বাংলাদেশে বিভিন্ন দুর্ঘটনার কাঠামোগত ভিত্তি

বাংলাদেশে বিভিন্ন দুর্ঘটনার কাঠামোগত ভিত্তি

কল্লোল মোস্তফা

বাংলাদেশে ‘দুর্ঘটনা’য় মৃত্যু অবিরাম এবং অবাধ। প্রশ্ন হলো এসব অকালমৃত্যু কি দুর্ঘটনা নাকি কাঠামোগত হত্যাকান্ড? সড়ক-নৌ-রেল পথে, কর্মস্থলে, আগুনে পুড়ে, রাসায়নিক বিস্ফোরণে নানা ভাবে অসংখ্য মানুষ নিহত ও জখম হচ্ছে প্রতিবছর। এর প্রতিকারের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা কোনো সরকারের আমলেই দেখা যায় না। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর রুটিন অনুসারে এক বা একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেসব তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয় না। প্রকাশিত হলেও তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না। আবার তদন্তে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনেক ক্ষেত্রেই কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়না। দুর্ঘটনার কারণে বহু ক্ষেত্রে জীবন ও সম্পদহানির জন্য কোনো ক্ষতিপূরণও দিতে হয়না, জবাবদিহিও করতে হয় না। এসবের জন্য মন্ত্রীসহ রাজনৈতিক নেতাদের কোনো দায়দায়িত্ব নেবার প্রক্রিয়াও দেখা যায় না। একইরকম কারণ বিদ্যমান থাকায় একই ধরনের দুর্ঘটনা বারে বারে এবং আরও ভয়ংকরভাবে ঘটতে থাকে। বর্তমান প্রবন্ধে বার বার ঘটতে থাকা বিভিন্ন ধরনের ‘দুর্ঘটনা’র বিশ্লেষণ করে তার কাঠামোগত কারণগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

বিভিন্ন দুর্ঘটনার কার্যকারণ ব্যাখ্যার একটি জনপ্রিয় মডেল হলো “সুইস চিজ মডেল” (Swiss cheese model)। যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জেমস রিজন কর্তৃক তৈরি এই মডেলটি দুনিয়াজুড়ে বিমান যোগাযোগ, প্রকৌশল, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ইত্যাদি বিভিন্ন খাতের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় ব্যবহার করা হয়। সুইস চিজ মডেল অনুসারে যে কোনো দুর্ঘটনার উৎস (যেমন জ্বালানি) এবং অপ্রত্যাশিত ঘটনার (যেমন অগ্নিকাণ্ড) মাঝে অনেকগুলো প্রতিবন্ধকতা থাকে যে প্রতিবন্ধকতাগুলোকে চিজ বা পনিরের টুকরার সাথে তুলনা করে ব্যাখ্যা করা হয়। এই প্রতিবন্ধকতাগুলো সব সময় নিখুঁত থাকেনা, মানুষের ভুল কিংবা সিস্টেম বা ব্যবস্থার সমস্যার কারণে অনেক সময় প্রতিবন্ধকতাগুলোতে ছিদ্র তৈরি হয়। যে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবেই দুর্ঘটনা ঘটার পথে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয় এবং এই প্রতিবন্ধকতাগুলো যেন ঠিকঠাক কাজ করে, যেন প্রতিবন্ধকতাগুলোতে ছিদ্র তৈরি না হয় তার জন্য কতগুলো নিয়মকানুন, প্রসেস, প্রটোকল তৈরি করা হয়। অনেক সময় এই নিয়মকানুনগুলো মেনে না চলার কারণে বা ভুল ভাবে মানার কারণে প্রতিবন্ধকতাগুলোতে ছিদ্র তৈরি হয়।

সুইস চিজ মডেল, সূত্র: publishing.energyinst.org

মানুষের এইসব ভুলকাজ আপাত অর্থে দুর্ঘটনার কারণ (ইমিডিয়েট কজ) মনে হলেও সুইস চিজ মডেল এবং তা থেকে পরবর্তীতে ১৯৮০ এবং ১৯৯০ এর দশকে নেদারল্যান্ডের লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাজ্যের ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায় গড়ে উঠা “ট্রাইপড বেটা”( Tripod Beta) মডেল মনে করে মানুষের ভুল আচরণের পেছনে থাকে নানা রকম পূর্বশর্ত বা প্রিকন্ডিশান যেগুলো দুর্ঘটনার পেছনের প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। এইসব পূর্বশর্ত আবার বিভিন্ন পদ্ধতিগত ও সাংগঠনিক দুর্বলতার ফলাফল- যেগুলোকে বলা হয় দুর্ঘটনার অন্তর্নিহিত কারণ বা আন্ডারলাইয়িং কজ। এইসব কারণ পরিবেশে থাকা জীবাণুর মতো দীর্ঘদিন সুপ্ত থাকতে পারে। এই কারণগুলো কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, নীতিমালা, কার্যপদ্ধতি, ডিজাইন, প্রশিক্ষণ, নজরদারি, জবাবদিহিতা, সাংগঠনিক সংস্কৃতি ইত্যাদির মধ্যে নিহিত থাকে। এইসব ব্যবস্থাপনাগত, প্রক্রিয়াগত এবং সাংগঠনিক সংস্কৃতিগত সমস্যা সমাধান করতে অনেক সময় তুলনামূলক বেশি সময় ও অর্থ লাগে কিন্তু দুর্ঘটনা প্রতিরোধে তার ফলাফল হয় সুদূরপ্রসারী।

ব্যক্তির আচরণ যেভাবে প্রভাবিত হয়, সূত্র: publishing.energyinst.org
ট্রাইপড বেটা মডেল অনুসারে মানুষের ভুল আচরণের পেছনে থাকে নানা রকম পূর্বশর্ত বা প্রিকন্ডিশান যেগুলো আবার বিভিন্ন পদ্ধতিগত ও সাংগঠনিক দুর্বলতা বা আন্ডারলাইয়িং কজের ফলাফল, সূত্র: publishing.energyinst.org

কাজেই যে কোনো দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হলো দুর্ঘটনার পূর্বশর্ত ও অন্তর্নিহিত কারণগুলোকে নির্মূল করা, যেন দুর্ঘটনা ঘটতে না পারে। আর যদি কোনো কারণে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেই যায়, সেক্ষেত্রে  যথাযথ তদন্ত করে তার পেছনের কারণগুলোকে উন্মোচন করা এবং ভবিষ্যতে আর যেন এরকম দুর্ঘটনা ঘটতে না পারে তার জন্য যথাযথ সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেয়া। বাংলাদেশে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে- সড়ক-নৌ-রেল পথে, কর্মস্থলে, আগুনে পুড়ে, রাসায়নিক বিস্ফোরণে নানা ভাবে মানুষ নিহত ও জখম হয়, প্রাণ-প্রকৃতি বিপন্ন হয় কিন্তু সেইসব দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করার জন্য দুর্ঘটনার বিভিন্ন পূর্বশর্ত ও অন্তর্নিহিত কার্যকারণ সনাক্ত করে তা দূর করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয় না। দুর্ঘটনার পর রুটিন অনুসারে এক বা একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেসব তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয় না। প্রকাশিত হলেও তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না। তদন্তেও অনেক সময় বিভিন্ন ব্যক্তিগত-গোষ্ঠীগত স্বার্থে প্রকৃত ঘটনা উঠে আসে না, ফলে সমস্যার প্রকৃত সমাধান পাওয়া যায় না। আবার তদন্তে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনেক ক্ষেত্রেই কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়না। দুর্ঘটনার কারণে বহু ক্ষেত্রে জীবন ও সম্পদহানির জন্য কোনো ক্ষতিপূরণও দিতে হয়না, জবাবদিহিও করতে হয় না। এসব কারণে দেখা যায় একই ধরণের দুর্ঘটনা বার বার ঘটতে থাকে যা বাংলাদেশের বেশিরভাগ দুর্ঘটনার পেছনের কাঠামোগত পূর্বশর্তের প্রাধান্যের দিকটাই নির্দেশ করে। বর্তমান লেখায় বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে বার বার ঘটতে থাকা বিভিন্ন ধরণের দুর্ঘটনার বিশ্লেষণ করে এসব দুর্ঘটনার কাঠামোগত পুর্বশর্তগুলোকে উন্মোচন করার চেষ্টা করা হয়েছে।

যে কোনো দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হলো দুর্ঘটনার পূর্বশর্ত ও অন্তর্নিহিত কারণগুলোকে নির্মূল করা, যেন দুর্ঘটনা ঘটতে না পারে। আর যদি কোনো কারণে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেই যায়, সেক্ষেত্রে  যথাযথ তদন্ত করে তার পেছনের কারণগুলোকে উন্মোচন করা এবং ভবিষ্যতে আর যেন এরকম দুর্ঘটনা ঘটতে না পারে তার জন্য যথাযথ সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেয়া।

১। সড়ক দুর্ঘটনা

সড়ক মহাসড়কে মানুষের নিয়মিত মৃত্যু এখন “স্বাভাবিক” ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন আমরা সড়ক মহাসড়কে বহু মানুষের আহত-নিহত হওয়ার খবর শুনি এবং তারপর ভুলে যাই। কিছু সংস্থা অবশ্য সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত মানুষের হিসাব রাখে, ফলে বছর শেষে এই মানুষেরা সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানে পরিণত হন। এভাবে আমরা জানতে পারি ২০১৯ সালে যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেবে সড়ক দুঘটনায় নিহত হয়েছে ৭ হাজার ৮৫৫ জন এবং নিরাপদ সড়ক চাই(নিসচা) এর হিসেবে ৫ হাজার ২২৭ জন।সড়ক মহাসড়কে অকালে আহত/নিহত হওয়া এই মানুষগুলো শুধুই সংখ্যা হয়ে যায়- পরিসংখ্যানের আড়ালে হারিয়ে যায় এক একজন রক্ত মাংসের মানুষের স্বপ্ন কল্পনা, এক একটি পরিবারের আশা আকাঙ্ক্ষা।

২০১৯ সালে যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেবে সড়ক দুঘটনায় নিহত হয়েছে ৭ হাজার ৮৫৫ জন এবং নিরাপদ সড়ক চাই(নিসচা) এর হিসেবে ৫ হাজার ২২৭ জন।সড়ক মহাসড়কে অকালে আহত/নিহত হওয়া এই মানুষগুলো শুধুই সংখ্যা হয়ে যায়- পরিসংখ্যানের আড়ালে হারিয়ে যায় এক একজন রক্ত মাংসের মানুষের স্বপ্ন কল্পনা, এক একটি পরিবারের আশা আকাঙ্ক্ষা।

২০১৯ সালে বিভিন্ন ধরণের সড়ক দুর্ঘটনার ছবি, ডেইলিস্টার ৪ জানুয়ারি ২০২০

আভিধানিক সংজ্ঞা অনুসারে দুর্ঘটনা হলো একটি অদৃষ্টপূর্ব, অকল্পনীয় এবং আকস্মিক ঘটনা। কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু ঘটনা যখন একইরকম কারণে বার বার ঘটতে থাকে, যে কারণগুলো ব্যবস্থা বা কাঠামোর সাথে সংযুক্ত,  তখন সেগুলো আর আকস্মিক বা অদৃষ্টপূর্ব থাকেনা, ফলে সেগুলো আর সাধারণ দুর্ঘটনা থাকেনা, হয়ে উঠে ব্যবস্থাপনাগত বা কাঠামোগত অবহেলার ফল। বাংলাদেশের সড়ক মহাসড়কে প্রতিদিন নিয়মিতভাবে যেসব ঘটনায় বহু মানুষ আহত নিহত হচ্ছেন সেসব ঘটনা বিভিন্ন ব্যক্তির খেয়ালখুশির কারণে ঘটছে নাকি যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার কাঠামোর ধরণ ও তার বিভিন্ন অন্তর্গত সমস্যার কারণেই ঘটছে তার বিশ্লেষণ করলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে এসব ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা বলা যাবে কিনা।

সড়ক পথে নিরাপদ যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থার অপরিহার্য উপাদান হলো: ত্রুটিমুক্ত যথাযথ ডিজাইনের সড়ক মহাসড়ক, ত্রুটিমুক্ত যানবাহন, লাইসেন্সধারী দক্ষ চালক, চালক ও হেলপারদের যথাযথ মজুরি ও কর্মপরিবেশ, পরিবহন মালিক ও পরিবহন কোম্পানিগুলোকে আইন মানতে বাধ্য করতে সক্ষম নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইত্যাদি। এর কোনো একটির অনুপস্থিতিতেই যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থা অনিরাপদ হয়ে উঠতে বাধ্য। চলুন দেখা যাক বাংলাদেশের যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থায় নিরাপদ যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থার অপরিহার্য শর্তগুলোর বাস্তব পরিস্থিতি কী এবং সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে এসব শর্তের ভূমিকাই বা কেমন।

সূত্র: প্রথম আলো, ২১ অক্টোবর ২০১৮

১.১। যানবাহনের ফিটনেস: সড়ক মহাসড়কে যথাযথ ফিটনেস ছাড়া যানবাহন চলাচল করলে দুর্ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক। একারণেই যানবাহনের নিয়মিত ফিটনেস পরীক্ষা করে সনদ হালনাগাদ রাখা সড়ক নিরাপত্তার একটা অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। কিন্তু বাংলাদেশে সড়ক মহাসড়কগুলোতে ফিটনেস ছাড়াই চলছে অসংখ্য যানবাহন যা সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর একটা বড় কারণ। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) কর্তৃক ফেব্রুয়ারি ২০১৯ এ হাইকোর্টে দাখিল করা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন সড়কে চলাচলকারী ৩৩ শতাংশ যাত্রীবাহী বাসের ফিটনেস সার্টিফিকেট এবং ৫৬ শতাংশ বাসের গতি নিয়ন্ত্রক সার্টিফিকেট নেই। আর বিআরটিএ’র জুলাই ২০১৯ এ হাইকোর্টে দাখিল করা প্রতিবেদন অনুসারে, সারা দেশে ফিটনেস নবায়ন ছাড়াই ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৩২০টি যান চলাচল করছে।

দেশের বিভিন্ন সড়কে চলাচলকারী ৩৩ শতাংশ যাত্রীবাহী বাসের ফিটনেস সার্টিফিকেট এবং ৫৬ শতাংশ বাসের গতি নিয়ন্ত্রক সার্টিফিকেট নেই। আর বিআরটিএ’র জুলাই ২০১৯ এ হাইকোর্টে দাখিল করা প্রতিবেদন অনুসারে, সারা দেশে ফিটনেস নবায়ন ছাড়াই ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৩২০টি যান চলাচল করছে।

আবার যেসব গাড়ির ফিটনেস সনদ রয়েছে সেগুলোর ফিটনেস কার্যত রয়েছে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। কারণ ফিটনেস প্রদানকারী সংস্থা বিআরটিএর রয়েছে লোকবল সংকট ও উপযুক্ত যন্ত্রপাতির অভাব। মোটরযান আইনে যানবাহনের ফিটনেস দেওয়ার আগে ৬০ ধরনের কারিগরি ও যানের বাহ্যিক দিক বিবেচনা করতে হয় যার অনেকগুলোই খালি চোখে দেখে দেওয়া সম্ভব নয়। অথচ সারা দেশে খালি চোখে, অনেক সময় যানবাহন না দেখেই ফিটনেস সনদ দেওয়ার অভিযোগ আছে।  উদাহরণ স্বরূপ, গড়ে প্রতিদিন হাজারখানেক গাড়ি মিরপুরে আসে ফিটনেস সনদ হালনাগাদ করাতে। ১০ জন পরিদর্শক তা যাচাই করেন। একজন পরিদর্শক গাড়ি পরিদর্শনে সময় পান এক মিনিটেরও কম। বাকি সময় যায় গাড়ির কাগজ যাচাইয়ে। এভাবে একজন মানুষের পক্ষে একদিনে ১০০টি গাড়ি ভালভাবে যাচাই করা সম্ভব নয়। মিরপুর ছাড়া বিআরটিএর আর কোনো সার্কেলে ডিজিটাল ভেহিকল ইন্সপেকশন সেন্টার (ডিভিআইসি) নেই। তাই কার্যত চোখে দেখে ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়। মিরপুরে ডিভিআইসিতে ঘণ্টায় ১৫টি গাড়ির ফিটনেস যাচাই করা যায়। এ হিসাবে দিনে সর্বোচ্চ ১২০টি যানবাহন পরীক্ষা করা সম্ভব। প্রতিদিন ফিটনেস হালনাগাদ করতে আসা হাজারো গাড়ির বাকিগুলো চোখের দেখাতেই সনদ পায়।

গড়ে প্রতিদিন হাজারখানেক গাড়ি মিরপুরে আসে ফিটনেস সনদ হালনাগাদ করাতে। ১০ জন পরিদর্শক তা যাচাই করেন। একজন পরিদর্শক গাড়ি পরিদর্শনে সময় পান এক মিনিটেরও কম।

ফিটনেসবিহীন বাস রং মেখে হচ্ছে ‘ফিট’, ১৩ মে ২০১৯, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

১.২। সড়কের ত্রুটি: ২০১১ সালে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে ৫১৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯৬ জন মারা যান, যাঁদের মধ্যে ছিলেন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর। আহত হন ৪২১ জন। বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. শামসুল হক ২০১১ সালের ১৩ আগস্টের যে সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ নিহত হয়েছিলেন সেই দুর্ঘটনার কার্যকারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন:

“যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেখানকার রাস্তার বাঁকও ছিল অবৈজ্ঞানিক ৷ ১১ ফুট প্রশস্ত ওই রাস্তায় কোনো বাঁক থাকলে রাস্তার বক্রতার ধরন অনুসারে অংশটি অন্তত ১৩ ফুট চওড়া হওয়ার কথা ছিল৷ বাস্তবে যা ছিল না৷ একইসঙ্গে বাঁকটিতে গাছপালা থাকায় দৃষ্টিসীমা ছিল একদম কম৷ ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যেসব ব্ল্যাকস্পট ছিল, এই বাঁকটি তার একটি৷ মানিকগঞ্জের জোকায় তখন প্রতি বছর তিনটির বেশি করে দুর্ঘটনা ঘটছিল৷ এখন সেখানে ডিভাইডার করা হয়েছে, রাস্তা চওড়া হয়েছে, ফলে এখন আর সেখানে দুর্ঘটনা হচ্ছে না৷”

তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মৃত্যুর পর ওই মহাসড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ বাঁকগুলো সংস্কার করা হয়। ফলে পরের বছর ২০১২ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা কমে হয় ১৪১, এসব দুর্ঘটনায় ৩৯ জন নিহত ও ১১০ জন আহত হন।ফলে সড়ক মহাসড়কের নির্মাণ-প্রকৌশলগত ত্রুটির কারণে যে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে এবং সেইসব ত্রুটি দূর করার মধ্য দিয়ে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি যে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব, তা বাস্তবে প্রমাণিত।

আগস্ট ২০১৪ তে প্রথম আলোয় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা ইনস্টিটিউট সারা দেশের মোট তিন হাজার ৫৮০ কিলোমিটার মহাসড়কে ২০৯টি স্থানকে অতি-দুর্ঘটনাপ্রবণ ‘ব্ল্যাক স্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করে। মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩৫ শতাংশ এবং মোট মৃত্যুর ৯০ শতাংশ ঘটে এই স্থানগুলোতে। এই ‘ব্ল্যাক স্পট’গুলো ছড়িয়ে আছে মোট মহাসড়কের মাত্র ৫৫ কিলোমিটার জুড়ে। এগুলোতে রয়েছে সরু বাঁক ও নির্মাণ প্রকৌশলগত অন্যান্য ত্রুটি। আবার বেশ কিছু স্থানে রয়েছে অবৈধ হাটবাজার, বাসস্ট্যান্ড ও অন্যান্য স্থাপনা, যেখানে লোকসমাগম ঘটে, কিন্তু ট্রাফিক ব্যবস্থা নেই।১০ কিন্তু সড়কের ত্রুটি চিহ্নিত হওয়ার পরেও সেগুলো সময়মতো সংশোধন করা হয় না, সংশোধন যেগুলো করা হয় সেগুলোতেও ত্রুটি থেকে যায়। যেকারণে ৬ বছর পর ৭ মার্চ ২০২০ তারিখে প্রথম আলোর রিপোর্ট থেকে দেখা যায় সরকার ১৬৭ বাঁক সোজা করেছে। তবে সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সিটিটিউট বড় দুর্ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে দেখেছে সড়কে ত্রুটি আছে।১১

সারা দেশের মোট তিন হাজার ৫৮০ কিলোমিটার মহাসড়কে ২০৯টি স্থানকে অতি-দুর্ঘটনাপ্রবণ ‘ব্ল্যাক স্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করে। মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩৫ শতাংশ এবং মোট মৃত্যুর ৯০ শতাংশ ঘটে এই স্থানগুলোতে। এই ‘ব্ল্যাক স্পট’গুলো ছড়িয়ে আছে মোট মহাসড়কের মাত্র ৫৫ কিলোমিটার জুড়ে।

আবার, ২০১২ সালে এশিয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে চালানো জরিপের মাধ্যমে ৩০০ কিলোমিটার সড়ক মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে ১৪৬ কিলোমিটার সড়কে ঝুঁকি কমাতে বাঁক সোজাকরণ, সড়ক প্রশস্ত করাসহ নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে প্রকাশিত খবর অনুসারে তখনো ১৫৪ কিলোমিটার সড়ক মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে।১২ আবার সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের(সওজ) নিজস্ব জরিপ অনুসারে, ৬২ শতাংশ জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে যথাযথ সাইন-সংকেত নেই।১৩

এখন চিহ্নিত হওয়ার পরেও বিপজনক সরু বাঁক, নির্মাণ প্রকৌশলগত ত্রুটি ও যথাযথ সাইন-সংকেতবিহীন সড়ক মহাসড়কে যেসব দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে সেগুলো কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড ছাড়া আর কিছুই নয়।

সূত্র: প্রথম আলো, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

১.৩। চালকের লাইসেন্স:  নিরাপদ সড়কের জন্য জরুরি হলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ চালক। বাংলাদেশের চালকদের প্রশিক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই “ওস্তাদের” কাছ থেকে ব্যক্তিগত ভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে হেলপার থেকে চালকে উন্নীত হন চালকেরা। আবার চালকের দক্ষতা অনুযায়ী ভারী ও হালকা যানবাহনের লাইসেন্স প্রদানের ব্যবস্থাও দুর্নীতি মুক্ত নয়। সংবাদ মাধ্যমে বিআরটিএ সূত্রে প্রকাশিত হিসেব অনুসারে বিভিন্ন শ্রেণির যানবাহনের জন্য চালক লাইসেন্স আছে প্রায় ২৮ লাখ। এর মধ্যে একই লাইসেন্সে একজন ব্যক্তি মোটরসাইকেল ও অন্য যানবাহন চালান। এদের বাদ দিলে চালকের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ২০ লাখ। সারা দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৩৮ লাখ। অর্থাৎ ১৮ লাখ যানবাহন ‘ভুয়া’ চালক দিয়ে চলছে। আবার চালকের লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন, প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ স্কুলের অনুমোদন, সচেতনতা বৃদ্ধি এসব করার দায়িত্ব বিআরটিএর। অথচ সংস্থাটির জনবল মাত্র ৬৮৯ জন। ফলে বিআরটিএর পক্ষে লিখিত, মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষা যথাযথভাবে নেওয়া সম্ভব হয় না। অনেক জেলা কার্যালয়ে পরীক্ষা নেওয়ার জায়গাও নেই। ফলে মানুষ দালাল ধরে কোনোরকমে লাইসেন্স পাচ্ছে।১৪

বিভিন্ন শ্রেণির যানবাহনের জন্য চালক লাইসেন্স আছে প্রায় ২৮ লাখ। এর মধ্যে একই লাইসেন্সে একজন ব্যক্তি মোটরসাইকেল ও অন্য যানবাহন চালান। এদের বাদ দিলে চালকের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ২০ লাখ। সারা দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৩৮ লাখ।

আবার বাস, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের মতো ভারী যানবাহন চালানোর জন্য যতজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লাইসেন্সধারী চালক প্রয়োজন, চালকের সংখ্যা তার তুলনায় কম হওয়ার কারণেও নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব অনুসারে, ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ ২৯ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান জড়িত। আর প্রায় ১৯ শতাংশ ঘটেছে বাস-মিনিবাসের কারণে। অর্থাৎ সড়ক দুর্ঘটনার ৪৮ শতাংশের সঙ্গেই বাস, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান জড়িত। বিআরটিএর তথ্য বলছে, দেশে ভারী যানবাহন আছে ২ লাখ ৫২ হাজার। এসব যানবাহনের বিপরীতে বৈধ লাইসেন্স আছে এমন চালকের সংখ্যা ১ লাখ ৫৫ হাজার। অর্থাৎ ৩৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ যানবাহন চলছে ভুয়া চালক দিয়ে। ভারী যানবাহনের চালকের সংকটের কারণে আট ঘণ্টার বেশি যানবাহন চালাতে না দেওয়ার যে আইনি বাধ্যবাধকতা আছে, তা মানা হয় না। প্রতি পাঁচ ঘণ্টা পর বিশ্রামের যে বিধান, তা–ও কাগজপত্রেই সীমাবদ্ধ। সংকটের কারণে যানবাহনের মালিক লাইসেন্সবিহীন চালকের হাতে নিজের যান তুলে দেন। আবার কম মজুরিতে চালক পেতে অনেকে হালকা যানের চালক দিয়ে ভারী যান পরিচালনা করেন। ভারী যানবাহনের মালিকদের একটি বড় অংশই ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মী। মালিক শ্রমিক সংগঠনগুলোও নিয়ন্ত্রণ করেন ক্ষমতাসীন নেতারা। যেমন বাসমালিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান। তিনি জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রতিমন্ত্রী। সংগঠনটির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের দক্ষিণ শাখার সহসভাপতি। শ্রমিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি হলেন আওয়ামী লীগের সাংসদ ও সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান।১৫

ভারী যানবাহনের মালিকদের একটি বড় অংশই ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মী। মালিক শ্রমিক সংগঠনগুলোও নিয়ন্ত্রণ করেন ক্ষমতাসীন নেতারা। যেমন বাসমালিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান। তিনি জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রতিমন্ত্রী। সংগঠনটির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের দক্ষিণ শাখার সহসভাপতি। শ্রমিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি হলেন আওয়ামী লীগের সাংসদ ও সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান।

১.৪। বেপরোয়া চালনা: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) গবেষণা অনুসারে, দেশে ৩৭ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে।১৬ কিন্তু প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের চালকরা বেপরোয়া চালান কেন? এটা কি চালকদের ব্যক্তিগত চারিত্রিক সমস্যা নাকি এর পেছনে কোনো কাঠামোগত সমস্যা রয়েছে? এর উত্তর খুঁজতে হলে দেখতে হবে বহু মানুষের জীবন ও নিরাপত্তা যেই ব্যক্তির আচরণের উপর নির্ভর করে, তার নিজের জীবন ও জীবিকার কোনো নিরাপত্তা আছে কিনা। বাস্তবতা হলো বাসের চালক, হেলপারসহ পরিবহন শ্রমিকদের কোনো নিয়োগপত্র দেয়া হয় না, তাদের ন্যূনতম মজুরি ও সর্বোচ্চ কর্মঘণ্টা সুনির্দিষ্ট নয়। চালকের মজুরি দেয়া হয় ট্রিপ ভিত্তিতে অর্থাৎ তারা যত বেশি দ্রুত চালিয়ে যত বেশি ট্রিপ শেষ করবেন তত বেশি আয় করবেন। সড়ক পরিবহন আইনে একটানা ৫ ঘণ্টা এবং দিনে ৮ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাতে না দেয়ার বিধান থাকলেও তা মানা হয় না। একই চালককে দিয়ে মালিকরা আপ-ডাউন করায়, মাঝখানে তেমন একটা বিশ্রাম না দিয়েই। একটানা আট/দশ ঘণ্টা বাস চালিয়ে মাঝখানে কোনো ঘুম বা বিশ্রাম না পেয়ে কোনো চালককে যদি আবার আট/দশ ঘণ্টা বাস চালিয়ে ফিরে আসতে হয়, তাহলে যত দক্ষ তিনি হোন না কেন, ক্লান্তিতে তার ভুল হবেই, বেপরোয়া চালিয়ে দ্রুত ফেরার প্রবণতা কাজ করবেই। তাছাড়া যানজটের মহাসড়কে ফাঁকা স্থানে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে সময় পুষিয়ে নেয়ার চাপ তো আছেই। কিন্তু এইসব সমস্যার সমাধান করতে গেলে চালক হেলপারসহ পরিবহন শ্রমিকদের স্থায়ী ভাবে নিয়োগ দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের সমস্ত অধিকার প্রদান করতে হবে, মাসিক ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করতে হবে, পরিবহন কোম্পানিগুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যক চালক নিয়োগ দিতে হবে, চালকের বিশ্রামের জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে যা শেষ পর্যন্ত পরিবহন মালিকদের অবাধ মুনাফা আহরণে বাধা তৈরি করবে। এই সব ন্যূনতম শ্রম অধিকার নিশ্চিত না করে বেপরোয়া চালনার দায় স্রেফ ব্যক্তি চালকের উপর চাপানোর অর্থ কাঠামো ও ব্যবস্থার দায় ব্যক্তির উপর চাপিয়ে সমস্যা সমাধানের পথ রুদ্ধ করা।

বাসের চালক, হেলপারসহ পরিবহন শ্রমিকদের কোনো নিয়োগপত্র দেয়া হয় না, তাদের ন্যূনতম মজুরি ও সর্বোচ্চ কর্মঘণ্টা সুনির্দিষ্ট নয়। চালকের মজুরি দেয়া হয় ট্রিপ ভিত্তিতে অর্থাৎ তারা যত বেশি দ্রুত চালিয়ে যত বেশি ট্রিপ শেষ করবেন তত বেশি আয় করবেন। সড়ক পরিবহন আইনে একটানা ৫ ঘণ্টা এবং দিনে ৮ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাতে না দেয়ার বিধান থাকলেও তা মানা হয় না। একই চালককে দিয়ে মালিকরা আপ-ডাউন করায়, মাঝখানে তেমন একটা বিশ্রাম না দিয়েই। একটানা আট/দশ ঘণ্টা বাস চালিয়ে মাঝখানে কোনো ঘুম বা বিশ্রাম না পেয়ে কোনো চালককে যদি আবার আট/দশ ঘণ্টা বাস চালিয়ে ফিরে আসতে হয়, তাহলে যত দক্ষ তিনি হোন না কেন, ক্লান্তিতে তার ভুল হবেই, বেপরোয়া চালিয়ে দ্রুত ফেরার প্রবণতা কাজ করবেই।

বাংলাদেশে এমন একটি সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে যেখানে লাইসেন্স বিহীন চালকের স্বার্থ ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির মালিকের স্বার্থ একসূত্রে গাঁথা। চাঁদাবাজ মালিক সমিতি ও দালাল শ্রমিক ফেডারেশন পরস্পরের স্বার্থের পাহারাদার। প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স পাওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন পর্যাপ্ত ও সহজলভ্য না হওয়ার কারণে বহু চালকেরই লাইসেন্স নাই। ফলে মালিকের দয়া, মালিক সমিতি ও দালাল শ্রমিক ফেডারেশনের প্রটেকশানের উপর সে নির্ভরশীল, এমনকি লাইসেন্স নিতে হলেও এদের উপর তাকে নির্ভর করতে হয়। সহকারী নির্ভরশীল ওস্তাদের উপর, তার কাছ থেকেই তো তাকে ওস্তাদ হওয়ার প্রশিক্ষণ নিতে হবে। মাসিক ন্যূনতম মজুরির ব্যবস্থা না থাকলেও, মালিক চালককে ট্রিপ প্রতি যে মজুরি দেয় তা জীবন ধারণের জন্য পর্যাপ্ত না হলেও, মালিক সমিতি ও দালাল শ্রমিক সমিতির প্রটেকশানের উপর নির্ভরশীল বলে তার পক্ষে মজুরি নিয়ে আন্দোলন করা সম্ভব হয় না, বাড়তি যাত্রী তুলে আর বেশি বেশি ট্রিপ মেরে তাকে পুষিয়ে নিতে হয়। আর ইজারা দেয়া হলে একদিকে মালিকের আয় নিশ্চিত, মজুরি কিংবা অন্যান্য খরচ নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। অন্যদিকে চালক ও সহকারি মরিয়া হয়ে বেশি ট্রিপ মারে আর বাড়তি যাত্রী তুলে ইজারা আর চাঁদার টাকাসহ নিজেদের আয়ের জন্য। মালিক শ্রেণির জন্য এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা আর কী হতে পারে? বাসের ফিটনেসের পেছনে খরচ করতে হচ্ছেনা, মালিকদের জন্য সাধারণত সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় যে মজুরি, তা নিয়েও কোনো শ্রমিক আন্দোলনের মুখে পড়তে হচ্ছে না। রুট পারমিট পাওয়ার জন্য ভাল বাস ও দক্ষ জনবলের পেছনে বিনিয়োগও করতে হয় না, জায়গা মতো চাঁদা দিলেই চলে। এদিকে রুট পারমিট বরাদ্দ কিংবা ফিটনেসবিহীন বাস চালানোর অনুমতির বিনিময়ে ঘুষ কিংবা চাঁদার ভাগ বিআরটিএর কর্মকর্তা কিংবা ট্রাফিক পুলিশ থেকে শুরু করে উপরমহলের কমবেশি সবারই জোটে।

বাংলাদেশে এমন একটি সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে যেখানে লাইসেন্স বিহীন চালকের স্বার্থ ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির মালিকের স্বার্থ একসূত্রে গাঁথা। চাঁদাবাজ মালিক সমিতি ও দালাল শ্রমিক ফেডারেশন পরস্পরের স্বার্থের পাহারাদার।

২। নৌ পথে দুর্ঘটনা

বাংলাদেশ সরকারের নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে ১৯৯১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৬০৮টি নৌ দুর্ঘটনা ঘটে যেসব দুর্ঘটনায় মারা যান ৩ হাজার মানুষ। এদের মধ্যে লঞ্চের যাত্রী এক হাজার ৭৮১ জন।১৭ আর বেসরকারি সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে ছোট-বড় মিলিয়ে ৬৫৩টি লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটেছে যেসব দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৬,৪০৮।১৮ অন্যদিকে নদী নিরাপত্তা বিষয়ক সামাজিক সংগঠন নোঙরের হিসাব অনুযায়ী ২০০৫ থেকে ২০১৯ এই ১৪ বছরে ৫৩৫টি বড় নৌ দুর্ঘটনায় ৬ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে আর এসব দুর্ঘটনা তদন্তে ৮৬৩টি কমিটি গঠন করা হয়েছে।১৯ এসব তদন্ত কমিটির খুব কম রিপোর্টই আলোর মুখ দেখেছে। এর মধ্যে একটি ব্যতিক্রম হলো এমভি বিপাশা নামক লঞ্চ দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট। ২০১১ সালের ২১ এপ্রিল ভৈরব-সাচনা-সুনামগঞ্জ রুটে চলাচলরত এমভি বিপাশা নামক একটি লঞ্চ ভৈরব হতে যাত্রী ও মালামাল নিয়ে সাচনা যাবার পথে মেঘনা নদীতে অন্য একটি নিমজ্জিত কার্গো জাহাজের সাথে ধাক্কা লেগে ডুবে যায়, প্রাণ যায় ২৮ জন যাত্রীর।২০ এই দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্টটি বিআইডব্লিউটিএর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। রিপোর্টটিতে এমভি বিপাশা লঞ্চ দুর্ঘটনার কারণ যেমন তুলে ধরা হয়, তেমনি ভবিষ্যতে এ ধরণের দুর্ঘটনা যেন না ঘটে সে জন্য অনেকগুলো সুপারিশও করা হয়। নৌ পথে দুর্ঘটনার পেছনে কাঠামোগত অব্যবস্থাপনা কতটা দায়ী তা বোঝার জন্য এই রিপোর্টে উল্লেখকৃত দুর্ঘটনার কারণগুলো খতিয়ে দেখা দরকার, সেই সাথে দেখা দরকার তদন্ত রিপোর্টটিতে প্রতিকারের যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল সেগুলো কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে এবং পরবর্তীতে ঘটা বিভিন্ন দুর্ঘটনার পেছনে এমভি বিপাশার তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখকৃত কারণগুলো ক্রিয়াশিল কিনা।

২০০৫ থেকে ২০১৯ এই ১৪ বছরে ৫৩৫টি বড় নৌ দুর্ঘটনায় ৬ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে আর এসব দুর্ঘটনা তদন্তে ৮৬৩টি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

ছবি: এমভি বিপাশা নামের লঞ্চডুবিতে নিহত যাত্রীর স্বজনের কান্না, প্রথম আলো, ২২ এপ্রিল ২০১১

২.১। রাতে ও কুয়াশায় চলাচলে অনুপযুক্ত নৌপথ ও নৌযান: বাংলাদেশের নৌপথে যত দুর্ঘটনা ঘটে তার দুই তৃতীয়াংশই দুটো নৌযানের মধ্যে সংঘর্ষের কারণে ঘটে। এই বেশিরভাগ সংঘর্ষই ঘটে রাতে বা শীতকালে কুয়াশার মধ্যে যখন দৃষ্টিসীমা থাকে সীমিত।২১ সড়ক বা রেলপথের চেয়ে অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত নেভিগেশন চ্যানেলের নদী পথে নৌযানগুলোর পরস্পরের সাথে সংঘর্ষের বিষয়টি এমনিতে খুব অস্বাভাবিক। কিন্তু নদী শুকিয়ে নাব্যতা কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে রাত্রিকালীন নৌ চলাচলের জন্য যদি নৌ-রুটে রাত্রিকালীন নৌ-চলাচল সহায়ক যন্ত্রপাতি না থাকে, যদি নৌপথে স্থানে স্থানে অচিহ্নিত ডুবোচর থাকে কিংবা নৌযানগুলোতে যদি রাতে এবং কুয়াশার মধ‌্যে চলাচলের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সরঞ্জাম না থাকে তাহলে এই অস্বাভাবিক ব্যাপারটিই স্বাভাবিক ও নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়।

সড়ক বা রেলপথের চেয়ে অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত নেভিগেশন চ্যানেলের নদী পথে নৌযানগুলোর পরস্পরের সাথে সংঘর্ষের বিষয়টি এমনিতে খুব অস্বাভাবিক। কিন্তু নদী শুকিয়ে নাব্যতা কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে রাত্রিকালীন নৌ চলাচলের জন্য যদি নৌ-রুটে রাত্রিকালীন নৌ-চলাচল সহায়ক যন্ত্রপাতি না থাকে, যদি নৌপথে স্থানে স্থানে অচিহ্নিত ডুবোচর থাকে কিংবা নৌযানগুলোতে যদি রাতে এবং কুয়াশার মধ‌্যে চলাচলের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সরঞ্জাম না থাকে তাহলে এই অস্বাভাবিক ব্যাপারটিই স্বাভাবিক ও নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়।

২০১১ সালে এমভি বিপাশার দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে সরকারি তদন্ত রিপোর্টটিতে রাত্রিকালীন নৌ-চলাচল সহায়ক যন্ত্রপাতি না থাকা এবং তা স্বত্ত্বেও বিপুল সংখ্যক রুটে রাতে লঞ্চ চলাচলের অনুমোদন দেয়ার ঘটনাকে দায়ী করা হয় যা সুস্পষ্ট ভাবেই কাঠামোগত সমস্যা:

”…ভৈরব-সাচনা-সুনামগঞ্জ নৌ-রুটে রাত্রিকালীন নৌ-চলাচল সহায়ক যন্ত্রপাতি নেই। বিআইডব্লিউটিএ হতে প্রাপ্ত তথ্য হতে দেখা যায় যে, বিগত ৩০ বৎসরেরও অধিককাল যাবৎ ভৈরব-সাচনা-সুনামগঞ্জ রুটসহ বিপুলসংখ্যক রুটে রাত্রিকালীন নৌ-সহায়ক যন্ত্রপাতি না থাকলেও রুট পারমিট প্রদান অব্যাহত আছে। রাত্রিকালীন নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা নিরাপদ রাখার স্বার্থে নৌ-সহায়ক যন্ত্রপাতির আবশ্যকতা রয়েছে। তাছাড়াও বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগ সুদীর্ঘকাল যাবৎ রুট পারমিট জারি করছে এবং অন্যদিকে বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ-সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগ নদী বিজ্ঞপ্তি দ্বারা রাত্রিকালীন চলাচল ব্যাহত করছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় বর্তমানে বিপুল সংখ্যক রুটে রাতে চলাচল উপযোগী নৌ-সহায়ক যন্ত্রপাতি না থাকলেও সুদীর্ঘকাল যাবৎ রুট পারমিট নিয়ে লঞ্চ চলাচল অব্যাহত আছে এবং এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে কখনও কেউ আমলে আনে নি। এতে সুষ্পষ্টই প্রতীয়মাণ হচ্ছে যে, বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ-সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগ এবং নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগ-এর কাজের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। তাছাড়া প্রদত্ত রুট পারমিট বিবেচনায় জারিকৃত নৌ-বিজ্ঞপ্তির অসম্পূর্ণতা রয়েছে।”

২০১১ সালে চিহ্নিত এইসব কঠামোগত সমস্যার কি সমাধান হয়েছে?

বিভিন্ন সময়কার লঞ্চ দুর্ঘটনা ও সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকে এসব কাঠামোগত সমস্যা সমাধানের কোনো দৃষ্টান্ত মেলে না। সংবাদপত্রে প্রায়ই ডুবোচরে লঞ্চ আটকে পরা, আটকে পড়া লঞ্চের সাথে অন্য লঞ্চের সংঘর্ষ, নৌপথে পর্যাপ্ত বিকন বাতি না থাকার খবর প্রকাশিত হয়। যেমন: নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ায় এবং নিয়মিত ড্রেজিং না করার কারণে মেঘনা ও কুশিয়ারা নদীর নৌ-চ্যানেল, চাঁদপুর-নারায়ণগঞ্জ নৌ রুট, ঢাকা-বরিশাল, পটুয়াখালির নৌ-পথসহ সারা দেশের নৌ পথের বিভিন্ন স্থানে চর ও ডুবোচর জেগে উঠায় এসব রুটে লঞ্চ চলাচল ঝুকিপূর্ণ।২২ ঢাকা-বরিশাল নৌরুটের বরিশাল অংশের চরবাড়িয়া, চরমোনাই, ভাসানচর, হিজলা, কালীগঞ্জ হয়ে লালখারাবাদ পর্যন্ত একাধিক বাঁক এবং অসংখ্য ডুবোচর রয়েছে। এসব স্থানে প্রয়োজনীয় বিকন বাতি, বয়া বা মার্কা নেই।২৩ চাঁদপুর-ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ নৌপথের বয়া-বিকন বাতি নষ্ট ও চুরি যাওয়ায় ঝুঁকি নিয়ে অর্ধশতাধিক নৌযান চলাচল করছে। গুরুত্বপূর্ণ এ পথের বিভিন্ন স্থানে পথনির্দেশক বয়া ও বিকন বাতি না থাকায় বাঁশের ওপর নির্ভর করে প্রতিনিয়ত ঝুঁকি নিয়ে চলছে যাত্রীবাহী লঞ্চসহ বিভিন্ন নৌযান।২৪

নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ায় এবং নিয়মিত ড্রেজিং না করার কারণে মেঘনা ও কুশিয়ারা নদীর নৌ-চ্যানেল, চাঁদপুর-নারায়ণগঞ্জ নৌ রুট, ঢাকা-বরিশাল, পটুয়াখালির নৌ-পথসহ সারা দেশের নৌ পথের বিভিন্ন স্থানে চর ও ডুবোচর জেগে উঠায় এসব রুটে লঞ্চ চলাচল ঝুকিপূর্ণ।২২ ঢাকা-বরিশাল নৌরুটের বরিশাল অংশের চরবাড়িয়া, চরমোনাই, ভাসানচর, হিজলা, কালীগঞ্জ হয়ে লালখারাবাদ পর্যন্ত একাধিক বাঁক এবং অসংখ্য ডুবোচর রয়েছে।

বাংলাদেশে সব যাত্রীবাহী লঞ্চে আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই। ফলে এক লঞ্চের সঙ্গে অন্য লঞ্চ যোগাযোগ স্থাপন করে দুর্ঘটনা এড়িয়ে চলতে পারে না। কুয়াশার মধ্যে গতি কমিয়ে ও মিনিটে মিনিটে হর্ন বাজিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলাচল করে।২৫ দিক নির্ণয়ের জন্য লঞ্চে রাডার, জিপিএস, নদীর তলদেশের গভীরতা মাপার জন্য ইকোসাউন্ডার, কুয়াশার জন্য ফগলাইট, এক নৌযানের সঙ্গে অন্য নৌ-যানের যোগাযোগের জন্য অতি ক্ষমতাসম্পন্ন ভিএইচএফ রেডিও, জাহাজ দ্রুত নিয়ন্ত্রণের জন্য ইলেকট্রিক হুইল ইত্যাদি থাকা জরুরি। কিন্তু সারাদেশে ৬৯৫টি যাত্রীবাহী নৌ-যান চলাচল করলেও এর অর্ধেক নৌযানেই নেই এসব সরঞ্জামাদি। বিলাসবহুল ৭০টি লঞ্চের মধ্যে মাত্র ১০টি লঞ্চ ঘন কুয়াশায় চলাচল উপযোগী।২৬

দিক নির্ণয়ের জন্য লঞ্চে রাডার, জিপিএস, নদীর তলদেশের গভীরতা মাপার জন্য ইকোসাউন্ডার, কুয়াশার জন্য ফগলাইট, এক নৌযানের সঙ্গে অন্য নৌ-যানের যোগাযোগের জন্য অতি ক্ষমতাসম্পন্ন ভিএইচএফ রেডিও, জাহাজ দ্রুত নিয়ন্ত্রণের জন্য ইলেকট্রিক হুইল ইত্যাদি থাকা জরুরি। কিন্তু সারাদেশে ৬৯৫টি যাত্রীবাহী নৌ-যান চলাচল করলেও এর অর্ধেক নৌযানেই নেই এসব সরঞ্জামাদি। বিলাসবহুল ৭০টি লঞ্চের মধ্যে মাত্র ১০টি লঞ্চ ঘন কুয়াশায় চলাচল উপযোগী।

২.২। নৌযানের ডিজাইন ও ফিটনেস সমস্যা:বাংলাদেশে যত নৌদুর্ঘটনা ঘটে তার প্রায় অর্ধেক(৪৫%) ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনার শিকার নৌযানটি পানিতে ডুবে যায়। কিন্তু কোনো কারণে কোনো লঞ্চ দুর্ঘটনায় পড়লে, এক লঞ্চের সাথে অপর কোনো লঞ্চের/জাহাজের সংঘর্ষ হলেই তা ডুবে যাওয়ার কথা না। বিশেষজ্ঞদের মতে নৌযানের নকশা ও কাঠামোয় ত্রুটি থাকলেই এমনটি বেশি ঘটে।২৭

বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ট্রাস্ট ‘নিরাপদ নৌপথ বাস্তবায়ন জোট’ এর ২০০৬ সালে করা এক গবেষণার বরাত দিয়ে জানায়, ১৯৭৬ সাল থেকে ২০০৫ পর্যন্ত যত উল্লেখযোগ্য নৌদুর্ঘটনা ঘটেছে তার প্রায় ৭০ ভাগই ঘটেছে ত্রুটিপূর্ণ নকশার কারণে। লঞ্চের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, ড্রাফট (ড্রাফট হলো নৌযানের পাটাতন হতে নিচের দিকের গভীরতা যা নৌযানের ভারসাম্য বজায় রাখে) ও উচ্চতা- এ চারটি বিষয় একে অপরের সাথে আনুপাতিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে সম্পৃক্ত। যখন কোনো লঞ্চের যাত্রী ধারণক্ষমতা বাড়ানোর জন্য খেয়াল খুশিমতো দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা বাড়ানো হয়, তখনই লঞ্চটি ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যায়। যথাযথ নিয়ম মেনে লঞ্চ নির্মাণ করলে লঞ্চ ৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত কাত হলেও তাতে পানি ওঠার কথা নয়, কিন্তু আমাদের দেশের লঞ্চগুলো ১৫ থেকে ১৮ ডিগ্রি কাত হয়ে গেলেই পানি উঠে যায়।২৮

২০১১ সালে এমভি বিপাশার দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্টে এ বিষয়ে বলা হয়েছিল: “…Ship Building Technology তে নৌযানের Design এবং Construction এমনভাবে করা হয় যেন তা ছিদ্র না হলে অথবা তাতে অনুমোদিত যাত্রী ও মালামালের বেশী পরিমাণ পরিবহন না করা হলে নৌযান কোনক্রমেই ডুবে যাওয়ার কথা নয়।…দূর্ঘটনা কবলিত লঞ্চটি Sunken deck বিশিষ্ট হওয়ায় তলা (Bottom) ফেটে যাওয়ার সাথে সাথে লঞ্চটির খোলে পানি প্রবেশ করায় লঞ্চটি তার Buoyant force হারায় এবং ধীরে ধীরে ডুবতে থাকে। এক পর্যায়ে সম্পূর্ণ খোল (Hold) পানিতে ভর্তি হয়ে গেলে লঞ্চটি খাড়াভাবেই পানিতে নিমজ্জিত হয়। কিন্তু Sunken deck যদি পানি রোধী (Water tight) থাকে তাহলে নৌযানের নীচে ছিদ্র হলে অথবা ফেটে গেলে Sunken deck-এর নীচে পানি ভর্তি থাকার কথা, ডেকের উপরে পানি উঠা সম্ভব নয়। …. এখানে উল্লেখ্য যে, নৌযানের হাল যদি ওয়াটার টাইট কম্পার্টমেন্ট বেশী থাকে তাহলে নৌযানটি ডুবতে বেশী সময় নিবে। Water tight Compartment এর Volume Optimum রাখা হলে হয়তো নৌযান ডুববে না অথবা ইঞ্জিন চালু রেখেই নৌযানটিকে নিরাপদ স্থানে নেয়া সম্ভব পর হয়।

এই বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে এমভি বিপাশা সম্পর্কে তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্ত ছিল: “নৌযানটি দীর্ঘদিনের পুরানো হয়ে যাওয়াতে ও যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করার ফলে বহিঃ কাঠামোগত দুর্বলতা/ত্রুটি রয়েছে বলে কমিটি মনে করে।

এখন প্রশ্ন হলো, এমভি বিপাশার দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্টের ফাইন্ডিংসকে গুরুত্ব দিয়ে এরপর থেকে বিশেষ করে যেসব লঞ্চ যাত্রী পরিবহণ করে সেসব লঞ্চের রুট পারমিট প্রদান ও ফিটনেস প্রদানের ক্ষেত্রে কি বহিঃ কাঠামোগত দুর্বলতা/ত্রুটির বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়? এই তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরবর্তি বিভিন্ন দুর্ঘটনার দৃষ্টান্ত কিন্তু সেরকম কোনো বার্তা দেয় না।

৩ মে ২০১৪ তারিখ পটুয়াখালির গলাচিপা নদীতে কয়েক মিনিটের ঝড়ে এমভি শাথিল-১ লঞ্চডুবির ঘটনায় ১৬ যাত্রী নিহত হন৷ এই ঘটনার তদন্ত কমিটির রিপোর্টে লঞ্চটির কারিগরি, কাঠামোগত ও নকশায় ত্রুটি ছিল বলে উল্লেখ করা হয়।২৯ এমভি শাথিল-১ লঞ্চটি এর আগেও দুর্ঘটনা কবলিত হয়েছিল, ২৭ জানুয়ারি ২০১৪ তে পটুয়াখালীতে এমভি আঁচল নামের অপর একটি লঞ্চের ধাক্কায় এটি ডুবে যায়। এই লঞ্চটি বার বার ডুবে যাওয়ার কারণ ছিল ডিজাইন বা নকশার ত্রুটি, ২০০৬ সাল থেকে এ ধরনের লঞ্চকে চলাচলের উপযুক্ত মনে করা না হলেও লঞ্চটি নদীতে যাত্রী বহন করে বার বার দুর্ঘটনায় পড়েছে।৩০

এর মাত্র ১২ দিন পর অর্থাৎ ১৫ মে ২০১৪ তারিখ মেঘনা নদীতে ঢাকা থেকে শরীয়তপুরের সুরেশ্বরগামী লঞ্চ এমভি মিরাজ-৪ ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়। এ ঘটনায় অন্তত ৫৫ জন যাত্রী মারা যান। এমভি মিরাজ-৪ লঞ্চটি এতটাই দুর্বল ও জরাজীর্ণ ছিল যে উদ্ধারের সময় এর যে অংশ তার দিয়ে বাঁধা হতো, সেই অংশই ভেঙে যেত। ফলে গোটা লঞ্চটিই উদ্ধার করতে গিয়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে পরিস্কার যে লঞ্চটির ফিটনেস ছিল না।৩১ এমভি মিরাজ-৪ লঞ্চডুবির বড় কারণ হিসাবে সঠিক নকশা অনুযায়ী নির্মাণ না করা, ভুল নকশার বিপরীতে সনদ দেওয়ার ঘটনা উঠে আসে। ২০০২ সালে নির্মিত লঞ্চটি তৈরি হয় পুরোনো অগ্রহণযোগ্য নকশায়। এমভি মিরাজ-৪-এর দৈর্ঘ্য ছিল ৩৫ দশমিক ৬৭ মিটার, প্রস্থ ৭ দশমিক ০৩ মিটার এবং গভীরতা ১ দশমিক ৯০ মিটার। অথচ লঞ্চটির দৈর্ঘ্য অনুযায়ী গভীরতা হওয়া উচিত ছিল ৩ মিটার। গভীরতা কম হলে এবং ওপরের দিকে ভারী হলে লঞ্চ চলাচলের সময় ভারসাম্য হারানোর ঝুঁকি থাকে৷ ভারসাম্য রক্ষার জন্য মিরাজ-এর তলদেশে ইস্পাত, সিমেন্টের বস্তাসহ ভারী পদার্থ (সলিড ব্যালাস্ট) দিয়ে ভরাট করার কথা ছিল। কিন্তু সেটাও করা হয়নি। এরকম ভুল নকশা ও ত্রুটিপূর্ণ কাঠামোর কারণে এমভি মিরাজ-২ আগেও দুবার দুর্ঘটনাকবলিত হয়েছিল।৩২

মেঘনায় ডুবে যাওয়া লঞ্চ এমভি মিরাজ–৪, ১৮ মে ২০১৪, প্রথম আলো

২০১৪ সালের ৪ আগস্ট কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া নৌরুটে পদ্মায় ডুবে যায় পিনাক-৬ নামের একটি লঞ্চ। এই ঘটনায় ৪৯টি মরদেহ উদ্ধার হলেও নিখোঁজ ছিলেন বহু।৩৩ দুর্ঘটনার সময় লঞ্চটির কোনো সার্ভে (ফিটনেস) সনদ ছিলনা, ৪৫ দিনের বিশেষ টোকেন অনুমোদন নিয়ে চলছিল লঞ্চটি।৩৪ ২০১৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার পাটুরিয়ায় পদ্মা নদীতে পাটুরিয়া ঘাট থেকে ৮০০ গজ দূরে এমভি নার্গিস নামের একটি কার্গো জাহাজ এমভি মোস্তফা নামের একটি যাত্রীবাহী লঞ্চের মাঝামাঝি স্থানে ধাক্কা দিলে লঞ্চটি উল্টে গিয়ে ডুবে যায়। এ ঘটনায় লঞ্চের ৮০ জন যাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়।৩৫ এ ঘটনার জন্যও লঞ্চের নকশা ও ফিটনেসের ত্রুটি দায়ী। দুর্ঘটনাকবলিত এমভি মোস্তফা ১৯৬৬ সালে নির্মিত। ২০০৮ সালে এটি কাঠের কাঠামো থেকে গোঁজামিল দিয়ে ইস্পাত কাঠামোতে রূপ দেওয়া হয়। অন্যদিকে এমভি নার্গিস-১-কে কার্গো থেকে কোস্টাল (সমুদ্রে চলাচলকারী) নৌযানে রূপান্তর করা হয়।৩৬

পিনাক-৬ এর হঠাৎ ডুবে যাওয়ার দৃশ্য, ডেইলিস্টার অনলাইন বাংলা, ৪ আগস্ট ২০২০

ত্রুটিপূর্ণ নকশার কারণে বার বার লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটেছে কিন্তু এই ভুল নকশা যারা প্রণয়ন ও অনুমোদন করেন এবং যারা এই নকশা অনুসরণ করে অথবা ভুল নকশায় লঞ্চ নির্মাণ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনও আইন নেই। লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটলে মালিক, চালক, জরিপকারীসহ অনেকের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থার কথা থাকলেও নকশাকারী বা নির্মাণকারী সম্বন্ধে কিছু নেই এ সংক্রান্ত আইন অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশে (আইএসও)।৩৭

ত্রুটিপূর্ণ নকশার কারণে বার বার লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটেছে কিন্তু এই ভুল নকশা যারা প্রণয়ন ও অনুমোদন করেন এবং যারা এই নকশা অনুসরণ করে অথবা ভুল নকশায় লঞ্চ নির্মাণ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনও আইন নেই।

নৌযান দুর্ঘটনায় পড়লেই বেরিয়ে আসে সার্ভে(ফিটনেস) সনদ না থাকার ঘটনা। পুরনো ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় লঞ্চ রঙ কালি আর মেরামতের মাধ্যমে চালিয়ে দেয়া হয়।৩৮ আবার যেসব নৌযানের সনদ আছে সেগুলো কতটা যথাযথ সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। অভিযোগ আছে, নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের শিপ সার্ভেয়াররা নৌযান পরিদর্শন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই সার্ভে ও নিবন্ধন সনদ প্রদান করেন।৩৯ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, দেশে ১৫ হাজার নৌযানের জন্য রয়েছে মাত্র চারজন স্থায়ী সার্ভেয়ার। হিসাব করে দেখা গেছে, একজন সার্ভেয়ার গড়ে ১৯ মিনিট ২ সেকেন্ড সময় পান একটি নৌযান সার্ভে করতে। কিন্তু নৌযান সার্ভের সময় ফাইলেই ২১টি বিষয় পর্যবেক্ষণ করতে হয়। প্রতিটি বিষয় ৩ মিনিট করে পর্যবেক্ষণ করলেও সময় লাগে ৬৩ মিনিট। আর ইঞ্জিন পরীক্ষায় আরও অন্তত দুই ঘণ্টা সময় প্রয়োজন হয়। যেখানে এত সময়ের প্রয়োজন হয়, সেখানে মাত্র ১৯ মিনিট ২ সেকেন্ড ব্যয় করে কী মানের সনদ দেওয়া হয়, তা সহজেই বোধগম্য।৪০

দেশে ১৫ হাজার নৌযানের জন্য রয়েছে মাত্র চারজন স্থায়ী সার্ভেয়ার। হিসাব করে দেখা গেছে, একজন সার্ভেয়ার গড়ে ১৯ মিনিট ২ সেকেন্ড সময় পান একটি নৌযান সার্ভে করতে। কিন্তু নৌযান সার্ভের সময় ফাইলেই ২১টি বিষয় পর্যবেক্ষণ করতে হয়। প্রতিটি বিষয় ৩ মিনিট করে পর্যবেক্ষণ করলেও সময় লাগে ৬৩ মিনিট। আর ইঞ্জিন পরীক্ষায় আরও অন্তত দুই ঘণ্টা সময় প্রয়োজন হয়।

রঙে নতুন হয়ে উঠছে ফিটনেসবিহীন লঞ্চ, সমকাল, ৩১ মে, ২০১৮

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় নৌপথসহ বিভিন্ন নৌপথে হাজার হাজার ইঞ্জিনচালিত নৌকা অবৈধভাবে যাত্রী পরিবহন করে। যাত্রী পরিবহনের জন্য বিশেষ ধরনের কাঠ ও স্টিলের কাঠামো তৈরি করে তাতে শ্যালো ইঞ্জিন বসিয়ে নদীতে নামিয়ে দেয়া হয়। আবার বড় ট্রলারগুলোকে লঞ্চ হিসেবে বিভিন্ন রুটে পরিচালনা করা হয়। এসব নৌযানের যাত্রী পরিবহনের অনুমতি তো দূরের কথা, ফিটনেস সনদ, সার্ভে সনদ, রুট পারমিট, এমনকি নিবন্ধন পর্যন্ত নেই। এসব অবৈধ নৌযান ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বহন করায় প্রায়ই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।৪১ ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখ বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার সন্ধ্যা নদীতে ঐশী প্লাস নামের একটা ট্রলারডুবির ঘটনায়২৭ জনের মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনার পর জানা যায় ট্রলারটির কোনো রেজিস্ট্রেশন ছিল না, সার্ভে সনদ ছিল না এবং রুট পারমিট ছিল না।৪২ অভিযোগ রয়েছে, বাণিজ্যিকভাবে এসব নৌযানে যাত্রী পরিবহনের কোনো অনুমোদন না থাকলেও অতিরিক্ত লাভের আশায় স্থানীয় প্রশাসনকে মাসোহারা দিয়ে এসব অবৈধ নৌযান চলাচল করছে।

২.৩। যাত্রী ও মালামাল ওভারলোড: লঞ্চের নকশা এবং ফিটনেস ঠিক থাকলেও যাত্রী ও মালামাল ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি থাকলে লঞ্চ ভারসাম্য হারিয়ে একদিকে কাত হয়ে ডুবে যেতে পারে। কাজেই যে কোনো নৌযানের ভারসাম্য নিশ্চিত করার জন্য এর সঠিক দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা, তলার গভীরতা ইত্যাদি বিবেচনার পাশাপাশি লঞ্চটি দিনে এবং রাতে কতজন যাত্রী ও কতটুকু মালামাল পরিবহণ করতে পারবে তার একটা হিসাব বেঁধে দেয়া হয় যার ব্যতিক্রম ঘটলে সামান্য ধাক্কাতেই লঞ্চটি ভারসাম্য হারিয়ে ডুবে যেতে পারে। ঘাট থেকে লঞ্চ ছাড়বার সময় যদি যাচাই করে দেখা হয় লঞ্চের যাত্রীর সংখ্যা ও মালামালের পরিমাণ ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী আছে কিনা তাহলে ওভারলোডের কারণে লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটার কোনো কারণ থাকে না। বাস্তবে এই সাধারণ কাজটি করা হয়না বলেই বিশেষ করে উৎসবের প্রাক্কালে যখন যাত্রীর চাপ বেশি থাকে তখন ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের ঘটনা ঘটে যার ফলে নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটে। ওভারলোডের কারণে দুর্ঘটনা বিষয়টা সংশ্লিষ্ট সকলেরই জানা থাকা স্বত্ত্বেও এবং লঞ্চ দুর্ঘটনার বিভিন্ন তদন্ত রিপোর্টে সুষ্পষ্ট ভাবে উঠে আসলেও বার বার ওভার লোডের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। ‘সোসাইটি অব মাস্টার মেরিনার্স’ এর হিসেব অনুসারে দেশে ৩৪% লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত যাত্রী বহনের কারণে!৪৩

২০১১ সালের ২১ এপ্রিলে এমভি বিপাশার দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্টে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে ওভারলোডের প্রসঙ্গ আসে, লঞ্চে যাত্রী সংখ্যা ঠিক কত ছিল তার কোনো সুনির্দিষ্ট লিখিত হিসেব খুঁজে পায়নি তদন্ত কমিটি: “দূর্ঘটনা কবলিত লঞ্চের যাত্রী সংখ্যা বিষয়ে অনুমান নির্ভর বিভিন্ন সংখ্যা পাওয়া গিয়েছে এবং যা ৭০/৮০ হতে আনুমানিক ১৫০-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। সার্ভে সনদে রাত্রিকালীন চলাচলের জন্য নির্ধারিত যাত্রী সংখ্যা-৮০।” যেন ভবিষ্যতে পুনরাবৃত্তি না হয় সে জন্য এ বিষয়ে তদন্ত রিপোর্টের ১০.০৬ নং সুপারিশে বলা হয়েছিলো: ”নৌযান বন্দর ত্যাগের পূর্বে কতজন যাত্রী ও কি পরিমাণ মালামাল নিয়ে বন্দর ত্যাগ করা হচ্ছে সে মর্মে মালিকের ঘোষণা বাধ্যতামূলক করা;”।

এমভি বিপাশার তদন্ত রিপোর্টের এই সুপারিশ যে বাস্তবায়িত হয়নি তা পরবর্তী দুর্ঘটনার ঘটনাগুলো থেকেই বোঝা যায়। এমভি বিপাশার দুর্ঘটনার প্রায় ১ বছরের মাথায় ২০১২ সালের ১২ মার্চ মেঘনা নদীতে কার্গোর আঘাতে ডুবে যাওয়া ‘এমভি শরীয়তপুর-১’ এ দিনের বেলায় ৩৩২ জন এবং রাত্রিকালীন ২২৫ জন যাত্রী পরিবহনের অনুমতি ছিল। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটার পর দেখা গেল কর্তৃপক্ষের কাছে সঠিক তথ্য নেই লঞ্চটিতে কতজন যাত্রী ছিল। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী লঞ্চটি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার সুরেশ্বর ঘাট থেকে যাত্রা শুরু করার সময় মোটের উপর ৩শ জন যাত্রী পরিবহন করছিল (যা অনুমোদিত সংখ্যার চেয়ে ৭৫ জন বেশি) এবং পরবর্তিতে রাত ১০টার দিকে কাচিকাটা লঞ্চঘাট থেকে আরো ১শ জন যাত্রী যুক্ত হয় অর্থাৎ অনুমোদিত সংখ্যার চেয়ে আনুমানিক ১৭৫ জন বেশি যাত্রী নিয়ে রাত্রি বেলা এই লঞ্চটি চলছিল যার কোনো সঠিক হিসেব কারো কাছেই নাই!৪৪ এমভি শরীয়তপুর দুর্ঘটনার পর যাত্রী ও মালামাল বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য না থাকা এবং বাড়তি যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের খবর পাওয়াতে এটা পরিষ্কার যে আগের তদন্ত রিপোর্টের সুপারিশ বাস্তবায়িত হয় নি।

‘এমভি শরীয়তপুর-১’ এ দিনের বেলায় ৩৩২ জন এবং রাত্রিকালীন ২২৫ জন যাত্রী পরিবহনের অনুমতি ছিল। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটার পর দেখা গেল কর্তৃপক্ষের কাছে সঠিক তথ্য নেই লঞ্চটিতে কতজন যাত্রী ছিল।

অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই লঞ্চ, বেআইনি ভাবে ছাদেও যাত্রী পরিবহন, ১০ আগস্ট, ২০১৯, যুগান্তর

২.৪। জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম না থাকা: লঞ্চে কোনো কারণে লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটলেও পর্যাপ্ত জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম যেমন লাইফ জ্যাকেট ও বয়া থাকলে একজন মানুষেরও প্রাণহানি ঘটার কথা না। বাংলাদেশের বেশির ভাগ লঞ্চেই কোনো লাইফ জ্যাকেট এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক বয়া থাকেনা, অনেক সময় বয়া থাকলেও এমন ভাবে বাধা থাকে যে দুর্ঘটনার সময় ব্যবহার করার উপায় থাকে না। অথচ নিয়ম হলো লঞ্চগুলোর যাত্রী ধারণক্ষমতা অনুযায়ী জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জামের সংখ্যা নির্ধারণ করে প্রতিটি লঞ্চে টানিয়ে দেয়া এবং বন্দর ত্যাগ করার আগে লঞ্চ ছাড়ার ঘোষণাপত্র পেয়ে সেগুলো যাচাই-বাছাই করে লঞ্চ ছাড়ার অনুমতি দেয়া। বাস্তবে এই নিয়মটা মেনে চলা হয় না বলেই লঞ্চদুর্ঘটনা ঘটলেই অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

২০১১ সালে এমভি বিপাসার দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুসারে লঞ্চটির নিমজ্জিত লঞ্চ এম.ভি.বিপাশার জানালায় নাইলনের দড়ি বাঁধা ছিল। দড়ির ওপরে জড়ানো অবস্থায় ত্রিপল ছিল। যার ফলে ডুবে যাওয়া মালবাহী জাহাজ এম.ভি. আনোয়ার ইসলাম-১ এর সাথে ধাক্কা খেয়ে নিমজ্জিত হওয়ার কালে যাত্রী সাধারণ লঞ্চের জানালা দিয়ে বের হতে গিয়ে চরম বিপদের মুহুর্তেও বাঁধাগ্রস্থ হয়েছে বলে প্রতীয়মাণ হয়। জানালা সম্পূর্ণরূপে উম্মুক্ত থাকলে প্রাণহানী কম হতো বলে তদন্তকমিটি মনে করে।

না, এমভি বিপাশার ঘটনা ও তদন্ত কমিটির রিপোর্ট থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জাম ব্যবস্থাপনার কোনো উন্নতি হয়নি। সেকারণেই এমভি বিপাশার দুর্ঘটনার ১ বছর পর ২০১২ সালে ডুবে যাওয়া ‘এমভি শরীয়তপুর-১’ এর দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া যাত্রী ও উদ্ধারকার্যে নিয়োজিত ডুবুরিদের ভাষ্য অনুসারে কয়েকশো মরিচের বস্তা লঞ্চের জানালায় স্তুপ করে রাখার কারণে যাত্রীদের বের হতে সমস্যা হয়েছে। ডুবে যাওয়া লঞ্চ থেকে প্রথম লাশ উদ্ধারকারী ডুবুরি আলাউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, লঞ্চের জানালায় মরিচের বস্তা স্তূপ করে রাখার কারণে দুর্ঘটনার সময় অনেকেই চেষ্টা করেও বের হতে পারেনি।৪৫ এমনকি দুর্ঘটনার পর লাশ উদ্ধারকাজও ব্যাহত হচ্ছে ওই মরিচের বস্তার কারণে। আবার কেউ কেউ লঞ্চ ডুবে যাওয়ার পর মরিচের বস্তা ধরে ভাসতে ভাসতে পাশ দিয়ে যাওয়া লঞ্চ এমভি মিতালি-৩ থেকে ছুড়ে দেয়া বয়া’র সাহায্যে বেঁচে গেছেন। এভাবে প্রায় ৩০ জন যাত্রীর প্রাণ রক্ষা হয়।৪৬ প্রশ্ন হলো, যাত্রীদেরকে কেন অন্য লঞ্চের বয়া ব্যবহার করে ভেসে থাকতে হলো? এমভি শরীয়তপুর-১ এ কি তাহলে ভেসে থাকার জন্য পর্যাপ্ত বয়া বা অন্য কোনো সরঞ্জাম ছিলো না? অথচ এমভি বিপাশার তদন্ত কমিটির রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়েছিল : “যাত্রীবাহী লঞ্চে উপযুক্ত পরিমাণ জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম নিশ্চিত করন;”। এই সুপারিশ অনুসারে এমভি শরীয়তপুর-১ লঞ্চে পর্যাপ্ত জীবন রক্ষাকারী সামগ্রী থাকলে এবং ৪শ মরিচের বস্তা যাত্রী চলাচলে বাধা সৃষ্টি না করলে, যেহেতু দুর্ঘটনার পরপরই সৌভাগ্যক্রমে ঘটনা স্থলে আরেকটি লঞ্চ হাজির ছিল, ফলে আরো বেশি সংখ্যক যাত্রীর জীবন রক্ষা করা সম্ভব হতো। কিন্তু মালিকের মুনাফালোভ ও কর্তৃপক্ষের নজরদারি ও ব্যাবস্থাপনার সমস্যার কারণে সামান্য এই আয়োজনটুকুও করা হয়নি লঞ্চটিতে।

এরপরেও কি পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়েছে? এমভি শরীয়তপুর-১ এর মর্মান্তিক দুর্ঘটনার ১ বছরেরও বেশি সময় পরে ৩০ জুলাই ২০১৩ তে দৈনিক প্রথম আলোর এক রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে:

আসছে ঈদ। দক্ষিণাঞ্চলের ঘরমুখী যাত্রীদের অতিরিক্ত চাপ পড়বে লঞ্চে। কিন্তু লঞ্চগুলোতে সাধারণ যাত্রী ধারণক্ষমতা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম নেই। তার ওপর ভরা বর্ষায় লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী উঠলে হুমকির মুখে পড়বে নিরাপত্তা।

 ঢাকা নদীবন্দর সদরঘাট টার্মিনালে গত রোববার সকালে গিয়ে কোনো লঞ্চে জীবন রক্ষার জ্যাকেট পাওয়া যায়নি। জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম বয়া, ফায়ার বাকেট, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, হস্তচালিত পাম্প ও বালুর বাক্স বা বালতি পাওয়া গেলেও তা ছিল লঞ্চের প্রধান ফটকে টানানো তালিকার চেয়ে কম। যেগুলো ছিল তার মধ্যে অনেক সরঞ্জাম নষ্ট। পাঁচটি লঞ্চে উঠে এ চিত্র দেখা গেছে। 

বরগুনাগামী লঞ্চ এমভি আল্লার মর্জির যাত্রী ধারণক্ষমতা ৭৬০ জন। লঞ্চের প্রধান ফটকের সামনে লেখা ছিল বয়া ৮৫টি, ফায়ার বাকেট ১৬টি, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র আটটি, হস্তচালিত পানির পাম্প একটি, বালুর বাক্স দুটি। অথচ বয়া ছিল ৬৭টি। এর মধ্যে বিভিন্ন স্থানে ছিঁড়ে ২৫টি বয়া নষ্ট হয়ে গেছে। ফায়ার বাকেট ছিল ১২টি। দুটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে ছিল। ভোলার লালমোহনগামী পাতার-৫ লঞ্চে যাত্রীধারণক্ষমতা দিনে ৩৬৪ জন, রাতে ২৪০ জন। ৪২টি বয়ার মধ্যে ছিল ৩১টি। ফায়ার বাকেট ১২টির মধ্যে দুটি নষ্ট। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ছয়টি, হস্তচালিত পানির পাম্প একটি ও দুটি বালুর বালতি ছিল।…বরিশালের ঘোষেরহাটগামী কর্ণফুলী-৩ লঞ্চে যাত্রী ধারণক্ষমতা দিনে ৫৮০ জন, রাতে ৪০৫ জন। বয়া ৬৫টির মধ্যে ৪৭টি, ফায়ার বাকেট ১৪টির মধ্যে ১৩টি, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ছয়টি, একটি পাম্প ও দুটি বালুর বালতি আছে। একটি বালতিতে বালু ছিল না।… মানিক-৬ লঞ্চে যাত্রী ধারণক্ষমতা ২৫৪ জন (রাতে)। এখানে ৫২টি বয়ার মধ্যে ৪৩টি, একটি পানির পাম্প ও দুটি বালুর বালতি ছিল। ফায়ার বাকেট ১০টির মধ্যে দুটি ও অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র চারটির মধ্যে একটি ছিল নষ্ট। মিরাজ-২ লঞ্চের যাত্রী ধারণক্ষমতা ৩৫৭ জন (রাতে)। এখানে ৪২টি বয়ার মধ্যে ৩৪টি, একটি পানির পাম্প আছে। ফায়ার বাকেট ১২টির মধ্যে একটি নষ্ট। দুটি বালুর বালতি থাকলেও বালু ছিল না।৪৭

একই সংবাদপত্রে ৩ বছর পর প্রকাশিত সরেজমিন প্রতিবেদনে একই পরিস্থিতির প্রমাণ মেলে:

ঢাকার সদরঘাট নৌ টার্মিনাল থেকে দক্ষিণাঞ্চলে চলাচলকারী বেশির ভাগ লঞ্চে যাত্রীদের জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জাম প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এসব সরঞ্জাম আছে কি না, লঞ্চ ছাড়ার আগে তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব নৌ পরিদর্শকদের। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, তাঁরা এ দায়িত্ব পালনে হেলাফেলা করেন।

 গত বুধবার দুপুরে সদরঘাট টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেছে, বরিশালের ভাষানচরগামী যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি রাজহংস-৮-এর প্রধান ফটকের সামনে লেখা, এর যাত্রীধারণক্ষমতা ৫৬৯ জন। জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জামের মধ্যে লাইফ বয়া ৭০টি, ফায়ার বাকেট ১৬টি, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ২২টি, বালতি ১৩টি, হস্তচালিত পাম্প ৩টি ও বালুর বাক্স আছে ২টি। কিন্তু সরেজমিনে পাওয়া যায় মাত্র ৩৭টি লাইফ বয়া। এর মধ্যে তিনটি নষ্ট। ফায়ার বাকেট আছে ১৩টি, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ৫টি, তা-ও আবার জরাজীর্ণ। এ ছাড়া দুটি বাক্স থাকলেও সেখানে বালু রাখা হয়নি।…

মাদারীপুরগামী পারাবত-১৪ লঞ্চের যাত্রীধারণক্ষমতা ৮৪৮ জন বলে উল্লেখ রয়েছে। লাইফ বয়া ১৪৫টি, ফায়ার বাকেট ১৫টি, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ৮টি, হস্তচালিত পাম্প ১টি ও ২টি বালুর বাক্স আছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, লঞ্চটির নিচতলায় ৭৮টি ও দ্বিতীয় তলায় ৫৩টি বয়া আছে। ফায়ার বাকেট পাওয়া গেছে ১৩টি। এর মধ্যে ২টি নষ্ট।…

 লালমোহনগামী কর্ণফুলী-৩ লঞ্চের যাত্রীধারণক্ষমতা ৫৮০ জন। জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জামের মধ্যে লাইফ বয়া ৬৫টি, ফায়ার বাকেট ১৪টি, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ৬টি, হস্তচালিত পাম্প ১টি ও ২টি বালুর বাক্স রয়েছে বলে লেখা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ৫৪টি বয়া, ১১টি বাকেট, ৫টি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ও ২টি বালুবিহীন বাক্স পাওয়া গেছে।…

 গলাচিপাগামী এমভি মডার্ন সান লঞ্চের সামনে লেখা, যাত্রীধারণক্ষমতা ৩১৫ জন। জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জামের মধ্যে লাইফ বয়া ৬৩টি, ফায়ার বাকেট ১৬টি, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র আছে ৬টি। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫৪টি লাইফ বয়া, ৫টি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র আছে।

 রিশালগামী এমভি রেড সান-৫ লঞ্চের যাত্রীধারণক্ষমতা ১১৫ জন। লঞ্চটিতে লাইফ বয়া ৬৭টি, ফায়ার বাকেট ১২টি, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ৮টি, হস্তচালিত পাম্প ২টি ও বালুর বাক্স ২টি রয়েছে বলে লেখা রয়েছে। কিন্তু সরেজমিনে ৫৮টি বয়া, ১০টি ফায়ার বাকেট, ৭টি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র পাওয়া গেছে।…

সরেজমিনে ১৩ লঞ্চের কোনোটিতেই লাইফ জ্যাকেট পাওয়া যায়নি।৪৮

২.৫। দায়ী ব্যক্তির শাস্তি না হওয়া: বিভিন্ন ধরনের কাঠামোগত অবহেলার কারণে ঘটা এসব নৌদুর্ঘটনার পর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়না। আর যেসব তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হয় সেগুলোতে ভবিষ্যৎ দুর্ঘটনা এড়াতে যেসব সুপারিশ করা হয়, সেগুলোরও বাস্তবায়ন করা হয় না। একই ভাবে তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না বললেই চলে। কখনও কখনও দায়ী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা কিংবা সাময়িক বরখাস্তের শাস্তি দিয়েই দায় এড়িয়ে যাওয়া হয়। পরে এই লঘু শাস্তিমূলক পদক্ষেপও উঠিয়ে নেওয়া হয়।

সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর সংঘটিত নৌদুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছে প্রায় ৯০০টি। তদন্ত প্রতিবেদনগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে কয়েক হাজার মামলাও হয়েছে। তবে বড় ধরনের শাস্তির নজির নেই বললেই চলে। মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যাও খুবই কম, মাত্র দেড় শতাধিক। ঢাকার নৌ-আদালতের (মেরিন কোর্টে) কয়েক বছরের কার্যবিবরণী অনুযায়ী, সেখানে দায়েরকৃত ৩৬টি নৌদুর্ঘটনার মামলার মধ্যে মাত্র দুটির রায় হয়েছে। প্রায় তিন হাজার নৌ-আইনভঙ্গজনিত মামলার মধ্যে মাত্র ৪০টির মতো মামলায় অভিযুক্তদের জরিমানা করা হয়। এরপরও বর্তমানে এই আদালতে বিভিন্ন সময় দায়েরকৃত কয়েক হাজার মামলা চলমান রয়েছে। এই মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীরা বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চ মালিকসহ অপরাধীরা প্রভাবশালী হওয়ায় আদালতে হাজির হন না। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার পরও তাদের গ্রেপ্তার করে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এতে অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখিও করা যায় না। আবার তাদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নিলে ওপর মহল থেকেও চাপ সৃষ্টি হয়। নৌদুর্ঘটনা মামলার আসামিরা প্রভাবশালী নেতাদের কারণেও পার পেয়ে যাচ্ছেন।৪৯

স্বাধীনতার পর সংঘটিত নৌদুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছে প্রায় ৯০০টি। তদন্ত প্রতিবেদনগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে কয়েক হাজার মামলাও হয়েছে। তবে বড় ধরনের শাস্তির নজির নেই বললেই চলে। মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যাও খুবই কম, মাত্র দেড় শতাধিক। ঢাকার নৌ-আদালতের (মেরিন কোর্টে) কয়েক বছরের কার্যবিবরণী অনুযায়ী, সেখানে দায়েরকৃত ৩৬টি নৌদুর্ঘটনার মামলার মধ্যে মাত্র দুটির রায় হয়েছে।

৩। রেলপথে দুর্ঘটনা

সারা দুনিয়াতেই রেল নিরাপদতম যাতায়াত মাধ্যম হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের রেলপথ সড়ক বা নৌ পথের তুলনায় নিরাপদ হলেও রেলপথে জীবন ও সম্পদহানিকর দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। গণমাধ্যমকর্মীদের সংগঠন শিপিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরামের (এসসিআরএফ) ‘রেলপথে দুর্ঘটনার বার্ষিক প্রতিবেদন-২০১৯’ অনুসারে, ২০১৯ সালে ৩৯৩টি রেল দুর্ঘটনায় ৮৯ নারী ও ৪৬ শিশুসহ ৪২১ জন নিহত এবং চার নারী ও ৩৩ শিশুসহ ৩৬৬ জন আহত হয়েছে।৫০ আর বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেব অনুসারে ২০১৯ সালে রেলপথে ৪৮২টি দুর্ঘটনায় ৪৬৯ জন নিহত ও ৭০৬ জন আহত হয়েছে।৫১ বাংলাদেশে রেল দুর্ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে আর সবেচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে অন্যান্য যানবাহনের সংঘর্ষে। চলুন দেখা যাক এসব দুর্ঘটনার পেছনে কাঠামোগত সমস্যার ভূমিকা কি।

২০০৮-০৯ থেকে ২০১৭-১৮ এই দশ বছরে মোট ২ হাজার ৪২৮টি দুর্ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনা ২ হাজার ১৫৫ টি যা মোট দুর্ঘটনার ৮৯ শতাংশ।

৩.১। ঝুঁকিপূর্ণ রেলপথ: বাংলাদেশ রেলওয়ে ইনফরমেশান বুক ২০১৮ থেকে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৭-১৮ এই দশ বছরে মোট ২ হাজার ৪২৮টি দুর্ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনা ২ হাজার ১৫৫ টি যা মোট দুর্ঘটনার ৮৯ শতাংশ।৫২ আর ট্রেন লাইন চ্যুত হয়ে দুর্ঘটনার পেছনে যেসব কারণ দায়ী তার মধ্যে রয়েছে ত্রুটিপূর্ণ রেলপথ, ইঞ্জিন বা বগির যান্ত্রিক সমস্যা, সিগনাল ব্যবস্থার সমস্যা, বিভিন্ন ধরণের মানবীয় ভুল ও নিয়ম অমান্য করা ইত্যাদি। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুসারে, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় সর্বোচ্চ। ক্ষমতাসীন সরকার ১১ বছরে রেলের উন্নয়নে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে।৫৩ উচ্চব্যয়ে রেলপথ নির্মাণের প্রকল্প নিতে যতটা উৎসাহ দেখা যায়, ততটাই নিরুৎসাহ বিদ্যমান রেলপথ ও রেলসেতু সংস্কারে। ফলে সারা দেশে মানসম্পন্ন রেললাইন রয়েছে ৭৩৯ কিলোমিটার, যা মোট রেললাইনের মাত্র ২৫.২৩ শতাংশ। রেলসেতু ঝুঁকিপূর্ণ ৪০২টি। লাইনে পাথরস্বল্পতা, রেলক্লিপ ও নাট-বল্টু চুরি হয়ে যাওয়ায় নড়বড়ে ট্র্যাক মেরামতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ ও যন্ত্রাংশের অভাবে রেললাইনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণ রেলপথের পাশাপাশি ২৭৮ ইঞ্জিনের মধ্যে ১৯৫টির এবং হাজার ৬৫৬টি কোচের মধ্যে ৯০০টির আয়ু শেষ।৫৪  আবার এগুলোর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজও সঠিক ভাবে করা হয়না। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, রেলের পূর্বাঞ্চলে ২০ শতাংশ বগি বার্ষিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও মেরামত ছাড়াই চলছে। লোকবলের অভাব এবং বগির স্বল্পতার কারণে এই কাজ হচ্ছে না। অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চলে মিটারগেজের ১২ শতাংশ এবং ব্রডগেজের ৮ শতাংশ বগি সময়মতো মেরামত হয়না। আবার, একটি যাত্রীবাহী ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছালে এর ইঞ্জিন ও বগি ৪৫ মিনিট ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার নিয়ম। এ সময় বগি ধোয়া-মোছা, কলকব্জা পরীক্ষা করার কথা। কিন্তু এই কাজে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এ ছাড়া তিন মাস পরপর মেরামত কারখানায় নিয়ে বগির দিনব্যাপী পরীক্ষা-নিরীক্ষার নিয়ম আছে। এক বছর পর কারখানায় নিয়ে বড় ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মেরামতের কথা। এসবের জন্য বরাদ্দও আছে। কিন্তু নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের কাজটাই ঠিকভাবে হয় না।৫৫

উচ্চব্যয়ে রেলপথ নির্মাণের প্রকল্প নিতে যতটা উৎসাহ দেখা যায়, ততটাই নিরুৎসাহ বিদ্যমান রেলপথ ও রেলসেতু সংস্কারে। ফলে সারা দেশে মানসম্পন্ন রেললাইন রয়েছে ৭৩৯ কিলোমিটার, যা মোট রেললাইনের মাত্র ২৫.২৩ শতাংশ। রেলসেতু ঝুঁকিপূর্ণ ৪০২টি। লাইনে পাথরস্বল্পতা, রেলক্লিপ ও নাট-বল্টু চুরি হয়ে যাওয়ায় নড়বড়ে ট্র্যাক মেরামতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ ও যন্ত্রাংশের অভাবে রেললাইনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণ রেলপথের পাশাপাশি ২৭৮ ইঞ্জিনের মধ্যে ১৯৫টির এবং হাজার ৬৫৬টি কোচের মধ্যে ৯০০টির আয়ু শেষ।

সিলেট থেকে চট্টগ্রাম-ঢাকা রেললাইনের বিভিন্ন এলাকার রেলসেতুগুলোর অবস্থা জরাজীর্ণ, প্রথম আলো অনলাইন, ২৭ জুন ২০১৯

রেলপথের এই দুরবস্থা নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই সংবাদপত্রে নিয়মিত খবর প্রকাশিত হয়েছে। এসব রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন স্থানের রেলপথের বিভিন্ন সেতুর অবস্থা জরাজীর্ণ। অনেক স্থানে স্লিপারের নাটবল্টু নেই। কাঠের স্লিপারগুলোর অবস্থা বেহাল অবস্থা। অনেক জায়গায় খসে পড়েছে স্লিপারের কাঠ। আর স্লিপারগুলো শক্ত রাখতে স্টিলের পাতের বদলে লাগানো হয়েছে বাঁশের ফালি! কিন্তু তারপরও যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি ফলে দুর্ঘটনাও বন্ধ হয়নি। উদাহরণ স্বরুপ ঢাকা সিলেট রেলপথের কথাই বলা যাক। বার্তা সংস্থা ইউএনবির রিপোর্ট অনুসারে, সিলেট-আখাউড়া রেলপথে ১৩টি সেতু দীর্ঘদিন ধরে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এসব সেতুর অনেকগুলোতেই স্লিপারের নড়াচড়া বন্ধে বাঁশ ব্যবহার করা হয়েছে। এই রুটে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হয় ট্রেন। তবুও টনক নড়েনি কর্তৃপক্ষের। রেললাইন ও সেতু সংস্কারে নেওয়া হয়নি তেমন কোনো উদ্যোগ। রেল কর্তৃপক্ষের এমন উদাসীনতায় গত ২৩ জুন ২০১৯ তারিখ রাতে এই রুটের কুলাউড়ায় ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয় উপবন এক্সপ্রেস। কুলাউড়ার বরমচালে সেতু ভেঙ্গে সিলেট থেকে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেসের একটি বগি ছিটকে পড়ে পাহাড়ি ছড়ায়। লাইনচ্যুত হয় আরও চারটি বগি। আখাউড়া-সিলেট রেলপথের ১৭৯ কিলোমিটারের মধ্যে ১৩ টি ঝুঁকিপূর্ণ সেতুর ওপর ট্রেন পারাপারে ‘ডেড স্টপ’ (সেতুর আগে ট্রেন থেমে যাবে,এরপর পাঁচ কিলোমিটার গতিতে চলা শুরু করবে) ঘোষণা করা হয়েছে। সিলেট থেকে মোগলাবাজার স্টেশন পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে আটটি এবং মোগলাবাজার থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ১৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে পাঁচটি সেতু ‘ডেড স্টপ’-এর আওতাধীন। সেতু সংস্কারের কোনো প্রকল্প না থাকায় এগুলো সংস্কার হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা। ইউএনবি লিখেছে, মনু স্টেশনের পাশে মনু ব্রিজের দুরবস্থা নিয়ে ২০১৭ সালে বিভিন্ন গণমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। মনু ব্রিজের স্লিপারের নাট খুলে যাওয়া এবং কাঠের বদলে বাঁশ দিয়ে স্লিপার বানিয়ে তখন রেলসেতুটি মেরামত করে কর্তৃপক্ষ। সেই মনু সেতুটি এখনও (২৮ জুন ২০১৯ ইউএনবি’র রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার সময়) সেই অবস্থায়ই আছে এবং রেলওয়ের ঝুঁকিপূর্ণ সেতুর তালিকায়ও রয়েছে এটি। শ্রীমঙ্গল-সাতগাঁও স্টেশনের মাঝামাঝি এলাকায় ভইষমারা রেল সেতুটিও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে দীর্ঘদিন ধরে। ২০১৭ সালের ৫ এপ্রিল পাহাড়ি ঢলে সেতুটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর থেকেই এটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার ইটাখোলা এলাকার ৫৬ নম্বর সেতু ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ বৃষ্টির পর মাটি সরে যায়। এতে  রেল যোগাযোগ কয়েক ঘন্টা বন্ধ থাকে ৷ তারপর থেকে ওই সেতুটিতে ডেড স্টপ দিয়েই চালানো হচ্ছে ট্রেন।৫৬ এ বিষয়ে সমকাল-এ প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে, চীনের ঋণে আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত রেললাইন ডুয়েলগেজ নির্মাণ করার কথা। নতুন রেললাইন নির্মাণের কাজ শুরুর অপেক্ষায় থাকায় পুরনো রেলপথ সংস্কারে মনোযোগ ছিল না। ১৯১৫ সালে সিলেট-কুলাউড়া রেল সেকশন নির্মাণ করা হয়। শতবর্ষী এ রেলপথে স্লিপার, ব্যালাস্ট (পাথর) সঠিক মানে নেই। অনেক অংশে পাথরই নেই। ফিসপ্লেট নেই অনেক জায়গায়। এ কারণে রেলপথ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। একই অবস্থা সেতু ও কালভার্টগুলোর।৫৭

আখাউড়া-সিলেট রেলপথের ১৭৯ কিলোমিটারের মধ্যে ১৩ টি ঝুঁকিপূর্ণ সেতুর ওপর ট্রেন পারাপারে ‘ডেড স্টপ’ (সেতুর আগে ট্রেন থেমে যাবে,এরপর পাঁচ কিলোমিটার গতিতে চলা শুরু করবে) ঘোষণা করা হয়েছে।

৩.২। ট্রেন থামানোর স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা না থাকা:  গত ১২ নভেম্বর ২০১৯ ভোর রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার মন্দবাগ স্টেশনে অপেক্ষমান সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী ‘উদয়ন এক্সপ্রেস’কে ধাক্কা দেয় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী ‘তূর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেস’। এতে ১৭ জন নিহত এবং ৫৪ জন আহত হন। দুর্ঘটনার কারণে রেল মন্ত্রণালয় এবং রেলওয়ে চারটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করে। এর মধ্যে তিনটি কমিটির প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে দুর্ঘটনার কারণ চালকের অসর্তকতা। ‘তূর্ণা নিশীথা’র চালক তাসির উদ্দিন তিনটি সিগন্যাল অমান্য করে স্টেশনে প্রবেশ করে ‘উদয়ন এক্সপ্রেস’কে ধাক্কা দেয়। ট্রেন থামাতে সময়মত ব্রেক করেননি চালক। ভ্যাকুয়াম খুলে দিয়ে ট্রেন থামানোর সুযোগ ছিল গার্ডের কিন্তু গার্ড সেই দায়িত্ব পালন করেননি। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে পাঁচটি সুপারিশ করে তদন্ত কমিটিগুলো। এগুলো হলো- ট্রেনের লোকোমোটিভে (ইঞ্জিনে) সিসি ক্যামেরা স্থাপন, ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে যুক্তদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ, ট্রেন পরিচালনায় যুক্ত কর্মচারীদের শূণ্য পদ দ্রুত পূরণ করা, স্টেশন ও ট্রেনের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা এবং স্বয়ংক্রিয় ট্রেন থামানো (এটিএস) পদ্ধতি চালু করা।৫৮

এখন প্রশ্ন হলো এক ট্রেনের সাথে আরেক ট্রেনের সাথে সংঘর্ষের ঘটনা তো বাংলাদেশে প্রথম নয়। ২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর নরসিন্দীতে গোধুলি ও চট্টলা – এই দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছিল কারণ চট্টলার চালক সিগনাল অমান্য করেছিল। রেলওয়ের তদন্ত রিপোর্টে তখন বলা হয়েছিল চালক ভৈরব স্টেশানে চা পান করে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় নাকি এই সংকেত অমান্য করার ঘটনাটি ঘটেছিল!৫৯ চালক অজ্ঞান হোক, ঘুমিয়ে পড়ুক বা অবহেলা করুক, প্রশ্ন হলো একই ধরনের দুর্ঘটনা দ্বিতীয়বার কেন ঘটবে? এতদিনেও কেন ট্রেন চালনার সময় চালকদের উপর নজরদারি, স্টেশন ও ট্রেনের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা কিংবা স্বয়ংক্রিয় ট্রেন থামানোর ব্যবস্থা চালু করা হলো না?

৩.৩। অরক্ষিত রেলক্রসিং: রেল দুর্ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে আর সবেচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে অন্যান্য যানবাহনের সংঘর্ষে। রেলওয়ের হিসাব অনুসারে, ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত সারা দেশে মোট ৮৬৮টি দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় ১১১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। লেভেল ক্রসিংয়ে ৯৬টি দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৯৯ জন। তাঁদের প্রায় সবাই ক্রসিং পার হতে যাওয়া বাস, মাইক্রোবাস ও ছোট যানবাহনের আরোহী। রেলক্রসিং পারাপারের সময় যেসব পথচারী প্রাণ হারান, সেই হিসাব রেল কর্তৃপক্ষ সংরক্ষণ করে না। রেলওয়ের হিসাবে, সারা দেশে রেলক্রসিং আছে ২ হাজার ৫৭৪টি। এর মধ্যে অনুমোদিত রেলক্রসিং ১ হাজার ৪৬৮টি। অর্থাৎ ৪৩ শতাংশ ক্রসিং অবৈধ। অনুমোদিত বলতে, সংশ্লিষ্ট সংস্থা রেললাইনের ওপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণের সময় রেলের অনুমোদন নিয়েছে। ক্রসিংগুলোতে প্রতিবন্ধক ও অবকাঠামো তৈরি এবং কর্মী নিয়োগের পর ১০ বছরের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ দেওয়ার পরই অনুমতি পাওয়া যায়। ফলে অনুমোদিত ক্রসিং সুরক্ষিত রাখা রেলের দায়িত্ব। অথচ প্রতিবন্ধক, পাহারাদার এবং ট্রেন চলাচলের খবরাখবর জানা যায় এমন ব্যবস্থা আছে মাত্র ৫৬৪টি ক্রসিংয়ে। অর্থাৎ বৈধ বাকি ৯০৪টি ক্রসিংয়েও কোনো সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই। এসব ক্রসিংয়ে সতর্কবার্তা–সংবলিত সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দায় সারছে রেল কর্তৃপক্ষ। ফলে বার বার দুর্ঘটনা ঘটছে যে দুর্ঘটনাগুলো সহজেই প্রতিরোধযোগ্য।৬০

রেলওয়ের হিসাবে, সারা দেশে রেলক্রসিং আছে ২ হাজার ৫৭৪টি। এর মধ্যে অনুমোদিত রেলক্রসিং ১ হাজার ৪৬৮টি। অর্থাৎ ৪৩ শতাংশ ক্রসিং অবৈধ। অনুমোদিত বলতে, সংশ্লিষ্ট সংস্থা রেললাইনের ওপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণের সময় রেলের অনুমোদন নিয়েছে।

৪। অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু

বাংলাদেশে প্রতিবছর অসংখ্য অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। যথাযথ অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় এসব অগ্নিকাণ্ড সময় মতো নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, বহু মানুষ হতাহত হয় এবং সম্পদ নষ্ট নয়। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুসারে ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল এই ১১ বছরে দেশে ছোট-বড় অন্তত ১ লক্ষ ৯২ হাজার ৯২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে যেসব ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার ৬৭৪ জন। ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৯ সালে সারা দেশে ১২ হাজার ১৮২টি অগ্নিকাণ্ডে ১১৮ জন নিহত ও ১ হাজার ৮৭ জন আহত হন। ২০১০ সালে ১৪ হাজার ৬৮২টি অগ্নিকাণ্ডে ২৭১ জন নিহত ও ৭১৯ জন আহত হন। ২০১১ সালে ১৫ হাজার ৮১৫টি দুর্ঘটনায় ৩৬৫ জন নিহত ও ১ হাজার ৩৮৫ জন আহত হন। একইভাবে ২০১২ সালে ২১০ জন নিহত ও ৭৫৯ জন আহত, ২০১৩ সালে ১৬১ জন নিহত ও ১ হাজার ৩৮৫ জন আহত, ২০১৪ সালে ৭০ জন নিহত ও ২১০ জন আহত, ২০১৫ সালে ৬৮ জন নিহত ও ২১৬ জন আহত, ২০১৬ সালে ৫২ জন নিহত ও ২৪৭ জন আহত, ২০১৭ সালে ৪৫ জন নিহত ও ২৬৯ জন আহত, ২০১৮ সালে ১৩০ জন নিহত ও ৬৬৪ জন আহত এবং ২০১৯ সালে ২৪ হাজার ৭৪টি অগ্নিকাণ্ডে ১৮৪ জন নিহত ও ৫৬০ জন আহত হন। লক্ষণীয় যে ২০১৯ সালে ২০০৯ সালের তুলনায় দ্বিগুন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।৬১অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিসের তদন্তে দেখা গেছে, বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণেই বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ২০১৯ সালের ২৪ হাজার ৭৪টি অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে ৮ হাজার ৬৪৪টি(৩৯ শতাংশ) অগ্নিকাণ্ডই ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে। চুলার আগুন থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে ৪ হাজার ৪২৮টি(১৮ শতাংশ), আর সিগারেটের আগুন থেকে ৪ হাজার ১৫৩টি(১৫ শতাংশ)।৬২

২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল এই ১১ বছরে দেশে ছোট-বড় অন্তত ১ লক্ষ ৯২ হাজার ৯২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে যেসব ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার ৬৭৪ জন।

অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত যেভাবেই হোক যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকলে, অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ থাকলে, সতর্কীকরণ(ফায়ার এলার্ম), বহির্গমন(ফায়ার এস্কেপ), আগুন নেভানোর জন্য প্রয়োজনীয় জলাধার ইত্যাদি থাকলে এবং নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও মহড়া দেয়া হলে আগুন লাগলেও দ্রুত নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা যায়, এমনকি নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলেও ফায়ার এস্কেপের মাধ্যমে মানুষকে সরিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব হয়। কিন্তু বাংলাদেশের অগ্নিদুর্ঘটনাগুলোতে দেখা যায় যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, ফায়ার এলার্ম, ফায়ার এস্কেপ ইত্যাদি না থাকায় বা থাকলেও সেটা বন্ধ থাকার কারণে বহু মানুষ হতাহত হয় যা অগ্নি দুর্ঘটনা মোকাবিলার কাঠামোগত সমস্যার বিষয়টিই সামনে নিয়ে আসে। বিগত কয়েক বছরে ঘটে যাওয়া আলোচিত অনালোচিত কয়েকটি অগ্নিদুর্ঘটনার বিশ্লেষণে বিষয়টি আরো স্পষ্ট বোঝা যাবে।

অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত যেভাবেই হোক যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকলে, অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ থাকলে, সতর্কীকরণ(ফায়ার এলার্ম), বহির্গমন(ফায়ার এস্কেপ), আগুন নেভানোর জন্য প্রয়োজনীয় জলাধার ইত্যাদি থাকলে এবং নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও মহড়া দেয়া হলে আগুন লাগলেও দ্রুত নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা যায়, এমনকি নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলেও ফায়ার এস্কেপের মাধ্যমে মানুষকে সরিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব হয়। কিন্তু বাংলাদেশের অগ্নিদুর্ঘটনাগুলোতে দেখা যায় যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, ফায়ার এলার্ম, ফায়ার এস্কেপ ইত্যাদি না থাকায় বা থাকলেও সেটা বন্ধ থাকার কারণে বহু মানুষ হতাহত হয় যা অগ্নি দুর্ঘটনা মোকাবিলার কাঠামোগত সমস্যার বিষয়টিই সামনে নিয়ে আসে।

৪.১। তাজরীন গার্মেন্টসের অগ্নিকাণ্ড:  ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সাভারের আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লেগে নিহত হয় ১১১ জন শ্রমিক।৬৩ তাজরিন গার্মেন্টস এ আগুন লাগে প্রথমে নীচ তলার ‘গোডাউন’ এ রাখা বিপুল পরিমাণ সিনথেটিক সুতার স্তুপে। পাশেই অবস্থিত জেনারেটর রুম থেকে শর্ট সার্টিক বা অন্য কোনো উপায়ে সে আগুনের সূত্রপাত। জেনারেটর রুমের পাশেই নীচতলার পুরো ফ্লোরকে ‘গোডাউন’ বা ‘স্টোর রুম’ বানিয়ে সেখানে সুতার মতো দাহ্য পদার্থ রাখা একটা অপরাধ। তারচেয়ে ভয়াবহ অপরাধ হলো এমন একটা স্থানকে দাহ্য পদার্থ রাখার গোডাউন বানানো যেস্থানটিতে ভবনের সবগুলো সিঁড়ি এসে মিশেছে! ফলে গোডাউন জুড়ে আগুন ছড়িয়ে যাবার পর যারাই সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছেন, তারা একেবারে জ্বলন্ত নরকের মধ্যে এসে পড়েছেন। একেবারে প্রথম ধাক্কায় আগুন লাগার সাথে সাথে, আগুন ছড়িয়ে পড়ার আগেই যারা নামতে পেরেছে, কেবল তাদের পক্ষেই এই নরক অতিক্রম করে মূল প্রবেশ পথ দিয়ে বের হয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে কিন্তু প্রতিটা ফ্লোরের কলাপসিবল গেইট বন্ধ থাকায় এবং  প্রডাকশন ঠিক রাখার চাপ ও মালামালের নিরাপত্তার অযুহাতে পিএম ও সিকিউরিটি গার্ডরা আগুন লাগার পরও বেশির ভাগ ফ্লোরেই কলাপসিবল গেইট না খোলায় বহু শ্রমিক সময় মতো সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারে নি, ফলে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসা ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে, আগুনে পুড়ে কয়লা হতে হয়েছে তাদেরকে। আগুন লাগার পরও কলাপসিবল গেটগুলো তালাবন্ধ রাখার প্রমাণ পাওয়া যায় ২৫ নভেম্বর ২০১২ তারিখে সরেজমিন পর্যবেক্ষণের সময় প্রতিটি গেইটের তালা কাটা অবস্থায় পাওয়ার মাধ্যমে।৬৪ কলাপসিবল গেইট তালাবন্ধ অবস্থায় পাওয়া গেছে বলেই আগুন নেভানোর কাজে আসা ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীদেরকে গেইটের তালা কেটে তারপর ভেতরে ঢুকতে হয়। আগুনে এত বেশি সংখ্যক শ্রমিক নিহত হওয়ার পেছনে যে কাঠামোগত সমস্যাগুলো দায়ী ছিল সেগুলো হলো-

– তাড়াহুড়া করে নির্মিত ভবনটিতে কোনো ফায়ার এস্কেপ বা ভবনের বাইরের দিকের বিকল্প সিঁড়ি ছিল না।

– সুতার মতো দাহ্য পদার্থ রাখার জন্য গোডাউন বানানো হয়েছে এমন একটি স্থানকে যেখানে ভবনের সবগুলো সিঁড়ি এসে মিশেছে।

– ভবনের সিঁড়িমুখে জেনারেটর রুমের অবস্থান যেখানে আবার সুতার মতো দাহ্য পদার্থ স্তুপ করে রাখা

– বাই ডিফল্ট প্রতিটা ফ্লোরের কলাপসিবল গেইট বন্ধ করে রাখা ও আগুন লাগার পরও গেইট খুলে না দেয়া

– ভবনে কোনো জলাধার না থাকা

তাজরীণ গার্মেন্টসে গোডাউনের মধ্যে নেমে আসা সিড়ি, দুপাশে পুড়ে যাওয়া সুতা। ছবি: কল্লোল মোস্তফা
কলাপসিবল গেইট তালাবন্ধ অবস্থায় পাওয়া গেছে বলেই আগুণ নেভানোর কাজে আসা ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীদেরকে গেইটের তালা কেটে তারপর ভেতরে ঢুকতে হয়েছে। ছবি: কল্লোল মোস্তফা

সঠিক নকশার মাধ্যমে ফায়ার এস্কেপসহ ভবন নির্মাণ করা হলে, ভবনে অগ্নিনির্বাপণের যথাযথ ব্যবস্থা রাখা হলে, ভবনের নীচতলাকে গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করা না হলে, ভবনের সিঁড়ির মুখে জেনারেটর স্থাপন না করা হলে, কারখনার কলাপসিবল গেট বন্ধ করে না রাখা হলে হয়তো এতবড় অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটতেই পারতো না বা ঘটলেও এতগুলো মানুষের মৃত্যু ঘটতো না। ভবন মালিক, ভবনের নকশাকার, কারখানার মালিক ও ব্যবস্থাপক থেকে শুরু করে কলকারখানা পরিদর্শক অধিদপ্তর সকলেই যার যার অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্বে অবহেলা করেছে বলেই এরকম দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং এতগুলো মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

সঠিক নকশার মাধ্যমে ফায়ার এস্কেপসহ ভবন নির্মাণ করা হলে, ভবনে অগ্নিনির্বাপণের যথাযথ ব্যবস্থা রাখা হলে, ভবনের নীচতলাকে গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করা না হলে, ভবনের সিঁড়ির মুখে জেনারেটর স্থাপন না করা হলে, কারখনার কলাপসিবল গেট বন্ধ করে না রাখা হলে হয়তো এতবড় অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটতেই পারতো না বা ঘটলেও এতগুলো মানুষের মৃত্যু ঘটতো না।

৪.২। শিকদার প্লাস্টিকের আগুন: ২০১৩ সালের ২৯ জুলাই ইসলামবাগের হাজী মুরাদ হোসেনের ‘শিকদার প্লাস্টিক’ নামের জুতার সোল তৈরির কারখানায় আগুন লেগে ঘটনাস্থলেই নিহত হন এক শ্রমিক, আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হন আরো ৭ জন শ্রমিক। সরেজমিন পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, দোতালা ভবনের ছাদে টিনের ঘেরাও দেয়া স্থানে এক দিকে চলে ঝালাইয়ের কাজ আরেক দিকে তারপিন জাতীয় দাহ্য কোনো কেমিকেল দিয়ে নিচ তলায় চলে তৈরি জুতার সোল এ রং স্প্রে করা এবং সোল বান্ডিল করার কাজ। আহত শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ঝালাইয়ের আগুনের স্ফুলিংগ কেমিকেলের উপর পড়ে জ্বলন্ত নরকে পরিণত হয় ‘কারখানার’ছাদ।৬৫ এসব কারখানায় ন্যূনতম কোনো অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই। এই কারখানায় একই স্থানে ১৩ জুলাই আরেকবার আগুন লেগেছিল। সেবার আগুন লেগেছিল সর্ট শার্কিটের কারণে। সেই একই স্থানে ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে একই সাথে ঝালাই আর রং করার কাজ করার কারণে আবারও আগুন লাগলো, শ্রমিক পুড়লো। পুরান ঢাকার গলিতে গলিতে এরকম অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ কারখানায় মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করছে হাজার হাজার শ্রমিক। এর দায় সেইসব কারখানার মালিকদের তো অবশ্যই, সেই সাথে কারখানা পরিদর্শন বিভাগ, শ্রম, শিল্প মন্ত্রণালয়সহ সরকারেরও।

৪.৩। আসওয়াদ কম্পোজিট মিলস অগ্নিকাণ্ড: ২০১৩ সালের ০৮ অক্টোবর গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় পলমল গ্রুপের আসওয়াদ কম্পোজিট মিলস লিমিটেড নামের একটি পোশাক কারখানায় আগুন লেগে কমপক্ষে নয়জন নিহত হন।৬৬সরেজমিন পর্যবেক্ষণে গিয়ে শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, টেক্সটাইল ফ্যাব্রিক ফিনিশিং এর কাজে ব্যাবহৃত স্টেনটার(Stenter) মেশিনে প্রায়ই আগুন লাগতো। এর আগে প্রতিবারই কারখানার কর্মীরা আগুন নিভিয়েছিলেন। কিন্তু সেবার দাবানলের মতো দ্রুত আগুন ছড়িয়েছে। বিশাল দোতলা কারখানা ভবনের (সেকশন-২)  নিচতলার স্টেনটার মেশিন থেকে আগুন দ্রুত দোতলার নিটিং সেকশনে গুদামের মতো গাদা করে রাখা সুতা ও কাপড়ের স্তুপের মাধ্যমে পুরো কারখানায় ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার এলার্ম সিস্টেম থাকলেও আগুন লাগার সাথে সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাজেনি, বেশ কিছুক্ষণ পড়ে ম্যানুয়ালি বাজাতে হয়েছে। ফলে আগুনের উৎস স্থল থেকে দূরের দিকে কর্মরত শ্রমিকদের আগুনের বিষয়টি নিশ্চিত হতে দেরী হয়েছে। আগুন লাগার পর কারখানার জেনারেটর ও বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়ায় পানি তোলার পাম্প কাজ করেনি, ফলে প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে যানজট ঠেলে আগুন লাগার প্রায় ২ ঘণ্টা পড়ে ফায়ার ব্রিগেড কারখানায় পৌঁছানোর আগপর্যন্ত কারখানার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আগুনে পানি দেয়া সম্ভব হয় নি। পানির পাম্পের জন্য স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ সরবরাহের অপরিহার্য ব্যবস্থাটি থাকলে আগুন হয়তো আরো আগেই হয়তো নিয়ন্ত্রণে আনা যেত।৬৭

৪.৪। কালার ম্যাক্স (বিডি) অগ্নিকাণ্ড: ২০১৬ সালের ২২ নভেম্বর ঢাকার আশুলিয়ায় কালার ম্যাক্স (বিডি) লিমিটেড নামের গ্যাস লাইটার তৈরির কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ২৬ জন নারী ও শিশু শ্রমিক দগ্ধ হয় যার মধ্যে পাঁচজন মারা যায়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, কারখানাটি লাইটার থেকে বের হওয়া দাহ্য গ্যাসে পূর্ণ থাকতো। তাদেরকে কোনো মাস্ক বা নিরাপত্তা জ্যাকেট দেয়া হতো না। কারখানায় এমনকি আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা পর্যন্ত ছিল না। কারখানার জায়গায় প্রথমে ছিল মুরগীর খামার তারপর প্রতিষ্ঠা করা হয় গরীব মানুষ পোড়ানোর এই কারখানা। এই শ্রমিকদের কোনো নিয়োগপত্র ছিল না, পরিচয় পত্রও না। কারখানাটির তিন মালিকের একজন সরকারদলীয় এক সাংসদের আত্মীয়। কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর কিংবা বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়াই চলছিল বিপদজনক এই কারখানাটি।৬৮

কারখানাটি লাইটার থেকে বের হওয়া দাহ্য গ্যাসে পূর্ণ থাকতো। তাদেরকে কোনো মাস্ক বা নিরাপত্তা জ্যাকেট দেয়া হতো না। কারখানায় এমনকি আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা পর্যন্ত ছিল না। কারখানার জায়গায় প্রথমে ছিল মুরগীর খামার তারপর প্রতিষ্ঠা করা হয় গরীব মানুষ পোড়ানোর এই কারখানা। এই শ্রমিকদের কোনো নিয়োগপত্র ছিল না, পরিচয় পত্রও না। কারখানাটির তিন মালিকের একজন সরকারদলীয় এক সাংসদের আত্মীয়।

৪.৫। এফআর টাওয়ার অগ্নিকাণ্ড: ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লেগে ধোঁয়ায়, লাফিয়ে পড়ে, পুড়ে ২৭ জন নিহত ও অন্তত ৭৫ জন আহত হন।৬৯ ফারুক রূপায়ন টাওয়ার বা এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকান্ডে জীবনহানির মূল দায় ভবনটির নির্মাতা ডেভলাপার কোম্পানি ও অনুমোদন প্রদানকারী রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক)। অগ্নি নিরাপত্তার জন্য যে বেসিক ডিজাইনগুলো নিশ্চিত করতে হয়, রূপায়ন গ্রুপ তা করেনি। যেমন:

– ফায়ার এক্সিট স্থাপন করতে হয় ভবনের বাইরের দিকে, মূল সিঁড়ি থেকে দূরে যেন ভবনের ভেতরে আগুন লাগলে তা কোনো ভাবেই আগুন ও আগুনের ধোঁয়া ফায়ার এক্সিটে পৌঁছুতে না পারে। কিন্তু এফ আর টাওয়ারের ফায়ার এক্সিট ছিল ভবনের ভেতরের দিকে মূল সিঁড়ির পাশাপাশি।

– কথিত ফায়ার এক্সিট যথেষ্ট প্রশস্ত ছিল না। ফায়ার এক্সিট যা ছিল তাও অনেক ক্ষেত্রে ছিল তালাবদ্ধ।

– ফায়ার এক্সিটের মুখে অগ্নি প্রতিরোধী ফায়ার ডোর থাকতে হয় যেন কোনো তলায় আগুন লাগলে ধোঁয়া ও আগুন সাথে সাথে ফায়ার এক্সিটে ঢুকতে না পারে। এফ আর টাওয়ারে শুধু একটি তলা বাদে আর কোনো তলাতেই ফায়ার ডোর ছিল না।

– একতলা থেকে আরেক তলায় যেন আগুন না ছড়ায় সেজন্য একটি ভার্টিক্যাল সেপারেশন লাগে যার উচ্চতা অন্তত ১ মিটার বা ৩.২৮ ফুট হতে হয়, এফ আর টাওয়ারে যেটা আছে তা মাত্র ২ ফুট। এই দেয়াল যথাযথ মাপের না থাকায় আগুন ও ধোঁয়া সহজে উল্লম্বভাবে প্রবাহিত হয়ে অন্যতলাকে গ্রাস করেছে।

– বহুতল ভবনে কার্যকর ফায়ার এলার্ম থাকা বাধ্যতামূলক যেন কোনো এক তলায় বা অংশে আগুন লাগলে অন্য তলা বা অংশের মানুষ তা দ্রুত জানতে পারেন এবং বের হয়ে যেতে পারেন। বিস্ময়কর হলো, এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে কোনো ফায়ার এলার্ম বাজেনি যে কারণে বহু মানুষ আগুন লাগার সাথে সাথে জানতে পারেননি এবং নিরাপদে বের হতে পারেন নি।

– বহুতল ভবনে ফার্ষ্ট এইড ফায়ার ফাইটিং এর জন্য বহনযোগ্য অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, হোস পাইপ ইত্যাদি থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু এফ আর টাওয়ারে কোনো বহনযোগ্য অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ছিল না। হোসপাইপ থাকলেও তা সচল করার জন্য কোনো পাম্প ছিল না।

– এই বহুতল ভবনে আগুন নেভানোর প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহের কোনো জলাধার ছিল না।

– অনুমোদন না নিয়ে ১৮ তলা থেকে ২২ তলা করা হয়েছে। নির্মাণের সময়কার অগ্নিনিরাপত্তার ত্রুটি তখনো সংশোধনের সুযোগ ছিল কিন্তু তা করা হয় নি।৭০

রাজধানীর বনানী এলাকায় এফআর টাওয়ারে আগুন- ছবি- প্রবীর দাশ, ডেইলিস্টার, ২৮ মার্চ ২০১৯

আরো ভয়ংকর অবহেলার দৃষ্টান্ত হলো, রূপায়ন গ্রুপের নির্মাণ করা এই টাওয়ারে এর আগেও আগুন লেগেছিল কিন্তু তারপরেও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার ত্রুটি চিহ্নিত করে তা দূর করা হয় নি। ২০০৮ সালের ৩১ আগস্ট এফ আর টাওয়ারের বেজমেন্টে পার্কিং করা একটি গাড়িতে আগুন ধরে। এতে যে ধোঁয়ার সৃষ্টি হয় তা ভবনটির ১৮ তলা পর্যন্ত অন্ধকার করে ফেলে।৭১ সে সময় যদি অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো দূর করা হতো তাহলে হয়তো এবারের অগ্নিকাণ্ডে এতগুলো প্রাণ হানি হতো না।

রূপায়ন গ্রুপ মুনাফার জন্য অগ্নিনিরাপত্তায় অবহেলা করলেও রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব ছিল তা প্রতিহত করে রূপায়ন গ্রুপকে অগ্নিনিরাপত্তাসহ অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী চলতে বাধ্য করা। ভবনমালিক ও ফ্ল্যাট মালিকদেরও দায়িত্ব ছিল তা নিশ্চিত করা। কিন্তু রাজউক থেকে শুরু করে সিটি কর্পোরেশন ফায়ার সার্ভিসসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও তার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ও আমলাসহ সংশ্লিষ্ট কেউই দায়িত্ব পালন করেননি বলেই এই কাঠামোগত দুর্ঘটনাটি ঘটেছে।

রূপায়ন গ্রুপ মুনাফার জন্য অগ্নিনিরাপত্তায় অবহেলা করলেও রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব ছিল তা প্রতিহত করে রূপায়ন গ্রুপকে অগ্নিনিরাপত্তাসহ অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী চলতে বাধ্য করা। ভবনমালিক ও ফ্ল্যাট মালিকদেরও দায়িত্ব ছিল তা নিশ্চিত করা। কিন্তু রাজউক থেকে শুরু করে সিটি কর্পোরেশন ফায়ার সার্ভিসসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও তার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ও আমলাসহ সংশ্লিষ্ট কেউই দায়িত্ব পালন করেননি বলেই এই কাঠামোগত দুর্ঘটনাটি ঘটেছে।

৪.৬। চুড়িহাট্টার রাসায়নিক অগ্নিকাণ্ড: ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের পারফিউম কারখানা ও কেমিকেলের গোডাউন থেকে ভয়াবহ বিস্ম্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান ৭১ জন। এ বিষয়ে গঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুসারে ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলার রাসায়নিক গুদাম থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল। ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলায় প্রচুর পরিমাণে সুগন্ধি ক্যান, লাইটার রিফিল করার ক্যান, কাস্টার অয়েলের ছোট কাচের বোতল ও টিনের ক্যান, নেইলপলিশের বোতল, ছোট ও বড় বাল্বের গুদাম ছিল, দোতলায় কয়েক বস্তা রাসায়নিক পদার্থ ছিল, যা প্রচণ্ড তাপে শক্ত হয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া ভবনের নিচতলায় প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিকের মজুত পাওয়া যায়। ভবিষ্যতে যেন এ ধরণের আগুনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে জন্য ৩১ দফা সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি যার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হলো- জরুরি ভিত্তিতে আবাসিক এলাকা থেকে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর গুদাম বা কারখানা সরিয়ে নেওয়া, অবৈধ, অননুমোদিত বা লাইসেন্সবিহীন রাসায়নিক কারখানা ও গোডাউন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী সমন্বিত অভিযান পরিচালনা, আবাসিক এলাকায় সব ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ দাহ্য রাসায়নিক ব্যবসার লাইসেন্স না দেওয়া, অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন, ২০০৩ ও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা, লাইসেন্সবিহীন কারখানার মালিকদের আইনের আওতায় আনা, ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স ছাড়া অন্য কোনো সংস্থা লাইসেন্স দেবে না বিষয়টি জানিয়ে নির্দেশ জারি করা, রাসায়নিক কারখানার পাশে বহুতল ভবন নির্মাণ না করা, একই কক্ষে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক মজুত না রাখা, রাসায়নিক ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের সময় ফায়ার সার্ভিসের অনাপত্তি নেওয়া, পুরান ঢাকার রাস্তাঘাট প্রশস্ত করা, এসব এলাকায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, ব্যর্থতায় ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল করা ইত্যাদি।৭২

আগুনে পুড়ে যাওয়া চুড়িহাট্টা, দেশ রুপান্তর, ২ এপ্রিল ২০১৯

মর্মান্তিক ব্যাপার হলো, ঠিক এরকমই কিছু সুপারিশ করা হয়েছিল এই অগ্নিকাণ্ডের ৯ বছর আগে, ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিকেল গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৩ জনের প্রাণহানির পর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরই তদন্ত কমিটি সে সময় ভবনের নিচতলার গুদামে এনএন ডাই নাইট্রোসো পেন্টামিথিলিন টেট্রামিন (ডিএনপিটি) নামের উচ্চমাত্রার তাপ সৃষ্টিকারী ও সম্প্রসারণশীল রাসায়নিক দ্রব্য সংরক্ষণকে দায়ী করে এরকম অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ করার জন্য ১৭ দফা সুপারিশ করে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু সুপারিশ হলো: জরুরি ভিত্তিতে আবাসিক এলাকা থেকে গুদাম বা কারখানা সরিয়ে নেওয়া, অনুমোদনহীন কারখানার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া, অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন-২০০৩ ও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা, রাসায়নিক দ্রব্যের মজুদ, বাজারজাতকরণ এবং বিক্রির জন্য লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে তদারকি প্রক্রিয়া জোরদার করা, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক বা বিস্ফোরক দ্রব্যের মজুদ বা বিপণনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন, দ্রুত অগ্নিনির্বাপণের জন্য স্থানীয়ভাবে পৃথক পানির লাইনসহ হাইড্রেন্ট পয়েন্ট স্থাপন, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক বা বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থ মজুদকরণ বা বিপণন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা, বাড়িঘরে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক তারের গুণগতমান নিশ্চিত করা, রাস্তায় স্থাপিত খোলা তারের ব্যাপারে সাবধানতা, সম্ভাব্য দুর্ঘটনা পরিহার করতে প্রতি মাসে অন্তত একবার ট্রান্সফরমার সরেজমিনে পরীক্ষা করা ইত্যাদি৭৩

২০১৯ সালে চুড়িহাট্টার দুর্ঘটনা পরবর্তী তদন্ত কমিটির সুপারিশের সাথে ২০১০ সালের নিমতলী অগ্নিকাণ্ড পরবর্তী তদন্ত কমিটির সুপারিশ মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায় ৯ বছরেও সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হয়নি বলেই ৯ বছর আগের সুপারিশগুলোই তাদের আবার করতে হয়েছে। আর ৯ বছরে সেই সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হয়নি বলেই চুড়িহাট্টায় আবারও রাসায়নিক অগ্নিকাণ্ডে এতগুলো মানুষকে প্রাণ হারাতে হলো। ভয়ংকর ব্যাপার হলো, এমনকি চুড়িহাট্টা দুর্ঘটনার পরে ১ বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও পুরান ঢাকা থেকে সরেনি ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানা ফলে আগের মতোই কাঠামোগত দুর্ঘটনার ঝুঁকির মধ্য বসবাস করছেন ঘনবসিতিপূর্ণ পুরান ঢাকার নাগরিকরা।৭৪

২০১৯ সালে চুড়িহাট্টার দুর্ঘটনা পরবর্তী তদন্ত কমিটির সুপারিশের সাথে ২০১০ সালের নিমতলী অগ্নিকাণ্ড পরবর্তী তদন্ত কমিটির সুপারিশ মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায় ৯ বছরেও সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হয়নি বলেই ৯ বছর আগের সুপারিশগুলোই তাদের আবার করতে হয়েছে। আর ৯ বছরে সেই সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হয়নি বলেই চুড়িহাট্টায় আবারও রাসায়নিক অগ্নিকাণ্ডে এতগুলো মানুষকে প্রাণ হারাতে হলো। ভয়ংকর ব্যাপার হলো, এমনকি চুড়িহাট্টা দুর্ঘটনার পরে ১ বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও পুরান ঢাকা থেকে সরেনি ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানা ফলে আগের মতোই কাঠামোগত দুর্ঘটনার ঝুঁকির মধ্য বসবাস করছেন ঘনবসিতিপূর্ণ পুরান ঢাকার নাগরিকরা।

নাগরিকের জীবন নিয়ে এই ধরণের কাঠামোগত অবহেলার পেছনে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের জনগণের কাছে জবাবদিহিতার কোনো ব্যবস্থানা না থাকার পাশাপাশি দুর্নীতি ও অবৈধ অর্থ উপার্জনের প্রণোদনাও দায়ী। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা অনুসারে, নিয়ম লঙ্ঘন করে পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের ব্যবসা চালিয়ে নিতে ৩০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা ঘুষ লেনদেন হয়। টিআইবির গবেষণা থেকে দেখা যায়, আনুষ্ঠানিক ভাবে রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানা স্থাপনে লাইসেন্স প্রদান বা নবায়ন বন্ধ থাকলেও অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে এবং রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে লাইসেন্স বের করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের অসাধু কর্মকর্তাদের পরামর্শে ব্যবসায়ীরা তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নাম থেকে রাসায়নিক শব্দটি বাদ দিয়ে এন্টারপ্রাইজ হিসেবে ট্রেড লাইসেন্স বের করে নেয়। লাইসেন্স বের করা কঠিন হয়ে পড়লে রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার রাসায়নিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত না হয়েও কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা নিজেদের নামে লাইসেন্স করে তা ব্যবসায়ীদের প্রদান করে থাকে। রাসায়নিকের ব্যবসায় অনাপত্তিপত্র, লাইসেন্স, ছাড়পত্র নেওয়া বা নবায়নের ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরকে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা, বিস্ফোরক পরিদপ্তরকে দেড় থেকে আড়াই লাখ টাকা, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরকে ৩ থেকে ১২ হাজার টাকা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা নিয়মবহির্ভূতভাবে দিতে হয়।৭৫

রাসায়নিকের ব্যবসায় অনাপত্তিপত্র, লাইসেন্স, ছাড়পত্র নেওয়া বা নবায়নের ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরকে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা, বিস্ফোরক পরিদপ্তরকে দেড় থেকে আড়াই লাখ টাকা, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরকে ৩ থেকে ১২ হাজার টাকা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা নিয়মবহির্ভূতভাবে দিতে হয়।

৫। বয়লার বিষ্ফোরণ

২০১৬ সালের ২৩ জানুয়ারি গাজীপুরের পুবাইলের ‘স্মার্ট মেটাল অ্যান্ড কেমিক্যাল’ কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে সাতজনের প্রাণহানির ঘটে।৭৬ ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল দিনাজপুর শহরের রানীগঞ্জ এলাকার যমুনা অটো রাইস মিলে বয়লার বিস্ফোরণে ১৯ জন নিহত হন।৭৭ এই ঘটনার কিছুদিন পরেই ২০১৭ সালের ৩ জুলাই গাজীপুরের কাশিমপুরে মাল্টি ফ্যাবস নামের পোশাক কারখানার বয়লার বিস্ফোরণে ১৩ জন নিহত হন।৭৮ এরকম বড় ঘটনা ছাড়াও ছোট ছোট দুর্ঘটনায় কখনো চাল কলে কখনো পোষাক কারখানায় বা অন্য কোনো করখানায় নিয়মিত বয়লার বিস্ফোরণে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে থাকে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুসারে সর্বশেষ ২০১৯ সালে বয়লারে ১১টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১৫ জন নিহত ও ১০ জন আহত হয়েছেন।৭৯ অথচ নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে এবং নিয়ম মেনে পরিচালনা করা হলে বয়লার বিস্ফোরিত হওয়ার কথা না। সাধারণভাবে বললে বয়লার হচ্ছে এমন একটি যন্ত্র যার ভেতরে উচ্চ চাপের মাধ্যমে পানিকে বাষ্পে পরিণত করা হয়। সাধারণত পোশাক কারখানা, চালকল, রঙের কারখানা, হাসপাতাল, বিদ্যুৎকেন্দ্রে এই বয়লার ব্যবহার করা হয়। বয়লার যদি ত্রুটিপূর্ণ হয় বা ঠিকভাবে চালানো না হয় বা যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করা না হয় তাহলে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। কলকারখানায় বৈধ এবং মানসম্পন্ন বয়লার ব্যবহার নিশ্চিত করা, মাননিয়ন্ত্রণ এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমানোর দায়িত্ব হলো শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রধান বয়লার পরিদর্শকের কার্যালয়। নতুন বয়লার চালুর অনুমতি, নিবন্ধন ও নিবন্ধন নবায়ন তাদের প্রধান কাজ। পরিদর্শনের মাধ্যমে এসব কাজ সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু বয়লা বিস্ফোরণ ঘটার পর দেখা যায় বয়লার অনুমোদনহীন বা মেয়াদোত্তীর্ণ বা মানহীন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, জনবলসংকটের কারণে নিয়মিত বয়লার পরিদর্শন করা সম্ভব হয় না তাদের পক্ষে। ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সাড়ে পাঁচ হাজার বয়লারের জন্য পরিদর্শক ছিল মাত্র ৫ জন!৮০ ফলে অনেক কারখানাতেই মানহীন মেয়াদোত্তীর্ণ বয়লার ঝুঁকি নিয়েই চলতে থাকে বিস্ফোরণের আগ পর্যন্ত। আবার বিস্ফোরণ ঘটার পর এর জন্য দায়ী কারখানা মালিক, ব্যবস্থাপক বা সংশ্লিষ্ট পরিদর্শককে বিচার বা শাস্তিরও মুখোমুখি হতে হয় না যে কারণে এসব ঘটনা নিয়মিতই ঘটে চলেছে।

২০১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সাড়ে পাঁচ হাজার বয়লারের জন্য পরিদর্শক ছিল মাত্র ৫ জন!৮০ ফলে অনেক কারখানাতেই মানহীন মেয়াদোত্তীর্ণ বয়লার ঝুঁকি নিয়েই চলতে থাকে বিস্ফোরণের আগ পর্যন্ত। আবার বিস্ফোরণ ঘটার পর এর জন্য দায়ী কারখানা মালিক, ব্যবস্থাপক বা সংশ্লিষ্ট পরিদর্শককে বিচার বা শাস্তিরও মুখোমুখি হতে হয় না যে কারণে এসব ঘটনা নিয়মিতই ঘটে চলেছে।

মেয়াদোত্তীর্ণ বয়লার বিস্ফোরণে মাল্টি ফ্যাবস লিমিটেড নামের কারখানায় আগুন, ৪ জুলাই ২০১৭, অর্থসূচকডটকম

উদাহরণ স্বরূপ গাজীপুরের মাল্টি ফ্যাবস ও ‘স্মার্ট মেটাল অ্যান্ড কেমিক্যাল’ কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণ ও তার পরবর্তী ঘটনাবলির কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ‘স্মার্ট মেটাল অ্যান্ড কেমিক্যাল’ কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণের  পর প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের গঠন করা দুটি তদন্ত কমিটির রিপোর্টেই বিস্ফোরণের জন্য কারখানার মালিক, জমির মালিক, কারখানার ব্যবস্থাপক, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক অধিদপ্তরের দুইজন উপমহাপরিদর্শক, পরিবেশ অধিদপ্তরের গাজীপুরের তৎকালীন উপপরিচালক, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এই ৭ জনকে দায়ী করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কারখানার মালিক কোনো প্রকৌশলীর নকশা ছাড়াই স্থানীয়ভাবে লোহার পাত দিয়ে বয়লার প্রস্তুত করে অদক্ষ শ্রমিক দিয়ে চালাচ্ছিলেন। অবৈধ কারখানার জন্য জমি ভাড়া দিয়ে জমির মালিকও অপরাধ করেছেন। ব্যবস্থাপক মালিকের নির্দেশে ঝুঁকিপূর্ণ বয়লারটি চালিয়ে শ্রমিকদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন। আর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান যথাযথ নিয়ম না মেনে ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে অবৈধ কারখানা পরিচালনার সুযোগ করে দিয়েছেন। কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে কারখানাটি পরিচালনা করার পরও ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই ঘটনার পর দায়ের করা মামলায় ২০১৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। আদালত ২০১৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রতিবেদনটি গ্রহণ করলে মামলা থেকে অব্যাহতি পান কারখানার মালিক-ব্যবস্থাপকসহ সাত আসামি। এই ব্যাপারে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার যুক্তি হলো, বিস্ফোরণের ঘটনায় মালিক বা কর্তৃপক্ষের কোনো গাফিলতি ছিল না। যাঁরা কর্মরত ছিলেন এবং মারা গেছেন—তাঁদের অবহেলার কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল! বয়লারের দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতেন, তাহলে বিস্ফোরণ হতো না। তাই তাঁদের বাদ দিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।৮১

২০১৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। আদালত ২০১৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রতিবেদনটি গ্রহণ করলে মামলা থেকে অব্যাহতি পান কারখানার মালিক-ব্যবস্থাপকসহ সাত আসামি। এই ব্যাপারে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার যুক্তি হলো, বিস্ফোরণের ঘটনায় মালিক বা কর্তৃপক্ষের কোনো গাফিলতি ছিল না। যাঁরা কর্মরত ছিলেন এবং মারা গেছেন—তাঁদের অবহেলার কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল!

গাজীপুরের পুবাইল এলাকায় স্মার্ট মেটাল অ্যান্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি নামের একটি টায়ার কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণের পর কারখানার চিত্র, ২৩ জানুয়ারি ২০১৬, প্রথম আলো

অন্যদিকে মাল্টি ফ্যাবস নামের পোশাক কারখানার বয়লার বিস্ফোরণে ১৩ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় কারখানা কর্তৃপক্ষকে পুরোপুরি খালাশ দেয়া না হলেও “অনুমোদনের চেয়ে বেশি চাপে ও ছাড়পত্র ছাড়া বয়লার চালানোর” দায়ে মাত্র ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়!৮২ ঠিক কী ঘটেছিল মাল্টিফ্যাবস গার্মেন্টস এ? বয়লারের বাস্প চাপ বেড়ে গিয়েছিল কিন্তু প্রেসার রিলিজ ভাল্ব ত্রুটিপূর্ণ থাকায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গিয়ে অতিরিক্ত বাষ্প বের করে দিতে পারেনি। নির্ধারিত সীমার চেয়ে অতিরিক্ত বাস্প চাপে ত্রুটিপূর্ণ ভাল্ব সহ মেয়াদোত্তীর্ণ বয়লার চালানো একটা বড় গাফিলতি। এদিকে ভাল্ব ত্রুটিপূর্ণ থাকলেও অতিরিক্ত চাপের সর্তকতামূলক এলার্ম কিন্তু ঠিকই বাজিয়েছিল। আফসোসের ব্যাপার হলো বয়লার অপারেটররা তাতে তেমন পাত্তা দেন নি, এমনকি বার বার অ্যালার্ম বা উচ্চ শব্দ শুনে শ্রমিকরা বার বার বলার পরেও না। এরপর অতিরিক্ত চাপে বয়লার যখন বিস্ফোরিত হলো, এই অপারেটর শ্রমিকরাও কিন্তু বাঁচলেন না। এই ঘটনা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, এই কারখানায় বয়লার পরিচালনার কোনো স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর ছিল না, কোন পরিস্থিতিতে কী করতে হবে সে বিষয়ে বয়লার অপারেটরদের কোনো যথাযথ প্রশিক্ষণ ছিল না, অপারেটররা তা মানছেন কিনা তার জন্য মালিকপক্ষের কোনো তদারকি ছিল না। থাকলে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটতো না। এখন এর জন্য মূল দায় কার- মৃত অপারেটরদের নাকি কারখানার মালিক, পরিচালক বা ব্যাবস্থাপকদের?

আসলে একটি কারখানা কীভাবে পরিচালিত হবে, তার সেফটি কীভাবে রক্ষা করা হবে এটা অপারেটর বা শ্রমিকদের ঠিক করার কথা না। মালিক, পরিচালনা পরিষদ ও ব্যবস্থাপকরাই এটা ঠিক করবেন এবং শ্রমিক/কর্মীরা যেন তা মেনে চলেন তা নিশ্চিত করবেন। গাজীপুর জেলাপ্রশাসন গঠিত তদন্ত রিপোর্টেও এসব যান্ত্রিক ও ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কথা উঠে আসে। ১৩ জুলাই ২০১৭ তারিখ প্রকাশিত তদন্ত রিপোর্টে বয়লার বিস্ফোরণের সাতটি কারণ চিহ্নিত করা হয়। তার মধ্যে পাঁচটি হলো যান্ত্রিক ও বাকি দুইটি হলো কারখানার প্রশাসনিক ত্রুটি। এর মধ্যে প্রধান কারণই হচ্ছে কারখানার সেফটি বাল্বের যান্ত্রিক ত্রুটি। অন্য যান্ত্রিক ত্রুটিগুলো হলো ফিজিক্যাল ফ্লাগে ত্রুটি, মেটালিক ক্ষয়, বয়লার পেশার গেজে ত্রুটি এবং বৈদ্যুতিক সিগন্যালে ত্রুটি। এছাড়া অপারেটর প্রেসার রিলিজ করতে ব্যর্থ হয় ও বয়লার মেইনটেন্যান্স কর্তৃপক্ষের বয়লার অপারেটরদের উপযুক্ত তদারকির অভাব ছিল। প্রশাসনিক ত্রুটি দুইটি হলো, কারখানার প্রশাসনিক অবকাঠামোগত ও ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি। এসব কারণেই বয়লারটি বিস্ফোরিত হয়েছে বলে তদন্ত কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।৮৩

১৩ জুলাই ২০১৭ তারিখ প্রকাশিত তদন্ত রিপোর্টে বয়লার বিস্ফোরণের সাতটি কারণ চিহ্নিত করা হয়। তার মধ্যে পাঁচটি হলো যান্ত্রিক ও বাকি দুইটি হলো কারখানার প্রশাসনিক ত্রুটি।

মালিক/পরিচালকেরা অতিরিক্ত মুনাফার লোভে যেন কর্মস্থলের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো গাফিলতি না করতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তার জন্য রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে- যেমন কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর, বয়লার পরিদর্শন দপ্তর ইত্যাদি। কিন্তু পাঁচ ছয় হাজার বয়লারের জন্য যদি মাত্র ৫ জন পরিদর্শক থাকে তাহলে কীভাবে এই তদারকির কাজ যথাযথ হবে? এভাবে মালিকগোষ্ঠীর মুনাফার স্বার্থে যদি এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করে রাখা হয়, যদি প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত লোকবল না থাকে, যদি নিয়মিত তদারকি না হয় এবং মালিকরা যদি যা ইচ্ছা তা করে পার পেয়ে যেতে থাকে, তাহলে তো একের পর এক এরকম দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

পাঁচ ছয় হাজার বয়লারের জন্য যদি মাত্র ৫ জন পরিদর্শক থাকে তাহলে কীভাবে এই তদারকির কাজ যথাযথ হবে? এভাবে মালিকগোষ্ঠীর মুনাফার স্বার্থে যদি এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করে রাখা হয়, যদি প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত লোকবল না থাকে, যদি নিয়মিত তদারকি না হয় এবং মালিকরা যদি যা ইচ্ছা তা করে পার পেয়ে যেতে থাকে, তাহলে তো একের পর এক এরকম দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

৬। তেল দূষণ

২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত শ্যালা নদীতে ফার্নেস তেলবাহী জাহাজ দুর্ঘটনার কারণে প্রায় সাড়ে তিন লাখ লিটার তেল সুন্দরবনের জয়মনি, নন্দবালা, আন্ধারমানিক, মৃগমারী এলাকার প্রায় ২০ কিলোমিটারজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।৮৪তেল দূষণ পরবর্তী সরকারি তৎপরতা থেকে বোঝা যায় সুন্দরনবনের মধ্যে দিয়ে নদী পথে তেলবাহী জাহাজ চলাচলের অনুমোদন দেয়া হলেও তেল দূষণ ঘটলে কী করতে হবে তার কোনো প্রস্তুতিই সরকারের ছিলনা।

২০১৪ এর ডিসেম্বরে সুন্দরবনে শেলা নদীতে তেল দূষণ, ছবি: কল্লোল মোস্তফা

বিশ্বের অন্যান্য স্থানে এ রকম তেল দুর্ঘটনা কোনো সাগর, নদী বা স্থলভূমিকে যখন দূষিত করে, তাৎক্ষণিক দূষণ প্রতিরোধী নানা যন্ত্র যেমন তেল ছড়িয়ে পড়া রোধে ‘কনটেইনমেন্ট বুম’ এবং ছড়িয়ে পড়া তেল উঠিয়ে ফেলার জন্য নানা ‘অয়েল স্কিমার’ ব্যবহার করা হয়। আর এসব যন্ত্রপাতি বিশ্ববাজারে সহজলভ্য, অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের হয়ে থাকে এবং তা কারও কাছে না থেকে থাকলে সহজেই তাৎক্ষণিকভাবে ক্রয় ও জোগাড় করা যায়। অথচ আমরা লক্ষ্য করি যে, কোনো রকম যান্ত্রিক বা কারিগরি পন্থা অবলম্বনের পরিবর্তে সুন্দরবনে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া তেল পরিষ্কার করতে কেবল স্থানীয় জনগণকে কাপড় বা স্পঞ্জের টুকরো দিয়ে তেল ওঠানোর কাজে লাগানো হয়!৮৫

২০১৪ এর ডিসেম্বরে সুন্দরবনে তেল দূষণের পর স্থানীয় এক শিশুর ঝুঁকিপূর্ণ তেল সংগ্রহ, ছবি: কল্লোল মোস্তফা

সুন্দরবনের তেল দূষণের ঘটনায় সরকার ও জাতিসংঘেরযৌথ তদন্ত দলের পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশগুলোর মধ্যে দশমটিতে বলা হয়েছিল: “তেল দূষণ মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি খুবই দুর্বল।“৮৬ এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠার জন্য যে সুপারিশগুলো করা হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল: তেল দূষণ বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য খসড়া ন্যাশনাল অয়েল কন্টেনজেন্সি প্ল্যান চূড়ান্ত করা, আন্তর্জাতিক আইন কানুনের সাথে মিল রেখে দেশে তেল দূষণ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন আইনকানুন তৈরি করা। তেল দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ওপিআরসি বা অয়েল পলিউশান প্রিপেয়ার্ডনেস, রেসপন্স এন্ড কো অপারেশন নামের যে আন্তর্জাতিক কনভেনশনে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে, সেই কনভেশনের নিয়ম অনুযায়ী তেল বিপর্যয় মোকাবিলার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করা। শুধু জাতিসংঘ ও সরকারি যৌথ তদন্ত দলই নয়, দেশের ও দেশের বাইরের বহু সংগঠন ও বিশেষজ্ঞ পর্যায় থেকেও তেল দূষণ মোকাবিলার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছিল। ৯ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে দেয়া সুপারিশে বলা হয়েছিল: “ভবিষ্যতে নদী বা সাগরে যে কোনো ধরণের তেল দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব সীমিত করণের জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে, দ্রুত প্রয়োজনীয় উপকরণ ও যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করতে হবে।৮৭

শুধু তাই না ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সুন্দরবনে তেল দুর্ঘটনা ঘটারও বহু আগে ২০০২ সনে এডিবি’র ঋণ নিয়ে করা “অয়েল স্পিল ইমপ্যাক্ট অন সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট” নামের একটি স্টাডি রিপোর্টে তেল দুর্ঘটনা মোকাবিলার জন্য বুম, স্কিমার, সরবেন্ট ম্যাটেরিয়াল, ভ্যাকুয়াম পাম্প সংগ্রহ করার সুপারিশ করা হয়েছিল।৮৮ তখন সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে সুন্দরবনের ভেতর তেল দুর্ঘটনা ঘটলেও এত বড় আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারতো না। এমনকি সাম্প্রতিক সুন্দরবনের তেল দুর্ঘটনার পরেও যদি এই যন্ত্রপাতিগুলো সংগ্রহ করা হতো এবং একটি সমন্বয় কর্তৃপক্ষ গঠন করা হতো তাহলেও ভবিষ্যতের যেকোনো তেল দূষণ মোকাবিলা সহজ হতো। কিন্তু সুন্দরবনের তেল দূষণের ৬ মাস পার হয়ে গেলেও এ সকল সুপারিশ অনুযায়ী সরকার সারা দেশের নদী বা সাগরে তেল দূষণ মোকাবিলার কোনো প্রস্তুতিই যে গ্রহণ করেনি তা স্পষ্ট হয়ে যায় ২০১৫ সালের ১৯ জুন চট্টগ্রাম-দোহাজারি লাইনের একটি ঝুঁকিপূর্ণ সেতু ভেঙে দোহাজারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বহন করা তেল ভর্তি ওয়াগান পানিতে পড়ার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ থেকে।৮৯ ১০ বছর আগেই ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষিত রেল সেতুর উপর দিয়ে দোহাজারির ১০০ মেগাওয়াট তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য তেল পরিবহন করতে গিয়ে সেতু ভেঙে তেল ভর্তি ৩টি ওয়াগন পানিতে ডুবে যায়। প্রতিটি ওয়াগনে থাকা ২৫ হাজার টন করে মোট প্রায় ৭৫ হাজার টন তেল পানিতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তেল ভর্তি ওয়াগন পানিতে পড়ার পর ৫ দিনের বেশি পার হয়ে গেলেও সুন্দরবনের তেল দূষণের ঘটনার মতোই এবারও তেল ছড়ানো বন্ধ করা কিংবা পানি থেকে তেল উত্তোলনের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি।৯০ অথচ সুন্দরবনের শ্যালা নদীর তেল দূষণ থেকে শিক্ষা নিলে খুব দ্রুতই তেল দূষণ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হতো।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সুন্দরবনে তেল দুর্ঘটনা ঘটারও বহু আগে ২০০২ সনে এডিবি’র ঋণ নিয়ে করা “অয়েল স্পিল ইমপ্যাক্ট অন সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট” নামের একটি স্টাডি রিপোর্টে তেল দুর্ঘটনা মোকাবিলার জন্য বুম, স্কিমার, সরবেন্ট ম্যাটেরিয়াল, ভ্যাকুয়াম পাম্প সংগ্রহ করার সুপারিশ করা হয়েছিল।৮৮ তখন সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে সুন্দরবনের ভেতর তেল দুর্ঘটনা ঘটলেও এত বড় আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারতো না।

তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য তেল পরিবহন করতে গিয়ে রেল দুর্ঘটনা এই প্রথম নয়, এই দোহাজারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য তেল পরিবহন করতে গিয়ে এর আগে আরো দুটি ঘটনা ঘটেছে। গত ৯ জুলাই ২০১৪ তারিখ ৬টি তেল ভর্তি ওয়াগান সিতাকুণ্ড উপজেলার ফৌজদারহাট রেল স্টেশনের কাছে লাইন চ্যুত হলে প্রায় ৫৩ হাজার লিটার ফার্নেস তেল নিকটতস্থ ক্যাডেট কলেজ ছড়া নামে পরিচিত খালে ছড়িয়ে পড়ে এবং ৩০ জুলাই ২০১৩ সালে তিনটি তেল ভর্তি ওয়াগন বোয়ালখালি উপজেলার বড়ুয়া পাড়া এলাকায় লাইনচ্যুত হয়।৯১ কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ কিংবা সরকার এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেনি বা সতর্কতা মূলক কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি উল্টো ১০ বছর আগেই ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষিত সেতুর উপর দিয়ে তেল ভর্তি ওয়াগন চালনা করেছে। তেল দূষণ মোকাবিলার ন্যূনতম প্রস্তুতি থাকলেও ঘটনা ঘটার সাথে সাথে পানির উপর ভাসমান বুম দিয়ে ওয়াগন থেকে তেল চারিদিকে ছড়িয়ে পড়া ঠেকানোর ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হতো। এরপর বিভিন্ন ধরণের তেল শোষণকারী সরবেন্ট ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে পানি থেকে দ্রুত তেল শোষণের ব্যবস্থা নেয়া হতো এবং খুব দ্রুত পানি থেকে ওয়াগনগুলো তুলে ফেলার ব্যবস্থা হতো। তেল দূষণ মোকাবিলার জন্য এগুলো খুবই সাধারণ প্রক্রিয়া, অথচ যথাযথ প্রস্তুতি না থাকার কারণে এ ধরণের কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। যে কারণে পানিতে ডুবন্ত ওয়াগন থেকে ফার্নেস তেল বোয়াল খালি খাল থেকে কর্ণফুলি ও দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদীতে চলে গেছে।

অবহেলা, প্রস্তুতিহীনতা ও সমন্বয়হীনতার একটা দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় সরকারি জোটের অন্তর্ভুক্ত জাসদের সাংসদ মঈন উদ্দীন খান বাদলের সংসদে দেয়া বক্তব্য থেকে। বিডিনিউজ২৪ এ প্রকাশিত খবর থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০১৫ সালের ২১ জুন জাতীয় সংসদে এক অনির্ধারিত আলোচনায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ দ্রুত তেল অপসারণের ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে স্থানীয় সাংসদ বাদল সংসদে বলেন,

আমি রেলের কর্মকর্তাদের তেল নিঃসরণ বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললে তারা বলেন, ‘স্যার আমাদের কিছু করার নেই’।”তিনি বলেন, “কর্ণফুলী পোর্ট অথরিটির তেল অপসারণের একটি জাহাজ আছে। আমি চেয়ারম্যানকে ফোন করেছিলাম। কিন্তু ছুটির দিন বলে পাইনি।

“শুনেছি আজ তারা জাহাজ নিয়ে কর্ণফুলী নদীতে দেখতে গেছেন- কি করা যায়। দুর্ঘটনাস্থল থেকে বন্দর নয় কিলোমিটার দূরে। ১৯ তারিখে ঘটেছে, আজ ২১ তারিখ। ৭২ ঘণ্টা লেগেছে নয় কিলোমিটার যেতে।”৯২

তেল ছড়িয়ে পড়া সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর ২১ জুন ভাসমান বুম বসানো হয় কিন্তু সে বুমও কোনো কাজ করছে না বলে সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।৯৩ পানি থেকে তেল উত্তোলনের তৎপরতা বলতে কেবল স্থানীয় জনগণের মাধ্যমে খালি হাতে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে তেল সংগ্রহ।৯৪

চট্টগ্রামের বোয়ালখালিতে তেল দূষণের পর ঝুঁকিপূর্ণভাবে তেল উত্তোলণের চেষ্টা করছে একজন শিশু। ছবি: অরুপ কান্তি দাশ, ডেইলিস্টার, ২৬ জুন ২০১৫

কেউ যদি ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনে শ্যালা নদীতে তেল দূষণের পরবর্তী সংবাদগুলো এখন পড়ে দেখেন, দেখবেন তখনও এই ঘটনাগুলো ঘটেছে- তেল ছড়িয়ে পড়া বন্ধে বা ছড়িয়ে পড়া তেল উত্তোলণের কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, ঘটনাস্থলে সরকারি জাহাজ অনেক দেরীতে পাঠানো হয়েছে কিন্তু তেল দূষণ নিয়ন্ত্রণে সেই জাহাজের কোনো ভূমিকা দেখা যায় নি, তেলের ট্যাংকার দ্রুত পানি থেকে উত্তোলণের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এই কাজগুলো না করার পেছনে বনবিভাগ, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়, মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তর পরস্পরকে দায়ী করেছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। সুন্দরবনের সেই তেল দূষণের ৬ মাস পরেও ২০১৫ সালের জুন মাসে একই ধরণের অবহেলা ও সমন্বয়হীনতা দেখা যায়, যার খেসারত দিতে হয় কর্ণফুলি ও হালদানদীর প্রাণ-প্রকৃতি ও তার উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর জীবন জীবিকার ব্যাপক ক্ষতির মধ্যে দিয়ে।

সুন্দরবনের সেই তেল দূষণের ৬ মাস পরেও ২০১৫ সালের জুন মাসে একই ধরণের অবহেলা ও সমন্বয়হীনতা দেখা যায়, যার খেসারত দিতে হয় কর্ণফুলি ও হালদানদীর প্রাণ-প্রকৃতি ও তার উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর জীবন জীবিকার ব্যাপক ক্ষতির মধ্যে দিয়ে।

ছয় মাস সময়কে যদি প্রস্তুতি নেয়ার জন্য যথেষ্ট সময় মনে না হয় তাহলে চলুন দেখা যাক সুন্দরবনের তেল দূষণের প্রায় সাড়ে ৪ বছর পর আরেকটি তেল দুর্ঘটনার পর কী ঘটেছিল। চট্টগ্রামের হাটহাজারী একশ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আনা ফার্নেস অয়েলবাহী সাতটি রেলওয়ে ওয়াগনের তিনটি ২০১৯ সালের ২৯ এপ্রিল বিকালে উপজেলার এগার মাইলস্থ আবুল কালাম মাদরাসার ব্রিজ ভেঙে হালদা নদীর শাখা খাল ‘মরা ছড়ার’ নিচে পড়ে যায়। এতে প্রায় কয়েক হাজার লিটার ফার্নেস অয়েল খালে ছড়িয়ে পড়ে। তিনটি ওয়াগনে এক লাখ পাঁচ হাজার লিটার ফার্নেস অয়েল ছিল বলে জানায় কর্তৃপক্ষ। ডেইলি স্টার বাংলা অনলাইনে প্রকাশিত “হালদার সংযোগ খালে কয়েক হাজার লিটার ফার্নেস ওয়েল, ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে জীব বৈচিত্র্য” শীর্ষক সংবাদ থেকে দেখা যায়-

বিষাক্ত তেলের স্রোত যাতে হালদা নদীর দিকে যেতে না পারে, সেজন্য তাৎক্ষণিক খালটির ভাটা এলাকায় বালির বস্তার ১০টি বাঁধ দেওয়া হয়েছে। তাই অল্পের জন্য প্রাকৃতিক উপায়ে মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীর মাছ, পরিবেশ ও প্রকৃতি ভয়াবহ হুমকি থেকে রক্ষা পেলেও এখনো শঙ্কামুক্ত নয়।

স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র জানায়, হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুহুল আমিনের দ্রুত সিদ্ধান্তে এই বাঁধ দেওয়ার পর রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ৬ হাজার লিটার ফার্নেস ওয়েল তেল নদী থেকে তোলা সম্ভব হয়েছে। বাকি তেল উত্তোলনের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।

তেল নিষ্কাশনে স্থানীয়দের মাঝে আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, যারা এসব তেল তুলে আনবে তাদের কাছ থেকে ২০ টাকা দরে প্রতি লিটার কিনে নেওয়া হবে। এ ঘোষণার পর স্থানীয়রা খাল থেকে ফার্নেস ওয়েল তুলে এনে উপজেলা প্রশাসনের কাছে বিক্রি করতে দেখা গেছে।.., …৯৫

 
হালদা নদীর শাখা খাল ‘মরা ছড়ায়’ কয়েক হাজার লিটার ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ে, ছবি: রাজিব রায়হান, ২৯ এপ্রিল ২০১৯, ডেইলিস্টার
হালদার সংযোগ খাল ছড়া থেকে ফার্নেস ওয়েল সংগ্রহ করছে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয়রা। ছবি- ইউএনবি, ৩০ এপ্রিল ২০১৯

আসলে যে কোনো দুর্যোগ বা দুর্ঘটনা মোকাবিলার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পরিকল্পনা ও সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি। কোনো দুর্ঘটনা প্রথমবার ঘটলে এবং তার কোনো পূর্বাভাস না থাকলে প্রস্তুতিহীনতা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু কোনো ঘটনা বারবার ঘটতে থাকলে প্রস্তুতিহীনতার কোনো সুযোগ নেই। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তৈরির সময়ই পরিকল্পনা করা প্রয়োজন ছিল তেল পরিবহণ কোন পথ দিয়ে কীভাবে হবে এবং তার জন্য নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা কী হবে, দুর্ঘটনা ঘটলে কীভাবে তা মোকাবিলা করা হবে। তেল পরিবহন হলে যে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এটা কারোরই অজানা থাকার কথা নয়। জীর্ণ রেল সেতু কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ নদীপথে দিনের পর দিন তেল পরিবহন করা হবে কিন্তু কোনো দুর্ঘটনা মোকাবিলার প্রস্তুতি নেওয়া হবে না-এটা কাঠামোগত অব্যবস্থাপনা ছাড়া আর কিছু নয়।

জীর্ণ রেল সেতু কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ নদীপথে দিনের পর দিন তেল পরিবহন করা হবে কিন্তু কোনো দুর্ঘটনা মোকাবিলার প্রস্তুতি নেওয়া হবে না-এটা কাঠামোগত অব্যবস্থাপনা ছাড়া আর কিছু নয়।

৭। শেষ কথা

বাংলাদেশে নিয়মিত ঘটতে থাকা বিভিন্ন দুর্ঘটনার বিশ্লেষণে দেখা যায় এমন সব কাঠামোগত কারণে বার বার মর্মান্তিক সব দুর্ঘটনা ঘটে যার অধিকাংশ কারণই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জানা থাকার কথা এবং সুনির্দিষ্ট কতগুলো পদক্ষেপ নিলে সেইসব দুর্ঘটনার হার বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু নানা কারণে এই অতি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো না নেয়ার কারণে দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিদ্যমান ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থা চলমান থাকাই বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য লাভজনক, ফলে এসব গোষ্ঠির প্রভাবে কাঠামোগত সমস্যাগুলো সমাধানের পথে বাধা তৈরি হয় । আবার দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য যে বাড়তি বিনিয়োগ করতে হয় তা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জন্য দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হলেও তাৎক্ষণিক লাভ লোকসান বিবেচনায় অনেকেই এই বিনিয়োগটুকু করতে চায় না। আর এ কারণেই নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের প্রাতিষ্ঠানিক তদারকি এক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি দেখে দুর্ঘটনা ঘটলে তাদের কোনো শাস্তি বা ক্ষতিপূরণের মুখোমুখি হতে হচ্ছে না তাহলে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বিনিয়োগের কোনো তাগিদ সেই প্রতিষ্ঠানের থাকে না। বিপরীতক্রমে দুর্ঘটনা ঘটলে যদি তার পুঙ্খানুপঙ্খ তদন্তের মাধ্যমে দুর্ঘটনার পূর্বশর্ত ও অন্তরালের বিভিন্ন কাঠামোগত কারণ উন্মোচন করে তার জন্য সংশ্লিষ্টদের সকলকে শাস্তি ও ক্ষতিপূরণের মুখোমুখি করা হয় তাহলে ঐ প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সকল ধরণের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বনে বাধ্য হয়। বাংলাদেশে খুব কম ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনার জন্য কোনো কারখানা বা যানবাহন বা কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিক ও ব্যবস্থাপক থেকে শুরু করে অনুমোদন ও তদারককারী প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের জবাবদিহি ও শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়! বিশ্বের যেসব দেশে সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রতিটি দুর্ঘটনার জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয় সেসব দেশে দুর্ঘটনার হার অনেক কম। বাংলাদেশে এমন কোনো জবাবদিহিতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে ওঠেনি বলেই দুর্ঘটনার কাঠামোগত ভিত্তিগুলো দিনের পর দিন অক্ষুন্নই থেকে যায়।

বিশ্বের যেসব দেশে সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রতিটি দুর্ঘটনার জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয় সেসব দেশে দুর্ঘটনার হার অনেক কম।

কল্লোল মোস্তফা: প্রকৌশলী, লেখক
ইমেইল: Kallol_mustafa@yahoo.com

তথ্যসূত্র:

১) ‘Tripod Beta: Guidance on using Tripod Beta in the investigation and analysis of incidents, accidents and business losses’, February 2015, Energy institute London

২) ‘বিশৃঙ্খল সড়কে শুধুই কান্না’, প্রথম আলো, ৭ মার্চ ২০২০,

৩) ‘৩৩ শতাংশ বাসের ফিটনেস নেই’, সমকাল, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

৪) ‘ফিটনেস সনদ ছাড়া সড়কে ৪ লাখ ৭৯ হাজার যান’, প্রথম আলো, ২৩ জুলাই ২০১৯

৫) ‘সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন নয় লাখ ভুয়া চালক’, প্রথম আলো, ০৩ আগস্ট ২০১৮

৬) ‘ফিটনেস সনদ মেলে এক পলকের দেখায়’, সমকাল, ২২ অক্টোবর ২০১৮

৭) ‘ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমেছে’, প্রথম আলো, ২১ আগস্ট ২০১৩

৮) ‘বাসচালক জামিরের মৃত্যুতে আমাদের দায়’, https://www.dw.com/bn, ৩ আগষ্ট ২০২০

৯) ‘ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমেছে’, প্রথম আলো, ২১ আগস্ট ২০১৩

১০) ‘সম্পাদকীয়: সড়ক দুর্ঘটনা’, প্রথম আলো, ১৪ আগস্ট ২০১৪

১১) ‘বিশৃঙ্খল সড়কে শুধুই কান্না’, প্রথম আলো, ৭ মার্চ ২০২০

১২) ‘সড়ক, যান, চালক কিছুই ঠিক নেই’, প্রথম আলো, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

১৩) ‘বিশৃঙ্খল সড়কে শুধুই কান্না’, প্রথম আলো, ৭ মার্চ ২০২০

১৪) ‘সড়ক, যান, চালক কিছুই ঠিক নেই’, প্রথম আলো, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

১৫) ‘ভুয়া চালকে চলছে ৩৮% ভারী যান’, প্রথম আলো, ২৩ জুন ২০১৯

১৬) ‘অর্ধেক চালকেরই লাইসেন্স নেই’, প্রথম আলো, ২৩ মার্চ ২০১৯

১৭) ‘নৌ দুর্ঘটনা কমছে, দাবি নৌ অধিদপ্তরের’, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ৩ এপ্রিল ২০১৯

১৮) ‘২০ বছরে লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহত ৬৪০৮’, মানবজিমন, ৬ মে ২০১৭

১৯) ‘১৪ বছরে ৫৩৫টি বড় নৌ দুর্ঘটনা’, বাংলা ট্রিবিউন, জানুয়ারি ২৫, ২০১৯

২০) ‘লঞ্চডুবিতে ২৮ জনের মৃত্যু’, প্রথম আলো, ২২ এপ্রিল ২০১১

২১) ‘An Analysis of Accidents in the Inland Waterways of Bangladesh: Lessons from a Decade (2005-2015)’, 2016, Md. Imran Uddina, M. Rafiqul Islamb, Zobair Ibn Awalb, Kazi Md. Shifun Newaz, Procedia Engineering, Volume 194, 2017, Pages 291-297

২২) ‘চাঁদপুর-নারায়ণগঞ্জ নৌ-পথে ডুবোচরে নাব্য সংকট’, চ্যানেল আই অনলাইন, ১৭ এপ্রিল, ২০১৮; ‘ঢাকা-বরিশাল নৌপথে চর ও ডুবোচরে লঞ্চ চলাচল ঝুঁকিতে’, ইত্তেফাক, ২৩ জানুয়ারি, ২০১৯; ‘ডুবোচরে ৪ হাজার যাত্রী নিয়ে দুই লঞ্চ আটকা’, যুগান্তর, ১০ অক্টোবর ২০১৯

২৩) ‘ঢাকা-বরিশাল নৌরুটে দুর্ঘটনার আশঙ্কা: বিকন বাতি, বয়া ও মার্কার সংকট’, ভোরের কাগজ, ১৪ জুন ২০১৮; ‘ঢাকা-বরিশাল নৌপথ: বয়া ও বিকন বাতির সংকট ঝুঁকি নিয়ে চলছে নৌযান’, প্রথম আলো, ২৮ আগষ্ঠ ২০১১

২৪) ‘বয়া-বিকন বাতি নষ্ট অনুমানে চলছে চাঁদপুর-ঢাকা নারায়ণগঞ্জ রুটে নৌযান’, মানবজমিন, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

২৫) ‘ঝুঁকি বাড়াচ্ছে ঘন কুয়াশা’, প্রথম আলো, ১৮ জানুয়ারি ২০২০

২৬) ‘আধুনিক সরঞ্জামের অভাবে কুয়াশায় ঝুঁকিপূর্ণ নৌপথ’, ইত্তেফাক, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৮

২৭) ‘An Analysis of Accidents in the Inland Waterways of Bangladesh: Lessons from a Decade (2005-2015)’, 2016, Md. Imran Uddin, M. Rafiqul Islamb, Zobair Ibn Awalb, Kazi Md. Shifun Newaz, Procedia Engineering, Volume 194, 2017, Pages 291-297

২৮) ‘নৌযানের নকশা অনুমোদন এবং তদারকি ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ চাই’, কোস্ট ট্রাস্ট, ২০১৫

http://coastbd.net/wp-content/uploads/2015/12/Position-Paper_Launch-accident.pdf acceesed on 22 March 2020

২৯) ‘ঝড়ের মৌসুমে নদীতে বড় লঞ্চ চালানোর সুপারিশ’, প্রথম আলো, ০৯ মে ২০১৪

৩০) ‘দ্বিতীয় দফায় ডুবল এমভি শাথিল’, প্রথম আলো, ০৪ মে ২০১৪

৩১) ‘মেঘনায় লঞ্চডুবি’, প্রথম আলো, ১৮ মে ২০১৪

৩২) ‘লঞ্চ নকশাকার, সনদ প্রদানকারী ও নির্মাতার শাস্তির বিধান নেই!’, প্রথম আলো, ১৭ মে ২০১৪

৩৩) ‘পিনাক-৬ লঞ্চডুবি: তিন বছরেও অভিযোগপত্র জমা হয়নি’, প্রথম আলো, ০৩ আগস্ট ২০১৭

৩৪) ‘Reasons and Remedies of Inland Passenger Vessels Accidents in Bangladesh’, Cdr Kaosar Rashid, (E), psc, BN1, and Major Muhammad Rabiul Islam, PhD, EME1, AIP Publishing, 28 December 2017; ‘তিন কারণে সর্বনাশ’, কালেরকন্ঠ, ৫ আগস্ট, ২০১৪

৩৫) ‘দুর্ঘটনা তদন্তে দুটি কমিটির গণশুনানি’, প্রথম আলো, ০১ মার্চ ২০১৫

৩৬) ‘লঞ্চডুবিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৭০’, প্রথম আলো, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

৩৭) ‘লঞ্চ নকশাকার, সনদ প্রদানকারী ও নির্মাতার শাস্তির বিধান নেই!’, প্রথম আলো, ১৭ মে ২০১৪

৩৮) ‘রঙে নতুন হয়ে উঠছে ফিটনেসবিহীন লঞ্চ’, সমকাল, ৩১ মে ২০১৮

৩৯) ‘নৌযানের ফিটনেস পরীক্ষায় অনিয়ম বন্ধের দাবি’, কালেরকণ্ঠ, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

৪০) ‘সনদবিহীন নৌযান চলাচল’, প্রথম আলো, ২৫ মে ২০১৯

৪১) ‘অবৈধ নৌযান’, প্রথম আলো, ০৭ মে ২০১৭

৪২) ‘ডুবে যাওয়া ঐশী প্লাসের অনুমতি ছিল না’, প্রথম আলো, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

৪৩) ‘লঞ্চ দুর্ঘটনার ১০ কারণ’, প্রথম আলো, ০১ জুন ২০১৪

৪৪) ‘মেঘনায় লাশের সারি’, প্রথম আলো, ১৪ মার্চ ২০১২

৪৫) ‘মেঘনায় গেল কত প্রাণ’, কালের কন্ঠ, ১৪ মার্চ, ২০১২

৪৬) ‘মেঘনায় লাশের সারি’, প্রথম আলো, ১৪ মার্চ ২০১২

৪৭) ‘লঞ্চগুলোতে জীবন রক্ষাকারী পর্যাপ্ত সরঞ্জাম নেই’, প্রথম আলো, ৩০ জুলাই ২০১৩

৪৮) ‘লঞ্চযাত্রীদের জীবন রক্ষার সরঞ্জাম কম’, প্রথম আলো, ০৩ জুন ২০১৬

৪৯) ‘নৌদুর্ঘটনার বিচার তদন্তেই সীমাবদ্ধ’, সমকাল, ৩০ জুন ২০২০

৫০) ‘২০১৯ সালে ৩৯৩ রেল দুর্ঘটনায় নিহত ৪২১’, ইত্তেফাক, ০৬ জানুয়ারি, ২০২০

৫১) ‘২০১৯ সালে সড়কে প্রাণ গেছে ৭ হাজার ৮৫৫ জনের: যাত্রী কল্যাণ সমিতি’, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১২ জানুয়ারি ২০২০

৫২) ‘Information Book 2018’, Bangladesh Railway, পৃষ্ঠা ৯৮

৫৩) ‘রেলে বিপুল ব্যয়, তারপরও অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং’, প্রথম আলো, ১৮ জুলাই, ২০১৯

৫৪) ‘ঝুঁকিপূর্ণ রেলসেতু ৪০২টি মানসম্মত লাইন ২৫.২৩%’, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৩১ জুলাই, ২০১৯; ‘রেল দুর্ঘটনার যত কারণ’, বাংলা ট্রিবিউন, ১২ নভেম্বর ২০১৯; ‘রেলকে প্রাণঘাতী করছে জীর্ণ পথ আর সেতু’, কালেরকণ্ঠ, ২৫ জুন, ২০১৯

৫৫) ‘রেলে সব আছে, শৃঙ্খলা নেই’, প্রথম আলো, ৭ জুলাই, ২০১৯

৫৬) ‘সিলেট-আখাউড়া রেলপথে ১৩ টি ঝুঁকিপূর্ণ সেতু দিয়েই চলে ট্রেন’, ইউএনবি, ২৮ জুন, ২০১৯

৫৭) ‘সংস্কারের অভাবেই রেলে মৃত্যুফাঁদ’, সমকাল, ২৫ জুন ২০১৯

৫৮) ‘কসবার ট্রেন দুর্ঘটনা চালকের গাফিলতিতে’, সমকাল, ২০ নভেম্বর ২০১৯

৫৯) ‘চা পানে চালক অজ্ঞান’, প্রথম আলো, ১৪ ডিসেম্বর ২০১০

৬০) ‘রেলে বিপুল ব্যয়, তারপরও অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং’, প্রথম আলো, ১৮ জুলাই, ২০১৯

৬১) অগ্নিদুর্ঘটনার পরিসংখ্যান, ২০০৪ থেকে ২০১৮ এবং ২০১৯ এর বার্ষিক পরিসংখ্যান, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স

৬২) ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, বাৎসরিক পরিসংখ্যান-২০১৯

৬৩) ‘পুড়ে অঙ্গার শত প্রাণ’, প্রথম আলো, ২৭ নভেম্বর, ২০১২

৬৪) তাজরীণ অগ্নিকাণ্ড বিষয়ে সরেজমিন অভিজ্ঞতার বিবরণের জন্য দেখুন: ‘সরেজমিন: যেভাবে কয়লা বানানো হলো তাজরিন গার্মেন্টস এর শ্রমিকদের’, কল্লোল মোস্তফা, ২৫ নভেম্বর, ২০১২

https://web.facebook.com/notes/kallol-mustafa/431392746915117

৬৫) শিকাদর প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের সরেজমিন অভিজ্ঞতার বিবরণের জন্য দেখুন-

https://web.facebook.com/photo?fbid=10151768071812668

৬৬) ‘গাজীপুরে পোশাক কারখানায় আগুন, নিহত ৯’, প্রথম আলো অনলাইন, ০৮ অক্টোবর ২০১৩

৬৭) আসওয়াদ কম্পোজিট মিলস অগ্নিকাণ্ড বিষয়ে সরেজমিন অভিজ্ঞতার বিবরণের জন্য দেখুন: শ্রমিক পোড়ানোর এই আয়োজনে কেউ দায়ী নয়, কল্লোল মোস্তফা, ০৯ অক্টোবর, ২০১৩

https://web.facebook.com/notes/kallol-mustafa/558061087581615

৬৮) ‘বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়াই গ্যাস লাইটার কারখানা’, প্রথম আলো, ২৫ নভেম্বর ২০১৬

৬৯) ‘এফআর টাওয়ারে আগুন: মামলার তদন্ত এক বছরেও শেষ হয়নি’, প্রথম আলো, ২৮ মার্চ ২০২০

৭০) তথ্যগুলো নেয়া হয়েছে ৩০ মার্চ ২০১৯ প্রথম আলোতে প্রকাশিত বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো.মাকসুদ হেলালীর সাক্ষাৎকার ও ‘অগ্নি সংকেত বাজেনি তীব্র ধোঁয়ায় প্রাণহানি’ শীর্ষক রিপোর্টে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারীর দেয়া বক্তব্য থেকে। তার উভয়েই অগ্নিদুর্ঘটনাকবলিত বনানীর এফ আর টাওয়ার পরিদর্শন শেষে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।

৭১) ‘আগেও আগুন লেগেছিল এফ আর টাওয়ারে’, বাংলা ট্রিবিউন, ২৯ মার্চ ২০১৯

৭২) ‘রাসায়নিক থেকেই চুড়িহাট্টার আগুন’, প্রথম আলো, ১৪ মার্চ, ২০১৯

৭৩) ‘রাসায়নিক থেকেই নিমতলীর আগুন’, প্রথম আলো, ১৬ জুন, ২০২০

৭৪) ‘চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির ১ বছর: কেমিক্যাল শিল্প পার্ক কতদূর’, সমকাল, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০; ‘প্রকল্পই হয়েছে, পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের কারখানা সরেনি’, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০

৭৫) ‘টিআইবির গবেষণার তথ্য: কেউ নেন ৩০০, কেউবা আড়াই লাখ’, প্রথম আলো, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২০

৭৬) ‘বয়লার বিস্ফোরণে নিহত বেড়ে ৭, মালিকের বিরুদ্ধে মামলা’, বাংলা ট্রিবিউন, ২৬ জানুয়ারি, ২০১৬

৭৭) ‘যন্ত্রণা আর বিষাদে মলিন ঈদ’, প্রথম আলো, ৩০ জুন, ২০১৭

৭৮) ‘গাজীপুরে বয়লার বিস্ফোরণ: মালিকের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের রিট’, বাংলা ট্রিবিউন, ০৯ জুলাই, ২০১৭

৭৯) ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, বাৎসরিক পরিসংখ্যান-২০১৯

৮০) ‘৮০০ বয়লার মেয়াদোত্তীর্ণ’, সমকাল, ০৬ জুলাই ২০১৭

৮১) ‘নিহত ব্যক্তিরাই দায়ী’, প্রথম আলো, ২৮ এপ্রিল ২০১৯

৮২) ‘মালটিফ্যাবসের গাফিলতির মূল্য মাত্র ২০ হাজার টাকা!’, প্রথম আলো, ০৬ জুলাই ২০১৭

৮৩) ‘গাজীপুরে মাল্টি ফ্যাবস কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণ তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ’, ইত্তেফাক, ১৪ জুলাই, ২০১৭

৮৪) ‘সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়ছে তেল’, প্রথম আলো, ১০ ডিসেম্বর ২০১৪

৮৫) ‘তেল বিপর্যয় ঠেকাতে দুর্বল ব্যবস্থাপনা’, বদরুল ইমাম, প্রথম আলো, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪

৮৬) ‘SUNDARBANS OIL SPILL ASSESSMENT’, Joint United Nations/Government of Bangladesh Mission, December 2014, পৃষ্ঠা ৩৯

৮৭) ৯ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে দেয়া ৮ম সুপারিশ https://ncbd.org/?p=1352

৮৮) ‘Sundarban left unprotected for years: Govt ignores its own suggestions’, Tapos Kanti Das, Daily NewAge, 20 December, 2014

৮৯) ‘Three oil wagons plunge into canal in Chittagong of Bangladesh’, ডেইলি স্টার, ২০ জুন, ২০১৫

৯০) Oil spill spreads again, ডেইলি স্টার, ২৬ জুন, ২০১৫

৯১) ‘Three oil wagons plunge into canal in Chittagong of Bangladesh’, ডেইলি স্টার, ২০ জুন, ২০১৫

৯২) ‘তেল ছড়ানো ঠেকাতে ‘অবহেলায়’ বাদলের ক্ষোভ’, বিডিনিউজ২৪ডটকম, ২১ জুন, ২০১৫

৯৩) ‘তেল ছড়িয়েছে হালদায়, মা মাছের ক্ষতির আশংকা’, প্রথম আলো, ২৩ জুন ২০১৫

৯৪) ‘Oil spill spreads again’, ডেইলি স্টার, ২৬ জুন, ২০১৫

৯৫) ‘হালদার সংযোগ খালে কয়েক হাজার লিটার ফার্নেস ওয়েল, ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে জীববৈচিত্র্য’, ডেইলিস্টার বাংলা অনলাইন, ৩০ এপ্রিল, ২০১৯

Social Share
  •  
  •  
  • 123
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *