চীন : পরাশক্তির বিবর্তন-৭
এককেন্দ্রিক বিশ্বে চীনের অর্থনৈতিক সংস্কারের গতিপথ
আনু মুহাম্মদ
করোনা ভাইরাসে বিপর্যস্ত হলেও পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় চীন যে একটি নির্ধারক শক্তি তা এই মহাবিপর্যয়ে আবারও স্পষ্ট হয়েছে। তবে এই বিপর্যয়ের পূর্ব পর্যন্ত ‘বেল্ট এন্ড রোড’সহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে চীন যে গতিতে তার অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তৃত করছিল তার মধ্যে কিছু পরিবর্তন নিশ্চয়ই ঘটবে। বিশ্বের নানা প্রান্তে চীনের পণ্য, চীনের বিনিয়োগ। আফ্রিকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ঋণ ও বিনিয়োগ কার্যক্রমে চীন সাম্রারাজ্যবাদী বিশেষণেও অভিহিত হচ্ছে। ক্রয়ক্ষমতার সমতার নিরিখে (পিপিপি) বিচার করে চীন এখন বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি। আর প্রচলিত জিডিপি বিচারে যুক্তরাষ্ট্রের পরই চীন দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। চীন ঘিরে অনেক প্রশ্ন। এই চীন তার বিশাল জনসংখ্যা নিয়ে কীভাবে বিপ্লব করেছিল? বিপ্লবের পর চীনের অগ্রযাত্রা কীভাবে ঘটেছে? সম্প্রতি চীনের দ্রুত বিস্ময়কর অর্থনৈতিক গতির রহস্য কী? দেশের ভেতর বৈষম্য, দুর্নীতি বৃদ্ধি, বিশাল ধনিক গোষ্ঠীর প্রবল আধিপত্য ইত্যাদির সাথে কমিউনিস্ট পার্টির একক শাসন কীভাবে সঙ্গতিপূর্ণ? কথিত বাজার সমাজতন্ত্রেরই বা স্বরূপ কী? বিশ্বের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য এর তাৎপর্য কী? এসব বিষয় পর্যালোচনা করতে করতেই এই লেখা অগ্রসর হচ্ছে। কয়েক পর্বে প্রকাশিতব্য এই লেখার সপ্তম পর্বে চীনের নতুন অর্থনৈতিক যাত্রার ধরন, উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং পুঁজিবাদী কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার সাথে সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র সাম্রাজ্যিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, পুঁজিবাদের একক বৈশ্বিক ব্যবস্থার পথ নিশ্চিত হয়। একে ‘গণতন্ত্রের বিজয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করে ব্যাপক প্রচার করা হলেও দেশে দেশে দেখা দিতে থাকে ভিন্ন যাত্রা। দেখা যায়, এর মধ্য দিয়ে সারাবিশ্বের অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক, বর্ণবাদী, নিপীড়ক, যুদ্ধবাজ শক্তিসমূহেরই মতাদর্শিক বিজয় সূচিত হয়েছে, তাদের জন্য এতোদিনকার মতাদর্শিক ও শারীরিক বাধা পরাজিত হয়েছে। এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে শুধু যে পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের পুনরুজ্জীবন ঘটেছে তাই নয়, বৈষম্য নিপীড়নের নানারূপ আরও জোরদার ভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। নতুন উদ্যমে বিশ্বব্যাপী ঝাঁপিয়ে পড়েছে যুদ্ধবাজ ও গণবিরোধী সব ধরনের শক্তি।
অন্যদিকে এই পরিস্থিতিতে দেশে দেশে গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ও বিপ্লবী শক্তিগুলোও দিশেহারা অবস্থায় পতিত হয়। বাংলাদেশে পিকিংপন্থীরা আগেই ছিন্নভিন্ন হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো মস্কোপন্থীদের বিপর্যয় ঘটলো ব্যাপকভাবে। দেখা গেল-এই ধারার অনেকেরই নতুন উপলব্ধি। তাঁরা বলতে শুরু করলেন- মার্কসবাদ ভুল, লেনিনবাদ ভুল, বিপ্লব একটা ভুল চিন্তা এবং সমাজতন্ত্র একটি অসম্ভব অবাস্তব প্রকল্প। ছিন্নভিন্ন সমাজতন্ত্রী ও বিপ্লবীদের অনেকেই বসে পড়লেন, অনেকে যোগ দিলেন শত্রু শিবিরে।
অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে যুদ্ধ অর্থনীতির সাথে অবিচ্ছেদ্য পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা এবং এর কেন্দ্র রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রও নতুন এক সমস্যার মুখোমুখি হলো। প্রতিপক্ষ বা শত্রু না থাকলে এই যুদ্ধ অর্থনীতির যৌক্তিকতা দাঁড় করানোর কোনো উপায় থাকে না। আর যুদ্ধ আর দখলের ব্যবস্থা ছাড়া পুঁজিবাদেরও টিকে থাকার পথ নেই। এই সংকট থেকে উদ্ধারের পথ সৃষ্টি হলো মধ্যপ্রাচ্যকে নতুন যুদ্ধ ফ্রন্ট বানানোর মধ্য দিয়ে। ১৯৯১ সালে ইরাক আক্রমণ দিয়ে এর শুরু, ২০০১ সালে ‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ’ মন্ত্র দিয়ে পুরো পৃথিবীকেই যুদ্ধের ময়দানে পরিণত করা হয়েছে। যুদ্ধ অর্থনীতিরও বিস্তার ঘটেছে আগের তুলনায় বেশি।
বিশ্ব ব্যবস্থায় এসব পরিবর্তনে চীন রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিকভাবে তার যাত্রাপথে কোনো পরিবর্তন আনেনি। এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে কোনো অবস্থানও গ্রহণ করেনি। বরং নানাভাবে এর সাথে সমন্বয় করতে চেষ্টা করেছে, পরিবর্তিত ব্যবস্থার সাথে মানানসই হিসেবেই নিজেকে সজ্জিত করতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু এই এককেন্দ্রিক শক্তির সাথে দরকষাকষির ক্ষমতা যে কমে গেছে তা চীন টের পেয়েছে প্রথম থেকেই।
১৯৭০ দশকের প্রথম থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করায় চীনের আগ্রহ ছিল প্রধানত সোভিয়েত ইউনিয়নের বৈরিতা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য। আর চীনের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করায় যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রভাববলয় শক্তিশালী করার জন্য। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে এই সমীকরণ অকার্যকর হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র হয়ে দাঁড়ায় বিশ্বব্যবস্থার অপ্রতিরোধ্য একক কেন্দ্র। এতে চীনের উদ্বিগ্ন হবার যথেষ্ট কারণ ছিল। তিয়েন আন মেনের পর অবরোধ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে কর্তৃত্ব বিস্তারের পথ বেছে নিয়েছিল তা এরপর আরও শক্তিশালী হয়। চীনের তখন কূটনৈতিকভাবে এর ফয়সালা করাও দুরূহ ছিল। সামরিক বা রাজনৈতিকভাবে নতুন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য চীনা নেতৃত্ব কোনোভাবেই প্রস্তুত বা ইচ্ছুক ছিল না। তখন একমাত্র পথ অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে তার ওপর নির্ভরশীল করে তোলার মতো অবস্থায় পৌঁছানো। সেভাবেই অগ্রসর হয়েছে চীন।
১৯৭০ দশকের প্রথম থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করায় চীনের আগ্রহ ছিল প্রধানত সোভিয়েত ইউনিয়নের বৈরিতা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য। আর চীনের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করায় যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রভাববলয় শক্তিশালী করার জন্য। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে এই সমীকরণ অকার্যকর হয়ে যায়।
চীন যে অবরোধ তোলার জন্য ১৯৯০ সাল থেকে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে দেনদরবার শুরু করে তার কিছু প্রামাণ্য বিবরণ দিয়েছেন হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর চীন নিয়ে লেখা পূর্বোক্ত গ্রন্থে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট তখন সিনিয়র বুশ, তাঁর কাছে পাঠানো এক মৌখিক বার্তায় চীনা নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চীনা জনগণ বিদেশি শক্তির আধিপত্য এবং হয়রানির মধ্যে কাটিয়েছে। আমরা চাই না সেই জখম আবার উন্মুক্ত হোক। পুরনো বন্ধু হিসেবে আশা করি আপনি চীনা জনগণের অনুভূতি বুঝতে পারবেন। চীন-যুক্তরাষ্ট্র বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক, যা প্রতিষ্ঠা করা খুব সহজ ছিল না, তাকে চীন সবসময়ই গুরুত্ব দেয়, একই সঙ্গে আরও বেশি গুরুত্ব দেয় এর স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং মর্যাদাকে। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে আর বিলম্ব না করে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা আরও জরুরি।…’
ধারাবাহিক দেনদরবারের পর মার্কিন প্রশাসন অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও, বিশেষত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, অবরোধ শিথিল করে। ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চীন একটি ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। ক্লিনটন তাঁর প্রচারাভিযানের সময় বুশ প্রশাসনের সমালোচনায় চীনের প্রতি নমনীয়তাকেও উল্লেখ করেছিলেন। ক্লিনটন বলেছিলেন, ‘একদিন চীনও পূর্ব ইউরোপ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পথেই যাবে। সেই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে যা করা উচিৎ যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই তাই করতে হবে।’১
প্রকৃতপক্ষে মার্কিন প্রশাসনের মধ্যে চীনপন্থী এবং চীনবৈরী দুটো প্রবণতাই আছে। বলাই বাহুল্য, এর সাথে চীনে মার্কিন ব্যবসায়িক স্বার্থের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ।
সংস্কারের বেইজিং মডেলের বৈশিষ্ট্য
চীন কীভাবে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করলো এবং এতো বছর তা ধরে রাখতে পারলো, কীভাবে এতো দ্রুত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হলো, কীভাবে এতো বড় দেশে বাজার অর্থনীতিমুখী সংস্কার কোনো বড় বিপর্যয় সৃষ্টি করলো না তা অর্থশাস্ত্র এবং অর্থনীতি বিষয়ক সব গবেষণা ও নীতিনির্ধারণী আলোচনাতেই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে ওঠেছে। বিশ্বের মহাজন শক্তিগুলো এভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে চায় যে, ওয়াশিংটন ঐকমত্য বা নয়া উদারতাবাদ বা বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ নির্দেশিত পথে অর্থনীতির উদারীকরণ বা ব্যক্তিপুঁজির অবাধ বিকাশই এই দ্রুত প্রবৃদ্ধি সম্ভব করেছে।
কিন্তু এখানে প্রশ্ন থেকে যায় যে, এই মডেল তো বিশ্বের বহুদেশেই অনুসরণ করা হয়েছে, সেসব দেশে এরকম ফলাফল দেখা যায়নি। আফ্রিকা ল্যাটিন আমেরিকার বহুদেশ, বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তান সর্বত্রই বাজারমুখী সংস্কারের ফলাফলে অনেক উঠানামা আছে। বহুদেশ হোঁচট খেয়েছে, বহুরকম সংকটে হাবুডুবু খেয়েছে। চীনের ক্ষেত্রে তা দেখা গেলো না কেন? মোটাদাগে সংস্কারের দুই ধারার তুলনামূলক চিত্র নিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতি বিশ্লেষক কাভালজিৎ সিং গবেষণা করেছেন। চীনের সংস্কারের মৌলিক ভিন্নতার কারণে কাভালজিৎ ‘ওয়াশিংটন ঐকমত্য’ থেকে আলাদা করে একে ‘বেইজিং ঐকমত্য’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এ বিষয়ে তাঁর নিম্নোক্ত পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত আমিও সঠিক মনে করি।২
কিন্তু এখানে প্রশ্ন থেকে যায় যে, এই মডেল তো বিশ্বের বহুদেশেই অনুসরণ করা হয়েছে, সেসব দেশে এরকম ফলাফল দেখা যায়নি। আফ্রিকা ল্যাটিন আমেরিকার বহুদেশ, বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তান সর্বত্রই বাজারমুখী সংস্কারের ফলাফলে অনেক উঠানামা আছে। বহুদেশ হোঁচট খেয়েছে, বহুরকম সংকটে হাবুডুবু খেয়েছে। চীনের ক্ষেত্রে তা দেখা গেলো না কেন? মোটাদাগে সংস্কারের দুই ধারার তুলনামূলক চিত্র নিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতি বিশ্লেষক কাভালজিৎ সিং গবেষণা করেছেন। চীনের সংস্কারের মৌলিক ভিন্নতার কারণে কাভালজিৎ ‘ওয়াশিংটন ঐকমত্য’ থেকে আলাদা করে একে ‘বেইজিং ঐকমত্য’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
প্রথমত, ১৯৭৮ সালে যখন চীন অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করে ততোদিনে তার অনেক শক্ত ভিত্তি তৈরি হয়েছিল। এর আগেই দারিদ্র ব্যাপকভাবে দূরীভূত হয়েছিল। শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ সামাজিক সূচকগুলোতে এর আগেই উচ্চমাত্রার সাফল্য ছিল। এসব সাফল্য পুরোপুরি নষ্ট করে নয় বরং এগুলোর ওপর দাঁড়িয়েই সংস্কার কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, অন্য বহু দেশে যেমন ভারত, পাকিস্তান বা ব্রাজিলে এসব সংস্কার শুরু হয়েছে একেকটি অর্থকরী সংকটের মধ্যে (ঋণ, মুদ্রামান, লেনদেনের হিসাব ইত্যাদি), সংকট থেকে বের হবার উপায় হিসেবে। কিন্তু চীন কোনো অর্থকরী সংকটের চাপের কারণে সংস্কার শুরু করেনি, করেছে সম্পূর্ণ নিজস্ব চিন্তায় উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে, বিশ্বশক্তি হবার আকাঙ্ক্ষায়। এরকম নিজস্ব পরিকল্পনা ও কর্তৃত্ব অন্যদেশগুলোর সংস্কারের বেলায় দেখা যায়নি। এখানে তাই অন্যদেশগুলোর মতো বিশ্বব্যাংক আইএমএফের কোনো ভূমিকা বা কর্তৃত্ব ছিল না। সেকারণে করণীয়, গতি, অগ্রাধিকারে কোনো অসামঞ্জস্য তৈরি হয়নি।
তৃতীয়ত, চীন ধাপে ধাপে পরিকল্পিতভাবে সংস্কার কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হয়েছে। প্রথমে কৃষি, পরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং শেষে শিল্প। এসব ক্ষেত্রে পরিকল্পিতভাবে ব্যক্তিখাতের প্রসার ঘটানো হলেও অর্থকরী খাতের ওপর প্রধানত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা হয়েছে। যেকারণে ১৯৯৭ সালে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে অর্থকরী খাতে ধস নামলেও আন্তর্জাতিক মুদ্রা ফটকাবাজারি দ্বারা চীন কোনোভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়নি।
চতুর্থত, অর্থনৈতিক সংস্কার বা ব্যক্তিখাতের প্রসার কর্মসূচি পুরো চীনের ক্ষেত্রে একবারেই নেয়া হয়নি। বিভিন্ন অঞ্চলে পরীক্ষামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়েছে চীন। যেমন, উপকূলীয় ও পূর্ব চীন এলাকায় বিনিয়োগ, কর ব্যবস্থার সংস্কার সীমিত রাখা হয়েছে শুধু কিছু বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে।
পঞ্চমত, রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপে যেভাবে কোনোরকম আইনী ব্যবস্থা না রেখে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তুচ্ছ দামে কিছু গোষ্ঠীর মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে যার ফলে মাফিয়া পুঁজিবাদের বিস্তার ঘটেছে চীনে সেরকম ঘটনা ঘটেনি। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে ধাপে ধাপে সংস্কার করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রের হাতেই রাখা হয়েছে।
ষষ্ঠত, বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ অনেক বেড়েছে চীনে। কিন্তু অন্য অনেক দেশের মতো তা বহুজাতিক কোম্পানির আধিপত্য বাড়াতে পারে নি। প্রথম দিকে বিদেশি বিনিয়োগ গ্রহণ করা হয়েছে শুধুমাত্র বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে, হংকং ও তাইওয়ানে প্রবাসী চীনাদের থেকে। এই এলাকার বাইরে বিদেশি বিনিয়োগের ওপর বহুরকম নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা হয়েছে।
কিন্তু অনেকরকম সতর্কতা, নিয়ন্ত্রণ এবং সাফল্য সত্ত্বেও পুঁজিমুখি সংস্কারের অপরিহার্য অভিঘাত ঠিকই দেখা গেছে। গ্রাম শহর ও শ্রেণীগত বৈষম্য, বেকারত্ব, দুর্নীতি, সম্পদ কেন্দ্রীভবন, পরিবেশ দূষণ তার অন্যতম।
বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের অবস্থান
বার্ষিক জিডিপির সরল হিসাবে চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি, এর পরিমাণ প্রায় ১১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, মাথাপিছু আয় এই হিসাবে প্রায় ৮ হাজার মার্কিন ডলার। আর যদি অর্থনীতির তুলনামূলক ক্রয়ক্ষমতা দিয়ে বিচার করা যায় তাহলে দেখা যাবে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করে এখন বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি, এর আকার সেই হিসেবে প্রায় ১৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, মাথাপিছু আয় প্রায় ১৩ হাজার মার্কিন ডলার। এগুলো সবই চীনা সরকার ও আইএমএফ-এর হিসাব।৩
মোট আয়ে সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকলেও মাথাপিছু আয়ে চীন প্রায় ৮০টি দেশের পেছনে, পিপিপি-র হিসেবে ৭২টি দেশের পেছনে। সর্বোচ্চ জনসংখ্যা এর একটি কারণ। বিশ্ব বাণিজ্যে চীন এখন বৃহত্তম। এর পরিমাণ প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে বাজার দখলের জন্য দুর্নীতি, নিম্নমানের পণ্য এবং দাম কমিয়ে বাজার ছেয়ে ফেলার বদনাম চীনের প্রায় সবদেশেই।
বৈদেশিক মুদ্রার মজুদে চীন এখন বৃহত্তম, ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। বিদেশি বিনিয়োগ অন্ত:প্রবাহেও চীন বৃহত্তম, ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বিদেশেও চীনের বিনিয়োগ ক্রমেই বাড়ছে, প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। বিভিন্ন বিদেশি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কিনে ফেলার ঘটনাও বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিকভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করলে সেদেশের বৃহৎ তেল কোম্পানিসহ বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি এতোদিনে চীনের মালিকানায় চলে যেতো। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ২ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের সিকিউরিটি এখন চীনের মালিকানায়। একইসঙ্গে সমমূল্যের ট্রেজারী বন্ডের মালিকও চীন। সেই হিসেবে চীনই এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ঋণদাতা। অবশ্য গত এক দশকে চীনের নিজের ঋণের পরিমাণও অনেক বেড়েছে। ২০০৭ সাল থেকে চারগুণ বেড়ে এখন তা ২৮ ট্রিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে, যা তার জিডিপির দ্বিগুণেরও বেশি।
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ২ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের সিকিউরিটি এখন চীনের মালিকানায়। একইসঙ্গে সমমূল্যের ট্রেজারী বন্ডের মালিকও চীন। সেই হিসেবে চীনই এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ঋণদাতা। অবশ্য গত এক দশকে চীনের নিজের ঋণের পরিমাণও অনেক বেড়েছে। ২০০৭ সাল থেকে চারগুণ বেড়ে এখন তা ২৮ ট্রিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে, যা তার জিডিপির দ্বিগুণেরও বেশি।
২০১৬ সালের ২০ জুলাই ফরচুন পত্রিকা যে বৈশ্বিক বৃহত্তম ৫০০ কোম্পানির তালিকা প্রকাশ করেছিল তার মধ্যে সবচাইতে বেশি সংখ্যক কোম্পানি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের, ১৩৪টি। এরপরই ছিল চীনের অবস্থান ১০৩টি। বার্ষিক আয়ের দিক থেকে একেবারে শীর্ষস্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ালমার্ট। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে আছে চীনা কোম্পানি। এগুলো হলো যথাক্রমে বিদ্যুৎ কোম্পানি স্টেট গ্রীড এবং তেল কোম্পানি চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম ও সিনোপেক। পাশাপাশি বিশ্বের বৃহত্তম দশটি ব্যাংকের তালিকায় প্রথম তিনটিই চীনের। এগুলো হল যথাক্রমে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না, চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংক এবং এগ্রিকালচারাল ব্যাংক অব চায়না।৪
বার্ষিক আয়ের দিক থেকে একেবারে শীর্ষস্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ালমার্ট। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে আছে চীনা কোম্পানি। এগুলো হলো যথাক্রমে বিদ্যুৎ কোম্পানি স্টেট গ্রীড এবং তেল কোম্পানি চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম ও সিনোপেক। পাশাপাশি বিশ্বের বৃহত্তম দশটি ব্যাংকের তালিকায় প্রথম তিনটিই চীনের।
পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনীতিতে বিনিয়োগ, বাণিজ্য ইত্যাদিতে তাই চীনের অবস্থান ও প্রভাব দ্রুত নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে যাচ্ছে। ২০০৮ এর বিশ্ব আর্থিক সংকটের পর থেকে চীনা মুদ্রা দ্রুত আন্তর্জাতিক মুদ্রায় পরিণত হয়েছে। ২০১০ সালে রাশিয়া চীনের সাথে তার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে চীনা মুদ্রা ব্যবহার শুরু করে। এরপর জাপান, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য এবং কানাডাও একইপথ অনুসরণ করে। ব্রিকস জোট, জোট থেকে বিশ্বব্যাংকের পর্যায়ের একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ চীনের বৈশ্বিক ভূমিকার পথ প্রশস্ত করছে। কয়েকবছর আগে চীনের উদ্যোগে ও কর্তৃত্বে যাত্রা শুরু করেছে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)। এটি এশিয়ায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব করবে এবং এশীয় অঞ্চলে বিনিয়োগে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি করবে।
তবে চীনা অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গতি গত কয়েক বছরে কমেছে। সরকারি হিসাবেই দেখা যাচ্ছে ২০১১ সাল পর্যন্ত এক দশকেরও বেশি সময় শতকরা ১০ ভাগের বেশি প্রবৃদ্ধি হার বজায় ছিল। ২০১২ থেকে এই হারে নিম্নমুখি প্রবণতা দেখা দেয়। ২০১৫ সালে এই হার দাঁড়ায় ৭.৪। এরপর এই হার আরও কমে এখন ৭ এর নিচে নেমে গেছে। এছাড়া বহু খাতে বিনিয়োগ আটকে গেছে, অচলাবস্থা দেখা দিচ্ছে অতিরিক্ত বিনিয়োগের কারণে।৫ এর পরেও এই হার আর উর্ধ্বমুখী হয়নি।
গত তিন দশকে চীনের সমাজের অভ্যন্তরে পরিবর্তন হয়েছে ব্যাপক। বিলিয়নেয়ার বা কোটি কোটিপতিদের সংখ্যার দিক থেকে এখন চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। মধ্যবিত্তের আকারও বেড়েছে। তার ফলে আভ্যন্তরীণ বাজারও বেড়েছে অনেক। প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের ভোগ্যপণ্যের বাজার এখন চীন। পাশাপাশি বৈষম্যের বিভিন্ন দিক থেকে চীনের পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে দ্রুত। চীনের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলে বিনিয়োগের বড় অংশ যাবার ফলে আঞ্চলিক বৈষম্যও প্রকট হচ্ছে। সরকারি হিসাবেই দেখা যাচ্ছে শহরে মাথাপিছু বার্ষিক আয় যেখানে বেড়েছে শতকরা ৮.৫ হারে, সেখানে গ্রামে তা বেড়েছে শতকরা ৪.২ হারে। আসলে ধনী ও গরীব বৈষম্য এখন ১৯৪৯ সালে বিপ্লবপূর্ব চীনের বৈষম্য থেকেও বেশি। বেকারত্বের হারও বেড়েছে। প্রায় ১২ কোটি মানুষ এখন গ্রাম থেকে উপকূলীয় এলাকায় কাজের সন্ধান করছেন। ১৯৯৮ থেকে ১০ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান থেকেই ছাঁটাই হয়েছেন প্রায় ৪ কোটি মানুষ। শহরাঞ্চলে এখন বেকারত্বের হার শতকরা ১০ পার হয়েছে।
বিলিয়নেয়ার বা কোটি কোটিপতিদের সংখ্যার দিক থেকে এখন চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। মধ্যবিত্তের আকারও বেড়েছে। তার ফলে আভ্যন্তরীণ বাজারও বেড়েছে অনেক। প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের ভোগ্যপণ্যের বাজার এখন চীন। পাশাপাশি বৈষম্যের বিভিন্ন দিক থেকে চীনের পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে দ্রুত। চীনের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলে বিনিয়োগের বড় অংশ যাবার ফলে আঞ্চলিক বৈষম্যও প্রকট হচ্ছে।
বেকারত্ব আর বৈষম্য ছাড়াও চীনের উন্নয়ন ধারায় পরিবেশ দূষণ এখন বড় বৈশিষ্ট্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
সমৃদ্ধির গতিপথ
পুঁজিমুখি সংস্কারের মধ্য দিয়ে চীন দ্রুত পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার শক্তিশালী অংশীদারে পরিণত হয়েছে গত কয়েক দশকে। চীন যে খুব দ্রুত এবং ধারাবাহিকভাবে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করে সবাইকে বিস্মিত করেছে শুধু তাই নয়, খুব দ্রুত একটি ছোট কিন্তু খুবই সম্পত্তিশালী গোষ্ঠী গড়ে তুলেও বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। এই নতুন এলিট গোষ্ঠী চীনে তাইজিদাং (Taizidang) নামে পরিচিত। এদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রবাসী চীনা পরিবারের সাথে সম্পর্কিত, অনেকেই বিদেশে শিক্ষাপ্রাপ্ত, ব্যবসায় বিশেষ আগ্রহী এবং সফল। চীনা পার্টি প্রশাসনের সাথে এরা যে খুবই ঘনিষ্ঠ তা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। বিভিন্ন হিসাবে দেখা যায়, চীনে বিপুল সম্পদশালী (মার্কিন ডলারে বিলিয়নেয়ার)দের সংখ্যা এখন প্রায় ৩০০-তে পৌঁছেছে। ৬ বছর আগে এদের সংখ্যা ছিলো ১৩০।
এই একই প্রক্রিয়ায় চীনে মধ্যবিত্তেরও বিস্তার ঘটেছে, তাদের একটি শক্তিশালী ভিত্তি নির্মিত হয়েছে। চীনে বিভিন্ন বিলাস সামগ্রীর বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে তাদের ওপর ভর করেই। মাথাপিছু বার্ষিক আয় ১৭ হাজার মার্কিন ডলারের বেশি হলে মধ্যবিত্ত বলে বিবেচিত হয়। এই জনগোষ্ঠির সংখ্যা এখন ১০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে।
চীন এখনও নিজেকে সমাজতান্ত্রিক বলে দাবি করে। কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থা কি সমাজতান্ত্রিক না পুঁজিবাদী তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে তাত্ত্বিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। সুনির্দিষ্টভাবে এই বিষয় নিয়ে আমরা সামনের পর্বগুলোতে আরও বিশ্লেষণে যাবো। তবে এতোটুকু বলাই যায় এটি নিশ্চিতভাবে নতুন একটি মডেল উপস্থিত করেছে। চীনা অর্থনীতিকে এখন আর কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত বা রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি বলা যায় না। কেননা জিডিপির শতকরা প্রায় ৭০ ভাগই এখন আসে অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি মালিকানাধীন কৃষি ও ছোটবড় বিভিন্ন ব্যবসা থেকে। শিক্ষা ও চিকিৎসাও আগের মতো পুরো রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে বহন করা হয় না। জমির ওপর ব্যক্তি মালিকানা এখনও স্বীকৃত না হলেও দখলীস্বত্ত্ব আছে। তবে সরকারের ভূমিকা এখনও কেন্দ্রীয়। মূলধনী হিসাব, বিনিয়োগ, মালিকানা হস্তান্তর ইত্যাদিতে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ আছে। ব্যাংক ঋণ, বিনিয়োগ গতিমুখ সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত। নীতিমালা প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা চীনে এখনও অনেক বেশি। এর ভিত্তি বস্তুত বিপ্লব-উত্তর চীনেই নির্মিত হয়েছে।
চীনা অর্থনীতিকে এখন আর কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত বা রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি বলা যায় না। কেননা জিডিপির শতকরা প্রায় ৭০ ভাগই এখন আসে অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি মালিকানাধীন কৃষি ও ছোটবড় বিভিন্ন ব্যবসা থেকে। শিক্ষা ও চিকিৎসাও আগের মতো পুরো রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে বহন করা হয় না। জমির ওপর ব্যক্তি মালিকানা এখনও স্বীকৃত না হলেও দখলীস্বত্ত্ব আছে। তবে সরকারের ভূমিকা এখনও কেন্দ্রীয়।
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচাইতে ব্যাপক নিরক্ষরতা দূরীকরণ কর্মসূচিতে চীনের সাফল্য দীর্ঘমেয়াদে চীনকে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করায়। ১৯৪৯ সালে যেখানে শিক্ষার হার ছিল শতকরা মাত্র ২৮ ভাগ, তা দুইদশকের মধ্যে শতকরা ৭০ ছাড়িয়ে যায়। শিক্ষার মতো চিকিৎসার ক্ষেত্রেও বিপ্লব-উত্তর চীনে বিভিন্ন উদ্ভাবনী পথে বিশাল জনগোষ্ঠীর সুস্থ থাকার অধিকারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছিল। ১৯৪৯ সালে বিপ্লবী ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার আগেই মুক্তাঞ্চলে জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বিকাশ ঘটানো হয়েছিল। বিপ্লবের পরপরই সারাদেশে সর্বজনের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল। যথেষ্টসংখ্যক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তারের অভাবে নগ্নপদ ডাক্তার, ধাত্রীদের দিয়ে বিরাট বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। চীনের লোকজ চিকিৎসার বিকাশের পাশাপাশি আধুনিক চিকিৎসার সমন্বয় করে ক্রমে সবার কাছে চিকিৎসা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। চিকিৎসার আগে রোগের কারণ দূর করতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা, পরিচ্ছন্নতা ও সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করায় সামাজিক আন্দোলনসহ ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত পার্টি কমিটি ও কমিউন কাঠামো ছিল এসব বিষয়ে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রধান মাধ্যম। সবার আগে সবার জন্য খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করার বিষয়টি তো ছিলই। বস্তুত সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করবার মধ্য দিয়েই চীনের বিশাল জনসংখ্যার স্বাস্থ্য পরিস্থিতির গুণগত উন্নতি হয়েছিল। বাজারমুখি সংস্কার প্রক্রিয়ায় কমিউনের সাথে সাথে এসব সর্বজনকেন্দ্রিক রাষ্ট্রীয় কর্মসূচিও আর কার্যকর নেই। চিকিৎসা ব্যবস্থার অনেককিছুই এখন বাণিজ্যিক তৎপরতার আওতায়, রাষ্ট্রীয় ব্যয়ও সেকারণে বেড়েছে। উন্নয়ন বা প্রবৃদ্ধির ধরনের কারণে এখন জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে পানি ও বায়ুদূষণ।
১৯৪৯ সালে যেখানে শিক্ষার হার ছিল শতকরা মাত্র ২৮ ভাগ, তা দুইদশকের মধ্যে শতকরা ৭০ ছাড়িয়ে যায়। শিক্ষার মতো চিকিৎসার ক্ষেত্রেও বিপ্লব-উত্তর চীনে বিভিন্ন উদ্ভাবনী পথে বিশাল জনগোষ্ঠীর সুস্থ থাকার অধিকারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছিল। ১৯৪৯ সালে বিপ্লবী ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার আগেই মুক্তাঞ্চলে জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বিকাশ ঘটানো হয়েছিল। বিপ্লবের পরপরই সারাদেশে সর্বজনের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল। যথেষ্টসংখ্যক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তারের অভাবে নগ্নপদ ডাক্তার, ধাত্রীদের দিয়ে বিরাট বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। চীনের লোকজ চিকিৎসার বিকাশের পাশাপাশি আধুনিক চিকিৎসার সমন্বয় করে ক্রমে সবার কাছে চিকিৎসা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। চিকিৎসার আগে রোগের কারণ দূর করতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা, পরিচ্ছন্নতা ও সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করায় সামাজিক আন্দোলনসহ ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত পার্টি কমিটি ও কমিউন কাঠামো ছিল এসব বিষয়ে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রধান মাধ্যম।
বাজারমুখী সংস্কারের আগে দুর্নীতি, খুন, ধর্ষণ, গোপন অর্থনীতির অস্তিত্ব প্রায় ছিলই না বলতে গেলে। এমনকি ১৯৮৫ সালেও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের হিসাবেও চীন ছিল দুর্নীতির দিক থেকে অনেক নিচে।৬ বাজারমুখি সংস্কারে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি দ্রুত বাড়তে থাকার সাথে সাথে দুর্নীতির বিস্তার ঘটলেও খুন, ধর্ষণ, গোপন অর্থনীতির হারে চীন এখনও অনেক নিয়ন্ত্রিত। বিপ্লবের ধারায় গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত পার্টি কাঠামো, বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের মত ও সিদ্ধান্ত প্রকাশের পাশাপাশি সক্রিয়তার সুযোগ অনেকখানি অব্যাহত রাখায় রাষ্ট্রীয় নীতিমালা প্রয়োগের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো কার্যকর আছে এখনও। উন্নয়ন নামের বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক এমনকি প্রতিরোধের ঘটনাও ঘটছে।
অর্থকরী খাতের পুনর্বিন্যাস
চীনের পুঁজিমুখি অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য অর্থকরী খাতের খোলনলচে পাল্টানো বা এর আমূল সংস্কার ছিল অপরিহার্য। সংস্কারের ধারায় তাই পুরনো ব্যাংকসহ নানা অর্থকরী প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের সাথে সাথে অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়। চীনা ধরনে পুঁজিবাদের বিকাশে এই সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
১৯৭৮ সাল পর্যন্ত চীনে শুধু একটি ব্যাংক ছিল, ‘পিপলস ব্যাংক অব চায়না’। পরের ১০ বছরে ২০টি ব্যাংক প্রতিষ্ঠান, ৭৪৫টি ট্রাস্ট ও বিনিয়োগ কোম্পানি এবং ৩৪টি সিকিউরিটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। চীনের বর্তমান অর্থকরী খাতের উল্লেখযোগ্য সংস্কার শুরু হয় ১৯৯০ দশকের একেবারে শুরু থেকে। সাংহাই ও শেনজেন এই দুটো বৃহৎ স্টক এক্সচেঞ্জই খোলা হয় ১৯৯০ সালের শেষ কয়দিনে। ১৯৯৪ সালে অনেকগুলো আইন তৈরি করা হয় বৃহৎ ও বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য। এই সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ব্যাংক অব চায়না’, ‘চায়না কনস্ট্র্রাকশন ব্যাংক’, ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না’ এবং ‘এগ্রিকালচারাল ব্যাংক অব চায়না’। অর্থকরী খাতে এগুলোই প্রধান প্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ প্রাপ্ত হিসাবে চীনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১৫ কোটি মার্কিন ডলার, উপরের চারটি ব্যাংকের সম্পদ এর শতকরা ৬০ ভাগ।
এখন চীনে ব্যাংকসহ মোট ৩৭৬৯টি অর্থকরী প্রতিষ্ঠান আছে যার শাখাসংখ্যা ১ লক্ষ ৯৬ হাজার। এতে কর্মরত আছেন প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ। এগুলোর মধ্যে আছে ৫টি বৃহৎ রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংক, ৩টি নীতি নির্ধারণী ব্যাংক, ১২টি মাঝারি আকারের অংশীদারি ব্যাংক, একটি ডাক সঞ্চয়ী ব্যাংক, ১৪৭টি নগর বাণিজ্যিক ব্যাংক, ৮৫টি গ্রামীণ বাণিজ্যিক ব্যাংক, ২২৩টি গ্রামীণ সমবায়ী ব্যাংক, ৬৩টি ট্রাস্ট ও বিনিয়োগ কোম্পানি, বহুসংখ্যক অর্থকরী লিজিং ও অর্থ ব্রোকারি প্রতিষ্ঠান, ৪০টি বিদেশি ব্যাংকের চীনা শাখা। এতোগুলো ব্যাংক থাকলেও মাত্র ৫টি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকই পুরো অর্থকরী খাত নিয়ন্ত্রণ করে। এই ৫টি ব্যাংক সরকারের শতকরা ৫৯ ভাগ বন্ড, শতকরা ৮৫ ভাগ রাষ্ট্রীয় বিল, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের শতকরা ৪৪ ভাগ লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া ব্যাংকের আয়ের মধ্যে নাগরিকদের অর্থজমার শতকরা ৫৮ ভাগ, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের শতকরা ৫০ ভাগ জমা এদের হাতেই। চীনে বিদেশি ব্যাংকগুলোর সংখ্যা ক্রমে বাড়লেও এখনও অর্থকরী খাতে তাদের অবস্থান শতকরা ২ ভাগের কম।৭
এখন চীনে ব্যাংকসহ মোট ৩৭৬৯টি অর্থকরী প্রতিষ্ঠান আছে যার শাখাসংখ্যা ১ লক্ষ ৯৬ হাজার। এতে কর্মরত আছেন প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ। এগুলোর মধ্যে আছে ৫টি বৃহৎ রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংক, ৩টি নীতি নির্ধারণী ব্যাংক, ১২টি মাঝারি আকারের অংশীদারি ব্যাংক, একটি ডাক সঞ্চয়ী ব্যাংক, ১৪৭টি নগর বাণিজ্যিক ব্যাংক, ৮৫টি গ্রামীণ বাণিজ্যিক ব্যাংক, ২২৩টি গ্রামীণ সমবায়ী ব্যাংক, ৬৩টি ট্রাস্ট ও বিনিয়োগ কোম্পানি, বহুসংখ্যক অর্থকরী লিজিং ও অর্থ ব্রোকারি প্রতিষ্ঠান, ৪০টি বিদেশি ব্যাংকের চীনা শাখা। এতোগুলো ব্যাংক থাকলেও মাত্র ৫টি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকই পুরো অর্থকরী খাত নিয়ন্ত্রণ করে। এই ৫টি ব্যাংক সরকারের শতকরা ৫৯ ভাগ বন্ড, শতকরা ৮৫ ভাগ রাষ্ট্রীয় বিল, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের শতকরা ৪৪ ভাগ লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করে।
১৯৯৭ সালে আর্থিক খাতে বিরাট সংকট পূর্ব এশীয় দেশগুলোর বেশিরভাগ অর্থনীতির জন্য বিপর্যয় তৈরি করে। এই সংকট চীনের জন্য বিরাট শিক্ষণীয় ছিল। সেসময় মন্দ ঋণ দূর করবার জন্য চারটি বৃহৎ ব্যাংকের সাথে যুক্তভাবে চারটি ব্যাংক খোলা হয়। এই নতুন ব্যাংকগুলোতে ২০০৩ পর্যন্ত প্রায় ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মন্দ ঋণের হিসাব স্থানান্তর করা হয়। এরপর ব্যাংকগুলোতে পুঁজির যোগান দেয়া হয় এবং বৈশ্বিক কৌশলগত অংশীদারের জন্য দ্বার উন্মুক্ত করা হয়। ২০০৫ ও ২০০৬ সালে হংকং ও সাংহাই-র শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার তোলা হয়। চীনের বৃহৎ ব্যাংকগুলোর শেয়ার বাজারে প্রবেশ একটি উল্লেখযোগ্য পর্ব, যার মধ্য দিয়ে এগুলো বিশ্বের বৃহৎ ব্যাংকগুলোর সাথে একতালে অবস্থান গ্রহণ করে। হংকংসহ চীনের পুঁজি বাজার এখন বিশ্বের পুঁজি বিনিয়োগকারীদের অন্যতম মনোযোগ ক্ষেত্র। এর পুঁজি প্রবাহের পরিমাণ এখন ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে। এটি এখন নিউইয়র্কের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পুঁজিবাজার। চীনের রাষ্ট্রীয় অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানও শেয়ার বাজারের মাধ্যমে পুঁজি সঞ্চয় করেছে। সাংহাই ও শেনজেন-এর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ১৮০০। ১৯৯৩ সালে হংকং পুঁজিবাজারে চীনা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রবেশ শুরু হয়। এখন হংকং-এর পুঁজি বাজারে শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ কোম্পানিই চীনের।
১৫ বছরের অনেক কঠিন দরকষাকষির পর নানা শর্ত পূরণ করে চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে ২০০১ সালে। ১৯৯০ দশকে চীনের বিভিন্ন প্রদেশে বহুসংখ্যক অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে ওঠে। বিদেশি বিনিয়োগও ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। প্রথমদিকে বিদেশি বিনিয়োগের কমপক্ষে শতকরা ৫০ ভাগ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে হয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণের পর এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। ২০০৯ সালের মধ্যে শতকরা ৭৫ ভাগ বিদেশি বিনিয়োগ আসে শতভাগ বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান থেকে। বিদেশি বিনিয়োগের কেন্দ্রীভবন ঘটেছে প্রধানত দুটো এলাকায়। এগুলো হলো: গুয়াংদং এবং ইয়াংসী নদী অববাহিকা বা সাংহাই ও দক্ষিণ জিয়াংসু প্রদেশ। এই দুটি অঞ্চল মোট বিদেশি বিনিয়োগের শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ বাস্তবায়িত হয়েছে যা চীনের মোট রফতানির শতকরা ৭০ ভাগ গঠন করেছে।
চীনে শেয়ার বাজারের উচ্চলম্ফ
১৯৯০ দশকের শুরু থেকে চীনে শেয়ার বাজার এবং বাণিজ্যিক আবাসন খাতের বিস্তার বর্তমান চীনের চেহারা তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। এর আগে ৮০ দশকের শুরু থেকেই সরকারের কোনো কোনো অংশের মধ্যে পুঁজিবাজারের বিষয়ে আগ্রহ দেখা যায়। এসময়ে চীন সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার প্রকল্প ইঝেং কেমিক্যাল ফাইবার প্রজেক্ট ‘পুঁজির অভাবে’ পতিত হয়ে যখন চায়না ইন্টারন্যাশনাল ট্রাস্ট এন্ড ইনভেস্টমেন্ট (সিটিক)-এর শরণাপন্ন হয় তখন এই প্রতিষ্ঠান তাদের পরামর্শ দেয় জাপানে আন্তর্জাতিক বন্ড ছেড়ে এই পুঁজি সংগ্রহের। প্রথমদিকে এভাবে পুঁজি সংগ্রহের বিরুদ্ধে পার্টি ও সরকারের ভেতরে প্রতিরোধ দেখা গেলেও ১৯৮১ সালে চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদ এর অনুমোদন দেয় এবং জাপানের বাজারে বন্ড বিক্রি করে পুঁজি সংগ্রহ করা হয়। এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে পরের বছরগুলোতে ‘পুঁজির অভাবে’ অন্য কয়েকটি প্রকল্পের অর্থ সংগ্রহেও একই পথ অবলম্বন করা হয়।
আশি দশকের শেষ থেকে চীনের বাজারে কোম্পানির শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে পুঁজি সংগ্রহ বিষয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছিল। ১৯৮৭ সালে প্রথম শেনজেন-এর পাঁচটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান মূলধন সংগ্রহে শেয়ার বিক্রি করবার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল শেনজেন ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, এটি ছিল প্রথম অর্থকরী প্রতিষ্ঠান যেটি শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে পুঁজি সংগ্রহের চেষ্টা করে। এতে প্রথমে কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। সাধারণ মানুষের এই অনাগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে পার্টি কমিটির নেতাদেরকে তাদের সদস্যদের শেয়ার কিনতে উদ্বুদ্ধ করবার ঘটনাও দেখা যায়। অবশেষে ১৯৮৯ সালে এই ব্যাংক যখন লভ্যাংশ ঘোষণা করে তখনই সাড়া পড়ে যায়। এই ঘটনাকে চীনের অর্থনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁক বলে অনেকে মনে করেন।
এর মধ্যে ১৯৮৮ সালের ডিসেম্বরে শিজহিমেন হোটেলে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে চীনের ভবিষ্যত শেয়ার বাজারের রূপরেখা ঠিক করা হয়। সম্মেলন রিপোর্টে শেয়ার বাজার প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গে আরও যেসব বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয় তার মধ্যে ছিল: (১) রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিরাষ্ট্রীয়করণ করা যাবে না। (২) রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের লোকসান কমাতে হবে। (৩) অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য বজায় রাখতে হবে। সম্মেলনে শেয়ার ভিত্তিক নতুন কোম্পানি প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। ১৯৯০ সালের মে মাসে চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদ এই রিপোর্ট পর্যালোচনা করে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তার মধ্যে বলা হয়: (১) কোনো ব্যক্তি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারী হতে পারবেন না, শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করবে। (২) প্রতিষ্ঠানের কর্মচারিদের কাছে আর শেয়ার বিক্রি করা হবে না। এসব সিদ্ধান্ত অবশ্য পরে আরও পরিবর্তিত হয়। বিভিন্ন ধাপে বাজারমুখী সংস্কার নিয়ে পার্টির মধ্যে মতভেদ ও বিতর্কের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে বাজারমুখী সংস্কারপন্থীরাই বরাবর এগিয়ে ছিলেন।
১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ এবং ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ যাত্রা শুরু করে। শুরুর দিকে এগুলো ভৌগোলিকভাবে স্থানীয় প্রতিষ্ঠান ও খুচরা ব্যবসায়ীদের মধ্যে সীমিত ছিল। ১৯৯৪ এর দিক থেকে এর ব্যাপক পরিবর্তন হয়। দুটো সংস্থাই জাতীয়ভাবে উন্মুক্ত হয়। ১৯৯২ সালের ৭ অক্টোবর প্রথম চীনের তুলনামূলকভাবে ছোট একটি কোম্পানি নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ-এ তালিকাভুক্ত হয়। এরপর একে একে অনেক প্রতিষ্ঠানই আন্তর্জাতিক শেয়ার বাজারের সাথে যুক্ত হয়েছে। ১৯৯৩ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে চীনা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ২৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার তুলেছে। ২০০০ সালের পর থেকে আন্তর্জাতিক পুঁজি বাজারে চীনা কোম্পানিগুলোর তৎপরতা অনেক দক্ষ ও বিস্তৃত হয়। এর পেছনে মার্কিন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেরও ভূমিকা ছিল।
১৯৯০ সাল থেকে শেয়ার বাজারে চীনা কোম্পানিগুলোর মূলধনীকরণ বেড়েছে অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে। ১৯৯৬ সালে সাংহাই বাজারে শীর্ষ ১০টি কোম্পানির মোট মূলধন ছিল ১৭.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ১৯৯৯ এর শেষ দিকে এটি পৌঁছায় ২৫.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে, ১০ বছর পর এর পরিমাণ ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার পার হয়ে যায়। ২০০৬ এর জানুয়ারি থেকে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি আইপিও ছিল চীনা কোম্পানির। ২০০৯ এর মধ্যে যে দশটি কোম্পানি শীর্ষস্থান দখল করে এগুলোর সবই আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা তেল কোম্পানি।৮
এশিয়ার মধ্যে চীনের স্টক মার্কেট এখন বৃহত্তম। এর মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম কোম্পানির অনেকগুলোই তালিকাভুক্ত। পুঁজিবাজারে চীনের এই দক্ষ পদচারণা, দ্রুত বিকাশের পেছনে আন্তর্জাতিক বিশেষত মার্কিনী বিভিন্ন সংস্থাও ভূমিকা পালন করেছে। এছাড়া পশ্চিমা বিভিন্ন বিনিয়োগকারী সংস্থার দেনদরবার লবিংও ছিল উল্লেখযোগ্য।
এশিয়ার মধ্যে চীনের স্টক মার্কেট এখন বৃহত্তম। এর মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম কোম্পানির অনেকগুলোই তালিকাভুক্ত। পুঁজিবাজারে চীনের এই দক্ষ পদচারণা, দ্রুত বিকাশের পেছনে আন্তর্জাতিক বিশেষত মার্কিনী বিভিন্ন সংস্থাও ভূমিকা পালন করেছে। এছাড়া পশ্চিমা বিভিন্ন বিনিয়োগকারী সংস্থার দেনদরবার লবিংও ছিল উল্লেখযোগ্য।
বাজারমুখি সংস্কারের পেছনে গোল্ডম্যান ও মরগ্যান
একটি দেশ কয়েক দশকে সমাজতান্ত্রিক নীতিমালা ও কর্মপদ্ধতি, হিসাবপদ্ধতি অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পর কী করে বাজার অর্থনীতির সর্বাধুনিক ব্যবস্থাপনা, হিসাব পদ্ধতি ও নীতিমালা আয়ত্ত করে ফেললো তা এক বড় বিস্ময়ের বিষয়ই বটে। শুধু আয়ত্তই নয়, পুরনো এবং প্রভাবশালী পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে মোকাবেলা করে নিজেদের অর্থনীতি সংস্কার করে পাল্লা দিয়ে দ্রুতগতির প্রবৃদ্ধিও নিশ্চিত করলো।
এই বিষয়ে পুরো তথ্য পাওয়া কঠিন তবে যতটুকু জানা যায় তাতে দেখা যায় প্রথমত, বাজারমুখি সংস্কার সম্পর্কে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেবার পর চীনা পার্টি প্রস্তুতি নিতে সময় নিয়েছে, গবেষণা প্রশিক্ষণে বিস্তারিত কর্মসূচি নিয়েছে, বিশ্বের পুঁজিবাদী কেন্দ্র দেশগুলোতে লোক পাঠিয়েছে, সেসব দেশের বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ দিয়েছে আর সংস্কার নিয়ে খুব ধীর গতিতে অগ্রসর হয়েছে। চীনের বাজারমুখি এই সংস্কার নিয়ে বিশ্বের পুঁজিবাদী সকল প্রতিষ্ঠান বহুজাতিক কোম্পানি, বহুজাতিক ব্যাংক ছাড়াও বিভিন্ন অর্থকরী ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের আগ্রহ ছিল অপরিসীম। কেননা এর সাথে তাদের বিশাল বাণিজ্যিক স্বার্থ সম্পর্কিত ছিল। প্রথম থেকেই চীনে তাদের অবিরাম যাতায়াত এবং দেনদরবার দেখা যায়। দুপক্ষের আগ্রহেই তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। দীর্ঘমেয়াদে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনে স্থপতির কাজ প্রধানত পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোই করেছে। এদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় দুটো প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাদী বিশ্বের বহু ভাবে পরিচিত- গোল্ডম্যান স্যাকস ও মরগ্যান স্ট্যানলি। দুটো প্রতিষ্ঠানের সাথেই মার্কিন শীর্ষ পর্যায়ের নীতি নির্ধারকরা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে জড়িত ছিলেন, আছেন। গোল্ডম্যান স্যাকস এর মধ্যে অগ্রগণ্য। এর সাথে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের নামও উচ্চারিত হয়। একদিকে চীনের সাথে কাজ করবার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় অর্থকরী প্রতিষ্ঠানের আগ্রাসী প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে চীনের সরকারের তাদের ওপর ভর করে বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় প্রভাবশালী অবস্থান সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা এই দুই মিলে দ্রুত পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে।
প্রথম থেকেই চীনে তাদের অবিরাম যাতায়াত এবং দেনদরবার দেখা যায়। দুপক্ষের আগ্রহেই তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। দীর্ঘমেয়াদে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনে স্থপতির কাজ প্রধানত পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোই করেছে। এদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় দুটো প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাদী বিশ্বের বহু ভাবে পরিচিত- গোল্ডম্যান স্যাকস ও মরগ্যান স্ট্যানলি। দুটো প্রতিষ্ঠানের সাথেই মার্কিন শীর্ষ পর্যায়ের নীতি নির্ধারকরা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে জড়িত ছিলেন, আছেন।
চীনের সংস্কার নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দুজন বাজারমুখী গবেষক তাই যা বলেছেন তার মধ্যে সত্যতা আছে। তাঁরা বলেছেন, ‘একুশ শতকের নতুন চীন গোল্ডম্যান স্যাকস ও লিংকলেটারস এন্ড পেইনস এর সৃষ্টি, নতুন চীন সৃষ্টিতে এদের ভূমিকা সাংস্কৃতিক বিপ্লবে চীনের ছোট লাল বই এর মতোই।’৯ এই পশ্চিমা গবেষকদের গবেষণা থেকেই নিচে চীনের বিভিন্ন কোম্পানি কোন কোন বিনিয়োগ সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সাথে পশ্চিমা পুঁজিবাজারে দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে তার একটি তালিকা দেয়া হলো।
চীনা কোম্পানি ও তার প্রধান পশ্চিমা সহযোগী
কোম্পানি | শিল্প | প্রধান সহযোগী (লিড আন্ডাররাইটার) | আইপিও তারিখ | আইপিও আকার (বিলিয়ন মার্কিন ডলার) |
চায়না মোবাইল* | মোবাইল/ টেলিকম | গোল্ডম্যান স্যাকস | ২৩ অক্টোবর ১৯৯৭ | ৪.৫ |
পেট্রো চায়না | তেল ও গ্যাস | গোল্ডম্যান স্যাকস | ৭ জুলাই ২০০০ | ২.৯ |
চায়না ইউনিকম* | মোবাইল/টেলিকম | মরগ্যান স্ট্যানলি | ২২ জুন ২০০০ | ৫.১ |
সিনোপেক* | তেল ও গ্যাস | মরগ্যান স্ট্যানলি | ১৯ অক্টোবর ২০০০ | ৩.৩ |
এইচ এস চায়না ন্যাশনাল অফশোর অয়েল* | তেল ও গ্যাস | মেরিল লিঞ্চ/সিএসএফবি | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০১ | ১.৪ |
এ্যালুমিনিয়াম কর্পোরেশন অব চায়না (চালকো)* | খনি ও প্রক্রিয়াজাতকরণ | মরগ্যান স্ট্যানলি | ১২ ডিসেম্বর ২০০১ | ০.৫ |
চায়না টেলিকম* | টেলিফোন | মেরিল লিঞ্চ/ মরগ্যান স্ট্যানলি | ৮ নভেম্বর ২০০২ | ১.৪ |
চায়না লাইফ ইনসুরেন্স | ইনসুরেন্স | সিটি/সিএসএফবি/ডয়েশে ব্যাংক | ১৮ ডিসেম্বর ২০০৩ | ৩.৪ |
পিং এন ইনসুরেন্স | ইনসুরেন্স | গোল্ডম্যান স্যাকস/এইচএসবিসি মরগ্যান স্ট্যানলি | ২৪ জুন ২০০৪ | ১.৮ |
এয়ার চায়না* | এয়ারলাইন | মেরিল লিঞ্চ | ১৫ জুন ২০০৫ | ১.২ |
চায়না শিনহুয়া এনার্জি* | জ্বালানী ও বিদ্যুৎ | ডয়েশে ব্যাংক/ মেরিল লিঞ্চ | ১৫ জুন ২০০৫ | ৩.৩ |
ব্যাংক অব কমিউনিকেশন | ব্যাংকিং | গোল্ডম্যান স্যাকস/এইচএসবিসি | ২৩ জুন ২০০৫ | ২.২ |
চায়না কনস্ট্র্রাকশন ব্যাংক | ব্যাংকিং | সিএসএফবি/ মরগ্যান স্ট্যানলি | ২৭ অক্টোবর ২০০৫ | ৯.২ |
ব্যাংক অব চায়না | ব্যাংকিং | গোল্ডম্যান স্যাকস/ইউবিএস | ১ জুন ২০০৬ | ১১.১ |
আইসিবিসি | ব্যাংকিং | ডয়েশে ব্যাংক/মেরিল লিঞ্চ/সিএসএফবি | ২১ অক্টোবর ২০০৬ | ২১.৯ |
*চিহ্নিত কোম্পানিগুলোর চেয়ারম্যান চীনা কমিউিনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক কমিটির সাথে যুক্ত।
তথ্যসূত্র:
১) Henry Kissinger: On China, Penguin, 2011, pp 459-461
২) Kavaljit Singh: “From Beijing Consensus to Washington Consensus: China’s Journey to Liberalization and Globalization”, 2008.
৩) http://www.tradingeconomics.com/china/gdp
৫) National Bureau of Statistics of China, February 29, 2016
৬) Vladimir Popov: Is Chinese Variety of Capitalism Really Unique?http://www.networkideas.org/featart/jun2010/Unique.pdf
৭) Carl E. Walter, Fraser J.T. Howie: Red Capitalism, The Fragile Financial Foundation of China’s Extraordinary Rise, Wiley, 2012. pp 5-35.
৮) ibid. pp 162-175.
৯) ibid, p. 179.
97