২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় ৫ জুন হাইকোর্টের এক রায়ের মাধ্যমে ২০১৮ সালে বাতিল করা কোটাব্যবস্থা পুনর্বহালের পরিপ্রেক্ষিতে। এ সময় থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারের নির্বাহী বিভাগের কাছে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবি জানাতে থাকেন। কিন্তু সরকার শিক্ষার্থীদের দাবির ব্যাপারে কোনো কর্ণপাত করেনি, তাদের সঙ্গে আলোচনার কোনো উদ্যোগ নেয়নি; বরং আদালতের এখতিয়ার বলে পাশ কাটিয়ে গেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই মাসের শুরুতে কোটা সংস্কার আন্দোলন সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ পর্যায়ে প্রবেশ করে। আন্দোলনকারীরা এ সময় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশের এলাকায় মিছিল-সমাবেশ করেছেন এবং স্বল্প সময়ের জন্য সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করেছেন। তখন পর্যন্ত আন্দোলনে সরকার কোনো বলপ্রয়োগ করেনি, ফলে আন্দোলন শান্তিপূর্ণই ছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ১৫ জুলাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর সরকারি ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের হামলার মধ্য দিয়ে। নিচে এ সময়কার ঘটনাবলির টাইমলাইন দেওয়া হলো:
দেশের সরকারের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা না থাকলে তার পরিণতি কী হতে পারে তার সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হলো কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকারের অকল্পনীয় নৃশংসতা ও ২ শতাধিক মানুষ হত্যার ঘটনা।১ কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল একেবারেই শান্তিপূর্ণ একটি আন্দোলন। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বহাল করে উচ্চ আদালতের এক রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ৫ জুন থেকে যে আন্দোলন শুরু হয় তা শান্তিপূর্ণ মিছিল-সমাবেশের মধ্যেই সীমিত ছিল।
কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকার আদালতের দোহাই দিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়াকে কোনো গুরুত্ব দেয়নি, এমনকি আলোচনা পর্যন্ত করতে রাজি হয়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে জুলাইয়ের শুরুতে আন্দোলন খণ্ডকালীন সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ পর্যায়ে প্রবেশ করে। তখনও আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল। আন্দোলনে সহিংসতা শুরু হয় ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ কর্তৃক বহিরাগত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানোর ঘটনার মধ্য দিয়ে।২
এই লেখাটি শুরু করেছি সোমবার (২২ জুলাই ২০২৪)। কারফিউ শুরুর পর আজ তৃতীয় দিন, ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ার পর চতুর্থ দিন, এবং কোটা আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভ শুরুর পর ২২তম দিন। এই ক’দিনে শাসকগোষ্ঠীর হঠকারিতা, দ্বিচারিতা, উন্নাসিকতা ও সাধারণ মানুষের প্রতি অবহেলা নগ্নভাবে হাজির হয়েছে। ইন্টারনেট না থাকায়, সোশ্যাল মিডিয়ার অনুপস্থিতিতে টেলিভিশন সরকারের পক্ষে একতরফা প্রচারণা চালাচ্ছে। খবর পাওয়ার আশায় একটানা কয়েক দিন টিভি দেখে আর সহ্য করতে না পেরে এই লেখাটি শুরু করেছি, কেবলই নিজের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাগুলো লিখে রাখতে। এটাকে গবেষণা প্রবন্ধ বলা যাবে না। বলা যাবে নিজের সঙ্গে নিজের আলাপ।
[গত বেশ কিছুদিন ধরে গার্মেন্টস শ্রমিকের নিম্নতম মজুরি নতুনভাবে নির্ধারণের জন্য আন্দোলন চলছে। শ্রমিক সংগঠনগুলোর চলমান আন্দোলনে অনেকগুলো সংগঠন থেকে নিম্নতম মজুরি হিসাবে দাবি উঠেছে ২৫ হাজার টাকা এবং আরও বেশি কিছু সংগঠন দাবি করেছে ২৩ হাজার টাকা। তাদের উভয়ের পক্ষ থেকে বিস্তারিত তথ্য যুক্তিও দেয়া হয়েছে। মজুরি বোর্ডের কালক্ষেপনের মধ্যেও তাদের অনেকে নিজ নিজ ব্যাখ্যা জমাও দিয়েছে। এসব কর্মসূচী ও আলোচনার মধ্যে গত ৮ই অক্টোবর গার্মেন্ট শ্রমিকের জন্য ১৭,৫৬৮ টাকা নিম্নতম মজুরির প্রস্তাব দিয়েছে দেশের খ্যাতনামা গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। যেহেতু প্রস্তাবটি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে, এবং দেশের অর্থনীতি নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে যাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে, তাই তাদের এহেন কম মজুরির প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করা জরুরী বলে আমরা মনে করি। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই সিপিডির প্রস্তাব পর্যালোচনা করে এই লেখা।]
শুরুতেই বলে নেয়া ভাল যে, শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণ নিয়ে কথা বলা কোন ইচ্ছাপূরণের গল্প বা উইশফুল থিংকিং এর বিষয় নয় যে মন চাইল আর একটা বলে দিলাম। এটা শ্রমিকের অস্তিত্বের প্রশ্ন। তার সুস্থ শরীরে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার প্রশ্ন এবং বাজার অর্থনীতিতে সেটা দীর্ঘমেয়াদে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতার প্রশ্নও বটে। এই প্রস্তাব বিজিএমইএ দিলে সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন প্রয়োজনই পড়ত না। কারণ বিজিএমইএ এমন কম মজুরি বা তার থেকেও কম মজুরির প্রস্তাব দিবে তেমনটাই তাদের শ্রেণীস্বার্থে স্বাভাবিক। কিন্তু একটি বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান এরকম প্রস্তাব দিলে তা গুরুতর বিষয়ই বটে।
সিপিডি নিম্নতম মজুরীর প্রস্তাব করতে গিয়ে তাদের নিজেদের পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে (মূল রিপোর্ট তারা প্রকাশ করেনি এখনো) বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকের দুর্দশা অল্পবিস্তর তুলে ধরার পরেও, শেষমেষ যে পদ্ধতিতে ওই নিম্নতম মজুরি হিসাব করেছে তাতে শ্রমিকের প্রতি ভীষণ অসংবেদনশীলতা ও শ্রেণীগত অবহেলারই বহিপ্রকাশ ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সিপিডির করা সেই হিসাব নিয়ে পদ্ধতিগতভাবেই কতগুলো গুরুতর প্রশ্নের উদ্রেক হচ্ছে। কীভাবে সেটাই নীচে আলোচনা করা হচ্ছে।