সম্পাদকীয় ভূমিকা

সম্পাদকীয় ভূমিকা

করোনা পরিস্থিতির কারণে গত ফেব্রুয়ারির পর থেকে সর্বজনকথা অনলাইনে প্রকাশিত হচ্ছে। এবারেও যথারীতি যথাসময়ে প্রকাশিত হচ্ছে, তবে অনলাইনেই।

গত আগস্ট সংখ্যা জার্ণালে পাটশিল্প বিনাশ ও পাটশ্রমিকদের নিয়ে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়েছিল। তার আগে এ বছরের জুন মাসের শেষে, করোনার ঘোরতর সময়ে, বাংলাদেশের সর্বশেষ পাটকলগুলি বন্ধ করে দেয় সরকার। প্রায় ২৫ হাজার স্থায়ী শ্রমিক ও ২৫ হাজার বদলি শ্রমিক রাতারাতি বেকার হয়ে যায়। এই ভয়ংকর অপরাধের সাথে সাথে সরকারের পক্ষ থেকে প্রচার হতে থাকে অবিলম্বে পাটকলগুলো খুলে দেওয়াসহ শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের গল্প। এরপর প্রায় চারমাস হতে চললো, না খেয়ে চরম অনিশ্চয়তায় থাকা শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের কোনো ব্যবস্থা হয়নি। বদলি শ্রমিকদের সেই আশায় বসে থাকারও কোনো উপায় নেই, তাঁদের জন্য বরাদ্দের মিথ্যা প্রতিশ্রুতিও নেই।

এর আগে বরাবর এসব নিয়ে মিথ্যাচার ও দমনপীড়নে সরকারের সক্রিয়তা ছিল, এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ৫০ হাজার শ্রমিক আর তাঁদের পরিবারের সদস্য প্রায় ৩ লাখ মানুষকে রাস্তায় ছুঁড়ে দিয়ে সরকারের শান্তি হয়নি, তাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা আর দলীয় গুন্ডাবাহিনী। লাঠি, বন্দুক, জলকামান, টিয়ার গ্যাস সবই ব্যবহার হয়েছে নিরস্ত্র, নিরন্ন, আশ্রয়হীন মানুষদের প্রতিবাদ ঠেকাতে। হামলা হুমকি ছাড়াও পাটশিল্প চালু এবং পাওনা পরিশোধের দাবি করার অপরাধে প্রতিবাদী সংগঠকদের বারবার আটক করা হয়েছে। আশার কথা প্রতিবাদ থামেনি।  

এদিকে ঢাকার প্রেসক্লাবের সামনে একমাসেরও বেশি সময় ধরে তাজরিন গার্মেন্টস এর শ্রমিকেরা রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ক্ষতিপূরণের দাবি নিয়ে বসে আছেন, কোনো সরকার নেই। গত কিছুদিনে ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন বিস্তৃত হয়েছে দেশজুড়ে, তাদের ওপর হামলা হুমকি চলছে একদিকে, অন্যদিকে সরকারি দলের মদদপুষ্ট ধর্ষকদের ঔদ্ধত্বও অব্যাহত আছে। একদিকে ধর্ষক খুনিদের লালন পালন অন্যদিকে ‘ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ড’ ঘোষণা নিম্নমানের প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নেই।   

আসলে স্বৈরতন্ত্রী ব্যবস্থায় যা খুশি তাই করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সরকার। অনির্বাচিত সরকার টিকে আছে যাদের সমর্থনে তাদের স্বার্থরক্ষায় তারা বেপরোয়া। পুলিশ, আমলা আর সরকার দলীয় সন্ত্রাসী বাহিনী এই বেপরোয়া কাজের প্রধান সহযোগী। ক্রসফায়ার, খুন, চাঁদাবাজী, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনে খুনের সাথে দেশ জুড়ে গত কিছুদিনে ধর্ষণ যৌন সহিংসতার মাত্রাও বেড়েছে এই রাজনৈতিক ক্ষমতার ঔদ্ধত্বের কারণে।

এই সংখ্যায় ১৯৯৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ধর্ষণ ও ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন নিয়ে একাধিক লেখা দেয়া হলো। এইসংখ্যায় ‘সিপি গ্যাং-এর ‘বেশ্যা’ব্যানার’ ৭ম পর্ব “গণধর্ষণের পর হত্যা ও ‘পতিতা’পরিচয়” লেখায় আমরা জানবো ইয়াসমিনের কথা, একজন কিশোরী, যাকে কয়েকজন পুলিশ বাড়ি পৌঁছে দেবার কথা বলে তাদের ভ্যানে ধর্ষণ করে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে খুন করেছিল। এছাড়া ‘নারী-পুরুষের মানস : পুরুষতান্ত্রিক ধারণা ও বৈষম্যের জৈবসামাজিক ভিত্তি’ ৪র্থ পর্ব প্রকাশিত হলো।  

বাংলাদেশে সড়ক-নৌ-রেল পথে, কর্মস্থলে, আগুনে পুড়ে, রাসায়নিক বিস্ফোরণে নানাভাবে অসংখ্য মানুষ নিহত ও জখম হচ্ছে প্রতিবছর। একইরকম কারণ বিদ্যমান থাকায় একই ধরনের দুর্ঘটনা বারে বারে এবং আরও ভয়ংকরভাবে ঘটতে থাকে। বর্তমান সংখ্যার প্রবন্ধে বার বার ঘটতে থাকা বিভিন্ন ধরনের ‘দুর্ঘটনা’র বিশ্লেষণ করে তার কাঠামোগত কারণগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

বাংলাদেশে সরকার একদিকে আন্তর্জাতিক ফোরামে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে অন্যদিকে উপকূল জুড়ে সুন্দরবন বিনাশী রামপাল প্রকল্পসহ একের পর এক কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশে অনেকগুলো উন্মুক্ত খনি ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিদর্শন করে তার অভিজ্ঞতার সারসংক্ষেপ নিয়ে একটি লেখা দেয়া হচ্ছে এই সংখ্যায়। বাংলাদেশে নদী ও পানি প্রবাহ বাণিজ্য, দখল আর উন্নয়নের নানা প্রকল্পে বন্দী। এবিষয়ক লেখায় এই সংকটের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরে বিকল্প চিন্তার ওপর জোর দেয়া হয়েছে।

করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কিছু দেশের সফলতা চমকপ্রদ। বিপরীতে যাদের করোনা মোকাবেলায় সবার থেকে এগিয়ে থাকার কথা ছিল তারা এই ভাইরাসে বিপর্যস্ত ও পরাজিত। নির্বাচিত কয়েকটি দেশের করোনা অভিজ্ঞতা ও তাদের গৃহীত পদক্ষেপ পর্যালোচনা প্রকাশ করা হলো।  

নানা কারণে দ্রুত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। পুঁজির কর্তৃত্বের জগতে এই নির্ভরশীলতা কীধরনের সংকট তৈরি করছে, কীভাবে মানুষ সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে আটকে যাচ্ছে, কীভাবে তার চিন্তাশক্তি প্রান্তিক হয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে একটি অনুসন্ধানী গ্রন্থের একটি অধ্যায়ের বাংলা ভাবানুবাদ প্রকাশ করা হলো এই সংখ্যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে সেদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাস তুলে আনা হয়েছে একটি লেখায়, স্মরণ করা হয়েছে ইউজিন ডেবস নামে হারিয়ে যাওয়া একজন নেতাকে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের তাত্ত্বিক সংগঠক অ্যাঞ্জেলা ডেভিসের সাথে কথোপকথন ৫ম পর্ব সেদেশের ইতিহাসের দিকে নতুন দৃষ্টি দিয়েছে।

এবছর ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং অক্ষয়কুমার দত্তের জন্ম দ্বিশতবার্ষিকী। আমাদের চিন্তা ও কাজে বিভিন্ন দিক থেকে তাঁদের অবদান অপরিসীম। তাঁদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

আনু মুহাম্মদ

২৮শে অক্টোবর ২০২০   

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *