ফিডেল ক্যাস্ট্রো

স্মরণ

ফিডেল ক্যাস্ট্রো

তাহেরা বেগম জলি

স্পেনীয় বাবা অ্যাঞ্জেলা ক্যাস্ট্রো এবং কিউবান মা লীনা রুৎজ গঞ্জালেসের ঘরে জন্ম নেয়া এক মানবের নাম ফিডেল ক্যাস্ট্রো। তিনি জন্মে ছিলেন ১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট কিউবার পূর্বাঞ্চলে বিরান জেলায়। সান্টিয়াগোর ক্যাথলিক স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু হয় ফিডেল ক্যাস্ট্রোর। তবে তিনি অবসরে বাবার খামারেও কাজ করতেন। সে রকম একটা সময়ে খামারি শ্রমিকদের নিয়ে মালিক বাবার বিরুদ্ধেই এক ধর্মঘটের ডাক দেন তরুণ ফিডেল। লড়াইয়ের ময়দানে সেই তাঁর পথচলা শুরু। এর মধ্যেই তিনি ‘এল কলেজিও ডে বেলেন’ কলেজে শুরু করেন তাঁর কলেজজীবন। কিউবায় তখন সাম্রাজ্যবাদ পরিপুষ্ট ধনিক গোষ্ঠীর সীমাহীন দৌরাত্ম্য, বিক্ষুব্ধ ফিডেল তখন থেকেই আপোসহীন বিরোধে জড়িয়ে পড়েন এই গোষ্ঠীর সঙ্গে।

১৯৪৫ সালে হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ের ছাত্রত্ব গ্রহণ করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়েও তখন দৌরাত্ম্য মার্কিন মদদপুষ্ট গ্রাউ সরকারের। ফিডেল তাঁর এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন, “আমি পড়েছি এমন এক বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে হাজার হাজার ছাত্রের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্র ছিল মাত্র ৩০ জন। আমি হয়ে পড়ি সেই ৩০ জনের একজন।” বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে ছাত্র অধিকার আদায়ের একজন সক্রিয় নেতা হিসাবে আবির্ভূত হন তিনি। এবং যথারীতি তিনি রোষানলে পড়ে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের দালাল কর্তৃপক্ষ এবং তাদের সশস্ত্র গুণ্ডাবাহিনীর। নিষিদ্ধ করা হয় ফিডেলের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দি। কিন্তু ক্যাস্ট্রোর সাহসী মনোভাব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সব চক্রান্ত ও আক্রমণ রুখে দেয়। তিনি সমমনা আরও সাত-আটজন সাহসী ছাত্রকে সংগঠিত করে সশস্ত্র অবস্থায় প্রবেশ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্যাস্ট্রোর সশস্ত্র রাজনৈতিক জীবনের উত্থান ঘটে ঠিক এই সময়টাতেই।

ক্যাস্ট্রোর এই একরোখা ও সাহসী চরিত্র নিয়ে তাঁর ভাই রাউল ক্যাস্ট্রো বলেছেন, “ফিডেলের চরিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তিনি কখনও পরাজয় মেনে নেন না।” ফিডেলের চরিত্রের স্পর্ধাই তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল গোটা পৃথিবীর দুশমন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মুখোমুখি। ১৯৫০ সালে আইনে স্নাতক হন এই যুবক। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে বস্তিবাসীদের বাসস্থানের দাবিতে এক বড় ধরনের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন ফিডেল। বস্তিবাসীদের নিয়ে এই আন্দোলনই তাঁকে রাজনীতির পথ চিনতে সাহায্য করে। আইন পেশার শুরুতে গরিব মানুষদের বিনা পয়সায় আইনি সহায়তা দেয়ার খেসারত হিসাবে তিনি পড়ে যান মারাত্মক অর্থনৈতিক দুর্দশায়। কিন্তু এতে বিচলিত না হয়ে বরং গরিবি সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের দিকে পা বাড়ান তিনি।

১৯৪৭ সালে ছাত্রাবস্থায়ই তিনি যোগ দিয়েছিলেন ‘পার্টি অব দ্য কিউবান পিপলস’-এ। দলটির নেতা এদুয়ার্দ চিবাস রাজনৈতিক বিতর্কে জড়িয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। তাছাড়া এ সময় ফিডেল নিজেও দলের সঙ্গে মতবাদিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। দলীয় অভ্যন্তরীণ বিতর্ক চলাকালেই ১৯৫২ সালে সাধারণ নির্বাচনে প্রথমবারের মত দলীয় কংগ্রেস প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি। বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে পার্টি অব দ্য কিউবান পিপলস যখন ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে, তখন এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে নেন জেনারেল বাতিস্তা। এবং বাতিল করে দেন নির্বাচনি ফলাফল। তখন ক্যাস্ট্রো বুঝতে পেরেছিলেন, সশস্ত্র সংগ্রামই কিউবার জনগণের মুক্তির একমাত্র পথ। সেই পরিস্থিতিতে ১৯৫২ সালে অর্থোডক্স পার্টি এবং পিএসসি কমিউনিস্ট পার্টি মিলে ‘দ্য মুভমেন্ট’ নামে একটা জোট গঠন করা হয়। ১৯৫২ সালে জুলাই থেকে পরবর্তী এক বছরে প্রায় এক হাজার ২০০ জন কর্মী যোগ দেয় তাঁর সঙ্গে। সশস্ত্র আন্দোলন পরিচালনার জন্য তখন দরকার হয়ে পড়ে সমরাস্ত্র। সেই অস্ত্রের সন্ধানেই তিনি কিউবার দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক ঘাঁটি মনকাডা দুর্গে আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেন। সুসংগঠিত এবং অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী দ্য মুভমেন্টের ১৬৫ জনের একটি দল নিয়ে ১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই আঘাত হানেন মনকাডা সামরিক ব্যারাকে। বাতিস্তার পেশাদার সেনাবাহিনীর কাছে ক্যাস্ট্রোর এই আক্রমণ ব্যর্থ হয়ে যায়। ১৬৫ জন যোদ্ধার মধ্যে নিহত হন ৫৫ জন। তাঁদের মধ্যে যুদ্ধে মারা যান ৬ জন। বাকি ৪৯ জনকে বন্দি অবস্থায় নির্যাতন করে হত্যা করেন জেনারেল বাতিস্তা। ফিডেল ও রাউলসহ বেশ কয়েকজন বন্দি হন সরকারি বাহিনীর হাতে। বাইরেও দ্য মুভমেন্ট দল এক ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞের সম্মুখীন হয়। এবং বাতিস্তার সামরিক আদালতে বিচার শুরু হয় ফিডেল-রাউলসহ অন্য বন্দিদের। বিচারে ফিডেল ১৫ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।

তবে এই বিচার ফিডেলের সামনে কাজ করে এক উন্মুক্ত দরজার মত। জনাকীর্ণ সেই আদালতে ১৯৫৩ সালের ১৬ অক্টোবর চার ঘণ্টা সময় নিয়ে এক ঐতিহাসিক বক্তৃতা দেন বন্দি বিপ্লবী ফিডেল ক্যাস্ট্রো। ‘ইতিহাস আমাকে দায়মুক্ত করবে’ নামে খ্যাত ঐতিহাসিক সেই বক্তৃতায় ক্যাস্ট্রো তুলে ধরতে পেরেছিলেন কিউবার জনগণের বঞ্চনার কথা, এমনকি সামরিক বাহিনীর মধ্যে বৈষম্যের কথাও তিনি তুলে এনেছিলেন তাঁর বক্তৃতায়। পরিষ্কার করতে পেরেছিলেন-বাতিস্তা সরকার এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কেন কিউবার শত্রু। এই বক্তৃতা মুদ্রিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে জনগণের মধ্যে। ফিডেল এবং কিউবার জনগণের মধ্যে মূলত তা কাজ করে মেলবন্ধনের। বাতিস্তা সরকার দণ্ডপ্রাপ্ত ফিডেলকে পাঠিয়ে দেয় কিউবার পাইনস দ্বীপের এক অন্ধকার কারাগারে, তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যার গোপন ষড়যন্ত্র করে। ক্যাস্ট্রো হন্তারক সেই ষড়যন্ত্র জনসমক্ষে ফাঁস করে দেন মনকাডা আক্রমণের সমর্থক ক্যাপ্টেন পেলেতিয়ার। মূলত ক্যাপ্টেন পেলেতিয়ারের ওপরই দায়িত্ব পড়েছিল বিষ দিয়ে ক্যাস্ট্রোকে হত্যা করবার। ক্যাপ্টেন পেলেতিয়ার ছিলেন সৈনিকদের মধ্যে ফিডেলের অনুসারী এবং তিনি ছিলেন মনকাডা দুর্গ আক্রমণের ঘোরতর সমর্থক। ফিডেলকে হত্যার ষড়যন্ত্র দিনের আলোতে আনার অপরাধে ক্যাপ্টেন পেলেতিয়ারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেন জেনারেল বাতিস্তা। স্বাভাবিকভাবেই এই হত্যাকাণ্ড জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কিউবার জনগণ একাট্টা হয়ে দাঁড়িয়ে যায় ফিডেলের পক্ষে। সেই পরিস্থিতিতে ‘ক্যাস্ট্রো মুক্তি’র আন্দোলনের মুখে ১৫ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত ফিডেলকে দুই বছরের মাথায় মুক্তি দিতে বাধ্য হয় বাতিস্তা সরকার। জেলমুক্তির পরপরই দলের গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেতা এবং ছোট ভাই রাউলসহ গোপনে পাড়ি জমান মেক্সিকোতে।

১৯৫৫ সালের ৭ জুলাই ফিডেল ক্যাস্ট্রো মেক্সিকোতে পৌঁছান। মনকাডা দুর্গ আক্রমণের দিন স্মরণে রেখে ১৯৫৫ সালে ক্যাস্ট্রো তাঁর দলের নামকরণ করেন ‘২৬ জুলাই আন্দোলন’ বা ‘টোয়েন্টি সিক্স মুভমেন্ট’। এর আগে ঘটনাক্রমে চে গুয়েভারা যখন মেক্সিকোর পার্শ্ববর্তী দেশ গুয়েতেমালায় অবস্থান করছিলেন, তখন ২৬ জুলাই আন্দোলনের কিছু পলাতক গেরিলার মুখে ক্যাস্ট্রোর নামের সঙ্গে পরিচিত হন। ক্যাস্ট্রো তখন বন্দি কিউবার পাইনস দ্বীপের কারাগারে। তাঁর অন্য এক বন্ধু নিকো লোপেজের মাধ্যমে চে প্রথমে পরিচিত হন রাউল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে। ফিডেল জেল থেকে মুক্তি পেয়ে মেক্সিকো নগরীতে পৌঁছানোর দুই দিন পর রাউল ক্যাস্ট্রোর মাধ্যমে ফিডেল ও চের মধ্যে সাক্ষাৎ ঘটে। তাঁদের এই সাক্ষাৎ সম্পর্কে চে তাঁর স্মৃতিকথায় বলেন, “সারা রাত ফিডেলের সঙ্গে কথা বললাম। সূর্য যখন উঠেছে, সেই সময়ের মধ্যে ফিডেলের আগামী অভিযানে আমি ডাক্তার হিসাবে যোগ দেব বলে সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে।…এক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কোন বিপ্লবে যোগ দেবার জন্য আমাকে খুব বেশি বোঝানোর কিছু ছিল না। তবে অসাধারণ মানুষ হিসাবে ফিডেল আমাকে মুগ্ধ করে।” ফিডেলের সঙ্গে আলোচনার পর চে নিজেকে ‘২৬ জুলাই আন্দোলন’-এর একজন সক্রিয় যোদ্ধা হিসাবে ঘোষণা দেন। এরপর সিদ্ধান্ত হয়, এখান থেকেই একটা সামরিক বাহিনী গঠন করে ‘২৬ জুলাই মুভমেন্ট’ দল কিউবায় বাতিস্তার দুর্গে আক্রমণ চালাবে।

১৯৫৬ সালের মার্চ মাসে মেক্সিকোতে ফিডেল তাঁর গেরিলাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেন। মেক্সিকো সিটির বাইরে এক পশুখামারে দেয়া ক্যাস্ট্রোর এই গেরিলা প্রশিক্ষণের খবর চলে যায় পুলিশের কাছে। জুন মাসে ক্যাস্ট্রো, চে এবং আরও কিছু গেরিলা যোদ্ধা গ্রেফতার হয়ে যান। বন্দি অবস্থা থেকে ক্যাস্ট্রো সাত দিন পর মুক্তি পান, চে মুক্তি পান ৫৭ দিন পর। আক্রমণের নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী বাতিস্তা সরকারকে উৎখাতের যুদ্ধ পরিচালনার জন্য স্থান হিসাবে বেছে নেয়া হয় সিয়েরা মায়েস্ত্রা পার্বত্য অঞ্চল। ৬ হাজার ফুট উঁচু এই পার্বত্য অঞ্চলটির বিশাল সবুজ বনাঞ্চল ক্যাস্ট্রো বাহিনীর গেরিলা আক্রমণ পরিচালনার জন্য ছিল আদর্শ স্থান। এবার যুদ্ধযাত্রার জন্য ৬৩ ফুট লম্বা ‘গ্রানমা’ নামের সাত কেবিনেটের একটি নৌকা জোগাড় করা হয়।

১৯৫৬ সালের ২৫ নভেম্বর ‘গ্রানমা’য় চড়ে মেক্সিকো উপসাগরের ট্যাক্সলান থেকে একটি গেরিলা দল নিয়ে কিউবার কলোরাডোর উদ্দেশে রওনা দেন ক্যাস্ট্রো। কিউবার অভ্যন্তরে অবস্থানরত গেরিলা গ্রুপ একই সময়ে গণ-আন্দোলনের ডাক দেয়। নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাতে বিপ্লবী সশস্ত্র বাহিনীর সময় লাগার কথা ছিল পাঁচ দিন। কিন্তু উত্তাল ঝড়ো আবহাওয়ার কারণে নির্দিষ্ট স্থানে ক্যাস্ট্রো বাহিনীর পৌঁছাতে সময় লেগে যায় ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ইতোমধ্যে এই সশস্ত্র বাহিনীর আগমনের খবর পৌঁছে যায় বাতিস্তা সরকারের কাছে। এবং নির্ধারিত স্থানে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই ক্যাস্ট্রো বাহিনীর ওপর শুরু হয় বাতিস্তা বাহিনীর ভয়াবহ গুলিবর্ষণ। স্বয়ং চে বুকে ও গলায় গুলিবিদ্ধ হন। ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত ৮২ জন গেরিলার মধ্যে জীবিত ছিলেন মাত্র ১৫ জন, মতান্তরে ২২ জন। গুলিবিদ্ধ চে ও রাউলের সহযোগিতায় সিয়েরা মায়েস্ত্রায় অবস্থান করেই ক্যাস্ট্রো নতুন করে সশস্ত্র দল গঠনের কাজ শুরু করেন।

ফিডেলের নেতৃত্বে বিদ্রোহীদের ছোট একটা দল বাতিস্তা বাহিনীর ওপর আঘাতের জন্য আবার শক্তি সঞ্চয় করে। সিয়েরা মায়েস্ত্রা পাহাড়ে ক্যাস্ট্রো কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন। এবার ফিডেলের নেতৃত্বে ৩০০ জনের একটি গেরিলা দল বাতিস্তা দুর্গে আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত হয়। ক্যাস্ট্রো বাহিনীর সঙ্গে জনবিরোধী বাতিস্তার সামরিক বাহিনীর শুরু হয় ঘোরতর এক যুদ্ধ। ২৫ মাস ধরে চলে এই যুদ্ধ। ক্যাস্ট্রোর মেক্সিকোতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত গোটা দুনিয়া জানত তিনি বেঁচে নেই। সিয়েরা মায়েস্ত্রা পাহাড় থেকে বাহিনী প্রত্যাহারের সময় ক্যাস্ট্রোর একটা সাক্ষাৎকার নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হলে লড়াই আরও জোরদার হয়। কিউবার অভ্যন্তরে অবস্থিত ‘২৬ জুলাই মুভমেন্ট গ্রুপ’ ১৯৫৮ সালের এপ্রিলে সারা কিউবায় হরতালের ডাক দেয়। এদিকে হরতালের সমর্থক ও সংগঠকদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেন দিশেহারা সামরিক শাসক ফুলজেন্সিও বাতিস্তা। যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শে মার্চ মাসে হঠাৎ এক নির্বাচনের ঘোষণা দেন কিউবার সামরিক জান্তা। কিন্তু জনগণ সে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে। এদিকে বাতিস্তা তাঁর নিজের সেনাবাহিনীর সমর্থনও দ্রুত হারাতে থাকেন। মরিয়া হয়ে তখন যুক্তরাষ্ট্র বিমান, বোমা, জাহাজ, ট্যাংক পাঠিয়ে ফিডেল ক্যাস্ট্রোর গেরিলা বাহিনীকে ঠেকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু গেরিলারা সিয়েরা মায়েস্ত্রা পর্বত ছেড়ে একের পর এক শহর দখল করতে থাকে। ১৯৫৮ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বাতিস্তার এক হাজার সৈন্য গেরিলাদের হাতে প্রাণ হারায়।

১৯৫৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর এক সেনা কর্মকর্তার হাতে ক্ষমতা দিয়ে হাভানা ছেড়ে মেক্সিকো থেকে পালিয়ে যান বাতিস্তা। ফিডেল হাভানায় পৌঁছলে তাঁকে অভ্যর্থনা জানায় লাখো মানুষ। ক্যাস্ট্রোর হাত ধরে সেদিন কিউবা প্রবেশ করে এক নতুন জগতে। উল্লেখের দাবি রাখে, বিপ্লবের পর ফিডেল ক্যাস্ট্রো নিজে সরাসরি ক্ষমতা গ্রহণ করেননি। অন্তর্র্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেয়া হয় বিচারপতি ম্যানুয়েল উরুশিয়াকে। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন হোসে কারডোনা। হোসে কারডোনা ছিলেন পেশায় একজন আইনজীবী। নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাতিস্তাবিরোধী ছিলেন। কিন্তু তাঁরা ছিলেন ধনিক শ্রেণিভুক্ত। স্বাভাবিক কারণেই সমাজ ও অর্থনীতি রূপান্তর নিয়ে ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মতপার্থক্য দেখা দেয়। সংস্কারবিরোধী অবস্থান নেয়ার কারণে জনতার প্রতিরোধের মুখে ম্যানুয়েল উরুশিয়া ও হোসে কারডোনা পদত্যাগ করেন।

ফিডেল ক্যাস্ট্রো, ১৯৫৯ সালে। ছবিসূত্র: উইকিপিডিয়া

১৯৫৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ক্যাস্ট্রো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। ১৯৫৯ সালের ২০ এপ্রিল বাতিস্তা সরকারের পতনের চার মাসের মাথায় এক আকস্মিক সফরে ফিডেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে হাজির হন। তাঁর যুক্তরাষ্ট্র সফরের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রবাসী কিউবানদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা, তাদের কাছে কিউবার জনগণের বার্তা পৌঁছে দেয়া। ফিডেল ক্যাস্ট্রো তখনও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য নন বা তখন তিনি নিজেকে কমিউনিস্ট বলে দাবিও করেন না। পাইনস দ্বীপের কারাগারে অবস্থানকালে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন মার্ক্সীয় সাহিত্যের সঙ্গে। ইতোমধ্যে সমাজতান্ত্রিক বলয়ে নিজের একটা অবস্থান করে নিয়েছেন তিনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সফরে ফিডেল ছিলেন ১৫ দিন। যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় সেখানকার পত্রিকায় ফিডেলের ছবিসহ বক্তৃতার নানা দিক প্রকাশ করা হয়। উল্লেখ থাকে যে বিব্রত প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার নিজে কিউবার এই অপ্রতিরোধ্য নেতার মুখোমুখি না দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রীয় প্রটোকলের সমস্ত দায়িত্ব দেন ভাইস প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ওপর। ফিডেলকে নিয়ে যাওয়া হয় প্রিস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি প্রিস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করেন অনেকটা অধ্যাপকের মেজাজ নিয়ে-শান্তভাবে। ফিডেল ক্যাস্ট্রোর যুক্তরাষ্ট্র সফরের শেষ আয়োজন ছিল নিউ ইয়র্ক সেন্ট্রাল পার্কে। ৬০ হাজার মানুষের বিশাল এক ঢেউ যেন সেদিন আছড়ে পড়েছিল নিউ ইয়র্ক সেন্ট্রাল পার্কে। ল্যাটিন আমেরিকার পোড় খাওয়া জনগোষ্ঠী সেদিন স্রোতের মত ছুটে এসেছিল নিউ ইয়র্ক সেন্ট্রাল পার্কে। ক্যাস্ট্রো সেদিন মঞ্চে উঠে নির্দ্বিধায় ঘোষণা করলেন-শুধু কিউবা নয়, গোটা ল্যাটিন আমেরিকা মুক্ত করাই তাঁর লক্ষ্য।

১৯৬০ সালের মে মাসে কিউবা সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র তৎক্ষণাৎ কিউবার সঙ্গে সমস্ত কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। ছোট্ট দ্বীপদেশ কিউবা তখন একে একে ছিন্ন করে যুক্তরাষ্ট্রের নাগপাশে দীর্ঘদিন আটকে থাকা তাদের অর্থনৈতিক শৃঙ্খল। কিউবা সরকার যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন তেলের খনি, ব্যাংকিং সেক্টর, চিনি শিল্পসহ সব বেসরকারি ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। প্রতিশোধ হিসাবে ১৯৬০ সালের অক্টোবর থেকে খাদ্য ও ওষুধ ছাড়া সমস্ত পণ্য কিউবায় রফতানি নিষিদ্ধ করে মার্কিন সরকার এবং ১৯৬১ সালের জানুয়ারি মাস থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি বিপ্লববিরোধী পলাতক কিউবানদের দিয়ে ‘কিউবান রেভল্যুশনারি সংগঠন’ গড়ে তোলেন। ক্যাস্ট্রোবিদ্বেষী কিছু কিউবান তাদের সশস্ত্র এই ইউনিটের নাম রাখে ‘ব্রিগেড ২৫০৬’।

১৯৬১ সালের ১৫ এপ্রিল বে অব পিগস অভিযানের আগে কিউবার দুটি বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায় সিআইএ। যুক্তরাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নিয়েছিল লাগাতার আক্রমণের মুখে কিউবাকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার। কিউবানদের জন্য সে সময়টা ছিল অগ্নিপরীক্ষা। সব কিউবাবাসীকে একেকজন যোদ্ধায় পরিণত করার বিকল্প আর তাদের হাতে ছিল না। ১৯৬১ সালের ১৬ এপ্রিল কিউবাকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করে কিউবার বিপ্লবী সরকার। ১৯৬১ সালের ১৭ এপ্রিল সিআইএ পরিচালিত এক হাজার ৫০০ সেনা কিউবার উপকূল বে অব পিগসে হামলা চালায়। ‘ব্রিগেড ২৫০৬’-এর সঙ্গে যোগ দেয় খোদ যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য। চে গুয়েভারা সে সময় বলেছিলেন, “প্রত্যেক কিউবানকেই গেরিলা হতে হবে। কিউবার সব নাগরিকের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র থাকতে হবে এবং প্রয়োজন পড়লে দেশের স্বার্থে তা ব্যবহার করতে হবে।” ৭২ ঘণ্টার সেই যুদ্ধে সিআইএর ঘাতক সেনাদল সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হয়ে যায় কিউবান লালফৌজের হাতে। যুক্তরাষ্ট্রের কুখ্যাত এই বাহিনীর এত বড় পরাজয় পৃথিবীর বুকে একটা বিরল ঘটনা। তিন দিন স্থায়ী এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন স্বয়ং ফিডেল ক্যাস্ট্রো। যুদ্ধ শেষে ৬০ জন আহত মার্কিন সেনাকে নিজ উদ্যোগে দেশে পাঠিয়ে দেন ক্যাস্ট্রো। জীবিত বাকি সেনাদের বিশেষ আদালতে বিচার করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয় কিউবা আদালত। পরে ফিডেলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের রফা অনুযায়ী ৫৩ মিলিয়ন ডলারের সমমূল্যের খাদ্য ও চিকিৎসা সামগ্রীর বিনিময়ে তাদের সকল সৈন্য দেশে ফেরত যায়। ১৯৬২ সালের ২৪ ডিসেম্বর কিউবা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধবন্দি বিনিময় সম্পন্ন করে।

বে অব পিগস আক্রমণ ব্যর্থ হয়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র অগ্রসর হয় চোরাগোপ্তা পথে। কিউবা আক্রমণের এবারের পরিকল্পনার নাম ‘কিউবান প্রজেক্ট’ রাখা হয়, পরে তা ‘অপারেশন মনগুজ’ নামে পরিচিত হয়। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কিউবার বিরুদ্ধে সিআইএর অপারেশন মনগুজ আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়, মার্চ মাসে তা প্রেসিডেন্ট কেনেডি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটি কাউন্সিলের অনুমোদন পায়। প্রেসিডেন্ট কেনেডির ভাই অ্যাটর্নি জেনারেল রবার্ট কেনেডি এই অপারেশনের সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পান। আর মূল অপারেশন পরিচালনা করেন সিআইএর সিনিয়র কর্মকর্তা-যথাক্রমে ল্যানস ডেল, হার্বে ও ফিটজারেল্ড। এঁদের কাজ ছিল কিউবার অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাতমূলক কাজ পরিচালনা করা। যার মধ্যে ছিল বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস করা, গুপ্তহত্যা চালানো ইত্যাদি। জন এফ কেনেডির প্রধান লক্ষ্য ছিল, যেভাবেই হোক কমরেড ফিডেল ক্যাস্ট্রোকে হত্যা করা। ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা আছে, সিআইএর কিউবাবিরোধী এই ভয়ংকর পরিকল্পনা কিভাবে একের পর এক ব্যর্থ হয়ে যায়। ক্যাস্ট্রোর বিরুদ্ধে ৬৩৮ বার হত্যা পরিকল্পনা করেও সফল হতে পারেনি ঘাতক যুক্তরাষ্ট্র।

১৯৬১ সালের জুলাই মাসে ফিডেল ক্যাস্ট্রোর নেতৃত্বাধীন ২৬ জুলাই মুভমেন্ট, রোকার নেতৃত্বাধীন পিপলস সোশ্যালিস্ট পার্টি এবং ১৩ মার্চ রেভল্যুশনারি ডাইরেক্টরি মিলিত হয়ে গঠিত হয় সম্মিলিত বিপ্লবী সংগঠন। ১৯৬১ সালেই এই সম্মিলিত বিপ্লবী সংগঠনটির নতুন নামকরণ করা হয় ‘সম্মিলিত কিউবান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি’। ১৯৬৫ সালের ৩ অক্টোবর এই সংগঠনের নাম ঘোষণা করা হয় ‘কমিউনিস্ট পার্টি অব কিউবা’। ফিডেল ক্যাস্ট্রো ১৯৬৫ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত কিউবান কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। শুধু কিউবা নয়, ফিদেল ক্যাস্ট্রো তত দিনে হয়ে উঠেছেন গোটা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মহান নেতা এবং গোটা বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদ এবং শোষণ-নিপীড়ন থেকে মুক্তির আন্দোলনের অনুপ্রেরণা।

তাহেরা বেগম জলি: লেখক, রাজনৈতিক সংগঠক।

ইমেইল: taherajolly@gmail.com

Social Share
  •  
  •  
  • 484
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *