করোনাভাইরাসের অর্থনীতি

করোনাভাইরাসের অর্থনীতি

মো. মনির

করোনাভাইরাসের প্রভাবে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে পড়ছে; বাধাগ্রস্ত হচ্ছে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য। বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে মারাত্মকভাবে। দেশ এখন দীর্ঘ মন্দার হুমকিতে। একদিকে কর্মহীনতা, অন্যদিকে সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ এখন দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে। পণ্য পরিবহনের সংকট বাণিজ্যিক কৃষিকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। পোশাক শিল্পের অনিশ্চয়তা এবং কারখানা মালিকদের হয়রানি পোশাক শ্রমিকদের আর্থিক ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি দুইই বাড়িয়েছে। সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ ব্যবসায়ীদের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে সুফল বয়ে আনার সম্ভাবনা থাকলেও তাৎক্ষণিকভাবে তা মোটেও জনবান্ধব নয়। বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এই মুহূর্তে প্রয়োজন খাবার ও স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা। প্রয়োজন এখন জিডিপিকেন্দ্রিক উন্নয়ন দর্শন থেকে বের হয়ে এসে মানুষকেন্দ্রিক উন্নয়ন ভাবনার।

ভূমিকা

করোনা ভাইরাস রোগ ২০১৯ বা কোভিড-১৯ মানুষের একটি সংক্রামক ব্যাধি, যা গুরুতর তীব্র শ্বাসযন্ত্রীয় রোগলক্ষণসমষ্টি সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাস-২ (সার্স-কোভ-২) নামক এক ধরনের ভাইরাসের আক্রমণে হয়ে থাকে। সর্বপ্রথম ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহরে ধরা পড়ে।[১] বর্তমানে সারা বিশ্বের ১৮৫ দেশে এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে। রোগটিতে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৮ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং ১ লাখ ১০ হাজারের অধিক মানুষ মারা গিয়েছে। প্রতিদিনই সংখ্যাগুলো জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। এদিকে বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় মার্চ মাসের ৮ তারিখে। এখন পর্যন্ত (এপ্রিল ১২) দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪৮২, যার মধ্যে মারা গিয়েছে ৩০ জন। এই মুহূর্তে দেশের ৩১টি জেলায় শনাক্ত হয়েছে এই রোগ।[২] বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন) একে অতিমারি (প্যানডেমিক) ঘোষণা করেছে।

বিশ্বে অর্থনীতিতে এই ভাইরাসের ব্যাপ্তি ও প্রভাব অসীম। করোনার প্রকোপে দেশগুলো কার্যত একে অপরের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। এই ভাইরাসের কারণে পর্যদুস্ত বিশ্ব অর্থনীতি। সমগ্র বিশ্বের সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে পড়েছে। মোটরগাড়ি শিল্প, শেয়ারবাজার, পর্যটন শিল্প, তেলের বাজার- সবকিছুতেই এই ভাইরাসের কারণে দেখা যাচ্ছে মন্দা। ইতোমধ্যেই আইএমএফ বর্তমান পরিস্থিতিকে ১৯৩০-এর বিশ্ব মহামন্দার পর সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা বলে বিবৃতি দিয়েছে। অন্যদিকে দ্য চ্যারিটি জানিয়েছে, করোনা শেষে বিশ্বের অর্ধেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে। বিশ্ব শ্রম সংস্থা আইএলও বলছে, করোনার কারণে প্রায় ২০ কোটি মানুষের পূর্ণকালীন শ্রমের সমান শ্রম বিনষ্ট হচ্ছে। সংস্থাটি বর্তমান পরিস্থিতিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সবচেয়ে ভয়াবহ সংকট হিসেবে উলে­খ করেছে।[৩]

ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও মন্দা শুরু হয়েছে। আমদানি-রফতানি বাণিজ্য, কৃষি, পরিবহন, শেয়ারবাজার, ব্যাংকিং, পর্যটনসহ প্রায় সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে শুরু হয়েছে অচলাবস্থা। কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ আজ কর্মহীন। ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে দেশের মানুষের বিরাট একটা অংশ অর্ধাহারে কিংবা অনাহারে দিনাতিপাত করছে। অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের গবেষণা বলছে, করোনা পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে ছয় মাসে জিডিপির ৭% ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, আর টুলুস স্কুল অব ইকোনমিকসের হিসাব অনুযায়ী ক্ষতির পরিমাণ ১০%-এর বেশি হতে পারে।[৪],[৫] এডিবি বলছে, করোনার কারণে কর্মহীন হতে পারে দেশের ৯০ লাখ লোক। মন্দার কারণে বাংলাদেশে অর্থনীতির ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু বাস্তবে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি, যা ইতোমধ্যে প্রতীয়মান।

নিচে বাংলাদেশে অর্থনীতির যেসব খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার ওপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হল :

বাজেট ঘাটটি বৃদ্ধিঃ চলতি অর্থবছরে ৫ লক্ষ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার ব্যয়ের বিপরীতে ৩ লক্ষ ৮১ হাজার কোটি টাকার আয়ের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ঘাটতি ছিল ১ লক্ষ ৪১ হাজার ২১২ কোটি টাকা। করোনা ভাইরাসের কারণে এই ঘাটতি আরো বাড়বে। একদিকে প্রণোদনা, স্বাস্থ্য এবং ত্রাণের জন্য সরকারি খরচ বাড়বে, অন্যদিকে অর্থনীতির স্থবিরতার কারণে রাজস্ব আয় কমবে। সরকারি ঋণ বাড়বে, বাড়বে ঋণ সংকটের ঝুঁকি।
রাজস্ব আয় হ্রাস: ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসের কারণে রাজস্ব আহরণ কমেছে। চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত এনবিআর তার রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২২.৮৫ শতাংশ কম রাজস্ব আহরণ করতে পেরেছে। মার্চের শুরুতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর থেকে রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক। আমদানি-রফতানি বাণিজ্য হ্রাস, আয়কর রিটার্ন জমা দিতে না পারা, এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে রাজস্ব আয় কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। ২০২০ সালে বাংলাদেশের ১ লাখ কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি ইতোমধ্যে। ফলে বাজেট বাস্তবায়নের ওপর চাপ বাড়ছে, সরকারের ঋণ ঝুঁকি বাড়ছে।
রপ্তানি আয় হ্রাস : চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে রফতানি আয় কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ। এই ছয় মাসে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কম হয়েছে ১৩ শতাংশ।[৬] জানুয়ারিতে চীনে করোনা সংক্রমণের পর থেকে রফতানি আয় কমে অর্ধেক হয়েছে। বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের প্রধান ক্রেতা ইউরোপসহ পশ্চিমা সব দেশ করোনায় বিপর্যস্ত। তৈরি পোশাক, চামড়া, চামড়াজাত পণ্য, প্রসাধন, বৈদ্যুতিক পণ্য, কম্পিউটার, পাট সুতা, মুদ্রণ শিল্প, চিকিৎসা সরঞ্জাম, ইলেকট্রনিক পণ্য, কাঁকড়া, কুঁচে, চশমাসহ বিভিন্ন রফতানিমুখী শিল্পের আয়ে ভাটা পড়েছে।
রেমিটেন্স আয় হ্রাস : রেমিটেন্সের উৎস দেশগুলোতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে গত কয়েক মাসে প্রবাসী আয় কমেছে। কেবল মার্চ মাসেই প্রবাসী আয় কমেছে ১২ শতাংশ।[৭] সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইতালি, কানাডা, জাপান, হংকং, আরব আমিরাতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে এ ভাইরাস। এসব দেশে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্থবির হয়ে পড়েছে। অনেক দেশ থেকে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। ফলে সব মিলিয়ে রেমিটেন্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
পর্যটন শিল্পে ধস : করোনাভাইরাসের কারণে দেশের পর্যটন খাতের আয় প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে। এ খাতের অনুমিত মোট ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৯৭ বিলিয়ন টাকা।[৮] হজ, হোটেল, মোটেল, বিমান, ট্রাভেল এজেন্ট, ট্যুর অপারেটর, রেস্টুরেন্ট, পরিবহনসহ পর্যটন নির্ভর অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়েছে। আগে তারকা হোটেলগুলোর ৭০ থেকে ৮০ ভাগ বুকিং থাকত সর্বদা। করোনার প্রভাবে তা এখন শূন্যের কোঠায় পৌঁছেছে। এই খাতের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট মানুষরা হয়েছেন কর্মহীন।
ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট বৃদ্ধি : করোনার কারণে আগামী জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ আদায় এবং নিয়মিত ঋণের কিস্তি আদায়েও নানা বিধি-নিষেধ রয়েছে। এ অবস্থায় খেলাপি ঋণ ও নিয়মিত ঋণের কিস্তি আদায় করতে না পারলে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট সৃষ্টি হবে। এ ছাড়াও ব্যাংকের ডিপোজিট অনেক দিন আগে থেকেই কমছে। বর্তমান অবস্থায় ব্যাংকের ডিপোজিট আরও কমে যাবে। ফলে দেশের ব্যাংকিং খাতে আরও বিপর্যয় নেমে আসবে।
বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয়বৃদ্ধি : পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, মেট্রো রেল, পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র্র্র, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল সংযোগ, কর্ণফুলী টানেল, ঢাকা বাইপাস সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত আছেন ২০ হাজারের অধিক বিদেশি নাগরিক। এর মধ্যে প্রায় ৮ হাজার চীনা নাগরিক কাজ করছেন। আর সব মিলিয়ে মোট ১০ হাজার চীনা নাগরিক এখানে রয়েছেন।[৯] করোনাভাইরাসের কারণে বেশির ভাগ প্রকল্পের কাজই বন্ধ আছে। এ কারণে এসব প্রকল্প শেষ হতে দেরি হবে। ফলে বাড়বে প্রকল্প ব্যয়।

আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে করোনাভাইরাসের প্রভাব

করোনাভাইরাসের কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য। এরই মধ্যে ভেঙে পড়েছে বৈদেশিক বাণিজ্যের সাপ্লাই চেইন। রফতানি বাণিজ্যে ধস শুরু হয়েছে, আমদানি পণ্যের সরবরাহ কমে যাওয়ায় মূল্য বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। আমদানি নির্ভর শিল্পের কাঁচামলের সংকটে বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেক কারখানা। তৈরি পোশাক, চামড়া, চামড়াজাত পণ্য, প্রসাধন, বৈদ্যুতিক পণ্য, কম্পিউটার, পাট, সুতা, মুদ্রণ শিল্প, চিকিৎসা সরঞ্জাম, ইলেকট্রনিক পণ্য, কাঁকড়া, কুঁচে, চশমাসহ বিভিন্ন শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পোশাক শিল্পের মত অন্যান্য শিল্পও চীনের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। ফেব্রিকস, রঙ, ওষুধ, খাদ্যপণ্য, প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন শিল্পের জন্য দেশে প্রতিদিন রাসায়নিক দ্রব্যের চাহিদা রয়েছে ১৮ থেকে ২০ হাজার টন, যার ৮০ শতাংশই আসে চীন থেকে। ভাইরাসের কারণে সব ধরনের রাসায়নিকের দাম ইতোমধ্যেই বেড়ে গেছে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে আগামী ৫ থেকে ৬ মাস যদি চীন থেকে পণ্য না আসে বা বন্ধ থাকে তাহলে রফতানি খাতে ১২শ থেকে ১৫শ কোটি টাকার সমূহ ক্ষতি হবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ গার্মেন্টস এক্সেরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএপিএমইএ)।[১০] দেশের শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য থেকে শুরু করে যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ এবং নিত্যব্যবহার্য নানা পণ্যের বড় উৎস চীন।

এরই মধ্যে ভেঙে পড়েছে বৈদেশিক বাণিজ্যের সাপ্লাই চেইন। রফতানি বাণিজ্যে ধস শুরু হয়েছে, আমদানি পণ্যের সরবরাহ কমে যাওয়ায় মূল্য বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। আমদানি নির্ভর শিল্পের কাঁচামলের সংকটে বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেক কারখানা। তৈরি পোশাক, চামড়া, চামড়াজাত পণ্য, প্রসাধন, বৈদ্যুতিক পণ্য, কম্পিউটার, পাট, সুতা, মুদ্রণ শিল্প, চিকিৎসা সরঞ্জাম, ইলেকট্রনিক পণ্য, কাঁকড়া, কুঁচে, চশমাসহ বিভিন্ন শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পোশাক শিল্পের মত অন্যান্য শিল্পও চীনের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। ফেব্রিকস, রঙ, ওষুধ, খাদ্যপণ্য, প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন শিল্পের জন্য দেশে প্রতিদিন রাসায়নিক দ্রব্যের চাহিদা রয়েছে ১৮ থেকে ২০ হাজার টন, যার ৮০ শতাংশই আসে চীন থেকে।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ শিল্প এবং ইলেকট্রনিক্সসহ মোট ১৪টি খাত চিহ্নিত করে সরকারকে এক রিপোর্ট পাঠিয়েছে, যাতে বলা হয়েছে চীনের সঙ্গে আমদানি ও রফতানি উভয় খাতে আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।[১১]

  • তৈরি পোশাকের মধ্যে নিট খাতের ডাইং ও কেমিক্যাল এবং অন্যান্য অ্যাক্সেসরিজের ৮০-৮৫ শতাংশ আমদানি নির্ভর এবং সেগুলো চীন থেকে আসে। এর বাইরে ওভেন খাতের ৬০ শতাংশ আসে চীন থেকে।
  • গার্মেন্টস অ্যাক্সেসরিজ, প্যাকেজিং খাতে চার বিলিয়ন ডলারের কাঁচামাল দরকার হয়, এই খাতে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
  • ভোগ্যপণ্যের মধ্যে ১৭টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, যেমন- রসুন, আদা, লবণ, মসুর ডাল, ছোলা, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ আমদানি হয় চীন থেকে।
  • ফিনিশড লেদার ও লেদার গুডস অর্থাৎ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের জন্য আঠা, ধাতব লাইনিং ও অ্যাক্সেসরিজের ৬০ শতাংশ আমদানি হয় চীন থেকে। এ খাতে তিন হাজার কোটি টাকার মত ক্ষতি হবে।
  • বাংলাদেশ থেকে সামুদ্রিক মাছ অর্থাৎ কাঁকড়া ও কুঁচে মাছ রফতানি হয়, এর ৯০ শতাংশই যায় চীনে।
  • ইলেকট্রিক্যাল, মার্চেন্ডাইজ ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের ৮০-৮৫ শতাংশ যন্ত্রাংশ ও কাঁচামাল চীন থেকে আসে।
  • পাট স্পিনিং খাতে প্রতিবছর বাংলাদেশ চীনে ৫৩২ কোটি টাকার পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে। করোনাভাইরাসের কারণে এখন ক্ষতির পরিমাণ কত হবে তা নিরূপণের কাজ চলছে।
  • মেডিক্যাল ইনস্ট্রূমেন্টস ও হসপিটাল ইকুইপমেন্ট তৈরি শিল্পের যন্ত্রাংশ চীন থেকে আমদানি হয়।
  • কসমেটিকস অ্যান্ড টয়লেট্রিজ খাতে প্রতি মাসে ৭৫ কোটি টাকা মূল্যের পণ্য আমদানি হয়, যা এখন বন্ধ রয়েছে।

তথ্য : বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন, সূত্র : বিবিসি

প্রবাসী আয়ে ধস

মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকায় দীর্ঘদিন ধরে চলছে অচলাবস্থা। বন্ধ রয়েছে অধিকাংশ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। প্রবাসী অধ্যুষিত এই দেশগুলোতে লকডাউন থাকার কারণে গত মার্চ মাসে প্রবাসী আয় কমেছে প্রায় ১২ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চে আয় এসেছে ১২৮ কোটি ৬৮ লাখ ডলার। গত বছরের মার্চ মাসে এসেছিল ১৪৫ কোটি ৮৬ লাখ ডলার। আয় কমেছে ১১.৭৮ শতাংশ। গত ফেব্র“য়ারিতেও ১৪৫ কোটি ডলারের আয় এসেছিল। আর দেশে গত ডিসেম্ব^রে প্রবাসী আয় এসেছিল ১৬৯ কোটি ডলার, যা জানুয়ারিতে ৫ কোটি ডলার কমে নেমে যায় ১৬৪ কোটি ডলারে।[১২] দেশের প্রবাসী আয় আহরণের শীর্ষ ১৫টি উৎস দেশ হল সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), যুক্তরাষ্ট্র, কুয়েত, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, ওমান, কাতার, ইতালি, বাহরাইন, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া ও জর্ডান। জানা গেছে, যেসব দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় আসে, সেসব দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে রেমিট্যান্স হাউস ও ব্যাংকগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। বাংলাদেশি শ্রমিকরাও পড়েছেন বিপদের মুখে।

আর ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় যেসব মাস্ক এন৯৫ বলে বিক্রি হচ্ছে তা আসলে ননওভেন প্লাস্টিক কাপড়ের তৈরি। এ ধরনের কাপড় দিয়ে সাধারণত সস্তা শপিং ব্যাগ তৈরি করা হয়। এ ধরনের মাস্ক মানব শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এইসব মাস্ক জীবাণুর আক্রমণ প্রতিহত করতে তো পারেই না, বরং এর মাইক্রোপ্লাস্টিক ফুসফুসে গিয়ে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও দুর্বিষহ জনজীবন

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়ার পর থেকেই বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। চাল, ডাল, চিনি, পেঁয়াজ, আলু, ভোজ্যতেল, সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, জীবাণুনাশকসহ নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদির দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে। পেঁয়াজ, রসুন, আলুসহ বেশ কিছু সবজির দাম কমলেও চাল, ডাল, চিনি, তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। বাজারে এখন প্রতি কেজি মোটা চাল ৩৮ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা নভেম্বর মাসেও গড়ে ৩২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মাঝারি বিভিন্ন চাল পাওয়া যাচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা দরে, যা আগে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় পাওয়া যেত। সরু চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা। দুই মাস আগে যে মোটা ডাল কেজি প্রতি বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকা দরে, তা বেড়ে হয়েছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। মাঝারি দানার মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ টাকা দরে, যা দুই মাস আগেও ৭০ থেকে ৮০ টাকায় পাওয়া যেত। বছরের শুরুতেও ১ লিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকা দরে, করোনা সংক্রমণের পর তা বেড়ে এখন হয়েছে ৯৫ থেকে ৯৭ টাকা প্রতি লিটার।[১৩] স্থানীয় ফার্মেসিগুলোতে সার্জিক্যাল মাস্ক পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও কোথাও নিম্নমানের সার্জিক্যাল মাস্ক ৩০ থেকে ৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, যেখানে আগে ভাল মানের সার্জিক্যাল মাস্কের খুচরা মূল্য ছিল ৫ টাকা। আর ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় যেসব মাস্ক এন৯৫ বলে বিক্রি হচ্ছে তা আসলে ননওভেন প্লাস্টিক কাপড়ের তৈরি। এ ধরনের কাপড় দিয়ে সাধারণত সস্তা শপিং ব্যাগ তৈরি করা হয়। এ ধরনের মাস্ক মানব শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এইসব মাস্ক জীবাণুর আক্রমণ প্রতিহত করতে তো পারেই না, বরং এর মাইক্রোপ্লাস্টিক ফুসফুসে গিয়ে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। ৪০ টাকার হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়, তাও অপ্রতুল।

শ্রমজীবী মানুষের ওপর করোনাভাইরাসের প্রভাব

করোনা মহামারিতে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে জীর্ণশীর্ণভাবে বসবাস করা লাখ লাখ বস্তিবাসী। ঝুঁকি যতই থাকুক দিন এনে দিন খাওয়া এসব মানুষের জন্য ঘরে বসে থাকা এক ধরনের বিলাসিতা। জীবন-জীবিকার তাগিদে সর্বদা মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয় তাদেরকে। বিবিএসের সর্বশেষ বস্তি শুমারি অনুযায়ী দেশে মোট বস্তির সংখ্যা ১৩ হাজার ৯৩৫। একই সূত্র অনুযায়ী বস্তি ও ভাসমান খানার সংখ্যা ৫ লাখ ৯৪ হাজার ৮৬১। এর মধ্যে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় রয়েছে ৪ লাখ ৩১ হাজার ৭৫৬টি, পৌরসভা এলাকায় ১ লাখ ৩০ হাজার ১৪৫টি এবং ৩২ হাজার ৯৬০টি খানা রয়েছে অন্যান্য এলাকায়।[১৪] মানবেতর জীবন যাপন করা এই বস্তিবাসীকে বলা যায় শহর বা নগর অঞ্চলের সেবা সরবরাহের ব্লাড লাইন। কুলি, মজুর, নির্মাণ শ্রমিক, নাপিত, মুচি, ভ্যানওয়ালা, বাদামওয়ালা, বাসের হেলপার, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, রিকশাচালক, কাঠের কারিগর, দোকানি, সবজিওয়ালা, ফুটপাতের হকার, ঠিকা বুয়া, গার্মেন্টসকর্মী, পেপারওয়ালা, প্লাম্বার, নছিমনচালক। একটা গোটা শহরকে সচল রাখা হাজারখানেক পেশার মানুষের বাস বস্তিতে। প্রতিটি কাজের জন্যই এইসব মানুষকে জনসংস্পর্শে আসতে হয়। এতে তারা নিজেরা যেমন ঝুঁকিতে আছেন, তেমনি অন্যদের জন্য হচ্ছেন ঝুঁকির কারণ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) গবেষণা বলছে, রাজধানীর ৯৫ শতাংশ বস্তিবাসী প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার পায় না। সবচেয়ে দরিদ্র বস্তিবাসীদের দৈনিক খাবারের পিছনে মাথাপিছু ব্যয় মাত্র ৩৩ টাকা। ভোরে কাজের জন্য ঘর ছাড়া আর দিনশেষে কিছু সামান্য উপার্জন নিয়ে ঘরে ফেরা। নেই কোন সঞ্চয়। দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর লাখ লাখ বস্তিবাসী এখন কর্মহীন। ত্রাণের জন্য চলছে হাহাকার। কেউ কেউ করোনার ঝুঁকি নিয়ে বেরিয়ে পড়ছেন এক বেলা খাবারের ব্যবস্থার জন্য। বস্তিতে পাশাপাশি লাগোয়া এক একটি কক্ষে গড়ে ৪ জন মানুষের বাস। একবার করোনার সংক্রমণ শুরু হলে রক্ষা নেই কারও।

মানবেতর জীবন যাপন করা এই বস্তিবাসীকে বলা যায় শহর বা নগর অঞ্চলের সেবা সরবরাহের ব্লাড লাইন। কুলি, মজুর, নির্মাণ শ্রমিক, নাপিত, মুচি, ভ্যানওয়ালা, বাদামওয়ালা, বাসের হেলপার, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, রিকশাচালক, কাঠের কারিগর, দোকানি, সবজিওয়ালা, ফুটপাতের হকার, ঠিকা বুয়া, গার্মেন্টসকর্মী, পেপারওয়ালা, প্লাম্বার, নছিমনচালক। একটা গোটা শহরকে সচল রাখা হাজারখানেক পেশার মানুষের বাস বস্তিতে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, দেশে প্রায় ২ কোটি ৪২ লাখ মজুরি ও বেতনভুক শ্রমিক রয়েছেন। এর মধ্যে দৈনিক ভিত্তিতে মজুরি পান প্রায় ৮৩ লাখ ৩২ হাজার শ্রমিক। এছাড়া সাপ্তাহিক মজুরি পান ১৭ লাখ ৭২ হাজার শ্রমিক। সব মিলিয়ে প্রায় ১ কোটি ১ লাখ শ্রমিক দৈনিক কিংবা সাপ্তাহিক ভিত্তিতে মজুরি নিয়ে থাকেন। তবে এ তালিকায় আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত কিংবা পারিবারিক অর্থায়নে হেলপার হিসেবে যাঁরা আছেন, তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অন্যদিকে কৃষি খাতে প্রায় ৭২ লাখ ৯২ হাজার শ্রমিক রয়েছেন।[১৫] করোনাভাইরাসের কারণে প্রথম নেতিবাচক প্রভাবটা পড়ছে এই শ্রমজীবী মানুষদের ওপর। সরকারঘোষিত সাধারণ ছুটিতে বন্ধ হয়ে গিয়েছে কার্যত সবকিছু। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়ার ওপর রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। করোনার ঝুঁকি উপেক্ষা করে, কেবল পেটের দায়ে এই শ্রমজীবীদের অনেককে বের হতে হচ্ছে জীবিকার সন্ধানে। বের হয়ে কখনো আবার সহ্য করতে হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বা প্রশাসকদের লাঠির আঘাত কিংবা কান ধরে উঠবস।

গত ৩১ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল সমগ্র বাংলাদেশের ২ হাজার ৬৭৫ জন নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর করোনার প্রভাব নিয়ে মাঠ পর্যায়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে অংশ নেয়া ১৪ শতাংশ মানুষের ঘরে কোন খাবার নেই, আর ১ থেকে ২ দিনের খাবার আছে মাত্র ২৯ শতাংশ মানুষের ঘরে। চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৬০ শতাংশ। দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ২৪ শতাংশ মানুষ ছিল দারিদ্র্যরেখার নিম্নসীমার নিচে এবং ৩৫ শতাংশ ছিল দারিদ্র্যরেখার ঊর্ধ্বসীমার নিচে। করোনার আগে এই সকল মানুষের মাসিক গড় আয় ছিল ১৪ হাজার ৫৯৯ টাকা। করোনা সংক্রমণের পর তাদের গড় আয় কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৭৪২ টাকায়। জরিপে অংশ নেয়া মানুষদের ৯৩ শতাংশেরই আয় কমেছে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ৭২ শতাংশ মানুষ তাদের কর্ম হারিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অকৃষি খাতে নিয়োজিত দিনমজুররা। এই খাতের ৭৭ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছে। এর পরই রয়েছে কৃষিকাজে সম্পৃক্তরা- ৬৫ শতাংশ । ৫১ শতাংশ রিকশাচালক, ৫৮ শতাংশ কারখানা শ্রমিক, ৬২ শতাংশ দিনমজুর, ৬৬ শতাংশ হোটেল/রেস্তোরাঁকর্মী জানান, চলতি মাসে তাঁদের আয় নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়।

জরিপে অংশ নেয়া ১৪ শতাংশ মানুষের ঘরে কোন খাবার নেই, আর ১ থেকে ২ দিনের খাবার আছে মাত্র ২৯ শতাংশ মানুষের ঘরে। চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৬০ শতাংশ।

চিত্রঃ করোনা ভাইরাসের সাথে দুর্ভিক্ষ ঝুঁকির সম্পর্ক

কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের প্রভাব

করোনাভাইরাসের কারণে শাক-সবজি ও দুধের মত দ্রুত পচনশীল কৃষিপণ্য নিয়ে বিপাকে রয়েছেন কৃষক ও খামারিরা। পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও শহরকেন্দ্রিক বাজারগুলোতে ক্রেতার সংখ্যা উলে­খযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় বাজারে চাহিদা কমে গিয়েছে। প্রান্তিক চাষি ও ক্ষুদ্র খামারিরা যারা বাণিজ্যিকভাবে এই সকল কৃষিপণ্য উৎপাদন করে থাকেন, বাধ্য হয়ে তাঁরা নামমাত্র মূল্যে স্থানীয় হাটবাজারে বিক্রি করছেন।

দেশে বর্তমানে কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত ২ কোটি ৪৩ লাখ ৯২ হাজারের অধিক মানুষ। এর মধ্যে ৮৮ লাখ পারিবারিক কৃষি যোগাল (হেলপার) হিসেবে কাজ করেন, যা মোট কৃষি শ্রমিকের ৩৬ শতাংশ। ৩৩ শতাংশ মানুষ রয়েছেন স্ব-কর্মসংস্থানে নিয়োজিত। এবং ৩১ শতাংশের অধিক মানুষ অর্থাৎ ৭২ লাখের অধিক মানুষ করেন কৃষি শ্রমিকের কাজ। [১৭] কৃষিকাজ আংশিক সচল থাকায় সবাই কর্মহীন হননি সত্য, কিন্তু সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে রয়েছে সর্বশেষ শ্রেণিটি অর্থাৎ যারা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কৃষিজমিতে কাজ করেন বা শ্রম বিক্রি করেন।

প্রান্তিক কৃষক ফসলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। পত্রিকার প্রকাশিত খবর বলছে, বগুড়ার যে কৃষক স্বাভাবিক সময়ে এক কেজি শসা বিক্রি করেছেন ২০ থেকে ২৫ টাকা দরে, করোনাভাইরাসে বাজার পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পর ৫২ কেজির এক বস্থা শসা বিক্রি করছেন মাত্র ৩০ টাকায়। কেজি প্রতি শসার মূল্য দাঁড়াচ্ছে মাত্র ৫০ পয়সার মত। অথচ এক বিঘা শসা চাষ করতে কৃষকের খরচ ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। [১৮]

প্রান্তিক কৃষক ফসলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। পত্রিকার প্রকাশিত খবর বলছে, বগুড়ার যে কৃষক স্বাভাবিক সময়ে এক কেজি শসা বিক্রি করেছেন ২০ থেকে ২৫ টাকা দরে, করোনাভাইরাসে বাজার পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পর ৫২ কেজির এক বস্থা শসা বিক্রি করছেন মাত্র ৩০ টাকায়। কেজি প্রতি শসার মূল্য দাঁড়াচ্ছে মাত্র ৫০ পয়সার মত। অথচ এক বিঘা শসা চাষ করতে কৃষকের খরচ ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা।

করোনার প্রভাব পড়েছে গ্রীষ্মের অন্যতম দেশীয় ফল তরমুজ চাষিদের ওপরও। গলাচিপার যে কিষানি গত বছর পাইকারি ৩০ টাকা দরে তরমুজ বিক্রি করেছেন, এ বছর তিনি ১০ থেকে ১২ টাকায় ক্রেতা খুঁজে পাচ্ছেন না। তিন কানি জমিতে তরমুজ চাষ করে আয় হয় ৪ লাখ টাকা। সার, কীটনাশক, সেচ আর শ্রমিকের খরচসহ ব্যয় হয় ৩ লাখ টাকা। [১৯] কিন্তু এবার তরমুজের দাম না থাকায় কোথা থেকে পরিশোধ করবেন বাকিতে কেনা কৃষি উপকরণের মূল্য আর কিভাবে পরিবার-পরিজনের পেট চালাবেন, সে উত্তর জানা নেই এই কিষানির।

বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে শহরাঞ্চলগুলোতে ক্রেতার কম উপস্থিতি এবং পণ্য পরিবহনের সংকটের কারণে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শাক-সবজির বাজারে। বাণিজ্যিকভাবে শাক-সবজি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বগুড়া দেশের অন্যতম শীর্ষ জেলা। বর্তমানে বগুড়ার স্থানীয় পাইকারি বাজারগুলোতে শাক-সবজি বিক্রি হচ্ছে পানির দরে। [২০] ২৯ মার্চ মহাস্থান পাইকারি বাজারে কেজি প্রতি বেগুন বিক্রি হয়েছে ২ টাকা, মুলা ১ টাকা, শসা ৫ টাকা, টমেটো ৫ টাকা, ফুলকপি ৫ টাকা, বাঁধাকপি ৩ টাকা দরে। বাজারে আগে যেখানে ২ থেকে ৩ হাজার পাইকার আসত, করোনার প্রাদুর্ভাব ছড়ানোর পর তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ জনে। [২১]

২৯ মার্চ মহাস্থান পাইকারি বাজারে কেজি প্রতি বেগুন বিক্রি হয়েছে ২ টাকা, মুলা ১ টাকা, শসা ৫ টাকা, টমেটো ৫ টাকা, ফুলকপি ৫ টাকা, বাঁধাকপি ৩ টাকা দরে।

চৈত্র মাস দেশি পেঁয়াজ উত্তোলনের মৌসুম। দেশে চাষ হওয়া পেঁয়াজের ৭০ শতাংশই উত্তোলিত হয় এই সময়ে। গত বছর নিষেধাজ্ঞার কারণে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি না হওয়ায় প্রায় সারা বছরই পেঁয়াজের বাজারমূল্য ছিল চড়া। স্বাভাবিক মূল্য কেজি প্রতি ৩০-৪০ টাকা থেকে বেড়ে ২৫০ টাকায় বিক্রি হওয়ার রেকর্ড হয়েছে। বাজারের মূল্য চক্র মেনে এবারে পেঁয়াজের চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে উলে­খযোগ্য হারে। রবিশস্য কিংবা ধানি জমিতেও পেঁয়াজের চাষ হয়েছে এই মৌসুমে। রমজান মাস সামনে রেখে কৃষকের প্রত্যাশা ছিল ভাল দামে পেঁয়াজ বিক্রির। কিন্তু চলমান করোনাভাইরাসের কারণে কৃষক পেঁয়াজের ভাল মূল্য পাবেন না তা এক ধরনের নিশ্চিত। বর্তমানে কৃষক পর্যায়ে পেঁয়াজের পাইকারি বাজারদর মাত্র ১০ থেকে ১৫ টাকা। শহরাঞ্চলে খুচরা মূল্য ৩০ থেকে ৪০ টাকা। সামনে বৃষ্টির মৌসুম হওয়ায় এবং অধিকাংশ কৃষকের কাছে পেঁয়াজের যথাযথ সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায়, নাম মাত্র মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। ফলে ব্যাপক আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন পেঁয়াজ চাষিরা।[২২]

বাজারের মূল্য চক্র মেনে এবারে পেঁয়াজের চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে উলে­খযোগ্য হারে। রবিশস্য কিংবা ধানি জমিতেও পেঁয়াজের চাষ হয়েছে এই মৌসুমে। রমজান মাস সামনে রেখে কৃষকের প্রত্যাশা ছিল ভাল দামে পেঁয়াজ বিক্রির। কিন্তু চলমান করোনাভাইরাসের কারণে কৃষক পেঁয়াজের ভাল মূল্য পাবেন না তা এক ধরনের নিশ্চিত। বর্তমানে কৃষক পর্যায়ে পেঁয়াজের পাইকারি বাজারদর মাত্র ১০ থেকে ১৫ টাকা। শহরাঞ্চলে খুচরা মূল্য ৩০ থেকে ৪০ টাকা।

কৃষি ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের কারণে আরেটি বড় সংকট ধান কাটার জন্য পর্যাপ্ত শ্রমিকের সরবরাহ নিয়ে। পাহাড়ি ঢল আর আর আগাম বন্যার ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি শঙ্কায় রয়েছে হাওড় অঞ্চলের ধান চাষিরা। সামনেই বোরো ধান কাটার মৌসুম। চলতি বোরো মৌসুমে দেশে ৪১ লাখ ২৮ হাজার ৫৪৮ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছে, যার প্রায় ২৩ শতাংশই হয়েছে হাওড় অঞ্চল হিসেবে পরিচিত সাত জেলা সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এসব অঞ্চলে এরই মধ্যে হাইব্রিড জাতের কিছু ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে। পুরোদমে বোরো ধান কাটা শুরু হয় ১৫ এপ্রিলের পর থেকে। যদিও এ সময়েই সিলেট অঞ্চলে শুরু হয় বৃষ্টি। বৃষ্টি আর ঢলের কারণে হাওরে দেখা দেয় আগাম বন্যা। প্রতিবছর ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও উত্তরাঞ্চল থেকে প্রচুর মৌসুমি শ্রমিক হাওরাঞ্চলে যান ধান কাটতে। ব্যাপারী বা ঠিকাদারের মাধ্যমে আনা হয় এসব শ্রমিক। কিন্তু এবার করোনাভাইরাসের শঙ্কায় ধান কাটতে আসতে পারছেন না তাঁরা। উচ্চমজুরি দিয়েও শ্রমিক মিলছে না। অন্যান্য বছর বন্যার হাত থেকে ফসল রক্ষায় অধিক শ্রমিক দিয়ে তড়িঘড়ি করেই ধান কাটিয়ে নিলেও এবার সেক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে চলমান লকডাউন। [২৩]

হাঁস-মুরগি ও ডিম উৎপাদন শিল্পে করোনার প্রভাব

করোনাভাইরাসের প্রভাবে হুমকির মুখে পড়েছে হাঁস-মুরগি ও ডিম উৎপাদন শিল্প। পোলট্রি খাদ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় অনেক খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বড় সমস্যা হল, পরীক্ষাগার বন্ধ থাকায় আমদানি করা পোলট্রি ফিডের কাঁচামাল সরবরাহ হচ্ছে না। পর্যাপ্ত পোলট্রি খাদ্য সরবরাহ না থাকায় খামারিরা মুরগি ও ডিম বিক্রি করে দিচ্ছেন। ফলে বাজারে চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত সরবরাহ থাকায় মুরগি ও ডিমের দাম কমেছে। যেখানে স্বাভাবিক সময়ে একটি ডিম বিক্রি হয়েছে ৮ টাকা দরে, করোনার প্রভাবে তা এখন অর্ধেকে নেমে বিক্রি হচ্ছে ৪ থেকে ৫ টাকা দরে। কোন কোন স্থানে অবিক্রীত ১ দিন বয়সী মুরগির বাচ্চাগুলোকে পুঁতে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে ইতোমধ্যে। নানা গুজবের কারণেও এসব পণ্যের চাহিদা কমেছে। এতে মাংস ও ডিম অবিক্রীত থাকছে ৬০-৭০ শতাংশ। ফলে নতুন করে খামারিরা মুরগির বাচ্চা তুলছেন না। [২৪] হ্যাচারিগুলোর উৎপাদন করা এক দিন বয়সের মুরগির বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে না। এমনকি ফ্রি দিলেও তা কেউ নিতে চাচ্ছে না। এসব কারণে পোলট্রি খাতে প্রতিদিন শতকোটি টাকার বেশি ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়া এ খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত পোলট্রি সরঞ্জাম ও খামারিরা বেকার হয়ে পড়েছেন। এতে সব মিলিয়ে শতকোটি টাকার বেশি প্রতিদিন ক্ষতির মুখে পড়েছে পোলট্রি খাত। পোলট্রি খাতের এই সংকটে চরম হতাশায় আছেন খামারিসহ উদ্যোক্তারা। এই খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত উদ্যোক্তারা আশঙ্কা করছেন, বর্তমান পরিস্থিতি আরও দু-এক সপ্তাহ অব্যাহত থাকলে এ খাতে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হবে।

পোল্ট্রি ও ডিম উৎপাদন শিল্পে দৈনিক ক্ষতির হিসাব

পণ্যের বিবরণদৈনিক উৎপাদনমোট ব্যয় (টাকা)অবিক্রীত অংশক্ষতির পরিমাণ (টাকা)
মুরগির মাংস৩ হাজার ২৭ টন৩০ কোটি টাকা৭০ শতাংশ২১ কোটি
ডিম৪ কোটি ৬৬ লাখ পিস২৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা৬০ শতাংশ১৫ কোটি ৩৮ লাখ
একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা২৬ লাখ ৭২ হাজার পিস৯ কোটি টাকা৯০ শতাংশ৮ কোটি ৩২ লাখ
পোলট্রি খাদ্য৯ হাজার ৮৬৩ টন৩৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা৭০ শতাংশ২৪ কোটি ১৭ লাখ
পোলট্রির ওষুধ ১১ কোটি ১০ লাখ টাকা৭০ শতাংশ৭ কোটি ৭৭ লাখ
হিমায়িত পোলট্রি খাদ্য ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা৯৫ শতাংশ১ কোটি ২৭ লাখ

সূত্র: বিআইপিআইসি

কৃষি খাতকে বাঁচাতে হলে সরকারের উচিত নিন্মোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ ও তার দ্রুত বাস্তবায়নঃ

১। ধান কাটাসহ চৈতালি ফসল উত্তোলনের সময় পর্যাপ্ত শ্রমিক সরবরাহের ব্যবস্থা করা।

২। কৃষক পর্যায়ে কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতকল্পে সরকার থেকে মূল্য সহায়তা প্রকল্প (প্রাইস সাপোর্ট প্রোগ্রাম) চালু করা।

৩। যেহেতু কৃষি শ্রমিকদের জন্য হোম কোয়ারেন্টিন প্রায় অসম্ভব, তাই তাঁদের জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

৪। আগামী মৌসুমের ফসল উৎপাদনের জন্য বীজ, সার, কীটনাশকসহ ব্যয়বহুল কৃষি উপকরণ বিনা মূল্যে কিংবা ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহ নিশ্চিত করা।

৫। কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য সহজ শর্তে কৃষিঋণের ব্যবস্থা করা। আগামী এক বছর কৃষিঋণের কিস্তি স্থগিত করা এবং ক্ষেত্রবিশেষে মওকুফ করা।

৬। কৃষি শ্রমিকসহ কৃষিসংশ্লিষ্ট কাজে আর্থিক ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও চিকিৎসাসেবার সরবরাহ নিশ্চিত করা।

পোশাক শিল্পে করোনাভাইরাসের প্রভাব

তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী দেশে তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে ৪ হাজার ৬২১টি। এর মধ্যে ২ হাজার ৫০০টির অধিক সরাসরি পোশাক রফতানির সাথে যুক্ত। ৩০ বিলিয়ন ডলারের এই রফতানি শিল্পে মোট ৪৫ লাখের অধিক শ্রমিক কাজ করেন। বিশ্বে তৈরি পোশাকের সরবরাহকারী হিসাবে চীনের পর দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ খ্যাতনামা ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। দেশের রফতানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশই আসে এই খাত থেকে। [২৫] পশ্চিমা দেশগুলোই বাংলাদেশের পোশাকের প্রধান ক্রেতা। শিল্প খাতে কর্মসংস্থান হওয়া শ্রমিকদের দুই-তৃতীয়াংশ কাজ করছে এ খাতে। প্রিন্টিং, প্যাকেজিং, বোতাম, জিপার, লেবেল, ট্যাগ, কার্টুন থেকে শুরু করে শত শত শিল্পের সাফল্য নির্ভর করছে পোশাকের ওপর। পোশাকশিল্পের ওপর নির্ভরশীলতা আছে বৃহদাকার তুলা, সুতা, টেক্সটাইল, ডায়িং, উইভিং প্রভৃতি শিল্পেরও। ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও টিকে আছে তৈরি পোশাক শিল্পকে ঘিরে। সংগত কারণেই পোশাকশিল্পে কোন সংকট দেখা দিলে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় সংশ্লিষ্ট অগ্র ও পশ্চাৎ শিল্পগুলোয়। ঝুঁকিতে পড়ে সামগ্রিক অর্থনীতি। [২৬]

তৈরি পোশাক শিল্পে করোনাভাইরাসের প্রভাব বাংলাদেশের যে কোন শিল্প খাতের তুলনায় সবচেয়ে ভয়ংকরী এবং বহুমাত্রিক। তৈরি পোশাক শিল্পে করোনাভাইরাসের প্রাথমিক সংকটটি কাঁচামালের সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়া সংক্রান্ত। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের অথ্য অনুযায়ী, তৈরি পোশাকের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের ৫০ শতাংশ চীন থেকে আসে। ওভেন পোশাকের ৬০ শতাংশ কাঁচামাল চীনের ওপর নির্ভরশীল। এবং নিট পোশাকের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কাঁচামাল উৎসও হচ্ছে চীন। গত বছরের ডিসেম্বরের পর থেকে চীনে করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকার পর থেকে কাঁচামাল আমদানি ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। একসাথে কাঁচামাল ও গার্মেন্টস অ্যাক্সেসরিজের অপ্রতুল সরবরাহের কারণে এসব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েক গুণ।

পোশাকশিল্পের সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডায় ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, ফ্রান্স ও ইতালিতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। দেশগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্যান্য দোকানপাট ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। গ্যাপ, নাইকি, ইন্ডিটেক্স, কলাম্বিয়া স্পোর্টসওয়্যার, রিফোরমেশনের মত বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ঘোষণা দিয়ে বিভিন্ন দেশে তাদের বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ করেছে। এ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ১৩৬টি ব্র্যান্ড তাদের অর্ডার বাতিল বা স্থগিত করেছে। [২৭]

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে বিদেশি ক্রেতারা প্রায় ৪০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাকের রফতানি বা ক্রয়াদেশ বাতিল করেছেন। এর মধ্যে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর আদেশ বাতিল হয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি ডলারের। আর নিট খাতের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর বাাতিল হয়েছে ১০০ কোটি ডলারের মত। [২৮] এ অবস্থায় ইউরোপ-আমেরিকায় করোনাভাইরাসের প্রকোপ দ্রুত সময়ের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে না এলে ক্রয়াদেশ বাতিলের পরিমাণ বাড়বে। একদিকে ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হচ্ছে, অন্যদিকে নতুন করে ক্রয়াদেশও আসছে না। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে রফতানি বাণিজ্যের অন্যতম এই খাতটি। এই অবস্থা আরও কিছুদিন চলতে থাকলে অনেক কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে। পাশাপাশি শ্রমিকদের বেতন দেয়াও সম্ভব হবে না। তাহলে দেশের অর্থনীতি বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।

এখন পর্যন্ত ৯৩ কোটি ২৬ লাখ ৩০ হাজারটি পোশাক পণ্যের আদেশ বাতিল হয়েছে। যার আর্থিক পরিমাণ ২.৯৫ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় দাঁড়ায় প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা)। রফতানি আদেশ বাতিল হওয়া এসব কারখানায় ২১ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করেন। এদিকে বিকেএমইএর প্রায় ১০০ কোটি ডলারের রফতানি আদেশ বাতিল হয়েছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের আট মাস (জুলাই-ফেব্র“য়ারি) সময়ে পোশাক রফতানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে ২ হাজার ১৮৪ কোটি ৭৪ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩.৪৫ শতাংশ কম। একই সময়ে রফতানি প্রবৃদ্ধিও কমেছে ৫.৫৩ শতাংশ।

এখন পর্যন্ত ৯৩ কোটি ২৬ লাখ ৩০ হাজারটি পোশাক পণ্যের আদেশ বাতিল হয়েছে। যার আর্থিক পরিমাণ ২.৯৫ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় দাঁড়ায় প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা)। রফতানি আদেশ বাতিল হওয়া এসব কারখানায় ২১ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করেন। এদিকে বিকেএমইএর প্রায় ১০০ কোটি ডলারের রফতানি আদেশ বাতিল হয়েছে।

করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে গত ২৭ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের তৈরি পোশাক কারখানার অধিকাংশই ছুটি ঘোষণা করা হয়। এ সময়ে সরকারের সবচেয়ে বড় অপরিণামদর্শিতা ছিল শুরুতেই গণপরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করা। এই সময়ে সরকার কিংবা গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ থেকে শ্রমিকদেরকে যথাযথ নির্দেশনা কিংবা বিধি-নিষেধ দেয়া হয়নি। ফলে দীর্ঘদিনের ছুটিতে কারখানা শ্রমিকদের বিরাট একটা অংশ গ্রামে চলে যায়। তারপর গণপরিবহন বন্ধ রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে গণপরিবহন বন্ধ রাখার সময়সীমা আরও বাড়ানো হয়। এ সিদ্ধান্তের ফলে বিপত্তিতে পড়ে ছুটিতে বাড়ি চলে যাওয়া গার্মেন্টকর্মীরা। কেননা গণপরিবহন বন্ধের সময়সীমা বাড়ানো হলেও তাদের ছুটি বাড়েনি। হিসাব মতে, ৫ এপ্রিল কর্মস্থলে যোগ দিতে হবে তাদের। ফলে উপায় না পেয়ে ‘লকডাউনের’ মধ্যে দল বেঁধে হেঁটে রাজধানীর উদ্দেশে রওনা দেয় তারা। আবার কোথাও কোথাও ট্রাকে/পিকআপে পশু পরিবহনের মত গাদাগাদি করে ঢাকায় আসার চিত্র আমরা দেখতে পেয়েছি। মাছের ড্রামে করে ঢাকায় ফেরার নির্মম চিত্রও দেখেছি আমরা। করোনা প্রতিরোধের জন্য বার বার সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করা অসম্ভব৷ এমন পরিস্থিতিতে যদি শ্রমিকদের মধ্যে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, তাহলে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো অসম্ভব হয়ে পড়বে৷ এখানে দুটো প্রশ্ন: এক, করোনা আতঙ্ক আর পরিবহন বন্ধের মধ্যে এই লাখ লাখ শ্রমিক ঢাকায় ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে গেল? দুই, এত এত ক্রয়াদেশ বাতিল হলে কেন এত তড়িঘড়ি করে ‘লকডাউনের’ মধ্যে কারখানা চালু করার দরকার পড়ল? এর উত্তর হচ্ছে, ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে মাত্র ৩ বিলিয়ন ডলারের, যেখানে এই শিল্পের বাজার ৪০ বিলিয়ন ডলারের। অন্যদিকে বিদেশ থেকে নতুন করে পিপিই তৈরির ক্রয়াদেশ পাচ্ছে পোশাক কারখানাগুলো।

এখানে দুটো প্রশ্ন: এক, করোনা আতঙ্ক আর পরিবহন বন্ধের মধ্যে এই লাখ লাখ শ্রমিক ঢাকায় ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে গেল? দুই, এত এত ক্রয়াদেশ বাতিল হলে কেন এত তড়িঘড়ি করে ‘লকডাউনের’ মধ্যে কারখানা চালু করার দরকার পড়ল? এর উত্তর হচ্ছে, ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে মাত্র ৩ বিলিয়ন ডলারের, যেখানে এই শিল্পের বাজার ৪০ বিলিয়ন ডলারের। অন্যদিকে বিদেশ থেকে নতুন করে পিপিই তৈরির ক্রয়াদেশ পাচ্ছে পোশাক কারখানাগুলো।

ইতোমধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণজনিত অর্থনৈতিক সংকট সামলাতে বাংলাদেশ সরকার গার্মেন্টসসহ রফতানি খাতের জন্য প্রণোদনা হিসাবে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছে। গার্মেন্টসসহ রফতানি খাতের মালিকরা এই টাকা পাবেন ২ শতাংশ হারের সুদে ঋণ হিসাবে। যে শিল্প তাদের উৎপাদনের ৮০ শতাংশ রফতানি করে, তারাই এই প্রণোদনার টাকা পাবে। রফতানি শিল্পের মালিকদের প্রণোদনা পাওয়ার একমাত্র শর্ত হচ্ছে, এই টাকা দিয়ে শ্রমিকের বেতন দিতে হবে। সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্ত ৫ হাজার কোটি টাকা সাধারণ শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন প্রদানের জন্য যথেষ্ট ছিল।

সরকারের উচিত ছিল কারখানাগুলোকে বন্ধের নির্দেশ দিয়ে শ্রমিকদের অন্তত তিন মাসের সবেতন ছুটি নিশ্চিত করা। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, পোশাকশিল্পের ওপর সরকারের আদৌ কোন নিয়ন্ত্রণ আছে কি না। কারণ বিবিসিতে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে শ্রমসচিব জানিয়েছেন, ৫ তারিখে কারখানা খোলার ব্যাপারে তাঁরা কিছু জানেন না। আর্থিকভাবে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও গার্মেন্টস মালিকরা ক্রয়াদেশ বাতিলের অজুহাতে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের পরোক্ষ হুমকি দেয় সরকারকে। ইতোমধ্যে শ্রমিক ও স্টাফদের কাজ সন্তোষজনক না হওয়ার অজুহাতে আশুলিয়ায় তিনটি পোশাক কারখানায় ৩৬২ জন শ্রমিককে অব্যাহতি দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এবং বলা যায় এক ধরনের ব্ল্যাকমেইল করে সরকারের কাছ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা আদায় করে নেয়। এবং নতুন কৌশল হিসাবে তারা কার্যত লকডাউনের মধ্যে কারাখানা খোলার ঘোষণা দিয়ে, দেশের সব মানুষকে করোনার কাছে জিম্মি করে পেতে চাইছে নতুন আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ। বিজিএমইএর আহবান না মেনে এই ছুটির মধ্যেও সাভারে প্রায় অর্ধশত গার্মেন্টস চালু করেছেন মালিকরা।

সরকারের উচিত ছিল কারখানাগুলোকে বন্ধের নির্দেশ দিয়ে শ্রমিকদের অন্তত তিন মাসের সবেতন ছুটি নিশ্চিত করা। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, পোশাকশিল্পের ওপর সরকারের আদৌ কোন নিয়ন্ত্রণ আছে কি না। কারণ বিবিসিতে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে শ্রমসচিব জানিয়েছেন, ৫ তারিখে কারখানা খোলার ব্যাপারে তাঁরা কিছু জানেন না।

প্রণোদনা প্যাকেজ

করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় সরকার গত ৫ এপ্রিল ৬৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার চারটি প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এবং এর আগে পোশাকশিল্প ও রফতানি খাতের জন্য ঘোষণা করা হয়েছিল ৫ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার ৫ প্রণোদনা প্যাকেজ। অর্থের অঙ্কে যা মোট জিডিপির ২.৫২ শতাংশ। [২৯]

নতুন চারটি আর্থিক সহায়তা প্যাকেজের মাধ্যমে মূলত যে বিষয়গুলোতে প্রাধান্য দেয়া হয়েছেঃ

(ক) ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা প্রদান : ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রদানের লক্ষ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা প্রণয়ন করা হবে। ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশনসের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ সংশ্লিষ্ট শিল্প/ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল হতে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ দেবে। এ ঋণ সুবিধার সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। প্রদত্ত ঋণের সুদের অর্ধেক অর্থাৎ ৪.৫০ শতাংশ ঋণগ্রহীতা শিল্প/ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৪.৫০ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসাবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে প্রদান করবে।

(খ) ক্ষুদ্র (কুটির শিল্পসহ) ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা প্রদান : ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রদানের লক্ষ্যে ২০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা প্রণয়ন করা হবে। ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশনসের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল হতে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ প্রদান করবে। এ ঋণ সুবিধার সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। প্রদত্ত ঋণের ৪ শতাংশ সুদ ঋণগ্রহীতা শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসাবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে।

(গ) বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবর্তিত ইডিএফ (এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড)-এর সুবিধা বাড়ানো : ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় কাঁচামাল আমদানি সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইডিএফের বর্তমান আকার ৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হবে। ফলে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অতিরিক্ত ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ইডিএফ তহবিলে যুক্ত হবে। ইডিএফের বর্তমান সুদের হার লেবার + ১.৫ শতাংশ (যা প্রকৃতপক্ষে ২.৭৩%) থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হবে।

(ঘ) প্রি-শিপিং ক্রেডিট ফাইন্যান্সিং স্কিম নামে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন ঋণ সুবিধা চালু করবে। এ ঋণ সুবিধার সুদের হার হবে ৭ শতাংশ।

(সূত্র : যুগান্তর, ৫ এপ্রিল ২০২০)

বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত ৫টি প্রণোদনা প্যাকেজ হচ্ছে এক ধরনের সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি। কোন দেশের ব্যষ্টিক অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সাধারণত দুই ধরনের পলিসি গ্রহণ করে থাকে। একটি হচ্ছে মুদ্রানীতি, অন্যটি আর্থিক নীতি। অর্থনৈতিক লক্ষ্য বিবেচনায় নীতি দুটো সম্প্রসারণমূলক কিংবা সংকোচনমূলক হতে পারে। অর্থের সরবরাহ বাড়ানো অথবা সুদের হার কমানো হছে সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি। এবং অর্থের সরবরাহ হ্রাস কিংবা সুদের হার বৃদ্ধি হচ্ছে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি। অন্যদিকে কর হ্রাস অথবা সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি হচ্ছে সম্প্রসারণমূলক আর্থিক নীতি। এবং এর বিপরীতগুলো হচ্ছে আর্থিক সংকোচনমূলক নীতি।

মন্দাকালীন সময়ে যে কোন সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখা এবং এ থেকে উত্তরণ লাভ করা। ফলে এক্ষেত্রে সরকার সম্প্রসারণমূলক নীতি গ্রহণ করে থাকে। আর্থিক উদ্দীপনামূলক সব কটি ঋণ সহায়তার প্যাকেজই করা হয় অর্থ সম্প্রসারণ নীতি অনুসারে। বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় যে প্যাকেজগুলো সাপ্লাইসাইড অর্থনীতি কেন্দ্রিক। সরকার আশা করছে যে বিপৎকালীন এই সময়ে স্বল্প সুদের ঋণ বৃহৎ ও ক্ষুদ্র শিল্পের উৎপাদন ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক রাখবে। এবং এই শিল্পের সংশ্লিষ্ট কর্মী ও শ্রমিকরা বেতন-ভাতা প্রাপ্তির মাধ্যমে সুবিধা ভোগ করবেন। কিন্তু বেশ কয়েকটি কারণে এই ধরনের আর্থিক পরিকল্পনা কাজ না করার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রথমত, এই প্রণোদনার প্যাকেজসমূহ এক ধরনের ‘চুইয়ে পড়া’ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। এই তত্তে¡র অনুমিতি হচ্ছে কর, বৃহৎ শিল্পের কর কমানো অথবা নানা রকম আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে বিনিয়োগ উৎসাহিত করা এবং অর্থনীতি সম্প্রসারণের মাধ্যমে সর্বস্তরের সুবিধা নিশ্চিত করা। আশির দশকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের সময় তুমুল জনপ্রিয়তা পায় এই ‘চুইয়ে পড়া অর্থনীতি’ তত্ত¡। কিন্তু গত ৪০ বছরে বিভিন্ন দেশের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি যে এই তত্ত¡ তার অনুমিতিকে প্রমাণ করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, এই নীতি অনুসরণের ফলে ভয়ংকরভাবে আয়বৈষম্য বাড়ে, উৎপাদনশীল খাতে সে অর্থে বিনিয়োগ বাড়ে না, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয় এবং সর্বোপরি সর্বসাধারণের জন্য অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দুর্যোগ বয়ে আনে। নোবেলজয়ী বিখ্যাত মার্কিন অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান তাঁর সাম্প্রতিক এক বইয়ে ‘চুইয়ে পড়া অর্থনীতি’ ধারণাকে জম্বি অর্থনীতি বলে অভিহিত করেছেন; অর্থাৎ মৃত এবং বাস্তব অস্তিত্বহীন এক ধারণা, যা আগ্রাসীভাবে এখনও তারা করে বেড়াচ্ছে।

এই নীতি অনুসরণের ফলে ভয়ংকরভাবে আয়বৈষম্য বাড়ে, উৎপাদনশীল খাতে সে অর্থে বিনিয়োগ বাড়ে না, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয় এবং সর্বোপরি সর্বসাধারণের জন্য অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দুর্যোগ বয়ে আনে। নোবেলজয়ী বিখ্যাত মার্কিন অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান তাঁর সাম্প্রতিক এক বইয়ে ‘চুইয়ে পড়া অর্থনীতি’ ধারণাকে জম্বি অর্থনীতি বলে অভিহিত করেছেন; অর্থাৎ মৃত এবং বাস্তব অস্তিত্বহীন এক ধারণা, যা আগ্রাসীভাবে এখনও তারা করে বেড়াচ্ছে।

বর্তমানে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে। প্রণোদনা প্যাকেজের কারণে ঋণ বিতরণের চাহিদা আরও বাড়বে। ব্যাংকগুলোর কাছে পর্যাপ্ত ঋণ নেই। ফলে টাকা কোথায় পাবে ব্যাংকগুলো সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকে যায়। তাছাড়া প্রণোদনার অর্থ কিভাবে দেয়া হবে, কারা পাবে- এ বিষয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট মোকাবিলায় পুনরর্থায়ন কর্মসূচি চালু করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। এই কর্মসূচি থেকে ব্যাংকগুলোকে নামমাত্র সুদে ধার দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে আরও বেশি গরিব মানুষকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় হিসাব করে দেখেছে, ঋণনির্ভর এই প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করতে হলে সুদ ভর্তুকি বাবদ সরকারের বাড়তি তিন হাজার কোটি টাকা লাগবে। বর্তমানে কৃষি, বিদ্যুৎ, রফতানিসহ অন্যান্য খাতে ভর্তুকি বাবদ সরকারের মোট ব্যয় হয় বছরে ৩০ থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা। করোনার কারণে এখন নতুন করে বাড়তি তিন হাজার কোটি টাকা যোগ হবে। ফলে বাজেট বাস্তবায়নের ওপর চাপ বাড়বে।

মনে রাখতে হবে, এদেশের মোট কর্মসংস্থানের ৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক। করোনার কারণে এই অনানুষ্ঠানিক খাতের অধিকাংশ মানুষই এখন কর্মহীন। প্রণোদনা এই সকল মানুষের জন্য আশু এবং প্রত্যক্ষ কোন ভ‚মিকা রাখবে না। তাই এই প্রণোদনাকে জনবান্ধব বলা যায় না। এই মুহূর্তে প্রয়োজন ক্রয়ক্ষমতাহীন মানুষদের জন্য নগদ অর্থ অনুদান। সরকারি ব্যয় সম্প্রসারণ করে দেশের সামগ্রিক চাহিদা বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থনীতি সচল রাখাটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ। এই মুহূর্তে দরকার সরকারি ব্যয় সম্প্রসারণ করে সাধারণ মানুষকে সরাসরি নগদ সহায়তা প্রদান। তাতে মানুষের ভোগ বা চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। এতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন উৎসাহিত হবে। শ্রমিক ও কর্মীদের নিয়োগ ও উপার্জন বৃদ্ধি পাবে। অর্থনীতি আবার সচল হবে।

এদেশের মোট কর্মসংস্থানের ৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক। করোনার কারণে এই অনানুষ্ঠানিক খাতের অধিকাংশ মানুষই এখন কর্মহীন। প্রণোদনা এই সকল মানুষের জন্য আশু এবং প্রত্যক্ষ কোন ভ‚মিকা রাখবে না। তাই এই প্রণোদনাকে জনবান্ধব বলা যায় না। এই মুহূর্তে প্রয়োজন ক্রয়ক্ষমতাহীন মানুষদের জন্য নগদ অর্থ অনুদান।

উপসংহার

এই সময়ে প্রয়োজনজিডিপিকেন্দ্রিক উন্নয়ন চিন্তা বাদ দিয়ে মানুষকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা। সরকারের উচিত আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান সকল মানুষের জন্য অন্তত তিন মাসের খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা। একই সাথে দেশের সকল নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষাকৃত কম জরুরি পণ্য ও সেবা খাতসমূহ বন্ধ রেখে দেশ পুরোপুরি লকডাউন ঘোষণা করে দিতে হবে। খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি, উপযোগ সেবা, ব্যাংকের মত জরুরি খাতে নিয়োজিত মানুষদের যথাযথ সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। রেডিও, টেলিভিশন এবং জাতীয় গণমাধ্যমে করোনার বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। সামাজিক দূরত্ব নয়, সামাজিক সংহতি নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা জাল নিশ্চিত করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে, রাষ্ট্রীয় সাহায্য যেন সঠিক সময়ে সঠিক মানুষের কাছে পৌঁছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারকে সবাইকে নিয়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিতে হবে। এটা একটা ভীষণ লড়াই। এ লড়াইয়ে জয়ের কোন বিকল্প নেই।

মো: মনির: প্রভাষক, অর্থনীতি বিভাগ। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস।

ইমেইল: monirsquare@gmail.com

তথ্যসূত্র:

১) https://bn.wikipedia.org/wiki/ K‡ivbvfvBivm †ivM 2019

২) https://hub.jhu.edu/novel-coronavirus-information/

৩) https://www.bbc.com/news/business-52236936

৪) http://resources.oxfordeconomics.com/world-economic-prospects-executive-summary?interests_economic_topics=macroeconomics&interests_trending_topics=coronavirus

৫) https://www.tse-fr.eu/our-researchers-insights-covid-19

৬) https://samakal.com/economics/article/20018838

৭) https://www.bbc.com/bengali/news-39679977

৮) https://thefinancialexpress.com.bd/economy/bangladesh/tourism-sector-to-lose-tk-9705b-during-feb-june-period-1585757421

৯) https://www.prothomalo.com/bangladesh/article/1636818

১০)  http://www.dainikamadershomoy.com/post/241811

১১) https://www.bbc.com/bengali/news-51664932

১২) https://www.prothomalo.com/economy/article/1648574

১৩) https://www.prothomalo.com/economy/article/1648478

১৪) https://bonikbarta.net/home/news_description/224240

১৫) https://bonikbarta.net/home/news_description/225458/

১৬) https://www.jugantor.com/covid-19/297217/

১৭) https://bonikbarta.net/home/news_description/225458

১৮) https://www.banglatribune.com/country/news/616280/

১৯) https://samakal.com/todays-print-edition/tp-industry-trade/article/200434583

২০) http://www.jaijaidinbd.com/todays-paper/homeland/95966/

২১) https://samakal.com/todays-print-edition/tp-industry-trade/article/200434583

২২) https://www.banglanews24.com/economics-business/news/bd/779946

২৩) https://www.bbc.com/bengali/news-52241432

২৪) https://www.prothomalo.com/economy/article/1648005

২৫) https://www.bbc.com/bengali/news-52150609

২৬) https://cpd.org.bd/

২৭) https://www.prothomalo.com/economy/article/1645536

২৮) https://www.myamin.com/article.php?myamin=220116&cat=1

২৯) http://www.myamin.com/article.php?myamin=220721&cat=21

৩০) https://www.jugantor.com/covid-19/295913/

Social Share
  •  
  •  
  • 876
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *