চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা ও তার বিরোধ
মো. সাদ্দাম হোসেন ও মেহেদী হাসান শোভন
বিশ্ব একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রযুক্তিগত বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে, যা অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতি- সর্বোপরি মানুষের জীবনযাত্রায় একটি মৌলিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। এই বিপ্লব কিভাবে সংগঠিত হবে তা আমরা এখনও নিশ্চিতভাবে জানি না, তবে একটি বিষয় স্পষ্ট যে এর মধ্যে একটি সামগ্রিক রূপান্তর সাধিত হবে। এই রূপান্তর আমাদের জাতীয় জীবনের জন্য ঝুঁকি নাকি সম্ভাবনা তৈরি করবে, তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে আমরা এই পরিবর্তনকে কিভাবে গ্রহণ করব তার ওপর। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সকল ঝুঁকিকে সম্ভাবনায় রূপান্তরের জন্য দরকার বিস্তর আলোচনা, সচেতনতা এবং সামগ্রিক পরিকল্পনা যা টেকসই উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে, বৈষম্য দূর করবে, দক্ষ জনশক্তি তৈরি করবে এবং মানুষের জীবনমান উন্নত করবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে কোন্ প্রযুক্তিগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে, তাদের সম্ভাবনা ও বিশ্বায়নের এই সময়ে তার সম্ভাব্য বিরোধ নিয়ে এই প্রবন্ধে পর্যালোচনা করা হয়েছে।
সূচনা
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মূলত প্রযুক্তির বিপ্লব, যা পৃথিবীর মানুষকে একলাফেই ১০০ বছর সামনে নিয়ে যাবে। বলা হচ্ছে, এই পরিবর্তন সব মানুষের জীবনমান উন্নত করবে, আয় বাড়াবে সব শ্রেণির মানুষের। প্রযুক্তির উৎকর্ষ কাজে লাগিয়ে পরিবর্তিত-পরিবর্ধিত হবে শিল্প অর্থনীতির সকল ক্ষেত্র। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব পৃথিবীকে আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বগ্রামে পরিণত করবে। যোগাযোগব্যবস্থা হবে অভাবনীয় উন্নত, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হবে পাড়ার দোকানে কেনাবেচার মতই সহজ। এই ডিজিটাল বিপ্লব সম্পর্কে জানার পূর্বে তার আগের তিনটি শিল্প বিপ্লব সম্পর্কে কিছু ধারণা নেয়া আবশ্যক।
প্রথম শিল্প বিপ্লব : ১৭৬৩-১৭৭৫ সময়কালে জেমস ওয়াটের বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের ফলে প্রভূত অগ্রগতি অর্জিত হলে ক্রমে বাষ্পীয় ইঞ্জিন কারখানার মেশিনের চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। মার্ক্সের মতে, প্রথম শিল্প বিপ্লবের মোদ্দাকথা ছিল চালিকাশক্তি হিসেবে ‘যান্ত্রিক (মেশিন) শক্তি’ দ্বারা মানুষের ‘কায়িক শক্তির’ প্রতিস্থাপন। বাষ্পীয় ইঞ্জিন ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এই প্রতিস্থাপন পূর্ণ হয়। একলাফে এই শিল্প বিপ্লব অর্থনীতি ও সমাজকে বদলে দেয় না, তবে তা ধীরে ধীরে গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসে। দ্রুত বাষ্পীয় ইঞ্জিন ভিত্তিক রেলপথ ও জাহাজের আবির্ভাব ঘটে এবং তার ফলে বিশ্ব ছোট হয়ে আসে।
দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব : পুঁজিবাদের অধীনে প্রযুক্তির বিকাশ প্রথম শিল্প বিপ্লবে থেমে থাকে না। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি প্রথম বিপ্লবের প্রযুক্তিগত সাফল্যসমূহের প্রয়োগ পূর্ণতা অর্জন করে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে সূচিত হয় দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব (১৮৭০-১৯১৪)। এই বিপ্লবের মূল আবিষ্কার ছিল বিদ্যুৎ। বৈদ্যুতিক বাতিই ছিল বিদ্যুতের প্রথম সফল বাণিজ্যিক ব্যবহার। ক্রমে বিদ্যুৎ চালিকাশক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয় এবং শিল্পের সাধারণ চালিকাশক্তি হিসাবে বাষ্পীয় ইঞ্জিনকে প্রতিস্থাপিত করে। দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব নতুন আরও কিছু প্রযুক্তির অংশ ছিল, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল রাসায়নিক শিল্পের উদ্ভব এবং প্লাস্টিক, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ইত্যাদি উৎপাদনের সূচনা ও প্রসার। দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের ফলে শ্রমিককে যন্ত্রের কাছে নেয়ার পরিবর্তে যন্ত্রকে শ্রমিকের কাছে নেয়া বেশি উপযোগী হয়। ফলে শ্রমিককে স্থান পরিবর্তন করতে হয় না।
তৃতীয় শিল্প বিপ্লব : তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সময়কাল ধরা হয় ১৯৬৯ সাল থেকে, এই বিপ্লবের সাথে জড়িত মূল প্রযুক্তি হল কম্পিউটার। অন্যদিকে কম্পিউটারের ভিত্তি হল তথ্যের ডিজিটালাইজেশন, অর্থাৎ সব কিছুকে ০/১ এর সমাহারে পরিণত করা। সে জন্য কম্পিউটারভিত্তিক শিল্প বিপ্লবকে অনেক সময় ‘ডিজিটাল বিপ্লব’ বলে অভিহিত করা হয়। আরেকটি যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে সেটা হল ইন্টারনেটের উদ্ভব। ইন্টারনেট হল এক কম্পিউটারের সাথে আরেক কম্পিউটারের সংযুক্তি। এই সংযুক্তির ফলে একজন কম্পিউটার ব্যবহারকারী আরেক কম্পিউটার ব্যবহারকারীর সাথে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করতে পারে এবং এই সংযোগের মাধ্যমে তথ্য বিনিময় করতে পারে। প্রথম দিকে ইন্টারনেট ই-মেইল আদান-প্রদানের জন্য ব্যবহৃত হলেও এখন তা সর্বমুখী আদান-প্রদানের মাধ্যম হিসাবে কাজ করছে। তৃতীয় যে প্রযুক্তির উদ্ভব হয়েছে তা হল মোবাইল ফোন। মোবাইল ফোন উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি প্রযুক্তিগত উল্লম্ফনের উদাহরণ। উন্নত দেশের জনগণ প্রথমে তারযুক্ত ফোন ব্যবহার করেছে এবং তারপর বেতার ফোনের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। বিপরীতে উন্নয়নশীল দেশে বেশির ভাগ মানুষ সরাসরি মোবাইল ফোনের জগতে প্রবেশ করেছে। এরপর মোবাইল ফোনের সাথে ইন্টারনেটের যোগ হয়েছে, এটা সম্ভব হয়েছে স্মার্ট মোবাইল ফোনের আবির্ভাবের ফলে, যা বলা যেতে পারে একটি ছোটখাট কম্পিউটার। স্মার্টফোন দিয়েই এখন ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত হওয়া যায় এবং কম্পিউটারের মাধ্যমে যে সকল কাজ করা যেত তার সবই এখন ফোন দিয়ে করা যায়। (ইসলাম, ২০১৯)
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব : তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের ঠিক ৫০ বছর পরই শোনা যাচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের গান। ক্লাউস সোয়াব ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডাব্লিউইএফ) প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী প্রধান ২০১৬ সালে সর্বপ্রথম চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কথাটি ব্যবহার করেন তাঁর ‘দ্য ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন’ নামক বইয়ে। ক্লাউস সোয়াব চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে নিজের লেখা প্রবন্ধে বলেছেন, “আমরা চাই বা না চাই, এত দিন পর্যন্ত আমাদের জীবনধারা, কাজকর্ম, চিন্তাচেতনা যেভাবে চলেছে, সেটা বদলে যেতে শুরু করেছে। এখন আমরা এক প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।” (সোয়াব, ২০১৭) আগেকার বিপ্লবগুলোর মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল কৃষি, প্রাণিশক্তি, রাজনৈতিক শক্তি, ভৌগোলিক পরিবর্তন ইত্যাদি। কিন্তু চতুর্থ শিল্প বিপ্লব অনেকাংশেই ভিন্ন। অন্যান্য শিল্প বিপ্লবের সাথে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রধান পার্থক্য হচ্ছে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্প বিপ্লব শুধুমাত্র মানুষের শারীরিক পরিশ্রমকে প্রতিস্থাপন করেছে; কিন্তু চতুর্থ শিল্প বিপ্লব শুধুমাত্র শারীরিক নয়, মানসিক পরিশ্রমকে প্রতিস্থাপন করবে।
অন্যান্য শিল্প বিপ্লবের সাথে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রধান পার্থক্য হচ্ছে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্প বিপ্লব শুধুমাত্র মানুষের শারীরিক পরিশ্রমকে প্রতিস্থাপন করেছে; কিন্তু চতুর্থ শিল্প বিপ্লব শুধুমাত্র শারীরিক নয়, মানসিক পরিশ্রমকে প্রতিস্থাপন করবে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মূল প্রভাবক
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সামগ্রিক প্রভাব আমাদের জীবনে কতটা বিস্তৃত এবং গভীর হতে যাচ্ছে তা আমরা খুব সহজেই অনুধাবন করতে পারি যদি এর উদ্ভাবনগুলোর দিকে লক্ষ করি। যেমন-
রোবট : ইতিমধ্যেই রোবটিকস দূর নিরাপত্তা, কারখানার বিপজ্জনক কাজ, স্থাপনার শ্রমিক, কিংবা স্রেফ নিরাপত্তা প্রহরী বা গৃহস্থালি কাজ করতে সক্ষম। রোবটিকস অটোমেশন বলতে বোঝায় কারখানার সবগুলো মেশিন এমন একটি সিস্টেমের সাথে যুক্ত থাকবে, যেটি স্বয়ংক্রিয় চালনা থেকে শুরু করে পুরো উৎপাদনপ্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান করবে। এতে বাঁচবে শ্রম খরচ, কমবে মানবিক ত্রুটি।
রোবটের বৈশিষ্ট্য : ১। রোবট সফটওয়্যার নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় সুনির্দিষ্ট কোন কাজ দ্রুত ও নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করতে পারে। ২। পূর্ব থেকে দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী রোবট কাজ করে। ৩। রোবট অবিরাম কাজ করতে পারে। ৪। রোবট যে কোন ঝুঁকিপূর্ণ বা অস্বাস্থ্যকর স্থানে কাজ করতে পারে। ৫। এটি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরতে বা স্থানান্তরিত হতে পারে। ৬। দূর থেকে লেজার রশ্মি বা রেডিও সিগন্যালের সাহায্যে রোবট নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
রোবটের উল্লেখযোগ্য ব্যবহারগুলো : ১। রোবটকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয় কম্পিউটার-এইডেড ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে, বিশেষ করে যানবাহন ও গাড়ি তৈরির কারখানায়। ২। স্বাভাবিকভাবে মানুষের জন্য বিপজ্জনক, যেমন- বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয়করণ, ডুবে যাওয়া জাহাজের অনুসন্ধান, খনি অভ্যন্তরের কাজ ইত্যাদি কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের বা বিপজ্জনক ও জটিল কাজগুলো রোবটের সাহায্যে করা যায়। ৩। কারখানায় কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত রোবটের সাহায্যে নানা রকম বিপজ্জনক ও পরিশ্রমসাধ্য কাজ করা হয়। যেমন- ওয়েল্ডিং, ঢালাই, ভারী মাল উঠানো বা নামানো, যন্ত্রাংশ সংযোজন করা ইত্যাদি। ৪। চিকিৎসাক্ষেত্রে রোবট সার্জনদের জটিল অপারেশনে ও নানা ধরনের কাজে সহায়তা করে থাকে। ৫। মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে রোবটের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। মহাকাশ অভিযানে এখন মানুষের পরিবর্তে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সংবলিত রোবট ব্যবহৃত হচ্ছে। (ফোর্ড, ২০১৬)
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা : আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে মেশিন ইন্টেলিজেন্সও বলা হয়। কম্পিটার সাইন্সের উৎকৃষ্টতম উদাহরণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রধানত যে চারটি কাজ করে তা হল- কথা শুনে চিনতে পারা, নতুন জিনিস শেখা, পরিকল্পনা করা এবং সমস্যার সমাধান করা। মূলত এইসব সুবিধাই যখন বিভিন্ন বস্তুতে যোগ করা হয় তখনই সেটা হয় ইন্টারনেট অব থিংস। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার ইতিমধ্যে সকল স্মার্টফোনেই প্রায় ব্যবহৃত হচ্ছে, যেমন- ভাল সেলফি তুলতে, গ্রাহকের অভ্যাস এবং প্রয়োজনীয়তা মনে রেখে কাস্টমাইজ সেবা দিতে। ধারণা করা হচ্ছে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের বিকল্প হিসাবে কাজ করবে। যার মানে স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে ফসল উৎপাদন, পণ্য উৎপাদন এবং ট্রান্সপোর্টেশনে আমূল পরিবর্তন চলে আসবে। মানুষের হাত ছাড়াই নিয়ন্ত্রিত হবে এসব খাত। (রহমান, ২০১৭)
চিকিৎসাবিজ্ঞানে উৎকর্ষ : সুস্থতায় বংশগত রোগ কমাতে আসবে নীরোগ জিন, কঠিন অসুখের প্রতিষেধক। আর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অস্ত্রোপচার করতে ছুরি-কাঁচি ছাড়া কম্পিউটারের দক্ষ হাতের বহুল ব্যবহার শুরু হবে এই বিপ্লবে। মানুষ হয়ত অমর হবে না, কিন্তু পৌঁছে যাবে অমরত্বের কাছাকাছি!
ড্রোন : ড্রোন হচ্ছে এক বিশেষ ধরনের মানবহীন পাখিসদৃশ যন্ত্রবিশেষ (আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকল), যাকে সংক্ষেপে ইউএভি বলা হয়। হেলিকপ্টার বা এজাতীয় অন্যান্য গগনচারী যানের সঙ্গে ড্রোনের মূল পার্থক্য হচ্ছে, হেলিকপ্টার বা এজাতীয় কোন যান চালানোর জন্য এক বা একাধিক মানুষের প্রয়োজন হলেও ড্রোন চালানোর জন্য কোন মানুষের দরকার হয় না। দূর থেকেই তারহীন নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার মাধ্যমে অথবা আগে থেকে নির্ধারিত প্রোগ্রামিং দ্বারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ড্রোন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বর্তমানে গুগল, অ্যামাজনের মত বড় বড় কোম্পানি পণ্য পরিবহন, যোগাযোগ রক্ষা, তথ্য পরিবহনসহ নানা কাজে সার্থকতার সঙ্গে ড্রোন কাজে লাগাচ্ছে। ফেসবুক আজ ড্রোনের মাধ্যমে পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ‘ইন্টারনেট সেবা’ পৌঁছে দিচ্ছে। মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায়ও আজকাল ড্রোন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। (পাইক, ২০১৮)
কল্পবাস্তবতা বা ভার্চুয়াল রিয়ালিটি : প্রকৃত অর্থে বাস্তব নয় কিন্তু বাস্তবের চেতনার উদ্যোগকারী বিজ্ঞাননির্ভর কল্পনাকে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি বা অনুভবের বাস্তবতা কিংবা কল্পবাস্তবতা বলে। ভার্চুয়াল রিয়ালিটি হচ্ছে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত সিস্টেম, যাতে মডেলিং ও অনুকরণবিদ্যা প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষ কৃত্রিম ত্রিমাত্রিক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পরিবেশের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন বা উপলব্ধি করতে পারে।
প্রাত্যহিক জীবনে ভার্চুয়াল রিয়ালিটির ব্যবহার : ১. উন্নত বিশ্বে ডাক্তারদের আধুনিক মানের প্রশিক্ষণ প্রদানে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীরা কৌশলগত দক্ষতা, অপারেশন ও রোগ সম্পর্কিত তাত্ত্বিক বিষয়াদির কার্যপ্রণালী অনুশীলন করতে সক্ষম হন। ২. ভার্চুয়াল রিয়ালিটির মাধ্যমে ভার্চুয়ালি ড্রাইভিং ও ড্রাইভিংয়ের নানা নিয়ম-কানুন খুব সহজেই এর ফলে আয়ত্ত করা সম্ভব। ৩. উন্নত বিশ্বের বাণিজ্যিক বিমান সংস্থা কিংবা সামরিক বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে বিমান পরিচালনা প্রশিক্ষণে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি ব্যবহার করছে। ভার্চুয়াল রিয়ালিটি কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে ফ্লাইট সিমুলেশনের ক্ষেত্রে স্বল্প খরচে বিমানচালকের প্রশিক্ষণ প্রদান করা সম্ভব হয়। ৪. বিভিন্ন ধরনের সামরিক প্রশিক্ষণে ভার্চুয়াল রিয়ালিটিকে গুরুত্বের সাথে ব্যবহার করা হয়। ৫. ব্যবসা-বাণিজ্যে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি ব্যবহার করে তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও সহজ করা হয়েছে। ৬. সবাই জানে মহাশূন্য অভিযানের প্রতিটি পর্বেই রয়েছে নানা ধরনের ঝুঁকি, তাই প্রস্তুতিপর্বের নানা গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নভোচারীদের কার্যক্রম, নভোযান পরিচালনা সম্পর্কিত যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে প্রশিক্ষণে তাই ভার্চুয়াল রিয়ালিটি বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। (খানসামা, ২০১৮)
বর্ধিত বাস্তবতা বা অগমেন্টেড রিয়ালিটি : অগমেন্টেড রিয়ালিটি হলো এমন এক প্রযুক্তি, যাকে বাস্তব জগতের এক বর্ধিত সংস্করণ বলা যেতে পারে। আপনি বাস্তবে যা দেখবেন, তার ওপর কম্পিউটার নির্মিত একটি স্তর যুক্ত করে দেবে অগমেন্টেড রিয়ালিটি। অচেনা কোন এক স্থানে ঘুরতে গেলেন গাড়িতে করে। আপনি ড্রাইভ করার সময় চোখের ইশারাতেই আপনার সামনে ভেসে উঠছে রাস্তা কিংবা আশপাশের বিভিন্ন তথ্য। কখনও কখনও আপনি চাইলেই ইশারায় শুনে নিতে পারছেন দরকারি বিভিন্ন নির্দেশনা, যেমন- আজকের দিনের সম্ভাব্য আবহাওয়ার তথ্য। রাস্তায় জ্যাম থাকলে আপনার সামনে চলে আসছে শর্টকাট পথের নেভিগেশন, যা আপনার জন্য নিরাপদ ও সময়সাশ্রয়ী। কিংবা যাবার পথে খাবার জন্য হোটেল খুঁজছেন? রাস্তা দিয়ে যাবার সময়ই আপনি আপনার স্মার্টফোনটি বিল্ডিংগুলোর দিকে তাক করাতেই সেগুলোর ট্যাগ আপনার ফোনে স্ক্রিনে উঠে বলে দিচ্ছে, কোন বিল্ডিংটি কিসের আর সেটির কোন বিখ্যাত ইতিহাস আছে কি না। সাথে সাথে আপনি জেনে নিতে পারছেন আশপাশে কোন হোটেল থাকলে। (আরাফাত, ২০১৭)
ত্রিমাত্রিক মুদ্রণ বা থ্রিডি প্রিন্টিং : এটি এমন একটি ডিভাইস, যা যে কোন বাস্তব বস্তুর ত্রিমাত্রিক অনুলিপি বা রেপ্লিকা তৈরি করতে সক্ষম। সাধারণ প্রিন্টার থেকে এর পার্থক্য হচ্ছে, সাধারণ প্রিন্টারে আপনি একটি ছবি তুলে সেটি একটি কাগজের টুডি সারফেসে প্রিন্ট করে আনতে পারবেন, কিন্তু থ্রিডি প্রিন্টার আপনাকে সেই ছবিটির বাস্তব রূপটিই বের করে দেবে! একটি সম্পূর্ণ থ্রিডি প্রিন্টাররের তিনটি অংশ রয়েছে- মেশিন প্রোপার, কম্পিউটার এবং ত্রিমাত্রিক ছবি তোলার জন্য একটি ক্যামেরা বা স্ক্যানার। যে বস্তুটিকে প্রিন্ট করা হবে, প্রথমে স্ক্যানারের সাহায্যে তার একটি ত্রিমাত্রিক ছবি তোলা হয়, বস্তুটির সব দিক ঘুরিয়ে সব খুঁটিনাটি অংশ ক্যামেরায় ধরা পড়ে। এবার এই ইমেজটিকে কম্পিউটারে প্রসেস করা হয়। কম্পিউটারে চাইলে ইচ্ছামত এডিটও করা যায়, যেমন- আকার পরিবর্তন, কোন অংশ বাদ দেয়া বা সংযোজন বা রঙ পরিবর্তন ইত্যাদি। এবার প্রসেসিং শেষে প্রিন্ট দিলেই মেশিন প্রোপারে রাখা ম্যাটেরিয়ালের সাহায্যে বস্তুটির একটি বাস্তব রেপ্লিকা তৈরি হয়ে যায়! অর্থাৎ যদি কোন মানুষের ত্রিমাত্রিক ছবি তোলা হয় তবে এই প্রিন্টার তার একটি ত্রিমাত্রিক কপি তৈরি করে দেবে কয়েক মিনিটের মধ্যেই! এই যন্ত্র দ্বারা কিডনি থেকে শুরু করে বন্দুক, গাড়ি, কৃত্রিম হাত-পা সংযোজন, শিল্পকর্মের প্রতিরূপ (রেপ্লিকা) তৈরির মতো কাজে থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তির ব্যবহারে আগামী কয়েক দশকে আমাদের জীবনযাত্রায় অভাবনীয় পরিবর্তন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। (ফয়সাল, ২০১৩)
ইন্টারনেট অব থিংস : ইন্টারনেট অব থিংসকে সংক্ষেপে আইওটি বলে, যার বাংলা অর্থ হল বিভিন্ন জিনিসের সাথে ইন্টারনেটের সংযোগ। আমাদের চারপাশের সকল বস্তু যখন নিজেদের মধ্যে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ করবে এবং নেটওয়ার্ক গড়ে তুলবে, সেটাই হবে ইন্টারনেট অব থিংস। ইতিমধ্যে আমরা গুগল হোম, অ্যামাজনের আলেক্সার কথা শুনেছি, যা আপনার ঘরের বাতি, সাউন্ড সিস্টেম, দরজাসহ অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে আপনার বাসার চুলাকে আপনি একবার শিখিয়ে দেবেন কখন কী খেতে পছন্দ করেন। ধরুন বৃষ্টির দিনে আপনি খিচুড়ি ভালোবাসেন, আপনার চুলা সেটা মনে রাখবে এবং বাইরে বৃষ্টি পড়লে সেদিন আপনার জন্য খিচুড়ি রান্না করে রাখবে। আপনি সকালে ডিম-রুটি খাবেন, সেটাও সে প্রতিদিন করে দেবে অথবা সপ্তাহের একেক দিন তাকে একেক রেসিপি রাঁধতে বলবেন, সে তাই করবে। বাড়ির দরজা দিয়ে যখন বেরিয়ে যাবেন আপনাকে দরজা লাগাতে হবে না, আপনি বাড়িতে নেই জেনে দরজাটি আর খুলবে না, আবার আপনি এসে যখন দরজার সামনে দাঁড়াবেন, আপনার চোখ, হাত, পা, শরীর দেখেই আপনাকে চিনে নিজে নিজেই খুলে যাবে। আপনার চোখের চশমা কিংবা কানের হেডফোনই আপনাকে রাস্তা দেখাবে আর সব তথ্য দিয়ে দেবে।
ব্লকচেইন প্রযুক্তি : ব্লকচেইন হচ্ছে তথ্য সংরক্ষণ করার একটি নিরাপদ ও উন্মুক্ত পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে তথ্য বিভিন্ন ব্লকে একটির পর একটি চেইন আকারে সংরক্ষণ করা হয়। এটি একটি অপরিবর্তনযোগ্য ডিজিটাল লেনদেন, যা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক লেনদেনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে কোন কার্য-পরিচালনা রেকর্ড করা যেতে পারে; যার ফলে বিশ্বজুড়ে এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ব্লকচেইন প্রযুক্তি। ব্লকচেইনকে আধুনিককালের এক অভিনব উদ্ভাবন বলা হচ্ছে। ‘সাতোশি নাকামতো’ ছদ্মনামের এক বা একাধিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এ প্রযুক্তির উদ্ভাবক। ২০০৯ সালে প্রথমবারের মত বিটকয়েন সফটওয়্যার প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে ব্লকচেইন প্রযুক্তির অনেক বিবর্তন ঘটে চলেছে। তথ্যকে ডিজিটালরূপে বণ্টন করে (অনুলিপি নয়) এই ব্লকচেইন প্রযুক্তি এক নতুন ধরনের ইন্টারনেট সৃষ্টি করেছে। কেবল ডিজিটাল মুদ্রা বিটকয়েনের জন্য ব্লকচেইনের উদ্ভাবন করা হলেও এখন প্রযুক্তির নানা ক্ষেত্রে এর সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। ব্লকচেইন প্রযুক্তি বিকেন্দ্রিত হওয়ায় অনেক অনুক্রমিক কাজ একসঙ্গে হয়ে যায়। যেমন- এ প্রযুক্তি ব্যবহারে শেয়ারবাজারের লেনদেন যুগপৎভাবে হতে পারে; কিংবা ভূমি নিবন্ধন রেকর্ডকে জনসাধারণের জন্য অনেক সহজলভ্য করা যেতে পারে। বাংলাদেশেরও ব্লকচেইন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার সময় এসে গেছে বলে অনেকে বলছেন। (কবির, ২০১৮)
ক্লাউড কম্পিউটিং : ক্লাউড কম্পিউটিং এমন একটি প্রযুক্তি, যার ফলে আপনার কম্পিউটারের হার্ডডিস্কের ওপর আর চাপ থাকছে না। যে কোন স্টোরেজ, সফটওয়্যার এবং যাবতীয় অপারেটিং সিস্টেমের কাজ চলে যাচ্ছে হার্ডডিস্কের বাইরে। শুধু ইন্টারনেট থাকলেই ক্লাউড সার্ভারে কানেক্ট হয়েই সব সুবিধা নেয়া যাবে। কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক নষ্ট হওয়া বা সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও ক্লাউড সার্ভার ডাউন হওয়ার সুযোগ নেই। যেহেতু এতে আলাদা কোন সফটওয়্যার কেনার প্রয়োজন হয় না বা কোন হার্ডওয়্যারের প্রয়োজন হয় না, তাই স্বাভাবিকভাবেই খরচ কম। ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের কাজগুলো যে কোন স্থানে বসেই মোবাইলের মাধ্যমে কন্ট্রোল করা যায় এবং কম্পিউটিংয়ের সফটওয়্যারগুলো আপডেট করার প্রয়োজন নেই। এগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপডেট হয়ে থাকে। (নর, ২০১৮)
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বিভিন্ন বিরোধ
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে একদিকে যেমন তৈরি হয়েছে নতুন সম্ভাবনা, অন্যদিকে তৈরি হয়েছে নানাবিধ ঝুঁকি। এই নানাবিধ ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন এই বিপ্লবের বিরোধ সম্পর্কে অবহিত এবং সচেতন হওয়া।
শ্রমের মুক্তি বনাম শ্রমের অধীনতা ও বেকারত্ব : এখন পর্যন্ত চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিরোধ হল শ্রমের মুক্তির সম্ভাবনার সাথে শ্রমের অধীনতা ও বেকারত্বের মধ্যে বিরোধ। কেননা রোবট কঠিন একঘেয়ে ক্লান্তিকর কায়িক পরিশ্রমের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করেছে। বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট মানুষের একঘেয়ে ক্লান্তিকর কাজের অবসান ঘটাচ্ছে। ফলে তা অপ্রীতিকর শ্রম থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
এ ক্ষেত্রে দুইটি দিক বিবেচ্য- প্রথমত, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কিছু আবিষ্কার, যেটা শ্রমিকের পুরো অংশকে প্রতিস্থাপন করবে না; বরং একটা নির্দিষ্ট অংশকে প্রতিস্থাপন করবে। এর ফলে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে, যা তাদের মজুরি বৃদ্ধি করবে। দ্বিতীয়ত, কিছু আবিষ্কার শ্রমিকের সম্পূর্ণ অংশকে প্রতিস্থাপন করবে; যার ফলে তৈরি হবে বেকারত্ব। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডাব্লিউইএফ) দাবি করেছে যে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মানুষ তাদের চাকরি হারাতে পারে, প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাবে প্রায় ৫.৭ মিলিয়ন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাংলাদেশি বিদেশ থেকে তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত হতে পারে। বলা হয় যে, একটি মেশিন সম্ভাব্যভাবে ১০ জন কর্মীকে ছাঁটাই করতে পারে। অন্য একটি লক্ষণীয় বিষয় হল, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়মিত শ্রমিকের পরিবর্তে অনিয়মিত শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি করবে; এর ফলে শ্রমিককে কোন প্রকার ভাতা প্রদানের বাধ্যবাধকতা থাকবে না। (মেহেদী, ২০১৯)
উন্নয়নশীল বিশ্বের আরও পিছিয়ে পড়া : চতুর্থ শিল্প বিপ্লব অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্য প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। এযাবৎ যেসব উন্নয়নশীল দেশ উন্নয়নে সাফল্য অর্জন করেছে, তারা সেটা করেছে মূলত শ্রমঘন শিল্প স্থাপন এবং উৎপাদিত সামগ্রী উন্নত বিশ্বে রপ্তানির মাধ্যমে। এটা আরও সম্ভব হয়েছে, কারণ উন্নত বিশ্বের কোম্পানিসমূহ শ্রমের ব্যয় কমানোর জন্য তাদের শ্রমঘন উৎপাদন প্রক্রিয়াসমূহ উন্নয়নশীল দেশসমূহে স্থানান্তরিত করে, যা ইংরেজিতে ‘অফ-শোরিং’ বলে অভিহিত। কিন্তু চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এ ক্ষেত্রে এক ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে; কেননা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবটের ব্যবহারের ফলে উৎপাদনের জন্য শ্রমের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পাচ্ছে, ফলে শ্রম বাবদ খরচ সাশ্রয়ের চাপও কমছে। নতুন এই পরিস্থিতির কারণে ‘অফ-শোরিং’-এর পরিবর্তে ‘রি-শোরিং’ প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হচ্ছে। অর্থাৎ যেসব উৎপাদনপ্রক্রিয়া আগে উন্নয়নশীল দেশে স্থানান্তর করা হয়েছিল সেগুলো আবার উন্নত দেশে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। যদি এই প্রক্রিয়া আরও ব্যাপক ও বেগবান হয় তাহলে শ্রমঘন শিল্পায়নের মাধ্যমে উন্নয়নের যে স্বপ্ন অনেক উন্নয়নশীল দেশ দেখেছিল তা হুমকির সম্মুখীন হবে।
নতুন এই পরিস্থিতির কারণে ‘অফ-শোরিং’-এর পরিবর্তে ‘রি-শোরিং’ প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হচ্ছে। অর্থাৎ যেসব উৎপাদনপ্রক্রিয়া আগে উন্নয়নশীল দেশে স্থানান্তর করা হয়েছিল সেগুলো আবার উন্নত দেশে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।
পরিবেশের সুরক্ষা নাকি প্রাণপ্রকৃতির নাশ : চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বিভিন্ন প্রযুক্তি পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রের সুরক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করেছে; যেমন- হাইড্রোজেন ও ফুয়েল-সেল জ্বালানির বিকাশের ফলে বায়ুতে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেতে পারে। সৌর ও বায়ু বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ইতিমধ্যে বিপুলভাবে হ্রাস পেয়েছে। জীব প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে জৈব ও পচনশীল প্লাস্টিকের উৎপাদন ও ব্যবহারের ফলে পৃথিবীর মাটি, জল এবং বায়ুর প্রতি সৃষ্ট প্লাস্টিকের হুমকি প্রতিরোধে বিভিন্ন উপায় বের করা যেতে পারে। কিন্তু পরিবেশ রক্ষায় চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা দ্রুততার সাথে বাস্তবায়িত হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসন তার একটি বাস্তব উদাহরণ। ট্রাম্প প্রশাসন জলবায়ু পরিবর্তন প্রক্রিয়া অস্বীকার করেছে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার আরও বাড়ানোর চেষ্টায় রত। এ ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল নীতি কেবল যুক্তরাষ্ট্রে সীমাবদ্ধ নয়, ব্রাজিলের সরকার আমাজন বন রক্ষার পরিবর্তে সেখানে কৃষি উৎপাদন এবং অবকাঠামো বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিয়েছে। আমরা সবাই জানি আমাজন বন পুরো পৃথিবীর ফুসফুস বলে পরিচিত এবং বহু জীববৈচিত্র্যের আধার। এই বনের ধ্বংস গোটা পৃথিবীর প্রকৃতি ও বাস্তুতন্ত্রকে সংকটময় করবে তাতে সন্দেহ নেই। এই প্রযুক্তির নীতিবিরোধী, উচ্ছৃঙ্খল ব্যবহারের মাধ্যমে পৃথিবীর ভয়ংকর অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। ফলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তি ফ্রাংকেনস্টাইনের দৈত্য হিসাবে আবির্ভূত হতে পারে, যে দৈত্যকে মানুষের পক্ষে আর বোতলের ভেতরে রেখে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।
মাটি, জল এবং বায়ুর প্রতি সৃষ্ট প্লাস্টিকের হুমকি প্রতিরোধে বিভিন্ন উপায় বের করা যেতে পারে। কিন্তু পরিবেশ রক্ষায় চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা দ্রুততার সাথে বাস্তবায়িত হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসন তার একটি বাস্তব উদাহরণ। ট্রাম্প প্রশাসন জলবায়ু পরিবর্তন প্রক্রিয়া অস্বীকার করেছে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার আরও বাড়ানোর চেষ্টায় রত।
উপশম নাকি সমরাস্ত্রের মাধ্যমে পৃথিবীর বিলুপ্তি : পারমাণবিক অস্ত্রের যুগে কারও একার পক্ষেই যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়, বরং গোটা পৃথিবী বিলুপ্ত হয়ে যাবে। প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে এখন আরও সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছাতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র এবং আরও ভয়ংকর বোমা ও সমরাস্ত্রের আবিষ্কার হচ্ছে। স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে যে কোন অভীষ্ট লক্ষ্যে আঘাত করা সম্ভব হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ড্রোন প্রযুক্তির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এখন ড্রোন ব্যবহার করে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে যুদ্ধ করা সম্ভব। এর ফলে ধনী এবং প্রযুক্তিতে উন্নত দেশসমূহের জন্য এখন যুদ্ধক্ষেত্রে আর সৈন্য প্রেরণের প্রয়োজনীয়তা থাকছে না। এ পরিস্থিতি যুদ্ধকে আরও সহজ করে দিতে পারে; কিন্তু একই সাথে যুদ্ধের পরিণতিকে আরও ভয়ংকর রূপ দিতে পারে এবং বিশেষত দরিদ্র দেশসমূহের জন্য আরও বেশি হুমকির সৃষ্টি করতে পারে।
অসমতা বৃদ্ধি : ধারণা করা হচ্ছে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সবার জন্য উন্নত ভবিষ্যতের পথ তৈরি করবে। তবে প্রযুক্তির এই শক্তি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং উদ্ভাবনের অসাধারণ স্তরে আমরা উপনীত হচ্ছি এবং বিশ্বে আরও বেশি লোক ও জিনিস সংযুক্ত হয়ে উঠছে। তবে এটি অবিচ্ছিন্নভাবে আরও বেশি উন্মুক্ত, বিচিত্র এবং অন্তর্ভুক্ত বৈশ্বিক সমাজের পথ সুগম করে না। পূর্ববর্তী শিল্প বিপ্লবগুলোর পাঠগুলোর মধ্যে এই উপলব্ধি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যে প্রযুক্তি এবং এর মাধ্যমে যে সম্পদ অর্জিত হয় তা কেবল একটি ক্ষুদ্র, শক্তিশালী গোষ্ঠীর স্বার্থকে রক্ষা করে। বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (২.৪ বিলিয়ন) বিশুদ্ধ পানীয় জল এবং নিরাপদ স্যানিটেশনের অভাব রয়েছে, প্রায় এক-ষষ্টাংশের (১.২ বিলিয়ন) কোন বিদ্যুৎ নেই। অথচ উভয় ব্যবস্থাই দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবে বিকশিত হয়েছিল। এখনও ৪ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ ইন্টারনেটের সুবিধার বাইরে, যা তৃতীয় শিল্প বিপ্লবে বিকশিত হয়েছিল। (ইসলাম, ২০১৯)
বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (২.৪ বিলিয়ন) বিশুদ্ধ পানীয় জল এবং নিরাপদ স্যানিটেশনের অভাব রয়েছে, প্রায় এক-ষষ্টাংশের (১.২ বিলিয়ন) কোন বিদ্যুৎ নেই। অথচ উভয় ব্যবস্থাই দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবে বিকশিত হয়েছিল। এখনও ৪ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ ইন্টারনেটের সুবিধার বাইরে, যা তৃতীয় শিল্প বিপ্লবে বিকশিত হয়েছিল।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পথচলা এবং অগ্রগতি শুরু পুঁজিবাদের হাত ধরে, মুনাফা যেখানে শেষকথা এবং ধনী-গরিবের বৈষম্য তাদের কাছে উন্নয়নের স্বাভাবিক ধারা। এমতাবস্থায় বলাই বাহুল্য যে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব শোষণের নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে, যা ধনী-গরিবের বৈষম্যে নতুন মাত্রা যোগ করবে। আন্তর্জাতিক সেবা প্রতিষ্ঠান অক্সফামের একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে, বিশ্বের সম্পদের ৫০ শতাংশেরও বেশি শীর্ষ ১ শতাংশের মালিকানাধীন, আবার নিচের ৫০ শতাংশের মালিকানাধীন সম্পদ ১ শতাংশেরও কম। ধনী শ্রেণির ১০শতাংশ বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ সম্পদ ধারণ করে এবং প্রযুক্তিগত উল্লম্ফনের সাথে সাথে এই ব্যবধানটি আরও বাড়ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, স্বয়ংচালিত যানবাহন এবং ইন্টারনেটের মত নতুন প্রযুক্তিগুলো অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু সম্পদের এই গুরুতর বৈষম্যের ফলে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই ব্যাহত হচ্ছে বলে এই সমীক্ষায় মন্তব্য করা হয়েছে। অক্সফাম বলছে, এই পরিস্থিতি বদলে দেয়ার জন্য এই মুহূর্তে ধনীদের আয়ের ওপর কর বাড়াতে হবে এবং ন্যূনতম মজুরি বাড়াতে হবে।
গোপনীয়তা আর ব্যক্তিগত নয়
নজরদারি পুঁজিবাদ বা সার্ভেইলেন্স ক্যাপিটালিজম হল কোন ব্যক্তির আচরণগুলো নিন্ত্রয়ণ করে তার ফলাফলগুলোকে সর্বোচ্চ দরদাতাকে বিক্রি করার মাধ্যমে রিয়াল-টাইম ডেটা সংগ্রহ করার একটি ব্যবস্থা। এটি এমন একটি ব্যবস্থা, যা বর্তমান সময়ে এড়িয়ে চলা প্রায় অসম্ভব; কেননা আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনের জন্য, যেমন- শিক্ষা, চাকরি, স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন কাজে আমরা ইন্টারনেটের ব্যবহার অপরিহার্য হিসাবে দেখি।
তথ্য-প্রযুক্তির প্রতি এই অতিনির্ভরতা উন্নত বিশ্ব এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত টেক-জায়ান্টদের জন্য তৈরি করেছে সীমাহীন নজরদারির ক্ষেত্র। নজরদারি পুঁজিবাদ মূলধন গঠনের এবং সম্পদ সৃষ্টির উৎস হিসাবে কাজ করে। এটি আর গোপন নয় যে গুগল তার ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে ব্যক্তিগত ডেটা সংগ্রহ করে এবং বিক্রি করে, তবে ডেটা মাইনিং এখন কেবল ব্যবহারকারীদের জন্য বিজ্ঞাপনের প্রবণতা বা ভবিষ্যতে কেনার আচরণের পূর্বাভাসের জন্য ব্যবহৃত হয় না; বরং এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
এই অনলাইন অথবা ভার্চুয়াল জগৎ গড়ে উঠেছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে কোন রকম আইনের বাধ্যবাধকতা ছাড়াই। এটি প্রথমে গুগল আবিষ্কার করে, তারপর ফেসবুক এটা গ্রহণ করে এবং দ্রুত ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। সাইবার স্পেসই হল এর জন্মস্থান। এই বিষয়ে গুগল/অ্যালফাবেট চেয়ারপারসন এরিক শ্মিট এবং তাঁর সহকারী জ্যারেড কোহেন তাঁদের ‘দ্য নিউ ডিজিটাল এইজ’ বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় বলেছেন, “অনলাইন পৃথিবী সত্যিই স্থানীয় আইন দ্বারা আবদ্ধ নয় … এটি বিশ্বের বৃহত্তম অনিয়ন্ত্রিত স্থান।” (শ্মিট ও কোহেন, ২০১৩)
নজরদারি পুঁজিবাদের এই প্রক্রিয়ায় আমাদের আচরণকে সরাসরি প্রভাবিত করা হয় এবং আমাদের বাস্তব জীবনের রিয়াল-টাইম প্রবাহ বিক্রি করা হয়। পুঁজিবাদী বিশ্ব দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বের নানা প্রান্তের ‘প্রাকৃতিক সম্পদ’ শোষণ করার মাধ্যমে প্রাণপ্রকৃতির বিনাশ করে আসছে, বর্তমানে এই নজরদারি পুঁজিবাদ তারই নতুন রূপ। এটি কেবলমাত্র সম্পদ ও মূলধনই শোষণ করছে তাই নয়, বরং মানুষের ব্যক্তিগত অধিকারও হরণ করছে। এই পুরো প্রক্রিয়ায় সবচাইতে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ব্যবহারকারীরা প্রায়শই তাদের ব্যক্তিগত ডেটা সংগ্রহ এবং শোষণকে শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির গোপনীয়তা লঙ্ঘন হিসাবে দেখেন, কিন্তু এটি তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু। নজরদারি পুঁজিবাদ ব্যক্তির মৌলিক ক্ষমতাকে বিপন্ন করে, এটি এমন একটি ব্যবস্থা, যাতে ব্যবহারকারীরা মনে করে তা যা পাচ্ছে সবই ফ্রি এবং তারা তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা উপভোগ করছে, কেউ তাদের নিয়ন্ত্রণ করছে না। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমরা আসলে প্রতিমুহূর্তে অন্য কারও দ্বারা পরিচালিত হচ্ছি। তারাই আমাদেরকে পরোক্ষভাবে বলে দেয় আমরা কী কিনব, কী করব, কোথায় যাব প্রভৃতি। এইভাবে নজরদারি পুঁজিবাদ কেবল ব্যক্তিই নয়, গণতন্ত্র ও নীতিমালা এবং বাজার অর্থনীতির অনুশীলনকেও হুমকির মুখে ফেলেছে। এটি একটি অনির্বাচিত, অনিয়ন্ত্রিত ‘নজরদারি সরকার ব্যবস্থা’, যা এর হাতে অভূতপূর্ব নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করছে।
পুঁজিবাদী বিশ্ব দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বের নানা প্রান্তের ‘প্রাকৃতিক সম্পদ’ শোষণ করার মাধ্যমে প্রাণপ্রকৃতির বিনাশ করে আসছে, বর্তমানে এই নজরদারি পুঁজিবাদ তারই নতুন রূপ। এটি কেবলমাত্র সম্পদ ও মূলধনই শোষণ করছে তাই নয়, বরং মানুষের ব্যক্তিগত অধিকারও হরণ করছে।
নজরদারি পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন, তবে অতি গুরুত্বের সাথে এর নিয়ন্ত্রণ জরুরি। এর জন্য প্রথম পদক্ষেপটি হল এর স্বীকৃতি প্রদান এবং সকলের বোধগম্য করে উপস্থাপন করা যে কিভাবে তারা ব্যক্তিকে তার আচরণ থেকে ‘স্থানচ্যুত’ করছে এবং ডেটা মাইনিং করছে ‘ফ্রি কাঁচামাল’ হিসাবে। আর এই কাঁচামাল ব্যবহার করে তারা ‘ভবিষ্যদ্বাণীমূলক পণ্য’ তৈরি করছে। এরপর আমাদেরকে এই ডেটা সংগ্রহ এবং এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। (যুবফ, ২০১৫)
শেষকথা
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে আগামী কয়েক বছরেই মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কী প্রভাব পড়বে, সেটি নিয়ে দুই ধরনের মত পাওয়া যাচ্ছে। একদল বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই বিপ্লবের ফলে সব মানুষেরই আয়ের পরিমাণ ও জীবনমান বাড়বে। সব কিছু সহজ থেকে সহজতর হবে এবং মানুষ তার জীবনকে আরও বেশি মাত্রায় উপভোগ করবে। এছাড়া পণ্য/সেবা উৎপাদন ও প্রদান প্রক্রিয়ায়ও আসবে ব্যাপক পরিবর্তন। এক দেশ থেকে আরেক দেশে পণ্য পাঠানোর খরচ অনেক কমে আসবে, কিংবা পাঠানোর প্রয়োজনীয়তাই হয়ত থাকবে না। ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। আগে যেমন বাসায় বসে সদাই করার কথা কল্পনাও করা যেত না, সামনে হয়ত বাসার বাইরে একদমই না গিয়েও সারা বিশ্বের সব সুবিধা ভোগ করে জীবন যাপন করা যাবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বায়োটেকনোলজি, রোবটিকস এবং অন্যান্য উদীয়মান প্রযুক্তির উদ্ভাবনগুলো আমাদের ক্ষমতা, আমাদের পরিচয় এবং আমাদের সম্ভাব্যতাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে চলেছে।
তবে আরেক দল বিশেষজ্ঞ ধারণা করেন, ডিজিটাল বিপ্লব বিশ্বের অসাম্য ও দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে আরও দুর্বিষহ পর্যায়ে নিয়ে যাবে। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে মানুষের দ্বারা সম্পন্ন অনেক কাজ রোবট ও যন্ত্রপাতি দিয়ে করা হবে, এর ফলে নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে তা সমস্যা তৈরি করবে। এছাড়া শ্রমবাজারে অল্প কর্মদক্ষ শ্রমিকদের চাহিদা ও বাজার কমে যাবে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বেশি করে সমস্যায় ফেলবে। এর ফলে সারা বিশ্বে সম্পদ-বৈষম্য আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বাড়বে বলে অনেকের আশঙ্কা। ডিজিটাল প্রযুক্তির আবিষ্কারক, বিনিয়োগকারী দেশগুলো এর থেকে যতটা লাভবান হবে, অন্য দেশগুলো সেটা থেকে বঞ্চিত হবে। তাঁদের ধারণা, শুধুমাত্র একটি পক্ষ বা কিছু দেশ বা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে যাবে সব নিয়ন্ত্রণ। তারাই সব সুবিধা নিজেদের করে রাখতে পারে এবং অন্যরা বঞ্চিত হতে পারে এবং পিছিয়ে যাবে অনেক, যেমনটি শিল্প বিপ্লবের প্রথম দিকে ছিল। যাদের সম্পদ থাকবে তারাই দুর্বলকে আরও ঘায়েল করার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। (ইসলাম, ২০১৬)
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অগ্রযাত্রাকে মানবকল্যাণে ব্যবহার করার জন্য আমাদের অবশ্যই অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, বিশেষত সাম্য, কর্মসংস্থান, গোপনীয়তা রক্ষা এবং আস্থার ক্ষেত্রগুলোতে সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাবগুলোকে অবশ্যই রোধ করতে হবে। এবিষয়ে জনস্বার্থে শান্তিপূর্ণ বিশ্ব তৈরি নিয়ে চিন্তা, গবেষণা ও উদ্যোগ বাড়াতে হবে। পরিশেষে আমরা বলতে পারি, প্রযুক্তি ভাল বা খারাপও নয়Ñআমরা এটিকে কিভাবে ব্যবহার করব তাই পার্থক্য তৈরি করবে।
মো. সাদ্দাম হোসেন : স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী
ই-মেইল : saddameco43@gmail.com
মো. মেহেদী হাসান শোভন : স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী)
ই-মেইল : mehedihasan.econ43@gmail.com
তথ্যসূত্র
আবেদিন, ২০১৯ Abdin, Md. J. A. (2019, January 23). Fourth industrial revolution and its impact in Bangladesh. Retrieved from https://m.theindependentbd.com/printversion/details/184416
করিজেন, ২০১৯ Corrigan, F. (2019). How Do Drones Work And What Is Drone Technology? Retrieved from https://www.dronezon.com/learn-about-drones-quadcopters/what-is-drone-technology-or-how-does-drone-technology-work/
সু, ম, ডেভিড, জে এবং কিম, ২০১৮ Xu, M., David, J., & Kim, S. (2018). The Fourth Industrial Revolution: Opportunities and Challenges. International Journal of Financial Research, 9, 90. https://doi.org/10.5430/ijfr.v9n2p90
ফোর্ড, ২০১৬ Ford, M. (2016). The rise of the robots: technology and the threat of mass unemployment, Oneworld, London.
জোহানসেন, ২০১৬ Johannessen, J-A. (2016). Innovations leads to economic crises: explaining the bubble economy, Palgrave, London.
অ্যান্ডারসন, ২০১২ Anderson, C. (2012). Makers: The New Industrial Revolution. New York: Crown Publishing.
সোয়াব, ২০১৫ Schwab, K. (2015). The Fourth Industrial Revolution: What It Means and How to Respond. Retrieved from https://www.foreignaffairs.com/articles/2015-12-12/fourth-industrial-revolution.
মানয়িকা, ২০১৭ Manyika, J., et al. (2017, January). Harnessing Automation for A Future That Works. Report by McKinsey Global Retrieved from http://www.mckinsey.com/global-themes/digital-disruption/harnessing-automation-for-a-future-that-works
যুবফ, ২০১৫ Zuboff, Shoshana. (2015) “Big other: surveillance capitalism and the prospects of an information civilization”. Journal of Information Technology. 30 (1): 75–89. PDF file online. April 2015
আরাফাত, ২০১৭। এম.এস.এম আরাফাত: অগমেন্টেড রিয়ালিটি : কৃত্রিম আর বাস্তবের মিশেলে তৈরি নতুন জগৎ. https://roar.media/bangla/main/tech/augmented-reality-a-new-world-made-with-mixing-the-artificial-and-natural-world/
ইসলাম, ২০১৬ Islam, A. (2016, January 23). সময় এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের? প্রথম আলো. https://www.prothomalo.com/economy/article/747619
কবির, ২০১৮ Kabir, S. A. (2018, January 24).ব্লকচেইন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার সময় এসে গেছে. . https://www.prothomalo.com/opinion/article/1416021
খানসামা, ২০১৮ Khansama. (2018, February 4). প্রশ্ন : ভার্চুয়াল রিয়ালিটি কী? ভার্চুয়াল রিয়ালিটির প্রভাব বর্ণনা করো। https://ictpphsc.blogspot.com/2018/02/blog-post_4.html
নর, ২০১৮ Knorr, E. (2018, October 2). What is cloud computing? Everything you need to know now. InfoWorld. https://www.infoworld.com/article/2683784/what-is-cloud-computing.html
মেহেদী, ২০১৯ Mehedi, M. (2019, February 14). What the 4th Industrial Revolution has in store for Bangladesh. Dhaka Tribune. https://www.dhakatribune.com/opinion/op-ed/2019/02/14/what-the-4th-industrial-revolution-has-in-store-for-bangladesh
রহমান, ২০১৭ Rahman, M. (2017, August 6) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিকস, এক্সপার্ট সিস্টেম, রোবটhttp://www.edupointbd.com/artificial-intelligence-robotics/
সোয়াব, ২০১৭ Schwab, K. (2017). The Fourth Industrial Revolution. Currency.
ফয়সাল, ২০১৩ Faisal, H. M. A. (2013). 3D ৩উ প্রিন্টিং জিনিসটা কী? বেশতো, http://www.beshto.com/questionid/9737
পাইক, ২০১৮ Paik, S. (2018, June 1). ড্রোন : জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখা এক প্রযুক্তির গল্প. https://roar.media/bangla/main/tech/drones/
ইসলাম, ২০১৯ নজরু ল ইসলাম (২০১৯): অক্টোবর বিপ্লব থেকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এবং সাম্যবাদের ভবিষ্যৎ, ইস্টার্ন একেডেমিক, ঢাকা
শ্মিট ও কোহেন, ২০১৩ Schmidt, E., & Cohen, J. (2013). The New Digital Age: Reshaping the Future of People, Nations and Business. John Murray Press.
https://www.bbc.com/bengali/news/2015/01/150119_mk_rich_poor_wealth
262