বাংলাদেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা বাজেট:সংখ্যার মারপ্যাঁচ?

বাজেট ২০২১-২২

বাংলাদেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা বাজেট: সংখ্যার মারপ্যাঁচ?

মনিরুজ্জামান মনির

করোনাকালে দ্বিতীয়বারের মতো বাজেট পেশ করা হয়েছে গত ৩রা জুন। এই বৈশ্বিক করোনা অতিমারি কি বাংলাদেশের বাজেট প্রস্তাবে কোনো প্রভাব ফেলতে পেরেছে? শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তাখাতসহ যেসব দুর্বলতা এই সংকটকালে উন্মোচিত হয়েছে সেগুলো কি বিশেষ মনোযোগ পেল? উন্নয়ন বরাদ্দ ও তার বাস্তবায়নে অতীত ধারাবাহিকতায় কি কোনো পরিবর্তন এসেছে? বাজেট বরাদ্দের ধরন উপস্থাপন ছাড়াও এই লেখায় উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর সন্ধান করা হয়েছে।

জাতীয় বাজেট হচ্ছে রাষ্ট্রের আর্থিক পরিকল্পনা। বাংলাদেশে বাজেট একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৮৭(১) অনুচ্ছেদে প্রত্যেক অর্থবছর সরকারের অনুমিত আয়-ব্যয়সংবলিত একটি বিবৃতি জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের নির্দেশ রয়েছে। সেই হিসেবে সরকার কর্তৃক উপস্থাপিত বাজেট একটি রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দলিল। গত ৩ জুন ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী। (অর্থ মন্ত্রণালয়, ২০২১)

শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক সুরক্ষা–এই তিনটি খাত হচ্ছে সবচেয়ে জীবনঘনিষ্ঠ। করোনার বাস্তবতায় এই তিনটি খাত আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। করোনার অভিঘাতে নাজুক স্বাস্থ্যব্যবস্থা বলা যায় পুরোপুরি ভেঙে পড়ছে। গত বছরের মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। শিক্ষা খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষ অন্যরকম এক আর্থিক ও প্রযুক্তিগত বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সমাজে কর্মহীনতা বেড়েছে এবং নতুন দারিদ্র্য বেড়েছে দুই থেকে আড়াই কোটি। এমন বাস্তবতায় উল্লিখিত তিনটি খাতে প্রস্তাবিত অর্থবছরে সরকারি বরাদ্দের ওপর একটি সাধারণ পর্যালোচনা করা হয়েছে এই লেখনীতে।

 ১। শিক্ষা বাজেট

১.১। সবই কি শিক্ষা সম্পর্কিত?

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত মোট বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ৯৪ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মোট বাজেটের ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ। শিক্ষা বাজেটের আকার বাড়িয়ে দেখানোর জন্য শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, এমন খাতের বরাদ্দও জুড়ে দেওয়া হয় শিক্ষা বাজেটের সঙ্গে। শুধু শিক্ষার জন্য বরাদ্দ আরও কম। তথ্য ও যোগাযোগ বিভাগ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বাজেট একত্রে শিক্ষা খাতের বাজেটের সঙ্গে উপস্থাপন করা হয় মূলত বাজেটের আকার বাড়িয়ে দেখানোর জন্য। এই দুটি খাতের জন্য পৃথক দুটি মন্ত্রণালয় থাকলেও তা ঠিক কী উদ্দেশ্যে শিক্ষা খাতের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়, তা তাই বোধগম্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে শিক্ষার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়িত এই প্রকল্পের বরাদ্দ শিক্ষার বাজেটকে বড় করে দেখায়। এ ছাড়া ২০২১-২২ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের জন্য ২১ হাজার ২০৪ কোটি টাকা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জন্য ১ হাজার ৭২০ কোটি টাকা টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, এবারে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দকৃত ৯৪ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকার একটা উল্লেখযোগ্য অংশের সঙ্গে শিক্ষাখাতের যোগ নেই।

চিত্র ১: খাতভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ এবং শিক্ষা ও প্রযুক্তিকে একই খাতে উপস্থাপন

                উৎস: বাংলাদেশ অর্থ মন্ত্রণালয়

 

১.২। শিক্ষার বরাদ্দ দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনিম্ন

প্রস্তাবিত অর্থবছরে শুধু শিক্ষার জন্য মোট ৭১ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৯১ শতাংশ এবং জিডিপির ২ দশমিক ০৮ ভাগ। ২০২০-২১ অর্থবছরে শিক্ষা খাতের জন্য বরাদ্দ ৬৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ ও জিডিপির ২ দশমিক ০৯ ভাগ। সে হিসাবে টাকার অঙ্কে বা পরিমাণগতভাবে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়লেও জিডিপির অনুপাতে তা হ্রাস পেয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে সরকারি বরাদ্দ (জিডিপির অনুপাতে) গত ২০ বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্য সর্বনিম্ন। ইউনেসকোর নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা খাতে অন্তত জিডিপির ৬ ভাগ বরাদ্দ রাখা উচিত। অথচ বছরের পর বছর বাংলাদেশের বরাদ্দ ২ শতাংশের আশপাশে। (অর্থ মন্ত্রণালয়, ২০২১)

পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে সরকারি বরাদ্দ (জিডিপির অনুপাতে) গত ২০ বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্য সর্বনিম্ন। ইউনেসকোর নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা খাতে অন্তত জিডিপির ৬ ভাগ বরাদ্দ রাখা উচিত। অথচ বছরের পর বছর বাংলাদেশের বরাদ্দ ২ শতাংশের আশপাশে।

চিত্র ২: দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর শিক্ষা খাতে সরকারি বরাদ্দের তুলনামূলক চিত্র

উৎস: ক্যালিনা ব্লখ, আইপিসি-আইজি এবং ইউনিসেফ প্রতিবেদন, ২০২০

১.৩। প্রাথমিক ও কারিগরি শিক্ষায় গুরুত্ব কম

অন্যদিকে শুধু শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত ৭১ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকার মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য বরাদ্দ ২৬ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা, যা এ খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের ৩৬.৫৭ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মান এবং ইউনেসকোর নির্দেশনা অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষায় ন্যূনতম ৪৫ শতাংশ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হয়। দেশে বেকারত্ব হ্রাসের জন্য বিশেষজ্ঞরা কারিগরি এবং ব্যাবহারিক শিক্ষার ওপর জোর দিলেও এবারের বাজেটে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র ৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা, যা শিক্ষা বাজেটের ১২.৭২ শতাংশ। উল্লেখ্য, এর মধ্যে আবার একটা বড় অংশ ব্যয় হবে মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য। (ইউনেসকো, ১৯৯৪)

 ১.৪। উচ্চশিক্ষায় করারোপ: শিক্ষা কী পণ্য?

২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা শুধু তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষাদানে নিয়োজিত বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। শিক্ষার ওপর কর কোনোভাবেই কাম্য নয়; বরং সংবিধান পরিপন্থি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ১৫তম অনুচ্ছেদে মৌলিক চাহিদা হিসেবে নাগরিকের জন্য শিক্ষা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া কর আরোপিত হয় বাণিজ্যিক পণ্য বা সেবার ওপর। শিক্ষা প্রথমত পণ্য নয়। দ্বিতীয়ত, বেসরকারি উদ্যোগের উচ্চশিক্ষা কোনো বাণিজ্যিক তৎপরতাও নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী ট্রাস্টের অধীন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত। ট্রাস্ট আইন ১৮৮২ অনুযায়ী ট্রাস্টের অধীন পরিচালিত হওয়ায় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান করযোগ্য নয়। কোম্পানি আইন ১৯৯৪-এর আওতায় লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সঙ্গে ট্রাস্ট আইনে অলাভজনক হিসেবে পরিচালিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর একই আওতায় সমভাবে আয়কর আরোপের প্রস্তাবনা আইনের পরিপন্থি এবং তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

শিক্ষার ওপর কর কোনোভাবেই কাম্য নয়; বরং সংবিধান পরিপন্থি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ১৫তম অনুচ্ছেদে মৌলিক চাহিদা হিসেবে নাগরিকের জন্য শিক্ষা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া কর আরোপিত হয় বাণিজ্যিক পণ্য বা সেবার ওপর।

চিত্র ৩: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ এবং তার প্রভাব (লেখকের বিশ্লেষণ)

২০১৫ সালে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর ৭.৫ শতাংশ কর আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে সরকার সে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। সেবারও প্রাথমিকভাবে সরকারের যুক্তি ছিল, করের এই টাকা শিক্ষার্থীদের দিতে হবে না। বরং এই কর প্রদান করবে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। এই যুক্তি যে খুবই খোঁড়া যুক্তি, তা অর্থনীতির প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীও জানে। অর্থনীতির ভাষায়, শিক্ষার চাহিদা এর সরবরাহের তুলনায় অপেক্ষাকৃত অস্থিতিস্থাপক (Relatively Inelastic)। ফলে আরোপিত করের বোঝার সিংহভাগই শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে এসে পড়বে, এমনকি কর যদি সরাসরি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে না নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও নেওয়া হয়। দেশে ১০৭টি অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। বাড়তি করের চাপ একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের পরিবারের ওপর একটা অমানবিক বোঝা হয়ে দাঁড়াবে, অন্যদিকে দেশে উচ্চশিক্ষার প্রসারকে বাধাগ্রস্ত এবং নিরুৎসাহিত করবে।

১.৫। শিক্ষায় ডিজিটাল বৈষম্য

বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে সুযোগের অসমতা এমনিতেই প্রকট। আর্থিক অবস্থান, ধনী-দরিদ্র, গ্রাম-শহর, অঞ্চল, ধর্ম এবং জাতি-গোষ্ঠীর ভিন্নতায় এদেশে শিক্ষার সুযোগ সবার জন্য সমান নয়। এই বৈষম্যে নতুন মাত্রা যোগ করছে ডিজিটাল বৈষম্য। ধনী কিংবা শহরের শিক্ষার্থীরা যখন অনলাইনে শিক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে ডিজিটাল ডিভাইস কিংবা ইন্টারনেটের অভাবে পিছিয়ে পড়ছে দরিদ্র কিংবা গ্রামের শিক্ষার্থীরা। করোনা কবে শেষ হবে, তা অনিশ্চিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে খুলবে কিংবা কীভাবে খুলবে তার সুনির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে পরিষ্কার করা হয়নি। এ অবস্থায় ডিজিটাল মাধ্যমে শিক্ষাকার্যক্রম বৈষম্যহীনভাবে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য বাজেট বরাদ্দ প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু তা পাওয়া যায়নি।

এই বৈষম্যে নতুন মাত্রা যোগ করছে ডিজিটাল বৈষম্য। ধনী কিংবা শহরের শিক্ষার্থীরা যখন অনলাইনে শিক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে ডিজিটাল ডিভাইস কিংবা ইন্টারনেটের অভাবে পিছিয়ে পড়ছে দরিদ্র কিংবা গ্রামের শিক্ষার্থীরা।

১.৬। বাজেটে বরাদ্দ নেই কর্মহীন শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য

করোনার অভিঘাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ গত দেড় বছর। এতে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দশ লাখের বেশি শিক্ষক ও কর্মচারী। অনেকের বেতন বন্ধ, কেউ-বা সামান্য পান, যা প্রয়োজনের তুলনায় একদমই সামান্য। অনেকে পেশা ছেড়ে দিয়ে সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন পেশায় নিযুক্ত হয়েছেন। বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। রাজধানীর বিভিন্ন অলিতে-গলিতে স্কুল বিক্রির মতো হৃদয়বিদারক বিজ্ঞপ্তি দেখা যাচ্ছে যেখানে-সেখানে। সরকার একবার নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য এককালীন পাঁচ হাজার টাকা করে একটি সাহায্য দিয়েছিল। সেই যা। জীবন-জীবিকার কথা মাথায় রেখে এবারের বাজেটে চোখে পড়েনি তাদের জন্য কোনো বরাদ্দ।

করোনার অভিঘাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ গত দেড় বছর। এতে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দশ লাখের বেশি শিক্ষক ও কর্মচারী। অনেকের বেতন বন্ধ, কেউ-বা সামান্য পান, যা প্রয়োজনের তুলনায় একদমই সামান্য। অনেকে পেশা ছেড়ে দিয়ে সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন পেশায় নিযুক্ত হয়েছেন।

করোনার অভিঘাতে মাসের পর মাস বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বেশিরভাগ স্কুল-কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের রোজগার নেই। রাজধানীর অলিতে-গলিতে দেখা যাচ্ছে স্কুল বিক্রির পোস্টার!

২। স্বাস্থ্য খাত

২.১। করোনার মধ্যে বরাদ্দ কমেছে স্বাস্থ্য খাতে!

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪২ শতাংশ অথবা জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৯৫ শতাংশ। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় যে কোনো জরুরি চাহিদা মেটানোর জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে স্বাস্থ্য খাতে মোট ৪১ হাজার ২৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। টাকার অঙ্কে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়লেও জিডিপির অনুপাতে কমেছে। গত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১.০২ শতাংশ। এ বছর করোনায় দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার বেহাল দশা যখন আরও বেশি স্পষ্ট, তখন ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ অনুপাত কমে দাঁড়িয়েছে জিডিপির ০.৯৫ শতাংশ! বৈশ্বিক বিবেচনায় এমনকি আঞ্চলিক বিবেচনায় এ খাতে বাজেট বরাদ্দ অন্যতম সর্বনিম্ন। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২১-২০২৫) অনুসারে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির দুই শতাংশ বরাদ্দের পরিকল্পনা রয়েছে। অথচ গত ১২ অর্থবছরে জনস্বাস্থ্যে সরকারের ব্যয় ছিল জিডিপির এক শতাংশেরও নিচে। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ, স্বাস্থ্য খাতে মোট জিডিপির পাঁচ শতাংশ বরাদ্দ থাকতে হবে। (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ২০২০)

গত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১.০২ শতাংশ। এ বছর করোনায় দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার বেহাল দশা যখন আরও বেশি স্পষ্ট, তখন ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ অনুপাত কমে দাঁড়িয়েছে জিডিপির ০.৯৫ শতাংশ!

চিত্র ৪:  দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের তুলনামূলক চিত্র (লেখকের বিশ্লেষণ)।


২.২। বরাদ্দ না-বাড়া বনাম খরচ করতে
পারা/না-পারা 

স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ না বাড়ানোর পেছনে যুক্তি দেওয়া হয়, এ খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের বেশিরভাগ অংশ খরচ করতে না-পারাকে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দকৃত উন্নয়ন বাজেটের ২৪ শতাংশ অব্যবহৃত ছিল। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বরাদ্দ দেওয়া অর্থের মাত্র ২৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ অর্থ ব্যবহার করতে পেরেছে। এবং থোক বরাদ্দের ১০ হাজার কোটি টাকার বেশিরভাগই অব্যবহৃত থেকে গেছে। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এর মধ্যে আমরা দেখেছি নানা তছরুপ, অনিয়ম এবং কেলেঙ্কারি। ৫ টাকার পণ্য কেনা হয়েছে ৫ হাজার টাকায় কিংবা নকল বা নিম্নমানের চিকিৎসাসামগ্রী কেনা হয়েছে কাল্পনিক দামে। এই সময়ে যে খাতে দরকার ছিল সর্বাধিক বরাদ্দ এবং সর্বোচ্চ দক্ষতা, সেখানে ফুটে উঠেছে উলটো চিত্র।

২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দকৃত উন্নয়ন বাজেটের ২৪ শতাংশ অব্যবহৃত ছিল। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বরাদ্দ দেওয়া অর্থের মাত্র ২৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ অর্থ ব্যবহার করতে পেরেছে। এবং থোক বরাদ্দের ১০ হাজার কোটি টাকার বেশিরভাগই অব্যবহৃত থেকে গেছে।

ব্যয় করতে না-পারা অদক্ষতার পেছনে সাধারণত দুটি যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়: এক. যথেষ্ট স্বাস্থ্য অবকাঠামোর অভাব, দুই. স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক দক্ষ জনবলের অভাব। বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার জনে তিনজন চিকিৎসক। মানদণ্ড অনুসারে ২৩ জন থাকার কথা। আর প্রতি ১০ হাজার জনগণের জন্য আছে দুজন নার্স। চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য চিকিৎসাকর্মীর বৈশ্বিক অনুপাত ১:৩:৫। বাংলাদেশে তা বৈশ্বিক মানদণ্ডের বিপরীতে চিকিৎসকের দিকে ঝুঁকে অনুপাত ১:০.৫:০.৩। বৈশ্বিক মানদণ্ডে এই সময়ে বাংলাদেশ কমপক্ষে ৯১ হাজার চিকিৎসক, ২ লক্ষ ৮০ হাজার নার্স ও ৪ লক্ষ ৮৩ হাজার অন্যান্য চিকিৎসাকর্মীর (টেকনোলজিস্ট) ঘাটতিতে আছে। ৭০ শতাংশ মানুষ গ্রামীণ জনপদে বাস করলেও শহর এলাকায় ১৮ গুণ চিকিৎসক বেশি। স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে সরকার অনুমোদিত পদের বিপরীতে ৩০-৫০ শতাংশ পদ শূন্য থাকছে। (স ম মাহবুবুল আলম, ২০২০)

বৈশ্বিক মানদণ্ডে এই সময়ে বাংলাদেশ কমপক্ষে ৯১ হাজার চিকিৎসক, ২ লক্ষ ৮০ হাজার নার্স ও ৪ লক্ষ ৮৩ হাজার অন্যান্য চিকিৎসাকর্মীর (টেকনোলজিস্ট) ঘাটতিতে আছে। ৭০ শতাংশ মানুষ গ্রামীণ জনপদে বাস করলেও শহর এলাকায় ১৮ গুণ চিকিৎসক বেশি। স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে সরকার অনুমোদিত পদের বিপরীতে ৩০-৫০ শতাংশ পদ শূন্য থাকছে।

সরকার যদি সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এই প্রয়োজনীয়সংখ্যক জনবল নিয়োগ দেয়, তাহলে একদিকে যেমন বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ হবে, অন্যদিকে কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কিন্তু এই জনবল সংকট এক দিনে তৈরি হয়নি। মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল প্রস্তুত ও নিয়োগ দেওয়া যেতে পারত, যা সরকারের সদিচ্ছার অভাবকে নির্দেশ করে। নানারকম প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিদ্যমান জনবলকে দক্ষ ও অধিক উৎপাদনশীল করে গড়ে তোলা সরকারের জন্য খুব বড় চ্যালেঞ্জ নয়। এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের নানারকম প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করার মাধ্যমে এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করতে না-পারার জন্য বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অবকাঠামোকে দায়ী করা হয়। দেশের স্বাস্থ্য অবকাঠামো খুব শক্তিশালী না হলেও বেশ বিস্তৃত। ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রায় ১৩ হাজার ৫০০টি কমিউনিটি ক্লিনিক, ৪২১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং এর আওতাধীন এক হাজার ৩১২টি ইউনিয়ন উপকেন্দ্র এবং বিশেষায়িত সেবাসমৃদ্ধ ৬২টি জেলাভিত্তিক হাসপাতাল রয়েছে। এর বাইরেও দেশে প্রায় ছয় হাজার বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে এবং প্রায় ১০ হাজারের মতো নিবন্ধিত ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। পর্যাপ্ত বরাদ্দের মাধ্যমে বিস্তৃত অবকাঠামোকে শক্তিশালী করা সময়ের ব্যাপার। এ ব্যাপারে দরকার সরকারের সদিচ্ছা।

 ২.৩। স্বাস্থ্য ব্যয়ে বাড়ছে ব্যক্তির অংশ

বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় এ বছরেও বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে ব্যক্তির পকেট থেকে খরচ বেড়েই চলেছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী চিকিৎসাসহ স্বাস্থ্যসেবা খাতে যত খরচ হয়, তার ৭২ শতাংশ যায় ব্যক্তির পকেট থেকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আফগানিস্তানকে বাদ দিলে এই হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে মোট খরচের মধ্যে সরকারি বরাদ্দ থেকে আসে ১৫ শতাংশের মতো। বাকি অংশ খরচ করে এনজিও ও দাতা সংস্থা। ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাওয়ার সম্পর্ক আছে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা বলছে, চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে প্রতিবছর ৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে, যা স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দের অপ্রতুলতা প্রকাশ করে। (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ২০২০)

চিত্র ৫: দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তিগত খরচের তুলনামূলক চিত্র (লেখকের বিশ্লেষণ)

৩। সামাজিক নিরাপত্তা: নিরাপত্তা বেষ্টনী কার জন্য? কে পাচ্ছে? কতটুকু পাচ্ছে?

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১ লাখ ৭ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা বাজেটের ১৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং জিডিপির ৩ দশমিক ১১ শতাংশ। কিন্তু এই হিসাবের মধ্যে একটা শুভংকরের ফাঁক রয়েছে, যা একটু পরে উপস্থাপন করা হচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর উদ্দেশ্য হচ্ছে, সমাজে আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে থাকা দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া। কিন্তু বাংলাদেশে সামজিক নিরাপত্তা বাজেট এবং এর বাস্তবায়ন নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন রয়েছে। যেমন- এক. অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশ হওয়া সত্ত্বেও সরকার কি সামাজিক নিরাপত্তা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেয়? দুই. এই বরাদ্দের সুবিধাভোগীরা কি প্রকৃত অর্থেই সুরক্ষা প্রাপ্তির দাবিদার? তিন. প্রস্তাবিত বাজেটে কি সাম্প্রতিক পরিস্থিতিকে ধর্তব্যে রেখেছে?

প্রথমত, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাংলাদেশের বাজেট বরাদ্দ জিডিপির ৩ শতাংশের মতো, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর গড় বরাদ্দ ৪ শতাংশ, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর গড় বরাদ্দ ৮ শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর গড় ২০ শতাংশ। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাংলাদেশের বরাদ্দ সবচেয়ে কম। (জাতিসংঘ, ২০২০)

সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাংলাদেশের বাজেট বরাদ্দ জিডিপির ৩ শতাংশের মতো, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর গড় বরাদ্দ ৪ শতাংশ, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর গড় বরাদ্দ ৮ শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর গড় ২০ শতাংশ। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাংলাদেশের বরাদ্দ সবচেয়ে কম।

চিত্র ৬: স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা–সরকারি বরাদ্দের (জিডিপির অনুপাতে) ভিত্তিতে র‍্যাংকিং

চিত্রে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা–এই তিন খাতে সরকারি বরাদ্দের (জিডিপির অনুপাতে) ভিত্তিতে র‍্যাংকিং করা করা হলে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়ায় সবচেয়ে নিচে।

দ্বিতীয়ত, ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতের জন্য বরাদ্দের ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকার মধ্যে সাড়ে সাত লাখ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী ও তাদের পরিবারের পেনশন বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৬ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা, যা মোট সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বরাদ্দের ২৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। এর সঙ্গে মাসিক ২০,০০০ টাকা হারে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা যোগ করলে মোট বরাদ্দ দাঁড়ায় ২৯ দশমিক পাঁচ শতাংশ। দেশে ১ লাখ ৯১ হাজার ৫৩২ জন সাধারণ বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসিক সম্মানি ভাতা পেয়ে থাকেন। কিন্তু অনুমিতভাবে এই দুই শ্রেণির মানুষ আর্থিকভাবে খুব ঝুঁকিতে থাকে না।

প্রস্তাবিত বাজেটে বয়স্ক ভাতা পান ৫৭ লাখ জন এবং বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা পান ২৪ লাখ ৫০ হাজার জন। এ ছাড়া আগামী অর্থবছরে ২০ লাখ ৮ হাজার অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা পাবেন। সে অর্থে এক কোটির বেশি মানুষের জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ খুবই সামান্য। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে নয় ধরনের ভাতার কথা উল্লেখ রয়েছে: বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, বেদে, রূপান্তরিত মানুষ ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি ভাতা ও সরকারি কর্মচারীদের পেনশন। এগুলোতে ব্যয় হবে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে পেনশনের অংশই প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। পেনশন, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, সঞ্চয়পত্রের সুদের মতো ব্যয় বাদ দিলে প্রকৃত দরিদ্রদের জন্য থাকে জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৯৭ শতাংশ। তাই অর্থের অঙ্কে বরাদ্দ বেশ বড় মনে হলেও প্রকৃত সুবিধাভোগীদের জন্য তা খুব সামান্য। এখানে শুভংকরের ফাঁকি স্পষ্ট।

তৃতীয়ত, সরকারি প্রতিবেদন বলছে, যোগ্য না হয়েও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ভাতা নেন ৪৬ শতাংশ মানুষ। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে: প্রকৃত দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দকৃত টাকার কত অংশ প্রাপ্য মানুষের কাছে যাচ্ছে। এবং অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, পেনশন ব্যতীত সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ গত অর্থবছরের তুলনায় মোট বাজেটের শতাংশ হিসাবে বরাদ্দ কমেছে। গত অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৪১ শতাংশ, যা প্রস্তাবিত বাজেটে হ্রাস পেয়ে হয়েছে ১৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

ভারতে বয়স্ক কিংবা বিধবা ভাতা রাজ্যভেদে ১২০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা। বাংলাদেশের এ ধরনের ভাতার পরিমাণ ৫০০ টাকার বেশি নয়। অথচ ন্যূনতম জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন ১ হাজার ৮৬২ টাকা। অর্থনীতিবিদরা প্রশ্ন করছেন: মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে বেশি হলে ভাতার হার কম কেন?

প্রস্তাবিত বাজেটে আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, নতুন দারিদ্র্যকে অস্বীকার করা। বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, নতুন দারিদ্র্যের সংখ্যা দুই থেকে আড়াই কোটি। সামাজিক সুরক্ষা কিংবা বাজেট দলিলের কোথাও নতুন দারিদ্র্যের উল্লেখ নেই। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২১ সালে দারিদ্র্যের হার প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল ২৩ শতাংশ, ২০২৪ সালে ১৭ শতাংশ এবং ২০৪১ সালে এই হার শূন্য শতাংশ। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় জানিয়েছেন, সরকারের লক্ষ্য ২০২৪ সালে দারিদ্র্যের হার ১২ শতাংশে নামিয়ে আনা। অথচ বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, করোনার প্রকোপে দারিদ্র্যের হার ইতোমধ্যে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ হয়েছে। কিন্তু সে অনুযায়ী সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আলাদা কোনো বরাদ্দ নেই। যেখানে খোলা চোখেই মানুষের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে, সেখানে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, নতুন দারিদ্র্যের ব্যাপারে সরকারের কাছে তথ্য নেই। এবং পুরোনো তথ্যের ভিত্তিতে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ শুধু অদক্ষতাই নয়, সরকারের অনিচ্ছাকে প্রকাশ করে।

যেখানে খোলা চোখেই মানুষের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে, সেখানে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, নতুন দারিদ্র্যের ব্যাপারে সরকারের কাছে তথ্য নেই। এবং পুরোনো তথ্যের ভিত্তিতে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ শুধু অদক্ষতাই নয়, সরকারের অনিচ্ছাকে প্রকাশ করে।

শেষ কথা: কেমন বাজেট চাই

বাজেট বরাদ্দই শুধু শেষ কথা নয়। গুরুত্ব দেওয়া উচিত বাজেট বাস্তবায়নের দিকে। বাজেট তখনই সফল হয়, যখন বাজেটে জনগণের আশাআকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়। এর জন্য বাজেটের একটা নৈতিক ও দার্শনিক ভিত্তি থাকা জরুরি। যে বাজেটে নৈতিক ও দার্শনিক ভিত্তি থাকে না, সে বাজেট কখনো জনমুখী হয় না, হয় কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠীমুখী। নৈতিকতা বিবর্জিত ও দর্শনহীন বাজেটে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ে, সম্পদের অপচয় হয়, ভারসাম্যহীন সমাজ তৈরি হয়। একটা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের জন্য দরকার শক্তিশালী স্বাস্থ্য খাত। বাজেট শিক্ষাবান্ধব ও জনবান্ধব না হলে দেশ এগোয় না, সমাজ এগোয় না।

মনিরুজ্জামান মনির : শিক্ষক, অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)। ইমেইল: monirsquare@gmail.com

 

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •