বৈশ্বিক মহামারি ও বৈষম্য: ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা

বৈশ্বিক মহামারি ও বৈষম্য: ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা

গুইডো আলফানি

বৈশ্বিক মহামারির সঙ্গে বৈষম্যের সম্পর্ক নিয়ে বর্তমান সময়ে অনেকেই কাজ করছেন। চৌদ্দ শতকের ব্ল্যাক ডেথ বৈশ্বিক মহামারির এক বিশেষ উদাহরণ, সেসময়ে নাটকীয়ভাবে সম্পদের বৈষম্য হ্রাস পায়। এর পেছনের সুনির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে Bocconi University-র অর্থনৈতিক ইতিহাসের অধ্যাপক Guido Alfani- তাঁর ‘Pandemics and inequality: A historical overview’ শীর্ষক লেখায় দেখিয়েছেন চৌদ্দ শতকের এরকম ফলাফল পরের মহামারিকালে দেখা যায়নি। বিভিন্ন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ও শ্রমবাজার সংশ্লিষ্ট প্রভাবের কারণে পরবর্তী বৈশ্বিক মহামারিগুলো বরং বৈষম্য বৃদ্ধি করেছে। এসব অভিজ্ঞতা বলে দেয় যে, কোভিড-১৯ মহামারি-পরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে বৈষম্য ও দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাবে। মূল লেখার অনুবাদ করেছেন কল্লোল মোস্তফা

চলমান কোভিড-১৯ মহামারির বণ্টনমূলক ফলাফল কী হবে, সে বিষয়ে উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছে। এ কারণে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য অনেকেই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার দ্বারস্থ হচ্ছেন। বস্তুত সম্পদ ও আয়বৈষম্যের দীর্মমেয়াদি প্রবণতা নিয়ে করা সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোয় এসবের ওপর বৈশ্বিক মহামারির ভূমিকার কথা উঠে এসেছে (Alfani 2020a, 2020b)। অবশ্য এই গবেষণাগুলোর বেশিরভাগেরই মনোযোগ ছিল চৌদ্দ শতকের ব্ল্যাক ডেথ নামে পরিচিত বৈশ্বিক প্লেগ মহামারির ওপর। এই মহামারির কারণে ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের প্রায় অর্ধেক মানুষের মৃত্যু ঘটে এবং ব্যাপক অর্থনৈতিক পরিবর্তন হয় (Campbell 2016, Alfani and Murphy 2017, Alfani 2020c, Jedwab et al. 2020) যার মধ্যে আয় ও সম্পদের বণ্টনের মতো বিষয়ও রয়েছে। ব্ল্যাক ডেথ-এর দৃষ্টান্তের ওপর ভিত্তি করে অনেকেই মনে করেন, বৈষম্য (নির্মমভাবে) দূর করার বিশেষ ক্ষমতা আছে বৈশ্বিক মহামারিগুলোর (Milanovic 2016, Scheidel 2017)। কিন্তু আমরা যদি পরবর্তী কালের মহামারিগুলোর দিকে তাকাই, যার মধ্যে আধুনিক কালের প্লেগ থেকে উনিশ শতকের কলেরা ও তৎপরবর্তী মহামারিও রয়েছে, তাহলে দেখব যে, ব্ল্যাক ডেথের প্রভাবটি ছিল ব্যতিক্রমী। কারণ, পরবর্তী মহামারিগুলো এ ধরনের বড় আকারের ও দীর্ঘমেয়াদি বৈষম্য হ্রাস করতে ব্যর্থ হয়েছে (Alfani 2020b)। বরং ১৯১৮-১৯ সালের স্প্যানিশ ফ্লুর মতো বৈশ্বিক মহামারির কারণে বৈষম্য হ্রাস পাওয়ার বদলে উলটো বৈষম্য বৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায়।

১৩১৪ থেকে ১৩৫২ সালের ব্ল্যাক ডেথ-এর ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যটি স্পষ্ট হয়ে যাবে যদি আমরা বৈষম্যের দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতা নিয়ে প্রাপ্ত তথ্যের দিকে তাকাই। চিত্র-১-এ ইতালির পরিস্থিতি দেখানো হয়েছে, যে দেশটি সম্পর্কে বেশ ভালো মানের তথ্য আমাদের হাতে রয়েছে। চিত্রে ১৩০০ থেকে ১৮০০–এই পাঁচ শতাব্দীজুড়ে সম্পদের বৈষম্যের যে প্রবণতা দেখানো হয়েছে, সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে, শুধু ব্ল্যাক ডেথের সময়টাতেই সম্পদের বৈষম্য হ্রাস পায় (অবশ্য এই বিশ্লেষণটি উনিশ এবং বিশ শতক পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হলে আমরা বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এ রকম আরও কিছু বৈষম্য হ্রাস পাওয়ার ঘটনা দেখতে পাব (Piketty 2014, scheidel 2017)। ব্ল্যাক ডেথের কারণে সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ সম্পদ হ্রাস পেয়েছিল। সম্পদের বৈষম্য হ্রাসের এই ঘটনাটি দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়েছিল। কারণ, সতেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধের আগপর্যন্ত সম্পদের বৈষম্য ব্ল্যাক ডেথ-পূর্ব অবস্থায় পৌঁছেনি। এই বৈষম্য হ্রাসের পেছনে মূলত দুটো বিষয় কাজ করেছে।

প্রথমত, প্লেগের কারণে শ্রমিকের সংখ্যা হ্রাস পায়, শ্রমিকের অভাব দেখা দেয়, প্রকৃত আয় বৃদ্ধি পায় এবং সব মিলিয়ে দরিদ্র শ্রেণির মানুষের দরকষাকষির ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা আগের চেয়ে ভালো শর্তে কাজ করতে পারে।

একদিকে প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি, অন্যদিকে সম্পত্তির মূল্যহ্রাসের কারণে বহু মানুষের পক্ষে সম্পত্তির মালিকানা লাভের সুযোগ তৈরি হয়, যার ফলে সম্পদের বৈষম্য হ্রাস পায়।

দ্বিতীয়ত, ইউরোপের বেশিরভাগ অঞ্চলে সে সময় সম্পত্তির উত্তরাধিকার ব্যবস্থাটা এমন ছিল যে, মহামারিতে ভূস্বামীর মৃত্যুর কারণে বড় বড় তালুক উত্তরাধিকারদের মধ্যে ছোট ছোট ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এটাকে বলা হয় পার্টিবল ইনহেরিটেন্স সিস্টেম (partible inheritance system)। ফলে বহু মানুষের হাতে সম্পত্তি চলে যায়, যা হয়তো তাদের দরকার ছিল না বা যা দেখাশোনা করার সামর্থ্য তাদের ছিল না। ফলে এসব সম্পত্তি বাজারে বিক্রি করতে গিয়ে দাম তুলনামূলকভাবে কমে যায়। একদিকে প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি, অন্যদিকে সম্পত্তির মূল্যহ্রাসের কারণে বহু মানুষের পক্ষে সম্পত্তির মালিকানা লাভের সুযোগ তৈরি হয়, যার ফলে সম্পদের বৈষম্য হ্রাস পায়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির ঘটনা আয় বৈষম্য হ্রাসেরও লক্ষণ [Alfani (2020b)]।

চিত্র-১: ইতালির সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ ব্যক্তির সম্পদের ভাগ, ১৩০০ থেকে ১৮০০

সূত্র: Alfani (2020a) অনুসারে তৈরি

আমাদের হাতে প্রতিনিয়ত আরও তথ্য যুক্ত হচ্ছে যেখান থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ইতালির মতো ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলেও ব্ল্যাক ডেথের সময়টায় সম্পদের বৈষম্য হ্রাস পেয়েছিল। কিন্তু মধ্যযুগের ব্ল্যাক ডেথের এই বৈষম্য হ্রাসকারী ঘটনা কিন্তু পরবর্তী কালের বড় বড় প্লেগ মহামারির ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। উদাহরণস্বরূপ সতেরো শতকের প্লেগের কথা বলা যেতে পারে, যে প্লেগে, বিশেষ করে দক্ষিণ ইউরোপ অঞ্চলটি মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছিল। ইতালিতে ১৬২৯-১৬৩০ সালের প্লেগ উত্তর দিকে ও তুসকানি অঞ্চলের দিকে এবং ১৬৫৬-১৬৫৭ সালে পেনিনসুলার কেন্দ্রীয় ও দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে ছিল। এসব প্লেগে মৃত্যুর হার ছিল ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ, যা ব্ল্যাক ডেথের মৃত্যুর হারের (৫০ শতাংশ) প্রায় কাছাকাছি (Alfani 2013)। কিন্তু এই ক্ষেত্রে বৈষম্য হ্রাসের ব্যাপারটি ছিল একদম সীমিত: চিত্র-১-এ যার প্রভাব একেবারেই দেখা যায় না, এমনকি স্থানীয় অঞ্চলের জন্য সংগৃহীত ঐতিহাসিক তথ্যেও তার তেমন কোনো ছাপ পাওয়া যায় না। সম্ভবত এর কারণ হলো, পরবর্তীকালের প্লেগের সময় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো ছিল আগের চেয়ে ভিন্নরকমের। বিশেষ করে সম্পত্তির উত্তরাধিকারের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোটি আর আগের মতো ছিল না। ব্ল্যাক ডেথের পর এটা যখন স্পষ্ট হয়ে গেল যে, এই প্লেগ মহামারি সহজে নির্মূল হচ্ছে না, বারবার আসতেই থাকবে, তখন ধনিক শ্রেণির ব্যক্তিরা তাদের সম্পত্তিকে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে ফিদেইকমিশিয়ামের (fideicommissum) মতো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলেন, যে ব্যবস্থায় সম্পদ উত্তরাধিকারের মধ্যে টুকরো করে দেওয়ার বদলে একজনের হাতে সম্পত্তি–এই শর্ত দিয়ে ভোগদখলের অধিকার তুলে দেওয়া সম্ভব ছিল যে, তিনিও একটা নির্দিষ্ট সময় পর নির্দিষ্ট আরেকজনকে সম্পত্তি ভোগদখলের অধিকার দিতে বাধ্য থাকবেন। এই ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার কারণে প্লেগ যে প্রক্রিয়ায় সম্পত্তি টুকরো টুকরো করে সম্পদের বৈষম্য হ্রাসে ভূমিকা পালন করছিল, সেই রাস্তাটি বন্ধ হয়ে যায়।

ইতালিতে ১৬২৯-১৬৩০ সালের প্লেগ উত্তর দিকে ও তুসকানি অঞ্চলের দিকে এবং ১৬৫৬-১৬৫৭ সালে পেনিনসুলার কেন্দ্রীয় ও দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে ছিল। এসব প্লেগে মৃত্যুর হার ছিল ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ, যা ব্ল্যাক ডেথের মৃত্যুর হারের (৫০ শতাংশ) প্রায় কাছাকাছি (Alfani 2013)।

আরও কারণ আছে। সতেরো শতকের প্লেগের পর ইতালি কিংবা স্পেনের মতো ইউরোপের অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির কোনো প্রবণতা দেখা যায়নি। আমরা যদি ব্ল্যাক ডেথের সময়ের সঙ্গে এই সময়ের মজুরির তুলনা করি–পার্থক্যটা পরিষ্কার ধরা পড়ে, চিত্র-২ থেকে যা দেখা যাচ্ছে। উত্তর ইতালির মিলানে ১৬৩০ সালের প্লেগের ফলে জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশ এবং স্পেনের পূর্বাঞ্চলের ভ্যালেন্সিয়ায় ১৬৪৭-১৬৪৮ সালে জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু চিত্র-২-এর (খ) থেকে দেখা যাচ্ছে, এ সময় ইতালির মিলান কিংবা স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ায় অদক্ষ শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির কোনো চিহ্নই দেখা যায় না, যা প্রমাণ করে, এই প্লেগ মহামারিগুলোর ব্ল্যাক ডেথের মতো সমতাবিধানের কোনো ক্ষমতা ছিল না।

চিত্র-২: ১৩০০-১৪০০ এবং ১৬০০-১৭০০ সালে ইউরোপীয় শহরগুলোয় অদক্ষ শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি (প্রতি গ্রাম রুপার ভিত্তিতে)

ক) ব্ল্যাক ডেথ ও প্রকৃত মজুরি

খ)সতেরো শতকের প্লেগ ও প্রকৃত মজুরি

সূত্র: Alfani (2020b), Fochesato (2018)-এর তথ্য অবলম্বনে

চৌদ্দ শতকের ব্ল্যাক ডেথ ও সতেরো শতকের প্লেগের ফলে এই যে ভিন্ন ধরনের ফলাফল, তা থেকে বোঝা যায়, বিশেষ বিশেষ ঘটনার ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার সাধারণীকরণের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। কারণ, এমনকি একই ধরনের জীবাণু দ্বারা ছড়ানো একই বৈশিষ্ট্যের মহামারির অর্থনৈতিক ফলাফল সব সময় এক রকম হয় না। বিভিন্ন রকম জীবাণু দ্বারা ছড়ানো মহামারির মধ্যকার তুলনার বিষয়টা আরও জটিল। তারপরও, উনিশ শতকের কলেরা মহামারির বণ্টনমূলক ফলাফল কীরকম ছিল, সে সম্পর্কে আমরা ধারণা পেতে পারি, বিশেষত ফ্রান্সের মতো দেশের সম্পদবৈষম্যের প্রবণতা থেকে, যেহেতু ফ্রান্সের বৈষম্য বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে (Piketty et al. 2006, 2014; Piketty 2014)।

চৌদ্দ শতকের ব্ল্যাক ডেথ ও সতেরো শতকের প্লেগের ফলে এই যে ভিন্ন ধরনের ফলাফল, তা থেকে বোঝা যায়, বিশেষ বিশেষ ঘটনার ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার সাধারণীকরণের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। কারণ, এমনকি একই ধরনের জীবাণু দ্বারা ছড়ানো একই বৈশিষ্ট্যের মহামারির অর্থনৈতিক ফলাফল সব সময় এক রকম হয় না। বিভিন্ন রকম জীবাণু দ্বারা ছড়ানো মহামারির মধ্যকার তুলনার বিষয়টা আরও জটিল।

কলেরা ছিল উনিশ শতকের নতুন একটা রোগ। উনিশ শতকের শুরুর আগপর্যন্ত এই সংক্রামক ব্যাধিটি ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৮১০-এর দশক থেকে রোগটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এবং এক শতকেই ছয়টি মহামারির জন্ম দেয়: ১৮১৭-১৮২৪, ১৮২৯-১৮৩৭, ১৮৪০-১৮৬০, ১৮৮১-১৮৯৬ ও ১৮৯৯-১৯২৩ পর্যায়ে। পশ্চিমা দেশগুলো প্রথম মহামারিটির হাত থেকে মুক্ত ছিল; কিন্তু পরবর্তী মহামারিগুলোয় কম-বেশি আক্রান্ত হয় (Bourdelais 1987, Kohn 2007)। ইউরোপে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ মহামারির প্রভাব ছিল সবচেয়ে মারাত্মক। ফ্রান্স মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়, বিশেষত ১৮৩২ (১০২,০০০ জন) এবং ১৮৫৩-১৮৫৪ (১,৪৩,০০০ জন) সালে। আমরা যদি এই সময়কার বৈষম্যের প্রবণতাটি (চিত্র-৩) দেখি, তাহলে দেখা যায়, সংক্রমণের এই সময়টায় বৈষম্য হ্রাস পেয়েছিল।

এই তথ্যের বিশ্লেষণ করতে হবে খুব সাবধানতার সঙ্গে। কারণ, এই সময়ের জন্য আমরা শুধু প্রতি ১০ বছর অন্তর একটি করে পর্যবেক্ষণ পাই, যার শুরু ১৮০৭ সাল থেকে। এই তথ্য থেকে আমরা বড় বড় মহামারির মাধ্যমে অতীতে কীভাবে বৈষম্য হ্রাস পেয়েছিল, তার আরও একটা পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারি–দরিদ্রদের নির্মূল করার মধ্য দিয়ে। কলেরা যেহেতু অস্বাস্থ্যকর ও ঘনবসতি অঞ্চলে বেশি হয়, ফলে সমাজের আর যে কোনো অংশের চেয়ে কলেরা, বিশেষত শহরের দরিদ্রদের সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত করে এবং এর মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষের সংখ্যা কমিয়ে দেয়। এ কারণেই উক্ত মহামারির অন্য কোনো বণ্টনমূলক ফলাফল না-থাকলেও স্রেফ দরিদ্র মানুষের তুলনামূলক বেশি মৃত্যুর কারণে বেঁচে থাকা মানুষের মধ্যে বৈষম্য কমে যায় (Alfani 2020b)।

চিত্র-৩: ফ্রান্সে সম্পদের বৈষম্য ও কলেরা মহামারি, ১৮০০-১৯১০ (সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশের ভাগ)

সূত্র: Alfani (2020b), WID (World Wealth and Income Database)-এর তথ্য ব্যবহার করে তৈরি

কলেরা ও প্লেগ–এই দুই ধরনের মহামারির ঘটনা থেকে আমরা বলতে পারি, বিদ্যমান কাঠামো বা শর্তাবলি ছাড়াও মহামারির বণ্টনমূলক ফলাফল নির্ভর করে মৃত্যুর হার ও মৃত্যুর ধরনের ওপর। গিনি সহগ বা সম্পদে ধনীদের অংশীদারত্বের বিবেচনায় বৈষম্য হ্রাসে সতেরো শতকের প্লেগের ভূমিকা ছিল সীমিত। কিন্তু তার পরেও বেশিসংখ্যক দরিদ্র মানুষের মৃত্যুর কারণে প্লেগের ফলে দারিদ্র্য কিছুটা হ্রাস পেয়েছিল, যেমনটা ঘটেছিল কয়েক শতক পরে কলেরা মহামারির ক্ষেত্রেও (Alfani 2020b)। মধ্যযুগের ব্ল্যাক ডেথ শ্রমবাজারের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। কারণ, এই মহামারিতে মৃত্যুহার ছিল অত্যধিক বেশি। কিন্তু ১৯১৮-১৯১৯-এর স্প্যানিশ মহামারিতে মৃতের সংখ্যা বেশি হলেও মৃত্যুহার ছিল অনেক কম (০.২৫ থেকে ০.৫০ শতাংশ, Johnson and Mueller 2002)। ফলে স্প্যানিশ ফ্লুর কারণে শ্রমবাজারের সংকোচন ব্ল্যাক ডেথের মতো ঘটেনি। এতে বৈষম্য হ্রাসের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারেনি।

মধ্যযুগের ব্ল্যাক ডেথ শ্রমবাজারের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। কারণ, এই মহামারিতে মৃত্যুহার ছিল অত্যধিক বেশি। কিন্তু ১৯১৮-১৯১৯-এর স্প্যানিশ মহামারিতে মৃতের সংখ্যা বেশি হলেও মৃত্যুহার ছিল অনেক কম (০.২৫ থেকে ০.৫০ শতাংশ, Johnson and Mueller 2002)।

কোভিড-১৯ মহামারির বণ্টনমূলক ফলাফল অনুমান করার জন্য এই ঘটনাটি প্রাসঙ্গিক। কারণ, মহামারি বিদ্যার নিরিখে ব্ল্যাক ডেথের চেয়ে বরং স্প্যানিশ ফ্লুর সঙ্গে কোভিড-১৯ মহামারির বেশি মিল রয়েছে। বৈষম্যের ওপর স্প্যানিশ ফ্লুর প্রভাব নিয়ে খুব বেশি গবেষণা খুঁজে পাওয়া না-গেলেও আমাদের হাতে কিছু প্রমাণ আছে, যা থেকে দেখা যায়, এই মহামারির ফলে বৈষম্য আরও বেড়েছে–যেমন, ইতালিতে (Galletta and Giommoni 2020)। কারণ, এই মহামারির কারণে যে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছিল, তার ফলে কর্মসংস্থান ও আয়ের বিচারে সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সুইডেনের একটা গবেষণা থেকে দেখা যায়, স্প্যানিশ ফ্লুর কারণে প্রতিটি মৃত্যুর বিপরীতে চারজন করে নতুন দরিদ্র তৈরি হয়েছে, যাদেরকে সরকারি ত্রাণের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে (Karlsson et al. 2014)। কোভিড-১৯ মহামারির ক্ষেত্রেও, বিশেষত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্রুত বর্ধমান বেকারত্ব নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এই বেকারত্ব শুধু যে মহামারির কারণে বাড়ছে (অসুস্থ হয়ে কর্মসংস্থান হারানো) তা নয়, মহামারি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিশ্বজুড়ে লকডাউনের মতো যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে–তার কারণেও (OECD 2020)।

স্প্যানিশ ফ্লুর কারণে প্রতিটি মৃত্যুর বিপরীতে চারজন করে নতুন দরিদ্র তৈরি হয়েছে, যাদেরকে সরকারি ত্রাণের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে (Karlsson et al. 2014)। কোভিড-১৯ মহামারির ক্ষেত্রেও, বিশেষত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্রুত বর্ধমান বেকারত্ব নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এই বেকারত্ব শুধু যে মহামারির কারণে বাড়ছে (অসুস্থ হয়ে কর্মসংস্থান হারানো) তা নয়, মহামারি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিশ্বজুড়ে লকডাউনের মতো যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে–তার কারণেও (OECD 2020)।

গত সাত শতকের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যাচ্ছে, কোভিড-১৯ মহামারির ফলে বৈষম্য ও দারিদ্র্য আরও বাড়বে। একদিক থেকে চিন্তা করলে এটা ভালো খবর। কারণ, এর অর্থ হলো, ব্ল্যাক ডেথের মতো মহামারির চেয়ে এই মহামারিতে মৃত্যুহার অনেক কম। অন্যদিক থেকে দেখলে এর অর্থ হলো, বিশ্বজুড়ে সরকারগুলোকে এই স্বাস্থ্য সংকট-পরবর্তী সামাজিক সংকট মোকাবিলা বা প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।

তথ্যসূত্র:

Alfani, G (2013), “Plague in Seventeenth Century Europe and the Decline of Italy: An Epidemiological Hypothesis”, European Review of Economic History 17(3): 408-430.

Alfani, G (2020a), “Economic inequality in preindustrial times: Europe and beyond”, Journal of Economic Literature, forthcoming. 

Alfani, G (2020b), “Epidemics, inequality and poverty in preindustrial and early industrial times”, Journal of Economic Literature, forthcoming.

Alfani, G (2020c), “Pandemics and asymmetric shocks: Lessons from the history of plagues”, VoxEU.org, 9 April.

Alfani, G and T Murphy (2017), “Plague and Lethal Epidemics in the Pre-Industrial World”, Journal of Economic History 77(1): 314-343.

Bourdelais, P (1987), Une peur bleue: histoire du choléra en France. 1832-1854, Paris: Payot.

Campbell, B M S (2016), The Great Transition. Climate, Disease and Society in the Late-Medieval World, Cambridge: Cambridge University Press.

Fochesato, M (2018), “Origins or Europe’s North-South Divide: Population changes, real wages and the ‘Little Divergence’ in Early Modern Europe”, Explorations in Economic History 70: 91-131.

Galletta, S and T Giommoni (2020), “The effect of the 1918 influenza pandemic on income inequality: Evidence from Italy”, Covid Economics 33: 73-104.

Jedwab, R, N Johnson and M Koyama (2020), “The Economic Impact of the Black Death”Journal of Economic Literature, forthcoming. 

Johnson, N and J Mueller (2002), “Updating the accounts: global mortality of the 1918-1920 ‘Spanish’ influenza pandemic”, Bulletin of the History of Medicine 76: 105-115

Karlsson, M, T Nillson and S Pichler (2014), “The impact of the 1918 Spanish flu epidemic on economic performance in Sweden. An investigation into the consequences of an extraordinary mortality shock”, Journal of Health Economics 36: 1-19.

Kohn, G C (2007), Encyclopedia of Plague and Pestilence-Third Edition, New York: Facts on File.

Milanovic, B (2016), Global Inequality: a new approach for the age of globalization, Cambridge, MA: Harvard University Press.

OECD (2020), Employment Outlook 2020, Paris: OECD. 

Piketty, T (2014), Capital in the Twenty-First Century, Cambridge MA: Belknap Press of Harvard University Press.

Piketty, T, G Postel-Vinay and J-L Rosenthal (2006), “Wealth concentration in a developing economy: Paris and France, 1807-1994”, American Economic Review 96(1):236-256.

Piketty, T, G Postel-Vinay and J-L Rosenthal (2014), “Inherited vs self-made wealth: theory and evidence from a rentier society (Paris 1872-1937)”, Explorations in Economic History 51:21-40.

Scheidel, W (2017), The Great Leveler: Violence and the History of Inequality from the Stone Age to the Twenty-First Century, Princeton: Princeton University Press.

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •