
করোনা কালীন দুর্যোগ মোকাবেলায় কৃষি খাতে করণীয় প্রস্তাব
গবেষণা, তথ্য সংগ্রহ ও সংকলন: মাহা মির্জা
সাধারণভাবে অনিশ্চয়তায় ভরা কৃষকদের জন্য করোনাকালে বিপর্যয় গভীর সংকট তৈরি করেছে। এই সংকটের উৎস কৃষিখাতে বিদ্যমান বিভিন্ন বৈরী নীতি এবং করোনা কারণে বিদ্যমান বিধিনিষেধ। এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এই লেখায় কৃষি খাতের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন করণীয় প্রস্তাব করা হয়েছে।
দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৮ ভাগ কৃষিতে নিযুক্ত। এই কৃষকদের বড় অংশই জমির মালিক নন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) রিপোর্ট (২০১৮) অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ২ কোটি ৪৩ লাখের বেশি মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে পারিবারিক সহকারী : ৮৭ লাখ ৬৫ হাজার জন বা প্রায় ৩৫ শতাংশ; স্ব-কর্মসংস্থান: ৮১ লাখ ৭৭ হাজার বা প্রায় ৩৩ শতাংশ; কৃষিশ্রমিক: ৭২ লাখ ৯১ হাজার জন বা প্রায় ৩০ শতাংশ; এবং অন্যান্যভাবে নিয়োজিত: ১ লাখ ৬৮ হাজার শ্রমিক।
দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বছরের পর বছর কৃষিতে ব্যক্তিগত লোকসানের ভার বইতে হচ্ছে কৃষককে। অথচ, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা এফএওর (২০১৯)-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের কৃষক ২০১৭ সালে যে কৃষিপণ্য উৎপাদন করেছেন, তার আর্থিক মূল্য প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা। অনেকের মতেই, জমির মালিকানার পরিবর্তন বা ভূমি সংস্কার ছাড়া বাস্তবে কৃষকের অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব না। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থায় অন্ততপক্ষে বর্গা কৃষককে কীভাবে সরকারি ঋণ ও প্রণোদনার আওতায় আনা যায়, এই বিষয়টি নিয়ে অনেকেই ভাবছেন। বর্তমানে করোনার প্রাদুর্ভাবে কৃষিকাজ কিছুটা চলমান থাকায় সকল কৃষক যদিও কর্মহীন হয়ে পড়েননি, তবে পরিবহন সংকটের কারণে উৎপাদিত ফসল ও সবজি ঠিক সময়মতো বাজারজাত করতে না পারায় এবং দুর্যোগের সুযোগে ফড়িয়াদের সিন্ডিকেটের ফলে সবজির দাম পড়ে যাওয়ায় দেশের প্রতিটি অঞ্চলের অধিকাংশ কৃষক বিপুল লোকসানের সম্মুখীন হয়েছেন।
বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সর্বজনকথার পক্ষ থেকে কৃষি খাতের জন্যে একটি দুর্যোগকালীন সহায়তা প্রস্তাব তৈরী করা হয়। প্রস্তাবে কৃষি খাতের বহুমুখী বাস্তবতা ও চাহিদা বিবেচনা করে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি, এবং দীর্ঘমেয়াদি করণীয়গুলো উত্থাপন করা হলো।
স্বল্পমেয়াদে করণীয়
বর্তমানে করোনার প্রাদুর্ভাবে পরিবহণ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় কৃষকের পক্ষে তাদের উৎপাদিত শস্য/সবজি পাইকারি বা খুচরা বাজার পর্যন্ত নিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছেনা। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে কৃষকের দুরবস্থার খবর আসছে। উত্তরবঙ্গের সবজি উৎপাদনকারী কৃষকেরা সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন। বিভিন্ন জেলায় টমেটো, শশা, বেগুন, লাউ, কুমড়া, মরিচ সহ নানারকমের সবজির দাম কেজিতে মাত্র ৪-৫ টাকায় নেমে এসেছে। দিনাজপুরের কৃষক ৫০ পয়সা কেজিতে শশা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন এমন খবরও আমরা পাচ্ছি। পরিবহন সংকটের পাশাপাশি ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণেও কৃষক দাম পাচ্ছেননা এমন অভিযোগও আছে।
উত্তরবঙ্গের সবজি উৎপাদনকারী কৃষকেরা সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন। বিভিন্ন জেলায় টমেটো, শশা, বেগুন, লাউ, কুমড়া, মরিচ সহ নানারকমের সবজির দাম কেজিতে মাত্র ৪-৫ টাকায় নেমে এসেছে। দিনাজপুরের কৃষক ৫০ পয়সা কেজিতে শশা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন
এই পরিস্থিতিতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সবজি-কৃষকদের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে এবং উৎপাদিত সকল শস্য নষ্ট হওয়া থেকে বাঁচাতে স্বল্পমেয়াদে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:
১. স্বাস্থ্যবিধি মেনে পাইকারি বাজার চালু রাখা
বর্তমানে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা শহরগুলোতে খুচরা বাজার সকাল ৯টা থেকে ১১ টা পর্যন্ত চালু থাকে। অথচ পাইকারি বাজারগুলো বন্ধ রাখা হচ্ছে। সরবরাহ ব্যবস্থা চালু রাখতে পাইকারি বাজার গুলো ন্যূনতম ৫ ঘন্টা চালু রাখা জরুরি। বহু এলাকায় ক্ষেত থেকে সবজি বা অন্যান্য পচনশীল শস্য পাইকারি বাজার পর্যন্ত পরিবহণ করার মতো পর্যাপ্ত পরিমাণ ভ্যান নেই। কাজেই বিদ্যমান ২-৩টি ভ্যানকে ১০ থেকে ১৫ বার ক্ষেত থেকে বাজার পর্যন্ত আসা যাওয়া করতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ। কাজেই পাইকারি বাজারগুলো নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খোলা রাখতে হবে। প্রয়োজনে পৌরসভার অধীনে থাকা গাড়ি গুলো কাজে লাগাতে হবে। প্রশাসনের কর্মীরা সরাসরি স্বাস্থবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে নিবিড় তদারকি করবেন।
২. জনসমাগম ঠেকাতে ঢাকার মাঠগুলোকে বাজার হিসাবে কাজে লাগানো
বাজারে অতিরিক্ত জনসমাগম ঠেকাতে ঢাকার ভিতরের খোলা মাঠগুলোকে বিভিন্ন এলাকার বাজার হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। সিটি কর্পোরেশনের অধীনে মহাখালী, সায়দাবাদ এবং কারওয়ান বাজারে ইতিমধ্যেই বাজার বসানোর পর্যাপ্ত জায়গা আছে। এছাড়াও ঢাকার অন্যান্য খালি মাঠগুলোকেও বাজার হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রশাসনের কর্মীরা সরাসরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে নিবিড় তদারকি করবেন। এছাড়াও প্রতিটি এলাকার ওয়ার্ড কমিশনের পক্ষ থেকে এলাকার ভ্রাম্যমাণ ফেরিওয়ালা/মাছ, ফল বা সবজি বিক্রেতাদের মধ্যে মাস্ক ও স্যানিটাইজার সরবরাহ করতে হবে। খাদ্য বিক্রির সঙ্গে যুক্ত শ্রমজীবীদের কোনোভাবেই হয়রানি করা যাবে না।
মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে করণীয়
১. আসন্ন বোরো মৌসুমে ক্ষেতমজুর সংকট ও করণীয়
দেশে প্রায় ৪৭-৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়। এই বিপুল পরিমাণ ধান কাটার ক্ষেত্রে প্রতিবছরই ক্ষেতমজুর সংকট দেখা দেয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এক গবেষণা বলছে, হাওড় অঞ্চল হিসেবে পরিচিত সাত জেলা সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এবার মোট বোরো আবাদ হয়েছে নয় লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে, যার অর্ধেক সমতলে, বাকিটা মূল হাওড়ে। এসব জমির ধান কাটতে মোট শ্রমিকের প্রয়োজন প্রায় ৮৪ লাখ জন। কিন্তু সেখানে শ্রমিকের ঘাটতি আছে ১৫ লাখ জনের বেশি, যা মোট প্রয়োজনের ১৮ শতাংশ। ফলে এ সময়ে প্রায় ২৫ দিনের জন্যে প্রতিদিন প্রায় ৬৬ হাজার অভিবাসী শ্রমিকের প্রয়োজন রয়েছে সেখানে (বণিক বার্তা, এপ্রিল ১৬, ২০২০)।
বর্তমানে পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। চলতি মৌসুমে অন্য জেলা থেকে শ্রমিক যেতে পারছেন না সেখানে। ফলে এবার শ্রমিক সংকট আরো তীব্র হবে। অবশ্য সরকার ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে বিভিন্ন অঞ্চলে কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমিকদের ধান কাটার কাজে লাগানো হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, শ্রমিক সংকট এড়াতে এরই মধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছেন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। দেশের শ্রম উদ্বৃত্ত জেলাগুলো থেকে শ্রমিকদের হাওড় অঞ্চলে পাঠানোর জন্য তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। এরই মধ্যে মাঠ পর্যায়ের কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তারা শ্রম উদ্বৃত্ত জেলা বিশেষ করে মেহেরপুর, কুড়িগ্রাম, বগুড়া, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, জামালপুর, ময়মনসিংহসহ পার্শ্ববর্তী জেলাগুলো থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় হাওড়ে শ্রমিক নিয়ে যাওয়ার তালিকা করেছে। এরই মধ্যে শ্রমিক যাওয়া শুরু হয়েছে। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা তাদের তালিকা প্রস্তুত করে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন (বণিকবার্তা, এপ্রিল ১৬, ২০২০)।
এক্ষেত্রে এক অঞ্চলের শ্রমিক অন্য অঞ্চলে পরিবহণের কাজটি করতে হবে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক পরিবহণ (ট্রাক/বাস) ব্যবহার করতে হবে। ঠাসাঠাসি বা গাদাগাদি করে শ্রমিক পরিবহণ করা যাবেনা। সেই সঙ্গে কৃষি শ্রমিকের স্বাস্থ্য বিষয়ে বিশেষ পদক্ষেপ নেয়ার জন্যও সঠিক নির্দেশনা থাকতে হবে। হাওড় অঞ্চলে যেসব ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী করোনা আক্রান্ত রোগীর সেবায় নিয়োজিত নন, তাদের বোরো ধান কর্তনকালীন কৃষি শ্রমিকদের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত করা যেতে পারে। এছাড়া কেউ কেউ মনে করেন, এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে শ্রমিক পরিবহণের ক্ষেত্রে দেশের বড় পরিবহণ ব্যবসায়িদের কাজে লাগানো যেতে পারে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে দেশের উদ্বৃত্ত অঞ্চল থেকে শ্রমিক ঘাটতি অঞ্চলে যাতায়াদের ক্ষেত্রে এসব পরিবহণ ভূমিকা নিতে পারে।
২. ধান/চাল কেনা ও সরকারের মজুদ সক্ষমতা বাড়ানো
এবারে বোরো ধানের লক্ষমাত্রা প্রায় ২ কোটি টন। অথচ সরকার ধান-চাল ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে মাত্র ১৯ লাখ টন, যা একেবারেই পর্যাপ্ত নয়। সরকারকে ধাপে ধাপে ধান কেনার লক্ষমাত্রা বাড়াতে হবে। এদিকে সরকারি গুদামের ধারণ ক্ষমতা ২০ লাখ টনের কিছু বেশি। প্রশ্ন উঠেছে, সরকার সাধারণ সময়ের চেয়ে বেশি ধান-চাল কেনা শুরু করলে তা রাখবে কোথায়? অনেকেই প্রস্তাব করেছেন, প্রশাসনিক তালিকা তৈরি করে বোরো মৌসুমের ধান কৃষকদের কাছেই রেখে দেয়া যেতে পারে। সরকার ধাপে ধাপে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকেই এই ধান কিনে নেবে। আর দীর্ঘমেয়াদে সরকারের নিজস্ব মজুদ সক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নেই।
কৃষকের ধান মজুদের সক্ষমতা বাড়ানো
পূর্বের মতো প্রতি গৃহস্থ ঘরে একাধিক ধানের গোলা না থাকায় কৃষক পর্যায়ে ধান রাখার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে কিনা সেটাও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রস্তাব এসেছে: ক) উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে যেসব অডিটরিয়াম বা কমিউনিটি সেন্টার আছে সেগুলো ২-৩ মাসের জন্যে ভাড়া নিয়ে দ্রুত ধানের গুদামে পরিণত করে ফেলা যেতে পারে। খ) কৃষকদের টিন ও আনুষঙ্গিক কিছু উপকরণ প্রণোদনা আকারে দিলে কৃষক নিজের সুবিধা অনুযায়ী ধানের গোলা বা ছোট ছোট গুদামঘর তৈরি করে নিতে পারে। গ) প্রশাসনের উদ্যোগে উপজেলা পর্যায়ে বা ইউনিয়ন অফিসগুলোর সামনে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিয়ে খালি পড়ে থাকা মাঠে অস্থায়ী ধান গুদাম তৈরি করাও দুরূহ নয়। এছাড়া ধানের গুদামঘর তৈরি ও তার ব্যবস্থাপনা কারিগরী দিক থেকে কঠিন কোন কাজ নয়। কৃষকরাই পালা করে এসব গুদামের নিরাপত্তা প্রদান করতে পারবেন।
এর পাশাপাশি ধান থেকে চাল তৈরির সবগুলো বড় মিলকে আগামী কয়েক মাস সরকারের নিবিড় নজরদারিতে রেখে কাজে লাগাতে হবে। সরকার তার ক্রয়কৃত ধান নির্ধারিত দাম দিয়ে চাল করিয়ে নিবে এবং নিয়মিত বিতরণ করে যাবে। এছাড়া স্থানীয় চাতালগুলোকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজে লাগাতে হবে। এর মাধ্যমে স্থানীয় চালের বাজার স্থিতিশীল থাকবে।
সরকারি গুদামের সক্ষমতা বৃদ্ধি
দীর্ঘমেয়াদে সরকারি গুদামের সক্ষমতা ধাপে ধাপে বাড়াতে হবে। প্রতি জেলায় সরকারি গুদাম এবং সবধরনের পচনশীল সবজির জন্যে হিমাগারের ব্যবস্থা করতে হবে। কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ লক্ষ টন ধান মজুদের কাঠামোগত সক্ষমতার জন্যে কৃষক পর্যায়ে বা কমিউনিটি পর্যায়ে বিনিয়োগ করতে হবে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই সরকারকে ন্যূনতম এক কোটি টন ধান মজুদ করার কাঠামোগত সক্ষমতা অবশ্যই বাড়াতে হবে।
চালের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সতর্কতা
বেসরকারি মিলগুলোর ধারণ সক্ষমতা প্রায় ১ কোটি টন। এই মুহূর্তে প্রায় ৪০ লক্ষ টন স্থান খালি আছে। করোনাকালীন সময়ে সরকারি গুদামের চাল দুস্থদের মধ্যে বিতরণের পর সরকারি মজুদ কমে যাওয়ায় বেসরকারি চাল ব্যবসায়ীরা যেন সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়ে দিতে না পারে, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি রাখতে হবে। বড় মিল মালিকদের সঙ্গে সরকারি দলের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের সখ্যতার অভিযোগ রয়েছে। এই ধরণের সখ্যতার ভিত্তিতেই শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। ভবিষ্যতে সরকারকে এই ধরণের সিন্ডিকেট ভাঙতে সর্বোচ্চ শক্তি প্রদর্শন করতে হবে।
৩. কৃষি খাতে সরকারের করোনা-কালীন প্রণোদনা বাস্তবে কে পাবে?
সরকার ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে করোনা দুর্যোগ মোকাবেলায় ৪ শতাংশ সুদে মোট পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া হবে কৃষককে। কিন্তু ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, প্রকৃত কৃষক বা বর্গা কৃষক এই সরকারি ঋণ পর্যন্ত আদৌ পৌঁছাতে পারবে কিনা? গত ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সম্পর্কিত সার্কুলারে বলা হয়েছে, শস্য ও ফসল খাত ব্যতীত কৃষির অন্যান্য চলতি মূলধন নির্ভরশীল খাত, যেমন: হর্টিকালচার (মৌসুমি ফুল ও ফল চাষ), মাছ চাষ, পোলট্রি, ডেইরি ও প্রাণিসম্পদ খাতে এই ঋণ দেওয়া হবে। এবং কোনো খাতে ৩০ শতাংশের বেশি ঋণ দেওয়া যাবে না। এছাড়াও সার্কুলারে আরো উল্লেখ করা আছে, ঋণ নেয়ার ১৮ মাসের মধ্যে ঋণ ফেরত দিতে হবে। প্রথম ছয় মাস গ্রেস পিরিয়ড থাকবে (কিস্তি দিতে হবেনা)। পরবর্তী ১২ মাসে বারো কিস্তির মাধ্যমে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
সম্প্রতি প্রথম আলোর একটি পর্যবেক্ষণমূলক প্রতিবেদনে সাংবাদিক আরিফুজ্জামান তুহিন বাস্তব চিত্রটি তুলে ধরেন এভাবে: ‘‘মূলত, কৃষিঋণ-নীতিমালা অনুযায়ী কৃষকের উৎপাদিত ফসল বন্ধক রেখে কৃষিঋণ নিতে হয়। এর সরকারি নাম হলো ‘শস্য বন্ধকি দলিল’। অর্থাৎ কৃষক তাঁর শস্য একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখবেন। ধান বা যেকোনো শস্য বিক্রি করে ঋণের টাকা আবার ফেরত দেবেন। কৃষক ঋণ পাবেন কৃষিঋণ নীতিমালা অনুযায়ী। এ নীতিমালা অনুযায়ী ৫ একর বা ১৫ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিক সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাবেন। সে জন্য তাঁদের জমির দলিল বন্ধক রাখতে হবে। যাঁদের জমি নেই, তাঁরাও এই ঋণ পাবেন, তবে সে ক্ষেত্রে কৃষককে জমি লীজের চুক্তিপত্র জমা দিতে হবে। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে প্রান্তিক ভূমিহীন চাষি কখনোই চুক্তি করে জমি লিজ নেন না। আর অকৃষক জমির মালিক লিখিত চুক্তির মাধ্যমে কোনো চাষিকে জমি বর্গা দেন না।… কারণ লিখিত চুক্তির মাধ্যমে জমি বর্গা দিলে সরকারকে ফি দিতে হয়। সেই ফি জমির মালিককেই পরিশোধ করতে হয়। ফলে, এই পাঁচ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্যাকেজ থেকে বর্গা চাষির ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। শুধু তা-ই নয়, কৃষকদের সবচেয়ে বড় অংশ ধান চাষ করেন। কোনো এলাকায় যদি ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বড় একটি অংশ ব্যাংক পর্যন্ত যান ঋণের জন্য, তাহলে ওই অঞ্চলে বরাদ্দকৃত ঋণের ৩০ শতাংশই কেবল ধানচাষিরা পাবেন। এছাড়াও, বাংলাদেশে জেলাভেদে ফসলের উৎপাদনও ভিন্ন হয়। ফলে, সারা বাংলাদেশের কৃষকের জন্য গড় এই বেঁধে দেওয়া শতাংশ হার কৃষকের জন্য কতটা সুফল বয়ে আনবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়” (প্রথম আলো, এপ্রিল ১৭, ২০২০)।
এতে আরও বলা হয়েছে, “এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সার্কুলারে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, তা হলো যেসব উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান কৃষক কর্তৃক উৎপাদিত কৃষিপণ্য কিনে সরাসরি বিক্রি করে থাকে, তারা এই ঋণ প্যাকেজের আওতায় আসবে। এসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা ঋণ পাবে। অর্থাৎ যে কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল উৎপাদন করেন, তিনি পাবেন সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা। আর যিনি কৃষকের ফসল কম টাকায় কিনে বেশি টাকায় বিক্রি করবেন, সেই মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়ারা ঋণ পাবেন পাঁচ কোটি টাকা। অথচ বহুকাল ধরে দাবি জানানো হচ্ছে, কৃষকের উৎপাদিত ফসল কীভাবে সরাসরি ক্রেতার কাছে যেতে পারে, সেই ব্যবস্থা সরকারিভাবে গড়ে তোলা হোক। উল্টো এই ঋণব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পোক্ত করা হয়েছে” (প্রথম আলো, এপ্রিল ১৭, ২০২০)।
প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৮ ভাগ কৃষিতে নিযুক্ত। এর বড় অংশের হাতে নিজের জমি নেই। জমির মালিকদের একটি বড় অংশই অকৃষক। বড় ধরনের জমির মালিকানার পরিবর্তন বা ভূমি সংস্কার ছাড়া বাস্তবে কৃষকের জন্য কিছু করা সম্ভব না। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থায়ও যদি কৃষকের জন্য কিছু করতে হয়, তাহলে বর্গা কৃষককে সরকারি প্রণোদনার আওতায় আনার চেষ্টা করতে হবে।
কৃষি খাতে প্রণোদনার ধরণ কেমন হওয়া উচিত?
বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে বোরো ওঠার পরপরই কৃষক পরবর্তী মওসুমের ধান আবাদের প্রস্তুতি নেবে। সেক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট সরকারি সাহায্য নিশ্চিত করতে হবে। যেমন: ক) জমির লিজ মূল্য দিতে গিয়ে কৃষকের আয়ের একটা বড় অংশ বেরিয়ে যায়। এটা এলাকা ও জমির ধরন ভেদে কম-বেশি হলেও বাৎসরিক গড়ে প্রায় ১০ হাজার টাকা। যা কৃষককে অগ্রিম পরিশোধ করতে হয়। কমপক্ষে আগামী ১ বছর জমির লিজমূল্য সরাসরি ভর্তুকি হিসাবে উৎপাদক কৃষকদের হাতে পৌঁছে দিতে হবে এবং জমির মালিকরা যেন কোনভাবেই লিজ মূল্য বাড়াতে না পারে সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে। পাশাপাশি কৃষির শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে তোলার জন্য নতুন বাস্তবতার নিরিখে দীর্ঘমেয়াদে ভূমি সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। খ) কৃষি উপকরণ যেমন সার-বীজ-কীটনাশক ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরাসরি উৎপাদক কৃষকের হাতে ভর্তুকি পৌঁছে দিতে হবে। পাশাপাশি বাজারজাতকারীদের উপর কড়া নজরদারী রাখতে হবে যেন এ সময়ে কোনভাবেই এসব পণ্যের দাম বেড়ে না যায়। গ) ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি কমপক্ষে আগামী ১ বছর বন্ধ রাখতে হবে। উৎপাদক কৃষকদের জন্য দীর্ঘমেয়াদে এবং বিনাসুদে সরকারী ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. কৃষকের ঋণের জাল
আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) এর ২০১৯ সালের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কৃষকেরা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও), আত্মীয়স্বজন, বেসরকারি ব্যাংক, এবং দাদন ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন বেসরকারি উৎস থেকে প্রায় ৮১ শতাংশের বেশি ঋণ নিয়ে থাকেন। এসব ঋণের সুদের হার ১৯ থেকে ৬৩ শতাংশ। অন্যদিকে সরকারি কৃষি ব্যাংকের সুদের হার ৯ শতাংশ হলেও কৃষকের মোট ঋণের মাত্র ৬ শতাংশ আসে কৃষি ব্যাংক থেকে (প্রথম আলো, এপ্রিল ১৭, ২০২০)। ইফপ্রির সমীক্ষা অনুযায়ী: কৃষক মোট ঋণের ৩৬ শতাংশ নেয় এনজিও থেকে; আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ নেয় ১৯ শতাংশ; জমির মালিকের কাছ থেকে ঋণ নেয় ১৫ শতাংশ; মহাজন বা দাদন থেকে ১১ শতাংশ এবং বিভিন্ন সমিতি থেকে আসে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ ঋণ। এদিকে সরকারের কৃষি ব্যাংকের ৬ শতাংশ ঋণের সবচেয়ে বড় অংশটি পান বড় চাষিরা, যা প্রায় ১৫ শতাংশ। বড়, মাঝারি ও ছোট চাষি মিলে মোট ঋণের ৩৬ শতাংশ পান। আর প্রান্তিক চাষি পান মাত্র ৫ শতাংশের মতো। বর্গা চাষি, অর্থাৎ অন্যের জমি ইজারা নিয়ে চাষ করেন—এমন কৃষকেরা এই ঋণ পান না। ফলে তাঁদের এনজিওসহ অন্য উৎসের ঋণের ওপর নির্ভর করতে হয় (প্রথম আলো, এপ্রিল ১৭, ২০২০।)
বাংলাদেশের কৃষকেরা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও), আত্মীয়স্বজন, বেসরকারি ব্যাংক, এবং দাদন ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন বেসরকারি উৎস থেকে প্রায় ৮১ শতাংশের বেশি ঋণ নিয়ে থাকেন। এসব ঋণের সুদের হার ১৯ থেকে ৬৩ শতাংশ।
এক্ষেত্রে সরকারি ঋণের আওতা বাড়ানোর পাশাপাশি স্থানীয় ঋণদান সমিতি ও গ্রামে সঞ্চয়ী সমিতিগুলোর জন্য প্রণোদনা ও সহযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়াও ক্ষৃদ্র ঋণের বিকল্প মডেল হিসাবে সমবায় গঠনের দিকে জোর দিতে হবে। পুরনো ধারার সমবায়ের বদলে নতুন বাস্তবতার নিরিখে নতুন ধরনের কৃষি ও গ্রামীণ সমবায় গঠনে জোর দিতে হবে।
৫. দুর্যোগকালীন কৃষি সহায়তা প্রসঙ্গে
কৃষিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রায় কখনোই বিবেচনায় নেয়নি। বলা হয়, যুগে যুগেই কৃষি অরক্ষিত ও অনিশ্চিত জীবিকা। ঝড়, বন্যা, শিলাবৃষ্টি, পোকার আক্রমণ এসব প্রাকৃতিক কারণেই কৃষকের ঝুঁকি সীমাহীন। কৃষক বাজারদরের কাছেও জিম্মি। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে এমন একটি দেশও নেই, যেখানে কৃষি ঝুঁকিপূর্ণ নয়। পার্থক্য হলো কৃষি ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনিশ্চিত-এই বাস্তবতা বহু দেশে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে স্বীকৃত। তাই ঝুঁকি নিয়ে ফসল ফলানোর জন্য কৃষিতে বিপুল প্রণোদনা এবং ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা আছে। কখনো ভর্তুকি, কখনো শস্যবিমা, কখনো রিস্ক কাভারেজ (ঝুঁকি মিটিয়ে দেওয়া), কখনো প্রাইস লস কাভারেজ (দাম পড়ে যাওয়ার লোকসান মেটানো), কখনো সরাসরি অর্থ প্রদান ইত্যাদি বিভিন্নভাবে কৃষকদের সহযোগিতা করা হয়। বাংলাদেশে প্রান্তিক ও বর্গাচাষী কৃষিতে বিনিয়োগ করেন মূলত ঋণ করে ও বিকল্প পেশা থেকে আয় করে। ফলে বোরো মৌসূমে কাল বৈশাখী/শীলা বৃষ্টি/ পোকার আক্রমণ এবং বোরো পরবতী মৌসুমে অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল ইত্যাদি কারণে ফসলের ক্ষতি হলে কৃষকের পক্ষে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কৃষকদের দুর্যোগকালীন সহায়তা কী কী ধরনের হতে পারে এই বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনার প্রয়োজন আছে। এক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়কে সক্রিয় ভাবে একটি বিশদ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
মাহা মির্জা: লেখক, গবেষক
ইমেইল: maha.z.mirza@gmail.com
তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। ‘রিপোর্ট অন এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল স্ট্যাটিসটিকস ২০১৮’। ২০১৮।
আরিফুজ্জামান, মোঃ। ‘কৃষিঋণ কৃষককে কতটা রক্ষা করবে?’ প্রথম আলো। ১৭ এপ্রিল, ২০২০।
শাহীন, সাইদ। ‘হাওরে দিনে ৬৬ হাজার অভিবাসী শ্রমিক প্রয়োজন।’ বণিক বার্তা। এপ্রিল ১৬, ২০২০।
এছাড়াও মাঠ পর্যায়ের তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন: সাইদ শাহীন, আবুল কালাম আজাদ, এবং আলতাফ পারভেজ।
143