পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এবং ‘নারীসুলভ’ মনের গড়ে ওঠা

নারী-পুরুষের মানস : পুরুষতান্ত্রিক ধারণা ও বৈষম্যের জৈবসামাজিক ভিত্তি-৫

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এবং ‘নারীসুলভ’ মনের গড়ে ওঠা

মনিরুল ইসলাম

নারীসুলভ হতে হলে হতে হবে দুর্বল, অপদার্থ, উদ্যোগহীন ও বশ মানা। বালিকাকে…দমন করতে হবে তার স্বতস্ফূর্ততা এবং তার জায়গায় নিয়ে আসতে হবে গুরুজন শেখানো ছলাকলা ও আদবকায়দাকে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার যে কোনো উদ্যোগই কমাবে তার নারীত্ব ও আবেদন। তরুণ পুরুষের ক্ষেত্রে নিজের অস্তিত্বের ভেতর বিচরণ অপেক্ষাকৃত সহজ, কেননা মানুষ হিসেবে তার বৃত্তি এবং পুরুষ হবার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।৪৯

-সিমোনদ্য বুভোয়া, The Second Sex

বালিকা ও পূর্ণবয়স্ক নারীর আচরণ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট প্রত্যাশার মাধ্যমে প্রতিটি সমাজই নারীর ভূমিকা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয়। বালিকা ও পূর্ণবয়স্ক নারীর  যে ধরনের আচরণ আমাদের সমাজ যথাযথ বলে মেনে নেয় তা আমাদের চেতনায় সংজ্ঞায়িত ও সামাজিকৃত হয় নানা উৎস থেকে…।… আশা করা হয় মেয়েরা হবে ভদ্র, বাধ্যগত, মমতাময় এবং অপত্যস্নেহশীল। এসব সামাজিক প্রত্যাশাগুলোর পেছনে যে গুরুত্বপূর্ণ ধারণাটি রয়েছে তা হল (সামাজিক ভাবে) সম্পর্কিত থাকা এবং একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত থাকা বালিকা ও পূর্ণবয়স্ক নারীর জীবনের প্রয়োজনীয় একটি দিক।৫০

-পামেলা ট্রটম্যান রিড,  Girls to Women: Developmental Theory                                                                                                             

রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তী’ গল্পের ঘটনাটা আজ থেকে একশো বছর আগের। সে সময়ে দশ-এগারো বছর বয়সে এদেশের বেশির ভাগ মেয়ের বিয়ে হত। হৈমন্তীর ষোল হলেও বিয়ে হয় নি তখনও। তার কারণ তার বাবা লোক সমাজ থেকে দূরে থাকতেন যেখানে কেউ তাকে বিয়ের তাগিদ দেন নি। দূরে থাকায় মাতৃহারা মেয়ের ক্ষেত্রে আরেকটি ব্যাপার ঘটেছে যা লেখক আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন। “…বয়স যথাসময়ে ষোল হইল; কিন্তু সেটা স্বভাবের ষোল, সমাজের ষোল নহে। কেহ তাহাকে আপন বয়সের জন্য সতর্ক হইতে পরামর্শ দেয় নাই, সেও আপন বয়সের দিকে ফিরিয়াও তাকাইত না।”৫১ হৈমন্তী ব্যতিক্রম, এই ব্যতিক্রম থেকে আমরা অনুমান করতে পারি নিয়মটা কী। স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল এর বিপরীতটাই। শৈশবে না হলেও ‘বিয়ের বয়স’ হওয়া মাত্র মেয়েদের কাছে ‘আপন বয়সের জন্য সতর্ক’ হবার পরামর্শ, আদেশ ও নির্দেশ আসতে থাকে নানা ভাবে। এই সব সামাজিক নির্দেশনা অবশ্যই বালিকা ও তরুণীর জন্য যেমন বালক ও যুবকের জন্য সে রকম নয়। এগুলো একশো বছর আগেও ছিল এখনও আছে। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে এ ক্ষেত্রে মাত্রাগত কিছু পরিবর্তন হলেও গুণগত কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। শৈশবের সংজ্ঞা হয়তো কিছুটা বদলেছে, ‘বিয়ের বয়স’ কিছুটা বেড়েছে কিন্তু মূল ব্যাপারটা বদলায়নি। নারীর আচরণ সম্পর্কে সমাজের এই প্রত্যাশা ও নির্দেশনা বালিকা ও পূর্ণবয়স্ক নারীর আচরণ ও মানসিকতার  ধরণ গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

শৈশব থেকেই মেয়েরা সমাজের লিঙ্গ-নির্দিষ্ট ভূমিকার সঙ্গে মানিয়ে নেবার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে থাকে। এভাবে প্রস্তুত না হলে পুরুষতান্ত্রিক পরিবার ও সমাজের সম্পর্কগুলো তার জন্য সাংঘর্ষিক হয় এবং এর জন্য নারীকেই মূল্য দিতে হয়। যেমন দিতে হয়েছিল হৈমন্তীকে। অল্প বয়সে মাতৃহারা, লোকসমাজ থেকে দূরে থাকা এবং উচ্চ-শিক্ষিত পিতার উদারতা বা উদাসীনতাই হয়ত হৈমন্তীর ক্ষেত্রে সমাজের প্রত্যাশা অনুযায়ী আচরণ ও মানসিকতা গড়ে উঠতে দেয় নি যা অন্যসব মেয়ের ক্ষেত্রে স্বতস্ফূর্তভাবেই গড়ে ওঠে। হৈমন্তী যদি ‘সমাজের ষোল’ বছর বয়সের মেয়েদের আচরণ ও ছলাকলা রপ্ত করতে পারত তাহলে হয়ত সে শ্বশুর বাড়িতে টিকে যেতে পারত। গবেষণায় দেখা গেছে যে অনেক অল্প বয়সেই মেয়েরা নারীসুলভ আচরণ সম্পর্কে সামাজিক প্রত্যাশা ও নির্দেশনাগুলো অনুধাবন করতে পারে।৫২ বেড়ে ওঠার সময়ের এই উপলব্ধি মেয়েদের মানসিক বিকাশের             গতি-প্রকৃতিকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। লিঙ্গ-নির্দিষ্ট ভূমিকা সম্পর্কিত ধারণাগুলো মেয়েরা পায় সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে। তবে এগুলোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি উৎস হল পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। গুরুত্বের দিক থেকে এর পরেই রয়েছে সামাজিক কালচার ও মিডিয়ার ভূমিকা। 

‘মেয়েলী আচরণ’ বা ‘মেয়েলি স্বভাব’ সম্পর্কে আমাদের সমাজে যে সব ধারণা ব্যাপকভাবে প্রচলিত তার মধ্যে কিছু ইতিবাচক এবং কিছু নেতিবাচক। এই ধারণাগুলো সামাজিক পরিবেশে মেয়েদের আচরণ ও কার্যক্রমের আপাত পর্যবেক্ষণ এবং প্রচলিত সামাজিক বিশ্বাসের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠে। নেতিবাচক ধারণাগুলো হল- মেয়েরা বাচাল, লাজুক, নাজুক, ভীতু, দুর্বলমনা, ছিচকাঁদুনে, অপদার্থ, আত্মকেন্দ্রিক, সংকীর্ণমনা, ছলনাময়ী ইত্যাদি এবং ইতিবাচক ধারণা হল- তারা নম্র, বাধ্যগত, মায়াময়, সংবেদনশীল, ধীরস্থির ইত্যাদি। মেয়েদের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে এর অনেকগুলোর উপস্থিতি দেখা গেলেও সেগুলো তাদের জন্মগত বৈশিষ্ট্য নয়। কারণ মনোবিজ্ঞানের আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে সামাজিক পরিবেশের প্রভাবই মূলত মেয়েদের মানসিক বিকাশের গতি-প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ শতকে আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরা সূত্রায়িত করেন, মানুষের জন্মগত মানসিক প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্যগুলো তার ব্যক্তিত্বের নির্ণায়ক নয়। ব্যক্তিত্বের বিকাশ তখনই শুরু হয় যখন সে অন্য মানুষের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্কে নিয়োজিত হয়। তাই অনুমান করা যায় নরনারীর ব্যক্তিত্বের পার্থক্য তৈরির ক্ষেত্রেও সমাজ-বাস্তবতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নারী ও পুরুষকে ভিন্ন রকমের সামাজিক বাস্তবতা ও সম্পর্কের মধ্যে যেতে হয়। নারীর মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে উপরে উল্লিখিত সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাব সম্পর্কে গত কয়েক দশকে যে সব গবেষণা হয়েছে তার পর্যালোচনা আমাদেরকে এ ব্যাপারে আরও স্পষ্ট ধারণা দিতে পারে।

নরনারীর ব্যক্তিত্বের পার্থক্য তৈরির ক্ষেত্রেও সমাজ-বাস্তবতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নারী ও পুরুষকে ভিন্ন রকমের সামাজিক বাস্তবতা ও সম্পর্কের মধ্যে যেতে হয়।

মা বাবা ও পরিবারের ভূমিকা

বেড়ে ওঠার সময় শিশু সবার আগে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের মনোভঙ্গি ও আচরণ দ্বারা প্রভাবিত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মা-বাবা। যৌথ পরিবারে অন্যান্য বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রভাবও থাকে কিন্তু একক পরিবারে মা বাবার প্রভাবই মূখ্য। এই প্রভাবের দুটি প্রধান দিক রয়েছে। প্রথমত মেয়ে সন্তান তার মায়ের আচরণ ও মনোভঙ্গিকে নিজের অজান্তেই অনেকটা অনুসরণ করতে থাকে। অন্যদিকে মেয়ে সন্তান সম্পর্কে মা-বাবার ধারণা এবং তারা কন্যা সন্তানের কাছ থেকে কেমন আচরণ আশা করছেন সেটাও বেড়ে-ওঠা মেয়েটির আচরণকে সুনির্দিষ্ট আকার দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে বেশিরভাগ মা-বাবা মনে করেন মেয়েরা হবে বাচাল, বাধ্যগত, শারীরিকভাবে দুর্বল, ধীরস্থির এবং পরিচ্ছন্ন।৫৩ মেয়ে শিশুর প্রতি তাদের মনোভাব, আচরণ ও প্রত্যাশা এই ধারণা দ্বারা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। ছোটবেলা থেকেই ছেলের তুলনায় মেয়েকে বেশি আগলে রাখতে বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে দেখা যায় বাবা-মাকে । মেয়ে সন্তানের আঘাত বা বিপদ নিয়ে বাবা-মা ছেলে সন্তানের চেয়ে বেশি চিন্তিত বা উদ্বিগ্ন থাকেন। তাদের অধিকাংশের বিশ্বাস কাঙ্ক্ষিত আচরণ ও জীবনধারার বাইরে গেলে মেয়েরা সমূহ বিপদে পড়তে পারে।

এসব ধারণার প্রভাব পরিবারের ভেতর প্রচ্ছন্ন এবং প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় থাকে। এসব ধারণার কারণে মা-বাবা ছেলেমেয়েদেরকে লিঙ্গ-নির্দিষ্ট আচরণ, কাজকর্ম, পোশাক ও খেলা বা খেলার সামগ্রীতে উৎসাহিত করতে দেখা যায়।৫৪ আমরা আপাতদৃষ্টিতে দেখি মেয়ে শিশুরা ‘মেয়েলি খেলনা’, যেগুলো শারীরিক সৌন্দর্য, সন্তান-পালন এবং গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে সম্পার্কত, যেমন পুতুল, হাড়ি-পাতিল ইত্যাদি দিয়ে খেলতে পছন্দ করে। অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সে (যে বয়সে শিশুদের এধরনের কোনো পছন্দ থাকে না) মা বাবাই তাদের নিজস্ব ধারণা অনুযায়ী মেয়েদের পোশাক ও খেলনার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনেন। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় দেখা গেছে শিশুরা পরিবার বা পরিবারের বাইরের বড়দের কাছ থেকে সাধারণত লিঙ্গ-নির্দিষ্ট খেলনাই পেয়ে থাকে। এই গবেষণায় আরও দেখা যায় বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েলি খেলনার প্রতি মেয়েদের এই পছন্দ কমতে থাকে এবং ক্রমান্বয়ে ‘পুরুষালী’ ও নিরপেক্ষ খেলনার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে।৫৫,৫৬ শুধু খেলনার ধরণ নয় খেলার ক্রিয়া-কর্মের ক্ষেত্রেও মা-বাবা শিশুদের লিঙ্গ-নির্দিষ্ট আচরণের দিকে উদ্বুদ্ধ করে থাকে।৫৭ এর মাধ্যমে মা-বাবা তাদের লিঙ্গ-নির্দিষ্ট বিশ্বাস সন্তানের মধ্যে সঞ্চারিত করেন। শিশুদের সঙ্গে নিত্যদিনের যে আচরণ তার মাধ্যমেও তাদের এই বিশ্বাস সন্তানের কাছে উন্মোচিত হয়।

ধর্ম, লোকাচার এবং অন্যান্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিশ্বাস আর আচারের প্রভাব ছেলেমেয়ের কাছে আসে মা-বাবার কাছ থেকেই। সব ধর্মেই মেয়েদেরকে অবদমিত ও গন্ডীবদ্ধ রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পারিবারিক বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্ম-নির্দেশিত অবরোধ এবং বালিকা ও পূর্ণবয়স্ক নারীদের আগলে রাখার প্রবণতার কারণে সীমাবদ্ধ হয় মেয়েদের চলাফেরা ও কার্যক্রম। যা তার বাস্তবতা-বোধ ও আত্মবিশ্বাসকে খর্ব করে। নিজের মানসের উপর পরিবারের এই প্রভাব বেশিরভাগ নারীই পরবর্তী জীবনেও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারে না।

ধর্ম, লোকাচার এবং অন্যান্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিশ্বাস আর আচারের প্রভাব ছেলেমেয়ের কাছে আসে মা-বাবার কাছ থেকেই। সব ধর্মেই মেয়েদেরকে অবদমিত ও গন্ডীবদ্ধ রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পারিবারিক বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্ম-নির্দেশিত অবরোধ এবং বালিকা ও পূর্ণবয়স্ক নারীদের আগলে রাখার প্রবণতার কারণে সীমাবদ্ধ হয় মেয়েদের চলাফেরা ও কার্যক্রম। যা তার বাস্তবতা-বোধ ও আত্মবিশ্বাসকে খর্ব করে। নিজের মানসের উপর পরিবারের এই প্রভাব বেশিরভাগ নারীই পরবর্তী জীবনেও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারে না।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমবয়সীদের ভূমিকা

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবার পর শিশু নিয়মিত বাইরে যেতে থাকে এবং পরিবারের বাইরে নতুন কিছু মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ পায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বালিকাদের সামাজিকীকরণের গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখানে তারা শিক্ষক এবং সমবয়সী মেয়েদের মত, আচরণ ও পছন্দ-অপছন্দ দ্বারা প্রভাবিত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে শিক্ষক এবং সমবয়সীরা বালিকাদের লিঙ্গ-নির্দিষ্ট আচরণের শক্তিশালী প্ররোচক এবং মা বাবার মত শিক্ষকেরাও বালিকাদের উপর অনেক লিঙ্গ-নির্দিষ্ট আচরণ ও কর্মকাণ্ড চাপিয়ে দেন।৫৮ ক্লাসে শিক্ষকেরা ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের বাহ্যিক অবয়বের বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেন এবং মেয়েদের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত বেশি আবেগের প্রকাশ করে থাকেন। ক্লাশরুমে তারা শিক্ষার্থীদের লিঙ্গ-নির্দিষ্ট খেলনা দেন ও লিঙ্গ-নির্দিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনা করেন। গবেষকদের অনেকের ধারণা স্কুলে একটা ‘অদৃশ্য কারিকুলাম’ থাকে যা বালিকাদের লিঙ্গ-নির্দিষ্ট আচরণের গন্ডির মধ্যে নিয়ে আসে।৫৯ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রচলিত সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতিকে কঠোরভাবে আরোপ করে শিক্ষার্থীদের আচরণের কোড নির্ধারণ করে। নারীদের উপর এই সব কোড আরও প্রবলভাবে চাপানো হয়। লিঙ্গ-নির্দিষ্ট ‘নারীসুলভ’ আচরণকে শালীনতার অংশ বলে প্রচার করা হয়। আমাদের সমাজে প্রধানত মাদ্রাসায় এবং অন্যান্য অনেক অধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও এ ধরণের কঠোর অনুশাসন এবং অবরোধের মধ্যে মেয়ে শিক্ষার্থীদের থাকতে হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এধরণের নীতি মেয়েদের মানসিক গঠনের উপর গভীর ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে। বিদ্যালয়ে কর্তৃত্বপূর্ণ ও সিদ্ধান্তগ্রহণকারী পদে অধিক হারে পুরুষদের অবস্থানও তাদের মনের উপর প্রচলিত লিঙ্গবৈষম্য ও লিঙ্গ-নির্দিষ্ট আচরণের প্রভাবকে জোরদার করে। প্রচলিত ধারণার কারণে অনেক শিক্ষকই মনে করেন মেয়েদের গণিত ও বিজ্ঞান ইত্যাদি ‘কঠিন বিষয়’ পড়ার যোগ্যতা কম। এ ধরণের ধারণা প্রকাশের মাধ্যমে তারা মেয়েদের মধ্যে হীনমন্যতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব ইত্যাদি প্রবণতা জারিত করেন।

ক্লাসে শিক্ষকেরা ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের বাহ্যিক অবয়বের বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেন এবং মেয়েদের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত বেশি আবেগের প্রকাশ করে থাকেন। ক্লাশরুমে তারা শিক্ষার্থীদের লিঙ্গ-নির্দিষ্ট খেলনা দেন ও লিঙ্গ-নির্দিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনা করেন। গবেষকদের অনেকের ধারণা স্কুলে একটা ‘অদৃশ্য কারিকুলাম’ থাকে যা বালিকাদের লিঙ্গ-নির্দিষ্ট আচরণের গন্ডির মধ্যে নিয়ে আসে।

সহপাঠি ও সমবয়সীদের সম্পর্ক নারীসুলভ মানস গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করার পর থেকেই, বিশেষত বালিকা ও তরুণীদের ক্ষেত্রে সহপাঠি ও সমবয়সীদের সাহচর্য তাদের লিঙ্গ-নির্দিষ্ট আচরণ গড়ে তুলতে ক্রমান্বয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।সহপাঠিদের সাহচর্যে বালিকাদের মধ্যে কয়েকটি বিষয় গড়ে ওঠে –

ক) লিঙ্গ-ভিত্তিক সম্পর্কের মানদন্ড (Norm) সম্পর্কিত ধারণা
খ) বন্ধুত্ব ও সম্পর্কের নিজস্ব ধরণ সম্পর্কে উপলব্ধি
গ) লিঙ্গ-নির্দিষ্ট সামাজিক সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে নিজস্ব পছন্দ
ঘ) যৌনতা বা জেন্ডারের ভিত্তিতে অন্যদের সঙ্গে সামাজিক কার্যক্রমে যুক্ত হবার প্রবণতা৬০

এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বালিকাদের মানসিক প্রবণতার মূল-ভিত্তি তৈরি করে থাকে। সমবয়সীদের কাছ থেকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বালিকারা এমন মানসিকতা ও আচরণকে অগ্রাধিকার দেয় বা পছন্দ করে যা সমাজে প্রচলিত লিঙ্গ-নির্দিষ্ট আচরণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পরিবেশ ভিন্ন হলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও ঘটে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমবয়সীদের মধ্যে নারী এবং পুরুষ উভয়েই লিঙ্গ-নির্দিষ্ট আচরণকে পছন্দ করে এবং উৎসাহ দিয়ে থাকে। যেমন দেখা গেছে জনপ্রিয়তার রেটিং-এ বেশি নম্বর পেয়েছে সেই তরুণী যার মধ্যে লিঙ্গ-নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বেশি যেমন- বাহ্যিক সৌন্দর্য ও ‘মেয়েসুলভ’ সামাজিক দক্ষতা।৬১ মেয়েরা সাধারণত সম-লিঙ্গের সহপাঠি বা সমবয়সীদের উপর কিছুটা প্রতাপ বা প্রভাব খাটায় কিন্তু বিপরীত লিঙ্গের সহপাঠিদের ক্ষেত্রে তা মোটেও ঘটে না। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে বেশি যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও মেয়েরা পুরুষের অধীনস্ত পদ মেনে নিচ্ছে।৬২

প্রচলিত ধারণার কারণে অনেক শিক্ষকই মনে করেন মেয়েদের গণিত ও বিজ্ঞান ইত্যাদি ‘কঠিন বিষয়’ পড়ার যোগ্যতা কম। এ ধরণের ধারণা প্রকাশের মাধ্যমে তারা মেয়েদের মধ্যে হীনমন্যতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব ইত্যাদি প্রবণতা জারিত করেন।

অল্প বয়স থেকেই নারীর উপর চেপে বসা এই ‘নারীসুলভ’ আচরণ নারীর মধ্যে যে উদ্যোগহীনতা এবং বাধ্যতাকে আরোপ করে তা আরও শক্তিশালী হয় সমবয়সী পুরুষদের সঙ্গে মেশার ফলে। কিন্তু মেয়েরা যত পরিণত হয় ততই তাদের উপর চেপে থাকা লিঙ্গ-নির্দিষ্ট আচরণের বন্ধন শিথিল হতে থাকে।৬৩ ফলে ন্যাকামী, বাধ্যতা, আপোষ করার প্রবণতা, উদ্যোগহীনতা ইত্যাদি লিঙ্গ-নির্দিষ্ট মানসিক প্রবণতা যার অনেকটাই অল্প বয়সে সমবয়সীদের প্রভাবে নারীর মধ্যে আরোপিত হয়েছিল, সেগুলো কাটিয়ে ওঠা তার জন্য অপেক্ষাকৃত সহজ হয়। তবে অল্পবয়সে গেঁথে যাওয়া এসব প্রবণতা অনেকের ক্ষেত্রেই এতটা গভীরভাবে প্রভাব ফেলে যে সেই প্রভাব পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।

মিডিয়ার প্রভাব

হৈমন্তীর কালে মেয়েদের ‘বয়সের জন্য সতর্ক’ করার জন্য পরিবার ও আশে পাশের মানুষ ছাড়া আর কিছু ছিল না। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতা ভিন্ন। যোগাযোগ প্রযুক্তির চরম উন্নতির যুগে মেয়েদের লিঙ্গ-নির্দিষ্ট কর্মকান্ড ও আচরণে প্রভাবিত ও উদ্বুদ্ধ করতে আরও অনেক কিছুই রয়েছে। পত্র-পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, ইন্টারনেট ইত্যাদি গণযোগাযোগের নানান মাধ্যম এখন সহজলভ্য এবং সর্বত্রগামী । মিডিয়ার চরিত্রগুলি বালক বালিকাদেরদের রোল মডেল হয়ে যায়। বালিকারা নিজের অজান্তেই মিডিয়ার চরিত্রগুলোকে অনুসরণ বা অনুকরণ করে। কোনো ধরণের মানসিকতা ও আচরণ সমাজ তাদের কাছে আশা করে এদের দেখে সেটাও তারা ভালভাবে বুঝতে পারে।৬৪ এ সমাজে মেয়েদের জীবনে ‘বয়সের ষোল’ নিয়ে আসার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম বা মিডিয়ার ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ছেলেবেলা থেকেই গণমাধ্যমে দেখা কার্টুন, নাটক, সিনেমা, অন্যান্য অনুষ্ঠান ও বিজ্ঞাপনে নারীপুরুষের আচরণ ও কর্মকান্ডকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয় তা বেড়ে ওঠা মেয়েদের মানসিক গঠনের উপর গভীর ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে। মিডিয়ার প্রভাবে নারীপুরুষের আচরণ ও অন্যন্য ভূমিকা সম্পর্কিত লিঙ্গীয় ধারণাগুলো আরও পাকাপোক্ত হয়। মিডিয়ায় প্রতিফলিত যে বিষয়গুলি নারীর মানসের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে, সেগুলো হচ্ছে-  ক) নারী চরিত্রগুলির ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্টসমূহ, খ) পারিবারিক আচরণ গ) নারীদের পেশা ও বৃত্তি এবং ঘ) নারীপুরুষের শারীরিক অবয়ব।

ছেলেবেলা থেকেই গণমাধ্যমে দেখা কার্টুন, নাটক, সিনেমা, অন্যান্য অনুষ্ঠান ও বিজ্ঞাপনে নারীপুরুষের আচরণ ও কর্মকান্ডকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয় তা বেড়ে ওঠা মেয়েদের মানসিক গঠনের উপর গভীর ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে। মিডিয়ার প্রভাবে নারীপুরুষের আচরণ ও অন্যন্য ভূমিকা সম্পর্কিত লিঙ্গীয় ধারণাগুলো আরও পাকাপোক্ত হয়।

এ যুগে টেলিভিশন, ডিভিডি বা ইন্টারনেটে ডিজনির কার্টুন, মুভি, টিভি শো এবং নানা পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখতে দেখতে বড় হয় ছেলেমেয়েরা। এগুলোর সবগুলোতেই যে ধারণাটা প্রবল ভাবে আরোপিত হয় তা হল মেয়েদেরকে তাদের দৈহিক সৌন্দর্যের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে, নিজেকে পুরুষের কাছে যৌন অবেদনময়ী ও আকর্ষণীয় করতে হবে।৬৫

টেলিভিশন, ডিভিডি বা ইন্টারনেটে ডিজনির কার্টুন, মুভি, টিভি শো এবং নানা পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখতে দেখতে বড় হয় ছেলেমেয়েরা। এগুলোর সবগুলোতেই যে ধারণাটা প্রবল ভাবে আরোপিত হয় তা হল মেয়েদেরকে তাদের দৈহিক সৌন্দর্যের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে, নিজেকে পুরুষের কাছে যৌন অবেদনময়ী ও আকর্ষণীয় করতে হবে।

 মূলধারার চলচ্চিত্রের নায়িকা, ডিজনির কার্টুনের রাজকন্যা, টিভি শোর এর উপস্থাপক বা বিজ্ঞাপনের মডেল সবার কাছ থেকেই এই বালিকারা এই বার্তা পায় কারণ তাদেরকে এভাবেই তারা পর্দায় উপস্থিত হতে দেখে। বলিউডের সিনেমার নায়িকা, হিন্দি/বাংলা সিরিয়ালের নারী চরিত্র, ডিজনি কার্টুনের প্রিন্সেস কিংবা পণ্যের বিজ্ঞাপনের মডেল সবার ক্ষেত্রেই একথা সত্য। সিনেমায় নায়িকা গরীব চরিত্রে অভিনয় করলেও তাকে ফিটফাট আকর্ষণীয় হিসেবে দেখানো হয়। ডিজনির দি এম্পেরর’স নিউ গ্রুভ কার্টুনে বাহ্যিক অবয়ব দেখে তরুণী মেয়েদের ব্যক্তিত্ব বিচার করতে দেখা যায়। তেমনি ফেয়ার এন্ড লাভলি-র বিজ্ঞাপনে ক্যারিয়ারে সফল হবার জন্য সৌন্দর্য বৃদ্ধির পরামর্শ দেয়া হয়। এর প্রভাবে নিজের শরীর ও বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতি মেয়েদের অতি-স্পর্শকাতরতা তৈরি হয় যা তার স্বতস্ফূর্ত সামাজিকীকরণে এবং মানসের স্বাধীন বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিছু কিছু গবেষণায় দেখা গেছে মিডিয়াতে কিশোর-কিশোরীদের অনুষ্ঠানে এমন প্রচারণা প্রায়ই করা হয় যে মেয়েদের উপর যৌন হয়রানি এবং যৌন-নিপিড়নের জন্য তাদের (স্বাধীন) আচরণ ও পছন্দ অনেকটা দায়ী।৬৫,৬৬

একাধিক উন্নত দেশের টেলিভিশনে শিশু-কিশোরদের জন্য করা বিজ্ঞাপন ও অনুষ্ঠানের উপর সমীক্ষায় দেখা গেছে এসব অনুষ্ঠানে প্রচলিত লিঙ্গ-নির্দিষ্ট ধারণা অনুযায়ী মেয়েদের দেখানো হয়। যেমন, তাদেরকে দেখানো হয় (পুরুষের তুলনায়) কম সক্রিয়, কম জ্ঞানসম্পন্ন, কম কর্তৃত্বপরায়ণ, কম আগ্রসী ও বেশি বাধ্যগত হিসেবে।৬৭ ডিজনির কার্টুনের চরিত্র স্নো হোয়াইট এক রাজকন্যা হলেও বামনদের পরিবারে গিয়ে সে দেখায় তরুণী মেয়ের কর্তব্য হল পরিবারের সবাইকে সুখি করা, তাকে জানতে হবে যাবতীয় গৃহস্থালি কাজ। সিন্ডেরেলাও দেখায় মেয়েদের ঘরেই থাকতে হবে ঘরের কাজ নিয়ে। সিনেমায় ইঁদুরগুলোকেও প্রচলিত লিঙ্গ-নির্দিষ্ট কাজ করতে দেখা যায়। পুরুষ ইঁদুরগুলো জামা সেলাই করতে গেলে আরেকজন বলে ওঠে- ‘সেলাইটা মেয়েদের উপর ছেড়ে দাও’। পিটার প্যান উইন্ডির সঙ্গে প্রভুর মত ব্যবহার করে। ছবিগুলোতে নারীপুরুষের শারীরিক শক্তির পার্থক্যকেও অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়। বিউটি এন্ড বিস্ট ছবিতে গাস্টনকে দেখা যায় তার বাহুতে অতি সহজে তিনজন পূর্ণ-বয়স্ক মেয়েকে তুলে নিতে। পশ্চিমা টিভি চ্যানেল ও ইন্টারনেটে প্রচারিত মিউজিক ভিডিওগুলোতেও নারী ও পুরুষকে লিঙ্গ-নির্দিষ্ট ভূমিকায় উপস্থাপন করতে দেখা যায়। এই ভিডিওগুলোতে নারীদের দেখানো হয় অতি যৌনতাক্রান্ত, আবেগতারিত, ছলনাময়ী, অবিবেচক, ছেবলা বা লঘুচিত্তের, নির্ভরশীল ও নিষ্ক্রিয় হিসেবে।৬৮ অন্যদিকে ছেলেদেরকে দেখানো হয়- যৌন-আগ্রাসী, বিচারবুদ্ধি-সম্পন্ন, স্পর্ধা-সম্পন্ন ও দুঃসাহসী রূপে। জে জে আর্নেট তার The sounds of sex: Sex in teens’ music and music videos নিবন্ধে দেখিয়েছেন মিউজিক ভিডিওতে অংশগ্রহণকারী মেয়েদের কোনো চরিত্র বলে মনে হয় না বরং মনে হয় কিছু উপকরণের মত। স্বল্প বসনা হয়ে পুরুষ পারফরমারদের চারিদিকে ঘুরে বেড়ানোই যেন তাদের মূল কাজ।৬৯

মিডিয়া যেভাবে নারী পুরুষের আচরণ ও কর্মকান্ডকে তুলে ধরে তা বেড়ে ওঠা বালিকা ও তরুণীদেরমধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ও হীনমন্যতার জন্ম দেয়। এর প্রভাবে বেশিরভাগ বালিকা ও তরুণীর মানস কমবেশি প্রচলিত লিঙ্গ-নির্দিষ্ট ছাঁচে বাঁধা পড়ে।

সামাজিক অবস্থা ও কালচারের প্রভাব

সংস্কৃতি এবং সামাজিক পরিবেশ আমাদের চিন্তা, ভাষা ও আচরণকে প্রভাবিত করে। যে সামাজিক পরিবেশে আমরা বাস করি সেটা আমাদের মনোভঙ্গি, আবেগ ও আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং পারিপার্শিক বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধিকে গড়ে তোলে। একই সমাজে বাস করলেও নারী ও পুরুষকে এক সামাজিক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় না। একটি নির্দিষ্ট সামাজিক সংস্কৃতিতে নারী ও পুরুষের কাছে কাঙ্ক্ষিত আচরণের ভিন্নতা এবং তাদের অবস্থানগত ভিন্নতা তাদের মানসিক প্রবণতার ক্ষেত্রেও ভিন্নতা নিয়ে আসে। আমাদের সমাজে এখনও ধর্মীয় সংস্কৃতি এবং ধর্ম-ভিত্তিক লোকাচারের প্রবল উপস্থিতি রয়েছে। এই প্রভাব শহুরে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে আাগের তুলনায় অনেকটা কমে গেলেও গ্রামে এবং শহরের নিম্নবিত্ত মানুষের মধ্যে এখনও ব্যাপকভাবে রয়েছে। বেশিরভাগ ধর্মীয় কালচারেই নারীকে পুরুষের চেয়ে দুর্বল, অদক্ষ ও কমবুদ্ধির বলে মনে করা হয়। সেই আদলেই কাঙ্ক্ষিত হয় তাদের লিঙ্গ-নির্দিষ্ট আচরণ ও কর্মকান্ড। ধর্মীয় কালচারের কারণে মেয়েদের চলাফেরা, কর্মকান্ড ও আচরণের উপর নানা ধরণের প্রতিবন্ধকতা আছে যা পুরুষের উপর নেই।

এ ধরনের অবরোধের মানসিকতা ও প্রতিবন্ধকতার মধ্যে বড় হওয়া মেয়েদের আত্মবিশ্বাস, নিজেকে প্রকাশিত ও বিকশিত করার সহজাত ক্ষমতা, ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যেতে থাকে। অবরোধের মধ্যে থেকে মেয়েরা মানসিকভাবে পঙ্গু হতে হতে কত চরম পর্যায়ে যেতে পারে তার জ্বলন্ত নিদর্শন রয়েছে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের অবরোধ বাসিনী বইয়ে। একশো বছরের বেশি সময় পরে বাঙালি মুসলিম সমাজে অবরোধ সেই মাত্রায় না থাকলেও মেয়েদের চলাফেরা ও স্বাধীনভাবে জীবনশৈলী বেছে নেবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এখনও এদেশের মেয়েদের অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যায়। স্বামীর অধীনে শ্বশুর বাড়িতে প্রতিবন্ধকতা ও অনুশাসনের মধ্যে বড় হয় এই সব বালিকারা । বেশিরভাগ মেয়েই এসব প্রতিবন্ধকতাকে যথার্থ মনে করে, অন্যরা এর সঙ্গে আপোষ করে বা মেনে নেয়। এর ফলে তাদের আচরণ ও মনোভাব অনেকাংশে লিঙ্গ-নির্দিষ্ট পথেই এগিয়ে যায়।

নারীপুরুষের মানসের যে পার্থক্য আমরা দেখতে পাই তার বেশিরভাগটাই জন্মগত পার্থক্য থেকে আসে না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধারণা, বিশ্বাস, সংস্কৃতি, লোকাচার ও পারিবারিক রীতিনীতি নারী ও পুরুষের সামাজিক বাস্তবতাকে করেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই ভিন্ন সামাজিক বাস্তবতায় বেড়ে ওঠাই নারী ও পুরুষের মানসের পার্থক্য তৈরিতে মূল নির্ণায়ক। নারীর লিঙ্গ-নির্দিষ্ট মনোভঙ্গি বা ‘নারীসুলভ’ মানসের গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক এই অংশে আলোচিত হয়েছে। সামাজিক বাস্তবতার আরও দুটি দিক রয়েছে যা নারীর মানসিক গতি-প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক। এর একটি হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর নিপীড়িত হবার সম্ভাবনা তার মানসকে কীভাবে আক্রান্ত ও প্রভাবিত করে। অন্যটি হচ্ছে,  বাহ্যিক অবয়ব ও সৌন্দর্যকে বাড়াবার যে সামাজিক চাপ এ সমাজে নারীর উপর থাকে তা কীভাবে তার মনোভঙ্গিকে প্রভাবিত করে। এই দুটি দিক সম্পর্কে পরবর্তীতে পৃথকভাবে বিস্তৃত আলোচনা করার ইচ্ছে আছে তাই এই অংশে আর এ বিষয়ে আলোচনা করছি না।

মনিরুল ইসলাম: বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, লেখক ও শিক্ষক, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ।

ইমেইল: monirul852@gmail.com  

তথ্যসূত্র

৪৯. Simone De Beauvoir :The Second Sex, Translated To English By Constance Borde And Sheila Malovany Chevallier, VINTAGE BOOKS, New York, MAY 2011,Pp-402-403

৫০. Pamela Trotman Reid, Shauna M. Cooper and Kira Hudson Banks :Girls to Women: Developmental Theory, Research, and Issues; in the book,Psychology of women : A handbook of issues and theories /Florence L. Denmark and Michele A. Paludi. — 2nd ed, p-240.

৫১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : হৈমন্তী, গল্পগুচ্ছ

৫২. Martin, C. L., & Ruble, D. N. (2004). Children’s search for gender cues: Cognitive perspectives on gender development. Current Directions in Psychological Science, 13(2), 67–70

৫৩. Basow, S. (1992). Gender stereotypes and roles (3rd ed.). Pacific Grove, CA: Brooks/Cole.

৫৪. Fisher-Thompson, D., Sausa, A. D., & Wright, T. F. (1995). Toy selection for children: Personality and toy request influences. Sex Roles, 33(3/4), 239–255

৫৫. Etaugh, C., & Liss, M. B. (1992). Home, school, and playroom: Training grounds for adult gender roles. Sex Roles, 26, 129–147.

৫৬. Judith E. Owen Blakemore and Renee E. Centers: Characteristics of Boys’ and Girls’ Toys; Sex Roles, Vol. 53, Nos. 9/10, November 2005

৫৭. Gelman, S. A., Taylor, M. G., & Nguyen, S. P. (2004). Mother-child conversations about gender. Monographs of the Society for Research in Child Development, 69(1), ii–127

৫৮. Maccoby, E. E. (1998). The two sexes: Growing up apart and coming together. Cambridge, MA: Belknap Press.

৫৯. Ruble, D. N., & Martin, C. (1998). Gender development. In N. Eisenberg (Ed.),Handbook of child psychology, vol. 3, Personality and social development (pp.933–1016). New York: Wiley

৬০. Ibid. (pp-859-864)

৬১. Adler, P. A., Kless, S. J., & Adler, P. (1992). Socialization to gender roles: Popularity among elementary school boys and girls. Sociology of Education, 65, 169–187.

৬২. Lockheed, M. E., & Hall, K. P. (1976). Conceptualizing sex as a status characteristic and applications to leadership training strategies.Journal of Social Issues, 32, 111–124.

৬৩. McHale, S. M., Kim, J., Whiteman, S., & Crouter, A. C. (2004). Links between sex-typed time use in middle childhood and gender development in early adolescence. Developmental Psychology, 40(5), 868–881.

৬৪. Pamela Trotman, ReidShauna, M. Cooper Kira Hudson Banks :Girls to Women: DevelopmentalTheory, Research, and Issues,in the book, Psychology of women : A handbook of issues and theories, Florence L. Denmark and Michele A. Paludi. — 2nd ed. pp-246

৬৫. Diana Nelson and John Atwater, Eva and Bill Price :WATCHING GENDER: How Stereotypes in Movies and on TV Impact Kids’ Development; www.commonsense.org

৬৬. Silvia Galdi & Francesca Guizzo :Media-Induced Sexual Harassment: The Routes from Sexually Objectifying Media to Sexual Harassment; Sex Roles https://doi.org/10.1007/s11199-020-01196-0

৬৭.Beverly A. Browne: Gender Stereotypes in Advertising on Children’s Television in the 1990s: A Cross-National Analysis ;Journal of Advertising Volume 27, 1998 – Issue 1, Pages 83-96 | Published online: 31 May 2013

৬৮. Arnett, J. J. (2002). The sounds of sex: Sex in teens’ music and music videos. In J. Brown, K. Walsh-Childers, & J. Steele (Eds.), Sexual teens, sexual media (pp. 253–264). Hillsdale, NJ: Erlbaum.

৬৯. Arnett, J. J. (2002). The sounds of sex: Sex in teens’ music and music videos. In J. Brown, K. Walsh-Childers, & J. Steele (Eds.), Sexual teens, sexual media (pp. 253–264). Hillsdale, NJ: Erlbaum.

Social Share
  •  
  •  
  • 430
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *