ভারত: নব্য উদারবাদী প্রবৃদ্ধি ও নব্য ফ্যাসিবাদীকাল

ভারত: নব্য উদারবাদী প্রবৃদ্ধি ও নব্য ফ্যাসিবাদীকাল

প্রভাত পাটনায়েক

ভারতে নব্য উদারবাদী অর্থনীতি শুরুর দিকে জনসমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে সকলের জন্য সুখী-সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ তৈরির আশ্বাস দিলেও বর্তমানে আর সেরকম পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে না। বরং নব্য উদারবাদী নীতির বাস্তবায়নের ফলে এখন অর্থনৈতিক স্থবিরতা, বঞ্চনা, দুর্দশা আর অসমতার  চিত্রই অনেক বেশি দৃশ্যমান। তাই এখন পুরো ব্যাপারটির বৈধতা ও জনসমর্থন  ধরে রাখার রাজনৈতিক ভিত্তি হিসাবে নব্য-ফ্যাসিবাদের আর্বিভাব ঘটানো হয়েছে। এই প্রবন্ধের লেখক প্রভাত পাটনায়েক ভারতের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক। পড়াশোনা করছেন দিল্লীর সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০১০ সালে অবসর গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত তিনি জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইকোনোমিক স্টাডিজ এন্ড প্লানিং এ শিক্ষকতা করেছেন, এখন এমিরিটাস প্রফেসর হিসেবে যুক্ত আছেন। প্রভাত ২০০৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত কেরালা স্টেট প্ল্যানিং বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। ভারত সহ বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ লেখালেখি আছে। সর্বজনকথার জন্য তাঁর এই লেখা অনুবাদ করেছেন: জায়েদ বিন সাত্তার

নব্য উদারবাদী ধারার অর্থনীতিবিদদের প্রায়ই এরকম বলতে শোনা যায় যে, ১৯৯১ সালের পরে যে ধরনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে তার ফলে লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠে এসেছে তবে বর্তমান করোনা অতিমারির কারণে সেটি আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। কিন্তু যখন তাদের মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে এই অতিমারির আগেও তো দারিদ্র্য পরিস্থিতি তেমন একটা ভালো ছিল না, তখন তারা নরেন্দ্র মোদির ‘নোট বাতিল’ নীতি এবং ‘কর আইন’-এর (গুডস অ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্স-জিএসটি) দিকে আঙুল তোলা শুরু করেন। তাদের কথাবার্তা শুনলে মনে হবে মোদি আসার আগে নব্য উদারবাদী নীতিকাঠামো বেশ ঠিকঠাকভাবেই কাজ করছিল। তবে এ ধরনের আলাপের খুব একটা সত্যতা নেই। নরেন্দ্র মোদি এসেই অর্থনীতির সর্বনাশ করেছেন, ব্যাপারটা মোটেও এমন না। বলা যেতে পারে, মোদি এসে খারাপ পরিস্থিতিকেই আরও বেশি খারাপ  করে তুলেছেন। নব্য উদারবাদী নীতিকাঠামোর পুরো সময়কালে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে সত্য, একই সঙ্গে পুষ্টির মতো কিছু মৌলিক জায়গায় জনগণের আপেক্ষিক বঞ্চনার পরিমাণও বেড়েছে ।

নরেন্দ্র মোদি এসেই অর্থনীতির সর্বনাশ করেছেন, ব্যাপারটা মোটেও এমন না। বলা যেতে পারে, মোদি এসে খারাপ পরিস্থিতিকেই আরও বেশি খারাপ  করে তুলেছেন। নব্য উদারবাদী নীতিকাঠামোর পুরো সময়কালে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে সত্য, একই সঙ্গে পুষ্টির মতো কিছু মৌলিক জায়গায় জনগণের আপেক্ষিক বঞ্চনার পরিমাণও বেড়েছে ।

পুষ্টি গ্রহণের পরিমাণের দিক থেকে দারিদ্র্য হিসাবের ক্ষেত্রে ভারতের নগর অঞ্চলে ২১০০ কিলোক্যালরি আর গ্রামে ২২০০ কিলোক্যালরি পরিমাণকে খাদ্য-দারিদ্র্যের (Food Poverty) সীমা ধরা হয়। এ সীমা অনুসারে ১৯৯৩-৯৪ সালে ভারতের গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্যের হার ছিল ৫৮%, যেটি ২০১১-১২ সালে এসে হয়েছে ৬৮% (National Sample Survey-NSS অনুসারে)। শহরে এ হার ১৯৯৩-৯৪তে ছিল  ৫৭% আর ২০১১-১২তে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫%। তাই স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, নব্য উদারবাদী ধারার সময়কালে গরিব মানুষের যে কেবল সংখ্যাই বেড়েছে তা নয়, একই সঙ্গে এর শতকরা হারও বেড়েছে। এই ফলফলটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভোগব্যয়ও বৃদ্ধি পায়। বর্ধিত আয়ের পুরোটা না হলেও অন্তত একটা নির্দিষ্ট অংশ মানুষ ভোগে ব্যয় করে এবং সেটি মূলত অধিকতর পুষ্টিকর খাবারদাবার কেনার পেছনেই খরচ করে। সুতরাং নব্য উদারবাদী সময়কালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি বড়ো একটা জনগোষ্ঠীর যে দুর্দশাও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে, তা উপরের এই ফলাফল থেকে  খুব সহজেই অনুমান করা যায়।

 প্রকৃত ভোগব্যয় হ্রাস

২০১১-১২ সালের পরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। ২০১১-১২-এর পরের জাতীয় জরিপটি হয় ২০১৭-১৮ সালে। এই দুই জরিপের ফলাফল থেকে দেখা যায়, গ্রামীণ অঞ্চলে মাথাপিছু ভোগব্যয় গড়ে ৯ শতাংশের মতো হ্রাস পেয়েছে। এই ফলাফল এতটাই অপ্রত্যাশিত আর অবাক করার মতো ছিল যে সরকার জরিপের তথ্য-উপাত্ত পুরোপুরি গোপন করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় (তবে কিছু সংবাদপত্র মারফত ভোগব্যয় হ্রাসের তথ্যটি ফাঁস হয়ে যায়)। এই ঘটনার পরে যেসব প্রশ্ন ও পদ্ধতি অনুসরণ করে জরিপটি (NSS-National Sample Survey) করা হতো, সরকার সেটিও পালটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্তের ফলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো বৈজ্ঞানিক জরিপটির ধারাবাহিকতার পরিসমাপ্তি ঘটে।

২০১১-১২-এর পরের জাতীয় জরিপটি হয় ২০১৭-১৮ সালে। এই দুই জরিপের ফলাফল থেকে দেখা যায়, গ্রামীণ অঞ্চলে মাথাপিছু ভোগব্যয় গড়ে ৯ শতাংশের মতো হ্রাস পেয়েছে। এই ফলাফল এতটাই অপ্রত্যাশিত আর অবাক করার মতো ছিল যে সরকার জরিপের তথ্য-উপাত্ত পুরোপুরি গোপন করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়।

ব্রেটন উডস চুক্তির মাধ্যমে তৈরি হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন: ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ) তাদের আদর্শিক জায়গা থেকে লাখ লাখ লোকের দারিদ্র্য বিমোচন এবং এর মাধ্যমে সর্বত্র নব্য উদারবাদী ধারার প্রচার ও প্রসারের চেষ্টা জারি রাখছে। কিন্তু অন্যদিকে এই নব্য উদারবাদী কাঠামোতেই লাখ লাখ লোকজনের দুঃখ-দুর্দশাও যে বাড়ছে, সেটি আর সেভাবে সামনে আনছে না। নব্য উদারবাদী সময়কালে যেখানে প্রকৃত কৃষি উৎপাদন সামান্যই বেড়েছে, সেখানে কৃষির উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার ব্যয় উৎপাদনকৃত কৃষিপণ্যের দামের তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। খুব সাদা চোখে ব্যাপারগুলো সহজে ধরা পড়বে না। তবে আমরা যদি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের পেছনে ব্যয়ের সঙ্গে লোকজনের আয়ের তুলনা করি, তাহলে ব্যাপারটা বেশ পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে। নব্য উদারবাদী নীতিকাঠামো অনুসারে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে বেসরকারি খাতের হাতে ছেড়ে দেওয়া শুরু করার ফলে এসব সেবার মূল্য বেশ দ্রুত আকাশচুম্বী হয়ে গেছে। এদেশের মোট শ্রমশক্তির অর্ধেকই স্বল্প আয়ের ক্ষুদ্র কৃষক এবং কৃষি মজুর। তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও সেবার দাম বেড়ে গেলে তাদের জীবনযাত্রার ব্যয়ের উপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয় এবং সেই চাপ সামাল দিতে তারা বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নেয় বা নিজেদের বিভিন্ন ধরনের ভোগব্যয় কমাতে বাধ্য হয়। আর ভোগব্যয় কমাতে গিয়ে প্রথমেই তাদের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হয়।

তবে গরিবদের এসব ক্রমবর্ধমান দুঃখ-দুর্দশার পরিস্থিতিকে খারিজ করে এ অবস্থাকে মেনে নেওয়ার পক্ষেও শিক্ষিত সমাজের কিছু যুক্তি-তর্ক আছে। এসব আলোচনার বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি হিসাবে ধরা হয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে লুইসের দেওয়া ‘দ্বৈত অর্থনীতির’ তত্বকে (Dual Sector Model)। এই তত্ব অনুসারে অর্থনীতিতে যখন সনাতন (Traditional/কৃষি) ও আধুনিক (Modern/ শিল্প) খাতে বিভক্ত থাকে তখন অধিকতর আয়ের আশায় লোকজন সনাতন থেকে আধুনিক খাতের দিকে আসতে থাকবে (এখানে ধরে নেওয়া হয়েছে আধুনিক খাতের উৎপাদিকা শক্তি এবং মজুরি সনাতন খাত থেকে বেশি হবে)। তাই শিল্প খাত বড়ো হতে থাকলে সেদিকে শ্রমের প্রবাহ চলতে থাকবে এবং অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির দিকে অগ্রসর হতে থাকবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে লুইসের এ তত্ত্ব শিক্ষিত মহলে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে জায়গা করে নিতে পেরেছে, এমনকি বাম ঘরানার চিন্তার লোকজনের মধ্যেও । 

ক্ষুদ্র উৎপাদনী খাতকে উপেক্ষা

এই আলোচনায় রাজনৈতিক অর্থনীতির দিকটা অনুপস্থিত। রাজনৈতিক অর্থনীতির আলোচনাটা শুরু হয়েছিল মূলত কার্ল মার্ক্সের হাত ধরে এবং পরে রোজা লুক্সেমবার্গ এসে এই আলোচনাকে আরও শক্তিশালী করেন । তাদের মতে, পুঁজিবাদী নীতি কাঠামোতে উন্নয়ন ঘটলে অর্থনীতিতে যেসব ছোটো ছোটো উৎপাদনী খাত আছে সেগুলো ক্রমেই সংকুচিত হতে থাকে। তাই অর্থনীতিতে উৎপাদনের ধারাকে ‘সনাতন’ ও ‘আধুনিক’–এই দুই ভাগে না দেখে ‘পুঁজিবাদী খাত’  এবং ‘ক্ষুদ্র উৎপাদন খাত’ হিসাবে দেখতে হবে । যদিও  ‘ক্ষুদ্র উৎপাদন’ খাতের আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই খাতে কর্মসংস্থানও বাড়ে, তারপরও ‘পুঁজিবাদী খাত’ সবসময়ই অর্থনীতিতে ‘ক্ষুদ্র উৎপাদন খাতের’ অবদানকে অবমূল্যায়ন করে আসছে। তাই লুইস যেভাবে দেখেছেন যে সনাতন খাতে কোনোরকম প্রভাব ফেলা ছাড়াই ‘সনাতন’ খাত থেকে ‘আধুনিক’ খাতের দিকে শ্রমের প্রবাহ ঘটতে থাকবে, ব্যাপারটা ঠিক এমন নয়। সনাতন খাত সম্পর্কে লুইসের মডেলের পূর্বানুমান ছিল যে সনাতন খাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োজিত থাকে এবং সেখানে তাদের প্রান্তিক কর্মদক্ষতা কার্যত শূন্য, তাই সেখান থেকে শ্রমিক অপসারণ করলে উৎপাদনে কোনো পরিবর্তন আসবে না। কিন্তু পুঁজিবাদী খাতের সম্প্রসারণই ঘটে ক্ষুদ্র উৎপাদন খাতকে সংকুচিত করে (যেমন: অ্যামাজনের মতো বড়ো অনলাইন শপের প্রসার ঘটলে আপনার এলাকার মুদি দোকানের ব্যাবসা কমতে বাধ্য)। পুঁজিবাদী খাত এমন সব জমিতেই তার কারখানা এবং আবাসন প্রকল্প তৈরি / অন্যান্য কার্যক্রমের সম্প্রসারণ ঘটায়, যেগুলো আগে ক্ষুদ্র উৎপাদন খাতে নিয়োজিত ছিল। আবার পুঁজিবাদী খাতের পণ্য/সেবা উৎপাদনের  জন্য যে শ্রম ও কাঁচামাল দরকার হয়, সেটি সরবরাহের দাম ও শর্তও পুঁজিবাদী খাত থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়। এবং পুরো কাঠামোটা এমনভাবে কাজ করে যে পুঁজিবাদী খাতের চাপের কারণে রাষ্ট্রও আগে অন্যান্য  খাতে (বিশেষত: ক্ষুদ্র উৎপাদন খাতে) যেসব আর্থিক সহায়তা দিত সেটির পরিমাণও দিনদিন কমে সেই অর্থ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পুঁজিবাদের খাতের উন্নয়নেই ব্যয় হতে থাকে।

অর্থনীতিতে উৎপাদনের ধারাকে ‘সনাতন’ ও ‘আধুনিক’–এই দুই ভাগে না দেখে ‘পুঁজিবাদী খাত’  এবং ‘ক্ষুদ্র উৎপাদন খাত’ হিসাবে দেখতে হবে । যদিও  ‘ক্ষুদ্র উৎপাদন’ খাতের আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই খাতে কর্মসংস্থানও বাড়ে, তারপরও ‘পুঁজিবাদী খাত’ সবসময়ই অর্থনীতিতে ‘ক্ষুদ্র উৎপাদন খাতের’ অবদানকে অবমূল্যায়ন করে আসছে।

 আগে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে গিয়ে ক্ষুদ্র উৎপাদনকারীদের রক্ষায় রাষ্ট্রের কিছু হস্তক্ষেপের সুযোগ ছিল। কিন্তু নব্য উদারবাদী নীতি কাঠামোতে এ ধরনের প্রবণতা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। আগে অর্থকরী ফসলের (যেমন: চা, কফি, রাবার, মসলা প্রভৃতি) মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কিছু হস্তক্ষেপ থাকত, কিন্তু নব্য উদারবাদী কাঠামোতে এরকম কোনো ব্যবস্থা নেই। এর পরিবর্তে ‘সরকারি ক্রয়’ বলে নতুন একটি প্রক্রিয়া চালু হয়েছে (সরকার বাজারের অন্যান্য ক্রেতার মতো পণ্য ক্রয় করে জমা রাখে এবং পরে তা বাজারে উন্মুক্ত করে দেয় বা সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিতরণ করে)। তবে খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে আগের মতো সহায়তা প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত আছে।  কিন্তু মোদি সরকার আসার পরে নতুন কৃষি আইনের মাধ্যমে সেটিও বন্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে । এরই প্রতিবাদে দিল্লি ও এর আশেপাশের অঞ্চলের কৃষক ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ৯ মাসের বেশি সময় ধরে বেশ বড়োসড়ো একটা আন্দোলনও করেছিল । মোদির এই নীতির ফলে সেসময় কৃষিপণ্যের ব্যাপক দরপতন ঘটে।  এতে বহু কৃষক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা চাষাবাদের জন্য যে ঋণ  নিয়েছিল, সেগুলো শোধ করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে। অনেক কৃষক এ অবস্থা থেকে বাঁচতে আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়। এক হিসাবে দেখা যায়,  ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে ১৯৯৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত চার লাখের মতো কৃষক আত্মহত্যা করেছে। এখন কথা হচ্ছে, উন্নয়ন অর্থনীতির তত্ত্ব অনুসারে তো এসব কৃষক/কৃষি শ্রমিকদের শহরে এসে আধুনিক খাতে কাজ খোঁজা এবং এ খাতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঘটনা তো সেরকম ঘটল না।

জোর করে কৃষককে তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে সেখানে নানা ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, আদিবাসীদেরকে তাদের নিজেদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে সেখানে খনিজসম্পদ উত্তোলন ও অনুসন্ধান করা–এসবই পুঁজিবাদী খাতের ক্ষুদ্র উৎপাদন খাতকে গ্রাস করে নেওয়ার উদাহরণ। এ ধরনের প্রক্রিয়াকেই মার্ক্স পুঁজির প্রাথমিক পূঞ্জীভবন বলে আখ্যায়িত করেছেন। নব্য উদারবাদের বিকাশের ফলে পুঁজিবাদী উন্নয়ন প্রক্রিয়া অবাধে এর বিস্তার ঘটাতে পেরেছে এবং এর ফলসরূপ বহু শ্রমিককে তাদের আগের কাজ (সনাতন খাত/কৃষি খাতের) হারিয়ে বেকার হতে হয়েছে। ১৯৯১ ও ২০১১ সালে করা শুমারি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কৃষিকাজ করে এমন লোকের সংখ্যা প্রায় দেড়কোটি হ্রাস পেয়েছে; হয় তারা কৃষি মজুরে পরিণত হয়েছে অথবা তারা কাজের উদ্দেশ্যে (যদিও সে কাজের আদৌ কোনো অস্তিত্বই ছিল না) শহরে পাড়ি জমিয়েছে।

জোর করে কৃষককে তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে সেখানে নানা ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, আদিবাসীদেরকে তাদের নিজেদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে সেখানে খনিজসম্পদ উত্তোলন ও অনুসন্ধান করা–এসবই পুঁজিবাদী খাতের ক্ষুদ্র উৎপাদন খাতকে গ্রাস করে নেওয়ার উদাহরণ।

 ছদ্ম বেকারত্ব

এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের পণ্যসেবার তুলনামূলক অবাধ বাণিজ্যের ফলে উৎপাদন খাতে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারে শুরুতে যে ধীরগতি/প্রতিবন্ধকতা ছিল, সেটিও ধীরে ধীরে কমে আসছে। কারণ স্থানীয় উৎপাদনকারীরা যদি প্রযুক্তির ব্যবহার গ্রহণ না করে, তাহলে তারা নতুন পণ্যসেবার উৎপাদন সক্ষমতায় পিছিয়ে পড়বে এবং বাইরে থেকে আমদানির মাধ্যমে সেসব পণ্যদ্রব্যের চাহিদা মেটানো হবে। ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য এই প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের হারকে আরও ত্বরান্বিত করে তুলেছে। যেহেতু ভারতীয় ধনীরা অন্যান্য ধনী দেশের বড়ো বড়ো শহরের অধিবাসীদের মতো ভোগের সংস্কৃতি অনুসরণ করছে, তাই তাদের চাহিদা মেটাতে নিত্যনতুন পণ্য ও সেবার উদ্ভাবন ঘটাতে হচ্ছে। এর ফলে স্থানীয় অর্থনীতির উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রযুক্তিগত ও কাঠামোগত দুই ধরনেরই পরিবর্তন আসছে। নতুন ধরনের প্রযুক্তিগুলো উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শ্রমের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে আনার ফলে পণ্য ও সেবার প্রসারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়লেও কর্মসংস্থান সেভাবে বাড়ছে না।

অর্থনীতিতে ছদ্ম বেকারত্ব বলে একটি ধারণা আছে। এর মানে হচ্ছে কোনো লোক কোনো কাজে নিয়োজিত আছে; কিন্তু সেখানে তার ভূমিকা বা উৎপাদনশীলতা শূন্য। আরেকটু সহজভাবে বললে–কাজে নিয়োজিত লোকটিকে সরিয়ে নিলে উৎপাদনে কোনো হেরফের হবে না। তাই অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান কতটা বাড়ছে, এর প্রকৃত হিসাব বের করাটা একটু জটিল। অর্থনীতিতে যখন সরকারের হস্তক্ষেপ থাকত, সেসময়ের তুলনায় নব্য উদারবাদী সময়ে এসে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) দ্বিগুণ হলেও অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার আগের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এসেছে (আগে যেটি ছিল ২ শতাংশের মতো, এখন এসে সেটি ১ শতাংশ)। এমনকি এ সময়কালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হারের তুলনায় বেশি ছিল। তাহলে দেখা যাচ্ছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির পর নতুন করে শ্রমশক্তিতে ঢোকা লোকদের জন্যই পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না, সেখানে পুঁজিবাদী খাতের সম্প্রসারণের ফলে সনাতন/কৃষি খাতে নিয়োজিতরা পুঁজিবাদী খাতে আসতে চাইলে তাদের জায়গা হবে কীভাবে।

অর্থনীতিতে যখন সরকারের হস্তক্ষেপ থাকত, সেসময়ের তুলনায় নব্য উদারবাদী সময়ে এসে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) দ্বিগুণ হলেও অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার আগের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এসেছে (আগে যেটি ছিল ২ শতাংশের মতো, এখন এসে সেটি ১ শতাংশ)।

এরকম একটা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যে পুঁজিবাদী খাতের সম্প্রসারণের ফলে প্রাক-পুঁজিবাদী খাত ধ্বংস হয়ে গেলে সেখানকার শ্রমিকরা পুঁজিবাদী খাতে এসে শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে পারবে। কিন্তু এ ধরনের ধারণা পুরোপুরি ভুল। ইউরোপে যখন পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেছিল, তখন বেকারত্বের সমস্যা সেভাবে ঘনীভূত হয়নি। কারণ, প্রচুর লোক সেসময়  ইউরোপিয়ানদের তৈরি করা বিভিন্ন উপনিবেশে স্থানান্তরিত হয়েছিল। নেপোলিয়নিক যুদ্ধের শেষ থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত প্রায় ৫ কোটি ইউরোপিয়ান নিজেদের বাসভূমি থেকে উপনিবেশগুলোয় (অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি) পাড়ি জমিয়েছিল। ফলে পুঁজিবাদের বিকাশের দরুন ইউরোপের জনগণের মাঝে দরিদ্র্যতা, দুঃখ-দুর্দশা সেভাবে প্রকট হয়নি। কিন্তু এখনকার তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জনগণের জন্য এরকমভাবে স্থানান্তরিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই এসব দেশের ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের সম্প্রসারণের ফলে যে বেকারত্ব বা দুর্দশা সৃষ্টি হচ্ছে, সেটিও এড়ানোর উপায় নেই । তাই ইউরোপের অভিজ্ঞতাকে পৃথিবীর অন্যান্য অংশে পুঁজিবাদের বিকাশের জন্য সর্বজনীন অভিজ্ঞতা হিসাবে বিবেচনা করাটা ভুল হবে।

এরকম একটা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যে পুঁজিবাদী খাতের সম্প্রসারণের ফলে প্রাক-পুঁজিবাদী খাত ধ্বংস হয়ে গেলে সেখানকার শ্রমিকরা পুঁজিবাদী খাতে এসে শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে পারবে। কিন্তু এ ধরনের ধারণা পুরোপুরি ভুল। ইউরোপে যখন পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেছিল, তখন বেকারত্বের সমস্যা সেভাবে ঘনীভূত হয়নি। কারণ, প্রচুর লোক সেসময়  ইউরোপিয়ানদের তৈরি করা বিভিন্ন ` উপনিবেশে স্থানান্তরিত হয়েছিল। 

ক্রমবর্ধমান আর্থিক অসমতা

কাজের তুলনায় শ্রমশক্তির বর্ধিত হার থেকে এটাই দেখা যাচ্ছে যে শ্রমিকদের কোনো অংশেরই জীবনযাত্রার তেমন মানোন্নয়ন ঘটছে না। না যারা সনাতন খাতে কাজ করছে , না যারা সেখান থেকে পুঁজিবাদী খাতে এসে কাজ করছে বা খুঁজছে। এমনকি ট্রেড ইউনিয়নভুক্ত শ্রমিকদের অবস্থাও সুবিধাজনক নয়। বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার কারণে শ্রমিকদের দরকষাকষির জায়গাটাও ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে। এছাড়া প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা বৃদ্ধির কারণে শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা বেড়েছে। এতে পণ্যসেবার উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে চাহিদার উদ্বৃত্ত উৎপাদন হওয়াটা বেশ সাধারণ একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুঁজিবাদী কাঠামোয় এই উদ্বৃত্তের মালিকানা পুঁজিপতিদের হাতেই থাকে। ফলে নব্য উদারবাদী কাঠামোয় শ্রমিক এবং পুঁজিপতিদের মাঝে সম্পদ ও আয়বৈষম্য প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে।

সমাজের উচ্চ আয়ের প্রথম ১ শতাংশ জনগোষ্ঠীর কাছে জাতীয় আয়ের কতটা অংশ যাচ্ছে, সেটা দেখলেই এ ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যাবে। কিছুদিন আগেই থমাস পিকেটি এবং লুকাস চ্যাঞ্চেল এ বিষয়ে কিছু গবেষণা করেছিলেন। আয়করের তথ্য থেকে তারা কিছু হিসাবনিকাশ করেছিলেন। তারা দেখেছেন,  সমাজের সর্বোচ্চ আয়কারী প্রথম ১ শতাংশ মানুষ বর্তমান সময়ে এসে সবচেয়ে বেশি আয়কর প্রদান করেছে (তারা তাদের গবেষণায় সর্বশেষ ২০১৩-১৪ এবং ২০১৪-১৫ সালের হালনাগাদকৃত তথ্য ব্যবহার করেছিলেন)। বেশি আয়কর দেওয়ার মানে হচ্ছে ওই ১ শতাংশ জনগোষ্ঠীর আয় সমাজের অন্য যে কোনো অংশের চাইতে বেশি । অর্থাৎ জাতীয় আয়ের বৃহৎ অংশ এই ১ শতাংশ মানুষের কাছে যাচ্ছে। কিন্তু ১৯৮২ সালে জাতীয় আয়ের বৃহৎ অংশ যেত সমাজের উচ্চ আয়ের প্রথম ৬ শতাংশ মানুষের কাছে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ১৯৮২ সালের তুলনায় বর্তমান সময়ে এসে বেশি সম্পদ কম মানুষের হাতে পূঞ্জীভূত হচ্ছে।  সুতরাং যখন অর্থনীতির উপরে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ছিল, তখনকার তুলনায় নব্য উদারবাদী ধারায় (যখন অর্থনীতির উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ সীমিত করে অর্থনীতিকে বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে) আয় বৈষম্য বেড়েছে (১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে অর্থনীতিতে নব্য উদারবাদী ধারার সূচনা ঘটতে থাকে)

বিশ্বব্যাপীই বৈষম্য বৃদ্ধির এমন ঘটনা দেখা যাচ্ছে। এবং বিশ্ব অর্থনীতির সংকট ও স্থবিরতার সঙ্গেও এর যোগসূত্র আছে। গরিব জনগোষ্ঠী তাদের আয়ের বড়ো অংশই যেখানে ভোগে ব্যয় করে, সেখানে ধনীদের ভোগব্যয় তাদের আয়ের তুলনামূলক অংশ হিসাবে বেশ কম, অর্থাৎ তাদের আয়ের একটা বড়ো অংশই সঞ্চয় হিসাবে থেকে যায়। ফলে সমাজে যখন বৈষম্য বাড়তে থাকে এবং গরিবদের তুলনায় ধনীদের আয় বাড়তে থাকে, তখন অর্থনীতিতে মোট চাহিদার পরিমাণ হ্রাস পায় (যেহেতু ধনীদের আয়ের বড়ো অংশ ভোগব্যয়ে যাওয়ার পরিবর্তে সঞ্চয় হিসাবে জমা হয়)। ফলে সব মিলিয়ে অর্থনীতে চাহিদা কমার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানও কমতে থাকে। আবার পণ্য ও সেবার চাহিদা কমলে অর্থনীতিতে ধীরে ধীরে বিনিয়োগও কমতে থাকে এবং অর্থনীতিতে স্থবির পরিস্থিত তৈরি হয় (এখানে মনে হতে পারে যে সঞ্চয় তো পরে বিনিয়োগ হিসাবে অর্থনীতিতে আসবে; কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, বর্তমান সময়ে যেই বিনিয়োগের ফল আমরা দেখতে পাই, সেই বিনিয়োগটি  কিন্তু আগেই করা হয়েছিল। অর্থাৎ, সেটি বর্তমান সময়ে জমা হওয়া সঞ্চয় থেকে করা হয়নি )। সরকারি ব্যয় বাড়িয়ে  এ ধরনের স্থবিরতা /মন্দা কাটানো যায়;  কিন্তু এই ব্যয় বৃদ্ধি তখনই মন্দার বিরুদ্ধে কাজ করবে যদি সরকার ঘাটতি বাজেট দেয় বা ধনীদের উদ্বৃত্ত আয়ের উপরে করারোপ করার মাধ্যমে সরকারি ব্যয় বাড়ায়। কিন্তু নব্য উদারবাদী ধারা এ ধরনের নীতি সমর্থন করে না।

 আর্থিক পুঁজিপতিদের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া

নব্য উদারবাদী ধারায় মুক্ত বাণিজ্যের পাশাপাশি পুঁজির প্রবাহও অনেকটা মুক্ত । এখানে এমন একটা অর্থব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে, যেখানে জাতিরাষ্ট্র বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সস্পৃক্ত এবং এর ফলে রাষ্ট্রকে এই বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার কাছে নতজানু থাকতে হয়। এই ব্যবস্থার বাইরে কিছু করতে গেলেই রাষ্ট্রকে নানা ধরনের অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়। এই বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থা পুঁজিপতিদের উপর করারোপের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বৃদ্ধি কিংবা সরকারের ঘাটতি বাজেট দেওয়াকে সমর্থন করে না। কারণ, এগুলো করলে অর্থনীতির উপর পুঁজিপতি বিশেষত আর্থিক খাতের পুঁজিপতিদের যে নিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক বৈধতা সেটি কমে যাবে। রাষ্ট্রীয় ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে মন্দা মোকাবিলার বিপরীতে নব্য উদারবাদী  ধারার কৌশল হচ্ছে সম্পদের দাম (asset price) অস্বাভাবিক পর্যায়ে বাড়িয়ে দামের বুদ্বুদ (price bubble) তৈরি করা। এখানে সম্পদের দাম বাড়া-কমা তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে হয় না। বরং পারিপার্শ্বিক নানা ব্যাপার এবং ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে অনেকটা জুয়া খেলার সময় মানুষ যেভাবে সিদ্ধান্ত নেয় অনেকটা সেরকমভাবে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং এর মাধ্যমেই সম্পদের/ স্টকের দাম ওঠানামা করে। আর এই প্রক্রিয়াতেই ভোক্তার/ প্রতিষ্ঠানের সঞ্চয় বাজারে বিনিয়োগ হিসাবে আসবে বলে ধরে নেওয়া হয়।

যুক্তরাষ্ট্রে যখন সম্পদের দাম অস্বাভাবিক পর্যায়ে বৃদ্ধি পেয়ে হুট করে আবার একেবারে পড়ে গেল, তখন যুক্তরাষ্ট্র-সহ বিশ্বের অন্যান্য ধনী দেশের অর্থনীতি বেশ বড়ো অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। আর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় এ ধরনের ঘটনা না ঘটলেও বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত থাকার ফলে ওই বিপর্যয়ের প্রভাব তাদেরও ভোগ করতে হয়েছিল। ভারতের বর্তমান অর্থনৈতিক স্থবিরতার মাঝে এ ধরনের ঘটনার ছায়াই দেখা যাচ্ছে।

এরকম অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি যেহেতু কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুন মেনে হয় না (এবং হওয়াটা সম্ভবও নয়) তাই এর স্থায়িত্বও বেশিদিন থাকে না, দ্রুতই তা ধসে পড়ে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রে যখন সম্পদের দাম অস্বাভাবিক পর্যায়ে বৃদ্ধি পেয়ে হুট করে আবার একেবারে পড়ে গেল, তখন যুক্তরাষ্ট্র-সহ বিশ্বের অন্যান্য ধনী দেশের অর্থনীতি বেশ বড়ো অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। আর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় এ ধরনের ঘটনা না ঘটলেও বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত থাকার ফলে ওই বিপর্যয়ের প্রভাব তাদেরও ভোগ করতে হয়েছিল। ভারতের বর্তমান অর্থনৈতিক স্থবিরতার মাঝে এ ধরনের ঘটনার ছায়াই দেখা যাচ্ছে। নব্য উদারবাদী ধারার একনিষ্ঠ অনুসারী হিসাবে নরেন্দ্র মোদিও তার গৃহীত নীতিগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে একই পথে হাঁটছেন। কার্ল মার্ক্সের ভাষায় বলতে গেলে ভারতের শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী একই সঙ্গে নব্য উদারবাদী ধারার উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক স্থবিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। 

নব্য ফ্যাসিবাদের সঙ্গে সংযোগ

এ ধরনের সংকটের রাজনৈতিক দিকটাও বেশ লক্ষণীয়। এ ধরনের সংকটের সঙ্গে ফ্যাসিবাদের বিকাশের বেশ জোরালো সম্পর্ক আছে। ভারতে এমনকি বিশ্বজুড়েই নব্য উদারবাদী সংকট বাড়ার সঙ্গে  নব্য-ফ্যাসিবাদী চরিত্রের আর্বিভাবের একটা সংযোগ লক্ষ করা যাচ্ছে। কারণ, এ দুয়ের মাঝে একটা সহজাত যোগসূত্র আছে। নব্য উদারবাদী ধারার শুরুর দিকে এর পক্ষে জনসমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে সবার জন্য একটা মঙ্গলজনল/কল্যাণকর ভবিষ্যৎ তৈরির ব্যাপারে আশ্বাস ও আশাবাদের কথা শোনানো হয়েছিল। তাই লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করার যে আলাপ সেটিকেও আপাতদৃষ্টিতে বিশ্বাসযোগ্যই মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন যখন দেখা যাচ্ছে, নব্য উদারবাদী নীতি বাস্তবায়নের ফলে অর্থনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী স্থবিরতা তৈরি হয়েছে, তাই এখন এর পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য নতুন কোনো কৌশল দরকার। আর নব্য ফ্যাসিবাদের সঙ্গে নব্য উদারবাদী ধারার সম্পৃক্তায়নই সেই নতুন কৌশল হিসাবে কাজ করছে।

ভারতে এমনকি বিশ্বজুড়েই নব্য উদারবাদী সংকট বাড়ার সঙ্গে  নব্য-ফ্যাসিবাদী চরিত্রের আর্বিভাবের একটা সংযোগ লক্ষ করা যাচ্ছে। কারণ, এ দুয়ের মাঝে একটা সহজাত যোগসূত্র আছে।

বিশ্বের অন্যান্য অংশের মতো ভারতেও একধরনের হিন্দুত্ববাদী করপোরেট গোষ্ঠীর আর্বিভাব ঘটেছে। জাপানের জাইবাতসুর সঙ্গে এর তুলনা করা যায় (zaibatsu-জাপানের মেইজি শাসনকালে গড়ে ওঠা পরিবারকেন্দ্রিক শিল্পগোষ্ঠী, এরা ছিল মনোপলি (একচেটিয়া) ধরনের। জাপানের অর্থনীতি ও আর্থিক খাতের বড়ো অংশের নিয়ন্ত্রণ এদের হাতে ছিল )। সিদ্ধান্ত গ্রহণে একচেটিয়া প্রভাব ধরে রাখার মাধ্যমে নব্য উদারবাদী ধারাকে অটুট রাখার জন্য এজাতীয় করপোরেট গোষ্ঠী অর্থনীতিতে অন্য কোনো গোষ্ঠী যেন শক্তিশালী হয়ে নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকায় না যেতে পারে, সে ব্যাপারে সবসময় তৎপর থাকে। ১৯৩০ সালের অর্থনৈতিক সংকটের সময়ও এরকম করপোরেট ফ্যাসিবাদীরা রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছিল; কিন্তু তারা তখন জনগণকে বেকারত্ব এবং অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে কিছুটা মুক্তি দিয়েছিল। তখন অর্থনীতিকে চাঙা করা হয়েছিল ঘাটতি বাজেট দিয়ে সামরিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির মাধ্যমে। কিন্তু এখনকার এই নব্য ফ্যাসিবাদী শাসকরা এরকম কোনো কৌশলেও জনগণের দুঃখ-দুর্শশা কমিয়ে আনতে পারছে না। তাই এখন পারস্পরিক ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো এবং নিষ্পেষণমূলক আচরণই বর্তমান শাসনব্যবস্থার টিকে থাকার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। নব্য উদারবাদ ৩০ বছর ধরে শ্রমজীবী মানুষকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ও দুর্দশায় রাখার পর এখন তাদের অর্জিত মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে।

(লেখাটি “An Era Of Growth Sans Justice” শিরোনামে ভারতের Frontline পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১)

জায়েদ বিন সাত্তার: গবেষক, লেখক। ইমেইল: jayedsatter@gmail.com

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •