নেপাল : স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা

নেপাল : স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা

অর্ক ভাদুড়ি

দক্ষিণ এশিয়াসহ গোটা বিশ্ব জুড়ে ঘটতে থাকা একের পর এক রাষ্ট্রীয় ওলোটপালটের তালিকায় অন্যতম  সাম্প্রতিক সংযোজন নেপাল। নেপালের পরে আরও কয়েকটি দেশেও বিস্ফোরণ ঘটেছে। বিস্ফোরকের নাম যথারীতি তরুণ প্রজন্ম বা কথিত ‘জেন জি’। অনুঘটকের তালিকায় সরকারি দুর্নীতি, বৈষম্য, বেকারত্ব, দেশের রাজনৈতিক এলিটের প্রতি তীব্র হতাশা। নেপালের জনবিক্ষোভের ঐতিহাসিক সূত্র অনুসন্ধান করা হয়েছে এই লেখায়।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্য যে দুটি দেশে তরুণ প্রজন্মের বিক্ষোভ সরকার উচ্ছেদ করল, সেই  শ্রীলঙ্কা বা বাংলাদেশের তুলনায় নেপালের পরিস্থিতি কিছুটা আলাদা৷ নেপালের গণতন্ত্র অনেকটাই নতুন। মাত্র দেড় দশক আগে, ২০০৮ সালে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে শুরু করে নেপাল। সে হিসেবে সাবালকত্ব অর্জন করার আগেই দেশ জুড়ে বিদ্রোহের আগুন দেখতে হলো তাকে। রুটি-কাপড়-বাড়ি বা গণতন্ত্রের মতো প্রাথমিক দাবির স্লোগান তুলে পথে নামলেন মানুষ, বিশেষত নেপালের তরুণ প্রজন্ম – যাদের অধিকাংশের বয়স নেপালের প্রজাতন্ত্রের কাছাকাছি। সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের পিছনে থাকা তরুণসমাজের তীব্র অসন্তোষের কারণ বুঝতে হলে নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকাতেই হবে। বস্তুত এই অভ্যুত্থানের শিকড় ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গেই প্রোথিত।

ভারতের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নেপালেও গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ঘটতে থাকে। রানা সাম্রাজ্যের অধীনস্থ নেপালে গণতান্ত্রিক আকাঙ্খা তীব্রতর হতে থাকে। ১৯৪৭ সালেই প্রতিষ্ঠিত হয় নেপালী কংগ্রেস আর ১৯৪৯ সালে, চীন বিপ্লবের বছরে, নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি। এই দুটি দল রানাদের বিরুদ্ধে যৌথ আন্দোলন শুরু করে। ১৯৫১ সালের দিল্লী সমঝোতার মাধ্যমে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের অধীনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে নেপাল সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগোয়। কিন্তু ১৯৬০ সালের ডিসেম্বরে রাজা মহেন্দ্র নির্বাচিত সংসদ ভেঙে দিয়ে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেন। রাজনৈতিক দলের সদস্যদের জেলবন্দি করেন। স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার পরের তিন দশক যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তার অন্যতম প্রধান ভূমিকায় ছিলেন কমিউনিস্টরা।

সীমাবদ্ধ রাজনৈতিক পরিসরের মধ্যে থেকেও ১৯৯০ সালে নেপালী কংগ্রেস এবং কমিউনিস্টদের উদ্যোগে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবিতে বিরাট গণআন্দোলন সংগঠিত হয়। আন্দোলনের কাছে নতিস্বীকার করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের দাবি মেনে নেন তৎকালীন রাজা বীরেন্দ্র। সেই সঙ্গে গৃহীত হয় সাংবিধানিক রাজতন্ত্রিক ব্যবস্থা। ইতিমধ্যে বহু বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়া নেপালী কমিউনিস্ট পার্টির একটি লড়াকু অংশ পুষ্প কুমার দহল ওরফে প্রচন্ডর নেতৃত্বে শক্তিশালী মাওবাদী পার্টি গড়ে তোলেন। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে, দুর্নীতি ও ক্ষমতাকাঠামোয় উচ্চবর্ণের আধিপত্যের বিরুদ্ধে, প্রতিরোধ গড়তে তাঁদের গেরিলা বাহিনী পিপলস আর্মি কাজ শুরু করে নেপালের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। পরবর্তীতে এর নাম হয় পিপলস লিবারেশন আর্মি। ১৯৯৬ সাল থেকে রাজতন্ত্র উচ্ছেদের লক্ষ্যে মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রাম চলতে থাকে। হাজার হাজার কমিউনিস্ট বিপ্লবী এই সংগ্রামে শহীদ হন৷ তাঁদের রক্তে সিক্ত নেপালে গড়ে ওঠে বিপ্লবী ধারার কমিউনিস্ট আন্দোলনের শক্ত ভিত।

মাওবাদীরা ছাড়াও নেপালের মাটিতে আরেকটি বামপন্থী শক্তি সিপিএন (ইউএমএল) এরও ছিল দৃঢ় সাংগঠনিক ভিত্তি। ঝাপা-সহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক গণসংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁরা৷ মাওবাদীদের সশস্ত্র সংগ্রামের পথে না হেঁটে তাঁরা দীর্ঘদিন সংসদীয় ধারায় বাম রাজনীতি করে এসেছেন।

২০০১ সালের পয়লা জুন কাঠমান্ডুর নারায়নহিতি প্রাসাদের এক অনুষ্ঠানে যুবরাজ দীপেন্দ্র গুলি করে হত্যা করেন তাঁর বাবা রাজা বীরেন্দ্র এবং মা রানী ঐশ্বর্য্য সহ ন’জন রাজপরিবারের সদস্যকে। নিজের মাথায় গুলি করে দীপেন্দ্র কোমায় চলে গেলে রাজা হন তাঁর কাকা জ্ঞানেন্দ্র। এই ঘটনা নেপালের রাজনীতিতে ভূমিকম্পের সৃষ্টি করে। স্বৈরাচারী জ্ঞানেন্দ্র জরুরী অবস্থা জারি করে গায়ের জোরে শাসন চালাতে থাকেন। জনগণের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের অধিকার হরণ করেন, সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করেন এবং সংসদ ভেঙে দেন। এর প্রতিক্রিয়ায় রাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। কয়েক বছর পরে ২০০৬ সালে প্রচণ্ডর নেতৃত্বাধীন মাওবাদীদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নেপালি কংগ্রেস এবং সিপিএন- ইউএমএল রাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলন জোরদার করে। কোটি কোটি মানুষের অংশগ্রহণ এই আন্দোলনকে গোটা বিশ্বের মুক্তিকামী জনতার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে গণতন্ত্র পুনর্বহালের দাবিতে এই ব্যাপক আন্দোলন নেপালের ‘দ্বিতীয় জনআন্দোলন’ নামে পরিচিত। 

এই মহান গণআন্দোলনের ফলে নেপালে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। ২০০৮ সালের মে মাসে নেপাল নিজেকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ঘোষণা করে। ২০০৮ সালের সংসদীয় নির্বাচনে সর্বাধিক ভোট পায় নেপালের মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি। । যদিও একক সরকার গঠনের জন্য তাঁদের পাওয়া ৩০ শতাংশ ভোট যথেষ্ট ছিল না। জোট সরকার গঠিত হয় মাওবাদীদের নেতৃত্বে। গোটা পৃথিবীর বামপন্থীরা সশ্রদ্ধ বিস্ময়ে দেখলেন, বছরের পর বছর পাহাড়ে জঙ্গলে জনযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া একটি দল এখন ভোটে জিতে হিমালয়ের কোলের অনিন্দ্যসুন্দর দেশটির শাসক। এই ঘটনার তাৎপর্য বিরাট৷ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে যখন গোটা পৃথিবীতেই কমিউনিস্টরা পিছু হটছেন, তখন নেপালের মতো একটি ছোট্ট দেশে লাল পতাকার বিজয় সংগঠিত হল। এই সাফল্য দেশে দেশে মুক্তিকামী জনতার মধ্যে বিপুল অনুপ্রেরণার সৃষ্টি করেছিল।

পরবর্তী ইতিহাস নিঃসীম হতাশা এবং স্বপ্নভঙ্গের। ইতিহাসের ট্রেন গণঅভ্যুত্থানের স্টেশন থেকে বিপ্লবী সাম্যের গন্তব্যে গেল না। তার পথ বেঁকে গেল সংসদীয় কানাগলি এবং নয়া উদারবাদের দিকে। বিপ্লবকে থামিয়ে দেওয়া হল মাঝপথে। নেপালের বিভিন্ন প্রদেশ ঘুরে, গ্রাম শহর মফস্বল চষে ফেলার পর কানে বাজে কেবল দুটি শব্দ: অসম্পূর্ণ ক্রান্তি। অসমাপ্ত বিপ্লব। গোটা নেপাল জুড়ে ছড়িয়ে আছে ভাঙা স্বপ্নের অজস্র টুকরো। ২০২৩ সালে গিয়েছিলাম নেপালের এমন কিছু প্রাক্তন মাওবাদী নারী গেরিলার সাক্ষাৎকার নিতে, যাঁরা এখন আর রাজনীতিতে সক্রিয় নন। জনযুদ্ধের এত বছর তাঁরা কেমন আছেন, কী ভাবছেন- এই ছিল আমার খোঁজ। তিব্বত লাগোয়া একটি গ্রামে গিয়ে দেখলাম একজন দুর্ধর্ষ প্রাক্তন নারী গেরিলা বাড়িতে বাসন মাজছেন৷ তিনি এখন আর কোনও রাজনৈতিক দল করেন না। বহু প্রশ্ন করলাম, কিন্তু রাজনীতি নিয়ে কথা বলতেই চাইলেন না। অবশেষে জিজ্ঞাসা করলাম, “যে হাতে একসময় বিপ্লবের নিশান এবং বন্দুক ধরেছিলেন, এখন সেই হাতে সংসারের বাসন মাজছেন, খারাপ লাগছে না?” সেই নারী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন৷ তারপর চোখ তুলে বললেন, “যে হাতে আমি বন্দুক ধরেছিলাম, সেই হাত তো আর নেই। এটা অন্য হাত। আমার পার্টি বদলে গিয়েছে। আমার নেতারা বদলে গিয়েছেন৷ আমার হাতও বদলে গিয়েছে। ওঁরা ক্ষমতায় গিয়ে বদলেছেন, আমি সংসারে ফিরে এসেছি।” আমি স্তব্ধ হয়ে শুনলাম।

তিব্বত লাগোয়া একটি গ্রামে গিয়ে দেখলাম একজন দুর্ধর্ষ প্রাক্তন নারী গেরিলা বাড়িতে বাসন মাজছেন৷ তিনি এখন আর কোনও রাজনৈতিক দল করেন না। বহু প্রশ্ন করলাম, কিন্তু রাজনীতি নিয়ে কথা বলতেই চাইলেন না।

এই বদলে যাওয়া বিপ্লবীদের প্রতি তীব্র হতাশাকে না বুঝে কেবল ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে নেপালকে পড়তে গেলে তা আত্মপ্রতারণাই হবে। মাওবাদীদের সঙ্গে রাষ্ট্রের দুই দশকের (১৯৯৬-২০০৬) জনযুদ্ধ নিহত হন প্রায় ১৮ হাজারের কাছাকাছি মানুষ, বাস্তুচ্যুত হন কয়েক লক্ষ। এই রক্তাক্ত সংঘাত নেপালের সমাজে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি করে। নেপালের জনগণ রক্ত দিয়েছিলেন একটি উজ্জ্বল গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন ভবিষ্যতের জন্য। রাজতন্ত্রের অবসানের পর সামাজিক ন্যায়প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে গঠিত কমিউনিস্ট সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল ভূমি সংস্কারের, নারী ও দলিত সহ সমাজের নানা পিছিয়ে পড়া অংশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু নেপালের জনগণের চোখের সামনেই নতুন সরকারের মন্ত্রীরা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন মন্ত্রকের ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে। কয়েক বছর আগেই যে বিপ্লবী নেতারা জঙ্গলে পাহাড়ে সংগ্রাম করছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে উঠল দুর্নীতির অভিযোগ। অশ্লীলদর্শন বিলাসবহুল গাড়িতে তাঁদের দেখলেন জনতা। প্রত্যাশা ছিল নেপালে প্রতিষ্ঠিত হবে গণতন্ত্র, কিন্তু জনগণ দেখলেন, যে নেতাদের তাঁরা ভরসা করেছিলেন, তাঁরা গণতন্ত্রের নামে সার্কাসের প্রদর্শনী শুরু করলেন। প্রায় প্রতি বছর প্রধানমন্ত্রী বদলানোর খেলা শুরু হল। গড়ে উঠল একটি নতুন রাজনৈতিক এলিট শ্রেণি, যার প্রধান খেলোয়াড় তিনটি দল- মাওবাদীরা, ইউএমএল এবং কংগ্রেস। যেহেতু মাওবাদীরাই রাজতন্ত্র বিরোধী সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, রাজতন্ত্রের অবসানের পর তাঁদেরই সবচেয়ে বেশি সমর্থন দিয়েছিলেন মানুষ, তাঁদের প্রতি হতাশাও তৈরি হল সবচেয়ে বেশি। ২০০৮ এর মাত্র ৫ বছরের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয়তা হারিয়ে ২০১৩ সালের নির্বাচনে সিপিএন-ইউএমএল এবং নেপালী কংগ্রেসের থেকে বিশাল ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ল মাওবাদী পার্টি। ইতিমধ্যেই প্রচণ্ডকে ত্যাগ করেছেন তাঁর ঘনিষ্ঠ কিছু কমরেড ৷ মোহন বৈদ্য ওরফে কিরণ, নেত্র বিক্রম চাঁদ ওরফে বিপ্লবের মতো নেতারা গড়ে তুলেছেন নতুন কমিউনিস্ট পার্টি। যদিও তার সংসদীয় শক্তি বেশি নয়। দ্রুত এই দলেও ভাঙন হল।

মাওবাদী পার্টির মূল জনভিত্তি ছিল গ্রামীণ কৃষক ক্ষেতমজুর। সার্বিক ভূমিসংস্কারের অভাবে তাঁদের অবস্থার বিশেষ কোনো উন্নতি হল না। শহরাঞ্চলে বেড়ে চলল বেকারত্বের সমস্যা। নব্য গণতান্ত্রিক নেপালে এমন কোনও নতুন সামাজিক পরিকাঠামো গড়ে উঠল না, যা চাষবাসের শান্ত জীবন ছেড়ে গেরিলা যোদ্ধা হয়ে যাওয়া মানুষদের উন্নততর জীবনের স্বাদ দিতে পারে। ২০১৭-র নির্বাচনে মাওবাদী পার্টির ভোট আরও কমল। স্বপ্নভঙ্গের দগদগে ক্ষত ততদিনে বেশ স্পষ্ট। ২০১৮ সালে সিপিএন (ইউএমএল) এর সঙ্গে মিলে গিয়ে প্রচণ্ডর নেতৃত্বে মাওবাদীরা তৈরী করলেন ঐক্যবদ্ধ নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি। সমস্যার মূলে না গিয়ে বেছে নিলেন শর্টকাট রাস্তা। দুই বড় রাজনৈতিক দলের মিলন সাময়িক চমক জাগাতে সক্ষম হল, কিন্তু নেপালের সাম্যবাদী আন্দোলনের বুনিয়াদি সংকটগুলি একই থাকল। নতুন ঐক্যবদ্ধ পার্টি সরকার গড়ল। প্রধানমন্ত্রী হলেন কে পি ওলি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই দলের অন্দরে শুরু হল টানাপোড়েন। একদিকে প্রচণ্ড, অন্যদিকে ওলি। প্রচণ্ডপন্থীরা অভিযোগ করলেন, ওলি ক্ষমতায় একক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চান৷ ২০২০ সালে ওলি সংসদ ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করলেন। তার জেরে নতুন কমিউনিস্ট দলের তথাকথিত ঐক্য ভেঙে গেলো। দেড় বছর নেপালি কংগ্রেসের শের বাহাদুর দেউবা এবং দেড় বছর প্রচন্ডর প্রধানমন্ত্রীত্বের পর ২০২৪-এর মাঝামাঝি আবারও প্রধানমন্ত্রী হলেন কে পি ওলি। এবার তাঁর সমর্থনে কংগ্রেস, বিরোধী দলে প্রচণ্ডর সিপিএন (মাওবাদী কেন্দ্র)।

মাওবাদী পার্টির মূল জনভিত্তি ছিল গ্রামীণ কৃষক ক্ষেতমজুর। সার্বিক ভূমিসংস্কারের অভাবে তাঁদের অবস্থার বিশেষ কোনো উন্নতি হল না। শহরাঞ্চলে বেড়ে চলল বেকারত্বের সমস্যা। নব্য গণতান্ত্রিক নেপালে এমন কোনও নতুন সামাজিক পরিকাঠামো গড়ে উঠল না, যা চাষবাসের শান্ত জীবন ছেড়ে গেরিলা যোদ্ধা হয়ে যাওয়া মানুষদের উন্নততর জীবনের স্বাদ দিতে পারে।

বছরের পর বছর তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলের এই সব কার্যকলাপ নেপালের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করেছিল ৷ কর্মসংস্থান নেই , লক্ষ লক্ষ তরুণকে পেটের দায়ে বিদেশে যেতে হয়, বৈষম্য চরমে। রাজনৈতিক এলিটদের অধিকাংশের জীবনে ভোগবিলাসের অশ্লীল প্রদর্শনী। সোস্যাল মিডিয়ার যুগে সেসব জনগণের চোখে পড়ে। ব্যাপক প্রচার পেল ‘নেপো কিড’ শব্দবন্ধ। রাজনৈতিক নেতাদের সন্তানদের টাকা ওড়ানো এবং বিলাসী যাপনের ছবি ভাইরাল হল। জনগণের অধিকাংশই চরম ক্ষুব্ধ এবং হতাশ ৷ দেড় দশকের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ব্যর্থতা তাঁদের একাংশকে ‘আগেই ভালো ছিলাম’ গোছের কথা বলতে বাধ্য করল। চরম দক্ষিণপন্থীরা এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। ধীরে ধীরে নেপালে ডালপালা মেলতে শুরু করল ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী শক্তির মদতপুষ্ট রাজতন্ত্রীরা ৷ কাঠমাণ্ডুর এক গায়ককে কেন্দ্র করে সক্রিয় হল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। কয়েক বছর আগে যা অকল্পনীয় ছিল, তাই ঘটতে শুরু করল নেপালে- রাজতন্ত্রের পক্ষে হাজার হাজার জনতার মিছিল। সেই মিছিলে ভারতের কট্টর দক্ষিণপন্থী নেতা, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের ছবি।

কয়েক বছর আগে যা অকল্পনীয় ছিল, তাই ঘটতে শুরু করল নেপালে- রাজতন্ত্রের পক্ষে হাজার হাজার জনতার মিছিল। সেই মিছিলে ভারতের কট্টর দক্ষিণপন্থী নেতা, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের ছবি।

২০১৫ সালে প্রণীত সংবিধান মানুষের অধিকারের সুদীর্ঘ তালিকা দিয়েছিল। এর মধ্যে ছিল সবার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য ও আশ্রয়ের অধিকার। কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই হল না। নেপালি জনতার মূল জীবিকা কৃষি ক্রমশ ধ্বসে পড়লো। পরিসংখ্যান বলছে, কৃষি থেকে আসা গার্হস্থ্য আয়ের পরিমাণ যেখানে নয়ের দশকের মাঝামাঝি ছিল ৬০ শতাংশ, ২০২২-২৩ এ তা নেমে দাঁড়ালো ১৬-১৭ শতাংশে। ফলে শহরের ওপর চাপ বাড়তে থাকল। কিন্তু শহরে নতুন কাজ তৈরী হল না। স্থায়ী কাজের পরিবর্তে চুক্তিভিত্তিক কাজের পরিমাণ বাড়ল। প্রকৃত আয় ও  ক্রয়ক্ষমতা কমতে থাকায় সবথেকে শোচনীয় অবস্থা হলো ক্ষেতমজুর, দিনমজুর এবং ছোটখাটো ব্যবসার কর্মীদের। বিশেষত কোভিড-১৯ মহামারীর পর, ২০২২ সালে, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের বেকারত্বের হার দাঁড়ালো ২০ শতাংশ। সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে খাদ্য এবং জ্বালানির দাম দ্রুত বাড়ায় ২০২২-২৩ আর্থিক বর্ষে ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ৭ শতাংশ ছাপিয়ে গেলো। গ্রাম থেকে শহরে, আর শহর থেকে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে যেতে লাগলো দেশের মানবসম্পদ। নেপালের মোট জাতীয় আয়ের ২৫ শতাংশের কাছাকাছি বিদেশে কর্মরত নেপালীদের পাঠানো অর্থ। তাতে আর্থিক দারিদ্র্য কিছু কমলো, কিন্তু বৈষম্য কমলো না। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানে পথে নামা তরুণ ও বর্ষীয়ান অভিভাবকদের অনেকেরই দাবি ছিল দেশের মধ্যে কাজের সুযোগ। 

স্থায়ী কাজের পরিবর্তে চুক্তিভিত্তিক কাজের পরিমাণ বাড়ল। প্রকৃত আয় ও  ক্রয়ক্ষমতা কমতে থাকায় সবথেকে শোচনীয় অবস্থা হলো ক্ষেতমজুর, দিনমজুর এবং ছোটখাটো ব্যবসার কর্মীদের।

কমিউনিস্ট পার্টিগুলি এবং কংগ্রেসের প্রতি জনতার মোহভঙ্গ হচ্ছিল অনেকদিন ধরেই। ২০২২ সালে বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলিকে হারিয়ে নির্দল প্রার্থী গায়ক বলেন শাহকে মেয়র নির্বাচিত করলেন কাঠমান্ডুর জনগণ। তাঁর সমর্থকদের হাতে হাতে ঘুরেছিল “নো পার্টি, নো করাপশন” লেখা প্ল্যাকার্ড। বড় রাজনৈতিক দলগুলি এবং দুর্নীতি ততদিনে নেপালি জনতার বিরাট অংশের কাছে সমার্থক। সামাজিক-অর্থনৈতিক ভাবে দেশের অবস্থা শোচনীয়, অথচ প্রধান দলগুলি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বল নিয়ে লোফালুফি খেলছে জনতার চোখের সামনে। বিরক্ত, ক্ষুব্ধ নেপালের জনগণের মধ্যে ক্রমশই ক্ষোভ বাড়ছিল। প্রতিক্রিয়ার আশংকায় বাড়ছিল রাষ্ট্রের কর্তৃত্বপূর্ণ আচরণও। চলতি বছর সেপ্টেম্বরের গোড়ায় বেশ কয়েকটি সামাজিক গণমাধ্যম নিষিদ্ধ করলেন কে পি ওলি। তিনি যুক্তি দিলেন অধিকাংশ সমাজমাধ্যম নেপালের নিয়ম মেনে ব্যবসা করতে নারাজ ৷ কিন্তু তাঁর কথা শোনার মতো অবস্থা ছিল না যুবসমাজের। বরং ফল হল হিতে বিপরীত। কাঠমান্ডু, পোখরা, বিরাটনগর – সর্বত্র ফুঁসতে ফুঁসতে রাস্তায় নেমে এলেন তরুণরা, জ্বালিয়ে দিলেন সংসদ, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন। কাঁদানে গ্যাস, জলকামান, রাবার বুলেট নিয়ে জবাব দিলো রাষ্ট্রও। পাঁচদিনের রাষ্ট্র-জনতা সংঘর্ষে মারা গেলেন ৭৫ জন, আহত দু হাজারের বেশি। অবশেষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন কে পি ওলি। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল নেপালের বিদ্রোহী জেন জি কেবল কে পি ওলি-র দল সিপিএন (ইউএমএল) বা সরকারে তাঁর শরিক নেপালি কংগ্রেসের নেতাদের উপর হামলা করেনি, তারা বিরোধী দলে থাকা মাওবাদী কেন্দ্রের দফতরেও আক্রমণ করেছে। বাবুরাম ভট্টরাইও আক্রান্ত হয়েছেন। ক্রোধের এই লাভাস্রোত স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে, নেপালের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রায় সমবয়সী তরুণ প্রজন্ম সার্বিকভাবে গোটা ব্যবস্থার প্রতিই হতাশ।

ক্রোধের এই লাভাস্রোত স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে, নেপালের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রায় সমবয়সী তরুণ প্রজন্ম সার্বিকভাবে গোটা ব্যবস্থার প্রতিই হতাশ।

এই বিক্ষোভে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী শক্তি এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদেরও সমর্থন নিশ্চয় ছিল। কিন্তু শুধু তাই দিয়ে তরুণ প্রজন্মের ক্রোধকে পড়া অসম্ভব। জেন জি বিক্ষোভকারীরা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ঝালানাথ খানালের বাড়ি পুড়িয়ে দেয় ৷ তাঁর স্ত্রী এখন মৃত্যুশয্যায় লড়ছেন। সেই অবস্থায় এই প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা বলেছেন, নেপালের বামপন্থীদের সবার আগে তীব্র আত্মসমালোচনা করা দরকার। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে দেড় দশকের ব্যর্থতা, জনগণের স্বপ্নের সঙ্গে বেইমানিকে ব্যাখ্যা করা যাবে না।

মাওবাদীরা-সহ নেপালের বিপ্লবী বামপন্থীদের বিপ্লবের নকশাটি ছিল দুই ধাপ বিশিষ্ট। প্রথম ধাপে বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। দ্বিতীয় ধাপে সমাজতান্ত্রিক পরিবর্তন। কিন্তু বাস্তবে তাঁরা মাঝপথে বিপ্লবের হাত ছেড়ে দিয়েছিলেন। প্রথম ধাপের গৌরবোজ্জ্বল সাফল্যের পরে তাঁর দ্বিতীয় ধাপে যেতে পারলেন না তো বটেই, তার চেয়েও যন্ত্রণার বিষয় হল, তাঁরা আদতে অগ্রসর হওয়ার তেমন কোনও চেষ্টাও করলেন না। বরং ক্ষমতায় টিকে থাকার লোভে এলিট-রাজ ও নয়া উদারবাদী লুটপাটতন্ত্রের পথ প্রশস্ত করলেন। বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। চূড়ান্ত দুর্নীতিতে ডুবে গেলেন৷ নিজেদের মহান অতীতের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন তাঁরা। গেরিলা সংগ্রামের অবসানের পরে বিপ্লবী নেতারা জনগণের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিলেন, অথচ নতুন সামাজিক রাজনৈতিক বাস্তবতার উপযোগী কোনও আয়ূধ তুলে দিলেন না। বিপ্লবের ট্রেন মাঝপথে দাঁড়িয়ে পড়ল। ট্রেনের চালকরা উঠে পড়লেন নয়া উদারবাদী উন্নয়নের বিমানে। দুর্নীতি ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ফেটে পড়া নেপালি জনতার এই ক্ষোভ আসলে বিক্রি বা বেহাত হয়ে যাওয়া বিপ্লবের স্বপ্নভঙ্গের ফসল।

বিপ্লবের ট্রেন মাঝপথে দাঁড়িয়ে পড়ল। ট্রেনের চালকরা উঠে পড়লেন নয়া উদারবাদী উন্নয়নের বিমানে। দুর্নীতি ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ফেটে পড়া নেপালি জনতার এই ক্ষোভ আসলে বিক্রি বা বেহাত হয়ে যাওয়া বিপ্লবের স্বপ্নভঙ্গের ফসল।

অভ্যুত্থান-পরবর্তী নেপালে প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে ভারত, যুক্তরাষ্ট্রের মতো সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। জায়গা করতে চাইছে চীন-ও। একইভাবে রাজনৈতিক-মতাদর্শিক শূন্যতার আবহে জায়গা করে নিতে চাইছে দক্ষিণপন্থী শক্তি, রাজতন্ত্রের সমর্থকরা। কিন্তু ইতিহাসের প্রতি সৎ থাকলে বোঝা যায় যে, এই সব সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের ফলাফল যতটা, কারণ ততটা নয়। গত দেড় দশকের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সীমাহীন ব্যর্থতা, মূল্যবৃদ্ধি, বৈষম্য, মজুরি হ্রাস এবং গ্রামীণ অর্থনীতির ধ্বসকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনও উপায় নেই। তবে নেপালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পিছনে দীর্ঘ বামপন্থী লড়াইয়ের ইতিহাস এখনও খুব দূরবর্তী নয়। ইতিহাসের পাতায় ধুলো পড়েছে ঠিকই, কিন্তু তা মুছে ফেলা সম্ভব। নিজেদের ভুল শুধরে নিয়ে সমাজতান্ত্রিক উত্তরণের পথে ফিরে আসার সুযোগ নেপালের বামপন্থীদের সামনে এখনও রয়েছে, অবশ্যই সেই সুযোগকে চিনতে পারার মতো মেধা, ইচ্ছা, আর সাহস যদি তাঁদের থাকে। আশার কথা হল, ইতিমধ্যেই এমন কিছু উদ্যোগ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন মাওবাদী শক্তি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে। সিপিএন (ইউএমএল) দলেও মন্থন চলছে। নেপালের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এখনও কমিউনিস্টরা বিরাট শক্তি। তাঁরা যদি নিজেদের মুছে না ফেলেন, বাইরে থেকে তাঁদের ধ্বংস করা কঠিন।

অর্ক ভাদুড়ি: সাংবাদিক লেখক। ইমেইল: arka2020.ami@gmail.com

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •