রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: আশঙ্কা ও বিপদ
কল্লোল মোস্তফা
জেনারেল আইয়ুব খানের আমলে পরিকল্পিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের তোড়জোড় শুরু হয় ২০০৯ সালের পর। এর জন্য কোনো অর্থনৈতিক সমীক্ষা, পরিবেশ সমীক্ষা ইত্যাদি জনগণের কাছে উন্মোচিত করা হয়নি, হয়নি বিপুল আর্থিক দায় ও পারমাণবিক ঝুঁকি নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কোনো তর্ক-বিতর্ক। পারমাণবিক দুর্ঘটনার ঝুঁকি, শুকনা মৌসুমে পদ্মার পানি সংকট, পারমাণবিক দুর্ঘটনার দায় দায়িত্ব ও খেসারত, পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ঝুঁকি এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনীতির ওপর বিপুল পরিমাণ বিদেশি ঋণের চাপ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে রয়েছে নানা আশঙ্কা। এই লেখায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে সেসব আশঙ্কা ও বিপদের ঝুঁকির তথ্য ও যুক্তি পর্যালোচনা করা হয়েছে।
পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রথম পরিকল্পনা করা হয় পাকিস্তানি শাসন আমলে, ১৯৬১ সালের দিকে। সে সময় ছোট একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু নানা কারণে সে প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাশিয়ার সহযোগিতায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের তোড়জোড় শুরু হয়।১ এর মধ্যে ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মায় পানি কমেছে, রূপপুরে জনবসতি বেড়েছে, দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে নানান দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে পারমাণবিক বিদ্যুতের ঝুঁকি আরও স্পষ্ট হয়েছে; কিন্তু পাকিস্তান আমলের পরিকল্পনা আরও বড় আকারে স্বাধীন বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করার কাজ চলছে। এর জন্য কোনো অর্থনৈতিক সমীক্ষা, পরিবেশ সমীক্ষা ইত্যাদি জনগণের কাছে উন্মোচিত করা হয়নি, হয়নি বিপুল আর্থিক দায় ও পারমাণবিক ঝুঁকি নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কোনো তর্ক-বিতর্ক। এর মধ্যেই রাশিয়ার কারিগরি সহায়তা ও ঋণের অর্থে রূপপুরে ভিভিইআর-১২০০ মডেলের দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। পারমাণবিক দুর্ঘটনার ঝুঁকি, শুকনা মৌসুমে পদ্মার পানি সংকট, পারমাণবিক দুর্ঘটনার দায় দায়িত্ব ও খেসারত, পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ঝুঁকি এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনীতির ওপর বিপুল পরিমাণ বিদেশি ঋণের চাপ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে রয়েছে নানান আশঙ্কা। এখানে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে যেসব আশঙ্কা ও বিপদের ঝুঁকি রয়েছে, সে বিষয়ে আলোচনা করা হলো।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা ঝুঁকি
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে প্রথম এবং প্রধান আশঙ্কা হলো পারমাণবিক দুর্ঘটনার ঝুঁকি। এমনিতে পারমাণবিক প্রযুক্তি শতভাগ নিরাপদ কোনো প্রযুক্তি নয়, তার ওপর বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও পারমাণবিক প্রযুক্তিতে নিজস্ব সক্ষমতাহীন একটি দেশে স্রেফ আমদানি করে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার মানে হলো পারমাণবিক প্রযুক্তির স্বাভাবিক ঝুঁকির ওপর বাড়তি ঝুঁকি বাংলাদেশের জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া। চেরনোবিল, থ্রি মাইল আইল্যান্ড কিংবা সর্বশেষ ফুকুশিমার মতো বড় বড় দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে প্রযুক্তির দিক দিয়ে শীর্ষে অবস্থানকারী দেশগুলোয়, যারা নিজস্ব দক্ষতাকে কেন্দ্র করে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছিল। আর আমাদের মতো দেশে যেখানে কলকারখানা থেকে শুরু করে সড়ক মহাসড়ক সর্বত্র দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা প্রকট, সেখানে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল প্রযুক্তি মূলত বিদেশিদের ওপর নির্ভর করে পরিচালনা করা বাড়তি ঝুঁকি তৈরি করে।
বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও পারমাণবিক প্রযুক্তিতে নিজস্ব সক্ষমতাহীন একটি দেশে স্রেফ আমদানি করে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার মানে হলো পারমাণবিক প্রযুক্তির স্বাভাবিক ঝুঁকির ওপর বাড়তি ঝুঁকি বাংলাদেশের জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া।
বিষয়টি এরকম নয় যে, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না–সব পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালিনাকারী প্রতিষ্ঠান ও কর্তৃপক্ষই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে যেন কোনো ধরনের দুর্ঘটনা না-ঘটে তার জন্য নানারকম প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেও এরকম বহু ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যেমন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের পক্ষ থেকে ‘তেজস্ক্রিয়া থেকে প্রাণী ও পরিবেশের সুরক্ষা’ শীর্ষক প্রচারপত্রে বলা হয়েছে:
‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সর্বাধুনিক ডিজাইনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুরক্ষা ব্যবস্থাবিশিষ্ট জেনারেশন থ্রি প্লাস রিঅ্যাকটরসহ নির্মাণ করা হচ্ছে, যার ফলে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা একেবারে নেই বললেই চলে। এছাড়া পাঁচ স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা, তেজস্ক্রিয়তা যাতে কোনোক্রমেই (প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনা) বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্যানিটারি সুরক্ষা অঞ্চলের (৩০০ মিটার রেডিয়াস) বাইরে যেতে না পারে, তা নিশ্চিত করবে।’২
মুশকিল হলো, পারমাণবিক দুর্ঘটনার যে ইতিহাস, তাতে এরকম আশ্বাসে আশ্বস্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যেসব পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রেও এরকম অনেক ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থারই আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু সেসব নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাস্তব দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করতে পারেনি। দুর্ঘটনা ঘটার কারণে চেরনোবিল নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটরের ত্রুটির কথা আজ সবাই জানেন। কিন্তু একসময় এই চেরনোবিল রিঅ্যাকটরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার অনেক প্রশংসা করা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল ও ডিপার্টমেন্ট অব নিউক্লিয়ার সেফটি এনার্জির প্রধান বোরিস সেমেনভ চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে ভূয়সী প্রশংসা করে লিখেছিলেন:
‘এক হাজারেরও বেশি আলাদা প্রাইমারি সার্কিট থাকার কারণে এই নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটরের নিরাপত্তা বেড়েছে এবং কুলেন্ট বা শীতলীকরণের তরল হারিয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা বাস্তবিকই অসম্ভব।৩
কিন্তু আমরা জানি, চেরনোবিলে বাস্তবে দুনিয়ার ইতিহাসে মারাত্মকতম দুর্ঘটনা ঘটেছিল। এমনকি দুর্ঘটনা ঘটলে যেন দ্রুত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নিরাপদভাবে বন্ধ করা যায়, তার জন্য প্যাসিভ ও অ্যাকটিভ দুই ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও চেরনোবিল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ছিল:
‘প্যাসিভ সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত ছিল দুই সেট ট্যাংক, যেখানে ২০০ ঘনমিটার পানি থাকবে। দুর্ঘটনা ঘটার প্রথম তিন মিনিটের মধ্যে পুরো তাপ দূরীকরণের জন্য এই পরিমাণ পানিই যথেষ্ট ছিল। আর অ্যাকটিভ সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত ছিল ৫ সেট পাম্প, যেগুলোর কাজ হবে ট্যাংকের পানি শেষ হয়ে গেলে রিঅ্যাকটর কোরে পানি সরবরাহ করা। এই পাম্পগুলো চালানোর জন্য ব্যাকআপ হিসেবে ছিল ডিজেল জেনারেটর।’৪
তাহলে এই অ্যাকটিভ এবং প্যাসিভ শীতলীকরণ প্রক্রিয়া সময়মতো কাজ করল না কেন? কারণ, চেরনোবিল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সময় যে ধরনের দুর্ঘটনার কথা মাথায় রেখে এই অ্যাকটিভ এবং প্যাসিভ সিস্টেম ডিজাইন করা হয়েছিল, বাস্তবে দুর্ঘটনা ঘটে ভিন্ন ধরনের। ডিজাইনের সময় তারা বিবেচনা করেছিল, রিঅ্যাকটর কোরের তলা দিয়ে প্রবেশ করা পানির পাইপ ফাটার কথা। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটেছে কোরের উপরের দিকে। ফলে অ্যাকটিভ সিস্টেমের মাধ্যমে পানি কোরের গোড়ায় চালিত হলেও তেমন কাজে আসেনি। আর প্যাসিভ সিস্টেম কাজ করার আগেই রিঅ্যাকটরের তাপমাত্রা এত দ্রুত বেড়েছে এবং উচ্চ তাপমাত্রায় বাষ্পের সঙ্গে জিরকোনিয়ামের বিক্রিয়ায় উৎপন্ন হাইড্রোজেনের প্রেসার এত বেড়েছে যে, ইমার্জেন্সি সিস্টেম কাজ করে চ্যানেলের মধ্যে পানি প্রবেশের আগেই বিস্ফোরণ ঘটেছে।৫
ডিজাইনের সময় তারা বিবেচনা করেছিল, রিঅ্যাকটর কোরের তলা দিয়ে প্রবেশ করা পানির পাইপ ফাটার কথা। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটেছে কোরের উপরের দিকে। ফলে অ্যাকটিভ সিস্টেমের মাধ্যমে পানি কোরের গোড়ায় চালিত হলেও তেমন কাজে আসেনি।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুর্ঘটনার ঝুঁকির বিষয়টি বুঝতে হলে নিরাপত্তা ডিজাইনের এই সীমাবদ্ধতার বিষয়টি উপলব্ধি করা জরুরি। যে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থার ডিজাইন যখন করা হয় তখন কতগুলো সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করেই সেই ডিজাইন করা হয়। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে যদি এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, পরিস্থিতির কথা নিরাপত্তা ব্যবস্থা ডিজাইন করার সময় ভাবাই হয়নি, তাহলে দুর্ঘটনা ঘটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে যায়। পারমাণবিক প্রযুক্তির পক্ষে জনমত তৈরির জন্য যখন একে ‘আধুনিক-উন্নত-নিরাপদ’ প্রযুক্তি হিসেবে বিজ্ঞাপিত করা হয়, তখন এই সীমাবদ্ধতার বিষয়টি আড়াল করা হয়। কিন্তু যখন সেই ‘আধুনিক-উন্নত-নিরাপদ’ প্রযুক্তির পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তখন তার ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয়: পুরোনো মডেলের প্রযুক্তির কারণে সেই দুর্ঘটনা ঘটেছে, নতুন মডেলের বিদ্যুৎকেন্দ্রে পুরোনো মডেলের ত্রুটিগুলো সংশোধন করে ফেলায় নতুন মডেলের পারমাণবিক রিঅ্যাকটরে দুর্ঘটনা ঘটার আর কোনো আশঙ্কা নেই।
১৯৮৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে চেরনোবিল দুর্ঘটনার সময় বলা হয়েছিল, কনটেইনমেন্ট ডোমবিহীন ত্রুটিপূর্ণ ডিজাইনের রিঅ্যাকটরের কারণে যে দুর্ঘটনা চেরনোবিলে ঘটেছে, এর পর আর সেরকম দুর্ঘটনা ঘটবে না। কারণ, আধুনিক জেনারেশন-২-এর প্রযুক্তির পারমাণবিক রিঅ্যাকটর সেসব ত্রুটি থেকে মুক্ত। কিন্তু দেখা গেল, আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার সব প্রতিশ্রুতি ভুল প্রমাণিত করে ২০১১ সালে প্রযুক্তিগতভাবে সামনের সারিতে থাকা দেশ জাপানের ফুকুশিমায় ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটে গেল। জেনারেশন-২-এর পারমাণবিক রিঅ্যাকটরে এই দুর্ঘটনা ঘটার পর থেকে বলা হচ্ছে, জেনারেশন-৩-এর পারমাণবিক রিঅ্যাকটরের ডিজাইন আরও উন্নত ও ত্রুটিমুক্ত। ফলে জেনারেশন-৩ প্রযুক্তির পারমাণবিক রিঅ্যাকটর ব্যবহার করলে দুর্ঘটনা ঘটনার কোনো আশঙ্কা থাকবে না! আসলে পারমাণবিক রিঅ্যাকটর যখন কাগজে-কলমে থাকে, যখন পরীক্ষামূলক পর্যায়ে থাকে তখন নিরাপদই থাকে, দুর্ঘটনা ঘটার কোনো আশঙ্কাই তখন থাকে না। কারণ, তখন পর্যন্ত তাত্ত্বিকভাবে দুর্ঘটনা ঘটার যত ধরনের কারণ থাকতে পারে সেগুলো বিবেচনায় নিয়েই পারমাণবিক রিঅ্যাকটরের ডিজাইন করা হয়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এমন সব অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি তৈরি হয় যেগুলো ডিজাইন করার সময় হয়তো বিবেচনায় ছিল না কিংবা বিবেচনায় থাকলেও অপ্রত্যাশিত কারণে সেটা বাস্তবক্ষেত্রে কাজ করে না। ফলে প্রযুক্তিগতভাবে নিরাপদ রাখার শতচেষ্টার পরও দুর্ঘটনা ঘটে যায়।
১৯৮৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে চেরনোবিল দুর্ঘটনার সময় বলা হয়েছিল, কনটেইনমেন্ট ডোমবিহীন ত্রুটিপূর্ণ ডিজাইনের রিঅ্যাকটরের কারণে যে দুর্ঘটনা চেরনোবিলে ঘটেছে, এর পর আর সেরকম দুর্ঘটনা ঘটবে না। কারণ, আধুনিক জেনারেশন-২-এর প্রযুক্তির পারমাণবিক রিঅ্যাকটর সেসব ত্রুটি থেকে মুক্ত। কিন্তু দেখা গেল, আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার সব প্রতিশ্রুতি ভুল প্রমাণিত করে ২০১১ সালে প্রযুক্তিগতভাবে সামনের সারিতে থাকা দেশ জাপানের ফুকুশিমায় ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটে গেল।
আসলে শুধু পারমাণবিক প্রযুক্তিই না, কোনো প্রযুক্তিই শতভাগ নিরাপদ না। কিন্তু তারপরও আমরা সব প্রযুক্তির বিরোধিতা করি না, সাবধানতার কথা বলি। যেমন, গাড়ি বা বিমান দুর্ঘটনা ঘটে বলেই কিন্তু আমরা এর ব্যবহারের বিরোধিতা করছি না। কারণ, এতে কিছু মানুষের জীবন বিপন্ন হয়; কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতা করছি কারণ এটা এমন একটা প্রযুক্তি যা একবার ফেইল করলে একজন বা দুজন না, লক্ষ কোটি মানুষ তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয়ে কয়েক প্রজন্ম ধরে মারাত্মক সমস্যায় ভোগার ঝুঁকি থাকে। এমনকি দুর্ঘটনা না-ঘটলেও তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্তের ঝুঁকি থাকে কিংবা তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় মুশকিল থাকে।
গাড়ি বা বিমান দুর্ঘটনা ঘটে বলেই কিন্তু আমরা এর ব্যবহারের বিরোধিতা করছি না। কারণ, এতে কিছু মানুষের জীবন বিপন্ন হয়; কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতা করছি কারণ এটা এমন একটা প্রযুক্তি যা একবার ফেইল করলে একজন বা দুজন না, লক্ষ কোটি মানুষ তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয়ে কয়েক প্রজন্ম ধরে মারাত্মক সমস্যায় ভোগার ঝুঁকি থাকে। এমনকি দুর্ঘটনা না-ঘটলেও তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্তের ঝুঁকি থাকে কিংবা তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় মুশকিল থাকে।
নাইজেল হকস, জিওফ্রে লিন, ডেভিড লেই, রবিন ম্যাককে, পিটার প্রিঙ্গেল ও এন্ড্রু উইলসন তাদের ‘দ্য ওর্স্ট অ্যাক্সিডেন্ট ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ বইয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের এই অন্তর্নিহিত ঝুঁকির বিষয়টি চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন:
‘অন্য যে কোনো জটিল যন্ত্রপাতির মতো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও ফেইল করতে পারে। এবং এই ফেইল করার ঘটনা অনেক সময় এমন উপায়ে ঘটে যে উপায়ের কথা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডিজাইনাররা কখনো ভাবেনি। কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুতের মুখপাত্ররা কখনো এটা স্বীকার করতে চায় না। তারা নিশ্চিতভাবেই জানে যে, তাদের বানানো বিভিন্ন সাব-সিস্টেম ফেইল করতে পারে এবং ফেইল করেও। কিন্তু তারা এমন একটা ভান করে যে, এই জ্ঞান সাধারণের জন্য বিপজ্জনক।
প্রযুক্তির ইতিহাসই এরকম যে, প্রাথমিক পর্যায়ে নতুন যন্ত্রপাতি মারাত্মকভাবে ফেইল করে। আঠারো শতকে বাষ্পীয় ইঞ্জিন নিয়ে যারা কাজ করতেন তাদের অনেককেই বয়লার বিস্ফোরণের শিকার হতে হয়েছে। বাষ্পশক্তি কাজে লাগিয়ে রেল যোগাযোগ চালু হওয়ার পর লাইনচ্যুত হওয়া, এক্সেল ভেঙে যাওয়া, ব্রিজ ভাঙা, সিগন্যাল ব্যবস্থা কাজ না-করা ইত্যাদি কারণেও বহু মানুষকে একসময় জীবন দিতে হয়েছে। প্রকৌশলীরা এসব ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে রেলওয়েকে আজকের দুনিয়ার নিরাপদতম যোগাযোগ ব্যবস্থায় পরিণত করেছে। একই প্রক্রিয়া লক্ষ করা গেছে উনিশ শতকে উড়োজাহাজ এবং বিশ শতকে মহাকাশযান উন্নয়নের ক্ষেত্রেও। এ কথা বলাই যায়, যে প্রযুক্তির ইতিহাস দুর্ঘটনার ইতিহাস, বিপর্যয়ের ইতিহাস; সে দুর্ঘটনা ও বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষ আরও উন্নত ও নিরাপদ যন্ত্রপাতি তৈরি করেছে।
মুশকিল হলো, পারমাণবিক প্রযুক্তির বিপদটা এমন বড় মাত্রার যে, ভুলের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণের এই প্রচলিত পদ্ধতি এর জন্য মোটেই নিরাপদ নয়। পারমাণবিক বিপর্যয় ঘটলে সরাসরি এর সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষেরই শুধু বিপদ হয় এরকম না (উদাহরণস্বরূপ যেমনটা হয় কয়লা খনির দুর্ঘটনার বেলায়) সেইসঙ্গে এর ফলে বিপদে পড়ে এরকম হাজার হাজার মানুষ, যাদের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছে বসবাস করার। পারমাণবিক বিদ্যুৎ থেকে প্রাপ্ত সুবিধা আর ঝুঁকি হিসাব করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো ক্ষমতা থাকে না পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপদের আওতার মধ্যে বসবাস করা এসব মানুষের। এসব সিদ্ধান্তের ভার তাদের ছেড়ে দিতে হয় বিদ্যুৎ কোম্পানি, বিদ্যুৎ বিভাগ আর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের হাতে–যাদের স্বার্থ তাদের থেকে পুরোপুরি আলাদা এবং যাদের লাভক্ষতির হিসাবের দায় বহন করার মাত্রাও ভিন্নতর।’৬
ব্রিটেনের উইন্ডস্কেল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডিজাইনাররা নিশ্চিতভাবেই নানা ধরনের দুর্ঘটনার কথা চিন্তুা করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ডিজাইন করেছিলেন। কিন্তু ডিজাইনের সময় তাদের পক্ষে জানার উপায় ছিল না যে, ৮ অক্টোবর ১৯৫৭ সালে উইন্ডস্কেলের ১নং প্লুটোনিয়াম রিঅ্যাকটরের দায়িত্বে থাকা একজন পদার্থবিদ সাধারণ একটা রুটিন অপারেশনের সময় নির্ধারিত সময়ের আগেই একটা সুইচ অন করে দেবেন। ফলে সেই বিপদ মোকাবিলা করার মতো কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা ওই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছিল না, এমনকি ওই ঘটনার ৪২ ঘণ্টা পর ইউরেনিয়াম জ্বালানি ও গ্রাফাইটে আগুন লেগে এলার্ম বাজার আগপর্যন্ত এই বিপদের কথা কেউ জানতেও পারেনি। দুর্ঘটনায় চেরনোবিলের মতো মহাবিপর্যয় না ঘটার কারণ হলো, জন ককরোফট নামের এক বিজ্ঞানী কর্তৃক অন্য সবার মতামত উপেক্ষা করে বাড়তি খরচ করে কতগুলো ফিল্টার বসিয়েছিলেন।৭ বেশিরভাগ তেজস্ক্রিয় আইসোটেপ এই ফিল্টারেই আটকে থাকায় মহাবিপর্যয় ঘটেনি; কিন্তু তারপরও বিপুল পরিমাণ মারাত্মক তেজস্ক্রিয় প্লুটোনিয়াম আইরিশ সাগরে ঢেলে দেওয়া হয়। যে কারণে বিশ্বের অন্যতম তেজস্ক্রিয় সাগর হলো আইরিশ সাগর। যার তলদেশে ছড়িয়ে আছে তেজস্ক্রিয় প্লুটোনিয়াম এবং আরও আড়াই লাখ বছর থাকবে!৮
দুর্ঘটনায় চেরনোবিলের মতো মহাবিপর্যয় না ঘটার কারণ হলো, জন ককরোফট নামের এক বিজ্ঞানী কর্তৃক অন্য সবার মতামত উপেক্ষা করে বাড়তি খরচ করে কতগুলো ফিল্টার বসিয়েছিলেন।৭ বেশিরভাগ তেজস্ক্রিয় আইসোটেপ এই ফিল্টারেই আটকে থাকায় মহাবিপর্যয় ঘটেনি; কিন্তু তারপরও বিপুল পরিমাণ মারাত্মক তেজস্ক্রিয় প্লুটোনিয়াম আইরিশ সাগরে ঢেলে দেওয়া হয়। যে কারণে বিশ্বের অন্যতম তেজস্ক্রিয় সাগর হলো আইরিশ সাগর। যার তলদেশে ছড়িয়ে আছে তেজস্ক্রিয় প্লুটোনিয়াম এবং আরও আড়াই লাখ বছর থাকবে!
একইভাবে থ্রিমাইল আইল্যান্ডের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডিজাইনারদের পক্ষেও একটার পর একটা ম্যাকানিজম ফেইল করা এবং সেইসঙ্গে পরিচালনার ভুলের কথা মাথায় রেখে ডিজাইন করা সম্ভব হয়নি। ফলে দুর্ঘটনা ঘটার পর মার্কিন সরকারের ন্যাশনাল রেগুলেটরি কমিশনের (এনআরসি) চেয়ারম্যান জোসেফ হেনড্রিকে বলতে হয়:
‘আমাদেরকে প্রায় অন্ধের মতো কাজ করতে হচ্ছে। সরকারের তথ্য পরিষ্কার নয়, আমার হাতে কী ঘটেছে তার কোনো তথ্যই নেই। আমি জানি না, এটা অনেকটা একদল অন্ধ লোক মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো মনে হচ্ছে।’৯
এনআরসির আরেকজন শীর্ষ কর্মকর্তার বক্তব্য ছিল এরকম:
‘এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, যে দুর্ঘটনার কথা মাথায় রেখে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডিজাইন করা হয়নি। খুব কম করে যদি বলি, পরিস্থতি ধীরে ধীরে খারাপের দিকে যাচ্ছে… আমাদের উচিত দ্রুত লোকজনকে আশপাশ থেকে সরিয়ে নেওয়া। আমি জানি না, লোকজনকে এখান থেকে এখনো সরিয়ে না নিয়ে তোমরা কী রক্ষা করতে চাচ্ছ।’১০
আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষে জনমত তৈরির জন্য ‘আধুনিক-উন্নত-নিরাপদ’ প্রযুক্তির কথা বলে এমন একটা ধোঁয়াশা তৈরি করা হয় যে, এসব ‘আধুনিক-উন্নত-নিরাপদ’ প্রযুক্তির পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও যে অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ কতগুলো ভাল্ব, বিয়ারিং, পাইপলাইন, বৈদ্যুতিক তার, পাম্প, সেন্সর ইত্যাদির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করে এবং সামান্য অবহেলা ও অব্যবস্থাপনাও যে মারাত্মক সব বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে–এই বাস্তবতাগুলো আড়ালে পড়ে যায়। বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য, বাংলাদেশের পরমাণু নিরাপত্তায় কারিগরি সহযোগিতা প্রদানে চুক্তিবদ্ধ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা পরিস্থিতির কিছু অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করা যাক। এ জন্য ইকনোমিক ও পলিটিক্যাল উইকলিতে প্রকাশিত এমভি রামানা ও আশ্বিন কুমার-এর লেখা ‘Safety First? Kaiga and Other Nuclear Stories’ শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধের সহায়তা নেওয়া হবে।১১
১৯৯৪ সালের ১৩ মে ভারতের কাইগা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজ চলার সময় রিঅ্যাকটরের ইনার কনটেইনমেন্ট ডোমটি ভেঙে পড়ে। এ সময় ১৩ মিটার উঁচু থেকে ১৩০ টন ওজনের কংক্রিট ধসে পড়ে, ফলে ১৪ জন শ্রমিক আহত হয়। কনটেইনমেন্ট ডোমটি তৈরি সম্পন্ন হয়ে গেলেও সে সময় ‘ক্যাবল’ সংযোগসহ অন্যান্য কাজ চলছিল। ধসের কারণ হিসেবে দুটি সমস্যা চিহ্নিত হয়। এগুলো হলো: ত্রুটিপূর্ণ নকশা ও নির্মাণকালে যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণের অভাব: আলাদাভাবে সিমেন্ট এবং স্টিলের গুণগত মান পরীক্ষা করা হলেও এ থেকে নির্মিত কংক্রিট ব্লকগুলোর মানের কোনো পরীক্ষা করা হয়নি। নকশার ত্রুটি ধরা না পড়ার কারণ হলো, নিউক্লিয়ার পাওয়ার কোম্পানির (এনপিসি) সিনিয়র সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এবং ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমিক এনার্জি (ডিএই)-কে নকশা ও ড্রইং সরবরাহকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটির মধ্যে ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এরকম ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে এনপিসির প্রকৌশলীরা নকশাটি কাইগা প্রকল্প বাস্তবায়নকারীদের হাতে তুলে দেওয়ার আগে যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেননি। অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি বোর্ড (এইআরবি) ও এই নকশা যাচাই করেনি। কারণ, যাচাই করার মতো কোনো প্রকৌশলী এইআরবির ছিল না!
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইতিহাসে কাইগা ডোম ধস অভূতপূর্ব একটি ঘটনা। এই ঘটনাটি থেকে দেখা যায়, খোদ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিজেই অনেক ক্ষেত্রে বিপদের কারণ হয়ে যেতে পারে। কনটেইনমেন্ট ডোম তৈরির কারণ হলো, যদি কোনো কারণে চুল্লির সব নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যর্থ হয় এবং তার ফলে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যায়, সেক্ষেত্রে শক্তিশালী কনটেইনমেন্ট ডোমটি দুর্ঘটনা উদ্ভূত সব চাপ সহ্য করবে এবং ‘রিঅ্যাকটর কোর’ থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয় পদার্থ ধরে (কনটেইন) রাখবে। ফলে আপাতদৃষ্টিতে এর মাধ্যমে নিরাপত্তা আরও জোরদার হয় বলেই মনে হতে পারে। কিন্তু এই ধসটি যদি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু থাকা অবস্থায় ঘটত, তাহলে প্রায় ১৩ মিটার উঁচু থেকে পড়া ১৩০ টন কংক্রিটের কারণে ডোমের নিচে থাকা স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ রডগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ত। এর ফলে চুল্লি নিরাপদে বন্ধ করা কঠিন হয়ে যেত। কংক্রিটের বিপুল ওজনের কারণে শীতলীকরণ পাম্প ও পাইপলাইন ধ্বংস হতে পারত, যার ফলে শীতলীকরণ উপাদান হারাতে পারত কেন্দ্রটি। ফলস্বরূপ নিউক্লিয়ার ‘কোর’ গলে গিয়ে পরিবেশে বিপুল পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে যেতে পারত। সৌভাগ্যক্রমে দুর্ঘটনার সময় চুল্লির নির্মাণকাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি এবং চুল্লির ‘কোর’-এ কোনো জ্বালানিও ছিল না।
ভারতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনাটি ঘটে ১৯৯৩ সালের ৩১ মার্চ। ওইদিন ভোরে নারোরা বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের টারবাইনের দুটো ব্লেড ভেঙে যায়। ভাঙা ব্লেডগুলো অন্য ব্লেডের ভেতর ঢুকে গিয়ে টারবাইনকে অস্থিতিশীল করে তোলে এবং অত্যধিক কম্পন সৃষ্টি করে। এই কম্পনের কারণে টারবাইন শীতলীকরণের কাজে ব্যবহৃত হাইড্রোজেন গ্যাসের পাইপলাইন ফেটে যায়। ফলে হাইড্রোজেন গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে আগুন ধরে যায়। প্রায় একই সময়ে লুব্রিকেন্ট তেলও লিক হয়ে যায়। আগুন এই তেলেও লাগে এবং গোটা টারবাইন ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। আগুনের কারণে চার সেট বৈদ্যুতিক তারই নষ্ট হয়ে যায় এবং গোটা কেন্দ্রটি বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে। বৈদ্যুতিক তার নষ্ট হওয়ার কারণে শীতলীকরণ প্রক্রিয়াও বন্ধ হয়ে যায়। সেইসঙ্গে নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রও ধোঁয়ায় পূর্ণ হয়ে যায় এবং কর্মীরা ব্লেড নষ্ট হওয়ার ১০ মিনিটের মাথায় নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য হন।
ভারতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনাটি ঘটে ১৯৯৩ সালের ৩১ মার্চ। ওইদিন ভোরে নারোরা বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের টারবাইনের দুটো ব্লেড ভেঙে যায়। ভাঙা ব্লেডগুলো অন্য ব্লেডের ভেতর ঢুকে গিয়ে টারবাইনকে অস্থিতিশীল করে তোলে এবং অত্যধিক কম্পন সৃষ্টি করে। এই কম্পনের কারণে টারবাইন শীতলীকরণের কাজে ব্যবহৃত হাইড্রোজেন গ্যাসের পাইপলাইন ফেটে যায়। ফলে হাইড্রোজেন গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে আগুন ধরে যায়। প্রায় একই সময়ে লুব্রিকেন্ট তেলও লিক হয়ে যায়। আগুন এই তেলেও লাগে এবং গোটা টারবাইন ভবনে ছড়িয়ে পড়ে।
অপারেটররা দুর্ঘটনার ৩৯ সেকেন্ডের মাথায় ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ‘প্রাইমারি শাটডাওন সিস্টেম’ কার্যকর করেন। এতে চুল্লিটি প্রাথমিকভাবে বন্ধ হলেও, পুনরায় চালু হয়ে যাওয়ার ভয়ে কয়েকজন ভবনের ছাদে উঠে ব্যাটারিচালিত আলোর মধ্যে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ভাল্ব খুলে চুল্লির জ্বালানিতে তরল বোরন মিশিয়ে দেয় যেন পারমাণবিক বিক্রিয়ার গতি কমে যায়। এই কাজটি করতে হয়েছিল কারণ চুল্লিটি প্রাথমিকভাবে বন্ধ হলেও তাপ উৎপাদন বন্ধ হয়নি। চুল্লির ফুয়েল রড বা জ্বালানি দণ্ডগুলোয় ফিশন প্রক্রিয়ায় ইউরেনিয়াম পরমাণু বিভাজিত হয়ে উৎপন্ন উপাদানগুলো তেজস্ক্রিয় বিক্রিয়ার মাধ্যমে তাপ উদ্গিরণ করতে থাকে। চুল্লি চালু থাকার সময়ের তুলনায় এই তাপ (ডিকে হিট) উৎপন্ন হওয়ার হার যথেষ্ট কম হলেও চুল্লি পুরো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও তাপ উৎপন্ন হওয়া চলতে থাকে। দ্রুত অপসারণ করা না-হলে এই তাপের মাধ্যমে চুল্লির জ্বালানি পুনরায় উত্তপ্ত হয়ে গলে যেতে পারে। কাজেই চুল্লি বন্ধ করার পরও শীতলীকরণ প্রক্রিয়া চালু রাখতে হয়। এই কাজটি সম্পন্ন করতে অপারেটরদের অগ্নিনির্বাপণের পানি সঞ্চালনের জন্য রাখা ডিজেল জেনারেটর চালু করতে হয়েছিল। বিদ্যুৎ সংযোগ এবং চুল্লির নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুরোপুরি চালু করতে ১৭ ঘণ্টার মতো সময় লাগে। ধোঁয়ার কারণে যেসব কর্মী নিয়ন্ত্রণকক্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, ১৩ ঘণ্টা পর তারা সেখানে প্রবেশ করতে পারেন। জরুরি নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে কেন্দ্রটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের একটি চেষ্টাও করা হয়েছিল; কিন্তু বিদ্যুৎ না-থাকায় জরুরি নিয়ন্ত্রণ কক্ষের প্রথম কন্ট্রোল ইউনিটটি ব্যবহার করা যায়নি। অর্থাৎ, নারোরা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এদিক থেকে অনেকটা ব্যতিক্রম যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অপারেটরদের কোনো ধারণাই ছিল না, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ‘অন্ধের মতো চলছিল’।
বর্তমান আলোচনার জন্য এই দুর্ঘটনাটির কার্যকারণ বিশ্লেষণ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই দুর্ঘটনাটি আগেই প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল।
প্রথমত, টারবাইন ব্লেড বা পাখা নষ্ট হওয়ার ঘটনাটি এড়ানো যেত। ১৯৮৯ সালে জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানি টারবাইন নির্মাতা ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যালস লিমিটেডকে (বিএইচইএল) নকশার একটি ত্রুটি সম্পর্কে জানায়। এই ত্রুটির কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের টারবাইনের ব্লেডে ফাটল ধরেছিল। জেনারেল ইলেকট্রিক নকশা পরিবর্তনের কিছু সুপারিশ করেছিল, যে সুপারিশ অনুযায়ী বিএইচইএল এনপিসির জন্য নতুন করে বিস্তারিত নকশা তৈরি করে ব্লেডগুলো পালটে ফেলার পরামর্শ দেয়। কিন্তু এনপিসি সময়মতো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
দ্বিতীয়ত, এমনকি পরিবর্তন করার পরও যদি টারবাইনের ব্লেডগুলো কোনো কারণে নষ্ট হতো, তারপরও দুর্ঘটনা এড়ানো যেত যদি নিরাপত্তাব্যবস্থা সঠিকভাবে কাজ করত। আর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিকঠাক কাজ করত যদি বৈদ্যুতিক তারের সংযোগ পৃথকভাবে কোনো অগ্নিরোধক পাইপের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। নারোরা চুল্লি যে সময়টায় চালু হয় তার আগেই সারা দুনিয়ার নিউক্লিয়ার ডিজাইনারদের মধ্যে এই নিয়মটি প্রথায় পরিণত হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন্স ফেরি দুর্ঘটনার পর থেকেই সবাই এ ব্যাপারটি মেনে চলেন। অগ্নিপ্রতিরোধের জন্য বৈদ্যুতিক ও অন্যান্য কাঠামোগত নকশা পরিবর্তন করা হয়, বিকল্প ব্যবস্থা রাখা হয়। ১৯৮৯ সালে নারোরা কেন্দ্র চালু হওয়ার আগেই এসব ঘটনা ঘটে। তা সত্ত্বেও নারোরা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারটি বিকল্প বিদ্যুৎ সংযোগই একই পাইপের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় যার চারপাশে কোনো অগ্নিনিরোধক আবরণ ছিল না এবং বৈদ্যুতিক তারগুলোকে পরস্পর থেকে আলাদা রাখারও কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
তৃতীয়ত, ডিএইর বিভিন্ন চুল্লিতে এর আগে বিভিন্ন সময় আগুন লাগার ঘটনা ঘটার পরও ডিএইএ এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ১৯৮৫ সালে আরএপিএস-২ কেন্দ্রটির একটি ‘ওভারহেড কেবল’ সংযোগে আগুন লেগে পুরো ‘কেবল ট্রে’-তে ছড়িয়ে যায় এবং চারটি পাম্প বিকল করে দেয়। এর কয়েক বছর পর ১৯৯৯ সালে ওই একই ইউনিটের বয়লার রুমে এবং আরএপিএস-১ ইউনিটের ‘টারবো জেনারেটর অয়েল সিস্টেমে’ আগুন লাগে ।
দুর্ঘটনার কারণগুলো নারোরা দুর্ঘটনা ঘটার আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। ভারতীয় চুল্লির ‘টারবাইন বিয়ারিং’-এ মাত্রাতিরিক্ত কম্পন কোনো নতুন ঘটনা নয়। ১৯৮১ সালে আরএপিএস-২ বিদ্যুৎকেন্দ্রের টারবাইন ভবনে তেল চুইয়ে পড়ার ঘটনা থেকে ‘জেনারেটর এক্সাইটরে’ উঁচু মাত্রায় স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টির ঘটনায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দু-দুবার বন্ধ করতে হয়েছিল। পুনরায় চালু করার পর দেখা গেল, ‘টারবাইন গভর্নিং সিস্টেম’ থেকে ব্যাপক পরিমাণে তেল চুইয়ে পড়ছে। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আবারও বন্ধ করতে হয়েছিল। ১৯৮২ সালের শুরুর দিকে তৃতীয়বার চালু করার পরই শুধু টারবাইন বিয়ারিং-এ উঁচুমাত্রার কম্পন ও ব্লেড বিকল হওয়ার ঘটনাটি ধরা পড়ে। এর ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে বন্ধ থাকে; এমনকি সমস্যাটি সমাধানের পর টারবাইন বিয়ারিং-এর বাড়তি তাপমাত্রার কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আবারো বন্ধ করে দিতে হয়। আবারও ১৯৮৩ সালে টারবাইন বিয়ারিং-এ উঁচু মাত্রার কম্পন ধরা পড়ে এবং দেখা যায় উচ্চচাপ রোটরের দ্বিতীয় স্তরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টারবাইন জেনারেটরের উঁচু কম্পন সমস্যার কারণে ১৯৮৫ সালে মাদ্রাজ অ্যাটমিক পাওয়ার স্টেশনের প্রথম ইউনিটটি (এমএপিএস-১) বারবার বন্ধ করতে হয়। একই কারণে আরএপিএস-১ কেন্দ্রটি ১৯৮৫, ১৯৮৯ এবং ১৯৯০ সালে বন্ধ করতে হয়। ডিএই এসব অভিজ্ঞতা থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনি। এসব অবহেলাও নারোরা দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ছিল।
কাজেই নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রের আধুনিক-উন্নত-নিরাপদ প্রযুক্তি অলৌকিক জাদুমন্ত্রের মতো কোনো বিষয় নয় যে, তা সব ধরনের পরিস্থিতিতে সব সময় তা সঠিকভাবে কাজ করবে। নিরাপত্তাব্যবস্থা বাস্তবায়ন ও তদারকিতে সমস্যা থাকলে, নিরাপত্তাব্যবস্থায় ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ সঠিকভাবে কাজ না-করলে ও সময়মতো সেগুলো শনাক্ত করা না-গেলে, নিরাপত্তাব্যবস্থা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি দুর্বল থাকলে, নিরাপত্তাব্যবস্থা নকশা করার সময় ভাবা হয়নি–এরকম কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটলে আর যে কোনো প্রযুক্তির মতো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রেও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আর ঠিক এ কারণেই বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে–সড়ক-নৌ-রেলপথে, কর্মস্থলে, আগুনে পুড়ে, রাসায়নিক বিস্ফোরণে নানাভাবে মানুষ নিহত ও জখম হয়, প্রাণ-প্রকৃতি বিপন্ন হয়; কিন্তু সেসব দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করার জন্য দুর্ঘটনার বিভিন্ন পূর্বশর্ত ও অন্তর্নিহিত কার্যকারণ শনাক্ত করে তা দূর করার কোনো কার্যকর সংস্কৃতি দেখা যায় না, সেখানে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো অন্তর্নিহিতভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ একটি প্রযুক্তি স্থাপন মারাত্মক বিপজ্জনক।
শীতলীকরণের জন্য পদ্মা নদীর পানি ব্যবহারের বিপদ
অন্যান্য তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের মতোই পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রেও শীতলীরণের জন্য পানির ভূমিকা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অন্যান্য তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটা বড় পার্থক্য হলো, প্রচলিত তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিলেই সেখানে তাপ উৎপন্ন হওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বন্ধ করার পরও দীর্ঘদিন ধরে তাপ উৎপন্ন হতে থাকে। কাজেই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু থাকা অবস্থায় তো বটেই; এমনকি বন্ধ করার পরও রিঅ্যাকটর ঠান্ডা করার ব্যবস্থা চালু রাখতে হয়। উজানে বাঁধের কারণে শুকনো মৌসুমে পানির সংকটের বাস্তবতায় পদ্মা নদীর পানির ওপর নির্ভর করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের প্রশ্নের মুখে বিকল্প হিসেবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নকশায় কুলিং টাওয়ার যোগ করা হয়। কুলিং টাওয়ার ব্যবহার করে ক্লোজ লুপ কুলিং-এর মাধ্যমে শীতলীকরণের জন্য সার্বক্ষণিকভাবে নদী থেকে তুলনামূলক কম পরিমাণ পানি (মেকআপ ওয়াটার) তুলতে হলেও আশঙ্কা পুরোপুরি দূর হয়নি। পদ্মা নদীর পানি ব্যবহার করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার বিপদ সম্পর্কে প্রকৌশলী কেএম মাহবুবুর রহমান ডেইলি স্টারে ‘Cooling water requirement for Rooppur nuclear power plant’ শীর্ষক লেখায় বলেছেন:
২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের কুলিং টাওয়ারের কনডেন্সার সিস্টেমে সার্কুলেশনের জন্য সব সময় পানি থাকা লাগবে ৪ লাখ ৫৫ হাজার গ্যালন পার মিনিট বা জিপিএম বা ১০১৪ কিউবিক ফুট পার সেকেন্ড (কিউসেক)। ক্লোজ লুপ কুলিং-এ একবার এই পরিমাণ পানি নদী থেকে উত্তোলন করে ক্লোজ লুপে ঢোকানোর পর, যেটুকু পানি বাষ্পীভবনসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় লস হবে সেটুকু পানি (মেকআপ ওয়াটার) শুধু নদী থেকে প্রতিনিয়ত সংগ্রহ করতে হবে। ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এই মেকআপ ওয়াটারের পরিমাণ ৫০ হাজার ৬৫০ গ্যালন পার মিনিট (জিপিএম) বা ১১৫ কিউবিক ফুট পার সেকেন্ড (কিউসেক)।
এছাড়া ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি (সার্ভিস ইকুইপমেন্ট) ঠান্ডা করার জন্য নদী থেকে সরাসরি প্রতিনিয়ত ১ লাখ ৪ হাজার গ্যালন পার মিনিট (জিপিএম) বা ২৩০ কিউসেক পানি উত্তোলন করতে হবে। ফলে ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের কুলিং টাওয়ারের মেকআপ ওয়াটার আর সার্ভিস কুলিং ওয়াটার মিলে পদ্মা নদী থেকে সর্বক্ষণ পানি তুলতে হবে ১১৫+২৩০= ৩৪৫ কিউসেক বা ১৫৫ হাজার জিপিএম।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১২ বছরের পানিপ্রবাহের তথ্য থেকে দেখা যায়, পদ্মা নদীতে গড় ন্যূনতম পানিপ্রবাহ ২২ হাজার ৩০০ কিউসেক। ফলে ২২ হাজার ৩০০ কিউসেক থেকে ৩৪৫ কিউসেক পানি তোলায় সাধারণভাবে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্তু মুশকিল হলো, গড় ন্যূনতম প্রবাহ ২২ হাজার ৩০০ কিউসেক হলেও অনেক সময় পানিপ্রবাহ হঠাৎ করে এই গড়ের চেয়ে অনেক কমে যায়। যেমন, ২০১১ সালের মে মাসে পানিপ্রবাহ ৩ হাজার ১০০ কিউসেক হয়ে গিয়েছিল। পানিপ্রবাহ যদি ভবিষ্যতে ৩ হাজার ১০০ কিউসেক বা তার চেয়ে কমে যায়, তখন পদ্মা নদী থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৩৪৫ কিউসেক পানি উত্তোলন করা কঠিন হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রকৌশলী কেএম মাহবুবুর রহমান।১২
তাছাড়া কুলিং টাওয়ার করে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের শীতলীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় পানির দৈনন্দিন চাহিদা মেটানো সম্ভব হলেও কোনো দুর্ঘটনায় যদি বাড়তি পানি প্রয়োজন হয় তখন শুকনো মৌসুমে তা সরবরাহ করা কঠিন হয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি-বেসরকারি চারটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও স্থাপনায় ৩০ বছরের বেশি কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম প্রথম আলো আয়োজিত ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প: স্বপ্ন ও বাস্তবতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ বিষয়ে বলেন,
‘পত্রিকায় পড়লাম যে, রূপপুরে রাশিয়ানরা ‘কুলিং টাওয়ার’ করবে। তাতে কম পানিতেই চলবে। এ কথাটা সঠিক নয়। কুলিং টাওয়ার তো অপারেশনাল পিরিয়ডে রিঅ্যাকটর ঠান্ডা রাখবে। কিন্তু দুর্ঘটনার মতো কোনো জরুরি প্রয়োজনে পানি আসবে কোত্থেকে? এ জন্য তাহলে লেক করতে হবে। পদ্মা থেকে ১২ মাস প্রয়োজনীয় পানির নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে না।’১৩
পারমাণবিক দুর্ঘটনার দায়মুক্তি
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কোম্পানি ও তার কর্মকর্তা/পরিচালকদের সম্ভাব্য সব ক্ষতি ও ব্যয়ের জন্য দায়মুক্তি দিয়ে ‘পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আইন, ২০১৫’ প্রণয়ন করা হয়েছে! সেই আইনের ধারা ২৬(১)-এ বলা হয়েছে:
‘কোম্পানী কর্তৃক, বা ইহার চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রকল্প পরিচালক বা অন্য কোনো পরিচালক কর্তৃক সরল বিশ্বাসে তাহার কর্তব্য পালনকালীন কৃত সব ক্ষতি এবং ব্যয়ের জন্য চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রকল্প পরিচালক ও অন্যান্য পরিচালকগণ কোম্পানি, বা ক্ষেত্রমতো, সরকার কর্তৃক দায়মুক্তি পাইবে, যদি-না উক্ত ক্ষতি বা ব্যয় তাহাদের ইচ্ছাকৃত কার্য বা অবহেলার কারণে সংঘটিত হইয়া না থাকে।’
এবং ধারা ২৮-এ বলা হয়েছে:
‘এই অধ্যাদেশ জারির পূর্বে বা পরবর্তী সময়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনার বিষয়ে সরল বিশ্বাসে কৃত কোনো কাজকর্মের জন্য সরকার, চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রকল্প পরিচালক, অন্য কোনো পরিচালক, পরামর্শক, উপদেষ্টা, কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো আইনগত কার্যক্রম গ্রহণ করা যাইবে না।’১৪
অর্থাৎ ধারা ২৬(১) অনুসারে, কোম্পানি ও তার পরিচালকরা যদি ‘সরল বিশ্বাসে’ কোনো কাজ করে এবং ‘ইচ্ছাকৃত কার্য বা অবহেলা’ না করে তাহলে তাদেরকে সরকার দায়মুক্তি দেবে এবং ধারা ২৮ অনুসারে ‘সরল বিশ্বাসে’ করা কোনো কাজের জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না! পারমাণবিক বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জন্য এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ। তার ওপর যদি এভাবে ‘সরল বিশ্বাসের’ ওপর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তার ভার ছেড়ে দেওয়া হয়, দায়মুক্তির ব্যবস্থা রেখে দেওয়া হয়, তাহলে দুর্ঘটনা ও দুর্নীতির ঝুঁকি আরও বাড়ে।
ধারা ২৬(১) অনুসারে, কোম্পানি ও তার পরিচালকরা যদি ‘সরল বিশ্বাসে’ কোনো কাজ করে এবং ‘ইচ্ছাকৃত কার্য বা অবহেলা’ না করে তাহলে তাদেরকে সরকার দায়মুক্তি দেবে এবং ধারা ২৮ অনুসারে ‘সরল বিশ্বাসে’ করা কোনো কাজের জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না! পারমাণবিক বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জন্য এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ। তার ওপর যদি এভাবে ‘সরল বিশ্বাসের’ ওপর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তার ভার ছেড়ে দেওয়া হয়, দায়মুক্তির ব্যবস্থা রেখে দেওয়া হয়, তাহলে দুর্ঘটনা ও দুর্নীতির ঝুঁকি আরও বাড়ে।
এছাড়া দুর্ঘটনার দায় নিয়ে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে যে অস্পষ্টতা রয়েছে, সে বিষয়ে পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আবদুল মতিন বলেন:
‘আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছি। কিন্তু কেউ কোনো কর্ণপাত করেনি। সেটা হচ্ছে ‘থার্ড পার্টি লায়াবিলিটি’। পারমাণবিক রিঅ্যাকটরে চেরনোবিল বা ফুকুশিমার মতো একটা দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় কে নেবে। এখন যে প্রটোকল আছে–জয়েন্ট প্রটোকল, সে অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের যে স্বত্বাধিকারী দায় তার, দোষ-ত্রুটি যারই হোক না কেন। আমরা এই প্রটোকলে আছি।
কিন্তু ভারত ২০১০ সালে একটি আইন পাস করেছে। সেখানে বলা হয়েছে: যদি সরবরাহকারীর কোনো যন্ত্রপাতির নিম্নমান বা অন্য কোনো ত্রুটি দুর্ঘটনার কারণ হয়, তাহলে তার দায় সরবরাহকারীকেও নিতে হবে। রাশিয়া কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই আইন মেনেই চুক্তি সই করেছে।’১৫
এটা ভয়ংকর বিপজ্জনক একটি বিষয়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি তৈরি করছে রাশিয়ার প্রতিষ্ঠান, সেই যন্ত্রপাতি স্থাপন করে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনা করবে রাশিয়ার প্রতিষ্ঠান, তাহলে দুর্ঘটনার দায় কেন রাশিয়া বা রাশিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো নেবে না? রাশিয়ার প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ ও পরিচালনার ফলে দুর্ঘটনার দায় যদি বাংলাদেশকে নিতে হয়, তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই রাশিয়ার দিক থেকে অবহেলার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি তৈরি করছে রাশিয়ার প্রতিষ্ঠান, সেই যন্ত্রপাতি স্থাপন করে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনা করবে রাশিয়ার প্রতিষ্ঠান, তাহলে দুর্ঘটনার দায় কেন রাশিয়া বা রাশিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো নেবে না? রাশিয়ার প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ ও পরিচালনার ফলে দুর্ঘটনার দায় যদি বাংলাদেশকে নিতে হয়, তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই রাশিয়ার দিক থেকে অবহেলার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ঝুঁকি
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার একটি বড় সমস্যা হলো তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। এই বিষয়ে আশ্বস্ত করার জন্য বাংলাদেশ সরকার শুরু থেকেই বলে আসছে যে, রাশিয়া পারমাণবিক বর্জ্য সে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, ফলে তা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।১৬ কিন্তু বাস্তবে রাশিয়া পারমাণবিক বর্জ্য আদৌ ফেরত নেবে কি না, এবং নিলে কোন ধরনের বর্জ্য ফেরত নেবে তা নিয়ে নানান অনিশ্চয়তার মধ্যে গত ৩০ আগস্ট ২০১৭ তারিখে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে স্বাক্ষরিত আন্তঃসরকার চুক্তি (IGA) অনুসারে রাশিয়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পারমাণবিক বর্জ্য Spent Nuclear Fuel ফেরত নিয়ে যাবে। এই চুক্তি সম্পর্কে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রেস বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, রাশিয়া এই পারমাণবিক বর্জ্য ফেরত নেওয়ার পর পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ এবং পুনঃপ্রক্রিয়াজাত পদার্থের ব্যবস্থাপনাসহ বর্জ্য সংরক্ষণ করবে।১৭ কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপন্ন পারমাণবিক বর্জ্য বলতে শুধু Spent Nuclear Fuel বা পারমাণবিক জ্বালানি বর্জ্যই বোঝায় না। স্পেন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েল মূলত উঁচুমাত্রার তেজস্ক্রিয়তার পারমাণবিক বর্জ্য, যা ছাড়াও নিচু ও মাঝারি তেজস্ক্রিয়তার কঠিন ও তরল পারমাণবিক বর্জ্য তৈরি হয়। পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আওতায় এই নিচু ও মাঝারি তেজস্ক্রিয়তার বর্জ্যও পড়ে। রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি অনুসারে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে রাশিয়া স্পেন্ট ফুয়েল ফেরত নেবে; কিন্তু নিচু ও মাঝারি মানের তেজস্ক্রিয়তাসম্পন্ন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কী হবে সেটা স্পষ্ট নয়। একটি ভিভিইআর-১২০০ মডেলের রিঅ্যাকটর থেকে বছরে ২০–৩০ টন স্পেন্ট ফুয়েল বা উঁচুমাত্রার তেজস্ক্রিয় বর্জ্য তৈরি হয়। উঁচুমাত্রার তেজস্ক্রিয় বিকিরণে এই স্পেন্ট ফুয়েলের তাপমাত্রা অত্যধিক থাকার কারণে স্পেন্ট ফুয়েল পরিবহণ করার আগে ৩–১০ বছর রিঅ্যাকটর পার্শ্ববর্তী স্পেন্ট ফুয়েল পুলে ঠান্ডা করতে হয় যার জন্য ক্রমাগত শীতলীকরণের প্রয়োজন হয়।১৮ ফলে রাশিয়া সে দেশে স্পেন্ট ফুয়েল নিয়ে যাওয়ার আগে বাংলাদেশে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে বেশ কিছুদিন তা নিরাপদে রাখার চ্যালেঞ্জ থাকছেই।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপন্ন পারমাণবিক বর্জ্য বলতে শুধু Spent Nuclear Fuel বা পারমাণবিক জ্বালানি বর্জ্যই বোঝায় না। স্পেন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েল মূলত উঁচুমাত্রার তেজস্ক্রিয়তার পারমাণবিক বর্জ্য, যা ছাড়াও নিচু ও মাঝারি তেজস্ক্রিয়তার কঠিন ও তরল পারমাণবিক বর্জ্য তৈরি হয়। পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আওতায় এই নিচু ও মাঝারি তেজস্ক্রিয়তার বর্জ্যও পড়ে। রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি অনুসারে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে রাশিয়া স্পেন্ট ফুয়েল ফেরত নেবে; কিন্তু নিচু ও মাঝারি মানের তেজস্ক্রিয়তাসম্পন্ন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কী হবে সেটা স্পষ্ট নয়।
অন্যদিকে একটি ভিভিইআর-১২০০ মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বছরে প্রায় ৭৭ ঘনমিটার নিম্ন ও মাঝারি মাত্রার তেজস্ক্রিয় বর্জ্য তৈরি হয়, যার মধ্যে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজের সময় তৈরি তেজস্ক্রিয় বর্জ্য যেমন ব্যবহৃত পিপিই, প্লাস্টিক, কাগজ, অপরিবাহী পদার্থ, বৈদ্যুতিক তার, পরিষ্কার করার সামগ্রী, ভেনটিলেশন ফিলটার প্রভৃতি থেকে শুরু করে পানি পরিশোধনের সময় তৈরি তেজস্ক্রিয় বর্জ্য যেমন: স্পেন্ট আয়ন এক্সচেঞ্জ রেজিন, ফিল্টার, বাষ্পীভবনের বর্জ্য, অ্যাকটিভ কার্বন স্লাজ ইত্যাদি।১৯ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিয়মিত অপারেশনের সময় তৈরি হওয়া এই নিম্ন ও মাঝারি মাত্রার তেজস্ক্রিয় বর্জ্যগুলো যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনা করা না হলে চারপাশের মানুষ ও পরিবেশের জন্য তেজস্ক্রিয়দূষণের ঝুঁকি তৈরি করে। এ কারণে এগুলোকে নিয়মিতভাবে প্রক্রিয়াকরণ ও মাটির নিচের কংক্রিটের স্থাপনায় নিরাপদে সংরক্ষণের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে তৈরি হওয়া এই নিম্ন ও মাঝারি মানের তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কারা করবে, কীভাবে করবে এবং তার ফলে সম্ভাব্য লিকেজের ঝুঁকি কীভাবে মোকাবিলা করা হবে–এই বিষয়গুলো পরিষ্কার নয়।
২০১৫ সালের অক্টোবরে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এমএ মুহিত বলেছিলেন, বাংলাদেশের বর্তমান বৈদেশিক ঋণের মাত্রা বিবেচনায় রাশিয়ার কাছ থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য নেওয়া এই ঋণ দেশের অর্থনীতির জন্য একটা বড় বোঝায় পরিণত হবে।
বিপুল আর্থিক দায়
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার (১ লাখ কোটি টাকারও বেশি)। এই অর্থের ৯০ শতাংশ অর্থাৎ ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার রাশিয়া ৪ শতাংশ হারে সুদে ঋণ দিচ্ছে। ১০ বছরের রেয়াতকালসহ ২০ বছর মেয়াদে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে। আর সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হবে বাকি টাকা।২০ মূল বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণব্যয় ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলারের সঙ্গে সমীক্ষা পর্যায়ের ব্যয় ৫৫ কোটি ডলারও যুক্ত করলে মোট ব্যয় হচ্ছে ১৩ দশমিক ২০ কোটি ডলার।২১ এ বিষয়ে ২০১৫ সালের অক্টোবরে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এমএ মুহিত বলেছিলেন, বাংলাদেশের বর্তমান বৈদেশিক ঋণের মাত্রা বিবেচনায় রাশিয়ার কাছ থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য নেওয়া এই ঋণ দেশের অর্থনীতির জন্য একটা বড় বোঝায় পরিণত হবে।২২ শুধু তাই নয়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ খরচ চুক্তিতে উল্লিখিত অর্থের চেয়ে আরও বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে। এ বিষয়ে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে ৩৫ বছরের বেশি সময়ের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিজ্ঞানী এ রহমান ডেইলি স্টারে লিখেছেন:
‘এই চুক্তি কোনো ‘ফিক্সড প্রাইস’ কন্ট্রাক্ট বা স্থির মূল্যের চুক্তি নয়, এটা ‘কস্ট প্লাস’ কন্ট্রাক্ট যার অর্থ হলো নির্মাণ কাজ চলার সময় নির্মাণকারী কোম্পানির অধিকার রয়েছে চুক্তিতে উল্লিখিত অর্থের সঙ্গে আরও খরচ (সেইসঙ্গে লাভের অংশ) যোগ করার। অতীতে বিভিন্ন দেশে এ ধরনের রুশ চুক্তির অর্থ দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে ইরানের বুশেরে ১ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র (বুশের-১) নির্মাণে ২০ বছরেরও বেশি সময় (১৯৯৪–২০১৪) লাগে এবং ব্যয় বৃদ্ধি পায় বিপুল পরিমাণে, যা ইরান সরকারের জন্য বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করে।’২৩
আরেকটি বিষয় হলো, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের খরচ হিসেবে করতে হলে শুধু এককালীন নির্মাণ খরচ হিসাব করলেই হবে না, এর সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি, বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং মেয়াদ শেষে ডিকমিশনিং ও তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার খরচও যোগ করতে হবে। এই বিষয়গুলো যুক্ত করে এ রহমান রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের খরচের হিসাব করেছেন এভাবে–
‘সব মিলিয়ে হিসাব করতে হলে যেসব ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে সেগুলো হলো: নির্মাণ ব্যয় (১২.৬৫ বিলিয়ন ডলার); ৪০ বছর মেয়াদে সর্বমোট ২৬ বার জ্বালানি পরিবর্তন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, যার প্রতিবারের জন্য বর্তমান বাজারমূল্যে ব্যয় হবে ১০–১৫ কোটি ডলার করে; প্রতিবছরের জন্য ৫ কোটি ডলার হিসাবে ৪০ বছরের পরিচালনা ব্যয়, ঋণের সুদ বাবদ ব্যয় যা কমপক্ষে মূলধনের সমপরিমাণ হবে, যেহেতু ঋণটি প্রকল্পের শুরুতেই নেওয়া হচ্ছে; সর্বোপরি বাড়তি মূলধন ব্যয় যা প্রাথমিক হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি হবে। এসব খরচের সঙ্গে ডিকমিশনিং-এর খরচ যোগ করে এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ৭০ শতাংশ সময় ধরে চালু থাকবে (পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এটাই সর্বোচ্চ হার) ধরে হিসাব করলে প্রতি কিলোওয়াট-ঘণ্টা (ইউনিট) বিদ্যুতের খরচ দাঁড়ায় ১১ সেন্ট… ।’২৪
এ রহমানের করা হিসাবে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টার খরচ ১১ সেন্ট (বা ৯ টাকা ৩৫ পয়সা, ১ ডলার = ৮৫ টাকা ধরে) হলেও, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষের দেওয়া হিসাব অনুসারে এই খরচ প্রতি মেগাওয়াট ঘণ্টার জন্য ৫৬.৭৩ ইউএস ডলার যা প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টার জন্য দাঁড়ায় ৫.৬৭ সেন্ট (বা ৪ টাকা ৮২ পয়সা)।২৫ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষে একটা যুক্তি দেওয়া হয় যে, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য এককালীন বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হলেও বিদ্যুৎকেন্দ্র দীর্ঘমেয়াদে তুলনামূলক কম জ্বালানি খরচে চলতে পারে বলে কার্যত প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনায় অনেক কম পড়ে। যেমন, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের A snapshot on Rooppur Nuclear Power Plant Project শীর্ষক লেখায় দাবি করা হয়েছে:
‘অনেক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ও দীর্ঘ জীবনচক্রের কারণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কিছু বিশেষ অর্থনৈতিক সুবিধা রয়েছে। অর্থনৈতিক বিবেচনায় একটা বাড়তি সুবিধা হলো জ্বালানি এবং পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচ স্থিতিশীল থাকা। নির্মাণকালে এককালীন বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের প্রয়োজন হলেও, সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনে জীবনচক্রজুড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ (লেভেলাইজড কস্ট অব ইলেকট্রিসিটি) অনুমান করা হয়েছে কিলোওয়াট ঘণ্টাপ্রতি ৫ টাকারও কম, যা বাংলাদেশের বর্তমান গড় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেক কম।’২৬
কিন্তু উল্লিখিত এ রহমান ছাড়াও আরও অনেক স্বাধীন বিশেষজ্ঞের করা হিসাবে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ আরও অনেক বেশি পাওয়া গেছে। যেমন: জুবায়ের সাঈদ, শাহেদ হোসেন ও খোরশেদ আহমেদ কবীরের ‘Application of INPRO Methodology to Assess Economic Feasibility of Proposed Rooppur Nuclear Power Plant’ শীর্ষক স্টাডি রিপোর্ট অনুসারে রূপপুরে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ দাঁড়ায় ৯.৪৮ সেন্ট (বা ৮ টাকা, ১ ডলার = ৮৫ টাকা ধরে)।২৭ প্রকৌশলী কেএম মাহবুবুর রহমানের করা হিসাব অনুযায়ী, আদর্শ অবস্থায় প্ল্যান্ট লোড ফ্যাক্টর (গড় উৎপাদন সর্বোচ্চ উৎপাদনক্ষমতার কত অংশ তার হিসাব) ৮৫ শতাংশ হলে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টার খরচ পড়বে ৯ সেন্ট (৭ টাকা ৬৫ পয়সা) এবং প্ল্যান্ট লোড ফ্যাক্টর ৬৫ শতাংশ হলে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টার খরচ পড়বে ১২ সেন্ট (১০ টাকা ২০ পয়সা)।২৮
ফলে দেখা যাচ্ছে, রূপপুর বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ যেমন দাবি করেছে, স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের করা হিসাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ তার চেয়ে অনেক বেশি। আরেকটা বিষয় হলো, রূপপুরে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচের এসব হিসাব করা হয়েছে সবকিছু ঠিকঠাক থাকবে ধরে নিয়ে। বাস্তবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, দুর্ঘটনার কারণে মেরামতের জন্য মাসের পর মাস বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে রাখার প্রয়োজন হতে পারে। এর ফলে খরচ আরও অনেক বেড়ে যেতে পারে। আর বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও চারপাশের মানুষ, পরিবেশসহ গোটা দেশের বিপুল ক্ষতির শিকার হওয়ার ঝুঁকি তো রয়েছেই।
রূপপুরে মাত্র ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পারমাণবিক দুর্ঘটনা, তেজস্ক্রিয়দূষণ ও আর্থিক বিপর্যয়ের যে বিপুল পরিমাণ ঝুঁকি বাংলাদেশ নিচ্ছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মজার ব্যাপার হলো, বিদেশি ঋণ ও প্রযুক্তি আমদানির ওপর নির্ভর করে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনকে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির নজির হিসেবে হাজির করা হচ্ছে।
উপসংহার
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর কাছে ‘প্রেস্টিজ প্রকল্প’ হিসেবে এবং রাশিয়ার কাছে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যয়বহুল প্রযুক্তি রপ্তানির সুযোগ হিসেবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে; কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের দিক থেকে দেখলে রূপপুরে মাত্র ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পারমাণবিক দুর্ঘটনা, তেজস্ক্রিয়দূষণ ও আর্থিক বিপর্যয়ের যে বিপুল পরিমাণ ঝুঁকি বাংলাদেশ নিচ্ছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মজার ব্যাপার হলো, বিদেশি ঋণ ও প্রযুক্তি আমদানির ওপর নির্ভর করে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনকে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির নজির হিসেবে হাজির করা হচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন (পটভূমি)’ শীর্ষক রচনায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হবে বলে দাবি করার পাশাপাশি বলা হয়েছে: ‘It will also make the people confident that there is hardly any work that the Bengalese cannot do, if they strive.’ অর্থাৎ ‘এর মাধ্যমে জনগণের মধ্যে এই আত্মবিশ্বাসেরও জন্ম হবে যে, বাঙালি চাইলে পারে না এমন কোনো কাজ নেই।’২৯ রাশিয়ার উদ্ভাবিত প্রযুক্তি রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশে স্থাপন ও পরিচালনার ঘটনা কীভাবে বাঙালির পারঙ্গমতার প্রমাণ হতে পারে, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়েও এ ক্ষেত্রে যে কথাটা বলা জরুরি তা হলো, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে জাতীয় সক্ষমতা অর্জনই যদি লক্ষ্য হয়, তাহলে লক্ষ কোটি টাকার ঋণ ও বিদেশি প্রযুক্তিনির্ভর ঝুঁকিপূর্ণ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আমদানি না করে বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্থলভাগ ও সাগরের গ্যাস উত্তোলন কিংবা নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমেই তা করা সম্ভব–এর চেয়ে অনেক কম খরচে এবং বিনা ঝুঁকিতে।
কল্লোল মোস্তফা: প্রকৌশলী, লেখক
ইমেইল: Kallol_mustafa@yahoo.com
তথ্যসূত্র:
১। রূপপুর প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য মাইলস্টোনসমূহ, সর্বশেষ প্রবেশ করা হয়েছে ২৬ ডিসেম্বর ২০২০
২। ‘তেজস্ক্রিয়া থেকে প্রাণী ও পরিবেশের সুরক্ষা’, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, সর্বশেষ প্রবেশ করা হয়েছে ২৬ ডিসেম্বর ২০২০
৩। Nuclear power in the Soviet Union, Boris Semenov, IAEA BULLETIN, VOL.25, No. 2, পৃষ্ঠা ৫১, সর্বশেষ প্রবেশ করা হয়েছে ২৬ ডিসেম্বর ২০২০
৪। ‘দ্য ওর্স্ট অ্যাক্সিডেন্ট ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’, নাইজেল হকস ও অন্যান্য, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ১০৮-১০৯
৫। ‘দ্য ওর্স্ট অ্যাক্সিডেন্ট ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’, নাইজেল হকস ও অন্যান্য, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ১০৯
৬। ‘দ্য ওর্স্ট অ্যাক্সিডেন্ট ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’, নাইজেল হকস ও অন্যান্য, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ২২৩-২২৪
৭। ‘দ্য ওর্স্ট অ্যাক্সিডেন্ট ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’, নাইজেল হকস ও অন্যান্য, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ৫৫-৫৬
৮। ‘দ্য ওর্স্ট অ্যাক্সিডেন্ট ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’, নাইজেল হকস ও অন্যান্য, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ৫৪
৯। ‘দ্য ওর্স্ট অ্যাক্সিডেন্ট ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’, নাইজেল হকস ও অন্যান্য, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ৬৪
১০। ‘দ্য ওর্স্ট অ্যাক্সিডেন্ট ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’, নাইজেল হকস ও অন্যান্য, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ৬৫
১১। Safety First? Kaiga and Other Nuclear Stories, M V Ramana, Ashwin Kumar, Economic and Political Weekly, Vol. 45, Issue No. 07, 13 Feb, 2010, সর্বশেষ প্রবেশ করা হয়েছে ২৬ ডিসেম্বর ২০২০
১২। Cooling water requirement for Rooppur nuclear power plant, K.M. Mahbubur Rahman, ডেইলি স্টার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪, সর্বশেষ প্রবেশ করা হয়েছে ২৬ ডিসেম্বর ২০২০
১৩। ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প: স্বপ্ন ও বাস্তবতা’, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, প্রথম আলো, সর্বশেষ প্রবেশ করা হয়েছে ২৬ ডিসেম্বর ২০২০
১৪। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আইন, ২০১৫, সর্বশেষ প্রবেশ করা হয়েছে ২৬ ডিসেম্বর ২০২০
১৫। ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প: স্বপ্ন ও বাস্তবতা’, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, প্রথম আলো
১৬।Necessary safety measures taken for nuclear power plant, says Hasina, bdnews24.com, ১৪ জুলাই ২০১৮, সর্বশেষ প্রবেশ করা হয়েছে ২৬ ডিসেম্বর ২০২০
১৭। প্রেস বিজ্ঞপ্তি: রূপপুরের পারমাণবিক বর্জ্য রাশিয়া ফেরত নিয়ে যাবে: এ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর, ৩০ আগষ্ট, ২০১৭, সর্বশেষ প্রবেশ করা হয়েছে ২৬ ডিসেম্বর ২০২০
১৮। Environmental Impact Assessment Report for a Nuclear Power Plant, Fennovoima, February 2014, পৃষ্ঠা ৭৪, সর্বশেষ প্রবেশ করা হয়েছে ২৬ ডিসেম্বর ২০২০
১৯। পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৭১
২০। রূপপুরে ভিত্তি পেল দেশের প্রথম পারমাণবিক চুল্লি, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ৩০ নভেম্বর ২০১৭, সর্বশেষ প্রবেশ করা হয়েছে ২৬ ডিসেম্বর ২০২০
২১। রূপপুর নিয়ে ঋণ চুক্তি সই মঙ্গলবার, প্রথম আলো, ২৪ জুলাই ২০১৬, সর্বশেষ প্রবেশ করা হয়েছে ২৬ ডিসেম্বর ২০২০
২২। Bangladesh to spend $13.5b to build 2,400MW nuclear power plant, দ্য ডেইলি স্টার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৫, সর্বশেষ প্রবেশ করা হয়েছে ২৬ ডিসেম্বর ২০২০
২৩। A Rahman, Ruppur Nuclear Power Plant: Bangladesh’s Potential Blackhole, ডেইলি স্টার, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৫, সর্বশেষ প্রবেশ করা হয়েছে ২৬ ডিসেম্বর ২০২০
২৪। পূর্বোক্ত
২৫। A snapshot on Rooppur Nuclear Power Plant Project, rooppurnpp.gov.bd, সর্বশেষ প্রবেশ করা হয়েছে ২৬ ডিসেম্বর ২০২০, সর্বশেষ প্রবেশ করা হয়েছে ২৬ ডিসেম্বর ২০২০
২৬। পূর্বোক্ত
২৭। Jubair Sieed ও অন্যান্য, Application of INPRO Methodology to Assess Economic Feasibility of Proposed Rooppur Nuclear Power Plant, জুন ২০১৫, সর্বশেষ প্রবেশ করা হয়েছে ২৬ ডিসেম্বর ২০২০
২৮। কে এম মাহবুবুর রহমান, ROOPPUR NUCLEAR POWER PLANT: A REVIEW OF COST OF PROJECT & POWER, এনার্জি এন্ড পাওয়ার, ২৭ আগস্ট, ২০১৬, সর্বশেষ প্রবেশ করা হয়েছে ২৬ ডিসেম্বর ২০২০
২৯। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন (পটভূমি), https://most.portal.gov.bd, সর্বশেষ প্রবেশ করা হয়েছে ২৬ ডিসেম্বর ২০২০
212