এই অঞ্চলের নদ-নদী খাল-বিল জীবন-যাপন

খুলনার গণতান্ত্রিক আন্দোলন, কৃষক বিদ্রোহ ও সশস্ত্র সংগ্রাম-২

এই অঞ্চলের নদ-নদী খাল-বিল জীবন-যাপন

রণজিৎ চট্টোপাধ্যায়

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিক সামাজিক বৈচিত্র আছে, সমাজজীবনের পরিবর্তনের ধারা আছে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শক্তিশালী ঐতিহ্য আছে। অগণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের আধিপত্যের কালে নিজেদের শক্তির জায়গাগুলো পুনপাঠ প্রয়োজন। এই ধারাবাহিক লেখায় খুলনা অঞ্চলের বিশেষ অবস্থান এবং কৃষক বিদ্রোহ এবং সশস্ত্র সংগ্রামের অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে এই অঞ্চলের নদনদী খাল বিল ও জীবন যাপনের অতীত ও বর্তমান আলোচনা করা হয়েছে।

বিশ্ব প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে মানুষ। অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষও একটি জীব। তবে পার্থক্য হলো, মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে। এ পর্যন্ত মানবজাতি প্রকৃতির বিরুদ্ধাচারণ করেছে, তার নিজের সুখ ভোগের জন্য। ভোগবাদী উৎপাদনব্যবস্থায় মুনাফা বাড়িয়ে চলার জন্য মানুষ প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করেছে, তার ধ্বংসসাধনের চেষ্টা করেছে, প্রকৃতির বিরুদ্ধে তার স্বীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। অথচ প্রয়োজন ছিল বিশ্ব প্রকৃতির নিয়মবিধি জানা এবং সেই জানা জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজেদের জীবন-জীবিকা, আবাস, নগর, শহর সুখভোগের সামগ্রীগুলো প্রস্তুত করা এবং ভোগ করা।

পার্বত্যাঞ্চল থেকে নদীর উৎপত্তি এবং সমুদ্রের সঙ্গে মিলিত হওয়া নদ-নদীর নিয়ম। নদীর এই গতিপথে পাহাড়ি পাললিক শিলা, কর্দম, বালুকণা প্রভৃতি বহন করে নদী তার তীরভূমি গঠন করে, স্থলজ জীবকুলের বসবাসের উপযোগী করে, নানাবিধ বৃক্ষরাজি, ফুল-ফলে সুশোভিত করে তোলে। আগেই বলেছি, ভাগীরথী-পদ্মার অববাহিকা হলো বাংলাদেশ। তাই বিশেষ করে যশোর-খুলনাসহ অনেক জেলা এই যুক্ত স্রোতধারায় নির্মিত হয়েছে এবং বাসোপযোগী হয়েছে। এই লেখায় আলোচ্য খুলনা, বাগেরহাট সাতক্ষীরা অর্থাৎ বৃহত্তর খুলনার প্রধান প্রধান নদীর গতিপথ নিয়ে কিছু আলোচনা করা হচ্ছে।

খুলনার প্রধান নদী মূলত তিনটি। মধুমতী, ভৈরব ও কপোতাক্ষ। এ ছাড়া চিত্রা, আতাই, আত্রাই, সুজতখালি, আঠারোবাঁকি, শিপসা, রূপসা, বলেশ্বর প্রভৃতি শাখা নদী এখনো বিদ্যমান। তবে খুলনার অন্যতম প্রধান নদী কপোতাক্ষ, যা মূলত সাতক্ষীরার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত, তা এখন মৃতপ্রায়। সরকারি খননকাজের কিছু চেষ্টা দেখা গেলেও উজানের স্রোতধারা ক্ষীণ হওয়ায় এবং এতদঞ্চলের অধিকাংশ জলাভূমি, বিল, হাওড়-বাওড় নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হওয়ায় এই নদীর আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই।

খুলনার প্রধান নদী মূলত তিনটি। মধুমতী, ভৈরব ও কপোতাক্ষ। এ ছাড়া চিত্রা, আতাই, আত্রাই, সুজতখালি, আঠারোবাঁকি, শিপসা, রূপসা, বলেশ্বর প্রভৃতি শাখা নদী এখনো বিদ্যমান। তবে খুলনার অন্যতম প্রধান নদী কপোতাক্ষ, যা মূলত সাতক্ষীরার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত, তা এখন মৃতপ্রায়।

প্রকৃতপক্ষে ভৈরব নদের জন্ম গঙ্গার বুকে। মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি নামক স্থান থেকে এর উৎপত্তি। ভৈরব নদ নদীয়া জেলার করিমপুর থানার মধ্য দিয়ে সুবোলপুরে মাথাভাঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই মিলিত স্রোত দর্শনায় প্রবাহিত হয়ে চব্বিশ পরগনায় চলে যায়। এটি আবার দর্শনা থেকে ভৈরব নাম নিয়ে পুনরায় প্রবাহিত হয়ে কোটচাঁদপুরের ওপর দিয়ে যশোর শহরে প্রবেশ করে। ভৈরব কোটচাঁদপুর হয়ে হাকিমপুরে পৌঁছলেই আরেকটি স্রোতধারা দক্ষিণমুখে প্রবাহিত হয়। তাই দক্ষিণগামী স্রোতধারাই হলো কপোতাক্ষ। পথে মরজাদ নামের বিশাল এক বাঁওড় বেষ্টনী দিয়ে চৌগাছার কাছে যেতে-না-যেতেই ভৈরব থেকে আরেকটি শাখা যশোর জেলার মনিরামপুরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। মুক্তিশ্বরী নামে এই শাখাটি ভবদহের সঙ্গে মিলিত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে পশুরের সঙ্গে যুক্ত হয়। ভবদহের সঙ্গে মিলিত হলে মুক্তেশ্বরীর নাম পরিবর্তিত হয়ে ট্যাক নাম ধারণ করে। অবশেষে পশুরের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়।

ভৈরব যশোর শহরের পূর্বপ্রান্ত দিয়ে প্রবাহিত হয় নোয়াপাড়ার স্থলবন্দর, ফুলতলা হাট হয়ে আটরা-গিলাতলা গ্রামের পূর্বপ্রান্তে প্রবাহিত হয়ে সিদ্ধিপাশায়ে এলে মধুমতীর একটি উপশাখা সুজতখালী তার বিপুল জলরাশি বহন করে এই ভৈরবের সঙ্গে মিলিত হয়। তখন ভৈরবে স্রোতধারা আরও অনেক খরস্রোতা ও বেগবান হয়ে দৌলতপুর নদীবন্দরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণে টাউন খালিশপুরের কাছে এলে পূর্বদিক থেকে মধুমতীর আরেকটি শাখা আতাই বা চাড়াঘাটা এসে ভৈরবের সঙ্গে যুক্ত হয়। তারপর ভৈরব আরও বড় কলেবরে বিপুল স্রোত নিয়ে খুলনা শহরে প্রবেশ করে। খুলনা শহর থেকে জেলখানা ঘাটের কাছে এসে ভৈরব উত্তরগামী হয়ে আলইপুরের কাছে গেলে মধুমতীর আরেকটি শাখা মিলিত হয়। তখন ভৈরব পূর্বগামী হয়ে মৌভোগ, ঘাটভোগ, মালশা প্রভৃতি গ্রামের মধ্য দিয়ে যাত্রাপুর এসে দক্ষিণগামী হয়ে বাগেরহাট শহরে প্রবেশ করে। ভৈরব যখন খুলনা শহরের পূর্বপ্রান্তে, তখন ওখান থেকে একটি খাল খনন করে কাঁচিপাতা পশুরের সংগমস্থলের সঙ্গে ভৈরবকে সংযুক্ত করা হয়। এর ফলে যাতায়াতের অনেক সুবিধা হয় ঠিকই, কিন্তু ওই সংযোগ খালটি বর্তমানে বিশাল নদীতে রূপ নিয়ে ভৈরবের স্রোতধারাকে ক্ষীণ করে দিয়েছে। রূপলাল সাহা নামে জনৈক ব্যক্তি এই খাল খনন করেছিলেন বলে নাম ছিল রূপ সাহার খাল। কালক্রমে তা রূপসা খাল এবং বর্তমানে বিশাল রূপসা নদীতে পরিণত হয়েছে। ভৈরব নদ বাগেরহাট শহরে আসার পর অনুরূপ দাড়বান্ধা নামে আরেকটি খাল খনন করে ভৈরবের স্রোতধারাকে ক্ষীণতর করেছে। ভৈরব বাগেরহাট শহরের পূর্বপ্রান্ত থেকে পূর্বগামী হয়ে কচুয়ার কাছে এসে বলেশ্বরে মিলিত হয়েছে। বস্তুতপক্ষে বলেশ্বর মধুমতী ভিন্ন এক নাম।

রূপলাল সাহা নামে জনৈক ব্যক্তি এই খাল খনন করেছিলেন বলে নাম ছিল রূপ সাহার খাল। কালক্রমে তা রূপসা খাল এবং বর্তমানে বিশাল রূপসা নদীতে পরিণত হয়েছে।

মধুমতী বিচিত্র গতি। কুষ্টিয়ার কাছে গৌরী, গরুই বা গড়াই। পদ্মা থেকে বেরিয়ে নদীয়া হয়ে যশোরের কুমার নদের সঙ্গে মিলিত হয়ে তার শাখা নদী হয়ে বারাসিয়া নাম নিয়ে হলো সে দক্ষিণগামী। গৌরীর পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি পেলে বারাসিয়া থেকে এলেংখালী নামে আরেকটি শাখা বেরিয়ে গিয়ে আবার মধুমতীতে মিলিত হয়। দক্ষিণ মুখে বহুদূর এগিয়ে আসে এবং মানিকদহের কাছে আঠারোবাঁকি শাখার জন্ম দিয়ে খুলনা জেলায় প্রবেশ করে। আরও এগিয়ে এসে মধুমতীর নাম গেল পালটে, বলেশ্বর নাম নিয়ে কচুয়ার কাছে এলে ভৈরবের জলস্রোত মিলিত হয়। এই মিলিত স্রোত ক্রমান্বয়ে বিষখালী, পর্ণগুছি, কচা, ভোলা, পাঁকাশিয়া প্রভৃতি নদীর স্রোতধারা বহন করে হরিণঘাটার বিখ্যাত মোহনায় সমুদ্রে বিলীন হয়।

যশোর জেলার কোটচাঁদপুর হয়ে ভৈরব যখন হাকিমপুর আসে, তখন ওই ভৈরব থেকেই কপোতাক্ষের জন্ম। জন্মের পর থেকেই তা দক্ষিণমুখী। কপোতাক্ষ তার গতিপথে ডানে-বাঁয়ে গুয়াতলী, চৌগাছা, গঙ্গানন্দপুর, পলুয়া, মাগুরা, লাউজানি (ব্রাহ্মণনগর), ত্রিমোহনী, সাগরদাঁড়ি, কুমিরা, কপিলমুনি, বাড়ুলি, কাটিপাড়া, বড়দম, চাঁদখালী, আমাদি প্রভৃতি স্থানের বহুজনের বহু প্রাণের উৎসসাধনে প্রবৃত্ত হয়ে সুন্দরবনের মধ্যে খোলপেটুয়া নদীতে মিলিত হয়েছে। এই সংযুক্ত নদীর জলধারা বিশাল আকার ধারণ করে আড়পাঙ্গাসিয়া নামে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।

কপোতাক্ষ তার গতিপথে ডানে-বাঁয়ে গুয়াতলী, চৌগাছা, গঙ্গানন্দপুর, পলুয়া, মাগুরা, লাউজানি (ব্রাহ্মণনগর), ত্রিমোহনী, সাগরদাঁড়ি, কুমিরা, কপিলমুনি, বাড়ুলি, কাটিপাড়া, বড়দম, চাঁদখালী, আমাদি প্রভৃতি স্থানের বহুজনের বহু প্রাণের উৎসসাধনে প্রবৃত্ত হয়ে সুন্দরবনের মধ্যে খোলপেটুয়া নদীতে মিলিত হয়েছে। এই সংযুক্ত নদীর জলধারা বিশাল আকার ধারণ করে আড়পাঙ্গাসিয়া নামে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।

ভৈরবের আরেক শাখা যশোরের মহেশপুর নামক স্থানে জন্ম নিয়ে বেতনা, বেগতি বা বেত্রবতী নামে প্রবাহিত হয়ে সাতক্ষীরায় প্রবেশ করেছে বুধহাটার গাঙ নামে। এরপর নিম্নগামী হয়ে এ নাম নিয়েছে খোলপেটুয়া। খোলপেটুয়া নানাদিক থেকে অনেক ছোট ছোট নদীর মিলিত স্রোত নিয়ে বিশাল আকার ধারণ করে ২৬ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে আবার কপোতাক্ষে মিলিত হয়েছে। এই মিলিত স্রোতেরই নাম সেই আড়পাঙ্গাসিয়া।

কপোতাক্ষ থেকে হরিহর ও ভদ্র নামে দুটি শাখানদী প্রবাহিত হয়েছে। হরিহর কিছুদূর গিয়ে ভদ্র নদীতে মিশেছে। ভদ্র খুলনার ডুমুরিয়ায় এসে বর্তমানে মরে গেছে, কিন্তু দক্ষিণাংশে এখনো প্রশস্ত। এই প্রশস্ততা নিয়ে ভদ্র শিবসা ও পশুরে মিলিত হয়েছে। শিবসাও পশুরের মতো সমুদ্রে মিশেছে। সমুদ্রে পড়ার আগে শিবসার নাম হয়েছে মর্জাল বা মার্জার। পশুরকে পানি জুগিয়েছে ঢাকিসহ অনেক ছোট নদী। ঢাকি শিবসাকে পশুরের সঙ্গে মিলিয়েছে।

যশোর-খুলনা অঞ্চলের নদীগুলোর গতিপথ, ভূমিকা এবং অবদান লিখতে গিয়ে প্রসিদ্ধ ইতিহাসবেত্তা সতীশচন্দ্র মিত্র তার ‘যশোর খুলনার ইতিহাস’ প্রথম খণ্ড শেষ করেছেন এভাবে:

 ‘এতক্ষণে আমরা দেখিতে পাইলাম যে, প্রকৃত সুন্দরবনের নদীগুলোর কথা ছাড়িয়া দিলে, কেবলমাত্র গৌরী মধুমতী, নবগঙ্গা-চিত্রা এবং ইছামতী কালিন্দী গঙ্গায় পার্বত্য স্রোত বহন করিতেছে। এই তিনটি মাত্র নদীস্রোত মিষ্টিজল আনিয়া দেশের শোভা, সমৃদ্ধি ও উর্বরতা বৃদ্ধি করিতেছে এবং ইহার চিরানুগত প্রথায় গঙ্গার ভূমিগঠন কার্যের সহায়তা করিতেছে। কোনো প্রকারে ইহাদের গতিরুদ্ধ হইলে, দেশের যে কি গতি হইবে, তাহা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য।’

মহানুভব সতীশ মিত্রের বক্তব্য আজ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছে বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষ করে এ দেশের কৃষকসমাজ। প্রাকৃতিক নিয়মে শত শত বছর প্রবাহিত এ দেশের নদ-নদীর ওপর প্রথম আঘাত হানে পাকিস্তান সরকার এবং তার প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। কানাডা-কলম্বো পরিকল্পনার অধীন খুলনার দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোর পাড় দিয়ে উঁচু করে বাঁধ দিয়ে প্রাকৃতিক জোয়ার-ভাটা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ফলে স্বাভাবিক যে জলস্রোত সেটা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ৩০ বছরের মধ্যে বড় বড় অনেক নদী একেবারে শুকিয়ে গেছে। এখন সেসব মাঠে ধান চাষের বদলে মাছ চাষ হচ্ছে। বিশেষ করে বাগদা চিংড়ির চাষ। বাগদা নোনাজলের মাছ। নোনাজল উঠিয়ে এবং আটকে রেখে ওই মাছের চাষ করতে হয়। দীর্ঘদিন প্রচুর লবণাক্ত পানি জমে থাকার ফলে অন্য কোনো ফসল এখানে আর জন্মানোর উপায় নেই। তদুপরি ওইসব লোকালয়ে শত শত বছরের যে বৃক্ষরাজি যেমন: তাল, নারকেল, সুপারি, আম, জাম, বেল, কলা প্রভৃতি গাছ সব মরে গেছে এবং পুনরায় আর জন্মাচ্ছে না। ফলে জনপদগুলো বিরান উদ্ভিদশূন্য হয়ে রয়েছে। নানা উপাদানে এবং উপকরণে বাংলার কৃষককুল জীবন অতিবাহিত করত, তা এখন আর নেই। এসব এলাকায় তেমন সবজির চাষ করাও সম্ভব হচ্ছে না। প্রাকৃতিক একধরনের বিপর্যয় নেমে এসেছে এসব এলাকায়। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা এবং পরিমাণ দুই-ই মারাত্মকভাবে বেড়েছে।

এখন সেসব মাঠে ধান চাষের বদলে মাছ চাষ হচ্ছে। বিশেষ করে বাগদা চিংড়ির চাষ। বাগদা নোনাজলের মাছ। নোনাজল উঠিয়ে এবং আটকে রেখে ওই মাছের চাষ করতে হয়। দীর্ঘদিন প্রচুর লবণাক্ত পানি জমে থাকার ফলে অন্য কোনো ফসল এখানে আর জন্মানোর উপায় নেই। তদুপরি ওইসব লোকালয়ে শত শত বছরের যে বৃক্ষরাজি যেমন: তাল, নারকেল, সুপারি, আম, জাম, বেল, কলা প্রভৃতি গাছ সব মরে গেছে এবং পুনরায় আর জন্মাচ্ছে না। ফলে জনপদগুলো বিরান উদ্ভিদশূন্য হয়ে রয়েছে।

আরেকটি উপসর্গ হলো ভারত সরকারের গঙ্গার ওপর ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে গঙ্গার পানি প্রবাহের মুখ পরিবর্তন। এর ফলে বাংলাদেশে গঙ্গা দিয়ে যে পরিমাণ পানি আসত, তা আর আসতে পারছে না। তাই পদ্মার পানিপ্রবাহ শুকিয়ে গিয়ে বহু নদী মরে গেছে। স্বয়ং পদ্মা রাজশাহীর কাছে শুষ্কপ্রায়। পদ্মা থেকে যত নদীর জন্ম হয়েছে তার সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিপরীতে সমুদ্রের নোনাজল জোয়ারের স্রোতে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। বহু জেলায় নোনাজল ফসলহানি ঘটাচ্ছে। খুলনা জেলার পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। যশোরের কাছে ভৈরব শুকিয়ে গেছে। কপোতাক্ষ পুরোটাই প্রায় শুকনো। অন্যান্য ছোট ছোট নদ-নদী এবং খালগুলোও শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে পুরোনো দিনের হাওড়-বাওড়, বিল, ফসলের মাঠ প্রয়োজনীয় জলাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।

পদ্মার পানিপ্রবাহ শুকিয়ে গিয়ে বহু নদী মরে গেছে। স্বয়ং পদ্মা রাজশাহীর কাছে শুষ্কপ্রায়। পদ্মা থেকে যত নদীর জন্ম হয়েছে তার সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিপরীতে সমুদ্রের নোনাজল জোয়ারের স্রোতে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। বহু জেলায় নোনাজল ফসলহানি ঘটাচ্ছে। খুলনা জেলার পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। যশোরের কাছে ভৈরব শুকিয়ে গেছে। কপোতাক্ষ পুরোটাই প্রায় শুকনো। অন্যান্য ছোট ছোট নদ-নদী এবং খালগুলোও শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে পুরোনো দিনের হাওড়-বাওড়, বিল, ফসলের মাঠ প্রয়োজনীয় জলাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।

খুলনা জেলা প্রধানত ধান চাষের এলাকা। এ ছাড়া পাট, তিল, মটর, মসুর, সরিষাসহ নানা ধরনের সবজির জন্য বিখ্যাত। এ জেলায় রয়েছে বড় বড় বিল। হাওড়-বাওড়ে সারা বছর পানি জমে সেখানে প্রচুর মাছ জন্ম নিত। নদীগুলো মরে যাওয়ায় হাওড়-বাওড়ের পানিও শুকিয়ে যাচ্ছে। আবার নিষ্কাশিত হতে না পেরে বর্ষায় পানি জমে জনবসতি জলমগ্ন হয়ে পড়ছে। এভাবে নদীর ওপর নির্ভরশীল জনজীবন নদীর অভাবে দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে। খুলনা জেলার বড় বিলগুলোর মধ্যে বিল ডাকাতিয়া, বিল পাবনা, নালুয়ার বিল, ধতুখালির বিল, পাঙ্গাসিয়ার বিল, গাওলার বিল, কেন্দুয়ার বিল, পদ্মবিলার বিল প্রভৃতি প্রসিদ্ধ। কথিত আছে, বিল ডাকাতিয়া খুলনা থেকে সুদূর কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, এখন অধিকাংশই জনবসতি হয়ে গেছে।

হাওড়-বাওড়ে সারা বছর পানি জমে সেখানে প্রচুর মাছ জন্ম নিত। নদীগুলো মরে যাওয়ায় হাওড়-বাওড়ের পানিও শুকিয়ে যাচ্ছে। আবার নিষ্কাশিত হতে না পেরে বর্ষায় পানি জমে জনবসতি জলমগ্ন হয়ে পড়ছে। এভাবে নদীর ওপর নির্ভরশীল জনজীবন নদীর অভাবে দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে।

খুলনার জীবনজীবিকা

গত একশ বছরে খুলনা জেলায় মানুষের জীবন-জীবিকায় পরিবর্তন এসেছে। এর আগে প্রায় অনড় সামন্তবাদী প্রথায় কৃষিব্যবস্থাই ছিল এখানকার মানুষের জীবনপ্রবাহ। সামন্ত শ্রেণি সব সম্পদের মালিক। আর কৃষকরা হলেন উৎপাদক। এমনকি উৎপাদিত সামগ্রীর মালিকানাও কৃষকের হাতে ছিল না। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষক শ্রেণিকে জমিদারদের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত করা হয়েছিল। অবশ্য কৃষকরা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং সামন্তীয় শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে বারবার বিদ্রোহ করেছেন।

নিয়ত পরিবর্তনশীল বিশ্বজগতে সবকিছুর মতো সমাজজীবনও পরিবর্তনশীল। জীবিকার ধরন-ধারণ সবই পরিবর্তনশীল। কিন্তু খুলনা জেলায় গণমানুষের, সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার পরিবর্তন খুব দীর্ঘকাল ধরে প্রায় অনড় অবস্থায় ছিল। একই ধরনের জীবন পদ্ধতি চলে আসছিল কয়েকশ বছর ধরে। পাঠান আমল, মোগল আমলে জীবন পদ্ধতি কেমন ছিল, ব্রিটিশ আমলে তার থেকে তেমন কোনো পরিবর্তন বা রূপান্তর ঘটেনি খুলনার জনজীবনের। বরং ব্রিটিশ সময়কালে উৎপাদক শ্রেণির জীবন হয়ে উঠেছিল আরও বেশি কষ্টকর এবং বেদনাদায়ক। ব্রিটিশ রাজশক্তির বণিকের মানদণ্ড যখন রাজদণ্ডরূপে দেখা দিল এ দেশে, তখন থেকেই তারা যেনতেন প্রকারে মুনাফা করাটাই তাদের সকল কর্মের পরম ধর্ম হয়ে উঠেছিল। রাজ্য শাসন করতে গেলে প্রজাসাধারণের প্রতি ন্যূনতম যেসব দায়িত্ব পালন করতে হয়, তার কোনো কিছুই করায় তারা দায় বোধ করেনি। ফলে ওই সময়কালে পুরো দেশের মানুষের সঙ্গে খুলনার জনসাধারণও সীমাহীন দীনতা ভোগ করেছে, নিদারুণ কষ্টে জীবন কাটিয়েছে।

পাঠানরা প্রথম এ দেশে ধর্মপ্রচার করে। কিছু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে। শাসনকার্য পরিচালনা করার জন্য, সৈন্যবাহিনী গঠন করার জন্য স্থানীয় জনসাধারণের দরকার হতো। তখনকার সময়ে অধিকাংশ মানুষ ছিল হিন্দু এবং হিন্দুদের সহায়তা শাসকদের প্রয়োজন হতো। আরও আগে দেশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষের প্রাধান্য ছিল, তখন বৌদ্ধধর্ম একটা বিশেষ মত না হয়ে সর্বসাধারণের মতবাদ হিসেবে প্রচলিত ছিল। বৌদ্ধ মতবাদ অনুযায়ী সাধারণ মানুষ তখন ছিল শূন্যবাদী। সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে খুব শক্ত কোনো মনোভাব মানুষের ছিল না। অল্পসংখ্যক হিন্দু এবং ততোধিক স্বল্পসংখ্যক ব্রাহ্মণ্য এই শূন্যবাদী বৌদ্ধ শ্রমণের ওপর অত্যাচার শুরু করে। ব্রাহ্মণদের জীবন-জীবিকা ছিল সবসময়ই পরনির্ভরশীল। সমাজের সবচেয়ে অশ্রমজীবী, অনুৎপাদক শ্রেণি ছিল এই ব্রাহ্মণ সমাজ। এরা পরনির্ভরশীলও বটে। কীভাবে অত্যাচারের মাধ্যমে বৌদ্ধদের এ দেশ থেকে উৎখাত করা হয়েছিল, তার প্রামাণ্য বিবরণ হিসেবে সতীশচন্দ্র মিত্র মহাশয়ের ‘যশোর-খুলনার ইতিহাস’ থেকে একটা বড় উদ্ধৃতি দিলাম:

“পূর্বে এ দেশের অধিকাংশ লোক বৌদ্ধ ছিলেন। তখন বৌদ্ধধর্ম একটা বিশেষ মত না হইয়া সার্বজনীন লোকের সাধারণ মত ছিল। ব্রাহ্মণেরা শূন্যবাদী বৌদ্ধ শ্রমণদের ওপর এমন ভীষণ অত্যাচার করিয়াছিলেন যে, বৌদ্ধের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করিতে দিতেন না। যেটুকু বাকি ছিল, পাঠানদিগের অত্যাচার তাহা শেষ করিয়া দিয়াছিল। পূর্বে দেখিয়াছি পাঠানরা কীরূপে বৌদ্ধ পূর্ণ সংখ্যারাম ধ্বংস করিতেন এবং সহজ উপায়ে অধিক সংখ্যক বৌদ্ধকে মুসলমান ধর্ম পরিগ্রহ করিতে বাধ্য করিতেন। কীরূপে এত বড় একটা বৌদ্ধ জাতির যাহা-কিছু প্রতিপত্তি ছিল, তাহার লোপ হইয়াছিল। আবুল ফজল এত অনুসন্ধান দ্বারা যে প্রকাণ্ড ‘আকবরনামা’ গ্রন্থ প্রণয়ন করেন তার মধ্যে প্রসঙ্গক্রমেও বৌদ্ধ কথাটি নাই। ব্রাহ্মণ ও পাঠান উভয়ে বড় দক্ষ হস্তে কার্যসিদ্ধি করিয়াছিলেন।”

পরবর্তীকালে ইতিহাসের বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, বৌদ্ধরা দেশত্যাগ না করে এই দেশেই অবস্থান গ্রহণ করে। যেহেতু তারা ছিল কৃষিজীবী, তারা ছিল উৎপাদক তাই শাসকগোষ্ঠী ও ব্রাহ্মণরা আপস করতে বাধ্য হয় শুধু বৌদ্ধত্ববাদ ত্যাগ করার শর্তে। কিন্তু এই বিপুল জনগোষ্ঠী দীর্ঘকাল এ দেশে উৎপাদন কাজে নিযুক্ত থেকেছে উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো ধর্মাচরণ না করেই। মাত্র একশ বছর আগেও দেখা গেছে, যশোর-খুলনা অঞ্চলের কৃষকসমাজ তেমন কোনো ধর্মানুষ্ঠান, যজ্ঞানুষ্ঠান না করে জীবন ধারণ করেছে।

সেন রাজত্বে এবং পাঠান আমলে শিক্ষাদীক্ষার প্রচলন ছিল, শাস্ত্র চর্চা হতো। খুলনা তথা বাগেরহাটের প্রশাসক খানজাহান আলী এ অঞ্চলে শিক্ষায় পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। হুসেন শাহ সর্বত্র শিক্ষার উৎসাহদাতা ছিলেন। এসব স্থানে কাব্য, ব্যাকরণ, চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতি শিক্ষার প্রচলন ছিল। মুসলমান কাজি ও মৌলবিরা নিজ নিজ বাড়িতে ফারসি ও আরবি পড়াতেন। ভট্টাচার্য, অধ্যাপক এবং মৌলবিরা ছাত্রদের নিজ নিজ বাড়িতে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। এ ছাড়া ছিল পাঠশালা। সেখানে সাধারণ শ্রেণির সন্তানেরা বিদ্যাশিক্ষা করতে পারত। তারা মুখে মুখে নামতা, শতকিয়া, গণ্ডা, মনকষা প্রভৃতি বিদ্যাশিক্ষা করত। কিন্তু হিন্দু তথা ব্রাহ্মণ অধ্যাপকরা কখনোই নিম্নবর্ণের হিন্দু বা মুসলমানদের সংস্কৃত শিক্ষা দিতেন না। তখন পাঠদানের পুথিপত্র তালপাতায় লিখিত হতো। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে প্রথম এ দেশে কাগজের প্রচলন হয়। তখন খুলনা-সাতক্ষীরায় অনেকে কাগজ প্রস্তুত প্রণালি রপ্ত করেছিলেন। এখন বহু গ্রামে দেখা যায় ‘কাগুজি পরিবার’। তারা কাগজ তৈরি করতেন বলে তাদের ‘কাগুজি’ উপাধি ছিল। উৎপাদক শ্রেণি তথা কৃষকসমাজের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রচলন শুরু হয়েছে মাত্র একশ বছর আগে। তার আগে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাসাগর প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং বালিকা বিদ্যালয়ের প্রচলন করেছিলেন।

তখন পাঠদানের পুথিপত্র তালপাতায় লিখিত হতো। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে প্রথম এ দেশে কাগজের প্রচলন হয়। তখন খুলনা-সাতক্ষীরায় অনেকে কাগজ প্রস্তুত প্রণালি রপ্ত করেছিলেন। এখন বহু গ্রামে দেখা যায় ‘কাগুজি পরিবার’। তারা কাগজ তৈরি করতেন বলে তাদের ‘কাগুজি’ উপাধি ছিল।

খুলনা অঞ্চলে যথেষ্ট পরিমাণে কার্পাস তুলা উৎপাদিত হতো। কার্পাস থেকে ব্রাহ্মণরা চিকন সুতা তৈরি করে পৈতা বা উপবিত প্রস্তুত করতেন। সাধারণ মানুষ সূক্ষ্ম সুতা কেটে তাঁতি বা জোলাবাড়িতে নিয়ে গিয়ে সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে লুঙ্গি, থামি বা ধুতি প্রস্তুত করে আনতেন। খুলনার কোনো কোনো গ্রামে সূক্ষ্ম বস্ত্র তৈরি হতো, কিন্তু তা নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে বাইরে চালান হতো কি না, তা বলা যায় না। বাঁশ, বেত, নলখাগড়া প্রভৃতির সাহায্যে সাধারণ মানুষ গৃহ প্রস্তুত সামগ্রী বানাতেন। এ ক্ষেত্রে তারা সৌন্দর্যজ্ঞান ও শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় দিতেন। গাছের ছাল, বেতি, মালে প্রভৃতির সাহায্যে চমৎকার শীতলপাটি ও মাদুর প্রস্তুত হতো। এলাকায় প্রয়োজন মিটিয়ে তা সারা দেশের বহু জেলায় এমনকি ভারতেও রপ্তানি করা হতো। সাতক্ষীরার এই মাদুরের প্রচলন ছিল সবচেয়ে বেশি। কোটি কোটি টাকার মাদুর চালান যেত বিভিন্ন প্রান্তে। বর্তমানে নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ার দরুণ পরিবহণের সমস্যা এবং চিংড়ি ঘেরের জন্য মালে, বেতি উৎপাদনের সংকটের কারণে এই শিল্পটি বিলুপ্তির পথে চলে গেছে। হাজার হাজার মানুষ এ অঞ্চলে তাদের জীবিকা হারিয়েছেন। খুলনার বহু গ্রামে, বিশেষ করে প্রায় প্রতিটি হাটে একাধিক কামারশালা ছিল। সেখানে নৈমিত্তিক অস্ত্রপাতি প্রস্তুত হতো। দা, কাঁচি, খন্তা, কোদাল, কুড়াল, শাবল, জাঁতি, বঁটি প্রভৃতি প্রস্তুত করতেন স্থানীয় কামাররা। গ্রামে গ্রামে কুমাররা মাটির পাত্র প্রস্তুত করতেন। মাটি দিয়ে তারা হাঁড়ি, সরা, কড়াই, কলসি, ঠিলে, ঝাঁজরি, বদনা, জালো, খাবরা (পিঠের সাজ), খোরা প্রভৃতি মৃতপাত্র প্রস্তুত করে উৎপাদক শ্রেণির জন্য সস্তায় তৈজসপত্র সরবরাহ করতেন। অতি কম মূল্যে এসব সরঞ্জাম বিক্রি হতো। সাধারণত পৌষ-মাঘ মাসে ধানের সময় নৌকায় করে কুমাররা এসব পাত্র নিয়ে নদী বা খালের ঘাটে-ঘাটে উপস্থিত হতেন। সেখান থেকে বড় বাঁশের ঝাঁকায় করে মাথায় নিয়ে বাড়ি বাড়ি ফেরি করতেন। কোনো টাকা-পয়সা দিতে হতো না। সামান্য ধান, তা-ও নিম্নমানের চিটাযুক্ত ধান দিলে ওইসব মৃৎপাত্র লাভ করতেন কৃষক রমণীরা। কুমারদের আরেকাংশ মাটির পাত্রে সুন্দর রং করে চিত্র এঁকে সুন্দর সুন্দর মনোহারি দ্রব্য প্রস্তুত করতেন, যা সাধারণত ঘর সাজাতে ব্যবহার করতেন কৃষক রমণীরা। তা ছাড়া মাটি দিয়ে পুতুল, ঘট, ঘোড়া, হাতি, পালকি, পাখি, মানুষ নানান পশু-প্রাণী তৈরি করে বিভিন্ন মেলা বা হাটে বিক্রি করতেন। বর্তমানে কামার-কুমারদের এই উৎপাদন মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়ে অসংখ্য মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন।

খুলনার কোনো কোনো গ্রামে সূক্ষ্ম বস্ত্র তৈরি হতো, কিন্তু তা নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে বাইরে চালান হতো কি না, তা বলা যায় না। বাঁশ, বেত, নলখাগড়া প্রভৃতির সাহায্যে সাধারণ মানুষ গৃহ প্রস্তুত সামগ্রী বানাতেন। এ ক্ষেত্রে তারা সৌন্দর্যজ্ঞান ও শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় দিতেন। গাছের ছাল, বেতি, মালে প্রভৃতির সাহায্যে চমৎকার শীতলপাটি ও মাদুর প্রস্তুত হতো।

খুলনা অঞ্চলের কৃষক নারীরা ছেঁড়া কাপড় দিয়ে চমৎকার কাঁথা তৈরি করতেন। লেপের মতোই মোটা মোটা ভুটি দিয়ে তারা শীত নিবারণ করতেন। আলাদাভাবে শীতের জন্য কোনো শীতবস্ত্র তাদের লাগত না। ঘরে তৈরি এই কাঁথা এও ভুটি দিয়েই শত শত বছর ধরে কৃষকদের শীত নিবারণ হয়েছে। তা ছাড়া নকশিকাঁথা বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে একটি বিলাসী সুচিকর্ম। শিকে, দড়ি প্রভৃতি কৃষকরা ঘরে-বাইরে নিজেরাই বানিয়ে নিতেন।

খুলনার বিভিন্ন অঞ্চলে লবণ প্রস্তুত হতো। লবণের কারখানা ছিল নানান স্থানে। রায়মঙ্গল ছিল লবণ উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। তা ছাড়া খুলনায় চিনি উৎপাদন হতো প্রচুর। খেজুর গুড় থেকে একপ্রকার সুস্বাদু চিনি খুলনাতেই প্রস্তুত হতো। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সরকার আইন করে খুলনার কৃষকদের লবণ ও চিনি উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। খুলনা শহরের কাছে পাবনা ও মহেশ্বরপাশায় বণিকরা আবির প্রস্তুত করতেন। প্রথম এখানেই আবিরের উৎপাদন হয়। দৌলতপুর নদীবন্দর দিয়ে হাজার হাজার মণ আবির গঙ্গাসাগর, কলকাতাসহ ভারতের আরও নানা স্থানে রপ্তানি হতো।

খুলনার বিভিন্ন অঞ্চলে লবণ প্রস্তুত হতো। লবণের কারখানা ছিল নানান স্থানে। রায়মঙ্গল ছিল লবণ উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। তা ছাড়া খুলনায় চিনি উৎপাদন হতো প্রচুর। খেজুর গুড় থেকে একপ্রকার সুস্বাদু চিনি খুলনাতেই প্রস্তুত হতো। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সরকার আইন করে খুলনার কৃষকদের লবণ ও চিনি উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। খুলনা শহরের কাছে পাবনা ও মহেশ্বরপাশায় বণিকরা আবির প্রস্তুত করতেন। প্রথম এখানেই আবিরের উৎপাদন হয়।

পাঠান-মোগল দুই আমলেই খুলনার কৃষক প্রচুর ধান উৎপাদন করতেন এবং খাদ্যদ্রব্য সুলভ ছিল। সবজি উৎপাদন হতো একেবারে পারিবারিকভাবে। মাছের জোগান ছিল যথেষ্ট। সব খাল-বিল, নালা, জোলা ভর্তি ছিল নানা জাতের সুস্বাদু মাছে। মুসলমান আসার আগে এ অঞ্চলে মাংস খাওয়ার প্রচলন ছিল না বললেই চলে। সবজি, মাছ ও দুধ ছিল প্রধান খাদ্য। প্রতিটি সম্পন্ন কৃষকের বাড়িতে গরু থাকত। দুধ তাদের নিত্যদিনের খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। গোয়ালা, ব্রাহ্মণ ও মধ্যবিত্তরা বাড়িতে ঘি তৈরি করার পদ্ধতি জানতেন। দই ও ক্ষীর উন্নত খাদ্য বলে বিবেচিত হতো। তবে রসগোল্লা জাতীয় মিষ্টির প্রচলন ছিল না খুলনা অঞ্চলে। মুসলমানদের খাদ্যতালিকায় এছাড়া কাবাব, কোপ্তা, পরোটা, কোরমা প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত ছিল।

খুলনার সাধারণ মানুষ ছোট ধুতি পরতেন। গামছা হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই নিত্যসহচর ছিল। জামা বা পিরান খুব কম লোকই ব্যবহার করতেন। ধুতির একাংশ দিয়ে শরীর ঢাকতেন। কোথাও যাওয়ার কালে ধুতির একখানি চাদর বা উড়নি ব্যবহার করতেন হিন্দু-মুসলমান উভয়ই। অনেক পরে মুসলমান সম্প্রদায় লুঙ্গি ব্যবহার শুরু করেন। সধবা স্ত্রীলোক ডুরে লালপেড়ে শাড়ি পরতেন। পাঠান আমলে ডুরে পাড়ের শাড়ির প্রচলন হয়। শাড়ির আঁচল বা ভাঁজ করা আর একটা শাড়ি ছাড়া নারীদের অন্য কোনো শীতবস্ত্র ছিল না। ব্রাহ্মণরা উষ্ণীষ মাথায় বাঁধতেন এবং মৌলবিরা পাগড়ি ব্যবহার করতেন। অনেক পরে গোলটুপির প্রচলন হয়েছে। পাগড়ি-উষ্ণীষ বদল করে হিন্দু-মুসলমানের বন্ধুত্ব বা ধর্ম-আত্মীয়তা প্রতিষ্ঠা করতেন। হুঁকায় তামাক খাওয়ার প্রচলন এই এলাকায় ছিল না। তামাক সেবন খুলনায় অল্পদিন এসেছে। গৃহস্থঘরের মেয়েরা চুলে বেণি বাঁধতেন। খোপা বাঁধার ব্যাপক প্রচলন ছিল। মুসলমান মেয়েরা নথ, দুল, পেছা, ঝুমকা প্রভৃতি গহনা ব্যবহার করতেন। পুরুষরা মাথায় চুল কখনো কখনো লম্বা রেখে মেয়েদের মতো বেঁধে রাখতেন। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায় দাড়ি রাখত। ব্রাহ্মণরা পার্থক্য করার জন্য দাড়ির সঙ্গে মাথায় টিকি রাখতেন আর সাধারণ মানুষ গলায় তুলসীর মালা পরতেন। লাঠিয়ালরা ঘাড় পর্যন্ত বাবরি চুল রাখতেন।

কোথাও যাওয়ার কালে ধুতির একখানি চাদর বা উড়নি ব্যবহার করতেন হিন্দু-মুসলমান উভয়ই। অনেক পরে মুসলমান সম্প্রদায় লুঙ্গি ব্যবহার শুরু করেন। সধবা স্ত্রীলোক ডুরে লালপেড়ে শাড়ি পরতেন। পাঠান আমলে ডুরে পাড়ের শাড়ির প্রচলন হয়।

কৃষকরা তাদের উৎপাদিত সামগ্রী হাটবাজারে নিয়ে বিক্রি করতেন। ওখানে রাজা বা জমিদারের লোক থাকত। তারা রাজস্ব আদায় করত। তারা বাটখারার সঠিকতা অনুমোদন করত এবং নানাবিধ বিরোধের মীমাংসা করত। চৌকিদাররা গ্রাম পাহারা দিত। চুরি-ডাকাতির হাত থেকে গ্রামবাসীকে রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল প্রধানত চৌকিদারের। গ্রামের মধ্যে নাপিত বা পরামানিক আয়না-চিরুনি, ক্ষুর-নরুন প্রভৃতি নিয়ে ঘুরে বেড়াত–কে বা কারা ক্ষৌরকাজ করবে সে উদ্দেশ্যে। যার প্রয়োজন সে নাপিতকে দিয়ে ক্ষৌরকাজ করিয়ে নিত। এ জন্য পরামানিককে কোনো অর্থ দিতে হতো না। পৌষ-মাঘ মাসে ধান উঠলে তাদের ধান দিতে হতো। এই ধান দেওয়ার কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ বা নিয়ম ছিল না। পুরোহিতরা হিন্দুদের পূজা-পার্বণ, শ্রাদ্ধশান্তি করতেন আর মুনশিরা মুসলমানদের মিলাদ-মাহফিল, বিবাহ, খতনা ইত্যাদি করতেন।

মধ্যবিত্ত গৃহস্থের ঘরে বড় কাঠের সিন্দুকই ছিল প্রধান গৃহসজ্জা। তার মধ্যে সংসারের যাবতীয় দ্রব্যসামগ্রী থাকত। কাপড়-চোপড়, কাঁথা-ভুটি সবকিছু সিন্দুকের মধ্যে রেখে তার ওপর দিব্যি বিছানা করে ভালোভাবে একজন মানুষ শুতে পারতেন। দরিদ্র ব্যক্তিরা প্রায়ই ঘরের মাঝখানে গর্ত কেটে তার ওপর কাঠের পাটাতন দিয়ে ঢেকে তার ওপর রাতে বিছানা পেতে শুয়ে থাকতেন। তাতে চোরের উপদ্রবের হাত থেকে বাঁচা যেত। যেহেতু সমগ্র খুলনা জেলার সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের ঘরবাড়ি ছিল কাঁচা এবং বাঁশ-কাঠের বেড়া তাই প্রায়ই সিঁধকাটা চোরের উপদ্রব দেখা যেত। তৈজসপত্রের মধ্যে পাথরের থালা-বাটি, খোরা ব্যবহৃত হতো। তা ছাড়া তামা, কাঁসা, পিতলের ঘটি-বাটির প্রচলন ছিল হিন্দু-মুসলিম উভয় সমাজে।

সমগ্র খুলনার মানুষের জীবনযাপনে বর্তমানে অনেক পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন এসেছে এখানকার উৎপাদন ব্যবস্থায়,  সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন সম্পর্কেও। স্মর্তব্য যে, ব্রিটিশ রাজত্বের শেষদিকে, পাকিস্তান আমলজুড়ে এবং বাংলাদেশ জন্মের প্রথম দশকের সময়কাল মিলিয়ে প্রায় বিগত একশ বছর সময়কালে কতগুলো দুর্ভিক্ষ হয়েছে। যুদ্ধবিগ্রহ, দেশভাগ, আন্দোলন-সংগ্রাম, কৃষক বিদ্রোহ, সশস্ত্র যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এই সময়কালে; এবং সাধারণ মানুষ কৃষক শ্রেণি এসব ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত থেকেছেন। ব্রিটিশরা যখন বিদায় নেয়, তখন বাংলায় ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা ১৭ শতাংশ। পাকিস্তান এই ১৭ শতাংশ ভূমিহীনকে নিয়ে রাজত্ব শুরু করে এবং পাকিস্তানের বিদায়কালে ১৯৭১ সালে পূর্ববঙ্গে ভূমিহীনের সংখ্যা বেড়ে হয় ৩৩ শতাংশ এবং বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরে ভূমিহীন দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৬ শতাংশ।

কয়েক দশকের মধ্যে অকৃষক শ্রেণি- শহরবাসী ধনিদের হাতে গ্রামের অধিকাংশ জমি কেন্দ্রীভূত হয়েছে। খুলনা এর থেকে কিছুমাত্র ব্যতিক্রম নয়। তদুপরি খুলনায় নোনাজলে বাগদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতি শুরু হয়েছে বাংলাদেশ জন্মের এক দশক পর থেকেই। ক্ষমতাসীন লুটেরাগোষ্ঠী গ্রামের ব্যাপক জমিতে জোর করে বা প্রতারণা করে বড় বড় ঘের গড়ে তুলেছে। নোনাজল তুলে চিংড়ি চাষ করে জমির মালিক কৃষককে সামান্য অর্থ দিয়ে তারা পুঁজির পাহাড় গড়ে তুলেছে। ওই অর্থ দিয়ে ওই ঘেরের সম্পত্তিগুলো পানির দামে কিনে নিয়েছে। কোথাও-বা স্বেচ্ছায়, কোথাও-বা জোর করে এই জমি কেনাবেচা হয়।

এভাবে গত পঞ্চাশ বছরে খুলনার জমির মালিকানা ব্যাপক রদবদল হয়েছে। ফলে নিজ জমি হারিয়ে সেই জমিতেই মজুরি দাসত্ব খাটছে এখানকার কৃষকসমাজ। দ্বিতীয় বিষয় হলো, উৎপাদনের ধরন পালটে গেছে। খুলনার বর্তমান তিনটি জেলাতেই ব্যাপকভাবে চিংড়ি এবং বাড়ি ফসল হিসেবে সবজি চাষ অগ্রাধিকার পেয়েছে। আমন ধানের চাষ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। রবিশস্যের চাষ নেই বললেই চলে। খুলনার চিরকালের কয়েকটি ফসল যেমন: মটর, কলাই, খেসারি, তিল, মসুর ও পাটের চাষ হ্রাস পেয়েছে আনুমানিক ৭৫ শতাংশ। বিপরীতে নোনাপানির বাগদা চিংড়ি চাষের ফলে জমি এবং প্রকৃতি-প্রতিবেশে গুরুতর লবণাক্ততা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে হাজার বছরের ঐতিহ্য খুলনার নারকেল-সুপারি বিলুপ্তির পথে। এখন পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশে নারকেলের তেলের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ একা সরবরাহ করে বাগেরহাট। বিগত বিশ বছরে নারকেলের ফলন মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় এর তেলের মিলগুলো কাঁচামাল সংকটে পড়েছে। এখন পুরো বাংলাদেশে নারকেল তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে চার থেকে পাঁচ গুণ। এই সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সম্প্রতি হয়ে যাওয়া সিডর, আইলা ও আম্ফানের মতো মারাত্মক ঘূর্ণিঝড়ে বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার একাধিক উপজেলা বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। জনজীবন এখন মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে সমগ্র খুলনার জনজীবন ও জীবিকা কঠিন হয়ে পড়েছে।

এখন পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশে নারকেলের তেলের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ একা সরবরাহ করে বাগেরহাট। বিগত বিশ বছরে নারকেলের ফলন মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় এর তেলের মিলগুলো কাঁচামাল সংকটে পড়েছে। এখন পুরো বাংলাদেশে নারকেল তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে চার থেকে পাঁচ গুণ।

পাকিস্তান আমলেই খুলনা শহরের বিস্তৃতি হচ্ছিল। অনেক চটকলসহ কাগজের কারখানা, পাওয়ার স্টেশন, বোর্ড মিল, জুট প্রেস প্রভৃতি গড়ে উঠেছিল খুলনা শহর এবং শহর সংলগ্ন গ্রামগুলোতে। সরকার ভৈরব নদের দুই তীরের অনেক সমৃদ্ধ জনপদ ধ্বংস করে শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করেছিল। ওইসব গ্রামের জনসাধারণের পুনর্বসতির কোনো দায় না-নিয়েই অতি সামান্য টাকা হাতে তুলে দিয়ে তাদের সহায়-সম্পদ আত্মসাৎ করেছিল। ফলে বেশ কয়েক লক্ষ মানুষ দীর্ঘদিনের সঞ্চিত সহায়-সম্পদ, খেত-খামার, ঘরবাড়ি ছেড়ে অল্পকিছু টাকা হাতে নিয়ে পথে নামতে বাধ্য হয়েছিল। এই বাস্তুহারা অসহায় মানুষের বিরাট সংখ্যক ছিল হিন্দু। তারা দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এরপর বাংলাদেশ সময়ে এসে এসব শিল্প-কলকারখানা জাতীয়করণ করে পুনরায় তা ব্যক্তিমালিকানায় ফিরিয়ে দিয়ে সেখানকার লাখ লাখ শ্রমিককে সর্বস্বান্ত করে নতুন করে পথের ফকির করেছে। এতসব ঘটনা ঘটেছে নিষ্ঠুরভাবে।

বেশ কয়েক লক্ষ মানুষ দীর্ঘদিনের সঞ্চিত সহায়-সম্পদ, খেত-খামার, ঘরবাড়ি ছেড়ে অল্পকিছু টাকা হাতে নিয়ে পথে নামতে বাধ্য হয়েছিল। এই বাস্তুহারা অসহায় মানুষের বিরাট সংখ্যক ছিল হিন্দু। তারা দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

এই ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে সমগ্র খুলনা জেলায় নগরসভ্যতার বিকাশ ঘটেছে। সংগ্রামী মেধাবী কৃষকসমাজ বাম্পার উৎপাদন ঘটিয়েছে, তাদের সন্তানরা বিদেশে গিয়ে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে এবং তাদের কন্যাসন্তানরা ঢাকা-চট্টগ্রামের পোশাক কারখানাগুলোতে উৎপাদন ঘটিয়ে ব্যাপক নগদ অর্থ আয় করেছে। ফলে দেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদ সৃষ্টি হয়েছে। তার বিরাট অংশ উঠতি দালাল পুঁজিপতিরা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করেছে। তাদের প্রভু সাম্রাজ্যবাদীরা অর্থ, টেকনোলজিসহ নানাবিধ উৎপাদন উপকরণ যেমন: কৃষিতে সার, বীজ, কীটনাশক প্রভৃতি সাপ্লাই দিয়ে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তবে তাদের স্বার্থে জনপদগুলোর অবকাঠামোর কিছু উন্নয়ন ঘটানোর প্রয়োজন পড়েছে। তাই গ্রামগুলোতে পাকা রাস্তা করা হয়েছে, বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এভাবে সমগ্র খুলনাঞ্চলের জীবন-জীবিকার অনেক বদল ঘটেছে।

খাদ্য হিসেবে চিরায়ত ভাতের পাশে এখন রুটি যুক্ত হয়েছে। মাছ-সবজি প্রায় আগের মতোই আছে। সাধারণ মানুষের পাতে এখন দুধটা উঠে গেছে, কিন্তু মাংস বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যাপকভাবে। পরিধেয় বস্ত্র হিসেবে ধুতির প্রচলন নেই বললেই চলে। তার বদলে সাধারণভাবে লুঙ্গির প্রচলন অনেক বেড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে প্যান্ট, পাজামা, শার্ট, পাঞ্জাবি প্রভৃতি প্রচলন হয়েছে। মেয়েদের শাড়ি-ব্লাউজের সঙ্গে সালোয়ার-কামিজ-ওড়নার কদর বেড়েছে অনেক। সোনার অপরিসীম মূল্যবৃদ্ধির ফলে স্বর্ণালংকার গ্রামীণ জীবনের স্বপ্ন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। শহরের উচ্চ ও মধ্যবিত্তরা সোনার গহনা ব্যবহার করেন। তবে গ্রামে নানা নকল গহনা, চুড়ি, দুল, নথ ইত্যাদির ব্যবহার এখনো আছে। গ্রামীণ মানুষের ঘরবাড়ির অনেক বদল ঘটেছে। গ্রামে এখন পাকা বাড়ি প্রচুর। টিনের সেমি-পাকা ঘরের অভাব নেই। বরং কাঁচাঘর এখন দেখা যায় না বললেই চলে। শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপক প্রচলন হয়েছে। প্রায় প্রতিটি গ্রামে সরকারি বা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বিদ্যমান। খুলনার জীবন-জীবিকার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে সমাজে ধনবৈষম্য বেড়েছে আগের থেকে বহু গুণ, কিন্তু অনাহারে মৃত্যু নেই বললেই চলে, যা পাকিস্তান আমলে এবং ব্রিটিশ রাজত্বের শেষদিকে ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

রণজিৎ চট্টোপাধ্যায়: লেখক, রাজনৈতিক নেতা। বাগেরহাট।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •