কথাশিল্পী ইলিয়াসের মানুষ ও রাজনীতি

কথাশিল্পী ইলিয়াসের মানুষ ও রাজনীতি

আনু মুহাম্মদ

ছবি: আরাফাত করিম/প্রথম আলো

রাজনীতিবিদ হোক বা না হোক, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কারও সংশ্রব থাকুক বা না থাকুক, প্রতিটি ব্যক্তিরই রাজনৈতিক বোধ আছে, রাজনৈতিক মতাদর্শিক অবস্থান আছে, স্পষ্ট কিংবা অস্পষ্ট। এই অবস্থান জড়াজড়ি করে থাকে মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে, প্রত্যেকের বিশ্ববীক্ষার সাথে। সুতরাং সহজভাবে একজন মানুষের রাজনীতি মানে নিজকে এবং আর সকল মানুষকে সে কীভাবে দেখে বা দেখতে চায় তাই।

মানুষের রাজনৈতিক দার্শনিক অবস্থান বিচার করতে গেলে এর মধ্যে মোটাদাগে দুটো ভাগ পাওয়া যায়। একটি হল, যা মনে করে সমাজে মানুষে মানুষে বৈষম্য অবশ্যম্ভাবী। এই বৈষম্য অবশ্যই একজায়গায় সীমিত থাকে না; তা শ্রেণীগত, জাতিগত, ধর্মীয়, লিঙ্গীয়, বর্ণগত নানাভাবে বিস্তৃত হয়। আর এগুলো টিকিয়ে রাখতে তৈরি হয় নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা। যুদ্ধ, দখল, হত্যা, জুলুম এগুলো সবই অপরিহার্য অনুসঙ্গ হিসেবে আসে। এই রাজনীতি অতএব বৈষম্য, নিপীড়ন ও শোষণমুখি।

অন্যটি হল, যা সবরকম বৈষম্য নিপীড়ন ও শোষণমূলক ব্যবস্থার বিরোধী। যা মানুষের বৈষম্য ও নিপীড়নমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ও সক্রিয়তা তৈরি করে। একইকারণে যা যুদ্ধ, দখল, সাম্প্রদায়িক বা জাতিগত বিদ্বেষ, শ্রেণী ও যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।

ইলিয়াস স্পষ্টতই দ্বিতীয় ধারার অন্তর্ভূক্ত। তাঁর দৃষ্টিতে, বিদ্যমান ব্যবস্থা একদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনকে মানবেতর করে এবং সংখ্যালঘু সুবিধাভোগীকে করে অমানুষ। তিনি মানুষে মানুষে বৈষম্য আর নিপীড়নমূলক ব্যবস্থাকে অপ্রাকৃতিক অস্বাভাবিক মনে করতেন। মানুষে মানুষে সাম্য তাঁর কাছে ছিলো কান্ডজ্ঞানের বিষয়, সেভাবেই তাঁর চিন্তা ও দর্শন দাঁড়িয়েছিলো। শ্রেণী, জাতি, লিঙ্গ, বর্ণ, জাতপাতের বৈষম্য ও নিপীড়ন বিরোধী অবস্থানে তাই তাঁর কোন সংশয় ছিলো না।

সেইকারণেই হয়তো সবধরনের মানুষই ছিলো ইলিয়াসের মনোযোগের ক্ষেত্র। কোন মানুষ, মানুষ? শারীরতাত্ত্বিক একটা কাঠামো আছে সব মানুষেরই: চোখ, কান, মাথা, মুন্ডু, হাত পা..; সব মানুষই বাস করে এই একই কাঠামোর মধ্যে। কিন্তু সামাজিক ঐতিহাসিক কারণে এর মধ্যেই ঘটে বহু বিভাজন: শ্রেণী, লিঙ্গ, জাতপাত, ধর্ম, বর্ণ..। বৈচিত্র অস্বীকৃত হয়, মহিমান্বিত হয় বৈষম্য। কেউ কেউ শাসন দখল আর নির্মমতায় অমানুষ হয়; সম্পত্তির ব্যক্তি মালিকানা, বৈষয়িক লোভ, দখল, ক্ষমতা, মানুষ প্রকৃতি বিদ্বেষী মতাদর্শ একই চেহারার মানুষের মধ্যে যোজন যোজন ফারাক তৈরি করে। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ নারীপুরুষ তার জগত থেকে উৎপাটিত হয়ে, ন্যুনতম সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে দলিত আর দমিত থাকে। নিপীড়নের নানা ব্যবস্থা বৈধতা দিতে গড়ে ওঠে রাষ্ট্রের নানা প্রতিষ্ঠান আইন কানুন সাহিত্য সংস্কৃতি।

ইলিয়াস তাঁর শিল্পসৃষ্টিতে এই বৈপরীত্য অনুসন্ধান করেন নিজে নির্মোহ থেকে, সন্ধান করেন মানুষের ভেতর মানুষকে।

২.

মধ্যবিত্ত ব্যক্তি অনুসন্ধান করতে গিয়ে ইলিয়াসের লেখক ও চিন্তাজীবনের শুরু। কিন্তু তার মধ্য দিয়েই তিনি এই জগতের বন্দীশালা অতিক্রম করেছেন। পরিবর্তিত হয়েছে তাঁর ইতিহাস-জীবন-দর্শন সম্পর্কিত চিন্তার কাঠামো। মধ্যবিত্তের আত্মপ্রবঞ্চনায় ভরা চরিত্র বিশ্লেষণ করেছেন তিনি, কিন্তু তার মধ্যে আটকে থাকেননি। দৃষ্টি ও চিন্তাশক্তি প্রসারিত হয়েছে, সমাজের জালের মুখোমুখি হয়েছেন, ইতিহাস তাঁকে খুলে দিয়েছে অজানা জগত, মানুষের মধ্যে দেখেছেন বহু মানুষ, সন্ধান পেয়েছেন মানুষের অসীম শক্তি ও সৃজনশীলতার বিশাল সমুদ্র।

ইলিয়াস নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সমষ্টিকে দেখতে সক্ষম হয়ে ওঠেন। তাই নিজেকে সমষ্টির সঙ্গে মিলিয়ে, বর্তমানকে সময়ের এক গতিশীল প্রবাহের মধ্যে স্থাপন করে লেখেন, “অতীতের যতোটা চোখে পড়ে ততোটা জায়গা জুড়ে আমার বসবাস। দেখতে দেখতে দিব্যি চলে যাই সেই আদিম সময়ে, বোধহয় তারো ওপারে, যেখানে বিশাল জলরাশির ভেতর প্রাণের একটি বিন্দু হয়ে বুদবুদ করে ভাসছি। তারপর দেখি আরো কতোজনের সঙ্গে আমি, হ্যাঁ এই ভীতু ও মন খারাপ করা আমি ডাঙায় ওঠার জন্যে তীরের মাটি ধরার চেষ্টায় একনিষ্ঠভাবে মগ্ন। শেষ পর্যন্ত ডাঙায় উঠেও পড়েছি। তার পর কতোসব জানোয়ারের মার খেয়ে, কতো জানোয়ারকে মেরে, বৃষ্টিতে ধুয়ে, রোদে পুড়ে এতোটা পথ পেরিয়ে আটকে পড়েছি এখানে এসে। এখানে আমার ওপর পাথরের মতো চেপে বসতে চাইছে অতিকায় কোনো জীব।…… তাকে শেষ করতে পারি কি নাই পারি মরিয়া হয়ে আমাকে একবার লাগতে তো হবেই। হয়তো কে জানে, ভবিষ্যতের সময় আমার এই টুটাফাটা, পঙ্গু, ও রুগ্ন সময়কে সেই ইতর জীবটির সঙ্গে লড়াই করার সময় বলে সনাক্ত করবে। সেই ভরসাতেই বাঁচি। তোতলা কলম নিয়েও তাই একটু আধটু লিখতে চেষ্টা করি!!”

তারপর দেখি আরো কতোজনের সঙ্গে আমি, হ্যাঁ এই ভীতু ও মন খারাপ করা আমি ডাঙায় ওঠার জন্যে তীরের মাটি ধরার চেষ্টায় একনিষ্ঠভাবে মগ্ন। শেষ পর্যন্ত ডাঙায় উঠেও পড়েছি। তার পর কতোসব জানোয়ারের মার খেয়ে, কতো জানোয়ারকে মেরে, বৃষ্টিতে ধুয়ে, রোদে পুড়ে এতোটা পথ পেরিয়ে আটকে পড়েছি এখানে এসে। এখানে আমার ওপর পাথরের মতো চেপে বসতে চাইছে অতিকায় কোনো জীব।…… তাকে শেষ করতে পারি কি নাই পারি মরিয়া হয়ে আমাকে একবার লাগতে তো হবেই। হয়তো কে জানে, ভবিষ্যতের সময় আমার এই টুটাফাটা, পঙ্গু, ও রুগ্ন সময়কে সেই ইতর জীবটির সঙ্গে লড়াই করার সময় বলে সনাক্ত করবে। সেই ভরসাতেই বাঁচি। তোতলা কলম নিয়েও তাই একটু আধটু লিখতে চেষ্টা করি!!

জগত ও মানুষ দেখার এবং বিশ্লেষণের জন্য তিনি মার্কসের নিকটবর্তী হয়েছেন। কিন্ত নিজের চিন্তাশক্তির সক্ষমতার কারণেই প্রথাগত মার্কসবাদী ধরনের সঙ্গে তাঁর অনেকসময় মেলেনি। মার্কসীয় বিশ্লেষণ পদ্ধতির গতিশীলতা ও গভীরতা সেই প্রথাগত মার্কসবাদীদের থেকে পাওয়া যায় না যারা মার্কসবাদকে পরিণত করে একটি যান্ত্রিক নির্ধারণবাদী অসৃষ্টিশীল দর্শনে। এটা শুধু যে দার্শনিক অপরিপক্কতা থেকে তৈরি হয় তাই নয় এর পেছনে সুবিধাবাদিতাও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

ইতিহাসের সরলরৈখিক বর্ণনা, ভক্তি কিংবা নিন্দার মধ্যে আটকে থাকা, মানুষকে সাদাকালো হিসেবে দেখার ধরন সাধারণভাবেই আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত। বিশ্লেষণের দ্বান্দ্বিকতার কথা বললেও বামপন্থীদের বড় অংশও সরলীকরণের এই দোষে দুষ্ট। মার্কসবাদ কিংবা বিপ্লব মানে এক যান্ত্রিক ক্লান্তিকর সৃজনহীন দুর্বল আখ্যানও তাই বেশ শক্তিশালী। ইলিয়াস চিন্তার এই ধরনের প্রবল বিরোধী ছিলেন। গল্প, উপন্যাস, চরিত্র বিন্যাস এবং প্রবন্ধের বিশ্লেষণে তিনি তাই এই সহজ-মুখস্ত-জনপ্রিয় চিন্তার ধরনকে বারবার প্রশ্ন করেছেন, উন্মোচিত করেছেন, তীক্ষ্ন বাক্যবাণে আক্রমণ করেছেন। সেজন্যই ইলিয়াসের উপন্যাস ও গল্প এমনকি প্রবন্ধগুলোতে একদিকে যখন মানুষের অন্তর্গত শক্তির সন্ধান করেন ইলিয়াস, মানুষের মুক্তির চিন্তা ও লড়াইকে তুলে আনেন তেমনি তাঁর লেখায় আমরা পাই জনবিচ্ছিন্ন বামপন্থীদের সমালোচনা।

৩.

ইলিয়াসের দুই উপন্যাসে অসংখ্য চরিত্রের ভীড়ে খুবই শক্তিশালী চরিত্র শহরের শ্রমিক হাড্ডি খিজির, গ্রামের মজুর চেংটু, চেরাগ আলি ফকির, নাম না জানা তমিজের বাপ, কুলসুম, তমিজ ও ফুলজান আর তাদের মেয়ে সখিনা। তার পাশাপাশি বামপন্থী কর্মীর চরিত্র আছে বেশ কয়েকজন, যাদের মধ্যে শহরবাসী চিলেকোঠার সেপাইএর আনোয়ার কিংবা খোয়াবনামার গান্ধী-জিন্নাহ ঐক্যের জন্য প্রাণান্ত চেষ্টার নেতাকর্মীর চরিত্র অন্যতম; এতোবছর পরও এখনও এসব চরিত্র আমাদের চারপাশের, খুব পরিচিত।

খোয়াবনামায় দেখি, ভারত বিভাগের আগে আগে গ্রামে মাঝি চাষা অনৈক্য, মানুষের মধ্যে নানা বিভেদের বীজ, কমিউনিস্ট পার্টির লাইন সবকিছু তেভাগা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা ঐক্যকে দুর্বল করে। আর এই সুযোগে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস তাদের রাজনীতি গোছায়, সাম্প্রদায়িক সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। আর এই পরিপ্রেক্ষিতে কমিউনিস্ট পার্টির লাইন অনুযায়ী পার্টির নেতাকর্মীরা গ্রামে যাচ্ছে গান্ধী-জিন্নাহ ঐক্যের পক্ষে জনসভা করতে থাকে সাম্প্রদায়িক বিভেদ দূর করবার জন্য। এই কর্মসূচিতে এলাকার জোতদার খুশি, তার বাড়িতেই ভোজের আয়োজন। এলাকার ‘নিচুজাতের মানুষেরা তাদের কাছে ঘেঁষতে চায় নিজেদের নানাকথা নিয়ে, ঘেঁষতে পারে না।’

গ্রামের শিক্ষক যিনি তেভাগার আন্দোলনেও ছিলেন তাঁর এসব কাজে উৎসাহ নেই, বরং তিনি বিরক্ত হয়েই বলেন, ‘এ্যদ্দিন পরে ওরা কয় গান্ধি জিন্নাক একত্তর হবার। দুইজনে আলাদা থ্যাকা যে জুলুমটা চালাচ্ছে, একত্তর হলে দ্যাশের মানুষ একটাকও বাঁচবার দিবি না। তেভাগার মানুষ হয়া অজয় দত্ত হিন্দু মুসলমান মিল করাবার আর মানুষ পায় না? মাথা পাতে গান্ধি আর জিন্নার কাছে?’ কিন্তু এসব ঐক্য চেষ্টায় যথারীতি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কমে না, বরং তেভাগা সহ শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের শক্তি দুর্বল হয়ে যাবার সাথে সাথে ভয়ংকর আকারে বাড়তে থাকে সাম্প্রদায়িকতা। এর সুফল পায় দুদেশেরই জোতদার ধনিক শ্রেণী।

‘এ্যদ্দিন পরে ওরা কয় গান্ধি জিন্নাক একত্তর হবার। দুইজনে আলাদা থ্যাকা যে জুলুমটা চালাচ্ছে, একত্তর হলে দ্যাশের মানুষ একটাকও বাঁচবার দিবি না। তেভাগার মানুষ হয়া অজয় দত্ত হিন্দু মুসলমান মিল করাবার আর মানুষ পায় না? মাথা পাতে গান্ধি আর জিন্নার কাছে?’

সেসময় যেমন মুসলমানদের ঐক্যের কথা বলে মজদুরের লড়াইকে দুর্বল করা হয়েছিলো, তেমনি তার দুইদশক পরে বাঙালির ঐক্যের আওয়াজ তুলে গ্রামে শহরে মজদুরের লড়াইকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়া হয়। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সময় জনগণের বিশাল শক্তির প্রকাশ ঘটেছিলো কিন্তু কীভাবে তা শ্রমিক মজুরের মুক্তির রাজনীতি বিকশিত করতে ব্যর্থ হলো তার আঁচ চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসে গ্রাম শহরের ঘটনাবলী ও চরিত্রের শক্তিশালী বুনটের মধ্যে দিয়ে মনোযোগী পাঠকেরা পাবেন।

এই উপন্যাসে বাম বা বিপ্লবী পার্টির কোন উপস্থিতি না থাকলেও বিপ্লব আকাঙ্খী কর্মী চরিত্র আছে। আনোয়ার সেরকম এক কর্মী। শহুরে মধ্যবিত্ত এই তরুণ বিপ্লবী আকাঙ্খা নিয়ে গ্রামে যায়। কিন্তু তার আত্মীয় গ্রামের জোতদার, নিপীড়ক, খয়বার গাজী। গ্রামের গণআদালতে সে জনশত্রু হিসেবে বিচারের সম্মুখিন হলেও পরে বাঙালি ঐক্যের ধুয়া তুলে ছাড় পেয়ে যায়। এক্ষেত্রে আনোয়ারই হয়ে ওঠে তার রক্ষাকারি। আর গ্রামীণ মজুর চেংটু নতুনভাবে গজিয়ে ওঠা জোতদারদের হাতে খুন হয়।

একই উপন্যাসে একজন বৃদ্ধ মানুষের চরিত্র আছে, তার নাম নাদু। গ্রামের সেই মানুষ দীর্ঘকাল জমিদারের সেবা করেছেন শরীর মন সব দিয়ে, তারপরও লাথিগুতা খেয়েছেন বেশুমার । জমিদার গেছে, জমিদারী গেছে, কিন্তু যৌবনকালে জমিদারের কাছ থেকে খাওয়া শক্ত একটা জুতার লাথির দাগ ঘাড়ে রয়েই গেছে। শীতে তা ব্যথায় টনটনও করে। তারপরও বৃদ্ধ কোনো চিকিৎসা করতে নারাজ। বরং পরম যত্নে প্রায়ই ঐ দাগের উপর হাত বুলানো, আর সুযোগ পেলেই গর্বের সঙ্গে তা মানুষদের দেখানোতেই তাঁর প্রবল আগ্রহ। ঘটা করে বলেন কী জবরদস্ত লোক ছিলেন তার প্রভু। এমন লাথি দিয়েছেন যার দাগ এখনও যায়নি। বলে বলে নিজের ওজন বাড়াতে অস্থির তিনি। যেন সেই দাগ হারিয়ে গেলে তার গুরুত্বও চলে যাবার সম্ভাবনা।

কিন্তু চেংটু ভিন্ন। গ্রামের মানুষের নতুন জাগরণে চেংটু মুক্ত জীবনের স্বাদ পায়, আত্মমর্যাদাবোধে দাসত্বকে ঘৃণা করতে শেখেন। তিনি নাদুকে বলেন, ‘পিঠ তো ভাঙছে একজন, এখন বাকি আছে বুকখান। তুমি গাজীগোরে ঘরত যাও, খয়বার মিয়ার পাও আছে দুইখান, বুকখানা প্যাতা দিও খাম কর‌্যা দিবো….নাথিগুড়ি, যা খাবার চাও তাড়াতাড়ি খায়া আসো। কুনদিন যায়া শুনবা গাজীর ব্যাটার দুটো ঠ্যাংই ভ্যাঙা দিছে, তখন নাথি দিবো কি দিয়া?’ না গাজীর ঠ্যাং ভাঙা যায়নি, উল্টো চেংটুই নিহত হয়েছেন। আনোয়ার শহরে ফিরে গেছেন নিজ নিরাপদ কোটরে। এখন নিশ্চয়ই সেই গাজীর বা তার উত্তরসূরীদের প্রতাপ আরও বহুগুণ বেড়েছে। আর নাদু?

ইলিয়াস তাঁর আরও লেখার মধ্যে বাংলাদেশের অর্থবিত্ত দাপট ক্ষমতাওয়ালা হিসেবে যারা পরিচিত, যারা বিদ্বান হিসেবে পরিচিত, যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তাঁদের মধ্যেও নাদুর মতোই দাসকে আবিষ্কার করেছেন। এরা পরম যত্নে, আগ্রহে এবং আনন্দে দাস হিসেবে বিত্তবৈভবসহ নিজেদের জাহির করে। তারা ইলিয়াসের বর্ণনায় ‘মেরুদন্ডের উৎপাত থেকে মুক্ত’। এখনকার দাস মালিকদের সবাইকে শশরীরে পাওয়া যায় না। তারা হাজির থাকে পুঁজি আর ক্ষমতার আড়ালে। আবার যারা বাংলাদেশের মতো, ইলিয়াসের ভাষায় ‘সোনার দেশে’, মালিক হিসেবে হম্বিতম্বি করে তারা আবার ভিনদেশের বড় মালিকের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকে। যারা ভেতর থেকে দাস তারা আবার চেংটুর মতো স্বাধীন মানুষ দেখলে সন্ত্রস্ত হয়, শক্তি থাকলে তাকে গুড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে। আশার কথা এই যে, মানুষ আছে বলেই বারবার চেংটুর জন্ম হয়।

এই পৃথিবীতে মানুষের ইতিহাসে দাসপ্রথার শিকার হয়েছে বহু মানুষ। কিন্তু দাসপ্রথার শৃঙ্খল ভেঙে এই মানুষই বেরিয়ে এসেছে। আবার দাসপ্রথা যখন অতীত, তখনও সুবেশী ঝকমকে অনেক দাসদাসী সমাজে দাপট নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। শৃঙ্খল থাকলেই দাস হয় না, তা তার মনোজগত কতটা খেয়ে ফেলে সেটা দিয়েই তার পরিচয় নির্ধারিত হয়। সে-ই প্রকৃত দাস যে তার দাসত্বের শৃঙ্খলকে উপলব্ধি করতে জানে না; দাসত্বকে নিজের ভেতর লালন করে, সানন্দে দাসত্ব বহন করে যায়। নির্মমভাবে এই দাসদের সনাক্ত করা ইলিয়াস তাঁর দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

দাসপ্রথা যখন অতীত, তখনও সুবেশী ঝকমকে অনেক দাসদাসী সমাজে দাপট নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। শৃঙ্খল থাকলেই দাস হয় না, তা তার মনোজগত কতটা খেয়ে ফেলে সেটা দিয়েই তার পরিচয় নির্ধারিত হয়। সে-ই প্রকৃত দাস যে তার দাসত্বের শৃঙ্খলকে উপলব্ধি করতে জানে না; দাসত্বকে নিজের ভেতর লালন করে, সানন্দে দাসত্ব বহন করে যায়।

৪.

একেকটি চরিত্র নিয়ে কাজ করতে করতে ইলিয়াস থামতে পারেন না। দেখেন একজন ব্যক্তি কতভাবে কতকিছুর সাথে সম্পর্কিত। অন্য অনেকের মতো একই কাহিনীর হাজারো বয়ান দিয়ে ‘গল্প’ ‘উপন্যাস’ যদিও বা সম্ভব, শিল্প সৃষ্টি হয় না। ছোট গল্প সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকেই তিনি তাই প্রশ্ন করেন, বর্তমান সময়ে গ্রাম শহরের মানুষ যে হাজারো সূত্রে বাঁধা সেই “লোকটিকে নিয়ে গল্প লিখতে গেলে কি ‘ছোট প্রাণ ছোট কথা’র আদর্শ দিয়ে কাজ হবে? তার একটি সমস্যা ধরতে গেলেই তো হাজারটা বিষয় এসে পড়ে, কোনোটা থেকে আরগুলো আলাদা নয়। একজন চাষীর প্রেম করা কি বৌকে তালাক দেওয়া, তার জমি থেকে উচেছদ হওয়া কি ভূমিহীনে পরিণত হওয়া, তার ছেলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে শহরের দিকে রওনা হওয়া এবং সেখান থেকে সৌদি আরব যাওয়ার উচ্চাকাংখার কবলে পড়া, তরুণ চাষীর প্রেমিকার মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারা – এসবের সঙ্গে সারের উপর ভর্তূকি তুলে নেওয়া কিংবা জাতীয় পরিষদের ইলেকশনে কোটিপতির ইলেকশন ক্যাম্পেনে টাকার খেল দেখানো কিংবা এনজিও-র কার্যক্রমের সরাসরি বা পরোক্ষ সম্পর্ক থাকা এমন কিছু বিচিত্র নয়।”

বিশেষভাবে গত তিনদশকে একদিকে চোরাই অর্থনীতির বিস্তার অন্যদিকে এনজিও-র সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটেছে বাংলাদেশে। এগুলো এখন অনেক মধ্যবিত্তেরও দাঁড়ানোর জায়গা, মনস্তাত্ত্বিক – শারীরিক, জীবন জীবিকা, কারও কারও জন্য জৌলুস। এই অবস্থা ইলিয়াসও দেখেছেন তাঁর জীবদ্দশাতেই, বলেন, “রাজনীতি আজ ছিনতাই করে নিয়েছে কোটিপতির দল। … এনজিও তে দেশ ছেয়ে গেল, নিরন্ন মানুষের প্রতি তাদের উপদেশ – তোমরা নিজের পায়ে দাঁড়াও। কী করে? – না, মুরগী পোষো, ঝুড়ি বানাও, কাঁথা সেলাই করো। ভাইসব, তোমাদের সম্পদ নেই, সম্বল নেই, মুরগি পুষে, ডিম বেঁচে, ঝুড়ি বেঁচে তোমরা স্বাবলম্বী হও। কারণ, সম্পদ যারা হাইজ্যাক করে নিয়ে গেছে তা তাদের দখলেই থাকবে, ওদিকে চোখ দিও না। . . .”

সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের মূল পরিচয়কে ‘দারিদ্র’ এর মধ্যে আটকে ফেলায় দেশী-আন্তর্জাতিক শাসক শ্রেণীর বিশেষ আগ্রহ নিয়ে ইলিয়াসের লেখায় ব্যঙ্গ ক্রোধ কম নেই। এই জনগোষ্ঠীর সক্রিয়, সৃজনশীল জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা তাদের মনোযোগের বাইরে। বৈষম্য-নিপীড়নের জাল নয়, শুধু অর্থের অভাবের কারণে তারা দরিদ্র এই চিন্তার কাঠামোই তারা প্রধান করে তুলতে চায়। সুতরাং ক্ষুদ্রঋণ, রিলিফসহ টাকার যোগানের ইত্যাকার পথই মহিমাম্বিত হতে থাকে। এই দর্শন সামাজিক অর্থনৈতিক সম্পর্কগুলি যেমন আড়ালে নিয়ে যায়, তেমনি যাদের সৃজনশীলতা সমাজ বিকাশের উৎস তারাই ‘বোঝা’ ‘উদ্বৃত্ত’ ‘অসচেতন’ ‘দরিদ্র’ হিসেবে চিহ্নিত হন।

ইলিয়াস আরও দেখেন, ক্ষমতার জাল, ধর্ম আর দারিদ্র বিমোচনের বাণিজ্য কিংবা প্রহসন কেবল দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এর সাথে যুক্ত ‘নৈব্যক্তিক’ বিশ্বব্যবস্থা। তাই বলেন, “রাষ্ট্রের কোমরে বাঁধা দড়ির প্রান্তটি যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতে তাকে গণ্য করাও তো ছোটগল্পের লেখকের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। বাঙালি বনাম বাংলাদেশী যুদ্ধে প্রাণ দেয় ইউনিভার্সিটির ছেলে, ইউনিভার্সিটিতে তালা ঝোলে আর গ্রামে পাটের দাম না পেয়ে পাটে আগুন জ্বালিয়ে দেয় বৃদ্ধ চাষী। সেই রিক্ত চাষীর গালে কার হাতের থাপ্পড়ের দাগ? কার হাত? মায়ের গয়না বেচে যে তরুণ পাড়ি দিয়েছে জার্মানি আর আমেরিকায় সেতো আর ফেরে না, তার মায়ের নি:সঙ্গতাকে কি শুধু মায়ের ভালোবাসা বলে গৌরব দেওয়ার জন্য গদগদ চিত্তে লেখক ছোটগল্প লিখবে?”

“রাষ্ট্রের কোমরে বাঁধা দড়ির প্রান্তটি যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতে তাকে গণ্য করাও তো ছোটগল্পের লেখকের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। বাঙালি বনাম বাংলাদেশী যুদ্ধে প্রাণ দেয় ইউনিভার্সিটির ছেলে, ইউনিভার্সিটিতে তালা ঝোলে আর গ্রামে পাটের দাম না পেয়ে পাটে আগুন জ্বালিয়ে দেয় বৃদ্ধ চাষী। সেই রিক্ত চাষীর গালে কার হাতের থাপ্পড়ের দাগ? কার হাত? মায়ের গয়না বেচে যে তরুণ পাড়ি দিয়েছে জার্মানি আর আমেরিকায় সেতো আর ফেরে না, তার মায়ের নি:সঙ্গতাকে কি শুধু মায়ের ভালোবাসা বলে গৌরব দেওয়ার জন্য গদগদ চিত্তে লেখক ছোটগল্প লিখবে?”

৫.

জাল খুঁজতে খুঁজতেই ইলিয়াসের লেখায় ক্রমে আমাদের জনপদে নানাভাবে ছড়িয়ে থাকা মিথ খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো। চরিত্রকে যুৎসই ভাবে ধরতে গিয়ে বর্তমান বা চোখে দেখা বাস্তবতাই যথেষ্ট হচ্ছিলো না। ইলিয়াসের দৃষ্টিতে, মানুষের ভেতর পরম্পরার শক্তি আর তার অচেতন না বুঝলে চরিত্রটি অধরাই থেকে যায়। সেজন্য ইলিয়াস প্রকরণে নতুন নতুন সৃষ্টিশীল কাজে হাত দেন। খোয়াবনামায় ইলিযাস যেভাবে পোক্ত হাতে মিথ ব্যবহার করেছেন সে সম্পর্কে আরেক শক্তিমান কথাশিল্পী শওকত আলী বলেন, ইলিয়াসের আবিষ্কার করা “মিথ কেবল অতীতের জিনিস নয়- তা বর্তমানেও এসে পড়ে….(ইলিয়াস) দেখান যে মানুষের বিদ্রোহের আর লড়াইএর স্মৃতি থেকে যায় তার অবচেতনার পরতে পরতে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এবং তা বেরিয়ে আসে কখনো মন্ত্র বা গানের শোলোক হয়ে, কখনো আঁকিবুকি টানা নক্সার ভেতর দিয়ে, আবার কখনো বা স্বপ্ন ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে।…. মীথ এর অমন ব্যবহার সমগ্র বাংলা সাহিত্যে আর দেখা যায় না।..গত তিন/চার দশক ধরে হিস্পানী সাহিত্যে মীথ সৃজনশীলতার উপাদান এবং কৌশল হয়ে উঠেছে। আফ্রিকান সাহিত্যও সেই উদ্যোগের এখন অন্যতম শরিক। এক্ষেত্রে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে আমাদের স্মরণ না করে উপায় থাকবে না।”

“মিথ কেবল অতীতের জিনিস নয়- তা বর্তমানেও এসে পড়ে….(ইলিয়াস) দেখান যে মানুষের বিদ্রোহের আর লড়াইএর স্মৃতি থেকে যায় তার অবচেতনার পরতে পরতে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এবং তা বেরিয়ে আসে কখনো মন্ত্র বা গানের শোলোক হয়ে, কখনো আঁকিবুকি টানা নক্সার ভেতর দিয়ে, আবার কখনো বা স্বপ্ন ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে।…. মীথ এর অমন ব্যবহার সমগ্র বাংলা সাহিত্যে আর দেখা যায় না।..গত তিন/চার দশক ধরে হিস্পানী সাহিত্যে মীথ সৃজনশীলতার উপাদান এবং কৌশল হয়ে উঠেছে। আফ্রিকান সাহিত্যও সেই উদ্যোগের এখন অন্যতম শরিক। এক্ষেত্রে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে আমাদের স্মরণ না করে উপায় থাকবে না।”

বহুরকম শৃঙ্খলের মধ্যেও অতীত থেকে ভবিষ্যতে প্রবাহিত মানুষের চৈতন্য অনুসন্ধান করতে করতেই ইলিয়াস নতুন নতুন প্রান্তরে হাজির হচ্ছিলেন। এভাবেই বাস্তবতার ভেতর পরাবাস্তব, চেতনের মধ্যে অচেতন, জাগরণের মধ্যে স্বপ্ন, বর্তমানের ভেতর অতীত মানুষকে এক থেকে অসংখ্য রূপে হাজির করতে থাকে তাঁর লেখায়।

চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসে চেংটু নিহত হয়, মিছিল সভা সমাবেশ দখল হয়ে যায়, হাড্ডি খিজির বুকে গুলি খায়। কিন্তু এখানেই তো জগত শেষ হয় না। চেংটু, খিজির থেকে যায় কোথাও না কোথাও। খোয়াবনামায় ব্রিটিশদের হাতে গুলি খাওয়া মুন্সী যেভাবে পাকুড় গাছে গিয়ে বসে, তার মরণ হয় না। তেভাগা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় কিন্তু তমিজ তার ডাকেই অনির্দিষ্ট পথে পা বাড়ায়। ভবিষ্যতের দায়িত্ব নিয়ে শক্ত মাটির ওপর দাঁড়ায় তমিজ ফুলজানের মেয়ে সখিনা। সামরিক শাসন ভেঙে বুকে গুলি নিয়ে হাড্ডি খিজির যখন রাস্তায় তখন দৃশ্য অদৃশ্য অসংখ্য মানুষের মিছিল মুক্তির এক প্রবল মানবিক স্রোত তৈরি করে।

মানুষের যখন সামষ্টিক নতুন আবির্ভাব ঘটে, তখন আত্মকন্ডুয়নে আটকে থাকা ওসমানের মতো চরিত্রও বদলে যেতে থাকে এই প্রবাহের চাপে ও তাপে: “কিন্তু না, এত মানুষ ঢাকায় সে কোনদিন দ্যাখেনি।….শায়েস্তা খাঁর টাকায় আট মণ চালের আমলে না খেয়ে মরা মানুষ দেখে ওসমান আঁতকে ওঠে। ৪০০ বছর ধরে তাদের খাওয়া নাই- কালো চুলের তরঙ্গ উড়িয়ে তারা এগিয়ে চলে পায়ে পায়ে। মোগলের হাতে মার খাওয়া, মগের হাতে মার খাওয়া, কোম্পানির বেনেদের হাতে মার খাওয়া – সব মানুষ না এলে এই মিছিল কি এতো বড়ো হয়?…চার হাজার টাকা দামের জামদানী বানানো তাঁতীদের না খাওয়া হাড্ডিসার উদোম শরীর আজ সোজা হেঁটে চলেছে।… নারিন্দার পুলের তলা থেকে ধোলাই খালের রক্তাক্ত ঢেউ মাথায় নিয়ে চলে আসে সোমেন চন্দ। ….নতুন পানির উজান স্রোতে ঢাকার অতীত বর্তমান সব উথলে উঠছে আজ, ঢাকা আজ সকাল দুপুর বিকাল রাত্রি বিস্তৃত, আজ তার পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ নাই, সপ্তদশ অষ্টাদশ উনবিংশ বিংশ শতাব্দীর সকল ভেদচিহ্ন আজ লুপ্ত।…”

“কিন্তু না, এত মানুষ ঢাকায় সে কোনদিন দ্যাখেনি।….শায়েস্তা খাঁর টাকায় আট মণ চালের আমলে না খেয়ে মরা মানুষ দেখে ওসমান আঁতকে ওঠে। ৪০০ বছর ধরে তাদের খাওয়া নাই- কালো চুলের তরঙ্গ উড়িয়ে তারা এগিয়ে চলে পায়ে পায়ে। মোগলের হাতে মার খাওয়া, মগের হাতে মার খাওয়া, কোম্পানির বেনেদের হাতে মার খাওয়া – সব মানুষ না এলে এই মিছিল কি এতো বড়ো হয়?…চার হাজার টাকা দামের জামদানী বানানো তাঁতীদের না খাওয়া হাড্ডিসার উদোম শরীর আজ সোজা হেঁটে চলেছে।… নারিন্দার পুলের তলা থেকে ধোলাই খালের রক্তাক্ত ঢেউ মাথায় নিয়ে চলে আসে সোমেন চন্দ। ….নতুন পানির উজান স্রোতে ঢাকার অতীত বর্তমান সব উথলে উঠছে আজ, ঢাকা আজ সকাল দুপুর বিকাল রাত্রি বিস্তৃত, আজ তার পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ নাই, সপ্তদশ অষ্টাদশ উনবিংশ বিংশ শতাব্দীর সকল ভেদচিহ্ন আজ লুপ্ত।…”

ক্রমেই ইলিয়াস তাঁর কাজের বিস্তৃতি ঘটাচ্ছিলেন। কিন্তু অকাল মৃত্যু তাঁকে থামিয়ে দেয়। ‘মৃত্যু’র পাঁচ মাস আগে মহাশ্বেতা দেবীর কাছে লেখা এক চিঠিতে তিনি নিজের ভবিষ্যতের উপন্যাসের পরিকল্পনা সম্পর্কে লিখেছিলেন, “. . . বগুড়া শহরের উত্তরে সুবিল বলে একটা জায়গা আছে, পুন্ড্রনগরীর শুরু বলতে গেলে সেখান থেকেই। তারপর গোকুল, সেখানে বিশাল একটি বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসস্তুপ, গোকুল পেরিয়ে মহাস্থান। ওখানে এখন একটা মিউজিয়াম, মিউজিয়ামের সামনে দিয়ে আরো মাইল ছয়েক গেলে শিবগঞ্জ, সেটাও কিন্তু প্রাচীন পুন্ড্রনগরীর অংশ। আপনার এককড়ি করতোয়ার জলে মহাস্থানের ভাঙাচোরা প্রাসাদের লাল ইটের ছায়া দেখেছিলেন, মনে আছে? আমার উপন্যাসের লোকজন বাস করে সেই করতোয়ার তীরে। তবে এ লাল ছায়া কতোবার যে কায়া পেয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সেই দিব্যোক আর ভীমের কৈবর্তক বিদ্রোহের আমল থেকে মজনু শাহের ফকির বিদ্রোহ এবং শেষ পর্যন্ত- ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে অজস্র মানুষের রক্তে করতোয়া ভেসে গেছে। . . .”

৬.

ইলিয়াস বলেন, “উপনিবেশের মানুষ একটু ছোটই হয়, তাকে খাটো করে রাখতে না পারলে শাসক টিকে থাকে কী করে?” এই খাটো হয়ে থাকায় অনুগত শাসকেরা সদা গদগদ। এই দেশে ইউরোপের প্রভুদের অনুসরণে উপনিবেশের জন্মপঙ্গু ‘ব্যক্তি ভুগছে সায়েবদের ব্যক্তি সর্বস্বতার ব্যারামে।’ তাছাড়া ‘আমাদের এই উপনিবেশে মধ্যবিত্তের নাবালক ও বামন সন্তান শ্রীমান শক্তি বাবু চলছিলেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, তার খোঁড়ানোকে দেখা হচিছল নাচের মহড়া বলে। তা তিরিশের দশকে শ্রীমান আছাড় খেয়ে পড়েই গেলেন, তাঁর কাপড়চোপড় আর কিছুই রইল না, রোগাপটকা গতরটা উদোম হয়ে গেল।’ আবির্ভূত হল ‘ঢাল ও তলোয়ার বিহীন শ্রীযুক্ত নিধিরাম সর্দার ন্যায়রত্ন তর্কবাগীশ মহাশয়।’

এই ‘মহাশয়ের’ আত্মপরিচয়ের সংকট, বিশ্বাস আর সংশয়ের মধ্যে দোল খাওয়া, হীনমন্যতা জমিদারি স্বপ্নকল্পনা- আলস্যের ঢেকুর শর্টকাট রাস্তার ধান্ধা – শেকড়কে অস্বীকারের গর্ব – যত শিক্ষা তত দাসত্ব ইত্যাদি ইলিয়াস বিশদভাবে ধরতে চেষ্টা করেন। এই মধ্যবিত্ত উপনিবেশ পার হয়ে পাকিস্তান হয়ে এখন বাংলাদেশে লম্পট-লুটেরা-দুর্বৃত্তদের শাসক শ্রেণীর অংশীদার, সামরিক বেসামরিক আমলা-বিশেষজ্ঞ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক: ক্যারিয়ার, সাফল্য সবকিছুই চিন্তার নিষ্ক্রিয়তা আর আত্মমর্যাদাবোধহীন আনুগত্যের সাথে সম্পর্কিত।

এর সঙ্গে বাংলাদেশে রাষ্ট্র ক্ষমতার বিন্যাস, মালিকানা ব্যবস্থা, ধর্ম ও জাতীয়তাবাদের আড়ালে ফ্যাসিবাদের নানা হুংকার, শ্রেণী জাতি লিঙ্গীয় ধর্মীয় নিপীড়ন ও বৈষম্যে বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের আত্মসমর্পণ, চোরাই অর্থনীতির সাথে সাথে নৃশংসতার বিস্তার, রাষ্ট্রীয় হত্যা গুম দমনপীড়নের অবাধ আয়োজন এবং এগুলোর সুতা ধরে ধরে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা পর্যন্ত সম্পর্কিত।

কিন্তু জনগণের বিশাল শক্তির প্রতিরোধ এবং নিজের সভ্যতা নির্মাণের লক্ষণ কই? ইলিয়াস এই জন্য বিপ্লবীদের ওপরই ভরসা করেন, আবার সেখানে হতাশার চিত্রও দেখেন। শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন মধ্যবিত্ত থেকে আগত অনেক বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মী তার শ্রেণীর বৃত্তের ছায়াতেই আটকে থাকে। ফলে ‘যাদের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর সংগ্রামে নামা “তাদের প্রতি করুণা/দয়া/মমতা তৈরি হতে পারে কিন্তু “মর্যাদাবোধ” তৈরি হয় না। আর মর্যাদাবোধ না থাকলে প্রয়োজনীয় যোগাযোগই স্থাপিত হয় না।’ এই দূরত্বকেই ইলিয়াস বলেছেন, বিশাল জনগোষ্ঠীর সাথে মধ্যবিত্ত থেকে আগত পরিবর্তনকামী রাজনৈতিক কর্মী এমনকি লেখক শিল্পীদের “সংস্কৃতির ভাঙা সেতু”।

তিনি বলেন পুঁজিবাদ মানুষকে নিছক ভোক্তা বানাতে চায়, তার রাজনীতিতে মানুষকে ভোটার হিসেবেই গণতন্ত্রের সীমা আটকে রাখে। আর অনেক বিপ্লবীর কাছে মানুষ কেবলই আন্দোলনের হাতিয়ার, অনেক গবেষক লেখকের কাছে মানুষ কেবলই ইতিহাসের বা শিল্পের উপাদান। ইলিয়াস বারবার ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’র কথা বলেছেন তা অতিক্রম করবার জন্য। ‘উপাদান বা হাতিয়ার নয়, মানুষ ইতিহাসের নির্মাতা’ এই বোধ আত্মস্থ না হলে যে এই দূরত্ব ঘুচবে না এটাই তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ।

ইলিয়াস মানুষ অনুসন্ধান করছেন, তার জমিন ছিঁড়ে খুড়ে দেখছেন নেহায়েতই দেখার জন্য নয় – তার লক্ষ্য শিল্প সৃষ্টি এবং তার চাইতেও বড় নতুন জমিন সৃষ্টির অসাধারণ আনন্দের কষ্টকর যাত্রাকে স্পষ্ট করবার জন্য। এই শিল্প সৃষ্টি তাঁর কাছে বিপ্লবী রাজনীতির জমিন তৈরির জন্যও অত্যাবশ্যক। সেজন্য তাঁর বিশ্লেষণের একটা সারকথা – “নির্বাচনের জন্য পোস্টারই যথেষ্ট, কিন্তু বিপ্লবের জন্য চাই সাহিত্য”।

এইসব মুহূর্ত দাসের পরাজয় আর মানুষের মানুষ হয়ে উঠা। চিলেকোঠার সেপাইএর মিলিটারীর গুলি খাওয়া হাড্ডি খিজির, জোতদারের খুনিদের হাতে নিহত চেংটু, খোয়াবনামার মানুষের বিদ্রোহে যোগ দিতে যাওয়া নিখোঁজ তমিজ, শক্তমাটির ওপর দাঁড়ানো সখিনা সবাই এই সময়ে একে একে জড়ো হয় এই যাত্রায়। ইলিয়াস এখন গুলি খাওয়া মুন্সীসহ অনেকের সঙ্গে পাকুড় গাছে। হয়তো দেখছেন কিংবা আরও দেখার অপেক্ষায় আছেন দমিত, দলিত, শৃঙ্খলিত, অপমানিত অবস্থা থেকে মুক্ত মানুষের জন্ম। এটাই ইলিয়াসের শিল্প, ইলিয়াসের সাহিত্য, ইলিয়াসের রাজনীতি।

৭.

বহু আগে থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত এই জনপদ আত্মসন্তুষ্ট দাস-মানব কম দেখেনি। আবার মুক্ত মানুষের উত্থানও দেখেছে অসংখ্য। এখনও ইলিয়াস-এর অনেক মুহূর্ত তৈরি হচ্ছে দেশে দেশে। গুলি, হুমকি, ভয়, ত্রাস, লোভ কিছুুতেই কাবু হয় না এই মানুষ। এইসব মুহূর্ত দাসের পরাজয় আর মানুষের মানুষ হয়ে উঠা। চিলেকোঠার সেপাইএর মিলিটারীর গুলি খাওয়া হাড্ডি খিজির, জোতদারের খুনিদের হাতে নিহত চেংটু, খোয়াবনামার মানুষের বিদ্রোহে যোগ দিতে যাওয়া নিখোঁজ তমিজ, শক্তমাটির ওপর দাঁড়ানো সখিনা সবাই এই সময়ে একে একে জড়ো হয় এই যাত্রায়। ইলিয়াস এখন গুলি খাওয়া মুন্সীসহ অনেকের সঙ্গে পাকুড় গাছে। হয়তো দেখছেন কিংবা আরও দেখার অপেক্ষায় আছেন দমিত, দলিত, শৃঙ্খলিত, অপমানিত অবস্থা থেকে মুক্ত মানুষের জন্ম। এটাই ইলিয়াসের শিল্প, ইলিয়াসের সাহিত্য, ইলিয়াসের রাজনীতি।

Social Share
  •  
  •  
  • 1K
  •  
  •  
  •  
  •  

1 thought on “কথাশিল্পী ইলিয়াসের মানুষ ও রাজনীতি

  1. গভীর অনুসন্ধানী আত্ম মুগ্ধ লেখা।বাংলার শিল্প সাহিত্য নিয়ে আনু মুহাম্মদ স্যারের আরো বিশ্লেষণী লেখা সর্বজন কথায় প্রকাশিত হোক এই প্রত্যাশা করি।
    স্যারের প্রতি শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *