আফগানিস্তানে সংস্কার প্রচেষ্টা ও মার্কিন ভূমিকা

আফগানিস্তানে সংস্কার প্রচেষ্টা ও মার্কিন ভূমিকা

জন রায়ান

কানাডার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক অধ্যাপক জন রায়ান লিখেছেন:‘আফগানিস্তানে প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক একটি সরকার ক্ষমতায় আসার ছয় মাস পর, ১৯৭৮ সালের নভেম্বর মাসে আমার সেখানে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। পাকিস্তানে পেশোয়ার শহর থেকে খাইবার পাসের ভেতর দিয়ে কাবুলে যাই। সে সময় আমি শহর এবং শহরের আশেপাশের গ্রামগুলো ঘুরে ঘুরে দেখি। তখন উইনিপেগ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপক হিসেবে গবেষণা কাজের জন্য আমাকে ছুটি দেওয়া হয়েছিল। তারও আগে,কৃষিখামার সংক্রান্ত গবেষণা প্রকল্পের কেস স্টাডির জন্য এশিয়াতে ৭ মাস ছিলাম। ১২টি দেশের উপর ৭০টি কেস স্টাডির কাজটা শুরু হয়েছিল জাপান থেকে, আর শেষ হয় আফগানিস্তানের ৪টি খামার পরিদর্শনের মধ্য দিয়ে।’ সেই অভিজ্ঞতার পাশাপাশি লেখক যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান দখল পরবর্তী ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করেছেন। এখানে সেই লেখার একাংশ প্রকাশ করা হলো। অনুবাদ: মেহেদী হাসান

জনগণের বেশীরভাগ অংশের ব্যাপক সমর্থন নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আফগানিস্তানে একটি প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠিত থাকার ব্যাপারে পশ্চিমা বিশ্বের মূলধারার গণমাধমের নিরব ভূমিকা আমাকে রীতিমতো বিস্মিত করে দিয়েছে।

সে সময়ের সরকারটি বিভিন্ন ধরনের প্রগিতিশীল সংস্কারধর্মী কাজ এবং নারীদের সমান অধিকারের সুযোগ প্রতিষ্ঠা করে। যে কাজগুলো ছিল দেশকে ২০ শতকের দিকে এগিয়ে নেওয়ার কতগুলো সমন্বিত প্রক্রিয়া। মে ১৯৭৯, বৃটিশ রাজনীতি বিজ্ঞানী ফ্রেড হেলিডে মন্তব্য করেছিলেন যে, বিগত সেই বছরগুলোতে আফগানিস্তানের গ্রামাঞ্চলে যে (গুণগত) পরিবর্তন আনা হয়েছিল, রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দুই শতাব্দীতে সে ধরনের কোন কাজ হয়নি। প্রকৃতপক্ষে, এটি এখন এমন ধরনের সরকার হতে পারতো, যাকে আফগানিস্তান বা পশ্চিমের বেশীরভাগ মানুষ সম্ভবত স্বাগত জানাতে পারতো।কিন্তু কী পরিণতি হয়েছিল সে সরকারের?

সোভিয়েত ইউনিয়নের উপস্থিতির বহু আগে থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানা ধরনের (চক্রান্তমূলক) কর্মকাণ্ডের ফলে দেশটি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, সিআইএ, মুজাহেদিন সৃষ্টি করে, যাদের বহু ধরনের সর্বনাশা কর্মকাণ্ডের ফলে দেশটি ধ্বংসের পথে এগিয়ে যায়। তারই ধারাবাহিকতায়, মার্কিন মিলিটারি অক্টোবর ২০০১-এ আফগানিস্তান দখল করে এবং ২০ বছর থাকার পর গত কয়েক সপ্তাহ আগে সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করে। সুতরাং এ কথা নির্দ্ধিধায় বলা চলে যে, বিদ্যমান গণ্ডগোল এবং আফগানিস্তানের বর্তমান দুঃসহ অবস্থার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই প্রধানত দায়ী।

১৯৭৮ সালে আফগান সরকার বিপ্লবী উপায়ে ক্ষমতায় আসে। আশ্চর্যজনকভাবে, সে সময়টা ছিল খুব শান্তিপূর্ণ এবং সরকারি কর্তৃপক্ষ ও কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদ থেকে আমাকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন অনুষদের ডিন এবং আরো অনেক অধ্যাপক আমাকে আফগানিস্তানের ইতিহাস, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং বিপ্লবের কারণ সম্পর্কে অবহিত করেন।

এখনও আমার স্পষ্টভাবে মনে আছে সে দিনটার কথা। আমি যখন ডিনের অফিসে যাই তখন তিনি পরিপাটি অবস্থায় তার ডেস্কে বসে কাজ করছিলেন। আলাপের শুরুতে তাকে বললাম যে, এশিয়ায় কৃষি নিয়ে একটা গবেষণা প্রকল্পের জন্য মে’র শুরুতে যখন কানাডা ছাড়ি তার কিছুদিন আগে আমি আফগানিস্তানের বিপ্লবের কথা জানতে পারি। সে কারণে একটু দ্বিধায় ছিলাম যে, আমি আমার কাজটি করতে পারবো কি না! তিনি তখন তার চেয়ারটি একটু পেছনে ঠেলে দিয়ে ত্রুটিহীন ইংরেজিতে বললেন, ‘‘বিপ্লব…এপ্রিল ২৭ এবং ২৮, এই দেড় দিনের চূড়ান্ত ঘটনার কথা আপনি হয়তো জেনে থাকবেন। বেশীরভাগ সময় সেখানে আমি ছিলাম..প্রায় পুরোটাই আমি দেখেছি..এ ব্যাপারে আপনাকে অবশ্যই বলবো। তবে তার আগে একটু চা-এর ব্যবস্থা করি এবং আমাদের আলোচনায় অনুষদের অন্যান্য যারা যুক্ত হতে চান তাদেরকেও আহ্বান করি।’’

পরের এক ঘন্টার বেশী সময় ধরে সে সময় যা যা ঘটেছিল সেসব তিনি বিস্তারিত বললেন। ডিন এবং অধ্যাপকদের বর্ণনা অনুযায়ী, ১৯৭০ সালের দিকে বেশীরভাগ আফগানরা ছিলেন কৃষক। কিন্তু সামন্তীয় সময় থেকে ভূমির মালিকানা ব্যবস্থার কোনপ্রকার পরিবর্তন হয়নি। তারা বললেন যে, চারভাগের তিন ভাগ জমির মালিকানা ছিল ভূস্বামী এবং মোল্লাদের হাতে। তারা ছিল গ্রামীণ জনসংখ্যার শতকরা মাত্র ৩ ভাগ। একসময় যে জমি এবং বাড়ি ছিল খোদ কৃষকের; ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে না পারার কারণে কৃষকের সে জমি চলে যায় ভূস্বামী এবং মোল্লাদের হাতে।

কম উর্বর জমির ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ নিতো ভূস্বামী অথবা মোল্লারা এবং উর্বর জমির ক্ষেত্রে আদায় করতো পাঁচ ভাগের চার ভাগ ফসল। ফসলের যৎসামান্য যা কিছু অবশিষ্ট থাকতো তা দিয়ে কৃষক তার পরিবার নিয়ে কোনভাবে দিনযাপন করতেন। গ্রামীণ কৃষকের এই দুর্বিষহ অবস্থা ছিল অন্যান্য কারণের মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি, যার জন্য ১৯৭৩ সালে রাজাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা হয়। কিন্তু অবস্থার তাতে খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। নতুন সরকার ভূমি সংস্কারের কোন কাজে হাত দেয়নি এবং সে সরকার ছিল স্বৈরাচারী, দুর্নীতিপরায়ণ এবং অজনপ্রিয়।

এরপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৯৭৮ সালের ২৭ এপ্রিল। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের সামনে বিশাল জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। জনগণের সমর্থনে এগিয়ে আসে আর্মি। প্রেসিডেন্ট গার্ডের সাথে তাদের অল্প সময়ের জন্য প্রচণ্ড লড়াই হয় এবং সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। সামরিক বাহিনী কারাবন্দী বামপন্থী এবং মার্কসবাদী নেতাদের মুক্ত করে এবং নুর মোহাম্মদ তারাকি, যিনি ছিলেন একজন লেখক এবং কবি, তাঁর নেতৃত্বে পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ  আফগানিস্তান (PDPA)-কে সরকার গঠনে আহ্বান জানায়। সেনাবাহিনী এই দলটিকে সমর্থন দিয়েছিল কারণ, তারাই একমাত্র দল যারা ভূমি সংস্কার এবং প্রগতিশীল সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের কর্মসূচি দিয়েছিল।

ডিনের বক্তব্য অনুসারে, সরকার উৎখাতের পর নিকটস্থ জেলখানা থেকে বামপন্থী নেতাদের মুক্ত করে দেওয়া হয়। পরে সেনাবাহিনী তারাকিকে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের সামনের খোলা ময়দানে জনগণের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। খোলা ময়দানে একটি ট্যাংক রাখা ছিল। তারাকির সাথে কর্মকর্তাদের কথাবার্তার পর তারা তাকে ট্যাংক-এর উপর উঠতে সাহায্য করে। তারাকি চারপাশের জনগণের উপর একবার নজর বুলিয়ে নিলেন এবং বললেন, ‘‘ঠিক আছে…আপনাদের সহযোগিতায় আমরা সরকার গঠন করবো।’’ সিদ্ধান্ত শুনে উপস্থিত জনতা করতালি দিয়ে অভিবাদন জানায় এবং উল্লাসে ফেটে পড়ে।

এভাবে, বামপন্থী এবং সমাজতন্ত্রী সরকার ক্ষমতায় বসে — এটা একটা অন্যরকম ঘটনা — এমনকি এই ঘটনার জন্য সিআইএ রাশিয়াকে দায়ী করতে পারেনি। প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সেক্রেটারি অব স্টেট, সাইরাস ভ্যান্স, পরবর্তীতে স্মরণ করে লিখেছেন: ‘‘এই ক্যু এর পেছনে সোভিয়েতের জড়িত থাকার কোন প্রমাণ আমাদের কাছে ছিল না।’’ আসলে, সোভিয়েত ইউনিয়নও এই ধরনের পরিস্থিতির আকস্মিকতায় রীতিমতো অবাক হয়ে যায়। ক্ষমতা হাতে পাওয়ার পর নতুন এই সরকার খুব দ্রুত অত্যন্ত প্রয়োজনীয় নানা ধরনের সংস্কারমুখী কাজে হাত দেয়।

তারাকি সরকারের একগুচ্ছ কর্মসূচির প্রথমটি ছিল আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জোট নিরপেক্ষ অবস্থান ঘোষণা এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মধ্যেই ইসলামের প্রতি অঙ্গিকার নিশ্চিত করা। নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। এটি ছিল অন্যান্য সংস্কারের মধ্যে বহুল আকাঙ্ক্ষিত এবং প্রয়োজনীয়। মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং ছেলেদের সাথে একই শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের ব্যবস্থা করে। বাল্যবিবাহ এবং যৌতুক প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়। শ্রমিক ইউনিয়নগুলোকে আইনী অধিকার দেওয়া এবং বিভিন্ন জাতীয়তার মধ্যে সমতার নীতির কথা ঘোষণা করা হয়। কারাগার থেকে ১০,০০০ রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়, যেটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। খুব অল্প সময়ের মধ্যে গ্রামাঞ্চলে শত শত স্কুল এবং মেডিকেল ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করে সরকার।

মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং ছেলেদের সাথে একই শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের ব্যবস্থা করে। বাল্যবিবাহ এবং যৌতুক প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়। শ্রমিক ইউনিয়নগুলোকে আইনী অধিকার দেওয়া এবং বিভিন্ন জাতীয়তার মধ্যে সমতার নীতির কথা ঘোষণা করা হয়। কারাগার থেকে ১০,০০০ রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়, যেটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। খুব অল্প সময়ের মধ্যে গ্রামাঞ্চলে শত শত স্কুল এবং মেডিকেল ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করে সরকার।

সেপ্টেম্বর ১, ১৯৭৮ সালে বড় ধরনের সংস্কারের কাজে হাত দেয় সরকার। জমিদার এবং মহাজনরা কৃষকদের কাছ থেকে শতকরা ২৫ ভাগ হারে ঋণের সুদ আদায় করতো — কৃষকদের এই সমস্ত ঋণ মওকুফ করে দেওয়া হয়। তারই ধারাবাহিকতায়, কৃষক পরিবারগুলোর মাঝে (জমিদারসহ) সমপরিমাণ জমি বণ্টন করে দেওয়ার মতো বড় ধরনের সংস্কার কর্মসূচির পরিকল্পনা গ্রহণ করে সরকার।

তারাকি প্রশাসনের আংশিক ভূমি সংস্কার ছিল সামন্তীয় অঞ্চলগুলোর আফিম উৎপাদনের উপর বড় ধরনের আঘাত। পপি চাষের জমিতে বিকল্প শস্য উৎপাদনের জন্য ঋণ পাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি জাতিসংঘে যান। ঋণের আবেদন করলে জাতিসংঘ তা প্রদান করে।

তারাকি প্রশাসনের আংশিক ভূমি সংস্কার ছিল সামন্তীয় অঞ্চলগুলোর আফিম উৎপাদনের উপর বড় ধরনের আঘাত। পপি চাষের জমিতে বিকল্প শস্য উৎপাদনের জন্য ঋণ পাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি জাতিসংঘে যান। ঋণের আবেদন করলে জাতিসংঘ তা প্রদান করে।

কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কৃষি অধ্যাপকের সহায়তায় আমি আমার গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করি। এক সপ্তাহের বেশী সময় ধরে আমি গ্রামাঞ্চলে থাকি এবং বহু কৃষকের সাথে কথাবার্তা বলি। কৃষকরা তখন নানান ধরনের শস্য উৎপাদন এবং গবাদিপশুর লালন-পালন করতেন। খাদ্য উৎপাদনে আফগান কৃষকরা মূলত: নিজেরাই স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলেন। শস্যের মধ্যে কিসমিস ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানীশস্য।

সংস্কার কর্মসূচির ফলে যেহেতু কৃষকরা সবচাইতে উপকৃত হন, সে কারণে সরকারের প্রতি তারা ছিলেন খুব সন্তুষ্ট। ঋণ পরিশোধ করতে না পারার কারণে বহু কৃষক তাদের জমি কীভাবে খুইয়েছেন সে হৃদয়বিদারক কাহিনী আমি শুনেছি তাদের কাছ থেকে। ঋণের দায়ে দেশের প্রায় অর্ধেক কৃষকের জমি এবং বাড়ি ভূস্বামীর সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছিল। অধিকাংশ মানুষের এই ঋণ তাদের বাবা বা দাদার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এবং তাদের ধারণায়ও ছিলনা যে এই ঋণ পরবর্তীকালে তাদেরকে পরিশোধ করতে হবে।

তাদের মধ্যে বহুজন আমাকে বলেছিলেন যে, ঋণ মওকুফের এই আইন তাদের জন্য ছিল স্বর্গীয় আর্শিবাদস্বরূপ। তাদের মধ্যে একজনের কথা আমার পরিষ্কার মনে আছে। তিনি তার হাত দু’টোকে একসাথে আঁকড়ে ধরে অশ্রুসজল চোখে আমাকে বলেছিলেন, কীভাবে তিনি তার জমি এবং ঘর হারিয়েছিলেন।…পরে (তারাকি সরকারের সময়) তিনি সব আবার ফেরৎ পান।

এরপর কাবুলের দোকানদারদের সাথে আমার কথা হয়। দেখলাম, তারা সবাই খুব সন্তুষ্ট। তাদের মধ্যে একজন আমাকে বললেন যে, তিনি নিশ্চিত হতে পারছেন না, কী করে সরকারের এই নেতারা একইসাথে মার্কসবাদী, আবার মুসলিমও হতে পারেন। কেননা, তারা ধর্মীয় কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতেন না। কৃষকদের কাছে তখন নগদ অর্থ ছিল, ব্যবসা বাড়ছিল এবং তাদের কোন অভিযোগ ছিল না সরকারের প্রতি, আর এসবই ছিল তাদের সন্তুষ্টির বড় কারণ।

তাদের শান্তিময় জীবন আমি দেখেছি। (পরিদর্শনকালে)ঘটনাস্থলে অল্প ক’জন পুলিশ এবং সৈন্য আমার নজরে পড়েছে। নারীরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন। আমার কাছে রাস্তায় মানুষের চলাচলের একটি ছবি আছে। সে ছবিতে, রাস্তায় বোরকা পরা নারীর পাশাপাশি পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক পরা নারী, বিজনেস স্যুট পরা লোকের পাশাপাশি সাধারণ পোশাক পরিহিত মানুষ এবং প্রথাগত জোব্বা পরা ও আফগান পাগড়িধারী লোকজনকে অবাধ চলাচল করতে দেখা যায়। অসাধারণ বৈচিত্র্যপূর্ণ এই দৃশ্য সেখানে খুব সাধারণ একটা ব্যাপার ছিল।

কাবুলের রাস্তার দৃশ্য, নভেম্বর ১৯৭৮। মার্কসবাদী তারাকি সরকারের সময়, কোন প্রকার বিধিনিষেধ ছাড়াই সবাই তাদের ইচ্ছানুযায়ী পোশাক পরতে পারতেন। (ফটো: জন রায়ান)

নতুন সরকার বহু ধরনের বড় বড় সমস্যার সম্মুখীন হয়। ১৯৭০ সালে, গড় আয়ুসীমা ছিল ৩৫ বছর; প্রতি ৩ জনের ১ জন শিশু শৈশবকালেই মারা যেত। শিশুমৃত্যুর দিক দিয়ে এটি ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ। শতকরা নব্বই ভাগ ছিল নিরক্ষর। এইগুলো ছিল বড় ধরনের ইস্যু যেগুলো মোকাবেলা করতে সরকার বদ্ধ পরিকর ছিল।

এসব কাজ সত্যিকার অর্থে, প্রশ্নাতীতভাবে সরকারকে জনপ্রিয় করে তোলে এবং জনগণ উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিশা দেখতে পায়। অল্প সময়ের জন্য তারাকি সরকার সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রাপ্ত তহবিলের সাহায্যে রাস্তা-ঘাট,স্কুল, হাসপাতাল নির্মাণের জন্য সোভিয়েত ঠিকাদার এবং প্রকৌশলীদের আমন্ত্রণ জানান। সোভিয়েত ভূ-তত্ত্ববিদরা আফগানিস্তানের মাটির নীচে বিশাল পরিমাণের লিথিয়াম এবং খনিজের মজুদ আবিষ্কার করে। এই মূল্যবান খনিজ সম্পদ আহরণ করে সমগ্র জাতির স্বার্থে ব্যবহারে উদ্যোগী হয় সরকার।

প্রগতিশীল একজন চিকিৎসক, আনাহিতা রাতেবজাদকে তারাকি সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়।যখন প্রগতিশীল সেই সরকারকে উৎখাত করা হয় তখন থেকে আফগানিস্তানের ইতিহাসে রাতেবজাদের ভূমিকাকে মুছে ফেলার বহু চেষ্টা করা হয়। নিউ কাবুল টাইমসের জন্য লেখা সে সময় তাঁর বিখ্যাত একটি সম্পাদকীয়তে তিনি লিখেছিলেন:

‘‘নারীদের অবশ্যই (পুরুষের পাশাপাশি) শিক্ষার সমান সুযোগ, চাকুরীর নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য সুবিধা পাওয়ার অধিকার রয়েছে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে সুস্বাস্থ্যবান উপায়ে গড়ে তুলতে তাদের অবসর সময় প্রয়োজন, যাতে দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণকে এগিয়ে নিতে পারে..এজন্য নারীদের শিক্ষিত এবং সৃজনশীল করে গড়ে তোলা হলো এই সরকারের মূল মনোযোগের বিষয়।’’

তারাকি সরকারে নারীরা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন; এই ভূমিকা নজিরবিহীন। ১৯৮০ সালে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেক ছিলেন নারী। ডাক্তারদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ ছিলেন নারী। নারী শিক্ষক শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ এবং শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ নারী ছিলেন বেসামরিক কর্মচারী। হাজার হাজার নারী সশস্ত্র বাহিনীতে নাম লেখান এবং সংসদ সদস্যদের মধ্যে ৭ জন ছিলেন নারী। তরুণ-যুব নারী শিক্ষার্থীরা কাবুলের রাস্তায় উচ্ছ্লভাবে ঘুরে বেড়াতেন এবং তাদের নিজেদের পছন্দমতো কারো সাথে প্রেমময় সম্পর্কে আবদ্ধ হতে পারতেন। বহুজন স্বর্ণযুগের সে সময়টার কথা স্মরণ করে বলেছেন আমাকে

১৯৮০ সালে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেক ছিলেন নারী। ডাক্তারদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ ছিলেন নারী। নারী শিক্ষক শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ এবং শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ নারী ছিলেন বেসামরিক কর্মচারী। হাজার হাজার নারী সশস্ত্র বাহিনীতে নাম লেখান এবং সংসদ সদস্যদের মধ্যে ৭ জন ছিলেন নারী।

যারা বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়েছিলেন তাদের স্মৃতিতে আজও স্পষ্ট, মৌলিক পরিবর্তনের প্রাণবন্ত সে সময়টার কথা। সায়রা নুরানি, একজন নারী সার্জন, যিনি ২০০১ সালে আফগানিস্তান থেকে বিতাড়িত হন, সে সময়ের কথা স্মরণ করে বলেছেন:

‘‘প্রত্যেক নারীর হাই স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল। আমরা যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারতাম এবং মনমতো পোশাক পরতে পারতাম…চাইলেই আমরা ক্যাফে এবং শুক্রবারে সর্বশেষ ভারতীয় সিনেমাটা দেখতে যেতে পারতাম…এ সব পাওয়া থেকে আমরা বঞ্চিত হতে শুরু করলাম যখন থেকে মুজাহেদিনরা জেতা শুরু করলো…আর এই লোকগুলোকেই কিনা পশ্চিমা বিশ্ব সমর্থন দিয়ে গেল!’’

এটা স্বীকার করতে হবে যে, নারী অধিকার এবং নারী শিক্ষা অনেক ধরনের বিতর্কের জন্ম দেয়। মৌলবাদী মোল্লারা এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। এটা উল্লেখ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, ২ লক্ষ ৫০ হাজার মোল্লার মধ্যে অনেকেই ছিল ভূস্বামী এবং তারা বরাবরই ভূমি সংস্কারের তীব্র বিরোধিতা করে আসছিল।

মসজিদে মসজিদে তখন ধর্মীয় বয়ান দিতো মোল্লারা। তারা আফগান জনগণকে এই সরকারের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করতে আহ্বান জানাতো। তারা বলতো যে, একমাত্র আল্লাহ্ই তাদেরকে এই জমি উপহারস্বরূপ দিয়েছেন (দিতে পারেন) এবং তিনিই (আল্লাহ্) নারীদের সমান অধিকার কিংবা মেয়েদের স্কুলে দেওয়ার বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন (করতে পারেন)। কিন্তু, এসমস্ত আহ্বান সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের কাছে সংস্কার কার্যক্রম জনপ্রিয় হয়। হালে পানি না পেয়ে এই প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তিরা তথাকথিত ‘উদ্বাস্তু’ হিসেবে পাকিস্তানে পাড়ি জমায়। এই লোকগুলো ভূমি সংস্কারের বিরোধিতাই কেবল করেনি বরং অন্যসব সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সংস্কারেরও বিরোধিতা করেছিল।

কিন্তু…মোল্লাদের পেছনে আফগান সরকারবিরোধী যথেষ্ট শক্তিশালী একটি পক্ষ ছিল — মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যদিও ভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর কোন অধিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেই, তবু তারা নতুন সরকারটিকে মার্কসবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে এবং সরকার উৎখাতে নানা ধরনের পন্থা অবলম্বন করে। ৩ জুলাই, ১৯৭৯, আমেরিকার জনগণ এবং কংগ্রেসের অগোচরে, আফগানিস্তানের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ এবং প্রগতিশীল সরকারকে উৎখাতের জন্য প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ৫০০ মিলিয়ন ডলার খরচের ‘‘কভার্ট একশন’’’ কর্মসূচি অনুমোদন করে। সিআইএ যার গোপন নাম দেয়, ‘‘অপারেশন সাইক্লোন’’। এর পরপরই, পাকিস্তান এবং সৌদি আরবকে সঙ্গে নিয়ে সিআইএ মুজাহেদিন ও ‘‘ফ্রিডম ফাইটার’’ হিসেবে পরিচিত মুসলিম জঙ্গীদের সামরিক সাহায্য এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে।

৩ জুলাই, ১৯৭৯, আমেরিকার জনগণ এবং কংগ্রেসের অগোচরে, আফগানিস্তানের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ এবং প্রগতিশীল সরকারকে উৎখাতের জন্য প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ৫০০ মিলিয়ন ডলার খরচের ‘‘কভার্ট একশন’’’ কর্মসূচি অনুমোদন করে। সিআইএ যার গোপন নাম দেয়, ‘‘অপারেশন সাইক্লোন’’। এর পরপরই, পাকিস্তান এবং সৌদি আরবকে সঙ্গে নিয়ে সিআইএ মুজাহেদিন ও ‘‘ফ্রিডম ফাইটার’’ হিসেবে পরিচিত মুসলিম জঙ্গীদের সামরিক সাহায্য এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে।

মার্কিন অভিপ্রায় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দিতে সাংবাদিক জন পিলজার লিখেছেন যে,

১৯৭৯ সালের আগস্টে, কাবুলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস জানিয়েছিল যে, ‘আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য যে কোন ধরনের ভয়াবহ বিপর্যয় হতে পারে, তা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৃহত্তর স্বার্থে পিডিপিএ সরকারের মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে সে উদ্দেশ্য সফল করবে।’…এ ধরনের বিকৃত উদ্দেশ্য সবসময় ধামাচাপা দেওয়া যায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল যে, আফগান প্রগতিশীল  সরকার এবং আফগান নারীদের অধিকার জাহান্নামে যেতে পারে…(এজন্য) সমস্ত মুসলিম বিশ্ব থেকে লোকজন বাছাই করে নিয়োগ দেওয়া হয় মার্কিন গুপ্ত বাহিনীতে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা, সিআইএ এবং বৃটেনের এমআই ৬-এর মাধ্যমে পাকিস্তানের গোপন শিবিরগুলোতে এই গুপ্ত আর্মিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।’’

এছাড়াও, যে সমস্ত আফগান মোল্লা এবং ভূস্বামী মুসলিম উগ্র জঙ্গীদের সাথে মিলে পাকিস্তানে পাড়ি জমিয়েছিল, আফগান সরকারকে উৎখাতের জন্য তাদেরকে সিআইএ অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দেয়। পাকিস্তানে মিলিটারি প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র পাওয়ার পর সিআইএ নিয়োজিত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উগ্র মুসলিম জঙ্গীরা আফগানিস্তানের গ্রামগুলোতে হানা দিতে শুরু করে। সেখানে তারা ক্লিনিক এবং স্কুলগুলোকে পুড়িয়ে দেয় এবং যদি দেখতো যে কোন গ্রামে কোন শিক্ষক মেয়েদেরকে পড়াচ্ছেন তাহলে তারা প্রকাশ্যে সেই শিক্ষককে খুন করতো — জনগণের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য কখনও কখনও সন্তানদের সামনে সেই শিক্ষকের পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলতো।

পাকিস্তানে মিলিটারি প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র পাওয়ার পর সিআইএ নিয়োজিত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উগ্র মুসলিম জঙ্গীরা আফগানিস্তানের গ্রামগুলোতে হানা দিতে শুরু করে। সেখানে তারা ক্লিনিক এবং স্কুলগুলোকে পুড়িয়ে দেয় এবং যদি দেখতো যে কোন গ্রামে কোন শিক্ষক মেয়েদেরকে পড়াচ্ছেন তাহলে তারা প্রকাশ্যে সেই শিক্ষককে খুন করতো — জনগণের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য কখনও কখনও সন্তানদের সামনে সেই শিক্ষকের পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলতো।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবিপ্লবী কৌশলের সাথে আরেকটি নাম জড়িয়ে আছে। হাফিজুল্লাহ আমিন। ১৯৬০ সালে স্ট্যান্ডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যখন পড়তে যান তখন সেখানে সিআইএ তাকে রিক্রুট করে। পরবর্তীতে তাকে আফগানিস্তানে পাঠানো হয় এবং সেখানে তিনি নিজেকে কট্টর মার্কসবাদী হিসেবে দাবী করেন। তার মাধ্যমে সিআইএ তারাকি সরকারে প্রবেশ করে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এটি স্বীকৃত না কিন্তু এই এর পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। সিআইএ যেমনটি চেয়েছিল ঠিক সেভাবেই তিনি তার অফিসে কাজকর্ম চালাতেন। ক্ষমতার কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য তিনি খুব ধূর্ততার সাথে কাজ করেন। এভাবে প্রথমে তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং পরে প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৭৯ সালে সেপ্টেম্বরে তার নেতৃত্বে একটি ক্যু পরিচালিত হয় এবং ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ হাতে নেন। তারাকিকে খুন করা হয় এবং তারাকির বহু সহযোগী সমর্থককে খুন, জেল কিংবা দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়।

আমিন তখন মার্কসবাদী সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের বদনাম ছড়াতে থাকে। মুসলিম আলেমদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কঠোর আইন জারী করে যাতে তারাও আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারাকি সরকারের বহু ধরনের সংস্কারধর্মী কাজকে বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং হাজার হাজার মানুষকে জেলে বন্দী করে। উর্দ্ধতন আর্মি অফিসারদের পদচ্যুত করা হয়, কারাগারে পাঠায় কিংবা হত্যা করা হয়। এভাবে আফগান সেনাবাহিনীকে ভেতর থেকে দুর্বল করে ফেলে।

এই সময়টাতে, সিআইএ প্রশিক্ষিত সশস্ত্র মুজাহেদিন বাহিনী গ্রামাঞ্চলে হাজার হাজার আক্রমণ চালায়, বিশেষ করে ক্লিনিক ও স্কুলগুলোকে পুড়িয়ে দেয় এবং শিক্ষকদের হত্যা করে।

তিন মাসের মধ্যে, মুজাহেদিনদের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড এবং আমিনের গণবিরোধী নীতির যৌথ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে (পূর্ববর্তী) সমাজতান্ত্রিক প্রগতিশীল সরকার প্রায় নাই হয়ে যায়। এই সময়ের রেকর্ড ঘাঁটলে দেখা যায়, আমেরিকান চার্জ দ্যা এফেয়ার্স এবং অন্যন্য কর্মকর্তাদের সাথে আমিন বহুবার বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। মুজাহেদিনদের শীর্ষ নেতা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ায়ের সাথে গোপন বৈঠকের জন্য তিনি পাকিস্তানে দূতদেরও পাঠিয়েছিলেন। স্পষ্টতই, পুনরায় একটি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা ছিল তার। প্রাক্তন সরকারের যাবতীয় প্রগতিশীল উপাদানকে নিঃশেষ করে দেওয়া এবং মুজাহেদিন বাহিনীর যোগশাজসে ইসলামী মৌলবাদী রাষ্ট্র গঠন করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ও হেকমতিয়ারকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর উদ্দেশ্যে তিনি এই ছক আকেঁন।

কিন্তু, ১৯৭৯ সালে ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে, আমিনকে তারাকি’র সমর্থক আফগান সেনাবাহিনীর একটি রেজিমেন্ট কিংবা সোভিয়েত সৈন্যদের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত করে হত্যা করা হয়েছিল। ঘটনাটি আসলে কারা ঘটিয়েছিল সে সত্যটা খুঁজে বের করা মুশকিল। সোভিয়েত রাশিয়া বরাবরই এই দাবীকে নাকচ করে দিয়েছে। আসল ঘটনাটি হলো, আফগান সরকারের আমন্ত্রিত হয়ে যে সোভিয়েত সৈন্যরা এসেছিল তাদের মধ্যে কয়েকটি ট্রুপ ৮ ডিসেম্বর থেকে আফগানিস্তানে অবস্থান করছিল, যে কারণে তাদের দিকে সন্দেহের তীরটি ছোঁড়া হয়।

আমিনের উৎখাতের পর আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। বাবরাক কামাল প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত হন (চেকোশ্লোভাকিয়ায় নির্বাসিত ছিলেন)। প্রায় ১০,০০০ রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। যদি নিজের মতো করে আসতেন তাহলে তিনি হয়তো নায়কোচিত প্রশংসা পেতে পারতেন কিন্তু, ঘটনা পরম্পরায় সোভিয়েত বাহিনীর উপস্থিতির কারণে তার এই ক্ষমতারোহণের ব্যাপারে পুরোপুরি সন্দেহমুক্ত হওয়া যায়নি।

তারাকি’র হত্যার কিছুদিন আগে, আফগানিস্তানের বিদ্রোহমূলক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে সেনা সহযোগিতা পাওয়ার উদ্দেশ্যে তাকে (আমিনকে) মস্কো পাঠানো হয়। ১৯৭৮ সালের আফগান-সোভিয়েত চুক্তির শর্তের কারণে সোভিয়েত রাশিয়া সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে সৈন্য পাঠায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, উন্নত অস্ত্রধারী হাজার হাজার দখলদার মুজাহেদিনদের (যাদের বেশীরভাগেই ছিল ভাড়াটে সৈনিক) ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড বন্ধ করা।

সাধারণভাবে যেটি অজ্ঞাত থেকে যায় যে, সিআইএ-এর মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগান বিষয়ক তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড (তারাকি সরকার উৎখাতের) পরিচালনা করে আসছিল বছরখানেক ধরেই এবং তারই প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সোভিয়েত বাহিনীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।

আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠানো সোভিয়েত ইউনিয়নের দিক থেকে ছিল চরম একটা ভুল। যদি তারা আফগান সরকারি বাহিনীর কাছে কেবলমাত্র অস্ত্রশস্ত্র পাঠাতো তাহলে ‘‘বর্বররা দরজায় কড়া নাড়তে’’ পারতো না এবং দেশ হয়তো বেঁচে যেত। কারণ, সাধারণ আফগান জনগণ কখনোই মৌলবাদী ছিল না এবং বেশীরভাগ মানুষ সরকারের প্রগতিশীল কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল।

আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠানো সোভিয়েত ইউনিয়নের দিক থেকে ছিল চরম একটা ভুল। যদি তারা আফগান সরকারি বাহিনীর কাছে কেবলমাত্র অস্ত্রশস্ত্র পাঠাতো তাহলে ‘‘বর্বররা দরজায় কড়া নাড়তে’’ পারতো না এবং দেশ হয়তো বেঁচে যেত। কারণ, সাধারণ আফগান জনগণ কখনোই মৌলবাদী ছিল না এবং বেশীরভাগ মানুষ সরকারের প্রগতিশীল কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল।

আফগানিস্তানের মাটিতে সোভিয়েত সৈন্যদের আগমনের মধ্যে দিয়ে দু:খজনকভাবে দেশটির চূড়ান্ত ধ্বংসের মঞ্চ তৈরি হয়েছিলো। প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের ন্যাশনাল সিকিউরিটি এডভাইজার, জিবিগনিউ ব্রেজেজিনস্কি (Zbigniew Brzezinski) বড়াই করে বলেছিলেন যে, সোভিয়েতকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের স্বাদ পাওয়ানোর উদ্দেশ্যে, রাশিয়ান ভল্লুকদের জন্য ফাঁদ তৈরী করতে সিআইএ-এর অনুমোদনের ব্যাপারে তিনি জিমি কার্টারকে রাজী করিয়েছিলেন। ব্রেজেজিনস্কি প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম ধর্মান্ধদের কাজে লাগানোকে চমৎকার একটি সুযোগ হিসেবে দেখছিলেন। তিনি ধারণা করেছিলেন, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম ধর্মান্ধদের উদ্বুদ্ধ করা যাবে — ‘‘আফগান মাটি থেকে নাস্তিক কাফেরদের’’ বিরুদ্ধে জিহাদের (পবিত্র যুদ্ধ) ঘোষণা দেওয়ানো যাবে — এবং কেবলমাত্র সরকার উৎখাতই নয় বরং তাদেরকে দিয়ে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো ‘‘স্বাধীন’’ করা যাবে। পরবর্তী ১০ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরব বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে, হাজার হাজার অ-আফগান লোকজনকে রিক্রুট করে (ওসামা বিন লাদেনসহ), ধর্মান্ধ গোঁড়া মৌলবাদীদের দিয়ে আফগানিস্তানের মাটি ও মানুষকে কলুষিত করে।

প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের ন্যাশনাল সিকিউরিটি এডভাইজার, জিবিগনিউ ব্রেজেজিনস্কি (Zbigniew Brzezinski) বড়াই করে বলেছিলেন যে, সোভিয়েতকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের স্বাদ পাওয়ানোর উদ্দেশ্যে, রাশিয়ান ভল্লুকদের জন্য ফাঁদ তৈরী করতে সিআইএ-এর অনুমোদনের ব্যাপারে তিনি জিমি কার্টারকে রাজী করিয়েছিলেন।

মধ্য এশিয়া বিশেষজ্ঞ, আহমেদ রশিদ লিখেছেন:

‘‘সোভিয়েতবিরোধী মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সহায়তায় সিআইএ এবং পাকিস্তানের আইএসআই (ইন্টার-সার্ভিস ইনটেলিজেন্ট) মিলে চেয়েছিল আফগান জিহাদকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে। ১৯৮২-১৯৯২ সাল পর্যন্ত ৪০টি মুসলিম রাষ্ট্র থেকে প্রায় ৩৫,০০০ মুসলিম মৌলবাদীদের একত্রিত করে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়। (পবিত্র যুদ্ধের) শিক্ষা দিতে হাজার হাজার ছাত্রকে জড়ো করা হয় পাকিস্তানের মাদ্রাসাগুলোতে। অন্ততপক্ষে, ১ লক্ষ-এরও বেশী-বিদেশী মুসলিম উগ্রপন্থী আফগান জিহাদী কর্মকাণ্ডের ফলে সরাসরি প্রভাবিত হয়।’’

‘‘সোভিয়েতবিরোধী মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সহায়তায় সিআইএ এবং পাকিস্তানের আইএসআই (ইন্টার-সার্ভিস ইনটেলিজেন্ট) মিলে চেয়েছিল আফগান জিহাদকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে। ১৯৮২-১৯৯২ সাল পর্যন্ত ৪০টি মুসলিম রাষ্ট্র থেকে প্রায় ৩৫,০০০ মুসলিম মৌলবাদীদের একত্রিত করে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়। (পবিত্র যুদ্ধের) শিক্ষা দিতে হাজার হাজার ছাত্রকে জড়ো করা হয় পাকিস্তানের মাদ্রাসাগুলোতে। অন্ততপক্ষে, ১ লক্ষ-এরও বেশী-বিদেশী মুসলিম উগ্রপন্থী আফগান জিহাদী কর্মকাণ্ডের ফলে সরাসরি প্রভাবিত হয়।’’

এটা আমাদের জানা থাকা দরকার যে, গোঁড়া ধর্মান্ধতার ইতিহাস আফগানিস্তানের মানুষের নেই। সিআইএ-এর আকাঙ্ক্ষিত জিহাদের জন্য দরকার ছিল আরব, মিশরীয় এবং পাকিস্তানী জঙ্গীদের জড়ো করে নিয়োগ দেওয়া। সুতরাং বলা চলে, আফগানিস্তানের মৌলবাদীতার যে বাড়বাড়ন্ত দেখা যায়, তার জন্ম দিয়েছে সিআইএ। প্রথম দফায় ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনাকারী মুজাহেদিনদের ‘‘মুক্তিযোদ্ধা’’ হিসেবে যদিও স্বীকৃতি দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগ্যান।

গোঁড়া ধর্মান্ধতার ইতিহাস আফগানিস্তানের মানুষের নেই। সিআইএ-এর আকাঙ্ক্ষিত জিহাদের জন্য দরকার ছিল আরব, মিশরীয় এবং পাকিস্তানী জঙ্গীদের জড়ো করে নিয়োগ দেওয়া। সুতরাং বলা চলে, আফগানিস্তানের মৌলবাদীতার যে বাড়বাড়ন্ত দেখা যায়, তার জন্ম দিয়েছে সিআইএ।

ওয়াশিংটন পোস্ট (মে ১১, ১৯৭৯, পৃঃ ১২)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘‘মুজাহেদিনদের ‘খুব প্রিয় কৌশল’গুলোর মধ্যে একটি ছিল, তারা যে মানুষগুলোকে শিকার করতো (কখনও কখনও রুশদের ), প্রথমে তাদের নাক, কান এবং যৌনাঙ্গ কেটে দিতো। পরে তাদের শরীর থেকে পরতের পর পরত চামড়া স্লাইস করে কেটে নিতো যাতে তাদের ‘ধীরে এবং ভয়াবহ যন্ত্রণাদায়ক’’ মৃত্যু হয়। রুশ কয়েদীদের সাথে খাঁচায় বন্দী পশুদের মতো আচরণ করা হতো। ‘‘অবর্ণনীয় দুঃসহ যন্ত্রণাদগ্ধ জীবনের’’ কথা বর্ণনা করা হয়েছে সে প্রতিবেদনটিতে। অন্য আরেকটিপ্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘‘একটি গ্রুপকে (সোভিয়েত) মেরে ফেলার পর তাদের চামড়া ছিলে নিয়ে তাদেরকে একটি কসাইখানায় ঝুলিয়ে রাখা হয়’’।

এসব চিত্র দেখার পরও, রাষ্ট্রপতি রেগ্যান মুজাহেদিনদেরকে ‘‘মুক্তিযোদ্ধা’’ বলে ক্রমাগত সমর্থন দিয়ে গেছেন এবং ১৯৮৫ সালে তাদের একটি দলকে ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউজে দাওয়াত দিয়ে আপ্যায়ন করেছেন। পরে গণমাধ্যমের সামনে তাদের পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘এই ভদ্রমহোদয়েরা আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা জনকদের ন্যায় নৈতিক আদর্শ ধারণ করেন।’’

হোয়াইটহাউজে আফগান মুজাহেদিন কমান্ডারদের সাথে একান্ত আলাপে রোনাল্ড রেগ্যান। ১৯৮৫। (ফটো: রেগ্যান সংগ্রহশালা)

আফগানিস্তানে মুজাহেদিনদের অস্ত্র এবং অর্থ দিয়ে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়ার বিষয়টিতে আমেরিকার মানবিক মাহাত্ম্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে। এটা মূলত: সিআইএ, যারা মুজাহেদিনদের তৈরী করেছে,যাদের উদ্দেশ্য ছিল আফগান মার্কসবাদী সরকারকে উৎখাত এবং সোভিয়েত রাশিয়ার জন্য ফাঁদ তৈরী করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে আশা করেছিল সেভাবে ফাঁদে পা দিয়ে মুজাহেদিনদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সোভিয়েত তার আর্মি পাঠায়। ১০ বছরে সংঘাত চলাকালীন সময়ে, বিভিন্ন হিসাব অনুযায়ী পাঁচ থেকে দশ লাখ সাধারণ মানুষ এই সংঘাতে প্রাণ হারায়। তার মধ্যে প্রায় ৯০,০০০ মুজাহেদিন, ১৮,০০০ আফগান সরকারি সেনা এবং ১৪,৫০০ সোভিয়েত সেনা নিহত হয়।

এত বিপর্যয়, ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যার পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গী দেখে মনে হয়, সোভিয়েতকে পঙ্গু করার উদ্দেশ্যে এসব ‘‘প্রয়োজনীয় যোগান’’ ছিল। পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের পরামর্শদাতা ব্রেজেজিনস্কির সামনে যখন এ বিষয়গুলো তুলে ধরা হয় তখন তিনি ছিলেন নির্বিকার; অনুশোচনার রেশমাত্র ছিল না তার মধ্যে।

ভিয়েতনামের মতো অভিজ্ঞতা সোভিয়েতদের নড়িয়ে দেয় এবং ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তারা তাদের সেনা প্রত্যাহার করে কিন্তু যুদ্ধ তাতে থেমে থাকেনি। একরকম মনে করা হয়েছিল যে, আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সৈন্য চলে যাওয়া মাত্রই সমাজতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটবে, এই ধারণা সত্য হয়নি। মুজাহেদিনদের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের অভিজ্ঞতা লাভের পর আফগান জনগণের একটি বড় অংশ, বিশেষ করে নারীরা, মোহাম্মদ নজিবুল্লাহর সময়ে মধ্যপন্থী সরকারকে সমর্থন জানায়। সে সময়, যখন একজন  সোভিয়েত সৈন্যও ছিলনা তখনও এই জনগণ পরবর্তী তিন বছর তাদের যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। আসলে, তাদের সরকারই সোভিয়েতকে সরিয়ে দিয়েছে। পরে, ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে এই সরকারেরও পতন ঘটে।

নির্মম সত্য হলো এই যে, আমেরিকান বিশ্বাসঘাতকতাকে আফগান সরকার খুব খাটো করে দেখছিল। আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে রাজী হয় কারণ তারা ভেবে নিয়েছিল যে, সোভিয়েত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তারা উভয়েই আফগানিস্তানে সামরিক এবং অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়া থেকে বিরত থাকবে। পারস্পরিক চুক্তিকে সম্মান জানিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার কথামতো কাজ করে কিন্তু অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান এবং সৌদি আরব ক্রমান্বয়ে সে চুক্তি লঙ্ঘন করে এবং মুজাহেদিনদেরকে নানাভাবে সমর্থন দিয়ে যেতে থাকে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তিভঙ্গের বিষয়টি অনুধাবন করার পর সোভিয়েত ইউনিয়নের উচিৎ ছিল আফগান সরকারকে অর্থ ও সামরিক সহায়তা দিয়ে যাওয়া। এর ফলে তারা হয়তো মুজাহেদিনদের আক্রমণের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে দাঁড়াতে পারতো।১০ এটা না করার দরুণ যা হওয়ার তাই হলো। প্রতিনিয়ত মুজাহেদিনদের অত্যাধুনিক মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র যোগান দেওয়া এবং অর্থনৈতিক সাহায্যের কারণে, শেষ পর্যন্ত ১৯৯২ সালের এপ্রিল মাসে তারা মার্কসবাদী সরকারকে উৎখাত করতে সমর্থ হয়।

শুরুতে বিজয়ী মুজাহেদিনরা পূর্ববর্তী ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের সদস্য এবং হাজার হাজার প্রগতিশীল ধারার মানুষজনকে জবাই করার মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে। তার পরের চার বছর নিজেরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে কাটায়। মুজাহেদিনরা কমপক্ষে সাতটি উপদলে বিভক্ত হয়ে আফিমের ব্যবসা এবং অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিজেরা নিজেদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধকালীন এই সময়ে তারা ব্যাপকভাবে ধর্ষণ এবং লুটপাট চালায়। তারই এক পর্যায়ে মঞ্চে আবির্ভূত হয় সম্পূর্ণ নতুন পোশাকের অস্ত্রধারী তালেবানরা। ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাদের কাবুল দখলের মধ্য দিয়ে মুজাহেদিনদের অন্তর্কলহের আপাত পরিসমাপ্তি ঘটে।

১৯৯২ সালে মুজাহেদিনরা যখন কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয় তখন প্রগতিশীল ধারার শেষ রাষ্ট্রপতি, ড. নজিবুল্লাহ জাতিসংঘের প্রাঙ্গণে আশ্রয় নেন ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। সেপ্টেম্বর ২৭ তারিখে, তালিবানরা নজিবুল্লাহকে সে আশ্রয় থেকে বের করে নিয়ে আসে। তাকে খোজা করা হয় প্রথমে। তারপর একটা গাড়ির পেছনে তাকে ছুরি দিয়ে রক্তাক্ত করা হয় কাবুলের প্রকাশ্য রাস্তায়। শেষে গুলি করে তার লাশটি ঝুলিয়ে রাখে ট্রাফিক পোস্টে।

গৃহযুদ্ধের সময় অন্যান্য শহরের মতো কাবুল প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। মার্কসবাদী সরকারের পতনের পর গৃহযুদ্ধের সময়টাতে (উপদলীয় অন্তর্কলহের সময়) সবচাইতে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালিত হয়। মুজাহেদিনদের বিজয়ের পর ভূস্বামীরা আবার যার যার জায়গায় ফেরৎ চলে আসে।

তালিবানরা বিজয়ের পর রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। তারা পুরো দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে ইসলামী শরিয়া আইনের পতাকাতলে সবাইকে নিয়ে আসতে চায়। যুদ্ধবাজ নেতা এবং মুজাহেদিন শাসনামলের সমস্ত দুর্নীতি এবং নিরাপত্তাহীনতার পরিসমাপ্তি ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। এ প্রতিশ্রুতির কারণে, গ্রামাঞ্চলের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সময় যারা সবচাইতে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশেষ করে সেইসব গরীব মানুষদের কাছ থেকে সমর্থনও পেয়েছে।

তো, কারা এই তালেবান? কখনো কখনো বলা হয়ে থাকে যে, পাকিস্তানে ধর্মীয় পাঠশালাগুলো থেকে তাদের আবির্ভাব ঘটেছে। এজন্য তাদের পটভূমি বিস্তারিত জানা দরকার। মজার ব্যাপার হলো, এদের তৈরী করার পেছনেও রয়েছে সেই সিআইএ।

সিআইএ সৌদি আরব থেকে ওয়াহাবি মিশনারিদের পাকিস্তান যাওয়া এবং পরবর্তীতে আফগানিস্তানে সুন্নি ইসলামী মৌলবাদীদের ধর্মীয় পাঠশালা, মাদ্রাসা, স্থাপনের জন্য নিয়োগ দেয়। সিআইএ এবং তার এজেন্টরা তখন তরুণ আফগানদের সেই মাদ্রাসাগুলোতে যাওয়ার জন্য রিক্রুট করে যেখান থেকে মগজ ধোলাইয়ের পর তারা ধর্মীয় উন্মাদ হয়ে বের হয়ে আসতো। তালেবান শব্দের অর্থ হলো ‘‘ইসলামী পাঠশালায় পড়ুয়া ছাত্র’’। পাকিস্তান থেকে মাদ্রাসাগুলোকে আফগানিস্তানে স্থানান্তর করা হয় এবং ১৯৮০-র দশকে তাদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০,০০০। এই পাঠশালাগুলো ছিল সিআইএ-এর গুরুত্বপূর্ণ গোপন মগজ ধোলাইয়ের কারখানা। তাদের উদ্দেশ্য ছিল আফগান মার্কসবাদী সরকারের মধ্যে বিভাজন এবং বিরোধিতা উস্কে দেওয়ার জন্য তাদের তৈরি করা।

সিআইএ-এর গোপন চক্রান্তের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মূলত: আফগানিস্তানের ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। এ প্রক্রিয়া চালায়,

‘‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগান স্কুল শিক্ষার্থীদের সহিংস চিত্রসম্বলিত সব কিতাব এবং জঙ্গিবাদী ইসলামী শিক্ষায় ভরা পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করতে কয়েক মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে।…প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের বইগুলোতে জিহাদের গল্প এবং বন্দুক, বুলেট, সৈন্য ও স্থল মাইনের চিত্র দিয়ে বোঝাই থাকতো। তখন থেকেই এগুলো আফগান শিক্ষা ব্যবস্থার মূল পাঠ্যক্রম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এমনকি তালেবানরাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদিত বইগুলোকে ব্যবহার করতো…এই বইগুলো আফগানিস্তানের দুটি প্রভাবশালী ভাষা- দারি ও পশতুন এ লিখিত। ১৯৮০’র দশকের প্রথম দিকে অনুদানপ্রাপ্ত নেব্রাস্কা-ওমাহা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর আফগান স্টাডিস এই পাঠ্যবইগুলো তৈরী করে। সংস্থাটি (সিআইএ) ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত আফগানিস্তানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কর্মসূচিতে ৫.১ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করে।’’ (ওয়াশিংটন পোস্ট, ২৩ মার্চ ২০০২)।

যদিও তালিবানরা গৃহযুদ্ধের আপাত অবসান ঘটায় কিন্তু দুঃখজনকভাবে,নারীদের বিরুদ্ধে তাদের ভার্চুয়াল যুদ্ধ চলতে থাকে। তালিবানরা হলো ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এবং নারীদের সম্পর্কে তারা বিকৃত ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গী ধারণ করে যার কোন ভিত্তি ইসলামি আইনে নেই। হাজার হাজার নারীকে শিক্ষকতা, চিকিৎসা, অধ্যাপনা সহ সমস্ত ধরনের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। তাদেরকে এরপর আর কোন ধরনের কাজে যোগ দেয়ার অনুমোদন দেয়া হয়নি। এমনকি চিকিৎসকদের কাছ থেকে চিকিৎসা গ্রহণেও বাধা দেয়া হয় (পুরুষ আত্মীয়র অনুপস্থিতিতে। মেয়েদের স্কুলে যাওয়া নিষেধ করা হয়। যে কোন ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতা ছিল তাদের শাসনের ভিত্তি — এটি মুসলমান ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থায় পরিণত হয়েছিল। এবং, প্রথবস্থায় পাকিস্তান এই শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে।

হাজার হাজার নারীকে শিক্ষকতা, চিকিৎসা, অধ্যাপনা সহ সমস্ত ধরনের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। তাদেরকে এরপর আর কোন ধরনের কাজে যোগ দেয়ার অনুমোদন দেয়া হয়নি। এমনকি চিকিৎসকদের কাছ থেকে চিকিৎসা গ্রহণেও বাধা দেয়া হয় (পুরুষ আত্মীয়র অনুপস্থিতিতে। মেয়েদের স্কুলে যাওয়া নিষেধ করা হয়।

তালিবান শাসনামলের নৃশংসতা সত্ত্বেও ক্লিনটন প্রশাসন তাদের সমর্থন দিয়ে যায়। কারণ, তারা মনে করেছিল যে, তালিবানরা ‘‘স্থিতিশীলতা’’ আনতে পারবে এবং দেশটির মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক তেল এবং গ্যাসের পাইপলাইন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের) নির্মাণের কাজটি সহজ হবে। কেবল তাই নয়, বুশ প্রশাসন পরবর্তীতে ১২.৪ কোটি মার্কিন ডলার সাহায্য দেয় আফগানিস্তানে এবং সেপ্টেম্বর ১১-এর হামলার পূর্ব পর্যন্ত তাদের সাথে পাইপলাইন সংক্রান্ত কথাবার্তা চালিয়ে যায়।১১

এই সংকটের মধ্যে দিয়ে জন্ম হওয়া মুজাহেদিনরা নিজেদের জীবন নিজেরাই বেছে নিয়েছিল এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিলো। মার্কিন নেতৃত্বাধীন সরকার পরিবর্তন প্রকল্পের অন্যতম সোভিয়েতবিরোধী একজন প্রধান খেলোয়াড় ছিলেন সৌদি বংশোদ্ভূত কোটিপতি ওসামা বিন লাদেন। সৌদি আরবের একটি প্রভাবশালী ও ধনাঢ্য পরিবারে জন্ম নেওয়া লাদেনের সাথে গভীর সখ্যতা ছিল সৌদি রাজ পরিবারের। মুজাহেদিনদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য তাকে আফগানিস্তানে নিয়ে আসা হয় এবং ধারণা করা হয় যে, তিনি ছিলেন সিআইএ কর্তৃক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ১৯৮৯ সালে, যে বছর সোভিয়েত সেনাবাহিনীকে আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় সে বছরই ওসামা বিন লাদেনের আল কায়েদা’র জন্ম হয়। অদ্ভূত বিষয়, নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য যাকে গড়ে তোলা হলো সেই লাদেনকেই কিনা ২০০১ সালের সন্ত্রাসী আক্রমণের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত বলির পাঁঠা বানালো!

আফগানিস্তানের করুণ পরিস্থিতি থেকে আমাদের যদি কিছু শিক্ষা নেওয়ার থাকে তাহলে এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে, যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তারাকি সরকারকে একা পথ চলতে দিতো তাহলে মুজাহেদিনদের কোন সেনা তৈরীর প্রয়োজন হতো না, সোভিয়েতের কোন হস্তক্ষেপ থাকতো না, আফগানিস্তানকে ধ্বংসের জন্য কোন যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরী হতো না। কোন ওসামা বিন লাদেন থাকতো না এবং সম্ভবত মার্কিন মুল্লুকে সেপ্টেম্বর ১১-র মতো কোন করুণ কাহিনীও রচিত হতো না।

আফগানিস্তানের করুণ পরিস্থিতি থেকে আমাদের যদি কিছু শিক্ষা নেওয়ার থাকে তাহলে এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে, যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তারাকি সরকারকে একা পথ চলতে দিতো তাহলে মুজাহেদিনদের কোন সেনা তৈরীর প্রয়োজন হতো না, সোভিয়েতের কোন হস্তক্ষেপ থাকতো না, আফগানিস্তানকে ধ্বংসের জন্য কোন যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরী হতো না। কোন ওসামা বিন লাদেন থাকতো না এবং সম্ভবত মার্কিন মুল্লুকে সেপ্টেম্বর ১১-র মতো কোন করুণ কাহিনীও রচিত হতো না।

কিন্তু ১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১ সালের ঘটনার পর কী ঘটল? ৯/১১-এর হামলার প্রেক্ষিতে, যৌক্তিক প্রতিক্রিয়া কী হওয়ার দরকার ছিল? স্পষ্টতই, এটি একটি অপরাধমূলক কাজ কিন্তু এটি কোন বিদেশী সরকার পরিচালিত যুদ্ধমহড়া ছিল না। যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ওসামা বিন লাদেন কিংবা অন্য কারোর সম্পৃক্ততার কোনপ্রকার প্রমাণ থাকতো তাহলে তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সামনে হাজির করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ ছিল। তার পরিবর্তে, তালিবান সরকারের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাৎক্ষণিকভাবে দাবী করলো যে, ওসামা বিন লাদেনকে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে।

জবাবে তালিবান সরকার জানায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে নয় বরং আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের কাছে তাকে তুলে দিতে রাজী আছে যদি ৯/১১-এর সাথে তার সম্পৃক্ততার কোন প্রমাণ তারা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) দেখাতে পারে — কেবল তখনই।১২ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে দাবী নাকচ করে দেয়। এফবিআই-এর গোয়েন্দা প্রচার প্রধান, রেক্স টমব-এর সে সময়কার দেওয়া বিস্ময়জাগানিয়া বিবৃতি, ‘‘…৯/১১ ঘটনার সাথে বিন লাদেনের সম্পৃক্ততার কোন শক্ত প্রমাণ এফবিআই-এর কাছে নেই’’১৩ — স্পষ্ট করে, মার্কিন রাষ্ট্রের এ দাবীর পেছনে প্রকৃত রহস্য কী।

আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে যতসব কর্মকাণ্ড তাহলে কী ছিল? কয়েক বছর পার হওয়ার পরও যখন ৯/১১-এর সাথে বিন লাদেনের যুক্ততার কোন প্রমাণ হাজির করতে পারলো না, তখন একে কী বলা যায়? (প্রমাণ না থাকার বিষয়টি) বিস্ময়করভাবে উন্মোচিত হলেও মূলধারার গণমাধ্যমগুলো কিন্তু কখনই এই সংবাদটিকে গুরুত্ব সহকারে প্রচার করেনি।

৯/১১ ঘটনার জন্য দায় চাপিয়ে দেওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগের জবাবে সেপ্টেম্বর ১২, ১৬, ১৭ এবং ২৮ তারিখ পর্যন্ত বিন লাদেন বারবার বলেছেন যে, সেই আক্রমণের সাথে তার কোন প্রকার কোন সম্পৃক্ততা নেই। সেপ্টেম্বর ২৮ তারিখে, তিনি বলেছিলেন:

‘‘আমি ইতোমধ্যে বলেছি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১১ সেপ্টেম্বর হামলার সাথে আমি কোনভাবে জড়িত নই। মুসলিম হিসেবে মিথ্যাকে এড়িয়ে যেতে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। এই আক্রমণ সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না। এমনকি; নিষ্পাপ নারী, শিশু কিংবা অন্য যে কোন নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করা আমি কোন গর্বের কাজ বলে মনে করি না। নিষ্পাপ নারী, শিশু এবং অন্য মানুষকে অন্যায়ভাবে ক্ষতি করার ব্যাপারে ইসলামে পরিষ্কার নিষেধাজ্ঞা আছে। এমনকি যুদ্ধের সময়ও এই ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার কথা বলা আছে…আমরা মার্কিন সিস্টেমের বিরোধী, কিন্তু জনগণের বিরুদ্ধে নই, আর যেখানে এই ধরনের আক্রমণ করে আমেরিকার সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।’’

৯/১১-র সাথে বিন লাদেনের সম্পৃক্ততার কোন শক্তিশালী প্রমাণ এফবিআই পায়নি এবং এই অবস্থান থেকে অবশ্যই তাদের সরে আসার কোন উপায় নেই। কারণ, যেদিন মার্কিন মিলিটারি বিন লাদেনকে পাকিস্তানে হত্যা করে সেদিন অর্থাৎ মে ২, ২০১১ তারিখ পর্যন্ত এফবিআই-এর ওয়েবসাইটে এই তথ্যটা সাঁটানো ছিল। কিন্তু, এই এসব সত্ত্বেও, বিন লাদেনের মৃত্যু সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে যা বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে যাতে দেখা যায়, কিডনি বিকল হওয়ার কারণে কয়েক বছর আগেই (মার্কিন কর্তৃক হত্যাকাণ্ড ঘটানোর) আসলে বিন লাদেন মারা গেছেন। বিস্তারিত জানার জন্য দেখতে পারেন (এখানে, এখানে এবং এখানে)। যদিও এর বিশদ বিশ্লেষণ প্রয়োজন কিন্তু এই প্রবন্ধে সে সুযোগ নেই।

আফগানিস্তানের বিশাল সংখ্যক মানুষ, বিভিন্ন গ্রুপ ঐক্যবদ্ধভাবে বোমাবর্ষণ কিংবা দখল না করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আবেদন-নিবেদন করেছিল। সে সময় নোয়াম চমস্কি নিউ ইয়র্ক টাইমসে উল্লেখ করেছিলেন যে, সে ঐক্যবদ্ধতা ছিল, ‘‘বিভিন্ন জাতিসত্তার বয়স্ক মানুষ, ইসলামি চিন্তাবিদ, ছোট ছোট দলের রাজনীতিবিদ এবং প্রাক্তন গেরিলা কমান্ডারদের সমন্বয়ে একটি অভূতপূর্ব সম্মিলন’’।১৪ তারা সম্মিলিতভাবে, ‘‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলা বন্ধ করার জন্য দাবী জানিয়েছিলেন…এবং সাধারণ নিষ্পাপ মানুষের উপর বোমা হামলা বন্ধের আবেদন করেছিলেন’’ এবং তালিবানদের উৎখাত করার ভিন্ন উপায় অবলম্বন করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তারা অনুরোধ করেছিলেন।১৫

আফগানরা বলেছিলেন যে, যে তালিবানরা দেশকে শাসন করছে তারা খুব ছোট্ট এবং সংঘবদ্ধ একটি গোষ্ঠী। পাকিস্তান এবং সৌদি আরবের ধারাবাহিক সমর্থন ছাড়া তারা টিকে থাকতে পারবে না। যখনই তারা তাদের পেছনের সমর্থন হারাবে তখনই তাদের উৎখাত করা সহজ হয়ে যাবে। সুতরাং, যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সত্যিকার অর্থে তাদের শাসনক্ষমতার পরিবর্তন চায় তাহলে আফগান সাধারণ মানুষ সেই কাজে সহায়তা দিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সবার আগে যে কাজটি করতে হবে তা হলো, তালিবানদেরকে পাকিস্তান এবং সৌদি আরবের সমর্থন দেওয়া বন্ধ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হামলা চালানোর ফলে আফগানিস্তানে লক্ষাধিক নিরাপরাধ মানুষ নিহত হন। যাদেরকে এই যুদ্ধে হত্যা করা হয়েছে তারা নিউ ইয়র্কের আর দশটা নিরপরাধ সাধারণ মানুষের মতই মানুষ। পার্থক্যটা কেবল (নিউ ইয়র্কের সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টির বিপরীতে)…বিগত ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানের নিরাপরাধ এই মানুষগুলোকে নির্মমভাবে হত্যা করা অব্যাহত ছিল।

তাহলে, আমরা এখন কোথায় এসে পৌঁছলাম? এটা তো নিশ্চিত যে, উনিশ পেরোনো বাক্স কাটার ছুরি সজ্জিত সশস্ত্র গুণ্ডাদলের চাইতে ৯/১১-এর আক্রমণ ছিল আরও সংগঠিত শক্তিশালী এবং পেশাগতভাবে দক্ষ একটি সংগঠনের কাজ। তাই যদি হয় তাহলে, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কারা আক্রমণ করেছিল?

এটি অবাক হওয়ার মতোই ব্যাপার মনে হতে পারে যে, ২০ বছর পরেও, এখন পর্যন্ত জানা যায়নি, এই ঘটনার পেছনে কাদের হাত রয়েছে। প্রথমে সামনে এলো যে, জার্মানির হামবুর্গে বসে আল কায়েদার একটি গ্রুপ এটি সাজিয়েছিল। পরে দেখা গেল, আফগানিস্তানের সাথে এর কোন সম্পৃক্ততাই নেই। পরবর্তী বছরগুলোতে বহু স্বনামধন্য রিপোর্টে প্রমাণ দিয়ে দেখানো হলো যে, মোসাড এবং ইজরায়েল এই ঘটনা ঘটিয়েছে যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুসলিম দেশগুলোর উপর ভয়াবহ আক্রমণ চালাতে পারে। এ ধরনের প্রচার এখন পর্যন্ত চলমান। কিছুদিন আগে, সেপ্টেম্বর ১০ তারিখে একটি বিস্তৃত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় যেখানে বলা হয়েছে, ‘‘এই ঘটনা ঘটানোর পেছনে ইসরায়েল এবং মোসাডের যথেষ্ট শক্তিশালী উদ্দেশ্য, উপায় এবং সুযোগ আছে। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তীরটি শক্তিশালীভাবে ছোঁড়া হয়ে থাকে। কিন্তু, আমাদের নিজেদের মাটিতে আমেরিকার বিরুদ্ধে সর্বকালের সবচেয়ে বড় হামলা চালানোর বিষয়টি ইজরায়েল এবং তার দেশীয় সহযোগীদের জন্য সামাজিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।’’ এ বিষয়ে আরও প্রতিবেদন রয়েছে এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। এছাড়া আরও অন্যান্য প্রতিবেদন রয়েছে।

৯/১১ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপানো যুদ্ধ

৯/১১-র এক মাস পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে যুদ্ধ চাপিয়ে দিল। জাতিসংঘের অনুমোদন ছাড়া তারা এই বেআইনী যুদ্ধ আরম্ভ করে। কিন্তু মূলধারার সংবাদপত্রগুলো এ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেনি ফলে বেশীরভাগ মানুষের কাছে বিষয়টি অজানা থেকে যায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বোমা হামলা শুরু করে অক্টোবর ৭-এ। তাদের দ্বারা পরিচালিত নৃশংসতার যে ছবি প্রকাশিত হয়েছিল সেগুলো ছিল বীভৎস। আফগান সাধারণ মানুষকে আমলে না নিয়ে নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে ইউরোপের বহু মানুষ হতবাক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শরৎকালের সে সময়টাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মাঝে প্রতিশোধ স্পৃহা এবং দেশপ্রেমের সংমিশ্রিত বোধের কারণে ভিন্ন কণ্ঠস্বর বহুলাংশেই চাপা পড়ে গিয়েছিল।

প্রথমে বোমারু বিমান দিয়ে আক্রমণ চালানো হয় এবং পরে মার্কিন সৈন্যরা প্রবেশ করে দেশের অভ্যন্তরে। তালিবানরা বুঝে নিয়েছিল যে, তাদের প্রতিরোধ করা দুঃসাধ্য। তাই তারা কাবুল পরিত্যাগ করে গ্রামের দিকে চলে যায়। যা হোক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ হামলায় উত্তরাঞ্চলীয় জোটের সমর্থন ছিল, যে জোটটি দেশের উত্তরাঞ্চলের যুদ্ধবাজ নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল।

প্রথমাবস্থায় খুব একটা যুদ্ধ চালাতে হয়নি। তালিবান নেতা এবং তাদের সমর্থকরা যার যার গ্রামের বাড়িতে চলে যায় অথবা পাকিস্তানে নির্বাসিত হয়।

দুই বছরের মধ্যে আমেরিকান দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে শক্ত কোন প্রতিরোধ তৈরী হয়নি। কোথাও না — কী গ্রামে, কী শহরে। এর অন্যতম একটা কারণ হলো, বেশীরভাগ সাধারণ মানুষ ধারণা করেছিলেন যে, মার্কিন দখলদারিত্বের ফলে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে, ভয়াবহ দারিদ্রাবস্থার অবসান ঘটবে এবং অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটবে। তালিবানদের মূল কেন্দ্র, দক্ষিণের সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই ধারণা ছিল।

শান্তি প্রতিষ্ঠা খুব প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল সাধারণ আফগানদের জন্য। ২০০১ সাল অবধি, বিগত তেইশ বছর ধরে আফগানিস্তান নানা ধরনের যুদ্ধের ফাঁদে আটকা পড়ে ছিল। ২০০১ সালের দিকে, এমনকি তালিবান সমর্থকরাও ভাবতে শুরু করেছিল যে, একটা ভাল যুদ্ধের চাইতে একটা খারাপ ধরনের শান্তিও অনেক ভাল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যুদ্ধ শেষ করার সম্ভাব্য ভাল কিছু উপায় ছিল। কিন্তু শান্তিপূর্ণ সে পথে রাষ্ট্রটি যায়নি। মার্কিন কর্মকর্তারা মানুষের (শান্তির) আকাঙ্ক্ষাকে ভুল পথে পরিচালিত করেছে। তারা সাধারণ মানুষকে ধারণা দিতে চেষ্টা করতো যে, অবশিষ্ট ‘‘খারাপ লোক’’গুলোর মূলোৎপাটনের জন্য তাদের মিশন জারী রাখা দরকার। এজন্য তারা রাতের অন্ধকারে সাধারণ মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হানা দিতো। ঘরের মানুষগুলোকে অপদস্থ করতো। (নানা উপায়ে) আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষক সরকারের কেউ কোন বিরোধিতা করছে কি না, এ তথ্য বের করার জন্য পুরুষদের ধরে নিয়ে ভয়াবহ নির্যাতন চালাতো। সামান্য কোন অভিযোগও যদি কোথাও থেকে পাওয়া যেতো তাহলে বোমারু বিমানের আক্রমণ শুরু হয়ে যেতো। বোমার আঘাতে পরিবারের পর পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে দক্ষিণ এবং পূর্বাঞ্চলে (তালিবানদের সম্ভাব্য অবস্থান) তাদের সরে আসতে হয়েছে।

আফগানিস্তানে বছরের পর বছর এই ভয়াবহ নির্যাতন এবং হত্যাকাণ্ডের জন্য তাদেরকে কোথাও কোন জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হয়নি। ২০১৫ এবং ২০২০ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে ১৩,০০০ ড্রোন হামলা চালিয়েছে। প্রায় ১০,০০০ মানুষকে খুন করেছে। কোন একটা সাধারণ মোবাইল নম্বর থেকে আসা তথ্যের উপর ভিত্তি করে সিআইএ ভুল মানুষ অথবা সাধারণ মানুষের ছোট কোন জটলাকে লক্ষ্য করে করে মিসাইল ছুঁড়ে তাদের হত্যা করেছে।

(তাদের) এই কাজের ফলে আফগান গ্রামগুলো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। তারপরেও, ড্রোন হামলার ফলে সাধারণ মানুষের হতাহতের বিষয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোচরে আনতে অস্বীকার করেছিল। সব দিক বিচার করলে, মার্কিন দখলদারিত্ব যেমন অসহনীয় তেমনি দুর্নীতিতে ভরপুর ছিল। যার ফলে, বেশীরভাগ আফগান মানুষের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘৃণার পাত্র হিসেবে পরিণত হয় এবং এমতবস্থায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেখান থেকে বিদায় নেওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছিল।

আফিম বাণিজ্য পুনরায় শুরু হলে সিআইএ এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়ায়। সাংবাদিক ফিনিয়ান কানিংহাম যেমনটি বলেছেন, ‘‘মাদক ব্যবসার বড় একটা সুবিধা হলো যে এই হিসাবের কোন নথিপত্র রাখা লাগে না, তাই কংগ্রেসনাল তদারকির কোন বালাই নেই। কোনপ্রকার হিসাবপত্র রাখা ছাড়াই ‘‘বেআইনী’’ উৎস থেকে প্রাপ্ত আয় তাই মার্কিন সংস্থাগুলো গোপন অপারেশনে ব্যয় করতে পারে।’’

এর সাথে রাশিয়ান প্রেসিডেন্টের আফগানিস্তান বিষয়ক রাষ্ট্রদূত জামির কাবুলভের ভাষ্যটি উল্লেখ করা দরকার। তিনি বলেছেন যে, দেশটিতে (আফগানিস্তানে) সিআইএ-র মাদক পাচারের সাথে জড়িত থাকার বিষয়টি এখন ‘‘ওপেন সিক্রেট’’। ‘‘মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা মাদক পাচারের সাথে জড়িত। কোনপ্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই তাদের বিমান কান্দাহার, বাগ্রাম (কাবুলের নিকটবর্তী বিমানবন্দর) থেকে ছেড়ে জার্মানি, রোমানিয়া — যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারে — কোন প্রকার পরিদর্শন ব্যতিরেকেই।’’

সোভিয়েত সেনা আফগানিস্তানে থাকাকালীন সময়ে, সিআইএ এবং মুজাহেদিন উভয়ই মাদক বাণিজ্যের সাথে জড়িত ছিল। সারা বছর ধরে সিআইএ ৩২০ কোটি মার্কিন ডলার খরচ করেছে যুদ্ধের পেছনে যার একটি অংশ আসতো এই মাদক ব্যবসা থেকে।

আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততার মধ্যে অনেকগুলো দিক আছে যেগুলো খুঁজে বের করা খুব মুশকিল। আফগানিস্তানে আমেরিকার ঘোষিত কৌশলের উদ্দেশ্য অনেকের কাছে সুসঙ্গত কিংবা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি, এমনকি সরকারি উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছেও না। ‘‘৯/১১-এর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’’ নিয়ে প্রাথমিক যৌক্তিকতা এখন কেমন যেন গতানুগতিই শোনাচ্ছে।

২০ বছরের সময়কালে, ৭৭৫,০০০ মার্কিন সৈন্য আফগানিস্তানে নিয়োজিত ছিল। প্রতিবেদনে প্রকাশ, তাদের মধ্যে ২,৪৪২ জন সেনা নিহত এবং ২০,৬৬৬ জন আহত । এছাড়াও, ১,১৪৪ ন্যাটো সেনা নিহত হয়েছিল। আফগান মিলিটারি এবং পুলিশ নিহত হয়েছিল প্রায় ৭০,০০০ জন। রিপোর্টে আরও বলা হয় যে, প্রায় ৫০,০০০ তালিবান যোদ্ধা নিহত হয়। সবমিলিয়ে ২০০১ থেকে আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের যুদ্ধ বিঘ্নিত অঞ্চলগুলোতে প্রায় ২৪০,০০০ জন নিহত হয়। বাদবাকী নিহতদের অধিকাংশই ছিল বেসামরিক সাধারণ মানুষ।

২০ বছরের সময়কালে, ৭৭৫,০০০ মার্কিন সৈন্য আফগানিস্তানে নিয়োজিত ছিল। প্রতিবেদনে প্রকাশ, তাদের মধ্যে ২,৪৪২ জন সেনা নিহত এবং ২০,৬৬৬ জন আহত । এছাড়াও, ১,১৪৪ ন্যাটো সেনা নিহত হয়েছিল। আফগান মিলিটারি এবং পুলিশ নিহত হয়েছিল প্রায় ৭০,০০০ জন। রিপোর্টে আরও বলা হয় যে, প্রায় ৫০,০০০ তালিবান যোদ্ধা নিহত হয়। সবমিলিয়ে ২০০১ থেকে আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের যুদ্ধ বিঘ্নিত অঞ্চলগুলোতে প্রায় ২৪০,০০০ জন নিহত হয়। বাদবাকী নিহতদের অধিকাংশই ছিল বেসামরিক সাধারণ মানুষ।

এমনকি যুদ্ধের অবর্তমানে, এখনও, যুদ্ধের সময় পুঁতে রাখা মাইন এবং অবিস্ফোরিত তোপের বিস্ফোরণের আঘাতে প্রতিদিন সাধারণ মানুষ নিহত, আহত এবং পঙ্গু হচ্ছে। মার্কিনী দখলের প্রথমাবস্থায় আফগানরা আশা করেছিল যে, তাদের কিছুটা উন্নতি হবে। ধনী এবং দরিদ্র, সবাই কিছু না কিছু পাবে, লাভবান হবে। কিন্তু, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে যে অর্থ খরচ করে সেটি গেলো হামিদ কারজাই-এর নেতৃত্বাধীন সরকারি লোকজনের হাতে। মার্কিন এবং দখলদার অন্যান্য দেশের বাহিনীর সাথে যারা কাজ করতো তাদের পকেটে কিছু গেলো। এছাড়া, এই অর্থের ভাগ পেতো যারা সিআইএ এবং পাকিস্তানের হয়ে আফিম ও হেরোইনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাথে জড়িত ছিল সেই যুদ্ধবাজ নেতা এবং তাদের সহযোগীরা। এই অর্থের সামান্য অংশও আফগান সাধারণ মানুষের ভাগ্যে জোটেনি।

আফগানরা বহু আগে থেকেই (সরকারের) দুর্নীতির চাপে ছিল পিষ্ট। কিন্তু, মার্কিন আধিপত্যের সময়কালীন দুর্নীতি পূর্বের যে কোন সময়কেই ছাড়িয়ে গিয়েছিল। নয়া বিত্তশালীদের বাড়বাড়ন্ত ছিল চোখে পড়ার মতো। এসব অবশ্যই দুর্নীতির মাধ্যমে তৈরী হয়েছে। এই অবস্থাকে গরীব এবং মধ্য আয়ের মানুষজন সেভাবেই দেখেছেন। সামগ্রিক দুর্নীতি এবং অবহেলার চিত্রটি কী ধরনের তার ইঙ্গিত পাওয়া যাবে কিছু পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে। বিশাল সংখ্যক আফগান যারা কোনভাবে বেঁচে থাকার জন্য আপ্রাণ লড়াই করে যাচ্ছিলেন তাদের হার ২০০৮ সালের ৬০% থেকে ২০১৮ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৯০% -এ।

২০০১ সালের তালিবানরা ছিল পশতুন এবং তাদের রাজনীতিও ছিল পশতুন উগ্র জাতীয় চেতনায় পরিপুষ্ট। (পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে) ২০২১ সালে, বহু জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত তালিবান যোদ্ধারা উজবেক এবং তাজিক অধ্যুষিত অঞ্চলের ক্ষমতা গ্রহণ করেছে।

অবশ্যই, আফগানদের সবাই তালিবানদের পক্ষ নেয়নি। এই যুদ্ধটি ছিল বিদেশী দখলদারদের বিরুদ্ধে কিন্তু সেইসাথে এটি গৃহযুদ্ধও বটে। বহুজন ছিল যারা মার্কিনী এবং মার্কিন মদদপুষ্ট সরকারের পক্ষে কিংবা যুদ্ধবাজ (ভূস্বামী) নেতাদের পক্ষে যুদ্ধ করেছে। এমন বহুজন আছেন যারা এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না যে তারা কোন পক্ষে যাবেন। তারা আশঙ্কা এবং আশার দোলাচলে পড়ে অপেক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দেখতে চাচ্ছেন, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে পড়ে!

সময়ের সাথে সাথে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, অধিকাংশ আফগান আসলে মার্কিন দখলদারদের ঘৃণা করতেন এবং (অপরদিকে) একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে তালিবানরা সেই মার্কিন দখলদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে।

নির্মম পরিহাসের বিষয় হলো, চার চারটি মার্কিন প্রশাসন আফগান যুদ্ধের পেছনে কমপক্ষে ২২৬,০০০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে। তার মধ্যে অস্ত্রশস্ত্র এবং অন্যান্য সরবরাহ খাতে ৮,৮০০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করা হয়েছে একটি সেনাবাহিনীর পেছনে, শেষ পর্যন্ত যারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং ‘‘উধাও’’ হয়ে যায়।

সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২১।

*মূল এবং সম্পূর্ণ লেখা পাওয়া যাবে এই লিংকে। বাঁকা শব্দগুলো অনুবাদকের।

জন রায়ান, পিএইচ.ডি.:ভূগোল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং সিনিয়র স্কলার, ইউনিভার্সিটি অব উইনিপেগ, কানাডা।

 

পাদটীকা ও তথ্যসূত্র:

  1. কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের ডিন এবং কয়েকজন অধ্যাপক আমার সাথে দীর্ঘ সময়ের আলাপে সরকারের সমস্ত সংস্কার এবং কর্মসূচির বিষয়গুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বলেছেন।
  2. “How the CIA turns foreign students into traitors,”Ramparts (San Francisco), April 1967, pp. 23-24; Phillip Bonosky, Washington’s Secret War Against Afghanistan, New York: International Publishers, 1985, pp.33-34; The Truth About Afghanistan: Documents, Facts, Eyewitness Reports, Moscow: Novosti Press Agency Publishing House, 1980, pp. 83-96; Washington Post, December 23, 1979, p. A8.
  3. William Blum,Killing Hope: US Military and CIA Interventions Since World War II, Monroe, Maine: Common Courage Press, 1995, p. 343.
  4. Phillip Bonosky,Washington’s Secret War Against Afghanistan, New York: International Publishers, 1985, pp. 33-34
  5. The Truth About Afghanistan: Documents, Facts, Eyewitness Reports,Moscow: Novosti Press Agency Publishing House, 1980, pp. 91-92.
  6. Washington Post, December 23, 1979, p.A8. Soviet troops had started arriving in Afghanistan on December 8, to which the article states: “There was no charge [by the State Department] that the Soviets had invaded Afghanistan, since the troops apparently were invited.”
  7. “How Jimmy Carter and I Started the Mujahideen”: Interview of Zbigniew BrzezinskiLe Nouvel Observateur(France), Jan 15-21, 1998, p.76. 
  8. Ahmed Rashid, “The Taliban: Exporting Extremism,”Foreign Affairs, November-December 1999.
  9. John Fullerton,The Soviet Occupation of Afghanistan, (London), 1984 cites a journalist from the Far Eastern Economic Review reporting that “one [Soviet] group was killed, skinned and hung up in a butcher’s shop.”
  10. Zayar, “Afghanistan, Bin Laden and the hypocrisy of American imperialism,”In Defence of Marxism, September 26, 2001.
  11. “When the U.S. committed $43 million in aid to Afghanistan in May 2001, it brought the total of U.S. aid to the country that year alone to $124 million,” cited in article by Joseph Farah, “Murray pushed for aid to Taliban before to 9/11,”com, December 26, 2002. 
  12. “Taliban repeats call for negotiations,”com, October 2, 2001, includes the comment: “Afghanistan’s ruling Taliban repeated its demand for evidence before it would hand over suspected terrorist leader Osama bin Ladin.”; Noam Chomsky, “The War on Afghanistan,” Znet, December 30, 2001. 
  13. Ed Haas, “FBI says, it has ‘No hard evidence connecting Bin Laden to 9/11’,”Muckraker Report, June 6, 2006.
  14. Noam Chomsky, “The War on Afghanistan,”Znet, December 30, 2001.
  15. Barry Bearak, “Leaders of the Old Afghanistan Prepare for the New,”NYT, October 25, 2001; John Thornhill and Farhan Bokhari, “Traditional leaders call for peace jihad,” FT, October 25, 2001; “Afghan peace assembly call,” FT, October 26, 2001; John Burns, “Afghan Gathering in Pakistan Backs Future Role for King,” NYT, October 26, 2001; Indira Laskhmanan, “1,000 Afghan leaders discuss a new regime, BG, October 25, 26, 2001; Noam Chomsky, op. cit.
Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •