ক্যাথরিন গুন্ড ও দারেশা কি রচিত সাবেলা ভার্গাসের জীবনচরিত
মুহম্মদ আনোয়ার হোসেন
সিনেমা সম্পর্কিত তথ্য
নাম: সাবেলা/CHAVELA (২০১৭)
প্রযোজনা ও পরিচালনা: ক্যাথরিন গুন্ড ও দারেশা কি। সংগীত: গিল তালমি
চিত্রগ্রহণ: নাটালিয়া কিউভাস, ক্যাথরিন গুন্ড ও পলা গুতিরিজ ওরিও। সম্পাদনা: কার্লা গুতেরেস
দৈর্ঘ্য: ৯৩ মিনিট। ভাষা: স্পেনিশ ও কিছু কিছু ইংরেজি। দেশ: মেক্সিকো ও স্পেন।
সাবেলা/Chavela (২০১৭)। একজন শিল্পীর প্রতিকৃতি
মেহিকান/মোহিকান শিল্পী সাবেলা ভার্গাসকে (শাভেলা/চাভেলা ভার্গাস/সাবেলা ভার্গাস, ১৭ এপ্রিল ১৯১৯–৫ আগস্ট ২০১২) নিয়ে বানানো প্রামাণ্যচিত্র সাবেলা (২০১৭) দেখতে শুরু করে শেষ করার পর মনে হলো, এই সিনেমা জুড়ে প্রচুর পরিমাণে নানানজনের সাক্ষাৎকার থাকলেও ভালো চিত্রনাট্যের কারণে একবারের জন্যও মনে পড়েনি সাক্ষাৎকার প্রামাণ্য চিত্রের ক্ষেত্রে অতি ব্যবহারের ফলে জীর্ণ হয়ে যাওয়া একটা উপাদান। হতে পারে সাবেলার গানগুলো ঠিক ঠিক সময়ে ব্যবহারের ফলে, সাবেলার কণ্ঠের কারণে, গায়কির ঢঙে, গানের কথার কারণে, সাবেলাকে নিয়ে কথার কারণে, মনে পড়তে পারেনি।
সিনেমার শুরুতেই একজন জানান, সাবেলার কণ্ঠ ঠিক যেন ক্যানিয়নের শব্দের মতো/ক্যানিয়নের ধেয়ে আসা বাতাসের শব্দের মতো, হাহাকার, হারানোর বেদনা, একাকিত্বের যন্ত্রণা এবং দৃঢ়তা ও একাগ্রতায় ভরা, তার একাগ্রতা বেঁচে থাকার প্রতি, শিল্পের প্রতি। এই কিংবদন্তি শিল্পীর জন্ম কোস্টারিকায় হলেও শিল্পী হওয়ার বাসনায়, শিল্পের টানে ১৭ বছর বয়সেই নিজ পরিবার ছেড়ে চলে আসেন মেহিকোতে, যদিও পরিবার বলে তেমন একটা কিছু তার ঠিকমতো ছিল না, ছোটবেলায় বাবা-মার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার কারণে বড় হয়েছেন এক চাচা/মামার কাছে, আর সারা জীবন তার ক্ষোভ ছিল তার নিজের মায়ের প্রতি–কেন তার মা তাকে পছন্দ করতেন না, কেন তাকে ভালোবাসতেন না, আর নানাবিধ কারণেই সারা জীবন সাবেলার সঙ্গী ছিল একাকিত্ব।
আবার সাবেলাসহ অনেকেই মনে করেন, একাকিত্ব আছে/ছিল বলেই তিনি সাবেলা হতে পেরেছেন এবং সারা জীবন একাকিত্ব সাবেলাকে একনিষ্ঠভাবে সততার সঙ্গে সঙ্গ দিয়ে গেছে। আকন্ঠ টাকিলা পান করতে পছন্দ করতেন ছোটবেলা থেকেই, যৌবন পার করেছেন এক বার থেকে আরেকবারে গান গেয়ে, পান করে আর সবান্ধব বারের সব পানীয় শেষ করেছেন, তুমুল তৃষ্ণা নিয়ে, দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। তিনি সবসময় চেষ্টা করেছেন নিজের মতো থাকতে, নিজের মতো গাইতে–সেটা সমাজমান্য না-হলেও বা বিফলতার কারণ হলেও। তিনি যে রাঞ্চেরা ধারার গান করতেন সেটা ছিল মূলত পুরুষ গায়কদের গান। এ ধারার গানের জন্ম মেহিকোর বিভিন্ন গ্রামের কৃষিজমি বা খামারগুলোতে এবং মূলত অভিজাত সংস্কৃতির বিপক্ষে এ ধরনের গান।
তিনি সবসময় চেষ্টা করেছেন নিজের মতো থাকতে, নিজের মতো গাইতে–সেটা সমাজমান্য না-হলেও বা বিফলতার কারণ হলেও। তিনি যে রাঞ্চেরা ধারার গান করতেন সেটা ছিল মূলত পুরুষ গায়কদের গান। এ ধারার গানের জন্ম মেহিকোর বিভিন্ন গ্রামের কৃষিজমি বা খামারগুলোতে এবং মূলত অভিজাত সংস্কৃতির বিপক্ষে এ ধরনের গান।
তিনি ১৯৫০ সালের অনেক আগে থেকেই প্যান্ট-শার্ট পরা শুরু করেন, যদিও তখন তিনি রাস্তায় বের হলেই লেসবিয়ান, ডাইক, মাগি ইত্যাদি শুনতেন। নিজের পোশাক নিয়ে তিনি নিজেই রসিকতা করে বলেন, তিনি কখনোই মেয়েদের পোশাকে স্বস্তিবোধ করেননি। এমনও হয়েছে গান গাইতে গিয়ে তিনি হয়তো মন দিয়ে গান গাইছেন, যেই হাত উপরে তুলেছেন অমনি নিচ থেকে পোশাক নাই হয়ে গেছে! ভাবুন অবস্থা। তার মতে, মেয়েদের পোশাকে তাকে দেখতে ঠিক ‘হিজড়া’ ‘হিজড়া’ লাগে। তো, তিনি বেছে নিলেন তার আরাম আর স্বস্তির জন্য ছেলেদের মতো পোশাক আর তার সঙ্গে ছিল তার রমণীহরণকারী আত্মা। তিনি সমকামী ছিলেন, অনেক দাওয়াতে প্রচুর সরকারি আমলা-কর্মকর্তা-কর্মচারীর বউ রাতের আঁধারে নাই হয়ে যেত, সাবেলা ভার্গাসের সঙ্গে। তার সঙ্গে আরেক মোহিকান কিংবদন্তি ফ্রিদা কাহালোর সঙ্গেও এক ক্ষণকালীন ভালোবাসাপূর্ণ বিরহের সম্পর্ক ছিল। তিনি ফ্রিদাকে বলেছিলেন, আসলে কোনো সম্পর্কই তো টেকে না, হয়তো দেখা যাবে কোনো এক সকালে তিনি আর নেই–তার চলে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে এবং তিনি ফ্রিদাকে ছেড়ে তার গিটার নিয়ে চলে গেছেন এবং হয়তো আর কোনোদিন ফিরে আসবেন না। ফ্রিদা মেনে নিয়েছিলেন, ফ্রিদা নিজেও জানতেন জীবনের পূর্ণতা অনেকটাই অপূর্ণতার যাপনের ফসল। ফ্রিদার প্রতি তার বিরহ এবং ভালোবাসাভরা বয়ান, তার আবেগ পুরোটাই সম্মানে মোড়ানো।
একসময় বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমে তার মদপান বাড়তে থাকে এবং অনেক রাতেই গান শেষ করার আগে দেখা যেত তিনি মাতাল হয়ে মাতলামি করছেন অথবা বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছেন। সারা জীবনে কখনোই তিনি বৈষয়িক ছিলেন না, ফলে তার গান অনেক জনপ্রিয় হলেও তিনি গরিব এবং সাধারণ রয়ে গেছেন আর তার বোহেমিয়ান আচরণের ফলে তার তেমন কোনো সঙ্গীসাথি বা বন্ধুবান্ধব, কিছুই নেই–তিনি একা। ফলে তার জায়গা হয় শহরের বাইরের ছোট এক ঘরের বাড়িতে, যেখানে আসবাবপত্র বলে তেমন কিছু ছিল না আর সঙ্গী বলতে একমাত্র কুকুর। দিনের পর দিন দুজনেই না-খেয়ে পার করেছেন আবার কেউ কিছু দিলে খেয়েছেন।
৯০-এর দশকের শুরু পর্যন্ত এভাবেই চলছিল, তার খোঁজ কেউ নেয়নি এবং সবাই ধরে নিয়েছিল তিনি মারা গেছেন আর বেঁচে নেই! এর পর থেকেই আবার শুরু হয় তার নবজাগরণ, তার এক বন্ধু তার খোঁজখবর নেওয়া শুরু করে এবং ধীরে ধীরে সবাই জানতে শুরু করে সাবেলা এখনো বেঁচে আছেন, তিনি আগের মতোই গান গাইতে চান। এক তরুণী আইনজীবীর প্রেমে পড়েন তিনি এবং সেই সুদর্শনাও সাড়া দেয় তার প্রেমে। শুরু হয় আবার তার উতল হাওয়া জীবন, আবার সুযোগ ঘটে শহরের নামি বার, রেস্তোরাঁ আর হোটেলে গান গাওয়ার। এই নবজাগরণের ঢেউ সাগর পার হয়ে স্পেনেও ছড়িয়ে পড়ে। চলচ্চিত্রকার পেদ্রো আলমোদাভার তার সিনেমায় ব্যবহার করতে শুরু করেন সাবেলার গান আর তিনি জানান যে, সাবেলার গান দিয়ে তিনি এতই আবিষ্ট হয়ে পড়েন যে, একটা সময়ে চিত্রনাট্য লেখার সময়েই তার মাথায় থাকত কোথায় কোথায় কখন তিনি সাবেলার কোন গান ব্যবহার করবেন। শুরু হয়ে যায় সাবেলার নতুন জীবন। একটা সময়ে আবার তার প্রেমিকা চলে যায়। তিনি একা হয়ে পড়েন কিন্তু ততদিনে তিনি জেনে গেছেন একাকিত্ব তার সঙ্গে বন্ধুর মতোই আছে সেই ছোটবেলা থেকেই। মূলত এ সময় থেকেই চলচ্চিত্রকার ক্যাথরিন গুন্ড তাকে ধারণ করতে শুরু করেন।
সাবেলা ভার্গাসের জনপ্রিয়তার পরিধি দিন দিন বাড়ছে, একসময় তিনি নিন্দিত ছিলেন তার যৌন পরিচয়ের জন্য, মেয়ে হয়ে রাঞ্চেরা গান গাওয়ার জন্য, সমকামী পরিচয়ের কারণে নানান বিড়ম্বনা, অপমানের শিকার হতে হয়েছে বারবার। আর এখন তিনি তার শিল্পকর্মের জন্য তো বটেই এমনকি তার সমকামী পরিচয়ের জন্যও সমান নন্দিত।
সারা সিনেমা জুড়েই রয়েছে মেহিকান সংস্কৃতির উদ্দাম যাপনের, বিপ্লবের জীবনের নানান চিত্র, কখনো সাদাকালো, কখনো রঙিন, কখনো ধারণকৃত চিত্র, কখনো ছবি আবার কখনো খবর বা সিনেমার অংশ, সবকিছু মিলিয়ে দারুণ একটা রঙিন সুড়ঙ্গে পরিভ্রমণের অভিজ্ঞতা তৈরি করে দেয় ‘সাবেলা’। এবং শুরুতেই যে বিষয়টার অবতারণা করা হয়েছিল যে, এ ধরনের সংরক্ষিত চিত্রের সাহায্যে এবং সাক্ষাৎকার নির্ভর প্রামাণ্যচিত্র খুব সহজেই একঘেয়ে হয়ে উঠতে পারে এ বিষয়ে সচেতন না-থাকলে; কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেটা হয়নি, চলচ্চিত্রকারদ্বয় (ক্যাথরিন গুন্ড ও দারেশা কি) সেটা হতে দেননি। এবং দশকের পর দশক জুড়ে এমন জনপ্রিয় একজন শিল্পীকে বিষয় করে সিনেমা বানাতে গিয়ে সহজেই অতি ভাবাবেগে আক্রান্ত হয়ে পড়েননি তারা দুজন। আর সাবেলা ভার্গাসের জনপ্রিয়তার পরিধি দিন দিন বাড়ছে, একসময় তিনি নিন্দিত ছিলেন তার যৌন পরিচয়ের জন্য, মেয়ে হয়ে রাঞ্চেরা গান গাওয়ার জন্য, সমকামী পরিচয়ের কারণে নানান বিড়ম্বনা, অপমানের শিকার হতে হয়েছে বারবার। আর এখন তিনি তার শিল্পকর্মের জন্য তো বটেই এমনকি তার সমকামী পরিচয়ের জন্যও সমান নন্দিত।
মুহম্মদ আনোয়ার হোসেন: চলচ্চিত্রকার, চলচ্চিত্র সমালোচক। ইমেইল: raiparasadardi@gmail.com
তথ্যসূত্র
http://www.chavelavargasfilm.com/
https://en.wikipedia.org/wiki/Chavela_(film)
https://www.youtube.com/watch?v=Z-wxFpPGEno
https://www.youtube.com/watch?v=PRmE06fgwe4 (এখানে দেখতে পারেন সিনেমা ‘সাবেলা’।)
https://www.youtube.com/watch?v=Ms2ngcTbup0 (শুনতে পারেন সাবেলার গান।)
https://www.imdb.com/title/tt6217664/
https://en.wikipedia.org/wiki/Chavela_Vargas
https://en.wikipedia.org/wiki/Ranchera
https://en.wikipedia.org/wiki/Catherine_Gund
https://www.latimes.com/entertainment/movies/la-et-mn-capsule-chavela-review-20171005-story.html
https://www.screendaily.com/reviews/chavela-berlin-review/5114878.article