হিনডেনবার্গ রিপোর্টে আদানির জালিয়াতির বিবরণ ও বাংলাদেশের বিপদ
কল্লোল মোস্তফা
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হিনডেনবার্গ রিসার্চ ভারতের বৃহৎ করপোরেট কোম্পানি আদানি গ্রুপের জালিয়াতি, অর্থ পাচার ও শেয়ার কারসাজির তথ্যপ্রমাণসহ এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই আদানি গ্রুপের সঙ্গেই বাংলাদেশ ২০১৭ সালে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ আগামী ২৫ বছরের জন্য ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় অবস্থিত আদানি গ্রুপের ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ক্রয় করবে। বাংলাদেশের বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় অর্ধেক অব্যবহৃত রেখে ভারতীয় আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ আমদানি বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হবে কি না, সে বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। হিনডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্টে শেয়ারবাজারে কারসাজি ছাড়াও বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি ও কয়লা আমদানিকে কেন্দ্র করে যে ধরনের জালিয়াতির ঘটনা উঠে এসেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্বার্থের দিক থেকে ক্ষতির আশঙ্কা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই লেখায় হিনডেনবার্গ রিসার্চে আদানি গ্রুপের জালিয়াতির যেসব বিবরণ উঠে এসেছে তার কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশের সঙ্গে আদানির চুক্তি কেন বিপজ্জনক সেই আলোচনা করা হয়েছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ওভার-ইনভয়েসিং
আদানি পাওয়ার দুটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনের বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে বয়লার, জেনারেটর ও টারবাইন আমদানি করে। ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যায়ে আদানি পাওয়ার মহারাষ্ট্র লিমিটেড (এপিএমএল) এবং আদানি পাওয়ার রাজস্থান লিমিটেড (এপিআরএল) যথাক্রমে মহারাষ্ট্রের তিরোদা ও রাজস্থানের কাওয়াই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এসব যন্ত্রপাতি আমদানি করে। যন্ত্রপাতি দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনের প্রকৃত যন্ত্রপাতি নির্মাণকারী (ওইএম) কোম্পানি থেকে সরাসরি ভারতে এলেও এসব যন্ত্রপাতির মূল্য পরিশোধ করা হয় দুবাইভিত্তিক তৃতীয় একটি কোম্পানির মাধ্যমে। ইলেকট্রোজেন ইনফ্রা এফজেডই (ইএফই) আসল ইনভয়েসের ওপর জালিয়াতি করে দাম কয়েক গুণ বাড়িয়ে সেই ইনভয়েস আদানি পাওয়ারের কাছে পাঠায়। আদানি পাওয়ার সেই অনুযায়ী বাড়তি মূল্য পরিশোধ করে।
এরপর দুবাইভিত্তিক ইএফই যন্ত্রপাতির প্রকৃত মূল্য চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার যন্ত্রপাতি নির্মাতা কোম্পানিগুলোকে পরিশোধ করে বাড়তি অর্থ পাঠিয়ে দেয় ইএফই-এর প্যারেন্ট কোম্পানি মরিশাসভিত্তিক ইলেকট্রোজেন ইনফ্রা হোল্ডিংস প্রাইভেট লিমিটেডের কাছে। মরিশাসভিত্তিক এই কোম্পানির প্রকৃত মালিক হলো আদানি গ্রুপের কর্ণধার গৌতম আদানির বড় ভাই বিনোদ আদানি। এভাবে আদানি গ্রুপ ২০১১ থেকে ২০১৩ পর্যায়ে স্রেফ দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতির মূল্য বাড়িয়ে দেখানোর মাধ্যমে ৮০৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার করে।
যন্ত্রপাতির আমদানি মূল্য বাড়িয়ে দেখানোর ক্ষেত্রে আদানির বাড়তি কর দিতে হয়নি। কারণ, এসব যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা রয়েছে। বাড়তি আমদানি মূল্য দেখানোর মাধ্যমে আদানি গ্রুপ একদিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আদানি পাওয়ার লিমিটেড কোম্পানির অর্থ ডলার আকারে বিদেশে পাচার করে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, অন্যদিকে যন্ত্রপাতি আমদানির বাড়তি খরচ দেখিয়ে বেশি দামে বিদ্যুৎ বিক্রির ব্যবস্থা করে ভারতের জনগণের কাছ থেকে বাড়তি অর্থ আদায়ের ব্যবস্থা করেছে।
যে প্রক্রিয়ায় আদানি পাওয়ার ওভার-ইনভয়েসিং বা আমদানি খরচ বাড়িয়ে দেখানোর কারবার করে তার একটা চিত্র ভারতের ডিরেক্টরেট অব রেভিনিউ ইনটেলিজেন্সের তৈরি করা ডায়াগ্রাম থেকে দেখে নেওয়া যেতে পারে।
কয়লার আমদানি মূল্য বাড়িয়ে দেখানো
কয়লা আমদানি মূল্য বাড়িয়ে দেখানো প্রসঙ্গে ভারতের ডিরেক্টরেট অব রেভিনিউ ইনটেলিজেন্স (ডিআরআই) ২০১৬ সালে একটি সার্কুলার জারি করে। এই সার্কুলারে ভারতের যে ৪০টি কোম্পানির বিরুদ্ধে কয়লার আমদানি মূল্য ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেখানোর অভিযোগ আনা হয়, তার মধ্যে সরাসরি আদানি গ্রুপের কোম্পানি ছিল ৫টি। এ ছাড়া অভিযুক্ত আরও ৫টি কোম্পানির কয়লা সরবরাহকারী ছিল আদানি গ্রুপ। এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে আরও একটি অভিযোগ ছিল ল্যাবরেটরির টেস্ট রিপোর্ট জালিয়াতির মাধ্যমে কয়লার তাপীয় মান বা ক্যালোরিফিক ভ্যালু বাড়িয়ে দেখানো।
কয়লা ইন্দোনেশিয়া থেকে জাহাজে সরাসরি ভারতে আনা হলেও এসব কয়লার মূল্য পরিশোধ করা হয় হংকং, সিঙ্গাপুর, দুবাইভিত্তিক তৃতীয় কোনো কোম্পানির মাধ্যমে। এই কোম্পানিগুলো আসলে জালিয়াতির উদ্দেশ্যে আদানিরই তৈরি বিভিন্ন বেনামি কোম্পানি। এই কোম্পানিগুলো কয়লা আমদানির আসল ইনভয়েসের ওপর জালিয়াতি করে দাম বাড়িয়ে সেই বাড়তি মূল্যের ইনভয়েস আদানি গ্রুপের কাছে পাঠায়। আদানি গ্রুপের কোম্পানিগুলো সেই অনুযায়ী বাড়তি মূল্য পরিশোধ করে।
কয়লা ইন্দোনেশিয়া থেকে জাহাজে সরাসরি ভারতে আনা হলেও এসব কয়লার মূল্য পরিশোধ করা হয় হংকং, সিঙ্গাপুর, দুবাইভিত্তিক তৃতীয় কোনো কোম্পানির মাধ্যমে। এই কোম্পানিগুলো আসলে জালিয়াতির উদ্দেশ্যে আদানিরই তৈরি বিভিন্ন বেনামি কোম্পানি।
এরপর হংকং/সিঙ্গাপুর/দুবাইভিত্তিক বেনামি কোম্পানিগুলো কয়লার প্রকৃত মূল্য ইন্দোনেশিয়ার কয়লা রপ্তানিকারী কোম্পানিকে পরিশোধ করে আর বাড়তি অর্থ পাঠিয়ে দেয় এসব বেনামি কোম্পানির প্যারেন্ট কোম্পানি মরিশাসভিত্তিক বিভিন্ন শেল কোম্পানির কাছে। মরিশাসভিত্তিক এসব শেল কোম্পানির প্রকৃত মালিক হলো আদানি গ্রুপের কর্ণধার গৌতম আদানির বড় ভাই বিনোদ আদানি।
ভারতের ডিরেক্টরেট অব রেভিনিউ ইনটেলিজেন্সের বক্তব্য অনুসারে, কয়লার আমদানি মূল্য এভাবে বাড়িয়ে দেখানোর উদ্দেশ্য দুটি: ১) আদানি গ্রুপ শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আদানি পাওয়ার লিমিটেড কোম্পানির অর্থ ডলার আকারে বিদেশে পাচার করা, যার ফলে সাধারণ শেয়ার মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ২) কয়লার বাড়তি মূল্য দেখিয়ে বেশি দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করা।
ভারতের ডিরেক্টরেট অব রেভিনিউ ইনটেলিজেন্সের বক্তব্য অনুসারে, কয়লার আমদানি মূল্য এভাবে বাড়িয়ে দেখানোর উদ্দেশ্য দুটি: ১) আদানি গ্রুপ শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আদানি পাওয়ার লিমিটেড কোম্পানির অর্থ ডলার আকারে বিদেশে পাচার করা, যার ফলে সাধারণ শেয়ার মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ২) কয়লার বাড়তি মূল্য দেখিয়ে বেশি দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করা।
বাংলাদেশ কীভাবে নিশ্চিত করবে যে, আদানি গ্রুপ বাংলাদেশে রপ্তানির জন্য স্থাপিত গোড্ডা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেও একইভাবে কয়লার দাম বাড়িয়ে দেখাবে না? ইতোমধ্যে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে আদানি গ্রুপ ২০০ ডলারের কয়লার দাম ৪০০ ডলার দেখাচ্ছে! দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য ৫০৫০ ক্যালরিফিক মানের প্রতি টন কয়লার আমদানি খরচ যেখানে ২৪৫ ডলার পড়ছে, সেখানে আদানি গ্রুপ ভারতের গোড্ডায় অবস্থিত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৪৬০০ ক্যালরিফিক মানের কয়লার দাম ধরছে ৪০০ ডলার করে! (সূত্র: বাংলাদেশের সঙ্গেও আদানির কারসাজি, দৈনিক বাংলা, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)
কয়লা দাম বাড়িয়ে দেখালে যেহেতু কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম বেশি দিতে হবে, তাই আদানির এই কয়লার মূল্য-জালিয়াতির খেসারত বাংলাদেশের জনগণকেই দিতে হবে।
বেনামি কোম্পানির মাধ্যমে শেয়ার নিয়ে কারসাজি
ভারতের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির অন্তত ২৫ শতাংশ শেয়ার কোম্পানির নিজস্ব মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণের বাইরের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকতে হয়। কোম্পানির নিজস্ব মালিকানাধীন শেয়ারকে বলা হয় প্রমোটর শেয়ার বা ইনসাইডার হোল্ডিংস। নিয়মানুসারে কোম্পানিকে ঘোষণা করতে হয় তার প্রমোটর হোল্ডিং কতটুকু এবং কারা সেই প্রমোটর। এর উদ্দেশ্য হলো, কোনো কোম্পানির নিজস্ব শেয়ারহোল্ডাররা যেন সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের অন্ধকারে রেখে নিজের শেয়ার নিজেরা কেনাবেচা করে শেয়ারের দাম নিয়ে কারসাজি করতে না পারে।
এখন কোনো কোম্পানি যদি তার প্রমোটর হোল্ডিং গোপন করার জন্য বেনামি কোম্পানির মাধ্যমে শেয়ার ক্রয় করে, তাহলে সেই বেনামি কোম্পানির মাধ্যমে শেয়ার কেনাবেচা করে নিজস্ব শেয়ারের দাম বাড়ানো হলেও সাধারণ শেয়ার মালিকদের কাছে মনে হবে এটা স্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। হিনডেনবার্গ রিসার্চের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে আদানি দীর্ঘদিন ধরেই এ কাজটি করে আসছিল।
হিনডেনবার্গ মরিশাস, সাইপ্রাস, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও ক্যারিবীয় দ্বীপভিত্তিক অনেক কোম্পানির নাম বের করেছে যেগুলোর মালিকানায় প্রধানত আদানির শেয়ারই রয়েছে। সাধারণত বড় বিদেশি বিনিয়োগকারী কোম্পানিগুলোর একাধিক কোম্পানিতে বিনিয়োগ থাকে, তাদের শক্তিশালী অনলাইন উপস্থিতি থাকে, ব্যাবসায়িক লেনদেন সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়, বিনিয়োগের ফান্ড সংগ্রহের জন্য বিজ্ঞাপনী প্রচারণা থাকে, শক্তিশালী কর্মীবাহিনী থাকে। কিন্তু আদানি গ্রুপের কোম্পানিগুলোতে শত শত মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগকারী কথিত ইনডিপেনডেন্ট ফান্ডগুলোর ক্ষেত্রে এর কোনোটাই প্রযোজ্য নয়। অনলাইনে বা সংবাদমাধ্যমে এদের সম্পর্কে তেমন তথ্য পাওয়া যায় না, এদের ওয়েবসাইটগুলোতে তেমন কোনো তথ্য নেই, এদের অর্থের উৎস সম্পর্কে জানা যায় না এবং বিস্ময়করভাবে আদানির ব্যাবসায়িক পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, এদের আদানির শেয়ার ছেড়ে যেতে দেখা যায় না। লক্ষণীয় বিষয় হলো, আদানির শেয়ার নিয়ে সারা বছর যত লেনদেন হয়, তার ৩০ থেকে ৪৭ শতাংশ হয় এই সন্দেহভাজন কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে।
উদাহরণস্বরূপ, মনটেরোসা হোল্ডিংস লিমিটেডের কথা বলা যেতে পারে। এই কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে থাকা পাঁচটি কথিত ইনডিপেনডেন্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের আদানি গ্রুপে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। এই ফান্ডগুলো হলো: এপিএমএস ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড, আলবুলা ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড, ক্রেস্তা ফান্ড লিমিটেড, এলটিএস ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড লিমিটেড এবং লোটাস গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড। এসব ফান্ডের ৮৯.৫ থেকে ৯৯.৪ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ শুধু আদানি গ্রুপের। মনেটেরোসা হোল্ডিংসের সিইও-র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যাবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে ভারতের কুখ্যাত পলাতক হীরা ব্যবসায়ী যতীন রজনীকান্ত মেহতার, যার ছেলের সঙ্গে আবার বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ আদানি পরিবারের বড় ছেলে বিনোদ আদানির মেয়ে। শুধু তা-ই নয়, আদানি গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান গুদামি ইন্টারন্যাশনালের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গুদামি ইন্টারন্যাশনাল মনটেরোসার নিয়ন্ত্রণে থাকা ফান্ড লোটাস গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্টে ১৭ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এভাবে গুদামি ইন্টারন্যাশনালের বিনিয়োগের সূত্র ধরেও কথিত ইনডিপেনডেন্ট ফান্ডের সঙ্গে আদানি গ্রুপের আর্থিক সম্পর্কের বিষয়টি উন্মোচিত হয়।
বেনামি কোম্পানির মাধ্যমে অবৈধ লেনদেন, মানি লন্ডারিং
বেনামি শেল কোম্পানিগুলোকে শেয়ার জালিয়াতি ছাড়াও ভারত থেকে দেশের বাইরে এবং দেশের বাইরে থেকে ভারতে অর্থ আদান-প্রদানের কাজে ব্যবহার করা হয়। প্রয়োজনমতো দেশের বাইরে থেকে অর্থ এনে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আর্থিক অবস্থা ভালো দেখানো হয় আবার প্রয়োজনমতো দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আদানির ৭টি প্রধান কোম্পানির মোট ৫৭৮টি সাবসিডিয়ারি রয়েছে, যার অনেকগুলো মরিশাস, পানামা এবং দুবাইয়ের মতো দেশে নিবন্ধিত, যেসব দেশ অস্বচ্ছতার জন্য কুখ্যাত। শুধু এক বছরেই এসব সাবসিডিয়ারি পরস্পরের সঙ্গে ৬ হাজার ২৫টি লেনদেন করে। বিনোদ আদানি নিজে অনেক দেশে অফশোর শেল কোম্পানির বিশাল নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করে, যেগুলো আদানি গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে নিয়মিত লেনদেন করে। এক মরিশাসেই বিনোদের নিয়ন্ত্রণে ৩৮টি শেল কোম্পানির খোঁজ পাওয়া গেছে। আদানি গ্রুপ বিভিন্ন সময়ে যেসব কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে বিনোদ নিয়ন্ত্রিত শেল কোম্পানির সম্পর্ক দেখা গেছে। যেমন: ১৫১ মিলিয়ন ডলারের হীরা কেলেঙ্কারি, বিদ্যুৎ উৎপাদনের যন্ত্রপাতি আমদানিতে ৮০০ মিলিয়ন ডলারের ওভার-ইনভয়েসিং কেলেঙ্কারি।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আদানির ৭টি প্রধান কোম্পানির মোট ৫৭৮টি সাবসিডিয়ারি রয়েছে, যার অনেকগুলো মরিশাস, পানামা এবং দুবাইয়ের মতো দেশে নিবন্ধিত, যেসব দেশ অস্বচ্ছতার জন্য কুখ্যাত। শুধু এক বছরেই এসব সাবসিডিয়ারি পরস্পরের সঙ্গে ৬ হাজার ২৫টি লেনদেন করে।
২০১৩-২০১৫ সালে বিনোদ আদানির মালিকানাধীন কোম্পানি কারমাইকেল রেল অ্যান্ড পোর্ট সিঙ্গাপুর হোল্ডিংস লিমিটেড শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আদানি এন্টারপ্রাইজের কাছ থেকে এমন তিনটি সম্পদ ক্রয় করে- যে সম্পদগুলো আদানি এন্টারপ্রাইজের কাছে থাকলে তার আয় ও মুনাফা তুলনামূলক কম দেখাতে হতো। এভাবে লোকসানি সম্পদ বেসরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন কোম্পানিতে স্থানান্তর করে দিয়ে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আদানি এন্টারপ্রাইজের আর্থিক পরিস্থিতি ভালো দেখানো হয়েছে।
সন্দেহজনক লেনদেনের মাধ্যমে অর্থ দেশে আনার পর সেই অর্থ আবার প্রয়োজনে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কাছ থেকে দেশের বাইরে পাঠানোরও বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে আদানির। যেমন: মরিশাসভিত্তিক শেল কোম্পানি গ্রোমোর ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আদানি পাওয়ারের সঙ্গে স্টক একীভূতকরণের মাধ্যমে রাতারাতি ৪২৩ মিলিয়ন ডলার মুনাফা করে। ২০০৯ সালে আদানি পাওয়ারের সাবসিডিয়ারি আদানি পাওয়ার মহারাষ্ট্র লিমিটেড ১৯৮০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছিল। ২০১০ সালে মরিশাসভিত্তিক গ্রোমোর নামের কোম্পানিটি ১২৮ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে আদানি পাওয়ার মহারাষ্ট্রের ২৬ শতাংশ শেয়ার ক্রয় করে। এরপর ২০১১ সালে আদানি পাওয়ার স্টক মার্জার বা একীভূতকরণের মাধ্যমে আদানি পাওয়ার মহারাষ্ট্রের শেয়ারটুকু কিনে নেয়। রাতারাতি ১২৮ মিলিয়ন ডলার মূল্যের শেয়ার দাম বাড়িয়ে দেখানো হয় ৫৫১ ডলার; অর্থাৎ, আদানি পাওয়ার মহারাষ্ট্রের শেয়ার বিক্রি করে গ্রোমোরের মুনাফা হয় ৪২৩ মিলিয়ন ডলার। অথচ এই একীভূতকরণের মাত্র এক দিন আগেও এই শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ১২৮.৩ মিলিয়ন ডলার। আদানি পাওয়ার গ্রোমোরকে এই শেয়ারের মূল্য পরিশোধ করে আদানি পাওয়ারের শেয়ারের মাধ্যমে, ফলে আদানি পাওয়ারে গ্রোমোরের শেয়ারসংখ্যা দাঁড়ায় ২১৩ মিলিয়ন ডলার, যা ছিল আদানি পাওয়ারের মালিকানার ৯ শতাংশ।
আদানির সঙ্গে চুক্তি যে কারণে বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক
উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, ভারতের ক্ষমতাসীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে আদানি গ্রুপ ভারতের জনগণের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের জালিয়াতি ও প্রতারণা করে চলেছে। এরকম একটা প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ কীভাবে নিশ্চিত করবে যে, আদানি গ্রুপ বাংলাদেশের সঙ্গে এরকম প্রতারণা ও জালিয়াতি করবে না? তা ছাড়া জালিয়াতি ছাড়াও আদানির সঙ্গে চুক্তিটি এমনভাবে করা হয়েছে, চুক্তিতে এমনসব ধারা রয়েছে, যা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, চুক্তিটি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থবিরোধী এবং নরেন্দ্র মোদি ও আদানিকে খুশি করার জন্য বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে এটি একটি উপহার।
একসময় আদানির কাছ থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎ দেশের তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের চেয়ে সস্তা হবে বলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি হবে। বর্তমানে ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ১৫ টাকা পড়লেও আদানির কাছ থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের খরচ ইউনিট প্রতি ২০ থেকে ২২ টাকা করে পড়বে। বিষয়টি উপলব্ধি করে সম্প্রতি পিডিবির পক্ষ থেকে চুক্তি সংশোধনের জন্য আদানিকে চিঠি দেওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। (সূত্র: বিপিডিবি সিক্স রিভাইজড অ্যাগ্রিমেন্ট উইথ আদানি বিফোর ইমপোর্টিং পাওয়ার ফ্রম ঝাড়খণ্ড প্ল্যান্ট, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ইউএনবি)
অথচ ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে এই বিদ্যুৎ আমদানি বাংলাদেশের জন্য লাভজনক না কি বোঝা–সে বিষয়ে বেশ অনেক দিন ধরেই প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। ২০১৮ সালের এপ্রিলে ইনস্টিটিউট অব এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইফা) এক প্রতিবেদনের সূত্র ধরে প্রথম আলোর এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে বাংলাদেশকে ২৫ বছরে ৭০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় করতে হবে। আদানির বিদ্যুতের বাড়তি দামের কারণ হিসেবে ভারতের স্থানীয় কয়লার বদলে আদানির অস্ট্রেলিয়ার মালিকানাধীন কয়লাখনি থেকে জাহাজে করে আদানির বন্দরে কয়লা আনা এবং সেখান থেকে আবার ৭০০ কিলোমিটার রেললাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্রে পরিবহণ, ভারতের অংশে যে সঞ্চালন লাইন নির্মিত হবে, তার ব্যয়ও বিদ্যুতের দামের মধ্যে ধরা, আদানি কর্তৃক ওভার-ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে আমদানি করা কয়লার বাড়তি দর দেখানো ইত্যাদির কথা বলা হয়েছিল। (সূত্র: আদানির বিদ্যুৎ ঝুঁকিপূর্ণ, ব্যয়বহুল, প্রথম আলো, ১১ এপ্রিল ২০১৮)
৯ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত ‘হাউ পলিটিক্যাল উইল অফেন ফেভারস আ কোল বিলিয়নিয়ার অ্যান্ড হিজ ডার্টি ফসিল ফুয়েল ইন্ডাস্ট্রি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ভারতের ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদি সরকার ভারতীয় বৃহৎ ব্যবসায়ী গ্রুপ আদানিকে কীভাবে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে এমনকি বিদেশেও পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছে, তার দৃষ্টান্ত হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে আদানি গ্রুপের কয়লা বিদ্যুৎ রপ্তানি চুক্তির প্রসঙ্গটি উত্থাপন করা হয়। রিপোর্টটিতে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র ধরে বলা হয়, ২০১৫ সালের জুনে প্রথমবার বাংলাদেশ সফরের সময়ই নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভারতীয় কোম্পানির অংশ গ্রহণের সুযোগ তৈরি করতে বলেন, যার অন্যতম সুবিধাভোগী হলো আদানি গ্রুপ।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০-এর আওতায় বিনা দরপত্রে স্বাক্ষরিত এই চুক্তির বিভিন্ন ধারা ও এ বিষয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট, শেয়ারবিজ, দ্য ডেইলি স্টার, সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চুক্তির শর্তগুলো বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থবিরোধী।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০-এর আওতায় বিনা দরপত্রে স্বাক্ষরিত এই চুক্তির বিভিন্ন ধারা ও এ বিষয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট, শেয়ারবিজ, দ্য ডেইলি স্টার, সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চুক্তির শর্তগুলো বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থবিরোধী। কারণ,
প্রথমত, চুক্তির ধারা ৩.১(বি) অনুসারে, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনক্ষমতার ৩৪ শতাংশের চেয়ে কম বিদ্যুৎ ক্রয় করলে পিডিবিকে নির্দিষ্ট অঙ্কের জরিমানা দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, ধারা ১৩.১ (জি)-এর চার উপধারা অনুযায়ী, বার্ষিক ঘোষিত চাহিদার যত কম বিদ্যুৎ পিডিবি নেবে, ততটুকু বিদ্যুতের কয়লার দাম, জাহাজের ভাড়া, বন্দরের খরচ দিতে হবে পিডিবিকে।
তৃতীয়ত, শিডিউল ৬-এর টেবিল (সি) অনুযায়ী, আদানি যে কয়লাই ব্যবহার করুক, কয়লার দাম হিসাব করার ক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়ার ইনডেক্স ও নিউ ক্যাসল ইনডেক্সের গড় ধরার কথা বলা হয়েছে। তা ছাড়া এ ধরনের অন্য সব চুক্তিতে কয়লার মূল্য বৃদ্ধি পেলে বিদ্যুতের দাম সর্বোচ্চ কত হবে তার একটা সীমা নির্ধারণ করা থাকলেও আদানির সঙ্গে চুক্তিতে এ রকম কোনো সীমা নেই। এতে কয়লার দাম বেশি পড়বে।
চতুর্থত, ভারতের স্থানীয় কয়লার বদলে আদানির মালিকানাধীন অস্ট্রেলিয়ার কয়লাখনি থেকে জাহাজে করে আদানির বন্দরে কয়লা আনা এবং সেখান থেকে আবার ৭০০ কিলোমিটার রেললাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্রে পরিবহণ করা, ভারতের অংশে যে সঞ্চালন লাইন নির্মিত হয়েছে, তার ব্যয়ও বিদ্যুতের দামের মধ্যে ধরা ইত্যাদি কারণে বিদ্যুতের দাম বেশি পড়বে।
পঞ্চমত, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হওয়ার পর এমনকি কোনো বিদ্যুৎ আমদানি না করলেও বাংলাদেশকে প্রতিবছর গড়ে ৪৫ কোটি ডলার বা ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বাবদ প্রদান করতে হবে, যা এই ধরনের অন্যান্য চুক্তির তুলনায় অনেক বেশি।
ষষ্ঠত, চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ আগামী ২৫ বছরের জন্য আদানি পাওয়ারের করের বোঝা বহন করবে, যে বোঝা ভারতীয় কোম্পানিটি তার সরকারের কাছ থেকে এরই মধ্যে ছাড় পেয়েছে। কর ছাড়ের কারণে আদানির এক বিলিয়ন ডলারের চেয়ে বেশি অর্থ বেঁচে যাবে; কিন্তু সেই করের টাকা চুক্তিতে আগে থেকে যোগ করা ছিল বলে বাংলাদেশকে দিয়ে যেতে হবে।
সপ্তমত, প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কয়লার পরিমাণ অন্যান্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনায় বাড়িয়ে ধরা হয়েছে।
অষ্টমত, আর্টিকেল ১৬ এবং ১৬(এ) অনুযায়ী, রাজনৈতিক বা প্রাকৃতিক কোনো কারণে (ফোর্স মেজার) যদি আদানি নির্দিষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারে, তবে আদানিকে কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। কিন্তু একই কারণে পিডিবি নির্দিষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ কিনতে না পারলে ক্যাপাসিটি চার্জ বা জরিমানা থেকে কোনো ছাড়ের বিধান সেখানে নেই।
নবমত, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার একটা বড় অংশ সারা বছর অব্যবহৃত থাকে। কিন্তু বিদ্যুৎ না কিনলেও চুক্তি অনুসারে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ বা ভাড়া দিতে হয়। ২০১০-১১ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ১২ বছরে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জই পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা। এ রকম একটা উদ্বৃত্ত উৎপাদন ক্ষমতার প্রেক্ষাপটে নতুন করে আদানির বিদ্যুৎ তো দূরের কথা, এমনকি ভারত থেকে বর্তমানে যে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ, সেটিরও আসলে কোনো প্রয়োজন নেই।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার একটা বড় অংশ সারা বছর অব্যবহৃত থাকে। কিন্তু বিদ্যুৎ না কিনলেও চুক্তি অনুসারে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ বা ভাড়া দিতে হয়। ২০১০-১১ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ১২ বছরে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জই পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা।
তার ওপর আবার ২৫ বছর ধরে ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে আমদানি দেশের অর্থনীতির বোঝাই শুধু বাড়াবে। আদানির বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হলে দুই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে–হয় বাংলাদেশের আরও বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে, এমনকি সেই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে যদি আদানির চেয়ে কম দরে বিদ্যুৎ পাওয়া যায় তাহলেও। অথবা আদানির বিদ্যুৎ না কিনেই বাংলাদেশকে বৈদেশিক মুদ্রায় ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে। দুটি ঘটনার যেটিই ঘটুক, তা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হবে।
সবচেয়ে বড় কথা, অর্থনৈতিক বিবেচনা ছাড়াও ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকেও বাংলাদেশের মতো তুলনামূলক ছোট একটি দেশের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মতো কৌশলগত পণ্যের জন্য ভারতের মতো আগ্রাসি বৃহৎ প্রতিবেশী দেশের ওপর এ রকম নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি বিপজ্জনক।
ভারতের বেসরকারি খাতের বৃহৎ কোম্পানি হিসেবে আদানি গ্রুপ যে ভারতের মোদি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে, তা এরই মধ্যে দেশ-বিদেশে নানাভাবে আলোচিত। মোদি সরকারের এই আদানি তোষণ যে ভারতের সীমানার বাইরেও সম্প্রসারিত, তার সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে বাংলাদেশ কর্তৃক দেশের স্বার্থের বিপরীতে আদানির কাছ থেকে দীর্ঘ মেয়াদে অপ্রয়োজনীয় ও ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ আমদানির এই বন্দোবস্ত।
কল্লোল মোস্তফা: প্রকৌশলী, গবেষক। ইমেইল: kallol_mustafa@yahoo.com