করোনাভাইরাস মোকাবিলা: কারা ব্যর্থ কারা সফল

করোনাভাইরাস মোকাবিলা: কারা ব্যর্থ কারা সফল

আলমগীর খান

চলমান করোনাসংকট মোকাবিলায় সব দেশ একরকম সাফল্য বা ব্যর্থতা দেখায়নি। কীধরনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী, কীধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও দায়বদ্ধতা এররকম সংকটে সফল ভূমিকা পালন করতে পারে তার শিক্ষা গত কয় মাসে অনেক স্পষ্ট হয়েছে। এই সংকটের মধ্য দিয়ে যেসব সত্য প্রকাশিত হয়েছে তা চরম সম্পদশালী ০.০১ শতাংশের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। এই বিষয়েই আলোকপাত করা হয়েছে এই লেখায়।

কোভিড-১৯ বর্তমান বিশ্বে নানারকম বিপর্যয়ের পাশাপাশি কিছু সত্য ও শিক্ষণীয় বিষয় মানুষের সামনে তুলে ধরেছে। যার সারমর্ম হচ্ছে, সমাজতন্ত্রের পক্ষেই শুধু সম্ভব ভবিষ্যতের আসন্ন প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলা করা ও মানবতার প্রগতি নিশ্চিত করা। প্রমাণ করেছে, এই অতিমারি সৃষ্টিতে অবাধ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার লোভ-লালসাভিত্তিক অর্থনীতির ভূমিকা, একে প্রতিরোধে তার অক্ষমতা ও সামনে আরও ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে আসার পরিস্থিতি। এ সত্য প্রতিষ্ঠা করল যে, ভবিষ্যতে জীবন ও মানবসভ্যতাকে আসন্ন অপূরণীয় ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য মানুষকে অবশ্যই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে এক নতুন অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থায় উত্তরণ লাভ করতে হবে, যার ভিত্তি হবে সমানাধিকার, শান্তি, সাম্য ও ন্যায়। সমাজতন্ত্রের পক্ষে ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে কোভিড-১৯-এর রয়েছে কিছু অভূতপূর্ব শিক্ষা।

এসব শিক্ষা যথার্থভাবে কাজে লাগাতে পারলে মানবসভ্যতা শান্তি, সাম্য, সমৃদ্ধি ও কাঙ্ক্ষিত টেকসই উন্নয়নের দিকে এগোবে। তবে কাজে লাগানো সহজ নয়। বাস্তবতা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের এসব শিক্ষা ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে ও হবে। বিশ্বব্যাপী ক্ষমতাসীনরা এসব শিক্ষার বিপরীতটাই বাস্তবায়ন করবে। চলমান করোনাসংকটে যেসব সত্য প্রকাশিত হয়েছে তা চরম সম্পদশালী .০১ শতাংশের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। এরাই পৃথিবীর বেশিরভাগ সম্পদের মালিক হয়ে বসে আছে। অতএব এই ক্ষুদ্রাংশের ও তাদের সহযোগীদের পাহারাদার শাসকগোষ্ঠী এসব শিক্ষা গ্রহণ করবে না–এটাই স্বাভাবিক। এসব সত্য উন্মোচন করে সমাজের শোষিত-শাসিত বৃহদাংশের স্বার্থ কীভাবে লুণ্ঠিত হচ্ছে এবং গরিব কী করে আরও গরিব ও অধিকারহীন কী করে আরও অধিকারহীন হচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতায় এই বৃহদাংশের অংশগ্রহণ নেই। সুতরাং এসব সত্য ও শিক্ষা বাস্তবায়নের ক্ষমতা ও অধিকারও তাদের নেই। আর তাই করোনাভাইরাসের উন্মোচিত সত্যকে যত ভালোভাবে সম্ভব ঢেকে রেখে বিপরীতটা বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। বর্তমানের নয়া উদারনৈতিক পুঁজিবাদী পরিবেশে তো তাই হওয়া স্বাভাবিক।

কোভিড-১৯-এর শুরুতেই আশ্চর্যজনকভাবে দেখা গেল বিশ্বব্যাপী মানুষ বিজ্ঞানের শিক্ষা গ্রহণ করছে ও বিজ্ঞানীদের নির্দেশ অনুসরণ করতে চেষ্টা করছে। প্রধান প্রধান ধর্মের নেতা ও অনুসারীরা তাদের প্রার্থনালয় বন্ধ করে দিলেন সামাজিক দূরত্বের নির্দেশনা মানার জন্য। টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের কল্যাণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক হয়ে উঠলেন সর্বাধিক পরিচিত ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের সব প্রান্তের মানুষ, সরকার ও নীতিনির্ধারকরা রেডিও-টেলিভিশনে কান পেতে রাখলেন তার কথা শোনার জন্য ও সে অনুযায়ী চলার জন্য। লকডাউনের মাঝে পৃথিবীর কোলে প্রকৃতি ফিরে এলো নব উচ্ছ্বাসে। সবুজের নব আবির্ভাব দেখা গেল। দূষণ কমে বাতাস হয়ে উঠল অনেক বেশি অম্লজানসমৃদ্ধ। মানব-আক্রমণের ভয় কাটিয়ে পাখি, পতঙ্গ এবং জলজ ও বন্যপ্রাণীরা ফিরে এলো তাদের হারানো স্বভূমে। প্রকৃতি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল আর উল্লসিত হলেন প্রকৃতি-প্রেমিকরা। কিন্তু এ স্বস্তি ছিল সাময়িক। কেননা, এর উৎস সাধারণ মানুষের বেকারত্ব, কর্মহীনতা ও জীবনের অনিশ্চয়তা–ন্যায্য মানব-উন্নয়ন ও প্রগতি নয়।

মানুষের জন্য কোভিড-১৯-এর বড় শিক্ষাটা হলো সমাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। এই অতিমারি শেখাল মানুষের জীবনে ঐক্য ও সহমর্মিতার, সম্পদের সর্বজনীন বণ্টনের এবং পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা। এই অতিমারি এক মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত শোষণমূলক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী, তার সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রগতিশীল চিন্তাবিদ নোয়াম চমস্কি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন: ‘যেসব প্রাণীর সঙ্গে মানুষের সংযোগ ছিল না, তাদের বাসস্থান ধ্বংসের ফলে তারা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছে, আর সেখানে ঢুকেছে মানুষ। হয়েছে নবসংযোগ।’

মানুষের জন্য কোভিড-১৯-এর বড় শিক্ষাটা হলো সমাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। এই অতিমারি শেখাল মানুষের জীবনে ঐক্য ও সহমর্মিতার, সম্পদের সর্বজনীন বণ্টনের এবং পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা। এই অতিমারি এক মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত শোষণমূলক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী, তার সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রগতিশীল চিন্তাবিদ নোয়াম চমস্কি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন: ‘যেসব প্রাণীর সঙ্গে মানুষের সংযোগ ছিল না, তাদের বাসস্থান ধ্বংসের ফলে তারা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছে, আর সেখানে ঢুকেছে মানুষ। হয়েছে নবসংযোগ।’

এই ভাইরাসটি বাদুড় থেকে লাফিয়ে মানবদেহে এসেছে। চলমান নয়া উদারনৈতিক পুঁজিবাদী আদর্শের সঙ্গে এর রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এই রাজনৈতিক শিকড়ের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন চমস্কি। তিনি বলেছেন: ‘একটা শিক্ষা হলো, এটি পুঁজিবাদের নয়া উদারনৈতিক রূপের আরেক বিরাট চরম ব্যর্থতা। বিশাল ব্যর্থতা।’ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন যে, নয়া উদারনৈতিক হাতুড়ির আঘাত নিশ্চিত করল: ‘সরকার কিছু করতে পারবে না, সরকার হচ্ছে সমস্যা, সমাধান নয়।’

চমস্কি সম্প্রতি আরেক সাক্ষাৎকারে বলেছেন:

‘আমাদের মনে রাখতে হবে, ২০০৩-এ কী ঘটেছিল, যেহেতু আমরা আবার সেই সময়ে ফিরে গেছি। সার্স (SARS) মহামারি আটকানো হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা বিশ্বকে জানিয়েছিলেন, এরূপ করোনাভাইরাস আরও মহামারি কিংবা আরও অতিমারির জন্ম দিতে পারে। প্রস্তুত হওয়ার উপায় তখন ছিল, জানানো হয়েছিল; কিন্তু তা মানা হয়নি। যেহেতু মুনাফা নেই, তাই ওষুধ কোম্পানিগুলো আগ্রহী হয়নি। নয়া উদারনৈতিক ধ্যান-ধারণা সরকারকে পেছন থেকে টেনে ধরে রাখে, বলা হয় সরকারের পক্ষে কিছু করা সম্ভব না।’

কিন্তু এই অতিমারিকালে সংকট কাটিয়ে মানুষকে বাঁচাতে প্রত্যেক দেশে সরকারই এগিয়ে এলো, পালন করল মূল ভূমিকা। সরকার বিভিন্ন স্থানে লকডাউন ঘোষণা করল, মৃত্যু ও সংক্রমণের খবর সম্পর্কে মানুষকে ওয়াকিবহাল রাখল এবং ঘনঘন হাত ধোয়া ও ঘরের বাইরে মাস্ক পরা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করল। যেসব দেশের সরকার এ কাজগুলো যথার্থভাবে ও আন্তরিকতার সঙ্গে করেছে, তারাই এ সংকট সবচেয়ে ভালোভাবে মোকাবিলা করেছে। আর যেসব দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানরা করোনাভাইরাসকে পাত্তা না দিয়ে বৈজ্ঞানিক সতর্কতা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করেছে, তারা অধিক মৃত্যু ও অসুস্থতার মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় অধিক মূল্য দিয়েছে।

এ দলের শীর্ষে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প ও তার ভাবশিষ্য ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো। করোনাসংকট মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতার পেছনে রয়েছে ট্রাম্পের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ যা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজয়ে ভূমিকা রেখেছে। তার নির্বাচনি পরাজয়ের ফলে ব্রিটিশ ট্রাম্প বরিস জনসনসহ ট্রাম্পের অন্যান্য ভাবশিষ্য তাদের আচরণ আংশিক বদলাতে শুরু করেছেন। এসব সরকার গণবিরোধী নয়া উদারনৈতিক আদর্শের ধারক-বাহক। তারা নিজ নিজ দেশে সরকারি উদ্যোগগুলো গুটিয়ে আনছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করছে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে করে তুলছে আক্রমণাত্মক ও ফ্যাসিস্ট। তারা জনগণকে সার্বক্ষণিক নজরদারির মাধ্যমে বেশি বেশি নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনছে এবং এভাবে খর্ব করছে নাগরিকের চলাচলের ও কথা বলার মতো মৌলিক স্বাধীনতা।

গ্রিসের সাবেক অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারাওফ্যাকিস এ সম্পর্কে লিখেছেন:

‘যুক্তিসংগতভাবেই আমরা এ কথা ভাবতে অভ্যস্ত যে, বিশ্বায়ন জাতীয় সরকারগুলোকে দন্তনখহীন করে তুলেছে। … এরপর অতিমারি এলো। রাতারাতি সরকারগুলো তাদের ধারালো দাঁত ও নখ বের করে মানুষকে দেখিয়ে দিল। তারা সীমান্ত বন্ধ করল, বিমান মাটিতে নামিয়ে রাখল, শহরে কঠিন কারফিউ জারি করল, নাট্যশালা ও জাদুঘরগুলো বন্ধ করে দিল এবং আমাদেরকে মুমূর্ষু মা-বাবার পাশে দাঁড়াতে নিষেধ করে দিল। তারা এমন এক কাজ করল যা সম্ভব বলে আগে কেউ ভাবেনি: ক্রীড়া অনুষ্ঠানগুলো বাতিল করে দিল। প্রথম গোপন কথাটি এভাবে ফাঁস হলো: সরকার অপরিমিত ক্ষমতার অধিকারী। ২০২০-এ আমরা যা আবিষ্কার করলাম তা হলো, এতদিন সরকার তাদের বিপুল ক্ষমতা কাজে লাগায়নি যাতে বিশ্বায়ন যাদেরকে ধনী করেছে তারা অবাধে তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারে।*

ভারতের মোদি সরকার কোভিডের সুযোগকে পুরো কাজে লাগিয়েছে। নয়া উদারনৈতিক রাজনৈতিক আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য হঠাৎ করে লকডাউন ঘোষণার মাধ্যমে ইনফরমাল সেক্টরের শ্রমিকদের মৃত্যু ও তাদের জীবনে দুর্দশা ডেকে এনেছে, মুসলিমবিরোধী নাগরিকত্ব আইন চালু করেছে এবং প্রতিবাদকারীদের শায়েস্তা করেছে। অন্যান্য দেশের স্বৈরাচারী সরকারগুলোও একই পথ অবলম্বন করেছে। এর মাধ্যমে তারা নিজ দেশের গরিব মানুষকে কর্মহীন করে ও সংক্রমণের মুখে ঠেলে দিয়ে ধনিকশ্রেণির স্বার্থরক্ষার কাজে নেমেছে। এরা হলো মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাসী মৌলবাদী সরকার যারা জনজীবনে সরকারের ন্যূনতম কিংবা শূন্য ভূমিকার ফতোয়া দিয়ে বেড়ায়। কিন্তু এই অতিমারিতে তারা দাঁতনখ বের করে তাদের দৈত্যাকার চেহারাটা মানুষকে দেখাল, কারো যাতে টুঁ শব্দ করার জো না থাকে, লুটেরা ধনিকশ্রেণির স্বার্থে যাতে আঁচড় না পড়ে।

এরা হলো মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাসী মৌলবাদী সরকার যারা জনজীবনে সরকারের ন্যূনতম কিংবা শূন্য ভূমিকার ফতোয়া দিয়ে বেড়ায়। কিন্তু এই অতিমারিতে তারা দাঁতনখ বের করে তাদের দৈত্যাকার চেহারাটা মানুষকে দেখাল, কারো যাতে টুঁ শব্দ করার জো না থাকে, লুটেরা ধনিকশ্রেণির স্বার্থে যাতে আঁচড় না পড়ে।

অতিমারিকালে যুক্তরাষ্ট্রের বিলিয়নাররা কীভাবে তাদের সম্পদ এক ট্রিলিয়ন বাড়িয়েছে–এ সম্পর্কে মিগ্যান ডে লিখেছেন:

‘‘ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজ (আইপিএস) ‘বিলিয়নারদের সম্পদ বনাম সমাজের মানুষের স্বাস্থ্য: অতিমারির মুনাফাখোরদের হাত থেকে নিত্যাবশ্যক শ্রমিকদের রক্ষা’ (Billionaire Wealth vs. Community Health: Protecting Essential Workers from Pandemic Profiteers) শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর লেখকরা প্রকাশ করেছেন যে, ২০২০-এর মার্চ থেকে দেশের ৬৪৭ জন বিলিয়নারের নিট সম্পদ প্রায় ৯৬০ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। বৃদ্ধির এই হারে এ লেখা পাঠকের কাছে যাওয়া পর্যন্ত এ সম্পদ এক ট্রিলিয়ন ছাড়িয়ে যাওয়া স্বাভাবিক।”

ভারাওফ্যাকিসও একইভাবে কৌতুকভরে লিখেছেন:

‘মধ্য মার্চ থেকে আমেরিকার ৬১৪ জন বিলিয়নারের হতবুদ্ধিকর সম্পদ বৃদ্ধির কথাটা ভাবুন। যে বাড়তি ৯৩১ বিলিয়ন ডলার তারা জড়ো করেছে, তা ন্যূনতম কোনো উদ্ভাবন বা বুদ্ধিমত্তা থেকে প্রাপ্ত বাড়তি লাভের ফল নয়। বলতে গেলে তারা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ধনী থেকে আরও ধনী হয়েছে। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা বানিয়ে আর্থিক ব্যবস্থায় প্লাবন ঘটিয়েছে যা সম্পদের মূল্য বৃদ্ধি ও এভাবে বিলিয়নারদের সম্পদ আকাশছোঁয়া করেছে।’

এই অতিমারি সফলভাবে নিয়ন্ত্রণের কৃতিত্ব গিয়েছে সেসব দেশের ঘরে যাদের সরকার হয় কোনো সমাজতান্ত্রিক দল দ্বারা পরিচালিত অথবা সেসব বুর্জোয়া দল দ্বারা পরিচালিত যারা সবকিছু ব্যক্তিখাতে বেচে দিয়ে সরকারকে অস্তিত্বহীন করার ভুয়া ফতোয়া দিয়ে বেড়ায়নি। সফল দেশের মধ্যে আছে: চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি। দুর্দশাগ্রস্ত দেশগুলোর প্রতি সাহায্য ও সহমর্মিতার হাত নিয়ে যারা সবচেয়ে বেশি এগিয়ে এসেছে তারা হলো চীন ও কিউবা–আশ্চর্যজনকভাবে যে দুটি দেশই কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা শাসিত। অন্যদিকে তথাকথিত মুক্তবিশ্বের নেতা যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে সরে গিয়ে নিজেকে জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ জাতিবিদ্বেষী খোলসের মাঝে গুটিয়ে নিয়েছে।

এই অতিমারি সফলভাবে নিয়ন্ত্রণের কৃতিত্ব গিয়েছে সেসব দেশের ঘরে যাদের সরকার হয় কোনো সমাজতান্ত্রিক দল দ্বারা পরিচালিত অথবা সেসব বুর্জোয়া দল দ্বারা পরিচালিত যারা সবকিছু ব্যক্তিখাতে বেচে দিয়ে সরকারকে অস্তিত্বহীন করার ভুয়া ফতোয়া দিয়ে বেড়ায়নি।

এবারকার ও অতীতের অতিমারিগুলোর মাঝে একটা বড় পার্থক্য তৈরি করেছে চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিরাট অগ্রগতি। এ বছর করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কার হয়েছে মাত্র এক বছরের মধ্যে যেখানে কিনা অতীতে কোনো টিকা দশ বছরের আগে আবিষ্কার হয়নি। এত অল্প সময়ে টিকা আবিষ্কার চিকিৎসাবিজ্ঞানের অকল্পনীয় উন্নতির ফল। মানুষের চেষ্টার এই অনন্য সাফল্য সমাজতান্ত্রিক আদর্শগুলোকেই উচ্চে তুলে ধরে, যা হলো বৈশ্বিক সহযোগিতা, আন্তর্জাতিক ঐক্য, সরকারের ও রাষ্ট্রের শক্তিশালী ভূমিকা, মুনাফার পরিবর্তে জনকল্যাণের আদর্শ ইত্যাদি। পুঁজিবাদ যেসব আদর্শের বিপরীত প্রান্তে অবস্থান করে।

এত অল্প সময়ে এই টিকার আবিষ্কার কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন বা মুনাফাকেন্দ্রিক ব্যাবসাপ্রতিষ্ঠানের একক কৃতিত্ব নয়। এর পেছনে রয়েছে গবেষণার বৈশ্বিক সহযোগিতা ও আন্তর্জাতিকতার মনোভাব। একটি উদাহরণ দিলেই যথেষ্ট যে, প্রথম টিকা আবিষ্কারক ফাইজার-বায়োএনটেক পেয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তা আর এর নেতৃত্বে ছিলেন দুজন তুর্কি বংশোদ্ভূত জার্মান বিজ্ঞানী। অন্য ওষুধ কোম্পানিগুলোও নিজ নিজ সরকারের কাছ থেকে পেয়েছে আর্থিক প্রণোদনা ও নৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। সুতরাং এই টিকা আবিষ্কারের সফল গল্পের মঞ্চে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নায়কের ভূমিকায় দেখা গেলেও, পেছনে নাট্যকার, নির্দেশক ও অর্থযোগানদানকারীর ভূমিকায় আছে সরকার ও জনগণ।

প্রথম টিকা আবিষ্কারক ফাইজার-বায়োএনটেক পেয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তা আর এর নেতৃত্বে ছিলেন দুজন তুর্কি বংশোদ্ভূত জার্মান বিজ্ঞানী। অন্য ওষুধ কোম্পানিগুলোও নিজ নিজ সরকারের কাছ থেকে পেয়েছে আর্থিক প্রণোদনা ও নৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। সুতরাং এই টিকা আবিষ্কারের সফল গল্পের মঞ্চে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নায়কের ভূমিকায় দেখা গেলেও, পেছনে নাট্যকার, নির্দেশক ও অর্থযোগানদানকারীর ভূমিকায় আছে সরকার ও জনগণ।

লেই ফিলিপস লিখেছেন:

‘আমেরিকার ব্যক্তিমালিকানাধীন ওষুধ কোম্পানি ও এর অংশীদার জার্মান বায়োটেক সংস্থা যদিও প্রথম টিকা আবিষ্কারের কৃতিত্ব বহন করছে, এটি পুঁজিবাদের বিজয় নয়। সাফল্যের জন্য ফাইজার-বায়োএনটেক ও দ্বিতীয় স্থান লাভকারী মডার্নাসহ সম্মুখ কাতারের অন্যান্য সংস্থা দিনের পর দিন সরকারি অর্থসাহায্য এবং ২০২০-এর অনেক আগে থেকে সরকারি ও জনমালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে সম্পন্ন গবেষণার ফলাফল পেয়ে আসছে। আবার এ দুর্যোগের বছর এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পেয়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও টিকা তৈরির প্রক্রিয়ায় অর্থসাহায্য, ফাইজারের বেলায় লাখ  লাখ ডোজ টিকা কিনে নেওয়ার রাষ্ট্রীয় নিশ্চয়তা।’

একইভাবে উল্লিখিত নিবন্ধে ভারাওফ্যাকিস লিখেছেন: কোভিড-১৯ টিকার এত দ্রুত উন্নয়ন, পরীক্ষা, অনুমোদন ও প্রয়োগ এই সত্য প্রকাশ করে যে, ‘বিজ্ঞান রাষ্ট্রীয় সাহায্যের ওপর নির্ভর করে।’ দ্রুত মানুষের প্রয়োজন পূরণে মুক্তবাজারের ক্ষমতার যারা গুণগান করে তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন: ‘শতাব্দীর সবচেয়ে বড় অতিমারিতে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে যে কৌতুক করেছে, তাদেরকে উড়িয়ে দিয়েছে ও ভয় দেখিয়েছে–আমেরিকার সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞানবিরোধী সেই প্রেসিডেন্টের প্রশাসনই বিজ্ঞানীদের প্রতিবন্ধকতাহীন কাজের জন্য ১০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দিয়েছে।’

তবে ‘বিজ্ঞানের গৌরবজনক ভূমিকা, সহযোগিতা ও পরিকল্পিত অর্থনীতি’র ফলে এই টিকা আবিষ্কার ঘটলেও এর বিতরণ সম্পর্কে সতর্ক করে লেই ফিলিপস লিখেছেন: ‘জীবনরক্ষাকারী এই টিকা বিতরণে পুঁজিবাদের নির্মমতা ও অদক্ষতার ভয়ংকর দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।’

টিকা নিয়ে কাড়াকাড়িতে সমাজের ১ শতাংশ ও বিশ্বের ধনী রাষ্ট্রগুলো প্রথম কাতারে থেকে জয়লাভ করবে। অপেক্ষায় ও পিছিয়ে থাকবে সমাজের ৯৯ শতাংশ মানুষ এবং পিছিয়ে পড়া ও উন্নয়নশীল দেশগুলো যারা করোনাভাইরাসের আক্রমণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ও হবে। দেখা যাচ্ছে ‘বিজ্ঞানের গৌরবজনক ভূমিকা, সহযোগিতা ও পরিকল্পিত অর্থনীতি’ থেকে উৎপন্ন ফসলের সমবণ্টন হচ্ছে না। এই দুর্যোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো, মানবজাতিকে লুণ্ঠনবৃত্তিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ লাভ করতে হবে যা হচ্ছে আগামী দিনের সম্ভাব্য প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগের বিরুদ্ধে অন্যতম রক্ষাকবচ।

আলমগীর খান: সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি (ছোটকাগজ)

ই-মেইল: alamgirhkhan@gmail.com

তথ্যসূত্র:

১. https://lithub.com/noam-chomsky-what-history-shows-us-about-responding-to-coronavirus/

২. https://www.euractiv.com/section/economy-jobs/interview/chomsky-on-covid-19-the-latest-massive-failure-of-neoliberalism/

৩. Noam Chomsky: Fight the Class Struggle or Get it in the Neck, চমস্কির সাক্ষাৎকার, জ্যাকোবিন, ৩০ ডিসেম্বর ২০২০

৪. Yanis Varoufakis, The Seven Secrets of 2020, প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ২৮ ডিসেম্বর ২০২০

৫. Meagan Day, US Billionaires Have Increased Their Riches By $1 Trillion During the Pandemic, জ্যাকোবিন, ২৪ নভেম্বর ২০২০

৬. পূর্বোক্ত

৭. Leigh Phillips, Thank Socialism for the Vaccine. Blame Capitalism for Its Distribution., জ্যাকোবিন, ২২ ডিসেম্বর ২০২০

৮. পূর্বোক্ত

৯. পূর্বোক্ত

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *