মতামত/বিতর্ক
হোটেল রেস্টুরেন্ট শ্রমিকদের জীবন ও আন্দোলন
প্রকাশ দত্ত

শ্রমিক আন্দোলন এখন মূলত হিমাগারে। শ্রমিক নেতাদের একটা বড় অংশ ব্যস্ত বিলস্ এবং আইএলওর বিভিন্ন প্রজেক্ট ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে। যে কারণে শ্রমিকের স্বার্থ নিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে দেখা যায় না এখন অধিকাংশ শ্রমিক নেতাকে। শ্রমিক অঙ্গনে আজ শ্রমিক নেতাদের পদচারণ নেই বললেই চলে। এর বিপরীতে বিলস্ এবং আইএলও অফিস মুখরিত থাকে নেতাদের কোলাহলে। সরকার যখন হায়েনার মত হিংস্র মূর্তি নিয়ে সকল গণতান্ত্রিক অধিকার ও আন্দোলনকে পদদলিত করে চলেছে, নেতারা তখন আন্দোলন নয়, আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের বাণী শোনাচ্ছে, যা সামাজিক সংলাপ (Social Dialogue) নামে পরিচিত। নেতাদের মুখে আজ যে সমস্ত কথা শোনা যাচ্ছে তা বলার কাজ করাচ্ছে লগ্নিপুঁজি। পুঁজির প্রয়োজনে আজ শ্রমিক অঙ্গনে মালিক-শ্রমিক সমঝোতার আওয়াজ তোলা হচ্ছে। আর ট্রেড ইউনিয়নের বিকল্প হিসাবে সামনে আনা হচ্ছে পার্টিসিপেটরি কমিটিকে।
শ্রমিক আন্দোলনের এই ক্রান্তিলগ্নে বাতিঘরের মত জ্বলছে বাংলাদেশ হোটেল রেস্টুরেন্ট সুইটমিট শ্রমিক ফেডারেশন ও বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন। হোটেল সেক্টরে ফেডারেশনভুক্ত ক্রিয়াশীল বাংলাদেশ হোটেল রেস্টুরেন্ট মিষ্টি বেকারি শ্রমিক ইউনিয়নের ধারাবাহিক লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধা আদায় করতে পারলেও শ্রম আইন অনুযায়ী ৮ ঘণ্টা শ্রমদিবসের দাবি এখনও এই শিল্পে বাস্তবায়িত হয়নি। সর্বোপরি এখানে শ্রম আইন কার্যকর নেই বললেই চলে। এই শিল্পের শ্রমিকরা হচ্ছেন মালিকের হাতের পুতুল। শ্রমিকের চাকরি মালিকের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। আর আইন হচ্ছে মালিকের মুখের কথা। যে কারণে এই শিল্পের শ্রমিকরা আজও পায়নি নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, সার্ভিস বুক। দীর্ঘদিন চাকরি করার পর বাড়ি ফিরতে হয় শুধুমাত্র বেতনের টাকা নিয়ে। জাতীয় পত্রপত্রিকায় অন্যান্য শিল্পের শ্রমিকদের জীবন নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও হোটেল শ্রমিকদের জীবনচিত্র নিয়ে বিস্তারিত লেখালেখি নেই বললেই চলে। হোটেল শিল্প আর হোটেল ব্যবসা শ্রমিকের শ্রম-ঘামে দিন দিন বিকাশ ঘটছে। কিন্তু বাড়ছে না এই শিল্পের শ্রমিকের জীবনমান। নামি-দামি হোটেলের শানশওকত আর জৌলুসের নিচে চাপা পড়ে আছে শ্রমিকজীবনের করুণ কাহিনি। যেমন-ঢাকা শহরের নামকরা হোটেলের তালিকায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে স্টার হোটেল কাবাব অ্যান্ড বেকারি। কিন্তু এই হোটেলের শ্রমিকদের জীবনের চিত্র যেমন নিষ্ঠুর, তেমনি করুণ। সভ্যতার এই সময়েও এই শিল্পের শ্রমিকদের শ্রম সময় ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা।
এই শিল্পের শ্রমিকরা হচ্ছেন মালিকের হাতের পুতুল। শ্রমিকের চাকরি মালিকের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। আর আইন হচ্ছে মালিকের মুখের কথা। যে কারণে এই শিল্পের শ্রমিকরা আজও পায়নি নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, সার্ভিস বুক।
স্টার কোম্পানির জন্মলগ্ন থেকে শ্রমিকরা কখনও বোনাস পায়নি। অতিরিক্ত কাজের দ্বিগুণ মজুরিও কখনও দেয়া হয়নি। একটি হোটেল থেকে যাত্রা শুরু করে আজ ১৯টি প্রতিষ্ঠান স্টার কোম্পানির। স্টার হোটেলের নামের সাথে শ্রম দফতর, কল-কারখানা পরিদর্শক সকলেই পরিচিত। কিন্তু তাদের কাছে অপরিচিত হচ্ছে এই শিল্পের শ্রমিক। ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করতে গিয়ে কত শ্রমিক অকালে কর্মক্ষমতা হারিয়েছে তার হিসাব নেই। অতিরিক্ত পরিশ্রমে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে কত শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেছে তার খবর কে রাখে? শ্রম শোষণের এই কয়েদখানায় দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিকদের মধ্যে ধূমায়িত হচ্ছিল তীব্র ক্ষোভ। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটল ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে। শ্রমিকরা যোগাযোগ করল সংগঠনের সাথে। সংগঠনের কথামত শ্রমিকরা মালিককে শ্রম আইন বাস্তবায়ন করার জন্য আহ্বান জানাল। তাদের প্রথম দাবি ছিল ৮ ঘণ্টা শ্রম সময় বাস্তবায়ন, অতিরিক্ত কাজের দ্বিগুণ মজুরি ও দুইটি উৎসব ভাতা, নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, সার্ভিস বুক প্রদান। এই দাবিতে শ্রমিকদের বড় একটা অংশ যোগ দিল আর একটা অংশ সমর্থন দিল। এর পর থেকেই মালিকরা তাদের স্বভাবসুলভ চরিত্রানুযায়ী দাবি বাস্তবায়ন না করে দাবি দমন করতে নানামুখী অপতৎপরতায় লিপ্ত হল। প্রথমে শ্রমিকদের জানানো হল, সরকারের উপরের লেভেলে তাদের নিজস্ব লোক আছে। তাদের আশ্রিত শ্রমিক নেতা আছে, পুলিশ আছে, সর্বোপরি আছে সন্ত্রাসী বাহিনী। সকল চেষ্টাই করা হল, কিন্তু ব্যর্থ হল শ্রমিকদের একতার কাছে। একপর্যায়ে শ্রমিক প্রতিনিধিদের সাথে মৌখিক চুক্তি করল-ডিউটি হবে ৮ ঘণ্টা, বেতন বৃদ্ধি হবে। বছরে দুটি উৎসব ভাতা প্রদান করা হবে। পর্যায়ক্রমে নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, সার্ভিস বুক প্রদান করা হবে। যে শ্রমিক মালিক আর ম্যানেজারের সামনে দাঁড়াত নতজানু হয়ে, আজ সেই শ্রমিক মাথা উঁচু করে দাঁড়াল অধিকারের প্রশ্নে। এই চুক্তি আংশিক বাস্তবায়িত হওয়ায় শ্রমিকরা আরও বেশি করে বুঝল সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা। শ্রমিকরা সহজে বুঝল, মালিকের মুনাফা লুকিয়ে থাকে শ্রমিকের শ্রমের মূল্য না দেয়ার মধ্যে।
১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করতে গিয়ে কত শ্রমিক অকালে কর্মক্ষমতা হারিয়েছে তার হিসাব নেই। অতিরিক্ত পরিশ্রমে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে কত শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেছে তার খবর কে রাখে? শ্রম শোষণের এই কয়েদখানায় দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিকদের মধ্যে ধূমায়িত হচ্ছিল তীব্র ক্ষোভ। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটল ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে।
এবার মালিক-ম্যানেজাররা ধরল ভিন্ন পথ। শ্রমিকদের মধ্যে বিভক্তি তৈরির অপচেষ্টা নিল। বাবুর্চিসহ একটি অংশ, যাদেরকে প্রতি মাসে বেতন ছাড়াও অতিরিক্ত টাকা দেয়া হয়, তাদেরকে ব্যবহার করার অপকৌশল নিল। শ্রমিকরা সহজেই বুঝতে পারল মালিকদের এই অপকৌশল। এমনই নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছে স্টার হোটেল মালিক কর্তৃপক্ষ। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এখনও দেয়া হয়নি নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, সার্ভিস বুক। তবে মালিকরা এ পর্যায়ে খুঁজে বের করেছে তাদের আশ্রিত একটি সংগঠনকে, যাদের ডেকে এনে শ্রমিকদের ওই সংগঠনের সদস্য হওয়ার জন্য নানা অপচেষ্টা চালাচ্ছে। শুধু তাই নয়, সংগঠনের কার্ড করার জন্য শ্রমিকদেরকে টাকার প্রলোভন দেখাচ্ছে। একই সাথে শ্রমিক সংগঠনের কার্ড করার টাকা মালিকের পক্ষ থেকে পরিশোধ করার কথা জানানো হচ্ছে। ইতিমধ্যেই শ্রমিকরা সংগ্রাম করতে গিয়ে চিনেছে নিজের শক্তিকে আর চিনেছে তাদের স্বার্থের সংগঠনকে। লড়াই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কষ্টিপাথর, যার মধ্য দিয়ে চেনা যায় কে আপন আর কে পর। আজ শ্রমিকদের অধিকার ও দাবি আদায়ের ঠিকানা হচ্ছে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে পরীক্ষিত ‘বাংলাদেশ হোটেল রেস্টুরেন্ট মিষ্টি বেকারি শ্রমিক ইউনিয়ন’। এই সংগঠনের জন্মলগ্ন থেকেই মালিকরা সংগঠনটিকে ধ্বংস করতে নানা অপতৎরতা চালিয়েছে। এবার স্টার হোটেলের মালিকও সেই অপচেষ্টা করছে আর সকল মালিক তার সাথে থেকে ইন্ধন জোগাচ্ছে। মালিকরা জানে আঘাত করে সংগঠন ও আন্দোলনকে নস্যাৎ করা যাবে না, যে কারণে শুরু থেকেই ছলচাতুরীর পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছে আর চেষ্টা করছে শ্রমিকদের ঐক্যে ভাঙন ধরাতে।
স্টার হোটেলে অনেক শ্রমিক আছে, যাদের চাকরির বয়স ১৫ বছরের বেশি। এখন পরিচয়পত্র, নিয়োগপত্র দিলে বিদায়কালে একটা বড় অঙ্কের পাওনা দিতে হবে। যে কারণে মালিকরা নানান টালবাহানা করছে নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র দেয়া নিয়ে। আজ তাই স্টার হোটেলের মালিক-ম্যানেজারদের লক্ষ্য হচ্ছে পোষ্য সংগঠন দিয়ে শ্রমিকদের কার্ড করানো এবং তাদের ইচ্ছামত তারিখ দিয়ে নিয়োগপত্র-পরিচয়পত্র প্রদান। এই শিল্পের শ্রমিকরা বেতন-বোনাসের জন্য মালিকদের কাছে দাবি করায় শ্রমিকের চাকরি গেছে, মিথ্যা মামলা হচ্ছে, মাস্তান দিয়ে শারীরিক নির্যাতনের হুমকি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু শ্রম আইন ভঙ্গ করার দায়ে একজন মালিককেও আইনের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়নি। এই জন্য এ শিল্পের শ্রমিকদের মধ্যে আইনের আশ্রয় নেয়ার ব্যাপারে অনীহা আছে। আর শ্রমিকের জীবনের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, প্রচলিত ব্যবস্থায় আইন মালিকের পক্ষে থাকে। সরকার যে নামেই আসুক তাতে মালিকদের কোন সমস্যা হয় না। হোটেল শ্রমিকরা আজ যতটুকু সুযোগ-সুবিধা পায় তা সংগ্রামের ফসল।
এই শিল্পের শ্রমিকরা বেতন-বোনাসের জন্য মালিকদের কাছে দাবি করায় শ্রমিকের চাকরি গেছে, মিথ্যা মামলা হচ্ছে, মাস্তান দিয়ে শারীরিক নির্যাতনের হুমকি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু শ্রম আইন ভঙ্গ করার দায়ে একজন মালিককেও আইনের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়নি।
শোষণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেণি জন্মের পর থেকে তুলে ধরেছে লড়াইয়ের পতাকা আর শোষণমুক্ত সমাজের দাবি। আর এই সত্য ভোলাতে সব সময় সর্বত্র বাজানো হচ্ছে মালিক-শ্রমিক ঐক্যের গান। পুঁজির চাওয়া হচ্ছে দাসত্বের শৃঙ্খলে শ্রমিককে বেঁধে রাখা আর বিদ্রোহ করলে অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়ে স্তব্ধ করা। স্টার হোটেলের মালিকও আজ পথ খুঁজছে কিভাবে মোকাবিলা করবে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার। তারই সর্বশেষ রূপ হচ্ছে স্টার হোটেলের মালিক এলিফ্যান্ট রোড শাখায় টু-লেট টাঙিয়ে দিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে চাকরি হারানোর ভীতি সৃষ্টি, বিভিন্ন অজুহাতে শ্রমিকদের ডিউটি বন্ধ করা, অসদাচরণের ধারাকে কাজে লাগিয়ে চাকরিচ্যুত করা। এই ক্ষেত্রে প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে অগ্রণী নেতা-কর্মীদের চাকরিচ্যুত করা। মালিকের এই সকল অপতৎপরতা শ্রমিকদের বাধ্য করছে লড়াইয়ের পথে নামতে। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটল ১৩ মার্চ ২০২০ জনসন রোড শাখায় সকাল ছয়টা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত কর্মবিরতি পালনের মাধ্যমে। শ্রমিক শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষালয় ট্রেড ইউনিয়ন থেকে শ্রমিকরাও শিক্ষা গ্রহণ করছে। পুঁজির গর্ভে সৃষ্ট আধুনিক শ্রেণি হিসেবে শ্রমিক শ্রেণির চলার পথে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, সাময়িক পরাজয় থাকলেও শেষ বিচারে শ্রমিক শ্রেণিই বিজয় অর্জন করে। স্টার হোটেলের শ্রমিকদের একতাই পারবে মালিককে সমুচিত জবাব দিতে। তার জন্য দরকার সংগঠনের শক্তি বাড়ানো, সচেতনভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা। স্টার হোটেলের শ্রমিকদের লড়াই শুধু তাদের একার লড়াই নয়, এই লড়াই হোটেলশিল্পের সকল শ্রমিকের লড়াই। শেষ বিচারে যা শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি অর্জনেরই লড়াই।
প্রকাশ দত্ত: বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের যুগ্ম সম্পাদক।
122