বাংলাদেশ ‘জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি’: আসন্ন বাজেটের জন্য একটি প্রস্তাব
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর
এবং রওনক জাহান, অন্তরা চৌধুরী, রুবাইয়া সিদ্দিকা ও মো. গুলজার হোসেন
করোনা ভাইরাসে বিপর্যস্ত বিশ্বে উন্নয়ন ধরন ও রাষ্ট্রের দায়দায়িত্ব নিয়ে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। বাংলাদেশে বিশাল সংখ্যক মানুষ এখন আয়রোজগারহীন, ক্ষুধার্ত, নিরাপত্তাহীন। ‘সামাজিক নিরাপত্তা জাল’ নামে কিছু কর্মসূচি আছে কিন্তু তা খুবই অপ্রতুল, উপরন্তু দুর্নীতির শিকার। কিছুদিনের মধ্যেই সরকার ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবে। এই প্রবন্ধে উক্ত অর্থবছরে ‘পূর্ণাঙ্গ জীবনচক্র ভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি প্রাক্কলিত প্রাথমিক খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে।
করোনাভাইরাস মহামারি পুরো বিশ্বকে এ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়েছে। বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, মহামারি বা অর্থনৈতিক সংকটের মত বিপর্যয়সমূহ দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রেখে যায়। নেতিবাচক এসব প্রভাব মোকাবিলার জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাৎক্ষণিক জরুরি কর্মসূচি নেয়া হয়। সাধারণত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মাঝারি ও দীর্ঘ মেয়াদি অভিঘাত নিরসনে স্থায়িত্বশীল পদক্ষেপ নেয়া হয় না। সংকট উৎপন্ন বহুমুখী পার্থক্যমূলক নেতিবাচক প্রভাব নির্মূল না করায় দুর্বল, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত ব্যাপক জনগোষ্ঠী দুর্বিষহ জীবনযাপনে বাধ্য হয়।
এ ভাইরাস সংক্রমণে সৃষ্ট মন্দা অন্য অর্থনৈতিক মন্দা থেকে ভিন্ন। সাধারণত চাহিদা ও জোগানে ব্যাপক ধসের জন্য অর্থনীতি মন্দাবস্থায় পতিত হয়। সরকার কর্তৃক সকল প্রকার অর্থনৈতিক কার্যাবলি বন্ধের ফলে বিশ্ব আজ এই মন্দায় নিপতিত হয়েছে। বিচক্ষণতার সাথে সরকারকেই এ বিপর্যয় মোকাবিলায় নেতৃত্ব দিতে হবে। সরকার কর্তৃক অর্থনৈতিক কার্যাবলি বন্ধের কোন নজির ইতিহাসে নেই। সুতরাং প্রচলিত সমাধান কাজে আসবে না।
করোনাভাইরাস অনিশ্চিতি উদ্রেককারী। এই জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থার সমাপ্তি কখন এবং কিভাবে হবে তা অনিশ্চিত। বিশ্বে অর্থনৈতিক কার্যাবলি পুনরায় সচল হবার দিনক্ষণও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। বার বার বন্ধ করতে হবে কি না তা বলাও মুশকিল। একইভাবে করোনাভাইরাস বৈষম্য উদ্রেককারী। সবার উপরে সমানভাবে অভিঘাত ফেলছে না। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে ‘দিন আনে দিন খায়’ খেটে খাওয়া অনানুষ্ঠানিক খাতের মানুষেরা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। অন্যদিকে এই প্রাদুর্ভাবের অভিঘাতের প্রবলতাও বেশি। এবার তিন সপ্তাহেই যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তা বিগত অন্যান্য মন্দার তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে সৃষ্ট সংকট থেকেও ব্যাপকতর। যুক্তরাষ্ট্রে তিন সপ্তাহে প্রায় এক কোটি ৬৬ লাখ মানুষ বেকার ভাতার আবেদন করেছে। ২০০৮-১০ সালের অর্থনৈতিক মন্দায় ১০৬ সপ্তাহে ৮৮ লাখ মানুষ চাকরি হারায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আশঙ্কা করছে, ২০২০ সালের দ্বিতীয়ার্ধে ১০ কোটি ৯৫ লাখ মানুষ চাকরি হারাবে। একই সাথে কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবের পূর্বের তুলনায় ২ কোটি ১ লাখ থেকে ৩ কোটি ৫০ লাখ বেশি দারিদ্র্য বাড়াতে পারে। কবে অর্থনীতি ফিরে দাঁড়াবে তাও অনিশ্চিত। ইংরেজি অক্ষরের চারটি আকারের দৃশ্যকল্পের কোনটি হবে? ‘ভি’-ছয় মাস পর অর্থনীতি ফিরে দাঁড়াবে, ‘ইউ’য়ের মত বেশ কিছুদিন পর ঘুরে দাঁড়াবে, না ‘এল’-এর মত অনেক দিন লাগবে অথবা ‘আই’য়ের মত নিম্নগামী হতেই থাকবে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আশঙ্কা করছে, ২০২০ সালের দ্বিতীয়ার্ধে ১০ কোটি ৯৫ লাখ মানুষ চাকরি হারাবে। একই সাথে কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবের পূর্বের তুলনায় ২ কোটি ১ লাখ থেকে ৩ কোটি ৫০ লাখ বেশি দারিদ্র্য বাড়াতে পারে।
করোনাভাইরাস বৈষম্য উদ্রেককারী। সবার উপরে সমানভাবে অভিঘাত ফেলে না। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মত বাংলাদেশেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে ‘দিন আনে দিন খায়’ খেটে খাওয়া অনানুষ্ঠানিক খাতের মানুষেরা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছেন। বাড়ির কাজে সহায়তাকারী, রিকশাচালক, রাস্তার পাশের বিক্রেতা, পরিবহন শ্রমিক পুরোপুরি দৈনিক উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল। তাঁদের কোন সঞ্চয় থাকে না। যার ফলে করোনাভাইরাসমারি সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য দেশে দেশে লকডাউন ঘোষণা দেয়ার পর তাঁরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক শ্রমশক্তি জরিপ (২০১৭) অনুযায়ী, শ্রমশক্তির প্রায় ৮৫ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে নিযুক্ত রয়েছেন। ৬ কোটি ৮ লাখ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। এই অসংগঠিত খাতসমূহের প্রায় ৫ কোটি ১৭ লাখ শ্রমিক কোন প্রকার চাকরির সুরক্ষা ছাড়াই কাজ করছেন। অনানুষ্ঠানিক কৃষি খাতে ২ কোটি ৮ লাখেরও বেশি কর্মী নিযুক্ত রয়েছেন, শিল্প ও সেবা খাতে যথাক্রমে ১ কোটি ১১ লাখ ৬৮ হাজার এবং ১ কোটি ৭০ লাখ শ্রমিক নিযুক্ত আছেন। বেশির ভাগ শ্রমিক অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত থাকার কারণে তাঁরা শ্রম আইন অনুযায়ী ন্যূনতম মজুরি এবং সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ফলস্বরূপ, অনানুষ্ঠানিক শ্রমিকরা রফতানি খাতের জন্য সরকারঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার অর্থ সহায়তার আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছেন।
যে কোন মহামারি অবধারিতভাবে নারীদের ওপর পুরুষ অপেক্ষা অধিক বিরূপ প্রভাব ফেলে। যুগে যুগে ঘরের কাজ এবং সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্ব সব সময় নারীদের ওপরই ছিল। এ ভাইরাস সংক্রমণের ফলে ঘরের কাজ বেড়ে যাওয়ায় যেসব পরিবারের স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরি করেন তাঁদের একজনকে অবশ্যই বাড়িতে থাকতে হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নারীদের চাকরি ছাড়ার সম্ভাবনাই বেশি। পরিবারের স্বার্থেই তাঁরা তা করবেন। ফলে নারী ও পুরুষের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণে ও আয়ে অসমতা বেড়ে যাবে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ইবোলা, সার্স, সোয়াইন ফ্লু ও বার্ড ফ্লুর মত মহামারিগুলোর গবেষণার ফল বলছে, মহামারি-পরবর্তী অভিঘাত নারীদের ওপরই বেশি বর্তায়।
এরূপ ঋণাত্মক প্রভাব দ‚র করতে বাংলাদেশে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনচক্র ভিত্তিক জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। বিশেষত বিদ্যমান সামাজিক নিরাপত্তা জাল প্রকল্পসমূহ অপর্যাপ্ত, অকার্যকর এবং সর্বজনীন নয়। এই প্রকল্পগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খণ্ডকালীন বা মৌসুমি বা দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে স্বল্প পরিসরে গ্রহণ করা হয়।
তিন মাস পরই ২০২০-২১ সালের অর্থবছর শুরু হবে। এখানে উক্ত অর্থবছরে পূর্ণাঙ্গ জীবনচক্র ভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি প্রাক্কলিত প্রাথমিক খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে। একে কোনভাবেই পূর্ণাঙ্গ বলা যাবে না। তবে প্রস্তাবটি সম্ভাবনাময় আলোচনার দরজা খুলে দেবে। এই প্রাক্কলনে সর্বজনীন পেনশন ভাতা, বেকার ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, শিশু প্রতিপালন ভাতা, আবাসন সুবিধা, আয় সহায়ক ভাতা ও স্বাস্থ্য ভাতা- এই সাতটি ব্যবস্থার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। উলেখিত সাতটির বাইরেও প্রয়োজনীয় অন্যান্য ভাতা সংযুক্ত করা যেতে পারে।
দুই
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পূর্বেই বাংলাদেশে বহুমাত্রিক সমস্যা বিরাজমান ছিল; যেমন- বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে এখনও প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। পাশাপাশি বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাসের হারও আগের তুলনায় কমেছে। ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এদেশে দারিদ্র্য হ্রাসের হার ছিল ১.৮ শতাংশীয় পয়েন্ট; কিন্তু ২০১০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত সময়ে তা কমে ১.২ শতাংশ শতাংশীয় পয়েন্ট হয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমা তথা ১ দশমিক ৯ ডলার হিসাবে বাংলাদেশে এখন দারিদ্র্যের হার ১৪.৫৮ শতাংশ। মাথাপিছু মধ্যম আয়ের দারিদ্র্যসীমা (৩ দশমিক ২০ ডলার) ও উচ্চ মধ্যম আয়ের দারিদ্র্যসীমার (৫ দশমিক ৫০ ডলার) আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫২.৯ শতাংশ এবং ৮৪.৫ শতাংশ যথাক্রমে মধ্যম আয়ের দারিদ্র্যসীমা ও উচ্চ মধ্যম আয়ের দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের পূর্বের বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এদেশের অসহায় জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যসীমায় নেমে যাওয়ার যে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, তা বিদ্যমান সমস্যাকে আরও জটিলতর করে তোলে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশের অসহায় জনগোষ্ঠী, যাদের দারিদ্র্যসীমায় অবনমনের ঝুঁকি আছে, তাদের সংখ্যা প্রায় ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। দারিদ্র্য হ্রাসের হার কমে যাওয়া এবং অসহায় জনগোষ্ঠীর ওপর কোভিড-১৯-এর প্রভাবে দারিদ্র্য নিরসন ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। এমনকি যারা পূর্বেই দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করেছে, তারা পুনরায় দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে। বিশ্বব্যাপী এ দুর্যোগের কারণে প্রবাসী শ্রমিকদের জোরপূর্বক দেশে ফেরত পাঠানো হলে গ্রামীণ অর্থনীতি হুমকির সম্মুখীন হবে। এই দুঃসহ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিশ্চিতকরণে সুষ্ঠু নীতি নির্ধারণ ও তার যথাযোগ্য প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি।
আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমা তথা ১ দশমিক ৯ ডলার হিসাবে বাংলাদেশে এখন দারিদ্র্যের হার ১৪.৫৮ শতাংশ। মাথাপিছু মধ্যম আয়ের দারিদ্র্যসীমা (৩ দশমিক ২০ ডলার) ও উচ্চ মধ্যম আয়ের দারিদ্র্যসীমার (৫ দশমিক ৫০ ডলার) আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫২.৯ শতাংশ এবং ৮৪.৫ শতাংশ যথাক্রমে মধ্যম আয়ের দারিদ্র্যসীমা ও উচ্চ মধ্যম আয়ের দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।
বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটলেও নতুন কর্মসংস্থানের তেমন সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ থেকে দেখা যায়, বেকারত্বের হার ৪.২ শতাংশ। দীর্ঘমেয়াদি বেকারত্বের হার ১৫.২ শতাংশ। যুব বেকারত্বের হার অর্থাৎ যাদের বয়স ১৪ থেকে ২৪ তাদের বেকারত্বের হার ১২.৩ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক-আইএলওর হিসাব অনুযায়ী, চাকরি, শিক্ষা, প্রশিক্ষণে নিয়োজিত নয় বাংলাদেশের ২৬.২ শতাংশ কর্মক্ষম যুবক। বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় এখনও সঙ্গিন আবস্থায় আছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের যুবসমাজের দক্ষতার ঘাটতির কারণে তাদের উৎপাদনশীলতাও অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। আইএলওর আইএসসিও শ্রেণিকরণ অনুযায়ী দক্ষতাকে চারটি স্তরে ভাগ করেছে। প্রথম স্তর: প্রারম্ভিক কর্মদক্ষতা, নিম্নস্তরের কর্মদক্ষতাসম্পন্ন শ্রমিক; মধ্যম কর্মদক্ষতাসম্পন্ন কৃষিকাজে পারদর্শী শ্রমিক, সেবা খাতে নিয়োজিত শ্রমিক নিয়ে দ্বিতীয় স্তর; উচ্চ কর্মদক্ষতাসম্পন্ন মানুষ নিয়ে তৃতীয় ও চতুর্থ স্তর। বাংলাদেশে তৃতীয় ও চতুর্থ স্তরের কর্মদক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর সংখ্যা কম এবং এই ঘাটতি পূরণ করতে প্রায়শই বিদেশি জনশক্তি নিয়োগের প্রয়োজন হয়। নিয়োগপ্রাপ্ত এসব বিদেশির একটি বড় অংশ নথিভুক্ত না হওয়ায় তাদের থেকে প্রাপ্তব্য করের একটি বড় অংশ সরকারি কোষাগারে জমা হয় না।
কর্মক্ষমতা ও দক্ষতার সাথে মানুষের জন্ম ও জন্ম-পরবর্তী সময়ের লালন-পালনেরও জোরালো সম্পর্ক রয়েছে। যেমন- শিশুর জন্মপূর্ব ও শৈশবকালীন বিকাশ সম্পূর্ণভাবেই তার মায়ের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশের সামাজিক ও পারিবারিক বাস্তবতায় একজন মা বিভিন্ন প্রকারের বৈষম্যের শিকার হন। এ বৈষম্য সন্তানের পূর্ণ বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কিশোরী মেয়েদের এক-তৃতীয়াংশ ১৫-১৯ বছর বয়সের মধ্যে মা হয়, অথবা তারা গর্ভবতী হয়ে পড়ে। ফলে ২০ শতাংশ শিশু শারীরিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে জন্মায় এবং তাদের অনেকেই দক্ষ জনশক্তি হয়ে বেড়ে উঠতে ব্যর্থ হয়। পরিসংখ্যান জানায়, বাংলাদেশের ৩৯.৪ শতাংশ নারী প্রজনন বয়সে রক্তশূন্যতায় ভোগে এবং ৫০ শতাংশ নারী দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক দুর্বলতার শিকার হয়। পাশাপাশি খানা জরিপের তথ্য মতে, মাতৃপ্রধান গৃহের আয় তুলনামূলকভাবে ৫৫ শতাংশ কম। পুরুষ শিক্ষার হার যেখানে ৭৩ শতাংশ, নারী শিক্ষার হার ৬৮.৯ শতাংশ। নারীদের প্রতি এসব বৈষম্যের কারণে অনেক নারীই অবহেলার শিকার হন এবং অপুষ্টিতে ভোগেন। অপুষ্টিতে ভোগা এসব নারীর অনেকেই শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্ম দেন। ফলে দেশে অপুষ্ট ও অদক্ষ জনশক্তি বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশের ৩৯.৪ শতাংশ নারী প্রজনন বয়সে রক্তশূন্যতায় ভোগে এবং ৫০ শতাংশ নারী দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক দুর্বলতার শিকার হয়। পাশাপাশি খানা জরিপের তথ্য মতে, মাতৃপ্রধান গৃহের আয় তুলনামূলকভাবে ৫৫ শতাংশ কম।
স্কুলগামী ৪৬ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী অপুষ্টির শিকার এবং তাদের ওজন বয়সের তুলনায় কম। এসব ছাত্র-ছাত্রীর জ্ঞান, দক্ষতা, মানসিক শক্তি অর্জনে ব্যর্থতা দেখা যায়। এদেশে ১৮ শতাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে দরিদ্র শিশুদের তুলনায় অদরিদ্র শিশুদের যোগদানের সংখ্যা বেশি। একটি বিশাল জনশক্তি প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। উপরন্তু মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রশিক্ষণের উপকরণ, পরীক্ষাগার, শিক্ষা সহায়িকা গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র সচ্ছল পরিবারের সন্তানরাই গুণগত শিক্ষার সহায়ক উপকরণ জোগান নিশ্চিতির মাধ্যমে শিক্ষিত হয়ে ওঠে।
স্কুলগামী ৪৬ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী অপুষ্টির শিকার এবং তাদের ওজন বয়সের তুলনায় কম। এসব ছাত্র-ছাত্রীর জ্ঞান, দক্ষতা, মানসিক শক্তি অর্জনে ব্যর্থতা দেখা যায়। এদেশে ১৮ শতাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে।
২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশে প্রবীণ লোকের সংখ্যা দাঁড়াবে ১ কোটি ২০ লাখে। বার্ধক্যকালে স্বাস্থ্যের অবনতি, অপুষ্টি, নিরাপদ আশ্রয়ের অভাব, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, বিষণ্ণতা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশে ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে ২৫ শতাংশ মানুষ মানসিক সমস্যার শিকার।
বাংলাদেশে বৈষম্য উচ্চগতিতে বাড়ছে। এখানে শ্রম থেকে প্রাপ্তি পুঁজি থেকে প্রাপ্তির তুলনায় অনেক কম। গিনি সহগের সঠিকভাবে সমতা পরিমাপ করার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। যদিও নির্ভুল একক নয়, কিন্তু বৈষম্য পরিমাপে এটি বহুল ব্যবহৃত। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ খানা জরিপ অনুযায়ী, দিন দিন বৈষম্য বেড়ে চলছে। ২০১০ সালের গিনি সহগ ০.৪৫৮ থেকে বেড়ে ২০১৬ সালে ০.৪৮২ হয়েছে।
উপর্যুক্ত আলোচনা ও উদাহরণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে একটি পূর্ণাঙ্গ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। সামাজিক নিরাপত্তা জালের বিদ্যমান দুর্বলতা সমাধানে পূর্ণাঙ্গ জীবনচক্র ভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি প্রয়োজন।
বর্তমানে বাংলাদেশে স্বল্প পরিসরে সামাজিক নিরাপত্তা জাল এবং সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প আছে। সামাজিক নিরাপত্তা জালের আওতায় অনেক প্রকল্প কখনও অ্যাডহক বা বছরের একটি নির্দিষ্ট মৌসুমের বা কোন ক্রান্তিকালের জন্য। সারা বছর সুরক্ষা প্রদানের জন্য কার্যকরী নয়। ব্যাপক পরিসরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিও নেই। যেমন- সামাজিক নিরাপত্তা জালের আওতায় স্তন্যদানকারী মায়ের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা শুধুমাত্র ১০ শতাংশ জনসংখ্যার জন্য প্রযোজ্য। স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য প্রদানকৃত বৃত্তি ও খাবার অপ্রতুল। এছাড়া বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা নারী ভাতা, অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থান, কাজের বিনিময়ে খাদ্য, বয়স্ক ভাতা, একটি বাড়ি একটি খামার ইত্যাদি প্রকল্প রয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪০ লাখ মানুষকে বয়স্ক ভাতা দেয়া হয়েছে; কিন্তু দেশে বয়স্ক লোকের সংখ্যা প্রায় এক কোটি ২০ লাখ। ভাতা হিসাবে যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করা হয় তা পর্যাপ্ত নয়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সামাজিক নিরাপত্তা জাল খুব কার্যকর নয়। সামাজিক নিরাপত্তা জালের আওতায় সুবিধাভোগীদের বাছাই প্রক্রিয়াও সুষ্ঠু নয়। অনেকেই রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সুবিধা ভোগ করছেন। এছাড়া বণ্টনে অনিয়ম এবং অপব্যবহার দেখা যায়। বাজেটেও কিছু অসামঞ্জস্য লক্ষ করা যায়। যেমন- ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে এই খাতে মোট বরাদ্দ ৭৪ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন যোগ করা আছে। ছয় লাখ অবসরপ্রাপ্তদের পেনশন প্রায় ২৩ হাজার ১০ কোটি টাকা। এই বরাদ্দ উক্ত বাজেটের একটি বৃহৎ অংশ।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, সামাজিক নিরাপত্তা জাল এবং সামাজিক সুরক্ষার মধ্যে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য আছে। মোটাদাগে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে সরকার স্বল্প আয়ের অথবা আয়হীন মানুষকে অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় অসহায় মানুষদের দুর্যোগ এবং বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। সামাজিক নিরাপত্তা জাল ব্যবস্থায় অসহায় মানুষকে খাবার, নগদ টাকা, ভোগ্যপণ্য দিয়ে সাহায্য করা হয়ে থাকে।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, সামাজিক নিরাপত্তা জাল এবং সামাজিক সুরক্ষার মধ্যে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য আছে। মোটাদাগে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে সরকার স্বল্প আয়ের অথবা আয়হীন মানুষকে অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় অসহায় মানুষদের দুর্যোগ এবং বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। সামাজিক নিরাপত্তা জাল ব্যবস্থায় অসহায় মানুষকে খাবার, নগদ টাকা, ভোগ্যপণ্য দিয়ে সাহায্য করা হয়ে থাকে।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু হলে সামাজিক নিরাপত্তা জালের দুর্বলতা দূর হবার সাথে সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও সুনিশ্চিত হবে। যেমন- প্রস্তাবিত শিশু প্রতিপালন ভাতা মা ও শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করবে এবং শিশুমৃত্যুর হার কমাতে সাহায্য করবে। এর ফলে শিশুজন্মের হার কমবে এবং প্রত্যেক শিশুর জন্য মাথাপিছু সম্পদের ব্যবহার বেড়ে যাবে। স্বাস্থ্যবান ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। এসব দক্ষ কর্মী বিভিন্ন সম্মানজনক কাজ করার মাধ্যমে অধিক কর প্রদান করার সক্ষমতা অর্জন করায় জনহিতকর কাজে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বাড়বে। বেকার ভাতা, আয় সহায়ক ভাতা তরুণদের সুষ্ঠু প্রশিক্ষণ গ্রহণে উৎসাহী করে এবং দক্ষ জনশক্তি হিসাবে গড়ে তোলে। ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি সর্বজনীন পেনশন ভাতা অবসর-পরবর্তী জীবনে দারিদ্র্য থেকে রক্ষা করে এবং ভোগ্যপণ্যের ব্যবহার বাবদ ব্যয় বাড়ায়। এ সবগুলোই অর্থনীতি সচল রাখায় ভূমিকা রাখে।
তিন
এখানে সাতটি পূর্ণাঙ্গ জীবনচক্র ভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা সূচকের প্রথম পর্যায়ে ন্যূনতম আকারে বাস্তবায়নের জন্য প্রাক্কলিত ব্যয়ের একটি খসড়া হিসাব দেয়া হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে সকলের হাতে অর্থ পৌঁছাবে। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি ‘উৎকর্ষ চক্র’ তৈরি করবে।
এখানে সাতটি পূর্ণাঙ্গ জীবনচক্র ভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা সূচকের প্রথম পর্যায়ে ন্যূনতম আকারে বাস্তবায়নের জন্য প্রাক্কলিত ব্যয়ের একটি খসড়া হিসাব দেয়া হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে সকলের হাতে অর্থ পৌঁছাবে। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি ‘উৎকর্ষ চক্র’ তৈরি করবে।
সর্বজনীন পেনশন : উন্নয়নশীল বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে সর্বজনীন পেনশন ভাতা কার্যকর রয়েছে। ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে প্রত্যেক ব্যক্তিই এই ভাতার জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচনা করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে উপযুক্ত ব্যক্তিরা দারিদ্র্য বিমোচনের স্বার্থে ন্যূনতম হারে উক্ত ভাতা পাবেন। আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমা অনুযায়ী সর্বজনীন পেনশন ভাতার হার নির্ধারণ করা হয়েছে দৈনিক ১৬১.৫ টাকা (১.৯ ডলার)। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনসংখ্যা প্রক্ষেপণ মতে, ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের সম্ভাব্য বয়স্ক জনসংখ্যা হবে ১ কোটি ২৪ লাখ ৭৩ হাজার। জনপ্রতি মাসিক ৪ হাজার ৮৪৫ টাকা হারে মোট ৭২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পেনশন ভাতা হিসাবে প্রদান করা যেতে পারে।
বেকার ভাতা : বেকারত্বের কারণে আর্থিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তিদের বেকার ভাতার মাধ্যমে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রদান করা সম্ভব। ২২ বছর বয়স থেকে শুরু করে অবসর গ্রহণের বয়স পর্যন্ত চাকরিপ্রত্যাশী ব্যক্তিবর্গকে উক্ত ভাতার আওতাধীন হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। বেকার ভাতার হার সর্বোচ্চ কত হতে পারে তা তাদের বয়স, উপার্জন এবং সঞ্চয়ের ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সাল নাগাদ বেকার জনসংখ্যা হবে প্রায় ৭৫ লাখ। এক্ষেত্রে জনপ্রতি মাসিক ২ হাজার ৫৫০ টাকা হারে বেকার ভাতা নির্ধারণের কথা ভাবা হয়েছে।
প্রতিবন্ধী ভাতা : প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সংরক্ষণ এবং সুরক্ষা প্রদানের জন্য প্রতিবন্ধী ভাতা প্রয়োজন। বাংলাদেশের ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩’ অনুসারে প্রতিবন্ধী তালিকায় নিবন্ধিত ছয় বছরের অধিক অসচ্ছল ব্যক্তিবর্গ এই ভাতার আওতাধীন হবেন। দৈনিক ১৬১.৫ টাকা অর্থ প্রদানের মাধ্যমে ১৬ লাখ ৫৮ হাজার প্রতিবন্ধী মানুষকে সহায়তা করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমা অনুসারে এই ভাতার হার নির্ধারণ করা হয়েছে।
শিশু প্রতিপালন ভাতা : স্বল্প আয়ের পিতা-মাতার জন্য নিজেদের মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে শিশু প্রতিপালন কষ্টকর। শিশু প্রতিপালন ভাতা প্রদানের মাধ্যমে তাদের সাহায্য করা সম্ভব। অসচ্ছল পরিবারের শূন্য থেকে ১৪ বছর বয়সী সকল শিশুকে এই ভাতার জন্য বিবেচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে, ২০২১ সালে শিশুর সংখ্যা হবে ৪ কোটি ৫৮ লাখ, যার মধ্যে উক্ত ভাতার জন্য বিবেচিত হবে ৯৯.৯ লাখ শিশু, যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। মাসিক জনপ্রতি প্রস্তাবিত ভাতার পরিমাণ ৮৫০ টাকা ধরা হয়েছে।
আবাসন সুবিধা : আবাসন সুবিধাসমূহের উদ্দেশ্য হল মূলত বেকার জনগোষ্ঠী অথবা কম আয়ের জনগোষ্ঠীকে বসবাসের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান। বাংলাদেশে জীবনযাত্রার ব্যয় এবং বাড়িভাড়া যেভাবে বেড়ে চলেছে চাকরিপ্রার্থী এবং বয়স্কদের বাড়িভাড়ার টাকা জোগান দিতে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে। এক রুমের একটি আবাস ভাড়া করতে খরচ হচ্ছে ৯ হাজার ২২৯ টাকার মত। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল একটি রাষ্ট্রের পক্ষে সম্পূর্ণ ভাড়ার টাকা বহন করাও রীতিমত অসম্ভব। আবাসন সুবিধা প্রদান করা গেলে ২ কোটির বেশি চাকরিপ্রার্থী এবং বয়স্ক লোক সুফল পাবেন। এই সংখ্যক মানুষের জন্য প্রস্তাবিত আবাসন সুবিধা জাতীয় বাজেটের ১.৮ শতাংশ।
আয় সহায়ক ভাতা : বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে যারা বসবাস করে তাদের জীবনযাপনের ব্যবস্থার জন্যই মূলত এ আয় সহায়ক ভাতার প্রয়োজন। চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী ১৫-৫৯ বছরের জনগোষ্ঠীদের আয় সহায়ক ভাতার জন্য নির্বাচন করা যেতে পারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনসংখ্যার উপাত্তে দেখানো হয়েছে, ২০২১ সালে ২ কোটি ৪৩ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকবে। প্রতি মাসে আয় সহায়ক ভাতা হিসেবে প্রতিজনের জন্য ১১৪৭.৫ টাকা প্রস্তাব করা করা হয়েছে। এই ভাতাটি এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, যেন তারা এজাতীয় ভাতার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল না হয়ে পড়েন; শুধুমাত্র নিজেদের আয় ও চাহিদার ব্যবধান হ্রাস করতে পারেন। বর্তমান হিসাব অনুযায়ী বছরে ৩৩ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা আয় সহায়ক ভাতার জন্য দরকার হবে।
স্বাস্থ্য ভাতা : সকলের জন্য জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে ধনী-গরিব-নির্বিশেষে চিকিৎসা প্রদান করা দরকার এবং তা বাস্তবায়নও সম্ভব। তবে সবার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চালু হওয়ার দিকে যাত্রাপথে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য স্বাস্থ্য ভাতা দেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের দরিদ্র জনগণের জন্য স্বাস্থ্য বীমা অপেক্ষা স্বাস্থ্য ভাতা অধিকতর কার্যকর। ২০১৬-এর খানা জরিপের তথ্য মতে, প্রতি মাসে চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশের একজন মানুষ ৭৬৫ টাকা খরচ করেন। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী ৩ কোটি ৭৩ লাখ মানুষকে ৭৬৫ টাকা হারে অর্থ প্রদান করলে দ্রুতগতিতে দারিদ্র্য কমানো সম্ভব। হিসাবানুসারে মোট ৩৪ হাজার ২৪১ কোটি টাকা স্বাস্থ্য ভাতা হিসাবে প্রয়োজন। প্রস্তাবিত বাজেটের ৫.৭ শতাংশ।
এই সমীক্ষায় আগামী অর্থবছর ২০২০-২১-এর জন্য ছয় লক্ষ কোটি টাকার বাজেট অনুমিত হয়েছে। চলমান অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেট ৫,২৩,১৯০ কোটি টাকার এবং ধারণা করা যায়, পরবর্তী বছরে বাজেটের আকার বাড়বে। বাংলাদেশের বর্তমান বছরের লক্ষ্যমাত্রার জিডিপির পরিমাণ ২৫,৭০,৪০০ কোটি টাকা এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭.৫ শতাংশ ধরে ২০২১ সালের জিডিপির পরিমাণ ২৭,৬৩,১৮০ কোটি টাকা হিসাব করা হয়েছে।
সাতটি সামাজিক নিরাপত্তা ভাতার জন্য আনুমানিক ১ লাখ ৯৪ হাজার ২৩৬ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। উক্ত টাকা মোট বাজেটের প্রায় ৩২.৩৭ শতাংশ এবং জিডিপির প্রায় ৭ শতাংশ। সরকার ২০১৯-২০ অর্থবছরে সামাজিক সেবা খাতে ৭৪ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। মোট বাজেটের ১৪.২১ শতাংশ। ১০ বছর আগেও এই হার ছিল সাড়ে ১৭ শতাংশের মত। জিডিপির ২.৫৮ শতাংশ। অথচ সারা বিশ্বে সামাজিক নিরাপত্তা জিডিপির অনুপাতে ১১.২ শতাংশ। এ বছরের বরাদ্দকৃত বাজেটের তুলনায় এ খাতের জন্য প্রস্তাবিত অর্থের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ১৯ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা বেশি।
সরকার ২০১৯-২০ অর্থবছরে সামাজিক সেবা খাতে ৭৪ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। মোট বাজেটের ১৪.২১ শতাংশ। ১০ বছর আগেও এই হার ছিল সাড়ে ১৭ শতাংশের মত। জিডিপির ২.৫৮ শতাংশ। অথচ সারা বিশ্বে সামাজিক নিরাপত্তা জিডিপির অনুপাতে ১১.২ শতাংশ।
বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নের পিছনে প্রধান অন্তরায় হিসাবে ধরা হয় বাজেট ঘাটতিকে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের জন্য শুধুমাত্র সামাজিক নিরাপত্তা খাতে এরূপ বিশাল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা কষ্টকল্প মনে হতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে এই ঘাটতিও পূরণ করা সম্ভব। সরকারের তথা জনগণের করের অর্থের বেপরোয়া খরচ ও অপচয়ের নজির বাংলাদেশে অনেক পুরনো। অপ্রয়োজনীয় এসকল খরচের ওপর লাগাম টেনে আনতে পারলেই প্রয়োজনীয় এ খাতের জন্য অর্থের জোগান দেয়া সম্ভব।
২০২১ অর্থবর্ষের জন্য প্রস্তাবিত সামাজিক নিরাপত্তা সূচক সমুহ এবং সম্ভাব্য বাজেট এর তালিকা
ক্রমমান | সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা | ভাতার আওতাধীন সম্ভাব্য জনসংখ্যা (লাখ) | প্রস্তাবিত ভাতার পরিমাণ মাসিক জনপ্রতি (টাকা) | বাৎসরিক ভাতার পরিমান (কোটি) | ২০২১ সালের বাৎসরিক বাজেটের শতাংশ | ২০২১ সালের মোট জিডিপির শতাংশ |
১ | সর্বজনীন পেনশন ভাতা | ১২৪.৭ | ৪৮৪৫ | ৭২৫০০.৫৮ | ১২.০৮ | ২.৬২ |
২ | বেকার ভাতা | ৭৫.৩ | ২৫৫০ | ২৩০৪১.৮ | ৩.৮৪ | ০.৮৩ |
৩ | প্রতিবন্ধী ভাতা | ১৬.৫৮ | ৪৮৪৫ | ৯৬৩৯.৬ | ১.৬ | ০.৩৫ |
৪ | শিশু প্রতিপালন ভাতা | ৯৯.৯ | ৮৫০ | ১০১৮৯.৮ | ১.৭ | ০.৩৬ |
৫ | আবাসন সুবিধা | ২০০.০৩ | ৪৬৫ | ১১১৬১.৭ | ১.৮ | ০.৪ |
৬ | আয় সহায়ক ভাতা | ২৪৩ | ১১৪৭.৫ | ৩৩৪৬১.১ | ৫.৫৮ | ১.২ |
৭ | স্বাস্থ্য ভাতা | ৩৭৩ | ৭৬৫ | ৩৪২৪১.৪ | ৫.৭ | ১.২৪ |
মোট = | ১১৩২.৫১ | ১৯৪২৩৫.৯৮ | ৩২.৩৭ | ৭.০৩ |
মোট বাজেটের শতাংশ = (১৯৪২৩৫.৯৮ /৬০০০০০) * ১০০ = ৩২.৩৭%
মোট জিডিপির শতাংশ = (১৯৪২৩৫.৯৮ /২৭৬৩১৮০)*১০০ = ৭.০৩%
চার
উপর্যুক্ত প্রস্তাবনাসমূহ বাংলাদেশসহ তাবৎ বিশ্ব কর্তৃক অঙ্গীকারবদ্ধ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একই সাথে স্বকীয় নিজস্ব আকাক্সক্ষার বাংলাদেশের সঙ্গেও সাযুজ্যপূর্ণ। এ কর্মসূচির বাস্তবায়ন বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের ও পরবর্তীতে উন্নত দেশ হিসাবে অগ্রযাত্রার অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানোর উদ্যোগকে বেগবান করবে। সবচেয়ে বড় যুক্তি হল, এ কর্মসূচি মুক্তিযুদ্ধের মৌল ভিত্তি ‘সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার’বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে।
উন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশ ইতোমধ্যেই তাদের জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ধরনের নীতিকৌশল ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সেসব উদ্যোগের কার্যকারিতাও স্পষ্টত প্রতীয়মান এবং উক্ত দেশসমূহ সেসবের সুফলও ভোগ করছে। সকল প্রগতির সূচকেই তারা অগ্রগামী। বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতাকে বিবেচনায় রেখে অন্যান্য দেশের আলোকে বাংলাদেশও একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনচক্র ভিত্তিক অর্থবহ ও কার্যকরী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য নতুন আইন প্রণয়ন, প্রতিষ্ঠান গঠন ও সেসবের পরিচালনা বিষয়ক বিভিন্ন নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারবে।
মানুষের ইতিহাস মূলত ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস। জরা, মহামারি, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ- এরকম অজস্র প্রতিক‚লতার মুখোমুখি হয়ে সভ্যতা বারে বারে ঘুরে দাঁড়িয়েছে নতুন চিন্তা, নতুন উদ্যম নিয়ে। বিশ্বব্যাপী করোনা দুর্যোগ আজ যে সংকটের জন্ম দিয়েছে, এ সংকটকে মোকাবেলা করা এবং তা থেকে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার উন্মোচনে বাংলাদেশের জন্য দরকার নতুন ও বৈচিত্র্যময় সৃজনশীল চিন্তা, নীতি ও আইনের সমন্বয়। এর জন্য সর্বাগ্রে জরুরি দূরদর্শী রাজনীতি ও সঠিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত।
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: অধ্যাপক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইমেইল: rt@du.ac.bd
রওনক জাহান, অন্তরা চৌধুরী, রুবাইয়া সিদ্দিকা ও মো. গুলজার হোসেন: মাস্টার অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের শিক্ষার্থী।
671