বিশেষ প্রকাশনা
বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ: বাতিল প্রযুক্তি, অত্যধিক ব্যয় আর অচিন্তনীয় বিপদের পথ
বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কি মহাগৌরব না মহাবিপদ? এ নিয়ে বহুরকম প্রশ্ন, উদ্বেগ, ভয় থাকলেও এ বিষয়ে দেশের মানুষকে পরিষ্কার কিছুই জানতে দেয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে একটি সামগ্রিক বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য এই ক্রোড়পত্র তৈরি করা হয়েছে। এর জন্য বিশেষভাবে নির্ভর করা হয়েছে ইতোমধ্যে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণা-প্রবন্ধ, বার্ষিক প্রতিবেদন, বিশেষজ্ঞ মন্তব্য প্রতিবেদন এবং সংশ্লিষ্ট জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ওপর। ‘সর্বজনকথা’র পক্ষ থেকে তথ্যাদি সংগ্রহ, মতামত প্রদান, অনুবাদ, বিশ্লেষণ ও উপস্থাপনে বিশেষভাবে কাজ করেছেন দেবাশীষ সরকার, কল্লোল মোস্তফা, মোশাহিদা সুলতানা ও শোয়েব করিম। সমন্বয় করেছেন মওদুদ রহমান।
ভূমিকা
বাংলাদেশে কখনোই বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবিলার উপায় হিসেবে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চিন্তা করা হয়নি। ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার যখন রূপপুরে প্রথমবারের মতো ৭০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার চুল্লি নির্মাণের অনুমতি দেয়, সেই অনুমোদন কতটা এই ভূখণ্ডের মানুষের প্রয়োজন বিবেচনায় করা হয়েছিল আর কতটা আধিপত্য জারি রাখার হিসাব-নিকাশ ছিল–সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো; কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বজনের আগ্রহ, প্রয়োজন আর কল্যাণ শাসকদের কাছে বরাবরের মতোই তাচ্ছিল্যের বিষয় হয়েই রইল। আর ঠিক এ কারণেই ষাটের দশকের ৭০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার টার্গেট এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২,৪০০ মেগাওয়াটে; যদিও বর্তমানে চাহিদা না থাকায় ৮ থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র লাগাতারভাবে অলস পড়ে আছে [১]।
গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ২০২৯-৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ৫৮ শতাংশই অলস বসে থাকা কেন্দ্রে পরিণত হবে [২]; কিন্তু যুক্তি না মেনে, আলাপে না এসে, গবেষণায় মন না-দিয়ে বিদ্যুৎ সেক্টরে গত এক যুগে যে ক্ষত বাড়িয়ে তোলা হয়েছে তাতে প্রাণ-প্রকৃতির খরচ বাদ দিয়ে শুধু টাকার অঙ্কে এখনই প্রতি ১০০ মেগাওয়াট অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রে বছরে জনগণের ট্যাক্সের ৯০ কোটি টাকা শুধু ভাড়া বাবদই চলে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের পকেটে [৩]। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিকল্পনা আরও বড়, কাজেই এটিকে ঘিরে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কমিশন বেনিয়াদের আগ্রহও অনেক বেশি। লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্পে লুটপাটের সুযোগও বেশি। বাংলাদেশে বিনা প্রয়োজনের পারমাণবিক কেন্দ্র এত তড়িঘড়ি উপায়ে নির্মাণযজ্ঞের কারণ শুধু অসৎ রাজনীতিবিদ-আমলা-ব্যবসায়ী ত্রয়ীর ব্যক্তিগত লাভের ভাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর এর বিপরীতে সাধারণ মানুষের জন্য তৈরি হচ্ছে দীর্ঘদিনের ঋণের বোঝা এবং বাতিল প্রযুক্তি ব্যবহারের অপরিসীম ঝুঁকি। এই প্রযুক্তি কতটা সেকেলে, কতটা ঝুঁকিপূর্ণ আর কতটা খরুচে, তা আমরা বোঝার চেষ্টা করব আমাদের পরবর্তী আলোচনায়।
এই ক্রোড়পত্রটিকে জাতীয় কমিটি প্রণীত এবং ২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘বিকল্প জ্বালানি মহাপরিকল্পনা’র পারমাণবিক সংক্রান্ত আলোচনার বর্ধিত সংস্করণ হিসেবে পাঠ করলেই পাঠকের সুবিধা হবে [৪]।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ: বৈশ্বিক পরিস্থিতি
১৯৮৬ সালে যখন চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিস্ফোরণ ঘটে, তার দুই যুগেরও বেশি আগে মানুষ পৌঁছে গিয়েছিল মহাশূন্যে। বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে এভাবেই পৃথিবী এগিয়েছে, এগিয়ে যাবে। কিন্তু বিজ্ঞান যখন চর্চার বদলে বদ্ধবিশ্বাসে পরিণত হয়, তখনই ঘটে যত বিপদ। সত্তর আর আশির দশকে বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের অহমিকায় অন্ধ হয়ে যাওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) কেউই এই বিপদ থেকে রেহাই পায়নি।
১৯৭৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থ্রি মাইল আইল্যান্ড পারমাণবিক দুর্ঘটনার মাধ্যমে বেজেছিল সাবধান হয়ে যাওয়ার ঘণ্টা। কিন্তু সে সময়ে নীতিনির্ধারকরা তা কানে তোলেননি। যার মূল্য গুনতে হয়েছে ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল ইউক্রেনে চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিস্ফোরণের ঘটনার মাধ্যমে। ৩৪ বছর পেরিয়ে গেলেও চেরনোবিল শহর এখনো বসবাসের অনুপযুক্ত। বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম আর ক্যানসারে মৃত্যু এখনো সেখানে নিয়মিত ঘটনা। তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ছড়িয়ে পড়া রাশিয়া, বেলারুশ আর ইউক্রেনের কয়েক লাখ হেক্টর জমি আজও ফলনের জন্য অনুপযুক্ত।
ক্ষুদ্র পরমাণুর ভাঙনে বিপুল পরিমাণ শক্তি পাওয়ার স্বপ্নের সৌধ এতটাই উঁচুতে পৌঁছেছিল যে, গত শতাব্দীর ৫০-এর দশকে এই বিদ্যুৎকে ভবিষ্যতের সবচেয়ে সস্তা বিদ্যুৎ হিসেবে প্রচার করা শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই সস্তা বিদ্যুতের কাল আর আসেনি। দীর্ঘমেয়াদি সুবিধার আশ্বাস দিয়ে দেশে দেশে সবচেয়ে ব্যয়বহুল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণের খরচ জোগানো হয়েছে। প্রযুক্তিকে দোহাই মেনে এটিকে নিরাপদ বিদ্যুৎ হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু একের পর এক দুর্ঘটনায় নিরাপদ আর সস্তা হিসেবে জাহির করা পারমাণবিক বিদ্যুতের বিজ্ঞাপনী মুখোশ খসে পড়েছে।
প্রযুক্তির আধুনিকায়নে অন্যান্য বিদ্যুৎ উৎপাদনী ব্যবস্থায় খরচ কমে। যেমন, ২০১০ সালের তুলনায় প্রতি ইউনিট সৌর বিদ্যুতের দাম সাত বছরের ব্যবধানে কমে গেছে ৭২ ভাগ (আইআরইএনএ, ২০১৮)। অথচ, পারমাণবিক বিদ্যুতের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা যুক্ত হতে থাকায় খরচ শুধুই বাড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে সেখানে প্রতি ইউনিট সৌর বিদ্যুতের মূল্য ৮৮ শতাংশ এবং বায়ুবিদ্যুতের মূল্য ৬৯ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে, বিপরীতে এ সময়কালে পারমাণবিক বিদ্যুতের প্রতি ইউনিট মূল্য বেড়েছে ২৩ শতাংশ।
প্রযুক্তির আধুনিকায়নে অন্যান্য বিদ্যুৎ উৎপাদনী ব্যবস্থায় খরচ কমে। যেমন, ২০১০ সালের তুলনায় প্রতি ইউনিট সৌর বিদ্যুতের দাম সাত বছরের ব্যবধানে কমে গেছে ৭২ ভাগ (আইআরইএনএ, ২০১৮)। অথচ, পারমাণবিক বিদ্যুতের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা যুক্ত হতে থাকায় খরচ শুধুই বাড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে সেখানে প্রতি ইউনিট সৌর বিদ্যুতের মূল্য ৮৮ শতাংশ এবং বায়ুবিদ্যুতের মূল্য ৬৯ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে, বিপরীতে এ সময়কালে পারমাণবিক বিদ্যুতের প্রতি ইউনিট মূল্য বেড়েছে ২৩ শতাংশ [৫]। এ কারণেই ২০০৭ সালে নির্মাণকাজ শুরু হওয়া এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ফ্রান্সের ফ্লামেনভিলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ খরচ ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পর পাঁচ গুণ বেড়েছে; কিন্তু নির্মাণকাজ এখনো শেষ হয়নি [৬]। ক্রমাগত বাড়তে থাকা খরচের চাপে পিষ্ট হয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকারী কোম্পানি জাপানের তোশিবা আর ফ্রান্সের আরিভা উভয়েই ২০১৭ সালে দেউলিয়াত্বের খাতায় নিজেদের নাম লিখিয়েছে [৭]।
চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞ স্তিমিত হয়ে পড়ে। আর ২০১১ সালে জাপানে ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পর জার্মানি ২০২২ সালের মধ্যেই চালু থাকা সব পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেয়, তাইওয়ান এবং বেলজিয়াম ২০২৫ সাল নাগাদ সম্পূর্ণ বন্ধ এবং ফ্রান্স ২০৩৫ সাল নাগাদ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়ামের সবচেয়ে বেশি পরিমাণ মজুতের মালিক অস্ট্রেলিয়া কোনো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ না করার নীতি গ্রহণ করেছে। অতিরিক্ত খরচ আর নিরাপত্তাহীনতার কারণে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ দেশগুলো যখন পারমাণবিক বিদ্যুৎকে বিদায় জানাচ্ছে, তখন ঠিক কী কারণে বাংলাদেশ রূপপুরে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজ শুরু করল, তা পরিষ্কার নয়।
চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞ স্তিমিত হয়ে পড়ে। আর ২০১১ সালে জাপানে ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পর জার্মানি ২০২২ সালের মধ্যেই চালু থাকা সব পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেয়, তাইওয়ান এবং বেলজিয়াম ২০২৫ সাল নাগাদ সম্পূর্ণ বন্ধ এবং ফ্রান্স ২০৩৫ সাল নাগাদ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়ামের সবচেয়ে বেশি পরিমাণ মজুতের মালিক অস্ট্রেলিয়া কোনো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ না করার নীতি গ্রহণ করেছে।
২০১৮ সালে পুরো পৃথিবীতে চালু থাকা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে সর্বমোট দুই হাজার ৫৬৩ টেরাওয়াট-আওয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে, যা এর পূর্ববতী বছরের তুলনায় ২.৪ শতাংশ বেশি। এর একমাত্র কারণ, শুধু চীনেই এক বছরে ৪৪ টেরাওয়াট-আওয়ার পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। অন্যভাবে বললে বলা যায় যে, ২০১৮ সালে চীনের বাইরে বৈশ্বিক যে পরিমাণ পারমাণবিক বিদ্যুৎ যুক্ত হয়েছে তারচেয়ে বেশি কমেছে ২০১৫-১৭ সময়কালে। তবে ১৯৯৬ সালের পর পুরো বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থায় বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক বিদ্যুতের ভাগ কমেছে ধারাবাহিকভাবেই। ১৯৯৬ সালে ১৭.৫ শতাংশ বিদ্যুৎ এসেছিল পারমাণবিক ব্যবস্থা থেকে, ২০১৮ সালে তা কমে এসে দাঁড়ায় ১০.১৫ শতাংশে। ২০১৮ সালে ১৪টি দেশে এ বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে আর কমেছে ১২টি দেশে, অপরিবর্তিত রয়েছে ৫টি দেশে এবং ৬টি দেশে (চীন, হাঙ্গেরি, মেক্সিকো, পাকিস্তান, রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে [৮]।
ভারতের অভিজ্ঞতা
১৯৫০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ায় যখন পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনযজ্ঞ শুরু হয় তখন থেকেই এই ইন্ডাস্ট্রি ভর্তুকিনির্ভর। তখন ভর্তুকি প্রদান করা হতো এই বলে যে, সামনের দিনগুলোয় এই প্রযুক্তির এতটাই উন্নতি হবে যে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেয়ে বিল হিসাব করাটা বেশি খরচের হবে। যদিও জনগণের টাকা ভর্তুকির নামে এই খাতে অপচয় শেষ হয়নি। উদাহরণ হিসেবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কথা উল্লেখ করা যায়। সেখানে ২০০২-০৩ সালে পারমাণবিক প্রযুক্তি উন্নয়নকল্পে ৩৩.৫ বিলিয়ন রুপি বরাদ্দ দেওয়া হয়, বিপরীতে মাত্র ৪.৭ বিলিয়ন রুপি বরাদ্দ হয় সৌর, বায়ু, ছোট আকারের জলবিদ্যুৎ এবং বায়োমাস প্রযুক্তির উন্নয়নে। অথচ, পারমাণবিকের ওপর এই ধারাবাহিক অকারণ পক্ষপাত আর নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রতি এই বিমাতাসুলভ আচরণ সত্ত্বেও ভারতে বর্তমানে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৬ হাজার ৭৮০ মেগাওয়াট এবং বৃহদাকার জলবিদ্যুৎ ব্যতীতই নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ৯০ হাজার মেগাওয়াট [৯]।
ভারতের কথা উল্লেখ করা যায়। সেখানে ২০০২-০৩ সালে পারমাণবিক প্রযুক্তি উন্নয়নকল্পে ৩৩.৫ বিলিয়ন রুপি বরাদ্দ দেওয়া হয়, বিপরীতে মাত্র ৪.৭ বিলিয়ন রুপি বরাদ্দ হয় সৌর, বায়ু, ছোট আকারের জলবিদ্যুৎ এবং বায়োমাস প্রযুক্তির উন্নয়নে। অথচ, পারমাণবিকের ওপর এই ধারাবাহিক অকারণ পক্ষপাত আর নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রতি এই বিমাতাসুলভ আচরণ সত্ত্বেও ভারতে বর্তমানে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৬ হাজার ৭৮০ মেগাওয়াট এবং বৃহদাকার জলবিদ্যুৎ ব্যতীতই নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ৯০ হাজার মেগাওয়াট
সুলভ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিগত কয়েক যুগ ধরে বিপুল পরিমাণ টাকা ঢালা হলেও ভারত সেই সস্তা বিদ্যুৎ আজও উৎপাদন করতে পারেনি; যদিও পারমাণবিক প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি দ্বারা প্রাণ-প্রকৃতি-জল-জমি-জঙ্গল আক্রান্ত হয়েছে স্পষ্টভাবেই। অবশ্য নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে বিদ্যমান ঝুঁকি শনাক্তকরণ, ইতোমধ্যে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলোর কারণ অনুসন্ধান এবং এর পরিবেশ ও প্রতিবেশগত প্রতিক্রিয়া অনুসন্ধান ও পূর্ণাঙ্গ কার্যকারণ জনসমক্ষে প্রকাশে আগ্রহ ছিল না কোনো কালেই। আর এ কারণেই পরমাণু স্থাপনা নিরাপদকরণে ১৯৭৯, ১৯৮৬ এবং ১৯৯৫ সালে ভারত সরকার কর্তৃক গঠিত কমিটির সুপারিশগুলোও সেখানে পড়ে আছে লালফিতা বন্দি অবস্থায়। কারণ, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ‘নিরাপদ’ পরমাণু কেন্দ্রগুলোকে আরও ‘নিরাপদ’ করতে হাজার হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচের সিদ্ধান্ত। অথচ, অপরদিকে ভারতে ১৯৯৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত পারমাণবিক স্থাপনায় কর্মরত ১,৭৩৩ জন বিজ্ঞানী এবং কর্মচারী ক্যানসার, হৃদরোগ এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অকেজো হয়ে মারা গেছেন যাদের বেশিরভাগের বয়স ছিল ২৯ থেকে ৫০ বছর [১০]। এ তো শুধু নিবন্ধিত মৃত্যুসংখ্যার হিসাব! কিন্তু পারমাণবিক স্থাপনাগুলো যেসব অঞ্চলে অবস্থিত সেখানকার মাটি, পানি, বায়ুর গুণগত কী পরিবর্তন হচ্ছে, এই পরিবর্তন মানুষসহ পুরো জীববৈচিত্র্যকে কীভাবে প্রভাবিত করছে, ওইসব অঞ্চলে কী হারে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হচ্ছে, বছরপ্রতি কতজন মানুষ ক্যানসার আক্রান্ত হচ্ছেন, কতজন মানুষ পারমাণবিক দূষণে মারা যাচ্ছেন–এসবের কোনো পূর্ণাঙ্গ রেকর্ড নেই। কারণ, এই ক্ষতির সঠিক হিসাবের তালিকা প্রকাশ করা হলে হয়তো পারমাণবিক বিদ্যুৎকে কোনো কাঠমূর্খের কাছেও নিরাপদ বলে জাহির করা যাবে না।
পাশ্ববর্তী দেশ হিসেবে ভারতের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় কী ঘটছে, তা জানা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এই জরুরি বিশ্লেষণে স্মরণ নেওয়া যায় ভারতের ইকোনমিক ও পলিটিক্যাল উইকলি ম্যাগাজিনের ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১০ সংখ্যায় প্রকাশিত এমভি রামানা ও আশ্বিন কুমার-এর ‘Safety First? Kaiga and Other Nuclear Stories’ শিরোনামের লেখাটির। ‘সর্বজনকথা’ পত্রিকার জন্য লেখাটি অনুবাদ করেছিলেন প্রকৌশলী কল্লোল মোস্তফা [১১]।
বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ: পটভূমি, প্রচারণা, নীতিমালা ও বাস্তবতা
বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন বিষয়ে গত কয়েক বছরে (বিশেষ করে ২০০৯ সালের পর থেকে) সরকারের নানাবিধ তৎপরতা জোরালো হয়েছে। সরকারের তরফে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা, জীবাশ্ম জ্বালানির সংকট, নিম্ন বা শূন্য মাত্রার কার্বন নিঃসরণ, পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরা ইত্যাদিকে এ তৎপরতার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে [১২]। সেজন্য পাবনার অদূরে রূপপুরে ১২০০ মেগাওয়াটের দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইউনিট স্থাপনের কর্মতৎপরতা অব্যাহত আছে। এই আলোচনার শুরুতেই আমরা বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পটভূমি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব। সেইসঙ্গে এই প্রযুক্তি ব্যবহার সংশ্লিষ্ট দিক এবং অপরাপর বিষয়গুলোর ওপর আলোচনাপূর্বক একটা সারমর্ম দাঁড় করানো হবে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র: পটভূমি
বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি কমিশন এবং World Nuclear Association কর্তৃক প্রকাশিত ওয়েবপেজে বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পটভূমি, অতীত এবং কর্মতৎপরতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। ষাটের দশকের শুরুতে প্রথম তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ৭০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রস্তাব করা হয়। ১৯৬৩ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে পাবনার অদূরে রূপপুরে ১২৫ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন দেওয়া হয় এবং জমি অধিগ্রহণ করা হয়। কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানো হয়নি। ২০০১ সালে ‘National Nuclear Action Plan’ গৃহীত হয় এবং ২০০৫ সালে চীনের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি কমিশন ৫০০, ৬০০ বা ১০০০ মেগাওয়াটের বৃহৎ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং তার ব্যয় প্রস্তাব করে। ২০০৮ সালে সরকার চীনের সঙ্গে কাজ করার অবস্থান থেকে সরে আসে। রাশিয়া, চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়া এর আগে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা করতে চেয়েছিল। ২০০৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে রাশিয়া দুটি ১০০০ মেগাওয়াটের VVER 1000 মডেলের রি-অ্যাকটর প্রস্তাব করে এবং রি-অ্যাকটরগুলোর প্রতিটির মূল্য নির্ধারণ করা হয় দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১০ এবং ২০১১ সালে বাংলাদেশ এবং রাশিয়ান সরকারের মধ্যে প্ল্যান্ট নির্মাণ, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, আনুষঙ্গিক গবেষণা ইত্যাদি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় [১৩, ১৪]।
২০১৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত জানা যাচ্ছিল যে, রূপপুরের জন্য VVER 1000 মডেলের রি-অ্যাকটর বাছাই করা হয়েছে এবং সে সম্পর্কিত তথ্য, বিশ্লেষণ পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছিল। পরবর্তী সময়ে VVER 1000-এর পাশাপাশি VVER 1200 এবং VVER TOI-এর প্রস্তাব করা হয়। যেহেতু VVER TOI এখনো কনস্ট্রাকশন লাইসেন্স পায়নি এবং VVER 1200, VVER 1000-এর তুলনায় আপেক্ষিকভাবে অধিক নিরাপত্তাব্যবস্থা সংবলিত হওয়ায় বাংলাদেশ সরকার VVER 1200-কে বেছে নেয় [১৫]। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, VVER 1200 জেনারেশন ৩+ মডেলের। যদিও তথাকথিত জেনারেশন ৩ এবং ৩+ মডেলের রি-অ্যাকটর পৃথিবীর অন্য আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করে [১৬], কিন্তু রাশিয়ান কোম্পানি ROSATOM-এর VVER 1000 বা VVER 1200 ব্যতীত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও দরপত্র আহ্বান করে যাচাই-বাছাই করা হয়েছিল কি না, সে সম্পর্কিত তথ্য পত্র-পত্রিকা থেকে পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বিষয়ক চুক্তির বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন বিশিষ্টজন এ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করেছেন। একই রাশিয়ান কোম্পানি ROSATOM-এর সহযোগিতায় সাম্প্রতিক কালে ভারতের কুদানকুলামে জেনারেশন ৩ মডেলের VVER 1000 স্থাপন এবং চালু করা হয়েছে। কুদানকুলামের অভিজ্ঞতা নিয়ে রূপপুরে VVER 1200 মডেলের রি-অ্যাকটরের ফলাফল কী হতে পারে, তা নিয়ে ভারতীয় এবং বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞরা যৌথভাবে পত্রিকায় মতামত তুলে ধরেছিলেন। বিশেষজ্ঞরা দেখিয়েছেন, কুদানকুলামে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজের বিভিন্ন ধরনের ত্রুটির জন্য প্ল্যান্টের লাইফ-টাইম, ক্রেনের ভারবহন ক্ষমতা ইত্যাদি সীমিত করতে হয়েছে। এছাড়াও কমিশনিং পর্যায়ের বিভিন্ন ত্রুটি তুলে ধরা হয়েছে [১৭]। এছাড়া পারমাণবিক বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি উৎপাদন ও জোগানদানকারী কোম্পানির জোচ্চুরি একটা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। দুর্নীতি আর সস্তা যন্ত্রপাতি গছিয়ে দেওয়ার অভিযোগে কয়েক বছর আগে রাশিয়ান কোম্পানি রোসাটম-এর সাবসিডিয়ারি জিও-পোডলস্কের ডিরেকটর সার্গেই সুটভকে গ্রেফতার করা হয়। এই একই কোম্পানি ভারতের কুন্দানকুলাম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে যন্ত্রপাতি সাপ্লাইয়ের কাজে যুক্ত ছিল [১৮]।
দুর্নীতি আর সস্তা যন্ত্রপাতি গছিয়ে দেওয়ার অভিযোগে কয়েক বছর আগে রাশিয়ান কোম্পানি রোসাটম-এর সাবসিডিয়ারি জিও-পোডলস্কের ডিরেকটর সার্গেই সুটভকে গ্রেফতার করা হয়। এই একই কোম্পানি ভারতের কুন্দানকুলাম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে যন্ত্রপাতি সাপ্লাইয়ের কাজে যুক্ত ছিল।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞরাও ২০১৩ সাল থেকেই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বিষয়ে তাদের উদ্বেগ তুলে ধরছেন। তারা বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের নিজস্ব উপযুক্ত দক্ষ জনশক্তি না-থাকা, নিজেদের গবেষণা এবং গবেষণালব্ধ জ্ঞান না-থাকা, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কিত বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা না-থাকা ইত্যাদিকে সীমাবদ্ধতা হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশ সরকারকে এই প্রজেক্ট থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছেন। পরবর্তী সময়ে দায়মুক্তি বিল, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, দুর্ঘটনা, আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা প্রকাশ করেও অনেকেই আশঙ্কা পুনর্ব্যক্ত করেছেন [১৯, ২০]। এমনকি মূল নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার আগেই প্রজেক্টের বিভিন্ন কাজে রাশিয়ান কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলা এবং অনিয়মের কথাও পত্রিকায় এসেছে [২১]।
এতকিছুর পরও বাংলাদেশের সামগ্রিক বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনায় নিউক্লিয়ারভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা চলছে। পিএসএমপি ২০১৬-তে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০৪১ সালের মধ্যে ১০ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। আমদানি করা এলএনজি ও প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে উৎপাদন হবে ৩৫ ভাগ এবং কয়লা থেকে আসবে ৩৫ ভাগ বিদ্যুৎ (পিএসএমপি ২০১৬ এবং রিভিজিটিং পিএসএমপি ২০১৬ অনুসারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উৎসভিত্তিক তুলনামূলক ছক এই ক্রোড়পত্রের পরবর্তী আলোচনায় যুক্ত করা হয়েছে)। অন্যদিকে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম-এ বাংলাদেশে ২০৫০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন করার অঙ্গীকার করেছে [২২]।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনাগত আলোচনা
বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের আগে সাইট, নির্মিতব্য সুনির্দিষ্ট প্ল্যান্ট ও প্রযুক্তির বিবেচনায় Environmental Impact Assessment (EIA) রিপোর্ট করা, তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে EIA রিপোর্ট যাচাই-বাছাই করা এবং এসব রিপোর্ট জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা অত্যাবশ্যকীয়। কিন্তু VVER 1200-এর সাপেক্ষে রূপপুরের EIA রিপোর্ট আদৌ করা হয়েছে কি না, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কারণ, এরকম কোনো রিপোর্ট বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়নি বা জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক পত্রিকায় এ সংক্রান্ত কোনো খবর আসেনি। EIA রিপোর্ট প্রস্তুত করা হলে, অনুমোদিত হলে এবং প্রকাশিত হলে অথবা সংশ্লিষ্ট রেগুলেটরি কমিটিগুলো দ্বারা যাচাই-বাছাইয়ের রিপোর্টের মাধ্যমে VVER 1200 রি-অ্যাকটর এবং এর নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানা যেত। কিন্তু বাংলাদেশে নির্মিতব্য পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে জনগণকে এ বিষয়ে অন্ধকারে রাখা হয়েছে। সংবাদকর্মীরা রাশিয়ার পারমাণবিক প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা পেতে সেখানকার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ঘুরে এসেছেন। পত্রিকার রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, সাংবাদিকরা রাশিয়ায় ঘুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে কিছু মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে ফিরেছেন [২৩]। যেমন: রাশিয়ার নিউক্লিয়ার রি-অ্যাকটর কতটা নিরাপদ, VVER 1200-এর সুবিধা কী, রি-অ্যাকটর বহনের ফিজিবিলিটি টেস্ট কীভাবে করা হবে বা কীভাবে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন হবে ইত্যাদি। এসব প্রশ্ন নিয়ে রাশিয়ার নিয়োজিত কর্মকর্তাদের তারা প্রশ্ন করেছেন। অথচ এর বিপরীতে সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর এখনো সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। ইতোমধ্যেই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, পরিচালনা, লোকবল প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এমনকি বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করার বিধান রেখে ভারতের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যদিও নিজ দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের রি–অ্যাক্টর থেকে শুরু করে প্রায় সবকিছুর জন্যই ভারত রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল [২৪]।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, পরিচালনা, লোকবল প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এমনকি বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করার বিধান রেখে ভারতের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যদিও নিজ দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের রি–অ্যাক্টর থেকে শুরু করে প্রায় সবকিছুর জন্যই ভারত রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল।
তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
পারমাণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছিলেন যে, রাশিয়া স্পেন্ট ফুয়েল নিলেও নিম্ন বা মধ্যম মানের তেজস্ক্রিয় বর্জ্য রূপপুরেই সংরক্ষণ করতে হবে। এ বিষয়ে গত ২৭ নভেম্বর ২০১৬ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ‘স্পেন্ট ফুয়েল ফেরত নেওয়ার অর্থ হলো, তা ফেরত নিয়ে পরিশোধন করে পাওয়া পুনরায় ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি ও অবশিষ্ট অতিমাত্রায় তেজস্ক্রিয় পারমাণবিক বর্জ্য আবার বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দেওয়া। এ কাজটি তাঁরা করবে চুক্তিবদ্ধ অর্থের বিনিময়ে। আর পারমাণবিক বর্জ্য ফেরত নেওয়ার অর্থ হচ্ছে, স্পেন্ট ফুয়েল পরিশোধন করে তা থেকে পাওয়া ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি ফেরত দিয়ে অবশিষ্ট বর্জ্য রেখে দেওয়া। রাশিয়ার বিদ্যমান আইন আনুযায়ী সেটা তাঁরা করতে পারে না। তাই তেমন কোনো কথা তাঁরা কখনো বলেওনি। এমন কোনো চুক্তিও তাঁরা এখন পর্যন্ত সই করেননি।’ [২৫]
এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আবদুল মতিন বলেন যে, ‘তেজস্ক্রিয় জ্বালানি বর্জ্য অত্যন্ত সুরক্ষিত ব্যবস্থায় সংরক্ষণ করতে হয়। এ জন্য এমন একটি বিচ্ছিন্ন স্থান প্রয়োজন হয়, যেখানে কখনো কোনোভাবে পানি যাবে না। সাধারণত মাটির অনেক নিচে জলাধার তৈরি করে সেখানে শক্তিশালী কংক্রিট দিয়ে ঘিরে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য সংরক্ষণ করতে হয়। অনেক বছর ধরে তার ধারে কাছে কোনো মানুষের আনাগোনা চলে না। যদিও একসময় এই জ্বালানি পুনরায় ব্যবহার করা যায়; কিন্তু এর সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা আলাদা একটি বিশেষায়িত স্থাপনা নির্মাণ ও সংরক্ষণ করার মতো। এতে যেমন ব্যয় আছে, তেমনি আছে ঝুঁকি।’ [২৬]
এরপর ৩০ আগস্ট, ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক সরকারী প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এবিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের কথা বলা হয় এভাবে যে, ‘… রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পারমাণবিক বর্জ্য বাংলাদেশ থেকে রাশিয়া সে দেশে ফেরত নিয়ে যাবে। রাশিয়া এই পারমাণবিক বর্জ্য সে দেশে ফেরত নেয়ার পর পুনঃ প্রক্রিয়াকরণ এবং পুনঃপ্রক্রিয়াজাত পদার্থের ব্যবস্থাপনাসহ বর্জ্য সংরক্ষণ করবে।’ [২৬ (ক)] কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনাগত বিষয়ক উদ্বেগ এবং প্রশ্নগুলো এরূপ দায়সারা প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঝেড়ে ফেলা যায় না। কেননা প্রশ্ন থেকেই যায় যে, রাশিয়া কি সকল ধরনের তেজস্ক্রিয় বর্জ্য নিজ দেশে নিয়ে যাবে? নাকি কেবলমাত্র অতি তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ফেরত নিবে? রাশিয়া কি বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া বর্জ্য অনন্তকালের জন্য সংরক্ষণ করবে? নাকি একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সংরক্ষণ করে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা নির্দিষ্ট মাত্রায় নেমে আসলে তা আবার বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে? বর্জ্য সংরক্ষণের মত জটিল এবং ব্যয়বহুল কাজটি কি রাশিয়া নিজ খরচে করবে নাকি বাংলাদেশকে সকল খরচ বহন করতে হবে? এ খরচের পরিমাণ কত? অর্থের যোগান কোথা থেকে আসবে? এই খরচ কী উৎপাদিত বিদ্যুৎ মূল্যের সাথে হিসাব করা হয়েছে? স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুরো কাজ সম্পাদন হতে থাকলে এই প্রশ্নগুলোর জবাব প্রকল্প কাজের শুরুতেই সর্বজনের নিকট খোলাশা করে প্রকাশ হবার কথা ছিল। কিন্তু এগুলো এখনও খোলাশা হয়নি।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনাগত বিষয়ক উদ্বেগ এবং প্রশ্নগুলো এরূপ দায়সারা প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঝেড়ে ফেলা যায় না। কেননা প্রশ্ন থেকেই যায় যে, রাশিয়া কি সকল ধরনের তেজস্ক্রিয় বর্জ্য নিজ দেশে নিয়ে যাবে? নাকি কেবলমাত্র অতি তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ফেরত নিবে? রাশিয়া কি বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া বর্জ্য অনন্তকালের জন্য সংরক্ষণ করবে? নাকি একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সংরক্ষণ করে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা নির্দিষ্ট মাত্রায় নেমে আসলে তা আবার বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে? বর্জ্য সংরক্ষণের মত জটিল এবং ব্যয়বহুল কাজটি কি রাশিয়া নিজ খরচে করবে নাকি বাংলাদেশকে সকল খরচ বহন করতে হবে? এ খরচের পরিমাণ কত? অর্থের যোগান কোথা থেকে আসবে? এই খরচ কী উৎপাদিত বিদ্যুৎ মূল্যের সাথে হিসাব করা হয়েছে?
পানি ব্যবস্থাপনা
রূপপুর পাওয়ার প্ল্যান্টের পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা অর্থাৎ শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থায় কী পরিমাণ পানি লাগবে, শুষ্ক মৌসুমে নদীর সর্বনিম্ন পানির সরবরাহ কত থাকবে, পানির সরবরাহ নিশ্চিত রাখার জন্য ভারতের সঙ্গে সুনির্দিষ্ট কোনো চুক্তি হবে কি না, দুর্ঘটনাজনিত কারণে কী পরিমাণ অতিরিক্ত পানি লাগবে, তার সরবরাহ হবে কী করে ইত্যাদি খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন হিসেবে সামনে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে এসবের কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের হিসাবে দেখা যায় যে, দুই হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কুলিং টাওয়ারের কনডেন্সার সিস্টেমে সার্কুলেশনের জন্য সবসময় পানি থাকা লাগবে চার লাখ ৫৫ হাজার গ্যালন পার মিনিট বা জিপিএম। ক্লোজ লুপ কুলিং সিস্টেমে এই পরিমাণ পানি নদী থেকে উত্তোলন করে ক্লোজ লুপে ঢোকানোর পর যেটুকু পানি বাষ্পীভবনসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় লস হবে সেইটুকু পানি (মেকআপ ওয়াটার) নদী থেকে প্রতিনিয়ত সংগ্রহ করতে হবে যার পরিমাণ ৫০ হাজার ৬৫০ গ্যালন পার মিনিট (জিপিএম) বা ১১৫ কিউবিক ফুট পার সেকেন্ড (কিউসেক)। এছাড়া দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি (সার্ভিস ইকুইপমেন্ট) ঠান্ডা করার জন্য নদী থেকে সরাসরি প্রতিনিয়ত এক লাখ চার হাজার গ্যালন পার মিনিট (জিপিএম) বা ২৩০ কিউসেক পানি উত্তোলন করতে হবে, যেই পানিটুকু আবার উষ্ণ অবস্থায় নদীতে ছেড়ে দেওয়া হবে। এর অর্থ হচ্ছে, দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের কুলিং টাওয়ারের মেকআপ ওয়াটার আর সার্ভিস কুলিং ওয়াটার মিলে পদ্মা নদী থেকে সর্বক্ষণ পানি তুলতে হবে ন্যূনতম ১১৫+২৩০=৩৪৫ কিউসেক বা এক লাখ ৫৫ হাজার জিপিএম।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১২ বছরের পানিপ্রবাহের তথ্য থেকে দেখা যায় যে, পদ্মা নদীতে গড় ন্যূনতম পানিপ্রবাহ ২২ হাজার ৩০০ কিউসেক। ফলে ২২ হাজার ৩০০ কিউসেক থেকে ৩৪৫ কিউসেক পানি তোলায় সাধারণভাবে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু মুশকিল হলো গড় ন্যূনতম প্রবাহ ২২ হাজার ৩০০ কিউসেক হলেও অনেক সময় পানিপ্রবাহ হঠাৎ করে এই গড়ের চেয়ে অনেক কমে যায়। যেমন, ২০১১ সালের মে মাসে পানিপ্রবাহ তিন হাজার ১০০ কিউসেক হয়ে গিয়েছিল। পানিপ্রবাহ যদি ভবিষ্যতে তিন হাজার ১০০ কিউসেক বা তার চেয়ে কমে যায়, তখন পদ্মা নদী থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৩৪৫ কিউসেক পানি উত্তোলন করা কঠিন হয়ে যেতে পারে, যা পুরো বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ঠেলে দিতে পারে [২৭]।
কুলিং টাওয়ার নিজেও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর [২৮], তা মোকাবিলা করা হবে কীভাবে, কুলিং টাওয়ারের ফিড ওয়াটারে তেজস্ক্রিয় পদার্থ কী পরিমাণ থাকবে, তাকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে কী করে, বাতাসের সঙ্গে কুলিং টাওয়ারের পানির মাধ্যমে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে কি না–এই সবকিছুর ব্যাখ্যা এখনো অপ্রকাশিত। আবার প্রতিবছরই তাপমাত্রার তারতম্য বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ইউরোপ, আমেরিকার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে, কুলিং টাওয়ার ইউরোপ, আমেরিকার প্যারামিটারে হিসাব করে নির্ধারণ করাও যৌক্তিক হবে না; বরং আমদানিকৃত প্রযুক্তির খুঁটিনাটি বিষয়াদি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
গবেষণা এবং নিজস্ব জনবল তৈরি
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জনবল তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনায় যারা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে তাদের পাঁচ বছর মেয়াদি এবং যারা নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেছে তাদের তিন বছর মেয়াদি কোর্স করানো হবে। রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ২৫৩৫ জন জনবলের প্রয়োজন হবে বলে প্রকল্পের সঙ্গে জড়িতরা জানিয়েছেন। এর মধ্যে রাশিয়া ১৪২৪ জনকে প্রশিক্ষণ দেবে। রূপপুর প্ল্যান্টের পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তা নিশ্চিত, তেজস্ক্রিয়তামূলক নিরাপত্তা, ইনস্ট্রুমেন্টশন, ফুয়েল হ্যান্ডলিং–বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে তারা কাজ করবে [২৯]। ধারণা করা যায়, বাকিদের হয়তো ভারতে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, তিন বা পাঁচ বছর মেয়াদি একাডেমিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে একটি নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রের রি-অ্যাকটর কোর, প্রাইমারি কনটেইনমেন্ট, সেকেন্ডারি কনটেইনমেন্ট, অ্যাকটিভ-প্যাসিভ কুলিং সিস্টেম, কোর ক্যাচার প্রভৃতি উচ্চ ও সূক্ষ্ম প্রযুক্তির ডিজাইন জ্ঞান অর্জন এবং তাকে কাজে লাগানোর মতো যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করা কি সম্ভব হবে? বা রাশিয়া থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে কি রাশিয়ান প্রযুক্তিকে ক্রিটিক্যাল অ্যানালাইসিস করা সম্ভব হবে? বাস্তবিকপক্ষে নিজেদের স্বাধীন গবেষণালব্ধ জ্ঞান ছাড়া তা সম্ভব হওয়ার কথা না। এছাড়া রূপপুর প্রকল্পের জনবলের মাসিক বেতন, পরিবহণ সংক্রান্ত ব্যয়ের প্রস্তাবও ইতোমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে [৩০]।
অর্থনৈতিক দিক
২০০৯ সালে প্রকল্পের ব্যয় বলা হয়েছিল তিন থেকে চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার [৩১]। পরবর্তী সময়ে এই প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২.৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার [৩২]। আপাতত প্রকল্পের একটি ইউনিটের নির্মাণকাজ ২০১৭ থেকে শুরু হয়ে ২০২১ বা ২০২২ এবং অপর ইউনিটের কাজ ২০১৮ থেকে শুরু হয়ে ২০২২ বা ২০২৩-এ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু প্রকল্প নির্মাণের সময়কাল বৃদ্ধি পেলে এবং ‘কস্ট প্লাস’ মডেলে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রকল্পের সময়কাল বৃদ্ধি পেয়ে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার অনেক নজির রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের হিসাবে নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের গড় নির্মাণ কাল ৭.৫ বছর [৩৩]। এখন পর্যন্ত প্রাক্কলিত এই ১২.৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে ১১.৩৮ বিলিয়ন ডলার রাশিয়া ঋণ দেবে, বাকি অর্থ দেবে বাংলাদেশ সরকার নিজে। ঋণ পরিশোধ করার সময়কাল ২০ বছর এবং গ্রেস পিরিয়ড ১০ বছর। ঋণের সুদ দিতে হবে ১.৭৫% + LIBOR রেট। সর্বোচ্চ সুদের হার ৪%। এক হিসাবে বিশেষজ্ঞরা দেখিয়েছেন: নির্মাণ খরচ, জ্বালানির খরচ, রক্ষণাবেক্ষণ প্রভৃতি খরচ যোগ করলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়বে ৭.৫০ থেকে ৮.৫০ টাকা পর্যন্ত [৩৪, ৩৫]। সাবেক অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী বর্তমানে দেশের ঋণের পরিমাণ ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা বর্তমান হারে বৃদ্ধি পেলে পাঁচ বছর পর ৩০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে। রাশিয়ার ঋণ যুক্ত হলে এই ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার [৩৬]।
ব্যাপক সরকারি ভর্তুকি ছাড়া পরমাণু বিদ্যুৎ বাজার অর্থনীতিতে টিকে থাকতে পারে না।
ব্যাপক সরকারি ভর্তুকি ছাড়া পরমাণু বিদ্যুৎ বাজার অর্থনীতিতে টিকে থাকতে পারে না। নির্মাণ, তেজস্ক্রিয় বর্জ্য সমস্যা সমাধানের খোঁজসহ গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য ঋণ নিশ্চয়তাও যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের ভর্তুকিতে অন্তর্ভুক্ত থাকে। যে কোনো ধরনের বড় বিপর্যয়ের সময়, প্রাইস-এন্ডারসন অ্যাক্ট অনুযায়ী নিউক্লিয়ার ইন্ডাস্ট্রিকে জানমালের ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাৎক্ষণিকভাবে প্রথম ১০ বিলিয়ন ডলার দিতে হয়, যা সাধারণত তাদের মোট দায়মূল্যের ভগ্নাংশ মাত্র এবং যার বাকি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের আয়করদাতাদেরই নির্বাহ করতে হয় [৩৭]। ১৯৮২ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউক্লিয়ার রেগুলেটরি কমিশন-এর পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি CRAC2 রিপোর্ট অনুযায়ী পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারপাশে জনসংখ্যার ঘনত্ব সাপেক্ষে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে, যা আজকের হিসাবে ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১৫ কিলোমিটার এলাকার মধ্যেই বসবাস করে ৩০ লাখ মানুষ) [৩৮]।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চল্লিশ বছর সময়কালে আনুমানিক ২৬ বার রিফুয়েলিং ও মেরামতে প্রতিবার খরচ হবে আনুমানিক ১০০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন ডলার এবং চল্লিশ বছর ধরে প্রতিবছর এর পরিচালন ব্যয় আসবে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার [৩৯]। চুক্তি অনুযায়ী কোনো কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা রাশিয়ার বা রোসাটমের নেই। উল্টো কাজের মাঝ পর্যায়ে যদি কোনো দুর্ঘটনায়ও কাজ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলেও পুরো প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত ঋণের অর্থ বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হবে। অর্থাৎ, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিকেন্দ্রিক নিয়ত ঝুঁকির বিষয়টি বাদ দিলেও এই বিদ্যুৎ উৎপাদনী পুরো আয়োজন অথনৈতিক দিক থেকেও বাংলাদেশের জন্য লাভজনক তো নয়ই; বরং ভবিষ্যতের জন্য বিশাল এক বোঝা হয়ে চেপে বসতে যাচ্ছে।
চুক্তি অনুযায়ী কোনো কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা রাশিয়ার বা রোসাটমের নেই। উল্টো কাজের মাঝ পর্যায়ে যদি কোনো দুর্ঘটনায়ও কাজ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলেও পুরো প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত ঋণের অর্থ বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হবে। অর্থাৎ, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিকেন্দ্রিক নিয়ত ঝুঁকির বিষয়টি বাদ দিলেও এই বিদ্যুৎ উৎপাদনী পুরো আয়োজন অথনৈতিক দিক থেকেও বাংলাদেশের জন্য লাভজনক তো নয়ই; বরং ভবিষ্যতের জন্য বিশাল এক বোঝা হয়ে চেপে বসতে যাচ্ছে।
কার্বন নিঃসরণ ও অন্যান্য ব্যয়
নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রায়শই যুক্তি হিসেবে বলা হয় যে, জীবাশ্ম জ্বালানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হলে কার্বন নিঃসরণ মারাত্মক আকার ধারণ করে যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। দাবি করা হয়, নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থায় কার্বন নিঃসরিত হবে না। যদিও এই দাবি প্রশ্নসাপেক্ষ। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি অনুসারে ২০৫০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক নির্গত কার্বনের পরিমাণ দাঁড়াবে ৬৪ গিগাটন [৪০]। ওয়ার্ল্ড নিউক্লিয়ার অ্যাসোসিয়েশন-এর দাবি অনুসারে বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ বৃদ্ধি ও বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকাবিলায় ২০৫০ সালের মধ্যে এক হাজার নতুন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে। অথচ, অপরদিকে নিউক্লিয়ার ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন-এর হিসাব অনুযায়ী এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সম্মিলিতভাবে ২০৫০ সাল নাগাদ মাত্র ৩.৯ গিগাটন কার্বন নিঃসরণ কমাতে পারবে, যা কিনা ৬৪ গিগাটনের মাত্র ৬.১ শতাংশ। আর এই ৬.১ শতাংশ নির্গমন কমাতে অন্যান্য ক্ষতি, অপচয় আর ঝুঁকি বাদ দিয়ে শুধু নির্মাণব্যয়ই হবে আট হাজার ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আদতে কোনো সমাধান নয় [৪১]!
এছাড়াও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঘটলে দুর্ঘটনাকবলিত এলাকা থেকে লোকজনকে সরাতে হলে তাদের পুনর্বাসনের প্রয়োজন হবে। এত বিপুল জনগোষ্ঠীকে কীভাবে দ্রুত সরানো হবে, তার পরিকল্পনা অনুপস্থিত। তেজস্ক্রিয় পদার্থ বাতাস বা পানির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ছড়িয়ে পরা তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা নির্ধারণ, তার পরিমাপক, নিরাপত্তাজনিত বিভিন্ন প্রযুক্তি ইত্যাদির জন্য স্বাধীন রেগুলেটরি কমিটি থাকা প্রয়োজন। কিংবা রাশিয়ান কোম্পানির প্ল্যান্টের কার্যকারিতা যাচাই-বাছাই, নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুনঃপরীক্ষা করার জন্য তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি প্রয়োজন [৪২]। স্বাধীন তৃতীয় পক্ষের অনুপস্থিতি, দুর্ঘটনার আশঙ্কা, EIA না-করা, প্ল্যান্ট নির্মাণকাজ শুরুর আগেই কাজে অনিয়ম ইত্যাদি সমস্যাকে আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখার আবশ্যকতা তৈরি হয়েছে।
রোসাটমের মিথ্যা দাবি
২০১৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর রাশিয়ান কোম্পানি ‘রোসাটম’-এর দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত সিইও আন্দ্রেই শেভ্লাকোভ ‘Changing perceptions on nuclear energy’ শিরোনামে ডেইলি স্টার-এ একটি লেখা প্রকাশ করেন [৪৩]। সেই লেখায় উপস্থাপিত মিথ্যা সব দাবি এবং ভুলে ভরা বিশ্লেষণের প্রতিবাদস্বরূপ ২০১৮ সালের ২১ জানুয়ারি ডেইলি স্টারেই ‘Nuclear Power: Challenging Rosatom’s claims’ শিরোনামে লেখা প্রকাশিত হয় [৪৪]। শেভ্লাকোভ তার লেখায় দাবি করেছিলেন, তাঁর কোম্পানি ‘রোসাটম’ পরমাণু স্থাপনা নির্মাণে নিরাপত্তাকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় এবং এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি এজেন্সির (আইএইএ) নির্দেশনা মেনে চলে। আসলে কী?
আইএইএর গাইডলাইন অনুসারে যে কোনো নিউক্লিয়ার চুল্লির চারপাশের জায়গাকে দুটি স্তরে ভাগ করা হয়। প্রথম স্তরটি হচ্ছে Precautionary Action Zone, যা আশপাশের পাঁচ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত এবং দ্বিতীয় স্তরটি হচ্ছে Urgent Protective Action Planning Zone, যা কোনো চুল্লির আশপাশে ৩০ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত এবং কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে পুরো এলাকার সবাইকে ৩০ মিনিটের মধ্যে সতর্ক করে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকার কথা বলা হয়েছে, যাতে দ্রুত নিরাপদ স্থানে সবাইকে আশ্রয় নেওয়ার ব্যবস্থা করা যায় [৪৫]। পাবনা, ভেড়ামারা, লালপুর, কুষ্টিয়া, ঈশ্বরদীতে যারা বসবাস করছেন তারা সবাই রূপপুর পারমাণবিক চুল্লির ৩০ কিলোমিটার বলয়ের মধ্যেই থাকবেন। সরকারের তরফ থেকে কি এই এলাকার বাসিন্দাদের যে কোনো সময়ে উদ্ভূত জরুরি অবস্থা সম্পর্কে জানানো হয়েছে? আন্তর্জাতিক নিয়মাবলি মেনে কি কয়েক লাখ মানুষকে অতি দ্রুত সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি রাখা হবে? সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, ঘনবসতির বাংলাদেশে এই ধরনের প্রস্তুতি এবং কয়েক লাখ মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা রাখা আদৌ কি সম্ভব হবে?
পাবনা, ভেড়ামারা, লালপুর, কুষ্টিয়া, ঈশ্বরদীতে যারা বসবাস করছেন তারা সবাই রূপপুর পারমাণবিক চুল্লির ৩০ কিলোমিটার বলয়ের মধ্যেই থাকবেন। সরকারের তরফ থেকে কি এই এলাকার বাসিন্দাদের যে কোনো সময়ে উদ্ভূত জরুরি অবস্থা সম্পর্কে জানানো হয়েছে? আন্তর্জাতিক নিয়মাবলি মেনে কি কয়েক লাখ মানুষকে অতি দ্রুত সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি রাখা হবে? সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, ঘনবসতির বাংলাদেশে এই ধরনের প্রস্তুতি এবং কয়েক লাখ মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা রাখা আদৌ কি সম্ভব হবে?
পারমাণবিক বিদ্যুৎ নিয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বাংলাদেশ সরকার রূপপুরে দুটি ১২০০ মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইউনিটের নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার আগেই আরও দুটি ইউনিটের জন্য জায়গা নির্বাচন শুরু করেছে। প্রাথমিকভাবে পরবর্তী দুটি ইউনিটের জন্য সুন্দরবনের কাছে দুটি জায়গাসহ মোট কয়েকটি জায়গা নির্বাচন করা হয়েছে [৪৬]। Power System Master Plan-2016 অনুযায়ী সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে ৬টি রি-অ্যাকটর থেকে ৭২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদন করতে চায় (পিএসএমপি ২০১৬ এবং রিভিজিটিং পিএসএমপি ২০১৬ অনুসারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উৎসভিত্তিক তুলনামূলক ছক এ পুস্তিকার পরবর্তী আলোচনায় যুক্ত করা হয়েছে)। অথচ গত ২০ বছরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বিশেষ কোনো নতুন জায়গা করে নিতে পারেনি।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি, সক্ষমতা ও আইন
পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বসানোতেই কাজ শেষ হয়ে যায় না; বরং এই নির্মাণকাজের শেষ আসলে একটা পরস্পর নির্ভরশীল, জটিল ও চক্রাকার কর্মপদ্ধতির শুরু মাত্র। মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশে ইউরেনিয়ামের উত্তোলনযোগ্য কোনো রিজার্ভ নেই। কাজেই পারমাণবিক কেন্দ্র বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনায় স্বনির্ভরশীলতা আনয়নের নামে করা হলেও, প্রকৃত অর্থে এর মাধ্যমে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানি সরবরাহ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে রাশিয়া এবং জনশক্তি প্রাপ্তি ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভারতের ওপর নির্ভরশীল হতে যাচ্ছে। এ অধ্যায়ে আমরা বাংলাদেশের বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা এবং যে কোনো দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্ত মোকাবিলার ক্ষেত্রে সক্ষমতা বোঝার চেষ্টা করব।
চিরস্থায়ী ব্যয়
একটা বন্ধ হয়ে যাওয়া নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট অপসারণও অত্যন্ত ব্যয়বহুল। যেহেতু তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ফেলার কোনো ভাগাড় নেই তাই ওই তেজস্ক্রিয় অবকাঠামো এবং যন্ত্রপাতি সেখানেই বহু বছরের জন্য পড়ে থাকবে। বিপজ্জনক বলে নিশ্চিতভাবেই পরিবেশ নিরীক্ষক এবং সশস্ত্র রক্ষকেরও প্রয়োজন পড়বে (পরিকল্পনা অনুযায়ী ৪০ বছর বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর বন্ধ হয়ে যাবে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র)।
ফিনল্যান্ডে দুই হাজার ৮০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে মাটির এক হাজার ৩০০ ফুট গভীরে ছয় হাজার ৫০০ টন পারমাণবিক বর্জ্য ‘নিরাপদে’ লুকিয়ে রাখার আয়োজন শুরু হয়েছে ২০০৪ সাল থেকে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ফিনল্যান্ডে দুই হাজার ৮০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে মাটির এক হাজার ৩০০ ফুট গভীরে ছয় হাজার ৫০০ টন পারমাণবিক বর্জ্য ‘নিরাপদে’ লুকিয়ে রাখার আয়োজন শুরু হয়েছে ২০০৪ সাল থেকে [৪৭, ৪৮]। এই শতাব্দীর শেষদিকে এই পুরো প্রক্রিয়া শেষ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরপর এই বর্জ্য বিশেষ প্রক্রিয়ায় মাটির ভেতরে নিয়ে গিয়ে চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হবে এর সুড়ঙ্গমুখ। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, এর মাধ্যমে অন্তত এক লাখ বছর সময়ের জন্য আপাত নিরাপদ স্থানে ফিনল্যান্ডের পারমাণবিক বর্জ্যগুলো রাখার ব্যবস্থা করা যাবে [৪৯]। এই উদাহরণ থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় যে, পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কতটা জটিল, সময়সাপেক্ষ, অনিরাপদ আর খরুচে। কাজেই ভাবার কোনো কারণ নেই যে, বাংলাদেশে রূপপুরসহ অন্যান্য পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্য রাশিয়া কিংবা অন্য কোনো দেশ বিনা খরচে নিজ দেশে নিয়ে যাবে কয়েক হাজার কিংবা লাখ বছর ধরে নিরাপদ স্থানে রেখে দেওয়ার জন্য!
পরমাণু বিদ্যুতের জ্বালানি
নিউক্লিয়ার রি-অ্যাকটরে জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়াম ব্যবহৃত হয়। জ্বালানি ব্যবহার প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্যায়ে এই ইউরেনিয়াম তেজস্ক্রিয় বর্জ্য উৎপন্ন করে–প্রথমত, খনি থেকে উত্তোলনের সময়, অতঃপর ইউরেনিয়ামের কারখানায় যেখানে রাসায়নিক প্রক্রিয়াকরণ, সমৃদ্ধকরণ ও ফেব্রিকেশন বা ব্যবহারোপযোগী ইউরেনিয়াম রড তৈরি করা হয়। কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘটায়, এ নিয়ে সচেতন সবাই যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। কিন্তু ইউরেনিয়াম জ্বালানির উৎপাদনও গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপন্ন করে। বস্তুত খনি থেকে ইউরেনিয়াম উত্তোলন এবং এর প্রক্রিয়াকরণ সর্বাধিক কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনকারী শিল্পগুলোর একটি। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাংশে উৎপন্ন তেজস্ক্রিয় কার্বন গ্যাস ভেসে বেড়ায় যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে, আটলান্টিক পেরিয়ে ভেসে যায় আরও বহুদূরে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, নিউক্লিয়ার রি-অ্যাকটরগুলোয় ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হয় নিউক্লিয়ার ফিশন নামের একটি প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে অত্যধিক তাপ ও তেজস্ক্রিয়তা উৎপাদনের মাধ্যমে টারবাইন ঘোরানোর কাজে (যার গতিশক্তিকে বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তর করা হয়)।
তেজস্ক্রিয়তার পর্যায়ক্রমিক নিঃসরণ
তেজস্ক্রিয়তার বিষ ছড়ানোর জন্য নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোর ধ্বংস হতেই হবে কিংবা কোনো দুর্ঘটনা ঘটতেই হবে–এমন কোনো কথা নেই। নিয়মিত কার্যক্রমের সময় এই পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো তেজস্ক্রিয় বর্জ্য নিঃসরণ করে পরিবেশে; এবং যে নদী, লেক বা সাগর রি-অ্যাকটর শীতলীকরণের জল জোগায়, তাতে (রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পে যেমন জল জোগাবে পদ্মা নদী) এই পর্যায়ক্রমিক নিঃসরণ ছাড়া একটা রি-অ্যাকটর চালু রাখা অসম্ভব। ট্রাইটিয়াম (তেজস্ক্রিয় হাইড্রোজেন) তেজস্ক্রিয় ক্রিপটন ও জেনন গ্যাস, যেগুলোর কিছু কিছু তেজস্ক্রিয় স্ট্রনটিয়াম ও সিজিয়ামে রূপান্তরিত হয়, এগুলোসহ সব ধরনের তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পরিশোধনের পরিমিত ব্যয়সাপেক্ষ কোনো প্রযুক্তি নেই।
অপরিমেয় তেজস্ক্রিয়তা
তেজস্ক্রিয়তার যে নির্দিষ্ট মাত্রা শনাক্ত করার জন্য তেজস্ক্রিয়তা শনাক্তকরণ যন্ত্র বসানো হয়, তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা যখন বর্জ্য পানিতে সেই মাত্রা থেকে কম থাকে, নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট থেকে তখনই তেজস্ক্রিয় বর্জ্য নিষ্কাশন করা হয়। মার্কিন সরকার তেজস্ক্রিয়তার এই মাত্রাকে সহনীয় বলে অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু এই সহনীয় মানেই যে নিরাপদ, তা কিন্তু নয়। এর নিম্নে যতটুক পর্যন্ত গ্রহণ করা যায়, তার মানে সর্বনিম্ন যতটা সহনীয় বলে নিউক্লিয়ার ইন্ডাস্ট্রি দাবি করে ঠিক ততটাই।
একটা নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের তেজস্ক্রিয়তা নিঃসরণের মাত্রা নির্ণয়ের জন্য Nuclear Regulatory Commission নির্ভর করে প্ল্যান্ট মালিকদের নিজস্ব প্রতিবেদন এবং কম্পিউটারে আঁকা গ্রাফিক চিত্রের ওপর। পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনের তথ্যের একটা তাৎপর্যপূর্ণ অংশ আগে থেকেই অনুমান করা যায়; আর তাই এটা ভার্চুয়াল, বাস্তবিক নয়। তাই কেউ আসলে জানে না, ঠিক কতটা তেজস্ক্রিয়তার নিঃসরণ ঘটছে। কঠিন, বায়বীয় ও তরল তেজস্ক্রিয় পদার্থ ছড়িয়ে পড়ছে কাছে এবং দূরে।
মৃত্যুপরম্পরা
তেজস্ক্রিয় বর্জ্য শুধু যখন উৎপন্ন হয় তখনকার জন্যই নয়; বরং চিরকালের জন্যই বিপজ্জনক। সব ধরনের তেজস্ক্রিয় আইসোটোপই যে কোনো মাত্রার তাপে, চাপে এবং রাসায়নিক পরিবেশে একটা নির্দিষ্ট হারে তেজস্ক্রিয় রশ্মি এবং তেজস্ক্রিয় পরমাণুর নিঃসরণ ঘটায়, যতক্ষণ-না তা ভিন্ন কোনো তেজস্ক্রিয় আইসোটোপে বা স্থির অপরিবর্তনশীল আইসোটোপে রূপান্তরিত হয়। কিছুই তেজস্ক্রিয় নিঃসরণের সেই সুনির্দিষ্ট হারে তারতম্য ঘটাতে পারে না বা সেটাকে বন্ধ করতে পারে না। যে মেয়াদ অতিক্রম করলে একটি তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের অর্ধাংশের তেজস্ক্রিয়তা থেমে যায় তার দশ গুণ বেশি সময়জুড়ে তা পরিমাপযোগ্য তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায় (একটি তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের অর্ধাংশের তেজস্ক্রিয়তার মেয়াদ অর্ধেকটা পেরিয়ে গেলে, সেটার তেজস্ক্রিয়তা অর্ধেকটা কমে যায়, এবং অবশিষ্ট মেয়াদের দুই ভাগের এক ভাগ পেরিয়ে গেলে তেজস্ক্রিয়তা তিন-চতুর্থাংশ কমে যায়; কিন্তু ওই মেয়াদের এক-দশমাংশেও কিছু তেজস্ক্রিয়তা রয়ে যায়)। এর মানে প্লুটোনিয়াম-২৩৯-এর মতো কিছু তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের অর্ধাংশ তার ২৪০০০ বছরকার আয়ু নিয়ে আধুনিক মানুষ যত দিন ধরে এই পৃথিবীতে বিচরণ করেছে, তার চেয়ে আরও দীর্ঘ সময়ের জন্য বিপজ্জনক রয়ে যাবে।
ঝুঁকি এবং বিপদ
দুর্ঘটনা: এমআইটি প্রকাশিত একটি নিবন্ধ একটা দুর্ভাগ্যজনক সত্য তুলে ধরেছে: ‘একটা প্ল্যান্টের এবং এর যন্ত্রপাতির ডিজাইন থেকে শুরু করে এর প্রস্তুতকরণ, নির্মাণ এবং স্থাপনে এর পরীক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত ও ব্যবস্থাপনার প্রতিটি স্তরে এর সফলতা বা ব্যর্থতা নির্ভর করে মানবিক প্রভাবক ও দক্ষতার ওপর।’ (‘Human Error in Nuclear Power Plants,’ Technology Review, Feb. 1980, p.28)
হাজার হাজার পাম্প, ভাল্ব, মোটর আর সুদীর্ঘ সব সার্কিট নিয়ে প্রতিটি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট অত্যন্ত জটিল। আর তাই মানবিক ভুল, ডিজাইনের ত্রুটি এবং যন্ত্রাংশের ঠিকঠাক কাজ না-দেওয়া অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার। ‘নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের ব্যবস্থা, কাঠামো, যন্ত্রপাতি, কর্মসূচি এবং জনবল–সবকিছুই ব্যর্থতা ও ভুলের শক্তিশালী উৎস। সমস্যা দেখা দিতে পারে ডিজাইনের, প্রস্তুতকরণের, স্থাপনের, নির্মাণের ভুলে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের ত্রুটি থেকে, বিস্ফোরণ ও আগুনের ফলে, মাত্রাতিরিক্ত ক্ষয়, কম্পন, চাপ, তাপ, শীতলতা, তেজস্ক্রিয় বিপর্যয় এবং অন্যান্য ভৌত অনুঘটকের কারণে, যন্ত্রপাতির পুরোনো হয়ে যাওয়ার ভঙ্গুরতা থেকে এবং বাহ্যিক বিভিন্ন প্রভাবক, যেমন: বন্যা, ভূমিকম্প, টর্নেডো এবং ষড়যন্ত্রের কারণে।’ (Daniel F. Ford: Three Mile Island, 1982, p.29)
যাদের প্ল্যান্টের অতীতের সমস্যা মোকাবিলার গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা আছে, তাঁরাসহ বহু অভিজ্ঞ কর্মী যেহেতু অবসর নিয়েছেন বা অবসরগ্রহণের কাছাকাছি বয়সে পৌঁছে গেছেন, তাই এই ইন্ডাস্ট্রি একটা বড় ধরনের যোগ্য লোকবল সংকটের সম্মুখীন। একটা সাধারণ রি-অ্যাকটর কমপক্ষে ১০০০ হিরোশিমা বোমার তেজস্ক্রিয়তা ধারণ করে। যে কোনো দুর্ঘটনাই তাই বিপুল পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর ফলে প্রলয়ংকরী হয়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য সতর্কীকরণ ব্যবস্থা ও অতি উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয় দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট হাতিয়ারসমৃদ্ধ ও যথেষ্ট প্রশিক্ষিত ত্রাণকর্মীসহ জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা খুব কম দেশেরই আছে। তেজস্ক্রিয়তার শিকার মানুষের চিকিৎসার জন্য পৃথক হাসপাতালের অভাব রয়েছে সেসব দেশে। আর একটা বিপুল পরিমাণ আতঙ্কিত জনতাকে খুব সহজেই অকুস্থল থেকে সরিয়ে আনার চিন্তাটাও অত্যন্ত অবাস্তব। দীর্ঘস্থায়ী তেজস্ক্রিয় দূষণের কারণে নিজেদের ঘরবাড়ি এবং সমাজ ছেড়ে আসা মানুষের স্থায়ী পুনর্বাসন সমস্যার সমাধান জরুরি অবস্থা মোকাবিলার কোনো পরিকল্পনায়ই নেই। পরমাণু প্রযুক্তি উন্নয়ন ও ব্যবহারে কয়েক যুগের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাসম্পন্ন দেশগুলোতেই যখন এই অবস্থা তখন বাংলাদেশে কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
স্বাস্থ্যঝুঁকি : পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা কোষ, টিস্যু এবং ডিএনএ বিনষ্টকরণের ঝুঁকি বাড়ায় যা তেজস্ক্রিয়তার স্বভাব অনুযায়ীই মিউটেশন, ক্যানসার, জন্মগত বিকলাঙ্গতা ও অন্যান্য জন্মগত সমস্যা এবং প্রজনন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসংশ্লিষ্ট ব্যাধি, বক্ষ ও অন্তঃস্রাবী ব্যাধির কারণ। অত্যধিক পরিমাণে উৎপন্ন তেজস্ক্রিয় হাইড্রোজেন এবং কার্বন সারা শরীরের প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট ও চর্বির সঙ্গে মিশে যেতে পারে। বেড়ে ওঠার সময় দ্রুত এবং বিপুল কোষ বিভাজনের কারণে ভ্রূণ ও শিশুরাই বিশেষত তেজস্ক্রিয়তার সহজ শিকার হয়ে ওঠে।
পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা কোষ, টিস্যু এবং ডিএনএ বিনষ্টকরণের ঝুঁকি বাড়ায় যা তেজস্ক্রিয়তার স্বভাব অনুযায়ীই মিউটেশন, ক্যানসার, জন্মগত বিকলাঙ্গতা ও অন্যান্য জন্মগত সমস্যা এবং প্রজনন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসংশ্লিষ্ট ব্যাধি, বক্ষ ও অন্তঃস্রাবী ব্যাধির কারণ।
ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলের BEIR VII প্রতিবেদন অনুযায়ী তেজস্ক্রিয়তার কোনো মাত্রাই নিরাপদ নয়। (‘Health Risks from Exposure to Low Levels of Ionizing Radiation,’ 2005)
কার্যক্ষেত্রের ঝুঁকি: নিউক্লিয়ার ইন্ডাস্ট্রি সেসব কর্মীর ওপর নির্ভরশীল, সাধারণ জনগণের তুলনায় যাদের জন্য অনেক বেশি মাত্রায় তেজস্ক্রিয়তার সম্মুখীন হওয়াটাও অনুমোদিত। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে বেশকিছু পুরোনো হয়ে যাওয়া যন্ত্র, এমনকি শুধু মরিচা ধরা অংশও উচ্চ ও তীক্ষ্ণ গামা রশ্মি নির্গত করে। গতিরুদ্ধ বা ফুটো হয়ে যাওয়া পাইপ যখন মেরামত করতে হয় বা বদলে নিতে হয়, তখন ছোটখাটো মেরামতের সময়ও সারা বছরে সর্বোচ্চ যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা একজন শ্রমিকের জন্য অনুমোদিত সেই পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তার সম্মুখীন হতে পারেন তিনি কয়েক মুহূর্তেই।
সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাসী হামলা: একটা সাধারণ বাণিজ্যিক রি-অ্যাকটর বছরে যে পরিমাণ প্লুটোনিয়াম উৎপন্ন করে তা অন্তত চল্লিশটা অ্যাটম বোমা তৈরির জন্য যথেষ্ট। জ্বলে যাওয়া পরিত্যক্ত তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম রড পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা হলে তা থেকে উৎকলিত প্লুটোনিয়ামকে নিউক্লিয়ার বোমায় রূপান্তর করা যায়। বাকি তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলো সাধারণ বিস্ফোরকের সঙ্গে মিশিয়ে তেজস্ক্রিয়তা ছড়াতে সক্ষম ‘বিষক্রিয় বোমা’ তৈরি করা যায়। প্রতিটি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রই সন্ত্রাসী হামলার অন্যতম লক্ষ্যবস্তু, আঘাতটা আসতে পারে স্থলপথ, নৌপথ, আকাশপথে অথবা যারা সেখানে কাজ করে বা যাদের সেখানে প্রবেশের অনুমোদন রয়েছে তাদের কাছ থেকেও। সন্ত্রাসীরা আঘাত হানতে পারে রি-অ্যাকটরে, জ্বালানি সংরক্ষণের চৌবাচ্চায় অথবা অন্যান্য স্পর্শকাতর যন্ত্রাংশে, বিপুল পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তার নিঃসরণ ঘটিয়ে।
থ্রি মাইল আইল্যান্ড দুর্ঘটনা, চেরনোবিল দুর্ঘটনা, ফুকুশিমা দুর্ঘটনার মতো একের পর এক অভিশপ্ত ঘটনায় সাধারণ মানুষ যখন আতঙ্কগ্রস্ত তখন আমাদেরকে বোঝানো হচ্ছে, রূপপুরে নাকি বসানো হবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। বোয়িং বিমান এর ওপর বিধ্বস্ত হলেও নাকি এ কেন্দ্রের কিছু ঘটবে না। কিন্তু আমরা ভালো করেই জানি, প্রযুক্তি নিয়ে রাশিয়ার এই আস্ফালন, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যাবসা প্রসারে রাশিয়ার নানান ধরনের ছলাকলায় ভোলানোর প্রবণতা নতুন কিছু নয়। ষাটের দশকে এই রূপপুরেই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে রি-অ্যাকটরের চারপাশে নিরাপত্তা ব্যূহ (containment building) ছাড়াই ৪০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা প্রস্তাব জমা দিয়েছিল রাশিয়া। নিরাপত্তা ব্যূহর অনুপস্থিতির কারণ জানতে চাইলে তখনও দম্ভভরে বলেছিল: আমাদের রি-অ্যাকটর ডিজাইনে কোনো খুঁত নেই, তাই এর চারপাশে ব্যূহ তৈরির প্রয়োজন নেই। অথচ, এর কিছুকাল পরেই ১৯৮৬ সালে তাদের নিজেদের কেন্দ্রেই ঘটে চেরনোবিল দুর্ঘটনা, যাতে নিরাপত্তা ব্যূহ না-থাকার কারণে তেজস্ক্রিয় দূষণ ছড়িয়ে পড়ে তাৎক্ষণিকভাবে [৫০]।
বাংলাদেশে প্রচার করা হচ্ছে যে, যে কোনো ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ব্যবহার করা হবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। অথচ, আমরা দেখেছি, দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রযুক্তি যখন জাপানের ফুকুশিমা দুর্ঘটনার ভয়াবহতা ঠেকাতে পারল না, ঠিক তখনই বাজারে এলো তৃতীয় প্রজন্মের প্রযুক্তি। ফুকুশিমা দুর্ঘটনার দুই বছর পরও ওই অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানিতে উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয় পদার্থ পাওয়া গেছে। জাপান সরকার ইতোমধ্যে ফুকুশিমা পারমাণবিক চুল্লিকে সম্পূর্ণ তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবমুক্ত করতে ১৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১৫ লাখ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে বলে জানিয়েছে [৫১]।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পরিচালনার যে কোনো পর্যায়ে, যে কোনো কারণে পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় প্রকল্পের স্বত্বাধিকারী হিসেবে বাংলাদেশকে নিতে হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নকারী, যন্ত্রপাতি নির্মাণ ও সরবরাহকারী রাষ্ট্র রাশিয়া দুর্ঘটনার কোনো দায় নেবে না। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থ পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ার কারণে কোনো বিপর্যয় ঘটলে কিংবা কেন্দ্রটির জন্য সরবরাহ করা পারমাণবিক জ্বালানি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করার পর তা থেকে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দায়দায়িত্ব বাংলাদেশকেই নিতে হবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের মূল নির্মাণকাজের জন্য বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে যে সাধারণ চুক্তি (জেনারেল কন্ট্রাক্ট) সই হয়েছে, তার ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে পারমাণবিক দুর্ঘটনার দায়দায়িত্ব নিরূপণের (নিউক্লিয়ার লায়াবিলিটি) বিষয়ে এই বিধান যুক্ত করা হয়েছে…’ ।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঘটলে দুর্ঘটনাকবলিত এলাকা থেকে স্থানীয়দের সরাতে পুনর্বাসনের প্রয়োজন হবে [৫২]। অথচ, এত বিপুল জনগোষ্ঠীকে দ্রুত সরানোর পরিকল্পনা অনুপস্থিত। উল্লেখ্য, রাশিয়ার কোম্পানি রোসাটমের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের করা চুক্তিতে একটি দায়মুক্তি সম্পর্কিত বিধান যুক্ত করা হয়েছে। পত্রিকায় এ বিষয়ে খবর এসেছে এভাবে: ‘…রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পরিচালনার যে কোনো পর্যায়ে, যে কোনো কারণে পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় প্রকল্পের স্বত্বাধিকারী হিসেবে বাংলাদেশকে নিতে হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নকারী, যন্ত্রপাতি নির্মাণ ও সরবরাহকারী রাষ্ট্র রাশিয়া দুর্ঘটনার কোনো দায় নেবে না। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থ পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ার কারণে কোনো বিপর্যয় ঘটলে কিংবা কেন্দ্রটির জন্য সরবরাহ করা পারমাণবিক জ্বালানি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করার পর তা থেকে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দায়দায়িত্ব বাংলাদেশকেই নিতে হবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের মূল নির্মাণকাজের জন্য বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে যে সাধারণ চুক্তি (জেনারেল কন্ট্রাক্ট) সই হয়েছে, তার ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে পারমাণবিক দুর্ঘটনার দায়দায়িত্ব নিরূপণের (নিউক্লিয়ার লায়াবিলিটি) বিষয়ে এই বিধান যুক্ত করা হয়েছে…’ [৫৩]। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় ভবিষ্যতের যে কোনো দুর্ঘটনা কিংবা আর্থিক ক্ষতির ক্ষেত্রে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নীতি প্রণয়ন, নির্মাণ এবং পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়মুক্তি দিয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আইন-২০১৫ ইতোমধ্যে পাস করা হয়েছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: খরচ ও দুর্নীতির খতিয়ান
১৯৮৬ সালের চেরনোবিল দুর্ঘটনার পরবর্তী বছরগুলোয় ইদে অনেক পরিবারই বঞ্চিত হয়েছে দুধ, সেমাই খাওয়ার আনন্দ থেকে। কারণ, খবর রটেছিল যে, পোল্যান্ড থেকে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়া গুঁড়া দুধ কম দামে আমদানি করে বাজারে ছেড়ে দিয়েছে এক শ্রেণির ধুরন্ধর ব্যবসায়ী (নিউইয়র্ক টাইমস, ৫ জুন ১৯৮৭) [৫৪]। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের অন্যতম কারণ হিসেবেও চেরনোবিল নামটার উল্লেখ হয়েছে অনেকের বিশ্লেষণে। এরপর প্রায় দুই যুগের আপাত নিস্তব্ধতা শেষে হঠাৎ করেই ২০০৯ সাল থেকে শুরু হয় রূপপুর বিষয়ক আলাপ-আলোচনা, বিদেশ সফর এবং চুক্তি সইয়ের মতো আনুষ্ঠানিকতাগুলো। মনে রাখা প্রয়োজন, রূপপুর প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই নির্মাণ ব্যয় ৩২ হাজার কোটি টাকা (চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার) থেকে বেড়ে এক লাখ কোটি টাকায় (১২.৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) পৌঁছে গেছে (ডব্লিউএনআইএসআর, ২০১৭)। লাগামছাড়া খরচ আর নির্মাণের দীর্ঘসূত্রতায় শেষ পর্যন্ত এই প্রকল্পের মোট ব্যয় কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা কেউ জানে না। পরিবেশ সমীক্ষার মতো জনগুরুত্বপূর্ণ রিপোর্টটি কী কারণে এখন পর্যন্ত প্রকাশ করা হলো না, তা-ও কেউ জানে না। জনসংযোগ এখন পর্যন্ত শুধু বিজ্ঞাপন প্রচারেই সীমাবদ্ধ। রূপপুর প্রকল্পের নিরাপত্তার ব্যাপারে যদি এতটাই নিশ্চিত হওয়া যায়, তবে ঠিক কী কারণে ভবিষ্যৎ যে কোনো দুর্ঘটনার জন্য প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়মুক্তি দিয়ে আইন পাস করে রাখা হয়েছে–সেটাও একটা জরুরি প্রশ্ন।
পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুরে পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের উদ্বোধন হয় ২০১৩ সালে। ২০১৬ সালে চূড়ান্ত চুক্তির মাধ্যমে এর প্রথম ধাপের কাজ সমাপ্ত হলো। প্রায় বিনা তর্কে ও প্রায় বিনা প্রতিরোধে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা নজিরবিহীন ঘটনা। বাংলাদেশে হয়তো তা-ই হতে চলেছে। এর কারণ হিসেবে যে কোনো জাতীয় ইস্যুতে আমাদের সাধারণ উদাসীনতাকে পুরোপুরি দায়ী করার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে, এই বিষয়ে সার্বিক ধারণা দিতে সক্ষম লিফলেট, বুকলেট কিংবা পত্রিকার মন্তব্য প্রতিবেদন–এমনকি ফেসবুক পোস্টের অভাবটাকেও। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে রূপপুরবিষয়ক আলোচনা আমাদের যেমন প্রয়োজন, পরমাণু বিদ্যুৎকে সার্বিকভাবে আমাদের বোঝা প্রয়োজন। কারণ, রূপপুরই বাংলাদেশের একমাত্র এবং সর্বশেষ প্রস্তাবিত পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়।
বাংলাদেশে চলমান অন্যান্য মেগা প্রকল্পস্থানের মতো রূপপুরেও জারি করা হয়েছে ভয়ের নৈরাজ্য। সেখানে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রবিষয়ক যে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা, সভা-সমাবেশ, প্রতিবাদ কার্যত নিষিদ্ধ। এ কারণে প্রকৃত অবস্থা জানার সুযোগও খুবই কম। কিন্তু এত সব কিছুর পরও ঝুঁকিপূর্ণ কাজের পরিবেশের কারণে শ্রমিকের মৃত্যু, অতিরিক্ত মদ্যপানে রুশ নাগরিকের মৃত্যু আর বালিশকাণ্ডের মাধ্যমে রূপপুর বারবার এসেছে আলোচনায়। নিচের ছকের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলো:
পত্রিকার পাতা থেকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ সংক্রান্ত সাম্প্রতিক উল্লেখযোগ্য ঘটনার টাইমলাইন
সময়কাল | উল্লেখযোগ্য ঘটনার সারসংক্ষেপ |
এপ্রিল, ২০১৭ | ‘রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্রেন ভেঙে ওয়ার্কশপ ভবন ও সীমানাপ্রাচীর বিধ্বস্ত’ [৫৫] পাবনার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া দুই দফা প্রচণ্ড কালবৈশাখী ঝড়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্রেন ভেঙে নির্মাণাধীন অস্থায়ী শেডের একটি লোহার স্ট্রাকচার ভেঙে পার্শ্ববর্তী ভবনের ওপর হেলে পড়েছে। বুধবার রাতে এ ঘটনা ঘটে। তবে এতে কেউ হতাহত হয়নি। তবে এ ঘটনার পর থেকে স্থাপনা নির্মাণ সংক্রান্ত সব কাজ বন্ধ রয়েছে। প্রকল্প এলাকায় রাশিয়ার টেকনিশিয়ানসহ নিরাপত্তাকর্মীরা পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছেন। এই বিপর্যয়ে জনমনে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। |
ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ | ‘কর্মরত রুশ নাগরিকের মৃত্যু’ [৫৬] পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে কর্মরত এক রুশ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর নাম আহুন গিয়ানভ নোফেন (৫৬)। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে রুশ এএমটি ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। |
ডিসেম্বর, ২০১৮ | ‘রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে ক্রেন দুর্ঘটনায় নিহত ১, আহত ৩’ [৫৭]
পাবনার ঈশ্বরদীতে রূপপুর পারমাণবিক শক্তি প্রকল্পে (আরএনপিপি) ক্রেন দুর্ঘটনায় এক নির্মাণশ্রমিক নিহত ও তিনজন আহত হয়েছেন। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রকল্পের রি-অ্যাকটর বেজের ওয়াটার ট্যাংকের নির্মাণকাজের স্থলে ঢালাইয়ের শাটার খোলার সময় ক্রেনের চাকার জগ নরম মাটিতে দেবে ক্রেনের (ট্যানেস্ক) বোমার আঘাতে এই দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত শ্রমিকের নাম শিখন হোসেন (২৭)। তিনি উপজেলার পাকশী যুক্তিতলা গ্রামের নবাব আলীর ছেলে। আর জুয়েল রানাসহ আরও দুই শ্রমিক আহত হয়েছেন। |
জানুয়ারি, ২০১৯ | ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে আবারও রাশিয়ান নাগরিকের মৃত্যু’ [৫৮] জরুরি সুচিকিৎসার ব্যবস্থা না-থাকায় আবারও নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে রাশিয়ান নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া এই ব্যক্তির নাম শেরগিন ভ্যাইলি (৫৯)। তিনি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের রাশিয়ার ঠিকাদারি ‘রোসেম’ নামের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন বলে জানা গেছে। … সূত্র জানায়, এ সময় গ্রিন সিটির মেডিকেল কো-অর্ডিনেটর ডা. ফকরুলকে খবর দেওয়া হলে তিনি এসে পরীক্ষা করে জানান, আগেই ভ্যাইলির মৃত্যু হয়েছে। ভ্যাইলি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে তিনি ধারণা করছেন। … উল্লেখ্য, প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৬-৭ জন রাশিয়ান নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে। স্থানীয়রা জানান, বেশিরভাগ মৃত্যু হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঘটলেও মূলত অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণেই হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ‘ক্রেন ভেঙে ৩ শ্রমিক আহত’ [৫৯] পাবনায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে ক্রেন ভেঙে পড়ে ৩ শ্রমিক আহত হয়েছেন। শনিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। আহতরা হলেন : মো. ইব্রাহিম (৩৫), ওয়াছিম (৩২) এবং দানেস মিঞা (৩০)। এদের মধ্যে গুরুতর আহত মো. ইব্রাহিমকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। সূত্রমতে, পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের চুল্লির কাছে ১০০ টনের একটি ক্রেন দিয়ে কাজ চলছিল। হঠাৎ ক্রেনটি ছিঁড়ে পড়লে ওই তিন শ্রমিক আহত হন। |
ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ | ‘রূপপুরে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে রুশ নাগরিকের মৃত্যু’ [৬০]
পাবনার ঈশ্বরদীতে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে জেলেস্কি ভাৎজিম (৩৪) নামের এক রুশ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। শনিবার সকালে উপজেলার সাহাপুর নতুনহাট মোড়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের গ্রিনসিটি ভবন থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। জেলেস্কি নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে ট্রেট রোসিম নামের একটি বিদেশি সাব-ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে ইন্সট্রলার পদে কর্মরত ছিলেন। |
এপ্রিল, ২০১৯ | ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে এক প্রকৌশলীর মৃত্যু, ২ জন অসুস্থ’ [৬১] বিষাক্ত মদ্যপানে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের এক রুশ প্রকৌশলী মারা গেছেন। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন দুজন। সূত্রমতে, শনিবার দিবাগত রাতে তিনজন রুশ নাগরিক প্রকল্পে মদ্যপান করার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাদের প্রথমে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে রামেকে স্থানান্তর করা হয়। প্রকৌশলী দিমিত্রি বেল্লিকে (৪০) চিকিৎসক শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে মৃত ঘোষণা করেন। |
মে, ২০১৯ | ‘কেনা-তোলায় এত ঝাঁজ’ [৬২] যেন সুঁই টানার জন্য হাতি ভাড়া করার মতো ঘটনা ঘটেছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে। সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার জন্য সেখানে নির্মিত ভবনে আসবাবপত্র কেনা ও ফ্ল্যাটে তোলার ক্ষেত্রে ঘটেছে অস্বাভাবিক এ ঘটনা। কেজি খানেক ওজনের একটি বৈদ্যুতিক কেটলি নিচ থেকে ফ্ল্যাটে তুলতেই খরচ হয়েছে প্রায় তিন হাজার টাকা। একই রকম খরচ দেখানো হয়েছে জামা-কাপড় ইস্ত্রি করার কাজে ব্যবহৃত প্রতিটি ইলেকট্রিক আয়রন উপরে তুলতে। প্রায় আট হাজার টাকা করে কেনা প্রতিটি বৈদ্যুতিক চুলা ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিতে খরচ দেখানো হয়েছে সাড়ে ছয় হাজার টাকার বেশি। প্রতিটি শোওয়ার বালিশ ভবনে ওঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে প্রায় হাজার টাকা করে। আর একেকটি ওয়াশিং মেশিন ওঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৩০ হাজার টাকারও বেশি। এভাবে ওয়াশিং মেশিনসহ অন্তত ৫০টি পণ্য ওঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ক্রয়মূল্যের প্রায় অর্ধেক, কোনো কোনোটিতে ৭৫ শতাংশ। অস্বাভাবিক এই অর্থ ব্যয় শুধু ভবনে ওঠানোর ক্ষেত্রেই নয়, আসবাবপত্র কেনার ক্ষেত্রেও দেখানো হয়েছে। প্রতিটি বিছানার চাদর কেনা হয়েছে ৫ হাজার ৯৮৬ টাকা করে। এ হিসাবে ৩৩০টি চাদর কিনতে খরচ হয়েছে ১৯ লাখ ৭৫ হাজার ৩৮০ টাকা। ৩৩০টি বালিশের ক্ষেত্রেও দেখানো হয়েছে কাছাকাছি ব্যয়। কাপড় পরিষ্কারের জন্য ১১০টি ওয়াশিং মেশিনের প্রতিটি কেনা হয়েছে এক লাখ ৩৬ হাজার ১১২ টাকা করে। ১১০টি টেলিভিশনের প্রতিটি কেনা হয়েছে ৮৬ হাজার ৯৬০ টাকায় এবং সেগুলো রাখার জন্য টেলিভিশন কেবিনেট কেনা হয়েছে ৫২ হাজার ৩৭৮ টাকা করে। |
জুন, ২০১৯ | ‘রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের গ্রিনসিটিতে নির্মাণ শ্রমিক নিহত’ [৬৩]
পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের গ্রিনসিটি এলাকায় কাজ করার সময় ওপর থেকে ইট পড়ে এক নির্মাণশ্রমিক নিহত হয়েছেন। নিহত শ্রমিকের নাম আল আমিন (২৮)। তিনি নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার বোমতি গ্রামের আবুল হাশেম আলীর ছেলে এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সাজিন এন্টারপ্রাইজের শ্রমিক। |
জুলাই, ২০১৯ | ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে নির্মাণাধীন স্থাপনায় ধস, আহত ১০ শ্রমিক’ [৬৪]
পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের ভেতরে একটি স্থাপনায় নির্মাণাধীন কিছু অংশ ভেঙে ১০ শ্রমিক আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার রাত সাড়ে আটটার দিকে প্রকল্পের ভেতরে দুই নম্বর ইউনিটের কাছে এ ঘটনা ঘটে। আহত ব্যক্তিরা হলেন: ফিরোজ হোসেন (২২), রাকিব উদ্দীন (৪৪), আবু বক্কর (২৮), রইস উদ্দিন (৩২), হাবিবুর রহমান (৪৬), মেহেদী হাসান (৩০), আসিফ (২৬), আমির হোসেন (৩৫), আলা উদ্দিন (৩৩) ও ইসাহাক আলী (৩৫)। আহতদের ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আহতদের মধ্যে ফিরোজের অবস্থা গুরুতর।
|
সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ‘রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যয় কিছুটা বেশি’ [৬৫]
‘বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে নতুন। অন্যদিকে ভারত ৫০ বছরের অধিক সময় ধরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করছে। যে কারণে তাদের তামিলনাড়ুর কুদনকুলাম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবকাঠামো ব্যয় তুলনামূলকভাবে কম। নতুন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ব্যয় কিছুটা বেশি।’ জাতীয় সংসদে এ কথা বলেছেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান। |
অক্টোবর, ২০১৯ | ‘রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে পরামর্শ নিতেই খরচ হবে প্রকল্পের ৭৭% টাকা’ [৬৬]
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে আরও একটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এর আওতায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে পারমাণবিক নিরাপত্তা তদারকির জন্য একটি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো তৈরি করা হবে। এই প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে এক হাজার ৭১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে পরামর্শক সেবার জন্য ব্যয় করা হবে এক হাজার ৩২০ কোটি টাকা, যা প্রকল্পের ৭৭ শতাংশের বেশি। মূলত রাশিয়া ও ভারত থেকে পরামর্শক এনে এই সেবা নেওয়া হবে। এই প্রকল্পের খরচভিত্তিক বিভাজনে দেখা গেছে, পারমাণবিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কৌশল শেখার জন্য রাশিয়া থেকে যে পরামর্শসেবা নেওয়া হবে, এর মূল্য ধরা হয়েছে এক হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। আর ভারতীয় পরামর্শসেবার খরচ প্রায় ৬২ কোটি টাকা। এ ছাড়া আগামী ছয় বছরে ১৫০ জন কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে পাঠানো হবে। এ জন্য খরচ হবে প্রায় ২০ কোটি টাকা। অভিজ্ঞতা অর্জনে বিদেশভ্রমণ খাতে আছে ১২ কোটি টাকা। |
নভেম্বর, ২০১৯ | ‘রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র: এক হাজার টাকায় ১০০ একর জমি’ [৬৭]
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ছয় মাস আগেই নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলটি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পাবনার পাকশীতে অবস্থিত এই কাগজকলের ১০০ দশমিক ৫১ একর জমি রয়েছে। নিরাপত্তা ও ভৌত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পুরো জমিই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য লাগবে বলে সরকার মনে করছে। সে অনুযায়ী জমির প্রতীকী মূল্য ধরা হচ্ছে এক হাজার এক টাকা। |
ডিসেম্বর, ২০১৯ | ‘বালিশকাণ্ডে গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ গ্রেফতার ১৩’ [৬৮]
পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ‘বালিশ কেলেঙ্কারির’ ঘটনায় গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাসুদুল আলমসহ ১৩ জনকে গ্রেফতার করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন৷ |
মার্চ, ২০২০ | ‘রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পে লোহার রড গায়ে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যু’ [৬৯, ৭০]
পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ভেতরে কাজ করার সময় লোহার রড ভেঙে গায়ের ওপর পড়ে আব্দুল খালেক (৪০) নামে এক শ্রমিক নিহত হয়েছেন। সোমবার (২৩ মার্চ) বিকাল ৩টার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। |
এপ্রিল, ২০২০ | ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে দুর্ঘটনা, প্রকৌশলী নিহত’ [৭১]
পাবনায় নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে কর্মরত অবস্থায় মাথায় বোম প্লেসার পড়ে আব্দুল মবিন (৩৫) নামের একজন প্রকৌশলী নিহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার (২৩ এপ্রিল) বিকেলে প্রকল্পের পারমাণবিক চুল্লির শীতলায়ন টাওয়ারের (কুলিং টাওয়ার) ঢালাই কাজ চলার সময় এ দুর্ঘটনা ঘটে। পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত সাড়ে ৮টার দিকে তার মৃত্যু হয়। নিহত প্রকৌশলী আব্দুল মবিন পাবনা সদর উপজেলার টেবুনিয়া মজিদপুর গ্রামের কেরামত আলী খানের ছেলে। তিনি রূপপুর প্রকল্পের ভারতীয় সাব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘পাহাড়পুর কুলিং টাওয়ার’-এর প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। |
আগস্ট, ২০২০ | ‘চার দিন ধরে মদ খেয়ে রাশিয়ান নাগরিকের মৃত্যু’ [৭২] অতিরিক্ত মদ্যপান করে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজশাহীতে এক রাশিয়ান নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। তিনি পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রে চাকরি করতেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজশাহীর সিডিএম হাসপাতালে তিনি মারা যান। মৃতের নাম সেরগে স্মোলনিকভ (৪৩)। সিডিএম হাসপাতালের পরিচালক ডা. তোকি চৌধুরী জানান, বৃহস্পতিবার বিকেল সোয়া ৫টার দিকে তাকে ঈশ্বরদী থেকে সিডিএম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তারপর আমরা সবাই মিলে তাকে বাঁচিয়ে তোলার খুব চেষ্টা করেছি। এখানে একজন রাশিয়ান চিকিৎসকও ছিলেন। কিন্তু তার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হওয়ায় তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। তিনি আরও জানান, তার সঙ্গে যারা এসেছেন তারা আমাদের জানিয়েছেন, গত চার দিন ধরে তিনি টানা মদ্যপান করছিলেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি অন্য কোনো খাবার খাননি। ‘জামিনে মুক্ত বালিশকাণ্ডের সেই ঠিকাদার’ [৭৩] পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে আলোচিত বালিশকাণ্ডের ঘটনায় ঠিকাদার শাহাদত হোসেন জামিনে কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার পাবনা জেলা ও দায়রা জজ মকবুল আহসানের আদালত তাঁর আবেদন মঞ্জুর করেন। এদিন বিকেলেই তিনি কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্ত হন। তবে গণমাধ্যমকর্মীরা বিষয়টি জানতে পারেন রোববার। |
উপরিউক্ত টাইমলাইনের মাধ্যমে এটা পরিষ্কার যে, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিমাণ-পূর্ব ও নির্মাণকালীন সময়ে যে সভা-সেমিনার, আলাপ-আলোচনা, গবেষণা হওয়া দরকার তার পুরোটাই বাংলাদেশে অনুপস্থিত। মনে রাখা প্রয়োজন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষ অর্জন আমদানি করা প্রযুক্তি আর বৈদেশিক প্রশিক্ষণেই হয়ে যায় না। এর জন্য দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বরাদ্দ বাড়ানো, গবেষণার পরিবেশ তৈরি, শিক্ষক-শিক্ষার্থী-গবেষকদের কথা বলার জন্য, প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য ভয়হীন পরিবেশ নিশ্চিত করা, ভিন্ন মত প্রকাশ ও আলাপ-আলোচনাকে উদ্বুদ্ধ করা। বাংলাদেশে এই জরুরি আর অত্যাবশ্যকীয় সংস্কৃতির অনুপস্থিতিতে যারা ধার করা বাতিল প্রযুক্তি বসিয়ে ‘নিউক্লিয়ার ক্লাবে’ ঢুকে যাওয়া তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন, তাঁরা হয় এই চলমান অব্যবস্থাপনার অবৈধ সুবিধাভোগ করছেন কিংবা করার আশায় আছেন আর নয়তো সুস্থ ও স্বাভাবিক চিন্তার ক্ষমতা হারিয়েছেন।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষ অর্জন আমদানি করা প্রযুক্তি আর বৈদেশিক প্রশিক্ষণেই হয়ে যায় না। এর জন্য দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বরাদ্দ বাড়ানো, গবেষণার পরিবেশ তৈরি, শিক্ষক-শিক্ষার্থী-গবেষকদের কথা বলার জন্য, প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য ভয়হীন পরিবেশ নিশ্চিত করা, ভিন্ন মত প্রকাশ ও আলাপ-আলোচনাকে উদ্বুদ্ধ করা। বাংলাদেশে এই জরুরি আর অত্যাবশ্যকীয় সংস্কৃতির অনুপস্থিতিতে যারা ধার করা বাতিল প্রযুক্তি বসিয়ে ‘নিউক্লিয়ার ক্লাবে’ ঢুকে যাওয়া তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন, তাঁরা হয় এই চলমান অব্যবস্থাপনার অবৈধ সুবিধাভোগ করছেন কিংবা করার আশায় আছেন আর নয়তো সুস্থ ও স্বাভাবিক চিন্তার ক্ষমতা হারিয়েছেন।
কাজেই আমাদেরকে কোম্পানির বিজ্ঞাপন, দালালদের প্রলোভন আর শাসকের কলকাঠি নাড়ানোয় ভুললে চলবে না। অন্যান্য সিদ্ধান্তের মতো ভবিষ্যতে শুধু নীতিমালা পালটে দিয়েই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সংক্রান্ত ভুল সিদ্ধান্তের প্রায়শ্চিত্ত করা যাবে না। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে প্রতিটি দিনক্ষেপণে ভুলের মাশুল বাড়ছে। সর্বজনের স্বার্থে এ আলোচনায় দায়িত্বশীল সবার অংশগ্রহণ এবং কর্মপন্থা নির্ধারণ জরুরি। তা না-হলে বাংলাদেশের মাটি, পানি, বায়ুতে যে অদৃশ্য বিষকণা ছড়াবে, তার রেশ বয়ে বেড়াতে হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
পারমাণবিক বিদ্যুতের বিকল্প
‘খারাপ বিষ’-এর বিকল্প যেমন ‘ভালো বিষ’ হতে পারে না, ঠিক তেমনি পারমাণবিক বিদ্যুৎকে যুক্তি, তর্ক, গবেষণা দিয়ে খারিজ করে দেওয়ার পর এর বিকল্প উপস্থাপনের বিষয়টা কারও জন্য বাধ্যবাধকতা হতে পারে না। তবে এটা সবার জন্য খুবই দারুণ সংবাদ যে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেকগুলো খাত এবং প্রযুক্তি ইতোমধ্যে সস্তা, সুলভ এবং প্রাণ-প্রকৃতিবান্ধব হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বহু বছর ধরে ব্যবহৃতও হচ্ছে। কিন্তু এই বিকল্পগুলো যদি না-ও থাকত তবুও কোনোভাবেই পারমাণবিক বিদ্যুৎকে স্বীকার করে নেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।
বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থা বহু বছর ধরেই ভূতের মতো উলটো পায়ে চলছে। এই খাতে অর্থের অপচয়কে দেখানো হচ্ছে বিকাশ হিসেবে, জল, জমি, জঙ্গলের দখলকে দেখানো হচ্ছে উন্নয়ন হিসেবে আর জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়া পরনির্ভরশীলতাকে দেখানো হচ্ছে অগ্রগতির স্মারক হিসেবে। ঠিক এ কারণেই এই সার্বিক ভাবনাকে চ্যালেঞ্জ করে পুরো জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ খাতে জনকল্যাণমূলক বিকল্প নীতির বাস্তবায়নের পূর্ণাঙ্গ সুপারিশমালা জাতীয় কমিটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছে ২০১৭ সালেই। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ও গবেষণাপূর্বক প্রকাশিত ‘বিকল্প জ্বালানি মহাপরিকল্পনা’র কপি জাতীয় কমিটির ওয়েবসাইটে উন্মুক্ত করা আছে, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে পাঠিয়ে আলোচনার আহ্বান জানানো হয়েছে, কয়েক হাজার কপি ছাপিয়ে সারা দেশে আগ্রহীজনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। দেশ এবং বিদেশে বসবাসরত নানা পেশার মানুষ, ছাত্র, শিক্ষক, গবেষক এই মহাপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছেন, তাঁদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সমর্থন ব্যক্ত করেছেন, এটি বাস্তবায়নের তাগিদ বোধ করেছেন; কিন্তু অন্যান্য সব জনবান্ধব কাজের মতো এক্ষেত্রেও সরকারি পর্যায় থেকে পাওয়া গেছে শুধু নীরবতা এবং উপেক্ষা।
সরকার প্রস্তাবিত ‘পাওয়ার সেক্টর মাস্টার প্ল্যান-২০১৬’ এবং জাতীয় কমিটি প্রস্তাবিত ‘বিকল্প জ্বালানি মহাপরিকল্পনা’র প্রধান পার্থক্য এবং বৈশিষ্ট্যগুলো নিচের ছক দুটির মাধ্যমে তুলে ধরা হলো:
ছক: সরকার ও জাতীয় কমিটির মহাপরিকল্পনার তুলনামূলক চিত্র
বিষয় | সরকারের কর্মসূচি [৭৪] | জাতীয় কমিটির বিকল্প প্রস্তাব |
২০৪১ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ লক্ষ্যমাত্রা | ২৪৫ টেরাওয়াট-আওয়ার | ২৪৫ টেরাওয়াট-আওয়ার |
মূল বৈশিষ্ট্য | আমদানি ও রাশিয়া-চীন-ভারতের ঋণনির্ভর। পরিবেশবিধ্বংসী। | দেশের সম্পদনির্ভর। রাশিয়া-চীন-ভারতের ঋণমুক্ত। পরিবেশ অনুকূল। |
বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান উৎস | কয়লা, এলএনজি ও পারমাণবিক | প্রাকৃতিক গ্যাস ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি |
মূল চালিকাশক্তি | বিদেশি কোম্পানি, অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান, কনসালট্যান্ট | জাতীয় সংস্থা, দেশি প্রতিষ্ঠান ও জন-উদ্যোগ |
২০২১ সাল পর্যন্ত | মোট: ২৩৫০০ মেগাওয়াট। দেশের প্রাকৃতিক গ্যাস: ৩৪%, এলএনজি: ১১%, কয়লা: ৩০%, তেল: ১৫%, আমদানি/নবায়নযোগ্য: ১০% | মোট: ২৫২৫০ মেগাওয়াট: ১৪০৬৩ মে.ও. প্রাকৃতিক গ্যাস. ৪৩৪০ মে.ও. তেল, ২৭৫৯ মে.ও. সোলার, ৯৯৩ মে.ও. বায়ু, ৩৯৭ মে.ও. বর্জ্য, ১৫৯৯ মে.ও. আঞ্চলিক সহযোগিতা, ১০৯২ মে.ও. অন্যান্য। জ্বালানির ভিত্তিতে: প্রাকৃতিক গ্যাস ৫৯%, তেল ১৯%, নবায়নযোগ্য ১০%, অন্যান্য ১২% |
২০৩১ সাল পর্যন্ত | মোট: ৩৪৫০০ মেগাওয়াট। দেশের প্রাকৃতিক গ্যাস: ১৩%, এলএনজি: ১৭%, কয়লা: ২৬%, তেল: ১৫%, আমদানি/নবায়নযোগ্য: ১৫%, পারমাণবিক: ১৪% | মোট: ৪৯৭০০ মেগাওয়াট: ১৮৪৫৯ মে.ও. প্রাকৃতিক গ্যাস, ২৬৩৭ মে.ও. তেল, ২১০১৫ মে.ও. সোলার, ৩৯৯৫ মে.ও. বায়ু, ১৭১২ মে.ও. বর্জ্য, ১৮৮৪ মে.ও. আঞ্চলিক সহযোগিতা। জ্বালানির ভিত্তিতে: প্রাকৃতিক গ্যাস ৪৯%, নবায়নযোগ্য ৩৯%, অন্যান্য ১২% |
২০৪১ সাল পর্যন্ত | মোট: ৫৭০০০ মেগাওয়াট। দেশের প্রাকৃতিক গ্যাস: ১১.৩%, এলএনজি: ২৩.৭%, কয়লা: ৩৫%, আমদানি/নবায়নযোগ্য: ১৫%, পারমাণবিক: ১০%. তেল: ৫% | মোট: ৯১৭০০ মেগাওয়াট: ২২৭৬৬ মে.ও. প্রাকৃতিক গ্যাস. ২৪৬১ মে.ও. তেল, ৫৩৩৯৪ মে.ও. সোলার, ৭৪৫৮ মে.ও. বায়ু, ২৭৯৭ মে.ও. বর্জ্য, ২৭৯৭ মে.ও. আঞ্চলিক সহযোগিতা। জ্বালানির ভিত্তিতে: প্রাকৃতিক গ্যাস ৩৭%, নবায়নযোগ্য ৫৫%, অন্যান্য ৮% |
ছক: সরকার ও জাতীয় কমিটির মহাপরিকল্পনায় গ্রাহক পর্যায়ে দামের তুলনামূলক চিত্র
সময়কাল | সরকারের পরিকল্পনায় বিদ্যুতের গড় দাম (চলতি দামে) [৭৫] | জাতীয় কমিটির প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় বিদ্যুতের গড় দাম (চলতি দামে) [৭৬] | সরকারের পরিকল্পনায় বিদ্যুতের গড় দাম (২০১৫ দামস্তর অনুযায়ী) | জাতীয় কমিটির প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় বিদ্যুতের গড় দাম (২০১৫ দামস্তর অনুযায়ী) |
২০২১ | ১১.৫৬ | ৭.৬৫ | ৮.৫২ | ৫.২৩ |
২০৩১ | ৩১.৯৪ | ২০.০৭ | ১১.০২ | ৫.২৯ |
২০৪১ | ৭৯.১৪ | ৫০.১৯ | ১২.৭৯ | ৫.১০ |
সূত্র: সরকারের বিদ্যুতের দামের জন্য পিএসএমপি ২০১৬ পৃ. ২১-৪ (summary, tariff policy: electricity tariff) এবং জাতীয় কমিটির প্রস্তাবিত দামের জন্য প্যানেল বিশ্লেষণ।
অতএব, উপরের তুলনামূলক ছকের মাধ্যমে এটি পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সহজে ও সুলভে উৎপাদনের উপায় সরকারি মহাপরিকল্পনায় রাখা হয়নি। সরকারি মহাপরিকল্পনা সাজানো হয়েছে বাতিল ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রযুক্তির পারমাণবিক ও পরিবেশবিনাশী কয়লা বিদ্যুৎকে ঘিরে। অপরদিকে জাতীয় কমিটি প্রস্তাব করেছে দেশীয় প্রাকৃতিক গ্যাসসম্পদ আহরণ ও উত্তোলনে অধিক মনোযোগী হওয়ার আর নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রসারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার। জাতীয় কমিটির প্রস্তাব অনুসারে জল-জমি-জঙ্গল, প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদন যে নিশ্চিত করা সম্ভব হবে–শুধু তাই নয়; বরং এর মাধ্যমে পাওয়া যাবে তুলনামূলক সস্তা বিদ্যুৎ, নিশ্চিত হবে সর্বজনের স্বার্থ আর অর্জন হবে জ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ।
কাজেই শুধু দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াটের রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র কিংবা দেশজুড়ে পরিকল্পিত সাত হাজার ২০০ মেগাওয়াটের পারমাণবিক প্ল্যান্ট তৈরির সার্বিক পরিকল্পনা বাতিলই যথেষ্ট নয়; বরং বাতিল করতে হবে কয়লা আর আমদানিকৃত বিদ্যুতের সব পরিকল্পনা, যেগুলোর প্রাথমিক বাস্তবায়নকালে গত ১০ বছরে ৫২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির নামে ইতোমধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের পকেটে [৭৭]। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে বাড়তি খরচের এই টাকা জোগাতে, অপরদিকে বাংলাদেশের বৃহৎ বিদ্যুৎ ব্যবসায়ী গ্রুপের মালিক সিঙ্গাপুরে নাম লিখিয়েছে শীর্ষ ধনী ব্যক্তির তালিকায় [৭৮]।
উল্লেখ্য যে, ২০১৮ সালে Revisiting PSMP 2016 শিরোনামে একটি ডকুমেন্ট প্রকাশ করা হয়, যেখানে কিছু সংখ্যাগত পার্থক্য ব্যতীত মূল PSMP 2016-এর সঙ্গে আদতে কোনো পার্থক্য নেই বললেই চলে। আমদানি নির্ভরতা, কয়লা এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রভিত্তিক উৎপাদন কাঠামো এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির অনুপস্থিতি একইরূপে এই পরিকল্পনায়ও বিদ্যমান। শুধু পার্থক্য হিসেবে বলা যায়, PSMP 2016-তে যেখানে জাপানভিত্তিক সাহায্য সংস্থা জাইকার অর্থায়নে, জাপানিজ বিদ্যুৎ কোম্পানি টেপকোর কারিগরি নির্ভরতার মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল এবং বিদেশি এজেন্সি এবং কোম্পানির লোগো দৃষ্টিকটুভাবে উপস্থিত ছিল, বর্তমান ডকুমেন্টে সেই দৃষ্টিকটু উপস্থিতি নেই; যদিও এটিকে স্বাধীন কোনো গবেষণাভিত্তিক নীতিমালা বলার কোনো অবকাশ নেই। কারণ, মূল রেফারেন্স হিসেবে এখানে PSMP 2016-কেই ব্যবহার করা হয়েছে।
Revisiting PSMP 2016-এর শুরুতেই (২য় পাতা) মোটা দাগে এই নীতিমালার মাধ্যমে উৎপাদন লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ২০৪১ সালের মধ্যে টোকিওর সমান উৎপাদন কাঠামো গড়ে তোলা হবে এবং এর মাধ্যমে দেশও উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছে যাবে, বিদ্যুৎ চাহিদা হবে ৭২ হাজার মেগাওয়াট এবং মোট উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৭৯ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট, কয়লাভিত্তিক উৎপাদন ক্ষমতা হবে ২৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট, পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট এবং আমদানি করা হবে ১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ, প্রাকৃতিক গ্যাস কিংবা এলএনজিভিত্তিক উৎপাদন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক উৎপাদন হবে যথাক্রমে ৩৪ হাজার এবং ৭ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। হিসাবের গরমিল শুরুতেই চোখে পড়ার মতো। মোট উৎপাদন ক্ষমতার সঙ্গে উৎসভিত্তিক উৎপাদনের যোগফলের সঙ্গে কোনো মিল নেই!
Revisiting PSMP 2016 ডকুমেন্টে PSMP 2016-এর সঙ্গে তুলনামূলক ধারাবাহিক ছক লো কেইস, হাই কেইস এবং বেইজ কেইস অবস্থার সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদার প্রাক্কলন তুলে ধরা হয়েছে:
বিদ্যুৎ চাহিদার তুলনামূলক চিত্র
সময়কাল | পিএসএমপি-২০১৬ অনুসারে; প্রাক্কলিত সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদা (মেগাওয়াট) | রিভিজিটিং পিএসএমপি-২০১৬ অনুসারে, প্রাক্কলিত সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদা (মেগাওয়াট) | ||||
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী কাঠামো বিবেচনায় | বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী কাঠামো বিবেচনায় | |||||
হাই কেইস | বেইজ কেইস | লো কেইস | হাই কেইস | বেইজ কেইস | লো কেইস | |
২০২১ | ১৪৫০০ | ১৪৫০০ | ১৪৫০০ | ১৭৫১১ | ১৬৫৮১ | ১৫৪৭৭ |
২০৪১ | ৫৫৯০০ | ৫১০০০ | ৪৮০০০ | ৬৫৮৩৪ | ৬২০৩২ | ৫৭৯০৩ |
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী কাঠামোর অনুপস্থিতিতে | বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী কাঠামোর অনুপস্থিতিতে | |||||
২০২১ | ১৫৪০১ | ১৫৩৯৪ | ১৫৩৯০ | ১৯০৩৪ | ১৮০২৩ | ১৬৮২৩ |
২০৪১ | ৬৭৭১০ | ৬১৬৮১ | ৫৭৯৪৬ | ৮২২৯২ | ৭৭৫৪০ | ৭২৩৭৯ |
কীসের ভিত্তিতে মাত্র দুবছরের ব্যবধানে প্রাক্কলিত চাহিদা ৬১ হাজার ৬৮১ মেগাওয়াট থেকে ৭৭ হাজার ৫৪০ মেগাওয়াটে (বিদ্যুৎসাশ্রয়ী কাঠামোর অনুপস্থিতিতে) পৌঁছে যাওয়ার মতো, প্রতিটি প্রাক্কলনে সংখ্যাগুলো একলাফে বেড়ে গেল সেই ব্যাখ্যা অনুপস্থিত।
‘রিভিজিটিং পিএসএমপি-২০১৬’ ডকুমেন্ট অনুসারে হাই এবং লো কেইস অবস্থায় উৎসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কাঠামো নিচের ছকে দেওয়া হলো:
টেবিল: ‘রিভিজিটিং পিএসএমপি-২০১৬’ ডকুমেন্ট অনুসারে হাই এবং লো কেইস অবস্থায় উৎসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন
জ্বালানি
| হাই কেইস | লো কেইস | ||||||
২০২১ | (%) | ২০৪১ | (%) | ২০২১ | (%) | ২০৪১ | % | |
কয়লা | ৪৭৪৫ | ১৭ | ৩০১৬৬ | ৩২ | ২৮৬৪ | ১১ | ২৫৫৯৬ | ৩২ |
প্রাকৃতিক গ্যাস/ এলএনজি | ১৩১৮৭ | ৪৬ | ৪০৬৬১ | ৪৩ | ১৩৮৪৬ | ৫৩ | ৩৪১৬৫ | ৪৩ |
তরল জ্বালানি | ৮৭২৮ | ৩১ | ২১৮৬ | ২ | ৭৮৬৪ | ৩০ | ১৮৪০ | ২ |
আমদানিকৃত বিদ্যুৎ | ১৫০০ | ৫ | ১৪১২১ | ১৫ | ১৫০০ | ৬ | ১১৯৯৬ | ১৫ |
পারমাণবিক | ০ | ০ | ৬৬৯৬ | ৭ | ০ | ০ | ৫৫৮০ | ৭ |
জলবিদ্যুৎ | ২৩০ | ১ | ৩৩০ | ০.৩৫ | ২৩০ | ১ | ৩৩০ | ০.৪২ |
সর্বমোট (মেগাওয়াট) | ২৮৩৯০ | ১০০ | ৯৪১৬০ | ১০০ | ২৬৩০৪ | ১০০ | ৭৯৫০৭ | ১০০ |
(উল্লেখ্য যে, নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক উৎপাদন মহাপরিকল্পনায় অনুপস্থিত; যদিও নবায়নযোগ্য জ্বালানিবিষয়ক একটি পুরো অধ্যায় মহাপরিকল্পনায় যুক্ত করা হয়েছে যেখানে ২০৪১ সাল নাগাদ ১০% নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক উৎপাদনী অবকাঠামো গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে!)
লক্ষণীয় যে, পরিবর্তিত নীতিমালায় (রিভিজিটিং পিএসএমপি-২০১৬) নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক উৎপাদনের কোনো জায়গা হয়নি! যদিও নবায়নযোগ্য জ্বালানিবিষয়ক পুরো একটা অধ্যায় আছে। এ বিষয়ে বলা হয়েছে: ‘The peak power demand time in Bangladesh is at night, so the solar power does not work at peak time. Therefore, solar power is not considered in the integrated power development plan. If load pattern is changed from night peak to day peak in future, solar power will be considered in the future power development plan’–নবায়নযোগ্য জ্বালানিবিষয়ক অজ্ঞতা প্রকাশ হয়তো এর চেয়ে অবৈজ্ঞানিকসুলভ ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়!
অর্থাৎ, এটা পরিষ্কার যে, সরকার ঘোষিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মহাপরিকল্পনা ইতোমধ্যে ক্যানসার কোষে পরিণত হয়েছে। এটির ক্ষত মলম লাগিয়ে সারিয়ে তোলার উপায় নেই। পিএসএমপির সর্বশেষ ভার্সন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এ কারণে এই সর্বগ্রাসী পরিকল্পনার পুরোটাই বাতিল করে জনকল্যাণমূলক পরিকল্পনাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সেটির বাস্তবায়নে জাতীয় কমিটির প্রস্তাবিত বিকল্প মহাপরিকল্পনা নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক প্রচার-প্রচারণা ও আলোচনার মাধ্যমে জনমত গঠন প্রক্রিয়া হতে পারে বিদ্যুৎ সেক্টরের ক্যানসার থেকে মুক্তির প্রথম ধাপ।
উপসংহার
বিজ্ঞানের নামে যারা বিশ্বাস ছড়াতে চায়, তাঁরাই আধুনিকতা অর্জনের নামে বিনা প্রশ্নে প্রযুক্তির ঘাড়ে পা তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে। অথচ, এমন মিথ্যা আশ্বাস আর ভ্রান্ত প্রচারণায় সর্বজনের হিসাবের খাতায় ক্ষতির পরিমাণ শুধুই বাড়ে। অঢেল টাকা ছড়িয়ে পারমাণবিকের পক্ষে চলছে প্রচার-প্রচারণা, আমলাদের বিদেশ ভ্রমণ, তৈরি হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন অথচ অপরদিকে সর্বজনের পক্ষ থেকে উচ্চারিত প্রশ্নগুলোর কোনো প্রচার নেই, কোনো জবাবও নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, জটিল প্রযুক্তির লেবেল লাগানো নিউক্লিয়ার ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সব সময়ই রাষ্ট্রের থাকে মিথোজীবিতার সম্পর্ক। দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, ঘুষখোর আমলা, দালাল বুদ্ধিজীবী আর পদকলোভী বিজ্ঞানীদের একে অপরকে আশ্রয় করে দিনের পর দিন নিরাপদে টিকে থাকার আবাস হচ্ছে এই নিউক্লিয়ার ইন্ডাস্ট্রি। তাই পারমাণবিক বিদ্যুৎবিষয়ক প্রশ্ন এবং সংশয়গুলোকে যারা প্রপাগান্ডা হিসেবে খারিজ করে দেওয়ার চেষ্টা করেন, তাঁরা আসলে দিনশেষে ক্ষতি করেন সত্যের। ক্ষতিটা হয়ে যায় সাধারণ মানুষের, যাদের অশিক্ষিত আর মূর্খ জ্ঞান করে, জটিলতার প্যাকেটে সবকিছু বন্দি রেখে সরকার করে ফেলছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
বিজ্ঞানের নামে যারা বিশ্বাস ছড়াতে চায়, তাঁরাই আধুনিকতা অর্জনের নামে বিনা প্রশ্নে প্রযুক্তির ঘাড়ে পা তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে। অথচ, এমন মিথ্যা আশ্বাস আর ভ্রান্ত প্রচারণায় সর্বজনের হিসাবের খাতায় ক্ষতির পরিমাণ শুধুই বাড়ে। অঢেল টাকা ছড়িয়ে পারমাণবিকের পক্ষে চলছে প্রচার-প্রচারণা, আমলাদের বিদেশ ভ্রমণ, তৈরি হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন অথচ অপরদিকে সর্বজনের পক্ষ থেকে উচ্চারিত প্রশ্নগুলোর কোনো প্রচার নেই, কোনো জবাবও নেই।
তাই চেরনোবিল আর ফুকুশিমার আয়নায় যারা রূপপুরের রূপ দেখে আতঙ্কিত হচ্ছেন, বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন করছেন, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎ থেকে সরে আসার কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করছেন, তাঁদের আতঙ্ক আমলে নেওয়া প্রয়োজন, তাঁদের প্রশ্নের জবাব দেওয়া প্রয়োজন। অথচ প্রশ্নের বিপরীতে স্বৈরাচারী ডান্ডা দেখানোর প্রবণতাই অনেক বেশি। আমরা আশা করি, সরকার ভয়-ভীতি আর পেশিশক্তির প্রদর্শন বন্ধ করে যুক্তির টেবিলে বসবেন, রূপপুরে ইতোমধ্যে হয়ে যাওয়া দুর্নীতির সুষ্ঠু বিচার করে প্রত্যেক দোষীর শাস্তি নিশ্চিত করবেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসংশ্লিষ্ট দায়মুক্তি আইন বাতিল করবেন, সব চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশ করবেন, উত্থাপিত সব প্রশ্নের জবাব দেবেন এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প অবিলম্বে বাতিল করে সুলভ ও প্রাণ-প্রকৃতিবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনে মনোযোগী হবেন।
আমরা আশা করি, সরকার ভয়-ভীতি আর পেশিশক্তির প্রদর্শন বন্ধ করে যুক্তির টেবিলে বসবেন, রূপপুরে ইতোমধ্যে হয়ে যাওয়া দুর্নীতির সুষ্ঠু বিচার করে প্রত্যেক দোষীর শাস্তি নিশ্চিত করবেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসংশ্লিষ্ট দায়মুক্তি আইন বাতিল করবেন, সব চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশ করবেন, উত্থাপিত সব প্রশ্নের জবাব দেবেন এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প অবিলম্বে বাতিল করে সুলভ ও প্রাণ-প্রকৃতিবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনে মনোযোগী হবেন।
আর তা না-হলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রক্ষায় সরকারকে জনকল্যাণমূলক বিকল্প বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নীতি বাস্তবায়নে বাধ্য করার জন্য গণ-আন্দোলন ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
তথ্যসূত্র:
[১] দৈনিক প্রথম আলো, ১৮ মে, ২০২০, “বাংলাদেশের অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস পড়ে আছে”
[২] Nicholas S., Ahmed S. J, Institute for Energy Economics and Financial Analysis, “Bangladesh Power Review,” May, 2020.
[৩] দৈনিক প্রথম আলো, ১৮ মে, ২০২০, “বাংলাদেশের অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস পড়ে আছে”
[৪] তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি, “শিল্প ও কৃষি সহ সকল ঘরে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ কীভাবে সম্ভব?” জানুয়ারি, ২০১৮
[৫] Schneider et al. A Mycle Schneider Consulting Project, “The World Nuclear Industry Status Report 2019” 2019.
[৬] Le Monde, ১০ জুলাই, ২০২০, “Operational failure and cost drift: management of the EPR, a third generation nuclear reactor, criticized by the Court of Auditors”
[৭] BBC, March, 2017, “Toshiba’s Westinghouse files for US bankruptcy”
[৮] Schneider et al. A Mycle Schneider Consulting Project, “The World Nuclear Industry Status Report 2019” 2019.
[৯] Government of India, Ministry of Power, https://powermin.nic.in/en/content/power-sector-glance-all-india, accessed on 10 January, 2021.
[১০] Rediff.com, October 4, 2010, “197 suicides and 1,733 deaths at India’s nuclear establishments in last 15 yrs”
[১১] এম ভি রামান, আশিন কুমান, সর্বজনকথা, “ভারতের পারমাণবিক কেন্দ্র কতটা নিরাপদ-১”, ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল, ২০১৮
[১২] Bangladesh Atomic Energy Commission, http://www.baec.gov.bd/ accessed on 5 January, 2021
[১৩] World Nuclear Association, “Nuclear Power in Bangladesh,” http://world-nuclear.org/information-library/country-profiles/countries-a-f/bangladesh.aspx accessed on 10 January, 2021.
[১৪] Ministry of Power, Energy and Mineral Resources Government of the Peoples Republic of Bangladesh, Power Sector Master Plan 2016, September, 2016 PSMP 2016, pp 1-1128
[১৫] New Age, 29 September, 2015, “Rooppur NPP to get VVER-1200 nuclear reactor from Russia”
[১৬] World Nuclear Associate, Advanced Nuclear Power Reactors, accessed on 9 January, 2021
[১৭] NDTV, 14 May, 2013, “Top scientists express safety concerns over Kudankulam nuclear plant”
[১৮] Dianuke, 8 April, 2013, “Is Koodankulam Unsafe?: Russian Supplier Arrested for Corruption and Substandard Equipment”
[১৯] BDnews24.com, 10 July, 2013, “Rooppur Nuclear Power Plant: Unsafe, not viable!”
[২০] মওদুদ রহমান, বণিক বার্তা, ২৯ নভেম্বর, ২০১৭, “রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎঃ আধুনিকতা নাকি কূপমণ্ডূকতা?”
[২১] Dhaka Tribune, 15 July, 2019, “Report: Tk36 crore embezzled in Rooppur housing project scam”
[২২] Independent, “Nearly 50 countries vow to use 100% renewable energy by 2050” 18 November, 2016
[২৩] Peter Custers, Daily Star, 21 January, 2013, “Questions on Rooppur nuclear deal”
[২৪] প্রথম আলো, ১ নভেম্বর, ২০১৮, “রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজেও যুক্ত হচ্ছে ভারত!”
[২৫] প্রথম আলো, ২৭ নভেম্বর, ২০১৬, “স্পেন্ট ফুয়েল নেবে রাশিয়া, বর্জ্য নেওয়া অনিশ্চিত”
[২৬] প্রথম আলো, ২৭ অক্টোবর, ২০১৬, “তেজস্ক্রিয় বর্জ্য নিয়ে সরকার উদ্বিগ্ন”
[২৬ (ক)] গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ৩০ আগস্ট, ২০১৭, প্রেস বিজ্ঞপ্তি
[২৭] K.M. Mahbubur Rahman, Daily Star, 8 March, 2015, “Cooling water requirement for Rooppur nuclear power plant”
[২৮] K.M. Mahbubur Rahman, The Daily Star, 30 August, 2015, “A challenge for Rooppur nuclear power plant”
[২৯] www.rooppurnpp.gov.bd, accessed on 2 January, 2021
[৩০] দৈনিক ইনিকিলাব, ১৯ মে, ২০১৯, “২ কোটি টাকার বালিশ”
[৩১] World Nuclear Association, “Nuclear Power in Bangladesh,” accessed on 10 January, 2021.
[৩২] The Daily Star, 28 October, 2015, “Bangladesh to spend $13.5b to build 2,400MW nuclear power plant”
[৩৩] Energy Matters, 27 July, 2016, “How long does it take to build a nuclear power plant?”
[৩৪] প্রথম আলো, ১১ এপ্রিল, ২০১৬, “পারমাণবিক বিদ্যুতের দাম নিয়ে বিভ্রান্তি”
[৩৫] A Rahman, The Daily Star, 31 December, 2015, “Ruppur Nuclear Power Plant: Bangladesh’s Potential Blackhole”
[৩৬] The Daily Star, 28 October, 2015, “Bangladesh to spend $13.5b to build 2,400MW nuclear power plant”
[৩৭] American Nuclear Society, Center for Nuclear Science and Technology Information, November, 2005, “The Price-Anderson Act”
[৩৮] Citizen.org, September, 2004, “Price-Anderson Act: The Billion Dollar Bailout for Nuclear Power Mishaps”
[৩৯] A Rahman, The Daily Star, 31 December, 2015, “Ruppur Nuclear Power Plant: Bangladesh’s Potential Blackhole”
[৪০] Thruthout, 14 November, 2016 “Nuclear Power Is Not “Green Energy”: It Is a Fount of Atomic Waste”
[৪১] Thruthout, 14 November, 2016 “Nuclear Power Is Not “Green Energy”: It Is a Fount of Atomic Waste”
[৪২] Dhaka Tribune, July 2016, “We have no Expertise to Run Nuclear Plant”
[৪৩] Andrey Shevlyakov, The Daily Star, 25 December, 2017, “Changing perceptions on nuclear energy”
[৪৪] Mowdud Rahman, Debasish Sarker, The Daily Star, 21 January, 2018, “Nuclear Power: Challenging Rosatom’s claims”
[৪৫] International Atomic Energy Agency, “IAEA Safety Standards for protecting people and the environment” pp 1-159
[৪৬] World Nuclear Association, “Nuclear Power in Bangladesh,” accessed on 10 January, 2021.
[৪৭] Reuters, 25 June, 2019, “World’s first underground nuclear waste storage moves forward in Finland”
[৪৮] World Nuclear Association, “Nuclear Power in Finland,” accessed on 10 January, 2021.
[৪৯] মুহম্মদ আনোয়ার হোসেন, সর্বজনকথা, “মানুষকেন্দ্রিক সভ্যতা, পারমাণবিক সুবিধা, পারমাণবিক বর্জ্য এবং তার প্রতিফলন” ৭ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা
[৫০] Matin A. (2012), Rooppur & The Power Crisis
[৫১] Reuters, December 9, 2016, “Japan nearly doubles Fukushima disaster-related cost to $188 billion”
[৫২] Thethirdpole, June 5, 2015, “Water shortages pose risks to Bangladesh’s first nuclear plant”
[৫৩] প্রথম আলো, ৭ অক্টোবর, ২০১৬, “পারমাণবিক দুর্ঘটনার দায় বাংলাদেশের”
[৫৪] The NewYork Times, 5 June, 1987, “Specter of Chernobyl Looms Over Bangladesh”
[৫৫] দৈনিক ইনকিলাব, ২১ এপ্রিল, ২০১৭, “রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্রেন ভেঙ্গে ওয়ার্কশপ ভবন ও সীমানা প্রাচীর বিধ্বস্ত”
[৫৬] কালের কন্ঠ, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, “কর্মরত রুশ নাগরিকের মৃত্যু”
[৫৭] কালের কন্ঠ, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৮, “রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে ক্রেন দুর্ঘটনায় নিহত ১, আহত ৩”
[৫৮] দৈনিক ইত্তেফাক, ২৫ জানুয়ারি, ২০১৯, “রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে আবারো রাশিয়ান নাগরিকের মৃত্যু”
[৫৯] দৈনিক ইনকিলাব, ১৩ জানুয়ারি, ২০১৯, “ক্রেন ভেঙে ৩ শ্রমিক আহত”
[৬০] প্রথম আলো, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, “রূপপুরে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে রুশ নাগরিকের মৃত্যু”
[৬১] দৈনিক ইনকিলাব, ৭ এপ্রিল, ২০১৯, “রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে এক প্রকৌশলীর মৃত্যু, ২জন অসুস্থ”
[৬২] দেশ রূপান্তর, ১৬ মে, ২০১৯, “কেনা-তোলায় এত ঝাঁজ”
[৬৩] বাংলা ট্রিবিউন, ২ জুন, ২০১৯, “রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের গ্রিনসিটিতে নির্মাণ শ্রমিক নিহত”
[৬৪] প্রথম আলো, ১০ জুলাই ২০১৯, “রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে নির্মাণাধীন স্থাপনায় ধস, আহত ১০ শ্রমিক”
[৬৫] প্রথম আলো, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, “রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যয় কিছুটা বেশি”
[৬৬] প্রথম আলো, ৩০ অক্টোম্বর, ২০১৯, “রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে পরামর্শ নিতেই খরচ হবে প্রকল্পের ৭৭% টাকা”
[৬৭] প্রথম আলো, ২৪ নভেম্বর, ২০১৯, “রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র: এক হাজার টাকায় ১০০ একর জমি”
[৬৮] DW, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৯, “বালিশকাণ্ডে গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ গ্রেপ্তার ১৩”
[৬৯] দৈনিক অধিকার, ২৩ মার্চ, ২০২০, “রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পে লোহার রড গায়ে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যু”
[৭০] আমাদের সময়, ২৩ মার্চ, ২০২০, “রূপপুর প্রকল্পে দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যু”
[৭১] সময়, ২৪ এপ্রিল, ২০২০, “রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে দুর্ঘটনা, প্রকৌশলী নিহত”
[৭২] বাংলা ট্রিবিউন, ২৮ আগস্ট, ২০২০, “চার দিন ধরে মদ খেয়ে রাশিয়ান নাগরিকের মৃত্যু”
[৭৩] প্রথম আলো, ৩০ আগস্ট, ২০২০, “জামিনে মুক্ত বালিশ কাণ্ডের সেই ঠিকাদার”
[৭৪] GOB. ‘The Study for Master Plan on Coal Power Development in the People Republic of Bangladesh.’ PSMP 2016. Prepared by JICA. 2016. P. 7-26 11-33.
[৭৫] Estimated based on figures provided in PSMP 2016. GOB.
[৭৬] Estimated cost analysis done by National Committee research panel.
[৭৭] বাংলা ট্রিবিউন, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, “১০ বছরে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি ৫২ হাজার কোটি টাকা: নসরুল হামিদ”
[৭৮] প্রথম আলো, ১৬ আগস্ট, ২০১৮, “সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীর তালিকায় আজিজ খান”
638