কান পাতলে শালবৃক্ষের কান্না শুনতে পাই

কান পাতলে শালবৃক্ষের কান্না শুনতে পাই

বাংলাদেশে বন থেকে বনজীবীদের উচ্ছেদ করে বাণিজ্য সম্প্রসারণের নানা তৎপরতা চলছে। মুনাফার লোভে দখল ও বিনাশ হচ্ছে বন-নদী। বিপন্ন প্রাণ প্রকৃতি মানুষ। গত ৩১ জানুয়ারি মধুপুর এলাকায় এর বিরুদ্ধে সমাবেশ হয়। এখানে উচ্ছেদ ও নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলন অনেক দিন ধরেই চলছে, জীবন দিয়েও প্রতিরোধ জারি রেখেছেন বনজীবী মান্দি জনগণ। এলাকার মানুষ, পরিবেশ এবং প্রতিবাদ নিয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতা এখানে কথায় ও ছবিতে পেশ করেছেন “সাংসারেক- দ্য লাস্ট কিপার্স” চলচ্চিত্র টিম।

প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের কাজে গত দুই বছর যাবৎ আমাদের প্রায়ই যেতে ও থাকতে হয়েছে মধুপুর গড়ের জঙ্গলে। স্বভাবতই কোন হোটেল, সুসজ্জিত রিসোর্ট বা বনবিভাগের অভিজাত রেস্ট হাউসে না থেকে আমরা মান্দি আ’চিক বন্ধুদের আতিথেয়তাকে প্রাধান্য দিয়েছি। তাদের সবান্ধব উষ্ণতা, সরল যাপনে বারবার আপ্লুত হয়েছি, বিস্মিত হয়েছি। এবং ধীরে ধীরে নিজেদের অজান্তেই বন্ধুত্বের সীমানা পেরিয়ে কবে-কখন যেন হয়ে উঠেছি তাদের পরিবারের একজন। এখন বলা যায়, মধুপুর গড়ের আচিক জনজাতি অধ্যুষিত বনভূমি ঘেরা গ্রাম আমাদের দ্বিতীয় ও প্রধান আপন আবাস।  

দীর্ঘ দীর্ঘ সময়, দিনের পর দিন সেখানে অবস্থানের কারণে তাদের জীবন-যাপনের যে রীতি আমরা লক্ষ্য করেছি তা ঠিকঠাক বোঝা বা উপলব্ধি করা আমাদের মতো নগর জীবনের নাগরিকদের পক্ষে সত্যি-ই কঠিন। আমাদের শিক্ষা, আমাদের চিন্তা ও কর্মের ধারা থেকে অর্জিত অভ্যাস আমাদেরকে শেখায় বিনিময় সম্ভাবনা ছাড়া সম্পর্ক অপ্রয়োজনীয়, উদ্দেশ্য ছাড়া কেউ কারো উপকারে আগ্রহী হয় না। এই তথাকথিত সভ্য ব্যবস্থা আমাদের শেখায়, আমরা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব, কাজেই আমাদের প্রয়োজনে এবং অপ্রয়োজনে, আমাদের আভিজাত্য প্রদর্শনে, আমাদের বিলাস-ব্যসনে, আমাদের তথাকথিত শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিতে যথেচ্ছাচার প্রাণ-প্রকৃতি বিধ্বংসী উদ্যোগ ও কর্মতৎপরতার অধিকার আমাদের রয়েছে। সেইমতো আমরা প্রতিনিয়ত কাজ ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অকাজে উৎসাহী হচ্ছি। নদী হত্যা করছি, জলাশয় ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণ করছি, বনভূমি ধ্বংস করে পর্যটন এলাকা গড়ে তুলছি। আমাদের সকল ভাবনা, সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগের এক এবং একমাত্র উদ্দেশ্য আমরা নিজেরা। 

আবার এই নিজেরাও কিন্তু সকল মানুষ নয়। এখানে নিজেরা বলতে বুঝতে হবে সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগ নেবার ক্ষেত্রে দায়িত্ব ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত শ্রেণি। এর বাইরে আদিবাসী জনগোষ্ঠীসহ বাকি পাহাড়-সমতল বা উপকূলের সাধারণ মানুষ, পোকা-মাকড়, কীটপতঙ্গ, পক্ষী ও অন্যান্য প্রাণীকূল, জল ও মৃত্তিকা এবং বৃক্ষ ও তৃণরাজির কোন অবস্থান নেই। কাজেই আমরা বাকি ‘সাধারণ মানুষেরা’ “শ্রেষ্ঠ জীব” হবার বাসনায়, উচ্ছিষ্ট পেয়ে প্রাণ-প্রকৃতি বিধ্বংসী প্রকল্প ও উদ্যোগসমূহকে সরবে বা নিরবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি।

এই পর্যন্ত পড়ে পাঠকের মনে হতেই পারে আমরা ধান ভানতে শীবের গীত জুড়ে দিয়েছি। তেমনটা মনে হলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কিন্তু মুশকিল হলো এই শীবের গীত না গেয়ে মূল কথায় যাওয়া সত্যি-ই মুশকিল। আমরা অপারগ।

তো এই যখন আমাদের শহুরে সভ্য ভাবনা তখন ভাবনার সেই অপরিপক্কতা নিয়ে মান্দি আ’চিক জঙ্গলবাসীর জীবন বোঝা মুশকিলই বটে। আমরা দিনের পর দিন সেই সব বাড়িতে থেকে দেখেছি তারা পারতপক্ষে বাজারমুখী হন না। জুমের চালের ভাত আর জঙ্গলের আলু-কচু-লতাগুল্ম অথবা বসত-বাড়ির আশেপাশের চালা জমিতে লাগানো শাক-সবজি এবং রাত জেগে জঙ্গলের ঝিরিতে ফাঁদ পেতে ধরা পাঁচমিশালি মাছের ঝোল তাদের খাদ্য। শীতকালে ঝিরির জল শুকিয়ে গেলে আলু-কচুর সাথে শুটকি এবং বাড়িতে অতিথি এলে কদাচিৎ বাজার থেকে আনা মাছ খাদ্য তালিকায় যুক্ত হয়।

একবার ‘আদা-চা’ খেতে চেয়েছিলাম, গৃহকর্ত্রী সংকুচিত ও খানিক বিস্মিত হয়ে জানালেন, এখন তো আদার সিজান না, আদা কোথায় পাবো মানি! অর্থ্যাৎ, ঘরের পাশের চালা ভিটায় সিজনে লাগানো আদা ও আদার পাতা তারা সিজনে খান। সেটা শেষ হয়ে গেলে বাকি বৎসর আদা খান না। হররোজ একটা কিছু উপলক্ষ পেলেই আড়ং, কে-ক্রাফট, সাদা-কালোয় ঘোরাঘুরি করা আমাদের বাজারি মন লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে উঠেছিলো সেদিন।

প্রায় প্রতিদিন খেয়াল করতাম একটি কোন সবজি দিয়ে উনারা তরকারি রাঁধেন না। একদিন বললাম, হ্যা গো, তোমরা বুঝি সবসময় হরেক রকম সবজি মিলিয়ে রান্না করতে ভালোবাসো?  তিনি হেসে বললেন, না গো, আলাদা সবজির আলাদা স্বাদ আমরাও পছন্দ করি। কিন্তু বাগানে বা জঙ্গলে তো এক রকম শাক-পাতা-সবজি বেশি ফলে না। ধরো কয়েকটা সীম পেলাম, কিছু বরবটি, কয়েকটা উচ্ছে, দু’টো বেগুন, কিছু পেঁপের ফুল, বাসক পাতা তা দিয়ে আমাদের এত বড় সংসারের জন্যে আলাদা তরকারি তো রাঁধা যায় না। তাই সব মিলিয়ে একসাথে রাঁধি। এরা তবুও পারতপক্ষে বাজারমুখী হতে চান না।

গারো বাড়িগুলো মাটির তৈরি। ধবধবে নিকানো উঠান। প্রতিটি বাড়ির প্রবেশ পথ, উঠান ও দুয়ারের ধার ঘেঁষে নানান ফুলের গাছ। কিন্তু খেয়াল করলাম, ঘরের ঠিক পাশে হাত দুয়েক জায়গা তারা পরিষ্কার রেখে বাকি জায়গায় আগাছার ঝাড় রেখে দেন। ঘাস-লতা-গুল্মের জড়ানো সংসার সেখানে। বড়দাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা আগাছা নিড়াও না ক্যান? উনি অবাক হয়ে উল্টো জিজ্ঞেস করলেন, আগাছা আবার কোথায়? গাছ আবার আগাছা হয় নাকি? সাপ-খোপ ঘরে না সেঁধোয় তার জন্যে ঘরের পাশ ঘেঁষে একটু জায়গার গাছ কেটে দেই, ও টুকু দরকার। বাকি জায়গার গাছ তো আমার ক্ষতি করছে না, ওদের কাটবো কেন?  এই হচ্ছে আদিবাসী গারো আ’চিক জনগোষ্ঠী। এই ভাবনারীতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা তো ধাক্বা খাবোই। নির্বিচারে জল-জঙ্গল ধ্বংস করে ইকো পার্কের নামে মুনাফাভিত্তিক মনোবৃত্তিকে প্রশ্রয় দেয়া আমাদের পক্ষে এই ভাবনার তলে পৌঁছানো কি আদৌ সম্ভব? সম্ভব না, কোনদিন না। আর তাই, বনজীবী মানুষের বনের সাথে সম্পর্কিত আবেগ ও আখ্যান উপলব্ধিতে বারবার আমরা চরম ভাবে ব্যর্থ হই। ব্যর্থতা লুকাতে আমরা হিংস্র হই, নিষ্ঠুর হই। বন রক্ষার নামে বনজীবী মানুষকে তার হাজার বৎসরের শেকড় থেকে উপড়ে ফেলে বনকে মুনাফার পুঁজিতে পরিণত করতে দ্বিধাহীন ভাবে কুৎসিত ষড়যন্ত্রে মেতে উঠি।

জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা আগাছা নিড়াও না ক্যান? উনি অবাক হয়ে উল্টো জিজ্ঞেস করলেন, আগাছা আবার কোথায়? গাছ আবার আগাছা হয় নাকি?

ভেবে দেখতে হবে, আমরা তা পারি কিনা। না পারি না। দেশের সংবিধান আমাদের, অর্থাৎ আমাদের মধ্যের যে সকল ব্যক্তিবর্গ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ও দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন তাদের সে অধিকার দেয়নি। কেবল বাংলাদেশের সংবিধান নয়, সেই সাথে আন্তর্জাতিক আইন, এমনকি জাতিসংঘের ঘোষণাও আপনার বা আপনাদের এই সিদ্ধান্তের পক্ষে যায় না। আপনি বা আপনারা চাইলেই একটি গারো বা কোচ পরিবারকেও তাদের শত শত বৎসর ধরে বসত করা বাস্তভিটা থেকে উচ্ছেদ করতে পারেন না। অথচ পুরো মধুপুর গড়ে অবস্থিত প্রায় অর্ধশত আদিবাসী গ্রামকে আপনারা উচ্ছেদের পরিকল্পনা করছেন। কী আশ্চর্য! এই সংবাদে আমরা বিস্মিত, আমরা ব্যথিত এবং যারপরনাই লজ্জিত।

গত দু’বছরে মধুপুর গড়ের জঙ্গল সম্পর্কে আমাদের যে বাস্তব ও ঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতা তা থেকে নিশ্চিত করেই বলতে পারি, এই গড়ের আদিবাসীরা বন ধ্বংসকারী নন, বরং তাদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্য থেকেই এর সংরক্ষণের দাবীদার। এরা বনজীবী, বন এদের বেঁচে থাকার উৎস। আপনার-আমার কারো কাছে এই গড়াঞ্চল সৌন্দর্যপূর্ণ ট্যুরিস্ট স্পট, নগর জীবনের ক্লান্তি ও ক্লেদ মোছার অরণ্যরাজি, কারো কাছে প্রাচীন পুষ্ট শাল-গজারি বৃক্ষ নিধন করে আয়েশি আসবাব তৈরি অথবা বাজারজাত করে মুনাফা লুটের অভয়ারণ্য। অপর দিকে মান্দি আ’চিক জাতি এই গড়কে ‘আ’ বিমা’ বলে সম্বোধন করেন। আ’ বিমা মানে মায়ের মাটি। কাজেই এই বনকে, মায়ের মাটিকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা আপনার-আমার চেয়ে তাঁদের অনেক বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক নয় কি?

প্রায় তিনশত বৎসর আগে থেকেই গারো ও কোচ জাতির পূর্বপুরুষেরা এই গড়াঞ্চলে বসবাস করে আসছেন। তখন থেকেই এরা উঁচু চালা জমিতে জুম চাষ ও নিচু বাইদ জমিতে ধান চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ব্রিটিশ ভারতে ১৮৬০ এর দিকে এই দুই জনজাতির গ্রাম প্রধানদের সাথে নাটোর রাজ শ্রী যোগীন্দ্রনাথ রায় বাহাদুরের চুক্তি হয়। এই চুক্তি মোতাবেক তারা রাজাকে ‘চার্জশীট’-এর মাধ্যমে খাজনা দিয়ে জুম চাষ করে আসছিলেন।  

ব্রিটিশদের বিদায়ের পর পাকিস্তানি আমলে ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গীয় জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন জারি করে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করা হলে এই অঞ্চলের অনেক অংশ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং সেইসাথে এদেরকেও ‘রায়ত’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। ফলশ্রুতিতে এরা ভূমি মালিকানা থেকে বঞ্চিত হন। মূলত এই সময় থেকেই এরা মাতৃস্থান থেকে বিতাড়নের প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করেন, যা এই স্বাধীন বাংলাদেশেও ক্রিয়াশীল এবং তখন থেকেই এরা অসংখ্যবার মায়ের মাটি আর বনভূমি রক্ষায় পথে নেমেছেন।

আজ থেকে সতেরো বৎসর আগে, ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে এই মান্দি-কোচ জাতি ‘ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলন’-এ পথে নেমেছিলেন। নাড়িপোতা মাটি রক্ষায়, কাঁটাতার আর দেয়াল তোলা রুখতে শত শত মান্দি নারী-পুরুষ গ্রাম ছেড়ে ছুটে গিয়েছিলেন বনের পথে। আমরা জানি, ৩ জানুয়ারির সে মিছিলে বনরক্ষী আর পুলিশের সম্মিলিত গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন গারো মায়ের বীর সন্তান পা পীরেল স্নাল। চিরপঙ্গুত্ব বরণ করেছিলেন  উৎপল নকরেকসহ অনেকেই। কিন্তু তবু ইকোপার্কের নামে বন বিধ্বংসী অপতৎপরতা থামেনি আজও। 

আজ থেকে সতেরো বৎসর আগে, ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে এই মান্দি-কোচ জাতি ‘ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলন’-এ পথে নেমেছিলেন। নাড়িপোতা মাটি রক্ষায়, কাঁটাতার আর দেয়াল তোলা রুখতে শত শত মান্দি নারী-পুরুষ গ্রাম ছেড়ে ছুটে গিয়েছিলেন বনের পথে। আমরা জানি, ৩ জানুয়ারির সে মিছিলে বনরক্ষী আর পুলিশের সম্মিলিত গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন গারো মায়ের বীর সন্তান পা পীরেল স্নাল। চিরপঙ্গুত্ব বরণ করেছিলেন  উৎপল নকরেকসহ অনেকেই। কিন্তু তবু ইকোপার্কের নামে বন বিধ্বংসী অপতৎপরতা থামেনি আজও। 

২০১৬ সালে মধুপুর গড়াঞ্চলের অরণখোলা মৌজার ৯,১৪৫.০৭ একর জমিকে চূড়ান্ত ভাবে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করা হয়; যে মৌজার ১৩টি গ্রামেই সবচেয়ে বেশি আদিবাসীর বাস। প্রতিনিয়তই পুরাতন বসত ভিটায় নতুন ঘর তুলতে গেলে অথবা পুরাতন ফলের বাগান ভেঙ্গে নতুন ফল আবাদ করতে গেলে বন বিভাগ কর্তৃক বাধার মুখে পড়ছেন তারা। 

এরইমধ্যে ‘বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সংসদীয় কমিটি’ গত ২০ ডিসেম্বর, ২০২০ এর মধ্যে সংরক্ষিত বনভূমির দখলদারদের তালিকা তৈরি করে উচ্ছেদের নোটিশ দেবার নির্দেশ জারি করেছেন। দখলদার বলতে বোঝানো হচ্ছে বনের আদিঅধিবাসীদের। নির্দেশনা অনুযায়ী সারাদেশের মোট ৩৩,১০৯০৭.৫২ একর সংরক্ষিত বনভূমির মধ্য থেকে প্রাথমিকভাবে গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও কক্সবাজারের ১,৩৮৬১৩.০৬ একর বনভূমি থেকে দখলদার উচ্ছেদের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০-এ এই সংবাদ জানার পর থেকে উচ্ছেদ আতংক, আপন ভূমি, শত শত বছরের ঐতিহ্য, জীবিত ও মৃত প্রিয়জনের সুখ-দুঃখের স্মৃতিময় আবাস ছেড়ে যাবার বিভীষিকা নিয়ে কাটছে স্থানীয় আদিবাসী ও অ-আদিবাসী সকলেরই উৎকণ্ঠাময় দিন-রাত্রি। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে এটা কি তাদের প্রাপ্য? নিশ্চয় নয়!    

মুনাফার লোভ যখন ঘিরে ফেলে মানবিক চোখ তখন যা ঘটে এই গড়াঞ্চল নিয়ে আমরা দেখছি তাই-ই ঘটছে বারবার। মধুপুরসহ দেশের সকল বন রক্ষা পাক, জল ও ভূমি ধ্বংসকারী কর্পোরেট আধিপত্য নির্মূল হোক এটা আমরাও নিশ্চয় চাই। সেক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান বিবেচ্য থাকতে হবে বনজীবী জনজাতির জীবন ধারণ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়টি।  

মুনাফার লোভ যখন ঘিরে ফেলে মানবিক চোখ তখন যা ঘটে এই গড়াঞ্চল নিয়ে আমরা দেখছি তাই-ই ঘটছে বারবার। মধুপুরসহ দেশের সকল বন রক্ষা পাক, জল ও ভূমি ধ্বংসকারী কর্পোরেট আধিপত্য নির্মূল হোক এটা আমরাও নিশ্চয় চাই। সেক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান বিবেচ্য থাকতে হবে বনজীবী জনজাতির জীবন ধারণ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়টি।  

আমাদের মনে রাখা কর্তব্য, আদিবাসী বনজীবী মানুষের সাথে বনভূমির সম্পর্ক কেবল জীবিকার নয়, সেইসাথে গভীর আবেগের। আমরা চেষ্টা করেও বুঝতে ব্যর্থ হই, মাতৃভূমির জন্যে প্রাণ দেয়া একটি জাতি কী করে ভুলে যায় ভূমির সাথে মানুষের সম্পর্কের ইতিহাস, আবেগীয় বোধ!

মঞ্চে বক্তব্য দিচ্ছেন লিয়াং রিছিল, কেন্দ্রিয় সাধারন সম্পাদক, জিএসএফ, ছবি: জহিরুল হাসান
সমাবেশ শেষে ময়মনসিংহ-টাইঙ্গাল সড়ক অবরোধের চিত্র, ছবি: জহিরুল হাসান

পীরেন স্নালের রক্ত দেওয়া জানুয়ারিতে আবার মধুপুরের লাল মাটি কেঁপে উঠলো গারো-কোচ জনজাতির সংক্ষুব্ধ মিছিলে। ৩১ জানুয়ারি জলছত্র ফুটবল মাঠে দাঁড়িয়ে দেখলাম ভেঙ্গে পড়া মিছিলের ঢেউ, শুনলাম গগনবিদারী স্লোগান, “খা মারাক, খা সাংমা”, “আদিবাসী আসছে, রাজপথ কাঁপছে”, “পীরেন তোমায় ভুলি নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই”, “চলেশ তোমায় ভুলি নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই”, “মধুপুরের মাটিতে, ইকোপার্ক হবে না”, “আমার জমি আমার মা, কেড়ে নিতে দেবো না”।

সমাবেশে নারী উপস্থিতি ছিল উর্ল্লেখযোগ্য সংখ্যায়, ছবি: জহিরুল হাসান

গত ২৫ জানুয়ারি মধুপুর আনারস চত্ত্বরের সমাবেশে তারা বন বিভাগ, রাজস্ব বিভাগ ও আদিবাসী প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত ত্রি-দলীয় জরিপের মাধ্যমে আদিবাসীদের ভূমি চিহ্নিত করার দাবী জানিয়েছিলেন। ৩১ জানুয়ারির সমাবেশে এর সাথে মানবাধিকার কমিশনকেও যুক্ত করে চার-পক্ষীয় জরিপ ও আলোচনার মাধ্যমে ভূমি চিহ্নিতকরণ, সংরক্ষিত বনাঞ্চল বাতিল করে অর্থপূর্ণ আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ, ভ্রাম্যমাণ আদালতে দ্রুত বিচারের মাধ্যমে মিথ্যা বন মামলার নিষ্পত্তি, ইকোপার্ক, জাতীয় উদ্যানের ঘোষণা প্রত্যাহার, সামাজিক বনায়নের নামে বন ধ্বংস বন্ধ করে এলাকায় বসবাসকারী আদিবাসীদের তত্ত্বাবধানে কমিউনিটি ফরেস্ট্রি বা গ্রামবন পদ্ধতি চালু এবং ১৯৮২ সালের আতিয়া বন অধ্যাদেশ বাতিল করে আদিবাসীদের রেকর্ডকৃত জমির বন্ধ খাজনা নেয়া প্রথা পুনরায় চালু করার দাবী তুলেছেন।

মিছিল সহযোগে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যোগ দেন আদিবাসী নারী পুরুষ, ছবি: জহিরুল হাসান
রাস্তা অবরোধকালে সমবেত স্লোগানের খণ্ড চিত্র, ছবি: জহিরুল হাসান

সমাবেশে এর সাথে মানবাধিকার কমিশনকেও যুক্ত করে চার-পক্ষীয় জরিপ ও আলোচনার মাধ্যমে ভূমি চিহ্নিতকরণ, সংরক্ষিত বনাঞ্চল বাতিল করে অর্থপূর্ণ আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ, ভ্রাম্যমাণ আদালতে দ্রুত বিচারের মাধ্যমে মিথ্যা বন মামলার নিষ্পত্তি, ইকোপার্ক, জাতীয় উদ্যানের ঘোষণা প্রত্যাহার, সামাজিক বনায়নের নামে বন ধ্বংস বন্ধ করে এলাকায় বসবাসকারী আদিবাসীদের তত্ত্বাবধানে কমিউনিটি ফরেস্ট্রি বা গ্রামবন পদ্ধতি চালু এবং ১৯৮২ সালের আতিয়া বন অধ্যাদেশ বাতিল করে আদিবাসীদের রেকর্ডকৃত জমির বন্ধ খাজনা নেয়া প্রথা পুনরায় চালু করার দাবী তুলেছেন।

আমরা প্রত্যাশা করি, মধুপুর গড় ও এর বনাঞ্চলের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং বনের সাথে বনজীবী আদিবাসীর প্রথাগত ও আবেগীয় সম্পর্ক সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিগণ উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। আদিবাসীদের উপর বন বিভাগের দীর্ঘদিন যাবৎ ঘটানো অন্যায্য নির্যাতন-নিপীড়নের কারনে আজকের অবস্থা তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতি আর দীর্ঘায়িত করবেন না। অস্তিত্বের সংকট তৈরি করে তাদের আর বিক্ষুব্ধ করে তুলবেন না। 

এরা নিজেদের পরিচয় দেন মান্দি বলে। মান্দি অর্থ ‘মানুষ’। পৃথিবীতে এই একটিমাত্র জাতি মানুষের নামে যার জাতির নাম! এরা নারী-পুরুষ আছেন, আদি সাংসারেক আছে্ন, ধর্মান্তরিত হওয়া খৃস্টান আছেন, কিন্তু সকল পরিচয়ের উর্ধ্বে তারা মান্দি, তারা ‘খাদং আনি মান্দিরাং’- আশাবাদী, স্বপ্ন দেখা মানুষের দল। যে জাতি স্বপ্ন দেখতে জানে তাকে যে দাবিয়ে রাখা যায় না এই পাঠ আমাদের ইতিহাস থেকেই নিতে হবে।  

‘শালবৃক্ষের মতো সিনা টান করে’ আদিবাসীরা বাঁচতে জানেন, বাঁচার জন্যে লড়াই করতেও জানেন। জানেন তাদের আ’ বিমাকে রক্ষার জন্যে, বলসাল ব্রিংকে রক্ষার জন্যে কীভাবে কতটা প্রাণ দিতে হয়। তারা এই বনভূমির সন্তান, মুনাফার লোভে মা আর সন্তানকে পৃথক করে দেবার উদ্যোগ এখনই বন্ধ করুন। আদিবাসীর অস্তিত্বের শেকড় ধরে টান দেবেন না। 

যোগাযোগ: jewelhassan.film@gmail.com         

তথ্যসূত্র:

– ‘জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ’ কর্তৃক আয়োজিত ২৫ জানুয়ারি ২০২১ তারিখের মধুপুর আনারস চত্বরের সমাবেশ থেকে প্রধানমন্ত্রী বরাবর দেয়া স্মারকলিপি।
– সাক্ষাৎকার, লিয়াং রিছিল, সাধারন সম্পাদক, সেন্ট্রাল কমিটি, জিএসএফ ( গারো স্টুডেন্ট ফেডারেশন)

                                                                     

Social Share
  •  
  •  
  • 526
  •  
  •  
  •  
  •