পাটশিল্প বিশেষ ক্রোড়পত্র-৪
বন্ধ ঘোষিত রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল: আক্রান্ত শ্রমিকদের কথা
রুহুল আমিন
![](https://sarbojonkotha.info/wp-content/uploads/2020/07/jute-mill-workers.jpg)
“২৫ টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ”- খুব ছোট্ট এ বাক্যের গভীরতা ও বিস্তৃতি যে কত ব্যাপক, তা সেদিন যারা ২ জুলাই মিলগেটে বা মিল এলাকায় ছিলেন তারা জানেন। রাত ৯টা থেকে ১০ টার মধ্যে যখন প্রতিটি মিলগেটে নোটিশ লাগিয়ে গেটে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, তখনকার শ্রমিকদের কান্নার দৃশ্য না দেখলে এর গভীরতা বোঝা দুষ্কর।
এক প্রবীণ শ্রমিকের ভাষায়, ‘এর জন্য কি দেশ স্বাধীন করেছিলাম?’
মধ্যবয়সী একজন শ্রমিক আরেকজন শ্রমিকের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ভাই আমরা এখন যাব কোথায়? একেবারে যে সাগরে ভেসে গেলাম।
শ্রমিকের কান্না ও গেটের মুখেই সশস্ত্র অবস্থায় সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের দিকে তাকিয়ে চোখ লাল হয়ে যাওয়া একজন শ্রমিক বলে ওঠেন, এ যেন রাজ্য দখলের মহড়া! একটি রাষ্ট্রকে দখল করার জন্যও মনে হয় এত প্রস্তুতি কেউ নেয় না!
শ্রমিকের কান্না ও গেটের মুখেই সশস্ত্র অবস্থায় সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের দিকে তাকিয়ে চোখ লাল হয়ে যাওয়া একজন শ্রমিক বলে ওঠেন, এ যেন রাজ্য দখলের মহড়া! একটি রাষ্ট্রকে দখল করার জন্যও মনে হয় এত প্রস্তুতি কেউ নেয় না!
পাটকল শ্রমিকদের পরিস্থিতি
রাত বাড়ার সাথে সাথে ব্যস্ত শিল্পাঞ্চল পরিণত হয় শ্মশানে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলোর আলো যেন আজ ম্রিয়মাণ। কয়েকদিন আগেও বয়স্ক শ্রমিকেরা বলেছিলেন, একসাথে সকল পাওনা দিয়ে মিল যদি বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে তাদের কোন আপত্তি নেই। সেই বয়স্ক শ্রমিকদের মধ্যেও এক অজানা কষ্ট সেদিন ভর করেছিল। মিলের প্রতি আবেগ ও কমবয়সি শ্রমিকদের কথা চিন্তা করে তাদের মনও ভারি হয়ে উঠেছিল। তারা ভাবছিলেন, আমি না হয় টাকা পেলাম কিন্তু ওরা যাবে কোথায়? হাজার হলেও শ্রমিক তো !
গত দুই জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে খুলনা অঞ্চলের ৯টি সহ মোট ২৫ টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর ফলে, সরকারি হিসাব মতে কাজ হারান ৫৭ হাজার ১৯১ জন (স্থায়ী- ২৪,৮৮৬ জন, বদলি- ২৩,৮৪২ জন ও দৈনিক ভিত্তিক- ৮,৪৬৩ জন) শ্রমিক। এর সাথে যুক্ত আরো কয়েক লক্ষ পরিবার আজ দিশেহারা। যারা এতদিন যাবৎ এই সকল মিল এলাকায় কাজ ও নানা ধরনের ক্ষুদ্র ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিলেন তারা আজ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কোথায় যাবেন, কী করবেন তারা সেটা ভেবে পাচ্ছেন না।
সর্বাপেক্ষা বেশি খারাপ দৈনিক ভিত্তিক ও অস্থায়ী/বদলি শ্রমিকদের অবস্থা। স্থায়ী শ্রমিকদের বকেয়া টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও অস্থায়ী ও দৈনিক ভিত্তিক শ্রমিকদের টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে তৈরি হয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। বিজেএমসির চেয়ারম্যান ইতোমধ্যে পরিষ্কার করে বলেছেন, স্থায়ী শ্রমিকদের বাইরে তাদের আর কিছু করার নেই। ফলে ৩৩ হাজারের অধিক শ্রমিক পড়ে গেছেন মহা দুশ্চিন্তায়। ১৫ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত চাকরি করে আজ তাদেরকে ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে।
বিজেএমসির চেয়ারম্যান ইতোমধ্যে পরিষ্কার করে বলেছেন, স্থায়ী শ্রমিকদের বাইরে তাদের আর কিছু করার নেই। ফলে ৩৩ হাজারের অধিক শ্রমিক পড়ে গেছেন মহা দুশ্চিন্তায়। ১৫ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত চাকরি করে আজ তাদেরকে ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে।
ইখলাস ভাইয়ের বয়স ৪২ কি ৪৩ হবে। দীর্ঘ ২৪ বছর তিনি খুলনার খালিশপুরের প্লাটিনাম জুট মিলে অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে চাকরি করেছেন। এরপরও তাকে স্থায়ী করা হয়নি। গত এক বছর মিল কর্তৃপক্ষ অস্থায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়ার কারণে তিনি দৈনিক ভিত্তিক শ্রমিক হিসেবে পাশের দৌলতপুর মিলে জয়েন করেন। কিন্তু আজ সেটাও বন্ধ। এখন উপায়? হাজার হাজার শ্রমিকের অবস্থা আজ ইখলাস ভাইয়ের মত।
দীর্ঘ ২৪ বছর তিনি খুলনার খালিশপুরের প্লাটিনাম জুট মিলে অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে চাকরি করেছেন। এরপরও তাকে স্থায়ী করা হয়নি।
মিলে কাজ করা শ্রমিকদের একটা বড় অংশ থাকেন কলোনিতে। বংশ পরম্পরায় তারা এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। গ্রামের বাড়ি ভোলা, বরিশাল, নোয়াখালী, ফরিদপুর হলেও ঐ এলাকায় তাদের আজ কিছুই নেই। থাকার জায়গা বলতে ছিল কলোনির একটিমাত্র ঘর। কিন্তু মিল বন্ধ হওয়ার পর কলোনি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার ভয়ে তারা আতঙ্কিত। দুশ্চিন্তা করছেন, শেষ আশ্রয়ও কি তাদের হারাতে হবে?
পাটকল শ্রমিকদের বক্তব্য
শ্রমিকেরা মনে করেন, মাথায় যদি পচন ধরে তবে মাথা কেটে ফেলা সমাধান নয়। দরকার উন্নত চিকিৎসা। কিন্তু সরকার সেই পথে না হেঁটে মাথা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা আত্মঘাতি ছাড়া আর কিছুই না।
সারাবিশ্বে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা যখন বাড়ছে তখন হঠাৎ করে পাটকল বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়। আর যে লোকসানের কথা বলা হচ্ছে তার জন্য শ্রমিকেরা মোটেই দায়ী নন। এর জন্য দায়ী বিজেএমসির মাথাভারী প্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়। বিজেএমসির দুর্নীতি, পাট মৌসুমে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ ছাড় না দেওয়া ও সরকার দলীয় নেতাদের দালালি ও দুর্নীতির কারণে আজ এই পরিণতি। সরকার এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে শ্রমিকদের মাথায় কুঠারাঘাত করল। একজনের অপরাধের শাস্তি আর একজনকে দেওয়া হল। বছরের পর বছর শ্রমিকদের বেতন ভাতা ঠিকমতো না দিয়ে, আজ সরকার টাকার প্রলোভন দেখিয়ে মিলগুলো বন্ধ করে দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিল সেটা শ্রমিকদের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা।
আর যে লোকসানের কথা বলা হচ্ছে তার জন্য শ্রমিকেরা মোটেই দায়ী নন। এর জন্য দায়ী বিজেএমসির মাথাভারী প্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়। বিজেএমসির দুর্নীতি, পাট মৌসুমে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ ছাড় না দেওয়া ও সরকার দলীয় নেতাদের দালালি ও দুর্নীতির কারণে আজ এই পরিণতি। সরকার এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে শ্রমিকদের মাথায় কুঠারাঘাত করল।
আর যে পরিমাণ টাকার কথা (প্রতিজন শ্রমিক সর্বনিম্ন ৬ লক্ষ থেকে ৫৪ লক্ষ টাকা পাবেন) সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হচ্ছে, তা পাওয়া শ্রমিকদের জন্য আকাশ কুসুম চিন্তা করার সামিল। প্রত্যেকে তার পাওনা টাকা নিয়েই চিন্তিত। কেননা, শ্রমিকদের অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়। আর যে পিপিপির কথা সরকার বলছে সেটাও এক ধরনের ধাপ্পাবাজি বলে মনে করেন তারা। আপাত অর্থে শ্রমিকদের ক্ষোভকে প্রশমন করার জন্য, তাদেরকে দ্বিধা বিভক্ত করার জন্য এই কৌশল নেয়া হচ্ছে।
আজ পর্যন্ত খুলনা অঞ্চলে যতগুলো মিল ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়েছে, সেগুলো অতি দ্রুত চালু হওয়া ও শ্রমিকদের সকল বকেয়া পাওনা পরিষদের ঘোষণা দিয়েই বন্ধ করা হয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে, খুলনার নিউজপ্রিন্ট মিল, হার্ডবোর্ড মিল, খুলনা টেক্সটাইল মিলস, সোনালী, এজাক্স, আফিল জুট মিল ইত্যাদি। কিন্তু আজ অবধি এর একটাও যেমন চালু হয়নি, তেমনি এসকল শিল্পপ্রতিষ্ঠানের একটি বড় অংশের শ্রমিকেরা বুঝে পাননি তাদের পাওনা টাকা। ঐসকল মিলের অনেক বৃদ্ধ শ্রমিক আজ মানবেতর জীবন যাপন করছেন। পাওনা টাকা রেখে চিকিৎসার অভাবে তাদের পাড়ি দিতে হচ্ছে পরপারে।
আজ পর্যন্ত খুলনা অঞ্চলে যতগুলো মিল ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়েছে, সেগুলো অতি দ্রুত চালু হওয়া ও শ্রমিকদের সকল বকেয়া পাওনা পরিষদের ঘোষণা দিয়েই বন্ধ করা হয়েছিল।
আন্দোলন কেন গড়ে উঠছে না?
২৫ টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ হওয়ার পরও কেন শ্রমিকরা রাস্তায় নামলেন না? ৫৭ হাজারের অধিক শ্রমিক কি এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েছেন? দেশের সচেতন মহলকে বিষয়টি ভাবিয়েছে। একটি গার্মেন্টস বন্ধ হলেও শ্রমিকরা যেখানে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন, সেখানে হাজার হাজার শ্রমিক ও শ্রমিক নেতারা টু শব্দটি পর্যন্ত করলেন না!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথমদিকে জার্মান বাহিনী একটার পর একটা দেশ নিমেষেই দখল করে নিতে পারার পেছনে একটা অদ্ভুত কৌশল কাজ করেছিল। তারা একটি দেশ আক্রমণ করার পূর্বেই সে দেশে একটি বাহিনী পাঠাতো। তারা গিয়ে সেদেশের অভ্যন্তরে কিছু লোককে বিভিন্ন প্রলোভনের মাধ্যমে প্রথমে হাত করত। এরপর আক্রমণ করার সাথে সাথেই তারা জার্মান বাহিনীর হয়ে কাজ করত। যার ফলে প্রথমদিকে জার্মান বাহিনী খুব সাফল্যের পরিচয় দেয়।
ঠিক একই কৌশল অবলম্বন করে আমাদের দেশের সরকারগুলো জনগণের তথা জাতীয় সম্পদ ও রাষ্ট্রীয় পরিচালনাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহকে লুটপাটের আখড়া বানিয়ে হয় ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিয়েছে, নয়তো বন্ধ রেখে দেশের বড় বড় পুঁজিপতিদের একচেটিয়া ব্যবসা করার সুযোগ করে দিয়েছে। সর্বশেষ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের কৌশল সেসব কৌশলের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
সরকার পাটকল বন্ধের একমাত্র কারণ হিসেবে দেখিয়েছে লোকসান। কিন্তু কেন সেটা হয়?
এর প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে, মৌসুমে পাট কেনার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক টাকা ছাড় না দেওয়া। বছরের পর বছর ধরে একই সমস্যা থাকায় পাটকলগুলো সময় মতো নির্ধারিত দামে ভালো মানের পাট কিনতে না পারার ফলে পাট যখন মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যায় তখন দ্বিগুণ দামে অর্থাৎ ১২শ টাকার পাট ২২শ থেকে ২৫ শ টাকা দামে কিনতে হয়। এবং যেটা কেনা হয় সেটাও নিম্নমানের পাট। যার ফলে বরাদ্দকৃত টাকায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পাট কেনা সম্ভব হয় না। ফলে প্রতিটি মিলের যে উৎপাদন ক্ষমতা এখনো আছে, সেই অনুপাতে উৎপাদন করাও সম্ভব হয়না। উৎপাদন ব্যয় যায় বেড়ে। তাহলে সময়মতো অর্থ ছাড় না দেওয়ার কারণে যে সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে তার দায় কার? সরকার কি জানে না যে, সময়মতো পাট কেনার টাকা যদি না দেওয়া হয় তাহলে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কৃষক তার পাটের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে লাভবান হবে মধ্যস্বত্বভোগী!
এক বছর না হয় কোনো কারণবশত সময়মতো টাকা ছাড় না দেওয়া হতে পারে। কিন্তু বছরের পর বছর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তিকে আপনি কী বলবেন? এটা কি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র নয়?
এক বছর না হয় কোনো কারণবশত সময়মতো টাকা ছাড় না দেওয়া হতে পারে। কিন্তু বছরের পর বছর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তিকে আপনি কী বলবেন? এটা কি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র নয়?
দ্বিতীয়ত, পুরাতন মেসিনারিজ ও যন্ত্রাংশের ব্যবহার। পাটমন্ত্রী নিজেই বলেছেন ৬০/৭০ বছরের পুরাতন মেশিনারিজ দিয়ে আজ এ পাট কলগুলো চালানো সম্ভব নয়, এটাকে আধুনিকায়ন করতে হবে। তাহলে প্রশ্ন হলো, পিপিপি কেন? নিজেই যখন সমস্যা ও তার সমাধানের পথ জানেন তাহলে ব্যবসায়ীদের ডাকা কেন? সরকারের পক্ষে কি এই টাকা ছাড় দেওয়া সম্ভব নয় ? স্কপ বলেছে, দেশের ২৫ টি রাষ্ট্রায়ত্ত মিলকে আধুনিকায়ন করতে বারোশো কোটি টাকা লাগবে। ধরলাম যদি ৫ হাজার কোটি টাকাও লাগে সেটা কি সরকারের পক্ষে দেওয়া সম্ভব না? টাকার অভাব কি কেবলমাত্র এই সেক্টরেই হয়?
পাটকলের সিবিএ- নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার একটি অন্যতম দাবি মিলগুলো বিএমআরই করা তথা পুরাতন যন্ত্রাংশের সংস্কার করা। কিন্তু সরকার সে পথে হাঁটেনি। এটাতো সাধারণ কান্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষও বোঝেন, ৬০/৭০ বছরের পুরাতন মেশিনারিজ দিয়ে উৎপাদন করে আজকের এই প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকা সম্ভব না। তাহলে সেটা বুঝতে এত বছর সময় লাগল কেন? আর বোঝার পরেও নিজে দায়িত্ব না নিয়ে পিপিপি এর কথাই বা তারা ভাবছেন কেন? নিজের ছেলে অসুস্থ হলে কেউ কি খরচার ভয়ে অন্যের হাতে তুলে দেয়?
বকেয়া বেতনের দাবিতে কিছুদিন পর পর শ্রমিকেরা যে রাস্তায় নামেন এটা কি সরকার জানে না? সরকার কি জানে না যে ২০১৩ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যে সকল শ্রমিকেরা অবসরে গেছেন তাদের পিএফ, গ্রাচুইটির টাকা দেওয়া হয়নি? আজ শ্রমিক নেতাদের উপর দায় চাপিয়ে সরকার এই সকল শ্রমিকের অবসরকালীন টাকা একবারে দেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এতদিন আপনারা কোথায় ছিলেন? শ্রমিকের কান্না কি এত বছরেও শুনতে পাননি ? যথাসময়ে অবসরকালীন টাকা সরকার প্রদান না করার কারণে বৃদ্ধ বয়সে শ্রমিকদের হাঁটতে হয় নেতাদের পেছনে। আর এই সুযোগে সিবিএ নেতারাও টাকা তুলে দেওয়ার বিনিময়ে লাখে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা কমিশন নেন। তাহলে কি ঐসকল সিবিএ নেতাদের শ্রমিকদের কাছ থেকে কমিশন খাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য টাকা দিতে বিলম্ব করা?
বকেয়া বেতনের দাবিতে কিছুদিন পর পর শ্রমিকেরা যে রাস্তায় নামেন এটা কি সরকার জানে না? সরকার কি জানে না যে ২০১৩ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যে সকল শ্রমিকেরা অবসরে গেছেন তাদের পিএফ, গ্রাচুইটির টাকা দেওয়া হয়নি?
একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে কর্মকর্তাদের নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়ন হয় নিমেষেই। কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি কমিশন আদায় করতে গিয়ে বছরের পর বছর রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পুলিশ প্রশাসন, সরকারদলীয় ক্যাডারদের হামলা মামলা উপেক্ষা করে আন্দোলন করে যেতে হয়। জীবনের বিনিময়ে দাবি আদায় করতে হয় (গত ২০১৯ সালের মজুরি কমিশন আদায়ের আন্দোলনে আমরণ অনশন কর্মসূচিতে আব্দুস সাত্তার ও সোহরাব হোসেন নামে দুইজন শ্রমিক মারা যান) । শ্রমিকেরা কি ইচ্ছাকৃতভাবে রাস্তায় নামেন, না তাদের ঠেলে দেওয়া হয়? এবং আন্দোলন করতে বাধ্য করে এই রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকদের সম্পর্কে মানুষের মধ্যে একটি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করা হয়। এদেরকে দোষারোপ করার ও লোকসানি খাত হিসেবে এটাকে বন্ধ করে বেসরকারি মালিকানায় দেওয়ার পক্ষে জনমত তৈরি হয়। এই বক্তব্যকে আরো শক্তিশালী করার জন্য সরকার ও তার তার মন্ত্রীরা দেশবাসীর সামনে বেসরকারি পাটকলের সাফল্যকে সামনে তুলে ধরেন। তারা দেখাতে চান, জনগণের কষ্টার্জিত ট্যাক্সের টাকা এভাবে লোকসানি খাতে ব্যয় না করে বরং মিলগুলিকে সফল ব্যবসায়িদের হাতে তুলে দেয়াই শ্রেয়। এতে অর্থ যেমন বাঁচবে, তেমনি রক্ষা পাবে পাটকল, বিস্তার ঘটবে পাটশিল্পের।
একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে কর্মকর্তাদের নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়ন হয় নিমেষেই। কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি কমিশন আদায় করতে গিয়ে বছরের পর বছর রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পুলিশ প্রশাসন, সরকারদলীয় ক্যাডারদের হামলা মামলা উপেক্ষা করে আন্দোলন করে যেতে হয়।
তারা একবারের জন্যও ঐসকল ব্যবসাসফল পাটকলের ভেতরের চিত্র কে সামনে আনেন না। বর্তমান বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাটকল হল যশোর নোয়াপাড়ার আকিজ জুট মিল। এখানে কাজ করছেন ১০ হাজার শ্রমিক। সারা বিশ্বে বাৎসরিক সাড়ে চার লক্ষ টন পাট সূতার চাহিদার বিপরীতে আকিজ জুট মিল একাই উৎপাদন করছে ১ লক্ষ টনের অধিক ( বণিক বার্তা ৬ জুলাই ২০২০)। অথচ এখানকার শ্রমিকদের মাসিক বেতন স্কেল কত জানেন? মাত্র ২,৭০০ টাকা। মিলের স্পিনিং বিভাগে ১১ বছর চাকরি করছেন জরিনা, তিনি মেশিন চালান। কিন্তু তার দৈনিক বেতন ২১০ টাকা। একই বিভাগে ৯ বছর যাবৎ কাজ করা রেশমার বেতন ২০০ টাকা। প্রতিদিন ৮ ঘন্টা ডিউটি চলাকালীন সময়ে খাবার জন্য সময় দেওয়া হয় মাত্র ২০ মিনিট। ২-৩ মিনিট দেরি হলেই হাজিরা কাটা যায়। এই ৮ ঘন্টার মধ্যে আর কোনো বিরতি নেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নারী শ্রমিক বলেন, কিছুদিন আগে মেশিন চালাতে গিয়ে তার হাত ভেঙে যায়। এরপর তিনি বাসায় বসে তিন মাস ধরে চিকিৎসা নিয়েছেন। এ সময়ের জন্য তাকে কোনো বেতন দেওয়া হয়নি। কেবল ওষুধ কেনার জন্য দেওয়া হয়েছে মাত্র ২০০০ টাকা।
১৪ বছর বয়সী শিশু শ্রমিক রুবেল বলেন, তার মতো আরো অনেকেই এই মিলে চাকরি করে দৈনিক ১৮০- ১৯০ টাকা বেতনে। রুবেলকে সকাল ৬ টা থেকে ২ টা পর্যন্ত যেমন ডিউটি করতে হয়, তেমনি রাত ১০ টা থেকে ভোর ৬ টা পর্যন্ত কাজ করতে হয় (এ মিলে সর্বদা তিনটি শিফট চালু থাকে। ১৫ দিন পরপর শিফট চেঞ্জ হয়)। রাত জেগে ডিউটি করলেও তাদেরকে দেওয়া হয় না কোন নাস্তা বা টিফিন।
এই একই নিয়মে চলছে দেশের বর্তমান ২৮২টি বেসরকারি পাটকল। সরকার ঘোষিত লকডাউনের সাধারণ ছুটিকালীন মজুরির টাকাও বেসরকারি কোনো পাটকলে দেয়া হয়নি। খুলনার সাগর জুট মিলের শ্রমিকরা যখন সাধারণ ছুটিকালীন মজুরির টাকার দাবিতে আন্দোলনে নামে, তখন তাদের বলা হয় সারা দেশের মধ্যে একটি বেসরকারি পাটকল যদি সাধারন ছুটিকালীন মজুরির টাকা দেয় তাহলে তারা দিবে। শেষ পর্যন্ত কোনো অর্থ ছাড়াই ওই মিলের শ্রমিকরা আবার কাজে যোগ দিতে বাধ্য হয়।
কৃষকের কাছ থেকে ঐসকল মিল পাট কেনে স্বল্পমূল্যে। সরকার নির্ধারিত পাটের মূল্যকে তারা থোড়াই কেয়ার করে। তারা পাট মৌসুমের শুরুতে কৃষককে দাদন দেয়। শর্ত থাকে যে একমাত্র তাদের কাছেই পাট বিক্রি করতে হবে। অর্থাৎ কাজ না থাকা নিরুপায় বেকার শ্রমিকদের ন্যায় কৃষকদেরকেও তারা বেঁধে ফেলে দাদনের ফাঁদে।
যে সমস্ত বেসরকারি পাটকল মালিক এভাবে দরিদ্র শ্রমিক ও কৃষককে শোষণ করে, ঠকিয়ে ব্যবসায় লাভ দেখিয়ে যাচ্ছে, আমাদের সরকার মহোদয় তাদেরকে প্রশংসা করে তাদের হাতেই তুলে দিতে যাচ্ছে জনগণের সম্পদ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলসমূহ। আর দেশের অনেক শিক্ষিত, সুবিধাভোগী, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ সরকারের এই কৌশলকে বুঝে বা না বুঝে স্বাগত জানাচ্ছে।
যে সমস্ত বেসরকারি পাটকল মালিক এভাবে দরিদ্র শ্রমিক ও কৃষককে শোষণ করে, ঠকিয়ে ব্যবসায় লাভ দেখিয়ে যাচ্ছে, আমাদের সরকার মহোদয় তাদেরকে প্রশংসা করে তাদের হাতেই তুলে দিতে যাচ্ছে জনগণের সম্পদ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলসমূহ। আর দেশের অনেক শিক্ষিত, সুবিধাভোগী, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ সরকারের এই কৌশলকে বুঝে বা না বুঝে স্বাগত জানাচ্ছে।
রাষ্ট্র ও সরকার তাদের এই পরিকল্পনাকে আরো সুনিপুণভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য প্রতিটি মিলেই নিয়োগ করে নিজস্ব রাজনৈতিক বাহিনী। যারা মিলের ইউনিয়নের নেতা হয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দল থেকেই নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়। তারাই শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করেন এবং এদের নেতৃত্বে সকল আন্দোলন পরিচালিত হয়। সাধারণ শ্রমিক এই নেতাদের পাশ কাটিয়ে কোনো কিছুই করতে পারেন না। করলেই তাদের চাকরি খেয়ে দেন প্রশাসন সহ ঐ সিবিএ নেতারাই। এ বছর রোজার ঈদের আগে সাধারণ ছুটিকালিন বেতনের দাবিতে খালিশপুর জুটমিলের শ্রমিকেরা নেতাদের অনুমতি ছাড়াই আন্দোলনে নেমে পড়েন। আন্দোলন শেষে দেখা যায় ১৬ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৩০০/৪০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা করে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে আজ শ্রমিকরা আন্দোলনে নামতে ভয় পাচ্ছেন।
যে ইউনিয়ন একসময় গড়ে উঠেছিল শ্রমিকদের অধিকার আদায় করার লক্ষ্যে, আজ সেই ইউনিয়ন হয়ে গেছে শ্রমিকদের গলার কাঁটা। আঞ্চলিকতা ও দলীয় ইজম ব্যবহার করে তারা শ্রমিকদের বিভক্ত করে ফেলেছে। শ্রমিকদের মধ্যেও গড়ে উঠেছে নানান সুবিধাবাদী প্রবণতা। আবার দীর্ঘদিন কেবলমাত্র নেতাদের নেতৃত্বে আন্দোলন করতে করতে শ্রমিকরা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্ব ছাড়া পাটকল অঞ্চলে আন্দোলন হয় না।
আর আছে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও স্থানীয় সরকার দলীয় নেতাদের চাপ। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে প্রতিটি মিল এলাকায় এমন এক ত্রাস সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে যার ফলে শত কষ্ট বুকে চাপা থাকলেও শ্রমিকরা মুখ খুলতে পারছেন না। তবে হাজার ভয়-ভীতির মধ্যেও সাধারণ শ্রমিকেরা অপেক্ষা করছেন বলিষ্ঠ নেতৃত্বসম্পন্ন আন্দোলনের। অনেকে বাড়িতে চলে গেলেও ফিরে আসবেন আন্দোলনের ডাক পেলে। তারা মনে করেন, করোনার সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে সরকার। তা না হলে একসাথে সমস্ত পাটকল একবারে বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব হত না। শ্রমিকরা এটা কখনোই মেনে নিতেন না।
রুহুল আমিন: সংগঠক, শ্রমিক-ছাত্র-জনতা ঐক্য, খুলনা
ইমেইল: ruhulaminssj@gmail.com
10