অ্যাঞ্জেলা ডেভিসের সাথে কথোপকথন-৬
যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদী রাষ্ট্রীয় সহিংসতা
অনুবাদ: ফাতেমা বেগম
মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদী লেখক ও অধিকার আন্দোলনে সক্রিয় ব্যক্তিত্ব অ্যাঞ্জেলা ডেভিসের সাথে লেখক এ্যাক্টিভিস্ট ফ্রাংক বারাত দীর্ঘ আলাপ করেছেন, তাঁর বক্তৃতা সংকলিত করেছেন। এতে মার্কিন সমাজে বৈষম্য, বর্ণবাদী আক্রমণ, ফিলিস্তিনি জনগণ সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের লড়াই নিয়ে অ্যাঞ্জেলা ডেভিসের বক্তব্য পাওয়া যায়। এই সংকলন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়, নাম: Freedom is a Constant Struggle: Ferguson, Palestine and the Foundations of a Movement| এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে সর্বজনকথায় প্রকাশিত হচ্ছে। এবারে ষষ্ঠ পর্ব যেখানে অ্যাঞ্জেলা ডেভিসের দুটো বক্তৃতা সংকলিত হয়েছে।
১. মাইকেল ব্রাউন থেকে আসসাটা শাকুর পর্যন্ত: আমেরিকার বর্ণবাদী রাজত্ব
বর্ণবাদী রাষ্ট্রীয় সহিংসতা উত্তর আমেরিকার আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মানুষের ইতিহাসে একটি ধারাবাহিক বিষয়। তবে প্রথম আফ্রিকান আমেরিকান রাষ্ট্রপতির প্রশাসনের সময় এটি বিশেষভাবে লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে, যার নির্বাচিত হওয়ার ঘটনাটিকে একটি নতুন, বর্ণবাদ-পরবর্তী যুগের আবির্ভাবের সম্ভাবনা হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল।
পুলিশ কৃষ্ণাঙ্গ যুবকদের হত্যা করছে–এটি পুরোদস্তুর একটি বিদ্যমান ব্যাপার। এই বিদ্যমানতাকে একটি বিচ্ছিন্ন বিচ্যুতি বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। ওবামা প্রশাসনের দায়িত্বকালে পুলিশ এবং আততায়ীদের হাতে নিহত অসংখ্য কৃষ্ণাঙ্গর মধ্যে শুধু ফ্লোরিডার ট্রাভিয়ন মার্টিন এবং মিসৌরির ফার্গুসনে মাইকেল ব্রাউনের নাম সর্বাধিক পরিচিতি পেয়েছে। সরকারি এবং আইনবহির্ভূত–উভয় ক্ষেত্রেই তাদের ঘটনা প্রকৃতপক্ষে দাস টহল এবং কু ক্লাক্স ক্লান থেকে শুরু করে সমসাময়িক প্রোফাইলিং অনুশীলন এবং বর্তমানের নজরদারি পর্যন্ত বর্ণবাদী সহিংসতার এক অবিচ্ছিন্ন প্রবাহকেই উপস্থাপন করে।
তিন দশকেরও আগে আসসাটা শাকুর কিউবায় রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছিলেন। তখন থেকেই তিনি তার পড়ালেখা, কর্মজীবনের মাধ্যমে একজন উৎপাদনশীল সামাজিক নাগরিক হিসেবে সেখানে বসবাস করেছেন। ১৯৭০ দশকের শুরুর দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সময় তাকে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করে এবং মিডিয়ায় তাকে নিন্দনীয় ব্যক্তি হিসেবে প্রচার করতে থাকে। যৌনতাবাদী ভাষায় তাকে ব্ল্যাক লিবারেশন আর্মির ‘মা-মুরগি’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এই প্রচারণার ফলে ব্ল্যাক লিবারেশন আর্মি অবিচ্ছিন্নভাবে হিংস্র প্রচার চালানো একটি দল হিসেবে চিত্রিত হয়েছিল। এফবিআই-এর শীর্ষ দশজন পলাতকের তালিকাভুক্ত হিসেবে আসসাটা অস্ত্র ডাকাতি, ব্যাংক লুট, অপহরণ, খুন এবং একজন পুলিশকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন। যদিও তিনি দশটি পৃথক আইনি বিচারের মুখোমুখি হয়েছিলেন এবং ইতোমধ্যে মিডিয়া তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল, তবে একটি বাদে সব অভিযোগের মামলা খালাস হয় বা জুরিরা দ্বিধান্বিত হন। অবশেষে অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ পরিস্থিতিতে নিউ জার্সির রাষ্ট্রীয় সৈন্য হত্যার সহযোগী হওয়ার অপরাধের দায়ে তিনি অভিযুক্ত থাকেন।
তিন দশকেরও আগে আসসাটা শাকুর কিউবায় রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছিলেন। তখন থেকেই তিনি তার পড়ালেখা, কর্মজীবনের মাধ্যমে একজন উৎপাদনশীল সামাজিক নাগরিক হিসেবে সেখানে বসবাস করেছেন। ১৯৭০ দশকের শুরুর দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সময় তাকে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করে এবং মিডিয়ায় তাকে নিন্দনীয় ব্যক্তি হিসেবে প্রচার করতে থাকে। যৌনতাবাদী ভাষায় তাকে ব্ল্যাক লিবারেশন আর্মির ‘মা-মুরগি’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
প্রথমবার তার বিরুদ্ধে প্রচারের চার দশক পর এফবিআই আবার তাকে অপদস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়। গত বছর নিউ জার্সি টার্নপাইক গোলাগুলিতে নিহত রাজ্য পুলিশের সদস্য ওয়ের্নার ফরেস্টারের চল্লিশতম বার্ষিকী উদ্যাপনে আসসাটাকে আনুষ্ঠানিকভাবে এফবিআই-এর শীর্ষ দশ পলাতকের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অনেকের বিবেচনায়, এফবিআই-এর এই পদক্ষেপ অদ্ভুত এবং ব্যাখ্যাতীত ছিল। এর ফলে অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়েছিল। কথিত বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক সন্ত্রাসী, যাদের কর্মকাণ্ডের কারণে ইরাক, আফগানিস্তান এবং সিরিয়ায় সামরিক অভিযান করতে হয়েছিল তাদের তালিকায় আসসাটার নাম স্থান পেয়েছিল। একজন ৬৬ বছরের কৃষ্ণাঙ্গ নারী যিনি কিউবায় তার পূর্ববর্তী সাড়ে তিন বছর পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করছিলেন, তাকে এই তালিকায় স্থান দেওয়ার পেছনে এফবিআই-এর কী কারণে আগ্রহ থাকতে পারে?
একজন ৬৬ বছরের কৃষ্ণাঙ্গ নারী যিনি কিউবায় তার পূর্ববর্তী সাড়ে তিন বছর পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করছিলেন, তাকে এই তালিকায় স্থান দেওয়ার পেছনে এফবিআই-এর কী কারণে আগ্রহ থাকতে পারে?
স্থান এবং কাল–উভয় দিক বিবেচনায় ‘সন্ত্রাস’-এর সংজ্ঞা সম্প্রসারণের মধ্যেই এই প্রশ্নের একটি আংশিক, এমনকি নির্ধারক উত্তর পাওয়া যেতে পারে। বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার নেলসন ম্যান্ডেলা এবং আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে মনোনীত করার পর, এই শব্দটি ১৯৬০ দশকের শেষের দিকে এবং ১৯৭০ দশকের গোড়ার দিকে মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ মুক্তি-সংগ্রামীদের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট নিক্সনের আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বক্তব্যে ‘ব্ল্যাক প্যানথার পার্টি’র মতো দলকে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আমি নিজেও একইভাবে চিহ্নিত হয়েছিলাম। তবে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জর্জ ডব্লিউ বুশের বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ ঘোষণা দেওয়ার আগ পর্যন্ত ‘সন্ত্রাসী’রা পশ্চিমা ‘গণতন্ত্রের’ সর্বজনীন শত্রুর প্রতিনিধিত্ব করেনি। আসসাটা শাকুরকে অবৈধভাবে সমসাময়িক সন্ত্রাসবাদী ষড়যন্ত্রে ব্যাপকভাবে জড়িত করার সঙ্গে উদ্দেশ্য ছিল তার উত্তরসূরি হিসেবে যারা বর্ণবাদ এবং পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে অব্যাহত সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদেরকে ‘সন্ত্রাসী সহিংসতা’র আওতায় নিয়ে আসা। ঐতিহাসিকভাবে কিউবার উদ্দেশে পরিচালিত কমিউনিজম বিরোধী অভিযান পরিচালনাকে বিপজ্জনকভাবে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অভিযান হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছিল। কিউবান ফাইভের ঘটনা তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
একুশ শতকের পশ্চিমা গণতন্ত্র নামক প্রকল্পের বিস্তৃত উপাধি হিসেবে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের ব্যবহার মুসলিমবিরোধী বর্ণবাদকে জায়েজ করেছে; ইসরায়েলের প্যালেস্টাইন দখলকে বৈধতা দিয়েছে; এটি অভিবাসী দমনকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে এবং পরোক্ষভাবে সারা দেশে পুলিশ বিভাগগুলোকে সামরিকীকরণের দিকে পরিচালিত করেছে। ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স অ্যাক্সেস প্রোপার্টি প্রোগ্রাম-এর মাধ্যমে পুলিশ বিভাগ, যার মধ্যে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পুলিশ বিভাগও রয়েছে–ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধ থেকে ফেরত আসা বিভিন্ন সামরিক উদ্বৃত্তের অধিকারী হয়েছে। এভাবে সম্প্রতি মাইকেল ব্রাউনকে পুলিশি হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভকারীরা যখন বর্ণবাদী পুলিশের সহিংসতার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল, তখন তারা সামরিক পোশাক ও অস্ত্রসজ্জিত এবং সাঁজোয়া যানবাহনযুক্ত পুলিশ অফিসারদের মুখোমুখি হয়েছিল।
সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের ব্যবহার মুসলিমবিরোধী বর্ণবাদকে জায়েজ করেছে; ইসরায়েলের প্যালেস্টাইন দখলকে বৈধতা দিয়েছে; এটি অভিবাসী দমনকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে এবং পরোক্ষভাবে সারা দেশে পুলিশ বিভাগগুলোকে সামরিকীকরণের দিকে পরিচালিত করেছে।
একটি ছোট মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহরে পুলিশ একজন কালো কিশোরকে হত্যা করেছিল। এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। এই প্রতিক্রিয়া মার্কিন বিদ্যমান বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। অথচ এই সময়ে বর্ণবাদ হ্রাস পাওয়াটাই প্রত্যাশিত ছিল। আসসাটার উত্তরসূরিদের মধ্যে বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামকে প্রশস্ত ও গভীর করার প্রতিজ্ঞা দাবি করা হচ্ছে। এই বছর প্রকাশিত ইভোকিং দ্য ব্ল্যাক র্যাডিক্যাল ট্র্যাডিশন অব স্ট্রাগল নামক তাঁর আত্মজীবনীতে আসসাটা আমাদের বলেন: ‘আপনারা চালিয়ে যান। / নতুন প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করুন। / হস্তান্তর করুন। আপনারা চালিয়ে যান। … / স্বাধীনতার জন্য!’
—————————-
(গার্ডিয়ানের পহেলা নভেম্বর, ২০১৪ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত)
২. সত্য উন্মোচন প্রকল্প: যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাস
সত্য উন্মোচন প্রকল্পে অনন্য অবদানের জন্য যাজক কোরি বুশ এবং ড. ডেভিড রাগল্যান্ডকে শ্রদ্ধা জানাই। এই সমাবেশে আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য সেন্ট লুই অঞ্চলে ফার্গুসনের বিক্ষোভকারী এবং অন্যান্য নেতাকর্মীকে আমি গভীরভাবে ধন্যবাদ জানাই। যুক্তরাষ্ট্রের সহিংসতার স্থায়িত্ব নিয়ে আপনারা যারা চিন্তাভাবনা করছেন এবং জন্ম থেকেই জর্জরিত পৃথিবীর জঘন্য বর্ণবাদ সম্পর্কে পুরনো ও নতুন অর্থ এবং দীর্ঘস্থায়ী তবে অজ্ঞাত সত্যগুলো যেভাবে অনুসন্ধান করছেন, সেই আপনাদের সঙ্গে যোগ দিতে পেরে আমি নিজেকে সম্মানিত বোধ করছি। আমরা জানি, ঔপনিবেশীকরণের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় সন্ত্রাসের মাধ্যমে মানবজাতি এবং তাদের ভূমি দখল করা হয়েছে। তাই এই ভূখণ্ডের আদিবাসীদের ওপর গণহত্যার উদ্দেশ্যে চালানো হামলাগুলোকে পরবর্তী সময়ে চালানো নানা রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি সন্ত্রাসের ভিত্তি হিসেবে শনাক্ত করা জরুরি। অধিকন্তু ক্রীতদাস বাণিজ্যসহ ইউরোপীয় উপনিবেশের সব সহিংসতা আফ্রিকা, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং আমেরিকান গোলার্ধের সাধারণ ইতিহাসের বিষয়বস্তু হিসেবে বিদ্যমান। অন্য কথায়, আজ আমরা যে সহিংসতার সাক্ষী, তার এক দীর্ঘতর ও বৃহত্তর ইতিহাস রয়েছে। বর্তমান সময়ের বর্ণবাদী সহিংসতার সঙ্গে বোঝাপড়া ও একে মোকাবিলার তৎপরতা এমন হওয়া উচিত যেন তা সহিংসতার ঐতিহাসিক যোগসূত্রকে স্বীকার করতে পারে। এই ঐতিহাসিক সহিংসতার মধ্যে রয়েছে আদিবাসী আমেরিকানদের বিরুদ্ধে বসতি স্থাপনকারীদের ঔপনিবেশিক সহিংসতা এবং আফ্রিকানদের ওপর চাপানো দাসত্বের সহিংসতা। আমাদের আজকের ভূমিকা প্রমাণ করে যে, সমতা, ন্যায়বিচার এবং স্বাধীনতার জন্য বৈশ্বিক লড়াইটি এখনো অসমাপ্ত।
ঔপনিবেশীকরণের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় সন্ত্রাসের মাধ্যমে মানবজাতি এবং তাদের ভূমি দখল করা হয়েছে। তাই এই ভূখণ্ডের আদিবাসীদের ওপর গণহত্যার উদ্দেশ্যে চালানো হামলাগুলোকে পরবর্তী সময়ে চালানো নানা রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি সন্ত্রাসের ভিত্তি হিসেবে শনাক্ত করা জরুরি। অধিকন্তু ক্রীতদাস বাণিজ্যসহ ইউরোপীয় উপনিবেশের সব সহিংসতা আফ্রিকা, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং আমেরিকান গোলার্ধের সাধারণ ইতিহাসের বিষয়বস্তু হিসেবে বিদ্যমান।
সত্য কথা উপস্থাপনের জন্য আমি আমার বোন ফানিয়া ডেভিসসহ সব উপস্থাপককে ধন্যবাদ জানাই। ফানিয়া ডেভিস প্রথমে ফার্গুসনে তার যাত্রা শুরু করার পর থেকে এই প্রকল্পের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। মাইকেল ব্রাউনকে হত্যার পর গত গ্রীষ্মকালে সংঘটিত বিক্ষোভের প্রায় এক বছর হয়ে গেছে। আজ সকালে আমার বোন এবং আমি সেই মাটি ছুঁয়েছি যেখানে তাকে হত্যা করা হয়েছিল এবং যেখানে ফার্গুসন সম্প্রদায়ের প্রতিবাদকারীদের পথ তৈরি হয়েছিল। আমি জানি, আপনাদের মধ্যে অনেকে ফার্গুসন প্রতিবাদকারী রয়েছেন। আপনাদের জানাতে চাই, এই মুহূর্তে এই জায়গায় থাকতে পেরে আমি নিজেকে কতটা সম্মানিত বোধ করছি। বর্ণবাদ এবং পুলিশি সহিংসতার বিরুদ্ধে বর্তমান লড়াইগুলোর সঙ্গে একাত্মতা পোষণকারী আর সবার মতো আমিও ‘ফার্গুসন’ এবং ‘মাইকেল ব্রাউন’ শব্দটি অসংখ্যবার উচ্চারণ করেছি। দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরে–উভয় ক্ষেত্রেই আমার এবং সারা বিশ্বের মানুষের জন্য ফার্গুসনের উল্লেখের মাধ্যমে সংগ্রাম, অধ্যবসায়, সাহস এবং ভবিষ্যতের সম্মিলিত দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রকাশ করে।
আপনাদের একনিষ্ঠ সংগ্রামের বৈশ্বিক অনুরণন সম্পর্কে আমি একটি গল্প বলতে চাই। গত সেপ্টেম্বরে আমি ইতালির সেভোনায় গিয়েছিলাম। সেই সফরে আমি জেনোয়ার নিকটবর্তী উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ষাট হাজার লোকের শহর সাভোনায় কিউবান ফাইভের ওপর বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। সেখানকার মানুষ খুব আগ্রহের সঙ্গে ফার্গুসনের বিক্ষোভ অনুসরণ করেছিল। যে দলটির সঙ্গে আমি কথা বলেছিলাম, তারা ১৯৯৯ সালে মার্কিন সরকার কর্তৃক গ্রেফতারকৃত, কিউবার ওপর সন্ত্রাসবাদী হামলা প্রতিহত করতে অংশগ্রহণকারী, পাঁচজন কিউবানকে মুক্তি দেওয়ার জন্য বহু বছর ধরে কাজ করে আসছিলেন। আপনারা সম্ভবত জানেন, শেষ তিনজন বন্দিকে এই গত ডিসেম্বরে বন্দিবিনিময়ে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। আজ সন্ধ্যায় আমরা এখানে যে মুহূর্তে জড়ো হয়েছি, ঠিক একই সময়ে জোহানেসবার্গ শহরে কিউবান ফাইভকে নায়কের মর্যাদা দিয়ে উদযাপন করা হচ্ছে। কিউবান ফাইভ সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যে জাগ্রত সম্মিলিত সংকল্পের প্রতিনিধিত্ব করে। তারা মানুষের স্বাধীনতার জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে দীর্ঘ ষোলো বছর সংগ্রামরত ছিলেন। আমি মূলত বলতে চাচ্ছি, আমি যখন সাভোনায় পৌঁছলাম তখন সমবেত দর্শক উৎসাহের সঙ্গে মাইকেল ব্রাউন এবং ফার্গুসনের কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছিল। কিউবান ফাইভের স্বাধীনতাসহ পুরো বিশ্বের স্বাধীনতার জন্য ফার্গুসনে বিক্ষোভকারীদের পদক্ষেপগুলোকে তারা মুক্তির বিস্ফোরক হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।
আপনাদেরকে নেতৃত্ব দেওয়া বা এখান থেকে আপনাদের গন্তব্য সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়ার প্রাথমিক উদ্দেশ্য নিয়ে আমি এই বিকেলে এখানে আসিনি। যদিও আমি এই জাতীয় আলোচনায় জড়িত হতে পেরে খুশি হব। তবে ঠিক এই কারণে আজ আমি এখানে উপস্থিত নই। আপনাদের ফার্গুসনের নেতাকর্মীরা সংগ্রামের মশাল ফেলে দিতে অস্বীকার করেছিলেন। আমি এসেছি শুধু সেই নেতাকর্মীদের ধন্যবাদ জানাতে। কারণ, যখন আপনাদেরকে বাড়ি ফিরে গিয়ে দৈনন্দিন কাজে যোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল, তখন আপনারা তাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। আপনাদের এই পদক্ষেপের কারণে ফার্গুসন বিশ্বব্যাপী প্রতিরোধের এক প্রতীক হিসেবে পরিণত হয়েছে। যখন মীমাংসার জন্য আমাদের থেকে দ্রুত সমাধান, সহজ উত্তর, সূত্র সমাধানের আহ্বান জানানো হয়েছিল, তখন ফার্গুসন বিক্ষোভকারীরা বলেছিলেন, ‘না’। আপনারা কালো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতার বিষয়গুলো দৃশ্যমান করে তোলার বিষয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। আপনারা বিশ্বাস করতে অস্বীকার করেছেন যে, সমস্যাগুলোর কোনো সরল উত্তর রয়েছে। আপনারা প্রদর্শন করেছেন, সমস্যাগুলো শুধু কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনকেই প্রভাবিত করে না, তাদের জীবন রক্ষার জন্য অন্য অনেক সংগ্রামীর জীবনও প্রভাবিত করেছে। আপনারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন যে, সমাধান না করে সেই সমস্যাকে কবরস্থানে দাফন করতে দেবেন না। তাই আমি লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে এক হয়ে আপনাদের ধন্যবাদ জানাই যারা মিসৌরির ফার্গুসনের রাস্তায় স্বাধীনতার দাবি অব্যাহত রাখার জন্য মোটেই উদ্যম হারাননি এবং বাড়ি ফিরে যাননি। আপনাদের অসাধারণ অবস্থানের কারণে ফার্গুসন প্রতিবাদটি ফিলিস্তিন থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা, সিরিয়া থেকে জার্মানি এবং ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়ার প্রগতিশীল প্রতিবাদের সমার্থক হয়ে উঠেছে।
আমি লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে এক হয়ে আপনাদের ধন্যবাদ জানাই যারা মিসৌরির ফার্গুসনের রাস্তায় স্বাধীনতার দাবি অব্যাহত রাখার জন্য মোটেই উদ্যম হারাননি এবং বাড়ি ফিরে যাননি। আপনাদের অসাধারণ অবস্থানের কারণে ফার্গুসন প্রতিবাদটি ফিলিস্তিন থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা, সিরিয়া থেকে জার্মানি এবং ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়ার প্রগতিশীল প্রতিবাদের সমার্থক হয়ে উঠেছে।
আমি এখানে আসতে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছি যেখানে সবকিছু শুরু হয়েছিল। মাইক ব্রাউনকে যখন প্রায় এক বছর আগে হত্যা করা হয়েছিল, তখন ফার্গুসনের নেতাকর্মীরা ঘোষণা করেছিলেন, তারা শুধু এই যুবকের জীবনের অযথা আত্মত্যাগের জন্যই প্রতিবাদী হননি; বরং আরও অসংখ্য মানুষকে সমর্থন জানানোও তাদের উদ্দেশ্য ছিল। ফার্গুসনের ঘটনাটি না ঘটলে নিউইয়র্কের এরিক গার্নার, ক্লিভল্যান্ডের এগারো বছর বয়সি তামির রাইস, সাউথ ক্যারোলিনার নর্থ চার্লসটনের ওয়ালটার স্কট এবং বাল্টিমোরের ফ্রেডি গ্রের ঘটনার দিকে আমরা মনোযোগী হতে বাধ্য হতাম না। ফার্গুসনের ঘটনাটি না ঘটলে আমরা হয়তো ওয়াশিংটন ডিসির মিরিয়াম কেরি, শিকাগোর রেকিয়া বয়েড এবং লস অ্যাঞ্জেলেসের আলিসিয়া থমাসকে মনে রাখতাম না। ফার্গুসনের বিক্ষোভ না হলে আমরা সম্ভবত উত্তম বিশ্ব গড়ার প্রয়োজনে এত বিস্তৃত জনসচেতনতা অর্জন করতে পারতাম না। কৃষ্ণ নারী, অশ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়, কুইয়ার সম্প্রদায় এবং ফিলিস্তিনি কর্মীরা যে সরকারিভাবে বর্ণিত বর্ণবাদী সহিংসতার লক্ষ্য ছিল, একইসঙ্গে সেই ব্যাপারগুলোয়ও এই বিক্ষোভকারীরা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
কাঠামোগত বর্ণবাদের স্থায়িত্ব বোঝার সাবলীল সক্ষমতা তৈরি করার জন্য ব্যক্তি ও প্রতীকগুলোর ঊর্ধ্বে আমাদের মনোযোগ নিবেশ করতে হবে
চার্লসটনের ভয়াবহ ট্র্যাজেডি, যা বিশ্বজুড়ে মানুষকে একত্রিত করেছে, সেই অভিজ্ঞতা হয়তো আমরা অর্জন করতে পারতাম না। সম্মিলিত মানুষ স্বীকৃতি দিয়েছে যে, বর্ণবাদ সত্যিই একবিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ বছর ধরে বেঁচে আছে। আমরা হয়তো অনুধাবন করতে পারতাম না, কাঠামোগত বর্ণবাদের স্থায়িত্ব বোঝার সাবলীল সক্ষমতা তৈরি করার জন্য ব্যক্তি ও প্রতীকগুলোর ঊর্ধ্বে আমাদের মনোযোগ নিবেশ করতে হবে, যদিও এখন বর্ণভিত্তিক পৃথকীকরণ ঐতিহাসিকভাবে অপ্রচলিত এবং ব্যক্তিপর্যায়ে বর্ণবৈষম্যমূলক আচরণকে সহজেই ক্ষমা করা হচ্ছে না। অবশ্যই এটি একটি ভালো বিষয় যে, শেষ পর্যন্ত কনফেডারেট পতাকাটি বিলুপ্তির পথে। নাগরিক অধিকারের বিরোধিতা, কৃষ্ণাঙ্গ সমানাধিকারের বিরোধিতা এবং কৃষ্ণাঙ্গ ও ইহুদিবিরোধী সন্ত্রাসের প্রতীক হিসেবে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় টিকে থাকার পর কনফেডারেট পতাকাটি অবশেষে আমাদের আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। তবে প্রশ্ন হলো, বর্ণবাদের কাঠামো এবং পাশাপাশি তার প্রতীককে কীভাবে চিহ্নিত করা যায় এবং কীভাবে চ্যালেঞ্জ করা যায়।
মজার ব্যাপার হলো, ওবামার রাষ্ট্রপতিত্বের একেবারে শেষ সময়কালে এসে বর্ণবাদের প্যান্ডোরার বাক্সটি উন্মুক্ত হয়ে গেছে। তবে অনেকে আবার তা বন্ধ করতে ব্যস্ত হচ্ছেন। ২০১১ সালে যখন ট্রয় ডেভিস মৃত্যুদণ্ডের সম্মুখীন হয়েছিল, তখন আমরা তার জীবন বাঁচানোর জন্য জোরালোভাবে একটি আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। তবে কাঠামোগত বর্ণবাদ টিকিয়ে রাখার পেছনে মৃত্যুদণ্ডের কেন্দ্রীয় ভূমিকা বিষয়ে জনগণের মধ্যে তেমন শক্তিশালী কোনো বোঝাপড়া ছিল না। ফলে উপেক্ষা করা যাবে না, এমন সম্মিলিত দাবি তোলা সম্ভব হয়নি। ২০১২ সালে ট্রাভিয়ন মার্টিন যখন নিহত হন, তখন ‘জাস্টিস ফর ট্রাভিয়ন মার্টিন’ প্রচারটি বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার আশু প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে জনগণকে জাগ্রত করে তুলেছিল। তবে ব্যক্তি অপরাধী জর্জ জিমারম্যানের দিকে আমাদের মনোযোগ এত বেশি ছিল যে, বর্ণবাদী সহিংসতার কাঠামো এবং বিশেষত ভিজিলেন্টি (নজরদারি বাহিনী বা পাহারা-পরিষদ) সহিংসতা ও রাষ্ট্রীয় সহিংসতার যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল। কিন্তু ফার্গুসনে যখন মাইকেল ব্রাউনকে হত্যা করা হয়েছিল, তখন আন্দোলনটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়নি। এমনকি পুলিশ যখন প্রতিবাদীদের দমন করার জন্য সামরিক প্রযুক্তি এবং কৌশল ব্যবহার করেছিল, তখনও তারা সংযত হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। পুলিশের টিয়ারগ্যাস হামলায় অভ্যস্ত ফিলিস্তিনি কর্মীরা ফার্গুসনের বিক্ষোভকারীদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও উৎসাহ দিয়ে টুইট করেছিলেন। কিছু মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে এমন আচরণ করেছিল যা হয়তো আন্দোলনের জন্য হিতে বিপরীত হয়েছিল; কিন্তু আন্দোলনকারীরা আত্মসমর্পণ করেনি এবং সংগ্রামকে ছিন্ন করতে অস্বীকার করেছিল। এমনকি লোকেরা বিক্ষোভকারীদের বদনাম করার মাধ্যমেও এই আন্দোলনটি ভেঙে দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। যখন বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি জিজ্ঞাসা করেছিলেন: ‘নেতারা কোথায়?’ তখন আন্দোলনের জবাব ছিল: আমরা নেতৃত্বহীন আন্দোলন নই, আমরা নেতাপূর্ণ আন্দোলন।
আপনাদের আন্দোলন ঘোষণা করেছে যে, আমাদের এখন ঐতিহ্যবাহী, স্বীকৃত, চমকদার কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ নেতার দরকার নেই। আমরা অবশ্যই মার্টিন এবং ম্যালকমকে ভালোবাসি এবং তাদের ঐতিহাসিক অবদানের গভীর প্রশংসা করি। তবে আমাদের অতীতের পুনরাবৃত্তি করার দরকার নেই। তদুপরি এটি একবিংশ শতাব্দী এবং ইতোমধ্যে আমাদের শিখে ফেলা উচিত যে, নেতৃত্ব বলতে শুধু পুরুষের অগ্রগতিমূলক শক্তিকে বোঝায় না। নারীরা সব সময় র্যাডিক্যাল কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলন সংগঠিত করার কাজটি করেছে। তাই নারীরাও নেতৃত্বের মধ্যে থাকবে। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে এবং বিশেষত ১৯৬০ এবং ১৯৭০-এর দশকে কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলনের মধ্যে এই লিঙ্গ সমস্যা ঘিরে আমরা সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছি। পরিশেষে আমরা এমন আন্দোলন দেখতে পাই যেখানে র্যাডিক্যাল নারীসংগ্রামীদের মূল্যায়ন হয়েছে, র্যাডিক্যাল কৃষ্ণ কুইয়ার নারীসংগ্রামীদের মূল্যায়ন হয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা যেমন মন্টগোমেরি বাস বর্জনে সক্রিয় হয়েছিলেন, তারা একইভাবে কৃষ্ণাঙ্গ মুক্তি আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। যার ফলে পৃথিবী কাঁপানো ঘটনা ঘটেছিল।
তবে, আন্দোলনকারী ও ইতিহাসবিদ বারবারা র্যান্সবি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন যে, আমরা নেতৃত্বহীনতাকে রোমান্টিক রূপ দিতে পারি না। তিনি সম্প্রতি উল্লেখ করেছেন:
যারা নেতৃত্বহীন আন্দোলনের ধারণাকে রোমান্টিক করে তোলে তারা প্রায়শই বিভ্রান্তিকরভাবে এলা বাকেরের কথাটি ব্যবহার করেন, ‘শক্তিশালী মানুষের জন্য [একজন] শক্তিশালী নেতার দরকার নেই।’ বাকের তার পঞ্চাশ বছরের কর্মজীবনে জাতিগত ন্যায়বিচারের লড়াইয়ে বিভিন্ন সময়ে বারবার এই বার্তাটির উল্লেখ করেছেন। তবে এই বার্তার মাধ্যমে তিনি যা বোঝাতে চেয়েছেন তা সুনির্দিষ্ট এবং প্রাসঙ্গিক ছিল। তার ব্যাখ্যায় দেবদূতসম এবং মনোমুগ্ধকর নেতারা বশ্যতা স্বীকারের বিনিময়ে মানুষকে রাজনৈতিক মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি সেই ধরনের নেতা থেকে নিজেদের প্রত্যাহারের জন্য মানুষকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। এছাড়া বাকের কখনোই বলতে চাননি যে, সম্মিলিত বিশ্লেষণ, গুরুতর কৌশল গঠন, সংগঠন, সংহতকরণ এবং সর্বসম্মতি তৈরি ব্যতিরেকে কোনো আন্দোলন স্বাভাবিকভাবেই উদ্ভূত হয়।
নতুন প্রজন্মের সংগঠনগুলোর মধ্যে অল্প কিছু উল্লেখযোগ্য নাম হলো: ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার, ড্রিম ডিফেন্ডার্স, ব্ল্যাক ইয়ুথ প্রজেক্ট হানড্রেড, জাস্টিস লিগ এনওয়াইসি এবং উই চার্জ জেনোসাইড। তারা নেতৃত্বের নতুন মডেল তৈরি করেছে।
নতুন প্রজন্মের সংগঠনগুলোর মধ্যে অল্প কিছু উল্লেখযোগ্য নাম হলো: ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার, ড্রিম ডিফেন্ডার্স, ব্ল্যাক ইয়ুথ প্রজেক্ট হানড্রেড, জাস্টিস লিগ এনওয়াইসি এবং উই চার্জ জেনোসাইড। তারা নেতৃত্বের নতুন মডেল তৈরি করেছে। একবিংশ শতাব্দীর র্যাডিক্যাল কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলনের কার্যকর বিকাশের জন্য অন্তর্দৃষ্টিমূলক কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদ যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা তারা স্বীকার করে। বিভিন্ন সর্বজনীন প্রকরণকে গোপনে গোপনে বর্ণ ও লিঙ্গের ভিত্তিতে বিভক্তকরণের বিষয়টি এই সংগঠনগুলো বুঝতে পারে। যেমন তারা বুঝতে পারে, যারা ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ স্লোগানের বিপরীতে ‘অল লাইভস’ স্লোগান দেয়, তারা আসলে এমন একটা কৌশলের আশ্রয় নেয় যার মাধ্যমে বর্ণবাদী সহিংসতার অবসান কেন জরুরি, তার বিশেষ বিশেষ কারণ অগ্রাহ্য করা হয়। কিছুদিন আগে ফার্গুসন থেকে প্রায় পাঁচ মাইল দূরে ফ্লোরিসান্টের একটি চার্চে হিলারি ক্লিনটন তার বক্তব্যে ‘অল লাইভস ম্যাটার’ স্লোগানটির ওপর জোর দেন। তিনি কি অনুধাবন করেন না, এ ধরনের সর্বজনীন ঘোষণা বর্ণবাদিতাকে সব সময় কোন মাত্রায় শক্তিশালী করে? বর্ণবাদের সঙ্গে জড়িত যে কোনো সমালোচনামূলক বিষয়ে আমাদের সর্বজনীনতার নেতিবাচক প্রভাব বুঝতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সর্বজনীন প্রকরণগুলো গোপনে গোপনে বর্ণবাদী। বর্ণবাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হলে সর্বজনীনতার প্রতারণার দিকটি উপলব্ধি করতে হবে। মূলত বর্ণের ক্ষেত্রে সাদা মানুষ এবং লিঙ্গের ক্ষেত্রে পুরুষের অস্তিত্ব প্রাধান্য পায়। আমি ভাবছি, হিলারি ক্লিনটন কি অল দ্য উইমেন আর হোয়াইট, অল দ্য ব্ল্যাক আর মেন, বাট সাম অব আস আর ব্রেভ বইটির সঙ্গে পরিচিত আছেন?
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সর্বজনীন প্রকরণগুলো গোপনে গোপনে বর্ণবাদী। বর্ণবাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হলে সর্বজনীনতার প্রতারণার দিকটি উপলব্ধি করতে হবে। মূলত বর্ণের ক্ষেত্রে সাদা মানুষ এবং লিঙ্গের ক্ষেত্রে পুরুষের অস্তিত্ব প্রাধান্য পায়।
যদি আসলেই সবার জীবন গুরুত্ব পেত তাহলে আমাদের জোরালোভাবে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ ঘোষণা করার দরকার পড়ত না। আমরা ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ ওয়েবসাইটে আবিষ্কার করলাম: ব্ল্যাক উইমেন ম্যাটার, ব্ল্যাক গার্লস ম্যাটার, ব্ল্যাক গে লাইভস ম্যাটার, ব্ল্যাক বাই লাইভস ম্যাটার, ব্ল্যাক বয়েজ লাইভস ম্যাটার, ব্ল্যাক কুইয়ার লাইভস ম্যাটার, ব্ল্যাক ম্যান লাইভস ম্যাটার, ব্ল্যাক লেসবিয়ান লাইভস ম্যাটার, ব্ল্যাক ট্রান্স লাইভস ম্যাটার, ব্ল্যাক ইমিগ্র্যান্টস লাইভস ম্যাটার, ব্ল্যাক ইনকারসেরেটেড লাইভস ম্যাটার, ব্ল্যাক ডিফারেন্টলি অ্যাবলড লাইভস ম্যাটার। হ্যাঁ, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার, ল্যাটিনো/এশিয়ান আমেরিকান/নেটিভ আমেরিকান/মুসলিম/দরিদ্র এবং শ্রমিকশ্রেণি শ্বেতাঙ্গদের জীবন গুরুত্বপূর্ণ। নীতিগত ও সুবিধাজনকভাবে দাবি হিসেবে অল লাইভস ম্যাটার (সবার জীবন গুরুত্বপূর্ণ) ব্যবহার করার আগে এমন আরও অনেক সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠীর নাম বলতে হবে।
এই প্রসঙ্গে আমি গতকাল দক্ষিণ ক্যারোলিনার চার্লসটনে রেভারেন্ড ক্লেমেন্টা পিঙ্কনেকের প্রতি চমৎকার স্তুতিকালে ওবামার উল্লিখিত একটি মন্তব্যের সমস্যা তুলে ধরতে চাই। তিনি উদ্দীপ্ত হয়ে বলেছিলেন: ‘আমরা যদি বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সফল হতে চাই তবে বর্ণবাদ সম্পর্কে আমাদের আরও কথোপকথনের প্রয়োজন না বলে বরং বলা উচিত আমাদের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। অবশ্যই আমাদের কথোপকনের চেয়ে বেশি কিছু করা প্রয়োজন। তবে আবশ্যিকভাবে আমাদেরকে জাতি এবং বর্ণবাদের ব্যাপারে কীভাবে কথা বলতে হবে, সেটা শিখতে হবে। যদি বর্ণবাদের ব্যাপারে আমরা অর্থপূর্ণভাবে কথা বলতে না পারি, তাহলে আমাদের গৃহীত যে কোনো পদক্ষেপ ভুল পথে চালিত হবে।’
জাতি ও বর্ণবাদ সম্পর্কে জন সংলাপের ডাক দেওয়ার অর্থ একইসঙ্গে নতুন এক ধরনের শব্দভান্ডার গড়ে তোলারও আহ্বান। যেন এর মাধ্যমে আমাদের সংলাপগুলো অর্থপূর্ণ হয়। যদি আমরা ঐতিহাসিকভাবে অপ্রচলিত শব্দভান্ডার ব্যবহার করার চেষ্টা করি, তবে বর্ণবাদ সম্পর্কে আমাদের সচেতনতা সংকীর্ণ থাকবে এবং আমরা সহজেই ভাবতে উদ্বুদ্ধ হব যে, শুধু আইনের পরিবর্তনগুলোই স্বতঃস্ফূর্তভাবে সামাজিক বিশ্বে কার্যকর পরিবর্তন আনতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, অনেকে মনে করেন যে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে আইনগতভাবে দাসত্ব বিলুপ্ত হওয়ার কারণে দাসত্ব ব্যাপারটি ইতিহাসের ডাস্টবিনে পতিত হয়েছে। তারা প্রকৃতপক্ষে বিদ্যমান দাসত্বের সাংস্কৃতিক এবং কাঠামোগত উপাদানের অস্তিত্বকে বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন। কারাগার-শিল্প কমপ্লেক্স থেকে দাসত্বের বিদ্যমানতার অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। অনেকে বিশ্বাস করেন, নাগরিক আন্দোলনের সম্পূর্ণ বিজয় হয়েছে। অথচ অনেক কৃষ্ণাঙ্গ, বিশেষ করে কারাবন্দি এবং সাবেক অপরাধীরা এখনো ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত। অধিকন্তু আগে ভোটাধিকারহীন ব্যক্তিরা যদিও বা এখন সেই অধিকার লাভ করেছে; কিন্তু তারা এখনো কর্মসংস্থান, শিক্ষা, বাসস্থান এবং স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
জাতিগত সমতা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর নাগরিক অধিকার আন্দোলন একটি আবশ্যকীয় মুহূর্ত ছিল। কিন্তু আমাদের সেই শব্দভান্ডার তৈরি করা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে আমরা অনুধাবন করতে পারি যে, নাগরিক অধিকার আন্দোলন একটি সম্পূর্ণ ব্যাপার ছিল না। তখনও ছিল না, এখনো নয়। বর্ণবাদের এই জাতীয় বিশ্লেষণ তাদের কাছেই আদৃত হবে যারা বিয়ের সমতা নিয়ে গতকাল সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে ঘিরে উদযাপন করছেন এবং ভাবছেন যে, এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের জন্য ন্যায়বিচারের চূড়ান্ত বাধাটি দূর হয়ে গেল। কোর্টের এই সিদ্ধান্ত অবশ্যই ঐতিহাসিক। কিন্তু আর্থিক অধিকার, স্বাস্থ্যসেবার অধিকার ইত্যাদি প্রসঙ্গে সমকামবিদ্বেষী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এখনো অব্যাহত আছে। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমরা ন্যায়বিচারের লড়াইয়ে কখনোই উল্লেখযোগ্য বিজয় অর্জন করতে পারব না, যদি বর্ণবাদ, হোমোফোবিয়া এবং ট্রান্সফোবিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্যে আন্তঃসংযোগ হ্রাস পায়। এটি আরও একটি কারণ, যার জন্য বর্ণবাদ সম্পর্কিত উপলব্ধিগুলোকে প্রকাশ করার জন্য আরও সমৃদ্ধ এবং সমালোচনামূলক শব্দভান্ডার বিকাশ করা জরুরি।
আমরা ন্যায়বিচারের লড়াইয়ে কখনোই উল্লেখযোগ্য বিজয় অর্জন করতে পারব না, যদি বর্ণবাদ, হোমোফোবিয়া এবং ট্রান্সফোবিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্যে আন্তঃসংযোগ হ্রাস পায়।
বর্ণবাদিতার জটিলতাগুলো বুঝতে সক্ষম না হলে, উদাহরণস্বরূপ, এমন একটা ধারণা তৈরি হতে পারে যে, কালোর প্রতি কালোর বৈষম্যের সঙ্গে বর্ণবাদের কোনো সম্পর্ক নেই। সুতরাং বর্ণবাদ সম্পর্কে চিন্তাভাবনার নতুন পদ্ধতির বিকাশের জন্য আমাদের শুধু বর্ণবাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং আদর্শিক কাঠামোই নয়, সম্মিলিত মানসিক কাঠামোও বোঝা দরকার। বর্ণবাদের সহিংসতার অন্যতম প্রধান উদাহরণ কৃষ্ণাঙ্গ প্রজন্মের লালন-পালনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত, যারা ভবিষ্যতের কল্পনা করতে শেখেনি–ভবিষ্যৎ কল্পনা করার মতো কোনো শিক্ষা ও কল্পনা-প্রতিভা তাদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। এই সন্ত্রাস অন্যান্য সন্ত্রাসের দিকে পরিচালিত করে–শিশুদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, সহকর্মীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, বন্ধুদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস… আমরা প্রায়শই অসচেতনভাবে আমাদের পরিবারে এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংসতাকে ব্যক্তিগত এবং স্বজাতির মনে করে প্রকৃতপক্ষে বর্ণবাদের বৃহত্তর শক্তির হয়েই কাজ করতে থাকি।
বর্ণবাদ সম্পর্কে, বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গ এবং অশ্বেতাঙ্গ নারীবাদের প্রসঙ্গে আরও জটিল বিশ্লেষণকে জনপ্রিয় করা সম্ভব হলে তা আমাদেরকে বুঝতে সহায়তা করতে পারে–আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ও আদর্শিক কাঠামোয় বর্ণবাদী সহিংসতা কতটা গভীরভাবে প্রোথিত। বর্ণবাদ সম্পর্কে কথা বলার এই পদ্ধতি আমাদের সংগ্রামকে বিশ্বব্যাপী পৌঁছতে সহায়তা করতে পারে। ফার্গুসনের বিক্ষোভে ফিলিস্তিনি-আমেরিকানদের সম্পৃক্ততা পশ্চিম তীর এবং গাজায় ফিলিস্তিনি কর্মীদের কাছ থেকে ফার্গুসনের প্রতি সংহতি প্রকাশের এক পরিপূরক প্রকাশ ছিল। ফার্গুসন সংগ্রাম আমাদের শিখিয়েছে, স্থানীয় সমস্যাগুলোর বৈশ্বিক প্রভাব রয়েছে। ফার্গুসন পুলিশের সামরিকীকরণ এবং টুইটে ফিলিস্তিনি নেতাদের পরামর্শ আমাদেরকে বর্জন, উচ্ছেদ এবং নিষেধাজ্ঞার আন্দোলনে এবং ফিলিস্তিনে ন্যায়বিচারের বৃহত্তর সংগ্রামের সঙ্গে রাজনৈতিক আত্মীয়তার স্বীকৃতি দিতে সহায়তা করেছে। অধিকন্তু আমরা ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর-এর পর বর্ণবাদের নতুন রূপের উত্থান হিসেবে ইসলামফোবিয়া যে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছে, তা বুঝতে পেরেছি।
নিরাপত্তাকে আমাদের নতুনভাবে কল্পনা করতে হবে, যার মধ্যে রয়েছে পুলিশি ও কারাব্যবস্থার বর্তমান রূপটির অবসান। আমরা বলব, পুলিশের বিসামরিকীকরণ করতে হবে, পুলিশকে নিরস্ত্রীকরণ করতে হবে, প্রচলিত পুলিশিব্যবস্থা বিলুপ্ত করতে হবে এবং শাস্তির প্রধান পদ্ধতি হিসেবে কারাবাসের ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সহিংসতা সম্পর্কে সত্য বলার স্রেফ শুরু হবে তখন।
বর্ণবাদী সহিংসতার গভীর উপলব্ধির মাধ্যমে প্রতারণামূলক সমাধানের হাত থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি। যখন বলা হয়, আমাদের আরও ভালো পুলিশ এবং আরও ভালো কারাগার প্রয়োজন, তখন তার বিপরীতে আমরা আমাদের আসল প্রয়োজন তুলে ধরতে পারি। নিরাপত্তাকে আমাদের নতুনভাবে কল্পনা করতে হবে, যার মধ্যে রয়েছে পুলিশি ও কারাব্যবস্থার বর্তমান রূপটির অবসান। আমরা বলব, পুলিশের বিসামরিকীকরণ করতে হবে, পুলিশকে নিরস্ত্রীকরণ করতে হবে, প্রচলিত পুলিশিব্যবস্থা বিলুপ্ত করতে হবে এবং শাস্তির প্রধান পদ্ধতি হিসেবে কারাবাসের ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সহিংসতা সম্পর্কে সত্য বলার স্রেফ শুরু হবে তখন।
—————————-
মিসৌরির সেন্ট লুইসে প্রদত্ত ভাষণ (২৭ জুন ২০১৫)
ফাতেমা বেগম: লেখক, অনুবাদক। কানাডা প্রবাসী ফিনান্সিয়াল কনসালট্যান্ট।
ইমেইল: fatemaorama@gmail.com
340