শিক্ষায় বাধ্যতামূলক ইংরেজি ভাষা: জাতীয় বিকাশের গলায় ফাঁস

শিক্ষায় বাধ্যতামূলক ইংরেজি ভাষা: জাতীয় বিকাশের গলায় ফাঁস

আলমগীর খান

২১শে ফেব্রুয়ারি একই সঙ্গে লড়াইএর ইতিহাস সামনে হাজির করে একইসঙ্গে হাজির করে গুরুতর প্রশ্নমালা। এই লেখায় সেগুলোই তুলে ধরা হয়েছে।

পৃথিবীতে এমন একটি সোনার দেশের নাম উল্লেখ করতে পারবেন কি, যে দেশে একটি নির্দিষ্ট ভিনদেশি ও ভিনজাতির ভাষার ব্যাকরণিক নিয়মকানুন না জানলে কাউকে শিক্ষিত বলে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকার করা হয় না—অর্থাৎ, পরীক্ষা পাসের সনদপত্র দেওয়া হয় না? উদ্ভট ব্যাপার হচ্ছে, সেই সোনার দেশের কিছু মানুষ একসময় মাতৃভাষায় পড়ালেখা ও রাজকার্য পরিচালনার অধিকার অর্জনের জন্য রক্তদান করেছিল। সেই সোনার দেশ বাংলাদেশ। দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত বিষয় কিছুতেই মিলতে চায় না। কিন্তু বেশ মিলেমিশে আছে, কারো টুঁ শব্দ নেই।

সত্তর বছর আগে রক্তদানের সেই দিনটিকে অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে এ দেশে পালন করা হয়। সর্বোপরি এ ঐতিহাসিক দিনটি বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে এ দেশের মানুষের মাতৃভাষা বাংলার অবস্থা কী? এ দেশের যে কোনো শহরের রাস্তায় নামলেই দেখা যাবে সাইনবোর্ডে বিভিন্ন দোকানপাট, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের নাম ইংরেজিতে লেখা খুব সুন্দর জ্বলজ্বলে অক্ষরে। আর বাংলায় লেখা বিভিন্ন সাইনবোর্ডে ও নির্দেশিকায় ভুল ব্যাকরণ ও বানানের ছড়াছড়ি।

এটা এমনই একটি দেশ, যার বিভিন্ন গণ্ডিতে, প্রাঙ্গণে ও প্রতিষ্ঠানে বাংলায় কথা বলা রীতিবহির্ভূত মনে করা হয়, যেখানে প্রবেশ করলে যে কারো একে এক অদ্ভুত ভিন ভাষার ভূখণ্ড মনে হতে পারে, যা কিছুটা ইংরেজির মতো শোনায়। এ এমনই এক দেশ, যার কোনো কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ বিশেষ গণ্ডির মাঝে মাতৃভাষায় কথা বলা নীচুতার বা আতরাফের পরিচয় বলে মনে করে এবং এমন একটি ভাষায় কথা বলার কসরত করে, যাকে তারা ‘ইংরেজি’ বলে মনে মনে বিশ্বাস করে। এ শ্রেণিটি অত্যন্ত ক্ষমতাশালী, যারা মাতৃভাষা ভালো জানে না বলে গৌরব অনুভব করে এবং বিদেশি ভাষা না পারলেও তাতে খুব পারঙ্গম মনে করে এক মিথ্যাগর্বের মায়ায় বুঁদ হয়ে থাকে। যারা ইংরেজি নামের বিদেশি ভাষাটি গরিব স্বদেশিদের পিঠের ওপর ছড়ির মতো ঘোরায়। অথচ এ উদ্ভট ইংরেজি এ সীমানার বাইরেই এক অচল মাল।

এ এমনই এক দেশ, যার কোনো কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ বিশেষ গণ্ডির মাঝে মাতৃভাষায় কথা বলা নীচুতার বা আতরাফের পরিচয় বলে মনে করে এবং এমন একটি ভাষায় কথা বলার কসরত করে, যাকে তারা ‘ইংরেজি’ বলে মনে মনে বিশ্বাস করে। এ শ্রেণিটি অত্যন্ত ক্ষমতাশালী, যারা মাতৃভাষা ভালো জানে না বলে গৌরব অনুভব করে এবং বিদেশি ভাষা না পারলেও তাতে খুব পারঙ্গম মনে করে এক মিথ্যাগর্বের মায়ায় বুঁদ হয়ে থাকে।

আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশে প্রথম শ্রেণি থেকেই ছেলেমেয়েদের ইংরেজি শিক্ষা দেওয়া হয়। বেসরকারি স্কুলগুলোয় প্রাক-প্রাথমিক থেকেই এ উদ্যোগ শুরু হয়। আর ছেলেমেয়ে যতই ওপরের ক্লাসে ওঠে, ততই বাড়তে থাকে ইংরেজির গুরুত্ব। ইংরেজিতে পাস না করে কারো পক্ষে ওপরের ক্লাসে ওঠা সম্ভব নয়। অথচ সেই ইংরেজি শিক্ষার অবস্থাটা কী? এক কথায়: করুণ। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো তাদের পুওর ইকোনমিকস বইয়ে লিখেছেন,

‘সন্তানকে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাদান দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে বাবা-মায়ের কাছে বেশ আকর্ষণীয়। কিন্তু অ-ইংরেজিভাষী বাবা-মায়ের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় যে, শিক্ষক ইংরেজি শেখাতে পারছেন কি না।’

সত্যিটা হচ্ছে, আসলেই তারা পারেন না। স্কুল-কলেজ থেকে কেউ ইংরেজি শেখে না, যা শেখে তা পারিবারিকভাবে কিংবা ব্যক্তিগত চেষ্টায়। পারিবারিক সহযোগিতা ছাড়া কিংবা বিশেষ ক্ষেত্রে খুব ভালো কোনো শিক্ষকের তত্ত্বাবধান ছাড়া আমাদের স্কুল-কলেজে যে ইংরেজি শিক্ষা তা খুবই কৃত্রিম, বাস্তবতাবিচ্যুত ও অপ্রয়োজনীয়। বহুভাষীর দেশ ভারতে ও পাকিস্তানে তা ভিন্ন প্রদেশের মানুষের যোগাযোগের ভাষা হিসেবে কাজে লাগলেও আমাদের তা কোনো কাজে আসে না। অথচ স্কুল-কলেজের দরজা পার হওয়া থেকে শুরু করে চাকরির দরজায় প্রবেশ পর্যন্ত এই বিদেশি ভাষার দৌরাত্ম্য। যার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

প্রশ্ন হচ্ছে: কেন এই দৌরাত্ন্য? সে কি কেবলই না-বুঝে, না-জেনে? আমাদের স্বাধীন দেশের শাসকগোষ্ঠী কি এতই নির্বুদ্ধি যে তারা স্বাধীন ও ভাষিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত প্রায় একভাষী জনগোষ্ঠীর এই দেশে ইংরেজির অপ্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারেন না? তারা আমার-আপনার চেয়ে হাজার গুণ ভালো বোঝেন। তবু ইংরেজির দৌরাত্ন্য আছে ও ততদিন থাকবে, যতদিন-না দেশটি সর্বজনের হয়ে উঠবে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন,

‘পূর্ববঙ্গে ভাষাকে ভিত্তি করে একটা নতুন সমাজ গড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভাষা বলছে ঐক্যবদ্ধ হতে এবং ভাষাই বলে দিচ্ছে কীভাবে তা সম্ভব হবে, শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের বিভাজনকে ভেঙে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলে।’

সংকটের শিকড় ইতিহাসের গভীরে। শাসকগোষ্ঠীর মানুষ সবসময়ই জনগণের চেয়ে ভিন্ন ভাষায় কথা বলে। শাসকগোষ্ঠীর একটি নিজস্ব ভাষা থাকে, যা জনগণ জানে না কিংবা পারে না। এখানে যেমন একসময় শাসকগোষ্ঠীর ভাষা ছিল ফারসি। ভারতে একসময় ছিল সংস্কৃতের আধিপত্য। ইউরোপে ছিল ল্যাটিনের দৌরাত্ন্য। ভারত ব্রিটিশ শাসনের অধীন যাওয়ার পর থেকে এখানকার শাসকগোষ্ঠীর ভাষা ইংরেজি; এমনকি ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তা-ই থেকে গেছে।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে বাঙালি ছাত্র-জনতার মহান আত্মত্যাগ ও দুর্বার আন্দোলনের পর ১৯৫৩ সালের মার্চে কবি হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনটি প্রকাশিত হয়। এটি একটি ঐতিহাসিক সাহিত্যিক-দলিল। এ সংকলনে প্রকাশিত আলী আশরাফের লেখা ‘সকল ভাষার সমান মর্যাদা’ একটি গভীর চেতনাসমৃদ্ধ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রচনা। এ ঐতিহাসিক রচনাটিতে শাসক ও জনগণের ভাষিক দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে লেখক বলেছিলেন:

“তদানীন্তন শাসকচক্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা জনগণের ভাষার দাবি মেনে নেয়নি। অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠী জোর করে চাপিয়ে দিল যে, ইংরেজিই হবে একমাত্র ‘রাষ্ট্রভাষা’। ‘রাষ্ট্রভাষা’ কথাটাও স্বৈরাচারী-রাষ্ট্রব্যবস্থার ফলরূপেই প্রচলিত হয়ে আসছে। অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পত্তনের আগে রাষ্ট্রব্যবস্থা যখন ছিল সামন্তযুগীয় রাজতন্ত্র, যখন শাসকগোষ্ঠী দেশের জনসাধারণ থেকে আলাদা ও উচ্চতর জীব হিসেবে একটা বিশেষ মর্যাদা ও অধিকারসম্পন্ন শ্রেণি (Privileged Class) বলে নিজেদের জাহির করত, তখন রাজদরবারে ব্যবহৃত হতো একটি বিশেষ ভাষা (Court Language), যে ভাষা অধিকাংশ জনসাধারণের ভাষা হতো না। যেমন, নবাবি আমলের এক সময়ে বাংলাদেশের রাজদরবারে ব্যবহৃত হতো ফারসি।’

শাসকগোষ্ঠীর লোকজনকে সবসময় জনগণ থেকে কিছুটা আলাদা হতে হয় ভাষায়, পোশাকে, শিক্ষায় ও সংস্কৃতিতে। তা নাহলে তো জনগণকে ভালোমতো শাসন ও দমন করা যায় না। অভিজিৎ ও দুফলো তাদের বইয়ে লিখেছেন,

‘শিক্ষাবিষয় ও বিদ্যালয় সংগঠন সবই ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের অতীতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা, যার লক্ষ্য হচ্ছে তাদের ও বাকি জনগণের মাঝে যতদূর সম্ভব দূরত্ব সৃষ্টি।’

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, ‘মর্মান্তিক হলেও এটা সত্য যে, বাংলায় সাম্প্রদায়িকতার জন্য দুই সম্প্রদায়ের শিক্ষিত মানুষেরাই দায়ী, তারাই চাকরি ও জনপ্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে পারস্পরিক রেষারেষিটাকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়েছে। শিক্ষা খুব বেশি বেশি পরিমাণে যা তৈরি করেছে তা হলো শ্রেণি-বিভাজন।’

এই দূরত্ব তৈরির কাজে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আগের চেয়ে আরও বেশি পারঙ্গম। আমাদের শিক্ষকের ভাষা ছাত্রছাত্রী বোঝে না, বিচারকের ভাষা আসামি বোঝে না এবং চিকিৎসকের ভাষা রোগী বোঝে না—কারণ, তারা ভিন্ন ভাষায় কথা বলেন। চিকিৎসকরা ইংরেজিতে পড়ালেখা করেন ও ইংরেজিতে প্রেসক্রিপশন লেখেন, রোগী কিছু জানতে চাইলে দু-চারটে ধমকধর্মী ইংরেজি শব্দ প্রয়োগ করে তাকে থামিয়ে দেন। অথচ স্বাধীনতার এত বছর পরও এসব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পেশার মানুষ বাংলায় লিখতে ও বলতে পারেন না? কেন বিশেষায়িত ও উচ্চশিক্ষা ইংরেজি ছাড়া সম্ভব নয়? দেখেশুনে মনে হয়, ১৭৫৭ সালে পলাশির প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে ব্রিটিশরা এ দেশ দখল করে দুইশ বছর পদানত না রাখলে এ দেশে কোনোদিন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি পয়দা হওয়াই সম্ভব হতো না! কী ভাগ্য আমাদের!

আমাদের শিক্ষকের ভাষা ছাত্রছাত্রী বোঝে না, বিচারকের ভাষা আসামি বোঝে না এবং চিকিৎসকের ভাষা রোগী বোঝে না—কারণ, তারা ভিন্ন ভাষায় কথা বলেন।

স্বাধীনতার এত বছর পরও উচ্চশিক্ষা কেন ইংরেজি ছাড়া সম্ভব নয়? অজুহাত হিসেবে শোনা যায়, বিশেষায়িত ও উচ্চশিক্ষার বই বাংলায় নেই। নেই কেন, অনুবাদ হয়নি বলে? তা যারা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য পর্যায়ে এসব বিষয় পড়ান, তারাও এসব বই অনুবাদ করতে পারেন না? তা হলে তারা কী পড়ান ও কী করে পড়ান? নাকি আসলে কিছুই পড়ান না, কেবল কিছু চর্বিতচর্বণ করে বেড়ান, মুখস্থবিদ্যা ক্লাসে উগরে দেন? যদি তারা এগুলো পড়াতে পারেন, তবে অনুবাদ করতে পারেন না কেন? শিক্ষকদের পদোন্নতির সঙ্গে ক্লাসের বইয়ের অনুবাদ যুক্ত করে দিলেই খুব সহজে কাজটা হয়ে যায়। কর্তৃপক্ষ তা করে না কেন? তা করলে দূরত্বটা ঘুচে যাবে, অনেক কিছু বিপজ্জনক সমতায় চলে আসবে, তাই।

আর তাই আমাদের ছেলেমেয়েকে ১২ থেকে ১৭ বছর একটানা এই ইংরেজির ঘানি টানতে হবে। কোনো সুফল ছাড়াই। ইংরেজির এই ঘানি টানার সংকটটি যেমন ব্যক্তিগত, তেমনি জাতীয় ও ঐতিহাসিক। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এই ঐতিহাসিক জাতীয় ঘানি টানার প্রসঙ্গে বাঙালির জাতীয়তাবাদে ‘মেকওলে, বিদ্যাসাগর ও বিবেকানন্দ’ অধ্যায়ে লিখেছেন,

‘বাঙালি মধ্যবিত্তের জন্য ভাষার প্রশ্নটি খুবই জরুরি। ইংরেজি শিখে সে তার মধ্যবিত্তের অবস্থানের প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছে। ভাষা একটা বোঝাও ছিল বইকি। বিস্তর সময় গেছে ওই ভাষা শিখতে, যার ফলে অন্য কিছু শেখা কঠিন হয়েছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতি বাধা পেয়েছে।’

এর অর্থ এই নয় যে, ইংরেজি শিক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই, বা হুট করে শিক্ষা থেকে ইংরেজি তুলে দিতে হবে। প্রয়োজন আছে তো অবশ্যই। শুধু ইংরেজি কেন, যে কোনো বিদেশি ভাষা শিক্ষারই মূল্য আছে। একাধিক ভাষা জানা নিঃসন্দেহে একটি ভালো গুণ। আর আজকাল একটি দেশে যত বেশি মানুষ বিভিন্ন ভাষা জানবে, সেই দেশের তত মঙ্গল। কারণ, তাদের তত বেশি আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতির সম্ভাবনা। কিন্তু সেই ভাষা শিক্ষাটা হতে হবে সম্পূর্ণ স্বাধীন ইচ্ছানির্ভর, বাধ্যতামূলক নয়। প্রয়োজন আন্তরিক কার্যকর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।

শুধু ইংরেজি কেন, যে কোনো বিদেশি ভাষা শিক্ষারই মূল্য আছে। একাধিক ভাষা জানা নিঃসন্দেহে একটি ভালো গুণ। আর আজকাল একটি দেশে যত বেশি মানুষ বিভিন্ন ভাষা জানবে, সেই দেশের তত মঙ্গল। কারণ, তাদের তত বেশি আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতির সম্ভাবনা। কিন্তু সেই ভাষা শিক্ষাটা হতে হবে সম্পূর্ণ স্বাধীন ইচ্ছানির্ভর, বাধ্যতামূলক নয়। প্রয়োজন আন্তরিক কার্যকর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য ও মূল কথা তো এই: কোনো ভাষার প্রতি বিদ্বেষ নয়, ‘সকল ভাষার সমান মর্যাদা’। অথচ দোকানের নামফলকে, উচ্চশিক্ষার বিদ্যালয়ে, আদালত প্রাঙ্গণে, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনে, পরীক্ষাযুদ্ধে, চাকরির আবেদনে—এ দেশে সর্বত্র একটি ভাষার আধিপত্য, তা হলো ইংরেজি। এ কি কাকতলীয়?

‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনে ‘সকল ভাষার সমান মর্যাদা’র লেখক আলী আশরাফ তখনই সতর্ক করেছিলেন,

“একুশে ফেব্রুয়ারির সে গৌরবময় গণজাগরণের সামনে স্বৈরাচারী লীগ শাসনকে সাময়িকভাবে হলেও পিছু হটতে হয়েছে। তার প্রমাণ হলো, শাসনতন্ত্রের মূলনীতি কমিটির রিপোর্টে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। স্বৈরাচারী শাসকচক্রের এখন এ সাহস নেই যে, প্রকাশ্য ঘোষণা করতে পারে, ‘উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা।’ তাই তারা চুপ করে আছে। এটা তাদের দুর্বলতার লক্ষণ। তবে তাদের এ নীরবতার আর একটা দিক আছে। প্রথমত: এ নীরবতার ফাঁকে এখনো কার্যত ইংরেজি ‘রাষ্ট্রভাষারূপে’ চালু থেকে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত: স্কুল-কলেজে উর্দুকে বাধ্যতামূলক করে এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার কার্য পরিচালনায় উর্দুভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে শাসকচক্র অপেক্ষা করছে সুযোগের সন্ধানে।’

কোন সুযোগ? লেখকের কথায়, “যেহেতু এরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর ব্রিটিশের প্রভাব রয়েছে ও এরা রাখতে চাচ্ছে, সে জন্য এরা ‘আরও ২০ বৎসর’ ‘রাষ্ট্রভাষারূপে ইংরেজিকেও চালু রাখার জন্য ওকালতি করছে। অর্থাৎ, উর্দুকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ করেও নানা যুক্তি ওজর দেখিয়ে তার সঙ্গে ইংরেজিকেও ‘রাষ্ট্রভাষার’ মর্যাদা দিয়ে রাখা এই স্বৈরাচারী শাসকচক্রের অভিসন্ধি।”

অর্থাৎ, উর্দুকে নামকাওয়াস্তে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে রেখে কার্যত ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় রেখে দেওয়ার অভিসন্ধি। স্পষ্টতই তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দুটি দুরভিসন্ধির উল্লেখ করেছেন উক্ত ঐতিহাসিক প্রবন্ধটির লেখক। প্রথমত, বাংলার দাবিকে কৌশলে পাশ কাটিয়ে উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় রাখা। দ্বিতীয়ত, কূটবুদ্ধিমূলক: কার্যত ইংরেজিকেই রাষ্ট্রভাষার স্থানে রাখা। বায়ান্নয় আমরা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রথম দুরভিসন্ধিকে প্রতিহত করেছি এবং আন্দোলনের সেই গতিবেগকে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় রূপান্তর করেছি। কিন্তু তাদের দ্বিতীয় দুরভিসন্ধি?

লেখক তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক চরিত্রটি চিহ্নিত করেছিলেন এভাবে: ‘এরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর ব্রিটিশের প্রভাব রয়েছে ও এরা রাখতে চাচ্ছে।’ এখানে উল্লেখ্য যে, লেখক আলী আশরাফ মূলত তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা খোকা রায়ের ছদ্মনাম। স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী হলেন বাঙালিরা, কিন্তু এই জাতিগত পরিবর্তনটুকু ছাড়া স্বাধীনতার পর আমাদের শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক চরিত্র কি ভিন্ন ছিল যারা আর ব্রিটিশ বা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী নয় এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব রাখতে চায় না?

ফলে আজ দেখা যাচ্ছে, মাত্র ‘আরও ২০ বৎসর’ নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আজও ইংরেজি ভাষাটি বহাল তবিয়তে আছে। এতটা বহাল তবিয়তে যে এ দেশের কোনো ছেলে বা মেয়ে পরীক্ষা পাসের সনদপত্রই লাভ করবে না, যদি-না সে ইংরেজিতে অন্তত একটা পাস নম্বর পায়। বিজ্ঞানে, সমাজে, গণিতে ও প্রত্যেক বিষয়ে ১০০ নম্বর করে পেয়েও যদি কোনো শিক্ষার্থী একটি সাম্রাজ্যবাদী জাতির ভাষায় পাস নম্বর না পায়, তার ওপরের ক্লাসে ওঠার অধিকার নেই। এই ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর ভাষাটিতে পাস নম্বর না পেলে কার্যত ধরে নেওয়া হয় তার বিজ্ঞানের, সমাজের, গণিতের ও মাতৃভাষার জ্ঞান ও দক্ষতা শূন্য–ফলে পরীক্ষায় সে অকৃতকার্য।

এ অবস্থায় সেই শিক্ষার্থীর মনে যদি প্রশ্ন আসে: সে কি একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক, না একটি ঔপনিবেশিক শক্তির অধীন রাষ্ট্রবিহীন দাস, তাকে দোষ দেওয়া যাবে কি? নিজস্ব স্বতন্ত্র ভাষা সমৃদ্ধ একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হলে একটি বিদেশি ভাষায় পাস নম্বর পাওয়া এই দেশে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক কেন? মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ও ভাষা আন্দোলনের সত্তর বছর পরও এ লজ্জা কোথায় রাখি?

ঔপনিবেশিক আমলের শিক্ষার ধারণার মধ্যে ইংরেজি ভাষায় লিখতে ও পড়তে পারাটা অন্তর্নিহিত। এই বিদ্যাশিক্ষা নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নানারূপ বিদ্রুপ রয়েছে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, ‘ইংরেজ শাসনের প্রত্যক্ষ ফলগুলোর মধ্যে একটি নতুন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি সৃষ্টি।’১০ আরেক স্থানে তিনি লিখেছেন, ‘শিক্ষার উদ্দেশ্যই ছিল বিজাতীয় মানুষ তৈরি করা; চীনকে ইংরেজ আফিম খাইয়েছে, বাঙালিকে খাইয়েছে শিক্ষা …।’১১ বাঙালির জন্য এটি আরও বিপজ্জনক হয়েছে। কেননা, সেই শিক্ষার আফিমটা আবার ইংরেজিতে গুলানো।

একটু ইংরেজিতে লিখতে ও পড়তে পারা এবং উদ্ভট উচ্চারণে ভুল ইংরেজি বলতে পারা এই তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ মধ্যবিত্ত শ্রেণিটি সুবিধাভোগী একটি শ্রেণি হিসেবে আরামদায়ক জীবনযাপনের সুযোগটা সহজে হাতছাড়া করবে কেন? সে কি এতই বেকুব? সে কারণে বাংলাদেশে ইংরেজিও আছে বহাল তবিয়তে এবং থাকবে ততদিন পর্যন্ত, যতদিন সর্বজনের রাষ্ট্র গড়ে না উঠবে। ভাষার লড়াইটা তা বাংলাদেশে এখনও শেষ হয়নি—চলছে ও চলবে।

আলমগীর খান: সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি। ই-মেইল: alamgirhkhan@gmail.com

তথ্যসূত্র

১. অভিজিৎ ভি ব্যানার্জি ও এস্থার দুফলো, Poor Economics: A Radical Rethinking of the Way to Fight Global Poverty, c„. 91, Public Affairs, পৃ. ৯১, Public Affairs, নিউ ইয়র্ক, ইউএসএ, ২০১১

২. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বাঙালির জাতীয়তাবাদ, পৃ. ৪৮, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ২০১৫

৩. একুশে ফেব্রুয়ারি, সম্পাদনা: হাসান হাফিজুর রহমান, সময় প্রকাশন, ২০১৬

৪. পূর্বোক্ত, পৃ. ৮৭

৫. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি, পৃ. ৮৯, সংহতি, ঢাকা, ২০১৫

৬. পূর্বোক্ত, বাঙালির জাতীয়তাবাদ, পৃ. ৪১৮

৭. পূর্বোক্ত, একুশে ফেব্রুয়ারি

৮. ওই

৯. অধ্যাপক যতীন সরকার, বর্তমান প্রবন্ধলেখকের ফোনালাপ থেকে জানা তথ্য, ১ জানুয়ারি ২০২৩

১০. পূর্বোক্ত, জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি

১১. পূর্বোক্ত, বাঙালির জাতীয়তাবাদ, পৃ. ৮৮

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •