৮ বছর পরও ক্ষতিপূরণ নাই। তাজরীন শ্রমিকদের অবস্থান কর্মসূচি।
পারভেজ আহমদ রনি
তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডের ৮ বছর হতে চলেছে এই নভেম্বর মাসে। অথচ এখনো তাজরীনের আহত শ্রমিকদের একটা অংশকে রাস্তায় দাঁড়াতে হচ্ছে ক্ষতিপূরণের দাবিতে। এই আহত শ্রমিকেরা বিদেশী সংস্থা থেকে সামান্য কিছু অনুদান পেয়েছিলেন ২০১৬ সালে। কেউ কেউ সরকার থেকে কয়েক হাজার করে টাকাও পেয়েছিলেন। একটি এনজিও কিছু মাস তাদের চিকিৎসা ভাতাও দিয়েছিল যতদিন প্রকল্প ছিল। ব্যস। ওই পর্যন্তই। আজ পর্যন্ত তাদের সম্মানজনক ক্ষতিপূরণ, কিংবা দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার ব্যবস্থা কিংবা বাস্তবসম্মত পুনর্বাসন কোনটারই ব্যাপারেই সরকার কোন মাথাব্যাথা দেখায়নি। এক্ষেত্রে তাদের সম্মানজনক ক্ষতিপূরণ দেয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান শ্রম আইনের ক্ষতিপূরণ বিষয়ক ধারাগুলো স্বয়ং একেকটি বড় বাধা তৈরি করে রেখেছে। এরা কেউ জমি বেচে, কেউ ধার করে আট বছর ধরে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এরা প্রায় প্রত্যেকেই এখন কয়েক লাখ টাকার ঋণগ্রস্ত। সাম্প্রতিক করোনা আসার পর থেকে এদের পরিবারের বাকি যারা উপার্জনক্ষম ছিলেন তাদেরও উপার্জনের উপর আঘাত এসেছে। একেকজনের ঘর ভাড়াই বাকি অনেক মাসের। নিতান্ত নিরুপায় হয়ে আজ ৪৫ দিন ধরে তারা প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান করছেন তিন দফা দাবিতে। টানা অবস্থানে অনেকেই আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তাদের দাবি তিনটি হল: (১) শ্রম আইনের ক্ষতিপূরণের ধারা সংশোধন সাপেক্ষে সকল আহত শ্রমিকের জন্য সম্মানজনক ক্ষতিপূরণ প্রদান, (২) সকল আহত শ্রমিকদের জন্য সম্মানজনক ও বাস্তবসম্মত পুনর্বাসন এবং (৩) আহত শ্রমিকদের জন্য দীর্ঘ মেয়াদী সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা। তাদের অবস্থানের ৪৫ দিন পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোন দায়িত্বশীল আচরণ এক্ষেত্রে চোখে পড়ে নি। মাঝখানে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের নাম ঠিকানা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ব্যাস। ওই পর্যন্তই। সরকার খিচুড়ি রান্না করা শেখাতে অন্য দেশে তার কর্মকর্তাদের পাঠানোর জন্য টাকা খরচ করতে রাজী কিন্তু এইসব শ্রমিকদের দিকে তাকাতে রাজী না। অন্যদিকে এই শ্রমিকেরা দুই দফা সংবাদ সম্মেলন করলেও মিডিয়াতে তাদের ব্যাপারে এখন আগ্রহ কম হয়ত বাজারে এই ইস্যুর “কাটতি” নেই বলে। উল্লেখ্য, তাজরীনের মালিক দেলোয়ার বর্তমানে জামিন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদিকে তাজরীনের অবহেলাজনিত হত্যাকান্ডের মামলার তারিখের পর তারিখ পড়ে। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ নাকি কোন সাক্ষী খুঁজে পায় না। প্রেসক্লাবের সামনে তাজরীনের আহত শ্রমিকদের অবস্থানের ১৪ তম দিনে গত ২রা অক্টোবর, ২০২০ তারিখ, দিবাগত রাতে এই ছবিগুলো তুলেছেন আলোকচিত্রী পারভেজ আহমদ রনি।
ছবিতে যেসব মানুষকে রাস্তার পাশের ফুটপাথে বৃষ্টি চলাকালীন সময়ে রাত্রি যাপন করতে দেখা যাচ্ছে তারা আট বছর আগের তাজরীন ফ্যাশন লিমিটেডের ভয়াবহ আগ্নিকাণ্ডে আহত শ্রমিক। ২৫টি পরিবারের সদস্য এই শ্রমিকেরা রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের ফুটপাথে ছোট্ট এক টুকরো তেরপাল এবং ছেঁড়াফাটা পলিথিন-পিভিসি ব্যানার কোনরকমে বিছিয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ থেকে অবস্থান কর্মসূচী পালন করে যাচ্ছেন। ধুলা-বালি-রোদ, কখনো একটানা বৃষ্টিতে ভেজা, দিনভর ব্যাপক মাত্রার শব্দ দূষণ, খাবারের কষ্ট, টয়লেটের অসুবিধা, খাওয়ার পানির সংকট, মশা-পিঁপড়ার কামড়, কখনো কখনো নারী শ্রমিকদের প্রতি পথচারীদের যৌন হয়রানিমূলক কটুক্তি আর করোনাকালীন সময়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকির তোয়াক্কা না করে এই মানুষগুলো দিনের পর দিন এখানে বসে আছেন।
আহত পুরুষ শ্রমিকদের বেশিরভাগকে পাঠানো হয়েছে রাস্তার ওপারের আরেক জায়গায় ঘুমাতে। কারণ এক ছোট্ট তেরপালের নিচে এতজনের জায়গা হয় না। তেরপালেও খুব যে কাজ হয় তা না, বৃষ্টির ছাঁট সব কিছুই ভিজিয়ে দেয়। (অতি সম্প্রতি তাদের পুরো জায়গায় পলিথিনের একটা ছাউনির ব্যবস্থা হয়েছে। তাতে বৃষ্টির ছাঁট অপেক্ষাকৃত বেশি আটকানো যাচ্ছে, এখন অবশ্য সবাই একসাথেই থাকতে পারছেন)
বৃষ্টি থেমেছে। কিন্তু অনেকের চোখেই ঘুম নেই। কেউবা মশার কামড়ে নির্ঘুম রাত পারছেন, কেউবা জেগে আছেন তীব্র মানসিক যন্ত্রণা আর অনাগত দিনের অনিশ্চয়তার কথা ভেবে।
যে মানুষগুলোর আয়ে এক সময় পরিবার চলেছে, জাতীয় অর্থনীতিতে তাদের অবদান ছিল, তারাই এখন ন্যায্য দাবিতে রাস্তায় বসে আছেন দিনের পর দিন। তাদেরকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা। এদের বেশিরভাগই মেরুদন্ডের আঘাতে ভুগছেন। অর্থনীতির মেরুদন্ডদের মেরুদন্ড ভাঙ্গা থাকলে কার কি আসে যায়?
এখনো তাদেরকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সেদিনের সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা। তারা সেদিনের স্মৃতিচারণ করা শুরু করলে তাদের দেখে মনে হয় যেন গতকালকের ঘটনা আজ বলছেন গড় গড় করে বিস্তারিত। মাঝের এই শ্রমিকের নাম রাজবানু। তার ৭ বছরের ছোট্ট মেয়ে সিদরাতকে সাভারে রেখে এসে বসে আছেন দিনের পর দিন। সিদরাত মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কাঁদে। কিন্তু তিনি যেতে পারেন না। কিভাবে যাবেন? কি নিয়ে বাড়ি ফিরবেন? আর পাশের শ্রমিকটি হলেন আকাশ। তাজরীনের আগুনে তার আরেক সহকর্মী অনেকজনকে আগুন থেকে বের করে আনার পর নিজেই সেই আগুনের হাত থেকে আর বাঁচতে পারেন নি। আহত আকাশ ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও দীর্ঘদিন তিনি মানসিকভাবে ট্রমার মধ্যে ছিলেন।
”হায় রে গার্মেন্টেসের চাকরী, আগে জানলে করতে আসতাম না”
এটি এই শ্রমিক জরিনা বেগমের লেখা গানের কথা। তিনি এই অবস্থান কর্মসূচি পালন করা শ্রমিকদের একজন দলনেতাও। এই গান পরবর্তীতে তিনি গেয়ে শুনিয়েছিলেন বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে তাদের অবস্থানস্থলেই যে সমাবেশ করেছিল সেখানে।
চোখে ঘুম নেই। রাত তখন প্রায় ১টা। এর কিছুক্ষণ পর ওইদিন যে তীব্র বৃষ্টি নেমেছিল তাতে তাদের সবারই ভিজে চুপচুপে হয়ে যাওয়ার কথা।
বৃষ্টি থেমেছে একটু আগে। অনেকগুলো কয়েল জ্বালানো থাকলেও মশার কামড় থেকে নিস্তার নেই। শ্রমিকরা বসে আছেন, অনেকেরই ঘুম আসছে কিন্তু মশার জ্বালায় ঘুমাতে পারছেন না। যারা বেশি ক্লান্ত তারা শুয়ে পড়েছেন এর মধ্যেই। এর উল্টোপাশেই মেট্রোরেলের উন্নয়নকর্ম চলছে। (অতি সম্প্রতি অবশ্য তাদের মশারির ব্যবস্থা হয়েছে)।
480