(আদি) ক্র্যাক প্ল্যাটুন, ভাষা ও পৌরুষ

নৈতিক স্মৃতিচারণ হিসেবে ইতিহাস। সিপি গ্যাং-এর ‘বেশ্যা’ ব্যানার-৮

(আদি) ক্র্যাক প্ল্যাটুন, ভাষা ও পৌরুষ

রেহনুমা আহমেদ

এই ধারাবাহিক লেখার এই পর্বে আমরা জানবো পৌরুষ প্রকাশের ধরন নিয়ে পর্যালোচনা। একদিকে মুক্তিযোদ্ধার কথা, পাক বাহিনীর সাথে তাদের লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, এই কালে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ব্যবহার করে, পাবলিক রাজনৈতিক আলাপচারিতায় বুদ্ধিবৃত্তিক সমালোচকদের “বেশ্যা” শব্দ দিয়ে আক্রমণ করার সংস্কৃতি, পৌরুষ দেখাবার ভাষায় নিপীড়ন লিঙ্গীয় সন্ত্রাসের আশ্রয় গ্রহণ।

(আদি) ক্র্যাক প্ল্যাটুনের শত্রুকে উপস্থাপনের ভাষা

যত গভীরভাবে অনুসন্ধান করি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও নারী-বিদ্বেষ, আধিপত্যের ভাষা ও পীড়িতদের দমন করার-বিষয়, ততই আমার  কৌতুহল বাড়ে আর মনে প্রশ্ন জাগে, আচ্ছা, আদি ক্র্যাক প্ল্যাটুন কীভাবে শত্রুকে উপস্থাপন করেছিল? তারা কোন শব্দ, কী ধরনের বাক্য ব্যবহার করেছিল?

বন্ধু শিরীন হক ১৯৭১-এ আদি ক্র্যাক প্ল্যাটুনের গেরিলা যোদ্ধাদের অর্থ, আশ্রয়, গরম কাপড় ও ঔষধপত্র যোগান দিয়ে সাহায্য করেছিল, তার কাছ থেকে ক্র্যাক প্ল্যাটুনের সদস্য বীর প্রতীক হাবিবুল আলম-এর লেখা ব্রেভ অফ হার্ট (২০০৬)এর কপি ধার নিলাম।  (এই অংশের উপ-শিরোনাম কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে যেহেতু আমি ‘ক্র্যাক প্ল্যাটুনের ভাষা’র কথা বলছি কিন্তু  যেখানে ক্র্যাক প্ল্যাটুনের অন্যান্য সদস্যরাও আত্মজীবনী লিখেছেন বা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, আমি শুধু আলমের বইয়ের সূত্র ধরে আলোচনা দাঁড় করাচ্ছি; আমি দাবি করছি না যে আলমের বয়ান ক্র্যাক প্ল্যাটুনের অভিজ্ঞতার প্রতিনিধিত্ব করে, আমি তাঁর কাজকে ব্যবহার করছি সিপি গ্যাংয়ের ভাষাব্যবহারের বিশিষ্টতা তুলে ধরার জন্য)।

পুরো বইয়ের শুধু দুটো জায়গায় গালাগালি পেলাম, একটি, পাকিস্তানি আর্মি দ্বারা উচ্চারিত,

‘…মিলিটারি পুলিশ…[আমাদের] গালি দিল, হারামজাদা! চুতিয়ারা কোথায় যাওয়ার চেষ্টা করছ? থামো!’

অন্যটি, মরণোত্তর বীর বিক্রম পদকপ্রাপ্ত জাহানারা ঈমামের ছেলে, মুক্তিযোদ্ধা শফি ঈমাম রুমির,

‘রুমি চিৎকার করল, ‘সাবধান! ওখানে জিপ। হারামজাদারা আমাদের পিছু নিয়েছে।’

এ বাদে আছে ‘পাকি’ শব্দটি (পাকিস্তানীর সংক্ষেপণ হিসেবে), যা একটি বর্ণবাদী গালি হিসেবে সারা বিশে^ পরিচিত। ‘পাকি’ শব্দটি খোদ প্রচ্ছদেই আছে উদ্ধৃত উক্তির অংশ হিসেবে, একজন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা যিনি ‘পাকি’ শব্দ ব্যবহার করেছেন তাকে উদ্ধৃত করে একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক বলেন,

কর্নেল দেশপান্ডের প্রাঞ্জল ভাষায় বোঝা কঠিন না [তিনি কেন বলেছেন], “পাকিদের আত্মবিশ্বাস তাদের বুটজুতার ভিতর।” ভারতীয়রা মাইক, লিফলেট ও রেডিওর মাধ্যমে নিরন্তর ঘোষণা করছে, “মুক্তিবাহিনী তোমাদের [পাকিস্তানী সৈনিকদের উদ্দেশ্য করে বলা] ধরে ফেলার আগে [তোমরা] আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করো।”

হেনরি ব্র্যান্ডন, সাংবাদিক, দ্য সানডে টাইমস, ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১

বাকি বইয়ে শত্রু বা শত্রুপক্ষকে বোঝানোর জন্য আলম সাধারণ বর্ণনাত্মক ভাষা ব্যবহার করেন: “সৈনিকরা,”“সৈনিকরা ফেরি নিয়ন্ত্রণ করছিল,”“পাকিস্তান আর্মি,”“শত্রু বাহিনী,”“পাকিস্তানী শাসক,”“পাকিস্তানী আর্টিলারি,”“সেনা জান্তা,”“[সেনা] বহর,”“পাকিস্তানীরা,”“সিপাহি,”“আইয়ুব শাসন,”“দুই বা তারো অধিক শত্রুপক্ষের লাশ,”“অ-বাঙালি – বেশির ভাগ বিহারী,”“সৈনিক,”“পুলিশ,”“পুলিশ ও আর্মি,”“পাঞ্জাবী সৈনিক,”“পাকিস্তানী শত্রু সৈনিক,”“পাকিস্তানী আর্মির প্যাট্রোল বোট,”“দুজন মিলিটারি পুলিশ,”“রাজাকার,”“পাকিস্তানী গানবোট,”“স্থানীয় [বিহারী] টাউট ও ইনফর্মার।”

কারো কারো মনে হতে পারে আলম যেই বর্গগুলো ব্যবহার করেছেন তার মধ্যে কিছু বর্গ “essentialist” এই অর্থে যে, তিনি জাত তুলে কথা বলেছেন কিন্তু  আমার এই প্রয়াসের উদ্দেশ্য ভিন্ন। আমি মনে করি পাঠকের কাছে তুলে ধরতে পারা যে একজন পুরুষ মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে যৌনবাদী শব্দ বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও গেরিলা জীবনের অভিজ্ঞতার নানাদিক বর্ণনা করেছেন তা অর্থবহ: গেরিলা প্রশিক্ষণ, যুদ্ধচলাকালীন নানা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়ার অনুভূতি প্রকাশ করতে পারা (হারানো, ব্যথা,বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হওয়া), জীবনের ঝুঁকি নেওয়া, মনের ভিতরের ভয়-শঙ্কা, স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার গর্ব।  যারা সেল্ফ-সেন্সরশিপ নিয়ে ভাবছেন, ভাবছেন যে লিখতে বসলে কোন শব্দ ঠিক-বেঠিক সেটা নিয়ে ভাববার সময় পাওয়া যায়, শোধরানোর সময় পাওয়া যায়৬  পক্ষান্তরে, মুখে বলার সময় হঠাৎ দু-চারটা বেমানান শব্দ বেরিয়ে যেতে পারে, এ কথার প্রত্যুত্তরে আমি বলব, আলোচ্য ব্যানারটিও লিখিত, শব্দ ব্যবহারের ব্যাপারে, তার ফলাফল কী হতে পারে সে বিষয়ে ভাববার পর্যাপ্ত সময় ব্যানার-উদ্যোক্তাদের ছিল। বেশ্যা শব্দটি স্বেচ্ছায় আর ইচ্ছাকৃতভাবে বাছাই করা হয়েছে।

যারা সেল্ফ-সেন্সরশিপ নিয়ে ভাবছেন, ভাবছেন যে লিখতে বসলে কোন শব্দ ঠিক-বেঠিক সেটা নিয়ে ভাববার সময় পাওয়া যায়, শোধরানোর সময় পাওয়া যায়৬  পক্ষান্তরে, মুখে বলার সময় হঠাৎ দু-চারটা বেমানান শব্দ বেরিয়ে যেতে পারে, এ কথার প্রত্যুত্তরে আমি বলব, আলোচ্য ব্যানারটিও লিখিত, শব্দ ব্যবহারের ব্যাপারে, তার ফলাফল কী হতে পারে সে বিষয়ে ভাববার পর্যাপ্ত সময় ব্যানার-উদ্যোক্তাদের ছিল। বেশ্যা শব্দটি স্বেচ্ছায় আর ইচ্ছাকৃতভাবে বাছাই করা হয়েছে।

ব্রেভ অফ হার্ট-এ শত্রুকে ইতিবাচক ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে শুধু একটি বাক্যে, “পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সুপ্রশিক্ষিত স্থায়ী পেশাদার সৈনিকরা,”  বাকি সবই নেতিবাচক: “রক্তপিপাসু শাসক জান্তা,” “রক্তপিপাসু পাকিস্তানী সৈনিক,’  [একজন রিকশাচালেকর কথা উদ্ধৃত] “খুনি পাকিস্তানী সৈনিক,”১০ “বারো জন বর্বর পাকিস্তানী সৈনিক,”১১ “তথাকথিত টাইগার নিয়াজির পাকিস্তানী সৈনিকরা ভয় পেয়েছিল,”১২ “পাকিস্তানী সৈনিকরা ভয় পেয়ে চুপসে গেল আমরা দেখে মজা পেলাম,”১৩ “তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা গাড়ি অ্যাম্বুশ করার পর পাকিস্তানী সৈনিকদের আক্রমণ করে। শত্রুপক্ষের সেনারা ভয়ার্ত কুকুরের মতো দু’পায়ের মাঝে লেজ গুটিয়ে পালাল,”১৪ “পাকিস্তান আর্মি গুন্ডারা,”১৫ “একজন খুনি পাকিস্তানী সেনা,”১৬ “পাকিস্তান আর্মির অত্যাচার,”১৭ “নৃশংস পাকিস্তান আর্মি,”১৮ “ক্যাপ্টেন বোখারি…কুমিল্লার কসাই,”১৯ “লুইচ্চা ক্যাপ্টেন,”২০ “চারজন সেনা বানরের মতো হামাগুড়ি দিল।”২১

বইটিতে উল্লিখিত নৃশংসতম ঘটনা হচ্ছে একজন অল্পবয়ষ্ক অন্তঃসত্তা নারীর যিনি পুকুরপাড়ে বসে কাপড় ধুচ্ছিলেন। পাকিস্তানী সেনারা কাছের গ্রামে অভিযান চালাচ্ছিল, ইশরাক আর লেফটেন্যান্ট মেহবুব পুকুরে ডুব দিয়ে কচুরিপানার আড়ালে অপেক্ষা করছিল। মহিলাটি আড় চোখে তাদের দেখেছিল কিন্তু অবিচলিত ছিল। চার-পাঁচজন পাকিস্তানী সেনা চলে আসে, তারা চোখ কুঁচকে ঘাঁসের দিকে তাকায়, তারপর গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে কোনো ‘মুক্তি’ দেখেছে কি না। মহিলা বেশ হাল্কা স্বরে বলেন, না। হঠাৎ দুজন সেনা তাকে টান মেরে তুলে দাঁড় করায়, তৃতীয় সেনা বেয়নেট দিয়ে তার পেট চিরে ফেলে, জরায়ু থেকে শিশুটিকে টেনে ছিঁড়ে পানিতে ফেলে দেয়। এই ঘটনা বর্ণনা করার সময় হাবিবুল আলম শত্রুপক্ষকে বোঝানোর জন্য যেই শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করেন, তা হলো: “পাকিস্তানী সেনা,”“পাকিস্তানী আর্মি গু-ারা,”“একজন খুনি পাকিস্তানী সেনা,”“পাকিস্তান আর্মির নৃশংসতা” ও “নৃশংস পাকিস্তানী আর্মি।”২২

হঠাৎ দুজন সেনা তাকে টান মেরে তুলে দাঁড় করায়, তৃতীয় সেনা বেয়নেট দিয়ে তার পেট চিরে ফেলে, জরায়ু থেকে শিশুটিকে টেনে ছিঁড়ে পানিতে ফেলে দেয়।

এই আলোচনা থেকে আমি প্রজন্ম পৌরুষ (masculinity) প্রসঙ্গে যেতে চাই (এরশাদ-শাসনোত্তর স্বাধীনতাযুদ্ধ ডিসকোর্সে ‘প্রজন্ম’ বলতে বোঝায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাসকে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে প্রবাহিত করার কাজ/গুরুদায়িত্ব বোঝানোর জন্য)। শুধু ‘বেশ্যা ব্যানার ধরে-থাকা পৌরুষ’ নিয়ে অল্প কিছু কথা পাঠকদের সামনে tentatively হাজির করছি।

পৌরুষ: হেজেমনিক, বিজয়ী, হাইপার

ম্যাসকিউলিনিটির প্রসঙ্গটি -অর্থাৎ, পৌরুষের বহুবিধ অর্থ -আলোচনা করা জরুরি। Concept হিসেবে ম্যাসকিউলিনিটির সাথে যারা পরিচিত নন তাদের কথা ভেবে জেন্ডার থিওরিস্ট আর ডব্লিউ কনেলএর চিন্তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। কনেল বলেন, ম্যাসকিউলিনিটি (বা পৌরুষ) একটি relational পদ, অর্থাৎ, একে সবসময় সংজ্ঞায়িত করা হয় নারীত্বের বিপরীতে (আর সেই অর্থে এটি স্বতন্ত্র কিছু না, পৌরুষের ধারণা নারীত্বের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত)। আর তাই তিনি বলেন, যখন আমরা পৌরুষের কথা বলি তখন আসলে আমরা লিঙ্গীয় সম্পর্কের কথা বলছি। “ম্যাসকিউলিনিটি পুরুষের সমতুল্য না, এই [প্রত্যয়]টি লিঙ্গীয়ভাবে-শৃঙ্খলিত সমাজে পুরুষের পজিশন বা অবস্থানটি বোঝায়।”২৩ প্রতিটি সমাজে শ্রেণী, বর্ণপ্রথা, নরবর্ণ, যৌনতা, বয়স, ধর্ম ইত্যাদি সম্পর্কের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে শৃঙ্খলা গঠিত হয়। ম্যাসকিউলিনিটিকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়? কনেল বলেন, ম্যাসকিউলিনিটি হচ্ছে অনুশীলন বা চর্চার ধারা যার মাধ্যমে নারী ও পুরুষ উভয়েই কিন্তু প্রধানত পুরুষরা,নিজেদের (লিঙ্গীয়) সামাজিক পজিশনের সাথে বোঝাপড়া করেন (কনেল বলেন, নারীরাও ম্যাসকিউলিনিটি চর্চা করতে পারে;২৪  যেমন কিনা তুবার সেই গুন্ডা নারীরা…?)। ম্যাসকিউলিনিটি বহুবিধ, প্রতিটি ধারার ভিতর আছে অভ্যন্তরীন জটিলতা, বৈপরীত্য। ম্যাসকিউলিনিটি সামাজিকভাবে নির্মিত, এটি ঐতিহাসিক (অর্থাৎ, এটি অটল-অনড় বা অপরিবর্তনীয় কিছু না, পৌরুষের ধারণা ও চর্চায় পরিবর্তন ঘটে), এটি“চলমান অর্জনের ব্যাপার, [এটি] স্থিত কোনো বিষয়-আষয় না বা সম্পত্তি না।’২৫  ম্যাসকিউলিনিটি পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে, “কোনো নির্দিষ্ট সামাজিক পরিস্থিতিতে হাতের কাছে মজুত সম্পদ ও কৌশলের ব্যবহারের মাধ্যমে এটি সক্রিয়ভাবে উৎপাদিত হয়।’২৬

ম্যাসকিউলিনিটি পদের আধুনিক ব্যবহার উপনিবেশবাদ ও পুঁজিবাদের বিকাশের সাথে সম্পর্কিত; ইউরোপীয় ব্যক্তিবাদের (individualism) ধারণা ম্যাসকিউলিনিটিকে আকার-আকৃতি দান করেছে। কনেল বলেন, “ম্যাসকিউলিনিটির ভিতরে লিঙ্গীয় রাজনীতি কাজ করে।”২৭  তিনি চারটি প্রধান বর্গের কথা বলেন যেগুলো মিলে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন স্তরে বিন্যস্ত পৌরুষ-ব্যবস্থা: হেজেমনিক, যোগসাজশকারী, প্রান্তিক ও অধস্তন। মার্টিন মিলস বলেন, একটি পিতৃতান্ত্রিক সমাজে হেজেমনিক ম্যাসকিউলিনিটির মূল্য সবচাইতে বেশি, “এটি নির্মিত হয় নারীত্ব ও অধস্তন ম্যাসকিউলিনিটির পরিপ্রেক্ষিতে, তার বিপরীতে। অধিপতিশীল ম্যাসকিউলিনিটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিষমকামীতা, ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, মারমুখোপনা ও প্রযুক্তিগত কর্মক্ষমতা।’২৮  যোগসাজশকারী (complicit)  ম্যাসকিউলিনিটির বৈশিষ্ট্য কি হতে পারে তা তার নাম থেকেই অনুমেয়, “পিতৃতান্ত্রিক লিঙ্গীয় শৃঙ্খলা চ্যালেঞ্জ করার ক্ষেত্রে তেমন কিছু করে না, আর এ কারণেই পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুযোগসুবিধা ভোগ করে।”২৯  অধস্তন (subordinate) ম্যাসকিউলিনিটির ভিতরে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এমন আইডেন্টিটি যা ম্যাসকিউলিনিটির বিপরীত ভাবা হয়: নারীসুলভ পুরুষ, সমকামী পুরুষ, এমন পুরুষ যারা ‘পৌরুষের আদর্শ মূর্ত বা আলিঙ্গন করে না।’৩০  প্রান্তিক (marginalised) ম্যাসকিউলিনিটি লিঙ্গীয়, শ্রেণী ও নরবর্ণগত সম্পর্কের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ারই বহিঃপ্রকাশ যেমন শ্রমিক শ্রেণীর পুরুষ, কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ।

কনেলের তত্ত্বায়ন কি আমাদের প্রজন্ম পৌরুষের ধরন অনুসন্ধান করতে সাহায্য করে? “পিয়াস করিমের লাশের ভার, বইবে না শহীদ মিনার” — এই স্লোগান/স্লোগানযুক্ত কর্মকাণ্ডের সৃষ্টি-করা-পরিসরে কোন্ ধরনের পৌরুষ বসবাস করে? হেজেমনিক? নাকি তারা যোগসাজশকারী, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তগ্রহণকারী জগতের যারা, তারা হচ্ছেন হেজেমনিক কারণ কনেল তো বলেইছেন, ম্যাসকিউলিনিটি হচ্ছে রিলেশনাল।

১৯৭১-এ পাকিস্তান আর্মির দখল-করা পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি মুসলমান পৌরুষের কী অবস্থা ছিল, নিশ্চয়ই পশ্চিম পাকিস্তানের/পাঞ্জাবীদের পৌরুষ হেজেমনিক ছিল? আর বাঙালি মুসলমান পৌরুষ তার তুলনায়, প্রান্তিক? কিন্তু মুক্তিবাহিনীর বেলায়? লড়াইরত অবস্থায় কোন্ কোন্ ধরনের পৌরুষ যুদ্ধক্ষেত্রে বিরাজ করত? নিঃসন্দেহে সাহসী, কিন্তু আমি বীরাঙ্গনা বলছি-তে ধর্ষণের শিকার নারীরা এদেশের পুরুষদের ধিক্কার জানান তাদের অরক্ষিত রেখে চলে যাওয়ার জন্য, পাকিস্তান আর্মির হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। সর্বোপরি, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে তাদেরকে নিজ জীবনে, নিজ ঘরে গ্রহণ না করার জন্য। পঞ্চাশোর্ধ্ব বাঙালি মুসলমান পুরুষ, শেফার (ছদ্মনাম) মতে, “মনোবলে…আমার চেয়ে নিকৃষ্ট।”৩১  তারা ব্যানার্জী (ছদ্মনাম, পরে মিসেস টি নিয়েলসেন) তার আত্মকাহিনীতে উল্লেখ করেন একজন আর্মি অফিসারের কথা যিনি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন, ধানমন্ডির পুনর্বাসন কেন্দ্রে স্ত্রীর সাথে দেখা করতে গিয়ে বলেছিলেন, মাসে মাসে টাকা পাঠাতে পারব কিন্তু ঘরে তুলতে পারব না।৩২  তারা লেখেন, হয়ত এদ্দিনে তিনি জেনারেল হয়ে গেছেন, বীরত্বের পুরষ্কারও পেয়েছেন, “আর সুলতানা সম্ভবত টান বাজারে জীবনযুদ্ধের শেষ লড়াইয়ে ব্যস্ত।”৩৩

নাকি আমাদের তাড়িত হওয়া উচিৎ অন্য ধরনের প্রশ্ন দ্বারা, পরিপ্রেক্ষিত-নির্ভর প্রশ্ন: যেমন ধরেন, প্রজন্মের বিভাজন ভুলে গিয়ে আমাদের কি মুক্তিযুদ্ধের-চেতনা পুনরুদ্ধারকারী পুরুষদের একটি সমষ্টি হিসেবে দেখা উচিৎ যারা পুনর্জাগরিত ‘বিজয়ী’ পৌরুষকে মূর্তিমান করে?

কিন্তু নিশ্চয়ই প্রযুক্তির একটি প্রভাব আছে, বহু “প্রজন্ম” ও “লাশের ভার” দল হচ্ছে অনলাইন গ্রুপ (উল্লেখ করা জরুরি যে, সব প্রজন্ম দল শাসক দলের হাতিয়ার নয়, ছোটখাটো দল আছে যারা নিজেদের ও চারপাশ নিয়ে ভাবেন, যারা মারমুখো নন, যাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অনুদ্ধত), যাদের বিরুদ্ধে সাইবার-জগতে যৌন হয়রানিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার অভিযোগ আছে।৩৪ তারা যেই সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছেন, যেটিকে টিকিয়ে রাখেন ও জারি রাখেন সেটি কি হাইপার-পৌরুষালি(hypermasculine)? সারা মিলস্ হিপ-হপ সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে হাইপার ম্যাসকিউলিনিটির এই বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করেন: উগ্র পৌরুষপণা, বিষমকামী বাধ্যবাধকতা, দুর্বল বা কোমল উপাদানের প্রতি অবজ্ঞা, “আসল পুরুষ হওয়ার অর্থ শুধু স্বীয় পুরুষ যৌনাঙ্গ থাকা না; এর অর্থ হচ্ছে পুরুষোচিৎ আচার-আচরণ ও ভাবভঙ্গি প্রদর্শন করা।”৩৫ মিলস্ যোগ করেন, আর ম্যাসকিউলিন-এর অর্থ হচ্ছে নিজেকে “শক্তপোক্ত, কঠিন, পোড়-খাওয়া, রাগে পরিপূর্ণ” পুরুষ হিসেবে প্রকাশ করা।’৩৬

যাদের বিরুদ্ধে সাইবার-জগতে যৌন হয়রানিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার অভিযোগ আছে। তারা যেই সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছেন, যেটিকে টিকিয়ে রাখেন ও জারি রাখেন সেটি কি হাইপার-পৌরুষালি(hypermasculine)? সারা মিলস্ হিপ-হপ সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে হাইপার ম্যাসকিউলিনিটির এই বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করেন: উগ্র পৌরুষপণা, বিষমকামী বাধ্যবাধকতা, দুর্বল বা কোমল উপাদানের প্রতি অবজ্ঞা, “আসল পুরুষ হওয়ার অর্থ শুধু স্বীয় পুরুষ যৌনাঙ্গ থাকা না; এর অর্থ হচ্ছে পুরুষোচিৎ আচার-আচরণ ও ভাবভঙ্গি প্রদর্শন করা।”

ব্যানারে “বেশ্যাবুদ্ধিজীবী”র অন্তর্ভুক্তি কি বাস্তবের অফলাইন জগতে সাইবার-সংস্কৃতির যৌনবাদী ষণ্ডাগিরি ও হাইপার-পৌরুষপণার ছলকে-পড়াকে ইঙ্গিত করে?

যেভাবেই বিশ্লেষণ করুন না কেন পাবলিক রাজনৈতিক আলাপচারিতায় “বেশ্যা” শব্দ অন্তর্ভুক্ত করার গৌরবের ভার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, যার প্রধান ছিলেন অধ্যাপক আআমস আরেফিন সিদ্দিক—আজীবন বহন করবেন।

কিন্তু এটি বলা কি যৌক্তিক?

অযৌক্তিক মনে হয় না এ কারণে যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিপি গ্যাংয়ের এই শব্দব্যবহারে কোনো ধরনের অসন্তোষ প্রকাশ করেননি, নিন্দা করা তো দূরের কথা।

ছবি: (অরিজিনাল) ক্র্যাক প্লাটুনের একটি ঐতিহাসিক ছবি। আবুল ফজল মোহাম্মদ সিদ্দিক মনু (মাঝে, নৌকা দুর্ঘটনায় ২০০৪ সালে মারা যান)। মুনির (ডানে)। তৃতীয় ব্যক্তির নাম জানা যায়নি। আলোকচিত্রীর নাম অজানা।

তথ্য সূত্র:

১। Habibul Alam, Brave of Heart. The Urban Guerilla Warfare of Sector-2, during the liberation War of Bangladesh, Dhaka: Academic Press and Publishers Library, 2006|

২। উপরোক্ত, পৃ. ১৮০।

৩। উপরোক্ত, পৃ. ১৮১।

৪। প্রচ্ছদ, Brave of Heart, প্রাগুক্ত।

৫। একটি দৈনিক পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হাবিুবল আলম বলেন, ৭১-এর দিকে ফিরে তাকালে খারাপ লাগে, আমাদের ৩টা স্বপ্ন ছিল- পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে ভাগিয়ে দেওয়া, দেশকে স্বাধীন করা, আরো ভালো একটি দেশ গড়ে তোলা। আমরা শুধু প্রথম দুটোতে স্বার্থক হয়েছি। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দোষারোপ করে তিনি বলেন, প্রধান দুটো রাজনৈতিক দলের কোনোটাই গণতন্ত্র চর্চা করে না। তারা ভ-ামি করে, শুধু মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে। স্বাধীনতা অর্জনকে বিসর্জন করা হচ্ছে পরিবারতন্ত্রের স্বার্থে। “বিএনপি প্রমাণ করতে চায় জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর চাইতে শ্রেষ্ঠ আর অন্য দিকে আওয়ামী লীগ মনে করে ‘জয় বাংলা’ তাদের দলীয় সম্পত্তি।” আলম আরো বলেন, ইতিহাসকে বিকৃত করা একটি অপরাধ, শিশুদের ভুল ইতিহাস পড়ানো হচ্ছে। “যখন যেই রাজনৈতিক দল শাসন করে তারা যা চায় সেটাই পাঠ্যবইয়ে পড়ানো হয়। যেই শিক্ষার্থীরা বিএনপি আমলে পড়াশোনা করে তারা একধরনের ইতিহাস পড়ে আর যারা আওয়ামী লীগ আমলে পড়াশোনা করে তারা অন্য ধরনের ইতিহাস।” তিনি যোগ করেন, “[বিকৃত] ইতিহাস যারা লেখেন আর অনুমোদন করেন তাদের ফাঁসি হওয়া উচিৎ।” দেখুন “Remembering our victory, our freedom fighters” (Reference: Brave of Heart by Habibul Alam, Bir Pratik, and interview with freedom fighter), The Daily Star, 13 December2006|

আলোচ্য বিষয়ে ফিরে আসি, আলমের কথা থেকে স্পষ্ট যে নারীমুক্তির বিষয়টি স্বাধীনতার রাজনৈতিক এজেন্ডায় অনুপস্থিত ছিল।

৬। অন্য ধরনের প্রশ্নও তুলতে পারেন কেউ কেউ, যুদ্ধচলাকালে লেখক কি সত্যিই এই ভাষায় কথা বলেছেন? তার উত্তরে বলব, জানি না।

৭। Brave of Heart, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৯।

৮। উপরোক্ত, পৃ. ১৫।

৯। উপরোক্ত, পৃ. ৪০।

১০। উপরোক্ত, পৃ. ৭৫।

১১। উপরোক্ত, পৃ. ১৫৬।

১২। উপরোক্ত, একই পৃষ্ঠা।

১৩। উপরোক্ত, পৃ. ১৬৫।

১৪। উপরোক্ত, পৃ. ২৩৪।

১৫। উপরোক্ত, পৃ. ২৬৪।

১৬। উপরোক্ত, পৃ. ২৬৫।

১৭। উপরোক্ত, পৃ. ২৬৬।

১৮। উপরোক্ত, একই পৃষ্ঠা।

১৯। উপরোক্ত, পৃ. ২৭৫।

২০। উপরোক্ত, একই পৃষ্ঠা।

২১। উপরোক্ত, পৃ. ২৮৫।

২২। উপরোক্ত, পৃ. ২৬৪-২৬৬।

২৩। “Masculinities,” raewynconnell.net; see also, RW Connell, The Men and the Boys, Berkeley, Los Angeles: University of California Press, 2000|

২৪। raewynconnell.net|

২৫। Sinikka Elliott, “Men, Race and Emotions: Men of color and masculine productions,” in Rebecca F Plante and  Lis M Maurer (eds), Doing Gender Diversity: Readings in Theory and Real-World Experience, Boulder, CO: Westview Press, 2010,পৃ. ৪৫৪।

২৬। উপরোক্ত, একই পৃষ্ঠা।

২৭। RW Connell, Masculinities, 2nd edition, Polity: Cambridge, 2005,পৃ. ৩৭।

২৮। Elizabeth J. Meyer, Gender and Sexual Diversity in Schools. An Introduction, New York: Springer, 2010,পৃ. ৩৪।

২৯।  উপরোক্ত, পৃ. ৩৫।

৩০। “Men, Race and Emotions,”প্রাগুক্ত,পৃ. ৪৫৪।

৩১।  নীলিমা ইব্রাহিম, “শেফা,” আমি বীরাঙ্গনা বলছি, পৃ. ৮০।

৩২। “তারা,” উপরোক্ত, পৃ. ৩৪।

৩৩।  উপরোক্ত, একই পৃষ্ঠা।

৩৪। এই সিরিজের দ্বিতীয় লেখা, ‘“বেশ্যা”-নামক ধারণার প্রবলেমেটাইজেশান’-র ১৫ নম্বর টীকা দেখুন।

৩৫। Sara Mills, Language and Sexism, Cambridge: Cambridge University Press, 2008|

৩৬। Sara Mills, “Rap lyrics and sexism,” www.academia.edu, এই নির্বাচিত অংশটি প্রথম প্রকাশিত হয় এই বইয়ে, Sara Mills, Language and Sexism, Cambridge: Cambridge University Press, 2008|

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *