মেগা প্রকল্পের রাজনৈতিক অর্থনীতি
মাহা মির্জা
বর্তমান উন্নয়ন ধারার একটি অন্যতম দিক হলো চোখ ঝলসানো সুবৃহৎ বা মেগা প্রকল্প। শিক্ষা চিকিৎসাসহ সর্বজনমুখী বহুরকম প্রয়োজনীয় কর্মসূচির বদলে এরকম প্রকল্পের ব্যাপারে নীতিনির্ধারকদের বিশেষ আগ্রহ দেখা যায়। এর কারণ প্রথমত, বিপুলাকারের কারণে তা দিয়ে রাজনৈতিকভাবে মানুষকে মোহাবিষ্ট করা সহজ। দ্বিতীয়ত, এরকম মেগা প্রকল্প দেশি বিদেশি বহুগোষ্ঠীর মুনাফার ক্ষুধা মেটাতে সক্ষম। সেজন্য এগুলোকে মহিমান্বিত করায় আগ্রহী অনেকে। এগুলোর যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথম থেকেই লাভ ক্ষতি বিষয়ে যে মিথ্যাচারের ওপর ভর করা হয় তারও প্রমাণ বহুবিধ। এসব প্রকল্প যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে শুরু হয় তা পূরণ হবার বদলে জনগণের জন্য যে বিপদের কারণ হয় তারও বহু প্রমাণ আছে। এই লেখায় এসব বিষয়ের ব্যাখ্যাসহ মেগা প্রকল্পের সহযোগী বিভিন্ন গোষ্ঠীর পরিচয়, তাদের ভূমিকা এবং তার লাভক্ষতির ধরন পরীক্ষা করা হয়েছে।
১. মানুষ ও বাঁধ
সর্দার সারোভার বাঁধের ফলে উচ্ছেদ হওয়া আদিবাসীদের পুনর্বাসনের জমি দেওয়া নিয়ে দিল্লির সুপ্রিম কোর্টে শুনানি চলছিল। একপর্যায়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরা সরকারি আইনজীবীদের প্রশ্ন করেছিলেন পুনর্বাসনের এলাকায় আদিবাসী বাচ্চাদের জন্য খেলার পার্ক আছে কি না। সরকারি উকিল খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলেন: ‘আছে মাই লর্ড। শুধু পার্কই নয়, সি’ স আছে, স্লাইড আছে, দোলনাও আছে।’
বিচারক এই উত্তরে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন কি না, সেই তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে বাচ্চাদের জন্য সি-স এবং স্লাইড আছে এই তথ্যে হয়তো অনেকেই নিশ্চিত হবেন যে নর্মদা বাঁধের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত কমিউনিটিকে বেশ ভালো জায়গায়ই স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
আসলেও কি তাই?
১৯৯৯ সালে অরুন্ধতী রায় লিখলেন তার অন্যতম সেরা প্রবন্ধ ‘গ্রেটার কমন গুড’। ভারতের নর্মদা আন্দোলনের ব্যাপারে আমরা অনেকেই প্রথম জানতে পারি এই লেখার মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে ২০০৩ সালে নর্মদা আন্দোলন নিয়ে তৈরি হয় Drowned out (ড্রাউন্ড আউট) নামের একটি প্রামাণ্য চিত্র। এই প্রামাণ্য চিত্র দেখার আগে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে আদিবাসী বা গ্রামীণ মানুষের সঙ্গে আসলে কী ঘটে, সেই বিষয়ে আমার নিজের অন্তত খুব কম ধারণা ছিল। নর্মদা বাঁধের বুকে হারিয়ে যাওয়া হাজারো সবুজ গ্রামের ‘ভিজুয়াল’ আমার মনস্তত্ত্বে গভীর আঘাত করে। কী ঘটেছিল নর্মদায়? কেন তৈরি হলো সর্দার সারোভার বাঁধ? একটা বাঁধের কারণে কী করে শত ফুট পানির তলায় ডুবে গেল হাজারো গ্রাম? তারপর সেই গ্রামের মানুষগুলো কোথায় গেল? একজন-দুজন তো নয়, লাখো লাখো মানুষ! তারা কি ফিরে পেল তাদের সবুজ মাঠ আর বন-পাহাড়ের জীবন?
নর্মদার ওপর বার্গি বাঁধ নির্মাণের পর রাম বাই নামের এক নারী তার পরিবারসহ উচ্ছেদ হয়েছিলেন। তার শৈশবের সবুজ গ্রামটি পানির তলায় ডুবে গিয়েছিল। রাম বাইয়ের ঠাঁই হয়েছিল জাবালপুরের এক বস্তিতে। রাগে দুঃখে রাম বাই বলেছিলেন, ‘এর চেয়ে আমাদের বিষ খাইয়ে মেরে ফেলল না কেন? তাহলে আর এমন জঘন্য জায়গায় থাকতে হতো না আমাদের!’ (ইংরেজিতে থেকে অনূদিত) (মূল টেক্সট: ‘Why didn’t they just poison us? Then we wouldn’t have to live in this shit-hole and the Government could have survived alone with its precious dam all to itself’ (রয়, ১৯৯৯।)
গ্রেটার কমন গুড-এ অরুন্ধতী রায় লিখেছিলেন: ‘For the people who’ve been resettled, everything has to be re-learned. Every little thing, every big thing: from shitting and pissing (where d’you do it when there’s no jungle to hide you?) to buying a bus ticket, to learning a new language, to understanding money. And worst of all, learning to be supplicants. Learning to take orders. Learning to have Masters. Learning to answer only when you’re addressed. From being self-sufficient and free, to being impoverished and yoked to the whims of a world you know nothing, nothing about – what d’you suppose it must feel like? Would you like to trade your beach house in Goa for a hovel in Paharganj? No? Not even for the sake of the Nation’ (রয়, ১৯৯৯)? (অর্থাৎ পুনর্বাসিত মানুষকে ছোট বড় সবকিছুই আবার নতুন করে শিখতে হয়। এমনকি জঙ্গলের আড়াল ছাড়া প্রস্রাব করাটাও তাকে নতুন করেই শিখতে হয়। বাসের টিকিট কেনা, নতুন ভাষা শেখা, টাকাপয়সার লেনদেন শেখা, উর্দ্ধতনের অর্ডার নিতে শেখা, সম্বোধন করা হলেই উত্তর দিতে শেখা, এবং সর্বোপরি একটা মুক্ত এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবন থেকে গরিব হতে শেখা। এবং এমন এক জগতে আটকা পড়তে শেখা যেই জগৎ সম্পর্কে সে কিছুই জানেনা। ঠিক কেমন হতে পারে সেই নতুন জীবন? আসলেও তো, দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে কেউ কি তার সমুদ্রপাড়ের বাংলো বাড়িটি বদলাতে চাইবেন কড়াইলের একটি বস্তি ঘরের সঙ্গে?)
সর্দার সারোভার বাঁধের পুনর্বাসন নীতিতে অনেক বড় বড় কথা লেখা ছিল: ‘everybody will have land for land, every village will be resettled as a village’। অর্থাৎ, জমির বদলে জমি দেওয়া হবে, প্রতিটি গ্রামের পুনর্বাসন হবে গ্রাম হিসেবেই (যেন গ্রামের লোকজন পুনর্বাসনের পর তাদের বহুদিনের কমিউনিটি হারিয়ে না ফেলে)। কিন্তু সেটা কি সম্ভব হলো শেষ পর্যন্ত? শুধু নর্মদা বাঁধের কারণেই উচ্ছেদ হয়েছিল প্রায় ৪১ হাজার পরিবার (ঠাক্কার, ১৯৯৯)। বলা হয়, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ আর মহারাষ্ট্র মিলিয়ে উচ্ছেদ হয়েছিল প্রায় ২ লাখ মানুষ। প্রথম কয়েকটি গ্রামকে ১৯২ ভাগে টুকরো টুকরো করে ‘রিসেটেল’ বা পুনর্বাসন করা হয়েছিল। পরের গ্রামগুলোর জন্য ঠিকঠাকমতো পুনর্বাসনের জমিও পাওয়া যায়নি (ঠাক্কার, ১৯৯৯)। অনেক ক্ষেত্রে একসঙ্গে থাকা একই পরিবারের ভাইদের একেকজনকে একেক ‘সাইটে’ পুনর্বাসিত করা হয়। বাবা এক সাইটে, ছেলে আরেক সাইটে এমন উদাহরণও আছে। ১০ বছর পর বলা হলো: ‘এখন আর কোনো জমি নাই, সরি।’ তার মানে, সরকারি প্রতিশ্রুতির কোনো ভিত্তিই ছিল না।
গুজরাটের রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ৭ হাজার ৫০০ উচ্ছেদ হওয়া পরিবারকে জমি দেওয়া হয়েছিল। অথচ শতাধিক ক্ষেত্রে দেখা গেছে সাইটের জমি চাষযোগ্য নয়। অনেক জমিতে জলাবদ্ধতা হয়, অনেক জমি পানির নিচে। গবেষকরা দেখিয়েছেন, বেশির ভাগ ক্যাম্পেই পর্যাপ্ত পানি এবং স্যানিটেশনের সুবিধা নেই। মধ্যপ্রদেশের উচ্ছেদ হওয়া আদিবাসী পরিবারগুলোকে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল গুজরাটের রামেশ্বরপুরের পুনর্বাসন ক্যাম্পে! ১৯৯৯ সালের মে মাসে ১০ দিনের মাথায় অপুষ্টি আর খাবার পানির অভাবে মারা যায় পরপর সাতজন আদিবাসী। এরপর উচ্ছেদের প্রায় ৩০ বছর পর ১৯৯২ সালে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারকে প্রতি হেক্টর জমির জন্য মাত্র ১২ হাজার রুপি ‘অফার’ করা হয় (ঠাক্কার, ১৯৯৯)।
অরুন্ধতী রায়ের গ্রেটার কমন গুড-এ ফেরত যাই। রায় লিখেছেন, তিনি ভাদায়ের এক পুনর্বাসন ক্যাম্প দেখতে গিয়েছিলেন। চুল্লির মতো গরম টিনশেডের ঘরে চারদিকে মাছি থিকথিক করছিল। নর্মদার পাড় থেকে উচ্ছেদ হওয়া এক কৃষক তার অসুস্থ বাচ্চাকে কোলে নিয়ে অরুন্ধতীকে নদী-বন-পাহাড়ের গল্প শোনাতে গিয়ে হঠাৎ একটা তালিকা তৈরি করে ফেললেন। অরুন্ধতীর ভাষায়: ‘He was making me a list of the fruit he used to pick in the forest. He counted forty-eight kinds. He told me that he didn’t think he or his children would ever be able to afford to eat any fruit again. Not unless he stole it. I asked him what was wrong with his baby. He said it would be better for the baby to die than to have to live like this’ (রায়, ১৯৯৯।) (সে আমাকে বনবাদাড়ে পাওয়া যায় এমন সব ফলমূলের একটা তালিকা তৈরি করে দিল। সবমিলিয়ে আটচল্লিশ রকমের ফল! সে জানতো আর কোনোদিনও এইসব ফল তারা খেতে পারবেননা। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম তার বাচ্চার কি সমস্যা হয়েছে। সে বললো, এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে বাচ্চাটার মরে যাওয়াই ভালো।)
উচ্ছেদের পর কে কোথায় যায়, তাদের আয়-রোজগার বাড়ে-কি-কমে, তাদের জীবনমানের আসলেই কোনো উন্নয়ন হয় কি না, এ বিষয়ে খুব গভীর কোনো ‘ফলোআপ’ গবেষণা আসলে চোখে পড়ে না। ভারতের নর্মদার ক্ষেত্রে সরকারি পুনর্বাসন ক্যাম্প থাকার ফলে নির্দিষ্ট এলাকাজুড়ে জরিপ করে পুনর্বাসন ক্যাম্পগুলোর শোচনীয় অবস্থা নথিবদ্ধ করা গেছে। কিন্তু বেশির ভাগ প্রকল্পের ক্ষেত্রেই পুনর্বাসন ক্যাম্পের ব্যবস্থা করাই সম্ভব হয় না। ফলে উচ্ছেদ হওয়া মানুষ কে কোথায় যায়, সেটা দীর্ঘদিন ধরে ‘ট্র্যাক’ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
উচ্ছেদের পর কে কোথায় যায়, তাদের আয়-রোজগার বাড়ে-কি-কমে, তাদের জীবনমানের আসলেই কোনো উন্নয়ন হয় কি না, এ বিষয়ে খুব গভীর কোনো ‘ফলোআপ’ গবেষণা আসলে চোখে পড়ে না।
নর্মদা বাঁধের ফলে উচ্ছেদ হওয়া মানুষের পুনর্বাসন ক্যাম্পগুলো ঘুরে ১৯৯৯ সালে লেখক হিমাংশু ঠাক্কার লিখেছিলেন: ‘And Sardar Sarovar is an example where one would have hoped to see the best situation for the adivasis: Because of the 14 year struggle of the affected people, because of the involvement of the World Bank, because of the national and international media attention and debate, because of the ongoing case in the highest court of the nation. The situation of the adivasis elsewhere is much worse than this. The adivasis displaced by in the 1950s and 1960s by the Hirakud, Bhakhra, and other projects still struggle to get the paltry compensation promised to them at that time’ (ঠাক্কার, ১৯৯৯)। ঠাক্কার এখানে বলতে চেয়েছেন যে ৫০ ও ৬০ এর দশকে হিরাকুদ বা বাখরা বাঁধের কারণে উচ্ছেদ হওয়া আদিবাসীরা এখন পর্যন্ত অনেকেই তাদের প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণ পাননি। ভারতের অন্যান্য বাঁধের ক্ষেত্রেও আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা খুবই খারাপ। কিন্তু সর্দার সারোভার বাঁধের ক্ষেত্রে প্রত্যাশা ভিন্ন ছিল। ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের ১৪ বছরের সংগ্রাম, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মনোযোগ, বিশ্বব্যাংকের জড়িত থাকা, এবং ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে চলমান মামলার কারণে সর্দার সারোভার বাঁধের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে ভালো পুনর্বাসন ব্যবস্থা প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু সেটা হয়নি।
তবে উল্লেখিত ৪৮ রকমের ফলের হিসাব নিয়ে ভাবতে বসলে বন-পাহাড়-জঙ্গল-নদী থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষের ক্ষতির যে আসলে কোনো ক্ষতিপূরণ হয়না, সেই সত্যটাই সামনে চলে আসে।
বাঁধ নির্মাণের উদ্দেশ্য কী? বাঁধের কাজ কী?
বলাই বাহুল্য, নেহেরুর প্রথম দশকে বাঁধকে বলা হতো ‘টেম্পল অব মডার্ন ইন্ডিয়া’ বা আধুনিক ভারতের মন্দির। ১৯৫৭ সালে নির্মিত হিরাকুদ বাঁধ ছিল ওই সময়কালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাঁধগুলোর একটি। এই বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ভারতের সেরা প্রকৌশলী ও ভারতের সেরা ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের অধ্যাপকরা। অথচ শুধু হিরাকুদ বাঁধের কারণেই ভারতের তিন লাখ মানুষকে উচ্ছেদ হতে হয়েছিল।
১৯৫৭ সালে নির্মিত হিরাকুদ বাঁধ ছিল ওই সময়কালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাঁধগুলোর একটি। এই বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ভারতের সেরা প্রকৌশলী ও ভারতের সেরা ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের অধ্যাপকরা। অথচ শুধু হিরাকুদ বাঁধের কারণেই ভারতের তিন লাখ মানুষকে উচ্ছেদ হতে হয়েছিল।
ভারত কৃষিপ্রধান দেশ। কিছু অঞ্চলে প্রাকৃতিক নিয়মেই নিয়মিত বন্যা হয় এবং কিছু অঞ্চল খরার সময় সেচের পানি পায় না। চল্লিশের দশকে বাঁধ নির্মাণের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল, এক অঞ্চলের বাড়তি পানি অন্য অঞ্চলে খরা চলাকালীন সেচের পানি হিসেবে ব্যবহার করা। আবার এই পানির ‘ফ্লো’র মাধ্যমেই জলবিদ্যুৎ উৎপন্ন করা।
আপাতদৃষ্টিতে উদ্দেশ্য মহৎ, বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে বা নিয়ন্ত্রণ করে খরায় পানি না-পাওয়া কৃষকের জন্য পানির ব্যবস্থা করে দেওয়া। এই উদ্দেশ্য সামনে রেখেই চল্লিশের দশকে নেহেরু সরকার একের পর এক বৃহৎ বাঁধ নির্মাণ করার প্রকল্প হাতে নিয়েছিল।
কিন্তু বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করার সময়ই এটি পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, এত বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এত বিশাল আয়তনের বাঁধ যদি নির্মাণ করতেই হয়, তাহলে এসব অঞ্চলের নদীপাড়ের লাখো লাখো স্থানীয় মানুষকে তাদের কৃষিজমি ও বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। হয়েছিলও তা-ই। পরবর্তী সময়ে এত বিশালসংখ্যক মানুষকে কোথাও আর ঠিকঠাকমতো পুনর্বাসন করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে প্রতিশ্রুতি ছিল লাখ লাখ হেক্টর কৃষিজমি সেচের পানি পাবে, কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ এলাকায়ই পানি পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়নি। নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে নদীর পানি ‘ডাইভার্ট’ করা গেলেও এত বিপুল পরিমাণ পানি হাজার হাজার কৃষকের ফসলি জমি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার মতো ক্যানেল নির্মাণ করা প্রায় অসম্ভব ছিল। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, হাজার কোটি টাকার এসব বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প শুরু থেকেই অবাস্তব ছিল। পরবর্তী সময়ে মেগা বাঁধের মহাবিপর্যয়গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠলে নেহেরুর উন্নয়ন ভাবনায় আমূল পরিবর্তন ঘটে। মেগা প্রকল্পের উন্নয়ন চিন্তা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে তিনি স্থানীয় অর্থনীতিভিত্তিক উন্নয়ন চিন্তায় মনোযোগী হন (দেখুন: ‘নেহেরুর উন্নয়ন ভাবনা এবং বাংলাদেশের মেগা উন্নয়নের ঘোর’, সর্বজনকথা, নভেম্বর, ২০১৯)। তবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, পঞ্চাশের দশকেই নেহেরু বৃহৎ প্রকল্পের ‘ফ্যাসিনেশন’ থেকে সরে এলেও ভারতের পরবর্তী সরকারগুলো বড় বাঁধ ও মেগা অবকাঠামোর মোহ থেকে প্রায় কখনোই আর বেরিয়ে আসতে পারেনি। বলা হয়, শুধু বাঁধের কারণেই ভারতে সব মিলিয়ে প্রায় দেড় কোটির বেশি মানুষ উচ্ছেদ হয়েছে।
প্রতিশ্রুতি ছিল লাখ লাখ হেক্টর কৃষিজমি সেচের পানি পাবে, কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ এলাকায়ই পানি পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়নি। নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে নদীর পানি ‘ডাইভার্ট’ করা গেলেও এত বিপুল পরিমাণ পানি হাজার হাজার কৃষকের ফসলি জমি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার মতো ক্যানেল নির্মাণ করা প্রায় অসম্ভব ছিল। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, হাজার কোটি টাকার এসব বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প শুরু থেকেই অবাস্তব ছিল।
২. মেগা প্রকল্পের খরচ বাড়ে কেন?
The Iron Law of Megaprojects: ‘Over time, over budget, under benefits, over and over again.’ ‒বেন্ট ফ্লাইভবজার্গ (Bent Flyvbjerg)
যেকোনো মেগা প্রকল্পের খরচই অত্যধিক বেশি। তার ওপর প্রায় প্রতিটি মেগা প্রকল্পের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, প্রস্তাবিত খরচের চেয়ে আসল খরচ দিনে দিনে বাড়তেই থাকে। কিন্তু মেগা প্রকল্পের খরচ সংক্রান্ত আলোচনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি দিক হলো: এক. প্রাথমিক প্রস্তাবনার সময় প্রকল্প ব্যয় আসল খরচের চেয়ে কম করে দেখানোর প্রবণতা, দুই. প্রকল্পের উপকারিতা বা ‘বেনিফিট’ বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা। অর্থাৎ, প্রকল্পের শুরু থেকেই খরচের ব্যাপারে একধরনের লুকোচুরির আশ্রয় নেওয়া।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি দিক হলো: এক. প্রাথমিক প্রস্তাবনার সময় প্রকল্প ব্যয় আসল খরচের চেয়ে কম করে দেখানোর প্রবণতা, দুই. প্রকল্পের উপকারিতা বা ‘বেনিফিট’ বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা।
বেশির ভাগ মেগা প্রকল্পের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, প্রস্তাবিত ব্যয়ের তুলনায় পরবর্তী সময়ে খরচ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। এই ক্রমাগত ব্যয় বৃদ্ধির ব্যাখ্যা কী? প্রকল্পের শুরুতে ব্যয় কম করে দেখানোর এই প্রবণতা কি ইচ্ছাকৃত? নাকি ভুলভাবে হিসাব করার ফলাফল? এ বিষয়ে খুব বিস্তারিত কাজ করেছেন ডেনিশ গবেষক বেন্ট ফ্লাইভবজার্গ। তার মতে, মেগা প্রকল্পের খরচ ক্রমাগত বাড়তে থাকা নিছক কোনো অনিচ্ছাকৃত ‘এরর’ নয়; বরং এটি পরিকল্পনামাফিকই করা হয় (দেখুন: Underestimating Costs in Public Works Projects: Error or Lie?, ২০০২)। ফ্লাইভবজার্গ-এর মতে, মেগা প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধিকে সরলভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই; বরং প্রতিটি মেগা প্রকল্পের ব্যয় ধাপে ধাপে কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা খুঁজতে গেলে মেগা প্রকল্পের কারিগর বা পেছনের ‘প্লেয়ার’দের আর্থিক/বাণিজ্যিক স্বার্থের বিষয়টি সামনে চলে আসে।
মেগা প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধিবিষয়ক একটি পরিসংখ্যান এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। গত কয়েক দশকে তৈরি হওয়া বিভিন্ন দেশের প্রায় ২৫৮টি ট্রান্সপোর্ট বা যোগাযোগ প্রকল্পের (৯০ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের) ওপর জরিপ চালিয়ে একটি বিস্ময়কর সাদৃশ্য পাওয়া গেছে। গবেষণার ফলাফল বলছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রকল্পগুলো গ্রহণ করা হবে-কি-হবে না, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যে ‘কস্ট অ্যান্ড বেনিফিট এনালাইসিস’ (লাভক্ষতির সমীক্ষা) করা হয়েছে, সেখানে ইচ্ছাকৃতভাবেই প্রচুর বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়া হয়েছে (‘The cost estimates used to decide whether such projects should be built are highly and systematically misleading’)। অর্থাৎ মেগা প্রকল্পের খরচ কমিয়ে দেখানোর এই প্রবণতা কোনোভাবেই ‘এরর’ বা ভুল নয়; বরং একটি সুপরিকল্পিত কৌশল। গবেষণায় এমন মন্তব্যও করা হয়েছে যে: ‘Underestimation cannot be explained by error and is best explained by strategic misrepresentation, that is, lying.’ (ফ্লাইভবজার্গ, হোম ও বুল, ২০০২) । অর্থাৎ, প্রস্তাবিত খরচের ‘underestimation’ সচেতনভাবেই মিথ্যার ওপর দাঁড় করানো এবং গবেষকের ভাষায় ‘overwhelming statistical significance’-সহই এটি প্রমাণিত।
এ ছাড়া খোদ এআইআইবির (এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক) সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ভারতে মোট ৩৫০টি প্রকল্পের ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত খরচের চেয়ে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের খরচ বৃদ্ধির নজির আছে। পাকিস্তানে প্রায় ১০০০ প্রকল্পের ক্ষেত্রে খরচ বৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া গেছে। মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে দেখা গেছে প্রায় ৫০ ভাগের বেশি প্রকল্পই খরচ বৃদ্ধির শিকার (এআইআইবি, ২০২০)।
বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি মেগা প্রকল্পের খরচ নিয়েই বিতর্ক আছে। রাস্তা, ব্রিজ, হাইওয়ে, বিদ্যুৎকেন্দ্র, টার্মিনাল, বন্দরসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই প্রকল্পের অস্বাভাবিক খরচের বিষয়টি বারবার সামনে এসেছে। বেশির ভাগ প্রকল্পের খরচই প্রাথমিক ধাপে দেখানো খরচের তুলনায় পরবর্তী সময়ে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা সেতু, পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে শুরু করে গত দেড় দশকে অনুমোদন পাওয়া প্রায় সব কটি মেগা প্রকল্পের ক্ষেত্রেই এই ‘ট্রেন্ড’ বা প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি মেগা প্রকল্পের খরচ নিয়েই বিতর্ক আছে। রাস্তা, ব্রিজ, হাইওয়ে, বিদ্যুৎকেন্দ্র, টার্মিনাল, বন্দরসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই প্রকল্পের অস্বাভাবিক খরচের বিষয়টি বারবার সামনে এসেছে। বেশির ভাগ প্রকল্পের খরচই প্রাথমিক ধাপে দেখানো খরচের তুলনায় পরবর্তী সময়ে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ক্রমাগত খরচ বৃদ্ধির এসব ঘটনায় নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি খুব স্পষ্ট বার্তা আছে। আর তা হলো, এই ধরনের মেগা প্রকল্পগুলোর ‘কস্ট এনালাইসিসে’র ওপর কোনোভাবেই আস্থা রাখা যায় না। ফ্লাইভবজার্গের ভাষায়: legislators, administrators, investors, media representatives, and members of the public who value honest numbers should not trust cost estimates and cost-benefit analyses produced by project promoters and their analysts (ফ্লাইভবজার্গ, হোম ও বুল, ২০০২)। অর্থাৎ, আইন প্রণেতা, প্রশাসক, বিনিয়োগকারী, মিডিয়া, অথবা নাগরিক প্রতিনিধিদের প্রকল্পের ‘কস্ট অ্যান্ড বেনিফিট’ বা লাভ ক্ষতির সমীক্ষাগুলোকে একেবারেই বিশ্বাস করা উচিত নয় (অবশ্য এখানে হিলয়ার্ড একটি আদর্শ পরিস্থিতির বর্ণনা করছেন যেখানে দেশের প্রশাসন বা আইন প্রণেতারা জনগণের পক্ষেই কাজ করেন। বাস্তবে আমরা দেখি, অন্তত ভারত বা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে- মন্ত্রী, এমপি, বা এমনকি মিডিয়াও এই ধরণের প্রকল্পের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী এবং সমর্থক।)
এখানে উল্লেখ্য, মেগা প্রকল্পের প্রস্তাবনা তৈরির সময় নিয়মানুসারেই ‘কস্ট অ্যান্ড বেনিফিট এনালাইসিস’ বা লাভক্ষতির সমীক্ষাসহ প্রস্তাব দিতে হয়। হাইওয়ে, রাস্তা, ব্রিজ, বিমানবন্দর বা কয়লা প্রকল্পের খরচ যেহেতু এমনিতেই অনেক বেশি এবং জনগণের ট্যাক্সের টাকা বা বিদেশি ঋণেই এসব খরচবহুল প্রকল্প নির্মিত হয় (প্রকল্পের জন্য নেওয়া বৈদেশিক ঋণ জনগণকেই করের টাকা দিয়ে শোধ করতে হয় বহু বছর ধরে), তাই প্রশ্ন ওঠে, এসব প্রকল্পের সব কটিই কি শর্তহীনভাবে উপকারী প্রকল্প? প্রতিটি প্রকল্পেরই যেমন কিছু-না-কিছু উপকারিতা থাকে, প্রকল্পের সামাজিক এবং পরিবেশগত বহুমুখী ক্ষতিও থাকে। সে কারণেই কতটুকু খরচের বিনিময়ে কতটুকু আর্থিক লাভ, কতটুকু পরিবেশ বিপর্যয়ের বিনিময়ে কতটুকু বাণিজ্যিক উপকারিতা, তার বিস্তারিত বিশ্লেষণ থাকা জরুরি।
কিন্তু অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক বা সামাজিক লাভের পরিমাণ যদি শুরুতেই বেশি করে দেখানো হয় (বেনিফিট ওভারএস্টিমেশন), আর অর্থনৈতিক, সামাজিক বা পরিবেশগত ক্ষতিকে যদি ইচ্ছাকৃতভাবেই ‘আন্ডারএস্টিমেট’ করে বা কম করে দেখানো হয়, সে ক্ষেত্রে অতিরিক্ত খরচবহুল এবং মারাত্মক ক্ষতিকর সব প্রকল্পকেও জনগণের সামনে লাভজনক এবং আকর্ষণীয় হিসেবে উপস্থাপন করা সহজ হয়।
মেগা প্রকল্পের ক্ষতির হিসাব বা খরচের হিসাব কমিয়ে দেখানোর (কস্ট আন্ডারএস্টিমেশন) বিষয়ে ফ্লাইভবজার্গের বিস্তারিত বিশ্লেষণ আছে। ফ্লাইবভজার্গ বলছেন, খরচ এবং ক্ষতি কম করে দেখালে মূলত দুটি সমস্যা তৈরি হয়। প্রথমত, অযৌক্তিক, অ-টেকসই এবং অতিরিক্ত খরুচে সব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের পথ সহজ হয় (শেষ পর্যন্ত যার ব্যয়ভার বহন করতে হয় জনগণকে)। আর দ্বিতীয়ত, এসব প্রকল্পের অপ্রত্যাশিত খরচ বৃদ্ধির কারণে তুলনামূলক ভালো এবং উপকারী প্রকল্পগুলো অগ্রাধিকার তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়। ফ্লাইভবজার্গের ভাষায়: ‘The dubious … practices of underestimating costs and overestimating benefits used by many mega project… create a distorted hall-of-mirrors in which it is extremely difficult to decide which projects deserve undertaking and which not’ (ফ্লাইভবজার্গ, ২০১৪)। অর্থাৎ সহজ করে বললে, মেগা প্রকল্পের খরচ কম করে দেখানো এবং উপকারিতা বেশি করে দেখানোর এই প্রবণতার কারণে কোনটা ভালো প্রকল্প আর কোনটা খারাপ প্রকল্প তা নির্ধারণ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
ফ্লাইভবজার্গ আরও বলছেন: ‘The projects that look best on paper are the projects with the largest cost underestimates and benefit overestimates…. Therefore the projects that have been made to look best on paper become the worst, or unfittest, projects in reality, in the sense that they are the very projects that will encounter most problems during construction and operations in terms of the largest cost overruns, benefit shortfalls, and risks of non-viability. They have been designed like that, as disasters waiting to happen’ (ফ্লাইভবজার্গ, ২০১৪)। (কাগজে-কলমে সেই প্রকল্পগুলোকেই সবচেয়ে ভালো দেখায়, যেগুলো খরচ সবচেয়ে কমিয়ে দেখাতে পারে এবং প্রকল্পের উপকারিতা সবচেয়ে বাড়িয়ে দেখাতে পারে। … কিন্তু কাগজে-কলমে সবচেয়ে ভালো দেখানোর জন্য তৈরি করা প্রকল্পগুলো বাস্তবে সবচেয়ে খারাপ বা অযোগ্য প্রকল্পে পরিণত হয়। কারণ, প্রকল্পের নির্মাণকাজের সময় সবচেয়ে বেশি অপ্রত্যাশিত খরচ এবং ঝুঁকির সম্মুখীন হয় এসব প্রকল্প। যে প্রকল্পের গোড়াতেই গলদ, সেই প্রকল্প বিপর্যয় ডেকে আনবে‒সেটাই স্বাভাবিক)।
এখন প্রশ্ন ওঠে: এই যে প্রাথমিক প্রস্তাবের চেয়ে প্রকল্পের খরচ পরে গিয়ে বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে, এই সম্ভাবনার
বিষয়ে সরকারের মন্ত্রণালয়গুলো কি অবগত নয়? নাকি জেনেশুনেই তারা এসব প্রকল্প হাতে নেয়? ইচ্ছাকৃতভাবে খরচ কমিয়ে দেখানোর বিষয়টি জানা থাকলেও কি এসব মারাত্মক খরচবহুল প্রকল্প হাতে নেওয়া হতো? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে প্রশ্ন ওঠে: প্রকল্পের ‘কস্ট অ্যান্ড বেনিফিট এনালাইসিস’ বা লাভক্ষতির সমীক্ষাটি আসলে কে বা কারা করে? কীভাবে করে?…
৩. মেগা প্রকল্পের ‘লাভক্ষতির সমীক্ষা’
মেগা প্রকল্পের প্রাথমিক প্রস্তাবনা পর্যায়ে ‘কস্ট অ্যান্ড বেনিফিট এনালাইসিস’ অথবা এনভায়রনমেন্ট ইম্প্যাক্ট এনালাইসিস (পরিবেশ সমীক্ষা) করার প্রক্রিয়াটিকে আমরা মোটাদাগে একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়া হিসেবেই দেখি। আমরা ধরেই নিই, নিরপেক্ষভাবে লাভক্ষতির হিসাব করে বা পরিবেশদূষণের বিশ্লেষণ করে প্রকল্প হবে-কি-হবে না, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নিয়মানুসারে তাই হওয়ার কথা। যেমন, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্থনৈতিক লাভের চেয়ে উচ্ছেদের ক্ষতি এবং পরিবেশগত ক্ষতির পরিমাণ যদি বেশি হয়, সে ক্ষেত্রে এ ধরনের ‘লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি’ প্রকল্পে বিনিয়োগ করার কোনো যৌক্তিকতা থাকে না। আবার কয়লা, পারমাণবিক এবং এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্রমাগত বাড়তে থাকা নির্মাণ ও উৎপাদন খরচ এবং পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্রমাগত পড়তি দাম এবং উন্নততর প্রযুক্তির বিষয়টি আমলে নিলে যেকোনো দেশের জন্যই সৌর বা বায়ুবিদ্যুতে বিনিয়োগ করাটাই আর্থিকভাবে সবচেয়ে যৌক্তিক। কিন্তু তারপরও ভারত, পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আমরা মারাত্মক খরচবহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ মেগা প্রকল্পের দিকে ঝুঁকতে দেখি।
কয়লা, পারমাণবিক এবং এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্রমাগত বাড়তে থাকা নির্মাণ ও উৎপাদন খরচ এবং পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্রমাগত পড়তি দাম এবং উন্নততর প্রযুক্তির বিষয়টি আমলে নিলে যেকোনো দেশের জন্যই সৌর বা বায়ুবিদ্যুতে বিনিয়োগ করাটাই আর্থিকভাবে সবচেয়ে যৌক্তিক।
তাই প্রশ্ন ওঠে: প্রথমত, ‘কস্ট অ্যান্ড বেনিফিট এনালাইসিস’-এর ওপর কতটা নির্ভর করে প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত?
দ্বিতীয়ত, ওপর মহল থেকে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত যখন আগেভাগেই নেওয়া থাকে, তখন নির্মোহভাবে লাভক্ষতির সমীক্ষা অথবা পরিবেশ সমীক্ষা প্রকাশ করা সম্ভব কি না?
তৃতীয়ত, লাভক্ষতির এই বিশ্লেষণ কারা করেন? তৃতীয় কোনো পার্টি? এই পার্টি, বা ব্যক্তি, বা বিশেষজ্ঞ নিরপেক্ষ কি না, তা নির্ণয় করবে কে? প্রকল্পের সঙ্গে তার কোনো আর্থিক স্বার্থ জড়িত নেই, তা নিশ্চিত করবে কে?
সাধারণত ‘ইনডিপিনডেন্ট’ বা নিরপেক্ষ কোনো প্রতিষ্ঠান বা বিশেষজ্ঞকে দিয়ে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করার কথা থাকলেও বাস্তবে আমরা কী দেখি? এ ধরনের হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের ‘কস্ট অ্যান্ড বেনিফিট’ সমীক্ষাটি কি আসলেও নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ দিয়ে করানো সম্ভব? যেখানে প্রচুর পরিমাণে আর্থিক লেনদেন বা কমিশন বাণিজ্যের সম্ভাবনা, সেখানে ‘নিরপেক্ষ’ দেখিয়ে বিশেষজ্ঞ ‘কিনে ফেলা’, অথবা প্রভাব খাটিয়ে প্রতিবেদনের ফলাফল ঘুরিয়ে দেওয়ার ঘটনা কি এই দেশে নতুন?
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকারের ‘পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান’টি করে দেওয়ার জন্য কনসালট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল টোকিও ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি (টেপকো) নামের একটি জাপানি বেসরকারি কোম্পানিকে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, জাপানি এই কোম্পানি বাংলাদেশের নিজস্ব গ্যাস ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা বাদ দিয়ে একচেটিয়াভাবে আমদানি করা কয়লা ও এলএনজির ওপর ভিত্তি করে সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের মহাপরিকল্পনাটি তৈরি করেছে, এবং তারপর নিজেরাই বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের নির্মাণকাজের ‘কনসালট্যান্ট’ হয়েছে, আর নিজেরাই পরিবেশ সমীক্ষা, সম্ভাব্যতা সমীক্ষা (ফিজিবিলিটি স্টাডি) ইত্যাদি তৈরি করে রায় দিয়ে দিয়েছে! যেমন: মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং আনোয়ারা-মাতারবাড়ি ট্রান্সমিশন লাইন প্রকল্পের পরিবেশগত সমীক্ষা (এনভায়রনমেন্ট ইম্প্যাক্ট এনালাইসিস) করেছে টেপকো। এ ছাড়াও হরিপুর বিদ্যুৎ প্রকল্প ও ডেসকোর একটি সাবস্টেশনের নির্মাণ কনসালট্যান্ট হিসেবেও কাজ করেছে টেপকো। অর্থাৎ, এখানে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’-এর বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, টেপকোর তৈরি করে দেওয়া মাস্টার প্ল্যানে দেশের জ্বালানি খাতে জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের কোনো চিন্তাভাবনা তো নেই-ই; বরং আগামী কয়েক দশকের জন্য দেশের জ্বালানি খাতকে একাধিক মেগা কয়লা প্রকল্পের ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ডে’ পরিণত করার পরিকল্পনা স্পষ্ট। অর্থাৎ, দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সবচেয়ে বড় পরিকল্পনাটির ক্ষেত্রেও বিদেশি কোম্পানির বাণিজ্যিক স্বার্থের বিষয়টি পরিষ্কার। এই বাস্তবতায় মেগা প্রকল্পের ‘লাভক্ষতির সমীক্ষা’র বিষয়টি কি শেষ পর্যন্ত নিরপেক্ষ বা বৈজ্ঞানিক যুক্তির ওপর নির্ভর করে?
জাপানি এই কোম্পানি বাংলাদেশের নিজস্ব গ্যাস ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা বাদ দিয়ে একচেটিয়াভাবে আমদানি করা কয়লা ও এলএনজির ওপর ভিত্তি করে সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের মহাপরিকল্পনাটি তৈরি করেছে, এবং তারপর নিজেরাই বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের নির্মাণকাজের ‘কনসালট্যান্ট’ হয়েছে, আর নিজেরাই পরিবেশ সমীক্ষা, সম্ভাব্যতা সমীক্ষা (ফিজিবিলিটি স্টাডি) ইত্যাদি তৈরি করে রায় দিয়ে দিয়েছে!
‘মেগা প্রকল্পে কার লাভ’‒এই প্রশ্নটি তাই মেগা প্রকল্পবিষয়ক আলোচনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। মেগা প্রকল্পের বিনিয়োগে, নির্মাণে এবং বাস্তবায়নে কাদের স্বার্থ জড়িত থাকে? মেগা প্রকল্পের ‘প্ল্যানিং’-এর শুরু থেকেই কারা জড়িত থাকে? মেগা প্রকল্পগুলোর ‘প্রোফাইল’ বা ওয়েবসাইট দেখলেই পরিষ্কার হয়, দেশি-বিদেশি ব্যাংক, দেশি-বিদেশি কনসালট্যান্ট, নির্মাণ কোম্পানি, ‘ডেভেলপার’, সিমেন্ট কোম্পানি, ইট-বালু-রডের স্থানীয় সরবরাহকারী, স্থানীয় এজেন্ট, প্রকৌশলী, স্থাপত্যবিদ, প্রযুক্তিবিদ ও করপোরেট আইনজীবীসহ বহু পার্টি, কোম্পানি, ব্যক্তি ও প্রভাবশালী মহলের যুক্ততা এবং বাণিজ্যিক স্বার্থ ছাড়া এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এ ছাড়াও প্রকল্প নির্মাণের বিভিন্ন ধাপে একাধিক সাবকন্ট্রাক্টর কোম্পানিও কাজ পেয়ে থাকে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও মাতারবাড়ি, পায়রা, রামপাল বা কক্সবাজারে নির্মিত প্রায় সব কটি মেগা প্রকল্পের আগে-পিছেই একাধিক দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া যায়। স্বভাবতই প্রকল্প নির্মাণের আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে এতগুলো ব্যাবসায়িক গোষ্ঠী জড়িত থাকে বলেই নির্মাণ ও বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে মুনাফা করাটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। ফ্লাইভবজার্গের ভাষায়: ‘Given the enormous budgets for megaprojects there are ample funds to go around for all, including contractors, engineers, architects, consultants, construction and transportation workers, bankers, investors, landowners, lawyers, and developers’ (ফ্লাইভবজার্গ, ২০১৭)। অর্থাৎ, মেগা প্রকল্পের বিশাল বাজেটের কারণে ঠিকাদার, প্রকৌশলী, স্থপতি, কনসালট্যান্ট, নির্মাণ কর্মী, পরিবহন কর্মী, ব্যাংকার, ব্যাবসায়ী, জমির মালিক, আইনজীবী সহ সকলেরই পর্যাপ্ত মুনাফা করার সুযোগ থাকে। সামগ্রিকভাবে তাই বলা যায়, প্রকল্পের শুরু থেকেই প্রকল্প খরচ কম করে দেখানো বা ‘বেনিফিট’ বেশি করে দেখানোর এই প্রবণতা মোটেও কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং ফ্লাইভবজার্গের বিশ্লেষণটিই যথার্থ। মেগা প্রকল্পের ব্যয় কম করে দেখানো একটি পরিকল্পিত বা সিস্টেমেটিক ‘ভুল’-এর অংশ। আরও সহজ করে বললে, লাভক্ষতির হিসাব করার এই পুরো প্রক্রিয়াটিই আগাগোড়া সচেতন মিথ্যার ওপর দাঁড় করানো।
মেগা প্রকল্পের বিশাল বাজেটের কারণে ঠিকাদার, প্রকৌশলী, স্থপতি, কনসালট্যান্ট, নির্মাণ কর্মী, পরিবহন কর্মী, ব্যাংকার, ব্যাবসায়ী, জমির মালিক, আইনজীবী সহ সকলেরই পর্যাপ্ত মুনাফা করার সুযোগ থাকে। সামগ্রিকভাবে তাই বলা যায়, প্রকল্পের শুরু থেকেই প্রকল্প খরচ কম করে দেখানো বা ‘বেনিফিট’ বেশি করে দেখানোর এই প্রবণতা মোটেও কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়
৪. মেগা প্রকল্পে কাদের আগ্রহ? কেন আগ্রহ?
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ২০১৭ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২৯ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনের নাম ‘ক্লোজিং দ্য ফাইন্যান্সিং গ্যাপ ইন এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার’। এখানে ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা অবকাঠামো বলতে এডিবি বুঝিয়েছে, রাস্তা, হাইওয়ে, রেলরোড, এয়ারপোর্ট, সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎ, টেলিযোগাযোগ, পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন। এডিবির এই প্রতিবেদন বলছে, সমগ্র এশিয়ায় অবকাঠামো খাতে প্রায় ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের ঘাটতি আছে এবং এ খাতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত দেশগুলোকে খরচ করতে হবে বছরে প্রায় ১.৩৪ ট্রিলিয়ন ডলার। সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি পড়ে মূল উদ্দেশ্য যা বোঝা যায় তা হলো, এশিয়ার দেশগুলোতে অবকাঠামো খাতের ‘ফাইন্যান্স গ্যাপ’ বা বিনিয়োগের ‘ঘাটতি’ চিহ্নিত করা।
এখানে উল্লেখ্য, ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা অবকাঠামো খাতে ঠিকমতো বিনিয়োগ হচ্ছে না’, ‘এ খাতে প্রচুর পরিমাণে টাকা-পয়সা ঢালতে হবে’, এ ধরনের প্রচারণা শুরু হয়েছিল আরও বেশ কয়েক বছর আগে। মূলত ২০১৫ সাল থেকেই বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো মেগা অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা, কীভাবে বিনিয়োগ হবে, কোন মডেলে হবে, কে করবে‒এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা শুরু করে। এ-বিষয়ক রচনাবলি, ওয়ার্কিং পেপার, আন্তর্জাতিক সেমিনার বা বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানদের বক্তব্য অনুসরণ করলে একটি টাইমলাইন তৈরি করা যেতেই পারে।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) মেগা অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ নিয়ে কী বলছে?
* ২০১৫ সালে এডিবি ২৫টি উন্নয়নশীল দেশের অবকাঠামো ঘাটতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে (ADB South Asia Working Paper Series No. 57)। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০২০ সালের মধ্যে এই দেশগুলোর অবকাঠামো খাতে (ইকোনমিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার) মোট ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ দরকার।
* পরবর্তী সময়ে ৪৫টি উন্নয়নশীল দেশের অবকাঠামো ঘাটতি নিয়ে আরেকটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে এই দেশগুলোর অবকাঠামো খাতে বছরে প্রায় ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ লাগবে। সব মিলিয়ে ১৫ বছরে লাগবে প্রায় ২৬ ট্রিলিয়ন ডলার।
* ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় ‘Closing the Financing Gap in Asian Infrastructure’ নামের প্রতিবেদনটি (উপরে এই প্রতিবেদনের মূল বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে)।
বিশ্বব্যাংক মেগা অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ নিয়ে কী বলছে?
* ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ মিলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনের নাম ‘From Billions to Trillions: Transforming Development Finance’। এশিয়ার দেশগুলোর ‘ডেভেলপমেন্ট’-এর জন্য বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন, বিলিয়নে আর কুলাচ্ছে না, ট্রিলিয়ন্স দরকার- এই হচ্ছে প্রতিবেদনের মূল বক্তব্য।
* ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাংকের ‘Maximizing Finance for Development’ নামের আরেক প্রতিবেদনেও সেই একই সুর পাওয়া যায়। এই প্রতিবেদনেও ‘ডেভেলপমেন্ট’ বলতে যা বোঝানো হয়েছে, তার প্রায় পুরোটাই অবকাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কিত।
জি ২০ কী বলছে?
* ২০১৭ সালের জুলাই মাসে জি-২০ দেশগুলোর অর্থমন্ত্রীদের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংকের জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করা হয়। এটি ছিল উন্নয়নশীল দেশগুলোর ‘ডেভেলপমেন্ট’ বা ‘উন্নয়ন’-এর জন্য প্রাইভেট খাতের বিনিয়োগ কীভাবে বাড়ানো যায়, সে-বিষয়ক নীতিমালা। এখানেও ‘ডেভেলপমেন্ট’ বলতে বড় প্রকল্পগুলোকেই বোঝানো হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে: প্রায় এক দশক ধরে বিশ্বব্যাংক, এডিবি বা এআইআইবির মতো ব্যাংকগুলো বা জি-সেভেনের মতো প্রভাবশালী দেশগুলো হঠাৎ করেই ‘এশিয়ায় মেগা প্রকল্প করতে প্রচুর অর্থ লাগবে’-এ ধরনের হাইপ তোলা শুরু করল কেন? প্রশ্ন ওঠে: এডিবি অবকাঠামো চাহিদার যে হিসাব দেখিয়েছে, তার ভিত্তি কী? আরও প্রশ্ন করা যেতে পারে: বছরে ১.৭ বিলিয়ন ডলারের এই বিনিয়োগ চাহিদার বয়ানটি উন্নয়নের ঠিক কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করা হয়েছে?
বলাই বাহুল্য, বিশ্বব্যাংক বা এডিবির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এশিয়া বা আফ্রিকার দেশগুলোর উন্নয়ন এজেন্ডা বা অগ্রাধিকারগুলো ঠিক করে দেয়। গত তিন দশকের উন্নয়নের ইতিহাস বলে, কখন কোথায় কী খাতে ব্যয় করতে হবে বা কোন প্রকল্প অগ্রাধিকার পাবে তা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জনগণ নয়, বরং ঋণদাতা সংস্থাগুলোই এসব ঠিক করে দিয়েছে। পাশাপাশি ঋণের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে ‘মুক্তবাণিজ্যে’র শর্ত। যেমন, আশি-নব্বইয়ের দশকে এই সংস্থাগুলোই ঋণের সঙ্গে বেসরকারিকরণের এজেন্ডা ধরিয়ে দিয়েছিল। ‘ফ্রি-ট্রেড’ বা এক্সপোর্ট-এর ‘হাইপ’ তাদেরই ধরিয়ে দেওয়া নীতিমালার ফলাফল।
২০১৫ সাল থেকে মেগা অবকাঠামো বিষয়ে তাদের আগ্রহ, গবেষণা, দিকনির্দেশনা এবং নীতিমালাগুলো দেখলেই পরিষ্কার হয়, ‘মেগা অবকাঠামো খাতে বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি আছে’, ‘ডেভেলপমেন্টে’র জন্য ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ প্রয়োজন, ‘সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে বিনিয়োগ করতে হবে’, ‘সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে’-এই বিশেষ হাইপটি হঠাৎ করে তৈরি হওয়া কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ২০১৪ সাল থেকে সব কটি ‘হাই প্রোফাইল’ আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা মিলে একযোগে একের পর এক গবেষণা করে ‘এশিয়ার অবকাঠামো খাতে অনেক অনেক বিনিয়োগ লাগবে’-এ ধরনের মেসেজ হাজির করাকে তাই শুধু একটি ‘দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্প’ হিসেবে দেখার কোনো কারণ নেই।
২০১৪ সাল থেকে সব কটি ‘হাই প্রোফাইল’ আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা মিলে একযোগে একের পর এক গবেষণা করে ‘এশিয়ার অবকাঠামো খাতে অনেক অনেক বিনিয়োগ লাগবে’-এ ধরনের মেসেজ হাজির করাকে তাই শুধু একটি ‘দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্প’ হিসেবে দেখার কোনো কারণ নেই।
তাহলে কি এর পেছনে বৃহৎ কোনো বাণিজ্যিক স্বার্থ কাজ করছে? এই বাণিজ্যিক স্বার্থের অংশীদার কারা বা স্টেকহোল্ডার কারা? মেগা প্রকল্পে মেগা বিনিয়োগের উদ্দেশ্য কী? এ ধরনের বিনিয়োগে লাভ কার? আর্থিক সংস্থাগুলো কোন উপায়ে এই বিনিয়োগে জড়িত থাকবে? কোন পদ্ধতিতে বা কোন মডেলে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে?
উল্লেখ্য, এখন পর্যন্ত মেগা প্রকল্পে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে যে মডেলটি বারবার সুপারিশ করা হয়েছে বা সামনে আনা হয়েছে তা হলো, পিপিপি বা পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেল। এই মডেলে মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে লাভ কার? এই মডেলের অংশীদার কারা? মেগা প্রকল্পের বাণিজ্যিক স্বার্থের আলোচনায় এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
৫. পিপিপি বা পাবলিক–প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেল: কার লাভ কার ক্ষতি?
The history of PPPs is history of privatized gains and socialized losses.
-নিকোলাস হিলয়ার্ড (Nicholas Hillyard)
এটা পরিষ্কার যে, ৭-৮ বছর ধরে মেগা অবকাঠামো ইস্যুকে বারবার সামনে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, এডিবি বা এআইআইবির মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মেগা প্রকল্পে বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা, পরিমাণ এবং ধরন নিয়ে একের পর এক প্রতিবেদন ও নীতিমালা প্রকাশ করেছে। এখানে খেয়াল করার মতো ব্যাপার হলো, কে এই বিনিয়োগ করবে, কোন মডেলে করবে-এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘ সময় ধরে একই সুরে কথা বলেছে। মোটাদাগে ‘উন্নয়নশীল দেশের সরকারের পক্ষে এককভাবে এই অর্থায়ন করা সম্ভব নয়’-এই যুক্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ বিষয়ে ২০১৭ সালে জি-২০ দেশের সরকার প্রধানদের বক্তব্যও ছিল একই রকম। অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করবে কে?-এই প্রশ্নের উত্তরে প্রাইভেট খাতের সম্ভাবনার কথাই বারবার বলা হয়েছে।
যেমন, বিশ্বব্যাংকের ২০১৭ সালের একটি প্রতিবেদনে মেগা প্রকল্পে প্রাইভেট খাতের বিনিয়োগ নিয়ে তাদের আগ্রহের জায়গাটি অত্যন্ত স্পষ্ট। বলা হচ্ছে: ‘While the development goals set for 2030 call for funding on a much larger scale, there is also considerable capital, concentrated in the private sector of wealthier countries, that could play a larger role.’ (বিশ্বব্যাংক, ২০১৭)। সংক্ষেপে বললে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ‘উন্নয়নে’ বিনিয়োগ করার মতো উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পুঁজি (ক্যাপিটাল) উন্নত দেশগুলোর প্রাইভেট খাতে জমা আছে, যা ‘উন্নয়নে’ বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। বলা হচ্ছে: ‘If we equip countries to attract and manage private solutions, we help level the playing field for the poorest’ (বিশ্বব্যাংক, ২০১৭)। অর্থাৎ, এখানেও প্রাইভেট খাতের বিনিয়োগ আকর্ষণ করার দিকেই ইঙ্গিত করা হচ্ছে এবং সেটাও গরিব মানুষের জন্য ‘লেভেল-প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরী হবে এই যুক্তিতে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে: বিশ্বব্যাংক বা এডিবির মতো সংস্থাগুলো কি মেগা অবকাঠামো খাতে শুধু প্রাইভেট খাতের বিনিয়োগ নিয়েই উৎসাহী? নাকি এর সঙ্গে আরও উপকরণ আছে? একটু লক্ষ করলেই দেখা যায়, শুধু প্রাইভেট খাত নয়; বরং প্রাইভেট খাতের ব্যাবসায়িক ঝুঁকি কমিয়ে আনতে সরকারি সংস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করে বা ‘পার্টনার’ করে কাজ করার ব্যাপারেই তাদের আগ্রহ। এ ধরনের ‘পার্টনারশিপ’কেই সাধারণত পিপিপি মডেল বা পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ বলা হচ্ছে।
আপাতদৃষ্টিতে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ একটি কার্যকরী মডেল। সরকার এবং প্রাইভেট খাত মিলেমিশে কাজ করবে। এতে আর্থিক ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্সও’ বজায় থাকবে। অর্থাৎ, সরকারি প্রকল্পে যে একচ্ছত্রভাবে দুর্নীতি করার সুযোগ থাকে, প্রাইভেট খাতের যুক্ততার কারণে সেটা সম্ভব হবে না। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা কী বলে? এই পার্টনারশিপে কার কী ভূমিকা? প্রাইভেট খাত কি মেগা প্রকল্পের মেগা ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত?
মেগা প্রকল্পের ঝুঁকি বহুমুখী। প্রাথমিক পর্যায়ে আছে জমি অধিগ্রহণের ঝুঁকি, ক্ষতিপূরণ নিয়ে দরকষাকষির ঝুঁকি এবং স্থানীয় কমিউনিটির আন্দোলনের ঝুঁকি। পরবর্তী পর্যায়ে আছে অর্থনৈতিক মন্দার ঝুঁকি এবং ইনফ্লেশন বা মুদ্রাস্ফীতির ঝুঁকি (অর্থাৎ, রড, বালু, সিমেন্ট বা স্টিলের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি)। এ ছাড়াও আছে রাজনৈতিক ঝুঁকি, সরকার পরিবর্তনের ঝুঁকি বা যুদ্ধের ঝুঁকি। তার ওপর দীর্ঘ মেয়াদে আছে ক্লাইমেট চেঞ্জ বা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি (অতিবৃষ্টি, বন্যা, ঢল, সাইক্লোন ইত্যাদি)। সব মিলিয়ে মেগা প্রকল্পের নানা ধরনের মেগা ঝুঁকি সামলে প্রাইভেট খাতের পক্ষে কী করে সম্ভব লাভের ষোলো আনা নিশ্চিত করা? কী করে সম্ভব ‘গ্যারান্টিড রিটার্ন’ নিশ্চিত করা? অর্থাৎ, মেগা প্রকল্পের দুনিয়ায় প্রাইভেট বিনিয়োগকারীদের জন্য বর্ণাঢ্য সব সুযোগ আছে, এটা যেমন সত্যি, আবার এটাও সত্যি যে নানামুখী জটিল ঝুঁকির মুখে লম্বা সময় ধরে ‘মিনিমাম রেভিনিউ’র নিশ্চয়তা ছাড়া এ খাতে বিনিয়োগ করা আর্থিকভাবে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।’ তাহলে এতসব ঝুঁকির মধ্যে কে দেবে সেই নিশ্চিত রেভিনিউর নিশ্চয়তা? কে হবে শর্তহীন ‘গ্যারেন্টার’? লাভ করার গ্যারান্টি না থাকলে প্রাইভেট পার্টি এসব ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে কেন?
বিশ্বের মেগা প্রকল্পগুলোর রেকর্ড ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, কয়েক দশক ধরেই মেগা প্রকল্পগুলো পিপিপি মডেল বা পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেলে তৈরি হচ্ছে। সরকার, প্রাইভেট খাত ও বিশ্বব্যাংক-এই তিন জায়গা থেকেই পিপিপি মডেলকে প্রাধান্য দিয়ে মেগা প্রকল্প নির্মাণকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। তাহলে প্রশ্ন ওঠে: কী এই পিপিপি মডেল? এই মডেলের ব্যাপারে সরকার ও বিশ্বব্যাংক কেন এত আগ্রহী? মেগা প্রকল্পে বিনিয়োগের মেগা ঝুঁকি সামাল দিতে ‘পিপিপি’ মডেলকেই কেন সমাধান হিসেবে হাজির করা হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে নিশ্চিত ‘রিটার্ন’-এর বিষয়টি মাথায় রেখেই কি এই বিশেষ মডেলের উদ্ভাবন? বলাই বাহুল্য, ‘প্রাইভেট পার্টি’র জন্য পিপিপির মতো চমৎকার কার্যকরী মডেল আর কিছুই হতে পারে না। সেটা কী করে?
* প্রথমত, প্রকল্পের জন্য বিপুল পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ, লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া, পুলিশ দিয়ে স্থানীয় আন্দোলনকারীদের ‘পেটানো’ থেকে শুরু করে যাবতীয় ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো করে রাষ্ট্রীয় সংস্থা। এরপর কয়েক হাজার পরিবার উচ্ছেদ করে ‘রেডিমেড’ জমিতে নির্বিঘ্নে কাজ শুরু করে প্রাইভেট কোম্পানি।
প্রকল্পের জন্য বিপুল পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ, লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া, পুলিশ দিয়ে স্থানীয় আন্দোলনকারীদের ‘পেটানো’ থেকে শুরু করে যাবতীয় ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো করে রাষ্ট্রীয় সংস্থা। এরপর কয়েক হাজার পরিবার উচ্ছেদ করে ‘রেডিমেড’ জমিতে নির্বিঘ্নে কাজ শুরু করে প্রাইভেট কোম্পানি।
* দ্বিতীয়ত, বিনিয়োগ ও লাভের ক্ষেত্রে ‘ফিফটি-ফিফটি’ ডিল থাকলেও পরবর্তী সময়ে ‘লস’ বা ঝুঁকির পুরোটাই চাপানো হয় রাষ্ট্রের ওপর। অর্থাৎ, মোটাদাগে বলা যায়, ঝুঁকি মোকাবিলা করবে সরকার, আর্থিক লস হলে পুষিয়ে দেবে সরকার; কিন্তু লাভ হলে সেটা প্রাইভেট খাতের অ্যাকাউন্টে যাবে।
* তৃতীয়ত, আর্থিক বা সামাজিক ঝুঁকিগুলো সামলাতে গিয়ে সরকারকে যে বিপুল পরিমাণ খরচ করতে হয় (জনগণের ট্যাক্সের টাকায়), তার কোনো হিসাব জনগণের সামনে আনার কোনো দায়বদ্ধতা কোনো পক্ষেরই থাকে না।
এ বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন ব্রিটিশ গবেষক নিকোলাস হিলয়ার্ড। মেগা প্রকল্পে বিনিয়োগের সঙ্গে প্রাইভেট খাতের লাভ-লোকসানের সম্পর্কটি তিনি বারবার সামনে এনেছেন। তার ভাষায়: ‘A road, hospital or oil pipeline is not ‘infrastructure’ unless it provides a stable, contracted cash flow for the longterm’ (হিলয়ার্ড, ২০১৬)। অর্থাৎ, সোজা বাংলায়, রাস্তা হোক, ব্রিজ হোক বা বন্দর হোক, দীর্ঘ মেয়াদে নিরাপদ এবং চুক্তিবদ্ধ আর্থিক ‘রিটার্ন’ বা মুনাফার ‘গ্যারান্টি’ না থাকলে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর অবকাঠামো খাতে টাকা-পয়সা ঢালার কোনো কারণ নেই। প্রাইভেট কোম্পানি অবকাঠামো খাতে শত শত কোটি টাকা ঢালতে তখনই উৎসাহিত হবে, যখন ‘রিটার্ন’ হিসেবে শত শত কোটি টাকা ফেরত আসার গ্যারান্টি থাকবে।
হিলয়ার্ডের মতে, বিশ্বব্যাংক বা এডিবির মতো উন্নয়ন সংস্থাগুলো অতিরিক্ত ঝুঁকি নিয়ে মেগা প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহ হারাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়নও আর মেগা প্রকল্প খাতে এককভাবে অর্থায়ন করছে না। আবার প্রাইভেট খাতের পক্ষেও ‘সেফ রিটার্ন’-এর গ্যারান্টি ছাড়া এত মেগা প্রকল্পে বিনিয়োগ করা ঝুঁকিপূর্ণ। তাহলে কে দেবে সেই নিরাপদ ‘রিটার্ন’-এর গ্যারান্টি?
লক্ষ করলেই দেখা যাবে, বাংলাদেশসহ অন্যান্য অনেক দেশের প্রায় সব কটি মেগা প্রকল্পই হচ্ছে পিপিপি মডেলে। সে ক্ষেত্রে নিয়মানুসারে সরকার ও প্রাইভেট কোম্পানি মিলেঝুলে বিনিয়োগ করার কথা। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখছি? বাস্তবে সরকারের ভূমিকা হলো প্রাইভেট কোম্পানির জন্য ‘সেফ রিটার্ন’ নিশ্চিত করা, অর্থাৎ গ্যারান্টার হওয়া। সরকার ‘গ্যারান্টার’ হয়ে ‘গ্যারান্টি’ দিচ্ছে যেন কোম্পানিকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে না হয়। সরকার বিপুল পরিমাণ ট্যাক্সের টাকা খরচ করে এমন পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছে যেন কোম্পানিকে প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো টাকা-পয়সা খরচ করতে না হয়। এই যে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সরকারের বিবিধ খরচ, এ খরচের একটি বড় অংশই প্রকল্পের খরচের খাতায় ওঠে না (কারণ, সরকারি মাল দরিয়া মে ঢাল-এর মতো একটি ব্যাপার যেহেতু)। মূলত এভাবেই সরকার ও প্রাইভেট খাতের যৌথ পার্টনারশিপের মডেলটি কাজ করছে।
পিপিপি মডেলে সরকারের ঝুঁকি নিয়ে হিলয়ার্ড আরও বলছেন: ‘The government would shoulder most of the risk in the early stages of design and construction and the institutional investors would take the revenue stream over decades’ (হিলয়ার্ড, ২০১৬)। অর্থাৎ সরকার মেগা প্রকল্পের পরিকল্পনার শুরু থেকেই ঝুঁকি নেবে, আর দশকের পর দশক ধরে মুনাফা করে যাবে প্রাইভেট বিনিয়োগকারীরা (হিলয়ার্ড, ২০১৬)।
বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও এআইআইবির মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর হঠাৎ পিপিপি মডেলে আগ্রহী হয়ে ওঠা নিয়ে নিকোলাস হিলয়ার্ড খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। তার ভাষায়: ‘When the World Bank and other well-known enablers of wealth extraction start to organize to promote greater private-sector involvement in ‘infrastructure’, for example through Public-Private Partnerships (PPPs), alarm bells should start to ring. How are roads, bridges, hospitals, ports and railways being eyed up by finance? What..polishes the lens through which they are viewed?’ (হিলয়ার্ড, ২০১৬)। সহজ করে বললে, এশিয়ার রাস্তা, ব্রিজ, পোর্ট বা রেলওয়ের মতো মেগা অবকাঠামোগুলোর দিকে বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের হঠাৎ মনোযোগ দেওয়া এবং এই ওসিলায় সরকারি-বেসরকারি পার্টনারশিপকে উৎসাহিত করা যথেষ্টই সন্দেহজনক। ঠিক কোন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পিপিপিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে?
উল্লেখ করা দরকার, সাম্প্রতিক কালে বিশ্বব্যাংক নিজেই স্বীকার করছে যে, পিপিপি মডেলের মারাত্মকসব ঝুঁকি রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ভাষায়: While private sector can make it easier to get finance, finance will only be available where the operating cashflows of the project company are expected to provide a return on investment (i.e., the cost has to be borne either by the customers or the government through subsidies, etc) (বিশ্বব্যাংক ওয়েবসাইট, ২০১৭) অর্থাৎ, যদিও বেসরকারী খাতের জন্যে প্রকল্পের অর্থায়ন ‘ম্যানেজ’ করা কঠিন নয়, কিন্তু প্রকল্প থেকে ‘রিটার্ন’ এর নিশ্চয়তা না পেলে এতো ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ করবে কে?
আবার পিপিপি মডেলের মাধ্যমে কীভাবে রাষ্ট্রের ওপর ‘লায়াবিলিটি’ বা দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা ব্যাখ্যা করতে হিলয়ার্ড বলছেন: ‘One only need to examine the World Bank’s ‘Guidance on PPP Contractual Provisions’ (2017) to see how risk is heaped upon governments, building up liabilities that one day may transform into huge debt burdens, at the expense of public expenditure on schools, housing and health’ (হিলয়ার্ড, ২০১৬)। অর্থাৎ, বিশ্বব্যাংকের ২০১৭ সালের পিপিপি চুক্তি সম্পর্কিত নির্দেশিকাটি দেখলেই বোঝা যায়, কিভাবে পিপিপির মাধ্যমে সবধরণের আর্থিক ঝুঁকি মোকাবেলার দায় রাষ্ট্রের উপরই চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, যা পরবর্তীতে বিশাল ঋণের বোঝায় পরিণত হতে পারে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতের পরিবর্তে জনগণের ট্যাক্সের টাকাতে খরচবহুল প্রকল্পের ঋণ শোধ করাকেই তখন অগ্রাধিকার দিতে হবে।
৬. মেগা প্রকল্প, মুক্ত বাণিজ্য ও ফসিল ফুয়েল: কার লাভ, কার ক্ষতি?
মেগা প্রকল্প ও মুক্ত বাণিজ্য
মেগা প্রকল্পের সঙ্গে কি মুক্ত বাণিজ্য বা ফ্রি ট্রেডের কোনো সম্পর্ক আছে? মেগা হাইওয়ে, ব্রিজ, টানেল বা গভীর সমুদ্রবন্দরের আকাঙ্ক্ষা কি কোনোভাবে বাজার অর্থনীতি বা মুক্তবাণিজ্যের ধারণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট? এ বিষয়টি নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন ফ্লাইভবজার্গ ও হিল্ডয়ার্ড। তাদের মতে, যোগাযোগ ব্যবস্থার এই বিকাশ, বিশেষ করে মেগা করিডোর বা আন্তঃদেশীয় রাস্তা ও হাইওয়ের নির্মাণ মূলত ‘ফ্রি ট্রেড’ এবং ‘এক্সপোর্ট’ শিল্পের বিকাশকে মাথায় রেখেই করা হয়। যেমন, এ ধরনের মেগা যোগাযোগ অবকাঠামোগুলোর অন্যতম মূল ব্যবহার হলো:
‒ভারী শিল্পের জন্য কাঁচামাল পরিবহণ করা
‒শিল্প এলাকায় উৎপাদিত পণ্য বা ‘ফিনিশড গুড’ বন্দর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া
‒সমুদ্রবন্দর থেকে রাজধানী বা স্থানীয় মার্কেট পর্যন্ত বিদেশি পণ্য পরিবহণ
‒বন্দর থেকে বিদেশি কাঁচামাল শিল্প এলাকা পর্যন্ত নিয়ে আসা
‒বন্দর ও টার্মিনাল থেকে জ্বালানি তেল, ডিজেল বা কয়লা পরিবহণ করে বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিয়ে আসা
হিলয়ার্ড বলছেন: মোটাদাগে বন্দর, টার্মিনাল, রাস্তা, হাইওয়ে বা সেতুর মতো যোগাযোগ অবকাঠামোগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা হলেও এ ধরনের মেগা প্রকল্পগুলো সাধারণত ভারী শিল্প, কাঁচামাল পরিবহণ, জ্বালানি আমদানি ও পরিবহণ এবং রপ্তানি বাণিজ্য স্বার্থকে মাথায় রেখেই নির্মিত হয়। যে কারণে যোগাযোগ অবকাঠামোতে ব্যাপক বিনিয়োগের ব্যাপারে দেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী মহল বা ‘বিজনেস অ্যাসোসিয়েশন’গুলোর পক্ষ থেকে বরাবরই সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়।
কিন্তু রপ্তানি শিল্প কি দারিদ্র্য দূর করে?
যদি ধরেও নিই, রপ্তানি শিল্প ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিকাশকে মাথায় রেখেই যোগাযোগ অবকাঠামোতে বড় বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে: গত তিন দশকে রপ্তানি শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে বাংলাদেশের পোশাক খাতের শ্রমিক জনগোষ্ঠী দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে কি না। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রপ্তানি শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে লাখ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। কিন্তু পোশাকশ্রমিকের তিন দশকের জীবনমান, মজুরি, কর্মপরিবেশ, সঞ্চয় করার সক্ষমতা/অক্ষমতা এবং সাম্প্রতিক কালে ব্যাপক হারে অটোমেশনের প্রাদুর্ভাবে কিছু জরুরি প্রশ্ন বারবার উত্থাপিত হয়েছে:
* প্রচুরসংখ্যক কর্মসংস্থান তৈরি হলেও এ ধরনের কর্মসংস্থান দীর্ঘ মেয়াদে শ্রমিককে দারিদ্র্যের চক্র থেকে বের করে আনতে পারে কি না?
* তীব্র বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার মুখে এ ধরনের কর্মসংস্থান দীর্ঘস্থায়ী কি না?
* রপ্তানি শিল্পে ব্যাপক অটোমেশনের ফলে ক্রমাগত ছাঁটাইয়ের বাস্তবতায় বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকে কি না?
বিভিন্ন সময়ে এ-বিষয়ক একাধিক গবেষণা/প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি যে, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ বা ভিয়েতনামের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রপ্তানি শিল্পে প্রচুরসংখ্যক চাকরি তৈরি হলেও এর মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদে শ্রমিক জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য দূর হয়নি; বরং কয়েক দশকে শিল্পের মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে সম্পদের বৈষম্য তীব্র আকার ধারণ করেছে। অর্থাৎ, এই মডেলের মাধ্যমে স্বল্প মেয়াদে শ্রমিক পরিবারগুলোর জীবনে কিছু পরিবর্তন এলেও দীর্ঘ মেয়াদে দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয় না; বরং এই প্রক্রিয়ায় বৈষম্য বাড়তেই থাকে। একশ্রেণির মানুষের হাতে বিপুল পরিমাণ সম্পদ জমা হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত দারিদ্র্য বা ‘সস্তা’ শ্রমিকের পুনরুৎপাদন ঘটতে থাকে।
এ ধরনের মেগা প্রকল্পের সঙ্গে সস্তা শ্রমিকের পুনরুৎপাদনের সম্পর্কটি হিল্ডয়ার্ড ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে: ‘They are not aiming at improving the lives of the many, but rather to favour specific regions and geographic areas by ‘agglomerating’ cheap labour and capital’ (হিল্ডয়ার্ড, ২০১৬)। অর্থাৎ, মোটাদাগে মেগা যোগাযোগ প্রকল্পগুলোর মূল উদ্দেশ্য থাকে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন নয়, বরং সস্তা শ্রমিকের সুযোগ নিয়ে উন্নত দেশগুলোতে নিয়মিতভাবে সস্তা পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং বড় ব্র্যান্ডগুলোর মুনাফার সরবরাহ ঠিক রাখা।
মেগা হাইওয়ে বা মহাসড়ক কাদের জন্য?
প্রশ্ন ওঠে: মহাসড়ক কি শুধু ব্যবসায়ীদের জন্য নির্মিত হয়? মহাসড়কের সুফল কি সাধারণ মানুষ পায় না? এক্সপ্রেস হাইওয়ে, বৃহৎ সেতু বা ফ্লাইওভার কি সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে না? অবশ্যই করে। কিন্তু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, মেগা যোগাযোগ অবকাঠামোগুলো সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা দরিদ্রবান্ধব থাকছে না। যেমন:
এক. বুড়িগঙ্গা, কর্ণফুলী, রূপসা, পাকশী, মেঘনা-গোমতীসহ দেশের প্রায় অর্ধশত সেতুতে অতিরিক্ত টোল আদায়ের ফলে সাধারণ মানুষ এসব অবকাঠামোর অর্থনৈতিক সুবিধা বা সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অর্থাৎ, অতিরিক্ত টোল আদায়ের ফলে বড় সেতু বা হাইওয়েগুলো শেষ পর্যন্ত দরিদ্র জনসাধারণের ব্যবহারের উপযোগী থাকছে না।
দুই. সুলভে গণপরিবহণের ব্যবস্থা না-করেই বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমে মেট্রোরেল বা ফ্লাইওভারের মতো অতিরিক্ত খরচবহুল মেগা যোগাযোগ অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করার ফলে জনসাধারণের পরিবহণ ব্যয়ভার দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন, অতিরিক্ত মেট্রো ভাড়ার কারণে রাজধানীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পক্ষে নিয়মিত মেট্রোরেল ব্যবহার করা সম্ভব হবে কি না-এই প্রশ্ন উঠেছে।
তিন. ইজিবাইক এবং অটোরিকশা মহাসড়কে চলবে-কি-চলবে না, এ নিয়ে কয়েক বছর ধরে হাইকোর্টে একের পর এক রিট করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আইন করেই অটোরিকশা বা ইজিবাইকের মতো সুলভ বাহনগুলোকে হাইওয়ে বা মহাসড়কে চলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ এ রকম বহু এলাকা আছে, যেখানে কৃষিপণ্য পরিবহণ, রোগীকে হাসপাতালে নেওয়া বা মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার একমাত্র ভরসা ভ্যান অথবা ইজিবাইক এবং এই বাহনগুলোকে একপর্যায়ে মহাসড়কে উঠতেই হয়। গ্রামীণ সম্প্রদায় এবং জেলা শহরগুলোর বাড়ন্ত চাহিদা আমলে নিয়ে মহাসড়কগুলোর সঙ্গে সার্ভিস রোড সংযুক্ত করা তাই অপরিহার্য। মহাসড়কগুলো এমনিতেই চীন বা ভারতের চেয়ে দ্বিগুণ বা তিন গুণ খরচে তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ, দুর্নীতি বা কমিশন বাণিজ্যের কারণে খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে । অথচ প্রায় অর্ধলক্ষ অটোরিকশা ও ইজিবাইকচালক সুষ্ঠু সার্ভিস রোডের অভাবে হাইওয়ে ব্যবহার করার অনুমোদন পাচ্ছে না। অর্থাৎ, বিপুলসংখ্যক নিম্ন আয়ের মানুষের প্রতিদিনকার ব্যবহার করা পরিবহণটি বিপুল খরচে নির্মিত মহাসড়কগুলোতে নিষিদ্ধ।
মহাসড়কগুলো এমনিতেই চীন বা ভারতের চেয়ে দ্বিগুণ বা তিন গুণ খরচে তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ, দুর্নীতি বা কমিশন বাণিজ্যের কারণে খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে । অথচ প্রায় অর্ধলক্ষ অটোরিকশা ও ইজিবাইকচালক সুষ্ঠু সার্ভিস রোডের অভাবে হাইওয়ে ব্যবহার করার অনুমোদন পাচ্ছে না।
চার. যোগাযোগ অবকাঠামোর একটি বড় অংশই জ্বালানি পরিবহণের উদ্দেশ্যে নির্মিত হচ্ছে, যা জনসাধারণের ব্যবহার করার সুযোগ নেই। যেমন: বহুল খরচে নির্মিত সমুদ্রবন্দর, ফ্লোটিং টার্মিনাল, টার্মিনালের সঙ্গে সংযোগ সড়ক ইত্যাদি খরচবহুল প্রকল্প জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত নয়।
অর্থাৎ, সামগ্রিকভাবে দেখা যাচ্ছে, গণপরিবহণ ব্যবস্থায় বিনিয়োগ না করে মেগা যোগাযোগ অবকাঠামোগুলোতে অতিরিক্ত বিনিয়োগে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পরিবহণ খরচ বেড়েছে এবং বহুলাংশেই এই অবকাঠামোগুলো তাদের আয়ত্তের বাইরে থেকে যাচ্ছে।
মেগা প্রকল্প ও ফসিল ফুয়েল
মেগা প্রকল্পের একটি বড় অংশই বিদ্যুৎ উৎপাদন, মাইনিং, পরিবহণ এবং ভারী শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। মূলত কয়লা/এলএনজি পরিবহণ, কয়লা টার্মিনাল, এলএনজি টার্মিনাল, সংযোগ সড়ক, অয়েল পাইপলাইন বা জ্বালানি আমদানির বিভিন্ন অবকাঠামোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে তেল-গ্যাসের ব্যাবসা করা বহুজাতিক কোম্পানি, অর্থাৎ ফসিল ফুয়েলভিত্তিক কোম্পানি। এই প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে দুটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
এক. জলবায়ু, পরিবেশ, স্থানীয় কৃষি ও স্থানীয় কমিউনিটির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হওয়ার পরও এই প্রকল্পগুলোতে বিপুল বিনিয়োগ হচ্ছে।
দুই. দেশ-বিদেশের বৃহৎ করপোরেশন এবং তাদের দেশীয় এজেন্টরাই প্রক্রিয়াটিকে নিয়ন্ত্রণ করছে ও মুনাফা করছে। অর্থাৎ, ক্ষতিকর প্রকল্প হলেও এ প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক স্বার্থের বিষয়টি পরিষ্কার।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মেগা প্রকল্পের প্রস্তাবনার সময় বরাবরই সরকারের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে, বাণিজ্য যোগাযোগ বাড়বে, প্রচুরসংখ্যক কর্মসংস্থান তৈরি হবে এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ হবে-মোটাদাগে এসব যুক্তিই তুলে ধরা হয়। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে: এসব ফসিল ফুয়েলভিত্তিক মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে আসলেও কি টেকসই কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে বা দারিদ্র্য দূর হচ্ছে? নাকি আন্তর্জাতিক ব্যাবসায়িক গোষ্ঠীর বাণিজ্যিক স্বার্থই শুধু রক্ষিত হচ্ছে? এ প্রবন্ধের শুরুতেই আলাপ করা হয়েছে যে, ভারতে মেগা বাঁধ বা মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো দীর্ঘ সময় ধরে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য মহাবিপর্যয় তৈরি করেছে। রাজধানীকেন্দ্রিক উন্নয়ন, মধ্যবিত্তের কর্মসংস্থান ও নগরের বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে একের পর এক গ্রামীণ কৃষি সম্প্রদায়কে উচ্ছেদ করা হয়েছে এবং স্থানীয় কর্মসংস্থান নষ্ট করা হয়েছে। বাংলাদেশে পায়রা, রামপাল, বাঁশখালী বা মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, এসব এলাকার জনগোষ্ঠী কৃষিজমি, বাসস্থান ও কর্মসংস্থান হারিয়েছে, পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পায়নি এবং শেষ পর্যন্ত উচ্ছেদ হয়ে কে কোথায় গেছেন তার হিসাবও মেলেনি। সামগ্রিকভাবে দেখলে, যত বেশি মেগা প্রকল্প নির্মিত হচ্ছে, স্বল্প মেয়াদে কিছু মানহীন কর্মসংস্থান তৈরি হলেও দীর্ঘ মেয়াদে ক্রমাগত বৈষম্য উৎপাদনকারী একটি ‘উন্নয়নে’র চক্র শক্তপোক্ত হচ্ছে।
পরিশেষ
সাধারণত একটা দেশের পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর জীবনের মান উন্নয়নের জন্য অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করার কথা বলা হয়। যেমন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য রাস্তা, হাইওয়ে বা ব্রিজ দরকার। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন বিদ্যুৎকেন্দ্র। গ্যাস, তেল বা কয়লা আমদানি করতে প্রয়োজন টার্মিনাল। আবার মোটাদাগে যোগাযোগের অবকাঠামোগুলোকে বলা হয় গেম চেঞ্জার। কেননা, দুটি অঞ্চলকে সংযুক্ত করা একটি ‘হাইওয়ে’ বা সেতু ওই দুই অঞ্চলের মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিতে পারে। এতে উৎপাদকের সঙ্গে ভোক্তার যোগাযোগের দূরত্ব কমে এবং ব্যাবসা-বাণিজ্যের পথ প্রশস্ত হয়। স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের প্রকল্পগুলোর সঙ্গে উন্নয়নের বহুলচর্চিত ‘পপুলার’ সম্পর্কও রয়েছে। তাই আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এসব প্রকল্প উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্যই দরকার। বিশ্বব্যাংক বা এডিবির মতো আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলোও বরাবর দারিদ্র্য দূরীকরণের কথা বলেই মেগা প্রকল্পের পক্ষে আদর্শিক অবস্থান নিয়েছে।
কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি কি আসলেও দরিদ্রবান্ধব? গরিব মানুষের গরিবি দূর করার চিন্তা থেকেই কি মেগা প্রকল্পে বিনিয়োগের আগ্রহ? গরিব মানুষের অর্থনৈতিক বা সামাজিক মুক্তির ঠিক কতটুকু ব্রিজ, টানেল, মেট্রোরেল বা কয়লা প্রকল্পের ওপর নির্ভরশীল? বেশির ভাগ মেগা প্রকল্পের প্রাথমিক সমীক্ষার সময় যদি প্রকল্পের উপকারিতা ‘ওভারএস্টিমেট’ করে দেখানো না হতো এবং সেই সঙ্গে প্রকল্পের খরচ ‘আন্ডারএস্টিমেট’ করা না হতো, তাহলে বহু প্রকল্পের ক্ষেত্রেই ‘লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি’-এ বাস্তবতাই কি প্রকাশ পেত না?
মেগা প্রকল্প মাত্রই ক্ষতিকর-এই উপসংহার টানা এ আলোচনার উদ্দেশ্য নয়; বরং মেগা প্রকল্প কোথায় হবে, কেন হবে, পরিবেশ ও স্থানীয় কমিউনিটির ক্ষতি হবে কি না, দীর্ঘ মেয়াদে দারিদ্র্য দূর হবে কি না, টেকসই কর্মসংস্থান তৈরি হবে কি না, অতিরিক্ত খরচবহুল হলে এর বিকল্প আছে কি না, বিকল্প থাকলে কোন উদ্দেশ্যে বিকল্প সমাধানের পরিবর্তে খরচবহুল সমাধানকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে, প্রকল্পের ফলে দীর্ঘ মেয়াদে কার লাভ হচ্ছে, কার ক্ষতি হচ্ছে-এসব বহুবিধ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার উদ্দেশ্যেই এ আলোচনাটি করা হয়েছে।
মাহা মির্জা: লেখক, গবেষক। ইমেইল: maha.z.mirza@gmail.com
তথ্য সূত্র:
(এআইআইবি) AIIB (Asian Infrustructure Investment Bank). Asian Infrastructure Finance 2020. 2020. Link. https://www.aiib.org/en/news-events/asian-infrastructure-finance/2020/_common/pdf/AIIB_AIF2020_16April2020.pdf#page=26
(এডিবি) ADB (Asian Development Bank). ‘Closing the Financing Gap in Asian Infrstructure’. ADB South Asia Working Paper Series. No 57. June 2018. Link. https://www.adb.org/sites/default/files/publication/431261/swp-057-financing-gap-asian-infrastructure.pdf
(ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক) World Bank. ‘Maximizing Finance for Development’. 2018.
(ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক ও আইএমএফ) World Bank & IMF. ‘From Billions to Trillion: Transforming Development Finance’. Development Committee (Joint Ministerial Committee of the Boards of Governors of the Bank and the Fund on the Transfer of Real Resources to Developing Countries), 2015.
(ফ্লাইভবজার্গ) Flyvbjerg, Bent. What You Should Know About Megaprojects and Why: An Overview. Saïd Business School, Oxford University, Oxford, United Kingdom. 2014.
(ফ্লাইবভবজার্গ) Flyvbjerg, Bent. “Introduction: The Iron Law of Megaproject Management,” in Bent Flyvbjerg,ed., The Oxford Handbook of Megaproject Management (Oxford: Oxford University Press), 2017. pp. 1-18.
(ফ্লাইবভবজার্গ, হোম ও বুল) Flyvbjerg, Bent; Holm, Mette & Buhl, Søren. “Underestimating Costs in Public Works Projects: Error or Lie?” Journal of the American Planning Association, vol. 68, no. 3, Summer 2002, pp. 279-295.
(হিলয়ার্ড) Hillyard, Nicholas. Licensed larceny: Infrastructure, financial extraction and the global South (Manchester Capitalism). Manchester University Press. 2016.
(ঠাক্কার) Thakkar, Himangshu. Displacement and Development: Construction of the Sardar Dam. Link: Cultural Survival Quarterly Magazine September 1999. Link: https://www.culturalsurvival.org/publications/cultural-survival-quarterly/displacement-and-development-construction-sardar-dam
(রায়) Roy, Arundhati. The Greater Common Good. India book distributor limited. 1999.