পাটশিল্প বিশেষ ক্রোড়পত্র-১
পাট, পাটশিল্প ও পাটভূমি
আনু মুহাম্মদ
করোনাকালে যখন অসংখ্য মানুষ কর্মহীন, খাদ্য ও চিকিৎসা সংকটে বিপর্যস্ত, যখন বিশ্বজুড়ে একদিকে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলো মজবুত করার জন্য চেষ্টা চলছে যখন পরিবেশবান্ধব শিল্প আর অর্থনৈতিক তৎপরতাকে গুরুত্ব দেবার তাগিদ বাড়ছে ঠিক সেই সময় লক্ষাধিক শ্রমিক ও কৃষক পরিবারের মাথায় বাড়ি মেরে দেশের প্রধান পরিবেশবান্ধব শিল্পকে অনিশ্চয়তায় ফেলে একসাথে বন্ধ করে দেয়া হলো ২৬টি পাটকল। মিথ্যা প্রতিশ্রুতির বস্তায় আরও কতগুলো প্রতিশ্রুতি ঢুকলো তা আর কিছুদিনের মধ্যেই পরিষ্কার হবে। শিল্পবিনাশের এই কাজ অবাধে সম্পন্ন করার জন্য মিথ্যা প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি জোরজুলুম ভয়ভীতি হুমকি ইত্যাদিও ব্যবহার করা হয়েছে। এই ঘটনা যে হঠাৎ করে ঘটেনি, বা লোকসান ইত্যাদির অজুহাতও যে সাজানো তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। বাংলাদেশের জন্য এই শিল্পের গুরুত্ব বিবেচনা করে তাই আমরা ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে সর্বশেষ পরিস্থিতির বিস্তারিত পর্যালোচনার উদ্যোগ নিয়েছি। এর অংশ হিসেবে এই সংখ্যায় বেশ কয়েকটি লেখা যুক্ত করা হলো। ২০০৭ সালে লেখা আনু মুহাম্মদের প্রবন্ধে ২০০২ সালে আদমজী বন্ধসহ সেসময়ে প্রণীত পাটনীতি ও পাটশিল্প নিয়ে এর আগে পরে বিভিন্ন সরকারের বাস্তব ভূমিকার ধারাবাহিকতা সনাক্ত করা হয়েছে। পাটশিল্প ও পাটশ্রমিকদের ওপর সর্বশেষ আক্রমণ যে আকস্মিক নয়, বরং বহুবছরের পরিকল্পিত কার্যক্রমেরই ফলাফল তা এই লেখা থেকে বোঝা সম্ভব হবে। পরিপ্রেক্ষিত মনে করিয়ে দেবার জন্য এই লেখাটি পুনপ্রকাশ করা হলো। এছাড়া সর্বশেষ পরিস্থিতির বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে, রাষ্ট্রায়ত্ত ও ব্যক্তিমালিকানাধীন পাটকলের শ্রমিকদের তুলনামূলক চিত্র পর্যালোচনা করে, তথ্য ও যুক্তি দিয়ে এই শিল্পের গতিমুখ অনুসন্ধান করে তিনটি প্রবন্ধ লিখেছেন যথাক্রমে কল্লোল মোস্তফা, মোশাহিদা সুলতানা ও অনুপম সৈকত শান্ত। প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ থেকে স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিকদের অভিজ্ঞতা ও ভয়ংকর অনিশ্চয়তা নিয়ে লিখেছেন রুহুল আমিন। এর মধ্যে দুটো লেখা আগাম প্রকাশ করা হয়েছে।
গত ২৯ জুলাই ‘পাট ও পাটশিল্প গণকমিশন’ সিরাজগঞ্জ সফর করেন। সেখানে অনুষ্ঠিত এক সভায় কওমী জুট মিল রক্ষা সমিতির সদস্যসচিব যেসব তথ্য দেন তা পরে কমিশন সদস্য সেলিনা হোসেন পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এসব তথ্যেসরকা রি নীতিমালার কারণে সিরাজগঞ্জে জনগণের কী অবস্থা দাঁড়িয়েছে তার একটি চিত্র পাওয়া যায়। এগুলো নিম্নরূপ:
‘– ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত একমাত্র কওমী জুল মিল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
—স্পিনিং অ্যান্ড কটন মিল ছয় মাস ধরে বন্ধ।
—পাঁচটি টেক্সটাইল মিল বন্ধ।
—দুই লাখ ২০ হাজার তাঁতশিল্পের মধ্যে এক লক্ষ বন্ধ। ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতিতে ৩০-৪০ হাজার তাঁত বন্ধ হয়ে আছে।
—মিল্কভিটার অবস্থা খুবই খারাপ। গত পাঁচ বছরের দুর্নীতি এই প্রতিষ্ঠানটিকে বসিয়ে দিয়েছে। দুগ্ধ উৎপাদনকারীরাসহ এই প্রতিষ্ঠানের ৬০-৭০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত।
—বিশ্বরোডে ভ্যান-রিকশা বন্ধ করায় ছয় হাজার ভ্যান ও রিকশাচালক বেকার।
—১৩০টি টুইষ্টিং মিলের মধ্যে ৫৭ টি বন্ধ হয়ে গেছে।
—নয়টি বিড়ি কারখানা ছিল, চারটি বন্ধ। দুই হাজার শ্রমিক বেকার।
—জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পর খুদে ব্যবসায়ীরা উচ্ছেদ হয়েছে ১৮ থেকে ২০ হাজার ।
—লঞ্চ ও নৌকাঘাট বন্ধ। ১৬ হাজার মানুষ বেকার।
—পাঁচটি রেল ষ্টেশন ছিল-সারা দিনে ছয়টি ট্রেন চলাচল করত, এখন একটি চলাচল করে। দুটি ষ্টেশন চালু আছে। সাত-আট হাজার মানুষ বেকার।’ (প্রথম আলো, ১৩ আগস্ট ২০০৭)
সকল পাটকল এলাকাসহ বিভিন্নস্থানে প্রায় একইরকম চিত্র। কোথায় যাবো কী করবো? এই প্রশ্ন অসংখ্য মানুষের। বলাবাহুল্য, বন্যা এই পরিস্থিতিকে আরও অবর্ণনীয় করে তুলেছে।
সরকারি নোটিশ
এরপর গত ৩১ জুলাই খুলনার খালিশপুরের পিপলস জুট মিল কর্তৃপক্ষ ‘মিল বন্ধের বিজ্ঞপ্তি’ শিরোনামে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেন। এর আগে ১৮ জুলাই ডাকযোগে বিজেএমসির সচিব স্বাক্ষরিত (১৬/৭/০৭) যে চিঠিটি এইসব মিলে পাঠানো হয়সেটি হুবহু নিচে উপস্থিত করা হল:
‘গত ০৩/০৬/০৭ ইং অনুষ্ঠিত বিজেএমসির পরিচালক মণ্ডলীর ১৮৩,০৩/০৬-০৭ নং সভায় কর্ণফুলী জুট মিল লি: (D. P. F সহ) এফ কে সি এবং কওমী ও পিপলস জুট মিলস লিঃ এর অবস্থা, শ্রমিক পরিস্থিতি, কাঁচা পাটের অভাব, তীব্র অর্থ সংকট ও উৎপাদন ঘাটতি, অনিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ ইত্যাদি কারণে পারফরমেন্স সন্তোষজনক পর্যায়ে আনা সম্ভব হবেনা মর্মে প্রতীয়মান হওয়ায় এই ৪টি মিল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
‘২। বিজেএমসির সংস্কার পরিকল্পনা নিয়ে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার সাথে গত ১৪/০৭/০৭ ইং তারিখে অনুষ্ঠিত সভায় বর্ণিত মিল ৪ টির বন্ধের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং আগামী ৩১ জুলাই ২০০৭ দিবসান্তে মিল ৪টি বন্ধ করার জন্য মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় সদয় নির্দেশনা প্রদান করেন।
‘৩। এমতাবস্থায় উপরিউক্ত বোর্ড সিদ্ধান্ত ও মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার সদয় নির্দেশনার আলোকে কর্ণফুলী, (D. P. F সহ) এফকেসিএফ, কওমী ও পিপলস জুট মিল লিঃ ৩১/০৭/০৭ দিবসান্তে বন্ধ ঘোষণা করার সদয় অনুমতি প্রদানের জন্য নির্দেশ ক্রমে অনুরোধ করা হইলো।’
এই পত্র বরাতে কয়েকটি বিষয় বলা দরকার:
১। ‘পারফরমেন্স সন্তোষজনক পর্যায়ে আনা সম্ভব হবেনা মর্মে প্রতিয়মান হওয়ায়’ মিল বন্ধ ঘোষণা করা হল, কিন্তু সন্তোষজনক পর্যায়ে যাতে আসে তার কোনো চেষ্টা কখনও দেখা যায়নি বরঞ্চ যাতে না আসে সে চেষ্টাই প্রথম থেকে দেখা গেছে;
২। তাই চারটি মিল বন্ধ করে দেয়ার যেসব কারণ দেখানো হচ্ছে সেগুলো আসলে টিকিয়ে রাখা কারণ;
৩। লেঅফ করে যখন বলা হয়েছিল এগুলো আবার খোলা হবে তা আসলে ঠিক ছিল না, মিথ্যা বলা হয়েছিল; এবং
৪। প্রধান উপদেষ্টার অজান্তে এই বন্ধ কর্মসূচি নেয়া হয়েছে বলে যে ধারণা তৈরি হয়েছিল তাও ঠিক নয়।
পাটশিল্প সংস্কার কর্মসূচি, ২০০৭
গত কয়েকমাসে বিভিন্ন দফায় চারটি মিল বন্ধ করবার কর্মসূচি বাস্তবায়নকালে চার/ছয়/আট মাসের বকেয়া মজুরির দাবিদার অনাহারী শ্রমিকদের উপর হামলা হয়েছে, গুলি হয়েছে, এমনকি তাদের ত্রাণ দেয়ার কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। শিল্প উপদেষ্টা এইসময়ই ‘নতুন’ পাট সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং তাকে অভিহিত করেন ‘জেহাদ’ বলে। এই কর্মসূচি যেভাবে সাজানো হয়েছে তার মূল দিকগুলো নিম্নরূপ:
চিত্র ১: পাট সংস্কার কর্মসূচি (‘জেহাদ’) ২০০৭
১। ভিশন -বিজেএমসিকে স্বাবলম্বী ও লাভজনক প্রতিষ্ঠান রূপে গড়ে তোলা
মিশন -২০২০ সালের মধ্যে সংস্কার কর্মসূচির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন
২। বর্তমান সংস্কারের আগে পাটকল সংখ্যা- ২৪
সংস্কারের পরে পাটকল সংখ্যা – ১৮
বন্ধ/বিক্রয়ের প্রক্রিয়াধীন – ৬
৩। ‘জনবল হ্রাস ও সুষমকরণ’
ছাঁটাই লক্ষমাত্রা (ডিসেম্বর ২০০৭) – ১৪, ০০০
বন্ধ পাটকলে – ৬,৩৭৩
চালু পাটকল -৭,৬২৭
৪। শ্রমিক সম্পর্কিত অন্যান্য-
— শ্রমিক নিয়োগে ‘আউটসোর্সিং’ অর্থাৎ প্রয়োজন অনুসারে শূন্যপদে দৈনিক ভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ
— মজুরি খাতে ব্যয় হ্রাস
(সূত্র: বিজেএমসি)
পাট বিষয়ক এরকম উন্নয়ন কর্মসূচি বাংলাদেশে এটাই প্রথম নয়। আমরা ক্রমে দেখবো এধরনের উন্নয়ন কর্মসূচি চলছে কয়েক দশক ধরে, জোরদার হয়েছে ১৯৯৪ থেকে। এসবেরই ফলাফল বর্তমান ধস।
২০০২ সালের পাটনীতি
২০০২ সালে এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী বন্ধ হয় এবং সে বছরই ঘোষিত হয় ‘বাংলাদেশের পাটনীতি’। এই পাটনীতি শুরুই হয়েছে এই বলে যে, ‘বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ‘সোনালী আঁশ’ আজ গভীর সংকটে নিপতিত। একদিকে বিশ্ববাজারে পাট ও পাট পণ্যের চাহিদা ও মূল্য হ্রাস অপরদিকে পাট ও পাটপণ্যের ক্রমবর্ধমান উৎপাদন ব্যয়ের প্রভাবে পাট ও পাটশিল্পের অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন। পাটশিল্পে লোকসানের পরিমাণ দিন-দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে যা দেশের সার্বিক অর্থনীতির উপর এক বিরূপ প্রভাব ফেলছে। অথচ পাটের সঙ্গে সম্পৃক্ত কৃষক-শ্রমিকসহ এক বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থে পাটখাতের এ অবস্থার উত্তরণ একান্ত আবশ্যক।’
এতে আরও স্বীকার করা হয়েছে যে, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান, দারিদ্র বিমোচন ও রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে পাটখাতের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মোট চাষে ৩০-৩৫ লক্ষ কৃষক, পাটশিল্পে দুই থেকে আড়াই লক্ষ শ্রমিক-কর্মচারী, পাট বাণিজ্যে প্রায় এক লক্ষ ব্যবসায়ী এবং পরিবহণ ও অন্যান্য সেবার কাজে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক নিয়োজিত রয়েছে। পূর্বে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বৃহত্তম অংশ অর্জিত হত পাটখাত থেকে।’
সেই পাটনীতিতেই বলা হয়েছে: ‘এখন পর্যন্ত বিভিন্ন গবেষণা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সহায়তায় যেসব পণ্য উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে –
ক) নিম্নমানের পাট ও কাঁচাপাট ব্যবহার করে কাগজ তৈরির পাম্প।
খ) পাটের কম্বল।
গ) কাপড় তৈরির লক্ষ্যে তুলা ও পাটের সংমিশ্রণে মিহি সুতা।
ঘ) ঘরের দরজা-জানালা ফ্রেম তৈরির লক্ষ্যে কাঠের বিকল্প সামগ্রী।
ঙ) ঘরের ছাদে ব্যবহারের জন্য সি আই সিট এর বিকল্প হিসেবে পাট মিশ্রিত করোগেটেড সিট।
চ) ঘরের অন্যান্য দ্রব্যসহ আসবাবপত্র তৈরির জন্য জুটো-প্লাসটিক সামগ্রী।
ছ) মোটর গাড়ির বডি ও অভান্তরের বিভিন্ন অংশ
জ) নদী ও রাস্তার ভাঙ্গন রোধকল্পে জুট জিও-টেক্সটাইল।
ঝ) রেফ্রিজারেটরের বডি।
ঞ) বিভিন্ন প্রকার ডেকোরেটিভ সামগ্রী।
ট) পাটের তৈরি বিভিন্ন প্রকারের কাপড়।’
সোনালি আঁশ পাট আর পাটশিল্পের এই যখন গুরুত্ব তখন এর সংকট কীভাবে এত গভীর হল? এর কারণ কোথায়? এটা কি পাট বা পাটশিল্পের নিয়তি, উন্নয়নের অপরিহার্য বলি, উন্নয়নের যাত্রায় অসঙ্গতিপূর্ণ প্রাচীন ঐতিহ্য? পাটনীতি ঘোষণার পর কী কী উদ্যোগ নেয়া হল?ফলাফল কী? বিশ্লেষণে আমরা অবাক বিস্ময়ের সঙ্গে দেখবো কীভাবে এরকম এক বিশাল সম্ভাবনার খাতকে খুবই সংগঠিত কার্যক্রমের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ পাটভূমি কেন?
পাট ও পাটশিল্পে বাংলাদেশের তুলনামূলক সুবিধার ক্ষেত্র বহুবিধ। আবার এর গুরুত্ব এই দেশের একটি শক্ত মাজা দাঁড় করানোর জন্যও অপরিহার্য। তুলনামূলক সুবিধার দিকগুলো সংক্ষেপে নিম্নরূপে বলা যায়:
- উৎকৃষ্ট মানের পাট উৎপাদনের উপযোগী মাটি ও প্রাকৃতিক পরিবেশ;
- ৫ দশকে গড়ে উঠা অভিজ্ঞ ও দক্ষ শ্রমশক্তি;
- আন্তর্জাতিক বাজারে পাটজাত দ্রব্যের প্রতি আগ্রহ, পাটজাত দ্রব্যের ব্যবহার বৃদ্ধি। অভ্যন্তরীণ বাজারেও এর বিস্তারের অসীম সম্ভাবনা;
- পরিবেশ অনুকূল হওয়ায় এর প্রবৃদ্ধির সামাজিক ও পরিবেশগত ব্যয় শূণ্য;
- পাট রপ্তানিতে বিদেশি মুদ্রা আসে শতকরা ১০০ ভাগ যেখানে গার্মেন্টস এ তা ৪০ ভাগ; চিংড়ি মাছে যা পরিবেশ ও সামাজিক উচ্চ ক্ষতির কারণ;
- পাট একসঙ্গে কৃষি ও শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকায় দুই খাতের বিকাশই এর উপর নির্ভরশীল;
- পাট ও পাটজাত দ্রব্য দুইক্ষেত্রেই বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ;
- পাট বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয় ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত।
এতগুলো অনুকল উপাদান থাকবার পরও এই শিল্প যে এখন ‘গভীর সংকটে পতিত’ এবং বিলুপ্তির পথে তার কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে রাষ্ট্রীয় নীতির ব্যাকরণ দেখতে হবে।
কীভাবে গড়ে উঠলো এই শিল্প?
বর্তমান বিশ্বে প্রধান পাট উৎপাদনকারী দেশ বাংলাদেশ, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, মায়ানমার। বাংলাদেশ এখনও উৎকৃষ্ট পাট উৎপাদনের ভূমি এবং বৃহত্তম কাঁচাপাট রপ্তানিকারক। হাতে বোনা পাটতন্তু বাংলা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হতো অষ্টাদশ শতাব্দীতেই। ডান্ডি কেন্দ্র করে পাটশিল্প গড়ে উঠতে শুরু করে ১৮৩৩ সাল থেকে। প্রথম ভারতীয় পাটকল নির্মিত হয় ১৮৫৫ সালে, কলকাতায়। ১৯০০ সালের মধ্যে কলকাতাকেন্দ্রিক পাটশিল্প ইউরোপীয় পাটশিল্প ছাড়িয়ে যায়। বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল প্রথম পাট ব্যবসায়ী কোম্পানি। একচেটিয়াভাবেই তারা দীর্ঘদিন ব্যবসা করে।
১৯৪৭-র পর ভারতে প্রতিষ্ঠিত পাটশিল্প বৃটিশদের থেকে মারওয়ারিদের হাতে আসে। পূর্ব বাংলা থেকে তখন কাঁচা পাট পশ্চিমবঙ্গে যেতো। একপর্যায়ে তা বন্ধ হয়ে গেলে ভারতে পাট উৎপাদন শুরু হয়। ভারত এখন বৃহত্তম পাট উৎপাদক। ভারতের বৃহৎ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান টাটা বিড়লার ব্যবসাও শুরু হয় পাট দিয়ে। মিত্তাল গ্রুপেরও পাট ব্যবসা ছিল অন্যতম। ১৯৫০ দশকে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ও সমর্থনে পাটশিল্প প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। আদমজী বাওয়ানিসহ বিভিন্ন বৃহৎ ব্যবসায়িক গ্রুপ অল্প ইক্যুয়িটি দিয়ে ক্রমে এসব শিল্পের মালিকানা লাভ করে। এরপরও এসব মিল কারখানা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুবিধা ও ভর্তুকি পাবার কারণেই অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকে ও বিকশিত হয়। ৬০ দশকে বাংলাদেশের পাট ছিল বৈষম্য ও নিপীড়নবিরোধী রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয়। পুরো পাকিস্তানের রফতানি আয়ের প্রধান উৎস ছিল পাট কিন্তু এই বৈদেশিক মুদ্রার অধিকাংশ ব্যয় হতো তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে। স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম স্বপ্ন ছিল এই পাটকে ঘিরে যে, এই পাট বাংলাদেশের মানুষেরই কাজে লাগবে। কিন্তু তা যে হয়নি তা আজকের নিশ্চিহ্ন বা বিধ্বস্ত পাটকলগুলোর এলাকা আর ততোধিক বিধ্বস্ত মানুষদের দেখলে বুঝতে কারও সময় লাগে না।
যখন পাটশিল্প আরও বিকশিত হবার কথা
বাংলাদেশে স্বাধীনতা লাভের পর ২৬ মার্চ ১৯৭২ এক অধ্যাদেশ বলে পরিত্যক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। পাটকলগুলোর সামগ্রিক তত্ত্বাবধানের জন্য গঠন করা হয় বাংলাদেশ পাটকল সংস্থা। সেসময় এর অধীনে ৭৭টি জুট মিল ছিল। ১৯৮২-৮৩ থেকে বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু হয়, প্রথম দফায় ৩৫ টি জুট মিল তাদের আগের মালিকদের হাতে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এই মুহূর্তে সরকারের হাতে আছে মাত্র ২৮টি পাটকল। এই হল যাত্রাপথের ক্রমঅবনতিশীল রেখা।
পাটকলসহ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রায়ত্তকরণ খুব সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত ছিল না। ব্যবস্থাপনা ছিল দুর্বল। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমে নতুন ধনিক শ্রেণি গড়ে উঠার একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। এরই বহিপ্রকাশ ঘটে পাটশিল্প সম্পর্কে সরকারি চরম অবহেলা, কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করা, সরকারি দলের প্রভাববলয় সৃষ্টির কাজে পাটশ্রমিকদের ব্যবহার, মিলগুলোতে ট্রেড ইউনিয়নের নামে সরকারি মাস্তান বাহিনী তৈরির মধ্যে।
পাটকলে লোকসানের কারণ
‘পাট খাতের সমস্যা’ হিসেবে ২০০২ সালের পাটনীতিতে যেগুলো বলা হয়েছে তা নিম্নরূপঃ
- ‘বিশ্ববাজারে কৃত্রিম আঁশ ও পণ্যের সহিত পাট ও পাটপণ্যের তীব্র প্রতিযোগিতা এবং বাল্ব হ্যান্ডলিং বিশ্ববাজারে প্রচলন বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রমশই পাট ও পাটপণ্যের চাহিদা ও মূল্য হ্রাস।
- বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও ঘাটতিজনিত কারণে প্রায় ১০ শতাংশ উৎপাদন ক্ষতি।
- পুরাতন মেশিন ও যন্ত্রাংশ পরিবর্তন না করায় উৎপাদনশীলতা হ্রাস।
- সরকারি পাটকলগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত শ্রমিক কর্মচারী থাকায় এবং শ্রমিকরা কাজে অনুপস্থিত থাকায়, অবহেলা ও ফাঁকি দেওয়ায় এবং শ্রমিক-কর্মচারী/কর্মকর্তাদের সময় সময় মজুরি/বেতন বৃদ্ধি করা।
- ব্যাংক ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি করায় পাটপণ্যের উৎপাদন ব্যয় ক্রমশ বৃদ্ধি। পাটকলগুলোর লোকসান দিনদিন বৃদ্ধি প্রাপ্তি।’
লক্ষণীয় যে, এখানে শ্রমিকদের উপর দায় চাপানোর আগ্রহটা বেশ যার সমর্থনে কোথাও কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। এগুলো ক্রমান্বয়ে বলে বলে আসল দায়দায়িত্ব যাদের সেই নীতিনির্ধারকদেরই রক্ষা করবার চেষ্টা করা হয়েছে। অথচ পাট মন্ত্রনালয়েরই সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে গত বছরের লোকসান ৪২১ কোটি টাকার মধ্যে মাত্র ৩০ কোটি টাকা, তাদের ভাষায়, শ্রমিক আন্দোলন থেকে সৃষ্ট। সর্ববৃহৎ হচ্ছে পাটক্রয়ে বরাদ্দ যথাসময়ে না পাওয়ার কারণে ১৪০ কোটি টাকা এবং এছাড়া বিদ্যুৎ না থাকা ও অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় এর কারণে ১৩০ কোটি টাকা। এছাড়া রফতানিমুখী খাত হিসেবে অন্যান্য শিল্প যেসব সুবিধা পায় সেগুলো থেকে পাটশিল্প বিশেষত রাষ্ট্রায়ত্ত পাটশিল্প বঞ্চিত থাকে। এমনকি এই শিল্প পাকিস্তান আমলে যেরকম সুবিধা বা সমর্থন পেয়ে এসেছে সেগুলোও আর অব্যাহত রাখা হয়নি।
স্বাধীনতার পর থেকে পাটকলে কমবেশি যে লোকসান বাড়তেই থাকে তার পেছনে কয়েকটি কারণ তাই সুনির্দিষ্ট করা যায় এভাবে:
- পাকিস্তান আমলে পাটশিল্পের জন্য যেসব সুবিধা ও ভর্তুকি ছিল সেগুলো অব্যাহত না রাখা।
- যথাসময়ে পাট ক্রয়ের বরাদ্দ না দেয়ায় বিলম্বে দুই বা তিনগুণ বেশি দামে পাট ক্রয়।
- মেশিনপত্র কোনোরকম নবায়ন না করা।
- বিদ্যুতের সংকট সমাধানে এমনকি বিকল্প জেনারেটর ব্যবহারেও উদ্যোগ না নেয়া।
- দেশের মধ্যে পাটজাত দ্রব্য ব্যবহার বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ না নেয়া।
- আন্তর্জাতিকভাবে পাটজাত দ্রব্যের নতুন চাহিদা তৈরি না করা, বিদ্যমান চাহিদার বাজার ধরবার উদ্যোগ না নেয়া।
- ব্যাংকঋণ এবং চক্রবৃদ্ধি সুদের চাপ বৃদ্ধি।
- সরকারি দলের কাজে শ্রমিকদের কর্মসময় ব্যবহার করা।
- সরকারি দলের প্রভাববৃদ্ধির জন্য শ্রমিক নেতার নামে সন্ত্রাসীদের লালন পালন। এবং
- মন্ত্রণালয় থেকে বিজেএমসি এবং মিল ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতিবাজদের অবস্থান।
স্বাধীনতার পর থেকে পাটকলে কমবেশি যে লোকসান বাড়তেই থাকে তার পেছনে কয়েকটি কারণ তাই সুনির্দিষ্ট করা যায় এভাবে:
- পাকিস্তান আমলে পাটশিল্পের জন্য যেসব সুবিধা ও ভর্তুকি ছিল সেগুলো অব্যাহত না রাখা।
- যথাসময়ে পাট ক্রয়ের বরাদ্দ না দেয়ায় বিলম্বে দুই বা তিনগুণ বেশি দামে পাট ক্রয়।
- মেশিনপত্র কোনোরকম নবায়ন না করা।
- বিদ্যুতের সংকট সমাধানে এমনকি বিকল্প জেনারেটর ব্যবহারেও উদ্যোগ না নেয়া।
- দেশের মধ্যে পাটজাত দ্রব্য ব্যবহার বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ না নেয়া।
- আন্তর্জাতিকভাবে পাটজাত দ্রব্যের নতুন চাহিদা তৈরি না করা, বিদ্যমান চাহিদার বাজার ধরবার উদ্যোগ না নেয়া।
- ব্যাংকঋণ এবং চক্রবৃদ্ধি সুদের চাপ বৃদ্ধি।
- সরকারি দলের কাজে শ্রমিকদের কর্মসময় ব্যবহার করা।
- সরকারি দলের প্রভাববৃদ্ধির জন্য শ্রমিক নেতার নামে সন্ত্রাসীদের লালন পালন। এবং
- মন্ত্রণালয় থেকে বিজেএমসি এবং মিল ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতিবাজদের অবস্থান।
স্বাধীনতার পর থেকে এরমধ্যে আমরা অনেকরকম সরকার দেখেছি, তাদের মধ্যে নানা বিষয়ে তুমুল বিরোধ থাকলেও যেসব বিষয়ে তাদের ভূমিকা অভিন্ন ছিল তার মধ্যে এগুলো অন্যতম। ক্রমবর্ধমান লোকসানের এই কারণগুলোর কোনো পরিবর্তন হয়নি। এব্যাপারে কোনো উদ্যোগ না নিয়ে লোকসানের অপরাধে পুরো শিল্প খাতের উপর নতুনভাবে আক্রমণ শুরু হয় ৮০ দশকের প্রথম থেকে। তখন কাঠামোগত কর্মসূচির আওতায় পুরো বাংলাদেশ। পাটখাতকে রাহুর হাত থেকে রক্ষার জন্য তাই উপরের বিষয়গুলোতে কোনো উদ্যোগ না নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বৈশ্বিক কৌশলের শিকারে পরিণত করা হয় পুরো খাতকে।
উন্নয়নের নামে ধ্বংসের কর্মসুচি
৯০ দশকের শুরুতে যখন দুর্নীতি, লুণ্ঠন আর সরকারের বৈরীনীতির কারণে পাটশিল্পের জীর্ণদশা তখন বিশ্বব্যাংকগোষ্ঠী আনুষ্ঠানিকভাবে মাঠে প্রবেশ করে, যথারীতি, ত্রাতা হিসেবে। পাটখাতে সংস্কার কর্মসূচির কথা বলে প্রথমে দুটো সমীক্ষা চালানো হয়। ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারি ও সেপ্টেম্বরে পরিচালিত এই সমীক্ষা দুটির একটি হল ইইসির অর্থসংস্থানে ‘দ্য জুট ম্যানুফ্যাকচারিং স্টাডি’ এবং আরেকটি হল বিশ্বব্যাংকের আইডিএ-র অর্থসংস্থানে সমীক্ষা ‘বাংলাদেশ-রিস্ট্রাকচারিং অপশনস ফর দ্য জুট ম্যানুফেকচারিং ইন্ডাস্ট্রি’। উল্লেখ্য যে, এসব সমীক্ষা সুপারিশে সরকারকে দেখা হয়েছে নিছক বাস্তবায়নের সংস্থা হিসেবে, নীতি নির্ধারক হিসেবে নয়।
১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারি ও সেপ্টেম্বরে পরিচালিত এই সমীক্ষা দুটির একটি হল ইইসির অর্থসংস্থানে ‘দ্য জুট ম্যানুফ্যাকচারিং স্টাডি’ এবং আরেকটি হল বিশ্বব্যাংকের আইডিএ-র অর্থসংস্থানে সমীক্ষা ‘বাংলাদেশ-রিস্ট্রাকচারিং অপশনস ফর দ্য জুট ম্যানুফেকচারিং ইন্ডাস্ট্রি’।
বলা দরকার যে, এরকম সমীক্ষা করে নিজেদের পছন্দসই পথ ও পদ্ধতিকে বৈধতা দেয়া এবং তার মাধ্যমে যে কোনো খাতে রাহুগ্রাস, এটাই বিশ্বব্যাংকগোষ্ঠীর কাজের ধরন। বাংলাদেশে অনেক খাতেই আমরা একইরকম ঘটনা দেখেছি। পাটখাতে তাই এসব সমীক্ষার ধারাবাহিকতাতেই ১৯৯৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জুট সেক্টর এডজাস্টমেন্ট ক্রেডিট এর আওতায় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি হয়। এতে ঋণ প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় ২৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর সময়কালেই প্রাইভেটাইজেশন বোর্ড গঠিত হয়। এর মধ্য দিয়েই শুরু হল পাটখাতের উপর সংগঠিত আক্রমণ।
চুক্তিতে যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেগুলো হল:
১। নয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত মিল বন্ধ ও দুটো সংকুচিত করে পুরো শিল্প সংকোচন করা;
২। ২০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করে ‘র্যাশনালাইজ’ করা;
৩। ১৯টি মিল বেসরকারিকরণ করা; এবং
৪। মজুরি বাড়ানো বন্ধ রাখা এবং মজুরির অনুপাত কমানো।
১৯৯৬ সালের আগষ্ট মাসে বিশ্বব্যাংক অবিলম্বে ৫টি মিল বন্ধ, একটি সংকুচিত করা এবং ২৭০০ লুম বন্ধ করার জন্য জোর দেয়। বলা হয় ১৯৯৬ এর শরতের মধ্যে অবশ্যই ৩টি মিল বন্ধ করতে হবে।
বিভিন্ন কিস্তি পরিশোধের সময় পাটকল বন্ধ ও শ্রমিক ছাঁটাইএর এর নতুন নতুন সীমা দেয়া হয়। প্রথম কিস্তি – চারটি মিল বন্ধ, ১২ হাজার ছাটাই। দ্বিতীয় কিস্তি – পাঁচটি মিল বন্ধ, নয়টি মিল বেসরকারিকরণ, ৮ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই, তৃতীয় কিস্তি – নয়টি মিল বেসরকারিকরণ।
এই ধারাতেই ক্রমে আদমজী বন্ধ হয়েছে। পাটশিল্পে লোকসানের সব কারণগুলো অব্যাহত রেখে যেন সযত্নে রুগ্ন অবস্থা বাড়ানো হয়েছে। একপর্যায়ে মজুরি দেয়া বন্ধ, লে অফ ঘোষণা, হুমকি ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে এখন তারই ধারাবাহিকতা চলছে।
বিভিন্ন কিস্তি পরিশোধের সময় পাটকল বন্ধ ও শ্রমিক ছাঁটাইএর এর নতুন নতুন সীমা দেয়া হয়। প্রথম কিস্তি – চারটি মিল বন্ধ, ১২ হাজার ছাটাই। দ্বিতীয় কিস্তি – পাঁচটি মিল বন্ধ, নয়টি মিল বেসরকারিকরণ, ৮ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই, তৃতীয় কিস্তি – নয়টি মিল বেসরকারিকরণ।
এই ধারাতেই ক্রমে আদমজী বন্ধ হয়েছে। পাটশিল্পে লোকসানের সব কারণগুলো অব্যাহত রেখে যেন সযত্নে রুগ্ন অবস্থা বাড়ানো হয়েছে। একপর্যায়ে মজুরি দেয়া বন্ধ, লে অফ ঘোষণা, হুমকি ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে এখন তারই ধারাবাহিকতা চলছে।
বিশ্বব্যাংকের সেই সংস্কার কর্মসূচিতে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল যে, সংস্কার শেষ হতে হতেই পুরো খাত ব্যক্তিমালিকানাধীনে চলে যাবে। বলা হয়েছিল, এসবের মধ্য দিয়ে উৎপাদনশীলতা বাড়বে, কর্মসংস্থান বাড়বে এবং এই খাতের উন্নয়ন ঘটবে। নিচের ছকে ২০০৫ পর্যন্ত এর একটি চিত্র পাওয়া যাচ্ছে।
চিত্র ২: স্থাপিত ও ব্যবহৃত তাঁত | ||
রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিমালিকানাধীন | ||
সময়কাল | স্থাপিত | ব্যবহৃত |
১৯৮০-৮১ | ২৫৭৯১ | ২৩৭৫৯ |
১৯৯৩-৯৪ | ২৬০৪৭ | ১৭৬৯১ |
২০০৪-০৫ | ২১৩৩২ | ৮৯১৫ |
প্রতিষ্ঠান | ||
রাষ্ট্রায়ত্ত | ১০৭৩৪ | ৫৯৪৩ |
ব্যক্তিমালিকানাধীন | ১০৫৯৮ | ২৯৭২ |
পাটনীতি: সরকারের সক্রিয়তা ও নিষ্ক্রিয়তা
পাটনীতিতে পাটখাত নিয়ে যেসব কর্মসূচি ছিল সেগুলো নিয়ে বাংলাদেশ সরকার কী করলো সেটা একটা দেখার বিষয়। নীতির সব অংশের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গী ও মনোযোগ একরকম ছিল না। সেটাই তাৎপর্যপূর্ণ। পাটনীতিতে সেসময় বলা হল, ‘বর্তমানে রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে পাট ও পাটপণ্য তৃতীয় বৃহত্তম অবস্থানে রয়েছে। সাম্প্রতিক বৎসরগুলোতে পাট ও পাটপণ্য রপ্তানি করে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮-১২% অর্জিত হচ্ছে।’ এই নীতি ঘোষণার কয়েকবছরের মধ্যে এই অনুপাত শতকরা ৪ এ নেমে আসে।
পাটনীতি ঘোষণাকালে মোট ১২৯টি পাটকল ছিল। এর মধ্যে সরকারি খাতে ৩৫টি এবং বেসরকারি খাতে ৯৪টি পাটকল (স্পিনিং মিলসহ) ছিল। পাটনীতিতে বলা হচ্ছে, ‘সরকারি খাতের মিলগুলোর মধ্যে ৫টি ও বেসরকারি খাতের মিলগুলোতে স্থাপিত তাঁতের মধ্যে ৭১% তাঁত চালু রয়েছে এবং বেসরকারি খাতের কম্পোজিট মিলগুলোর মধ্যে মাত্র ২৮% তাঁত চালু রয়েছে। বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স এসোসিয়েশনের আওতাধীন মিলগুলোর স্থাপিত স্পিন্ডেল এর ৬৯% চালু রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি খাতের কম্পোজিট মিলগুলোর উৎপাদনশীলতা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে।’ এরপর অবস্থার অবনতি ছাড়া কোনো উন্নতি আর হয়নি।
পাটনীতিতে বলা হয়েছে, ‘বিশ্বের অন্যান্য পাটপণ্য উৎপাদনকারী দেশসমূহের তুলনায় এদেশের পাটকলগুলোর উৎপাদনশীলতা অনেক কম, কারণ অন্যান্য পাটপণ্য উৎপাদনকারী দেশ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে এবং উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছে, সেখানে এদেশের পাটশিল্প পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে স্থাপিত মেশিনারি দ্বারা উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। উল্লেখ্য যে, স্বাধীনতার পর সুদীর্ঘ কাল অতিবাহিত হলেও পাটকলগুলোর যন্ত্রপাতি সুষমকরণ, আধুনিকীকরণ ও প্রতিস্থাপনের জন্য এ পর্যন্ত কোনো দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়নি । ফলে পাটকলগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা সর্বনিম্ন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এতে উৎপাদন ব্যয় ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থার উন্নতিকল্পে পাটশিল্পের যন্ত্রপাতির সুষমকরণ, আধুনিকীকরণ ও প্রতিস্থাপন কার্যক্রম গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে।’ কিন্তু এরপর এই ব্যাপারে কোনো উদ্যোগই দেখা যায়নি।
চিত্র ৩: পাটনীতি ২০০২ ও বর্তমান সংস্কার (২০০৭)
কর্মসূচি | পাটনীতি ২০০২ | ২০০২ থেকে বর্তমান পর্যন্ত সরকারের ভূমিকা | বর্তমান কর্মসূচি |
মেশিনপত্র নবায়ন | উল্লেখ ছিল | কিছু করা হয়নি | উল্লেখ নেই |
অভ্যন্তরীণ ও আন্তজার্তিক বাজার বিস্তার | উল্লেখ ছিল | কিছু করা হয়নি | উল্লেখ আছে |
বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান | উল্লেখ ছিল | কিছু করা হয়নি | উল্লেখ আছে |
পাটক্রয়ে সময়মতো বরাদ্দ | উল্লেখ ছিল | কিছু করা হয়নি | উল্লেখ আছে |
বেসরকারিকরণ ও বন্ধকরণ | উল্লেখ ছিল | সক্রিয়ভাবে করা হয়েছে | সক্রিয়ভাবে করা হচ্ছে |
পাটনীতিতে স্বীকার করা হয়েছে, ‘দেশে সিমেন্ট প্যাকিং এর জন্য পিপি ব্যাগ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানী করা হচ্ছে এবং এ ধরনের ব্যাগ দেশেই উৎপাদন করা হচ্ছে।পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এ ধরনের ব্যাগের স্থানীয় উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ করে তার পরিবর্তে পাটের ব্যাগ ব্যবহারকরা গেলে এক লক্ষ মেট্রিন টনেরও বেশি পাটপণ্য ব্যবহৃত হতে পারে।’ কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
বলা হয়েছে, ‘সমীক্ষার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাজারে পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা নিরূপণ করে পাটজাত দ্রব্যের বিক্রয় বৃদ্ধি প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হবে। সরকারি আধাসরকারি ও বেসরকারি দপ্তর ও সংস্থাসমূহে পাটপণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে যথাযথ কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। পাটজাত দ্রব্য/পণ্যের বিকল্প কৃত্রিম পণ্য উৎপাদনের জন্য নতুন শিল্প স্থাপন নিষিদ্ধ করতে সরকারকে উৎসাহিত করা হবে। পাটজাত দ্রব্যের বিকল্প কৃত্রিম পণ্য আমদানী/ব্যবহার হ্রাসের জন্য জনগণকে উদ্ভুদ্ধ করা হবে।’ করা হয়নি।
বলা হয়েছে, ‘পাট ও পাটজাত দ্রব্যের আন্তর্জাতিক বাজার সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিদেশে প্রতিনিধিদল প্রেরণ, আন্তর্জাতিক মেলায় অংশ গ্রহণ, সভা-সেমিনারের আয়োজন করা এবং ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন করা।’ বিদেশ সফর, বিভিন্ন দূতাবাসে ব্যয়বহুল অফিস খোলা হয়েছে কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।
‘সরকার কর্তৃক ঘোষিত আমদানীনীতি, রপ্তানি নীতি ও শিল্পনীতিতে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয় পাট ও পাটশিল্পের ক্ষেত্রেও যাতে অনুরূপ সুযোগ-সুবিধা সমভাবে প্রযোজ্য হয় সে লক্ষ্যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।’ হয়নি।
‘বর্তমানেরপাটকলগুলোতে স্থাপিত তাঁতের সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার । তম্মধ্যে বর্তমানে চালু রয়েছে ১৪ হাজারের কিছু বেশি।’ এরপর তা কমে হয়েছে ৮ হাজার।
‘পাটকলগুলোতে বিদ্যুৎ ঘাটতি ও বিভ্রাটের ফলে ২০০০-২০০১ সালে প্রায় ০.২৭ লক্ষ মেঃ টন উৎপাদন ক্ষতি হয় যার জন্য ঐ বছর সংস্থাটির অতিরিক্ত লোকসান হয়েছে ৪৩.৬৫ কোটি টাকা। এ পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষ্যে সরকারি এবং বেসরকারি পাটকলগুলোতে নিজস্ব জেনারেটর স্থাপনের উদ্যোগ উৎসাহিত করা।’ হয়নি।
বলা হয়েছে, ‘দেশে উৎপাদিত মোট প্রচলিত পাটপণ্যের শতকরা প্রায় ৫০ ভাগই উৎপন্ন করে থাকে বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশন। সংস্থাটি উহার উৎপাদিত পণ্যের প্রায় ৮০-৮৫% রপ্তানি করে থাকে। বাংলাদেশে উৎপাদিত কাঁচা পাটের প্রায় ৩০% বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের অধীনস্ত মিলসমূহ ক্রয় করে থাকে।’ নীতিতেই আবার একই সঙ্গে বলা হচ্ছে, ‘বাংলাদেশে পাটশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে বেসরকারি খাতের কোনো বিকল্প নেই।’
বলা হয়েছে, ‘সরকার শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণ করে পাটকলগুলো বিক্রয় করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এ দায়িত্ব প্রাইভেটাইজেশন কমিশনকে দেয়া হয়েছে। প্রয়োজনবোধে বেসরকারিকরণ নীতি ও পদ্ধতি আরও বাস্তবধর্মী করা।’ কিন্তু শ্রমিক স্বার্থকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে সম্পদ ব্যক্তির হাতে স্থানান্তরে সরকারের কার্যকর ভূমিকা দেখা যায়। পাটনীতিতে আরও বলা হয়, ‘যে সমস্ত পাটকলগুলো কোনোক্রমেই বিক্রয় করা সম্ভব হবে না ঐ সকল পাটকলের ক্ষেত্রে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।’ এর অর্থ হতে পারে একটাই সেটা হল বন্ধ ঘোষণা করা। সেটা ব্যাপকভাবেই হচ্ছে। এই একটি জায়গাতেই সব সরকারকে ধারাবাহিক ভাবে সক্রিয় দেখা গেছে। বর্তমান সরকারের কথিত ‘দুর্নীতিবিরোধী’ অভিযানেও পাটশিল্পের দুর্নীতি দূর করবার কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে এর শিকার শ্রমিকদের উপরই আক্রমণ জোরদার করা হয়েছে। উপরের ছকে আমরা দেখছি বর্তমান ‘দুর্নীতিবিরোধী’ সরকারের পাটশিল্প বিষয়ক নীতিমালা আগের দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারগুলোরই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে।
বর্তমান সরকারের কথিত ‘দুর্নীতিবিরোধী’ অভিযানেও পাটশিল্পের দুর্নীতি দূর করবার কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে এর শিকার শ্রমিকদের উপরই আক্রমণ জোরদার করা হয়েছে। উপরের ছকে আমরা দেখছি বর্তমান ‘দুর্নীতিবিরোধী’ সরকারের পাটশিল্প বিষয়ক নীতিমালা আগের দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারগুলোরই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে।
এসব নীতিমালা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পাটখাতে কী দাঁড়াচ্ছে তার একটি দশকওয়ারি চিত্র নিচে দেয়া হল।
চিত্র ৪: পাটশিল্পের বিনাশ বৃত্ত?
৫০ দশকের পূর্বে | : কাঁচাপাট উৎপাদন ও কলকাতাকেন্দ্রিক শিল্পে যোগান |
৫০ দশকে | : উৎকৃষ্ট মানের পাটের প্রাপ্যতার কারণে রাষ্ট্রীয় সমর্থন ও ভর্তুকিতে পাটশিল্প প্রতিষ্ঠা : কোরীয় যুদ্ধের কারণে পাটজাত দ্রব্যের আন্তর্জাতিক চাহিদা বৃদ্ধি ও বাজার প্রাপ্তি |
৬০ দশকে | : রাষ্ট্রীয় সমর্থন ও ভর্তুকিতে শিল্পের প্রসার। : বোনাস ভাউচার স্কীমের কার্যকর ভূমিকা। : পাট ও পাটজাত দ্রব্য রফতানি পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠা। |
৭০ দশকে | :পরিত্যক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয়করণ কর্মসূচির অধীনে পাটকলও রাষ্ট্রীয়করণ। বিজেএমসি প্রতিষ্ঠা। পরিকল্পনা ও মনোযোগের অভাব, দুর্বল ব্যবস্থাপনা। দুর্নীতির মাধ্যমে নব্য ধনিক শ্রেণির গঠনকাল, শিকার- রাষ্ট্রায়ত্ত খাত। : পাটশিল্পে রাষ্ট্রীয় সমর্থন ও ভর্তুকির পুরনো নিয়ম প্রত্যাহার। : নতুন মাত্রায় লোকসান শুরু। |
৮০ দশকে | : বিশ্বব্যাংকগোষ্ঠীর কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচি। পরিকল্পিতভাবে বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু। : পাটকল শ্রমিকদের সরকারি দলের জমায়েতে ব্যবহার। : শ্রমিক নেতা নামে সরকারি দলের সন্ত্রাসীদের আধিপত্য। : পাটক্রয়ে সময়মতো বরাদ্দ না দেয়ার রীতি শুরু। : লোকসান বৃদ্ধি। |
৯০ দশকে | : পাটখাত উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের ১৭০০ কোটি টাকা ঋণ। : শর্ত অনুযায়ী পাটকল বন্ধ, বিরাষ্ট্রীয়করণ, তাঁতের সংখ্যা হ্রাস, শ্রমিক ছাঁটাই শুরু। : বিদ্যুৎ সমস্যা, পাটকল ক্রয়ে বরাদ্দ না দেয়া অব্যাহত। : রাষ্ট্রায়ত্ত পাটশিল্প অধিকতর সংকোচন। : লোকসান বৃদ্ধি। |
২০০০ পরবর্তী সময়ে | : সরকার কর্তৃক বিশ্বের বৃহত্তম পাটকল বন্ধ ঘোষণা (২০০২)। বিশ্বব্যাংক, মার্কিন দূতাবাস ও বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর অভিনন্দন। : পাটনীতি ঘোষণা (২০০২)। : সময়মতো পাটক্রয় বরাদ্দে অর্থ প্রদান না করা অব্যাহত। : পাটজাত দ্রব্যের রফতানি অনুপাত হ্রাস। : দিনমজুরিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ করে বেসরকারি পাটকল প্রতিষ্ঠা। : ভারতে পাটনীতি (২০০৫)। পাটশিল্পের নতুন বিকাশ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন। : শ্রমিক ছাঁটাই ও পাটকল বন্ধের নতুন কর্মসূচি শুরু (২০০৭)। |
২০০৭ পরবর্তী সময়ে | পাটশিল্পে বৈরী নীতি অব্যাহত। কাঁচাপাট রপ্তানির অবস্থায় প্রত্যাবর্তন? |
ভারতের পাটশিল্প
৮০ দশকের গোড়াতেই ভারতে দুর্বল পাটকলগুলোকে চাঙ্গা করবার জন্য দ্য জুট কোম্পানিজ (ন্যাশনালইজেশন) এ্যাক্ট, ১৯৮০ প্রবর্তন করা হয়। ভারতে শুধু পাটশিল্প নয়, শিল্প রক্ষা ও বিকাশের জন্য এখানে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই নীতিতেই ভারতের জাতীয় পাটনীতি ঘোষিত হয় ২০০৫ সালের শেষে। এই নীতিতে ৩৫ বছরের ভারতীয় পাট সংস্থার পুনবির্ন্যাস করা হয়। একই সালে সমগ্র বকেয়া ঋণ (১৯৫.৬৮ কোটি রূপি), সুদ (৩১৭.৯৭ কোটি রূপি) মওকুফ করা হয়। ভর্তুকি ৩০১.৮৮ কোটি রূপি অব্যাহত থাকে।
ভারতের জাতীয় পাটনীতি ঘোষিত হয় ২০০৫ সালের শেষে। এই নীতিতে ৩৫ বছরের ভারতীয় পাট সংস্থার পুনবির্ন্যাস করা হয়। একই সালে সমগ্র বকেয়া ঋণ (১৯৫.৬৮ কোটি রূপি), সুদ (৩১৭.৯৭ কোটি রূপি) মওকুফ করা হয়।
২০০২ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশে আদমজী পাটকল বন্ধের মধ্য দিয়ে পাটশিল্পের ধস পরিস্কার হয়। অন্যদিকে তার ৮ দিন পর ভারতীয় পাটশিল্পে আধুনিকরণের নতুন যাত্রা শুরু হয়। এই দিন থেকে নতুনভাবে কর্মসূচি নেয়া হয় যে, পাটকলগুলো মেশিনপত্র নবায়নের জন্য রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি পাবে।
২০০৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের বস্ত্র মন্ত্রণালয় খাদ্যশস্য ও চিনির বস্তা হিসেবে যথাক্রমে শতকরা ১০০ ও ৯০ ভাগ পাটব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৮৭ সালে পাটজাত বস্তা ব্যবহার কমানোর সিদ্ধান্ত পুরোপুরি পাল্টে এভাবেই নতুন জীবন লাভ করে পাটশিল্প। ভারতের পূর্বাঞ্চলে এর গুরুত্ব বিবেচনা করেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এখানে ২.৭৬ লাখ পাটশ্রমিক (১ লাখ স্থায়ী), ৪০ লাখ কৃষক এবং সম্পর্কিত তৎপরতায় আরও ১.৪ লাখ মানুষ যুক্ত সেই বিবেচনায় এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ভারতে এখন ৭৮টি পাট কল, এর মধ্যে ৬১টি পশ্চিমবঙ্গে। বিহার ও উত্তর প্রদেশে তিনটি করে, অন্ধ্র প্রদেশে ৭টি এবং আসাম, উড়িশায়, ত্রিপুরা ও মধ্যপ্রদেশে একটি করে।
২০০৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের বস্ত্র মন্ত্রণালয় খাদ্যশস্য ও চিনির বস্তা হিসেবে যথাক্রমে শতকরা ১০০ ও ৯০ ভাগ পাটব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৮৭ সালে পাটজাত বস্তা ব্যবহার কমানোর সিদ্ধান্ত পুরোপুরি পাল্টে এভাবেই নতুন জীবন লাভ করে পাটশিল্প।
২০০৫ এর পাটনীতি পাট গবেষণা ও উন্নয়ন, প্রযুক্তি, অবকাঠামো উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন নির্দিষ্ট করেছে। লক্ষ্য হচ্ছে রপ্তানি বর্তমানের ১০০০ কোটি রূপি থেকে ২০১০ সালে মধ্যে ৫০০০ কোটি রূপিতে নিয়ে যাওয়া এবং রপ্তানি অনুপাত ৮২:১৮ থেকে ৬৫:৩৫ এ উন্নয়ত করা। একটা থোক বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে রপ্তানি থেকে শুল্ক ও অশুল্ক প্রতিবন্ধকতায় সহায়তা দেয়ার জন্য । উৎপাদন বৈচিত্রকরণের বিষয়েও দৃষ্টি দেয়া হবে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে বিকশিত করাটাই মূল উদ্দেশ্য। কয়েকবছর আগে বাংলাদেশে মোট রপ্তানি আয়ের শতকরা ৯.৮ ভাগ ছিল পাট ও পাটজাত দ্রব্য। ২০০৫-০৬ সালে তা কমে হয়েছে ৪.৭। এটি আরও কমবে বলে ধারণা করা যায়। ভারত ২০১০ সালের মধ্যে পাট রপ্তানি ৫ গুণ করবে। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের পাটনীতিই স্বীকার করছে, বাংলাদেশে পাট থেকে ১ ডলার আয় গার্মেন্টস থেকে ৪ ডলার আয়ের সমান। নিচে দুইদেশে পাটশিল্পের ভিন্নযাত্রার সারসংক্ষেপ দেয়া হল।
চিত্র ৫: পাটশিল্পের ভিন্নযাত্রা: বাংলাদেশ ও ভারত
বিষয় | বাংলাদেশ | ভারত |
মেশিনপত্র | একবারও নবায়ন করা হয়নি | নবায়নের জন্য রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। |
ব্যাংকঋণ | বহুবছরের পুরনো ব্যাংকঋণ সুদে আসলে বাড়ছে। ঋণ খেলাফীদের নানা সুবিধা দেয়া হলেও পাটশিল্পে কোনো ছাড় নেই। | নতুন করে ব্যাংকঋণ ও সুদ মওকুফ |
আভ্যন্তরীণ বাজার | পাটজাত দ্রব্য ব্যবহারে কোনো বাধ্যবাধকতা বা প্রচারণা নেই। | খাদ্যশস্য ও চিনির বস্তাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা আরোপ। |
আন্তর্জাতিক বাজার | বিভিন্ন ব্যয়বহুল অফিস খোলা হলেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। | আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমান্বয়ে আধিপত্য বিস্তার |
কর্মসংস্থান | কমছে | বাড়ছে |
উৎপাদনশীলতা | কমছে | বাড়ছে |
রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গী | পাটশিল্পের প্রতি বৈরী | পাটশিল্পের প্রতি বিশেষ মনোযোগী |
বিশ্বব্যাংকগোষ্ঠীর উন্নয়ন কর্মসূচি | দেশিয় শিল্পের প্রতি বৈরী | কোনোকোনো ক্ষেত্রে শিল্প সহযোগী |
শিল্পবিনাশী কর্মসূচি
বিচ্ছিন্ন করে দেখা ঠিক নয়, গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে ধরনের সংস্কার চলেছে তার একটি বহিপ্রকাশ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটশিল্পের ধস। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার প্রান্তস্থ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংক আইএমএফ এডিবির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর চারণ ক্ষেত্র হিসেবে পরিণত হতে পেরেছে এদেশের লুটেরা, সামাজিক দায়হীন, মতাদর্শিকভাবে দেউলিয়া, দুর্নীতিগ্রস্ত, অতি অল্প পয়সায় বিক্রিযোগ্য রাজনীতিবিদ, আমলা, কনসালট্যান্টদের আধিপত্যের কারণে। বিশ্ব পুঁজির প্রতিনিধি, নিদির্ষ্টভাবে বহুজাতিক সংস্থাসমূহের লবিস্ট বিশ্বব্যাংক অর্থএমএফ এডিবির আঞ্চলিক কৌশল, মতাদর্শিক অবস্থান আর অন্যদিকে দেশীয় লুটেরাদের স্বার্থ একসাথে এই শিল্পবিরোধী কর্মসুচি জোরদার করেছে।
পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার প্রান্তস্থ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংক আইএমএফ এডিবির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর চারণ ক্ষেত্র হিসেবে পরিণত হতে পেরেছে এদেশের লুটেরা, সামাজিক দায়হীন, মতাদর্শিকভাবে দেউলিয়া, দুর্নীতিগ্রস্ত, অতি অল্প পয়সায় বিক্রিযোগ্য রাজনীতিবিদ, আমলা, কনসালট্যান্টদের আধিপত্যের কারণে।
বাংলাদেশে পাট ও পাটশিল্পের অমিত সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনা বাস্তবায়নের সঙ্গে যোগ আছে বাংলাদেশের শিল্পায়নের দৃঢ় ভিত্তি নির্মাণের, বিশাল কর্মসংস্থান সৃষ্টির, পরিবেশ অনুকূল কর্মতৎপরতায় সুস্থ জীবন লাভ এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে শক্ত অংশগ্রহণের। এর উপলব্ধি ও সে অনুযায়ী নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব যখন জাতীয় সক্ষমতার বিকাশ প্রশ্নটি উন্নয়ন দর্শনের কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। এই উন্নয়ন দর্শন জনগণের রাজনৈতিক শক্তি বিকাশেরও দাবি করে।
২০০৭
213