সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিগ ডাটা ও মানুষের ‘স্বাধীন ইচ্ছা’র ভবিষ্যত

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিগ ডাটা ও মানুষের ‘স্বাধীন ইচ্ছা’র ভবিষ্যত

জেমি বার্টলেট

মানুষ আপাত কিছু সুবিধার জন্য দ্রুত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। পুঁজির কর্তৃত্বের জগতে এই নির্ভরশীলতা কীধরনের সংকট তৈরি করছে, কীভাবে মানুষ সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে আটকে যাচ্ছে, কীভাবে তার চিন্তাশক্তি প্রান্তিক হয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে বিভিন্নধরনের গবেষণা হচ্ছে। Jamie Bartlett এর The People Vs Tech (Ebury Press, London, 2018) এরকম একটি অনুসন্ধানী গ্রন্থ। এই গ্রন্থের “The New Panopticon: What the Power of Data is Doing to Our Free Will” শীর্ষক অধ্যায় অবলম্বনে লেখকের বক্তব্য সর্বজনকথার জন্য বাংলায় উপস্থাপন করেছেন কল্লোল মোস্তফা

গুগল, স্ন্যাপচ্যাট, টুইটার, ইন্সট্রাগ্রাম কিংবা ফেসবুকের মতো কোম্পানিগুলো অনেকদিন হলো শুধু আর প্রযুক্তি কোম্পানি নয়, সেই সাথে বিজ্ঞাপনি প্রতিষ্ঠান হিসেবেও কাজ করছে। ফেসবুক আর গুগলের আয়ের ৯০ শতাংশই আসে বিজ্ঞাপন বিক্রয় করে। সামাজিক মাধ্যমের ব্যবসার ভিত্তিই হলো বিভিন্ন “বিনামূল্যের” সেবা প্রদানের বিনিময়ে ডাটা বা উপাত্ত সংগ্রহ করা, যেন সেইসব ডাটা ব্যবহার করে তারা আমাদেরকে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করতে পারে।

ফেসবুক আর গুগলের আয়ের ৯০ শতাংশই আসে বিজ্ঞাপন বিক্রয় করে। সামাজিক মাধ্যমের ব্যবসার ভিত্তিই হলো বিভিন্ন “বিনামূল্যের” সেবা প্রদানের বিনিময়ে ডাটা বা উপাত্ত সংগ্রহ করা, যেন সেইসব ডাটা ব্যবহার করে তারা আমাদেরকে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করতে পারে।

এই ধরনের কার্যক্রমের উৎস বেশ পুরাতন ও তেমন সুনামধন্য নয়: স্যুট টাই পরা বিক্রেতা ও মনোবিজ্ঞানিরা বহু বছর ধরেই মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণের রহস্য উন্মোচনের সাধনা করছেন যেন মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোবের (মস্তিষ্কের সম্মুখভাগের যে অংশ প্রজ্ঞা চিন্তা ইত্যাদির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে) ঠিক কোন অংশে কেনা-কাটার সিদ্ধান্ত নেয়ার চাবিকাঠিটা (বাই বাটন!) থাকে সেটা খুঁজে পাওয়া যায়। এ বিষয়ে মার্কিন মনোবিদ্যা ইউরোপীয় মনোবিদ্যা থেকে বেশ আলাদা। ইউরোপীয়দের মতো “স্বাধীন ইচ্ছা”, “মন” ইত্যাদি নিয়ে তেমন আগ্রহ না দেখিয়ে জেমস কেটেল এবং হারলো গেইলের মতো পাইওনিয়ারদের নেতৃত্বে মার্কিন মনোবিদ্যা মানব সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়াকে এক কাঠখোট্টা বিজ্ঞানে পরিণত করতে চেয়েছে যেন এটাকে ব্যবসার কাজে লাগানো যায়।

১৯১৫ সালে জন ওয়াটসন যুক্তরাষ্ট্রের সাইকোলজিকাল এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচত হন। তিনি মনে করেন, মানুষের প্রত্যেক আচরণই আসলে বিভিন্ন পরিমাপ যোগ্য বাহ্যিক উদ্দীপনার ফলাফল যাকে গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। মনোবিজ্ঞানের এই ধারাটি বিহেভিয়ারিজম বা আচরণবাদ নামে পরিচিতি পায়, যা পরে বি এফ স্কিনারের কাজের মাধ্যমে আরো জনপ্রিয়তা লাভ করে।

পণ্য বিক্রেতা কোম্পানিগুলোর কাছে মানুষের আচরণ পরিবর্তনের এই প্রতিশ্রুতি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং কর্পোরেট জগতে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ওয়াটসনের মতো মানুষদের উৎসাহে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বাস করতে থাকে যে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভয়-ভীতি ও কেনাকাটা নিয়ন্ত্রণের ঐশ্বরিক ক্ষমতা তাদের আছে। কিন্তু ১৯২০ এর দশকে পরিসংখ্যানমূলক বাজার গবেষণার পদ্ধতি এসে বিহেভিয়ারিজমকে কিছুটা পেছনে ফেলে দেয়। এই পদ্ধতিতে মানুষকে প্রশ্ন করে তাদের পছন্দ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তবে বিহেভিয়ারিজম ও বাজার গবেষণা এই দুটো মিলিতভাবে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে কার্যকর বিজ্ঞাপন দেয়ার গুরুত্ব তুলে ধরে, যা এখনও টিকে আছে।

আজকে জন ওয়াটসন বেঁচে থাকলে হয়তো গুগল, আমাজন বা ফেসবুকের চিফ নাজার (nudger) বা প্রধান ধাক্কা দানকারী হিসেবে নিয়োগ পেতেন। মানুষের মনের উপর বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সমাজ ব্যবস্থাপনার যে আকাঙ্ক্ষা আচরণবাদীরা পোষণ করেন তার সর্বশেষ নজির হলো বর্তমান সময়ের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো: তারা মানুষের উপর বিভিন্ন পণ্যের প্রভাব পরীক্ষা করেন, প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ করেন এবং সেই অনুযায়ী পণ্যের নকশা পরিবর্তন করেন। এই ধারণাটি আরেকটি শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যেতে পারে, ইয়োভাল নোয়া হারিরি যাকে বলেছেন “ডাটাইজম”(Dataism):  এই ধারণা অনুসারে ডাটা বা উপাত্তের গাণিতিক নিয়মকানুন মানুষ ও মেশিন উভয়ের উপরই সমান প্রযোজ্য। পর্যাপ্ত পরিমাণে ডাটা বা উপাত্ত পেলে মানব মনের রহস্য উন্মোচন করা এবং মানুষকে প্রভাবিত করা সম্ভব- এটাই হলো আজকের যুগের সিলিকন ভ্যালির প্রধান দর্শন।

মানুষের মনের উপর বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সমাজ ব্যবস্থাপনার যে আকাঙ্ক্ষা আচরণবাদীরা পোষণ করেন তার সর্বশেষ নজির হলো বর্তমান সময়ের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো: তারা মানুষের উপর বিভিন্ন পণ্যের প্রভাব পরীক্ষা করেন, প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ করেন এবং সেই অনুযায়ী পণ্যের নকশা পরিবর্তন করেন।

২০০৮ সালে ওয়্যার্ড (wired) ম্যাগাজিনের তৎকালীন প্রধান সম্পাদক ক্রিস এন্ডারসন তাঁর বহুল উদ্ধৃত এক প্রবন্ধে তত্ত্বের অবসানকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, বিগ ডাটার কল্যাণে এখন আর বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের প্রয়োজন নেই। “মানব আচরণের উপর তো কত তত্ত্ব আছে কিন্তু তার মাধ্যমে কি জানা যায় মানুষ যা করছে তা কেন করছে? আসল কথা হলো মানুষ নির্দিষ্ট কিছু কাজ করে আর আমরা অভূতপূর্ব দক্ষতার সাথে সেগুলো ট্র্যাক করতে পারি, পরিমাপ করতে পারি।” মানুষ কেন এক ওয়েবসাইটের বদলে অন্য ওয়েবসাইটে যায় তা নিয়ে গুগলের প্রকৌশলীরা কোনো তত্ত্ব দাঁড় করান না- তারা স্রেফ পরীক্ষা করে দেখেন যে এর পেছনে কোন প্রক্রিয়াটি কাজ করছে।

বড় বড় কোম্পানিগুলোতে আজকে বিশ্বের সবচেয়ে মেধাবী কিছু মানুষকে বিপুল অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ করা হচ্ছে শুধু এইটুকু বোঝার জন্য যে আপনি ইন্টারনেটে কখন কেন কোন জিনিসের উপর ক্লিক করেন এবং কী করে আপনাকে দিয়ে আরো বেশি জিনিসের উপর ক্লিক করানো যায় তা বের করার জন্য।

বড় বড় কোম্পানিগুলোতে আজকে বিশ্বের সবচেয়ে মেধাবী কিছু মানুষকে বিপুল অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ করা হচ্ছে শুধু এইটুকু বোঝার জন্য যে আপনি ইন্টারনেটে কখন কেন কোন জিনিসের উপর ক্লিক করেন এবং কী করে আপনাকে দিয়ে আরো বেশি জিনিসের উপর ক্লিক করানো যায় তা বের করার জন্য। সন্দেহ নেই, ফেসবুকের সফলতার মূলে রয়েছে মানুষের মন। মানুষ এমন এক প্রাণী যারা একে অন্যকে দেখতে চায়, অনুকরণ করতে চায়। আর ফেসবুক এই কাজটি সহজ ভাবে করবার সুযোগ করে দিয়েছে বলেই ফেসবুক সফল। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ফেসবুক সব কিছু মানুষের স্বতস্ফুর্ততার উপর ছেড়ে দিয়েছে বরং মানুষকে কী করে বড়শিতে গেঁথে রাখা যায় তার সবধরণের চেষ্টাই ফেসবুক সবসময় করতে থাকে। কারণ সামান্য একটু বেশি কার্যকারিতার ফলে বিপুল অর্থ উপার্জন হতে পারে। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো কোটি কোটি ব্যবহারকারির উপর হাজার হাজার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়- ব্যাকগ্রাউন্ড, রং, ছবি, অক্ষর, শব্দ- ইত্যাদি নানা কিছু পরিবর্তন করে দেখা হয়- যার উদ্দেশ্য হলো “ক্লিক” সর্বোচ্চকরণ। ফেসবুকের হোমপেজ যত্নের সাথে এমন ভাবে নকশা করা হয়েছে যেন লাইকস, ফ্রেন্ডস, পোস্টস, মেসেজ ইত্যাদির সংখ্যা সবসময় চোখে পড়ে। অটোপ্লে, সীমাহীন স্ক্রল করা এবং রিভার্স ক্রনলজিক্যাল টাইমলাইন- সবকিছুই আপনার মনোযোগ ধরে রাখার উদ্দেশ্যে তৈরি করা।

ফেসবুকের হোমপেজ যত্নের সাথে এমন ভাবে নকশা করা হয়েছে যেন লাইকস, ফ্রেন্ডস, পোস্টস, মেসেজ ইত্যাদির সংখ্যা সবসময় চোখে পড়ে। অটোপ্লে, সীমাহীন স্ক্রল করা এবং রিভার্স ক্রনলজিক্যাল টাইমলাইন- সবকিছুই আপনার মনোযোগ ধরে রাখার উদ্দেশ্যে তৈরি করা।

ইলাস্ট্রেশান: Janne Iivonen

আর এসব কৌশল যে বেশ ভালভাবেই কাজ করছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা এখন এক জোম্বি আর্মির সদস্য যারা নিজেদের ফোনের দিকে তাকিয়ে হাঁটি আর পাশের মানুষটির সাথে কথা না বলে চ্যাট করি দূরের অশরীরী অবতারের সাথে। আরো অনেক মানুষের মতোই আমি মনে করি আমি নিজে এসবের শিকার না, স্রেফ একজন পর্যবেক্ষক। কয়েকদিন আগে আমি RealizD নামে একটা অ্যাপ ডাউনলোড করি, যে অ্যাপের কাজ হলো আমি দিনে কতবার ফোন চেক করি এবং মোট কতক্ষণ ধরে করি তার একটা হিসেব রাখা। ফলাফল নিম্নরুপ-

সোমবার: ১০৩ বার, মোট ৫ ঘন্টা ৪০ মিনিট

মঙ্গলবার: ৯০ বার, ৪ ঘন্টা ২৯ মিনিট

বুধবার: ৬৩ বার, ৬ ঘন্টা ১ মিনিট

বৃহস্পতিবার: ৫৮ বার, ৩ ঘন্টা ৪২ মিনিট

শুক্রবার: ৭১ বার, ৪ ঘন্টা ১২ মিনিট

এই ফলাফল অনুসারে আমি দৈনিক ৭৭ বার আমার ফোন চেক করি। ঘুমের সময়টা বাদ দিয়ে হিসেব করলে দেখা যায়, প্রতি ১২ মিনিটে আমি একবার ফোন চেক করি। আমি একলা নই, অ্যাডাম অল্টারের মতে ডিজিটাল নির্ভরতার তুলনায় মাদক ও তামাকের উপর আসক্তি পিছিয়ে পড়ছে, বাড়ছে চেক করা, পিক করা, সুইপ করা আর ক্লিক করার মহামারি। উল্ল্যেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ এখন বলছেন তারা ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়েছেন, ফোন ছাড়া তাদের আর চলছে না। অল্টার লিখেছেন, ২০০৪ সালে ফেসবুক ছিল মজার বিষয়, আর ২০১৬ সালে এটা একটা নেশা। আর এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়। এর জন্য দায়ী অ্যাটেনশন ইকোনমি বা মনোযোগ অর্থনীতি।

প্রতি ১২ মিনিটে একবার করে আমার ফোন চেক করার কারণ হলো ক্রমাগত আসতে থাকা বিভিন্ন রকমের ফিডব্যাক বা প্রতিক্রিয়া। বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা গেছে মস্তিস্কের ডোপামিন রিওয়ার্ড সিস্টেমের সাথে তথ্যের প্রত্যাশার গভীর সম্পর্ক রয়েছে, রিওয়ার্ড বা পুরস্কার যত বিচিত্ররকম হবে আসক্তিও তত তীব্র হবে। পুশ নোটিফিকেশানের ডিজাইনটাও এসব মাথায় রেখেই করা হয়েছে। ‘বিপ’ আওয়াজ বা মেসেজের মতো পুশ নোটিফিকেশান দিয়ে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে আপনার ইনবক্সে কিছু এসেছে কিনা, কেউ লাইক দিয়েছে কিনা। ২০০৯ সালে লাইক বাটনের জন্মও হয়েছে লাইক স্টাডিজ নামের বেশ পুরনো একটা গবেষণা খাতের উপর ভিত্তি করে। লাইক স্টাডিজের মাধ্যমে দেখা যায় কোন বিজ্ঞাপনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো তার লাইকেবিলিটি বা পছন্দসই হওয়ার বৈশিষ্ট্য। (ফেসবুক প্রথম যে বাটনটির কথা চিন্তা করেছিল তার নাম ছিল ‘awesome’ বাটন) ফেসবুকের প্রথম প্রেসিডেন্ট শিন পার্কার সম্প্রতি লাইক বাটন সম্পর্কে বলেছেন “এটা হলো সামাজিক অনুমোদনের ফিডব্যাক লুপ… ঠিক এইরকম কিছুই আমার মতো হ্যাকাররা তৈরি করতে চায়, কারণ এর মাধ্যমে আপনি মানব মনের দুর্বলতার সুযোগ নিতে পারবেন।” তিনি বলেছেন, মার্ক জুগারবার্গ সহ তিনি এবং অন্যরা এটা খুব ভালো করে বুঝেছেন এবং “যেভাবেই হোক তার বাস্তবায়ন করেছেন।”১০

২০০৯ সালে লাইক বাটনের জন্মও হয়েছে লাইক স্টাডিজ নামের বেশ পুরনো একটা গবেষণা খাতের উপর ভিত্তি করে। লাইক স্টাডিজের মাধ্যমে দেখা যায় কোন বিজ্ঞাপনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো তার লাইকেবিলিটি বা পছন্দসই হওয়ার বৈশিষ্ট্য।

ডাটা

অন্য যে কোনো বিজ্ঞাপন ব্যবসায়ীর মতোই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মূল মন্ত্র হলো আপনাকে আপনার নিজের চেয়েও ভাল বোঝা। আপনি কখন কী করবেন, কী বলবেন, এমনিক কী চিন্তা করবেন তা অনুমান করা। ফেসবুক স্রেফ মজা করার জন্য আপনার কাছ থেকে ডাটা সংগ্রহ করে না, ডাটা সংগ্রহ করে আপনার মাথায় ঢুকে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। আপনার ফেসবুকে কাটানো সময়ের উপর ভিত্তি করে ফেসবুক আপনার সম্পর্কে যা জানে তা দিয়ে দিস্তা দিস্তা লেখা যাবে- আপনার আগ্রহ, বয়স, বন্ধু, পেশা, কার্যক্রমসহ নানাকিছু। শুধু তাই নয়, এক্সিয়মের মতো শক্তিশালী “ডাটা ব্রোকার” কোম্পানির সাথে অংশীদারিত্ব আছে ফেসবুকের, যার কাছে সারা বিশ্বের ৫০ কোটিরও বেশি সক্রিয় ভোক্তা সম্পর্কে তথ্য আছে। একেকজন ব্যক্তি সম্পর্কে হাজারেরও বেশি ডাটা পয়েন্ট তাদের সংগ্রহে, যার মধ্যে রয়েছে বয়স, বর্ণ, লিঙ্গ, ওজন, উচ্চতা, বৈবাহিক অবস্থা, শিক্ষা, রাজনীতি, কেনা-কাটার অভ্যাস, স্বাস্থ্য সমস্যা, ছুটিছাটা ইত্যাদি সম্পর্কিত তথ্য যেগুলো দোকানপাটসহ আরো বিভিন্ন ধরনের রেকর্ড থেকে সংগ্রহ করা হয়।১১ এইসব তথ্য ক্রস রেফারেন্সিং করে বা একটির সাথে আরেকটি মিলিয়ে বিশ্লেষণ করে কোম্পনিগুলো এখন আগের চেয়ে আরো অনেক বেশি দক্ষতার সাথে আপনাকে টার্গেট করতে সক্ষম। 

বিস্ময়কর ব্যাপার হলো ডাটা সংগ্রহের এই তৎপরতা কেবল শুরু হলো বলা যায়, পর্যায়ক্রমে আরো অনেক বিষয়ে ডাটা সংগ্রহ হতে থাকবে: গাড়ি, ফ্রিজ, পোশাক, রাস্তার সাইন, বই ইত্যাদি। আপনার আদরের কন্যা তার পুতুল নিয়ে খেলছে- এটা একটা উপাত্ত বা ডাটা পয়েন্ট! আপনার সঙ্গী তার চায়ে চিনি মেশাচ্ছে- ডাটা পয়েন্ট! এই ডাটা রাক্ষসদের হাত থেকে কোনো কিছুই নিরাপদ থাকবে না। গুগল দোকান, অফিস এবং জাদুঘরে স্ট্রিট ভিউ ফটোগ্রাফারদের পাঠিয়েছে যেন আপনি যেখানেই যেতে চান, তার ত্রিমাত্রিক মডেল থাকে। স্মার্ট হোম জানতে চায় আপনার পছন্দের তাপমাত্রা কত, আপনি কখন ধোয়া মোছা করেন, রান্না করেন, কতক্ষণ ঘুমান। ডাটাইজমের নামে সবকিছুই সংগ্রহ করা হবে, বিশ্লেষণ করা হবে এবং একটির সাথে আরকটি তুলনা করে দেখা হবে।

ইলাস্ট্রেশান: Janne Iivonen

এতো বিপুল পরিমাণ ডাটা মানুষের পক্ষে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয় আর সে কারণেই আধুনিক অর্থনীতিতে এলগরদিমের ভূমিকা এত গুরুত্বপূর্ণ। এলগরিদম হলো একধরণের গাণিতিক কৌশল, এক সেট ইন্সট্রাকশান বা নিদের্শনা যা অনুসরণ করে কম্পিউটার বিভিন্ন কাজ করতে পারে। এটা হলো কারিগরি সংজ্ঞা কিন্তু বাস্তবে এটা হলো এমন এক জাদুর কাঠি যার মাধ্যমে ফিল্টার করা, অনুমান করা, তুলনা করা, টার্গেট করা যায়। ইতোমধ্যেই আপনার জীবনের অনেক কিছুর উপর এলগরিদমের প্রভাব পড়ছে যেমন আমাজনের রিকমেন্ডেশান, ফেসবুকের নিউজ ফিড বা গুগল সার্চের ফলাফল, আপনার অফিসে যাওয়ার রাস্তা, গান শোনা, খবর পড়া, পোশাক কেনা ইত্যাদি।

এতো বিপুল পরিমাণ ডাটা মানুষের পক্ষে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয় আর সে কারণেই আধুনিক অর্থনীতিতে এলগরদিমের ভূমিকা এত গুরুত্বপূর্ণ। এলগরিদম হলো একধরণের গাণিতিক কৌশল, এক সেট ইন্সট্রাকশান বা নিদের্শনা যা অনুসরণ করে কম্পিউটার বিভিন্ন কাজ করতে পারে। এটা হলো কারিগরি সংজ্ঞা কিন্তু বাস্তবে এটা হলো এমন এক জাদুর কাঠি যার মাধ্যমে ফিল্টার করা, অনুমান করা, তুলনা করা, টার্গেট করা যায়। ইতোমধ্যেই আপনার জীবনের অনেক কিছুর উপর এলগরিদমের প্রভাব পড়ছে যেমন আমাজনের রিকমেন্ডেশান, ফেসবুকের নিউজ ফিড বা গুগল সার্চের ফলাফল, আপনার অফিসে যাওয়ার রাস্তা, গান শোনা, খবর পড়া, পোশাক কেনা ইত্যাদি।

আধুনিক কালের বিগ ডাটা এলগরিদমের সবচেয়ে ভীতিকর দিকটি হলো- এলগরিদম এমন অনেক কিছুই আমাদের সম্পর্কে জানে যা সম্পর্কে হয়তো আমাদের নিজেদের কোনো ধারণাই নেই। মানুষের আচার আচরণ বিষয়ে অনেক ক্ষেত্রেই অনুমান করা সম্ভব আর পর্যাপ্ত ডাটা বা উপাত্ত থাকলে- এমনকি আপাত দৃষ্টিতে গুরুত্বহীন উপাত্ত যেমন গান শোনার তথ্য- কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের ধরন সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনুমান এলগরিদমের মাধ্যমে করা সম্ভব।

২০১১ সালের কথা, ড. মাইকেল কোসিনিস্কি নামে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মনোবিজ্ঞানী একটি অনলাইন সার্ভে বা জরিপ তৈরি করেছিলেন যার মাধ্যমে উত্তরদাতাদের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানা যাবে। বহু বছর ধরেই মনোবিজ্ঞানীরা প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছেন। কোসিনিস্কির আগ্রহ ছিল যাচাই করে দেখা যে জরিপ ছাড়া স্রেফ অনলাইনে মানুষের আচরণের উপর ভিত্তি করে মানুষের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানা সম্ভব কিনা। হতে পারে ফেসবুকে মানুষ কীকী বিষয় লাইক করে তার উপর ভিত্তি করে ব্যক্তির সাইকোলজিকাল প্রোফাইল তৈরি করা সম্ভব। সুতরাং কোসিনিস্কি ও তার দল কতগুলো পার্সনালিটি টেস্ট তৈরি করলেন এবং ফেসবুকে মানুষকে সাড়া দেয়ার আহবান জানালেন। সার্ভেটা একরকম ভাইরাল হয়ে গেল এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ তাতে অংশগ্রহণ করলেন। মানুষের ফেসবুক লাইকের সাথে জরিপে পাওয়া উত্তরের তুলনা করে কোসিনিস্কি এমন একটি এলগরিদম তৈরি করতে সক্ষম হলেন যার মাধ্যমে স্রেফ ফেসবুক লাইকের তথ্য থেকে জরিপে অংশ নেননি এরকম লক্ষ কোটি মানুষ সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ ধারণা অর্জন সম্ভব। ২০১৩ সালে তিনি তার গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে দেখালেন মানুষের আচরণের ডিজিটাল রেকর্ড ব্যবহার করে মানুষ সম্পর্কে দ্রুততার সাথে এবং নিখুঁত ভাবে বহু কিছু বের করে ফেলা সম্ভব যার মধ্যে রয়েছে যৌনতা, জাতীয়তা, ধর্ম, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, ব্যক্তিত্বের ধরণ, বুদ্ধিমত্তা, নেশাজাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার, মাতাপিতার পৃথক হওয়ার ঘটনা, বয়স, লিঙ্গ ইত্যাদি।১২ (ফেসবুক যে এই কৌশলগুলো ব্যবহার করে তার সপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। যদিও  ২০১৭ সালের মে মাসে গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক প্রবন্ধ অনুসারে, ফেসবুক অস্ট্রেলিয়া বিজ্ঞাপনদাতাদের বলেছে যে, টিনএজাররা কখন চাপের মধ্যে থাকে, অনিরাপদ বোধ করে বা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয় তা তারা সনাক্ত করতে সক্ষম। ফেসবুক জবাব দিয়েছে যে তারা “মানুষকে তাদের ইমোশানাল অবস্থা ভেদে টার্গেট করার কোনো টুল ব্যবহার করে না”।)১৩

কোসিনিস্কি ও তার দল কতগুলো পার্সনালিটি টেস্ট তৈরি করলেন এবং ফেসবুকে মানুষকে সাড়া দেয়ার আহবান জানালেন। সার্ভেটা একরকম ভাইরাল হয়ে গেল এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ তাতে অংশগ্রহণ করলেন। মানুষের ফেসবুক লাইকের সাথে জরিপে পাওয়া উত্তরের তুলনা করে কোসিনিস্কি এমন একটি এলগরিদম তৈরি করতে সক্ষম হলেন যার মাধ্যমে স্রেফ ফেসবুক লাইকের তথ্য থেকে জরিপে অংশ নেননি এরকম লক্ষ কোটি মানুষ সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ ধারণা অর্জন সম্ভব।

২০১৭ সালে আমি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে যাই মাইকেল কোসিনিস্কির সাথে দেখা করতে, যেখানে তিনি এখন কাজ করছেন। অনেকেই স্ট্যানফোর্ডকে সিলিকিন ভ্যালির নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয় মনে করেন- এটা সিলিকন ভ্যালির কাছেই অবস্থিত এবং সিস্কো, গুগল, হিউলেট-প্যাকার্ড এবং ইয়াহু!- এর প্রতিষ্ঠাতা এখান থেকে বের হয়েছেন। মাইকেল আমাকে গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব বিজনেসে অবস্থিত তার অফিসে নিয়ে দেখালেন তার সিস্টেমটি কীভাবে কাজ করে। আমি আমার ২০০ ফেইসবুক লাইকের তথ্য তার এলগরিদমের কাছে হস্তান্তর করলাম যার মধ্যে ছিল: দ্যা সোপরানোস, কেইট বুশ, টার্মিনেটর ২, দ্যা স্পেক্টেটর ম্যাগাজিন ইত্যাদির জন্য আমার লাইক। এলগরিদম এবার খুঁজতে শুরু করলো লাইকের এরকম কম্বিনেশান আর কার কার আছে এবং কয়েক সেকেন্ডর মধ্যেই জানিয়ে দিল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে: মুক্তমনা, লিবারেল বা উদারনৈতিক, শিল্পরসিক এবং অতিমাত্রায় বুদ্ধিদীপ্ত। আমি মাইকেলকে বললাম তোমার সিস্টেম তো বেশ নিখুঁত কাজ করে! আরো অদ্ভুত হলো এই সিস্টেম জানালো আমি নাকি ধার্মিক নই, কিন্তু যদি হতাম তাহলে নাকি ক্যাথলিক হতাম। নিজের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে এর চেয়ে ভালভাবে আমার পক্ষেও বলা সম্ভব না- আমি ৫ থেকে ১৮ বছর বয়সে ক্যাথলিক স্কুলে গিয়েছি এবং ধর্ম সম্পর্কে আমার কিছুটা দুর্বলতা থাকলেও আমি নিয়মিত চার্চে যাওয়া মানুষ নই। একই ভাবে, মাইকেল কসিনিস্কির সিস্টেম জানাল আমি সাংবাদিকতা করি এবং ইতিহাসে আমার গভীর আগ্রহ আছে। আসলেই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেছি এবং ঐতিহাসিক গবেষণা পদ্ধতি নিয়ে মাস্টার্স করেছি।

অনেকেই স্ট্যানফোর্ডকে সিলিকিন ভ্যালির নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয় মনে করেন- এটা সিলিকন ভ্যালির কাছেই অবস্থিত এবং সিস্কো, গুগল, হিউলেট-প্যাকার্ড এবং ইয়াহু!- এর প্রতিষ্ঠাতা এখান থেকে বের হয়েছেন।

আর এইসব কিছুই বের হয়ে এসেছে স্রেফ ফেসবুক লাইক থেকে যার সাথে আমার ব্যাকগ্রাউন্ড কিংবা বেড়ে ওঠার কোনো সম্পর্কই নেই। মাইকেল জানালেন, “মানুষ সাধারণত প্রেডিকশান বা অনুমান করার এই বিষয়টা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। আসলে আপনি যদি ফেসবুকে লেডি গাগাকে লাইক দেন, তাহলে তো আমি বলতে পারবই যে আপনি লেডি গাগাকে পছন্দ করেন।… এই ধরণের এলগরিদমের বিশেষত্ব হলো এই যে এর মাধ্যমে আপনার সঙ্গীত কিংবা বই পছন্দ করার মতো নিরীহ বিষয়কে কাজে লাগিয়ে আপনার ধর্মবোধ, নেতৃত্বের গুণাবলী, ব্যক্তিত্ব এবং এরকম আরো অনেক কিছু সম্পর্কে নিখুঁত ধারণা করা যেতে পারে।” রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়টিকে কীভাবে কাজে লাগাতে পারে- এটা আলাদা একটা আলোচনার বিষয়। কিন্তু মাইকেলের অফিস থেকে চলে আসার সময় আমার এমন একটা বোধ হলো যে, এই ধারণা করতে পারার বিষয়টি বেশ আকর্ষণীয় কিন্তু এটা এমন নতুন এক ধরণের ক্ষমতার উৎস যা সম্পর্কে আমাদের জানা বোঝা খুবই কম, নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতার তো প্রশ্নই আসে না।

ডাটাইজমের যৌক্তিক পরিণতি হলো- এর মাধ্যমে আমাদের সকলকে বিশেষ অনুমানযোগ্য ডাটা পয়েন্টে পরিণত করা। যারা চ্যাটবটের সাথে কথা বলেছেন কিংবা সদ্য ক্রয় করা পণ্যের বিজ্ঞাপনের মুখোমুখি হয়েছেন তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এটা এখনো ততটা নিখুঁত হয়নি। কিন্তু গতিপথটা তো পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে, ফলে এমন একসময় হয়তো আসবে যখন দেখা যাবে আপনি যা কিছু পছন্দ করছেন তার সবকিছুই আপনাকে উদ্দেশ্য করে ব্যবহার করা কোনো এলগরিদমের প্রভাবের মাধ্যমে নির্ধারিত। কল্পনা করে দেখুন- আপনি ঘুম থেকে উঠছেন স্বয়ংক্রিয় ভাবে সেট করা এলার্মের মাধ্যমে যে এলার্মের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে আপনার দিনের কর্মসূচি, তৈরি হওয়ার গড় সময় এবং রাস্তার ট্রাফিক প্যাটার্নকে মাথায় রেখে। আপনাকে ডাটা নির্ভর ব্রেকফাস্টের প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে যে ব্রেকফাস্টের মেনু নির্ধারণ করা হয়েছে আপনার এবং আপনার মতো আরো অনেকের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি ও দৈনিক পুষ্টি চাহিদার উপর ভিত্তি করে। এই ব্রেকফাস্ট যদি আপনি গ্রহণ করেন তাহলে আপনার স্বাস্থ্যবিমার প্রিমিয়াম কিছুটা কমিয়ে দেয়ার প্রস্তাবও এর সাথে যুক্ত। এবার আপনি আপনার চালকবিহীন গাড়িতে উঠে বসবেন যা স্বয়ংক্রিয় ট্যাক্সি হিসেবে সারারাত যাত্রী বহন করে অর্থ উপার্জন করে কিছুক্ষণ আগেই  ফিরেছে। আর আপনি যখন গাড়িতে আরাম করে বসেছেন, আপনার ব্যক্তিগত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত সহকারি (এআই এসিসটেন্ট বট) আপনাকে আজকের গুরুত্বপূর্ণ সেলস মিটিং এ কী বলবেন সে বিষয়ে পরামর্শ দিতে থাকবে, যে পরামর্শ তৈরি হয়েছে এর আগের মিটিংগুলোর ফলাফলের উপর ভিত্তি করে। বাড়ি ফেরার আগে… …

এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন দেয়ার সম্ভাবনা অসীম। আপনার ঘুমের ধরণ, ডায়েট, ফেসবুকে ব্যবহার করা বিভিন্ন শব্দ এবং কণ্ঠের ধরণ ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে যদি দেখা যায় আপনি স্বাস্থ্য ঠিকঠাক বজায় রাখতে পারছেন না বা ঠিকঠাক বজায় না রাখতে পারার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তাহলে হয়তো আপনাকে স্থানীয় একটি ব্যায়ামাগারের বিজ্ঞাপন দেখানো হবে। আপনার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যক্তিগত সহকারি আপনাকে জানাবে আপনার কোন কোন জিনিস প্রয়োজন, ঠিক কখন প্রয়োজন, আপনার হয়তো জানাও লাগবে না এগুলো কেন প্রয়োজন।

এসবের যে কোনো ভাল দিক নেই তা কিন্তু নয়। আমার বিগ ডাটা এনালাইসিসের একটি প্রতিষ্ঠান আছে যার মাধ্যমে আমরা নতুন নতুন সামাজিক প্রবণতা, অসুস্থতা, সন্ত্রাসের হুমকিসহ আরো অনেক বিষয়ে জানতে পারি। ডাটার মাধ্যমে জনগণ হয়তো আগের চেয়ে বেশি করে সরকারের জবাবদিহি আদায় করতে পারবে। এমন ঘটা তো অবশ্যম্ভাবী যে বিভিন্ন কোম্পনির এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা)- এর সাথে দরকষাকষির জন্য আমাদের ব্যক্তিগত এআই থাকবে (ক্রেডিট কার্ড, গাড়ি ঋণ, পেনশন, বিনিয়োগ ইত্যাদির কথা ভাবা যেতে পারে)।১৪ ব্যবহারকারীর দিক থেকে এগুলো সবই ভাল সম্ভাবনা।

কিন্তু ডাটা সংগ্রহ থেকে শুরু করে বিশ্লেষণ, অনুমান, টার্গেট করা- এই পুরো প্রক্রিয়াটি একজন গণতান্ত্রিক নাগরিককে তিনটি চ্যালেঞ্জের সামনে ফেলে দেয়। প্রথমত, প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নজরের আওতায় এবং ডাটা সংগ্রহের প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে মানুষের পক্ষে রাজনৈতিক পরিপক্কতা অর্জন করা সম্ভব কিনা এই প্রশ্ন। দ্বিতীয়ত, এই টুলসগুলো ব্যবহার করে আমাদের স্বার্থের বিপরীতে প্রভাবিত করা কিংবা আমাদের মনোযোগ সরিয়ে দেয়ার বিপদ। তৃতীয়ত, আমরা এভাবে এক পর্যায়ে এমনকি নিজেদের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়ার মত বিশ্বাসযোগ্য থাকব কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন। আমার এখন একটা একটা করে এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করব।

প্রথমত, প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নজরের আওতায় এবং ডাটা সংগ্রহের প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে মানুষের পক্ষে রাজনৈতিক পরিপক্কতা অর্জন করা সম্ভব কিনা এই প্রশ্ন। দ্বিতীয়ত, এই টুলসগুলো ব্যবহার করে আমাদের স্বার্থের বিপরীতে প্রভাবিত করা কিংবা আমাদের মনোযোগ সরিয়ে দেয়ার বিপদ। তৃতীয়ত, আমরা এভাবে এক পর্যায়ে এমনকি নিজেদের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়ার মত বিশ্বাসযোগ্য থাকব কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন।

অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে জীবন

১৮৯০ সালে স্যামুয়েল ওয়ারেন এবং লুইস ব্র্যান্ডিস (যারা পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হয়েছিলেন) হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ এর জন্য লেখা একটা ঐতিহাসিক এবং বর্তমান সময়েও প্রাসঙ্গিক এক প্রবন্ধে প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, ক্যামেরার আবির্ভাবের ফলে নাগরিকেরা সরকারের সার্বক্ষণিক নজরদারির ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন কিনা। তারা অনুধাবন করেছিলেন, নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাবের ফলে অনেক সময় সামাজিক আদর্শ পাল্টে যায়, যে কারণে সমন্বয় রক্ষার জন্য অনেক সময় নতুন আইনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তারা ভেবেছেন, আঠার শতকের জীবনের জটিলতা ও তীব্রতা এত বেশি যে “ব্যক্তির জন্য একাকিত্ব ও প্রাইভেসি বা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা আগের চেয়ে আরো বেশি জরুরি।” তারা মনে করেন যে, নাগরিকের একলা থাকবার অধিকার রয়েছে।

সে সময় থেকে আইনে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং রাষ্ট্র ও বিভিন্ন কোম্পানির হাত থেকে নাগরিকদের রক্ষার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার আইন না থাকলে- যা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মাত্রায় বাস্তবায়িত- আমরা সকল সময়েই সর্বাত্মক নজরদারির মধ্যে থাকতাম। আমার আশংকা হলো, যেসব দেশে এইসব আইন কানুনের কোনো বালাই নেই, সেখানে ওয়্যারেবল টেক বা পরিধানযোগ্য প্রযুক্তি, স্মার্ট হোম, এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অভূতপূর্ব সরকারি নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের পরিবেশ তৈরি করবে।১৫ আর এই ভয় কেবল গোষ্ঠীতান্ত্রিক বা স্বৈরতান্ত্রিক দেশের জন্যই নয়, মুক্ত সমাজের দেশেও আমরা আর একলা থাকতে পারিনা; ডাটার গোল্ড রাশের ফলে গণতান্ত্রিক সরকারের দিক থেকেও নজরদারির নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে যার ফলে অনেক নাগরিক স্বাধীনতার সপক্ষের সংগঠন রাজনৈতিক বিতর্ক ও আন্দোলনের ভবিষ্যত নিয়ে আশংকিত। আরো অনেকের মতো আমিও শুধুমাত্র আক্রমণাত্মক বা নোংরা কথা বলার জন্য মানুষের আটক হওয়ার খবর পড়ে উদ্বিগ্ন। কিছু ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক ব্যক্তির উপর আলাদা করে নজরদারির প্রয়োজন থাকছে না, স্রেফ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকেই তারা তাদের প্রয়োজনীয় তথ্যাদি পেয়ে যাচ্ছে।(এনএসএ’র প্রিজম কর্মসূচির উদ্দেশ্য ঠিক এটাই ছিল- যে কর্মসূচির তথ্য এডওয়ার্ড স্নোডেন ফাঁস করে দিয়েছিলেন।)

কিছু ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক ব্যক্তির উপর আলাদা করে নজরদারির প্রয়োজন থাকছে না, স্রেফ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকেই তারা তাদের প্রয়োজনীয় তথ্যাদি পেয়ে যাচ্ছে।(এনএসএ’র প্রিজম কর্মসূচির উদ্দেশ্য ঠিক এটাই ছিল- যে কর্মসূচির তথ্য এডওয়ার্ড স্নোডেন ফাঁস করে দিয়েছিলেন।)

প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর (লিটল ব্রাদার!) ক্রমাগত নজরদারি ও তথ্য ভাগাভাগির আরেকটা সূক্ষ্ম বিপদ রয়েছে। আঠার শতকে দার্শনিক জেরেমি বেনথাম এক নতুন ধরনের জেলখানার কথা বলেন, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘প্যানঅপ্টিকন’। এর নকশা এমন যে, কেবলমাত্র একজন কারারক্ষীর মাধ্যমেই সকল বন্দীকে নজরে রাখা যাবে- বন্দীরা জানতেও পারবেনা যে তাদের উপর নজরদারি করা হচ্ছে। এক জায়গা থেকে সবার উপর নজর রাখা যেতে পারে- এই সম্ভবনাটাই মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যথেষ্ট মনে করেছিলেন বেনথাম। আমাদের আধুনিক প্যানঅপ্টিকনে অবশ্য নজরদারির জন্য কেবল একজন থাকে না- সবাই সবার উপর নজরদারি করে। এই জাতীয় চিরস্থায়ী দৃশ্যমানতা ও পর্যবেক্ষণ সক্ষমতার মাধ্যমে বাধ্যতা ও আনুগত্য নিশ্চিত করা যায়। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে যা বলছি তাই সংগ্রহ করা হচ্ছে- এরকম একটা বাস্তবতার মধ্যে থাকবার ফলে আমাদের মধ্যে সেলফ সেন্সরশিপ বা স্ব-নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা গড়ে উঠে।

এই জাতীয় চিরস্থায়ী দৃশ্যমানতা ও পর্যবেক্ষণ সক্ষমতার মাধ্যমে বাধ্যতা ও আনুগত্য নিশ্চিত করা যায়। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে যা বলছি তাই সংগ্রহ করা হচ্ছে- এরকম একটা বাস্তবতার মধ্যে থাকবার ফলে আমাদের মধ্যে সেলফ সেন্সরশিপ বা স্ব-নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা গড়ে উঠে।

এরফলে নাগরিকদের মধ্যে নিজের জীবনের ক্ষেত্রে নৈতিক বিচারবোধ প্রয়োগের সক্ষমতা গড়ে উঠায় সমস্যা তৈরি হচ্ছে। স্বাধীন চিন্তা করবার সক্ষমতা গড়ে উঠার জন্য এমন একটা পরিবেশ প্রয়োজন যেন মানুষ বিতর্কিত কথা বলতে পারে, ভুল করতে পারে এবং সেখান থেকে শিক্ষা নিতে পারে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা আজব রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হয় যেখানে আমাদের সবাইকে নির্দিষ্ট কিছু ভূমিকায় অভিনয় করতে হয় এবং সবসময় জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য আচরণ করতে হয়, যা মানুষের প্রকৃত বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।১৬ উদাহরণস্বরূপ, আত্মউন্নয়ন প্রক্রিয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ভুলতে পারার সক্ষমতা কারণ নিজের মনোভাব পরিবর্তন করতে করতেই আমরা পরিপক্ক হই ও বিকাশ লাভ করি। কিন্তু প্রতিনিয়ত বিপুল সংখ্যক মানুষ- বিখ্যাত ও সাধারণ উভয়ই- অনেক ক্ষেত্রে বহু খেসারত দিয়ে উপলব্ধি করছেন যে ডিজিটাল প্রযুক্তি কোনো কিছুই ভোলে না। অনেক সময় ক্ষমতাবানদের  উদ্দেশ্য উন্মোচন করতে এই ব্যাপারটা বেশ কাজে লাগে। কিন্তু কোনো একটা ফোরামে বোকার মতো অল্প বয়সে না জেনে, না বুঝে করা একটা মন্তব্য যখন চিরকাল থেকে যায় এবং বিভিন্ন উপলক্ষে খুঁজে বের করে ব্যবহার করা যায়, তখন মানুষের মনে হয়- এরচেয়ে বরং কোনো কিছু না বলাই ভাল। সুস্থ ও চিন্তাশীল মানুষ গড়ে তোলার জন্য যথাযথ পরিবেশ এটা না।

কোনো একটা ফোরামে বোকার মতো অল্প বয়সে না জেনে, না বুঝে করা একটা মন্তব্য যখন চিরকাল থেকে যায় এবং বিভিন্ন উপলক্ষে খুঁজে বের করে ব্যবহার করা যায়, তখন মানুষের মনে হয়- এরচেয়ে বরং কোনো কিছু না বলাই ভাল। সুস্থ ও চিন্তাশীল মানুষ গড়ে তোলার জন্য যথাযথ পরিবেশ এটা না।

দ্যা পাওয়ার অব ম্যানিপুলেশান

দ্বিতীয় সমস্যাটি হলো কারসাজি ও মনোযোগ বিভিন্নমুখি করার সমস্যা। আমরা সবসময়ই বিজ্ঞাপন, ব্র্যান্ডিং, এমনকি সুপার মার্কেটের নকশার মাধ্যমে প্রভাবিত হতে থাকি (মিষ্টিগুলো সবসময়ই শিশুদের দৃষ্টিরেখা বরাবর রাখা হয়) । এখন শুধু যে এইসব প্রভাবের পরিমাণ বেড়েছে তাই না, গুণগত দিক থেকেও তা ভিন্ন ধরণের। ডাটা বিশ্লেষক কিংবা এলগরিদম যদি আমাদের চেয়েও আমাদেরকে ভালো বোঝে, তাহলে তারা আমাদেরকে এমনভাবে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করতে পারবে যে আমরা বুঝতেও পারব না।

ধরা যাক, একটা পারসনালাইজড বিজ্ঞাপনদাতা সিস্টেম আপনার পূর্ববর্তী কথাবার্তা ব্যবহার করে বুঝে নিল ঠিক কী ভাষায় কথা বললে আপনি কোন বক্তব্যকে সত্য ও আকর্ষণীয় বলে মনে করেন। দেখা গেল আপনি যখন অনলাইনে তখন আপনার মানসিক অবস্থা বুঝে সেই অনুযায়ী আপনার আবেগকে স্পর্শ করতে পারে এমন স্পন্সরড টুইট করছে। হয়তো একজন বিদেশির সাথে আপনার ঝগড়া হয়েছে- এমন সময় দেখা গেল স্থানীয় এক রাজনৈতিকের হয়ে আপনার উদ্দেশ্যে অভিবাসী বিদ্বেষী টুইট করা হলো।

এগুলো তুলনামূলক মামুলি বিষয়। কেমন হবে যদি বিষন্নতায় আক্রান্ত মানুষদেরকে সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে নিজের সম্পর্কে ধারণা আরো নীচু করে দেয় এমন মেসেজ পাঠানোর মাধ্যমে এন্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ ২০ শতাংশ বেশি বিক্রয় করা সম্ভব হয়? কী ঘটবে যদি কোনো মানুষের দুর্বল একটা মুহুর্তে বা যখন তিনি অর্থের সংকটে ভুগছে এমন একটা সময়ে উপযুক্ত শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করে কোনো মানুষকে ঋণ ও জুয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়?

কেমন হবে যদি বিষন্নতায় আক্রান্ত মানুষদেরকে সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে নিজের সম্পর্কে ধারণা আরো নীচু করে দেয় এমন মেসেজ পাঠানোর মাধ্যমে এন্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ ২০ শতাংশ বেশি বিক্রয় করা সম্ভব হয়? কী ঘটবে যদি কোনো মানুষের দুর্বল একটা মুহুর্তে বা যখন তিনি অর্থের সংকটে ভুগছে এমন একটা সময়ে উপযুক্ত শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করে কোনো মানুষকে ঋণ ও জুয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়?

আমাদের ইচ্ছাগুলো আসলে কতটা স্বাধীন ভাবে তৈরি হয় সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে। স্বাধীন ইচ্ছা বলে আদৌ কিছু আছে কিনা এটা নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু বিগ ডাটা এলগরিদম বিষয়টি ক্ষমতার নতুন আস্তানা, প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন হাজির করে। আধুনিক কারসাজিগুলো কীভাবে কাজ করে তা কেউই জানেন না। কোনো একটি প্রযুক্তি কোম্পানির এলগরিদম কীভাবে কাজ করে তার পরিপূর্ণ ধারণা উক্ত কোম্পানির কোনো কর্মীরই থাকেনা, যেমন একজন কর্মীর পক্ষে একাই একটা গাড়ি বা পেন্সিল বানানো সম্ভব নয়। লাইনের পর লাইন প্রোগ্রামিং কোডের মাধ্যমে লেখা এলগরিদম বর্তমান দুনিয়াকে প্রভাবিত করছে। স্বয়ংক্রিয় ফিডব্যাক লুপের মাধ্যমে এদের নানান উন্নয়ন ঘটছে। একসময়কার কোকাকোলার গোপন রেসিপির মতো, এই কোডগুলোও গোপনীয় এবং খুব কম মানুষের কাছে বোধগম্য- ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রেগুলটর বা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ জানেন না কখন কীভাবে অবিচার ঘটতে পারে এবং কীভাবেই বা তা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

স্বাধীনতা

ক্রমশ আরো শক্তিশালী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাবের সাথে সাথে ডাটাইজমের সম্ভাবনা আমাদের নিজের সম্পর্কের আমাদের ধারণা বিষয়ে মৌলিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। ডাটাইজম মনে করে যে, ডাটার গাণিতিক নিয়মাবলীকে মানবীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রয়োগ করা সম্ভব। এটা হলো ডাটার তৃতীয় ও শেষ সমস্যা। ইয়োভাল নোয়াহ হারিরি যেমন তার বিখ্যাত বই হোমো ডিউসে ব্যাখ্যা করেছেন, শত শত বছর ধরে আমরা বিশ্বাস করে এসেছি যে, আমরাই অর্থময়তার একমাত্র উৎস এবং মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাই হলো কর্তৃত্বের চূড়ান্ত রূপ। এটা আমাদের প্রতিষ্ঠাকালীন রূপকথা: আমরা তুলনামূলকভাবে বৃহৎ ও শক্তিশালী হওয়ার কারণে বিশ্ব জয় করিনি, আমরা বিশ্ব জয় করেছি বুদ্ধিমত্তার জোরে। আমরা মনে করি, গণতন্ত্রের একটি বিশেষ নৈতিক মূল্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে কারণ আমরা মানুষের বিচারবোধ ও নৈতিক পছন্দ-অপছন্দকে বিশেষ মূল্যবান হিসেবে দেখি।

কিন্তু কী ঘটবে যদি বিপুল পরিমাণ ডাটার জোরে স্মার্ট মেশিনগুলো আমাদের চেয়ে ভাল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম হয়ে যায়?

ভবিষ্যতবাদীরা অনেক সময় কর্মসংস্থানের উপর এর প্রভাব নিয়ে কথা বললেও আমাদের আত্ম-বিশ্বাস ও মর্যাদার উপর এর কী প্রভাব পড়বে সে সম্পর্কে খুব কমই আলোচনা করেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত অগ্রগতি থেকে বোঝা যায় যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ক্রমশ আরো বেশি করে মানুষের চেয়ে উন্নতমানের অর্ন্তদৃষ্টি ও সমাধান প্রদান করতে পারবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের কথাই ধরা যাক। কয়েক বছরের মধ্যেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চিকিৎসকের চেয়েও দক্ষতার সাথে রোগ নির্ণয় করতে পারবে (ইতোমধ্যেই অনেক ক্ষেত্রেই করতে সক্ষম কিন্তু রেগুলেশান বা বিধি নিষেধ প্রযুক্তির তুলনায় পিছিয়ে আছে)। শুরুর দিকে আমরা জীবন মৃত্যুর প্রশ্নে হয়তো মেশিনের উপর বিশ্বাস রাখতে পারবনা। কিন্তু দ্রুতই আমরা তা গ্রহণ করব যেমন করে বিমান চালানার ক্ষেত্রে অটো পাইলটকে গ্রহণ করেছি। ত্রাণ বিতরণ, স্মার্ট বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা, ফসল ফলনের ভবিষ্যতবাণী, তেল দূষণ চিহ্নিত করা ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রেও একই রকম ঘটনা ঘটবে।১৭

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসঙ্গটির কার্যকারিতার প্রশ্ন থেকে নৈতিকতার প্রশ্নের দিকে মোড় নেয়া এখন স্রেফ সময়ের ব্যাপার কারণ এই দুইয়ের মধ্যে দূরত্ব খুব বেশি নয়। ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকেই প্রত্যেক নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের সাথে সাথে বিশুদ্ধ ও নিখুঁত বিজ্ঞানের মাধ্যমে জটিল নৈতিক সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে জল্পনা কল্পনা হয়েছে। আজ পর্যন্ত তা সম্ভব না হলেও এবারের বিষয়টি একটু ভিন্ন যার কারণ সংখ্যার মাদকতাময় ক্ষমতা। সংখ্যা মাদকতাময় কারণ এর মাধ্যমে বিশুদ্ধ, যথার্থ এবং নির্মোহ সমাধান পাওয়া সম্ভব। এ হিসেবে এলগরিদমের আকর্ষণ দ্বিগুণ কারণ এলগরিদম হলো কোটি কোটি উদাহরণের ভিত্তিতে কাজ করা এক যৌক্তিক ও নৈর্ব্যক্তিক গণনার যন্ত্র।

আপনি অস্বীকার করতে পারেন, কিন্তু বাস্তবতা হলো আমরা এখনই নৈতিক সিদ্ধান্তের জন্য মেশিনের উপর নির্ভর করছি। ক্যাথি ও’নিল তার সাম্প্রতিক বই উইপনস অব ম্যাথ ডেস্ট্রাকশানে কয়েক ডজন উদাহরণ দেখিয়েছেন যেখানে নিয়োগ, শিক্ষক মূল্যায়ন, পুলিশ পাঠানো- এরকম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কার্যত ডাটা ও এলগরিদমের শীতল ও প্রশ্নহীন সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে, যদিও এইসব সিদ্ধান্তের গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক দিক ও ফলাফল রয়েছে।১৮ আমি এখনই কল্পনা করতে পারি এই ধরণের উপযোগবাদী চিন্তাভাবনাই একসময় বিশ্বজুড়ে প্রাধান্য পাবে। আর ফলাফল হবে বিপর্যয়কর। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে আপাত দৃষ্টিতে নৈর্ব্যক্তিক মনে হতে পারে, কিন্তু এলগরিদম সবসময়ে উদ্ভাবকের তোলা প্রশ্ন থেকে জন্ম নেয়। যার ফলে এলগরিদম কখনই তার স্রষ্টার পক্ষপাতিত্বের প্রভাব মুক্ত হতে পারে না। বর্তমান সময়ের এলগরিদমগুলো উত্তর ক্যালিফর্নিয়ার একদল শ্বেতাঙ্গ প্রযুক্তিবিদের হাতে তৈরি হয়েছে বলে ইতোমধ্যেই বেশ কিছু সমস্যার জন্ম দিয়েছে। এসব এলগরিদম মোটেই নিরপেক্ষ নয়। যেমন, কিছু কিছু পুলিশ বাহিনী ডাটা মডেলের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয় কোথায় কোথায় পুলিশ পাঠাতে হবে। যেহেতু দরিদ্র প্রধান অঞ্চলগুলোতে অপরাধ বেশি সংগঠিত হয়, কাজেই সেসব অঞ্চলেই বেশি পুলিশ নিয়োজিত করা হয়। তার অর্থ হলো, প্রতিনিয়ত আরো বেশি সংখ্যক মানুষ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়, মডেলে আরো বেশি সংখ্যক অপরাধের খবর প্রবেশ করে এবং ফলে আরো বেশি পুলিশ নিয়োজিত হয়। আর এভাবেই ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও এলগরিদম-চালিত অবিচারের স্ব-চালিত একটা চক্র তৈরি হয়।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে আপাত দৃষ্টিতে নৈর্ব্যক্তিক মনে হতে পারে, কিন্তু এলগরিদম সবসময়ে উদ্ভাবকের তোলা প্রশ্ন থেকে জন্ম নেয়। যার ফলে এলগরিদম কখনই তার স্রষ্টার পক্ষপাতিত্বের প্রভাব মুক্ত হতে পারে না।

আসল ব্যাপারটি এখানেই। বিপদ এটা নয় যে মেশিনের মাধ্যমে দুর্বল সমাধান বের হচ্ছে বরং তার বিপরীত। সময়ের সাথে সাথে এই এলগরিদমের উন্নয়ন ঘটবে এবং এর মাধ্যমে অনেক ভাল ও অর্থ সাশ্রয়ী সমাধান বের হবে (অন্তত মানুষের নেয়া সিদ্ধান্তের তুলনায়)। আর এভাবে আমাদের জীবনে এলগরিদমের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে যদিও তা নানান অদৃশ্য উপায়ে অবিচারের জন্ম দেয়। যদি কোনো মেশিন বার বার চিকিৎসকের চেয়ে ভালো রোগ নির্ণয় করে, তাহলে রোগ নির্ণয়ে মেশিনের ব্যবহার না করাটা অনৈতিক সাব্যস্ত হতে পারে। কোনো মেশিন যদি সরকারকে পুলিশি ব্যবস্থা বিষয়ে এমন পরামর্শ দেয় যার মাধ্যমে অপরাধ ও অর্থ ব্যয় উভয়ই হ্রাস করা সম্ভব হয়, তাহলে তার ব্যবহার ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। যদিও এর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে সমস্যার সমাধান হবে না।

এলগরিদমের ভূমিকা নাগরিকের মূল কাজের ক্ষেত্রেও বা কেন বিস্তৃত হবে না? ইতোমধ্যেই কেমন করে ভোট দিতে হবে তা শেখানোর সৎ উদ্দেশ্যে অনেক ধরনের অ্যাপ তৈরি হয়ে গেছে। আপনি আপনার মতামত ও পছন্দ অ্যাপের মধ্যে প্রবেশ করাবেন আর অ্যাপ আপনাকে বলে দেবে কাকে ভোট দিতে হবে। প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ ব্রিটিশ ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি নির্বাচনে ভোট বিষয়ক অ্যাপ ‘iSideWith’ ব্যবহার করেছেন। এই যে পঞ্চাশ লক্ষ নাগরিক তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের কাজটি একটি অ্যাপকে জিজ্ঞেস করে সম্পন্ন করেছে – এটা নিয়ে যেন কারোরই মাথাব্যথা নেই।

যুক্তরাজ্যে ২০১৫ সালের নির্বাচনের আগে আমার প্রতিষ্ঠান ডেমোস(Demos) ভার্টো(Verto) নামের একই ধরনের একটি অ্যাপ তৈরিতে সাহায্য করেছিল। আমরা সকলেই এটাকে দারুণ একটা কাজ মনে করেছিলাম- আমি সবাইকে বলেছিলাম এই অ্যাপটি বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান কী তা বুঝতে ভোটারদেরকে সাহায্য করবে। কিন্তু এখন আমার মত পাল্টে গেছে, আমি মনে করি স্বল্প মেয়াদে এই ধরণের অ্যাপ সুবিধাজনক হলেও আমাদের দীর্ঘ-মেয়াদী চিন্তার সামর্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আমাদের সকলেরই উচিত এগুলোকে বর্জন করা।

আমি সবাইকে বলেছিলাম এই অ্যাপটি বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান কী তা বুঝতে ভোটারদেরকে সাহায্য করবে। কিন্তু এখন আমার মত পাল্টে গেছে, আমি মনে করি স্বল্প মেয়াদে এই ধরণের অ্যাপ সুবিধাজনক হলেও আমাদের দীর্ঘ-মেয়াদী চিন্তার সামর্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আমাদের সকলেরই উচিত এগুলোকে বর্জন করা।

অ্যাপই যদি ব্যবহার করবেন, তাহলে আপনার ভোটটিই বা এলগরিদমের হাতে তুলে দিচ্ছেন না কেন? ভোটাররা অনেক সময় নিজের পছন্দও ভালো ভাবে বুঝতে পারেন না। আমরা অনেক বেশি আবেগি আচরণ করি এবং ভোট কেন্দ্রে একগাদা বুদ্ধিবৃত্তিক পক্ষপাতিত্ব নিয়ে হাজির হই। কী হবে যদি একটা ভোট-বট আপনার যাবতীয় অনলাইন পোস্ট, লাইক, বন্ধুদের লাইক এবং এরকম হাজার ধরণের ডাটার উপর ভিত্তি করে আপনার পছন্দের প্রার্থীকে খুঁজে বের করে দেয়?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের চেয়ে বেশি স্মার্ট (স্মার্ট বলতে আমি ডাটা ভিত্তিক কার্যকর সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতাকে বুঝিয়েছি, বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে নয়)- এই বোধটি আমাদের রাজনৈতিক ও নৈতিক কর্তৃত্বের ধারণার উপর এমন ব্যাপক প্রভাব ফেলবে যা এখন হয়তো আমরা কল্পনাই করতে পারছিনা। আমরা হয়তো প্রথমে এইসব মেশিনকে এড়িয়ে যাওয়া বা ধ্বংস করার চেষ্টা করব। তারপর ব্যর্থ হয়ে আস্তে আস্তে নিজেদেরকে বোঝাতে শুরু করব যে, আমরা তো আসলেই সবচেয়ে ভালোটা কী হবে তা জানিনা, কাজেই গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোর জন্য নিজেদের মতামতের উপর নির্ভর করা বোধহয় ঠিক হবে না। হতে পারে বিশ্বব্যবস্থা আস্তে আস্তে এমন জটিল ও বিভ্রান্তকর হয়ে যাবে যে কেবল মাত্র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পক্ষেই সবকিছু ঠিকঠাক চালিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। বিকল্প একটি উন্নততর সিস্টেম থাকার পরেও মানুষ কর্তৃক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারটি কেমন হবে তখন?

এলগরিদম যত বেশি দ্রুতগতি সম্পন্ন ও স্মার্ট হতে থাকবে, এই অসুবিধাজনক দায়িত্বগুলো এলগরিদমের উপর ছেড়ে দেয়ার চাপ তত বাড়বে। এই তাগিদে সাড়া দেয়া কঠিন কিছু নয় কিন্তু এর ফলে আমরা স্বাধীন ভাবে চিন্তা করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলব এবং মেশিনের উপর আরো বেশি করে নির্ভর করতে থাকব।

ভবিষ্যতবাদীরা অনেক সময় টেকনোলজিক্যাল সিঙ্গুলারিটির কথা বলেন, যখন মেশিনের আত্ম-উন্নয়ন এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছাবে যে কারো সাহায্য ছাড়াই নিজে নিজে অসীমকাল ধরে চলতে থাকবে। গুগলের মেধাবী প্রকৌশলী রে কুরজেল মনে করেন বর্তমান শতাব্দির মাঝামাঝিতে এসে এই পরিস্থিতি তৈরি হবে (অন্য অনেকেই অবশ্য এর সাথে একমত নন)। আগে হোক আর পরে, যা আসলে ঘটবে বলে আমি মনে করি তা হলো- “মোরাল সিঙ্গুলারিটি”- যখন আমরা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের একটা বড় অংশ মেশিনের হাতে তুলে দিতে শুরু করব। এরপর আর ফেরার কোনো রাস্তা থাকবে না: একবার নির্ভর করা শুরু করলে আমরা আর থামতে পারব না। কেনাকাটা, ভোট প্রদান, শিশু লালন পালন, প্রচার প্রচারণা ইত্যাদি হাজারো কর্মকাণ্ড বিষয়ে বার বার বিভিন্ন নৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতার উপর নিজেদেরকে আমাদের নৈতিক সত্ত্বা মনে করার ব্যাপারটি নির্ভরশীল। হ্যাঁ, হতে পারে ঐসব সিদ্ধান্তে নানা ধরণের ত্রুটি ও পক্ষপাতিত্ব থাকে- যেকারণে মেশিনের ত্রুটিহীন সিদ্ধান্ত এত আকর্ষণীয়। কিন্তু আমাদের চিন্তা করবার সক্ষমতা তৈরিই হয় যুক্তি, তথ্যপ্রমাণ, নৈতিক অনুসন্ধান ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। এগুলো কোনো সহজ কাজ নয়, এসব কাজের জন্য নাগরিকদের সদা সতর্ক ও সজাগ থাকতে হয়, বিভিন্ন বিতর্কিত ধারণা ও নাগরিকদের উপর এসবের প্রভাব বিষয়ে যত্নের সাথে চিন্তা করতে হয়। গণতান্ত্রিক দেশে বসবাস করছেন এমন সকল নাগরিকের দায়িত্ব এটা। এলগরিদম যত বেশি দ্রুতগতি সম্পন্ন ও স্মার্ট হতে থাকবে, এই অসুবিধাজনক দায়িত্বগুলো এলগরিদমের উপর ছেড়ে দেয়ার চাপ তত বাড়বে। এই তাগিদে সাড়া দেয়া কঠিন কিছু নয় কিন্তু এর ফলে আমরা স্বাধীন ভাবে চিন্তা করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলব এবং মেশিনের উপর আরো বেশি করে নির্ভর করতে থাকব। আমরা যেহেতু অনেক সময় ভুল সিদ্ধান্ত নেই, কাজেই মেশিনের হাতে সিদ্ধান্তের ভার ছেড়ে দিলে অনেক সময় ভাল ফলাফল আসলেও এই ধরনের ব্যবস্থাকে তখন আর গণতন্ত্র বলা যাবে না।

তথ্যসূত্র:

১) Wiiliam Davies এর The Happiness Industry (Verso, 2015) তে শুরুর দিককার দিনগুলো নিয়ে বেশ চমৎকার আলোচনা রয়েছে।

২) John Lanchester, ‘You are the product’, London Review of Books 17 August 2017

৩)Elizebeth Stinson, ‘Stop the Endless Scroll. Dlete Social Media from Your Phone’, www.wired.com, 1 October 2017

৪)Adam Alter, Irresistable, (Penguin Press 2017)

৫)Matt Richtel, ‘Are Teenagers replacing Drugs with Smartphones?’,New York Times, 13 March 2017

৬) Adam Alter, Irresistable

৭)Tristan Harris, ‘How Technology Is Hijacking Yourt Mind- from a Magician and Google Design Ethicist’, www.thriveglobal.com, 18 May 2016

৮) Robert Gehl, ‘A History of Like’, https://thenewinquiry,com, 27 March 2013

৯)Kathy Chan, ‘I like this’, www.facebook.com, 10 Feb 2009

১০) Tom Huddleston Jnr, ‘Sean Parker Wonders What Facebook is “Doing to Our Children’s Brains”’, www.fortune.com, 09 Nov 2017

১১)Natasha Singer, ‘Mapping, and Sharing, the Consumer Genome’, New York Times, 16 June 2012

১২) Michal Kosinski, David Stillwell, and Thore Graepel (2013),’Private traits and attributes are predictable from digital records of human behaviour’, PNAS, 110 (15), 5802-5805

১৩) Sam Levin, ‘Facebook told advertiser it can identify teens feeling “insecure” and “worthless”’, Guardian, 1 May 2017

১৪) Dave Birch, ‘Where are the customer’s bots?’, www.medium.com, 30 Dec 2017

১৫) Evgeny Morozov এ বিষয়ে তার বই To Save Everything, Click Here (Allen Lane 2013) এ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

১৬) Angela Nagle, Kill All Normies (Zero Books, 2017)

১৭) `The outstanding truth about artificial intillegence supporting disaster relief’, www.ifrc.org, 28 Nov 2016.

১৮) Franklin Wolfe, ‘How Artificial Intelligence will revolutionize the industry’, www.harvard.edu, 28 Aug 2017.

১৯) Alex Brokaq, ‘This startup uses machine learning and satellite imagery to predict crop yields’, www.theverge.com, 4 Aug 2016

২০) Maria Araujo and Daniel Davila, ‘Machine learning improves oil and gas monitoring’, www.talkingiotinenergy.com, 09 june 2017

১৮) Cathy O’Neil, Weapons of Math Destruction (Penguin Books, 2016). এছাড়া O’Neil তার ব্লগ www.mathbabe.org এ এরকম আরো অনেক দৃষ্টান্ত নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *