বিল পরিশোধ করতে নাভিশ্বাস ওঠে।

স্বামী-সন্তানসহ এক বেডরুমের স্যাঁতসেঁতে একটি বাসার জন্য তাকে মাসে ভাড়া দিতে হয় ৭০০ পাউন্ড। কাজের সময় তার সন্তানকে যে স্থানীয় নার্সারিতে রেখে যেতে হয়, তার জন্য খরচ সপ্তাহে ১৫০ পাউন্ড। আবাসন সুবিধা ও চাইল্ড ট্যাক্স ক্রেডিট থেকে অর্থ না-পেলে তার বেতনের পুরো অর্থই খরচ হয়ে যেত চাইল্ডকেয়ার বাবদ ৮০০০ পাউন্ড এবং বাসাভাড়া বাবদ ৮৪০০ পাউন্ড দিতে গিয়ে। এমিলির স্বামী সংগীত জগতে কাজ করেন, যেখান কাজের চুক্তি হয় খুবই স্বল্প মেয়াদের। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলিতভাবে বছরে ২০০০০ পাউন্ড আয় করলেও বাসাভাড়া, চাইল্ড কেয়ারসহ বিভিন্ন খাতের বিল পরিশোধ করতে নাভিশ্বাস ওঠে।

এমিলির জন্য এ ধরনের আয়োজনের একটাই সুবিধা থাকতে পারে–যেহেতু তিনি স্বনিয়োজিত–তাই যদি তিনি এনইএ (নিউ এন্টারপ্রাইজ অ্যালাউন্স) স্কিমের সুবিধাটা ধরে রাখতে পারেন। ‘আমার ব্যাবসায়িক পরিকল্পনার চেয়ে অনেক বেশি সময় আমি কাজ করছি; কিন্তু জুনের আগ পর্যন্ত আমি তাদেরকে কিছুই জানাইনি। কারণ, আমি মনে করেছি, এতে কোনো সমস্যা নেই,’ তিনি জানালেন। ‘তারা আমাকে বলেছেন, আয় এবং কর্মঘণ্টার হিসাব করবর্ষের শেষে করা হবে।’

কিন্তু জুলাই মাসে তিনি যখন তার চাইল্ড ট্যাক্স ক্রেডিট সুবিধা–নিম্ন আয়ের পিতামাতার সন্তানের যত্ন বাবদ দেওয়া অর্থ সহায়তা–নবায়ন করতে গেলেন এবং নিজের আয়ের হিসাব জমা দিলেন, তাকে জানানো হলো, ফেব্রুয়ারি আর জুনের মধ্যে তার আয় এত বেশি ছিল যে, তিনি আর এই সুবিধা পাওয়ার যোগ্য নন। প্রকৃতপক্ষে তার কাছে উলটো কর্তৃপক্ষের অর্থ পাওনা, যা শোধ না-করা পর্যন্ত তিনি আর কোনো চাইল্ড ট্যাক্স ক্রেডিট পাবেন না।

এমিলি আপিল করলেন, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করার সময় তার বার্ষিক আয় ছিল ২০০০০ পাউন্ড; কিন্তু তারপরও তিনি চাইল্ড ক্রেডিট ট্যাক্স পেয়েছেন। যদি তিনি বাহান্ন সপ্তাহ ধরে প্রতি সপ্তাহে ৩৮৫ পাউন্ড আয় করতেন, তাহলেও তার বার্ষিক আয় হতো মোটামুটি ২০০০০ পাউন্ড। তিনি জানতে চাইলেন, প্রতি মাসে ট্যাক্স ক্রেডিট আগের চেয়ে আরো কম করে নিলে চলবে কি না, তার সন্তানের নার্সারির বেতন দেওয়ার আর কোনো উপায় তিনি দেখছেন না। তাকে বলা হলো নবায়নের আবেদন জমা দেওয়ার দশ সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগে তারা তাকে কিছু বলতে পারবে না। ১০ অক্টোবরের আগপর্যন্ত তিনি তাদের সঙ্গে কথাই বলতে পারলেন না।

তিনি পুরো গ্রীষ্মকাল কাটিয়েছেন তার এক বন্ধুর জন্য কাজ করে; কিন্তু সন্তানের নার্সির বেতন দিতে গিয়ে তিনি ঋণে ডুবে গেছেন–বর্তমানে তার ঋণ ৭০০ পাউন্ড। ‘আমি ভেবেছিলাম আমার নতুন চাকরির আয়ের হিসাব দেওয়ার পর সবকিছু এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে; কিন্তু নবায়নের জন্য আবেদন করায় তারা আমার সঙ্গে কথাই বলল না। আমি জানি না, সমস্যাটা ঠিক কী এবং কেউ আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে রাজি হলো না।’

তিনি একদল বন্ধুর কাছে তার দুর্দশার কথা বর্ণনা করছিলেন। তিনি বললেন, ‘তারা সবাই বেশ স্মার্ট, উদার এবং গার্ডিয়ান পত্রিকা-পড়া মানুষ। আমি তাদেরকে আমার অবস্থার কথা বর্ণনা করলাম; কিন্তু তারা কোনোভাবেই বুঝতে পারছিল না জব সেন্টারে যাওয়া, সেখানে গিয়ে নিজেকে আবর্জনার মতো মনে হওয়া… এগুলো আসলে কেমন লাগে। একজন মাত্র নারী ব্যাপারটা ধরতে পারলেন, যিনি নিজেও কাছাকাছি সময়ে ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন। তিনি বললেন, এমিলি শোনেন, এই মানুষগুলো আসলে বুঝতে পারছে না, আমরা আজ যে অবস্থায় আছি, তারা নিজেরা তা থেকে মাত্র কয়েকটা পদক্ষেপ দূরে অবস্থান করছে। বেকার হওয়া, আবাসন সুবিধার ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হওয়া এবং সমস্যায় পড়া থেকে তাদের অবস্থানের দূরত্ব স্রেফ কয়েক পদক্ষেপ।’

 

Social Share
  •  
  •  
  • 574
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *