অভিজিৎ ও দুফলোর ভাবনায় উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষা

গ্রন্থ পর্যালোচনা

অভিজিৎ ও দুফলোর ভাবনায় উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষা

আলমগীরখান

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো তাদের যৌথভাবে রচিত পুওর ইকোনমিকস বইয়ে সমাজে ও জাতীয় জীবনে ক্ষুদ্রঋণের প্রভাব, প্রত্যাশা ও সীমাবদ্ধতার ওপর অন্তর্ভেদী আলো নিক্ষেপ করেছেন। তারা এমন কিছু সত্য আবিষ্কার করেছেন, যা ক্ষুদ্রঋণ সম্পর্কিত বিতর্কে সবচেয়ে ভালো মসলা সরবরাহ করবে–পক্ষে ও বিপক্ষে দুদিকেই।

ক্ষুদ্রঋণের বাইরে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মানুষের মৌলিক চাহিদা নিয়েও তারা বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এ বইয়ে। তাদের বক্তব্য অনুমাননির্ভর ও নিছক পুস্তকনির্ভর নয়; মন্তব্য দেখা বিষয়ের ভেতর থেকে, মোটেও বাইরে থেকে নয়। নির্দিষ্ট স্থান-কালের পরিপ্রেক্ষিতে তারা কোনো উন্নয়নমূলক সামাজিক উদ্যোগের বিভিন্ন দিক বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। কোনো উদ্যোগের কার্যকারিতা চূড়ান্ত বিশ্লেষণের জন্য তারা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীতে তা প্রয়োগ করেছেন এবং তার ফলাফল কন্ট্রোল গ্রুপের সঙ্গে তুলনা করে দেখেছেন। এর পরেই শুধু প্রস্তাব করেছেন সমাধানের ও কাঙ্ক্ষিত উদ্যোগের।

২০১৯-এ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় তার স্ত্রী দুফলো ও সহ-গবেষক মাইকেল ক্রেমারের সঙ্গে একত্রে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হলে গ্রিসের সাবেক অর্থমন্ত্রী ও খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ইয়ানিস ভারাওফ্যাকিস লিখেছিলেন: ‘তারা বিশ্বের দরিদ্রতম মানুষের জীবন নিয়ে অধ্যয়ন করে সুনাম কুড়িয়েছেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, অর্থনৈতিক গবেষণায় তারা ওষুধের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত পরীক্ষা-নিরীক্ষা পদ্ধতি চিকিৎসাবিজ্ঞান থেকে ধার করেছেন এবং তা উন্নয়নশীল দেশে প্রয়োগ করে ঠিক করেছেন নির্দিষ্ট সম্পদ নিয়ে কোন কোন নীতি মানুষের দুর্দশা দূর করতে পারে।’

তাদের গুড ইকোনমিকস ফর হার্ড টাইমস বই সম্পর্কে একইদিনে ভারাওফ্যাকিস টুইটারে মন্তব্য করেছিলেন: ‘তবে তাদের আলোকময় দৃষ্টি পুঁজিবাদের বড় ত্রুটিগুলো মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে।’

তবে ওষুধের কার্যকারিতা নির্ণয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানে বহুল ব্যবহৃত র‌্যান্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল বা আরসিটি উন্নয়ন অর্থনীতিতে গবেষণায় সাম্প্রতিক সংযোজন আর তা সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। ওষুধের জন্য ব্যবহৃত পরীক্ষা-পদ্ধতি সামাজিক-অর্থনৈতিক উদ্যোগ ও পদক্ষেপের মত জটিল বিষয়েও সমানভাবে কার্যকর কিনা তা অনেকের কাছেই প্রশ্নসাপেক্ষ। গ্রিভ চেলওয়া ও সিয়ান মুলারের মত অনেকেই তাই এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রাপ্ত সামাজিক-অর্থনৈতিক ফলফল ও সিদ্ধান্তকে ভিত্তিহীন ও চাপিয়ে দেয়া বলে মনে করেন।8  

 

ভারাওফ্যাকিসের এ প্রশংসা ও সমালোচনাকে মাথায় রেখে আমরা পুওর ইকোনমিকস নিয়ে আলোচনাটি করব ও তা একটি বিষয়ে সীমিত রাখব। অভিজিৎ ও দুফলোরের বইয়ের একটা বড় অংশ হলো শিক্ষা নিয়ে। তারা ব্যাপক ও সূক্ষ্ম উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে দেখেছেন। মন্তব্য দাঁড় করিয়েছেন বাস্তবের কঠিন মাটিতে, কল্পনার নরম ইচ্ছেভূমিতে নয়। শিক্ষা নিয়ে ‘সরবরাহওয়ালা’ এবং ‘চাহিদাওয়ালা’ উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গির সারসংক্ষেপ টেনেছেন। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিশুদের শিক্ষাক্ষেত্রে সংকটের গোড়া খুঁজে বের করতে উভয় শিক্ষাওয়ালার ব্যর্থতাকে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন।

সরবরাহওয়ালারা যে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য ঘোষণা করেছিলেন তাতে শিশুর বিদ্যালয়ে কিছু শেখার আবশ্যকতা ছিল না, কেবল বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে শিক্ষাচক্র সম্পন্ন করলেই তাদের আশা পূরণ হলো। এমডিজিকালে বাংলাদেশ, ইকুয়েডর, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পেরু ও উগান্ডার বিদ্যালয়ে শিক্ষক অনুপস্থিতির হার ছিল বেশ উঁচুতে। দেখা যেত, যখন তাদের শ্রেণিকক্ষে থাকার কথা তখন তারা অন্য কোনোভাবে তাদের খেয়ালখুশিমতো সময় কাটাচ্ছেন। বিদ্যালয় কি তাদের শিক্ষা-দীক্ষা ভুলিয়ে দিচ্ছিল? অভিজিৎ ও দুফলোর মতে, ‘দেখা গেল, তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে যারা বাবা-মার দোকানপাটে বসে তাদেরকে সাহায্য করে, তারা জটিল হিসাব-নিকাশে বিদ্যালয়ে ভর্তি ছেলেমেয়েদের চেয়ে পটু।’

অন্যদিকে চাহিদাওয়ালাদের মতে, স্থানীয় পর্যায়ে শিক্ষা নিয়ে কোনো আগ্রহ তৈরি না হলে এ নিয়ে উপর থেকে কারও মাথা ঘামানোর দরকার নেই। তাদের মতে, ‘শিক্ষা একরকমের বিনিয়োগ।’ অতএব অর্জিত শিক্ষা থেকে যদি লাভসহ টাকা উঠে না আসে, কেউ এতে বিনিয়োগ করবে না। চাহিদাওয়ালাদের নীতি হলো ‘না-শিক্ষা নীতি’।

‘উপর থেকে চাপানো শিক্ষানীতি কি কাজ করে?’ প্রশ্ন করেছেন অভিজিৎ ও দুফলো। এর পক্ষে তাদের কাছে ভালো প্রমাণ আছে। তারা বলছেন, ‘শিক্ষার লাভ কেবল অর্থে নয়: শিশুমৃত্যুর হার কমাতে তাইওয়ান কর্মসূচির বড় ভূমিকা ছিল। মালাউইতে টাকা পাওয়ায় যেসব মেয়েশিশু বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েনি তারা অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভবতী হয়েছে কম। কেনিয়ায়ও একই ফল দেখা গেছে।’

তবে কোথাও কোথাও দেখা যায়, ব্যক্তিমালিকানাধীন বিদ্যালয় সরকারি বিদ্যালয়ের চেয়ে ভালো শিক্ষা প্রদান করে। যদিও তারা আরও যতটা ভালো করতে পারত তা করে না। বিদ্যালয়ে পড়া শেষ হওয়ার পর যেসব বিষয়ে শিশুশিক্ষার্থীরা দুর্বল সেসব বিষয়ে আলাদা করে সংশোধনমূলক শিক্ষা অনেক ভালো ফল দিতে পারে। আর বিদ্যালয়ের নির্ধারিত সময়ের বাইরে এই বাড়তি শিক্ষা দিতে তেমন উচ্চশিক্ষার দরকার হয় না। স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে অল্প বা মাঝারি শিক্ষাপ্রাপ্ত যে কেউ এটি করতে পারেন।

তারা পিতামাতার ‘প্রত্যাশার অভিশাপ’ নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ রকম একটি প্রত্যাশা হলো, বাবা-মায়ের চোখে শিক্ষা প্রাথমিকভাবে তাদের সন্তানের জন্য সম্পদ আহরণের একটা পথ। সবচেয়ে সোজা পথটা হলো, কোনো একটা সরকারি চাকরি লাভ, যা বাগিয়ে নিতে তারা প্রাণপণ চেষ্টা করে থাকেন। এভাবে শিক্ষার মৌল উদ্দেশ্যটাই বিপথগামী হয়ে যায়।

আরেকটা ব্যাপার হলো, “বাবা-মা হরহামেশা নিজের সন্তানদের প্রতি তাদের সামনেই ‘নির্বোধ’ ও ‘চালাক’ প্রভৃতি বিশেষণ ব্যবহার করতে সবসময় উদ্‌গ্রীব থাকেন, যা বিজয়ী বাছাই করার বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ (যেখানে পরিবারের বাকি সবাই বিজয়ী সন্তানকে যারপরনাই সহায়তা করে থাকে)। যদিও বেঁচে থাকার ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তির সংগ্রামে এ হচ্ছে একটা পারিবারিক কৌশল, এই প্রতিযোগিতায় যারা ‘বিজয়ী’ নয় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় একই ঘটনা ঘটে বিদ্যালয়ে, যা সমগ্র জাতির জন্য ক্ষতিকারক।”

এ পরিস্থিতিতে বড়লোকি স্কুলব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাই এর সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। লেখকদ্বয় ঔপনিবেশিক শাসকদের স্বার্থে কিছু কেরানি ও স্থানীয় প্রভুদের প্রতি বশংবদ একটা গোষ্ঠী তৈরির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট উল্লেখ করেছেন। তারা বলেছেন, ‘নতুন নতুন শিক্ষার্থী অনেক আসা সত্ত্বেও শিক্ষকরা এখনো সেই পুরোনো অভ্যাসের জায়গায়ই পড়ে থাকেন এই ভেবে যে, তাদের একমাত্র কর্তব্য হলো সেরা শিক্ষার্থীগুলোকে কঠিন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করে তোলা।’ যা তাদের পরবর্তী জীবনে সুখ-সমৃদ্ধির দরজা খুলে দেবে। ইতোমধ্যে আধুনিকায়নের নামে শিক্ষার নতুন নতুন বিষয় বিদ্যালয়ে যুক্ত হতে থাকে আর পাঠ্যবই হতে থাকে স্থূল ও ভারী। ফলে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সব মনোযোগ চলে যায় সিলেবাস ও পাঠ্যবিষয় শেষ করার দৌড়ে, যা শিক্ষার পথে এক বিরাট বাধা।

এসব অঞ্চলে বিদ্যালয় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কারণ, ‘বিষয় ও শিক্ষাদান দুই-ই তৈরি করা হয় বড়লোক ছেলেমেয়েদের উদ্দেশ্যে, যারা নিয়মিত সাধারণ শিক্ষার্থী তাদের জন্য নয়।’ উদ্দেশ্য হলো, ‘অগ্নিপরীক্ষাতুল্য পরীক্ষার জন্য সেরা শিক্ষার্থীদের আলাদা করা, যাতে তারা জীবনে আরও উপরে লাফিয়ে ওঠার সুযোগ পায়, যার জন্য প্রয়োজন বিরাট সিলেবাস ও পাঠক্ষমতা আহরণ।’

এ রকম শিক্ষাব্যবস্থায় বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর পেছনে পড়ে যাওয়া কোনো দুর্ঘটনা নয়; বরং অপরিহার্য। এ ব্যবস্থার গোপন এজেন্ডা হলো, ‘প্রতিবছর মোটাদাগে তলার শ্রেণি থেকে অনেককে সেচে ফেলা, যাতে অগ্নিপরীক্ষাটা যখন আসবে তখন পাসের শ্রেষ্ঠ রেকর্ড হস্তগত করা যায়।’

এই কাঠামোর সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে প্রচলিত ইংরেজি শিক্ষাটাও খাপ খায়। বাবা-মা সন্তানকে ইংরেজি শিক্ষা দিতে চান; কিন্তু বুঝতে পারেন না, বিদ্যালয়ে সেটি ঠিকমতো দেওয়া হচ্ছে কি না। বাড়িতে সন্তানকে সাহায্য করার মতো যদি কেউ না থাকে, তবে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দেয় ইংরেজিসহ বিরাট পাঠ্যতালিকা শেষ করার চাপ–শিক্ষার কিছু হোক বা না হোক।

তবে ধনীর সন্তানেরা এই সমস্যা পাশ কাটিয়ে যেতে পারে ব্যক্তিমালিকানাধীন স্কুলের সাহায্যে। যেখানে শিক্ষার্থীদের তুলনামূলকভাবে বেশি যত্ন নিয়ে পড়ালেখা করানো হয়। অন্যদিকে দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে-না-হতেই একটা বার্তা পেয়ে যায়। বার্তাটা হচ্ছে: ‘তারা এখানে কাঙ্ক্ষিত নয়, যদি তারা মেধার কোনো বিশেষ ঔজ্জ্বল্য দেখাতে না পারে।’ যার ফল হয়, একসময় তাদের অনেকেরই স্কুল থেকে ঝরেপড়া। এভাবে ‘উন্নয়নশীল দেশসমূহের শিক্ষাব্যবস্থা দুটি মৌলিক লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়: প্রত্যেকের জন্য ন্যূনতম দক্ষতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি এবং শিক্ষার্থীর প্রতিভার দিক খুঁজে বের করা।’

এ দুটি লক্ষ্য পূরণ শুধু যে সম্ভব তা-ই নয়, বেশ সহজও। লেখকদ্বয়ের এ বিশ্বাসের কারণ অমূলক নয়, সাক্ষ্য-প্রমাণসহ বাস্তব। উদাহরণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছেন ভারতের বেসরকারি সংস্থা ‘প্রথম’ ও আরও কিছু সংস্থার কথা, যারা বিদ্যালয়ের পরে বিভিন্ন সংশোধনমূলক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। এসব শিক্ষা কার্যক্রমে কোনো বিষয়ে দুর্বল ও পিছিয়ে-পড়া শিক্ষার্থীকে আলাদাভাবে বাড়তি শিক্ষাদান করে সক্ষম করে গড়ে তোলা হয়।

অতএব অভিজিৎ ও দুফলোর কথা: ‘প্রথম বিষয় হচ্ছে ন্যূনতম দক্ষতা অর্জনের ওপর জোর দেওয়া এবং প্রত্যেক শিশু যাতে এ ন্যূনতম দক্ষতা অর্জন করতে পারে, তার জন্য শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রচেষ্টা।’

এ ব্যাপারে তাদের একটি পরামর্শ হলো, ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির বা গ্রেডের মধ্যে সীমান্তদেওয়াল না তোলা। যাতে যে শিশুটি বয়সের কারণে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে তার যদি দ্বিতীয় শ্রেণির উপযোগী কোনো বিষয়ে ভালো করে পড়া ও দক্ষতা অর্জন প্রয়োজন হয়, সে যাতে তা পায় বিব্রত না হয়েই।

অভিজিৎ ও দুফলোর পরামর্শ হচ্ছে: ‘প্রত্যাশা কমানো, ন্যূনতম দক্ষতার ওপর জোর দেওয়া ও প্রযুক্তি ব্যবহার’ ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন। যে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা দরিদ্রদের ঠকানো ছাড়া কিছু নয়, যা ‘বিরাটসংখ্যক শিশুকে বলতে গেলে কিছুই দেয় না’। এক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে, ‘বিদ্যালয়গুলোকে সেসব শিক্ষার্থীর জন্য কাজ করতে হবে, যেসব শিক্ষার্থী তাদের আছে, যাদের পেলে তারা খুশি, কেবল তাদের জন্য নয়।’ আর সেইসঙ্গে প্রত্যেক শিশুকেই ন্যূনতম দক্ষতা অর্জনের ও নিজস্ব মেধা বিকাশের সুযোগ করে দেওয়া।

অভিজিৎ ও দুফলোর অভিমত ও দৃষ্টিভঙ্গি সেসব দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে সাহায্য করবে, যেখানে শিক্ষার ঘোষিত লক্ষ্য ও প্রত্যাশিত ফল আর যাই হোক–দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বঞ্চনা ছাড়া বলতে গেলে তেমন কিছুই দেয় না।

ফলাফলওঅভিজিৎ ও দুফলোর অভিমত ও দৃষ্টিভঙ্গি সেইসব দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে সাহায্য করবে যেখানে শিক্ষার ঘোষিত লক্ষ্য ও প্রত্যাশিত ফল আর যাই হোক- দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদেরকে বঞ্চনা ছাড়া বলতে গেলে কিছুই দেয় না। তবে তাদের প্রেসক্রিপশন উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে তেমন কিছু করবে না।

উন্নয়নশীল দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে অক্ষুণ রেখে তাদের পরামর্শ নিঃসন্দেহে কিছু কাজ দিবে। তবে তা সীমিত। তাদের আলোচনা মূলত এসব দেশের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকার্যক্রমকে কীভাবে আরও ফলপ্রসূ করা যায় আর মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থা এ থেকে কী কী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে তা নিয়ে।

২০১০এ এস্থার দুফলো, রেমা হাননা ও স্টিফেন পি. রায়ানের যৌথভাবে লিখিত গবেষণা-প্রবন্ধে (Incentives Work: Getting Teachers to Come to School by Esther Duo, Rema Hanna, and Stephen P. Ryan)  গণশিক্ষা বিস্তারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকার্যক্রমের বিশেষ অবদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তারা ভারতের এনজিও ‘সেবা মন্দির’ পরিচালিত উপানুষ্ঠানিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক অনুপস্থিতি হ্রাস করার উপায় ও তার মাধ্যমে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার মান উন্নয়নের প্রমাণ উল্লেখ করেছেন।

তারা দেখেছেন এসব শিক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষা-সহায়ক/সহায়িকাদের (প্যারাটিচার) ওপর নজরদারি বাড়িয়ে ও তাদেরকে আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে শিক্ষক অনুপস্থিতি হ্রাস করা যায়। এর ফলে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া কমে মূলধারার বিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্তি বাড়ে। তবে ক্যামেরা-নজরদারি রাজনৈতিক কারণে সরকার পরিচালিত বিদ্যালয়ে সম্ভব নয় বলে তারা এখানেও স্বল্পমেয়াদী চুক্তিভিত্তিক প্যারাটিচার যুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন। যা এ প্রবন্ধের উপসংহারের শেষ বাক্য। পুওর ইকোনোমিকসেও শিক্ষা নিয়ে তাদের শেষ কথা এই। কেনিয়ায় শিক্ষা নিয়ে এ ধরনের ও ভারতে বিশেষ করে উপরোক্ত গবেষণার কথাটি নোবেল কমিটি কর্তৃপক্ষ বিশেষভাবে স্মরণ ও উল্লেখ করেছেন।৬ 

কিন্তু এখানে আছে এক শুভঙ্করের ফাঁকি। উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান মূল সমস্যা ও তা সমাধানের কার্যকর উপায় সম্পর্কে কিছু না বলে রোগের যন্ত্রণা কমাবার কিছু ওষুধ বাতলেছেন অভিজিৎ ও দুফলো। তাদের এ প্রেসক্রিপশন বর্তমান পুঁজিবাদী নয়া উদারনৈতিক অর্থনৈতিক নীতিমালার সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণÑশিক্ষাখাতকে আরও বাণিজ্যমুখী ও ব্যক্তিমালিকানাকেন্দ্রিক করার পথে আরেকটি পদক্ষেপ।

লক্ষণীয় যে, অভিজিৎ ও দুফলো তাদের গবেষণাসমূহ করেছেন উন্নয়নশীল দেশে পিছিয়ে পড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে অনেকটা অগোচরে তাদেরকে প্রায় গিনিপিগ বানিয়ে। শ্রেণিকক্ষে ক্যামেরা বসিয়ে শিক্ষকদের উপস্থিতির পুলিশি তদারকি করার মত উপরোক্ত গবেষণার ব্যাপারে Grieve Chelwa ও Seán Muller তাদের The poverty of poor economics শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন, “এ ধরনের বিষয়ের একটা ভাসাভাসা যৌক্তিকতা আছে, কিন্তু এরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা যা অনেক আছে ধনী পশ্চিমা মানুষের ওপর করলে কখনও আলোর মুখই দেখত না।“      

স্বল্প প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে নামমাত্র পারিশ্রমিকের বিনিময়ে চুক্তি ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ করে (কন্ট্রাক্ট টিচার) সংশোধনীমূলক শিক্ষা বা রেমিডিয়াল টিউটরিংয়ের যে পরামর্শ তারা দিয়েছেন তা শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান সংকটের সমাধান নয়, বরং রোগের লক্ষণ। যেসব দেশে উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে, তাদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষকতা বিশেষত প্রাথমিক পর্যায়ে হতে হবে অত্যন্ত সম্মানজনক ও গুরুত্বপূর্ণ পেশা। শিক্ষক সংকট দূর করতে শিক্ষকের সংখ্যা বাড়াতে হবে, আরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে, বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে, দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে এবং আরও নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শ্রেণিকক্ষে ক্যামেরা বসিয়ে পুলিশি নজরদারি বাড়িয়ে এবং শিক্ষকদের পেশাগত নিরাপত্তা হ্রাস করে দীর্ঘমেয়াদে ভাল ফল পাওয়া যাবে না।

তবে পুওর ইকোনোমিকস উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষায় অনেক ফাঁকি ধরিয়ে দেয়। সেইসঙ্গে নোবেল বলে পরিচিত ব্যাংক অফ সুইডেন পুরস্কারজয়ী অভিজিৎ ও দুফলোর নিজেদের ফাঁকি সম্পর্কেও সচেতন না হলে এসব দেশ কখনও শিক্ষায় উন্নত দেশের সমকক্ষ হতে পারবে না। 

আলমগীর খান: সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি

ইমেইল: alamgirhkhan@gmail.com

তথ্যসূত্র

১. অভিজিৎ ভি ব্যানার্জি ও এস্থার দুফলো, পুওর ইকোনমিকস, PublicAffairs, নিউইয়র্ক, ইউএসএ, ২০১১

২. ইয়ানিস ভারাওফ্যাকিস, Good Economics for Hard Times by Abhijit V Banerjee and Esther Duflo review – methodical deconstruction of fake facts – দা গার্ডিয়ান, ১১ নভেম্বর ২০১৯

৩. https://twitter.com/yanisvaroufakis/status/1193844689683791872?lang=en

৪. https://africasacountry.com/2019/10/the-poverty-of-poor-economics

৫. https://economics.mit.edu/files/5995

৬. https://www.nobelprize.org/prizes/economic-sciences/2019/press-release

৭. পূর্বোক্ত

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •