সম্পাদকীয় ভূমিকা

সম্পাদকীয় ভূমিকা

করোনা বিপর্যয়ের কাল এখনও শেষ হয়নি, কবে শেষ হবে তাও কেউ বলতে পারে না। বাংলাদেশে অসংখ্য মানুষ কাজ, খাদ্য ও চিকিৎসা সংকটে বিপর্যস্ত। সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ ও নীতিমালা জনগণের এই পরিস্থিতি, প্রয়োজন সম্পর্ক ভয়ংকর রকম নির্লপ্ত থাকায় কয়েক কোটি মানুষের অসহায়ত্ব মারাত্নক আকার ধারণ করেছে।

করোনাকালে যখন দেশের মানুষ এরকম সংকটের মুখে, যখন করোনার সাথে বন্যা যোগ হয়ে অসহায় মানুষদের আরও কঠিন পরিস্থিতিতে নিক্ষেপ করেছে, যখন বিশ্বজুড়ে একদিকে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলো মজবুত করার জন্য চেষ্টা চলছে অন্যদিকে পরিবেশবান্ধব শিল্প আর অর্থনৈতিক তৎপরতাকে গুরুত্ব দেবার তাগিদ বাড়ছে ঠিক সেই সময় বাংলাদেশে লক্ষাধিক শ্রমিক ও কৃষক পরিবারের মাথায় বাড়ি মেরে দেশের প্রধান পরিবেশবান্ধব শিল্পকে অনিশ্চয়তায় ফেলে একসাথে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ২৬টি পাটকল। মিথ্যা প্রতিশ্রুতির বস্তায় আরও কতগুলো প্রতিশ্রুতি ঢুকলো তা আর কিছুদিনের মধ্যেই পরিষ্কার হবে। শিল্পবিনাশের এই কাজ অবাধে সম্পন্ন করার জন্য মিথ্যা প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি আটক, জোরজুলুম, ভয়ভীতি, হুমকি ইত্যাদিও ব্যবহার করা হয়েছে। এই ঘটনা যে হঠাৎ করে ঘটেনি, বা লোকসান ইত্যাদির অজুহাতও যে সাজানো তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। ২৬ পাটকল বন্ধ ঘোষণার পর সম্প্রতি সরকার একটি কমিটি গঠন করেছে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য, সেই কমিটির সদস্যরা হলেন পাটশিল্পের বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী বিজেএমসি-মন্ত্রণালয় কর্মকর্তা আর তাদের সাথে জমিসহ এসব পাটকলের সম্পদে ভাগ বসাতে অস্থির বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা। বোঝা যাচ্ছে এর গতিমুখ।

দেশের জন্য এই শিল্পের গুরুত্ব বিবেচনা করে তাই আমরা ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে সর্বশেষ পরিস্থিতির বিস্তারিত পর্যালোচনার উদ্যোগ নিয়েছি। এই জন্য পাটশিল্পের বিভিন্ন দিক নিয়ে বেশ কয়েকটি নতুন পুরনো লেখা সম্বলিত বিশেষ ক্রোড়পত্র এই সংখ্যার প্রধান দিক। এসব লেখায় ২০০২ সালে আদমজী বন্ধসহ সেসময়ে প্রণীত পাটনীতি ও পাটশিল্প নিয়ে এর আগে পরে বিভিন্ন সরকারের বাস্তব ভূমিকার ধারাবাহিকতা সনাক্ত করা হয়েছে। পাটশিল্প ও পাটশ্রমিকদের ওপর সর্বশেষ আক্রমণ যে আকস্মিক নয়, বরং বহুবছরের পরিকল্পিত কার্যক্রমেরই ফলাফল তা একাধিক লেখা থেকে বোঝা সম্ভব হবে। এছাড়া সর্বশেষ পরিস্থিতির বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে, রাষ্ট্রায়ত্ত ও ব্যক্তিমালিকানাধীন পাটকলের শ্রমিকদের তুলনামূলক চিত্র পর্যালোচনা করে, তথ্য ও যুক্তি দিয়ে এই শিল্পের গতিমুখ অনুসন্ধান করা হয়েছে বিভিন্ন লেখায়। প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ থেকে স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিকদের অভিজ্ঞতা ও ভয়ংকর অনিশ্চয়তাও তুলে ধরা হয়েছে একটি লেখায়। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে এর মধ্যে দুটো লেখা আগাম প্রকাশ করা হয়েছে।

গত কয়েকমাসে নাগরিকদের জরুরী বিভিন্ন বিষয়ে মতামত সুপারিশমালা প্রকাশিত হয়েছে বিবৃতি ও সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে। তার কয়েকটি আমরা গত সংখ্যায় প্রকাশ করেছি। এই সংখ্যায় করোনা মোকাবিলা ও ২৬টি পাটকল বন্ধ নিয়ে দুটো যুক্ত বিবৃতির পাশাপাশি অনলাইন ক্লাশ নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক এর পক্ষ থেকে উপস্থাপিত বক্তব্য প্রকাশ করা হলো।

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সহ বিভিন্ন দেশে বর্ণ ধর্ম লিঙ্গ নির্বশেষে মানুষের সাম্প্রতিক লড়াই নিয়ে দুটো লেখা প্রকাশিত হলো এই সংখ্যায়। একটি সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে লেখা আরেকটি ধারাবাহিক লেখা যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদের সাথে রাষ্ট্রের নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক চরিত্র ব্যাখ্যা করে বিশ্ব লড়াইএর ঐক্যসূত্র দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।  করোনাকালে পুলিশী বর্বরতা যেমন থেমে নাই তেমনি আশার কথা এই যে, মানুষের লড়াইও করোনা বা পুলিশী লালচক্ষু দিয়ে থামানো যায়নি। দেশে দেশে দখলদার, খুনি, নির্যাতকদের মূর্তি টেনেহিঁচড়ে নামাচ্ছে মানুষ, এটা খুবই শক্তিশালী এক বার্তা।

দুইসংখ্যা বিরতির পর ‘পরাশক্তির বিবর্তন: চীন’ এবং ‘সিপি গ্যাং ও বেশ্যা ব্যানার’ শিরোনামের দুটো ধারাবাহিক লেখা আবারও প্রকাশ শুরু হলো। এছাড়া ‘নারী পুরুষের মানস’ এবং ‘অ্যাঞ্জেলা ডেভিসের সাথে কথোপকথন’ শীর্ষক ধারাবাহিক লেখার এবারের পর্ব যথারীতি প্রকাশিত হলো। পরিবেশ বিষয়ে তিনটি চলচ্চিত্রের পর্যালোচনা, অবলা বসুর পরিচিতি আর কয়েক মাসের খবরও গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে প্রকাশিত হলো।  

করোনার এই সংকট রাষ্ট্র আর সমাজের অনেককিছুই আমাদের সামনে উন্মোচিত করছে। প্রয়োজন তা দেখা ও বোঝার শক্তি অর্জন এবং সে অনুযায়ী ভূমিকা নির্ধারণ।

আনু মুহাম্মদ

৩০ জুলাই ২০২০

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •