বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কালো-সাদা মানুষের আন্দোলন: বর্বর ইতিহাসের উন্মোচন

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কালো-সাদা মানুষের আন্দোলন: বর্বর ইতিহাসের উন্মোচন

আলমগীর খান

করোনার ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যেও মার্কিন পুলিশের বর্বরতার শিকার হয়েছেন এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ। ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন ছিলো না; যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদী, শ্রেণী ও লিঙ্গীয় বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার মধ্যে এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে। তাই এবারে প্রতিবাদের বিস্ফোরণ হয়েছে। প্রতিবাদ শুধু নির্দিষ্ট পুলিশ নির্যাতককে নয়, পুরো ইতিহাস আর বর্ণবাদী বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকেই আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। এতোদিন যেসব বর্বর খলনায়কদের নায়ক বানানো হয়েছিল তাদের মূর্তি টেনে নামাচ্ছে প্রতিবাদী তরুণেরা, সাদা কালো সবাই। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয় অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও। বিস্তারিত…

১৯৬৪ সালের ১০ ডিসেম্বর অসলোয় নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণ কালে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ জননেতা মার্টিন লুথার কিং তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, “আমি নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণ করছি সেই মুহূর্তে যখন জাতিগত অবিচারের দীর্ঘ রাত্রি অবসানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ২ কোটি ২০ লক্ষ নিগ্রো অনন্য সংগ্রামে লিপ্ত। … আমি স্মরণ করছি যে, মাত্র গতকাল আলাবামার বার্মিহামে ভ্রাতৃত্বের দাবি জানানোর অপরাধে আমাদের সন্তানদেরকে আগুনের, ক্ষিপ্ত কুকুরের ও এমনকি মৃত্যুর অভ্যর্থনা জানানো হয়েছে। আমি স্মরণ করছি যে, গতকাল মিসিসিপির ফিলাডেলফিয়ায় ভোটাধিকার চাওয়ার জন্য তরুণদেরকে পাশবিকভাবে নির্যাতন ও খুন করা হয়েছে। আর মাত্র গতকাল মিসিসিপি রাজ্যে ৪০টি উপাসনালয় বোমা মেরে ও পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়েছে কারণ যারা বর্ণবাদী আলাদাকরণের ব্যবস্থা (সেগ্রিগেশন) মেনে নেয়নি তারা এখানে আশ্রয় পেয়েছিলো। আমি মনে রাখছি, এক নিস্তেজকারী ও হাড়ভাঙা দারিদ্র্য আমার জনগণকে নিষ্পেষণ করছে এবং তাদেরকে অর্থনৈতিক মইয়ের সর্বনিম্ন ধাপে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে।”      

তবে মার্টিন লুথার কিং যেসব ঘটনার বর্ণনা করছিলেন তার নোবেল-বক্তৃতায়, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস তার চেয়ে অনেক ভয়ংকর ঘটনার সাক্ষী। আর সেসব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলো সবই একটা নৃশংস ব্যবস্থার প্রতিফলন যার মূল অনেক গভীরে। 

ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার

যুক্তরাষ্ট্রে কালোদের জীবনের মূল্য শাদাদের জীবনের চেয়ে অনেক কম। বর্ণবাদ সেখানে দৈনন্দিন জীবনাচরণ, সাংস্কৃতিক চর্চা, সামাজিক প্রথা, রাষ্ট্রীয় আইনকানুন ইত্যাদি সবকিছুতেই গভীরভাবে প্রোথিত। কালোদের প্রতি দৈনন্দিন বৈষম্য প্রায়ই হত্যাকান্ডে পর্যবসিত হয়।  

২০১২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যের স্যানফোর্ডে ১৭ বছর বয়সের আফ্রিকান-আমেরিকান কিশোর ট্রেভন মার্টিন বৃষ্টিস্নাত রাতে এক দোকান থেকে বরফ-চা ও ক্যান্ডি কিনে ফিরে যাওয়ার পথে খুন হয় স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী জর্জ জিমারম্যানের গুলিতে। বিচারে জিমারম্যান নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে খালাস হয়ে গেলে রায়ের ৬ দিন পর ২০১৩ সালের ১৯ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা হোয়াইট হাউজে প্রদত্ত এক আবেগী বক্তৃতায় বলেন, “ট্রেভন মার্টিন হতে পারতো আমার ছেলে। অন্যভাবে বলা যায়, ৩৫ বছর আগে সে আমিও হতে পারতাম।”

এবিসি নিউজে ১৭ বছরের ওবামার ও মার্টিনের ছবি পাশাপাশি রেখে দেখানো হয় তাদের চেহারায় আশ্চর্য মিল। সে বক্তৃতায় ওবামা আরও বলেন, “এমন কোনো আফ্রিকান-আমেরিকান নেই, যার অভিজ্ঞতায় নেই কোনো ডিপার্টমেন্ট স্টোরে কেনাকেটার পর পুলিশের পিছু লেগে থাকা। আমিও ব্যতিক্রম নই।” তিনি বলেন, এসব অভিজ্ঞতা থেকে এই ধারণাই জন্মায় যে, একজন শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তির বেলায় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটনা ভিন্ন হয়।  

এমন কোনো আফ্রিকান-আমেরিকান নেই, যার অভিজ্ঞতায় নেই কোনো ডিপার্টমেন্ট স্টোরে কেনাকেটার পর পুলিশের পিছু লেগে থাকা। আমিও ব্যতিক্রম নই।

ট্রেভনকে হত্যার প্রতিবাদে ২০১৩য় শুরু হয় সোশাল মিডিয়াভিত্তিক ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার। মিজৌরি রাজ্যের ফারগুসন শহরে ২০১৪ সালের ৯ আগস্ট ১৮ বছর বয়সের কিশোর মাইকেল ব্রাউন এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশের গুলিতে খুন হয়। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার রাস্তায় নামে। ফ্লয়েডের মৃত্যুতে ন্যায়বিচার ও সাম্যতার দাবিতে তাদের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। যে আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে শাদা, কালো, বাদামী সকল বর্ণের, ধর্মের ও জাতির মানুষ। এ আন্দোলনের দাবিসমূহ হয়ে উঠেছে বহুমুখী ও সুদূরপ্রসারী।    

শ্বাস নিতে পারছি না

এ বছর ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটায় কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে পুলিশ ধরে, সিগারেট কিনতে ২০ ডলারের একটি জাল নোট ব্যবহারের অভিযোগে। এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা তাকে হাতকড়া পরিয়ে সাড়ে ৮ মিনিট তার গলায় হাঁটু গেড়ে বসে থাকে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগে পর্যন্ত ফ্লয়েড ষোলবার বলেন, “আমি শ্বাস নিতে পারছি না।”    

২০১৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়ার একজন আদিবাসী ডেভিড ডুঙ্গে সিডনির এক কারাগারে বিস্কুট খাওয়া বন্ধ না করায় একইভাবে পুলিশের হাতে খুন হন। মৃত্যু তাকে ছিনিয়ে নেয়ার আগে পর্যন্ত তিনিও পুলিশের হাঁটুর নিচে বারোবার বলেন, “আমি শ্বা নিতে পারছি না।” দেশটিতে ১৯৯১ সাল থেকে পুলিশের হাতে ডুঙ্গের মতো ৪৩৬ জন আদিবাসী মৃত্যুবরণ করেছেন।

এরও আগে ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই নিউ ইয়র্কের পুলিশের হাতে একইভাবে খুন হন কৃষ্ণাঙ্গ এরিক গার্নার। অবৈধ সিগারেট বিক্রির অভিযোগে যখন পুলিশ তাকে মাটিতে ফেলে তার গলায় হাঁটু গেড়ে বসে তিনিও এগারোবার উচ্চারণ করেন, “আমি শ্বাস নিতে পারছি না।”   

এসব কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। যুক্তরাষ্ট্রে এরকম হত্যাকা- প্রায়ই ঘটে যা কখনো কখনো দেশটিতে প্রতিবাদের ঝড় তোলে। তবে ফ্লয়েডকে হত্যার প্রতিবাদ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। শ্বাসরোধী এই ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের একার নয়, পৃথিবীর বহু দেশের। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকার বহু দেশের নির্যাতিত মানুষ গার্নার, ডুঙ্গে ও ফ্লয়েডের সঙ্গে নিজেদের ভাগ্যকে একাত্ম করে দেখছে। এ গণআন্দোলন এখন আর কেবল শাদা-কালোর প্রশ্নে সীমাবদ্ধ নেই। ঔপনিবেশিক শোষণ, পুলিশি বর্বরতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যসহ বহু বিষয় সামনে চলে এসেছে। দেশে দেশে বহুরকম অবিচারের বিরুদ্ধে রুষে উঠেছে সাধারণ মানুষ। তারাও চিৎকার করে বলছে- দম বন্ধ হয়ে আসছে হে শাসক-শোষক, হে পেটোয়াবাহিনী, হে রাষ্ট্র।      

যুক্তরাষ্ট্রের দমবন্ধ করা ৪০০ বছরের ইতিহাস

যুক্তরাষ্ট্রের আছে ৪০০ বছরের বেশি কৃষ্ণাঙ্গ নির্যাতনের ইতিহাস। দেশটি মূলত দাসব্যবসায়ীদের সাম্রাজ্য। এ দেশের যা কিছু ঐশ্বর্য্য সবই আসলে কালো দাসদের শ্রমে, ঘামে ও প্রাণের বিনিময়ে তৈরি। দেশটির প্রতিষ্ঠাতা-পিতাদের সকলেই ছিলেন ধনবান ও ক্ষমতাবান দাস-মালিক। জর্জ ওয়াশিংটন, থমাস জেফারসন, জেমস ম্যাডিসন ও প্যাট্রিক হেনরি সকলেই তাই। দাসরা ছিলো তাদের সবার কাছে ব্যক্তিগত কেনাসম্পত্তি এবং তারা প্রত্যেকে দাসদাসী বেচাকেনা করতেন। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণারও বহু আগে থেকেই সেখানে দাসব্যবসার প্রতিষ্ঠা হয়। ষোড়শ শতকে কলম্বাসের সমুদ্র অভিযানের পর থেকেই শুরু হয় উত্তর আমেরিকায় দাসব্যবসা।

১৫০০ সাল নাগাদ আফ্রিকার জনসংখ্যা ছিলো ৪ কোটি ৭০ লাখের মতো। এরপর সাড়ে তিনশো বছর ধরে ১ থেকে দেড়কোটি আফ্রিকানের গলায় শিকল পরিয়ে তাদেরকে রপ্তানি করা হয় নয়াবিশ্বে। এর বাইরেও ৪০ থেকে ৬০ লাখ আফ্রিকান কালো মানুষের মৃত্যু ঘটেছে ধরা পড়ার ও আটলান্টিক পাড়ি দেয়ার সময়। তাদেরকে জাহাজে ভরা হতো ‘মাল’ হিসেবে। পশুর মতো হাটে তুলে বিক্রির জন্য তাদের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হতো।  এ দাস-ব্যবসার পাপে কেবল আমেরিকাই নয়, তৎকালীন সকল পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশই এ পঙ্কে নিমজ্জিত। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী হোতাদের কাছে মানুষ, পশু ও জড়বস্তুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মুনাফা লাভই আসল কথা। মানুষ ও পশুর আমদানি-রপ্তানি ও ব্যবহার হয়েছে জড়বস্তুর মত করে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারচেয়ে ভয়ংকর উপায়ে কেননা নির্যাতিত মানুষ বিদ্রোহ করে বসে, যে ভয় নির্জীব বস্তুর বেলায় নেই।

১৫০০ সাল নাগাদ আফ্রিকার জনসংখ্যা ছিলো ৪ কোটি ৭০ লাখের মতো। এরপর সাড়ে তিনশো বছর ধরে ১ থেকে দেড়কোটি আফ্রিকানের গলায় শিকল পরিয়ে তাদেরকে রপ্তানি করা হয় নয়াবিশ্বে। এর বাইরেও ৪০ থেকে ৬০ লাখ আফ্রিকান কালো মানুষের মৃত্যু ঘটেছে ধরা পড়ার ও আটলান্টিক পাড়ি দেয়ার সময়। তাদেরকে জাহাজে ভরা হতো ‘মাল’ হিসেবে। পশুর মতো হাটে তুলে বিক্রির জন্য তাদের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হতো।

ইতালি-ভিত্তিক সংবাদপত্র ‘ইলমেনিফেস্টো’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এখনকার আন্দোলন সম্পর্কে অন্যতম প্রগতিশীল চিন্তাবিদ নোয়াম চমস্কি বলেন, “গভীরে যা আছে তা হলো ৪০০ বছরের পাশবিক নির্যাতন। প্রথমত, মানবেতিহাসে দাসপ্রথার সবচেয়ে নৃশংস রূপ, যা যুক্তরাষ্ট্রের (ও যুক্তরাজ্যের) অর্থনৈতিক উন্নতি ও সমৃদ্ধির ভিত্তি। এরপর স্বাধীনতা- যখন কালোরা সমাজে প্রবেশ করতে পারলো ও সেটা তারা আশ্চর্য সাফল্যের সঙ্গে করলো। তারপর উত্তর-দক্ষিণ সমঝোতা যা আগের দাসমালিক-প্রধান রাজ্যগুলোকে যা ইচ্ছে তাই করার সুযোগ করে দিলো। তারা যা করলো তা হচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গ জীবনকে অপরাধীর জীবনে পর্যবসিত করা। সৃষ্টি হলো অন্যরূপে দাসত্ব।” 

২০১৬য় ও এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মনোনয়ন লাভের জন্য প্রতিযোগী জননেতা বার্নি স্যান্ডার্স তার ওয়েবসাইটে উল্লেখ করেছেন, “আমরা জানি আফ্রিকান-আমেরিকানদের বন্দী হওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণ ও পুলিশের হাতে শারীরিক নির্যাতন ভোগের সম্ভাবনা প্রায় চারগুণ। কোনো অপরাধে শ্বেতাঙ্গদের যে শাস্তি দেয়া হয়, একইরূপ অপরাধে কৃষ্ণাঙ্গদেরকে ভোগ করতে হয় বেশি কারাদন্ড। আর শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় আফ্রিকান আমেরিকানদেরকে পাঁচগুণ বেশি জেলে পুরা হয়।”          

পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার অন্দোলনের ফলে আজ রাষ্ট্রের পেটোয়াবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঢেউ যুক্তরাষ্ট্র থেকে পৃথিবীর বহু দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রে পুলিশবাহিনীর ভূমিকা বড়রকম প্রশ্নের মুখে। ফ্রান্সে ২০১৬ সালে পুলিশের হাতে খুন হন মালিয়ান বংশোদ্ভূত অ্যাডামা ট্রেওর। ফ্লয়েডকে হত্যার পর ফ্রান্সে পুলিশি নির্যাতন বন্ধের দাবিতে রাস্তায় নামে মানুষ। ৩০ মে ইজরায়েলি পুলিশের গুলিতে অটিস্টিক ইয়াদ হালাকের মৃত্যুতে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ হয়েছে জেরুজালেমের রাস্তায়। প্যালেস্টাইনবাসীর বিরুদ্ধে ইজরায়েলের পুলিশি নির্যাতন সবচেয়ে সুপরিকিল্পিত, সুসংগঠিত ও নিয়মিত এক বর্বরতা। নিজ নিজ দেশে পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া, ইংল্যান্ড, ইটালি, বেলজিয়ামসহ বহু দেশে।  

দাবি উঠেছে পুলিশি কার্যক্রমে টাকা দেয়া বন্ধ করার ও এমনকি পুলিশ বিভাগই বাতিল করে দেয়ার। সারা যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশি কার্যক্রমে ব্যয় হয় ১১৫ বিলিয়ন ডলার। অথচ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ইত্যাদি খাতে পর্যাপ্ত বাজেট নেই। মিনেসোটার জনপ্রিয় কংগ্রেসওম্যান ইলহান ওমর এবিসি নিউজকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “মিনিয়াপলিসের পুলিশ শিকড় পর্যন্ত পচে গেছে এবং এটা এখন একটা ক্যান্সার।” তিনি আরও বলেন, পুলিশি কার্যক্রমে ১৯৩ মিলিয়ন ডলার খরচ করা হয় যা গৃহায়ণ খরচের ৬ গুণ, স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়ের ১১ গুণ ও অপরাধ প্রতিরোধের জন্য ব্যয়ের ৪৮২ গুণ।       

দাবি উঠেছে পুলিশি কার্যক্রমে টাকা দেয়া বন্ধ করার ও এমনকি পুলিশ বিভাগই বাতিল করে দেয়ার। সারা যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশি কার্যক্রমে ব্যয় হয় ১১৫ বিলিয়ন ডলার। অথচ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ইত্যাদি খাতে পর্যাপ্ত বাজেট নেই।

ভেঙে পড়ছে মূর্তি

আন্দোলনকারীরা ইতিহাসের প্রচলিত বীর ও পূজনীয়দেরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে, ভেঙে ফেলছে তাদের মূর্তি। ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে স্থাপিত দাসব্যবসায়ী এডওয়ার্ড কলস্টোনের মূর্তি নদীতে ছুঁড়ে ফেলে আন্দোলনকারী জনতা। দাসব্যবসায়ী রবার্ট মিলিগানের মূর্তি লন্ডন যাদুঘরের সামনে থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী সেসিল রোডসের মুর্তি সরিয়ে ফেলার দাবি উঠছে অনেক দিন থেকে।

আন্দোলনকারীরা ইতিহাসের প্রচলিত বীর ও পূজনীয়দেরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে, ভেঙে ফেলছে তাদের মূর্তি।

বেলজিয়ামে আফ্রিকান-হত্যাকারী নৃশংস রাজা লিওপল্ডের মূর্তিতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। অগণ্য হত্যাকান্ড ও দাসব্যবসায়ের হোতা ইতালিয় নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মূর্তির গলায় দড়ি বেঁধে ছুঁড়ে ফেলা হয় নদীতে। আমেরিকায় দাসত্বপ্রথার সমর্থক সামরিকনেতা রবার্ট ই. লি এবং জেনারেল জে. ই. বি. স্টুয়ার্টের মূর্তি সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ায় গণহত্যা ও দাসত্বের হোতা ক্যাপ্টেন কুকের মূর্তি সরিয়ে ফেলার দাবি উঠেছে। ইতালির মিলানে ফ্যাসিজম সমর্থক ইন্দ্রো মনতানেলির মূর্তির গায়ে লিখে দেওয়া হয়েছে ‘জাতি-বিদ্বেষী, ধর্ষক’। বাংলায় দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী উইনস্টন চার্চিলের মূর্তির গায়েও সেঁটে দেয়া হয়েছে তার আসল পরিচয়- ‘ওয়াজ এ রেসিস্ট’। পলাশী যুদ্ধের ঘৃণ্য বিজয়ী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা লুণ্ঠনকারী রবার্ট ক্লাইভের মূর্তি ভেঙে ফেলার দাবি উঠেছে।                

পুঁজিবাদের লেজুড় বর্ণবাদ

ঘটনাক্রমে বর্তমানের এই পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের প্রাথমিক বৈপ্লবিক বিকাশ হয়েছে ইউরোপ-আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মাঝে। পরবর্তীতে মানবাধিকারের প্রশ্ন জোরদার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ্য দাসব্যবসার আইনি বিলুপ্তি ঘটে। তারপরও মজুরিদাসদের অনেক সংগ্রাম করে ৮ ঘণ্টা-শ্রমদিবসের স্বীকৃতি লাভ করতে হয়। পুঁজির মালিকের কাছে তার দাস শাদা না কালো তাতে কিছু আসে যায় না। কারখানার শ্রমিকরা হচ্ছে পুঁজির অধীন শাদা ও কালো রঙের দাস। কিন্তু আইডেন্টিটি পলিটিক্সের রীতি অনুযায়ী একসময় তাদের মাঝে একটা পার্থক্য সূচিত হয়। মনে হতে থাকে যে, বিভাজনটা পুঁজি আর শ্রমের মাঝে নয়, শাদা আর কালোয়। আইডেন্টিটি পলিটিক্স এরকম নানা পরিচয়ের ছুতোয় মানুষকে ইচ্ছেমতো বিভক্ত করে রাখে।

ভারতের বর্ণপ্রথা কেবল ব্রাহ্মণ্যবাদীদের নিজস্ব আবিষ্কার ও সম্পদ নয়, সব দেশেই এটি বিভিন্ন রূপে থাকে। মানুষকে পেশার ভিত্তিতে বর্ণে বা সামাজিক শ্রেণিতে ভাগ করা আর গাত্রবর্ণের ভিত্তিতে পেশা বা সামাজিক শ্রেণিতে ভাগ করা মূলে অভিন্ন। এক প্রথা আরেক প্রথায় দ্রবীভূত হয়ে একইরূপ লাভ করে। ভারতের বর্ণপ্রথায় বা কাস্ট সিস্টেমেও গায়ের রঙ অনুপস্থিত ছিলো না। আর্যদের ভারতে আসা থেকে এখন পর্যন্ত ভারতীয় ও আশপাশের সমাজে ফর্সা ও উজ্জ্বল রঙের প্রতি একটা বদ্ধমূল পক্ষপাতিত্ব রয়েছে। দুইশো বছরের ইংরেজ শাসনে সে পক্ষপাতিত্ব আরও পোক্ত হয়। ফর্সা-উজ্জ্বল রঙের প্রতি এ পক্ষপাতিত্বকে পুঁজি করে ‘ফেয়ার এন্ড লাভলি’র মতো নানারকম প্রসাধনী বিক্রির মাধ্যমে কর্পোরেটরা কোটি কোটি টাকা সাধারণ মানুষের পকেট থেকে লুটে নেয়। দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া জুড়েই এ ফর্সা-সংস্কার প্রবল। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্মূলে ও নির্যাতনেও এ গায়ের রঙ একটা ছুতা হিসেবে ব্যবহার হয়।   

ভারতের বর্ণপ্রথায় বা কাস্ট সিস্টেমেও গায়ের রঙ অনুপস্থিত ছিলো না। আর্যদের ভারতে আসা থেকে এখন পর্যন্ত ভারতীয় ও আশপাশের সমাজে ফর্সা ও উজ্জ্বল রঙের প্রতি একটা বদ্ধমূল পক্ষপাতিত্ব রয়েছে। দুইশো বছরের ইংরেজ শাসনে সে পক্ষপাতিত্ব আরও পোক্ত হয়।

এ সংস্কারাচ্ছন্নতা এতো বদ্ধমূল যে, কালো মানুষ পুঁজিপতি বা মজুরিদাস যাই হোক না কেন, তাকে, তার সন্তানকে ও তার সন্তানের সন্তানকে সবসময় কমবেশি বিভিন্ন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার হতে হয়। আইডেন্টিটি পলিটিক্সের খপ্পরে পড়ে তখন শ্রম ও পুঁজির বৃহত্তর দ্বন্দ্বটিকে নিছক শাদা ও কালো মানুষের বিরোধ মনে হয়। অথবা ধর্মে ধর্মে, জাতিতে জাতিতে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে, নারী-পুরুষে ইত্যাদি বিভিন্ন পরিচয়ভিত্তিক দ্বন্দ্ব বলে প্রতীয়মান হয়। এই আইডেন্টিটি পলিটিক্সকে অবলম্বন করে লেখা হয় হান্টিংটনদের ‘সভ্যতার সংঘর্ষ’ বা এই জাতের অনেক ভুয়া গল্প যাতে সমাজের মৌলবিরোধকে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের, ইসলাম-খ্রিস্টধর্মের, সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বা তথাকথিত ‘সভ্যতা’র বিভ্রান্তিকর যুদ্ধের মোড়কে ভাসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়।

মুক্তির পথ

১৮৬৭ সালে লেখা চিরনূতন ‘পুঁজি’ গ্রন্থে কার্ল মার্ক্সের কথা, “যুক্তরাষ্ট্রীয় উত্তর আমেরিকায় শ্রমিকদের প্রত্যেক স্বাধীন আন্দোলন নিস্তেজ হয়ে গেছে যতদিন দাসত্বপ্রথা প্রজাতন্ত্রটির একাংশ বিকৃত করে রেখেছে। কালো যেখানে বিশেষভাবে দাগাঙ্কিত, কেবল শাদা চামড়ায় আবৃত শ্রম নিজের মুক্তি আনতে পারবে না। তবে দাসত্বপ্রথার মৃত্যু থেকে এক নতুন জীবন শুরু হয়েছে।” ১০

প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের ‘মুক্তির সনদ’ ঘোষণা ও গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৮৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দাসত্বপ্রথা বিলুপ্ত হয়, মার্ক্স ও এঙ্গেলসকে যা ব্যাপকভাবে আশান্বিত করে। মার্ক্স ঐ বছর ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিং মেন’স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হওয়ায় লিঙ্কনকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানিয়ে একটা চিঠি লেখেন। কিন্তু পরবর্তীতে ক্ষমতাবানদের হস্তক্ষেপে যুক্তরাষ্ট্রে দাসমুক্তির সে বৈপ্লবিক ধারায় ছেদ পড়ে, চমস্কির পূর্বে উল্লিখিত বক্তব্য থেকে যা স্পষ্ট। ফলশ্রুতিতে কালো মানুষের সার্বিক মুক্তি সম্পন্ন হয় না। আজও হয়নি। দাসত্ব তার বিমানবিকীকরণের সকল উপকরণ নিয়ে এখনও শাদা আর কালো সকলকে একই শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রেখেছে। এমনকি একসময় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি বারাক ওবামা সারা জীবন শাদা মানুষের স্বার্থ রক্ষা করেও কালোদের প্রতি বৈষম্যের হাত থেকে সবসময় রক্ষা পাননি। তারই কথা মতো, তিনিও হতে পারতেন ট্রেভন মার্টিন।

আজ কালো মানুষের এই আন্দোলন কেবল গায়ের রঙে সীমাবদ্ধ নেই। এটি গায়ের রঙ নির্বিশেষে পিছিয়ে পড়া, সামাজিক বৈষম্যের শিকার, দরিদ্র-শ্রমজীবী ও ইতিহাস-সচেতন সব মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। এ আন্দোলন সঠিকভাবেই জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা, বাসস্থান, কর্মসংস্থান, ন্যায্য মজুরি, শিক্ষা ইত্যাদি সার্বজনীন দাবিসমূহকে সামনে নিয়ে এসেছে। আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীগণ এটা বুঝতে ভুল করেননি যে, কালো মানুষের মুক্তি নিহিত আছে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তিতে। যেরকম একইভাবে শ্রমের মুক্তিও কালো মানুষের, নারীর, প্যালেস্টাইনবাসীর এবং সকল অধিকৃত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মুক্তির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

আজ কালো মানুষের এই আন্দোলন কেবল গায়ের রঙে সীমাবদ্ধ নেই। এটি গায়ের রঙ নির্বিশেষে পিছিয়ে পড়া, সামাজিক বৈষম্যের শিকার, দরিদ্র-শ্রমজীবী ও ইতিহাস-সচেতন সব মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।

১৯০১ সালের ৪ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বক্তৃতায় সোশালিস্ট পার্টি অব আমেরিকার পক্ষ থেকে পাঁচবার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী সমাজতান্ত্রিক শ্রমিকনেতা ইউজিন ডেবস বলেছিলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা সকল মানুষ সমান ঘোষণার মধ্যে আসলে কেবল নিজেদেরকেই মানুষ হিসেবে বুঝিয়েছেন। তারা নিগ্রোদেরকে অন্তর্ভুক্ত করেননি, যাদেরকে এখানে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এনে চরম দাসত্বের মাঝে নিক্ষেপ করা হয়েছে। বংশপরম্পরায় দাসত্ব ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে তাদের মালিকানা লাভ ততদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।” তিনি আরও বলেন, “তুমি, তোমার সন্তান ও তোমার সন্তানের সন্তানেরা- যদি পুঁজিবাদ তাদের জন্ম পর্যন্ত টিকে থাকে- দাসজীবন যাপনের দন্ডে দন্ডিত এবং কোনো আশা নেই যদি পুঁজিবাদকে ছুঁড়ে ফেলে সমাজতন্ত্র বেছে নেয়া না হয়।”১১ 

এবার বার্নি স্যান্ডার্সের নির্বাচনী ইশতেহারে দেশটিতে বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক জাতিবিদ্বেষ নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিলো। বলা হয়েছিলো, “কাঠামোবদ্ধ জাতিবিদ্বেষকে জরুরি মোকাবিলা করার এখনই সময়।”১২

জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুতে স্যান্ডার্স তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ চায় এমন এক জাতি যে প্রত্যেক ব্যক্তির মানব-মর্যাদাকে সমুন্নত রাখবে, “যা শুরু হবে জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার বিচারের মধ্য দিয়ে।”১৩  

বিশ্বের প্রত্যেক দেশের জনগণ নিজ নিজ দেশের বেলায়ও এই সামান্য দাবিই করে। অথচ তা অর্জন করা কত কঠিন।  

আলমাগীর খান: নির্বাহী সম্পাদক, শিক্ষালোক

ইমেইল: alamgirhkhan@gmail.com

তথ্যসূত্র:

১।  https://www.nobelprize.org/prizes/peace/1964/king/26142-martin-luther-king-jr-acceptance-speech-1964/

২।  https://www.youtube.com/watch?v=l_oy-9-ELtM

৩।  Daniel Lopez I Babs Rapeport, Aboriginal Deaths in Police Custody Are Fueling an Australian Black Lives Matter Movement, জ্যাকোবিন, ২৭ জুন ২০২০ 

৪।  Howard W. French, The World: The Atlantic Slave Trade; On Both Sides, Reason for Remorse, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ৫ এপ্রিল ১৯৯৮

৫।  https://global.ilmanifesto.it/noam-chomsky-theyre-protesting-400-years-of-brutal-repression/

৬।  https://berniesanders.com/issues/racial-justice/

৭।  https://www.youtube.com/watch?v=8daRHmALdWc

৮।  অমর্ত্য সেন,, Identity and Violence: The Illusion of Destiny, পেঙ্গুইন বুকস ইন্ডিয়া, ২০০৭

৯।  Samuel P. Huntington, The Clash of Civilizations, Simon & Schuster, 1996, নিউ ইয়র্ক

১০।  Karl Marx, Capital, vol. I, পৃ. ৩০১, প্রোগ্রেস পাবলিশার্স, মস্কো, ১৯৬৫           

১১।  Eugene Debs, Independence Day Address, জ্যাকোবিন, ৪ জুলাই ২০২০

১২।  https://berniesanders.com/issues/racial-justice/

১৩।  David Sharp, Sen. Bernie Sanders decries ‘police murder,’ demands justice, ওয়াশিংটন টাইমস, ৩১ মে ২০২০

Social Share
  •  
  •  
  • 225
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *